Tag: স্মৃতিকথা

  • কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-১)

    কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-১)

    সময় টা ছিল ২০১৭ সালের মার্চ মাস।আমার ছোটো ছেলের এস এস সি পরীক্ষা শেষ। আমি ওকে নিয়ে মাকে দেখতে মেহেরপুর যাবার জন্য রেডি হচ্ছি।

    আর ওর বন্ধুর পরিবার গুলো সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল একসাথে কোথাও ঘুরতে যাবার। বাচ্চা ও আমাদের ১২ বছরের পথচলা স্মৃতি টাকে ধরে রাখতে এই প্রয়াস!

    কেননা এরপর কলেজে উঠে কে কোথায় ভর্তি হবে তাতে সেই নার্সারি থেকে একসাথে বারোবছরের জার্নিটা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যাবে।

    যেই কথা সেই কাজ।ভাইয়ারা প্রতি সন্ধ্যায় বড়ো পোল অথবা আর্টিলারিতে একসাথে হন আর মিটিং করেন।

    ভাবিরাও কম জান না। তাঁরাও উঠে পড়ে লাগলেন প্ল্যান সফল করতে। আমাদের সাতটি পরিবারের মধ্যে আমি ও আমার হাসবেন্ড ছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠ।

    সেই হিসাবে অন্যেরা যথেষ্ট সন্মান করেন।আমরাও তাদের স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছি।

    তো,মিটিং এর পর মিটিং শেষে সিদ্ধান্ত হল ২৪/৩/২০১৭ সবাই ভোরের বাসে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে ঐরাত টা সেখানে থেকে পরের ভোরে সেন্টমার্টিন যাবে ওখানে অন্তত একরাত থাকবে।

    এরপর সবাই মিলে আমাকে কনভিন্স করে ফেল্লো। আমি না গেলে তাদের খুব খারাপ লাগবে। সেটা আমার ও লাগছিল। কিন্তু মা কে দেখতে যাবার টান টাও ছিল।কিন্তু ভালোবাসার মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে না করতে পারলাম না। মেহেরপুরের টিকেট ক্যানসেল করে দিলাম।

    তবে একটা সমস্যা ছিল, আমার হাসবেন্ড কে নিয়ে। উনি যাবেন না। প্রথমে সিদ্ধান্ত হল আমি আর ছোটু যাব।তাতে অন্যান্য ভাই-ভাবিরা ভাবলেন তারা সবাই পরিবার সহ যাবেন সেখানে আমার নিশ্চয় খারাপ লাগবে। তাছাড়া আমাদের দুজনের যদি কোনো বিপদ আসে তখন আমাদের দায়িত্ব কে নিবে। এই ভেবে একেক দিন একেক ভাই, বিশেষ করে মঞ্জু ভাই, ফেরদৌস ভাই আর জীবন ভাই ফোন করে করে শেষ পর্যন্ত আমার হাসবেন্ড কে রাজি করিয়েই ফেললেন!

    আমরা সিলভার বেলস কিন্ডারগার্টেন থেকে কলিজিয়েট স্কুল পর্যন্ত এক সাথে পড়া ছয়জন ছেলে বাচ্চার পরিবার ও আরেক জন মুসলিম হাই স্কুলের বাচ্চার পরিবার মোট সাতটি পরিবারের সাথ মঞ্জু ভাই এর দুই বন্ধু পরিবার এক সাথে যাচ্ছি।

    এরমধ্যেই আমরা সবার জন্য একই রকম জামা খুব দ্রুততার সাথে বানিয়ে ফেললাম। আর ভায়েরা এক রকম টিশার্ট কিনে ফেললেন।সিদ্ধান্ত হলো এগুলো সেন্টমার্টিন যাবার দিন একসাথে পরা হবে।

    ভায়েরা একেকজন একেক টা কাজ ভাগ করে নিলেন। কেউ কটেজ ঠিক করা, কেই বাসের টিকেট কাটা কেউ খাবার ব্যাপার টা দেখা।তবে সার্বিক দায়িত্ব নিলেন করিৎকর্মা জীবন ভাই। সাদমানের আব্বা আমাদের লাকি ভাবির হাসবেন্ড।

    চলবে…

    ফাতেমা হোসেন
    ৭ই মার্চ, ২০২২ইং

  • ছোট থেকে বড় হবার গল্প শুরু

    ছোট থেকে বড় হবার গল্প শুরু

    দ্বিতীয় সন্তান তাও আবার মেয়ের পরে পরে আমি ও একজন মেয়ে হয়ে আসলাম এ পরিবারে। বাবা মায়ের স্কুলে ভর্তি করায় বিশেষ আশা ছিল। স্কুল হতে হবে সেরাটি। রাজশাহীর মিশন উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে। লন্ডনের অধিনে ছিল স্কুলটি। শিশু ক্লাস থেকে দশম ক্লাস। এগারোটি শ্রেনীর স্কুলএ পড়তে কখনো খারাপ লেগেছে বলতে হলে ভাবতে হবে। বাবা সরকারি চাকরি করতেন – হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা। মা গৃহিনী হলেও সব দিকে চৌকস ছিলেন আমাদের মা। আমরা পরে তিন বোন হলাম। তখন ছোট্ট বোনটিকে রেখে স্কুলে যেতে একটু কষ্টই হতো। নাদুস নুদুস বড়সড় বোনটি আমার।

    স্কুলে যাওয়া শুরু হলো আর বিড়ম্বনা ও পিছু নিল।একটু একটু সমস্যা শুরু হলো – আমার বড় বোনটি দেখতে বেশ সুন্দর হওয়ায় আশেপাশে চলতি রাস্তায় ওকে ছেলেরা ক্লাস ফাইভ হতে জ্বালাতন শুরু করলো। বোনের সাথে যাওয়া আসা করতাম। আপাকে ওরা টিপ্পনী কেটে কথা বলতো এটা আমার খারাপ লাগতো। আমাকেও ছাড় দিত না ঐ পাজি ছেলেরা। রইলাম আশে পাশে খেলাধুলা সব বাদদিয়ে গৃহবন্দী হয়ে। এমন এক সময় ঘনিয়ে আসলো আমরা নানা বাড়িতে বেশি থাকা শুরু করলাম। একটা স্বপ্ন দেখতাম আমি চাকরি করবো তা হবে কলেজে অধ্যাপনান।

    স্কুল জীবনে কখনো বাইরে বলতে আত্বীয় স্বজন ছাড়া অন্য কোথাও যাবার সাহস ছিলনা। কোথাও গেলে আব্বার সংগে। তিন কন্যার বাবার দায়িত্ব অনেক ছিল। আমরা ছাড়া ও তো তাদের আরও দায়িত্ব কিছু পালন করতে হতো! তাই চাইলেও সব শখ আহ্লাদ পূরণ হতোনা স্বাভাবিক ভাবেই। তবে মামা খালাদের সাথে আমাদের কিছু বাড়তি পাওয়া জড়িত ছিল। উনাদের সাথে বেড়ানো ঘোরাঘুরি হতো।

