Tag: স্মৃতিকথা

  • আমি শশুর বাড়ী যাবো

    আমি শশুর বাড়ী যাবো

    এটা ১৯৬৯/৭০ এর কথা৷ আমার বয়স তখন খুব সম্ভবতঃ ৩/৪ বছর৷ আমার ওসময়ের কথা কিছুই মনে নেই বলতে গেলে৷ তবুও কিছু কিছু কথা আবছা আবছা মনে পড়ে।

    আমরা থাকতাম ফেনী মাষ্টার পাড়ায়৷ আমাদের বাসার সামনে থাকতো ছবি আপারা৷ ছবি আপারা ছিলেন খুব সম্ভবত ৫ ভাই আর ১ বোন৷ কেন যেন আমি ছবি আপার আব্বা আম্মাকে শশুর আব্বা শাশুড়ী আম্মা বলে ডাকতাম৷ ঐ বাসার সবাই আমাকে পাগলের মতো আদর করতেন৷ ছবি আপার ভাইয়েরা কিন্তু অনেক বড় বড় ছিলো৷ আমি শশুর আব্বা আম্মা ডাকার কি কারন ছিলো জানিনা৷

    বলে রাখি, আমি কিন্তু বিড়ালের মতো ছিলাম। মানে সর পড়া দুধ খেতে ভীষণ পছন্দ করতাম। এখনও করি৷ আমাকে নাকি অনেক কষ্টে যুদ্ধের সময় ভাত খাওয়ানো ধরিয়েছিলো৷

    আচ্ছা, এবার আসল কথায় আসি৷ মর্জিনা নামে আমাদের বাসায় একটা কাজের মেয়ে ছিলো৷ আমি সারাক্ষন তার সাথে সাথে থাকতাম৷ হঠাত আমি নাকি কান্না করছিলাম দুধ খাবো বলে৷ এটা শুনে মর্জিনা চুলায় দুধ গরম করতে গেলো৷ আমি দুধ খাবো বলে যখন কাঁদছিলাম, তখন মর্জিনা আমাকে ডেকে বললো, দেখেন দেখেন আপু দুধে বলক আসছে৷ সে সময়ে এক ফিতার কেরোসিন চুলা ছিলো৷ যেহেতু আমি ছোট্ট ছিলাম, তাই পাতিলের দুধ দেখতে না পেরে যেখানে কেরোসিন থাকে সেখানে ভর করে আমি পাতিলের দুধ বলক দেখতে গেলাম৷ আর ঠিক অমনি চুলা সহ কেরোসিন সহ সব দুধ আমার গায়ে এসে পড়লো। আর আমি আগুন এবং গরম দুধে দগ্ধ হয়ে গেলাম৷ সনা এসে আমাকে বার্নল লাগাচ্ছে। আমাকে নিয়ে ঘরের সবাই ব্যস্ত৷ আর আমি কান্না করছিলাম, আমি শশুর বাড়ী যাবো৷ শশুর আব্বা, শশুর আম্মার কাছে যাবো৷ আমার কান্না থামাতে না পেরে আমাকে ওই বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো৷ তারপর জানিনা কি হয়েছিলো৷ তবে সে ঘটনা আমার আজও মনে পড়ে৷ তবে আমি সর পড়া দুধ খেতে আজও খুব ভালোবাসি৷

  • সুলতানা

    সুলতানা

    উনিশ ‘শ বিরাশি সাল। নভেম্বর মাস ছিলো। কয়েকদিন আগেই টেস্ট পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী। বিকেলে হাটতে বেরিয়েছে আমি আর আমার বন্ধু মুনির। হঠাত করেই মুনির বলে, চল ওদিক থেকে হেটে আসি। আমি বললাম, ওদিকে হাটার কি আছে? চাষের জমি, হাটার মতো চিকন আইল – হাটা যায়? যাবো না ওদিকে। মুনির বললো, সামনে দেখ। ঐ যে কারা যায়। আমি দেখি সুলতানা আর তার এক বন্ধবী। বলে রাখছি, তখন ইব্রাহিমপুরের প্রায় পুরোটা জুড়েই চাষাবাদ হতো। এখনকার মতো ইটের শহর ছিলো না। প্রান ভরে নিঃশ্বাস নেবার মতে জায়গা ছিলো।

    ওরা সামনে আর আমরা কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে পিছু নিয়েছি। সেদিন বুঝতেই পারিনি কেনো পিছু নিয়েছিলাম। আমার বন্ধু মুনির একটু বেশিই পুংটা ছিলো। হাটটে হাটতে আমারা প্রায় কাজিপাড়া পর্যন্ত চলে গিয়েছিলাম। আজও চোখে ভাসে সেদিনের সেই বিকেলের রোদের বাসন্তি আলো। কিছু আলোর রঙ মন থেকে হারায় না।

    হঠাত যখন ওরা ফেরার পথ ধরে তখন আমরাও তাড়াতাড়ি ইউ টার্ণ নিয়ে ফিরতে থাকি। মাগরিবের ওয়াক্ত প্রায় হয়ে গিয়েছিলো। মসজিদের কাছে ফিরতে ফিরতে আযান হচ্ছিলো। রাস্তা ঘেষে ওযুখানা মসজিদের বাইরে ছিলো। কাঁচা মসজিদ। ওযু করছি আমি আর মুনির। ওযু শেষ করে নামায পড়লাম।

    নামায শেষ মুনির বললো, বাসায় গেলে আজ খবর আছে। আমি বললাম, কি হয়েছে? মুনির বললো, কি হয়েছে, মানে? তুই কি কিছুই শুনিসনি? যখন আমরা ওযু করছলাম তখন আমাদেরকে যে অকথ্য গালাগালি করে গেলো তা তুই কিছুই টের পাসনি? আমি বললাম, না তো – আমি কিছুই শুনিনি।

    এবার ভয় ধরে গেলে। ভাবতে থাকলাম, বাসায় তো নিশ্চয়ই বিচার আসবে। কি হবে? মাইর যা খাবার তা তো মাফ নেই। সম্ভবত বাসায় বিচার আসতো আর আমাদের আমল এবং তার পরের আরো দুই এক আমল বাবা মায়ের মাইর খাবারের চল ছিলো।

    ভয়ে ভয়ে বাসায় এলাম। দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে পড়তে বসলাম আর ভাবতে লাগলাম এই বুঝি বিচার আসলো, এই বুঝি শুরু হয়ে গেলো মাইর।

    রাত বাড়তে লাগলো। আশঙ্কা কাটে তো কাটে না। রাত পেরোলো। পরের দিন। একটু একটু করে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম মনে হচ্ছিলো। এবারের মতো বেঁচে গেলাম।

    এসএসসি পাশ করার পর আমার বুকের পাটা বড় হয়ে গেছিলো। এরপর অনেক দিনই পেছন নিয়েছিলাম। বাসায় বিচার কখনোই আসেনি। হয়তো সুলতানা মনে মনে আমায় পছন্দ করতে শুরু করে দিয়েছিলো।

    জীবনের প্রথম ভালোলাগা, – সুলতানা। ভালোবাসা ছিলো কিনা জানিনা।

  • ভুলু – একটা লাল কুকুরের নাম

    ভুলু – একটা লাল কুকুরের নাম

    বর্তমান ওসমানী মিলনায়তনের পেছনে ছোট খাটো একটা ডোবা বা পুকুর ছিলো। মেতরেরা প্রতিদিন সকালে প্রতিটা বাড়ির টয়লেটের নীচে রাখা বালতিতে জমানো মানুষের বর্জ্য একসাথ করে ঐ ডোবা বা পুকুরে ফেলতো।

    দক্ষিনে রেলওয়ে হাসপাতাল (বর্তমানে সরকারী কর্মচারী হাসপাতাল), পূবে ওয়ার্কসপ, পশ্চিমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল, ফজলুল হক হল আর উত্তরে খাদ্য ভবন ও সচিবালয়ের রাস্তা – এর মাঝখানটায় উঠোন ওয়ালা বাড়িগুলো ছিলো রেলওয়ে কলোনী হিসেবে। সেখানে ভাড়া থাকতাম।

    সেইখানে একটা স্কুল ছিলো। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি। টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুরা মিলে বল খেলতাম। কতোবার যে সেই গুয়ের পুকুরে বল পড়েছে তার ইয়াত্তা ছিলো না। সেই দিনগুলো আজ কোথায় হারিয়ে গেলো!

    তখন প্রায় দুপুর কোনো এক ঈদে আমরা ছোট ছোট বন্ধুরা দৌড়ঝাপ খেলাধুলা করছি এমন সময় একটা লাল কুকুরকে দেখি। কুকুর দেখলে যেমনটা করবার কথা আমরা বন্ধুরা তাই করেছি – কুকুরকে ধাওয়া দিয়েছি। তারপর ভুলে গেছি লাল কুকুরটার কথা।

    সন্ধ্যে বেলা – হঠাত দেখি কুকুরটা আমাদের বাড়ির গেটের কাছে। আমার বাবা কুকুরটাকে ডাক দেয়াতে বাড়ির ভেতরে চলে আসে। ঈদের কিছু খাবার কুকুরটাকে দেয়া হয়। এরপর আমার বাবা একটা ব্লেড দিয়ে গলায় বাঁধা ছিঁড়ে আসা দড়িটা কেটে দেন। রাতে কুকুরটা আমাদের বাড়ির উঠোনেই থেকে যায়।

    আমার বাবা খাদ্য ভবনে চাকুরী করতেন। তখন অফিস আওয়ার শুরু হতো সকাল সাড়ে সাতটায়। বাসার কাছেই অফিস। হেটে যেতে তিন চার মিনিটের রাস্তা। এবার থেকে লাল কুকুরটা আমার বাবাকে অফিস পর্যন্ত পৌঁছে দেবার দায়িত কাঁধে নিয়ে নেয়। দেখেই মনে হতো কুকুরটা বেশ শক্তিশালী ছিলো। গলার দড়িটা কেটে দেয়াতেই এতোটা আনুগত্য?

