Tag: স্মৃতিকথা

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৮)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৮)

    পালমার্সটন নর্থে বসবাস আর বাস ভ্রমণ

    সভ্যতা মানুষকে যতটুকু দেয় তার চাইতে ঢের বেশী কেড়েই নেয়। অন্তত আমার সেরকমই ধারণা। এই যেমন মায়া মমতা ভালবাসা সবই হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সভ্যতা আর করে ফেলেছে সহজলভ্য। মাত্র একদিন মা দিবসে মা’কে ভালবাসা জানাবো একদিন বাবা দিবসে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাবো, জন্মদিনে বন্ধুকে মনে করে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলবো না।অন্য সবদিন সে আমার মনে নাই বা থাকলো – কি যায় আসে তাতে! বিবাহ বার্ষিকীতে একদিন ঘটা করে অনুষ্ঠান করবো আর তাতেই প্রমাণিত হবে জগতের কাছে যে আমরা কতটা সুখী। নিজের অন্তরে অনুভবের চাইতে আজকাল লোক দেখানো কৃত্রিম প্রকাশ মানুষের মাঝে তুমুলভাবে বেড়ে গেছে আর সাথে সাথে টান পড়ছে ভালবাসার। এর অভাবে কিছু মানুষ মারা যাচ্ছে আর কিছু বিভ্রান্ত হয়ে নকলের মুখোশ পরে ভুল ভালবাসা বিকোচ্ছে।আমি এখনো মামুলী তাই প্রতিদিন আমার জন্যে মা দিবস বাবা দিবস বন্ধু দিবস আর ভালবাসা আমার প্রতি মূহুর্তের ‌অলংকার। অনেকে বলে থাকেন ভুল মানুষে আর ভুল জায়গায় ভালবেসে নিজেকে নিঃস্ব করতে নেই। আমি বলি ভালবাসার কোন ভুল নেই, কোনো ভুল মানুষ নেই আর তাতে শুধু দিনে দিনে সমৃদ্ধই হওয়া যায় তবে তা প্রকৃত ভালবাসা হওয়া চাই।

    প্রমার বাবার চাকুরীর পর পালমার্সটন নর্থে প্রথম বিবাহ বার্ষিকিতে কেন জানি আমার একটা হীরের আংটির শখ হয়েছিলো। পরে অবশ্য হীরের অনেক গহনাই কেনা হয়েছে জন্মদিনে আর বিবাহ বার্ষিকিতে তবে সেগুলো আমার চাকরী শুরুর পর এবং সংগত কারণেই তা দু’জনের টাকায়। আমরা একদিন দোকানে গেলাম এবং মোটামুটি সামর্থের মধ্যে তিন পাথরের একটা আংটি সে কিনে দিয়েছিল। আমার কাছে ঐ আংটি বা তার দামের চাইতেও মুহূর্তটি বড় ছিল আর তা এখনো সতেজ হয়ে বুকে আছে। এজন্যে উপহার কিনবার আর দেবার সময়টুকু যথাসম্ভব সুন্দর করে তোলা আমাদের দায়িত্ব। সেই সুন্দর মুহূর্ত তখন আরও অনেক অভিনব মুহূর্তর জন্ম দিতে পারে।

    পালমার্সটন নর্থে আমাদের বেশ ভালো সময় কাটতে থাকলো। ‌কম সংখ্যক বাঙ্গালী কোনো শহরে থাকলে সবাই সবাইকে চিনে আর সবার সাথেই মিশে। ঈদে সব বাসায় যেতে হবে, সবাই আসবে আমার বাসায়। সে এক অন্যরকম মজা। আমরা দু’জনই ওখানকার সংগঠন মানোওয়াটো বাঙ্গালী সমিতিতে সক্রিয় হলাম। আমি সাংস্কৃতিক দিকে আর প্রমার বাবা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিলো। আমরা বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে ‌অংশগ্রহণ করলাম করলাম আর তাতে বহু বৎসর ধরে জড়িত এবং সম্ভবত সংগঠনের উদ্যোক্তরা সন্ধ্যা বৌদি আর চ্যাটার্জি দাদা ছিলেন কেন্দ্রবিনদু। তাছাড়াও হুদা ভাই বৌদি, মামুন ভাই জলি ওনাদের বেশ মনে পড়ে।

    আমি যতটুকু পারি ঘরে বসে পড়াশুনা করেই ইউ এস এম এল এ দ্বিতীয় পর্ব দেবার সিদ্ধান্তে নিলাম। তার জন্যে সুদূর অকল্যানড যেতে হবে। আমি মা অতএব ছোট্ট প্রমার দায় আমারই আর প্রমার বাবা রেজিস্ট্রারের দায়িত্বশীল পদে থাকবার জন্যে তার পক্ষে কোনোই ছুটি নেয়া সম্ভব হলো না আমার পরীক্ষা উপলক্ষে। তবে সে আমাদের জন্যে বাসের টিকিট কেটে দিয়েছিল আর সকাল সকাল কাজে যাবার আগে বাসে তুলে দিয়েছিল। আমি তখন বুঝতে পারিনি মোটেই চার বৎসরের ছোট্ট প্রমাকে নিয়ে আট নয় ঘন্টা বাস জার্নির পরিনাম। আর তারপর আত্মীয়ের বাসায় তাকে রেখে পরদিনই সারাটাদিন পরীক্ষা দেবার দুঃসাহস আমি কেমন করে করেছিলাম। প্রমা মা আমার শান্ত স্বভাবের তাই কান্নাকাটি করতো না। তাই বলে আমি ওর প্রতিটা কষ্টের অনুভব বুঝেছি আর আজ অবদি মনে রেখেছি। বলাই বাহুল্য প্রমার তো না ই আমারও এর আগে বাসে এতত বড় ভ্রমণের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।

    চার ঘন্টা পর বাস একটা ছোট্ট শহরের রেস্টুরেন্টে থামল দুপুরের খাবার আর টয়লেটের কাজ সারবার জন্যে। প্রমার মুখ ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে, ক্ষুধায়, জার্নিতে আর পেশাবের বেগে। আমি দেখলাম লোকজনের বিশাল লাইন রেস্টুরেন্টের সামনে তাই আমি ওকে প্রথম টয়লেট সারিয়ে আনতে গেলাম। ফিরে এসে খাবার পেতে বড্ড দেরী হয়ে গেলো। যখন প্রমার হট চিপস আর খাবার নিয়ে বসলাম তখনই হলো বাস ছাড়বার উপক্রম। আমি কিছুটা মুখে দিয়ে আমার খাবারটা নির্দবিধায় ফেলে দিলাম আর প্রমার চিপস গুলো হাতে নিয়ে বাসে উঠতে গেলাম। বাস ড্রাইভার ভীষণই বিরক্তির সাথে আমাকে নোটিশটা দেখালো যেখানে পরিষ্কার লিখা আছে শুধুমাত্র পানি ছাড়া অন্য কোনো খাদ্য বা পানীয় নিয়ে বাসে উঠা নিষেধ। আমি প্রমার চিপস, কমলার রস ফেলে দিয়ে অশ্রুসজল চোখে বাসে উঠেছিলাম আর ভেবেছিলাম এ কোন দেশে আসলাম যেখানকার মানুষ এতো বর্ণবাদী।

    আমার পুরো ভ্রমণে একবারও মনে হয়নি যে সে তার কাজ রুটিন মাফিক করে গিয়েছিল। আমাকে আঘাত করবার জন্যে তার আলাদা কোনো ইচ্ছেই ছিল না। আমি পরদিনই হয়তো তাকে মাফ করে দিয়েছি কিন্তু আজ অবধি ক্ষতটা লালন করছি।

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৭)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৭)