    প্রাইভেট পড়ে বাসায় আসা ছিল আতংক। এরপর এস.এস.সি পাশ করে কলেজে ভর্তি হই। রাজশাহী গভঃমেন্ট কলেজ এ। স্কুলের জন্য খুব মন কাঁদত কারণ বয়েজ কলেজে চিল্লা চিল্লি আমার ভালোলাগতো না। এরপর এগারোটা বা জলেই মিছিল স্লোগান এটা একটা ভয়ংকর মনে হতো। এস.এস সির সময়টি আমার মামার বাসায় থাকতাম কলেজ পাশে ছিল। যাওয়া আসার কোন সমস্যা হতোনা আমার। এভাবে শুরু হয়ে গেলো বিশ্ববিদ্যালয় জীবন। রাজশাহী ৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ -শহিদুল্লাহ কলা ভবন। একমাস ক্লাস করিনি ইতিহাস পড়বোনা তাই। পরে সবাইকে দিয়ে আমাকে বোঝানো হলো। আমি বিতর্কে না জড়িয়ে ক্লাস শুরু করলাম। একমাস ক্লাস না করার ঔষধ পেলাম। কোন অবস্থান হলোনা আমার। মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করে বৃত্তি পেলাম। অনার্স শেষ হতেই আমি বুঝে গেলাম আমার রাজশাহী তে থাকতে ও চাকরি করতে করতে হবে। সরকারি চাকরি করলে বদলির একটা ব্যাপার থাকবে। তাই পাশ করেই ঢুকে গেলাম কলেজে । চাকরি সংসার শুরু হলো । রাজশাহী কলেজ ক্যাম্পাস এ থাকতাম কর্তার চাকরির কারণে। এরপর ২৮ বছর কেটে গেলো ২টি পুত্র সন্তান আমার। ১ম জন কম্পিটার সায়েন্স ইন্জিনিয়ারিংএ পাশ করেছে আর ছোটটি এবার এ্যাডমিশন দিবে। আমার আর পাঁচ বছর চাকরি আছে। একটি কথা না বল্লেই নয় যে সংসার শুরু হয়েছিল ২জন ননদ কলেজ পড়ুয়াদের নিয়ে। আমি নিজেই রান্মা করতাম। ভালোবেসেই করতাম। আলহামদুলিল্লাহ ননদের বিয়ে ও বাচ্চা হওয়া পর্যন্ত আমি তাদের পাশে ছিলাম। ২০০৬ সালে শ্বশুর ও ২০১৭ সালে বাবাকে হারাই। এখন মায়েরা আছেন। দোয়া করবেন আপনারা আমাদের মায়েদের জন্য।

    মাহবুবা ইয়াসমিন
    ৭ই মার্চ, ২০২২ইং

  • ৫ টাকায় সুচিত্রা সেন

    ৫ টাকায় সুচিত্রা সেন

    সালটা ১৯৮১ বা ৮২ হবে। মিরপুরে নেভি কলোনীর সাথে সাগরিকা সিনেমা হল চালু হয় ভারতীয় ছবি উত্তম সুচিত্রার সাগরিকা ছবিটা দিয়ে। যথারীতি ছবিটা দেখলাম। সুচিত্রাকে দেখে মাথাটাই নষ্ট হয়ে গেলো। আমি সালার কি গাধা রে বাবা যে সুচিত্রাকে বিয়ে করতেই হবে। প্রতিদিন ছবিটা দেখতে যাই।

    এমন একদিন দুপুরের শো দেখে বাসায় ফিরছি তখন প্রায় সন্ধ্যা। রাস্তায় দেখি কেউ যাদু দেখাচ্ছে তার ভীর, কেউ জোকের তেল বেচতেছে তার ভীর। সবগুলোই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন দেখি। আর দেখি এটাই যেন চাইছিলাম। তাবিজ ওয়ালা। ৫ টাকা তাবিজ, ৫ টাকা তাবিজ। তাবিজ নিয়ে রাতে বালিশের নীচে রেখে ঘুমালে যাকে চাই তাকে নাকি স্বপ্নে দেখা যাবে। আমায় পায় কে। আমি তো সুচিত্রাকে চাই। কিনে ফেললাম তাবিজ, ৫ টাকার তাবিজ। এ যেন তাবিজ নয়, সুচিত্রাকে কিনে ফেললাম ৫ টাকা দিয়ে।

    আমি সে কি যে খুশি আজ আর বলে বুঝাতে পারবো না। বাসায় ফিরলাম। তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘুমাতে গেলাম। বালিশের নীচে তাবিজ। আজ আর ঘুম যেন কিছুতেই আসে না। একসময় কখন সকাল হয়ে গেছে টেরই পাইনি। তাড়াহুড়ো লেগে যায় ইস্কুলে যাবার।

    পরের দিন একই কান্ড। বালিশের নীচে তাবিজ। আমি স্বপ্নে দেখি মারামারি করে বেড়াচ্ছি কিংবা ইস্কুলে জিন্নাহ স্যারের (আমাদের অংক স্যার ছিলেন, কয়েক বছর আগে জান্নাতবাসি হয়েছেন) হাতে মার খাই ইত্যাদি ইত্যাদি।

    আশাহত হতে থাকলাম। এরপর তাবিজ ওয়ালাকে খুঁজি। আর কি পাই?

    মজার ব্যাপার হলো যে তাবিজটা একসময় ফেলে দিয়েছিলাম ঠিকই কিন্তু কাজ করেছে আমার বিয়ের পর। আমি বিয়ে করেছিলাম ২০+ বয়েসে ১৯৮৮ সালে। খুচরা প্রেম যা এসেছে বিয়ের পরেই। সবাই ছিলো সুচিত্রা সেন।

    আজও আমি সেই ৫ টাকার কথা ভুলিনি। বিরাট লস!

  • আজ আটাশে ফেব্রুয়ারী পপ সম্রাট আজমখাঁন এর জন্মবার্ষিকী

    আজ আটাশে ফেব্রুয়ারী পপ সম্রাট আজমখাঁন এর জন্মবার্ষিকী

    আমার ছেলেবেলা কেটেছে মতিঝিল এজিবী কলোনীর মুক্ত অবারিত পরিবেশে। আমার শৈশবকালে আমাদের আনন্দ অনেক বেশী ছিলো কারন আমার নানুবাসাও ছিলো মতিঝিল এজিবী কলোনীতে, আমার ছয় মামা দুই খালা সবাই আমার বড় ছিলেন শুধু আমার ছোটমামা ও আমি সমবয়সি ছিলাম, আর মাসুদ মামা আমার বড় হলেও আমরা সহপাঠী বন্ধু ছিলাম ছেলেবেলা থেকেই। আমার নানু খুব চেষ্টা করেছিলেন আমি যেনো এই দুইমামাকেও নাম ধরে না ডাকি কিন্তু আমি নাম ধরে ডাকা ও তুই বলা দুটোই করেছি।

