Tag: ধারাবাহিক গল্প

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৮)
    মন অশান্ত। শান্ত হবে কবে? সারাক্ষণ এই এক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় । একা থাকলে বা রাতের নির্জনতায় এই চিন্তা আরো বেয়ারা হয়ে উঠে। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বিয়ের উৎপাত। আম্মা ফোন করলেই এক কথা বলে। আমি রেসপন্স করিনা বলে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে আমি এখনো সেই কিউটির মা জেমিকে নিয়েই পড়ে আছি। বিরক্ত হয়ে একদিন বললো, “কোথাকার কোন মেয়ে, কার বৌ দেখে পাগল হয়েছে। আর ঐ মেয়েই বা কেমন অসভ্য। কি জানি বাপু আমি এসব চিন্তাও করতে পারিনা। এই ছিলো আমার কপালে। বুড়োকালে এগুলোও হজম করতে হচ্ছে”? কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,“শোন্, ঐ মেয়েকে নিয়ে যদি কিছু করিস্ তাহলে আমাদের সাথে তোর আর কোন সম্পর্ক থাকবেনা। মান-ইজ্জত তো সব যেতে বসেছে”। আমি কোন উত্তর দেই না। দেওয়ার মত কিছু নেইও। আম্মা ইদানীং নিজে না করে মলিকে দিয়ে ফোন করায়। মলিও একদিন ধুম্ করে বলে বসলো, “তোমার সেই কিউটির মা’র নম্বর দাও তো”। আমি বিস্ময়ে হতবাক। বললাম, “কেন? কি হয়েছে”?
    — ফোন দেবো। কথা বলবো। প্রয়োজনে বাড়ী বয়ে কথা শুনিয়ে আসবো। মলির ঝাঁঝালো কন্ঠ।
    — হঠাৎ ক্ষ্যাপলি কেন?
    — ডিসগাস্টিং। শুনলেও গা ঘিন্ ঘিন্ করে
    — শুনিস না। আমার উত্তর
    — সেলিম জেনে গেছে।
    — কিভাবে?
    — তোমার সাথে আম্মার ফোন আলাপে। শ্বশুর বাড়ীতে আমার মুখ আর থাকলো না
    — কবে ছিলো? সেলিম যা করেছে উল্টো তাদেরই মুখ থাকার কথা না। তুইও তো কম কাহিনী করে বিয়েটা করিস নি। বলামাত্রই মলি ফোন রেখে দিলো। তার শ্বশুরবাড়ী নিয়ে কিছু বলা যাবে না। সেলিমকে নিয়েও না। জানি বেশ কয়দিন লাগবে এই অবস্থা কাটাতে।

    জেমি সম্মন্ধে আমিও ত্যক্ত। হতাশ। আগের সেই মোহের বিপরীতে ঘৃণা বোধ হচ্ছে আজকাল। বরং শৈলীর প্রজাপতি নৃত্য মাঝেমধ্যে দোলা জাগায়। জানি এটারও ভবিষ্যত নেই। তৌহিদকে খুলে বললাম। হেসে কুটি কুটি হয়ে দম নিয়ে বললো, “তোমার চোখের আর মনের অসুখ হয়েছে। যাকেই দেখো তাকেই ভালো লাগে। এক ধরণের মানসিক বৈকল্যও বলতে পারো। ডাক্তার দেখাও। বলো তো পাত্রী দেখি”। আমি চমকে উঠলাম। সত্যিই তো। মানসিক কিছু সমস্যা নিশ্চয় হচ্ছে। তা না হলে বিবাহিতা জেমি, অসম শৈলী এদেরকে নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করছি কেন? জামান ভাইও দেখালেন ডানা কাটা পরী, মডেল। আজকাল মাথা প্রায়ই ঝিম্ঝিম্ করে। প্রথমে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। পরে চিন্ চিন্ করে। তারপর ক্লান্তি বোধ হয়। খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় বদলীর বিষয়টাও চাপা পড়ে গেছে। দেখতে দেখতে পাহাড়ে দেড় বছরেরও বেশি হয়ে গেলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। আমার জন্য অতি নির্জনতা যেমন দুর্বিষহ তেমনি অতি মুখরতাও অসহ্যকর। আমি মাঝারি গোছের জীবন যাপনে সিদ্ধ। সুন্দরীদের ভালো লাগে কিন্তু তাদের সাহচার্যে ভয়। স্বভাবে ভীতু ও স্বল্পবাক হলেও সাহসী ও উচ্ছ্বল প্রাণ সুন্দরীদের ভালো লাগে। কিন্তু এ কেমন অদ্ভুত বৈপরীত্য! জামান ভাইকে ফোন দিলাম। বললাম, “ভাই, হাঁপিয়ে উঠেছি। আর কতদিন”?
    — বদলী? আপাতত বন্ধ। ম্যানেজমেন্ট ডিসিশন।
    — আমি তাহলে মরেই যাবো
    — পাগলামী করো না। ঐদিন যে মেয়েটাকে দেখিয়েছিলাম সে ব্যাপারে কিছু বললে না তো
    — ভাই, আমি মাফ চাই। আমার মাথা কাজ করছে না। পারলে এখান থেকে আমাকে নিয়ে যান।
    — পাগলামি করো না। মেয়ের বায়োডাটা পাঠাবো?
    — ভাই, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।

    জামান ভাই কি বুঝলেন জানিনা। ফোন রেখে দিলেন। মনে হচ্ছে আরেক দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে পড়ছি। জামান ভাইয়ের সাথে সেই মডেল কন্যাকে নিয়ে আগামীতে হয়ত মন কষাকষি হবে। আমার ঢাকার বদলীও ঝুলে যেতে পারে। আমার ভেতরের মনোরোগ আবার চাগা দিয়ে উঠতে চাচ্ছে। মাথা আর নিতে পারছেনা।

    অসময়ে আম্মার ফোন। বাসায় ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে নোটিশ এসেছে। এবারের রিটার্ন এখনো জমা প্রদান করা হয়নি। ট্যাক্স রিটার্ন হয় আম্মার নামে। আমাদের এক পরিচিত উকিল চাচা আছেন। তিনি প্রতি বছর আম্মার সাথে আলাপ করে রিটার্ন দাখিল করেন। এবার পারিবারিক ঝামেলার কারণে আম্মা খেয়াল করেনি। আর উকিল চাচাও খবর করেন নি। এখন উপায়? উকিল চাচাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা। ফোন লাগাতার বন্ধ। তিনি বসেন শ্যামলীতে। এমন তো কোনোবার হয়না। করোনার মধ্যে অবশ্য তার সাথে যোগাযোগও হয়নি। উনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন তাও জানিনা। ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর সম্মন্ধে সাধারণ ট্যাক্সপেয়িদের দারুণ ভীতি কাজ করে। বেছে বেছে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ফাইল নিয়ে টানাহেঁচড়া করে। অথচ কোটি কোটি টাকা যারা ফাঁকি দেয় তাদের কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। হলেও আন্ডার হ্যান্ড ট্রানজেকশনে দফারফা হয়ে যায়। ছোট মামার স্মরণাপন্ন হওয়া ভিন্ন কোন পথ নাই। মামা সার্কেল কমিশনারকে বিস্তারিত বলে একটা টাইম পিটিশনের ব্যবস্থা করেছেন। স্বস্তি পাওয়া গেল। কিন্তু মাথার উপর ঘন্টা ঝুলেই রইলো।

    বহুদিন পর উকিল সাহেবকে পেয়ে ভালোই লাগলো। তবে সাথে নতুন উপদ্রব যোগ হলো। আলাপের শেষে এসে বললেন, “বাবাজী, আপনার অবস্থা কি”? বললাম, “আলহামদুলিল্লাহ”। তিনি আরো পরিষ্কার করে বললেন, “আপনার রিটার্ন দিয়েছেন তো”? আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “আমার আবার কিসের রিটার্ন”? উকিল সাহেব বেশ রসিক। এখন অবশ্য করোনার খোঁচা খেয়ে অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছেন। বললেন, “চাকরি করলে রিটার্ন দিতে হবে। আর আপনি তো মা শা আল্লাহ ভাল চাকরিই করেন”। বললাম, “অফিস তো সেলারি থেকে ট্যাক্স কেটে রেখেছে”। “খুব ভালো করেছে। এখন সেই কাগজ পত্র দিয়ে আপনার নামে নতুন ফাইল খুলতে হবে”। বুঝলাম কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমারই খেয়াল করা উচিত ছিলো। বললাম, “চাচা, টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি মেইলে কাগজপত্র পাঠাচ্ছি। আপনি ফাইল ওপেন করে রিটার্ন দাখিল করার ব্যবস্থা করেন”। উকিল চাচা টাকার কথা শুনে গদ্ গদ্ হয়ে গেলেন। দেশের মানুষ। আব্বার পরিচিত ছিলো। বিশ্বস্তও।

    মতিঝিলে তৌহিদের অফিস। তাকে নিয়ে রাজউকে যাবো কাজে। ঐ অফিসের কথা শুনলেই আমার আত্মা থেকে থেকে চমকে উঠে। অগনিত লোকের আনাগোনা। কারো কোন উচ্চবাচ্য নেই। কার কি ব্যাথা, কার কত খসলো জানার উপায় নেই। রেফারেন্স নিয়ে কোন কাজে গেছেন তো আপনার পদে পদে বিপদ। এটা নাই, ওটা লাগবে। এভাবে হবেনা। আজ সম্ভব না। কাগজগুলো অস্পষ্ট ফেয়ার কপি দিতে হবে। আর যেই মাত্র দফারফা হয়ে গেল আপনি বুঝবেন সরকারি অফিস কত আন্তরিক। কাজ হচ্ছে ‘ফেল কড়ি ধরো পোয়া’ গতিতে। তৌহিদ পোড় খেতে খেতে এখন সিজনড। সেকশনের পিওন দেখামাত্রই দৌড়ে আসে। ঠান্ডা গরম কি খাবে জিজ্ঞেস করে। তার মাধ্যমেই আমাদের উত্তরা প্লটের রেজিস্ট্রেশন কাজ শুরু হলো। আমাকে সালাম দিয়ে পিওন বললো, “স্যার, নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। সব দায়িত্ব আমার। ফোন দিলে এসে কাগজ নিয়ে যাবেন”। শুনেই সুখ লাগলো। পকেট যতই ফাঁকা হোক। সেই তৌহিদকে নিয়ে লালনের কাছে গেলাম। পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জে তার অফিস। ইনসিওরেন্স কোম্পানীর এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। কাজও ছিলো। আমাদের পুরোনো গাড়ীটার ইনসিওরেন্স রিনিউ করাতে হবে। বরাবর সে-ই করে দেয়। বললো এখন আর লাগবেনা। বিস্মিত হলাম। বললাম, “পুলিশের ছত্রিশ বাহানার এক বাহানা এই ইনসিওরেন্স পেপার। লাগবেনা মানে”? জানলাম, থার্ড পার্টি ইনসিওরেন্সের এখন আর প্রয়োজন নেই। পুলিশও আর দেখতে চাইবেনা। তার অফিসেই লাঞ্চ হলো। কথা প্রসঙ্গে তৌহিদই প্রসঙ্গটা তুললো। লালন থতমত খেয়ে বললো, “লিভ ইট। যে যাবার সে চলে গেছে। বাট কুডন্ট নো হোয়াই”?। লালনের গার্ল ফ্রেন্ড চার বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে হুট করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছে কানাডা প্রবাসী এক জনের সাথে। নিজেকে বাঁচাতে সে কথা ঘুড়িয়ে ফোকাস ফেললো আমার উপর। নাচুনে কাঠি তৌহিদ সরব হয়ে উঠলো। টিপ্পনী কেটে বললো, “উনার দীপিকা পাডুকোন ফেসিনেশন রোগ হয়েছে”। লালন হাসলো। সে হাসিতে তাচ্ছিল্য বা রঙ্গ জাতীয় কিছু বোধ হলো না। যা বুঝলাম তা হলো সবই কপালের লিখন। লালনের ওখান থেকে বের হয়ে তৌহিদ চলে গেলো তার অফিসে। আর আমি উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে থাকলাম।

    হঠাৎই মামার অফিসের কথা মনে হলো। অফিসে গিয়ে দেখলাম মামা নেই। মফস্বল গেছেন। তাই পিওনও আসেনি। ফিরে যাচ্ছিলাম। করিডোরে সেই উচ্ছ্বল প্রিয়দর্শিনী সাবরিনার সাথে দেখা। লাস্যময়ী সাবরিনা দেখামাত্রই ফোঁড়ন কাটলেন,“মামা নেই জেনেও ভাগ্নে অফিসে যে”? তাইতো। পরশু আলাপকালে মামা বলেছিলেন দু’দিন তিনি চিটাগাং থাকবেন অফিসের কাজে। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে গেলো। কোন মন্ত্র বলে কিসের নেশায় কিসের আশায় এলাম বুঝে উঠতে পারলাম না। “স্যরি, ভুলে গেছিলাম। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই ঢু মারতেই এসেছি”। সাবরিনা চোখ ঈষৎ কুঁচকে বললেন, “তাই নাকি? এদিকে প্রায়ই আসেন নাকি? কই এতদিন তো টের পেলাম না”। আমার সেই ডায়ালগের কথা মনে পরে গেলোঃ হে ধরণী, দ্বিধা হও। পরক্ষণেই মনে হলো ধরণী দু’ভাগ হওয়ার চান্স নেই। আমিই বরং পাংচার হয়ে গেছি। সাবরিনাই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে বললেন, “আসেন। আমার রুমে আসেন। এক কাপ চা বা কফি খেয়ে যান। নাকি এখন আর রুচি নেই”? সত্যি আমার রুচি হাওয়া হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বললাম, “পানি খাবো”। সাবরিনা হাসলো,“সিওর”। সাবরিনার রুমটা ছোট কিন্তু পরিপাটি। চেয়ারের পাশে ফাইল কেবিনেটের উপর ক্যাকটাসের বনসাই। টেবিলে ছোট্ট পারিজাত ফুলের শোভা। বললেন এটা তার বাসার ছাদ বাগানের ফুল। পানি খেলাম। গুগলী ফেস করার আগেই কেটে পড়া উত্তম ভেবে উঠতে যাবো তখন ইশারা করে বসতে বললেন “এসেই যখন পড়েছেন তখন আলাপ করি। আপনার সম্মন্ধে জানি”। আমি ঢোক গিললাম। আমার স্বভাবে দু’ধরণের চরিত্রের মিশ্রণ আছে আমি জানি। মনোবিজ্ঞানীরা এদেরকে বলে এম্বিভার্ট। এরা খানিকটা ইন্ট্রোভার্ট আর খানিকটা এক্সট্রোভার্ট টাইপের হয়ে থাকে। পালাবার উপায় খুঁজছি। সাবরিনা নিরবতা ভাঙ্গলো, “কি ভাবছেন”?
    — এখন উঠবো
    — ভয় পাচ্ছেন?
    — উহু
    — পথ ভুল করে যখন এসেই পড়েছেন তখন আলাপ করি। স্যার নেই, তাই হাতে কাজও নেই।
    — আমার অন্য কাজ আছে
    — কি কাজ?
    — জানিনা
    — এই যে বললেন অন্য কাজ আছে
    — বাসায় যাবো
    — যাবেন তো অবশ্যই। আপনাকে কে বেধে রাখছে? তবে একসাথে লাঞ্চ করি আগে
    — জ্বীনা। থ্যাংকস
    — লাঞ্চ করেন না নাকি?
    — করি তো
    — তো এখন করলে দোষ কিসে?