    পালমার্সটন নর্থ আগমন আর বন্ধুত্ব

    সময় বয়ে যায় নদীর স্রোতের মতন আর তাতে হাজার লক্ষ কোটি ঢেউ তুল্য মূহুর্ত তৈরী হয়। প্রতিটি মুহূর্ত একসময় মূল্যবান স্মৃতি হয়ে মনের পাতায় আঁকা হয়ে যায়। যে কেউ যখন খুশী তা সাদা কাগজে এঁকে দিতে পারে এবং তা দেখতে হবে অনিন্দ সুন্দর- আমি হলফ করে বলে দিতে পারি। আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে যাবার পরে নিতে এসেছেন প্রমার বাবার দুই বন্ধু মোখলেস ভাই আর শরীফ ভাই বুলস শহরের কাছাকাছি একটি গ্রাম থেকে। আমি আর প্রমা পূর্বপরিচিত মোখলেস ওরফে মুকুল ভাইয়ের গাড়িতে উঠেছি।বুঝতে পারলাম উনি সাংঘাতিক সাবধানি চালক।মোটরওয়েতে একশো কিলোমিটর বাঁধা থাকলে উনার গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা নিরানব্বই এ থাকে। অতঃপর অবশ্য বেশ রাতে নয়টা সাড়ে নয়টায় উনার বাসায় পৌঁছি। উনার বউ কামরুন আবার বন্ধু সিলেট মেডিক্যাল কলেজের ব্যাচমেট। অকল্যানডে ওরা থাকতে আমাদের তাই বেশ যাতায়াত ছিল। ক্ষুধার্ত আমরা কামরুনের হাতের সুস্বাদু রান্না গোগ্রসে গিলে ফেললাম। তারপর ডেসার্ট খেতে খেতে প্রমার বাবার আরেক ঢাকা কলেজের বন্ধু শরীফ ভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম। অমায়িক ভদ্রলোক তখন পালমার্সটন নর্থ ইউনিভার্সিটির এসিসট্যানট প্রফেসর। আমরা খাবার দাবার শেষে আমাদের জন্যে বরাদ্দ করা বাসায় গিয়ে উঠলাম।

    ঐ শহরে তখন আমাদের মেডিক্যাল কলেজেরই বড়ভাই জামিল ভাই কাজ করতেন আর অদূরে পরিবারসহ থাকতেন। মাসখানেক পরেই চাকুরী সুবাদে একই মেডিক্যালের মহিউদ্দিন ভাই পরিবারসহ এসে উপস্তিত হলেন। অবশ্য আমাদের থাকার শেষের দিতে ঢাকা মেডিক্যালের আলী ভাই আর আরেফীন ভাই মিলি আপারাও এসেছিলেন। শহরটি তখন মোটামুটি ঢাকা মেডিক্যাল এলামনাই হয়ে গেলো। আমাদের তখন ছিল স্বর্ণযুগ। অবশ্য তখন সেই সুখের উপর একটা ছায়া পড়ে থাকতো আমার পরীক্ষাগুলোর চিন্তা আর চাকুরীতে ঢুকা। প্রমার বাবা পালনার্সটন নর্থ হাসপাতালে কাজ শুরু করবার পর সুনাম অর্জনের জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন করা শুরু করলো। হাসপাতালে কাজের পরেও থেকে যাওয়া, নিখুঁতভাবে কাজ শেষ করা এসবের পরে তাকে মাস দু’য়েকর মধ্যেই প্রমোশন দিয়ে রেজিস্ট্রার বানানো হলো। স্বাভাবিকভাই কাজের চাপ তখন আরও বাড়লো এবং সে কাজের পরে লাইব্রেরিতে যাওয়া শুরু করলো ফেলোশীপ পরীক্ষা দেবার আকাঙ্খায়। আমার আশা প্রত্যাশাগুলো আমি বুকের মাঝেতে লুকিয়ে জীবন উপভোগ করা শুরু করলাম। তবে সকল সাংসারিক সামাজিক কাজের মধ্যেও আমি পড়াশুনা চালিয়ে গেছি।

    সবার প্রথম চাকুরী আর আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে স্বামীরা এবং ভাবীরাও বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকতেন। বিকেলে আমরা মেয়েরা লোপা ভাবী, লাকী ভাবী, কামরুন আর আমি হাঁটতে বের হতাম। আর আমাদের বাচ্চারাও একসাথে খেলাধূলা করতো। তখনই ঠিক হয়ে যেতো সেই রাতে কার বাসায় আমরা সবাই রাতের আহার সারবো। কোনো কোনো দিন এমন হয়েছে যে আমরা শুধু আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজি দিয়েই উদোর পুর্তি করেছি। ভাবী বা আমি হয়তো সেটুকু করবার সময়ই পেয়েছি কিন্তু ওগুলো আমাদের কাছে অমৃত মনে হতো আর আন্তরিকতা ছিল অতুলনীয়।গল্পে গল্পে হাসিতে আনন্দে সন্ধ্যা রাত কাটিয়ে দিতাম । ওই সময় ঠিক করে নিতাম আমরা কে কে এবং কোন সপ্তাহানতে কাছের কোন শহরে বেড়াতে যাব। দলবেঁধে বেড়াতে যাবার আনন্দ অপরিসীম। একসাথে যাত্রা, চা জলপানি খাওয়া, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা আবার হঠাৎ হঠাৎ অন্য শহরে পরিচিত বন্ধু ডাক্তার পরিবারে হামলা দেয়া। আমাদের বাচ্চাগুলোও খুব মজা করতো একমাত্র মুকুল ভাই কামরুন এর ছেলে তাহমীদ ছাড়া। ওর বয়স মাত্র তখন দেড় দুই বৎসর আর ওর মা ওর খাবার নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকতো। আর তাহমিদের জিদও তখন অনেকটা কলা কেনো ছিললে বুঁজে দাও এমনটাই ছিল। আমরা অবশ্য সবাই মুকুল ভাই কাজে থাকলে কামরুনকে সাহায্য করবার চেষ্টা করতাম। আজ ও ইনজিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে, বাকী বাচ্চাগুলোর বেশীর ভাগেরই বিয় আর বাচ্চা কাচচা ও হয়ে গেছে- কি আশ্চর্য। মন থেকে সব বাচ্চাগুলোর জন্যে অনেক দোয়া আসে, ভালো থেকো তোমরা সবাই।

    আমরা আশেপাশের সব শহরে মোটামুটি ঘুরতাম, নিউ প্লি মাউথ, ওয়েলিংটন, ওয়াঙগানুই এদের মধ্যে অন্যতম। ওযাঙগানুই শহরে আমাদের খুব প্রিয় বড়ভাই শহীদ ভাই ভাবী তাদের দুই কন্যা নিয়ে থাকতেন হাসপাতালে কাজের সুবাদে। শহীদ ভাই মানুষ হিসেবে ছিলেন অতুলনীয় – ধার্মিক বন্ধুবৎসল আর অমায়িক। উনাদের ওখানে হামলা দিতাম প্রায়শই আর ভাবী আমাদের মজাদার ইরানি কুইজিন খাওয়াতেন খুব যত্ন করে। পরে অবশ্য অকল্যানড থাকাকালীন উনাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছিল। উনার ছোট মেয়ে সুমাইয়া আমার প্রমার সমবয়সী আর বন্ধুত্বও ছিল ওদের মধ্যে। কয়েক বৎসর আগে ভাই আর ভাবী মেয়েদেরকে অকল্যানড রেখে ওমরাহ করতে গেলেন। ওমরাহ সুন্দর ভাবে শেষ করবার পরে ওনারা এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করার জন্য মরক্কোতে গেলেন। ওখানে হোটেলে রাতে ভাবীর হঠাৎ মৃত্যু হলো। কোনো রকম অসুস্থতা ছাড়াই উনার আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা সবাই হতভমভ হয়ে গেলাম। ভাইকে সূদুর মরক্কোতেই একা একা শোক বহন করতে হলো আর ভাবীর পোস্টমর্টেম সহ লাশ নিয়ে দেশে ফিরাও একা করতে হলো। আল্লাহ এমনই পরীক্ষার মধ্যে মানুষকে ফেলে দেন যা শুনে বিশবাস করাও মাঝে মধ্যে কঠিন। শুনেছি বড় মেয়ে সাদিয়ার বিয়ে হয়েছে। আল্লাহ ওকে অনেক অনেক সুখী রাখুন। আর আমার মনের পর্দায় ভাবীর হাস্যোজজবল সুন্দর মুখচছবি আজীবন থাকুক যাতে আমি দোয়া করতে পারি আল্লাহ তায়ালা তাকে চির শান্তিতে রেখেছেন।

    মানুষের জীবন আনন্দের আর তার মাঝেই কষ্ট লুকিয়ে থাকে নাকি ঠিক তার উল্টোটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৬)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৬)