    আমাদের বাসার সামনে বিশাল ঈদগাঁও মাঠ সন্ধা হলেই সব উঠতি বয়সের যুবকদের আড্ডা হতো বাসা থেকে দেখতাম, একদম ছেলেবেলার কথা বলছি ।সেই আড্ডা থেকে মাঝে মাঝেই একটা সুরেলা কন্ঠের সুরের যাদু রাতের আঁধার ভেদ করে ভেসে বেড়াতো। আস্তে আস্তে জানলাম তার নাম আজম খান ।তার কন্ঠ ভেসে আসলেই আমি দৌড়ে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়াতাম আর মুগ্ধ হয়ে শুনতাম। মনে হতো কলোনীর বাতাসে ভেসে বেড়াতো সেই মধুর সুরেলা কন্ঠ।

    রেললাইনের ওই বস্তিতে , ওরে সালেকা ওরে মালেকা, বা আলাল ও দুলাল, সেই গান গুলো শুনতাম আর সেই ছোট্ট বয়সেই আমার মনে খুব দাগ কেটেছিলো গানগুলি। তার অনেক দিন পর আমার বিয়ের পর মতিঝিল এজিবী কলোনীতে আম্মার বাসায় গিয়েছি সামিনকে নিয়ে, গিয়ে শুনলাম ঈদগাহ মাঠে অনুষ্ঠান হবে রাতে আজম খান গান করবে, আমি তো শুনে বাপপীকে বললাম আমি থাকবো আম্মার বাসায়, নিজের বাসায় ফিরে যাবো না আজ। তারপর থাকলাম আর বেলকনিতে দাডিয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন আজম খান এর গান শুরু হবে? রাতের আধার ভেদ করে তা ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত কলোনীর আকাশ বাতাশ জুড়ে।

    শহীদ জননী জাহনারা ইমামের “একাত্তের দিনগুলি” বইটি পড়বার সময় পড়েছি মেলা ঘর এর ট্রেনিং এর সময় শহীদ মুক্তিযাদ্ধা রুমীরা অনেক রাতে আজম খান এর গান শুনতে পায় রাতের আধার ভেদ করে “হিমালয় থেকে সুন্দরবন হটাত বাংলাদেশ”! সবাই নিস্তব্ধ হয়ে সেই গান শুনছিলো। আসলেই তাই পপ সম্রাট আজম খান এর কন্ঠটাই ছিলো মুগ্ধ হবার মতো। যা মন মাঝে এক ভালোবাসার সুর বইয়ে দিতো।

    আজ আটাশে ফেব্রুয়ারী পপ সম্রাট আজমখাঁন এর জন্মবার্ষিকী।

    গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি মরণোত্তর একুশে পদকপ্রাপ্ত মুক্তিযাদ্ধা এই পপ সম্রাট আমার প্রিয় শিল্পী আজম খানকে।

  • নাকি অন্য কিছু?

    নাকি অন্য কিছু?

    ১৯৮৩ সাল। সবেমাত্র এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। থাকি সরকারী কোয়ার্টার মিরপুর ১৪ তে ২০ নম্বর বিল্ডিং এ। সুলতানারা থাকে আমাদের পেছনেই ১৭ নম্বর বিল্ডিং এ। মনের অজান্তেই ১৭ সংখ্যাটা আমার প্রিয় হয়ে গেছে। এই বিল্ডিং এর চার ধারে কতো যে চক্কোর কেটেছি! এই ১৭ নিয়ে অন্য কোনো একদিন বলবো। আজ বলি অন্য কথা।

    একটি টিউশনির অফার পেলাম। পড়াতে হবে ১৭ নম্বর বিল্ডিং এর একটা বাসায়। যদিও সুলতানাদের বাসা অন্য সিড়িতে। তবুও ১৭ বলে কথা।

    বিকেল বেলা। পড়াতে গেলাম। বারান্দায় ডাইনিং টেবিলেই পড়াতে শুরু করলাম। দুটো ছেলে – একজন ক্লাস সিক্সে আরেকজন এইটে। অংক পড়াতে হবে।

    পড়াতে পড়াতে হঠাত টেবিলের ওপর একটা বইয়ের দিকে আমার নজর যায়। বইটা হাতে নেই। ছাত্রদের পড়াতে পড়াতে বইটার পাতা উল্টাতে থাকি। কিরোর লেখা হস্তরেখার বই – হাতের রেখা কথা বলে।

    ঘন্টাখানেক পড়ানো শেষ করে বিদেয় দেবার সময় খালাম্মা’কে বললাম – বইটা আমি নেবো। উনি দিতে রাজি হলেন তবে একটা শর্তে। আগামীকাল পড়াতে আসার সময় বইটা ফেরত দিতে হবে আর আমি যেনো তার হাত দেখে দেই। আমি রাজি হয়ে গেলাম।

    বইটা বেশি মোটা ছিলো না। রাতের মধ্যেই পুরোটা পড়ে শেষ করলাম।

    পরের দিন পড়াতে গেলাম। বইটা সাথে নিয়ে গেলাম ফেরত দিতে। টেবিলে বসে অপেক্ষা করছি ছাত্রদের জন্য। কিন্তু খালাম্মাই চেয়ার টেনে নিয়ে আমার সামনে বসলেন। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন – দেখে দাও। আমি ধারনাও করিনি সত্যি সত্যি আমার হাত দেখে দিতে হবে। আমি লজ্জায় বারবার বলতে থাকলাম, এতো অল্প সময়ে আমি তেমন কিছু পড়ে বুঝতে পারিনি। তাকে বললাম, বইটা আজও নিয়ে যাবো। আরো ভালোভাবে পড়ে দেখবো। তারপর চেষ্টা করবো আপনার হাত দেখে দেবার।

    উনি নাছোড় বান্দার মতো বললেন, – হাত দেখে দিতেই হবে। কোথায় পালাই বুঝতে পারছিলাম না। অগত্যা হাত দেখতে লাগলাম।

    ঝরঝর করে বলে যেতে লাগলাম। উনি হা করে আমার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন। কয়েক মিনিট বলার পর থাকলাম। দেখি উনার বিস্ময় যেনো কাটছেই না। অবশেষে বললেন, তুমি এক রাতের মধ্যে বইটা পড়ে এতোকিছু বললে কিভাবে। তুমি তো সব মিলিয়ে দিয়েছো। কিভাবে সম্ভব করলে।

    …সেদিন বেশিক্ষন আর পড়ানো হলো না। ফিরে আসার সময় খালাম্মা আমাকে ডেকে বইটা আবার আমাকে দিয়ে বললেন, বইটা নিয়ে যাও। এটা তোমাকে দিলাম।

    বইটার একেবারে মালিক বলে যাওয়ায় আমার খুশি আর দেখে কে। আমি নতুন উদ্যমে বইটা আবার পড়া শুরু করলাম। বই পড়ি – নিজের হাত দেখি আর মিলাই।

