Tag: ধারাবাহিক গল্প

  • কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-৪)

    কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-৪)

    বেলা যখন প্রায় আড়াইটা তিনটা তখন আমরা আমাদের নয়টি পরিবারের জন্য নির্ধারিত কটেজ এ গিয়ে পৌছালাম। এখানে ঘটলো তিন নাম্বার অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা টি।

    আমাদের জন্য যে আট টা কটেজ বুকিং দেয়া ছিলো (কটেজ বুকিং হবার পর আমরা যেহেতু যাবার জন্য রাজি হয়েছিলাম সেহেতু আমাদের জন্য আলাদা কটেজ বুক করা সম্ভব হয়নি বিধায় ফেরদৌস ভাই সুমি ভাবি উনাদের সাথে আমাদের রুম কটেজ শেয়ার করলেন)কিন্তু ওখানে আমাদের পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় এবং ২৬ মার্চের ছুটির কারণে অতিথির অনেক চাপ ছিলো। তাই তারা উচ্চ ভাড়ায় অন্যদের চারটি কটেজ দিয়ে দিয়েছে। আমাদের নয়টি পরিবারের জন্য মাত্র পাঁচটা কটেজ দিলে সাথে থাকা ভাইয়াদের সাথে কটেজ কতৃপক্ষের একপ্রকার ঝুটঝামেলা হয়ে গেল।

    এদিকে বাচ্চাদের খুধা লেগে গেছে বিকেল হয়ে আসছে বিচেও যেতে হবে তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো যেকটা দিচ্ছে, ওকটার ভিতর আগে লাগেজ পত্র রেখে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।সে মতে লাগেজ রেখে আমরা সবাই নিচে নেমে আসলাম। পাশেই খাবার হোটেল সেখানে গিয়ে খাবার অর্ডার দিয়ে বসে গেলাম খেতে। নানা রকম ভর্তা আর সামুদ্রিক মাছের তরকারি দিয়ে খিদে পেটে খুব জমিয়ে খাওয়া হলো।

    খাওয়ার পর আমরা আর উপরে গেলাম না। সেখান থেকেই বিচে চলে গেলাম। শুধু আমার হাসবেন্ড রুমে গিয়ে রেস্ট নিতে চাইলে আমাদের তাকে রেখেই চলে যেতে হলো। বিচে আমরা ও বাচ্চারা অনেক আনন্দ করলাম ছবি তুল্লাম। লাকি ভাবি জীবন ভাইয়ের বড়ো ছেলে আইমান (চুয়েটের কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্ট) ছবি তুলছিল। সামুদ্রিক ঢেউয়ের দোলায় ওর প্যান্টের পকেটে থাকা নতুন মোবাইল পানি বালি ঢুকে ভিজে গেলে বাবাটার মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সাথে আমাদের ও।ভাগ্যিস ডিজিটাল ক্যামেরা টার কোনো ক্ষতি হয়নি! শেষমেশ সূর্য ডোবার পরে সবাই মিলে দল বেঁধে ফিরে এলাম।

    বিচ থেকে ফিরে সবাই গোসল সেরে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। একে একে সব ভাবিরা আমার রুমে চলে এলে আমরা ওখানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম।বাচ্চারা তাদের রুমে।ভাইয়ারা এক টাতে। এরপর ডাক পড়লো নিচে চা নাস্তা খেতে গেলাম। ওখান থেকেই সোজা গাড়িতে করে হাণ্ডি তে গেলাম রাতের খাবার খেতে। ওখানে যাবার পর মানুষের ঢল দেখে তো আমাদের আক্কেল গুড়ুম! একটা টেবিল ও খালি নেই। বাইরেও বিশাল লম্বা লাইন।ভাইয়ারা চেষ্টা করতে থাকলেন,আর আমরা সামনের দোকানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। কেউকেউ কেনাকাটা করলেন।রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা য় আমরা টেবিল খালি পেলাম।তবে খাবার অপ্রতুল! বাচ্চাদের কাচ্চিবিরিয়ানি দিয়ে আমরা পরোটা মাংস সালাদ ডাল যে যা পেলাম ভাগাভাগি করে খেয়ে রাত্রি প্রায় একটার দিকে কটেজে ফিরলাম। দুইজন ভাই সকালের বাসের বন্দোবস্ত করে রাত্রি দুইটায় ফিরলেন।ভোর ছটায় হোটেলের নিচ থেকে রিজার্ভ বাস টেকনাফের উদ্দেশ্যে ছাড়বে।একটু ও দেরি করা যাবেনা। তাহলে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন এর জাহাজ মিস হয়ে যাবে। আমরা সতর্কবাণী শুনে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।

    চলবে…

    ফাতেমা হোসেন
    ১২/৩/২০২২

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (শেষ পর্ব-২১)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (শেষ পর্ব-২১)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    শেষ পর্ব
    দেখতে দেখতে সময় কেটে যাচ্ছে। বদলীর আশা ছেড়ে দিয়েছি। খাগড়াছড়িতে মনঃস্থাপন করার চেষ্টা করছি। ভাবছি পাহাড়ে এক খন্ড জমি কিনতে পারলে মন্দ হত না। সেটা নাকি অফিসিয়ালি সম্ভব না। শৈলী আরেকবার খাগড়াছড়ি , বিশেষ করে সাজেকে আসতে চেয়েছিলো। বলেছিলাম সাজেকে রাত্রিযাপন করলে সান সেটিং আর সান রাইজিং দেখার সুযোগ হবে। বলেছিলো আমি থাকলে সে আসবে। আমাকে ব্লকের মধ্যে ফেলে সে কি জিঘাংসা উপভোগ করছে জানিনা? ইচ্ছে ছিলো জেমিদেরকে এনে একবার ঘুরিয়ে নিয়ে যাবো। সেটাও পরিত্যক্ত প্রকল্পের মত মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ইদানীং চেনাজানা লোকের আগমন নেই বললেই চলে। সারাক্ষণ উন্মুখ হয়ে থাকি এই বুঝি কেউ ফোন দিলো। হাই-হ্যালো করে বললো, “আসছি”। লালনের মন খারাপ। আর তৌহিদ নানাবিধ কাজে ব্যস্ত।

    আজ ফজরের নামায জামাতে আদায় করলাম। মনে বড় তৃপ্তি। চারিদিকের সব কিছুই খুব সতেজ আর প্রাণবন্ত লাগছে। পাখ-পাখালীর ঘুম জাগানিয়া সুমধুর কলতান যুগপৎ কৌতুহল ও আফসোসের উদ্রেক করছে। একদিকে পাখীদের আলাপের মর্মার্থ জানার কৌতুহল হচ্ছে। অন্যদিকে তাদের ভাষা বুঝিনা বলে আফসোসও হচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারিদিকের নিসর্গ দেখছি আর ভাবছি দেখতে দেখতে কিভাবে ছাব্বিশ বসন্ত পার হয়ে গেলো! জীবনের চিত্র-বিচিত্র কত রুপ দেখলাম। কত মান-অপমানের খেলা দেখলাম। ভালবাসাবাসির এই রোদ, এই বৃষ্টিও দেখলাম অনেক। আপন মনেই হেসে উঠলাম। ভালোই হলো। টু বি ওর নট টু বি’র দোলাচালের পরিসমাপ্তি হয়েছে।

    জেমি নারী। আবেগ তার জন্য সহজাত। প্রেম তার জন্য অলংকার। বাস্তবতা তার জন্য নির্ধারিত নিয়তি। তার কথাই হয়ত সত্য। জীবন থেমে থাকেনা। মাঝে মধ্যে দম নেয় মাত্র। নতুন উদ্যমে দৌড়াবার জন্য। যারা দৌড়াতে পারেনা তারা হারিয়ে যায়। জেমির ভবিতব্য জেমি নিজেও জানেনা। সেটা নির্ভর করছে অনেক সমীকরণের উপর। নিজেকে সে ভেবে নিয়েছে ছিটমহলে আটকে পড়া একজন উদ্বাস্তু হিসেবে। শৈলী রঙ্গীন প্রজাপতির মত হাওয়ায় উড়ছে। বয়সটাই তো এমন। উড়তে উড়তেই একদিন কোন ঠিকানায় থিতু হয়ে যাবে নিশ্চয়। আর সাবরিনা? ক্ষনিকের অতিথি সব সময় দোলা দিয়ে যায়। তার ভূত, ভবিষ্যতের গতিপথ অজানা। বাসা থেকে সাবরিনার কথা ছোট মামাকে বলা হয়েছে। মামা সাবরিনার সাথে আলাপও করেছেন। কি যেন একান্ত কিছু কথা আছে তার। সাবরিনা তা সাক্ষাতে বলতে চায়। ছিটমহলে আটকে পরা উদ্বাস্তুর ইচ্ছে ঘুড়ির নাটাই নিজ হাতে থাকেনা।

    এখন সাহস করে প্রায়ই ফিল্ড ভিজিটে যাই। বিকেলে বাসায় ফিরে দেখি টেবিলের উপর কুরিয়ারের খাম। ঔৎসুক্য নিয়ে খুললাম।

    সুজনেষু,
    কোনদিন চিঠি লিখবো ভাবিনি। অনন্যোপায় হয়েই লিখছি। ধরে নাও কৈফিয়ত দিচ্ছি অথবা নিজের পজিশন ব্যাখ্যা করে দায়মুক্তি নেওয়ার প্রয়াস পাচ্ছি। তোমার সাথে আমার পরিচয় পর্ব তেমন সুখকর ছিলনা। ইলমার বড় বোন হিসেবে টিউটরকে একটু পরখ করে নেওয়াই উচিত, তাই ইন্টারভিউ স্টাইলে তোমাকে বাজিয়ে নিয়েছিলাম। তোমাকে দেখেই আমি কেন জানি মনে মনে ‘সিলেক্টেড’ মার্ক দিয়ে রেখেছিলাম। কোন রকম ভণিতা না করেই বলি প্রথম দেখাতেই তোমাকে আমার ভালো লেগে গিয়েছিলো। সে ভালোলাগা ছিলো নিছকই ভালোলাগা। কোনক্রমেই ভালোবাসা বা সিরিয়াস কিছু ছিলো না।