    পালমার্সটন নর্থ যাত্রা আর বন্ধুত্ব

    ভাগ্যটা বিধাতা নিজেই তৈরী করে দেন, এতে কারো কোনো হাত নেই। আমার মতে সকলের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ,রিজিক এমনকি কে কোথায় কখন কি করবে সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত। আর আমরা কি কষ্টই না করছি প্রতিমুহূর্ত সেই রম্যনাটকে অভিনয় করতে গিয়ে। কেউ ধনী কেউ গরীব কেউ সক্ষম কেউ অক্ষম কেউ উদার কেউবা কৃপণের ভূমিকায় নিরলস পরিশ্রম করে চলেছি। এতো এতো ধনী পৃথিবীতে থাকতেও যেখানে মাত্র একজন ধনী পৃথিবীর সকল ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে সেখানে প্রতি মিনিটে ক্ষুধায় কতজন মারা যাচ্ছে। অনেকেই যখন বলে দেখো দেখো আমি নিজ পরিশ্রমে নিজ শক্তিতে এতোদূর এসেছি আর এতো বড় হতে পেরেছি- আমি তখন মনে মনে হাসি আর বলি সবই তাঁর ইচ্ছে।

    আমি ইউ এস এম এল এ পার্ট ওয়ানের ফর্ম জমা দিয়ে মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকলাম। পড়াশুনা তেমন হয়নি, সারাদিন ঘর সংসার প্রমাকে দেখাশুনায় সময় পার হয়ে যায়। তারপর যখন পড়তে বসি চিন্তা আর অবসন্নতা মনকে ছেয়ে ধরে। ঘুম পায়,ভীষণ ঘুম পায়। মাঝে মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি আর স্বপ্নে দেখি আমি সবার শেষে পরীক্ষার হলে পৌঁছেছি ততক্ষণে সবার লিখা প্রায় শেষ। অথবা আমি যেগুলো জিনিষ রিভাইজ করে আসতে পারিনি সেগুলো সব প্রশ্নপত্রে আর আমি কিছুই পারছি না। সময় সময় অবশ্য ঘুমের মধ্যে আমি দেখি পাতার পর পাতা আমি পড়ে ফেলছি, হঠাৎ ঘুম ভাঙলে চেষ্টা করি দেখিতো যা পড়লাম তার কিছু মনে আছে কিনা! আমার কারো সাথে জোট করে পড়বার সৌভাগ্য হলো না বা একদিনও লাইব্রেরিতে যাওয়া হলো না। আমি প্রমাকে খাওয়াই আর পড়ি, রান্না করি আর পড়ি, সকল কাজে প্রমা আর বই আমার সঙ্গী। তবু আমি এক হীনমন্যতায় ভুগতে থাকলাম যদি আমি পাশ করতে না পারি? চুরি করে ফর্ম জমা দেবার সাজাটা ঠিক মিলবে আর সহজে জীবনে পরীক্ষার কথা তুলতে পারব কিনা সন্দেহ।

    আল্লাহর অশেষ রহমতে পরীক্ষা আমার মন্দ হলো না আর রেজাল্ট ও তদ্রুপ বেশ ভালোই পেলাম। ওমন নম্বর দুই চারজন পেয়েছে হয়তোবা। আমার মনে দৃঢ়তা চলে আসল যে কোনো উপায়েই আমাকে পড়াশুনা চালিয়েই যেতে হবে আর কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে হবে। আমি শুধু শুধু বাংলাদেশর সবচাইতে ভালো মেডিক্যাল কলেজ থেকে সন্মানের সাথে পাশ করে আসিনি। ইতোমধ্যে প্রমার বাবা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা পাশ করে চাকুরী যোগাড় করে ফেলল পালমার্সটন নর্থ নামের এক শহরে। আমাদের সেখানেই দ্রুত যেতে হবে আর আমি বুঝে গেলাম আমার সংগ্রাম তখন থেকে বাড়বে বৈ কমবে না। আমাদের বাসার যৎসামান্য ফার্নিচার বিক্রি করে দিলাম আর বাকী জিনিষগুলো যারা আসবাবপত্র কিনল তাদের এমনিতেই দিয়ে দিলাম। প্যসিফিক আইল্যনড এর যুগল তাতে দারুন খুশী হলো। আমি আমার স্বামীর বেতনের সংবাদ শুনে ওখানে নতুন জিনিষপত্র কিনে ভালমতন বাসা সাজানোর পরিকল্পনা মনে মনে করে ফেললাম। ওখানে হাসপাতালের দুই বেডরুমের একটা বাসা আমাদের জন্য বরাদ্দ করে রাখা হয়েছিল।

    তবে আমাদের মনে সামান্য দুশ্চিন্তা হতে শুরু করলো গাড়ির ব্যপারে। আমরা আমাদের পুরনো হোনডা সিভিক গাড়িতে সাত আট ঘন্টা দূরযাত্রায় পরিবহন করে ঝুঁকিমুক্ত পৌঁছাতে পারব কিন এব্যপারে সন্দেহ জাগলো। এর পরিপ্রক্ষিতে আমার সদয় বন্ধু মোমিন আমাদের অতদূরের শহর পর্যন্ত সঙ্গ দিতে রাজী হলো এবং কথা হলো ও দুই একদিন পালমারসটন নর্থ থেকেই আবার অকল্যনডে ফিরে আসবে। আমি প্রমা, তার বাবা আর মোমিন যথারীতি সকাল সকাল রওনা করলাম। সাথে ছিল গাড়ি ভর্তি নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল। অনেকটা পথ গাড়ি ভালোই চললো তবে শেষরক্ষা হলো না। এখানে বলে রাখা ভালো যে নিউজিল্যান্ডের প্রায় সব শহরে যাবার পথই বেশ দূর্গম আর পাহাড়ী। একবার চূড়োয় উঠতে হয় বেশ খানিকটা উপর আবার নামতে হয় ঢাল বেয়ে আর এরকম চক্রাকারে চলতেই থাকে। আমরা দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম আর বেশ খানিকটা পথ তারপর ভালোমতনই এগুলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন প্রায় রাত নেমে এসেছে তখন গাড়ি উচ্চগামী পথে আওয়াজ দিতে শুরু করলো যে তার কষ্ট হচ্ছে। তারপর আর বেশীক্ষণ লাগল না/একেবারে নির্জন এক পাহাড়ী জঙ্গলা জায়হায় গিয়ে গাড়ি পুরোই মারা গেলো। আশপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার পূরোই অরণ্য, জনমানব বা বাড়িঘরের অস্তিত্ব নেই। সেইযুগে সেলফোনের তেমন প্রচলন ছিল না বিধায় আমাদের বা মোমিনের সেই সুবিধাও নেই।

    ভয়ে আমার আত্মা প্রায় খাঁচা ছাড়া, ছোট্ট তিন বৎসরের প্রমাসহ অত রাতে আমরা কি বিপদেই না পড়লাম। এই বুঝি দূর্ধর্ষ ডাকাত বা ছিনতাইকারী আমাদের ধরলো! মোমিন সাহস করে বললো “ঐ দূরে প্রায় এক দেড় কিলোমিটার তো হবেই আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। ওটা নিশ্চিত কারো বাড়ি, আমি এগিয়ে দেখি কাউকে পাই কিনা। রশীদ ভাই আপনি থাকেন ওদের সাথে।” বেচারা কষ্ট করে কতক্ষণ তা বলতে পারব না পাহাড়ী পথে হেঁটে হেঁটে যেই বাড়ির আঙিনায় পৌঁছেছে। ওমনি বিশাল এক কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ও ভাবল বাঁচার আর উপায় নেই, কুকুরের আক্রমণেই শেষমেষ মৃত্যু। ওর প্রাণপন চিৎকারে বাড়ির মালিক এক মহিলা অবশেষে বেরিয়ে এলো। মোমিন আমাদের বিপদটা বুঝিয়ে বলে একটা ফোন করতে চাইলে মহিলা তা করতে দিলো। অবশেষে আবার অতটা পথ অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে ফিরে এলো। আমাদের অতঃপর পালমার্সটন থেকে প্রমার বাবার দুই বন্ধু মোখলেস ভাই আর শরীফ ভাই নিতে আসলেন । আমি আবার নিশ্বাস নিলাম তখন। উনাদের হাসিমুখ ভুলবার নয়। জানতে পারলাম আমরা বুলস শহরের কাছাকাছি ছিলাম। ওখানে এক জিপির নাকি প্লেন আর হেলিকপটার আছে। তাতে করে আমরা বাকী পথ যেতে পারতাম! আমরা বাকীটা পথ গাড়িতে বসে মোমিনের লোমহর্ষক কাহিনী শুনতে থাকলাম। আমি ভাবলাম জীবনে কোনো কোনো বন্ধুর একদিনের অবদানের জন্যেই আজীবন সেই বন্ধুর কাছে ঋণ থেকে যায় যা কোনোদিন শোধ করবার নয় । ভালো থাকুক মোমিন আর তার সংসার। ভালো থাকুক বন্ধুতব ..ভালো থাকুক মানবতা।

