Tag: ধারাবাহিক গল্প

  • প্রেম-বিয়ে এবং বিচ্ছেদ উপাখ্যান (পর্ব-১)

    প্রেম-বিয়ে এবং বিচ্ছেদ উপাখ্যান (পর্ব-১)

    বাইশ বছর আগে প্রথমবার অমিত আর তনু’র বিয়ে হয়েছিল। বিয়ের দু’বছরের মাথায় আনির জন্ম হয়েছিল, এর পাঁচবছর পর আয়ানের জন্ম। বিয়ের দশ বছরের মাথায় ওদের ডিভোর্স হয়। এরপর থেকে দু’জনেই একা, কেউই আর অন্য কোথাও গাঁটছড়া বাধেনি।

    আজ আনিকা আর আয়ান ওদের বাবা মায়ের দ্বিতীয় বারের মত বিয়ের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে ছিল, ওদের সাথে ওদের কিছু আপনজন ও ছিল, আনির দুই খালা, মামা-মামী, কাজিনরা, খালু, নানী আর একজন আলেম। বারো বছর পরে আনি আর আয়ানের বাবা-মায়ের দ্বিতীয়বারের মত বিয়ে হলো।

    তনু যখন ক্লাশ সিক্সে বা সেভেনে পড়ে তখন থেকেই অমিত তনুদের বাড়ীতে যাওয়া আসা করে, তনু ’র বড় আপু তাজি আর অমিতের বড়দি অনিমা দুইজন ঘনিস্ট দুই বান্ধবী, একই স্কুলে পড়ে, একই পাড়ায় থাকে। একজন আরেকজনের বাড়ীতে প্রয়োজন অপ্রয়োজেনে যাওয়া আসা করে, খেলা করে, সেই সুবাদে তনু আর অমিত ও খেলায় মেতে ওঠে, অমিত তখন কিশোর বয়স পার করছে, খেলতে খেলতে তারা কিশোর প্রেমে মেতে ওঠে। ব্যপারটা প্রথমে বুঝতে পারে তনু ’র বড় আপু, তারই বা বয়স কত সবে মাত্র ক্লাস টেনে পড়ে, তাজি যখন বুঝতে পারে তখন কি করবে বুঝে উঠতে পারে না, কিন্ত এটা ভাল করে বুঝতে পারে যে, এখনি যদি তনু কে ফেরানো না যায় তাহলে বড় ধরনের একটা কেলেংকারী ঘটে যেতে পারে।

    তনু ছিল অসম্ভব মেধাবী আর রূপবতী একটা মেয়ে, আর অমিতের নামটা শুনলেই একটা মায়াবী মুখ ভেসে ওঠে, হ্যঁা অমিত সত্যিই একটা মায়াবী চেহারার ছেলে,তবে গায়ের রং কুচকুচে কালো, আদর করে ওর মা ওকে মাঝে মাঝে কালা বলে ডাকে, অনিমা ও কিছুটা টের পেয়েছিল ওদের বাল্যসুলভ প্রেমের। তাজির মত এতটা সিরিয়াস ছিল না অনিমা।এই নিয়ে দুইবান্ধবীর মধ্যে কখনো কথা হয়নি।

    এভাবেই চলছিল,.দুই পরিবারের বড়রা কেউ ওদের বিষয়টা গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। এরই মধ্যে অনিমার বিয়ে হয়ে গেলো, বিশাল এক ব্যবসায়ীর সাথে বিয়ের পর ও কলকাতা চলে গেলো , তাজি একা হয়ে গেলো,অনিমাদের বাড়ীতে তাজি আর যায় না, কিন্তু তনু আর অমিত আগের মতই আছে।