    তুমি খুব ভাল। চেহারায়, স্মার্টনেসে আর সরলতায়। ইলমার মুখে তোমার প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার মনটাও মোহিত হয়ে গিয়েছিলো। তাই পড়া শেষে তত্ত্বতালাশের বাহানায় তোমার সাথে আলাপের ব্যাকুলতা প্রশমন করতাম। ভাবতাম এভাবে আস্তে আস্তে মোহান্ধতা কেটে যাবে। কিন্তু তা হয়নি। উল্টো নেশাক্রান্ত হয়েছি আরো। তাই, নিত্যদিন অপেক্ষায় থাকতাম সেই বিশেষ সময়টুকুর জন্য। আম্মা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। নানাভাবে তার মিশ্র অভিব্যক্তি প্রকাশ করতেন। একজন মেয়ে হয়ে আমি তা ভালোই বুঝতে পারতাম।

    মোহান্ধতা মানুষকে পাল্টে দেয়। মানুষ নিজেও বুঝতে পারেনা যে সে আবেশের ঘোড়ে রয়েছে। বুঝলেও হয় ইগনোর করে নয়ত এনজয় করে। মানুষের যেটাতে ঘাটতি সে সেটা পেলে সেটাতেই ডুবে থেকে সিক্ত হতে চায়। আমিও না জেনে না বুঝে সেরুপ হয়ে গিয়েছিলাম। আমার যে একটা অতীত আছে সেটা তোমাকে বলা হয়ে উঠেনি। আসলে বলার সুযোগও হয়ে উঠেনি। সেটা ছিলো আমার প্রথম ভুল। অল্প বয়সী আবেগে ভেসে এক ছন্নছাড়াকে মনে করেছিলাম ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’র পারফেক্ট শাহরুক। তবে সে মোহ কাটতে বেশি দিন সময় লাগেনি। হঠাৎ একদিন সে উধাও। পাড়ি জমালো বিদেশে। বলতে পারো কারো কথা না শুনেই। সেখান থেকে আরেক দেশে। এরপর আর হদিস নেই। সেই কালো অতীতের উজ্জ্বল প্রমানক যে আমার কিউটি তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছো। আমি তাকে নিয়ে অতীতকে ভুলে থাকতে চেয়েছি ভীষণ ভাবে। হয়ত ভেতরের সেই প্রবল চাপ হাল্কা করতে গিয়েই তোমার সাথে আলাপনের সূত্রপাত করেছি যেচে। এটি ছিলো আমার দ্বিতীয় ভুল।

    সে যাহোক। অবাক হয়ে হয়ত ভাবছো তোমার ঠিকানা যোগাড় করলাম কি করে? আমার এক কাজিন ইউ এন ডি পি তে চাকরি করে। তার মাধ্যমেই এই ঠিকানা পেয়েছি। আমার ফোনের সেই সীম আর ব্যবহার করিনা। সামাজিক সকল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রেখেছি নানা কারণে। তবু তোমাকে না জানিয়ে এই যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতাকে আমি মানসিক ভাবে নিতে পারছিলাম না। তাই কুরিয়ারের আশ্রয় নিয়েছি।

    ইদানীং আমি ভীষণ মানসিক ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এত বছর নিখোঁজ থাকার পর আমার কিউটির জনক বেশ কয়েক মাস যাবত কানাডা থেকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিল। এখন সে দেশেই। পুরুষ মানুষ যেমন ঘাড়ে চাপতে সময় নেয়না তেমনি পা ধরে বসে থাকতেও পিছ পা হয়না। আমরা মেয়েরা এখানেই বারবার ভুল করি । সে ভুলের দায় কি একান্তই মেয়েদের? বিতর্ক করার জন্য এটা উৎকৃষ্ট টপিক হতে পারে, কিন্তু লাভ কি? যে পুরুষ দায়িত্ব কি জিনিস বুঝেনা, শৃঙ্খলা কি জানেনা, সভ্যতা-ভব্যতা কি জিনিস তার পরোয়াও করেনা আখেরে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে সে-ই আসে স্বামীত্ব ফলাতে। হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে তার ঔরসের গরিমা। আমি আর ভুলের ট্রেনে চড়তে চাইনা। তাই কিউটিকে নিয়ে টানা হেচড়া চলছে। আম্মাও সেই তথাকথিত সামাজিক অনুশাসনের পক্ষে গা ভাসিয়ে গো ধরে বসে আছে। আত্মীয় স্বজনরাও একাট্টা। জানিনা আমার কি করা উচিত। মাথা আর কাজ করছেনা। আমার পক্ষে দাঁড়াবার মত কেউ নেই। আমি বড় একা।

    তুমি চলে যাবার পর একাকীত্ব পেয়ে বসে আমাকে। মনে হচ্ছিল কোথাও এতটুকু ছায়া নেই। নিঃশ্বাস ফেলার জায়গাটুকুও আর অবশিষ্ট নেই। সারাদিন তবু কোন মতে কেটে যায়। কিন্তু রাত যত বাড়ে ঘুম তত পালায়। দুঃশ্চিন্তা আর বিষন্নতা এসে ভর করে। তখনি তুমি আসো। আমি প্রবল ভাবে তাড়াতে চাই তোমাকে মনের পর্দা থেকে। অনুভব করতে পারি ‘কাছের তুমি’র চেয়ে ‘দূরের তুমি’ ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে আমাকে আরো গ্রাস করছো। তোমাকে জানাতে লজ্জার কিছু নেই। আমি মানসিক ট্রমার মধ্যে ডাক্তার বান্ধবীর কাউন্সেলিং এ আছি। আমার একমাত্র স্ট্রেংথ আমার কিউটি। আর আমার একমাত্র উইকনেস আমার ‘অতীত’ আর ‘তুমি’। আমি এ থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাই। অতীত নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। পাস্ট ইজ পাস্ট। কিন্তু সাম্প্রতিক ‘তুমি’কে নিয়েই আমার যত যন্ত্রণা, হতাশা আর সংশয়। এ থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছি। ইলমা মাকে সব বলে দিয়েছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। গন্তব্যহীন অনিশ্চিত এই পথ চলা দু’দিন আগে হক আর পরে হোক দশ জনের চোখে পড়বেই। কিউটির বাবার পক্ষে সবাই একাট্টা হয়েছে। তারা উঠে পড়ে লেগেছে আমাকে বেপথ থেকে পথে আনতে। আমার কথা কেউ ভাবেনা। নিজের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হয়ে যাচ্ছে। জানিনা শেষতক কোথায় আমার গন্তব্য?

    ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিও। আমার জন্য ভেবো না। মেয়েদের নিয়ে এত ভাবাভাবির কিছু নেই। যে পাত্রে রাখা হবে সে পাত্রেই সে ধাতস্থ হয়ে যাবে। হয়ে যেতে হয়।

    তোমার পক্ষে যেমন সাজেনা জীবন নিয়ে কোন এক্সপেরিমেন্ট। তেমনি আমার পক্ষেও শোভনীয় নয় চিত্ত চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে এমন কোন প্রজ্জ্বলন। শেষ করছি জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের পুরোনো দিনের গান দিয়ে। কেন জানি ভাবতে ভালো লাগে গানের কথাগুলো যদি সত্যি হত।

    পৃথিবীর যেখানে যত খাঁচার পাখী
    উড়িয়ে দেওয়া যেত যদি
    কত ভাল হত।
    হেলা ভরে ফেলে দেওয়াদের যতন করে কুড়িয়ে নেওয়া যেত যদি
    কত ভাল হত।
    কোথাও আলো সূর্য সমান কোথা চির অমানিশা
    কোথা অগুণ্তি ধারা বহমান কোথাও মরুতৃষা
    সে আলো সে জল সমানুপাতে ছড়িয়ে দেওয়া যেত যদি
    কত ভাল হত।

    কোথাও শুধুই চাওয়া চাওয়া কোথাও পাওয়ার ক্রান্তি
    কোথাও হিসাব নিজেই মিলে কোথাও শুধু ভুল ভ্রান্তি
    ভুল হিসেবের ভুল চাওয়াকে ছড়িয়ে দেওয়া যেত যদি
    কত ভাল হত।

    ইতি,
    ছিটমহলে আটকে পরা উদ্বাস্তু, একজন জেমি।

  • ফিরে আসার পর (পর্ব-২)

    ফিরে আসার পর (পর্ব-২)

    শাহেদের যেহেতু কোনও চাকরি ছিল না, কাজেই মিথির বাবা বিয়ের পর পরই তার নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে মাসে মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকা হাতখরচের জন্য রেখে দিতেন। শাহেদ সে টাকা খরচ করতো। মিথির শরীর দিন দিন দুর্বল হতে থাকে, শাহেদের এ ব্যপারে কোনও মাথাব্যথা ছিল না, বরং বিরক্ত লাগত। মিথি রাত হলে পাশের রুমে চলে যেত। মিথির মনে ক্ষীণ আশা ছিল, হয়ত তার স্বামী তাকে শরীরের অবস্থা জানতে চাইবে, তার জন্য ভালমন্দ এটা সেটা আনবে।কিন্তু বাস্তবে এ ধরণের কোনও ঘটনাই ঘটল না। মিথির তখন কেবল মনে হত, বাচ্চা হওয়ার পর নিশ্চয়ই শাহেদ আর এমন থাকবে না।

    এভাবেই মিথির ডেলিভারির দিন এগিয়ে আসল। শাহেদ এরই মাঝে সরকারি একটি চাকরীতে রিটেনে এলাউ হয়েছে। আজ তার ভাইবা, কাজেই একদিকে মিথির হাসপাতালে যাওয়া আর আরেকদিকে শাহেদের ভাইবা দিতে যাওয়া। মিথির নর্মাল ডেলিভারি সম্ভব হল না, সিজারিয়ান অপারেশন করে জমজ কন্যা সন্তানের মা হল সে। মিথির পাশে তার মা বাবা,বোন বোনজামাই ছিলেন, শাহেদ ছিল না।

    মিথির মা নাতনীদের নখ চুল কেটে দিলেন, গোসল দিলেন, আজ সাতদিন হয়। খবর পেয়ে শাহেদের বাবা মাও এলেন। শাহেদ এলো এর একদিন পর।

    কোথায় ছিল সে এতদিন, উত্তর নাই। শাহেদ মেয়েদের মুখ দেখে মিথির দিকে তাকিয়ে বললো, একসাথে দুই মেয়ের কি দরকার ছিল!

    মিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, শাহেদ তার রুমে চলে যায়। এর ঠিক এক মাস পর শাহেদের সরকারি চাকরিটা হয়ে যায়। শাহেদ এখন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। তার পোস্টিং অন্য জেলায় কাজেই সে ওখানেই চলে যাবে।

    অসংখ্য প্রশ্নবোধক চিহ্নে জর্জরিত মিথির চিন্তাক্লিষ্ট মুখ কেবল দেখল শাহেদের নিস্পৃহ চলে যাওয়া।
    মিথি একদিন শাহেদকে বলেছিল, ‘আপনার যদি এতটাই অমত ছিল তবে বিয়ে করেছিলেন কেন? মেয়েদের দিকেও আপনি ফিরে তাকান না?’-

    জবাবে শাহেদ নিষ্ঠুর এক বক্র হাসি উপহার দিয়েছিল।
    শাহেদ চলে যাওয়ার পর মিথি অপেক্ষা করেছিল শাহেদ ফোন দিবে, না দেয়নি,নাম্বারও আগেরটা নেই। শাহেদ যেন হারিয়েই গেল মিথির জীবন থেকে।

    কলকল হাসিতে শাহেদ চমকে তাকায়। রানু ওর ভাইবোনদের নিয়ে আনন্দে মেতে আছে। নীল শাড়িতে রানুকে আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে,৷ ইচ্ছে করছে ওর পাশে যায়, ওদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠে।
    কষ্টে সেই ইচ্ছেকে দমন করে শাহেদ। রানু হয়ত বিষয়টা পছন্দ নাও করতে পারে। রানুর পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব অনেক বেশি শাহেদের কাছে।

    আসলে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে শাহেদ বড় হয়েছে অনেক টানাপোড়েনের মাঝে। মনের মাঝে বড় স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন পূরণের জন্য যা যা করতে হয়েছে শাহেদ তাই করেছে নির্দ্বিধায়। সে মস্ত বড় অফিসার হয়েছে, আরাধ্যা রানুকে পেয়েছে।

    যদিও রানুর বিষয়টি শাহেদের কাছে দুর্বোধ্য অনেক, রানু তাকে কতটা ভালবাসে কিংবা আদৌ ভালবাসে কি না সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না শাহেদ। তারপরও রানুর মত মেয়ে তার স্ত্রী, যা বন্ধুমহলে ঈর্ষার কারণ, তার শ্বশুরবাড়িও অনেকের ঈর্ষার কারণ, শাহেদের মহাতৃপ্তি ওই এক জায়গায়।
    রানু শাহেদের জুনিয়র ছিল। ভার্সিটিতে এমন কোনও ছেলে বোধহয় তখন কম ছিল যে রানুর সাথে একটু কথা বলতে পারলে ধন্য হত না।

    গ্রাম থেকে আসা শাহেদের চোখে রানু ছিল স্বপ্নের রাণী। রানুর চোখে পড়ার জন্যই শাহেদ ভাল প্রোগ্রামে যুক্ত রাখত নিজেকে, সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করার চেষ্টা করত। অবশেষে রানুর চোখে সে ধরা পড়েছিল বটে। তবে রানু শাহেদের প্রেমে পড়ে নাই। রানুর সুবিধা অসুবিধায় শাহেদ দৌড়ে যেত। সেরকমই একবার রানুর এক মামার জন্য নিজের রক্ত দিয়েছিল শাহেদ, গ্রুপটা ছিল রেয়ার। কাজেই সে সূত্রে রানুর কাছাকাছি আসার সুযোগ পায় শাহেদ। এরপর থেকে চিনাজোঁকের মতই রানুর পিছে লেগেছিল শাহেদ।

    রানুর বাবা তখন বড় কর্মকর্তা, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, কাজেই রানু তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছিল তুমি আগে আমার যোগ্য হও, তারপর ভেবে দেখব। শর্ত মেনেই রানুর সাথে শাহেদের সম্পর্ক, কিছুটা দূরত্ব ছিল সেই দূরত্ব আজও আছে কিনা শাহেদ বুঝতে পারে না।

    বাবার মন রাখতে গিয়ে শাহেদ বিয়ে করেছিল বটে, তবে সেসব শাহেদ মনে করতে চায় না, বাবার বাড়ির কারও সাথে শাহেদ সম্পর্কও রাখে না। শাহেদের জীবন এখন কেবলই রানুময়।

    শেষ যখন শাহেদ বের হয়ে এসেছিল — তারপর ঝাড়া দু’বছর লেগেছিল শাহেদের নিজেকে গুছাতে, রানুর উপযুক্ত হতে। শাহেদ হিসেব করে মনে মনে রানুর সাথে তার পাঁচ বছরের সংসার চলছে। রানু হাসছে, শাহেদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, রানু সেই আগের মতই আছে।

    শহর থেকে কিছুটা দূরে নতুন একতলা বাড়িটা। বাড়ির কাজ চলছে পুরোদমে। শাহেদ তৃপ্তি নিয়ে দেখে, এই প্রথম সে একটা দামী উপহার রানুকে দিতে যাচ্ছে সে।যদিও রানুর কোনও শখ সে অপূর্ণ রাখেনি। কিন্তু এই যে বাড়িটা শাহেদ রানুর নামে করে দিচ্ছে রানু খুশি হবে, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও নিশ্চয়ই খুশি হবে।

    বিবাহিত জীবনে রানুর কোনও দুঃখ নেই, বরং শাহেদ না চাইতেই সব দেয়, একটু বেশিই দেয়। রানুর কেবল মাঝে মাঝে একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে।

    বিয়ের দশ বছর হতে চলল তাদের কোনও সন্তান নেই। রানু এ বিষয়টা কৌশলে এড়িয়ে যায়। কারণ সে জানে শাহেদ আগে বিয়ে করেছিল যদিও ওদের সাথে শাহেদের কোনও যোগাযোগ নেই। আর এও জানে যে শাহেদের জমজ দুটো কন্যা সন্তান আছে। কাজেই শাহেদের কোনও দোষ নেই, দোষ থাকলে রানুর। রানু নিজেই ভাবে তার নিজেরই মনে হয় মা হবার ক্ষমতা নেই। তার নিজেরই দোষ,কাজেই সে নিজে থেকে চুপ থাকে,শাহেদও কিছু বলে না। রানুর সংসারের সাথে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সম্পর্ক নেই, কাজেই তাকে কথা শুনানোরও কেউ নেই।

    চলবে…

  • ফিরে আসার পর (পর্ব-১)

    ফিরে আসার পর (পর্ব-১)

    পুকুরের এ পাশটায় পাকা ঘাটের পাশে একটা পাকা বেঞ্চ আছে। শাহেদ সেই কখন থেকে এখানেই বসে আছে। জানালার পাট বন্ধ, তবু ফাঁক গলে আলোর রেখাগুলো বের হয়ে আসছে। কাঠের জানালাগুলো কি আগের মতই আছে নাকি আরও ভেঙে গেছে!

    শাহেদ আনমনে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে ওপাশটা যদি দেখা যেত! কী করছে মিথি এখন?

    হঠাৎ করে এত বছর পর শাহেদকে দেখে তার মনের ভাব কী হতে পারে? সে-কি দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে নাকি কাছে টেনে নেবে? কিছুই জানা নেই তার। অনিশ্চয়তার দোলাচলে তার সময়টা যাচ্ছে।
    খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাড়িটা দরজার গিয়ে কড়া নাড়তে। কিন্তু কি এক অদৃশ্য অনুভূতি তাকে আটকে রাখছে পাকা বেঞ্চটির উপর। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে, ক্লান্ত অবসন্ন মন একটু বিশ্রাম চায়,কিন্তু!!
    পাকা বেঞ্চটি বেশ চওড়া অনায়াসে শোয়া যায়। সাথে থাকা নিত্য ব্যবহার্য কিছু কাপড় ভর্তি ব্যাগটি মাথার নিচে দিয়ে শাহেদ সটান লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বেঞ্চটিতে।

    দীর্ঘ জার্নি শেষে অবসাদে ঘুম আসার কথা, কিন্তু ঘুম আসছে না,কোন মুখ নিয়ে সে দাঁড়াবে মিথির সামনে!

    আজ বার বার মনে পড়ছে বিশ বছর আগের কথা।

    শাহেদ তখন সদ্য ভার্সিটি পাশ করে বের হওয়া টগবগে যুবক। এতটা মেধাবী না হলেও মোটামুটি মেধাবী সে ছিল, ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র, কাজেই একটা ভাল সরকারি চাকরির আশায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে।

    শাহেদের বাবা টেনেটুনে সচ্ছল, কাজেই ছেলেকে এতদূর পড়াতে তার বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তাছাড়া উনার আরও সন্তানাদি রয়েছে, তারাও পড়ছে, কাজেই তার সমস্ত আশা ভরসা ওই শাহেদ। শাহেদের বাবার বন্ধুর ছয় মেয়ে। পাঁচ মেয়েকে ভাল পরিবারেই পাত্রস্থ করেছেন, যেহেতু ছেলে নেই কাজেই ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজেদের কাছেই রাখার ইচ্ছে। কাজেই বন্ধুর কাছেই মনের কথা পাড়লেন।

    শাহেদের বাবা প্রথমত ইতস্তত করলেও পরে ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে রাজি হয়ে যান, কারণ বন্ধুর মেয়ের সাথে সম্পত্তি লাভের একটা সুস্পষ্ট ইংগিত তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। কাজেই শাহেদের ঘোর অনিচ্ছাসত্তেও বাবার মতের বিরুদ্ধে যাবার সাহস হয় নি,মিথির সাথেই শাহেদের বিয়ে হয়ে গেল।

    শাহেদের বাবার বুদ্ধি বেশ পাকাই ছিল। বিয়ের আগে মিথির বাবা নিজের বাড়িটা ছোট মেয়েকে লিখে দেবেন বলেছিলেন তবে সেটা ভবিষ্যতে। কারণ পুত্রহীন মিথির বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব যে শাহেদকেই নিতে হবে।

    শাহেদের বাবার বায়না ছিল বাড়ি এবং আর যা কিছু আছে তা বিয়ের আগেই লিখে দিতে হবে। যেহেতু মিথির আরও বোন আছে কাজেই অনেক দেন-দরবার শেষে মিথির বাবা বাড়িটা মিথি ও শাহেদের নামে লিখে দিলেন,তবে পূর্ণ মালিকানা পাবে তারা কেবল মিথির বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর।

    বিয়ের পর শাহেদ শ্বশুরবাড়ি উঠে এল অনিচ্ছাসত্ত্বেও।

    মেয়ে হিসেবে মিথি মন্দ নয়, যদিও অন্য বোনদের তুলনায় সে তেমন সুন্দরী নয়। কিন্তু শাহেদ কেন যেন মিথিকে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। শাহেদের মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও, মিথি বুঝতে পারে। স্বামী স্ত্রীর সব সম্পর্ক বজায় রাখলেও মিথি শত চেষ্টা করেও শাহেদের মন ছুঁতে পারে না যেন। কাছাকাছি থাকা আর একে অন্যকে বুঝতে পারা এক নয়। স্বাভাবিক নারী হৃদয় দিয়ে মিথি কিছু একটার অভাব বুঝতে পারে, কিন্তু কী সেটা তা বুঝতে পারে না।