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৫)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৫)

    প্রবাস জীবনে সংসার আর পেশার দ্বন্দ্ব

    হাসি আনন্দের পরিচায়ক এবং সাংঘাতিক সংক্রামক, মোটামুটি সকলেই হাসতে পছন্দ করে। হাসি নিমিষে কষ্ট বিলীন করতে পারে,হোক তা সাময়িক আর আমার হাসি যদি অন্য কারো মুখে মুহূর্তের হাসি আনন্দ এঁকে দিতে পারে তবে সেই হাসি ধন্য। কার জীবনে কষ্ট নেই তবে কষ্টগুলো একান্তই নিজস্ব এবং কোনো কোনো কষ্টকে মস্তিষ্কের এমন কুঠোরে রেখে দিতে হয় যাতে নিজেই তার খোঁজ সহসা না পাওয়া যায়। কষ্টে বুক ফেটে কান্না আসবেই এবং কান্নাটাও স্বাভাবিক মানুষ মাত্রেই। কেউ না কাঁদতে পারলেই বুঝতে হবে তার মানবিক কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু কষ্ট দেখানোর বিষয় নয়, যারা বুঝবার তারা মুখের শব্দে বা চোখের চাহনিতে ঠিকই বুঝে নিবে। আর জীবনে বাবা মা ছাড়াও এমন আর একজন মানুষ থাকাই যথেষট, যাকে কিছুই খুলে বলতে হবে না। আবার যাকে খুলে বলতে হবে- কি কখন কিভাবে কোথা থেকে এবং কেমন করে সে কোনোদিনই কষ্টের পরিমাপ বুঝতে পারবে না, পাশে থাকা দূরের কথা। আমাদের দেশের মেয়েগুলি সাধারণত এক্ষেত্রে বড্ড অসহায় কারণ মেয়েরা জন্মগতভাবেই সংবেদনশীল তাই তারা অন্যের মানবিক চাহিদা নিজ থেকে যেঁচেই পূরণ করে। অন্যদিকে বেশীরভাগ ছেলেদের ছোট থেকেই তৈরী করা হয় শক্ত, আত্মনির্ভর অনেকটা স্বার্থচিন্তক হিসেবে। কারো কান্না দেখলে তাদের দূর্বল মনে হয় আর বেদনার ভাষা না জানলে কিভাবে করবে সমবেদনা পোষণ। আমি তাই বিদেশ বিভুঁই এ ক্রমশ কারণে বা অকারণে হাসতে শিখে গেলাম যা আমার বুকে কষ্টের পরিধি নিয়ত বাড়িয়েই চললো।

    আমি সংসার করছি মন বেঁধে আর প্রচন্ড সফলতার সাথে তাই প্রমার বাবা দুই পার্ট ইউ এস এম এল ই পাশ করলো। তারপর শুরু হলো ক্লিনিকাল পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি। তার ফলে কিছু নতুন মানুষের সাথে যোগাযোগও তৈরী হলো-অবশ্য মূলত প্রমার বাবারই। আমি ঘরের বৌ ই থেকে গেলাম। তবে সুযোগ পেলে প্রমার মুখে এক লোকমা ভাত দিয়ে বা কখনো কখনো রান্না পুড়িয়ে হলেও বইয়ে ডুবে থাকতে পছন্দ করতাম। প্রমার বাবার বন্ধু কে ৩৬ নিপু ভাই আর হ্যাপী ভাবীর সাথে আমাদের সখ্যতা হলো। হ্যাপী ভাবী নামের মর্যাদা রেখে আমার সাথে দুর্দান্ত হাসতে পারতেন। খুব মজার মজার রান্না করতেন তবে পোলাও এর মাঝে কেনো যেনো উনি বুট মিশিয়ে দিতেন তা ছিল আমার বোধ আর আকাঙ্খার বাইরে। মাঝে মাঝে সপ্তাহানতে আমরা বেড়াতে যেতাম দূরে কোনো সমুদ্রতীরে নিপু ভাই ভাবীদের সাথে। উনাদের এক ছেলে ছিল অনিক, খুব কথা বলতে পছন্দ করতো। আমরা বেড়াতে যাবার সময় পাশে বসলে করতো হাজারো প্রশ্ন। একবার বেড়াতে যাবার সময় প্রমা আমি ঠিক বুঝে উঠবার আগেই গাড়িতে বমি করে ফেললো। প্রমার কোনো দিনই মোশন সিকন্যাস ছিল না। ওই প্রথম সে গাড়িতে বমি করলো, আর দশ বৎসরের দুষ্টু অনিক তিন সাড়ে তিন বৎসরের প্রমাকে পুরোটা পথ এ বিষয়ে মজা করেই ত্যক্ত করলো। অনিকের মা হ্যাপী ভাবী যখন গর্ভবতী হলেন , আমাকে বড্ড জ্বালিয়েছেন। হঠাৎ করে বাসায় এসে বলতেন ভাবী আমি কিছু গন্ধ সহ্য করতে পারছি না। আপনি আমার জন্য একটু রান্না করেন তো- পেঁয়াজ রসুন হলুদ মরিচ ধনে জিরার গুঁড়া কিছু দিবেন না।আমি বললাম তো কি দিয়ে রাঁধব? উনি নির্ধিধায় বললেন “শুধু কাঁচা মরিচ”- হায়রে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আর অযাচিতভাবে মানুষকে আপন করে নেবার আমাদের অভ্যেস।

    কে ৩৬ এর প্রমার বাবার আর এক বন্ধু মোদাসসির ভাইদের বাসায়ও আমাদের যাতায়াত আর তাদের সাথে আন্তরিকতা ছিল প্রথম থেকেই। ভাই ভাবী ফর্সা আর তাই তাদের টুকটুকে ফর্সা আর সুন্দর এক ছেলে এক মেয়ে ছিল। আমরা অকল্যানডে মাত্রই বাসা নিয়েছি, বিদেশী পরিবেশে একেবারেই নতুন। আমাদের ছোট্ট টেলিভিশন চলছে, আমি রাত ন’টার দিকে প্রমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বসার রুমে আসতেই প্রমার বাবার উৎকন্ঠিত স্বর শুনতে পেলাম। পৃথিবী তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! আমি টিভির দিকে তাকিয়ে আমারও উৎকন্ঠা লুকোতে পারলাম না। আমি একবার টিভিতে খবর শুনছি,এসটেরয়েড এসে পৃথিবী ধ্বংস করছে, লোকজন সব আতঙ্কিত হয়ে রাস্তায় ছুটাছুটি করছে। আবার জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশ বুঝবার চেষ্টা করছি-শুনশান নিরবতা যেমনটি সবসময়। ওদিকে প্রমার বাবা মা বাবা ভাই বোনদের সাথে কথা শেষ করে মোদাসসির ভাইকে ফোন দিয়েছ। জানিস পৃথিবী যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? “ কি বলিস?জানি না তো! “ সহজ সরল মোদাসসির ভাই তখন বউ বাচ্চাদের নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করেই একেবারে গ্যারেজে অবস্থান নিলেন। অতঃপর প্রমার বাবা নিপু ভাইকে ফোন দিলো ভাগ্যিস। নিপু ভাই তড়িৎ টিভি দেখে বললেন “ তোরা কি পাগল হয়েছিস? এটাতো মুভি!” এখন পর্যন্ত বাচ্চারা সব একত্রিত হলে আমাদের নিয়ে বিশেষ করে মোদাসসির ভাইকে নিয়ে হাসাহাসি করে।