    আমরা কুকুরটাকে নাম দিলাম ভুলু। এই নামে ডাকলে সাড়া দিতো। কিভাবে যেনো বুঝে গিয়েছিলো যে এটাই এখন থেকে ওর নাম।
    ভুলু আমাদের খেলার সাথী হয়ে গেলো।

    আমাদের একটা লাল রঙের বেড়ালও ছিলো, নাম পুষি। ছিলো একটা টিয়া পাখিও, মিঠু। পুষি কখনো ভুলুকে দেখে ভয় পেতো না। ভুলুও পুষিকে কখনো আক্রমন করেনি। মিঠুও ভুলু ও পুষির বন্ধুই ছিলো। কেউ কাউকে কখনোই আঘাত করেনি।

    পুষির সাথে ভুলুর বন্ধুত্ব ছিলো আরো একধাপ এগিয়ে। পুষি সন্ধ্যার পর বাড়ির বাইরে গেলে অন্য কুকুরেরা যখন ধাওয়া দিতো তখন দৌড়ে বাড়িতে এসে ভুলুকে সাথে করে নিয়ে বের হতো। ভুলু সব কুকুরকে তাড়িয়ে দিয়ে বীর দর্পে ঘরে ফিরে আসতো।

    ভুলু কোনো ট্রেইনিং প্রাপ্ত কুকুর ছিলো কিনা জানা ছিলো না। ভুলুর আত্মসম্মান বলে একটা ব্যাপার ছিলো। আমরা যেভাবে ইচ্ছে ভুলুর সাথে ব্যবহার করতে করতে পারতাম। একদিন কি যেনো একটা ভুলের জন্য আমার বাবা ভুলুকে অনেক মেরেছিলো – ভুলু একদম প্রতিবাদ করেনি। মার খেয়ে আমাদের ছেড়েও চলে যায়নি।

    কোনো একদিন সকাল বেলায় আমার এক বন্ধু আমাদের বাসায় আসে। বাড়ির উঠোনে ভুলু তখন শুয়ে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলো। বন্ধুটি পা দিয়ে ভুলুকে আদর করে দিচ্ছিলো। ঠিক তখন ভুলু হালকা গর্জে ওঠে। আমি বন্ধুকে নিষেধ করে বলি যে পা দিয়ে আদর না করে হাত দিয়ে যেনো করে। বন্ধুটি আমার কথা না শুনে আবারও পা দিয়েই আদর করতে থাকে। এবারও ভুলু আরেকটু উচু স্বরে গর্জে ওঠে। আমি বন্ধুকে নিষেধ করি। সে নিষেধ অমান্য করে যেই না তৃতীয়বার পা দিয়ে আদর করতে যায় তখনই দুই পা আমার বন্ধুর ঘাড়ে তুলে দিয়ে ভীষন ভয় দেখায়। আমার বন্ধু এতোটাই ভয় পেয়ে যায় যে সে আর কোনোদিন ভুলুর ভয়ে আমাদের বাসায় আসেনি।

    ভুলু বাইরে গেলে অনেকেই মারার ভঙ্গি করেছে বা ঢিল ছুড়েছে এবং এসবের কারনে পরবর্তীকালে এলাকায় ভুলুকে নিয়ে একটা গুরুতর সমস্যা তৈরী হয়। সমস্যাটা হচ্ছে যে ভুলে ওদের চেহারা মনে রেখেছিলো এবং ওদের দেখতে পেলেই দৌড়ানি দিতো। যেহেতু এলাকার বেশিরভাগ মানুষই ভুলুকে কোনো না কোনোভাবে বিরক্ত করেছে সেহেতু এলাকার লোকজন ভুলুর ভয়ে বাসা থেকে বের হতে ভয় পেতো।

    এর থেকে পরিত্রান পাবার জন্য এলাকার লোকজন সিদ্ধান্ত নেয় যে ভুলুকে মেরে ফেলবে। দুপুরের দিকে সবাই লাঠিসোট, দা, শাবল নিয়ে বাড়িতে হাজির। কিভাবে কিভাবে যেনো ভুলু ওদের সবার হাত থেকে বেঁচে বেড়িয়ে যায়। এবার এলাকার মানুষের আরো ভয় বেড়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো আমাদের ভুলু কিন্তু কোনোদিন কাউকে কামড়ায়নি – শুধু ধাওয়া দিয়েছে।

    ১৯৭৯ সালে আমার বাবা মিরপুর-১৪ তে সরকারী কোয়ার্টার পায়। সেপ্টেম্বরের দিকে আমরা মিরপুরে চলে আছি। আসার সময় ভুলুকে ঐ একালার একজনকে দিয়ে আসি। উনি ভুলুকে তার দেশের বাড়ি রাজশাহিতে নিয়ে যাবেন।

    ভুলুকে আমি আজও ভুলিনি। আমার এখনো মনে হয় হয়তো ভুলু বেঁচে আছে। শুধু গলার বাঁধন কেটে মুক্ত করে দেয়াতে এতোটা প্রভুভক্তি ভুলু কেনো দেখিয়েছিলো আজও ব্যাপারটা বুঝতে পারিনা। ও কুকুর ছিলো বলেই কি?

    ভুলু – একটা লাল কুকু্রের নাম, আমার ভালোবাসা!

  • অশিক্ষা ভ্রমণ (শেষ পর্ব-৪)

    অশিক্ষা ভ্রমণ (শেষ পর্ব-৪)

    রাতে মুখ খুলে ! না ঠিক তা নয়, জালা ভরে ও.টি. গেলা। সাত জন টলতে টলতে মাড়োয়ারি ঢাবায় খেতে যাওয়া। নিচে বসে খাবার খাওয়া। পেট ভর খেয়ে দশটাকা দেওয়া। গরম গরম রুটিতে ঘি লাগিয়ে এমন ভাবে ছুড়ে দিত ঠিক থালায় মাঝে এসে পড়তো। দু রকম সবজির সাথে আতপ চালের ভাত, ডাল ও পাঁপড় স্যাঁকা ও ঘি, পেট ভর। খেয়ে সরু সিঁড়ি দিয়ে দোতলা থেকে নেমে আসা। হোটেলে গিয়ে 29 তাস খেলে ঘুমিয়ে পড়া।

    পরদিন ৭.৩০মিঃ ঘুম থেকে উঠে গোছানো ব্যাগ কাঁধে নিয়ে, বিহারীর দোকানে টিফিন করে মহেশ দের ঘরের দিকে রওনা । দুজনকে ছাড়ার সাথে পাঁচ জন মিলে গান ধরা। আজ দুজনার দুটি পথ গেছে বেঁকে……, ওঁদের বাড়ির গেটে।

    তুলোগ লেটকরলিয়া, ব্রেকফাস্ট কে লিয়ে ইনতেজার কর রহে হ্যাঁয় হাম লোগ। আমরা করে এসেছি, sorry. প্রদীপ বলে ওঠে ববলু কাল আমরা বলে এসেছিলাম আমাদের গেস্ট তোরা। আরে ইয়ার ছোড়না ,হ্যায় না চার পাঁচ দিন। অপনা গাড়ী চলতে রহেগা।

    ওঁরা ব্রেকফাস্ট সেরে নিল। দশটার সময় সবাই মিলে বেড়োলাম কিছু নেপালি বন্ধু দের ডেকে নিয়ে পরিচয় করার পর মাল রোডে ঠেক দেওয়া। নেপালি মেয়ে দেখে হাই হ্যালো করে চলা। দেখতে দেখতে দুদিনেই লোকাল হয়ে যাওয়া। রোজ নামচা- সকালের টিফিন ওদের ঘরে, তারপর বেরিয়ে পরা, এক বোতল করে বিয়ার টেনে ঢাবায় খাওয়া সেরে ঘুরে বেড়ানো। কখনো বর্ধমান মহারাজের বাড়ী,জলা পাহাড়,রাজ্যপাল ভবন, লেবং রেস কোর্স, হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট, মহাকাল মন্দিরের গুহায় ঢুকে যতটা যাওয়া যায়, আরো অনেক জায়গায়। পুরো দার্জিলিং ঘুরে শেষ। আর সন্ধ্যার আগে থেকেই সবাই মিলে মাল খেয়ে আর নেপালি মেয়ে দের সাথে কথা বলে বলে, মেয়েদের সাথে কথা বলার সাহস বাড়িয়ে নেওয়া যাতে করে এক একজন পূর্ণ রোমিও হয়ে ওঠতে পারি। মাড়োয়ারী বন্ধুরা এ ব্যপারে পথ প্রদর্শক।

    এই কদিনে পাহাড়ের জনসাধারণ হয়ে উঠেছি। আর মনে হয় গুণ ও ধীরে ধীরে গ্রহণ করা শুরু। থাক গিয়ে সে সব কথা। চার দিন অতিবাহিত অতিথি রূপে। পকেট গড়ের মাঠ। অগত্যা ঠিক করা , কাল রওনা দেওয়াটা ফাইনাল।লজ্জায় বন্ধু দের কাছ থেকে টাকা চাওয়া হয়ে উঠলো না, নিজেদের স্ট্যাটাস ভাবনায় আসায়। ওদের জানিয়ে দিলাম কাল সকালে আমরা শিলিগুড়ি রওনা দেব। ওঁরা বারবার অনুরোধ করলো আরো দু দিন থেকে যা। তোদের জন্য ফুল প্রুফ ও কুমীরের মতো মাল ও খাবার খেয়ে কাটালাম। বছরে দু’বার চলে আসিস এভাবেই।
    সকাল হয়েছে চিন্তা বেড়েছে, কিভাবে শিলিগুড়ি পৌঁছাই। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বাই বাই করে দুশ্চিন্তার সমতল যাত্রা। কোথায় যাই কিভাবে যাই। রকে বসে গভীর আলোচনার পর স্থির হলো ট্রেনে ফিরবো, এখনোও ৩০ মিঃ আছে হাতে, গাড়ী ছাড়ার সময়। নেতাজির মতো আহ্বান ‘শিলিগুড়ি চলো’ , করো স্টেশন দখল। যা ভাবা তাই করা।