    আমি এক প্রকার ছেলেমানুষী করেই উঠে পড়লাম। উঠতে গিয়ে টেবিলের পায়ায় হোচট খেলাম। সাবরিনা হাসলো। বললো, “একা বাসায় যেতে পারবেন তো”? জানি মজা নিচ্ছে। এখনো ধরণী দু’ভাগ হচ্ছেনা। কোন মতে বেরিয়ে নীচে নেমে এলাম। ভাবছি এই মেয়ে এত প্রিয়দর্শিনী, এত প্রিয়ভাষিণী কেন? পেটে খিদে তবু মন ফুরফুরে। এটা কি মনোরোগের লক্ষ্মণ?

    চলব…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৭)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৭)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৭)
    জামান ভাইয়ের স্বপ্ন সাধ পূরণ হয়েছে। করোনার কারণে সীমিত পরিসরে ওয়েডিং রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে সেনাকুঞ্জে। ভাবীর বড় ভাই মেজর জেনারেল। বিত্ত বৈভবে তারা যে অতি উচ্চে তা আয়োজন দেখেই বুঝা গেলো। জামান ভাইয়ের তরফ থেকে ভালোবাসা একতরফা হলেও ভাবী নিমরাজি ছিলেন বরাবর। তার ভয় ছিলো ফ্যামিলি থেকে মেনে নেবে কিনা? যাহোক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই এই মেল বন্ধন সম্ভব হয়েছে।

    হাজার পাঁচেক টাকা মূল্যমানের প্রাইজ বন্ড তোফা হিসেবে নিয়ে গিয়ে বেওকুফ বনে গেলাম। উপহার গ্রহণের কোন ব্যবস্থাই নেই। জামান ভাইকে বলে ধমক খেলাম। আমাদের জন্য রিজার্ভ টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণত বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি যাই না। যদিও যাই প্রথম ব্যাচেই বসে পড়ি। এতে সুবিধে অনেক। প্রথমতঃ বিয়ের অনুষ্ঠানে সময়মত কেউ গিয়ে পৌছায়না। ঢাকা শহরের যানজট আর মহিলাদের সাজুগুজু ইত্যাদির কারণে সম্ভবও হয়ে উঠেনা। তাই বিয়ে বাড়ীর আমেজ পুরোপুরি জমে উঠেনা। তখন পরিচিতদের সাথে নিরিবিলি পরিবেশে হাই-হ্যালো করা যায়। দ্বিতীয়তঃ প্রথম ব্যাচের খাবার টেবিলে যে পরিচ্ছন্নতা ও খাবারের স্মেল, ফ্রেশনেস আর পরিবেশনার দক্ষতা যেরুপ থাকে পরবর্তী ব্যাচে তা সে পরিমাণে পাওয়া যায় না। তৃতীয়তঃ খাওয়া শেষে পান বা কফি হাতে বাকী পরিচিত অভ্যাগতদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়। চতুর্থতঃ ব্যাচেলরদের জন্য এই দীর্ঘ সময়টা খুব কাজে লাগে। পাত্রী তালাশে। এ যেন পাত্রীর হাট। একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর। তবে বিভ্রান্ত হতে হয় প্রায় এক রকম সাজ আর উচ্চমাত্রার প্লাস্টিক পেইন্ট এর কারুকাজ দেখে। এর মাঝেও রয়েছে হিন্দী সিরিয়ালের প্রভাব। জামান ভাই ঘুরে ঘুরে সব খোঁজ নিচ্ছেন। কানের কাছে এসে বললেন, “খেয়ে দেখা করো”। আমাদের খাবার শেষ হওয়ার আগেই চেয়ারের পিছনে এসে প্রায় সবাই পরবর্তী রাউন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে গেছে। সাউন্ড সিস্টেমে হিন্দী আর বাংলা ব্যান্ডের গান উচ্চগ্রামে বাজছে। বুঝলাম জামান ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণ এখানে অনুপস্থিত। ভাবছি এখনো কি জামান ভাই রাতের খাবারের পর পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গান জারি রাখতে পারবেন? পরক্ষণেই হাসি পেল। কি যা তা ভাবছি।

    এবার বিদায়ের পালা। জামান ভাইয়ের সামনাসামনি হতেই কাঁধে হাত রেখে কোণায় নিয়ে গিয়ে একটি মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, “ভালো করে দেখো। পছন্দ হলে আলাপ করা যাবে। বাবা এয়ার ফোর্সে উপরের লেভেলে আছে। একমাত্র মেয়ে। নর্থ সাউথে বিবিএ পড়ছে”। আমি দেখলাম। বিস্তারিত শুনে আর মেয়েটিকে দেখে আমার রীতিমত অস্বস্তি ও ভয় ধরে গেলো। অস্বস্তি এ কারণে যে আমার মাথায় এখন জেমি ভার্সেস শৈলীর আনফিনিসড ড্রামা চলছে। আর ভয় এ কারণে যে, অতি বিত্তবানদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি। তাদের কন্যাদেরকে তো অতি অবশ্যই। এদের চিন্তা-ভাবনা, আবদার-চাহিদা আর দৌড়াদৌড়ির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারার মত ছেলে আমি না। জামান ভাই হেসে বললেন, “ঘাবড়াও মাত। মেয়ে মডেলিং করে। নাটকেও ঝোঁক আছে”। আমি ঘন ঘন ঢোক গিললাম। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসা মাত্রই আম্মার ফোন, “তাড়াতাড়ি আয়। আমরা মলিকে নিয়ে ল্যাব এইড হাসপাতালে। মাথা ঘুড়ে পড়ে গেছিলো”। বুকে প্রচন্ড একটা শক্ খেলাম। সেলিম আবার কোনো অঘটন ঘটায়নি তো? আম্মা কিছু বললেন না। বললেন, “কিছু টেস্ট দিয়েছে। এখন সেটাই করাচ্ছি”। অজানা আশংকায় মনটা থেকে থেকে খামচাখামচি করছে।

    ল্যাব এইডে আর যাওয়া লাগেনি। সোজা বাসায় গিয়ে শুনি মলি সন্তান সম্ভবা। আম্মা খুশি। সেলিম আরো। আমারও খুব আনন্দ হলো। আমি মামা হতে যাচ্ছি। হঠাৎই আব্বার কথা মনে পড়লো। আব্বা আজ বেঁচে থাকলে কি থেকে কি যে করতেন অনুমানও করা যায় না। ছোট মামা ফোনে খোঁজ নিলেন। শেষে বললেন, “সেলিমের এখন কিছু একটা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তুমি কাল হক্কানী সাহেবের সাথে দেখা করে আমার অফিস হয়ে যেও”। ঠিকই তো। সেলিমের এখন কিছু একটা করা অতি অবশ্যই দরকার। মলির মেন্টাল সাপোর্টের জন্য এটা হবে অনেক উপকারী। সেলিমের জন্য মায়া হলো। হতভাগার এসবে খেয়াল নেই। মলির জন্য কেন জানি কান্নাই পাচ্ছে। বকাবাদ্য করি, রাগারাগি করি যা-ই করি ছোট বোন বলেই করি। ক্ষেপাবার জন্যও করি। হয়ত একটু বেশিই করে ফেলি।

    হক্কানী সাহেবের অফিসে গিয়ে তাঁকে পাইনি। ব্যস্ত মানুষ। বললেন, মঙ্গলবার লাঞ্চের পর যেতে। তাঁর অধস্তন এক ভদ্রলোক সব কিছু বুঝালেন। কফি খাওয়ালেন। আর উপদেশ দিয়ে বললেন, “যিনি এটা করতে চাচ্ছেন বা করবেন তাকে অবশ্যই হার্ড ওয়ার্কিং হতে হবে আর লেগে থাকতে হবে। আর নিজের বিজনেস টেকনিক কাজে লাগাতে হবে”। তার কথা শুনছিলাম আর সেলিমের সাথে মিলিয়ে নিতে গিয়ে হতাশ হচ্ছিলাম। এর কোন গুণই ওর মধ্যে নেই। আছে উচ্চাভিলাস আর তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার উদগ্র বাসনা। টেকনিক বলে কিছু নেই, যা আছে তাও খাটায় না। আবার বেশি বুঝতে গিয়ে লেজে গোবরে করে বাসায় এসে মলির আঁচল ধরে শুয়ে থাকে। আশ্চর্য। পুরুষ মানুষ এমন হয় চিন্তা করতেও কষ্ট হয়।

    হক্কানী সাহেবের অফিস থেকে বেরিয়ে মামার অফিসে গেলাম। মামা নেই। বসতে বলেছেন। পিওন বসিয়ে দিয়ে কফি দিয়ে গেল। খাওয়ার উদ্রেক হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি। বসে বসে উইন্ড স্ক্রীণ দিয়ে ঢাকা শহর দেখছি। গলি পথে একই রাস্তায় ঠেলা চলছে। রিক্সা, লেগুনা, মাইক্রো, পিক আপ, কভার্ড ভ্যান, কুরিয়ারের কার্গো, কার, জীপসহ রকমারি যানবাহন ছুটোছুটি করছে। এর ফাঁক গলে হাজার হাজার মানুষ কিলবিল করছে। ধুলো আর কালো ধোঁয়ায় মানুষগুলোর মুখাবয়বে আলাদা পলেস্তারা পড়েছে যেন। এর সাথে রয়েছে তীব্র হর্ন। ট্রাফিক আছে। তবে জায়গামত না। টংয়ে দাঁড়িয়ে পান-বিড়ি খাচ্ছে আর পাবলিকের সাথে কথা বলছে। ভাবটা এমন যে, অনিয়মই যেখানে স্বাভাবিক সেখানে নিয়মের শাসনে গতি বাধা গ্রস্থ করে কি হবে?

    সাবরিনা মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে এলো। বললো, “স্যরি, স্যার বলে গিয়েছিলেন আপনি আসবেন। পিওনকে বলেও রেখেছি আপনি আসলে যেন খবর দেয়। ভুলে গেছে। স্যরি”। সাবরিনার মুখে ‘স্যরি’ শুনতে অদ্ভুত ভাল লাগলো। হঠাৎই মনে প্রশ্নের উদয় হলো, সাবরিনারা কেন চাকরি করে? এরকম মাথা খারাপ করা সুন্দরীদের কারো অধীনে দেখলে খারাপ লাগে। বস্তুত এরা স্বামীর অধীনেও থাকার মত না। স্বামীরাই চন্দ্রমুখ দর্শনে মোহাবিষ্ট থেকে এদের অনুশাসনে তুষ্ট থাকে। এরা আসলেই নায়িকা হওয়ার মত। সারাক্ষণ মেনকা হয়ে থাকবে। ফ্যান ফলোয়াররা ঘুরঘুর করবে। মিডিয়া এদের নিয়ে সত্য-মিথ্যার মিশাল দিয়ে চটকদার গসিপ বানাবে। পাবলিক সেগুলো গাঁটের পয়সা খরচ করে এমবি কিনে পড়বে, দেখবে। প্রধান সড়কের মোড়ে মোড়ে দ্রষ্টব্য স্থানে তাদের বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড দ্যুতি ছড়াবে। “কফি খাচ্ছেন না যে” সাবরিনার কথায় ভাবালুতা কাটলো। নড়েচড়ে বসলাম। বললাম, “খেতে ইচ্ছে করছে না”।
    — সেদিন না বললেন খাগড়াছড়ি গিয়ে কফি খোর হয়েছেন? সাবরিনার গুগলি।
    — একটু আগেই খেয়েছি। আমার ততোধিক তরল উত্তর।
    — ঢাকায় পোস্টিং হবে না
    — কেন?
    — না, এমনি। সবাই তো ঢাকাতেই থাকতে চায়
    — ইচ্ছে তো হয়। সব ইচ্ছে কি পূরণ হয়?
    — আর কি ইচ্ছে হয়?
    — আছে অনেক কিছুই। কোনটা বলবো? তার চেয়ে আপনার সম্মন্ধে কিছু শুনি। আপনি বলুন।
    — আমার সম্মন্ধে? আমি সেলিব্রেটি নাকি?
    — মোর দেন দ্যাট
    — তাই নাকি? বুয়েটিয়ানরা দেখছি ইট পাথরের বাইরেও দৃষ্টি দেয়। সাবরিনা মুচকি হাসলো। সে হাসিতে দুষ্টুমির চিহ্ন সুস্পষ্ট। বললাম, “থাকেন কোথায়”?
    — কাছেই। সেগুন বাগিচায়।
    — বাসায় আর কে কে আছেন?
    — ফ্যামিলি আছে
    — ফ্যামিলিতে কে কে আছেন?
    — কি মনে হয়?
    — কিছুই মনে হয়না
    — তাহলে জানতে চাচ্ছেন যে?