    আমার বাবা মায়ের সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো প্রতিবার বড়জোর মিনিট দুই তিন। উনারা আমাদের বিশেষ করে প্রমার খোঁজ নেন তারপর আমার পড়ালিখার! আমি তেমন সহজ করে জবাব দিতে পারি না। তখন ওভারসিজ ফোনের বিল ছিল কড়া আর মিনিট হিসেবে, কথা বিস্তারিত হতো না। বড়ভাই কাওসার আয়ারল্যান্ডের কর্ক শহরে কাজে নিয়োজিত, কথা হতো মাঝেমধ্যে। নিউজিল্যান্ডের ভিসা রক্ষার্থে ও আবার আসবার প্ল্যান করছে অকল্যানড। আমি একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম “তুই কি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?” ও বললো পারব, কত এবং কিসের জন্য? আমি খুলে বলতেই ভাইয়া সেদিনই এগারো শত ইউ এস ডলার পাঠিয়েছিল – আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ। আমি দুঃসাহসিক কাজটা করেই ফেললাম। তাড়াতাড়ি ইউ এস এম এল এ পার্ট ওয়ান এর ফর্ম ফিলাপ করলাম নইলে পরের মাসে পরীক্ষা দিতে পারতাম না। প্রমার বাবা সেদিন ঘরে ফিরলে সব বলতেই সে বললো” তুমি টাকা পেলে কোথথেকে?” তার গলার স্বরে সেদিন আমি হয়তো নিরাশার স্বাদ পেয়েছিলাম, বা হতে পারে সেটা আমার নিছক কল্পনা।

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৪)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৪)

    বিদেশে আমার প্রথম সংসার

    খেয়াল করেছি মানুষের যখন অল্পতেই তুষ্টি তখন কোন কিছু খুঁজে পেতে বা কিনতে বেগ পেতে হয় না। আমাদের ও অকল্যান্ডে বাসা খুঁজে পেতে মাত্র এক সপ্তাহান্ত লাগল। বাসার ন্যুনতম নির্নায়ক ছিল এটি অকল্যান্ড হাসপাতালের কাছাকাছি হতে হবে যার লাইব্ররীতে প্রমার বাবা পড়তে যেতে পারবে পায়ে হেঁটে এবং সহজেই। দুপুরে ইচ্ছা করলে খেতে বাসায় আসতে পারবে। অন্যটি হলো দুই বেডরুম থাকতে হবে। আমাদের বাসা খোঁজা, পাওয়া, গাড়ী কেনায় তারিক ভাইয়ের সহায়তা অপরিহার্য় ছিল আর তাছাড়াও জুবায়ের ভাই, সায়েক ভাই, বাপ্পী ভাই ,মোমিন, আসিফ আর ফারহান সব সময় সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিতো। পার্নেল অকল্যানডের ‌অন্যতম দামী সাবার্ব বা শহরতলী হলেও মালিকের আমাদের জীবনের গল্প এবং আমরা দু’জন সংগ্রামরত ডাক্তার হওয়াতে ফ্ল্যাটটি আমাদের দিতে একটুকুও কুন্ঠাবোধ করলেন না। উপরন্তু পরে টের পেলাম খুবই কম ভাড়ায় এবং সামান্য নিরাপত্তা চুক্তি স্বরুপ টাকাতে উনি আমাদের বাসাটা দিয়েছেন।

    উনার বয়স হয়তো পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে। উনি দু’ সপ্তাহ পর পর ভাড়া নিতে নিজে আসতেন এবং তখন কিছু খাবার দিলে নিতান্ত মজা করে খেতেন। পরের দিকে অবশ্য রাতের খাবারের সময় আসতেন, রাজনীতি, খেলা পড়াশুনা আত্মীয় স্বজন এসব নিয়ে অনেক অনেক গল্প হতো এবং রাতের খাবার দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করতাম। আমার মনে আছে আমার ডাল রান্না উনার সবথেকে পছন্দ ছিল আর ডেভিড বোয়ি উনার প্রিয় মিউজিশিয়ান ছিল। বন্ধুত্বের কারণেই হোক বা নিজ উদারতা থেকেই হোক উনি দুই বৎসরের উপরের সময় কখনো বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর কথা একবারও বলেননি। আমরা আগাগোড়াই মাত্র দুইশ বিশ ডলার প্রতি সপ্তাহে দিয়ে থেকেছি এবং পুরো নিরাপত্তা চুক্তির টাকা উনি বাড়ি ছাড়বার সময় ফেরত দিয়েছেন। প্রমার বাবার চাকুরী হওয়াতে উনি সাংঘাতিক রকম খুশী হয়েছিলেন।

    আমাদের বাসা নেয়া হলো, প্রয়োজনীয় সাংসারিক জিনিষপত্র কেনা হলো, পুরনো একটা গাড়ীও কেনা হলো- মনে আছে হোল্ডা সিভিক সাদা রঙ্গের। ঢাকা থেকে ড্রাইভিং একটু শিখে আসাতে লাভ হয়েছিল আর তাছাড়া সাহস বেশী থাকাতে অভ্যাস সামান্য ঝালাই করে নিয়েই লার্নার লাইসেন্স নিয়েই আমি ড্রাইভিং শুরু করে দিলাম অকল্যানডে। আমাদের বাসায় আমার বড়ভাইয়ের বন্ধুরা সবাই আর আমার বন্ধুরা প্রায়ই আসতো আর আমাদের নির্ভেজাল আনন্দে গল্প করে সময় কাটতো। আমি পরীক্ষামূলক বিভিন্নরকম রান্না করতাম, মিষ্টি বানাতাম মুড়ি ভাজতাম- ওরা সবাই খেয়ে প্রশংসা করতো আর আমার উৎসাহ আরও বাড়তো। প্রমার বাবা পড়াশুনা করার জন্যে সারাদিন লাইব্রেরি থাকা শুরু করলো আর তার পরেও গ্রুপ করে পড়াশুনা বিভিন্ন বাসায় ঘুরে ঘুরে যার মধ্যে আমাদের টার্ন ও আসতো। যারা আসতো দীনা আপা আর সিনিয়র জুবায়ের ভাই, বুলা ভাবী তাদের মধ্যে অন্যতম।

    আমি নিয়ম মাফিক প্রায় সপ্তাহেই ঝিমা খালার বাড়ী যেতাম, যদিও উনারা মাউনট এলবার্ট থাকতেন,আমাদের থেকে বেশ দূরে। প্রমা খালার ছেলে সানিমের সাথে খেলতে পছন্দ করতো আর আমি পছনদ করতাম খালার সঙ্গ। খালা খালুও আসতেন আমাদের বাসায় মাঝে মধ্যে। আমি তখন বেশ সাংসারিক, নিউজিল্যান্ড সরকার আমাদের একটা ভাতা দিতো তা দিয়ে প্রমার ন্যাপীসহ প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র আগে কিনতাম আর বাকীটাকা দিয়ে বেশ সুন্দর সংসার সামলাতাম। আমার মনে আছে যেদিন আমরা টাকাটা হাতে পেতাম সেদিন ভালোমন্দ খেতে যেতাম। কেন যেন তখন কে এফ সি আমাদের ভীষণ প্রিয় খাবার ছিল। আমার নিত্য কর্ম ছিল প্রমাকে সাথে নিয়ে বাজার করা, লন্ড্রি রুমে গিয়ে কাপড় ধুয়ে ড্রাই করা, রান্না করা, প্রমাকে খাওয়ানো, টয়লেট, গোসল করানো, ঘুম পাড়িয়ে ঘর পরিষ্কার! অতঃপর নিজের যত্ন নেবার সময় হতো খুব কম।

    জাপানী এক প্রবাদ আমি বিশ্বাস করি, তা অনুসারে আমরা সকলেই মুখোশ পরে থাকি তিনটি স্তরে। বাইরের মুখেশটা সুখ বা দুঃখের যা আমরা সবাইকে দেখাতে চাই, দ্বিতীয় মুখোশ খুব কাছের লোকজন জানতে পারে বা দেখতে পারে আর তৃতীয়টি একান্তই নিজের। কিছু গোপনীয় জিনিষ বা কথা সব মানুষেরই অন্তরে লুকায়িত থাকে যা সে কোনেদিনই কারো সাথে হিস্যা নিতে পারে না। আমি এসব তখন না জানলেও নিশ্চিত সুখী এক মুখোশ তখন পরা শুরু করেছিলাম। আসলে প্রমাকে খাওয়াতে বসে বা রান্না চড়িয়ে আমি গ্রেইস এনাটমি বা মুরতাগের মেডিসিন বই নাড়াচাড়া করতাম আর গভীর বিষন্নতায় ভুগতাম। যদি কখনো এ বিষয়ে প্রমার বাবার সাথে আলাপ তুলতাম তবে তা তর্কযুদ্ধে পরিণত হতো। কারণ স্বাভাবিকভাবেই পড়াশুনার ব্যপারে প্রমার বাবার প্রাধান্য পাবার কথা- সে ছেলেমানুষ, বয়সে আমার থেকে অনেক বড় আর সর্বোপরি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও এতো ভালো নয় যে দুজনের পরীক্ষার বিশাল অংকের টাকা আমরা বহন করতে পারব। সুতরাং আমি তখন নিজের পরীক্ষা বা পেশার কথা চিন্তা করা বা তুলা কতটা অযৌক্তিক ছিল তা খুব সহজেই বোধগম্য!! আমি গভীর বিষন্ন আর একাকী দিন যাপন করতে থাকলাম আর তাই আমার হাসি খুশী মুখোশটা ব্যবহারও বেশ জরুরী হয়ে পড়লো।