    এখন ট্রেনে উঠে বসেছি। একটু ভুল হলো বসার জায়গা নেই দাঁড়িয়ে,কারণ ফার্স্ট ক্লাসে উঠেছি ।ভেবে চিন্তেই এই ক্লাশে, বিদেশিরা ওঠে বলে চেকিং হয় না। আমরা ঘুম, টুং ছেড়ে সোনাদায় পৌঁছে গেলাম। যতো গন্ড গোল সোনাদা থেকেই । ট্রেন ছাড়ার সাথে সাথে টিকিট চেকার এসে হাজির। টিকিট চেক করতে করতে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, প্রায় এসে গেছে ফলে ভয়ে আমাদের অবস্থা অকল্পনীয়, নিদারুন,সামনে গিলা পেছন পিলা( হিন্দি স্টাইলে বলা)। ফিস ফিসিয়ে বলে দিলাম আমি যা করবো তোরাও সেই ভাবে চলবি।

    টিটি: টিকট দেখাও। নেহি আছে। ট্রেন মে ব্যেঠ্ গিয়া উপর সে ফার্স্ট ক্লাস। বাপকা গাড়ী সমঝা। সামনের দিকে কাকে যেন ইশারা করলো , তিন চার জন নেপালি এগিয়ে আসছে। টিটি গলা হাকিয়ে রুপিয়া নেহি হ্যায় ,অব কার্শিয়াং কা জেল মে মর। ওর কথা শেষ বদাম করে মুখে ঘুসি এবং ট্রেন থেকে লাফ। দেখা দেখি পাঁচ জনই তাই করলো। এখন রাস্তায়,গাড়ি আস্তে হতে শুরু করেছে। পেছন থেকে একটা জীপ গাড়ি আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পরলো। ড্রাইভার বলে ওঠে সময় নাই গাড়ীর পেছনে ফটাফট উঠে পর। আমরাও মন্ত্রমুগ্ধের মতো উঠে পরলাম। ট্রেন থামার আগেই জীপ সাঁ সাঁ করে বেড়িয়ে গেল। কার্শিয়াং এ না দাঁড়িয়ে বেস কিছুটা গিয়ে ড্রাইভার গাড়ি দাড় করাল । কি হয়েছে ব্যাপার এবার বলো। আমরা সব কথা খুলে বললাম। ও বললো আমি তোমাদের নিয়ে যাব কিন্তু শিলিগুড়ি পৌঁছে ১২০/- টাকা আমায় কি ভাবে দেবে বলো। আমি নেপালি ভাষা বুঝি ও জানি। নেপালি তে ওকে বোঝালাম – দাজু তিমি চিন্তা ন গর স্ট্যান্ড পুগের চারজনা তিমি সংগ বসছ ,একজনা গয়ের রুপিয়া বোকের লিয়ের তিমিলাই দিনছ। হোস বস্ ।মানে স্ট্যান্ডে পৌঁছে চার জন তোমার কাছে থাকবে একজন গিয়ে টাকা এনে দেবে। তোমরা বসো। আমরা বাঁদর ঝোলা হয়ে শিলিগুড়ি র এয়ার ভিউ মোড়ে পৌঁছাই।
    সুবীর কে পাঠালাম। টাকা নিয়ে এলো। ড্রাইভার দাজুকে (দাদা) ১২৫/- দিলাম। ও বলে বেশি কেনো দিচ্ছ। আমাদের জোড় করে ২৫ টাকা ফিরিয়ে দিল। তোমাদের সততার জন্য ২০ টাকা ফিরিয়ে দিচ্ছি। আমি মনে মনে ভেবেই নিয়েছিলাম তোমরা দিতে পারবেনা। যাও এই টাকা দিয়ে কিছু খেয়ে নাও। আমরা ওকে ধন্যবাদ দিয়ে, যে যার বাড়ী ফিরে চললাম।

    আপনারাই বলুন এটাকে শিক্ষা ভ্রমণ না বলে অশিক্ষা ভ্রমণ বলাটা কি ভুল হলো। উত্তরের অপেক্ষায় থাকলাম?

    — শেষ —

  • স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার

    স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার

    আজকে আমি আমার স্বপ্নের আইফেল টাওয়ারের গল্প করবো। কয়েক বছর পিছন থেকে বলতে হবে।

    ২০১৩। ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে, দেশে যাওয়ার আয়োজন চলছে। যেহেতু ৩ পোলাপান এখনো ছোট বড় মেয়ে রুহি(১১) ছোট মেয়ে হাসরাত (৭) ছেলে মাহদী(৬), দের মাস তো থাকবোই থাকবো, এরকম একটা হিসেব করছি।
    হঠাৎ আমার উনি প্রস্তাব দিলেন, যদি দুই সপ্তাহ কম থাকি, তাহলে ফেরার পথে প্যারিস ঘুরতে নিয়ে যাবে। প্রথমে রাজী হইনি, পরে বড় মেয়ের প্যানপ্যানানিতে রাজি হয়ে গেলাম।

    দেশে গেলাম। হেব্বি মজা করে বিয়ে খেলাম। দুই সপ্তাহ চলে গেলো চোখের পলকে। আর দুই সপ্তাহ বাকি। এর মধ্যে আমার উনি চলে এলেন ক্যানাডার উদ্দেশে, আর কথা রইলো আমরা দু সপ্তাহ পর সবাই প্যারিস এয়ারপোর্ট এ দেখা করবো। কথা মত সেরকমই হলো।

    আল্লাহর নামে রওনা হলাম প্যারিসের উদ্দেশে। প্লেন উড়া শুরু করতেই মাহদী কান্না শুরু করলো ভ্যা ভ্যা করে। আর ছোট মেয়ে হাসরাত নিজের কানে নিজেই থাপর মারা শুরু করলো, কারণ কান বন্ধ হয়ে গেছে। আসে পাশের লোকজন গুলো মনে হচ্ছিল চিড়িয়াখানা থেকে ছুটে আসা বান্দরের খেলা দেখছিল। বাচ্চাদের বলছি চুপ করতে, কিন্তু কথা শুনছে না। কি যে একটা অবস্থা। মনে মনে ধৈর্য ধরলাম। ধৈর্যের ফল নাকি মিঠা হয়!

    চোখের সামনে ভেসে উঠলো আইফেল টাওয়ার! আহা… ভুলে গেলাম সব যন্ত্রণা। কুয়েতে ট্রানজিট ছিল এক রাত। কোনরকম হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে আবার আনডা বাচ্চা নিয়ে রওনা হলাম প্যারিসের উদ্দেশ্য। সেই আবারও একই কাহিনী। কান্না শুরু পোলাপানের। মনে হচ্ছিল বাসায় থাকলে সবগুলোকে মুখে কাপড় ঠুসে বেধে রাখতাম।

    কিছুই করার নেই। মানুষের সামনে কি আর মাইর দেয়া যায়! কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে চিমটি দিলাম কয়েকটা, আর কানে কানে বললাম “একদম প্লেন এর জানালা দিয়ে ফেলে দিবো”। কান্নার শব্দ না কমে বেড়ে গেলো আরো।

    আবারো নিজেকে শান্তনা “সবুরে মাওয়া ফলে” (আম্মা বলতো)

    অবশেষে পা রাখলাম স্বপ্নের শহরে! রাস্তায় যেতে যেতে ঠিক হলো হোটেলে গিয়ে রেস্ট নিয়ে বিকেলে ঘুরতে বের হবো। হোটেলে পৌঁছানোর পর দেখি মাহদীর গায়ে প্রচুর জ্বর। Plan changed, বিকেলে বের হলাম না। ভাবলাম জ্বর কমলে পরের দিন বের হবো।

    ঘুমিয়ে পড়লাম রাতে খাওয়া দাওয়ার পর। স্বপ্ন দেখলাম আইফেল টাওয়ার… Wow… কত সুন্দর! আমি উপরে উঠছি.. উঠছি.. উঠছি… হঠাৎ করে এত্ত উচু থেকে পরে গেলাম। ধরফর করে উঠে গেলাম ঘুম থেকে বুকে থুতু দিয়ে বললাম “যাক বাঁচলাম,স্বপ্ন ছিল”! আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর সকাল হবে, তার পর দেখবো… ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।

    সকালে নাস্তার পর থেকে ছোট মেয়ের বমি শুরু হলো। হয়তো কিছু উল্টা পাল্টা খাওয়াতে এমন হচ্ছে। এখন দুজনের শরীর খারাপ। প্ল্যান আবার চেঞ্জ। আজকের মধ্যে সুস্থ না হলে আগামী কাল চলে যাবো ক্যানাডা। মুটা মুটি সব গুছিয়ে রেডি থাকলাম পরের দিন রওনা হবো। ঘুমিয়ে পড়লাম।

    আবার স্বপ্ন দেখলাম, আমি আইফেল টাওয়ারের সামনে দাড়ানো…কি সুন্দর… কত উচু! হঠাৎ করে ভেঙে পড়তে লাগলো টুকরো টুকরো হয়ে, আর সেই কারণে ভূমিকম্পের মত পুরোটা শরীর কেপে উঠলো! লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম, জেগে দেখি জ্বরের কারণে ছেলে হাইপার হয়ে বিছানায় লাফাচ্ছে। সকালে উঠে চাট্টি বাটটি গোল করে রওনা হলাম নিজের গন্তব্যে।

    এই ছিল আমার স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার পরিদর্শন!