    এমন সময় মামা এলেন। সাবরিনা সৌজন্যতা শেষে বিদায় হলো। হক্কানী সাহেবের প্রপোজাল নিয়ে আলাপ হলো। বললাম সেলিমের জন্য এটা মোটেই উপযোগী না। মামাও মাথা নাড়লেন। লাঞ্চ করালেন। এরি মধ্যে শৈলীর ফোন। ঘন ঘন বেজে চলেছে। ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছি। শুধু শুধু জটিলতা বাড়াতে চাচ্ছিনা। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’? সাবরিনা কাজের জন্য আবার এলো। মৃদু হাসি বিনিময় হলো। আমার কাজ শেষ। তবু উঠতে ইচ্ছে করছেনা। এই বয়সেই কি গতি জড়তায় পেয়ে বসলো নাকি অন্যকিছু? অফিস থেকে বেরোবার পথে করিডোরে ব্যস্তসমস্ত সাবরিনার সাথে দেখা। হাসি বিনিময়ে বললো, “আবার আসবেন। আপনি খুব ইন্টারেস্টিং”। আমার লিফট এসে গেছে। অভ্যন্তরে প্রবেশ করা ভিন্ন আর কোন পথ খোলা নাই।

    চলবে…

  • ললাট লিখন (পর্ব-২)

    ললাট লিখন (পর্ব-২)

    আরশী বেশ কিছুক্ষণ ছবিটা পর্যবেক্ষণ করলো। ছবি থেকে রঙ গুলো দেওয়াল বেয়ে নেমে আসতে শুরু করেছে। হয়তো অতিরিক্ত রঙের ব‍্যবহারের জন্য এমন হচ্ছে। আরশী ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে ঐতিহ্যের দিকে তাকালো। ছেলেটা সেই আগের মতোই ঘুমে অচেতন। দেওয়ালের ছবিটা যে ওই এঁকেছে এতে কোনো সন্দেহ হচ্ছে না কিন্তু ছেলেটাতো বোবা কথা বলতে পারেনা ওর দ্বারা এতো সুন্দর নিখুঁত কাজ আদো কি সম্ভব? কথাগুলো ভেবে ও হাটতে হাটতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। রুম থেকে মন মাতানো ফুলের সুগন্ধি ভেসে আসছে। নানা রকমের ফুলের সমাহার। ঘরটাকে ঘর না ফুলের দোকান বলে মনে হচ্ছে। এসবের আদো দরকার ছিল বলে ওর মনে হয় না। লোকটা এসবের মানে বুঝলে কথা ছিল। আরশীর এখন আর কান্না পাচ্ছে না। কষ্ট গুলো হৃদয় দিয়ে তেমন করে অনুভব করতে পারছে না। এই বাড়িতে কে কে আছে ওর তার কিছুই জানেনা।

    এখন ভোররাত,কিছুক্ষণের মধ্যেই মসজিদে আজান হবে। কথাটা ভেবে ও আড়মোড়া দিতেই ঘাড়ে তীব্র ব‍্যাথা অনুভব করলো। ও হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল সেখানে সামান্য একটা ছিদ্র আর সেই ছিদ্র দিয়ে হালকা রক্ত বের হচ্ছে। হঠাৎ করেই ওর সেই স্বপ্নের কথা মনে হলো। সত্যিই কি ওটা স্বপ্ন ছিল নাকি বাস্তব? প্রশ্নটা মনে হতেই ওর গা ছমছম করে উঠলো। আরশী আর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তাড়াতাড়ি রুমে আসতে গিয়ে বাধলো বিপত্তি। রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। আরশী কয়েকবার দরজা ধাক্কা দিলো কিন্তু কেউ খুললো না। তবে ভেতর থেকে হাতে ক্লাব দেবার আওয়াজ হচ্ছে। মানে ঐতিহ্য ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মজা নিচ্ছে। আরশীর বিরক্তি লাগলো। হাবাগোবা দেখলে কী হবে পাজির পা ঝাড়া। ও মনে মনে আচ্ছা রকম বকা দিলো। তবুও মনকে শান্ত রেখে দরজায় হাত রেখে বলল,

    শুনছেন,দরজা খোঁলেন আমি ভেতরে আসবো।
    আরশীর আওয়াজ প্রতিধ্বনি করে ফিরে আসলো কিন্তু কোনো উত্তর আসলো না। বরং লাইট বন্ধ করে নীরব হয়ে গেলো। আরশী বিরক্তি নিয়ে বলল,
    এদের দ্বারা এসবই সম্ভব। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় দেই।

    আরশী ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে দরজার পাশে হেলান দিয়ে বসে থাকলো। কপাল চাপড়াতে মন চাইছে। ইচ্ছে করছে কপালে কেটে দেখতে সেখানে সুখের বিন্দু বিসর্গ আছে কিনা। বাকীরাতটুকু ও জেগেই কাটিয়ে দিলো। অনেক ঘুমিয়েছে এখন আর ঘুম আসবে না। লোকটা বোকা কিন্তু ভীষণ রকমের ফাজিল। এগুলোকে সকাল বিকাল নিয়ম করে থাপ্পড় দিলে সোজা হয়। আদর পেয়ে মাথায় উঠে বসে আছে। আরশী বিড়বিড় করে কথাগুলো বলল। ও কিছুইতেই নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। ওর সহজে রাগ হয়না আবার একবার হলে থামাতে চাইনা। কিন্তু এখানে রাগ করেই বা কি হবে। কথায় বলে শশুর বাড়ি না জমের বাড়ি। দাঁতে দাঁত চেপে সহ‍্য করতে হবে। ওর ভাবতে ভাবতেই দুর থেকে ফজরের আজানের সুর ভেসে আসলো। দূরে গেটের সামনে কুকুর ডাকছে। আরশী সেখানেই ঠাই বসে আছে। নামাজ পড়তে হবে কিন্তু ভেতরে যাবে কিভাবে? আজান শেষে চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে আসলো। আরশী এবার পাশ ফিরে দরজায় হাত রাখলো আর ওমনি দরজা খুলে গেলো। ওর আর অপেক্ষা করলো না তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখলো ঐতিহ্য সেখানে নেই। লোকটা গেলো কোথায় ভেবে ও বাথরুম চেক করলো কিন্তু সেখানেও কেউ নেই। ও লাইট জ্বালিয়ে নিয়ে ঘরটাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকলো। ঘরে আসবাবপত্র বলতে সোফা, একটা খাট,ড্রেসিং টেবিল আর ছোট একটা আলমারি আছে। ও দেখতে দেখতে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো কারণ সেখানে কোনো ছবি নেই। শূন্য নীল দেওয়ালটা ঝকঝক করছে। আরশীর চোখ কপালে উঠে গেলো। তাহলে কি তখন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছিল? জীবন্ত স্বপ্ন নাকি বাস্তব? ও এসব ভাবতে ভাবতে নামাজ শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আসলো। আরশী একপা দুপা করে নিচে নেমে আসলো। নীল রঙের ড্রিম লাইট জ্বলছে। বিশাল বড় ডাইনিং রুমটা কেমন মরুভুমির মতো ধু ধু করছে টেবিল ছাড়া কোনো আসবাবপত্র নেই। বড়লোক বাড়ির ডাইনিং রুম সাধারণ এমন হয়না। চারদিকে দামি দামি আসবাবপত্র থাকবে লাইন করে সোফা থাকবে কিন্তু এখানে কিছুই নেই। আরশীর কৌতূহল বেড়েই চলেছে। ও সাবধানে পা টিপে টিপে মাঝামাঝি আসতেই রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসলো,

    বউমা এদিকে আসো।

    রাত্রী আলো আধারের মধ্যে হঠাৎ আওয়াজ শুনে চমকে উঠে পা পিছলে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। রান্নাঘরে অন্ধকারের মধ্যে মোমবাতি জ্বালিয়ে ওর শাশুড়ি কিছু একটা তৈরী করছে। আরশী পাশে গিয়ে জিঞ্জাসা করলো,

    আম্মা এতো ভোর সকালে আপনি রান্না করছেন?
    ঐতিহ্যের ক্ষুধা পাইছে। কাল বিকালে খেয়েছিল আর খাওয়া হয়নি।। মারে আমার ছেলেটার বুদ্ধি খুবই কম কখন কি করে ঠিক পাইনা।রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে এখন জেগে উঠেই খাইতে চাইছে। তোমাকে ঘরে পাঠিয়ে ওকে কতবার বলেছি তোমার সঙ্গে ঘুমাতে কিন্তু ছেলেটা কিছুতেই রাজি হলো না। তোমাকে একা থাকতে হলো কিছু মনে করোনা মা। তুমি দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমারও তো সখ করে নাতি নাতনির মুখ দেখে কবরে যায়। বংশের বাতি জ্বলুক। আমার জন্য তোমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো।

    শাশুড়ির গলা থেকে আক্ষেপ ঝরে জরে পড়ছে কিন্তু একটা কথা আরশীর কানের মধ্যে ঝনঝন করে বেজে উঠলো। গতকাল রাতে ঐতিহ্য ওর ঘরেই ছিল ও নিজের চোখে দেখেছে এবং বেলকনির ঘটনাটা চোখের সামনে এখনো ভাসছে তাহলে উনি বললেন কেনো ঐতিহ্য ওর ঘরে আসেনি? আরশী ভাবলো ওর শোনায় ভুল ছিল তাই দ্বিতীয়বার আবারও জিঞ্জাসা করলো,

    আম্মা উনি আমার ঘরে আসলেন না কেনো?
    আসলে তুমি নতুন তো তাই ও তোমাকে ভয় পাচ্ছে। তুমি ভেবো না দিনদিন পরিচিত হয়ে যাবে তখন দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
    না আম্মা সমস্যা হয়নি। আম্মা আমি কি আপনাকে সাহায্য করবো? আর আপনি লাইট থাকতে এমন অন্ধকারের মোমবাতি জ্বালিয়ে রান্না করছেন কেনো?
    ছেলেটা আলো খুব একটা পছন্দ করে না।
    উনি এখন কোথায়?
    আমার ঘরে। তুমি নিজের রুমে যাও আমি রান্না শেষ করে যাচ্ছি।
    আরশী কথা বলে নিজের রুমে দিকে পা বাড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই পাশের রুম থেকে আওয়াজ আসলো। আরশী সেদিন এগিয়ে গিয়ে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলো ওর শশুর মশাই ঐতিহ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ছেলটা ঘুমের মধ্যেই শব্দ করছে। ওখানে দাঁড়িয়ে ও আর সময় নষ্ট করলো না। মাথাটা কেমন ঘুরছে। গতকাল রাতের বিষয়গুলো মাথার মধ্যে কেমন ঘুরপাক খাচ্ছে। আরশী নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ভেতরে আসতে আসতে খেয়াল করলো বেলকনির দরজা খোঁলা। খোলা দরজা দিয়ে বাতাস এসে পর্দা উড়ছে আর সেখানে একজন ছেলের ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। আরশীর শরীর বেঁয়ে ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেলে। ওর মনে প্রশ্ন জাগলো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কে?

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৪৩)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৪৩)

    আজ এক সপ্তাহ হয়ে গিয়েছে, কিন্তু ছেলে পক্ষ থেকে কোন খবর আসেনি, রাহেলা বেগম প্রতিদিন রুমির ফোনের অপেক্ষায় থাকেন, হয়তো ভালো কোন খবর আসবে।

    কলি বার বার বলছে মা, বাদ দাও তো! শুধু শুধু অপেক্ষা কর না, অসহ্য লাগে। আমি আর নাহিদ কলি আপার বাসায় বেড়িয়ে আসি।

    নাহিদ বললো আমি তোকে দিয়ে আসবো কিন্তু থাকতে পারবো না, কারণ স্টুডেন্টদের পরীক্ষা পরে, আবার নানান ধরনের ঝামেলা হবে।
    – খালার বাসায় যাবি?
    – না, আমার ভালো লাগেনা।
    – ওখানে লুবাবা আছে চল।
    – তুই যা। আমি যাবো না। চট্টগ্রাম গেলে চল, কাল শুক্রবার আছে, টিকেট কাটি।

    ওমা! আমি যাই?
    – মেয়েদের এতো অস্থিরতা ভালো নয়। আর ওদের টুনাটুনির সংসার, তুই গিয়ে কি করবি?
    – মা, আমাদের কি শখ নেই, কোথাও যেতে গেলেই অযুহাত। নানুর বাড়ী পর্যন্ত যেতে পারিনা।
    – যা, আমার কাছে টাকা নাই।
    – ছিল কবে?

    এই কলিপা আমি নিয়ে যাবো, কয় দিন থাকবি, ব্যাগ গুছিয়ে নে। ট্রেনের শোভন চেয়ার কিন্তু।
    – হবে, হবে। এক্ষুনি তোকে ঠান্ডা শরবত দিচ্ছি।
    – আমি ঘুষ নেই না! যা, ব্যাগ গুছিয়ে নে।

    রাহেলা বেগমের এক চিন্তা কলি, মেয়েদের বিয়ে হলেই চিন্তার ইতি। ছেলেরা তাদের মতো করে, পছন্দ করে, বিয়ে করে নিবে। কিন্তু মেয়েদের কে, সুপাত্রের কাছে দিতে না পারলে অশান্তির শেষ নেই।

    সাঈদ জিহান কে নিয়ে রাতের বেলা এসেছে, হাতে দুই হালি ডিম। ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসেছে সাঈদ।

    কলির বড় ব্যাগ দেখে বললেন কি রে কোথায় যাস?
    – পলিপার বাসায়!
    – পলিপার বাসায় যেতে পারিস আর ভাইয়ের বাসায় যেতে পারিস না! এখন তো ভাই ছাড়া থাকার জায়গা হয়েছে কিনা!

    কলি চুপ করে শুনছে সব কথা, কোন উত্তর দিচ্ছেনা।

    সাঈদ, রাহেলা বেগম কে বললো, পলি আমার বাসায় থাকলো, বিয়ে পর্যন্ত দিয়ে দিলাম। অথচ একটা দিন ফোন দিয়ে বললো না, ভাইজান চট্টগ্রাম আসেন, বেড়িয়ে যান!
    – ফোন নাই বাবা ওর।
    – বলার মন নাই, সেটা বল। জাহান আমাকে এজন্য খোঁটা দে, যে এরা কেউ কখনো তোমাকে ভালবেসে কিছু করেনা।
    – তুমি গেলে কত্ত খুশি হবে, যাও ঘুরে এসো।
    — আমি কি নাহিদের মতো চাইলেই যেতে পারি? কত টাকা পয়সার ব্যাপার। জাহানের কত্ত দিনের শখ কক্সবাজার যাবে, তাই যেতে পারিনি!
    – এখন ঘুরে এসো।
    – না! আমি যাই, আর কলি বড় হয়েছে, যেখানে-সেখানে থাকতে দিওনা, এমনি ভালো প্রপুজাল আসেনা। বয়স তো শুধু বাড়ছে!

    কলি সাথে সাথে গাল ফুলিয়ে বলছে মা, আমি কি খুব বোঝা হয়ে গিয়েছি? আমি কি কোন খারাপ কাজ করছি? নাকি অন্যায় করছি? কেন আমাকে ভাইজান এসব কথা বলেন।
    – রসুনের চামড়া গায়ে কেন? ভাই কিছু বললে এমন করে উঠিস কেন? তোর আব্বা থাকলে জীবনেও তোকে এভাবে যেতে দিত না! যাই হউক এখন নিয়ত করেছিস, যা ঘুরে আয়। আর, মেয়েদের চামড়া গন্ডারের মতো মোটা হতে হয়, মনে রাখিস।

    কলির আজ খুব আনন্দ হচ্ছে, যাক এই প্রথম বেড়ানোর জন্য কোথাও যাওয়া হচ্ছে। নাহিদ ট্রেনে ঘুরাঘুরি করছে, শান্তি নেই। এরকম একা একা ভয় লাগে, ট্রেনে। অথচ ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে ঘন্টা খানেক হবে, তার খোঁজ নেই। রাতের ট্রেনের সব মানুষকেই যেন ডাকাত লাগে!

    হাতে একটি প্লেট নিয়ে নাহিদ ফিরে এলো।
    – কি রে তুই? একা রেখে হাওয়া হয়ে গিয়েছিস?
    – খা! নাশতা রেডি হতে দেরী হয়েছে।
    – মাত্র ভাত খেয়ে আসলাম।
    – ভাইরে, পরে খাবি রাখ!