    তনু খুব বেশী বাড়ী থেকে বের হয় না,সারাক্ষন পড়াশোনা নিয়েই থাকে, রাতে মা তার পাশে বসে থাকে আর সে পড়ে চলে, পড়াশোনায় এত মনোযোগী যে বাড়ীতে বান্ধবীরা আসলে তাদের সাথে দেখা করে না , মাকে বলে ওদের বলে দাও আমি বাড়ীতে নাই, একটুও সময় নষ্ট করে না, শুধুমাত্র অমিত আসলে একটু কথা বলে, তাজি ওদের কাছেই থাকে, একা ওদেরকে গল্প করতে দেয় না, তাজি নিজেও মাত্র কিশোরী বয়সটা পার করেছে, তাজির ও বিয়ের জন্য পাত্র দেখা শুরু করেছে, বাড়ীর বড় মেয়ে এর পর ওর মেজো বোন আছে, এক এক করে বিয়ে না দিলে ওদের বাবা যে কন্যাদায় গ্রস্ত বাবা হয়ে যাবে, উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর তাজির ও বিয়ে হয়ে গেলো, তাজির মেজো বোন রাজিয়া এখন হয়ে গেলো তনু ’র একধরনের গার্জিয়ান, ততোদিনে তনু আর অমিতের বিষয়টা দুই পরিবারের সদস্যরা মানে গুরুজনরা একটু গুরত্ব দিতে শুরু করেছে, তারা তনু ’কে বোঝালো এতদিন তোমরা ছোট ছিলে না বুঝেই অনেক কিছু করেছো,কিন্তু এখন থেকে এগুলো আর চলবে না, অমিতের সাথে কখনই তোমোকে কোন সম্পর্কে জড়াতে দেয়া হবে না, ওর ধর্ম আর আমাদের ধর্ম কখনই এই সম্পর্ক সমাজে মেনে নেবে না, তুমি ঠিকমত পড়াশোনা করো নয়তো তোমার জন্য পাত্র দেখা শুরু করি।

    ওদিকে অমিতের বাবা অমিতকে বললো তোমার মত অপদার্থ ছেলেকে আমি আর বাড়ীতে রাখবো না, তুমি যদি তনু ’র কাছ থেকে ফিরে না আসো তাহলে তুমি বাড়ী থেকে বের হয়ে যেতে পারো, আমার কোন সম্পত্তির কিছু তুমি পাবে না।

    তনু এরই মধ্যে এইচ এসসি শেষ করেছে বোর্ডের মধ্যে মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে, তনু’র মায়ের চোখে আনন্দের জল, তনু এখন উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখে, তনু আর অমিত এখন আগের মত বাড়ীতে বসে গল্প করে না, মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে ওরা বাইরে দেখা করে, গল্প করে, সময় কাটায়, মাঝে মাঝে রাজিয়ার কাছে ধরা পড়ে, রাজিয়া মা’কে বলে দেয়,সেদিন আর তনু’র পালানোর কোনো পথ থাকে না।

    এই বয়সে এসেও মায়ের হাতে কঠিন মার খায়, তনু ’র অসুস্থ বাবা চেয়ে চেয়ে দেখে তার আদরের মেধাবী মেয়েটার অধোঃপতন। তনু ’র মা এবার তনু ’র জন্যে ঘটকের মা্ধ্যমে সত্যিই পাত্র ঠিক করে ফেলে, পাত্র পক্ষ ও তনুকে দেখে পছন্দ করে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করে ফেলে,বিয়ের কেনা কাটার দায়িত্ব পড়ে বড় আপুর উপর।

    এরই মধ্যে তনু ভালো সাবজেক্টে ভর্তি হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে, ছেলে পক্ষের কাছে তনু ’র মায়ের একটাই দাবী তার মেধাবী মেয়েটার লেথাপড়া যেনো বন্ধ না হয়, পাত্র নিজে রাজী হলে ও পাত্রের মা এই প্রস্তাবে রাজী না, তার একটাই কথা বাড়ীর বড় বউ পড়ালেখা করতে গেলে অন্যদের সেবা করতে পারবে না সুতরাং বিয়ের পর কোন লেখাপড়া চলবে না।

    চলবে…

  • কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-৬)

    কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-৬)

    নাফ নদীর ঢেউ আর উড়ে চলা গাংচিলের অপার সৌন্দর্য দেখে গল্পে গল্পে এগিয়ে যেতে থাকলাম। বাচ্চারা খুব খুশি। ওদের কিশোর সুলভ আচরন নিয়ে মেতে উঠলো, সাথের কোনো কোনো সৌখিন ভাই ভাবি যাত্রীরা জাহাজের কিনারে দাঁড়িয়ে তখন টাইটানিক এর নায়ক নায়িকার রোজ আর জ্যাকের বিখ্যাত পোজে ছবি তোলাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন।

    ওদিক থেকে আসা জাহাজ পাস করে গেল।আমি একযাত্রীর ফেলে রাখা প্রথম আলো পত্রিকা নিয়ে শব্দজট ছাড়ানোয় ব্যাস্ত হয়ে গেলাম।