    চলবে…

  • হ্যালো হ্যালো হ্যালো…

    হ্যালো হ্যালো হ্যালো…

    কয়েক দিন আগে আমার বর বাসার বাহিরে মানে গেটের সামনে কিছু লোকদের সাথে কথা বলার জন্য যায়। অনেক্ষন ধরেই দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। বাটন ও স্মার্ট ফোন দুটোই রুমে রেখে যায়।

    আমি ওর বাটন ফোন নিয়ে আমার মাকে কল দিয়ে কথা বলি। মাঝে মাঝেই ওর ফোন থেকে মায়ের সাথে অনেক্ষন কথা বলি। তাই আজ ভাবলাম চুপি চুপি কথা বলে রেখে দিবো। কথা শেষ হবার পরে আবার কি একটা কথা মনে পড়ায় মাকে কল দেয়ার চেষ্টা করি।

    ওর ফোনে মায়ের নাম্বারটা ‘Ma robi’ লিখে সেভ করা। ওর স্মার্ট ফোনের নাম্বার ‘My robi’ লিখে সেভ করা। তা আমি জানতাম না। আমি দ্বিতীয় বার মাকে কল দিতে যেয়ে ভুলে ওর স্মার্ট ফোনে My robi লেখা নাম্বারে কল দেই আর দেখতে পাই ফোনটাতে রিং বাজছে। আমি বুঝতে পারিনি ভুলে আমিই ওটাতে কল দিয়েছি। রিং বেজে কেটে গেলো তাই ভাবছি মা ফোন ধরছে না কেনো?

    আবার কল দেই দেখি ওর ফোনটাতে আবার ও রিং হচ্ছে আমি ওর ফোন নিয়ে বাসার সামনে যেয়ে ওর ফোন দিয়ে বলি কে যেনো রিং দিচ্ছে দেখো। নাম্বার না দেখেই হ্যালো বললো। আমি ওর হাতে ফোন দিয়ে রুমে এসে হ্যালো বললাম।

    হঠাৎ হ্যালো কন্ঠ শুনে চমকে গেলাম কয়েক সেকেন্ডেই ভাবছিলাম মায়ের কন্ঠ পুরুষের মতো কেনো? মায়ের ফোন কে ধরলো? মায়ের ফোন ধরার কেউ তো নেই? আমি দুবার হ্যালো বলে এইসব ভাবছিলাম। ওপাশ থেকে আবার বর হ্যালো হ্যালো বলেই চলেছে।

    আমি বরের কন্ঠ চিনতে পেরে ফোন কেটে দিয়ে দরজার সামনে গিয়ে হেসে হেসে বললাম- ভুলে আমি তোমাকে তোমার বাটন ফোন থেকে কল দিয়েছি আর সেটা মায়ের নাম্বার ভেবেই।

    ও একটু হেসে অনেকটা বিরক্তির ভাব দেখিয়ে আমার হাতে ফোন দিয়ে বাহিরের দিকে চলে গেলো। আমি রুমে এসে একা হাসতে হাসতে শেষ।

    তবে আমি অনেক দিন পরে নিজের বোকামোর জন্য হলে ও খুব জোরে জোরে হাসতে পেরেছি। খুব এনজয় করেছি একা একাই।

    লীনা ফারজানা
    ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ইং

  • কৌতুহল রোজনামচা

    কৌতুহল রোজনামচা

    ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ খুলনা যাবার উদ্দেশ্যে বাস স্টপে যাই। একদিন আগে টিকিট কাটার আগেই বলে নেই সিট জানালার পাশে দিতে হবে এবং পাশের সিট যেনো একজন মহিলার হয়।

    যথা সময়ে বাসে উঠে আমার সিটে একটা ব্যাগ দেখে সরিয়ে বসে পড়লাম। কয়েক মিনিট পরে একটি ছেলে এসে বললো- আপু, এই পাশে বসবেন? আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, এটাই আমার সিট। আমি সব সময় জানালার পাশের টিকিটই কাটি।

    কিছু না বলে আমার পাশে বসে পড়লো। আমি অবাক হয়ে বললাম- এটা আপনার জায়গা? ছেলেটি হ্যাঁ বললো। আমি বুঝতে পারলাম কোনো মহিলাকে না পেয়ে এই ছেলেটাকে দিয়েছে।

    বাস ছেড়ে দিলো। আমি মাস্ক সরিয়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছিলাম। কয়েক মিনিট পরেই ছেলেটি প্রশ্ন শুরু করে দিলো। আমি কি করি ,আমি কোথায় যাবো, কোথায় থাকি, এমন অনেক প্রশ্ন। আমি বিরক্ত হয়ে বর আছে, ছেলে আছে দশম শ্রেণীতে পড়ে বলে দিলাম। ছেলেটির বয়স সম্ভবত ২৪ বছরের মতো। আমি ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ফেবুতে ঢুকলাম।

    ছেলেটি হাত পা ছেড়ে বসে আছে। আমি যে বিরক্ত হয়ে যাচ্ছি বুঝতেই পারছে না। ঠিকভাবে বসতে পারছি না। এই প্রথম এমন অবস্থায় পড়েছি। যখনই একা যাবো কোনো মহিলাকে পাশে পাবই। এই প্রথম উল্টোটা হলো। কিছুই করার নেই চার ঘণ্টা পথ কষ্ট করেই যেতে হবে।

    ছেলেটি কিছুক্ষন পরে বললো, “আমি আর্মিতে জব করি। গোয়েন্দা বিভাগে আছি। খুলনা থেকে এখানে আসামী ধরতে এসেছি। গতরাতে মাইক্রো করে ৮ জন এসেছিলাম। আসামী সহ ৯ জন হলো। বসার জায়গা সমস্যা হওয়ায় তাই আমি আজ বাসে যাচ্ছি। আপনাকে দেখে মনে হয় না আপনার ছেলে দশম শ্রেণীতে পড়ছে। আপনার কথা এখনো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।” আমি কি তার কথা শুনতে চেয়েছি?

    আমি চুপ করে আছি ফেবু তে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না। বললো- আপনি ফেবু চালান? বললাম, হ্যাঁ। বললো- কি নাম আপনার? আমি রিকোয়েস্ট দেই। বিরক্ত হয়ে বললাম, অপরিচিতদের ফ্রেন্ড করি না। বললো- করেন না আপু প্লিজ, আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করবো না। ছেলেটি নাছরবান্দা। আমি নাম বললাম, আর সে রিকোয়েস্ট দিলো।

    মনে মনে ভাবলাম আজকেই তোকে ব্লক করে দিবো। মাথা ব্যাথা করছিলো চোখ বন্ধ করেও থাকতে পারছি না। ফেরিঘাটে পৌঁছাতেই আমড়া কিনে নিয়ে এসে খেতে বললো। আমি খাবোনা বলে বিরক্তি ভাবটা বুঝিয়ে দিলাম।

    দুপুর প্রায় তিনটায় পৌছালাম। ছেলেটি আমার ব্যাগ নিয়ে অটো রিকশায় তুলে দিলো। খালার বাসায় পৌঁছে খালা,খালাতো ভাই ও ভাইয়ের বউকে ছেলেটির গল্প বললাম। তারা হেসে মজা নিলো বেশ। কিছুক্ষন পরে মেসেঞ্জারে ছেলেটি কল দিলো। আমি কেটে দিচ্ছি আবার কল দিচ্ছে। নয় দশবার কল কেটে দিয়ে ব্লক করে দিলাম।

    সারাটা পথ আমাকে বিরক্ত করেছে। এমন বিবেকহীন মানুষ খুব কম দেখেছি। তবে ছেলেটি বলেছিলো – আপনি হয়তো আমাকে ব্লক করে দিবেন। আমি উত্তর না দিয়ে মনে মনে বলেছিলাম- আগে তো বাসায় যাই, তারপর দিবো।

    লীনা ফারজানা
    ৩ সেপ্টেম্বর,২০২১ ইং

  • কোন একদিন!