    আমি আর এক বন্ধু মিলে বাংলাবাজারে যাই। পুরোনো বইয়ের ভিড়ে হস্তরেখার বই খুঁজি। পেয়েও গেলাম অনেকগুলো বই। কিনে নিলাম সব। পুরোনো বই তাই বেশি টাকা গুনতে হয়নি।
    বই পড়ি আর হাত দেখে বেড়াই। যখন কথা মিলিয়ে দিতে পারি তখন মনে হয় এইতো শিখে গেছি হাত দেখা, হাতের রেখা দেখে ভাগ্য বলে দেয়া।

    ছাত্রদের পড়ানো শেষে খালাম্মার হাত আমাকে প্রতিদিনই দেখতে হতো এক কাপ চা খেতে খেতে। আমি তার অতীত বলে যাই একের পর এক – উনি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। ফিরে আসবার সময় প্রতিদিন একটাই কথা বলেন, তুমি এসব কথা বলো কিভাবে। আমি মাথা নীচু করে বলি, জানিনা।


    ইতোমধ্যে রেজাল্ট বের হলো। পাশ করলাম। কলেজে ভর্তি হলাম। টিউশনিটা ছেড়ে দিলাম। খালাম্মার হাত দেখার সমাপ্তি ঘটলো। তবে সুযোগ পেলেই কারো না কারো হাত আমি দেখেই চলেছি। এ এক অন্যরকমের নেশা। মানুষের অতীত বলে দেবার নেশা, ভাগ্য বলে দেবার নেশা।


    একসময় কলেজ পাশ করলাম। ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম বর্ষে থাকতেই আমার ভারতে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিলো। এটাই আমার এজীবনের একমাত্র বিদেশ ভ্রমন ছিলো মাত্র সাত দিনের জন্য। ফিরে আসার আগে আমি কোলকাতার বইয়ে দোকানে হস্তরেখার বই খুঁজতে থাকি। পেয়েও যাই অনেক বই। এবার পেয়ে যাই আরেক গুহার সন্ধান। সম্মোহন, হিপনোটিজম এর বই। বাংলা ইংরেজি দু’ধরনের বইই পেলাম। সেগুলোও কিনলাম। দেশে ফিরে এলাম একগাদা বই নিয়ে।

    সেই খালাম্মার সাথে পরে আর কখনো দেখা বা কথা হয়নি। আমিও যাইনি দেখা করতে। এগিয়ে গেছি সামনে। জীবনের পর্বগুলো এভাবেই সব রয়ে যায় পেছনে। আজও মাঝে মাঝে নিজের মনেই শুধু প্রশ্ন জাগে, – সেদিন কি সত্যি সত্যিই খালাম্মার হাতের রেখা কথা বলেছিলো, নাকি অন্য কিছু?

    এবার দেশে ফিরে ভাগ্য বলে দেবার পাশাপাশি শুরু করি সম্মোহন চর্চা। আত্ম-সম্মোহন এবং দুর-সম্মোহন।

    ইন্ডিয়া থেকে আনা হস্তরেখার বইয়ের পাশাপাশি হিপনোটিজমের বই নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা শিখতে হবে। কয়েকদিনেই সব কটা বই পড়া শেষ। এবার অনুশীলনের পালা।

    খুব ভোরে উঠে ঘরের অল্প আলোতে সাদা দেয়ালে একটা ছোট্ট কালো গোল চিহ্ন দিয়ে স্থির হয়ে বসে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা শুরু করে দিলাম। এক মিনিট যেতে না যেতেই চোখ আর খুলে রাখতে পারিনা। পলক পড়েই যায়। ঝরঝর করে চোখে পানি চলে আসে।
    যে কোনোভাবেই চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতেই হবে। প্রথমদিন বিফল হলাম। মনে হলো এটা একটা অসম্ভব কাজ।

    এভাবে করে প্রতিদিন ভোরে অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকলাম। ব্যর্থতা আমার পিছু ছাড়ে না। আধা মিনিট চোখের পলক না ফেলে এক দৃষ্টিতে কোনো স্পটের দিকে তাকিয়ে থাকাও যেনো অসম্ভব বলে মনে হতে লাগলো। সারাদিন কোনো কিছুতেই মন বসে না। ইচ্ছেমতো যেদিকে সেদিকে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করি।

    চেষ্টা আসলেই মানুষকে সফলতা এনে দেয়। ধীরে ধীরে আমার এক দৃষ্টে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকার সময়সীমা বাড়তে থাকলো। দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট, পনের মিনিট, ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত চোখের পলক না ফেলে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকার সফলতা পেলাম। নিজেকে কমান্ড দিতাম যে আমার অনেক ক্ষমতা। আমি চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেকে সত্যিই ক্ষমতাবান মনে হতো। মনে করতে পারতাম আমি অনেক কিছু করে ফেলতে পারবো। সে এক অন্য রকম অনুভুতি।

    এবার অন্যরকম অনুশীলনে মন দিলাম – Far hypnosis অর্থাৎ দূর সম্মোহন। যখন কারো সাথে কথা বলতাম তখন তার চোখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কথা বলতাম আর মনে মনে তাকে নিয়ন্ত্রনের কমান্ড দিতাম। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগেনি কেননা বুঝতে পারতাম না সামনের মানুষটা সত্যিই আমার নিয়ন্ত্রনে কিনা। আরো এক ধরনের দূর নিয়ন্ত্রনের প্রাকটিস করা শুরু করলাম। আমার সামনে হেটে যাওয়া কোনো মানুষকে মনে মনে ডাক দিয়ে বলতাম, এই পেছনে ফিরে তাকাও।

    কাউকেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছিলাম না। মনে মনে ডাকলেও কেউ পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলো না। আমি আমার অধ্যাবশায় চালিয়ে যেতেই থাকলাম। অবশেষে আমি আমার বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর করেই ফেললাম।

    জানিয়ে রাখছি, আমার ২০ বছর বয়েসেই বিয়ে করতে হয়েছিলো। পারিবারিক ভাবেই বিয়ে। বিয়ের গল্প পর্ব অন্য কোনোদিন সময় হলে বলবো। মাত্র ১৬ বছরের ছোট্ট বউ আমার। একদিন দেখি আমার বউটা আক্কেল দাঁতের ব্যথায় অস্থির হয়ে গেছে। সে তার চোয়ালে হালকা স্পর্শ পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। এতোটা ব্যথা! তখন আমার মনে হলো দেখিতো আজ আমার বউটাকে নিয়ন্ত্রনে নিতে পারি কিনা। যেই ভাবনা সেই কাজ। আমার বউকে বললাম, আমি তোমাকে যা যা বলবো তুমি শুধু তা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তাহলে আমি তোমার ব্যাথা সারিয়ে দিতে পারবো। অল্প বয়েসি বউ আমার কথায় বিশ্বাস করলো। আমি ওকে সোফার ওপর শুতে বললাম। ও শুয়ে পরলো। চোখ বন্ধ করতে বললাম। ও চোখ বন্ধ করলো।

    আমি আমার ভেতরের সমস্ত শক্তিকে একসাথ করার প্রচন্ড ইচ্ছেশক্তির প্রয়োগ করলাম। নিজেকে বিশ্বাস করাতে লাগলাম যে আমিই পারবো। মুখে শব্দ করে বলতে থাকলাম –