    শাহেদ দিনরাত বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকে। তার জগৎ আলাদা। একটা চাকরি, ভাল চাকরি তাকে পেতেই হবে। বাহ্যিক দিক থেকে শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চললেও কেবল মিথির ব্যপারে তার চরম নিঃস্পৃহতা মিথিকে ব্যকুল করে দেয় সময় সময়। প্রাণপনে স্বামীর মন পেতে চেষ্টা চালিয়ে যায় মিথি।

    মিথির একতরফা আকুলতা শাহেদের বিরক্তিকর মনে হয়। তা প্রকাশ করতে এতটুকু দ্বিধা বোধ তার নেই।কেবল শরীরের প্রয়োজন ছাড়া আর কোনও চাহিদায় মিথিকে যেন কাছে টানতে নেই। মিথি তবু আশায় বুক বেধে রাখে, হয়ত একদিন সে শাহেদের মন জয় করতে পারবে।

    খাবার টেবিলে মিথির বাবা শাহেদকে তার ব্যবসা দেখার অনুরোধ করলেন। মিথির বাবা মা দুজনেই অসুস্থ, হার্টের রোগী। এমতাবস্থায় শাহেদের হাতে সবকিছুর ভার দিতে পারলে তিনি যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হন। ব্যবসাটা তেমন বড় নয়, মার্কেটে দুটো কাপড়ের দোকান আছে, ভাল চলছে, শাহেদ কেবল একটু দেখাশোনা করবে।

    “বাবা,আমার এসব ব্যবসা পছন্দ নয়, আমি চাকরি করব। এত লেখাপড়া করে ব্যবসা করব, এ আমার পছন্দ নয়”।

    শাহেদ প্লেটের খাবার দ্রুত শেষ করে রুমে চলে যায়।

    মিথিও পিছু পিছু আসে। “তুমি বাবার কথা রাজি হলেও তো পারতে”– মিথি মৃদু গলায় অনুযোগের সুরে বলে।

    শাহেদ রাগত চোখে মিথির দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। দু’দিন ধরে শাহেদের খবর নেই।
    তার গ্রামের বাড়ি, আগের মেসবাড়ি সবখানেই খবর নেয়া হল, কোথাও যায়নি সে।

    দু’দিন পর বাড়ি ফিরল শাহেদ। দুশ্চিন্তায় মিথির কেমন দিন কাটল তা মিথিই জানে কেবল, আর সাথে বাবা-মাও। মিথি শাহেদের কাছে জানতে চায় কোথায় ছিল সে।

    জবাব শাহেদের রাগত উত্তর
    “তোমার কি মনে হয় আমাকে কিনে নিয়েছ তোমরা? আমার যখন যেখানে খুশি যাব, তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও যেও”। সটান বিছানায় শাহেদ, একবারও জানতে চাইল না মিথি কেমন আছে।

    মিথির শরীরটা ভাল যায় না, বিয়ের মাসখানেক পরই সে কনসিভ করে। শাহেদের তাতে কোনও মাথা ব্যথা নেই। বরং রাতে যখন তার ঘুম আসে না, যখন তখন বমি আসতে থাকে মহাবিরক্ত হয়ে শাহেদ তাকে অন্য রুমে চলে যেতে বলে। তার ঘুমের নয়তো লেখাপড়ার ব্যঘাত হয়।

    চোখের জল মুছতে মুছতে মিথি অন্য রুমে চলে যায়, কিন্তু শাহেদের এই নিষ্ঠুরতার কথা সে কাউকেই বলতে পারে না।

    চলবে…

  • কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-৩)

    কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-৩)

    শুরুতে একটা কথা বলে রাখি। আমার শ্বশুর বাড়ি ঢাকায়,আর বাপদাদার বাড়ি কুস্টিয়ার মেহেরপুর। আর আমরা চট্টগ্রামে থাকতাম। ননদ ভাসুরেরা সবাই ঢাকায় থাকেন। তাই ছুটিছাটায় ঢাকায় আসতে হতো, আবার বাবার বাড়ি যাবার জন্যও ঢাকা হয়েই যেতে হতো। উনি যখন রেলওয়ে তে চাকরি করতেন তখন ফার্স্ট ক্লাস রিজার্ভেশন পাশ পেতেন বলে তখন সব সময় রাতে সাড়ে দশটার মেইল ট্রেনেই আসা-যাওয়া করতাম। তারপর চাকরি ছেড়ে দিলেন। এরপর ও দু’বছর পাশে ট্রেনেই আসা-যাওয়া করেছি।

    তারপর থেকে ঢাকায় আসার সময় সকালের ট্রেনে আসি যাওয়ার সময় বিকেলের ট্রেনে। সুবর্ন ট্রেন চালু হবার পর আর কথাই নাই। সকাল আর বিকাল চালু আছে এখনো। উনি প্রয়োজনেও পারতপক্ষে বাসে উঠেন না।

    আর যেদিন ঢাকায় আসার থাকে সে রাতে উনি একটুও ঘুমান না এবং সবাই কে আজানের আগে উঠিয়ে দেন, রেডি হবার জন্য। আর ট্রেন ছাড়ার অন্তত দেড়ঘন্টা থেকে এক ঘন্টা আগে স্টেশনে পৌঁছে বসে থাকবেন সেও ভালো। এখনো ঐ নিয়ম চালু আছে। হাজার বুঝিয়ে শুঝিয়ে এমনকি রাগ করেও লাভ হয় নি।

    তো সেদিন ও আটটার গাড়ি ধরতে আমরা ছটায় আগ্রাবাদ থেকে গরীবুল্লাহ শাহ মাজারে পনের মিনিটের মধ্যে পৌঁছে গেলাম।আর অন্যদের জন্য কাউন্টারে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম।মোটামুটি সাড়ে সাত টার পরে একে একে পৌনে আটটা, কেউ আটটায় এসে পৌঁছালো।

    কিন্তু বাস বাবাজির খোঁজ নেই।তিনি নাকি বিয়ের ট্রিপ নিয়ে কুমিল্লায় আটকে আছেন সেকথা অনেক বাকবিতন্ডার পর জানা গেল।এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না। কতৃপক্ষ একখানা মোটামুটি বাসের ব্যাবস্থা করলে বেলা দশ টা র দিকে আল্লাহর নাম নিয়ে কক্সবাজার রওনা হলাম। সব কাপলকে জোড়ায় জোড়ায় বসতে বলা হলে আমার আন রোমান্টিক হাসবেন্ড সদ্য তব্দাখাওয়া চেহারা নিয়ে আমার পাশে চুপচাপ বসে গেলেন।

    বাচ্চারা যেহেতু নার্সারি ক্লাস থেকে বন্ধু, তাই তারা আব্দার করলো একসাথে বসার। তাদের আবদারে কোনো অভিভাবক ই আপত্তি করলেন না। অতিথি পরিবার গুলো আলাদাভাবে তাদের নিজস্ব গাড়িতে করে গিয়েছিলেন!

    সেদিন রাস্তায় প্রচুর জ্যাম ছিলো। অনেক থেমে থেমে যেতে হচ্ছিল। এরমধ্যে বাসেই আমাদের মধ্যে নাস্তা বিতরণ করা হল। আমি ও ও অন্য ভাবিরা আলাদা আলাদা করে কিছু কিছু বাড়তি খাবার আনায় দেরি হলেও পেটপুরতি নিয়ে দুশ্চিন্তা কম হচ্ছিলো।

    তারপর একসময় ফোর সিজনে যাত্রাবিরতিতে আমরা সবাই ফ্রেস হয়ে আরেকদফা নাস্তা, চা -কফি খেয়ে বাইরে একটু ঘোরাঘুরি করে হাত পা ঝাড়া দিয়ে আবারও বাসে উঠে বসলাম।

    চলবে…

    ফাতেমা হোসেন
    ৯ই মার্চ, ২০২২ইং

  • কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-২)

    কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-২)

    নয়টি পরিবারের ( আমার পরিবার ছাড়া) প্রায় প্রতিটি পরিবার ই একাধিক বার কক্সবাজার দর্শনের অভিজ্ঞতা আছে।কারো কারো সেন্টমার্টিন ও।তবে তা হাতে গোনা। আমিও বিয়ের আগে, আমার হাসবেন্ডও বিয়ের আগে এবং বিয়ের পরে একাধিক বার বিভিন্ন দলের সাথে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে কক্সবাজারে গেলেও আমার আর বাচ্চাদের কখনো যাওয়া হয়নি। সেন্টমার্টিন তো নয় ই।

    তাই প্রথমে ঠিক করা হল কক্সবাজারে না থেকে সেন্টমার্টিন এই থাকার।চাঁদনি রাতে প্রবাল দ্বীপের মোহময়ী রূপ নাকি দেখবার মতো একটা ব্যাপার! কিন্তু বারো মুনির বার মতে শেষ পর্যন্ত সেন্টমার্টিন এ রাত কাটানোর প্রস্তাব টা ধোঁপে টিকলো না।সিদ্ধান্ত হল দিনে গিয়ে দিনে ফেরার।

    বাস কনফার্ম, কটেজ কনফার্ম। খাওয়া দাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা হয়েও আবার সবাই একমতে পৌছলেন একসাথেই এবং সবাই মিলে একই খাবার খাওয়া হবে।

    সব যখন ঠিকঠাক তখন প্রথম অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলো আমার বাসায়। ২২/৩ এ সকালে আমার হাসবেন্ড চা খাওয়া শেষ করে ওয়াস রুমে যাচ্ছেন ফিরে এসে নাস্তা করবেন। এমন সময় ল্যান্ড ফোনে একটা কল এলে আমিই ধরলাম, উনাকে চাইছে উনি পিছন ফিরে জানতে চাইলে আমি ইশারা করে ধরিয়ে দিলাম। কল রিসিভ করেই নিমিষেই উনি পুরা ফ্যাকাশে হয়ে গেলেন।আর বারবার অনুনয় বিনয় করে তাদের কাছে মাফ চাইছেন। উনি মানসিক ভাবে খুবই নার্ভাস প্রকৃতির সাথে নির্ভেজাল মানুষ। হাইপার টেনসনের পেসেন্ট! ব্যাপার টা কি বুঝার জন্য আমি চট করে উনার হাত থেকে ফোন টা কেড়ে নিয়ে রেখে দিই।উনার কাছে সামান্য শুনে বললাম এগুলো কেউ দুস্টামি করছে তুমি যাও ফ্রেস হয়ে এসে নাস্তা খেয়ে নাও।ফোন আসলে আমি ধরবো। উনি অনেক উৎকন্ঠা নিয়ে ওয়াস রুমে গেলেন!