    কোন একদিন!

    সাল ১৯৯৯, মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছি। ইংরেজি প্রাইভেট শুরু করেছি। আর কোনো বইয়ের সাথে যোগাযোগ নেই। বাসায় শুয়ে বসে শুধু মুভি দেখা হয়।

    ছোট খালার বাসা আমাদের বাসার পাশেই। কোনো একদিন খালা এসে বলল, ছোট ছেলে মেয়ে দুটো আর একজন আত্মীয়কে নিয়ে সেজো খালার বাসা তালতলী বেড়াতে যাবে।

    তালতলী বরগুনা জেলার একটি থানা। ওখানে মনমুগ্ধকর কিছু জায়গা রয়েছে। আমি শুনেই বললাম- আমিও যাবো তোমাদের সাথে। খালা বলল আমরা একটা রিকশা করে সোজা নদীর পাড়ে যাবো। তোকে নিয়ে যাবো কিভাবে?

    বড় নদী পার হয়ে ওপারে তালতলী থানা। মা বললেন ওরা এক রিকশায় যাবে তোর জায়গা হবে না। এখন যেতে পারবি না। আমার খুব যেতে ইচ্ছে করছিলো। মনে খুব কষ্ট পেলাম।

    হঠাৎ আমার তালতলীর সেই পুলিশ খালু এসে হাজির। ঢাকা থেকে বদলি হয়ে তালতলী থানায় এসেছেন। তাদের বাসায়ই আমার ছোটো খালা যাবে। মাকে বললেন যে, কোর্টে কাজে এসেছেন আর কাজ শেষে ঘন্টা খানেক পরেই চলে যাবেন।

    আমি খালুকে দেখেই মহা খুশি। বললাম- খালু আমি আপনার সাথে যাবো। ছোটো খালা আমাকে সাথে নিবে না। আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন? বললেন চলো আমি একঘন্টা পরে আসছি তৈরি হয়ে থেকো। আমি মা কে রাজি করালাম আর বললাম আমি যাবো খালাকে সেটা বলবে না। আমি খালার পৌঁছানোর আগেই সেজো খালার বাসায় পৌঁছাতে চাই। আর খালাকে অবাক করে দিতে চাই কারন খালা জানবে আমি বরগুনা আছি। দেখেই থ বনে যাবে।

    পুলিশ খালু আসলেন মা নাস্তা দিলো খেয়ে আমাকে নিয়ে বাইকে রওয়ানা দিলেন। তার কিছু আগে খালার খোঁজ নিয়ে জানলাম যাবার জন্য তৈরি হচ্ছেন।

    আমি পথে যেতে যেতে খালুকে বললাম খালার সমস্যার জন্য আমাকে নিয়ে যেতে চায়নি। তাই আমি আপনাকে পেয়ে আমি যেতে পারছি আর খালার আগেই পৌঁছাতে চাই। খালু বললেন- চিন্তা করো না। তোমার খালার অনেক আগেই আমরা পৌঁছে যাবো।

    নদীর পাড়ে পৌঁছালাম খালুর সাথে চা খেয়ে ইঞ্জিন নৌকোয় উঠলাম। পিছু ফিরে দেখছি খালা আবার এলো কিনা।

    ওপারে পৌঁছে বাইকে কয়েক মিনিটে বাসায় পৌঁছালাম। সেজো খালা দেখেই অবাক। টেলিফোনে জেনেছিলেন ছোটো খালা যাবেন বেড়াতে। পুরো ঘটনা খুলে বললাম। শুনে খালা হাসছে । আমিও হাসছি আর খুব মজা পাচ্ছি। বলল এসে তোকে দেখে আকাশ থেকে পড়বে দেখিস।

    প্রায় ৪০ মিনিট পরে ছোটো খালাদের বাহিনী এসে হাজির। আমাকে দেখে তার বড় চোখ দুটো যেনো আরো বড় হয়ে গেলো। হেসে বলল, এটা কি করে সম্ভব ? তুই কি দুলাভাইয়ের সাথে এসেছিস? আমি বললাম তুমি তো আমাকে নিয়ে আসতে চাওনি তাই আমি তোমার আগেই চলে আসলাম।

    খালা বলল সম্ভব হলে তো নিয়েই আসতাম। এসেছিস ভালো করেছিস একসাথে ঘুরতে যাবো মজা করবো। আমি বললাম, তোমার সাথে ঘুরতে যাবোই না। তুমি একা যেও। খালা হেসে বলল, রাগ করিস না।

    খালা আমাকে সাথে না নেয়ার মস্ত বড় একটা কারণ ছিলো সেটি না হয় এখন নাই বা বললাম।

    লীনা ফারজানা
    ২৪-৮-২০২১ইং

  • রিকশাওয়ালা

    রিকশাওয়ালা

    প্রায় দু বছর আগের ঘটনা সকাল থেকে কলে চেষ্টা করে ও ডাক্তারের সিরিয়াল পাচ্ছিলাম না। বাধ্য হয়ে ধানমন্ডি ইবনে সিনায় যেয়ে নিজেই সিরিয়াল করি।

    রায়ের বাজার বাংলা সড়ক ভাতিজির বাসায় যাবো রিকশা ডেকে উঠে পড়ি। প্রথম যাচ্ছি বাসা কতদূরে হবে তাও জানি না।

    কিছু দূরে যাওয়ার পরে ভাতিজির কাছে কলে শুনে নিলাম কোন রাস্তা দিয়ে যেতে হবে।

    রিকশাওয়ালা জানতে চাইলো কোথা থেকে এসেছি।

    বরিশালের কথা বলতেই খুশি হয়ে আলাপ শুরু করে দিলো।

    আমার বাড়ি ও বরিশাল আপা। আপনার ভাবি ও ঢাকায় আমার সাথেই থাকতো এখানে ভালো লাগে না তাই দেশে চলে গেলো।
    আমি ভাবছিলাম উনি আমার ভাবি হোন? মনে হচ্ছে উনি আমাকে কতো চিনেন। সেভাবেই গল্প জুড়ে দিলো দেশের বাড়ির। অনেকটা বিরক্ত হই। ভাতিজি কল দিলো, রিকশাওয়ালা বললো আমাকে দিন আমি কথা বলে জেনে নেই।

    অনেক গুলো অলি গলি ঘুরে দু চারজন এর কাছ থেকে জেনে আমাকে পৌঁছে দিলো। ছিলো না কোনো বিরক্তির ছাপ।

    হয়তো দেশের লোক তাই বলেই।

    আমি ও অনেক খুশি হলাম দশ টাকা বাড়িয়ে দিয়ে এগোলাম।

    ভাতিজির সাথে বলতেই হেসে বললো উনার বউ আপনার ভাবী? আমি বললাম এক জেলার মানুষ ভাবীই হবে আমার।

    লীনা ফারজানা
    ১/৮/২০২১ইং

  • বৃষ্টিময় বিভীষিকার এক রাত

    তখন সবেমাত্র ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে রংপুরে শুভেচ্ছা কোচিং এ ভর্তি হয়েছি….এই প্রথম বাবা মাকে ছেড়ে বাইরে থাকা….যে কথা না বললেই নয় তা হলো, পড়াশোনায় বেশ ভালো হলেও আমার সমবয়সীদের তুলনায় আমি একটু বোকাসোকা ছিলাম…. সদ্য মায়ের আঁচল ছেড়ে আসা একটা ইমম্যাচিউরড মেয়ে —- যেদিন বাবা মা রেখে গেলো রংপুরে হাপুস নয়নে কাঁদছিলাম…. অই সময় আমার এলাকার এক আন্টি (পলি আন্টি) আমার থেকে সামান্য বড় হবে সেও একইসাথে কোচিং করতে এসেছিলো….সে আমাকে শান্ত করে, সেখানে একমাত্র ভরসার জায়গা হয়ে উঠে সেই সমবয়সী আন্টি…. একাধারে বান্ধবী আর অভিভাবক দুটোই…. ভালোই কাটছিলো কোচিং এর দিনগুলো….