    কলি আস্তে করে টিস্যু উঠিয়ে দেখলো, একটা স্যান্ডুইচ, একটা কাটলেট আর একটা চিকেন ফ্রাই।

    কি রে নাহিদ এতো কিছু কিনেছিস কেন?
    – প্রথমবার চট্টগ্রাম যাচ্ছিস, ভালো করে খেয়ে দেয়ে যা!
    – টাকা নষ্ট করলি কেন?
    – এই হচ্ছে মেয়েদের এক সমস্যা! যদি কিছু কিনে না দাও কিপটা আর দিলে, টাকা নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
    – প্রেম করছিস? অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে।

    নাহিদ লজ্জা পেয়ে বলছে, তুই একটু বেশি বুঝিস!
    – রাতে কার সাথে গুন গুন করি।
    – কারো সাথে না, তবে একজন আমার কানে গুনগুন করে।
    – কে?
    – মশা। এখন তুই নাশতা খা!

    কলি দেখছে, তার ছোট্ট ভাইটা কত্ত বড় হয়ে গিয়েছে। এই সামান্য নাশতাই যে তার কাছে কত্ত দামী! এত যত্ন করে এনেছে, তাই অনেক ভালো লাগছে। জলিপা নিশ্চয়ই সুন্দর করে নিজের মতো করে সব গুছিয়ে সংসার করছে! কত জায়গায় ঘুরবে, সব কিছুর লিস্ট মনে মনে ঠিক করছে কলি!

    ভোর সাতটায় গিয়ে দরজায় কড়া নাড়তেই আবিদ বেড়িয়ে এলো! আহা! শালিকা অপেক্ষা করছি তো!
    – আপাকে বলেন নি তো আবার?
    – না, না। তোমার আপা রান্নাঘরে যাও। শালাবাবু বসো।

    কলি পিছন থেকে বোন কে জড়িয়ে ধরতে বেশ অবাক হয়েছে পলি। আরে! কলি? তুই? কিভাবে!

    হাতে খুন্তি ছিল পলির, তরকারি রান্না করছিল সে, বরের টিফিন দিবে। বোন কে দেখে, হাত না ধুয়েই জড়িয়ে ধরেছে।

    কলি সকালের নাশতা করে, বোনের সাথে কুটকুট করে গল্প করছে। নাহিদ দুলাভাইয়ের সাথে বেড়িয়ে গিয়েছে, সে নাকি একা একা ঘুরবে।

    পলি বলছে তুই তোর দুলাভাইকে, আমাকে বলতে নিষেধ করেছিস?
    – হ্যা, কাল দুলাভাইয়ের স্কুলে ফোন দিয়ে, ঠিকানা নিয়ে বললাম তোকে এসে সারপ্রাইজে দিব।
    – এজন্য কি নাশতা করলি, আগে জানলে রান্না করে রাখতাম!
    – তোর সাথে গল্প করছি কত্ত দিন পর! নাশতা লাগবেনা আর! এতো ছোট্ট ঘর নিয়েছিস কেন আপা?
    – বড় ঘর দিয়ে কি করবো? দুজন মানুষ। আর ওর যা ইনকাম তাতে এই ঘর আসবাবপত্র দিয়ে সাজাতে অনেক সময় লাগবে!
    – তুই কোন ফার্ণিচার আনিস নি?
    – না,আর এগুলো শ্বশুরের জিনিস৷ আমি এনে কি করবো!
    – মা তোকে এক সেট ফার্নিচার দিলেই ভালো হতো! একই টাকার গহনা তো দিলেন।
    – হবে, আস্তে আস্তে।
    – তোকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম।
    – থাপ্পড় দিব নাকি? বেশি কথা বলিস কেন!

    দুই দিন থাকার পর, কলি বুঝলো আপার সংসার খুব টেনেটুনেই চলছে। এই শহরে দুই জন মানুষের থাকাই অনেক কষ্ট, তাদের জন্য । আবিদের সামান্য বেতন আর দুই/তিন টি টিউশনি। তাতে চলছে একমতো! বয়স্ক মানুষের অভিজ্ঞতা বেশি, মা না করেছিলেন শোনা উচিত ছিল, হয়তো আপার কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নাহিদ ও রাতের ট্রেনে চলে গেল, নয়তো পরের দিন ফিরতো সে।

    জাহিদ আজ ঢাকায় এসেছেন। হাত ভর্তি বাজার।

    রাহেলা বেগম বলছেন, কি রে এতো বাজার নিয়ে এসেছিস কেন?
    – খাবো। এজন্য।
    – কলি কবে গেল?
    – সপ্তাহ খানেক হয়েছে।
    – আমাকে বললে নাতো!
    – আসবি জানি, এজন্য বলা হয়নি। মন ও ভালো নেই। এতো ভালো স্বমন্ধ আমার একটু ভুলের জন্য হয়তো হয়নি।
    – আফসোস কর কেন? যা হয়েছে, ভালো হয়েছে। চিন্তা কর না।

    কলির এই বাসায় দমবন্ধ লাগে। এতো চটপটে পলিপা সারাদিম এই ঘরে একা একা কেমনে থাকে! এই এক সপ্তাহে দুলাভাই একদিন আইসক্রিম খাওয়াতে নিয়ে যায়নি। সে তার গতিতে স্কুল – টিউশনি করে ঘরে ফিরছে। কলির একদম আর ভালো লাগছেনা! কেন যে এখানে এলো, কে জানে!

    সন্ধ্যায় রুমি ফোন দিয়েছেন, রাহেলা বেগম কে বলছেন, আপা আগামী শুক্রবারে কলিকে নিয়ে রেডি থাকবা আমি আসছি, এবার ঘরে থেকো।
    – আলহামদুলিল্লাহ! উনারা রাজী হয়েছেন?
    – তুমি দোয়া কর আপা, আল্লাহর ইচ্ছা থাকলে হবে। এখন রাখি, একটু বের হবো।
    – আচ্ছা।

    রাহেলা বেগমের এতো শান্তি লাগছে খবর শুনে! আল্লাহ মেয়েটাকে ভালো পাত্রের হাতে তুলে দাও। ঘরে দৌড়ে এসে, রাহেলা বলছেন বাবা জাহিদ তুমি ভালো সময় এসেছো। আজ রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম যাও, কলিকে নিয়ে এসো। জামাইপক্ষ শুক্রবার আসছে, রুমি ফোন দিয়েছে।
    – বাহ, সুসংবাদ। আজই যাবো? এখনো শুক্রবার দেরী আছে।
    -আমি আর দ্বিতীয় বার ভুল করতে চাইনা। তুমি তাড়াতাড়ি মেয়ে ঘরে নিয়ে এসো।
    –আচ্ছা।

    আল্লাহ আমার আজ কি শান্তি লাগছে, আমি এক্ষুনি শোকরানা নামায আদায় করে আসি, আল্লাহ যেন আমার মেয়েকে চিরসুখী করেন…

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৬)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৬)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৬)
    জেমির আর কোন খবর পাওয়া যায়না। ইলমাও ফোন ধরেনা। নিরর্থক জেনেও ওদের বাসার সামনে দিয়ে ঘোরাঘুরি করি। নিজের কাছেই ব্যাপারটা অশোভন ঠেকে। বাসার সিকিউরিটি গার্ডের সাথে দেখা হয়। কথাও হয়। কিন্তু আসল কথা জানা যায়না। শুধু এটুকু জেনেছি জেমি অসুস্থ। হাসবেন্ড বিদেশ থেকে এসেছে। বিদেশে নিয়ে যাবে। তথ্য হিসেবে সিকিউরিটি গার্ডের কাছ থেকে এর চেয়ে অতিরিক্ত কি আশা করা যায়? এরিমধ্যে একদিন ইলমার সাথে তাদের বাসার গলিতে দেখা। দেখেই বললো, “আপনি এদিকে যে”? “এক আত্মীয়ের বাসায় এসেছিলাম” ঝটপট বানিয়ে বললাম। ইলমা সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে থেকে বললো, “আপুর সাথে দেখা করতে চাচ্ছেন”? বললাম “না, তা কেন হবে”? “লাভ নেই” বলেই হাঁটা দিলো। আমি নিশ্চিত এ নিয়ে বাসায় আলোচনা হবে, অশান্তি বাড়বে। জেমি বিব্রত হবে। এমনকি আমার উপর বিরক্তও হতে পারে। বুঝতে পারলাম এদিকে আর ঘোরাঘুরি করা যাবেনা।

    ছোট মামা অফিসে ডেকে পাঠিয়েছেন। আম্মাও তাগিদ দিচ্ছে যেতে। কি কাজ জানিনা। গেলাম তার সেগুন বাগিচা অফিসে। খুশি হলেন। মামীকে নিয়ে খাগড়াছড়ি যাবেন বললেন। চা খেতে খেতে অফিসের টুকটাক কাজও সারলেন। সাবরীনাকে বেশ কয়েকবার ডাকলেন। সাবরিনা তার জুনিয়র সহকর্মী। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, “আমার ভাগ্নে। বুয়েটিয়ান। ইউ এন ডিপিতে কাজ করে। খাগড়াছড়ি পোস্টেড”। কেমন করে যেন তাকালো। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে পরিচিত। সবাই জানে। হয়ত সে কারণেই। বসের কল পেয়ে সাবরিনাকে বসিয়ে রেখে মামা চলে গেলেন। আলাপের ক্ষেত্র খুঁজে পাচ্ছিনা। কিছুক্ষণ এভাবে চুপচাপ থাকলাম।

    সাবরিনাই জড়তা কাটালো, “চা বা কফি”? বললাম, “নো, থ্যাংকস। মামার সাথে খেয়েছি”।
    — চা, কফি কি মেপে মেপে খান? সাবরিনার প্রশ্ন।
    — না, না। আমি চা খোর। খাগড়াছড়ি গিয়ে হয়েছি কফি খোর।
    — তাহলে না করছেন কেন? এই বলে সে দু’কাপ কফির অর্ডার দিলো।

    সাবরিনা বেশ সুন্দরী। সরকারি অফিসে সাধারণত এরকম নায়িকা টাইপ সুন্দরী দেখা যায় না। থাকলেও হুট করে বিয়ে হয়ে যায়। অথবা বিয়ে করেই চাকরিতে ঢোকে। আমার সমস্যা হলো সুন্দরী মেয়েদের সাথে কথা জমাতে পারিনা। মনে হয় কখন দেমাগের হেড লাইট জ্বালিয়ে দেবে। আমার আত্মসম্মানে লাগবে। তাছাড়া সুন্দরীদের সম্মন্ধে আমার কিছু নেগেটিভ সেন্স কাজ করে। এরা দেমাগী হয়। উচ্চাভিলাষী হয়। সবাইকে ইগনোর করে। প্রশংসা পাবার জন্য মুখিয়ে থাকে। সবাইকে মনে করে তাদের এডমায়ারার। মামা ফিরে এলেন। সাবরিনা বিদায় নিয়ে চলে গেল। আমার হাতে একটা ব্রোসিয়ার আর একটা ভিজিটিং কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন হক্কানী সাহেবের সাথে দেখা করতে। সেলিমের জন্য নতুন বিজনেস প্রপোজাল আছে।

    পৃথিবী জুড়ে এক অদ্ভুত অসুখ এসেছে। সামান্য হাঁচি-কাশি দেওয়াও এখন ভয়ের, লজ্জার। সাধ্যমত চেপে রাখতে হয়। আগে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে সর্দি, কাশি, জ্বর, গলা ব্যাথা, নাক বন্ধ, নাকে গন্ধ না পাওয়া, জিহ্বায় স্বাদহীনতা ছিলো স্বাভাবিক। সবাই ধরে নিত সাত দিন ভুগতে হবে। বেশি বেশি লংকা, পেঁয়াজ, আদা, গরম চা, গরগরা, জাম্বুরা ইত্যাদিতেই পরিত্রাণ মিলত। তীব্রতা বেশি হলে বা সহ্য ক্ষমতা কম হলে যারা ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হত তাদের দেওয়া হত এন্টিবায়োটিক। এক সপ্তাহের ডোজ। আর এখন? কাশি যথাসাধ্য কন্ট্রোল করে রাখতে হয়, জ্বর গোপন রাখতে হয়, গা ব্যাথা, গলা ব্যাথা, নাকে ঘ্রাণ না থাকা ও স্বাদ বুঝতে না পারা রীতিমত চেপে যেতে হয়। চেপে চুপে আর কতক্ষণ থাকা যায়? এর কোনটির লক্ষ্মণ ধরা পরা মাত্র আপনি কট। অফিস থেকে ফরমান নাজিল হবে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’। অথবা সিক লিভ নিতে বলা হবে। অনিচ্ছাসত্ত্বেও কেউ কেউ নেয় আবার কেউ এটাকেই ফাঁকিবাজির হাতিয়ার বানায়। ঢাকা থেকে ফিরেই আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে আমার জোড়া টনসিল আক্রান্ত হয়েছে, সে কারণে গা ম্যাজ ম্যাজ করছে। সনাতনী পদ্ধতিতে যেই মাত্র গরম পানিতে গার্গেল করেছি অমনি রুমমেটরা ঘোষণা দিয়ে বসলো নির্ঘাত করোনা হয়েছে। তাদের সবার এক কথা “আইসোলেশন ইজ মাস্ট। বাট নট হিয়ার। এনি আদার প্লেস এলস হোয়ার”। সেকারণে, বলা চলে তাদেরকে আশংকামুক্ত রাখতে আর অফিসের আদেশ পালনে বাধ্য হয়ে আবার ঢাকায় ব্যাক করি। টেস্ট করানো হলো। রিপোর্ট নেগেটিভ। ডাক্তার দেখানো হলো। মুখে স্টেনলেস স্টিলের চামচাকৃতির দন্ড দিয়ে জিহ্বাকে চেপে ধরে আরেক হাতে টর্চের আলোর ফোকাস ফেলে ডাক্তার চোখ বড় বড় করে বললেন, “টু বিগ, লাইক গলফ বল”। ওষুধ দিলেন। বললেন, ওষুধে কাজ না হলে টনসিল অপসারণ ফর‍য হয়ে পড়বে।