    কল এল, আমি ধরলে অপর প্রান্ত থেকে বল্লো ভাইজান কই।আমি বললাম উনি ওয়াস রুমে গেছেন। তারা বিশ্বাস করলো না বল্লো বেশি চালাকি করতে মানা কইরেন। আমি তখন ক্ষেপে গিয়ে বললাম আমরা নিরীহ মানুষ, কারো সাথে পাঁচে নাই আমাদের সাথে এমন করছেন কেন? আপনারা কি চান আর আপনারা কারা? আমাকে বকা দেয়া শুরু করলে আমি রেখে দিলাম।

    উনি ওয়াস রুম থেকে বেরিয়ে ছোটো ছেলে খেলতে গিয়েছিল আর্টিলারি মাঠে তাকে ডেকে পাঠালেন। আবারও কল আসলে উনি ধরলে তারা অকথ্য ভাষায় গালাগালি শুরু করে দিলে উনি প্রায় কান্না শুরু করে দিলেন।

    উনি ওয়াস রুমে থাকা অবস্থায় আমাদের এক পারিবারিক শুভাকাঙ্ক্ষী ছোটো ভাই নিজামকে ফোন করে আসতে বলেছিলাম।নিজাম স্থানীয় ছেলে, পরিবার নিয়ে থাকে নিমতলায়। সুখে দুখে, বিপদ আপদে সবসময় তার ভাইয়ার পাশে থাকে। নিচে আমার দেবরের পরিবার ছিলো। ওর ছেলে শিহাবকে ডাকলাম। আমার বড়ো ছেলে গাজী নয়ন তখন ঢাকায় পড়াশোনা করে।

    নিজাম আসার আগেই আমার ছোটো ছেলে ও শিহাব এসে হাজির। আমি, ফাহমিদ ও শিহাব মিলে উনাকে বুঝাতে চেষ্টা করলাম মাত্র পাঁচ হাজার টাকা যাদের ডিমান্ড তারা কোনো বড়ো সংগঠন নয়।পাড়াইল্যা পোলাপান ই হবে তুমি নরম মানুষ দেখে হয়তো দুস্টুমি করছে।

    উনি আমাদের কথা কানে নিলেন না নাস্তা খেলেন না।নিমতলা থেকে নিজাম আসতে আসতে উনি বারবার তাড়া খেয়ে ভয় পেয়ে শিহাব কে পাঁচ হাজার টাকা আর ওদের দেয়া রকেট নাম্বার দিয়ে পাঠিয়ে দিতে বল্লেন। আমি ইশারা করে শিহাব কে চলে যেতে বললাম।শিহাব চলে গেলে নিজাম এল। ও, সব কথা শুনে একই কথা বল্লো। কেন দিলেন। এটা কোনো দুস্ট চক্র হবে।উনি বললেন, না তুমি বুঝছো না তোমার ভাবি ফাহমিদ বাইরে যায়।ওরা যদি কোনো ক্ষতি করে দেয়।শিশুর মতো কথা শুনে আমরা মুখ টিপে হাসি আর উনার জন্য চিন্তা করি।

    এর মধ্যে আবার কল টাকা পাঠিয়েছে জেনেও বকাবকি। এখনো তারা পাইনি।

    উনি প্রায় মূর্ছা যান।এমন অবস্থায় নিজামকে পাঠালেন শিহাবের খোঁজে। নিজাম ডানে বায়ে কোথাও খুঁজে না পেয়ে চলে আসলো।শিহাব কে পাবে কোথায়! সেতো চাচাকে শান্ত করতে আমার ইশারায় টাকা নিয়ে নিজ বুদ্ধি খাটিয়ে ঘরে গিয়ে দিব্বি বসে আছে। আবারও ফোন। পাঠানো হয়েছে বলার পরেও হুমকি ধামকি। নিজাম বল্লো ভাইয়া, “ওরা পেলেও এরকম করে। আপনি চুপচাপ থাকেন কল রিসিভ করেন না।

    সারাদিন চুপচাপ থাকলেন।বেরোলেন না। পরদিন টিভি প্রোগ্রাম তখনও কল আসছে। রিসিভ না করাতে মোবাইলে গালি গালাজ করে ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে ।উনি ঘটনার আকস্মিকতায় তব্দা খেয়ে বসে আছেন। নিজামকে সাথে করে টিভি প্রোগ্রাম করে আসলেন। নিজামকে নিয়েই সন্ধ্যার দিকে একটু মোড়ের দোকানের দিকে গেলেন। আমিও লাস্ট মোমেন্ট এর কেনাকাটার জন্য এক ভাবির সাথে লাকি প্লাজায় গেলাম।

    পরদিন সকাল আটটায় বাস। অনেক ভোরে রওনা হতে হবে।

    চলবে…

    ফাতেমা হোসেন
    ৮/৩/২

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২০)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২০)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (২০)
    কেবলমাত্র অসুস্থ হলেই সবার জীবনবোধ জাগ্রত হয়। মনে হয় দুনিয়াবি জীবন খেল তামাশা মাত্র। যে ঔজ্জ্বল্যের মোহে আমরা প্রাণান্তকর দৌড়ঝাঁপ করি দিন শেষে তা অধরাই থেকে যায়। দৌড়ের মাইল পোস্টটা কেবল সামনে সরে যায়। পৃথিবীর সকল সুস্থ মানুষকেই মনে হয় সবচেয়ে ভাগ্যবান। আর নিজেকে জীবন যুদ্ধে পরাস্ত সৈনিক বলে মনে হয়। ইমাম সাহেবের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। এক বয়ানে তিনি বলেছিলেন সুস্থতা যেমন আল্লাহর নিয়ামত তেমনি অসুস্থতাও। সুস্থতা মহান আল্লাহর নিয়ামত এটা সহজবোধ্য। তাই বলে অসুস্থতাও? তিনি ব্যাখ্যা করলেন। অসুস্থ হলে আমরা সুস্থতার মজা উপলব্ধি করতে পারি। অসুস্থ হলে আমরা সৃষ্টিকর্তাকে যেমন প্রতি পদে পদে স্মরণ করে থাকি তেমনি তাঁর কাছে উপুর্যুপরি মিনতিও করে থাকি। যে যতটুকু পারি এবাদত-বন্দেগীতে, তাওবা-এস্তেগফারে মশগুল হয়ে পড়ি। অথচ সুস্থ থাকলে, এত গভীরভাবে কোনদিনই আমল করা হয়ে উঠেনা। সত্যিই তো! অসুস্থতাও তো একপ্রকার নিয়ামত। আর অসুস্থ হলেই মানুষ নানাবিধ বিষয় নিয়ে সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে। চারপাশের অতি আপনজনের ছোট খাটো বিষয়গুলোও তখন প্রকট হয়ে দেখা দেয়।