    এই যে দেখো তোমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। তোমার কিছুই হয়নি। তোমার অনেক ভালো লাগছে। সুন্দর হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এই যে দেখো তোমার দাঁতে এখন কোনোই ব্যাথা নেই। আছে কি? ব্যথা নেই তো! তোমার এখন অনেক ঘুম পাচ্ছে। তুমি এখনি ঘুমোবে। তোমার দাঁতে কোনোই ব্যথা নেই। তোমার এখন শুধু ঘুম আর ঘুম…

    দুই মিনিটের মধ্যেই দেখি বউ আমার গভীর ঘুম। কোনো নড়াচড়া নেই। আমি ইচ্ছে করেই ওর চোয়ালে হাত দিয়ে চাপ দেই। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এরপর ডাকাডাকি শুরু করি। দেখি ঘুম আর ভাঙ্গে না। আমি ঘাবড়ে যাই। মনে মনে ভাবতে থাকলাম, আমি কি ওকে জাগাতে পারবো না! মগ ভরে পানি নিয়ে মুখে পানির ছিটা দিয়ে জোরে জোরে ডাকতে থাকলাম। অবশেষে ঘুম ভাঙ্গে। জানতে চাইলাম, দেখোতো তোমার দাঁতে এখন ব্যাথা আছে কিনা? সে বলে কোনো ব্যথাই নেই।
    এবার আমার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। আমার মনে হতে থাকে, আমি ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারি। আমার অনুশীলন আরো বাড়িয়ে দিলাম। আমি যাকে তাকে পেছন থেকে মনে মনে ডাকা শুরু করলাম, – পেছনে থাকাও। একসময় দেখলাম, যাকেই তাকাতে বলি সেই পেছন ফিরে তাকিয়ে কি যেনো ভাবে আবার আপন মনে চলে যায়।

    ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। আমি যার তার ওপর হিপনোটিজম প্রয়োগ করতে থাকি। এ যেনো এক ভয়ঙ্কর খেলা…

    আমার এ ভয়ঙ্কর অসুস্থ্যতা থেকে আমার নিজেকে নিজেই বের করতে হয়েছিলো। এবার নিজেকে উল্টো সম্মোহনের পালা, – আমার কোনোই ক্ষমতা নেই; আমি একজন অতি সাধারন মানুষ; আমি একজন অতি নগণ্য মানুষ; আমি একজন অতি সাধারন মানুষ; আমার কোনোই ক্ষমতা নেই…

    আমার কোনোই ক্ষমতা নেই…

  • বাতাসা

    বাতাসা

    ডায়েরির পাতা থেকে

    ছোটবেলার বেশিরভাগ সুন্দর, দুরন্ত বা দস্যিপনার সৃতি গুলো সব আমার নানাবাড়ি নিয়ে। যেখানে নির্দ্বিধায় হাস বা মুরগির বাচ্চাগুলোকে পানিতে চুবিয়ে আদর করতে পারতাম! অসাধারণ সুন্দর একটা নানাবাড়ি ছিল আমার।

    আম্মার মুখে শুনেছি, নানার পূর্বপুরুষরা নাকি পারস্য থেকে আসা। উনারা ইসলাম প্রচারের জন্য দেশ বিদেশ ঘুরতেন। অবশেষে যেখানে এসে স্থায়ী হলেন, উনাদের নামানুসারে ঐ জায়গার নাম করণ করা হয় “পাঠানটোলা” কারণ উনারা পাঠান ছিলেন। উনাদের যে লিডার ছিলেন উনি মারা যাওয়ার পর সেখানে একটা মাঝার স্থাপন করা হয়।

    বংশ পরম্পরাভাবে জেনেছি ওটা আমার নানাবাড়িরই মাজার।

    যদিও নানাকে বেশিদিন পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি, কিন্তু যত টুকু মনে আছে নানা উর্দু, পাশতু, ফারসি লিখতে ও পড়তে পারতেন। উনার ঘরে অনেক বই রাখা ছিল। বই খুলে খুলে দেখতাম, কিন্তু বুঝতাম না কিছুই।

    আগেই বলেছি মাজারের কথা, নানার অনেক মুরিদ ছিল। প্রতি বছর শিরনী হতো অনেক বড় মেলার মত আয়োজনে।
    অনেক ভক্তরা ছিল মাঝারের, যারা মান্নত করে অনেক কিছু দিয়ে যেতো। যেমন সন্দেশ, বাতাসা, বিস্কুট, ফুল ফল আবার টাকাও।

    আমার এক চাচাতো মামা ঐ মাঝারের তদারকি করতেন। মামা এতো কিপটা ছিলেন যে আমাদের কখনোই বাতাসা খেতে দিতেন না। আর আমার লোভী মন পরে থাকতো ঐ বাতাসার কাছে।

    মনে মনে সারাক্ষণ ফন্দি করতে থাকতাম কিভাবে ঐ বাতাসা পর্যন্ত পৌঁছানো যায়, আর কি ভাবে এর মালিক হওয়া যায়! এলাকাটাতে হিন্দু সম্প্রদায় বেশি থাকায় মাঝারের বেশির ভাগ ভক্ত ছিলেন হিন্দু। আর ভক্তরা যখন জানতে পারতেন আমরা মাঝারের সাথে related, খুব স্নেহ আর ভক্তি করতেন।

    বয়স তখন ১০/১১, দুপুরের ঘুম চুরি করে মাঝারের সামনে গিয়ে দোয়া করতে থাকতাম “আল্লাহ্ কাউকে পাঠাও অনেক বাতাসা দিয়ে” কারণ মামা এখন ঘুমাচ্ছেন। আমি হতে পারবো সব বাতাসার মালিক।

    মাঝে মাঝে দোয়া কবুলও হয়ে যেতো! যখনই দেখতাম কেউ আসছেন মান্নতের জন্য, পিছনের দরজা দিয়ে এক দৌড়ে চলে যেতাম ভেতরে, আর এমন ভাব দেখাতাম যেনো এই সময়টার জন্য আমিই ইনচার্জ এ আছি।

    ভক্তের হাত থেকে বাতাসা নিয়ে, তাতে সূরা ফাতেহা পড়ে ফু ফু ফু করে দিয়ে আগরবাতি জ্বালিয়ে দিতাম। ভক্তরা মুগ্ধ হয়ে যেতো, “আহা এত ছোট বয়সেও কি দারুন শিক্ষা, হাজার হলেও পীরের বংশধর” যাওয়ার সময় মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে যেতো।

    একবার যদি বাতাসায় হাত লেগে যেত, আগামী কয়েকদিন মাজারের ধারে কাছেও যেতাম না। যদি মামা জেনে যায়, একদম তালা পরে যাবে পিছনের দরজায়! আর এটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না।