    যাহোক, ওষুধেই সব কিছু নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে। আমি কোয়ারেন্টাইন পক্ষ পালন করার পর খাগড়াছড়ি ফিরেছি। জেমির কোন খবর নেই। জেমি এখন একটুকরো স্মৃতি কথা ভিন্ন অন্য কিছু না। শৈলী নতুন ক্লাসমেট পেয়ে ‘ফার্স্ট ইয়ার ডোন্ট কেয়ার’ ম্যুডে আছে। এ কয়দিন আমিও ফোন দেই নি। সেও না। পৃথিবীর সব কিছু একই নিয়মে চলতে থাকবে আশা করা বোকামী। বুঝতে পারছি শৈলীর এখন বসন্তকাল চলছে। চারিদিকে সৌরভ, রঙের মেলা। পিছু ফিরে তাকাবার ফুরসত নেই। এগিয়ে যাওয়াই যৌবনের ধর্ম। মাঝে মাঝে দারুণভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ি। জেমিতে মজলাম কোন যুক্তিতে? ভেতর থেকে উত্তর এলো, প্রেম, ভালবাসা লজিক মেনে হয়না। চকিতেই হয়ে যায়। শৈলীর সাথে ফোনালাপ আর এস এম এস এর খুঁনসুটির দায়ভার কার? সে টিন এজ বালিকা। ডানায় সদ্য শক্তি পেয়েছে, দেহে স্রোতস্বিনী যৌবনের ছলাৎ ছলাৎ আলোড়ন। তার পক্ষে এলোমেলো উচ্ছ্বাস সাজে। কিন্তু তাতে আমি কেন এত উদ্বেলিত বোধ করছি? ফাংশনাল সম্পর্কের বাইরে একজন টিউটরের দায়বদ্ধতা কি? জানিনা। খাগড়াছড়ি আসার পর থেকে তার সাথে এত বেশি ইন্টারেকশন কি নিছক সৌজন্যতা নাকি জেমিহীন পৃথিবীতে একজন চঞ্চলমতি বালিকার উজ্জ্বল উপস্থিতিজনিত আগ্রাসন? অনেক দিন হয়ে গেল শৈলীর ফোন আর আসেনা। সারাদিন এলোমেলো লাগে। রাতে প্রতীক্ষায় থাকি এই বুঝি শৈলী ফোন দিয়ে খোঁচা মেরে বললো, “আংকেল, এখনো ভাব ধরে আছেন? ভাব ধরেই থাকেন”। আগে জেমিহীন সব কিছু পানসে লাগত আর এখন তিতা তিতা লাগে। বাসায় ফোন দিতেও ভাল লাগেনা। আম্মা ফোন দিলে খবরাখবর নেই। মোটকথা কোন কিছুতেই আর উৎসাহ পাইনা। একজন জেমী বা একজন বালিকার কত শক্তি যে সব কিছু রূপহীন, রসহীন, গন্ধহীন, বর্ণহীন, ছন্দহীন, গতিহীন করে দেয় সহজেই।

    রুমমেটদের সাথে হাসি ঠাট্টা আর সমসাময়িক বিষয়াদি নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়। এক সাথে উঠাবসা হয়। কিন্তু একান্ত ব্যাক্তিগত অধ্যায় শেয়ার করার মত উদ্রেক হয়না। ইমাম সাহেবের কাছে বসলে দুনিয়াদারি তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় এ দুনিয়া খেল তামাসা ছাড়া আর কিছু না। একেকবার মনে হয় তার কাছে খুলে বলি সব কিছু। বললে হয়ত হাল্কা বোধ হবে। কিছু ভাল পরামর্শও পাওয়া যেতে পারে। আজ খুব শীত পড়েছে। সন্ধ্যায় ভাল বৃষ্টিও হয়েছে। এশার নামায শেষে লোকজন যে যার মত দ্রুতই বেরিয়ে গেলো। ইমাম সাহেবকে সালাম দিয়ে গিয়ে বসলাম সামনে। আরো দু’জন ছিলো বসা। তাদের ভিন্ন ভিন্ন সমস্যা। একজন বলেই ফেললেন তিনি পারিবারিক ভাবে খুব পেরেশানীতে আছেন। তার দুই ছেলে, এক মেয়ে। সবাই বড়। তাদেরকে শাসন করা যাচ্ছেনা। স্ত্রী তাদের হয়ে এমন ভাবে কোমর কেচে নামে বাসায় টিকাই দায়। ইমাম সাহেব হাসলেন। বললেন, “ স্ত্রীকে বেশি চাপাচাপি করবেন না। জানেন তো বাঁকা হাড় দিয়ে তৈরি। বেশি করবেন সোজা তো হবেই না বরং ভেঙ্গে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। আর ছেলে মেয়েদেরকে সময় দেন। তাদের চাহিদা বুঝার চেষ্টা করুন। সময়ে সব ঠিক হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ”। ভদ্রলোক চলে গেলেন। অপরজনের রাতে ঘুম হয়না। ডাক্তার হাই ডোজ মেডিসিন দিয়েছে। কাজ হচ্ছে না। ইমাম সাহেব শান্ত কন্ঠে বললেন, “বাবাজী, দুনিয়াবি ঝামেলা কমিয়ে দিন। রাতে তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়ুন। ডিম লাইট জ্বালাবেন না। ডান কাত হয়ে শোবেন। বিসমিল্লাহ পড়ে সুরা ফাতিহা আর তিন কুল পড়তে থাকবেন। তাতেও ঘুম না এলে তাসবীহ, তাহলীল যা জানেন তা পড়তে থাকবেন। ইন শা আল্লাহ ঘুম এসে পড়বে”। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনলাম। ভদ্রলোক চলে যাওয়ার পর পরই আমি বলে ফেললাম, “হুজুর,আমার একটা সমস্যা”। ইমাম সাহেব উঠতে গিয়েও বসলেন। বললাম, “আমার এক বন্ধু, কঠিন বিপদে পড়েছে”। আমার সমস্যা বন্ধুর নামে চালিয়ে দিলাম। ইমাম সাহেব হাসলেন। চুপ করে থেকে কয়েকবার নাউযুবিল্লাহ পড়লেন। পরে বললেন, “বাবাজী, এটা হাল আমলের মারাত্মক রোগ। পরকীয়া। হারাম, হারাম, হারাম। অন্যের স্ত্রীর সাথে যাই করা হবে তাই নাজায়েয। কবীরা গোনাহ। যত দ্রুত সম্ভব এ থেকে সরে আসতে বলেন। কোন ফায়দা তো নেই-ই বরং আখেরে ভীষণ মসিবত। দুনিয়াবিতেও অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে”। আমি বললাম, “এখন উপায়”? তিনি বললেন, “সামর্থ থাকলে দেখে শুনে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতে বলেন। আর সামর্থ না থাকলে তাড়াতাড়ি এই হারাম কাজ থেকে বেরিয়ে আসতে বলেন”। আমি চলে আসবো এমন সময় ডাক দিয়ে বললেন, “শয়তানের সবচেয়ে আনন্দ হয় তখন, যখন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ফাটল ধরাতে পারে। তালাকের মত অপছন্দনীয় কাজে প্ররোচিত করতে পারে। আর এ কাজে আপনার বন্ধুকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে”। আমার হাত ধরে বললেন, “বাবাজী বুঝতে পেরেছি আপনি নিজেই এই কঠিন বিপদে পড়েছেন”। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে এলো। এরপর আর কথা চলেনা। বিদায় নিয়ে চলে এলাম।

    ভাবছি, জেমি আসলে কে? তার সাথে আমার এই সম্পর্ক কি ভালবাসা, ইনফেচুয়েশন নাকি মায়া? নাকি আত্মাহুতির জ্বলন্ত অংগার? নিজেই নিজেকে বিশ্লেষণ করতে থাকলাম। এটা ঠিক যে জেমিকে দেখামাত্রই তার দীপিকা পাডুকোন লুক আমার দৃষ্টি কেড়ে নিয়েছে। ছাত্রীকে পড়ানোর সুবাদে আর জেমির ঔৎসুক্যে আমাদের আড়াল আবডাল গাঢ়ত্ব পেয়েছে। জেমির সাহসী ভূমিকা আমাকে খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসতে উজ্জীবিত করেছে। সেটা জেমির তরফ থেকে হতাশাকে লাঘব করার জন্য উত্তম টাইম পাস হতে পারে, হতে পারে “এমনি করেই যদি জীবনটা কেটে যায়, যাক না” জাতীয় সুখের বিকল্প অপশন। তার জন্য সিরিয়াস সিদ্ধান্ত নেওয়া যেমন কঠিন। তেমনি আমার জন্যও অনেক “যদি কিন্তু তবে” জাতীয় হার্ডেলস অতিক্রম করার কঠিন পরীক্ষা। আমাদের এই সম্পর্কের পরিণতি অংকের হিসেবে অনেক জটিল। মেয়েরা খুব আবেগী হয়। তাদের মননে-মগজে নানাবিধ রস খেলা করে। হাওয়া বদলের সাথে সাথে এর রুপও বদল হয়। অতি সংবেদনশীল হলেও এরা খুব বাস্তববাদী হয়ে থাকে। আবেগ তাদের খুব সহজেই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে, কখনো শ্লীল-অশ্লীলের পর্দা ছিন্ন করে ফেলতে পারে। কিন্তু দিন শেষে মাটির পৃথিবীতে ফিরে আসে খুব সহজেই। ভাবছি এলোমেলো এমন কিছু। হঠাৎ শৈলীর ফোন। বেজেই চলছে। ধরিনা। শুধু শুধু মায়া বাড়িয়ে জীবনকে আর জটিল করতে চাইনা।

    চলবে…

  • ললাট লিখন (সূচনা পর্ব-১)

    ললাট লিখন (সূচনা পর্ব-১)

    বিবাহ উপযুক্ত মেয়েকে ঘাড় থেকে নামাতেই হয়তো মহাসমারোহে বোবা লোকটার সঙ্গে আমার বিবাহের আয়োজন চলছে।চারদিকে কন‍্যা বিদায়ের আনন্দে মাতোয়ারা শুধু আমার দুচোখে অশ্রু।কিছুক্ষণ পূর্বে এক বোবা নির্বোধ বালকের সঙ্গে আমার বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। কাউকে দোষারোপ করবো না সব আমার ললাটের লিখন। কপাল গুণে এরকম একখানা ভাই পেয়েছিলাম যে নিজের বউকে খুশী করতে প্রাণ প্রিয় বোনকে বলি দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়নি। মা গত হয়েছেন আমার জন্ম ক্ষণে।না থাকার মতো নাম মাত্র বাবা আছেন । মা গত হবার কিছুকাল পরেই উনি নতুন করে সংসার পাতেন।কিন্তু এক বৃক্ষের ছাল আরেক বৃক্ষে কখনও জোড়া লাগেনা কথাখানা সত্য প্রমাণ করে নতুন গৃহকর্ত্রী আমাদের দুভাই বোনকে অবহেলা করতে শুরু করলেন। অনাদর অবহেলায় বড়তো হলাম কিন্তু যখন ভাইয়া বিয়ে করলো তখনই শুরু হলো সংসারে আরেক অশান্তি। ভাবির সহিত ছোট মায়ের মোটেই বনিবনা হলো না।। বাবা উপায়ন্তর না পেয়ে আমাদেরকে আলাদা করে দিলেন। ভাইয়ের ভাগে পড়লাম আমি। এদিকে ভাই ভাবির সংসারে পরগাছার মতো অবস্থান হবার জন্য মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা চিরতরে হারিয়ে ফেললাম । তাই বড়লোক বাপের একমাত্র ছেলে দেখেই উনারা পাগল হয়ে গেলেন।আমার মতামত নেবার প্রয়োজন মনে করলেন না। তাছাড়া সেখানে যৌতুকের কোনো ঝামেলা নেই,কেই কোনো উপহার সামগ্রীর ঝামেলা।কিছুই দিতে হবে না। আবার মাঝে মধ্যে সাহায্য পাওয়া যাবে এমন সুযোগ হাতছাড়া করার মতো বোকা আমাদের বাড়িতে বর্তমানে কেউ নেই। ভাইয়া আমার শশুরের কোম্পানিতে চাকরি করেন। এমন প্রস্তাব প্রত‍্যাখান করার মতো সাহস ভাইয়ার ছিলও না। কিন্তু টাকা পয়সা দিয়েই কি সুখ কেনা যায়? স্বামী নামক লোকটার সঙ্গে যদি নিজের ভালো-খারাপ,সুখ-দুঃখের চারটি কথা ভাগাভাগি করতেই না পারি তাহলে ওরকম টাকা দিয়ে কি হবে?

    অট্টালিকার মাঝে আমার হাহাকার ওই অর্থের সঙ্গে ধাক্কা লেগে ঝঙ্কার দিবে। আমি সহ‍্য করতে পারবো না। এর থেকে মৃত্যু ভালো ছিল।কথাগুলো আনমনে ভেবে চলেছে আরশি। খুব ধুমধাম করে কিছুক্ষণ পূর্বে ঐতিহ্য জুনায়েদ চৌধুরীর সঙ্গে ওর বিয়ে হয়েছে। ছেলেটা ওর পাশে বসে নিজের টুপির সুতা গুলো খুটিয়ে খুটিয়ে তুলছে। বিয়ে কি এসব বোঝার ক্ষমতা তার নেই। সে আছে আপন খেয়ালে। মা ছাড়া কাউকে ডাকতে পযর্ন্ত পারেনা। রাহাত চৌধুরী চেয়েছিলেন ছেলেকে কখনও বিয়ে দিবেন না তবুও দিতে হলো। মেয়েটা ভীষণ ভালো। উনার স্ত্রীর পছন্দ তাই বিয়েটা দিতে হলো। আরশী ছলছল চোখে ঐতিহ্যকে দেখছে। এই হাবা গোবা ছেলেটার সঙ্গে কিভাবে সংসার করবে এই চিন্তাই ওর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। তাছাড়া ওর এরমর মানুষ দেখলে ভয় হয়। লোকটা যদি উন্মাদ হয় তখন কী হবে? মারবে নাকি খামচে দিবে?কথাটা ভেবেই ও শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ বিদায় পর্বের সূচনা।। আরশীর বাড়ির জন্য না নিজের জন্য কষ্ট হচ্ছে। ও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো ওবাড়িতে বেশিদিন থাকবে না। একটা থাকার জায়গা খুঁজে সেখানে পালিয়ে যাবে।। বোবা কালা লোকের সঙ্গে থাকার চাইতে সারাজীবন একা থাকাই ভালো। ও এসব বলে নিজেকে সান্ত্বনা দিচ্ছে কিন্তু পরক্ষণেই ভেঙে পড়ছে। আদো কি সেখানে গিয়ে ও বের হতে পারবে নাকি বন্দী হয়ে যাবে?।? আরশীর পাশে ওর ভাবি সুলেখা বসে আছেন। উনি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন,

    বড়লোক বাড়িতে যাচ্ছ জীবনে আর যাইহোক টাকার অভাব হবে না। আরশী মানুষের জীবনে প্রচুর টাকার প্রয়োজন। টাকা ছাড়া জীবনে সুখ আসেনা। তোমার ভাইয়া তোমাকে সুখের রাজ‍্যে যাবার টিকিট দিচ্ছেন তাকে ভুল বুঝোনা।

    ভাবির বলা কথাগুলো শুনে আরশীর খুব বলতে ইচ্ছা হলো,
    “এই টিকিটের আমার প্রয়োজন ছিল না এটা বরং তোমাকে দিলেই ভালো হতো। নিজে যে সামান্য কৃষ্ণবর্ণের ছেলের সঙ্গে বিয়ে করবে না বলে বিয়ের আসর থেকে উঠে এসেছিলে সেই তুমি এখন আমাকে বোঝাতে আসছো?”