    প্রায় দুমাস পর সময়টা জুন -জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় হবে… প্রচন্ড বৃষ্টি… থামার নাম নেই… তিনদিন একনাগাড়ে বৃষ্টি… আমাদের কোচিং সেন্টার ডুবে গেলো… হোস্টেল এর প্রথম তলা পানিতে ডুবে গেলো…. বন্যা আসছে, সবদিক থেকে খবর আসতে লাগলো…. হঠাৎ সিদ্ধান্তে আমাদের কোচিং বন্ধ দিয়ে দিলো…. বলা হলো সবাই নিজ দায়িত্বে যেনো নিরাপদ জায়গায় চলে যায়… বলাই বাহুল্য যে রংপুরে আমাদের কোন আত্মীয় স্বজন নেই……কোচিং এর মোটামুটি সবাই বেডিং বোচকা নিয়ে আত্মীয় স্বজনের বাসায় চলে যাচ্ছে….. শুধু বাকি আমি, পলি আন্টি আর খুশি নামে একজন….. তখন তো আর মোবাইল এর যুগ না…. টেলিফোনে কখনো লাইন পাওয়া যায় কখনো যায়না…. তবুও বুদ্ধি করে পলি আন্টি বাড়িতে শুধু এটুকু খবর দিতে পেরেছিলো যে কোচিং বন্ধ দিয়ে দিয়েছে আমরা যেভাবে হোক বাড়িতে আসছি…. অভিভাবকরা চিন্তায় পড়ে গেলো তারাও টিভিতে বন্যা পরিস্থিতির খবর পাচ্ছে আর আমরা দুইটা মেয়ে কিভাবে বাড়ি ফিরবো সেই চিন্তায় অস্থির …. বিকেল চারটার দিকে আমরা হোস্টেল থেকে নেমে আসলাম ব্যাগ বোচকা সহ…. হাটু পানি পেড়িয়ে যখন রাস্তায় উঠবো কিছু একটা লেগে আমার পায়ের অনেকটা জায়গা ছিলে গেলো…. উঃ মাগো বলে ককিয়ে উঠলাম… কিন্তু সব ভুলে আবার সামনে এগুলাম…. যেভাবেই হোক বাড়িতে যেতেই হবে…. তিনজনে রিকশা নিয়ে বি আর টিসি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেলাম….. বাসে উঠে অনেকটা হালকা লাগছিলো…. কিন্তু সমস্যা হলো বাস দেরিতে ছাড়বে…. বৃষ্টির কারণে অনেকে আসতে পারছেনা…. এর মধ্যেই আবার আকাশ কালো হয়ে গেলো, সন্ধ্যা ছটা বাজে অথচ মনে হচ্ছে রাত আটটা…. মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো, এর মধ্যেই সাড়ে ছটা নাগাদ আমাদের বাস ছাড়লো…..বৃষ্টির কারনে খুব একটা স্পিড এ চলছিলো না বাস…. যাই হোক আটটা কি সাড়ে আটটা হবে আমরা সৈয়দপুর পৌঁছলাম…. পায়ের কাটা জায়গার ব্যাথা বাড়ছে….আর ভিতরে ভয় কাজ করছে আমরা ঠিকমতো বাড়ি পৌঁছাতে পারবো তো? এক পর্যায়ে আমি কাঁদতে শুরু করলাম…. পলি আন্টি সাহস দিলো, বললো ভয় পেয়োনা, এখানে নেমে একটা ফোন করবো… আর নাপা নিয়ে আসার ব্যাবস্থা করছি…. গাড়ির হেলপারকে দিয়ে ওষুধ আনানো হলো….আমি লক্ষ্য করলাম গাড়িতে আমরা তিনজন মেয়ে ছাড়া সবাই পুরুষ …. আর লোকসংখ্যা খুবই কম…… বাস ছাড়লো সৈয়দপুর থেকে…. আমি খুবই ভয় পাচ্ছি আর শুধু কান্না পাচ্ছে……কিছুদিন আগেই ঘটে যাওয়া দিনাজপুরের ইয়াসমিন এর ঘটনা মনে আসছে…. আমি পলি আন্টিকে বললাম ভয়ের কথা…. সে বললো চলো সবাই একসাথে “”লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নী কুন্তু মিনাজ্জোয়ালেমিন”” পড়তে থাকি….. চোখ বন্ধ করে দোয়া পড়তে শুরু করলাম তিনজন….

    এরমধ্যেই বাস চম্পাতলি এসে পৌঁছালো……এবার বাস থেমে গেলো… সামনে হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে…… কি হয়েছে?

    সামনে কোনো রাস্তা নেই, সব পানিতে ডুবে একাকার…. চারদিকে শুধু পানি আর পানি….আর বৃষ্টি তো চলছেই…. কি ভয়ংকর অবস্থা…. বাস শুদ্ধ সবাই আল্লাহকে ডাকছে…… কতক্ষণ অপেক্ষা করলো, কি করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলো না…. হেলপার, সুপারভাইজার গাড়ি থেকে নেমে গেলো….. গাড়ির আলো পর্যাপ্ত না, তারা বড় বড় টর্চ জ্বালিয়ে সামনে রাস্তা দেখাতে লাগলো আর ড্রাইভার খুব আস্তে আস্তে গাড়ি নিয়ে আগাচ্ছে…… এভাবে প্রায় একমাইল রাস্তা পার হতে সময় লেগে গেলো একঘন্টারও বেশি…. পুরো সময়টা যে কিভাবে কেটেছে তা একমাত্র গাড়িতে থাকা লোকজনই বুঝেছে….অবশেষে রাস্তার দেখা মিললো…. সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো…..আলহামদুলিল্লাহ পড়ে আবার যাত্রা শুরু……

    এই অঝোর বৃষ্টি পাশ কাটিয়ে রাতের অন্ধকারে আমাদের বাস এগিয়ে চলছে… এর মধ্যেই যাত্রী নামছে ভিজে জবুথবু হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে…. এভাবে চলতে চলতে ঠাকুরগাঁও রোডে যখন পৌঁছলাম তখন বাজে রাত বারোটার কিছু বেশি….আমার ঠিক মনে নেই কোনো একটা ব্রিজ এর কাছে একজন আমাদের জন্য ছাতা নিয়ে দাঁড়িয়ে……আমরা নামলাম ব্যাগ বোচকা নিয়ে… এখানে যেটা না বললেই নয় সেটা হলো গাড়ির হেলপার, সুপাভাইজার, ড্রাইভার মামারা খুব বেশি আন্তরিক আর অনেক হেল্পফুল ছিলো…… সামনে ছাতা নিয়ে দাঁড়ানো যিনি উনি আমাদের দুজনেরই গান শেখানোর মামা “”বাবলু মামা””…… আমি একটু অবাক হলাম…. পলি আন্টি অনেক বুদ্ধিমতি ছিলো, সে সৈয়দপুর থেকে মামাকে ফোন দিয়ে বলেছিলো আমাদের বেশি দেরি হলে এখনে নামবো…. আর বাবলু মামা কতটা দায়িত্ববান সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা….. আমরা ভিজে জবজবে অবস্থায় মামার বাসায় গেলাম…. কাপড় চোপড় পাল্টে খাওয়ার টেবিলে দেখি মামি আমাদের জন্য সে এক বিশাল আয়োজন করেছে…..খিচুড়ি, ডিম ভুনা, বেগুন ভাজি, মাংসের যেনো কি একটা পদ ছিলো….. গরম গরম ধোঁয়া উঠা খাবার…. সারাদিন আর রাতের টেনশন নিমিষে দূর…

    খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে মামা গানের আসর বসালো…. মামা, মামি, পলি আন্টি, আমি একে একে সবাই গান গাইলাম…. আর এর মধ্যে চা পর্ব চললো…..এ করে ভোর চারটা…. এরপর ঘুমাতে গেলাম….. সকাল নয়টায় উঠে নাস্তা সেড়ে দশটার ট্রেনে উঠলাম পীরগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে….বাবলু মামাই আমাদের তুলে দিলো ট্রেনে…..প্রায় দেড়ঘন্টা পর পৌঁছলাম বাসায়…… বাসায় পৌছানোর সাথে সাথে সে এক অভাবনীয় দৃশ্য, আম্মু আব্বুর টেনশন আর কান্না মাখানো মুখ, বুকের সাথে জাপটে ধরে চুমু খাওয়া…..আমার বাসা আমার স্বর্গে ভালোভাবে আসতে পেরে মনে আর শরীরে তখন এক প্রশান্তি…… সব আত্মীয় স্বজন একে একে আসতে লাগলো আর আমি আমার সেই ভ্রমণ এর সবটুকু তাদের খুব আগ্রহ ভরে বলতে লাগলাম…

    এভাবেই শেষ হলো একটা বিভীষিকাময় যাত্রা….

    ~শিমু কলি