  • অশিক্ষা ভ্রমণ (পর্ব-৩)

    অশিক্ষা ভ্রমণ (পর্ব-৩)

    সবাই নিশ্চুপ,হাঁ করা মুখ! দৃষ্টি পূর্ব দিগন্তে নিবদ্ধ।

    আমাদের চাক্ষুষ ধারাবিবরণী প্রসারণের নির্বাচিত অংশ তুলে ধরছেন সুরজিৎ।
    অন্ধকার ছিন্ন করে আলো আঁধারি পরিবেশ, মেঘের উপর অংশে হালকা আলোর রেখা, বজ্রপাত দেখার মতো বা অন্য কিছু, বলে ঠিক বোঝান মুশকিল। মুখ হাঁ থাকায় সবার মুখে গপ গপিয়ে কুয়াশা ঢুকছে। চোখ স্থির রেখে পরবর্তী বল অনুসরণ । রঙের ভেলকি খেলা আরম্ভ, হালকা লাল মিশ্রণে স্বর্ণালী আভায় আউট সুইং দৃশ্যমান কাঞ্চনজঙ্ঘা শীর্ষ। প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে রং পাল্টাচ্ছে। এখন কিছুটা লাল কমে সোনালী। মেঘ গুলোর উপর সোনালীর সাথে খানিক সাদা ও কালো সংমিশ্রণে মায়াময় অবগুণ্ঠন। সদ্য বিবাহিত মেয়ে তার ঘোমটা ধীরে ধীরে লজ্জা কাটিয়ে তুলে ধরার মতো। পূর্ব দিগন্ত আরো রঙে ভরে উঠেছে, নিজ চোখে না দেখলে আমার লেন্সে পুরোমাঠ তুলে ধরতে পারছিনা। পরের ওভারের প্রথম বল। বাউন্সারে আকাশ ফেটে ব্যাটস্ ম্যান এর কপাল দিয়ে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে।

    তার রেখা কাঞ্চনজঙ্ঘা শীর্ষে গিয়ে পরেছে। বন্ধু মাথা ফাটুক আর যাই ফাটুক, বল বাউন্ডারি ডিঙিয়ে ছয়। শীর্ষের লালের সাথে হলুদ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যেন ড্রিংকসে অরেঞ্জ জুস পরিবেশন। ধীরলয়ে রশ্মি ছিটকে আকাশ কেও রঙে ভরিয়ে দিচ্ছে,যেন বলে বলে চার আর ছয়। সূর্য দেবতা সূর্যবংশী মহলের মাথা থেকে উঁকি দিচ্ছেন। কি অভূতপূর্ব পরিবেশ। চারি ধারের দর্শক হাততালি ও চেঁচামেচিতে মাঠ ভরিয়ে দিয়েছেন। সামনের গাছপালা একটু একটু করে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হঠাৎ একটি বাউন্সার ও বিরাট ছক্কা এবং সূর্য গপ করে উপরে উঠে এলো। সারা আকাশ এখন লাল,আকাশি, সাদা ও কালো রঙে মুড়ে গেছে। এখন লাস্ট ওভারের শেষ বল নিয়ে বোলার তীব্র গতিতে ধেয়ে আসছে, দেখতে অনেকটা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভি.বি. হোল্ডার এর মতো। বল করেছেন এবং সেট ব্যাটস্ ম্যান আউট। আকাশ এখন ঝকঝক করছে। লোক বিজয় উল্লাসে ফেটে পড়েছে। সানরাইজার্সকে বিজয়ী ঘোষণা করলেন মধুবাবু।

    স্যারের কর্কশের সাথে কোকিল আওয়াজ মেশান গলার শব্দ- , কিরে কেমন দেখলি? আমি প্রতিবছর আসি কিন্তু প্রত্যেকবার নতুন বউয়ের মত লাগে। আমি স্যারের সাথে তাল মিলিয়ে বলে উঠলাম- এমন বউ পেলে আমি প্রতি বছর বিয়ে করতে রাজি আছি। স্যার খেঁকিয়ে বলেন, বেড়ে পালোয়ান হয়েছিস একটাকে সামলে দেখ আগে।

    সবাই চেঁচামেচি করতে করতে জীপের দিকে চললাম।সত্যি কথা বলতে কি আমরা সেভেন মাস্কেটিয়ার্শ স্পিচ লেস ছিলাম। আমাদের কাজ ছবি তোলা আর কুয়াশা খাওয়া ছাড়া এক দেড় ঘণ্টা কোন কিছু বলার ছিলো না।

    এবার নামার পালা। গাড়ি সোজা দার্জিলিং ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে থামলো। নেবে এক বিহারীর দোকানে পুরি ও ঘুগনি ,মিষ্টি সহযোগে চা গলাদ্ধকরণ । এবার হেঁটে হোটেল।

    খানিক বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে ধোপদুরস্ত হওয়া। একটু পরে মধুবাবুর ডাক, সবাই হলরুমে জড়ো হয়ে দাঁড়ালাম। স্যার বলে ওঠেন বয়েজ এখন আমরা নেমে যাব শিলিগুড়ি ,আর তোদের ফেরা কাল। কেন স্যার? কোনো ভুল ,আরে না না, আজকের পুরো দিন তোরা আনন্দ করে ঘুরে বেড়া। কাল দুপুরের খাওয়া সেরে বাস ধরবি। আর শোন হোটেলের টাকা মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে,কাল ১২টার আগে হোটেল ছেড়ে খাওয়া খেয়ে বাসে উঠবি। আর সুবীর তোর হাতে আজকের মধ্যাহ্ন,রাতের,বিকেলের,কাল সকালের টিফিন, লাঞ্চের আর বাস ভাড়া বাবদ যা খরচা তুই রাখ। দেখে রাখবি স্কুলের চিন্তা রাখবি, দায়িত্ব তোদের থাকলো। সব বুঝিয়ে স্যাররা বেরিয়ে গেলেন।

    আমাদের বাদ দিয়ে ছোট রাউন্ড টেবিল মিটিং করে ছেলেরা জানিয়ে দিল কাল সকালে টিফিন সেরে ওরা বাস ধরবে, কেন রে কোন অসুবিধা? না না ,আর তো কিছু করার নেই তাই। এখন থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাকি যা আছে দেখা হয়ে যাবে। ঠিক আছে তোরা যা ভালো মনে করিস। আমারা কিন্তু বিকেলে নামবো। তোরা এখন ছোট দলে বেরিয়ে পর । কেনো তোরা কি করবি? দেখি কি করা যায়। এক দু বোতল ভাল্লুক আর মুড হলে এক পেগ ও.টি.। অরিজিৎ তুই একটা গ্রুপ নিয়ে ঘুরে আয় আর গৌতম তোরাও যেতে পারিস বা অরিজিৎ এর সাথে। আমরা একসাথে বেরবো। জিজ্ঞেস করি ফিরে একসাথে খাবি, না কি রাস্তায় খেয়ে নিবি। ফেরার পথে খেয়ে নেব বলে দেয় অরিজিৎ। সুবীর ওদের লাঞ্চ,ডিনার টিফিনের টাকা দিয়ে দিল, সুশান্ত বলে ওঠে কাল সকালের টিফিন আর বাসের টিকিটের টাকাটা দিয়ে দে আমরা মুক্ত। সুবীর ওদের হাতে টাকা বুঝিয়ে দেয়।

    আমরা রুমে গিয়ে একটু নাচানাচি করে বেরোলাম। চল আবার সিমলা হোটেলে গিয়ে বসি। পৌঁছে তিন বোতল গোল্ডেন ঈগল বিয়ার অর্ডার করলো সুবীর। ধীরলয়ে প্রথম রাউন্ড শেষ। আওর দো বোতল দেনা। কিরে সুবীর মাসির কাছ থেকে কত ম্যানেজ করেছিস, আরে টুনটুনি শীল ওরা সকালে চলে যাবেনা! লাঞ্চের পয়সাটা! আমাদের পুঁজি বাড়বাড়ন্ত । বুঝতে কষ্ট হলো না ও কেন কন্ট্রাক্টার সুবোধ কুন্ডুর ছেলে।শালা হিসাবটা ভালো বোঝে। এক পেগ করে ও.টি. দো। দুপুরের খাবার এখানেই সেরে ফেলি কি বলিস শীল? শীল বেশ তাড়িয়ে বলে ওঠে, মন্দ নয় প্রস্তাব টা। সুশান্ত বলে বসে আমি ভাই রুটি আর চিলি ফাকসা(শুয়রের মাংস) খাবো।সবাই একমত। সমীর বায়না ধরে আর একটা পেগ চাই।ঘমকে চুপ করান হলো। রাতে আবার খাবোনা, তখন আধ পেগ এক্সট্রা দেব। তা বেশ, তা বেশ। খাওয়া সেরে টাকা পয়সা মিটিয়ে, মাল রোডে যাত্রা।