    আরশী কথাগুলো বলতে গিয়েও চুপ থাকল। সর্বনাশ যা হবার কিছুক্ষণ পূর্বেই হয়ে গেছে এখন বিবাদ করে কি হবে?মা মারা যাবার সময়ই সব সৌভাগ্য উনি সঙ্গে করে নিয়ে গেছেন। এসব ভাবতে ভবাতেই ওদেরকে নিয়ে গেলো গাড়িতে তুলে দিতে। ফরিদের চোখের কোনে অশ্রু চিকচকি করছে। একমাত্র বোনটার বিয়ে হচ্ছে। একচোখে আনন্দ অশ্রু অন‍্য চোখে কষ্ট। উনি আরশীকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলেন কিন্তু আরশী শক্ত পাথরের মূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। ওর এসব নেকামি বলে মনে হচ্ছে। বোনকে জলে ডুবিয়ে এখন লোক দেখানো নাটক করার কি মানে ওর মাথায় আসছে না। ওর বাবা আকবর হোসেন দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আরশী সেদিকে একবার তাকিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো। কিন্তু সমস্যা হলো বর ঐতিহ্য ওর পাশে কিছুতেই বসতে চাইছে না। লোকটার নাকি ওকে দেখে ভয় করছে তাই কিছুতেই সে মায়ের আচল ছাড়তে চাইছে না। তাই একপ্রকার বাধ‍্য হয়েই ডালিয়া চৌধুরী ছেলেকে নিয়ে অন‍্য গাড়িতে গিয়ে উঠলেন। আরশী চুপচাপ বসে আছে। কি অদ্ভুত বিয়ে। বউ একা একা শশুর বাড়ি চলেছে অথচ কাছে কোনো শুভাকাঙ্খী নেই। এসব দেখে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গেলো আরশী। ওর ঘুম ভাঙলো কারো চিৎকার শুনে। ও তাড়াতাড়ি উঠে বসতেই লক্ষ্যে করলো কিছু মেয়ে ওকে ডাকছে। আরশী বাইরে বেরিয়ে আসলো। সামনে দোতালা বিশিষ্ট বিশাল বড় বাড়ি। ও একপা দুপা করে ফুলের পাপড়ির উপরে পা ফেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। দরজা থেকে ওকে বরণ করে বাসর ঘরে রেখে আসা হলো। আরশীর এখনো ঘুম কাটেনি। ও বিছানায় হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ বসে আবারও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলো।

    গভীর রাত ঘুমন্ত আরশীর উপরে ঝাপিয়ে পড়লো কোনো এক ছায়ামানব। ধস্তাধস্তির এক পর্যায় আরশীর গলাই লোকটা তার লম্বা নক ফুটিয়ে দিলো। গলা থেকে পড়া রক্ত আর অজস্র যন্ত্রণায় ঘাবড়ে গেলো আরশী।।ও নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে ছায়াটাকে সরাতেই ওর ঘুম ভেঙে গেল।তারপর চোখ খুঁলে তাকিয়ে দেখল সোফায় ওর স্বামী ঐতিহ্য জুবায়ের ঘুমিয়ে আছে। কি মায়াবী ওই মুখখানা শুধু তাকিয়ে থাকতেই মন চাই কিন্তু লোকটা যে বোবা কথা বলতে পারেনা। নির্বোধ বোবাকে তো আর স্বামী হিসেবে ভালোবাসা যায় না। শুধু করুণা করা যায়। নিজের সুখ দুঃখের অংশীদার করা যায় না তার উপরে আবার কিসের ভালোবাসা? কথাটা ভেবেই আরশী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ঐতিহ্যের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। লোকটার ঝুলন্ত হাত থেকে টপটপ করে লাল রক্ত পড়ছে। আরশী দ্রুতপায়ে লোকটার দিকে এগিয়ে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো কারণ নীল দেওয়ালে একজন নববধূর ছবি অঙ্কিত আছে। আরশী একপা দুপা করে ছবিটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। টকটকে লাল বেনারসি পরা মেয়েটার চোখে মুখে কেমন রহস্যের ছাপ বিশেষ করে ওর হাসিটা। ছবির রঙ দেখে বোঝা যাচ্ছে কিছুক্ষণ পর্বেই ছবিটা আঁকা হয়েছে। নিখুঁত ছবির মেয়েটাকে দেখতে ঠিক ওর মতোই লাগছে। আরশী একবার ভাবলো ঐতিহ্য বুঝি ওর ছবিই এঁকেছে কিন্তু পরক্ষণেই মেয়েটার ঠোঁটের নিচের তিলটা দেখে বুঝলো না এটা ওর ছবি না। ছবিটা কোনো সুন্দরী রমনীর।

    কিন্তু কে এই রমনী?

    চলবে…

  • একটি খোলা চিঠি (পর্ব-২)

    একটি খোলা চিঠি (পর্ব-২)

    বন্ধু শুভঙ্কর,

    গত তারিখে তোমার কিছু কথার স্মৃতিচারণ করেছি লিখে পাঠিয়েছি বেশ ক’দিন হলো।মনে হয় এতোদিনে পেয়ে গিয়েছো চিঠি আমার। যদিও ঠিকানা বিহীন, ডিজিটাল যুগে ঠিকানা লিখতে নেই, পৌঁছে যাবে সময়ে কোনো একসময়ে।

    প্রিয় বন্ধু আমার, এখন সময়গুলো বড্ড এলোমেলো বেসামাল গো,প্রতিদিন,প্রতিক্ষণ মনে মনে লিখে যাই কত্তো শতো কষ্ট কথা মনে মনে।

    পাঠিয়ে দিই তোমাকে গোপনে গোপনে আর স্বস্তির শ্বাস নিতে থাকি।কেনো এমন হলো বলো তো? হ্যাঁ, তুমি ছিলে একটু চাপা গোছের মুখ খুলে কিছু বলতে চাইতেনা,কিন্তু সারা সময় আমাকে আগলে রাখতে দৃষ্টিতে। বাদ দিই অতসব কথা গো, আজ আমার জন্য একটি বিশেষ দিন। চমৎকার বসন্তের পলাশের মতো গভীর ভালোবাসার। তুমি তো জানো শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার সাথে পলাশের মেলেনা।তবুও চমৎকার যজ্ঞের, চমৎকার ভালোবাসার রঙ এরা।

    স্বাধীনতা দিবস,বিজয় দিবস,একুশ,বসন্ত দিবসে বেশি করেই এদের নাম, ভালোবাসার মহত্ব,মমত্ববোধে আনা হয়, কারণ জানিনা তবে বোধহয় ঐতিহাসিক বাস্তবতায় চমৎকার কোন মূল্যায়ন আছে।

    তোমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছি অনেক বার পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়ার লাল রঙটির গুরুত্বের কথা। তুমি অনেক যুক্তি তর্ক রেখে বুঝাতে চেয়েছো আর আমি বুঝতে গিয়ে শুধু তোমার দিকেই অপলক তাকিয়ে থেকেছি। জানিনা কেনো?

    কথা শেষ করে কি অদ্ভুত সুরে বলতে তুমি, বুঝেছো তো? আমি পাল্টা প্রশ্ন করে জিজ্ঞেস করতাম,
    “যাকে আরাধ্য করে প্রতিটি মুহূর্তের শুরু
    কি আছে তাহার মাঝে?
    কি আছে তাহার গভীর দু’টো চোখে,
    কি আছে তাহার উষ্ণতার ঠোঁটে
    কি আছে তাহার অমন মোহন হাসিতে
    কি আছে তাহার শ্বাসে-প্রশ্বাসে
    কি আছে তাহার অনুভবে,যার অনুভবের স্পর্শ

    সারা সময় তোলপাড় করে রাখে,দারুণ অহংকারী হতে শেখায় ভালোবাসায়?শরীরের সুবাস নিতে শেখায় অতি যতনে,মুগ্ধতায়। অনেক অনেক জিজ্ঞাসা, এমন কতো প্রশ্ন?

    তুমি অবাক হয়ে বলতে এতোসব কথা তো পরম মমতার প্রিয় মানুষের জন্য। প্রচন্ড বোধের, প্রচন্ড আকুলতার,নরোম রোদ্দুরের মতো ভালোবাসার গো,তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? মনে মনে, প্রকাশ্যে।

    আমি উত্তর না রেখেই আবার জিজ্ঞেস করি, বলো
    এগুলো কী চাওয়া,কোনো আবেদন অথবা কোনো প্রাপ্তির প্রকাশ?
    তুমি শুধু বড্ড একটা শ্বাস ছেড়ে বলেছিলে জানিনা আমি কিছু জানিনা,অনিমেষ চেয়ে থেকেছিলে মেঘে ভরা আকাশে,
    হঠাৎই বৃষ্টির লুটোপুটি, তুমি বৃষ্টিতে ভিজে সারারাত জ্বর মাথায় কষ্টে বিলাপ করেছো হ্যাঁ, হ্যাঁ হ্যাঁ চারুলতা আমি
    আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি, ভালোবাসি আমার জীবনের চেয়েও বেশি।

    চারুলতা খল খল হেসে ওঠে,চোখ ভরা জলে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।

    শুভঙ্কর বন্ধু আমার, সময় গড়িয়ে যায় স্মৃতির পাখি ডানা ঝাপটায়,আমার কষ্ট কথারা দাপিয়ে ঝর তোলে। আজকাল কষ্টরা বড্ড এলোমেলো হয়, নষ্ট হয় আমার বুকের গৃহস্থালি, ভালোবাসা জেগে থাকে বিষন্ন বিলাসে।

    চারুলতা নামটি তোমার দেয়া, তুমি তোমার যখন ইচ্ছে ডাকার সে নামেই ডাকতে। আমার মন্দ লাগতো না শুনতে। আমি ও তোমাকে ডেকে দিতাম নানান নামে তুমি চমৎকার করে হেসে দিতে নতুন নামের ডাক শুনে।

    শুভঙ্কর বন্ধু আমার,
    কথারা অনেক বেশি ভারি হয়ে গেছে গো, আমি আজ ভীষণ ক্লান্ত, ভীষণ খুশি, ভীষণ খুশি পরের চিঠির আলাপে বলবো সব কথা। আজ ফিরছি বন্ধু। সময়ে চিঠির উত্তর লিখে দিয়ো প্লিজ। অপেক্ষায় থাকবো। শুধু জেনে রেখো শুভঙ্কর বন্ধু আমার, ভালোবাসি,ভালোবাসি,শুভঙ্কর বন্ধু ভালোবাসি শুধু তোমাকে

    তোমার চারুলতা।
    ০২.০৩.২০২২খ্রি

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৪২)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৪২)

    রুমি খালা ঘরে এসেই কলিকে চোখ দিয়ে ইশারা করছেন। তিনি খুবই বিরক্ত বোঝা যাচ্ছে। এর মধ্যেই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন রাহেলা বেগম।

    রুমি হালকা হাসির রেখা টেনে বললেন, ভাবী, এই হচ্ছেন আমাদের রাহেলা আপা। বড় মামার মেয়ে, আমাদের সবার বড় আপা। আপার নাতি অসুস্থ তাই হুট করে বেড়িয়ে গিয়েছিলেন।
    – কি অবস্থা নাতির?
    – ভালো আছে এখন।
    – নাতি কি মেয়ের দিকের?
    – না, বড় ছেলের।
    – ওহ, ছেলে আলাদা থাকেন।

    রুমি সাথে সাথেই বললেন আজকাল মেয়েরা কি শ্বশুর বাড়ীর সাথে থাকতে চায়, আপার মেয়েরাই একটু অন্য রকম মনের। বড় মেয়েটা ননদ-দেবর নিয়ে সংসার করছে। মেজ মেয়ের শ্বশুর প্রফেসর মানুষ, তিনি ছেলের বউকে চোখে হারান, বিয়ের পর এম.এ পাশ করিয়েছেন।

    আমাদের কলিও খুব ভালো। আচ্ছা পরিচয় করিয়ে দেই, উনি শাহেনা ভাবী। আমার মামাতো ভাসুরের ওয়াইফ, ছেলের মা। আর ইনি হচ্ছেন আমার আরেক জা, শাহেনা ভাবীর ছোট জা, ছেলের চাচি। আর এই হচ্ছে আমাদের ছেলে, শাহরিয়ার কবির।

    রাহেলা বেগম বললেন আমি প্রথমেই দুঃখিত, নাতির অসুস্থতার খবর শুনে দৌড়ে গিয়েছি।
    – সমস্যা নেই।
    – আর রুমি বলেছিল আপনাদের ট্রেন বিকালে।
    – হ্যা, ছিল। কিন্তু কবিরের এক বন্ধুর বাসায় দাওয়াত থাকায় আর ট্রেনে যাচ্ছিনা। রাতের ট্রেন ধরবো।
    – আপা বসুন, আমি ভেতরে যাই।
    – আপনি ব্যস্ত হবেন না, আমরা মাত্র লাঞ্চ করেছি।
    – জি।

    রাহেলা বেগমের পিছনে পিছনে রুমি ভিতরে গেলেন। খুব বিরক্ত হয়ে বললেন কি আপা তুমি আজ না গেলে কি খুব সমস্যা হয়ে যেতো!
    – তুই বলেছিল বিকালের আগে আসবি, তাই…
    – এটা ঢাকা শহর কথা মতো কি আসা যায়? আর, এরকম বাসায় কি কেউ মেয়ে দেখায়? এটা কি কোন বাসা?
    – কি করবো বল, ছেলেদের অল্প আয়ে, এই সংসার।
    – সাঈদের বাসায় দেখালে কি হতো। বিয়ের পর তো সমস্যা নাই, কিন্তু বিয়ের আগে মানুষ টেবিলের উপরের ফুলদানীতে ধুলা আছে কিনা চোখ বড় বড় করে দেখে। কলি কি রেডি হচ্ছে?
    –হ্যা।
    – আপা রাগ করবেনা আমার কথায়, আমি তোমাকে খুব ভালবাসি, চাই কলির ভালো বিয়ে হউক। ছেলে মাস্টার্স পাশ, একটা এন.জিওর এরিয়া ম্যানেজার, নিজেদের তিন তলা বাড়ী, দুই ভাই মাত্র। বড় ভাই পরিবার নিয়ে ওমান থাকে। বাসাভাড়া, দোকান ভাড়া অনেক টাকা পায়।
    – নারে রাগ করিনি। তুই আমাদের সবার ছোট কত আদরের।
    – বেশি সাজ লাগবেনা, তারা আগেই দেখেছে রাস্তায়!

    কলির প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে! আর কত বার এভাবে ছেলে পক্ষের সামনে গিয়ে বসতে হবে কে জানে!

    কলি তাদের সামনে গিয়ে বসলো, অনান্য বারের মতো এবার আর লজ্জা লাগছেনা। কারণ কিছুক্ষণ আগেই সে তাদের নিয়ে এসেছে।

    ছেলের মা কলিকে বললেন, তুমি কি চাকরি করবে?

    কলি চিন্তা করছে কি উত্তর দিবে! তার মন চায় তার একটা নিজস্ব পরিচয় হোক, টাকার জন্য না হউক নিজের জন্য একটা চাকরি দরকার। কিন্তু তারা কি ভাব বে তাই চিন্তা করছে! পরে, আমার রুমি খালা চিৎকার করে উঠবেন!