    কতক্ষণ হয়েছে জানিনা,আসেপাশের যাত্রিরা বলেউঠলো জাহাজ এবার সমুদ্রে নামছে।তারপর পরই বেশ দুলুনি অনুভব করলাম।উনি বল্লেন দেখ নদি ছেড়ে সমুদ্রে ভাসা শুরু করেছে, আর পানির রঙ দুই রকম! নদীর পানি নিল আর সমুদ্রের পানি ফেনাযুক্ত ধূসর সাদা!একটু ঘোলাটে।আমি অবাক বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম!মুগ্ধতায় মনটা ভরে গেল। দূরে বার্মার (মিয়ানমারের) গাছপালা মাটি দেখতে পেলাম। অমনি প্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্যপাধ্যায়ের লেখা বার্মার কাহিনি স্মৃতির পাতা থেকে এসে দু’চোখের পাতায় যেন ভর করলো!

    এভাবেই একসময় জাহাজ যখন সেন্টমার্টিন এ এসে ভীড়লো তখন দুপুর শুরু হ’য়ে গেছে। বাইরে প্রচন্ড রোদ।জাহাজে উঠবার আগে যেমন অনেক টা পথ হেটে আসতে হয়েছিল তেমনি নামার পরও অনেক টা পথ হাটতে হল।পথের দু’ধারে ছোটো ছোটো অনেক দোকান। স্থানীয়রা নানাবিধ জিনিস এর পসরা সাজিয়ে বসে আছে। আমাদের অনেকেই দোকানপাটে ঢুকে যাচ্ছে দেখে ভাই এরা স্মরণ করে দিলেন খাবার জন্য হোটেল বুক করা আছে তাড়াতাড়ি না পৌঁছাতে পারলে খাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।তাড়া খেয়ে সবাই টমটম ধরতে এগিয়ে গেলে আমি আর উনি একটা দোকান থেকে উনার জন্য একটা হ্যাট আর আমার জন্য একজোড়া প্লাস্টিকের চপ্পল নিয়ে নিলাম কাদা-পানিতে নামার জন্য। আমরা পিছে পড়ে গেলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে একটা টমটম পেলাম। সেটা ধরে হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

    একটা বেড়ার হোটেলে বাসের কন্ট্রাক্ট ছিল দুপুরের খাবারের। আমরা সেখানে পৌঁছে হাতমুখ ধুয়ে যে যার মতো খেতে বসে গেলাম।

    এখানে একটা কথা বলার আছে। যাত্রার প্ল্যনিং এর প্রথম থেকে সাথে থাকা একটা প্রফেসর দম্পতি সবজান্তা ও স্বার্থপর আচরণ করে যাচ্ছিলেন।এখানেও তারা সবার আগে তাদের দুই বাচ্চাকে আলাদা খাবার খাওয়ালেন।অন্য বাচ্চারা না পেয়ে মন খারাপ করে রইল।এরকম কথা ছিলো না।সবাই একই রকম খাবার খাবে এরকম প্রস্তাব নাকি তাদেরই ছিলো। কিন্তু তারা সময়ে রং পাল্টে ফেললেন। আমাদের অন্যবাচ্চাগুলো ও আমরা ধৈর্য ধরে শান্ত থাকার চেষ্টা করলাম।

    সৈকত কাছেই। তারও কাছে লেখক হুমায়ুন আহমেদ এর সমুদ্র বিলাস কুটির।এক্সাইটেড হয়ে রয়েছি কখন দেখবো। খাওয়া শেষে হেটে হেটে সমুদ্র বিলাসের পিছন দিক থেকে সামনের গেটে পৌঁছালাম।আবেগে উৎফুল্ল হয়ে গেলাম।কত কথা মনে আসতে লাগলো। পিছনে বাইরের কিছু অংশ নস্ট অব্যাবহৃত হয়ে পড়ে আছে। ভিতরে তো যেতে পারলাম না তাই গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ভেতর টা যতটা দেখা গেল দেখলাম। রঙিন রঙিন কটেজ।গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। তারপর এগিয়ে গেলাম প্রবাল দ্বীপের সৈকতের দিকে।চৈত্রের এই ভর দুপুরে মোহময়ী যেন ইশারায় তার কাছে ডাকছে আমাদের…