    আমরা এখন পুরো ধুনকিতে।আমরা হাসি ঠাট্টা করতে করতে নেপালি মেয়ে দেখে চোখ সেকছি।ওদের খবর নেওয়া উচিৎ একটু। সুবীর গালি দিয়ে বলল একটু কেন পুরোটা নে। শান্তি করে মেয়ে দেখ সব নেশা নেমে যাবে,সন্ধ্যা আসর জমবে। সুশান্ত বলে ওঠে ,শীল বেশ রঙিন লাগছেনা , শীল ফোকলা দাঁত দেখিয়ে খিক খিক করে হেসে বলে ওঠে চলনা এক দুটো মেয়ে ফাঁসাতে চেষ্টা করি। স্যাররা তো নেই চিন্তা জিরো। বাদবাকি বালছাল কোথায় মরছে মরুক গিয়ে। বুঝতে বাকি নেই শীল এখন ফুলটুস।

    এখন আমরা মাল রোডে বেঞ্চে বসে আড্ডা দিচ্ছি ও সিগারেট ফুঁকছি। হঠাৎ দেখি মহেশ,প্রদীপ আর মহেন্দ্র। তিনজনই মাড়োয়ারি আর আমার ছোট বেলার স্কুল সঙ্গি। আমি ও মহেশ ছিলাম প্রথম ও দ্বিতীয় বয়। খুব কম্পিটিশন ছিল দু’জনের আবার খুব ভালো বন্ধুও। দুর ছাই আবার অন্য দিকে চললাম যে। জানা ছিল ওরা দার্জিলিং- এ পড়াশোনার জন্য আছে। বাবলু তু ইধার( আমার ডাক নাম) । সবটা জানালাম। ওঁরা আমাদের বলে চল আমাদের ভাড়া বাড়িতে থাকবি। চুটিয়ে আড্ডা আর ফুর্তি করা যাবে।চল এখন আমাদের ঘরে। এত জনের থাকার জায়গায় হবে। মহেশ চল তোদের বাড়িটা দেখে আসি। আগামী কাল সকালে চলে আসবো। আমাদের মধ্যে দু’জন বলে ওঠে আমরা কাল সকালে নেমে যাব। মহেশ বলে ওঠে, ফিরতো কোই প্রবলেম নেহি রহা।

    ওঁরা রুমে রয়ে গেল, আর বলে দিল সকাল ৮ টার মধ্যে পৌঁছে যাস। কাল থেকে ৭-১০দিন আমাদের সাথে থাকবি আমাদের গেস্ট হয়ে। খালি মস্তি আওর মস্তি। হোটেলে ঢুকতেই ম্যানেজার বলে ওঠে,আপ লোগোকা সাথী শিলিগুড়ি চলা গয়া। শালারা আমাদের চে বড় ধান্দা বাজ। তোরা দুজন কাল সকালে বেড়িয়ে যাস আর আমরা দিন সাতেক পরে ফিরবো। বাড়িতে খবর দিস।মাল ও চাখনা নিয়েই এসেছিলাম। আমাদের ফুর্তি নন্ স্টপ চলবে। সমীর মন ভরে টেনে নিস বড়ো বোতল এনেছি।

  • অশিক্ষা ভ্রমণ (পর্ব-২)

    অশিক্ষা ভ্রমণ (পর্ব-২)

    সব মিলে ২১ জন তাও আবার আমাদের চাপে পড়ে। ভালো ছেলেদের ভাবখানা এমন যে গন্ডমূর্খ ও স্প্যানিশ ষাঁড় দের সাথে কে লড়াই করে। মধু বাবুর হাতে টাকা ও লিস্ট তুলে দেওয়া হলো। রিং মাস্টার সুবীর একটু পয়সাওয়ালা,ওকে বললাম মাসিমার থেকে একটু বেশি মাল জোগাড় করিস কিন্তু, মাল খেতে হবে যে। হো … হো.. করে হেসে উঠলাম। সুবীরও একটু গম্ভীর ভাব দেখিয়ে, সে কথা বলতে… সে কথা বলতে, ভাবিস না মাল তো ভুতে জোগাবে।
    মাহেন্দ্র ক্ষণ আগত,সবাই বাস স্ট্যান্ডে স্থিত। টিকিট হাতে মধুদা থুরি বাবু। হাতে টিকিট ধরাচ্ছে, নম্বর অনুসারে যে যার জায়গায় বসে পর। একটু বিমাতাসুলভ হলো কারণ আমাদের স্থান পিছন দিকে। স্যার কেমন যেন হলো। পেছন থেকে সবচেয়ে ভালো দেখায়। আর না হয় আমরা দুজন পিছনে যাচ্ছি। থাক থাক চলবে স্যার। বাস চলছে দার্জিলিং মোড় পেড়িয়ে সুকনা ছাড়িয়ে পাহাড়ী আঁকা বাঁকা পথ দিয়ে এগিয়ে চলেছি। বাঁকে কখনো ও আমার ঘাড়ে আবার আমি ওর পেছন থেকে আমরা গান ধরলাম “মেরে স্বপ্নো কি রাণী কব আইগি তু…..”

    স্যার নিশ্চুপ। বকা না দেবার কারণ ‘আরাধনা’ সিনেমা একসাথে দেখেছিলাম কোনো কারণে স্কুল ছুটি হওয়ায়। আমরা লুকিয়ে তৃতীয় ক্লাসে আর স্যারেরা প্রথম ক্লাশে। মধ্যাহ্ন বিরতির সময় ধরা পড়ে গেলাম এবং কয় এক ঘা ও পড়েছিল।

    প্রায় চার ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম। গ্রীষ্মেও ভালোই শীত শীত ভাব। ব্যাগ থেকে সোয়েটার বের করে সবাই গায়ে চরালাম। বুকিং করা হোটেলে উঠে, স্যারের ঠিকানা মতো ঘরে উঠলাম। এবারের টায় ভুল করেননি। আমাদের পাশাপাশি দুটো রুম এবং শেষ মাথায়। স্যারেরা সামনে,আর পরপর ভালো ও সুবোধ বালকেরা। চল তাড়াতাড়ি খেয়ে নে বোটানিক্যাল গার্ডেনে যেতে হবে। সময় নষ্ট করা যাবে না।

    খেয়ে গার্ডেন মুখো, টিকিট কেটে ভিতর ঢোকা। ঘন্টা দুই বিভিন্ন গাছপালা,ফুল চেনালেন সায়েন্টিফিক নাম দিয়ে। আমাদের কাছে সব সমান সায়েন্টিফিক বা আন সায়েন্টিফিক। বাঘ ডাসার আবার বাঘের ভয়।

    মধু বাবুরা আবার কবে বায়োলজি ও বায়োলজিক্যাল নাম জানলেন, উনিতো ইংরেজি দ্বীতিয় পত্রের সাবজেক্ট টিচার(জ্ঞানের ফর্দা ফ্রাই ওটা গ্রামার হবে)। বুঝতে পারলাম বুড়োরা কেনো পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে বলেন। এসকার্সন করিয়ে করিয়ে দুধে জীব ও উদ্ভিদ বিদ্যায় মা সরস্বতী হয়ে গেছেন। অনেক হয়েছে চল তোরা,বাকিটা বাড়িতে গিয়ে পড়িস । আর তোদের তো বলা না বলা সমান। পাশেই পদ্মজা নাইড়ু জুলজিক্যাল পার্ক.. বুঝেছি স্যার। কি বুঝলি? মানে আপনি চিড়িয়াখানা র কথা বলছেন। আচ্ছা চিড়িয়া তো সহজেই বলে দিলি। আমরাও একটু আধটু পড়াশোনা করি একদম ছাট মাল ভাববেন না। বুঝিরে বাবা বুঝি, এমনি এমনি ৯,১০ পার করে ইলেভেন এ পৌঁছায়নি।হন্তদন্ত হয়ে জুতে পৌছালাম। একের পর এক রেড পান্ডা,স্নোলেপার্ড, হরিণ, বিভিন্ন পাখি ,লামা, হিমালয়ান ভাল্লুক ইত্যাদি দেখালেন ও লেখালেন, অবশ্যই উল্লুক…. না মানে রথীন ও ছিল। উল্লুক নামেই পরিচিত।

    যা লেখালেখি করেছিলাম হায়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার পর কাকিমা কেজি দরে আমার জ্ঞানের ভাণ্ডার বেচে দিয়েছিল। সেদিনের মতো শেষ। স্যার ক্লান্ত , চল হোটেলে ফেরা যাক। ফেরার সময় কিছুটা সময় ম্যালে কাটিয়ে ফেরা, ভুল ভাবেননি, মাল রোডে আমরা সেভেন মাস্কেটিয়ার্শ ই ছিলাম। দুজন স্যার ঘরে ঢুকে ঘর বন্ধ করলেন।নির্দেশ মত ছেলেরা বলে ডিনার রাত ঠিক ৮.৩০টা স্যার বলেছেন।স্যাররা কোথায়? ঘরেই আছে। এখন বুঝি এক আধপেগ ঘর বন্ধ করে টেনেছেন।

    রাত ৬.৩০টা মাস্কেটিয়ার্শ দের মধ্যে ফিসফাস আর মন উসখুস ও চঞ্চলতা পরিলক্ষিত, সুবীর কেন্দ্রীক দৃষ্টি। সুবীর বলে ওঠে চল সামনেই সিমলা হোটেল, ঢুকুর ঢুকুর করে দু পেগ ওটি( old travrin whiskey) মেরে আসি। ইলেভেনে ই রাজা বাদশাহ হয়ে গিয়েছিলাম, মাঝে মধ্যেই বিয়ার হুইস্কি খুড়িয়ে খুড়িয়ে চলা শুরু করে দিয়েছিল। ঠিক ৮.১৫মি তেই হোটেল প্রবেশ এবং দূরত্ব রেখে চলা। খাওয়া দাওয়া সেরে হোটেলে এসেই মধুবাবু বলেছিলেন কাল ভোর তিনটায় উঠে সবাই রেডি হয়ে নিবি,৩.৩০মিঃ জীপে উঠে টাইগার হিল আর সানরাইজ উপভোগ করবো। আকাশের রূপ পরিবর্তন ও আলোর খেলা দেখবি। আমি একটু ঘুম কাতুড়ে ছিলাম,স্যার ভূগোল শিখে কি হবে? চোপ ব্যাটা বলে গলা খেঁকিয়ে উঠলেন। একটু ভয় পেয়ে ছিলাম আমরা। মাই বিয়ার থেকে টাইগার হয়ে ওঠায়। চুপকরে ঘুমতে যা। এখন বুঝি মালের গন্ধ পেয়েছেন বা আমাদের মধ্যে কুইশলিং ছিল। ম্যাঁও,ম্যাঁও করে ঘরে ঢুকে ছিটকিনি।