    সবার চোখ ফাঁকি দিতে পারলেও আম্মার চোখে একবার পরেই গেলাম। বাতাসা নিয়ে বের হওয়ার সময় দেখি পিছনের দরজায় আম্মা দাড়ানো! একদম জ্বীন ভূত দেখার মত চমকে গেলাম! তার পর আর কি! আমার বেচারা কান আর পিঠের উপর দিয়ে চোট পাট গেলো। মনে পড়লে এখনও ব্যাথা করে।

  • হিপনোটিজম

    হিপনোটিজম

    ইন্ডিয়া থেকে আনা হস্তরেখার বইয়ের পাশাপাশি হিপনোটিজমের বই নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। এবার নিজেকে নিয়ন্ত্রন করা শিখতে হবে। কয়েকদিনেই সব কটা বই পড়া শেষ। এবার অনুশীলনের পালা।

    খুব ভোরে উঠে ঘরের অল্প আলোতে সাদা দেয়ালে একটা ছোট্ট কালো গোল চিহ্ন দিয়ে স্থির হয়ে বসে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা শুরু করে দিলাম। এক মিনিট যেতে না যেতেই চোখ আর খুলে রাখতে পারিনা। পলক পড়েই যায়। ঝরঝর করে চোখে পানি চলে আসে।

    যে কোনোভাবেই চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকতেই হবে। প্রথমদিন বিফল হলাম। মনে হলো এটা একটা অসম্ভব কাজ।

    এভাবে করে প্রতিদিন ভোরে অনুশীলন চালিয়ে যেতে থাকলাম। ব্যর্থতা আমার পিছু ছাড়ে না। আধা মিনিট চোখের পলক না ফেলে এক দৃষ্টিতে কোনো স্পটের দিকে তাকিয়ে থাকাও যেনো অসম্ভব বলে মনে হতে লাগলো। সারাদিন কোনো কিছুতেই মন বসে না। ইচ্ছেমতো যেদিকে সেদিকে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করি।

    চেষ্টা আসলেই মানুষকে সফলতা এনে দেয়। ধীরে ধীরে আমার এক দৃষ্টে চোখের পলক না ফেলে তাকিয়ে থাকার সময়সীমা বাড়তে থাকলো। দুই মিনিট, পাঁচ মিনিট, পনের মিনিট, ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত চোখের পলক না ফেলে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকার সফলতা পেলাম। নিজেকে কমান্ড দিতাম যে আমার অনেক ক্ষমতা। আমি চাইলেই অনেক কিছু করতে পারি, ইত্যাদি ইত্যাদি। নিজেকে সত্যিই ক্ষমতাবান মনে হতো। মনে করতে পারতাম আমি অনেক কিছু করে ফেলতে পারবো। সে এক অন্য রকম অনুভুতি।

    এবার অন্যরকম অনুশীলনে মন দিলাম – Far hypnosis অর্থাৎ দূর সম্মোহন। যখন কারো সাথে কথা বলতাম তখন তার চোখের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে কথা বলতাম আর মনে মনে তাকে নিয়ন্ত্রনের কমান্ড দিতাম। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগেনি কেননা বুঝতে পারতাম না সামনের মানুষটা সত্যিই আমার নিয়ন্ত্রনে কিনা। আরো এক ধরনের দূর নিয়ন্ত্রনের প্রাকটিস করা শুরু করলাম। আমার সামনে হেটে যাওয়া কোনো মানুষকে মনে মনে ডাক দিয়ে বলতাম, এই পেছনে ফিরে তাকাও।

    কাউকেই নিয়ন্ত্রন করতে পারছিলাম না। মনে মনে ডাকলেও কেউ পেছন ফিরে তাকাচ্ছিলো না। আমি আমার অধ্যাবশায় চালিয়ে যেতেই থাকলাম। অবশেষে আমি আমার বিশ্বাসের ভিত্তিপ্রস্তর করেই ফেললাম।

    জানিয়ে রাখছি, আমার ২০ বছর বয়েসেই বিয়ে করতে হয়েছিলো। পারিবারিক ভাবেই বিয়ে। বিয়ের গল্প পর্ব অন্য কোনোদিন সময় হলে বলবো। মাত্র ১৬ বছরের ছোট্ট বউ আমার। একদিন দেখি আমার বউটা আক্কেল দাঁতের ব্যথায় অস্থির হয়ে গেছে। সে তার চোয়ালে হালকা স্পর্শ পর্যন্ত করতে দিচ্ছে না। এতোটা ব্যথা! তখন আমার মনে হলো দেখিতো আজ আমার বউটাকে নিয়ন্ত্রনে নিতে পারি কিনা। যেই ভাবনা সেই কাজ। আমার বউকে বললাম, আমি তোমাকে যা যা বলবো তুমি শুধু তা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবে। তাহলে আমি তোমার ব্যাথা সারিয়ে দিতে পারবো। অল্প বয়েসি বউ আমার কথায় বিশ্বাস করলো। আমি ওকে সোফার ওপর শুতে বললাম। ও শুয়ে পরলো। চোখ বন্ধ করতে বললাম। ও চোখ বন্ধ করলো।

    আমি আমার ভেতরের সমস্ত শক্তিকে একসাথ করার প্রচন্ড ইচ্ছেশক্তির প্রয়োগ করলাম। নিজেকে বিশ্বাস করাতে লাগলাম যে আমিই পারবো। মুখে শব্দ করে বলতে থাকলাম –

    এই যে দেখো তোমার প্রচন্ড ঘুম পাচ্ছে। তোমার কিছুই হয়নি। তোমার অনেক ভালো লাগছে। সুন্দর হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। এই যে দেখো তোমার দাঁতে এখন কোনোই ব্যাথা নেই। আছে কি? ব্যথা নেই তো! তোমার এখন অনেক ঘুম পাচ্ছে। তুমি এখনি ঘুমোবে। তোমার দাঁতে কোনোই ব্যথা নেই। তোমার এখন শুধু ঘুম আর ঘুম…

    দুই মিনিটের মধ্যেই দেখি বউ আমার গভীর ঘুম। কোনো নড়াচড়া নেই। আমি ইচ্ছে করেই ওর চোয়ালে হাত দিয়ে চাপ দেই। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। এরপর ডাকাডাকি শুরু করি। দেখি ঘুম আর ভাঙ্গে না। আমি ঘাবড়ে যাই। মনে মনে ভাবতে থাকলাম, আমি কি ওকে জাগাতে পারবো না! মগ ভরে পানি নিয়ে মুখে পানির ছিটা দিয়ে জোরে জোরে ডাকতে থাকলাম। অবশেষে ঘুম ভাঙ্গে। জানতে চাইলাম, দেখোতো তোমার দাঁতে এখন ব্যাথা আছে কিনা? সে বলে কোনো ব্যথাই নেই।

    এবার আমার নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। আমার মনে হতে থাকে, আমি ইচ্ছে করলে অনেক কিছু করতে পারি। আমার অনুশীলন আরো বাড়িয়ে দিলাম। আমি যাকে তাকে পেছন থেকে মনে মনে ডাকা শুরু করলাম, – পেছনে থাকাও। একসময় দেখলাম, যাকেই তাকাতে বলি সেই পেছন ফিরে তাকিয়ে কি যেনো ভাবে আবার আপন মনে চলে যায়।