    চলবে…

    ফাতেমা হোসেন
    ২৪/৩/২২

  • আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (শেষ পর্ব-৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (শেষ পর্ব-৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা।
    লজিং মাস্টার
    (শেষ পর্ব)
    আনোয়ার হাকিম।

    দেখতে দেখতে বিসিএস প্রিলি রেজাল্ট বের হলো। পাস করে আমি যতটা উল্লসিত তার চেয়ে বেশি উল্লসিত বাবা-মা। তাদের উল্লসিত হওয়ার কারণ যৌক্তিক। কিন্তু কেয়া আর ছায়ার উচ্ছ্বাস দৃষ্টি কটু। আমি হাসি। ভাবছি বাবাকে বলে অন্যত্র শিফট হবো। একটা কিছু যুক্তি দেখিয়ে দিলেই হবে। দুরন্ত বিপ্লব আর ছায়ার রেজাল্ট তাদের ক্যালিবারের তুলনায় যথেষ্ট ভালো হলো। আমার কদর আরো বাড়লো। ওদিকে কেয়া মুখ অমবস্যা করে রাখে। আগের সেই উচ্ছ্বলতা আর নেই। কথা বললে দশ কথায় এক উত্তর মিলে। আগে খোঁচা দিত। এখন আর দেয় না। মেয়েরা যখন ভালোবাসার রেসে হেরে যায় বা পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করে তখন মুষড়ে পড়ে বা নিজেকে গুটিয়ে নেয়। আমি কি বালিকাদের মাইন্ড রিডার হয়ে যাচ্ছি? অথচ এই কয় বছর আগেও মেয়েদের নিয়ে এত গবেষণা বা অতি আগ্রহের জায়গাটা এত প্রকট ছিলো না। কেয়ার জন্য ভালো ভালো সম্পর্ক আসে। কিন্তু সে কোনটাতেই রাজী হয় না। তার বাবা-মা হতাশ। আন্টি একদিন ডেকে নিয়ে এগুলোই বললেন। আমার আইকিউ যদি কিছুটা থেকে থাকে তাহলে সঠিক আঁচ করতে পেরেছি আন্টি কেয়ার রোগের কারণ ধরতে পেরেছেন। মেয়েরাই মেয়েদের ভালো পরীক্ষক। তিনি ধরেই নিয়েছেন কেয়া আমার প্রতি ইনক্লাইন্ড। আসলে তিনি আমার মনোভাব জানতে চাচ্ছেন। আমার অন্তরাত্মা ভেতর থেকে গুন গুনিয়ে বলে উঠলো, ‘পালা। এখনো সময় আছে। বাঁচতে চাইলে পালা”। আমি পালাবার পথ খুঁজছি। ছায়ার আম্মাকে আমার পরিকল্পনার কথা জানালাম। বললাম আমাকে রিটেন এক্সামের জন্য গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে পড়তে হবে। তাই চার বন্ধু মিলে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েছি। সেখানেই উঠবো আগামী মাস থেকে। আন্টিও পাল্টা প্রস্তাব দিয়ে বসলেন, “তিন তলার ফ্ল্যাট আগামী মাস থেকে খালি হচ্ছে তোমরা এখানে এসে উঠো”। আমার প্ল্যান ভেস্তে যেতে বসলো। হাল ছেড়ে এখানেই চিলে কোঠায় পেয়িং গেস্ট বা লজিং মাস্টারের তকমা নিয়ে থাকলাম। আর কেয়া-ছায়ার খেলা দেখতে থাকলাম। আপদ সরাতে দু’জনকেই বললাম, “আমার অন্যত্র কমিটমেন্ট আছে। বিসিএস হয়ে গেলেই উই উইল টাই আপ টুগেদার”। মনে করেছিলাম আমার এই চায়নাম্যান গুগলিতে পরপর দুই বলে দুই উইকেটের পতন হবে। হাফ ছেড়ে বাঁচবো। কিন্তু হলো আরো বিপদ। উভয়েই মরিয়া হয়ে মাটি কামড়ে ক্রিজে পড়ে থাকার প্রানান্তকর প্রয়াস চালাতে থাকলো। কেয়ার স্ট্রেংথ সে আমার ক্লাসমেট, আর সরকারি কর্মকর্তা বাবার একমাত্র মেয়ে। আর ছায়ার স্ট্রেংথ হলো আমার উইকনেস। আমি লজিং মাস্টার, বাবার বন্ধুর ছেলে। তার ছোট ভাইয়ের প্রাইভেট টিউটর। এতদিন জানতাম ছেলেরা মেয়েদেরকে ইভ টিজিং করে। আর এখন দেখছি ছায়া, কেয়া উভয়েই আমাকে বিভিন্ন ভাবে সময় সুযোগ পেলেই টিজ করে। কেয়ারটা মেনে নেওয়া যায়, সে আমার ক্লাসমেট। কিন্তু ছায়া? সে তো অনেক জুনিয়র। দুরন্ত বিপ্লব এখন ফার্স্ট ইয়ার ডোন্ট কেয়ার ম্যুডে। তার সময় কম। আর ছায়া মেডিক্যাল ভর্তির জন্য যুদ্ধ করছে। তাকে এখন প্রায় সময়ই ছেদে দেখি। একদিন দেখা মাত্র বললাম, “সারাক্ষণ ছাদে ঘুরঘুর করো কেন”?
    — “কেন আপনার ডিস্টার্ব হচ্ছে? হবেই তো”। ছায়ার খোঁচা। কথার মোড় ঘুরিয়ে দিতে মেয়েদের মত এত নিপুণ শিল্পী আর হয়না। বললাম, “তোমার না সামনে মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষা”? কথা বলে শেষ করতে পারিনি ততক্ষণে ছায়ার পাল্টা হামলা, “আপনারও তো বিসিএস পরীক্ষা। সারাক্ষণ ছাদের দিকে তীর্থের কাকের মত তাকিয়ে বসে থাকেন। কখন উনি আসবেন সেই অপেক্ষায়”। বুঝলাম আমার মান-সম্মানে টান পড়েছে। আর এও বুঝলাম বালিকাদের নিয়ে বেশি ঘাটাঘাটি করা ঠিক না। এতে লাভ নেই, অহেতুক বিড়ম্বনা বাড়ে । বললাম, “আর কিছু বলবা”?
    — বলতে তো চাই
    — বলে ফেলো
    — লাইন ক্লিয়ার পাচ্ছি না তো
    — ব্যস্ত সংসারে লাইন ক্লিয়ার পাওয়া খুব কঠিন। দেখো না মোবাইলে বাজে “দা নাম্বার ইউ ডায়ালড ইজ বিজি নাও প্লিজ ট্রাই আফটার সাম টাইম”।
    — কারো মন ডিএক্টিভ থাকলে ঢুকবো কি করে?