    রাত তিনটা ,ঠক টক, তোরা ওঠে পর গাড়ি এসেগেছে। কোন ভাবে লেপ থেকে বেরিয়ে গিরগিটি মতো দ্রুত রূপ পাল্টে নিলাম আমরা সাত। একটু গম্ভীর পরিবেশ, গতকালের ধমকের জন্য। মধু বাবুরা এগিয়ে এসে বলেন কিরে এমন চাঁদ পানা মুখ গুলো কে ব্যাঙ পানা করে রেখেছিস যে। না মানে ঘুম ঠিকমতো হয়নি তো তাই। এখনো ঘোর কাটেনি? ঠিক বুঝলাম না সমস্বরে বলে উঠি।না মানে ঘুম ঠিকমতো পুরো পুরি হয়নি বুঝি? রাতে লেট করেছিস ঘুমতে । চল এবার দেখে মুগ্ধ হয়ে জাবি। স্যাররা কিছুটা নরমাল করলেন। আমি একটা ক্লিক থ্রী ক্যামেরা এনেছিলাম, সেটা নিলাম। সুবীর আগফা নিল। গাড়িতে উঠে বসলাম সবাই।

    ঘুম থেকে বাঁদিক দিয়ে সরু ও খাড়া রাস্তা বেয়ে আমাদের ল্যান্ড রোভার্স গাড়িগুলো গ্যাগ গ্যাগ করে এগিয়ে চলেছে। ভীষণ ভয় হচ্ছে,গাড়ি উলটে যাবেনাতো। ভয় উৎকন্ঠার মাঝে অন্ধকারে থাকতেই টাইগার হিলের ভিউ পয়েন্টে গিয়ে উঠলাম। বেশ ভিড়, সবার হাতে ক্যামেরা, সবাই দৃষ্টি পূর্ব দিগন্তে স্থির। অন্ধকারেই দেখছি সোয়েটার,জ্যাকেট, বাঁদর টুপি, কম্বল , চাদরে সবাই ঢাকা। ঠান্ডা বেশ জম্পেশ। মনে মনে ভাবছি চা হলো ভালোই হতো। মধুবাবু মনস্তাত্ত্বিক এর মতো মন বুঝে,এক চা ওয়ালাকে ডাকলেন।

    সবাইকে এক গেলাস করে চা ও দুটো করে কুকিজ বিস্কুট দাও দেখি ভাঙ্গা ভাঙ্গা নেপালি তে চা বিক্রেতার উদ্দ্যেশে বলেন। কুকিজ ডুবিয়ে চা খেয়ে চাংগা হয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিলাম কারণ পূর্ব দিগন্তে অন্ধকারের রূপ রং রাগ ভেঙে রঙিন হতে আরম্ভ করেছে।ক্যামেরা হাতে আমরা তৈরী।

  • ইরানের ডায়েরি (পর্ব-২)

    ইরানের ডায়েরি (পর্ব-২)

    দ্বিতীয় দিন ১৬ই মার্চ, শুক্রবার খুব ভোরে আবদুর রশীদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙল। জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলাম সাদা বরফে ঢাকা আলবান্দ পর্বতমালার ওপাশে লাল সূর্য উঁকি দিচ্ছে। সাদার উপর সূর্যের লাল আভা সে নৈসর্গিক দৃশ্য কেবল দেখলেই অনুভব করা যায়। আর হোটেল কম্পাউন্ডের গাছগুলোতে অপূর্ব সুন্দর বাসন্তী বাহারি ফুল।কিন্তু বেশিক্ষণ প্রকৃতির মনভোলানো সৌন্দর্য দেখা হলো না। বাচ্চাদের ডেকে দ্রুত রেডি হয়ে রওনা হলাম। ঐতিহাসিক ও রহস্যময় জলগুহাটি যেন আমাকে ডাকছিল। ১৪ বছরের ইরান প্রবাস জীবনে অনেক প্রদেশ ঘুরেছি কিন্তু মনের ভেতর তীব্র আকাঙ্খা ছিল এই ‘আলীসাদ্‌র’ জলগুহাটি দেখার। শহর ছেড়ে ট্যাক্সি ছুটে চলেছে পাহাড়ী এলাকার বুকচিরে। পথের দুপাশে পাথুরে রূক্ষ্ম পাহাড়। কোথাও কোথাও পাথর কেটে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে টানেল রয়েছে। একটু গা ছমছম করা ভাব অন্ধকার টানেলের ভেতর। রাস্তার দুপাশে মাঝে মাঝে আলু, পিঁয়াজ, আর রসুনের ক্ষেত দেখলাম। এক জায়গায় বিস্তৃত হলুদ সর্ষে ক্ষেত দেখে মনটা আনন্দে ভরে গেল। তবে বুঝতে পারলাম না কাঁকর মিশ্রিত মাটিতে কিভাবে ফসল ফলল। আরো কিছুদূর গিয়ে জলপাই বাগান দেখতে পেলাম মাইলের পর মাইল। ইরানে জলপাইকে জয়তুন বলে। ইরানের জলপাই গাছগুলো ছোট সাইজের, ঝোঁপের মত কিছুটা। এই জলপাই ঠিক আমাদের দেশের মত না। সাইজে ছোট এবং স্বাদ কিছুটা কষ টাইপের। এই জলপাই দিয়ে ইরানের বিখ্যাত “রওগানে জয়তুন ” বা ওলিভ অয়েল তৈরি হয়।

    আমাদের ট্যাক্সি হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছে। কোনো বাড়িঘর চোখে পড়ল না, কেবল ছুটে চলা টুরিস্ট মাইক্রোবাস, আর ট্যাক্সি চোখে পড়ল। সকাল নটার দিকে আমরা কাঙ্খিত গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম। সংরক্ষিত এলাকায় ঢোকার জন্য স্ক্যানিং মেশিনে চেকিং এর পর টিকিট কাউন্টারে গেলাম। বিদেশিদের জন্য প্রবেশ মূল্য ২০ ডলার হলেও আবদুর রশীদের চাকরির সুবাদে ইরানি হিসাবে বিবেচনা করল। ১০ ডলার মাথাপিছু দিয়ে টিকিট নিয়ে দীর্ঘ দিনের আকাঙ্খার সেই প্রাকৃতিক জলগুহার প্রবেশ দ্বারে পৌঁছলাম। সেখানে আমাদেরকে লাইফ জ্যাকেট দেয়া হলো। পরে নিলাম এবং গুহার ভেতর প্রবেশের আগে আরেক দফা চেকিং এর মুখোমুখি হলাম। গেট দিয়ে ঢুকে আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম আল্লাহর অপূর্ব সুন্দর সৃষ্টি দেখে।

    ‘আলীসাদ্‌র’ গুহা
    পাহাড়ের ভেতর দিয়ে বয়ে চলছে নদী বা লেক। কী শান্ত, স্রোতহীন। ঘাটে বাঁধা সারিসারি নানান রঙের বোট। বোটগুলো তিনটি করে পরস্পরের সাথে বাঁধা। প্রতিটি বোটে ৪ জন করে অর্থাৎ ১২ জনের এক একটা গ্রুপ। চারদিকে সুনসান নীরবতা। লাল, হলুদ, সবুজ, আর নীল আলোয় এক মোহনীয় পরিবেশ। গুহার ছাদ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে সৃষ্টি হয়েছে এই নদী বা লেক। পানির গভীরতা একেক বাঁকে একেক রকম। ৫ ফুট থেকে শুরু করে সাড়ে ২৬ ফুট পর্যন্ত। আর পাহাড়ের উচ্চতা ১৩২ ফুট। বিশেষজ্ঞদের মতে ১৩ কোটি ৬০ লক্ষ বছরের পুরানো এ গুহাটি আবিষ্কৃত হয় ১৯৬৩ সালে। ইরানের একদল পর্বতারোহী এ গুহাটি আবিষ্কার করেন। এপর্যন্ত গুহার ভেতরের লেকটি ২৪ মাইল পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছে। ভূতত্ত্ববিদদের মতে ট্রায়াসিক যুগের শেষ থেকে ক্রিটেশিয়াস যুগের মধ্যবর্তী সময় যেটাকে জুরাসিক যুগ বলা হয় সেসময়ের এ গুহাটি। গুহাটির ভেতর খনন কাজ চালিয়ে এমন বেশ কিছু নির্দশন পাওয়া গেছে যা থেকে বোঝা যায় যে সেলজুকিয় শাসনামলে এই গুহাতে মানুষ বাস করত।