    জি, চাকরি করার ইচ্ছা আছে।
    – আমাদের বাড়ীর বউরা কেউ চাকরি করেনা। আমার বড় বউমা মাস্কট থাকে, অত্যন্ত ভদ্র এবং সংসারী মেয়ে। তবে, তুমি যদি বউ হয়ে যায়, আমার ছেলের ভালো লাগলে চাকরি করবে।

    কলি মাথা নিচু করে আছে। সে কি বলবে জানেনা। সে কি অভদ্র মেয়ে? নাকি সে তাদের নিয়ে এসেছে এজন্য সে অভদ্র মেয়ে বলে বিবেচিত হচ্ছে।

    অল্প কিছুক্ষণ কথা বলে, নাশতা শেষ করেই চলে গেলে ছেলেপক্ষ। যাওয়ার সময় ছেলের মা, এক হাজার টাকা হাতে দিয়ে দিলেন।

    রুমি চোখ দিয়ে ইশারা করছেন রাহেলাকে, যাতে তিনিও সালামী দেন ছেলেকে। অথচ রাহেলার হাত শূন্য, সালামী দেওয়ার মতো টাকা এই মুহুর্তে নাই।

    রুমি বুদ্ধি করে কলিকে ভেতরে নিয়ে গেলেন, এবং নিজের ব্যাগের থেকে টাকা বের করে তাদের দেওয়া নোট গুলি তিনি নিলেন, আর রাহেলাকে অন্য দুয়ি পাঁচশো টাকার নোট দিয়ে বললেন, আরও দুইশো টাকা মিলিয়ে সালামী দাও যাও।

    কলির সবকিছুই বিরক্ত লাগছে, কত লোক দেখানো নিয়ম। তাদের টাকাই তাদের দিবে, কিন্তু নোট গুলি পরিবর্তন করতে হবে, যাতে বোঝা যায়, এটা আলাদা টাকা!

    রুমি যাওয়ার সময় রাহেলাকে বললেন বেশি করে দোয়া কর, যেন আল্লাহ ওদের মিলিয়ে দেন। তবে, তোমার রাজকপাল হবে। আজ যাই, সপ্তাহ খানেক পরে জানাচ্ছি। আর পারলে বাসাটা বদলে নিও।

    রাহেলা বেগম ছাদের উপর থেকে তাদের যাওয়া দেখছেন। আর ভাবছেন ছেলেটি বেশ সুন্দর এবং দ্মার্ট, কলির সাথে বিয়ে হলে, দারুন হবে।

    কলি মাকে এসে বললো, মা শুধুশুধু বড় আশা করবেনা। ওরা বড়লোক আমাকে বিয়ে করবেনা। আসো, ঘরে।

    দুদিন পর, পলি ফোন দিয়েছে কলিকে, যেন অবশ্যই একবার নাহিদ-শাহিদ আর মাকে নিয়ে চট্টগ্রাম আসে। কলির ইচ্ছে হচ্ছে যেতে, বাড়ী আর ভাইয়ের বাসা ছাড়া তেমন কোন জায়গায় কখনো যায়নি সে! এখন মনে হচ্ছে দূরে গিয়ে একটু শ্বাস নিয়ে আসতে।

    নাহিদ ও ট্রেনে করে আপার বাসায় চট্টগ্রামে যেতে রাজী। কিন্তু রাহেলা বেগমের এক কথা, ওরা যফি ভালো কিছু জানায়, আবার দেখতে চায় তখন! যাওয়ার দরকার নেই।

    কলি বার বার বলছে আর আসবেনা, কেন আশা বেঁশে আছ?
    – আশায় বাঁচ্ব চাষা। আমিও চাষা তাই আশায় বাঁচি।
    – মা, প্লিজ যাই।
    – তোরা গেল, জামাইয়ের আলাদা খরচ, নাহিদের খরচ না যাওয়া লাগবেনা!

    কলি সেই ফোনের অপেক্ষা করছে, যে ফোনে তাকে রিজেক্ট করেছে। কিন্তু ফোন আসছেনা, অথচ তার মন পড়ে আছে চট্টগ্রামে! যাওয়া হবে কিনা কে জানে, মন খুব অশান্ত হয়ে আছে, ঘুরলে হয়তো ভালো লাগবে। কে বুঝবে তাকে? কে শুনবে তার কথা…

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৪১)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৪১)

    কলি রুমে এসে টেবিলের উপর টিফিন রেখে, বাবুর কাছে গিয়ে বসলো। বাবু চোখ বড় বড় করে খালামনি কে দেখছে।

    রাহেলা বেগম বললেন কলি কখন এসেছিস?
    – এইতো মা! টিফিন দিয়ে দিয়েছেন ভাবী! খাও।
    – তুই এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছিস কেন? তোর ভাবীকে সাহায্য করতে পারতি?
    – ভাবীর বোন, খালাম্মা, বুয়া সবাই আছে। আর তোমরা খাবে তাই চলে এলাম।
    – মুখটা এমন করে আছিস কেন?
    – কিচ্ছু না! নাহিদ কোথায়?
    – পানির ট্যাংকের ছায়ায় বসে বই পড়ছে।
    – ওহ। তোমাদের খাবার দেই?
    – নাহিদ কে ডেকে নিয়ে আয়।

    নাহিদ এক দৃষ্টিতে বই পড়ছে। কলি গিয়ে পাশে বসলো।

    কলি বসতেই বললো কি রে ঘি ভাত হজম হয়নি?
    – তুই খেতে আয়।
    – না, আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা। আগে বল, মুখ এমন হয়ে আছে কেন? কাহিনি বল আগে?
    – গভর্নেসের চাকরির খবর এসেছে।
    – বুঝলাম না।
    – ভাবীর বাবু হবে, জিহান ছোট। তাই আমি আর মা নাকি তার বাসায় চলে যাবো। তুই আর শাহিদ নাকি মেসে চলে যাবি।
    – মামার বাড়ীর মোয়া! আমার মা, বোন কোথায় থাকবে, সে ঠিক করবে। এতো খাতিরের কারণ বুঝলাম। এখন অংক মিলেছে। বাই দ্যা ওয়ে মা কি বলেছেন।
    – বলিনি এখনো। তুই খেতে আয়।
    – তুই খা!

    নাহিদ আর কথা না বলে উঠে দাঁড়ালো, বই কলির হাতে দিয়ে বললো, বইটা রাখ, মাকে বলিস আমি টিউশনি তে গেলাম।
    – খেয়ে যা।
    – তুই খা।

    সাঈদ সন্ধ্যার পর মিষ্টি নিয়ে হাজির হলেন, এসে বললেন মা, মিষ্টি দিতে, তোমার বউমা ভুলে গিয়েছিল।
    – যা খাবার দিয়েছ, তা রয়েছে, আবার মিষ্টি কেন?
    – খাও, মা। নাহিদ যায় নি কেন?
    – ওর টিউশনি ছিল।
    – দুপুরবেলা কিসের টিউশনি? এতো অহংকার ওর! বুঝিনা কেন? কলি কিছু বলেছে।
    – হ্যা বলেছে।
    – আমার বাসায় কবে যাবে?
    – বাবা তুমি আমার কথা মনোযোগ সহকারে শুনবে। তারপর কথা বলবে।
    – বলো।
    – নাহিদ সারাদিন বাসা, ভার্সিটি আর টিউশনি দৌড়ায়। শাহিদ সারাদিন দোকানে। আমি ছাড়া এদের অনেক কষ্ট হবে। আমি প্রতিদিন বিকালে জিহান দাদুভাই কে নিয়ে আসবো। নতুন বাবু হওয়ার পর, আমি প্রতিদিন দুই বার যাবো। কলিও যাবে, কলেজ থেকে এসে।
    – মা, নাহিদ শাহিদ কি শিশু?
    – মায়ের কাছে সব সন্তান শিশু।
    – কলির যেতে সমস্যা কি?
    – ও আমাকে ছাড়া যেতে চায়না।
    – বরের বাড়ী কি তুমি যাবে সাথে? যত্তসব ফালতু কথা বার্তা। জাহান আগেই বলেছিল, ওরা নিতে জানে দিতে জানেনা।

    কথা শেষ করেই হন হন করে চলে গেল সাঈদ। রাহেলা বেগম বললেন সাঈদ শোন…

    কিন্তু শোনার আগেই চলে গেল সাঈদ।

    রাহেলা বেগমের মন টা খচখচ করছে, ছেলটা এমন করে রাগ রেগে গেল। কি করবেন তিনি কষ্ট হলেও এখানে থাকবেন। কারণ এই সংসার তার, ছেলের সংসার বউমার, তার নিজের না। ছেলে ভালো থাকুক তার মতো করে। অশান্তি নতুন করে সৃষ্টি করার অর্থ নেই।

    এক বছর পরের কথা…..

    পলি মাস্টার্স পাশ করেছে, অনেক মন খারাপের দিন গুলোর ইতি হয়েছে। আবিদ দুই রুমের বাসা নিয়েছে, ছোট্ট টিন শেডের বাসা কিন্তু সুন্দর। আজই পলিকে নিয়ে এসেছে এই বাসায়।

    ঘরে আসবাবপত্র খুবই সামান্য, একটা খাট, একটা আলমারী, একটা মিটসেইফ। আর কিছু দরকারী হাঁড়ি পাতিল কিনেছে আবিদ।

    পলি শাড়ি আঁচল কোমড়ে বেঁধে জিনিস পত্র ঘুছিয়ে নিচ্ছে। অবশেষে আজ সে একটা নিজের সংসার পেয়েছে, তাই শান্তি।

    যদিও সে বলেনি আলাদা হয়ে আবিদের কাছে আসবে, প্রফেসর সাহেব নির্দেশ দিয়েছেন যেন আবিদ তার নিজের কাছে বউ নিয়ে যায়।

    আবিদ বলছে, পলি আস্তে আস্তে সব কিনতে হবে, এখন একসাথে কিনতে পারবো না।
    – কোন সমস্যা নেই।
    – এখন জরুরি কিছু কি আছে?
    – যদি পার, দুই জানালার দুই সেট পর্দা কিনতে পার, জানালা খুলতেই বেশ লজ্জা লাগে।
    – আপাতত তোমার ওড়না দিয়ে রাখ, আমি দেখি মাস খানেক পরে কিচ্ছু করতে পারি কিনা!
    – আচ্ছা, কি রান্না করবো?
    – ডিম এনেছি সকালে দুইটা ভাজি কর, আলু ভর্তা কর, এখন এরকম শর্টকাট করে খেয়ে নিই। রাতে বাজার করে নিব।
    – হুম।

    পলি চারিদিক ভালো করে দেখছে, ছোট্ট দুটি রুম। অথচ কত মায়ায় জড়িয়ে আছে। আস্তে আস্তে করে সাজিয়ে নিবে সে!

    রাহেলা বেগম জাহিদের বিয়ের জন্য জাহিদ কে বার বার বলছেন। বয়স ত্রিশ পার হয়ে গিয়েছে। বিয়েটা করা দরকার। কিন্তু জাহিদের এক কথা আগে কলির বিয়ে হোক।

    কিন্তু অনেক গুলি পাত্রপক্ষ কলিকে দেখে গিয়েছে, তবে কেন যেন দুইপক্ষের পছন্দ এক জায়গায় মিলছেনা। এই নিয়েও রাহেলা বেগম বেশ দুঃচিন্তা করেন। রনি ঢাকায় আসলে প্রায়ই তার মামাতো ভাইয়ের কথা তুলেন। কিন্তু বার বারই না করেন রাহেলা।

    সাঈদের আবার আরেকটা ছেলে হয়েছে। নাম রাখা হয়েছে তিহান। রাহেলা বেগম প্রতিদিন দুপুর পরে গিয়ে নাতিদের দেখে আসেন। কিন্তু কলি যেতে চায়না, ভাবীর এতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা একদম ভালো লাগেনা।

    বিকাল বেলা রাহেলা বেগম বললেন, এই কলি আমি জিহান-তিহান কে দেখে আসি। তুই ঘরে থাক। আজ এক ছেলে পক্ষ দেখতে আসার কথা ছিল। আসলে রুমির( রাহেলার ফুপাতো বোন) নাহিদের ফোনে কল দিত। তাদের নাকি বিকাল পাঁচ টায় ট্রেন৷ তাহলে আজ আর আসবেনা, এখন সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। তুই থাক, ঘরে। আমি কিছু টুকটাক সবজি কিনবো। আর আমার দুটি ঔষধ। আসার সময় ওদের দেখে আসবো।
    – আর ছেলে পক্ষ দেখা লাগবেনা। আমি চাকরি করবো।
    – সে দেখা যাবে। বিয়েও জীবনের অনেক বড় একটা অধ্যায়। আমি পিঠা, পাটিসাপটা, সেমাই বানয়েছিলাম। কিন্তু তাদের সাড়ে তিন টায় আসার কথা। এখন ঘড়ি ছয়টা বাজে, আসার খবর নাই।
    – এগুলো কেন রান্না করে, পয়সা নষ্ট কর।
    – এতো কথা বলিস না, দরজা আটকে দে।

    কলি মাকে বিদায় দিয়ে ছাদে বসে আছে। ভাবছে, সে তো দেখতে সুন্দরী ধরা যায়, লম্বা, মাস্টার্স পাশ তবুও কেন এতো এতো ছেলের সামনে বসতে হবে? যে সত্যি বিয়ে করার জন্য আসবে, তার সামনে বসে, বিয়ে হয়ে যাক। আর নয়তো বিয়ে না করলে কি হয়!

    বাড়ীওয়ালার মেয়েটি দৌড়ে এসে বললো, কলি আপা নাহিদ ভাই কল দিয়েছেন।
    – নাহিদ?
    – হ্যা।

    নাহিদ কি মনে করে কল দিয়েছে, সমস্যা হয়নি তো! কলি দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলো

    হ্যালো।
    – এই আপা মা কোথায়? নাতিদের দেখতে গিয়েছেন।
    – রুমি খালা এখন কল দিয়েছেন। তিনি ছেলেপক্ষ নিয়ে এসেছেন। তারা রাস্তার মোড়ের দোকানে এসে, বাসা চিনতে পারছেন না! আজ কেন মা বের হলেন?
    – ঔষধ ও কিনবেন। আর ওদের বিকেলে ট্রেন ছিল।
    – যাই হউক, এখন তুই গিয়ে নিয়ে আয় ওদের। আমি ভাইজানের বাসায় কল দিচ্ছি। আমি মতিঝিল আছি, বেশিক্ষণ লাগবেনা, আসছি।
    – আমি গিয়ে নিয়ে আসবো?
    – বাড়ীওয়ালা চাচা ও বাসায় নাই, নয়তো চাচাকে বলতাম।
    – আমি গেলে কেমন দেখা যায়, বল?
    – এখন দাঁড়িয়ে আছে, তুই যা!