    ব্যাপারটা ভয়ঙ্কর রূপ নেয়। আমি যার তার ওপর হিপনোটিজম প্রয়োগ করতে থাকি। এ যেনো এক ভয়ঙ্কর খেলা…

    আমার এ ভয়ঙ্কর অসুস্থ্যতা থেকে আমার নিজেকে নিজেই বের করতে হয়েছিলো। এবার নিজেকে উল্টো সম্মোহনের পালা, – আমার কোনোই ক্ষমতা নেই; আমি একজন অতি সাধারন মানুষ; আমি একজন অতি নগণ্য মানুষ; আমি একজন অতি সাধারন মানুষ; আমার কোনোই ক্ষমতা নেই…

    আমার কোনোই ক্ষমতা নেই…

  • কিরো – হাতের রেখা কথা বলে (শেষ পর্ব-২)

    কিরো – হাতের রেখা কথা বলে (শেষ পর্ব-২)

    …সেদিন বেশিক্ষন আর পড়ানো হলো না। ফিরে আসার সময় খালাম্মা আমাকে ডেকে বইটা আবার আমাকে দিয়ে বললেন, বইটা নিয়ে যাও। এটা তোমাকে দিলাম।

    বইটার একেবারে মালিক বলে যাওয়ায় আমার খুশি আর দেখে কে। আমি নতুন উদ্যমে বইটা আবার পড়া শুরু করলাম। বই পড়ি – নিজের হাত দেখি আর মিলাই।

    আমি আর এক বন্ধু মিলে বাংলাবাজারে যাই। পুরোনো বইয়ের ভিড়ে হস্তরেখার বই খুঁজি। পেয়েও গেলাম অনেকগুলো বই। কিনে নিলাম সব। পুরোনো বই তাই বেশি টাকা গুনতে হয়নি।

    বই পড়ি আর হাত দেখে বেড়াই। যখন কথা মিলিয়ে দিতে পারি তখন মনে হয় এইতো শিখে গেছি হাত দেখা, হাতের রেখা দেখে ভাগ্য বলে দেয়া।

    ছাত্রদের পড়ানো শেষে খালাম্মার হাত আমাকে প্রতিদিনই দেখতে হতো এক কাপ চা খেতে খেতে। আমি তার অতীত বলে যাই একের পর এক – উনি বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। ফিরে আসবার সময় প্রতিদিন একটাই কথা বলেন, তুমি এসব কথা বলো কিভাবে। আমি মাথা নীচু করে বলি, জানিনা।

    ইতোমধ্যে রেজাল্ট বের হলো। পাশ করলাম। কলেজে ভর্তি হলাম। টিউশনিটা ছেড়ে দিলাম। খালাম্মার হাত দেখার সমাপ্তি ঘটলো। তবে সুযোগ পেলেই কারো না কারো হাত আমি দেখেই চলেছি। এ এক অন্যরকমের নেশা। মানুষের অতীত বলে দেবার নেশা, ভাগ্য বলে দেবার নেশা।
    একসময় কলেজ পাশ করলাম। ভর্তি হলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম বর্ষে থাকতেই আমার ভারতে বেড়ানোর সুযোগ হয়েছিলো। এটাই আমার এজীবনের একমাত্র বিদেশ ভ্রমন ছিলো মাত্র সাত দিনের জন্য। ফিরে আসার আগে আমি কোলকাতার বইয়ে দোকানে হস্তরেখার বই খুঁজতে থাকি। পেয়েও যাই অনেক বই। এবার পেয়ে যাই আরেক গুহার সন্ধান। সম্মোহন, হিপনোটিজম এর বই। বাংলা ইংরেজি দু’ধরনের বইই পেলাম। সেগুলোও কিনলাম। দেশে ফিরে এলাম একগাদা বই নিয়ে।

    এবার দেশে ফিরে ভাগ্য বলে দেবার পাশাপাশি শুরু করি সম্মোহন চর্চা। আত্ম-সম্মোহন এবং দুর-সম্মোহন। এ গল্পটা না হয় অন্য কোনো আরেকদিন বলি।

    সেই খালাম্মার সাথে পরে আর কখনো দেখা বা কথা হয়নি। আমিও যাইনি দেখা করতে। এগিয়ে গেছি সামনে। জীবনের পর্বগুলো এভাবেই সব রয়ে যায় পেছনে। আজও মাঝে মাঝে নিজের মনেই শুধু প্রশ্ন জাগে, – সেদিন কি সত্যি সত্যিই খালাম্মার হাতের রেখা কথা বলেছিলো, নাকি অন্য কিছু?

  • কিরো – হাতের রেখা কথা বলে (পর্ব-১)

    কিরো – হাতের রেখা কথা বলে (পর্ব-১)

    ১৯৮৩ সাল। সবেমাত্র এসএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। থাকি সরকারী কোয়ার্টার মিরপুর ১৪ তে ২০ নম্বর বিল্ডিং এ। সুলতানারা থাকে আমাদের পেছনেই ১৭ নম্বর বিল্ডিং এ। মনের অজান্তেই ১৭ সংখ্যাটা আমার প্রিয় হয়ে গেছে। এই বিল্ডিং এর চার ধারে কতো যে চক্কোর কেটেছি! এই ১৭ নিয়ে অন্য কোনো একদিন বলবো। আজ বলি অন্য কথা।

    একটি টিউশনির অফার পেলাম। পড়াতে হবে ১৭ নম্বর বিল্ডিং এর একটা বাসায়। যদিও সুলতানাদের বাসা অন্য সিড়িতে। তবুও ১৭ বলে কথা।

    বিকেল বেলা। পড়াতে গেলাম। বারান্দায় ডাইনিং টেবিলেই পড়াতে শুরু করলাম। দুটো ছেলে – একজন ক্লাস সিক্সে আরেকজন এইটে। অংক পড়াতে হবে।

    পড়াতে পড়াতে হঠাত টেবিলের ওপর একটা বইয়ের দিকে আমার নজর যায়। বইটা হাতে নেই। ছাত্রদের পড়াতে পড়াতে বইটার পাতা উল্টাতে থাকি। কিরোর লেখা হস্তরেখার বই – হাতের রেখা কথা বলে।

    ঘন্টাখানেক পড়ানো শেষ করে বিদেয় দেবার সময় খালাম্মা’কে বললাম – বইটা আমি নেবো। উনি দিতে রাজি হলেন তবে একটা শর্তে। আগামীকাল পড়াতে আসার সময় বইটা ফেরত দিতে হবে আর আমি যেনো তার হাত দেখে দেই। আমি রাজি হয়ে গেলাম।