    বোটে উঠে বসলাম, বোট এগিয়ে চলল আমাদের ১২ জনের দলটি নিয়ে। উপরের দিকে তাকিয়ে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। মনে হলো যদি লাইট অফ হয়ে যায় কিংবা ভূমিকম্প হয়ে গুহামুখের দরজা বন্ধ হয়ে যায়… ! হয়ত হাজার বছর পর আবার আমাদের কঙ্কাল আবিষ্কার হবে আর আমরা স্থান পাব ইতিহাসের পাতায়। এখানে কিছুক্ষণ থাকলে কবরের অন্ধকার, শীতলতা আর নিস্তব্ধতা অনুভব করা যায়।একটু ভয় পাচ্ছিলাম তালহা রোদোসি ভয় পাচ্ছে কিনা। কিন্তু ওদের হাসিখুশি মুখ দেখে নিশ্চিত হলাম। কিন্তু আঃ রশীদের দিকে তাকিয়ে দেখলাম মুখটা কেমন শুকনো শুকনো আর চোখ দুটো যেন ভয়ে ছানাবড়া। ওর এই ভীত ভাব নিয়ে আমি ও ছেলেমেয়েরা এখনো মজা করি।

    আমরা শীতের ভারী কোট পরে ছিলাম কিন্তু অনুভব করলাম বাইরে যে হিমাঙ্কের নিচে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছিল গুহার ভেতরে ঠিক ততটা না; ঠাণ্ডা তবে সহনীয়। আমরা লাইভ জ্যাকেট খুলে ফেললাম। সুনসান নীরবতা ভেদ করে আমাদের বোট এগিয়ে চলেছে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে। গাইড মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছে; বিবরণ দিচ্ছে। কোথাও কোথাও পথ এত সুরু যে ভয় পাচ্ছিলাম এই বুঝি দেওয়ালে ধাক্কা লেগে বোট উল্টে গেল। আবার কোথাও বা দেয়ালে মাথা ঠুকে যাওয়ার মত অবস্থা। বোটগুলো যাওয়ার রুটও ভাগ করা আছে। আাধা ঘন্টা চলার পর একটা স্টেশনের মত জায়গায় থামাল বোট। প্রায় ৫০০ মতো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেলাম। সিঁড়ির দুপাশে পাথরের দেয়ালে পানির ফোঁটা জমে জমে বিভিন্ন আকৃতির স্পাইক তৈরি হয়েছে। দেখলে মনে হবে লাখ লাখ মোমবাতি গলে এগুলো তৈরি হয়েছে। সাদা চকচকে ক্রিস্টালও তৈরি হয়েছে কোথাও কোথাও। তার ওপর বিভিন্ন রঙের আলোর আভা যে মোহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে তা সত্যিই বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কেবল দেখে হৃদয় দিয়ে অনুভব করা যায়। স্টেশনে পৌঁছে দেখলাম সেখানে বসার জায়গা করা আছে।চারদিকে নিয়ন আলো আধাঁরীতে এক নৈসর্গিক পরিবেশ। মনে হচ্ছিল লাখ লাখ লাল, নীল, সবুজ মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। আমরা ফ্লাক্স থেকে চা বের করে খেলাম। তালহা রোদোশী চিপস, স্যান্ডউইচ খেলো। আমাদের পাশেই একটা ইরানি পরিবার ছিল। কথা বললাম তাদের সাথে। বাচ্চাদের সাথে ছবি তুললাম। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা আবার নীচের দিকে রওনা হলাম বোর্টের উদ্দেশ্যে। একবার মনে হলো ইচ্ছে করে হারিয়ে যাই, কিভাবে রেসকিউ করে দেখার ইচ্ছা হলো। কিন্তু গাইডের সর্তক দৃষ্টি এড়িয়ে সম্ভব হলো না। বোর্টে এসে বসলাম। পানিতে হাত ডুবিয়ে রাখলাম। পানি এতটাই স্বচ্ছ যে ৫ মিটার পর্যন্ত দেখা যায় গাইড জানালো। স্বপ্নের ঘোর কেটে গেল গাইডের ডাকে। দেখলাম ঘাটে পৌঁছে গিয়েছি। অন্যান্য টুরিস্টরা অপেক্ষা করছে বোর্টে ওঠার জন্য। আমরা নেমে গেটের দিকে এগিয়ে গেলাম… আলোকময় পৃথিবীর দিকে।

    গাড়ি চালকের ভালোবাসা ও উদারতা
    সবশেষে একজনের কথা না বললে আমি স্বস্তি পাব না। তিনি হলেন আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার। মাহমুদ নামের ষাটোর্ধ্ব এই ভদ্রলোক যে আন্তরিকতা, স্নেহ ও ভালোবাসা দেখিয়েছেন তা আমি কখনই ভুলব না। তাঁর তিন ছেলেমেয়ে। বড় দু’জন ডাক্তার আর ছোট মেয়েটি তেহরান ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। হোটেলে পৌঁছে ভাড়ার যে হিসাব দিলেন তাতে দেখলাম ২০ ডলার কম নিয়েছেন তিনি। সেদিনই সন্ধ্যায় ফিরব শুনে তিনি বললেন, আমি তোমাদের স্টেশনে পৌঁছে দেব। আমরা ১৫ ডলার দিয়ে একটা গিফট কিনে দিলাম তাঁকে। ট্যাক্সি ছুটে চলেছে স্টেশনের দিকে। একটা গান বাজছিল ” তানহা গুজাসতে, মান চিতুর মিমুনাম, দোবরে মিবিনাম মান মনতাজের মিমুনাম।বাংলা অর্থ হলো — একা রেখে তোমরা যাচ্ছ, আমি কিভাবে দিন কাটাব, আবার দেখা পাব সে আশায় থাকব। ” তিনি স্টেশনে পৌঁছে দিয়ে ভাড়াও নিলেন না। বললেন, তোমরা আমার দেশে মেহমান। অজানা অচেনা এই বিদেশিদের জন্য যে আন্তরিকতা ও সৌজন্যতা তিনি দেখিয়েছেন তা কখনই ভুলব না। হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে এগিয়ে গেলাম গেটের দিকে। কানে বাজতে থাকল ” তানহা গুজাশতে, মান চেতুর মিমুনাম…

  • অশিক্ষা ভ্রমণ (পর্ব-১)

    অশিক্ষা ভ্রমণ (পর্ব-১)

    শ্রেণী একাদশ, গ্রীষ্মকাল। স্যার সময় অতিবাহিত যে।
    স্যা: কিসের?
    কবে নিয়ে যাবেন?
    স্যা: কোথায়?

    ভাবনায় ডুব সাঁতার! বয়সের গাছ পাতা আছে তো! কেন প্রতি বছর তো নিয়ে যাচ্ছেন। রাত কানার রতৌনী হয় (বিহারী ভাষায়), স্যারের কি ভুলৌনী হলো নাকি? অবশ্যই আমাদের সাতজনের ভাবনায় ঘুরপাক। মধুবাবু আমাদের হরিণ (my dear)ছিলেন। ছাত্রদের সাথে বন্ধুর মত মেলামেশা। দুচার জনের সাথে পোষ্ট অফিস মোড়ে সিগারেট ফুঁকতে ও দেখেছি কিন্তু কাকার কলিগ হওয়ায় ধৃষ্টতা দেখাইনি।

    মধুবাবু ও দূর্গাবাবু বন্ধু সুলভ হলেও ভীষণ শ্রদ্ধাশীল ছিলাম ছাত্ররা।

    আমরা সমস্বরে ‘এক্’স্ক্যশন বলে চেচিয়ে উঠলাম। স্যার হেসে বলে ওঠেন, তাই বল ব্যাটারা। এক একটা আস্ত গিনিপিগ তোরা, তোদের আবার শিক্ষা ভ্রমণের কি দরকার- উদ্দেশ্যের বর্শা মুখ আমরা সেভেন মাস্কেটিয়ার্শ। ঝড়ের বেগ বুঝে স্যারও বলে ওঠেন, ঠিকি তো সময় যায় যায় করছে, ঠিকই বলেছিস। ৭-১০ দিনে ফাইনাল করে দেব বাড়ি গিয়ে পেটপুরে খাওয়া দাওয়া কর এবার। হাত ওঠা তো, দেখি কে কে যাচ্ছিস। ১৯-২০ জন হলো, আমাদের দুজন সেদিন অনুপস্থিত, দুজনের নাম ঢুকিয়ে দিলাম। পরদিন জানিয়ে দিলেন হেডমাষ্টার মহাশয় নারায়ণবাবুকে বলা হয়েছে। স্যার দুতিন দিন সময় চেয়েছেন। উৎকন্ঠা,উদ্দীপনা ও উদ্বেগ একবিন্দু তে, কাল স্যার কি শোনাবেন।

    আমরা সেভেন মাস্কেটিয়ার্শ ছিলাম। প্রত্যেকের নাম এস দিয়ে আরম্ভ – যেমন সুরজিৎ, সুবীর, শুভঙ্কর, সমীর, সুশান্ত, সুদর্শন ও শীল। আশিষ শীল হলেও সবাই জানতো শীল বলে। আশিষ নামটা খুব কম ছেলেরা জানতো। পরিকল্পনায় ব্যস্ত কি কি করবো। কোথায় গেলে স্থান ভেদে রকমফের ইত্যাদি ইত্যাদি।

    তৃতীয় দিন, স্যার ঢুকেই “বয়েজ- নারায়ণবাবু অনুমতি দিয়েছেন”। চারদিন পর গন্তব্যে অভিযান,যাত্রা স্থির, স্থান দার্জিলিং। শোন তোরা সাতজন, স্কুলের মান মর্যাদা তোদের হাতে। মোদি হলে বুক ৫৬” হোতো, হয়নি! তবে ৩৩”.১/২এম. এম হয়ে গেল। কি কি নিতে হবে কত টাকা জমা দিতে হবে ইত্যাদি এক নিঃশ্বাসে বলে, ‘so boys, tomorrow you all deposit money to subir’, সেভেন এস your duty start now.,বলেই মধুবাবু ঘন্টা পরার আগেই বেরিয়ে গেলেন।