    এই কথার পর আর কথা চলে না। বালিকাদের সাথে তর্ক করা মানে নিজের আহাম্মকি প্রকাশ করা। কেন জানি বললাম, “তুমি তো আমার অনেক জুনিয়র। কথাতে তো মা শা আল্লাহ পাকা”। এ কথায় বোমা বিস্ফোরণের মত হলো। এক ঝটকানি দিয়ে মুখের কাছে মুখ এনে ঝামটা মেরে বললো, “থাকেন আপনি ঐ বুড়িরে নিয়ে”। আমি হতভম্ব। ছায়া বিকট আওয়াজ করে ছাদের দরোজার উপর রাগ দেখিয়ে শব্দ করে চলে গেলো। সেই শব্দের উৎস সন্ধানে কেয়া তদন্তে এলো। তদন্ত একটা বাহানা মাত্র। বললো, “কে এসেছিলো? আর দরোজায় এত শব্দই বা হলো কেন”? আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। এখানে থাকলে আমি নির্ঘাত পাগল হয়ে যাবো। কথা কমাতে, ঝামেলা এড়াতে বললাম, “কই কেউ না তো। হয়ত বাতাসে শব্দ হয়েছে”। বালিকারা গোয়েন্দাগিরিতে দক্ষ। গন্ধ শুঁকে শুঁকে ঠিকই বের করে ফেলেছে ছায়া এসেছিলো। মেয়েলী পারফিউমের গন্ধ নাকি পাওয়া যাচ্ছে। আমি বিস্ময়ে হতবাক। হে ধরণী দ্বিখন্ডিত হও, আমি প্রবেশ করি। আমার লেখাপড়া রসাতলে যাওয়ার পথে। যাওয়ার পথে কি? অলরেডি চলে গেছে। নিজেকে এ মুহুর্তে খুব অসহায় লাগছে। কেয়া এসে বললো, “ল্যান্ড লর্ডের মেয়ে এত ঘন ঘন কেন আসে তোমার কাছে? কি চায় সে”? কেয়ার কথা আমি ক্লাসমেট বিবেচনায় রসিকতা হিসেবে নেই। আজ তার কথা মর্মে গিয়ে লাগলো। রক্ত গরম করে দিলো। বিশেষত তার শব্দ চয়ন অত্যন্ত নিম্নমানের আর আপত্তিকর ঠেকলো। ‘ল্যান্ড লর্ড’ শব্দ উল্লেখ করে প্রকারান্তরে সে আমাকে চূড়ান্ত হেয় করেছে। বললাম, “তুমি কেন আসো? কি চাও আমার কাছে”?
    — আমি তোমার ক্লাসমেট
    — তো
    — আমাদের কথাবার্তা থাকতেই পারে
    — তো
    –ওই অল্প বয়সী মেয়ের চেয়ে আমি কম কিসে?
    — তো
    — কত ভালো ভালো প্রপোজাল এসেছিল। না করে দিয়াছি
    — কেন?
    — তোমার মাথা খাবো বলে। এই বলে একই রুপ আওয়াজ তুলে ছাদের দরোজায় প্রচন্ড ধাক্কা মেরে কেয়া চলে গেলো।