    ঢাকায় যাওয়া বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে। নিউরো ডাক্তারের ফলো আপ ভিজিটের আগেই কাউন্সেলিং করা দরকার। তৌহিদের কল্যাণে তার পরিচিত দুরসম্পর্কীয় আত্মীয় সায়ক্রিয়াট্রিস্টের কাছে বুকিং দেওয়া হয়েছে। মোট ছয় সেশন দিতে হবে। প্রগ্রেস ভালো হলে চারেই শেষ হতে পারে। প্রথম দিন ব্রিফিং এন্ড ইনফরমেশন কালেক্টিং। প্রতিদিন এক দেড় ঘন্টার সেশন। এ ধরণের কাউন্সেলিং এর কথা শুনেছি। কিন্তু নিকটজন কেউ করেছে শুনিনি। না শুনলেও, কেন জানি নেগেটিভ একটা ইমপ্রেশন মননে-মগজে ছায়াপাত করে আছে। এরা নাকি ম্যাসমারিজম জানে। নীলাভ আলোতে বসিয়ে কি-সব বলে কয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়। তারপর রুগী আপন মনে তার ভেতরগত ব্যাথার অকথিত কাহিনী গড়গড় করে বলে যায়। সায়ক্রিট্রিস্ট তার নিজের উত্তর পাওয়ার জন্য নিজেও কিছু প্রশ্ন করে সেগুলো বের করে আনে। এগুলো রহস্যোপন্যাস বা গল্প-কাহিনী, সিনেমা ইত্যাদি দেখে-শুনে জেনেছি। প্রথম দিন তৌহিদকে নিয়েই সায়ক্রিয়াট্রিস্টের চেম্বারে গেলাম। চেম্বারের সামনে কয়েকজন বসা। সবাই চুপচাপ। তবে তাদের চোখের নড়াচড়া পাগল পাগল টাইপের মনে হলো। ভয় ঢুকে গেলো মনে। কাউকে কাউকে পায়চারি করতেও দেখলাম। মনে হয় ভেতরে প্রবল স্যুনামী হচ্ছে। কাউকে দেখলাম আত্মীয় স্বজনরা ঘিড়ে ধরে বসে আছে। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। তৌহিদ সাথে থাকায় কিছুটা ভরসা পাচ্ছি। কতক্ষণ পর আমার ডাক এলো। রুমে ঢুকলাম। সাদা এপ্রোন পড়া একজন এসে আমার চৌদ্দ গুষ্ঠির কুষ্ঠি টুকে নিয়ে গেল। রুমে আমি একা। আলো কম। এসির বাতাস যথেষ্ট বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণ পর সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এলেন। ডিটেক্টিভ টাইপের প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আমার কাছে তাকেই উদ্ভ্রান্তের মত মনে হলো। মধ্যবয়সী। মুখে হাসির বালাই নেই। চোখ পানসে। কথা বলেন আর হাতের কলম কিছুক্ষণ পর পর নাকে ঠেকান। হয়ত এটা তার বদ অভ্যেস। আমাকে কেন কাউন্সেলিংয়ের জন্য প্রেসক্রাইব করা হয়েছে আমি জানিনা। আমি তো পাগল না। মাথার বিষয়টা আগের চেয়ে অনেক ইমপ্রুভ করেছে। মনে মনে ধরেই নিয়েছি উনি আমার ভেতরের কথা বের করে মাথার ব্যামোর উৎস খুঁজবেন। আমি নার্ভ টান টান করে তার মুখোমুখি বসা। তিনি শুরু করলেন, “কিছু বলুন”।
    — কি বলবো? ডেসপারেট ভঙ্গিতে আমার উত্তর।
    — যা মনে চায়
    — মন জানতে চাচ্ছে, আমাকে এখানে কেন রেফার করা হয়েছে?
    — যিনি রেফার করেছেন উনাকে জিজ্ঞেস করেন নি?
    — প্রফেসররা রোগীর কথা শুনে না
    — গুড। তো বলুন কি জানতে চান?
    — মনোরোগ নিয়ে বলুন।
    — পরিসংখ্যান অনুসারে পৃথিবীতে প্রতি চারজনের একজন মানুষই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত।
    — তাহলে এতে উদ্বেগের কি আছে?
    — কিছু অদ্ভুত, রহস্যময় আর বিরল মানসিক রোগ আছে পৃথিবীতে, যেগুলোর কথা আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা।
    — ভেরি ইন্টারেস্টিং।
    — এই যেমন ধরুন ফিলোফোবিয়া। যারা প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বা ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রতারণার শিকার হয়ে জীবনে আর কখনোই প্রেমের সম্পর্কে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আবার এমনও কিছু মানুষ আছে, যারা এরকম কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন না হয়েও কখনোই প্রেম করতে চায় না। প্রেম সংক্রান্ত এই ভীতি কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। এটি একটি রোগ। পৃথিবীতে প্রায় প্রতি দু’শ মানুষে একজন এই রোগে আক্রান্ত।
    — আমি এই ক্যাটাগরিতে পড়িনা। বরং আমার প্রেম রোগ আছে মনে হয়। আমি তার কথার মধ্যেই উত্তর দিলাম।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট নিরুত্তাপ ভাব নিয়ে আমাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছেন। আমি এখন পর্যন্ত শক্ত অবস্থানেই আছি। কাগজের টোকা দেখে শান্ত কন্ঠে বললেন, “আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি প্রেমিক পুরুষ”? “ঠিক সেরকম না” আমার ঝটপট উত্তর। তিনি হাতের কলম নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “কেন আপনার এমন মনে হয়”?
    — জানিনা
    — কি করেন?
    — চাকরি
    — কতদিন হলো?
    — দুই
    — দুই মানে কি?
    — বছর
    — পড়াশোনা?
    — ইঞ্জিনিয়ারিং
    — কোথায়?
    — বুয়েট।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট পানসে চোখ খানিকটা বড় করে তাকালেন। তারপর হাতের কলম আবার নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “ গুড। প্রেম করেছেন”?
    — জানিনা
    — জানেন না কেন?
    — কনফিউজড
    — ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন ফারদার? বিশেষ কাউকে পছন্দ আছে? মুখ ফুটে তাকে বলতে পারছেন না?
    — আছে
    — তিনি কি করেন? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড
    — ম্যারিড।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এবার নড়েচড়ে বসলেন। হাতের কলম নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “পরকীয়া”?
    — ডোন্ট নো।
    — বিয়ে করে ফেলুন
    — প্রবলেম আছে
    — যেমন?
    — ডোন্ট হেভ এনি কানেকশন রাইট নাউ
    — কেন?
    — আই থিংক ইটস এ ডেড ইস্যু রাইট নাউ। লিভ ইট।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এখনো বরফ শীতল। কিছু কিছু নোট নিচ্ছেন। আর হাতের কলম নাকের ডগায় ঘন ঘন ঠেকাচ্ছেন। তাকে আরো অনুসন্ধিচ্ছু মনে হলো। বললেন, “লিভ ইট। লেট’স প্রগ্রেস। মানসিক দুরাবস্থার অন্য অবস্থাগুলো হচ্ছে প্যারিস সিনড্রোম, এরোটোম্যানিয়া, ক্লেপটোম্যানিয়া, অ্যাপটেমনোফিলিয়া,পেডোফিলিয়া, নেক্রোফিলিয়া—-

    আমার মাথা আর কাজ করছে না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। যখন হুঁশ হলো তখন দেখি সেই নিরামিষ সায়ক্রিয়াট্রিস্ট নেই। সিস্টার টাইপের একজন বললেন, “আপনি এখন আসতে পারেন। আপনার নেক্সট সেশন-ডেট কার্ডে লেখা আছে”। বের হয়ে দেখি তৌহিদ বসা। এগিয়ে এসে বললো, “এতক্ষণ কি করলো”? বললাম, “জানিনা । তবে এখন অনেকটাই হাল্কা বোধ করছি”। এভাবে চারদিন সেই সায়ক্রিয়াট্রিস্টের মুখোমুখি হলাম। শেষ দিন সেশন শেষে কিছুটা হেসে বললেন, “ইয়াং ম্যান। বিলিভ ইন ইওরসেলফ। সুন্দরীদের ভালো লাগবেই। পুরুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যই এটি। নাথিং রঙ ইন ইট। ডু হোয়াটেভার ইউ ওয়ান্ট টু ডু। বাট ইউ পজেস সাম পিকিউলারিটিজ অলসো। ভেরি সিমিলিয়ার টু সো মেনি। বাই দা ওয়ে হু ইজ সাবরিনা”? আমি চমকে উঠলাম। সাবরিনার কথা এলো কিভাবে? বললাম, “হাও কাম ইউ নো হার”? তিনি হাসলেন। সে হাসিতে অনুসন্ধিচ্ছা নেই, নেই উদ্বিগ্নতা। আছে উদ্ঘাটনের আনন্দ। বললেন, “গেট ম্যারিড সুন এন্ড বি হ্যাপী। ডোন্ট বোদার হোয়াট আদার্স উইল সে”।
    মনটা যেন আজ পিওর অক্সিজেনে ওয়াশ করা হয়েছে। মাথা সুন্দর কাজ করছে। শরীরে ক্লান্তি নেই। তৌহিদকে বললাম, “ব্যাটা সায়ক্রিয়াট্রিস্ট খাসা চীজ। চাঙ্গা করে দিয়েছে। ফিলিং ড্যাম বেটার”। তৌহিদ হাসলো। বললো, “বাসায় চলো। খালাম্মার সাথে আলাপ আছে। তোমার বিয়ে জরুরি”। “কাকে? সাবরিনাকে”? মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো। তৌহিদ আশ্চর্য হয়ে বললো, “কাকে মানে? এতদিন জানতাম জেমি আর শৈলী। আর এখন সাবরিনা এলো কোত্থেকে”? আমি চট করে বাধা দিয়ে বললাম, “লিভ ইট। ফিলিং আনইজি নাও”। তৌহিদকে আর বাসা পর্যন্ত নিয়ে এলাম না। কি থেকে কি বলে পরিস্থিতি আরো সংকটাপন্ন করে তুলবে কে জানে?

    খাবার টেবিলে আম্মাকে খুব খুশি খুশি লাগছে। মলির ইডিডি দিন-দশেক এর মধ্যেই। হয়ত সে কারণেই নানী হওয়ার আনন্দে। হঠাৎই বলে বসলো, “সাবরিনা টা কে”? আমি যেন আকাশ থেকে পড়েছি। পরক্ষণেই বললাম, “কেন, কি হয়েছে”? আম্মা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “বল না”? সেলিম সামনে থেকে সরে গেলো। মলি এসে যোগ দিলো। আমার বুঝতে বাকি নেই যে বাসায় ইত্যবসরে সাবরিনা বিষয়ে গবেষণা হয়ে গেছে। তৌহিদই সেলিমকে বলে দিয়েছে। পরিস্থিতি নরমাল করার জন্য বললাম, “মামার অফিসে চাকরি করে”। বুঝতে পারলাম আম্মার আশার টিউব লাইট জ্বলে উঠেছে। বললো, “কথা হয় ওর সাথে”? উত্তরে বললাম, “হাই- হ্যালো হয়েছে। তাও মামার অফিসেই”। “তোর পছন্দ হয়েছে”? আম্মার স্ট্রেট ড্রাইভ। আমি ব্যাকফুটে গিয়ে বললাম, “যে কারোরই পছন্দ হবে”। আম্মা কি বুঝলো কে জানে? কথা এখানেই শেষ। মলি খুশি। সেলিম দরোজার পাশ থেকে সরে ভেতরে চলে গেলো। জানি আম্মা এখনই ছোট মামাকে ফোন দেবে। আমি রুমে গিয়ে কাপড়চোপড় গুছাতে লাগলাম। কাল ভোরে খাগড়াছড়ি যেতে হবে।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৪৪)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৪৪)

    জাহিদ কলিকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে বাসায় ফিরছে, রাহেলা বেগম ঘরবাড়ি ঠিকঠাক মতো পরিষ্কার করছেন। নাহিদ মাকে সাহায্য করছে। আগামীকাল কলিকে দেখতে আসবে ছেলেপক্ষ।

    রাহেলা বেগম নাহিদ কে বললেন, এই নাহিদ সাঈদের বাসায় কলিকে দেখালে কেমন হয়?
    – অত্যন্ত খারাপ হয়।
    – তুই এইভাবে কথা বলিস কেন?
    – মা, কলিপাকে এইখানে এই অবস্থায় দেখে নিলেই ভালো। সারাজীবন তো আর ভাইজানের বাসায় নিয়ে যেতে পারবেনা।
    – আমার ভয় হয়, যদি আবার এই বিয়েটাও ভেঙে যায়।
    – এতো দুঃচিন্তা কেন কর!
    – আমার মেয়ে, তাই চিন্তা ও বেশি। মেয়ের মায়ের চিন্তা ছাড়া উপায় আছে!
    – যত্তসব উল্টা-পাল্টা চিন্তা।

    কলি আর সাঈদ বাসায় আসতে আসতে ঘড়িতে প্রায় ছয়টা বেজে গেল। ক্লান্তিতে দুজনের মুখ কালো হয়ে গিয়েছে।

    রাহেলা বেগম লেবুর শরবত দিয়ে বললেন, মুখ হাত ধুয়ে এসে, শরবত টা খেয়ে নে তোরা! জাহিদ কে বার বার বললাম, দেরী করিস না, তবুও দুই দিন দেরী করে গেলি, এখন মেয়েটার চেহারা কালো হয়ে আছে।
    – মা, আমি স্কুলে গিয়ে ছুটি নিয়ে তবে গেলাম, এরকম কি যাওয়া যায়? বিনা ছুটিতে? আর আজ রেস্ট নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

    নাহিদ বললো কি রে কলিপা কোথায় কোথায় ঘুরেছিস বল? কক্সবাজারে গিয়েছিস নাকি?