    আমাদের কালেকশন আরম্ভ। কাল যে যার টাকা জমা করবি। সবাই ১৫ মিঃ আগে এসে সুবীরের হাতে দিবি, বলে ক্লাস ছেড়ে পালালাম।

    টেনিস ক্লাবের বারান্দায় বসে জল্পনায় লিপ্ত । বিষয় একটাই আমাদের উপর স্কুলের মর্যাদা নিয়ে? আলোচনা শেষে উপসংহার আমাদের সামলানোর জন্য স্যার ব্রহ্মাস্ত্র ছুঁড়েছে। আমরাও প্রস্তুত। পরদিন টাকা কালেকশন শেষ। সবাইকে বলে দিলাম ইস্ত্রি করা জামা পেন্ট সোয়েটার দুই সেট নেওয়া চাই। আমাদের দেখা গত দুটোর থেকে ভালো শিক্ষা ভ্রমণ হতে হবে। ভালো ছেলেদের উদ্দেশ্যে বলা হলো তোরা প্রাণী ও জীববিদ্যা মুখস্থ করে আসবি। অরিজিৎ বলে ওঠে তোরা কি করবি? আমরা তোদের সাথে সাথে শিখব। আর রাতে মাল খাবো।

    অচলা বাবুর থুরি অমলেন্দু চন্দ্র লাহিড়ী বাবুর শেষ ক্লাস। শেষের কথার জন্য অপেক্ষা না করে বলে দিলাম,পরশু আমাদের শিক্ষা ভ্রমণের যাত্রা.., স্যার মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে বলেন তোদের উপর দায়িত্ব। টাকা উঠিয়ে জমা করেছিস, পোষাক নিয়ে আলোচনা হয়েছে ,কখন বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছোতে হবে, হাতে টিকিট নিয়ে লাইন ধরে সিট নম্বর অনুসারে বসতে হবে ইত্যাদি…

    এবার তোরা আলোচনা কর আমি যাচ্ছি। অরিজিৎ,গৌতমেন্দু, কবীর দীপঙ্কর বলে ওঠে স্যার আপনি ক্লাস নিন। আমাদের চোখের দিকে চেয়ে দ্বিতীয় বার বলার সাহস পেল না ছেলেরা। অচলা বাবু বেরিয়ে গেল। আমরা বলে উঠলাম কোন শালারা কথা লিক করছিস? একটু সাবধান হতে বলছি , নাহলে গণপিটুনি। এবার আমাদের ক্লাস আরম্ভ। কাল বাদে পরশু যাত্রা। সুবীর আমি শুভঙ্কর একটু শৌখিন,ফলে জ্যাকেট ও কোট তোরা নিবি অবশ্যই, যার আছে। এরকম টুকটাক আলোচনা করে বাড়ি যাওয়া।

    পরদিন প্রথম ক্লাস থেকেই সবাই আলোচনায় ব্যস্ত উত্তেজনায় ফুটছি।একজনও স্যার ক্লাস নিলেন না, সবার মুখেই এসকার্সন এর গল্প, কথা ও জ্ঞান। এভাবেই দিন শেষ,স্কুল ছুটি।

  • তব্দা খাওয়া

    তব্দা খাওয়া

    তব্দা কি! অন্যের অভিধানে কি বলে আমার জানা নেই। তবে আমার অভিধানে তব্দা খাওয়া হলো স্তম্ভিত হয়ে নির্বাক হয়ে যাওয়া।

    এরকম আমার প্রায় ই হতো আগে। এখনো হয় তবে খুব কম। আমি মানুষ টা একটু বেশিপ্র‍্যাক্টিকাল। তাই অবাক হবার মতো কোনো বিষয়ে ও খুব একটা অবাক হইনা।এজন্য অনেকেই হয়তো আমার সাথে কথা বলে মজা পান না। সেটা তাদের ব্যাপার! আমি কি করতে পারি!

    আমি এক বিশেষ নীতিও ধারণ করি তা হল,টেনসন লেনেকা নেহি টেনসন দেনেকা। আর আমার হাসবেন্ড ফুল টাইম সিরিয়াস পাবলিক। টেনসন নিতেই ভালোবাসেন। এবং উনি সেই টেনসন কৌশলে আমার মাঝে স্প্রেড করতে চান। একই কথা অনেক বার বলেও যখন কাজ হয় না তখন ব্যাচারা মন খারাপ করে অন্য ঘরে গিয়ে বিড়ি ধরান।উনার এই যে একটা বিশেষ সংগী আছে বিড়ি। সুখে দুখে ভাবে অনুভবে,রাগে অনুরাগের সংগী! আমার কে আছে যে আমি অযথাই টেনশন করবো?

    তারপর ও মাঝে মাঝে তব্দা খেয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ি। আমার বড়ো ছেলে কেজি তে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগে ই বানান করে অনেক শব্দ ও বাক্য লিখতে পারতো। তাই পরীক্ষা নিয়ে আমার কোনো টেন্সন ছিলো না। জানি ভালোই করবে। আগের রাতে ফ্ল্যাটের এক বাচ্চার বার্থডে তে গিয়ে আনন্দ করলো। আনন্দের মাঝে তখনই ঢাকা থেকে অনেক গেস্ট এসেছিল আমাদের বাসায়। তাই বার্থডের প্রোগ্রামের মাঝে চলে এসেছিলাম। ওর দুই ফুপুর ফ্যামিলি এসেছিল। তাদের সাথে কথা বলে অনেক রাতে ওরা চলে যাবার পর অতি পরিশ্রমে তব্দা খেয়ে গেলাম। আমার মাথা ও মন কাজ করছিল না আমি আর ওকে কিছুই পড়াতে পারিনি বা কিভাবে পরীক্ষা দেবে তাও বলে দিইনি। তো সকালে উঠে ওকে নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে বললাম যা যা আসে সব লিখ। আমি জানি সে পারে। কিন্তু আমি বুঝিনি সে শিশু,তাকে ক্ষণে ক্ষণে ই মনে করিয়ে দিতে হয়। যথারীতি সে বিশাল খেলার মাঠ দেখে পাগল হয়ে গেল। কি যে লিখেছিল কে জানে। পরে প্রতিবেশীর বাচ্চার কাছে শুনলাম ও নাকি বেশির ভাগ সময় কে কি করছে তাই দেখেছে।তবুও দশম হয়েছিল।

    প্রাইমারি সেকসনে যখন পড়তো তখন রেজাল্ট দেয়া হতো ক্লাসে। সেবার ক্লাস টু থেকে থ্রি তে উঠবে, সেবারই প্রথম মাঠে রেজাল্ট দেয়া হচ্ছিল। আমি সাধারণত রেজাল্ট আনতে যেতাম না ওর বাবা যেতো। সে বার কি কারণে উনি যেতে পারেন নি,আমি ও সংসারের কাজকর্ম সেরে তখনই গেটে ঢুকেছিমাত্র রেজাল্ট ঘোষণা হচ্ছে। আমি আমার বাচ্চার রেজাল্ট শুনে তব্দা খেয়ে গেলাম। দুই সেকসান মিলে সে থার্ড হয়েছে!সবাই আমাকে বলছে কিন্তু তব্দা খেয়ে চুপসে আছি।কি করা উচিৎ কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না!

    এরপর এস এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট এর দিন।

    তার দুতিন দিন আগে ওর পা এর প্লাস্টার খোলা হয়েছিল। পরীক্ষা দিয়ে মামা বাড়ি গিয়ে ফেরার আগের দিন খেলতে গিয়ে লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। ঐ অবস্থায় ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামে ফিরেছিলাম। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ওর দাদি মারা গেলেন। ১৭/৬/২০০৮তারিখ দাদি মারা গেলেন ২৬/৬/২০০৮ রেজাল্ট হলো। বাইরে সকাল থেকে বৃষ্টি। ও কোত্থেকে যেন রেজাল্ট পেল। এ প্লাস পেয়েছে। আমরা ও তাই ই আশা করে আছি।বাবু তাড়াতাড়ি নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। এর একটু পর আমি আর বাবু নাসিরাবাদ স্কুলের দিকে রওনা হলাম। স্কুলে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বল্লো আম্মু আমি তো এ প্লাস পাইনি বি পেয়েছি! আমি আবার তব্দা খেয়ে গেলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এমন সময় ওর বন্ধু আরিক দৌঁড়ে এসে ওকে বল্লো, “আরে এটা সায়েন্স এর রেজাল্ট চাট। আমাদের টা ওদিকে চল দেখবি।আন্টি আসেন দেখেন। গেলাম দেখলাম সত্যি সত্যিই ডে সেকসানে সে একমাত্র এ প্লাস। কিন্তু সেই তব্দা খেয়ে আছি কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। ওই অবস্থায় দুই নাম্বার গেটের কাছে ওর অংকের স্যারের বাসায় গেলাম। স্যার আমাকে দেখে ধরে ফেললেন। বল্লেন, “আপনি খুশি হন নি। এমন চুপ করে আছেন কেন।সেলিব্রেট করেন।” উনার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বাসায় এসে আধামন মিস্টি কিনে বিতরণ করেছিলাম।

    তখনও সাথে সাথে গোল্ডেন কিনা জানা যেত না। পরদিন ২৭/৬ এ ওর জন্মদিন। ও মিস্টি নিয়ে আমার আম্মা কে সালাম করতে খুলসি রওনা হয়েছে বাসায় ল্যান্ড ফোনে ওর এক বন্ধু (আজ আর নাম মনে নেই) খবর দিল আন্টি নয়ন গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। পরে জানলাম স্ট্যান্ড ও করেছে।

    এরকম তব্দা খাওয়া গল্প আরও আছে। সময় করে আবারও বলবো!