    কলি রুমে গিয়ে নিজের জামা বদল করে বের হয়ে মোড়ের দোকানে গয়ে দেখলো। রুমি খালা সহ তিন/চারজন দাঁড়িয়ে আছেন।

    রুমি খালা তাকে দেখে সরু দৃষ্টিতে দেখছেন। তিনি হয়তো ভালো ভাবে দেখছেন না। তবে, এখন সে কি করবে? নিশ্চয়ই মায়ের ঔষধ টা বেশি জরুরি, নয়তো যেতেন না। আর বের হচ্ছেন দেখেই হয়তো নাতিদের দেখতে যাচ্ছেন! আর এরচেয়ে বড় কথা, তাদের ট্রেন ছিল সাড়ে পাঁচটায়, এজন্য ছয়টায় বেড়িয়েছেন মা! এখন কেন হুট করে চলে আসবেন, কে জানে এটা!

    কলি এক পা এক পা, এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে, বেশ লজ্জা লাগছে। কি বলবে এরা কে জানে! কলি প্রাথনা করছে মা যেন তাড়াতাড়ি চলে আসেন…

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৫)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৫)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৫)
    মানুষের জীবনটা যেন কেমন? এত ব্যস্ততা, এত পেরেশানী, এত লাভ-লোকসানের ছলচাতুরী প্রাণীকুলের আর কারো মাঝে নেই। এত রোগ,এত শোক, এত মনোবৈকল্য, এত চিকিৎসা, এত এত রিহেবিলিটেশন সেন্টার প্রাণীদেরও জন্য যদি প্রয়োজন হত তা হলে সৃষ্টিজগত ভিন্নরুপে সাজত। আগে ফ্যামিলি ছিলো সব কিছুর রক্ষাকবচ। এর কিছু সেট রুলস ছিলো। প্লাস মাইনাস করে চলত সবাই। আনন্দ-বেদনা ভাগাভাগি করে নিত। একের প্রয়োজনে দশজন চকিতে দৌড়ে আসত, ঝাঁপিয়ে পড়ত অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে। আর আজকাল? সামান্য স্বার্থে অতি আপনজন সরে যায়, চোখ উল্টিয়ে জিঘাংসা পুষে রাখে অন্তরে। বৃদ্ধ বাবা-মাকে বোঝা মনে করে। ভুলিয়ে ভালিয়ে ফেলে রেখে আসে ফুটপাতে অথবা ব্যাক পুশ করতে করতে বাধ্য করে বৃদ্ধ নিবাসের বাসিন্দা হতে। পরিবার ভেঙ্গে হয়েছে এক একটি ব-দ্বীপ। এতেই যেন তুষ্টি, এতেই যেন মুক্তি। সেই নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির বৃত্ত ভেঙ্গে সন্তানেরা পাড়ি জমাচ্ছে বিদেশে। সেখানেই তৃপ্তি সেখানেই স্থিতি। তাই মৃত্যুকালেও বাবা-মার মুখ দর্শন নেহায়েত মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট বলে মনে হয়। জনকের পচনপ্রায় লাশ পাশে সরিয়ে রেখে ভাগ-বাটোয়ারাতে মত্ত থাকে অপত্যস্নেহে লালিত তার উত্তরাধিকার। কার জন্য এই ত্যাগ? এই কি তার প্রতিদান? পত্রিকায় এরকম খবর চোখে পড়ে আর মনটা বিষিয়ে উঠে। মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন সেরা জীব হিসেবে। তার এই নমুনা? পত্রিকায় খবর দেখলাম দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা ক্রমশঃই বেড়ে চলেছে। জায়গায় জায়গায় তাই এত এত রিহাবিলিটেশন সেন্টার, ক্লিনিক, হাসপাতাল। সর্বত্র চাপ, পরিবারের, সমাজের, লেখাপড়ার , পেশাপ্রাপ্তির, পেশা টিকিয়ে রাখার। আরো রয়েছে উন্নতির চাপ। পশ্চাতে পড়ে যাবার চাপ। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের চাপ। প্রেম-ভালোবাসার চাপ আর সেটা টিকিয়ে রাখার চাপ। আরো আছে বিধ্বংসী ব্রেক আপের চাপ।

    আমি নিজেই এই কয়দিন চাপের মধ্যে ছিলাম। ঢাকা থেকে হেড অফিসের লোকজন প্রকল্প ভিজিট করে গেছেন। সাথে সাইট সিয়িংও। কাজের অগ্রগতিতে তারা সন্তুষ্ট। আপ্যায়ন ও তদারকিতেও। এতে কার কি লাভ হয়েছে জানিনা। আমার পারফম্যান্সে সন্তুষ্ট ভিজিটিং টীমের রিকমেন্ডেশন আমাকে প্রকল্প মেয়াদ পূর্তি পর্যন্ত এখানেই যেন রেখে দেওয়া হয়।

    জামান ভাই বললেন আর হাসলেন। বললাম, “ভাই হাসছেন? এ মুহুর্তে আমার ঢাকা যাওয়া কত জরুরি তা আর কেউ জানুক আর না জানুক আপনি তো জানেন”। জামান ভাই মজা নিলেন। বললেন, “টেক ইট এজ ফিউচার ইনভেস্টমেন্ট। ডোন্ট বি সো ডিসহার্টেন্ড”। জামান ভাই ভরসা। তাই চুপ করে গেলাম। মানুষের মন বড় নাজুক। একটুকুতেই উৎফুল্ল হয়, আবার বিপরীতে বিষাদে মুষড়ে পড়ে। বিষন্নতা আমাকে পেয়ে বসেছে। বন্যেরা বনে সুন্দর, আমি ঢাকায়।

    বাসার সব কিছু ‘টু বি কনটিনিয়ুড’ স্টাইলে চলছে। সেলিম এখন মলিকে নিয়ে হাওয়া খেতে বাইরে যায়। কফি শপে বসে। মার্কেটে টুকটাক কেনাকাটা করে। টাকার যোগানদার ওয়ান এন্ড অনলি মলি। আম্মা মন্দের ভালো হিসেবে শান্তিতে আছে। কিন্তু অজানা আতংকে আতংকিতও থাকে। আত্মীয়স্বজন বাড়ী বয়ে এসে তথ্য নিয়ে যায় সেলিম কিছু করে কিনা? তাদের মূল উদ্দেশ্য তথ্য কনফার্ম করা আর মনে মনে লাইভ সার্কাস দেখার মজা নেওয়া। শরাফত চাচা আবার এসে হাজির। এসেই ঘোষণা দিয়েছেন বেশিদিন থাকবেন না। বিশেষ কাজে এসেছেন। কাজ শেষেই চলে যাবেন। আসার সময় ক্ষেতের কিছু সব্জী আর ফল-মূল নিয়ে এসেছেন। তার এবারের মিশন হলো আবহাওয়া দপ্তরে চাকরির তদবির। ছোট মামা সরকারি চাকরি করেন। তাঁকে দিয়ে তদবির করাবেন। খবর পেয়েছেন পিওন পদে নিয়োগে পাঁচ-ছয় লাখ লাগে। তাই এসেছেন। টাকা কোন সমস্যা না। খালি নিশ্চয়তা দরকার। আম্মা বিরক্ত। ছোট মামা নিরিবিলি টাইপের মানুষ। তিনি এই ধরণের তদবির করবেন না। শরাফত চাচা উপায়ন্তর না দেখে আমাকে ফোন দিলেন।

    আমি বললাম, “চাচা, আপনি এই বয়সে এগুলো নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করেন কেন”?
    — বাবাজী, গ্রামে থাকলে একে অপরের সুখ-দুঃখ দেখন লাগে।
    — যার তদবিরে এসেছেন সে কি আপনার আত্মীয়?
    — না, না। গ্রাম সম্পর্কে ভাই। তার ছেলের।
    — আজকাল চাকরি কত কঠিন, জানেন?
    — কঠিন আবার সহজও
    — কেমনে?
    — এই ধরো টাকা হলেই সব সহজ
    — টাকা কে নেয়?
    — কে নেয়না বাবাজী? টপ টু বটম
    — এখন কি করবেন? ছোট মামা এগুলোতে ইনভলভ হবে না। তাছাড়া আপনার ইন্টারেস্ট কি?
    — জসীম মিয়ার পোলার চাকরি হইলে হের ক্ষেতটা আমার কাছে বেচবো”।

    তাঁকে নরম গরম বুঝিয়ে বাড়ী চলে যেতে বললাম। তিনি অসন্তুষ্ট হলেন। ভাবটা এমন যে সহজ কাজটা করে দিলাম না। সেলিমকে বাসায় দেখে তার হাজারো প্রশ্ন। তার প্রথম কৌতুহল, সে কি করে? চাকরি না ব্যবসা। সেলিমও কম না। বলেছে আউটসোর্সিং। শরাফত চাচা তা শুনে অবাক। সেলিম প্রথমে হোমিওপ্যাথিক ডোজ দিয়ে এর ব্যাখ্যা শুরু করলো। শরাফত চাচার কানের পাশ দিয়ে তা চলে গেলো। তিনি কিছুই বুঝতে পারলেন না। হা করে তাকিয়ে থাকলেন। এরপর তাকে দেওয়া হলো আয়ুর্বেদি ডোজ। এবারও কিছু বুঝে উঠতে পারলেন না। তবে বিষয়টা যে নতুন এটুকু বুঝতে পেরেছেন। এরপর দেওয়া হলো এলোপ্যাথি ডোজ। এবার তার কাছে বিষয়টা আগের চেয়ে ক্লিয়ার। তিনি এতটুকু বুঝতে পেরেছেন যে, এটা নতুন ধরণের ব্যবসা। মেলা টাকার ব্যাপার। তার লোভাতুর চোখ জিজ্ঞাসু হয়ে উঠে। কৌতুহল চেপে না রাখতে পেরে বললেন, “বাবাজী, কিরকম টাকা লাগে এতে”? সেলিম আরো আকর্ষণীয় করে উত্তর দিলো, “টাকা তেমন লাগে না বললেই চলে। টাকাই বরং হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। শুধু কায়দা মত ধরতে জানলেই হয়”। শরাফত চাচা এর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। অযথা সময় ক্ষেপন করার মানুষ তিনি না।। তিনি বিদায় হলেন। কিন্তু বলে গেলেন, বিষয়টা তার মনে ধরেছে। তার এক ভাতিজা কম্পিউটার ভালো জানে। তাকে নিয়ে আবার আসবেন। সেলিম এগুলো বলে আর হাসে। আপদ তাড়াতে গিয়ে বিপদ ডেকে আনা আর কি।

    এই কয়দিনে শৈলী অসংখ্যবার ফোন করেছে। বেশিরভাগই ধরিনি। কিছু কেটে দিয়েছি। ব্যস্ত বলে কিছু সংক্ষিপ্ত উত্তরে সেরেছি। আর বাকী গুলো নেটওয়ার্ক পুওরের কারণে সম্ভব হয়নি। খাগড়াছড়িতে মোবাইল নেটওয়ার্ক খুবই পুওর। একটু ভেতরে গেলে পাওয়াই যায় না। ডাটাও খুব স্লো চলে। এত কিছুর মধ্যেও ইন্টেরেস্টিং হলো শৈলীর ম্যাসেজ, “আম্মু বলেছে আপনাকে আংকেল বলে ডাকতে”। এটা যে আমাকে ক্ষেপানোর জন্য তা বুঝতে পারি। আমিও পাল্টা বার্তা দিলাম, “তাহলে এখন থেকে তোমার আব্বা-আম্মাকে ভাই-ভাবী বলে ডাকবো”। এরপর আর ম্যাসেজ আসেনি। এখন হয়েছে অন্য বিপদ। ঢাকা টিম ফিরে যাওয়ার পর যতই ফোন দেই শৈলী আর রিসিভ করেনা। বেশি করলে মোবাইল অফ করে রাখে। টেক্সট দিলে রিপ্লাই আসেনা। বালিকা মনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা ভালোই লাগে।

    বেশ চেষ্টা করে অবশেষে শৈলীকে ফোনে পাওয়া গেল। কেন এত চেষ্টা করলাম আমি নিজেও জানিনা। এটা কি নিছক ছাত্র-টিউটর এর দায়? নাকি অন্য কিছু। ফোন ধরেই বললো, “ হঠাৎ”?
    — স্যরি, ব্যস্ত ছিলাম।
    — আমিও।
    — মানে?
    — ড্রিম কামস ট্রু
    — মানে?
    — বুয়েটে হয়ে গেছে।
    — কনগ্রেচুলেশন্স
    — লাগবেনা। বলেই ফোন রেখে দিলো। আমি হতকচিত ও লজ্জিত। এই কয়দিন দুনিয়াদারির কোন খবরই আমি রাখিনি। বুঝলাম বালিকার দিলে চোট লেগেছে প্রচন্ড। কতক্ষণ পরে আবার ফোন দিলো, “আপনার কাজিন ফারিয়া আর ক্লাস মেট মুমুর খবর ভালো”? আমি বিস্মিত। বললাম, “তাদের প্রসঙ্গ এলো কেন”?
    — তাদের খবর তো ঠিকই রাখেন
    — মোটেই না। তাছাড়া ওরা আমার সমবয়ষ্ক। তোমার অনেক সিনিয়র। আমি ক্ষেপানোর জন্য মোক্ষম অস্ত্র ছুঁড়ে দিলাম।
    — তাদের নিয়েই থাকেন। আমি তো জুনিয়র
    — জুনিয়রই তো। বলামাত্রই ফোন কেটে দিলো।

    এই সময় জেমির সরব উপস্থিতির খুব প্রয়োজন। মানুষের মন শূন্যতায় ভেসে বেড়ায়। দমকা হাওয়ায় এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে চলে যায়। কখন কোথায় গিয়ে থিতু হয় তা সে নিজেই বুঝেনা। শুক্রবার বা’দ এশার বয়ানে হুজুরের কথাগুলো খুব কানে বাজছে। সমাজে অস্থিরতার সাথে সাথে ব্যাভিচার বাড়ছে। ছেলে-মেয়ের অবাধ মেলামেশা, বেপর্দা চলাফেরা, পরকীয়া আর জেনা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ছে অবিশ্বাস। ছোট খাটো বিষয় নিয়ে বাড়ছে ডিভোর্স। যে কাজ শরিয়াহ অনুমোদিত নয় সে কাজের প্রচার, প্রসার, পৃষ্ঠপোষকতা, উৎসাহ আর সায় দেওয়াও গুনাহের। তালাক শরিয়াহ সম্মত একটি বিধান। কিন্তু আল্লাহতায়ালার কাছে অত্যন্ত অপছন্দনীয়। তালাকে ইন্ধন দান সমপর্যায়ের অপরাধ, নাপছন্দ কাজ। কথাগুলো বুকে ধাক্কা মারলো। মননে মগজে অনুরণন তুলতে থাকলো। জেমি বিবাহিতা জেনেও তার সাথে সম্পর্কে জড়ানো কি সমপর্যায়ের অপরাধ? এর দ্বারা কি জেমিকে প্ররোচিত করা হচ্ছে? জেমির এই স্বেচ্ছাবিচ্ছিন্নতা কি সংশয়ের নাকি মুক্তির প্রচেষ্টা? এসব প্রশ্নের উত্তর যা-ই হোক , হাজারো যুক্তি মনকে জেমিতেই মোহাবিষ্ট করে রাখে।

    চলবে…