    কলি জাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে, জাহিদ পলির বাসার কথা সব জেনেছে কলির মুখে।

    জাহিদ বললো ও ওর দুলাভাই নিয়ে ঘুরেছে, তুই কলির জামাই নিয়ে ঘুরবি। এখন কালকের কি কি বাজার লাগবে, লিখে নে। দুইভাই গিয়ে নিয়ে আসি।
    – তুমি রেস্ট নাও, আমি নিয়ে আসি।
    – একটু অপেক্ষা কর, আমি সাথে যাবো, ভাইজান কে বলতে হবে।
    – তুমি ভাইজান কে বলতে যাও, আমি বাজারে যাই।

    রাহেলা বললেন নাহিদ যে কেন এমন করে বুঝিনা বাবা। কি যে জেদি হচ্ছে দিন দিন।
    – ও দুঃখ পেয়েছে বেশি, তাই এমন করে। ছোট মানুষ।

    কলি দুপুরের পর থেকে সেই ছেলের ছবি মাথায় নিয়ে বসে আছে। দেখতে ভীষণ স্মার্ট ছেলেটি। বিয়ে হলে খারাপ হবেনা অবশ্য! আজ কি পছন্দ করবে? নাকি আজ ও চলে যাবে।

    বিকাল চারটার দিকে, রুমি খালা ছেলেপক্ষ নিয়ে এলেন, তিনি এসে তাদের কে ছোট রুমে রেখে, ভিতরে গেলেন।

    রাহেলা বেগম নাশতা রেডি করে রেখেছেন, তিনি সব একে একে নিয়ে গেলেন। নাহিদ ও সাহায্য করছে, এবং সার্ভ করে দিচ্ছে।

    নাহিদ এক ফাঁকে এসে বললো আপারে, তুই আফ্রিকান দের বাড়ী যাচ্ছিস।
    – মোটেও না, ছেলে আমি দেখেছি ফর্সা সুন্দর।
    – এখানে সব কালো মামুষ এসেছে।
    – তাহলে ছেলে আজ আসেনি। কনফার্ম।

    রুমি রান্নাঘরে এসে বললেন আপা শোনো, আমি তোমাদের না জানিয়ে নিয়ে এসেছি। এই ছেলে আগের ছেলে পক্ষ না। আগে যারা এসেছিল তারা না করে দিয়েছে, কলি তাদের নিয়ে আসায়।
    – আগে বললি না কেন?
    – তুমি মন খারাপ করবে তাই। যাই হউক এই ছেলে জগন্নাথ থেকে এম.এ করেছে। সিটি করপকরপোরেশনে চাকরি করে। ভালো চাকরি, দুই ভাই। ছোট জন ও চাকরি করে, দুই বোন বিবাহিত। শুধু সমস্যা একটা।
    – আবার কি সমস্যা?
    – ছেলে একটু কালো। কিন্তু ছেলে ভালো। আমি চাই আপা, তুমি য্রন মত দাও।
    – আচ্ছা দেখি আগে।

    কলিকে রুমে নেওয়ার আগে, রুমি এক মিনিটে শুধু বললেন এই ছেলে, আগের জন নয়। আর শুধু চেহারা দেখবিনা, মন দেখবি।

    কলি রুমে গিয়ে দেখে সবাই কুচকুচে কালো। রুমি পরিচয় করিয়ে দিলেন, এই পাত্র জুয়েল খান।

    কলি এক ঝটকায় দেখেই মাথা ঘুরিয়ে গিয়েছে। ছিপছিপে কালো চেহারা, মাথায় চুল কম, লাল একটা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে এসেছে। কেমন যেন হ য ব র ল লাগছে। এই ছেলে? কেমনে বিয়ে করবে,মতকে আল্লাহ বাঁচাও।

    রাহেলা বেগমের ছেলে পছন্দ হয়নি, কালো সমস্যা না, কিন্তু এতো হেংলা ছেলে,বয়স এবং এই পরিবারের কালো।

    কিছুক্ষণ কথা বলার পর, ছেলের ফুপু বললেন, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে, যদি সম্ভব হয়, আজ রাতেই কাবিন করে ফেলতে চাই। পরে, মাস দুয়েক পরে অনুষ্ঠান!

    রাহেলা বেগমের একদম ভালো লাগেনি, কলি কি ভাবছে কে জানে, সাঈদের ফোনে কল যাচ্ছেনা। সাঈদ আসলে সহজেই সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। কলি কি রাজী হবে? আর এতো অল্প সময়ে কি করবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। সব জেনে মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে….

    চলবে…

  • কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-১)

    কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-১)

    সময় টা ছিল ২০১৭ সালের মার্চ মাস।আমার ছোটো ছেলের এস এস সি পরীক্ষা শেষ। আমি ওকে নিয়ে মাকে দেখতে মেহেরপুর যাবার জন্য রেডি হচ্ছি।

    আর ওর বন্ধুর পরিবার গুলো সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিল একসাথে কোথাও ঘুরতে যাবার। বাচ্চা ও আমাদের ১২ বছরের পথচলা স্মৃতি টাকে ধরে রাখতে এই প্রয়াস!

    কেননা এরপর কলেজে উঠে কে কোথায় ভর্তি হবে তাতে সেই নার্সারি থেকে একসাথে বারোবছরের জার্নিটা হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যাবে।

    যেই কথা সেই কাজ।ভাইয়ারা প্রতি সন্ধ্যায় বড়ো পোল অথবা আর্টিলারিতে একসাথে হন আর মিটিং করেন।

    ভাবিরাও কম জান না। তাঁরাও উঠে পড়ে লাগলেন প্ল্যান সফল করতে। আমাদের সাতটি পরিবারের মধ্যে আমি ও আমার হাসবেন্ড ছিলাম বয়োজ্যেষ্ঠ।

    সেই হিসাবে অন্যেরা যথেষ্ট সন্মান করেন।আমরাও তাদের স্নেহ ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছি।

    তো,মিটিং এর পর মিটিং শেষে সিদ্ধান্ত হল ২৪/৩/২০১৭ সবাই ভোরের বাসে কক্সবাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে ঐরাত টা সেখানে থেকে পরের ভোরে সেন্টমার্টিন যাবে ওখানে অন্তত একরাত থাকবে।

    এরপর সবাই মিলে আমাকে কনভিন্স করে ফেল্লো। আমি না গেলে তাদের খুব খারাপ লাগবে। সেটা আমার ও লাগছিল। কিন্তু মা কে দেখতে যাবার টান টাও ছিল।কিন্তু ভালোবাসার মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে না করতে পারলাম না। মেহেরপুরের টিকেট ক্যানসেল করে দিলাম।

    তবে একটা সমস্যা ছিল, আমার হাসবেন্ড কে নিয়ে। উনি যাবেন না। প্রথমে সিদ্ধান্ত হল আমি আর ছোটু যাব।তাতে অন্যান্য ভাই-ভাবিরা ভাবলেন তারা সবাই পরিবার সহ যাবেন সেখানে আমার নিশ্চয় খারাপ লাগবে। তাছাড়া আমাদের দুজনের যদি কোনো বিপদ আসে তখন আমাদের দায়িত্ব কে নিবে। এই ভেবে একেক দিন একেক ভাই, বিশেষ করে মঞ্জু ভাই, ফেরদৌস ভাই আর জীবন ভাই ফোন করে করে শেষ পর্যন্ত আমার হাসবেন্ড কে রাজি করিয়েই ফেললেন!

    আমরা সিলভার বেলস কিন্ডারগার্টেন থেকে কলিজিয়েট স্কুল পর্যন্ত এক সাথে পড়া ছয়জন ছেলে বাচ্চার পরিবার ও আরেক জন মুসলিম হাই স্কুলের বাচ্চার পরিবার মোট সাতটি পরিবারের সাথ মঞ্জু ভাই এর দুই বন্ধু পরিবার এক সাথে যাচ্ছি।

    এরমধ্যেই আমরা সবার জন্য একই রকম জামা খুব দ্রুততার সাথে বানিয়ে ফেললাম। আর ভায়েরা এক রকম টিশার্ট কিনে ফেললেন।সিদ্ধান্ত হলো এগুলো সেন্টমার্টিন যাবার দিন একসাথে পরা হবে।

    ভায়েরা একেকজন একেক টা কাজ ভাগ করে নিলেন। কেউ কটেজ ঠিক করা, কেই বাসের টিকেট কাটা কেউ খাবার ব্যাপার টা দেখা।তবে সার্বিক দায়িত্ব নিলেন করিৎকর্মা জীবন ভাই। সাদমানের আব্বা আমাদের লাকি ভাবির হাসবেন্ড।

    চলবে…

    ফাতেমা হোসেন
    ৭ই মার্চ, ২০২২ইং

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৯)
    সাবরিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বলা চলে পালিয়ে এসে পড়লাম আরেক বিপদে। রাজউকের কাগজপত্র ফেলে এসেছি তার টেবিলে। আসার সময় উঠতে গিয়ে টেবিলের সাথে হোচট খাওয়াতেই এই বিভ্রাট হয়েছে। অনেকটা পথ যাওয়ার পর মামা ফোন করে জানালেন। বললেন নিয়ে যেতে। আমি মরে গেলেও যাবো না। সাবরিনার কাছে আজ আচ্ছামত নাকাল হয়েছি। প্রেস্টিজ পাংচার যা হওয়ার হয়েছে। এবার গেলে টায়ার টিউবও যাবে। মামাকে বললাম অনেক দূর চলে এসেছি। প্রচন্ড জ্যাম। তার কাছেই যেন রেখে দেয়।

    এবার ঢাকায় এসে দারুণ অস্বস্তিতে কাটছে। বাসার পরিবেশ থমথমে। সবাই আমার সাথে ডিফেন্সিভ খেলছে। আগ বাড়িয়ে কেউ কিছু বলেনা। মনে হলো দুই শূন্য ভোটে আমার বিরুদ্ধে সাধারণ পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়ে গেছে। এখন স্বল্প পরিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। হয়ত নিকট ভবিষ্যতে আরো বড় আকারে নিষেধাজ্ঞা আসবে। আমার ভোটাধিকার নেই। সেলিম কৌশলগত কারণে ভোটদানে বিরত। তার সাথেই টুক টাক কথা হয়। তবে তারও গা ছাড়া গা ছাড়া ভাব দেখলাম। রাতে খাবার টেবিলে আম্মাকে পেলাম। কাছে গিয়ে বসলাম। আম্মা উঠে গেলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো, “টেবিলে সব দেওয়া আছে”। আমি পথ আগলে বললাম, “এরকম করছো কেন? কি হয়েছে খুলে বলো”। আম্মা চোখ বড় বড় করে তাকালো। বহুদিন এভাবে তাকায় নি। বুঝলাম তার মেজাজ সপ্তমে। বললাম, “তোমরা যা ভাবছো ব্যাপারটা আসলে ওরকম না”। “তাহলে কি রকম”? আম্মার পাল্টা প্রশ্ন। এ সময় সাঁড়াশি আক্রমণের অভিপ্রায়ে মলি রুম থেকে বের হয়ে এলো। সেও এই বিতর্কে যোগ দেবে আমি নিশ্চিত। বললাম, “কাল সকালে আলাপ করা যাবে”।