    বইটা বেশি মোটা ছিলো না। রাতের মধ্যেই পুরোটা পড়ে শেষ করলাম।

    পরের দিন পড়াতে গেলাম। বইটা সাথে নিয়ে গেলাম ফেরত দিতে। টেবিলে বসে অপেক্ষা করছি ছাত্রদের জন্য। কিন্তু খালাম্মাই চেয়ার টেনে নিয়ে আমার সামনে বসলেন। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন – দেখে দাও। আমি ধারনাও করিনি সত্যি সত্যি আমার হাত দেখে দিতে হবে। আমি লজ্জায় বারবার বলতে থাকলাম, এতো অল্প সময়ে আমি তেমন কিছু পড়ে বুঝতে পারিনি। তাকে বললাম, বইটা আজও নিয়ে যাবো। আরো ভালোভাবে পড়ে দেখবো। তারপর চেষ্টা করবো আপনার হাত দেখে দেবার।

    উনি নাছোড় বান্দার মতো বললেন, – হাত দেখে দিতেই হবে। কোথায় পালাই বুঝতে পারছিলাম না। অগত্যা হাত দেখতে লাগলাম।

    ঝরঝর করে বলে যেতে লাগলাম। উনি হা করে আমার দিকে বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন। কয়েক মিনিট বলার পর থাকলাম। দেখি উনার বিস্ময় যেনো কাটছেই না। অবশেষে বললেন, তুমি এক রাতের মধ্যে বইটা পড়ে এতোকিছু বললে কিভাবে। তুমি তো সব মিলিয়ে দিয়েছো। কিভাবে সম্ভব করলে।

    সেদিন বেশিক্ষন আর পড়ানো হলো না। ফিরে আসার সময় খালাম্মা আমাকে ডেকে বইটা আবার আমাকে দিয়ে বললেন, বইটা নিয়ে যাও। এটা তোমাকে দিলাম।

    চলবে…

  • আলহামদুলিল্লাহ, রাখে আল্লাহ মারে কে!

    আলহামদুলিল্লাহ, রাখে আল্লাহ মারে কে!

    এ যাবৎ আমি অনেকবার আমার জীবনে শৈশব থেকে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনা ও দুর্ঘটনার কথা বলেছি।আবার অনেক ঘটনা ভুলে গেছি। হঠাৎ হঠাৎ ই মনে এসে পড়ে। তখন মনে হয় এটা তো লিখিনি!সেরকম ই একটি দুর্ঘটনার কথা তিন চার দিন আগে মনে পড়ে গেল। তাই ভাবলাম এটাও লিখে ফেলি!

    ২০০৬ সাল, ডিসেম্বর মাসের ৬ তারিখ। আমি আমার দুইপুত্র ও মেজ ভাসুরের ছোটো ছেলে জনি কে নিয়ে সুবর্ন ট্রেনে করে ঢাকায় আসছি।তার ঠিক এক সপ্তাহ আগে জনি তার চাচা(আমার হাসবেন্ড) র সাথে চট্টগ্রামে গিয়েছিল বেড়াতে। তখন আমার দুই ছেলের ই বার্ষিক পরীক্ষা চলছিল। পরীক্ষা শেষ হল পাঁচ তারিখ, আমরা ছয় তারিখ রওনা হলাম।

    আমাদের চার টা সিট।টয়লেট এর সাথে দুইটা তার আগে একটা আর বাম পাশে সিংগেল একটা। সিংগেল টায় জনি বসেছে। পাশের ডাবল টায় আমি ছোটো ছেলে কে নিয়ে বসেছি।সামনের সিটে বড়ো ছেলে। আমাদের সিট ঢাকার দিকে পিছন চট্টগ্রামের দিকে মুখ ফেরানো। জনির সামনে না পিছনের সিটে এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক একা বসে আসছিলেন।

    আমার ছোটো ছেলে ছোট্ট বেলা থেকে খুব মিশুক সে ট্রাভেলিং এর সময় ছয় মাস বয়স থেকে কখনো আমার কাছে থাকতো না। যাত্রী ও এটেনডেন্ট দের কাছে চলে যেতো। সেদিন কেন জানি পুরা রাস্তায় সে মোটামুটি চুপচাপ করেই বসেছিল। আমি সাধারণত জানালার পাশেই বসি বাচ্চাদের দেই না। কারণ দুর্ঘটনার ভয়।

    ঐদিন সারারাস্তা আমরা নিরাপদেই আসলাম।আমরা মোহাম্মদপুর কলেজ গেটে বড়ো ননাসের বাড়ি যাব তাই কমলাপুর রেলস্টেশনে নামার জন্য সেখানে যাচ্ছিলাম।এমনিতে আমরা বিমানবন্দর স্টেশনেই নামি।

    বিমানবন্দরে অনেক যাত্রী নেমে যাওয়ায় অনেক সিট খালি হয়ে গেল। তখন সামনের সিটে আমার বড়ো ছেলের পাশে একজন এটেনডেন্ট বসে পড়ে। ট্রেন যখন তেজগাঁও ছেড়ে কমলাপুরে ঢুকবে তখন আমার ছোট ছেলে আমার কাছ থেকে সরে সামনে ঐ ছেলেটির কাছে গিয়ে বসে গল্প করতে শুরু করে দিল। আমি পিছনের সিটে হেলান দিয়ে সোজা হয়ে বসে ছিলাম। হঠাৎ ই কি মনে করে সামনের সিটে মাথা দিয়ে ঝুঁকে গেলাম। আওয়াজের সাথে এক গাদা কাঁচের টুকরো গায়ে মাথায় এসে পড়লো আর বাম পাশে জনির সিটের আগে পিছে সে বৃদ্ধ লোকটা চিৎকার করে উঠলেন। তাকিয়ে দেখি উনার মাথা থেকে ব্লিডিং হচ্ছে।কাঁচের টুকরোর আঘাতে কপাল এর উপরে কেটে গেছে। এটেনডেন্ট তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করতে লাগলো। জনি ঐ ভদ্রলোক কে সাথে থাকা পানি আর ফার্স্ট এইড দিয়ে সেবা করা শুরু করেছে এর মধ্যে ই ট্রেন স্টেশনে ঢুকে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতবিহ্বল হয়ে গেছি।বাচ্চাদের মাথা থেকে কাঁচ পরিস্কার করায় ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। জনি ডেকে বল্লো,” চাচি আপনার পাশের জানালার কাঁচটা দেখেন।”

    তাকিয়ে দেখি বিশাল এক গর্ত!একটা ছুঁড়ে দেয়া ইট বা পাথরের আঘাতে বামপাশের জানালা ভেংগে ডানপাশের জানালাও ভেংগে চলে গেছে। আমি যদি এক দুই মিনিট আগের মতো সোজা হয়ে থাকা অবস্থায় থাকতাম তাহলে আমার মাথা গাছ থেকে পড়া পাকা বেলের মতো চুর্নবিচুর্ন হয়ে থ্যাতলানো গোবর হয়ে যেতো,তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া সন্তানদের ঐ দৃশ্য দেখতে হয়নি।তারা অকালে মাতৃহারা হয়ে যায় নি।

    ট্রেন থেকে নেমে আসার সময় ও ভালো করে দেখে শিউরে উঠলাম! আলহামদুলিল্লাহ, রাখে আল্লাহ মারে কে!