    মাথার অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ডাক্তার দেখাতে ভয় হয়। রাজ্যের আজেবাজে চিন্তা আসে। ব্রেণ টিউমার হয়নি তো? নিজেই শিউরে উঠলাম। এত অস্থিরতা নিয়ে পৃথিবীতে আর কেউ আছে কিনা জানিনা। হেসে খেলে জীবনটা তো ভালোই কাটছিলো। আম্মার ঘ্যানরঘ্যানরের কারণে বাধ্য হয়ে টিউশনি নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম টিউশনি করবো আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ট্রাই করবো। সেই টিউশনি করতে গিয়েই পড়েছি বিপদে। ইলমাকে পড়াতে গিয়ে জেমিতে আটকে গেছি। ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি কোন বিবাহিতার সাথে এভাবে জড়িয়ে যাবো। শৈলীকে পড়াতে গিয়ে কক্ষণো তার উড়ুউড়ু মনের সাথে তাল মিলাইনি। এখন তার সরব, নিরব নড়াচড়া দোলা দিয়ে যায়। মাল্টিন্যাশনালে চাকরির ইচ্ছে থাকলেও হুট করেই ইন্টারন্যাশনালে হয়ে গেলো। মাঝখান দিয়ে সেলিমের সাপলুডু খেলায় সবাই উপুর্যুপরি পেরেশান আর নাস্তানাবুদ হয়েছি। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারিও হয়েছে। অন্যদিকে সুখের খবরও হয়েছে। মলি এখন সন্তান সম্ভবা।

    জামান ভাই সেই মডেল কন্যাকে নিয়ে আর কোন কথা বলেন নি। মনে হয় তার চয়েস আছে বা অন্য কোন এক্সপেক্টেশন আছে। আমারও আর ঢাকায় বদলীর খবর হয়নি। জামান ভাই এখন বিদেশে। ইউ এন ডিপি ডেলিগেশনের সাথে। ছোট মামা প্রমোশন পেয়ে আগারগাঁও অফিসে বদলী হয়েছেন। সাবরিনার সাথে দেখা হওয়ার চ্যাপ্টার ক্লোজ। তবু মাঝে মাঝে তার উচ্ছ্বল স্মৃতিতে মুগ্ধ না হয়ে পারিনা। সবার চাপে আর নিজের শারিরীক অবস্থার কারণে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। হাজারো টেস্ট। এম আর আই পর্যন্ত করতে হয়েছে। একগাদা ওষুধ দিয়েছে। মুড়ির মত তা তিন বেলা ভাগ করে খাই। বেশির ভাগই যে নার্ভ রিলাক্সেসন সংক্রান্ত বুঝি। সারাক্ষণ তন্দ্রালু ভাব লেগেই আছে। প্রথমে মেডিসিনের ডাক্তার দেখিয়েছি। এক পর্যায়ে তিনি নিউরোকে রেফার করলেন। তার কথা বার্তা, হাব ভাব দেখে শুনে গা ছম্ ছম্ করে উঠে। যতটা না মুখে বলেন তার চেয়ে বেশি চোখে মুখে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে তুলেন। অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়েছি। বলা চলে নিতে বাধ্য হয়েছি। দিনে দিনে ওয়েট লস হচ্ছে। এম আর আই রিপোর্ট খারাপ না। তবে বাসার কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলেনা। মাঝে মধ্যে মুখ ঠেলে বমি আসে। মাথাটা সারাক্ষণ ঝিম্ ঝিম্ করতেই থাকে। কখনো কখনো চিন্ চিন্ করে। আর কানে অনবরত ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ লেগেই আছে।

    আম্মার চোখ ভেজা থাকে। ছোট মামার সাথে পরামর্শ করেন। বড় মামা এসে দেখে যান। আর বলেন, “সুস্থ হলে বিয়ে করিয়ে দাও। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। স্থিরতা দরকার”। মামাদের তত্ত্বাবধানে মাল্টিন্যাশনালে সেলিমের একটা চাকরি হয়েছে। যদিও চাকরিতে তার আপত্তি। কিন্তু পিতৃত্বের জোয়াল কাঁধে চাপায় রাজী হয়েছে। মলি খুব খুশি। সাত মাস চলছে। নবাগতের আগমনে আম্মার মুখ জুড়ে সুখের হাসি লেগে আছে। এখন মলির সেবাতেও তাকে সময় দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আমাকে নিয়েও সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় থাকতে হচ্ছে। ওষুধে বেশ কাজ হয়েছে। আগের চেয়ে অনেকটাই স্বস্তি বোধ করছি। মাথার ঝিম্, ঝিম্, চিন্ চিন্ ভাবটা অনেকটাই লাঘব হয়ে এসেছে। কিন্তু কানের ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকটা রয়েই গেছে। চাকরি বাঁচাতে খাগড়াছড়ি যেতে হচ্ছে। সব শুনে জামান ভাই হায়ার লেভেলে আলাপ করে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। আমার একা একা খাগড়াছড়ি যেতে ভয় করছে। সাথে যাওয়ার কেউ নেই। সেলিম যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু মলির কথা ভেবে আমিই না করেছি। শেষ পর্যন্ত সেলিমের গ্রামের দুঃসম্পর্কের এক কাজিনকে ম্যানেজ করা হলো। এও বা কম কি? ডাক্তারদের অভিমত আমার কাউন্সেলিং জরুরি। নার্ভের উপর বেশ চাপ পড়েছে। গল ব্লাডারের অবস্থাও ভাল না।

    খাগড়াছড়িতে গিয়ে পৌছলাম প্রায় সন্ধ্যায়। মাগরিবের নামাযটা পড়ে চা নাস্তা খাচ্ছি এমন সময় ম্যাসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হলো। খুলে দেখি শৈলীর নক। অনেক দিন পর। এক ছেলের সাথে হাস্যোজ্জ্বল কিছু ছবি। কোন ক্যাপশন নেই। বুঝতে কষ্ট হলোনা যে বুয়েটে সে খুব ভালো আছে। উইশ করতে গিয়ে দেখলাম আমি ব্লকড। ভালোই হয়েছে। একে একে নিভিছে দেউটি। চা খেতে গিয়ে আমার প্রেসার হঠাৎ বেড়ে গেলো। সহকর্মীরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। টেস্ট রিপোর্ট আর মেডিকেশন দেখে বললেন, “নার্ভাসনেস থেকে এমন হয়েছে। টেনশন থেকে গ্যাস শ্যুট করেছে। ভেতরে অস্থিরতা আছে। স্টেবল হতে সময় নেবে। কোন চাপ নেওয়া যাবে না”।

    এখন আর ফিল্ড ভিজিটে যাই না। অফিসে বসেই রিপোর্ট রিটার্নের কাজ করি। রাত্রি ভীতি পেয়ে বসেছে। সেলিমের কাজিনকে সাথে নিয়ে ঘুমাই। বড় ভালো ছেলে। ইন্টার পর্যন্ত পড়ে আর এগোতে পারেনি। আর্থিক স্বচ্ছলতা ভালো না। ক্ষেত খলা করে খায়। তার নাম হালিম। তার আন্তরিকতার ফিরতি দেওয়া সম্ভব না। জানিনা আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন কিনা? তিনি যেন হালিমের জন্য হালাল রুজির ব্যবস্থা করে দেন। রুজিতে বরকত দান করেন। হালিম এখন আমার জীবন চলার পথে অন্যতম বন্ধুস্থানীয় হয়ে গেছে। জানিনা আমার এই রাত্রি ভীতি, মনের স্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে? আর হালিমই বা ক্ষেত খলা ছেড়ে কতদিন আমার সাথে থাকবে?

    হালিমকে নিয়েই মাগরিব আর এশার নামায মসজিদে গিয়ে পড়ি। হালিম পাক্কা নামাযী। ফজরও মিস নেই। আমি পারিনা। আফসোস হয়। সময় গড়িয়ে যায় আমার বদলীর আদেশ আর হয়না। হেড অফিসের সুপিরিয়র পজিশনে রদবদল হওয়ায় সব ক্ষেত্রে এখন স্থিতাবস্থা নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। জামান ভাই লেগে আছেন। কিছুতেই ব্যাটে বলে হচ্ছেনা। ইমাম সাহেব আমাকে দেখে খুব পেরেশানীতে পড়ে গেলেন। সুরা পড়ে ঝাড়ফুঁক দিলেন। বললেন, “বাবাজী, সারাক্ষণ তাওবা-এস্তেগফার পড়বেন। আল্লাহর কাছে খালেস নিয়তে মাফ চাইবেন। ইন শা আল্লাহ ভালো হয়ে যাবেন”। তাঁর এই কথাতে মনের জোর বেড়ে গেলো অনেক। কানে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ অনেকটাই কমে গেছে। মাথাটাও আগের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছে। নিয়ম করে নামায শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসি। নানা কথা শুনি। তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন বলে মনে হয়। হালিমকে ছেড়ে দিতে হবে। বাড়ী থেকে তার ডাক এসেছে। এখন নিজের উপর কিছুটা আস্থা পাচ্ছি। তাকে বিদায় দিয়ে দরোজা খোলা রেখে বাবুর্চিকে বললাম ডাইনিংয়ে এসে শু’তে।

    এখন আর কারো কথা মনে করতে চাই না। শৈলী তার আপন ভুবন বেছে নিয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। সময় ও স্রোত মানুষের মত ভুল করেনা। জেমির কথা চিন্তাতেও আনতে চাইনা। তার প্রতি মায়ার চেয়ে ঘৃণাই বেশি। সাবরিনার কথা মনে হয় মাঝে মাঝে। বিশেষত তার উচ্ছ্বলতা আর সহাস্য বদন ঈর্ষনীয়। আমার মনে হয় স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না। নিজের উপর আস্থা কমে গেছে। পৃথিবীটাকে বিবর্ণ মনে হয়। কোথাও এতটুকু ছায়া নেই, শীতলতা নেই। সর্বত্র ধুসর-উসর মরুময়তা। কোথাও সতেজ বৃক্ষ নেই, আছে মরু ক্যাকটাস। অবিকল সাবরিনার অফিস চেম্বারে রাখা বনসাই ক্যাকটাসের মত।

    চলবে…