    অবশেষে আমার বোধোদয় চূড়ান্ত হলো। এনাফ ইজ এনাফ। হেথা নয় হোথা নয় অন্য কোন খানে আমার গন্তব্য গাড়তে হবে। অতএব ব্যাক টু স্কয়ার। সেই আগের আইডিয়াতেই ফিরে যেতে হলো। চার বন্ধু মিলে তড়িঘড়ি করে একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলাম। বাবাকে বললাম গ্রুপ ডিসকাশনের মাধ্যমে বাকি ক’মাস না পড়লে হবে না। বাক্স পেটরা নিয়ে যাবার সময় নাটক হলো। কেউ কিছু বুঝলো না। আমি বুঝলাম। খবরটা জানার পর থেকে আন্টির সে কি দশা!

    এদিকে বাবার শারিরীক অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকলো। বড় বোনের বিয়ের সম্মন্ধ আসতে থাকলো। বয়স বেশি হয়ে গেলে মেয়েদের সম্পর্ক আগের মত আর আসেনা। আসলেও কেন বিয়ে হয়নি সে প্রশ্ন দারুণ প্রশ্নবোধক হয়ে ঘুরপাক খায়। কনে পক্ষ হিসেবে অস্বস্তি বোধ করি। বড় আপা তো বটেই। শেষমেশ বড় আপার বিয়ে হয়ে গেলো। হাসবেন্ড ভার্সিটির কেমিস্ট্রির এসিস্ট্যান্ট প্রফেসর।

    সেই ছায়া মেডিক্যালে চান্স পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। আমার উপর তার ভীষণ অভিমান আর ক্ষোভ। তার মনে হয়েছে আমি তাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেইনি। জুনিয়র বলে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। ভাবটা এমন যে, এবার তার দেখাবার পালা। আন্টি বাসায় ডেকে পাঠালেন। সবাই খুব খুশি। স্বল্প দিন হলেও ছায়া আমার ছাত্রী ছিলো। তাই আমারও খুশী লাগছে। দেখা হতেই বললাম, “কংগ্রেচুলেশন”। ফোঁড়ন কেটে বললো, “থাক লাগবেনা”। বললাম, “খবরটা শোনার পর থেকে আমার ভীষণ ভালো লাগছে”।
    — কেন?
    — বাহরে। এত ভাল করেছো। মেডিক্যালে চান্স পায় কয়জন?
    — কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছেন?
    — কখনো কি এমন বলেছি?
    — নিতেই পারেন। আফটার অল টিচার ছিলেন তো
    — খোঁটা দিচ্ছো?
    — মোটেই না। আমি বরং আপনার কাছে খুব কৃতজ্ঞ
    — কেন?
    — আপনার অবজ্ঞা আমাকে জেদি করেছে। আমি নিজেকে সেভাবেই প্রিপেয়ার্ড করেছি। লিভ ইট। আপনার সেই
    কেয়া না ফেয়ার খবর কি?
    — যোগাযোগ নেই
    — আহারে। সো স্যাড। পাখী অন্য ডালে বসেছে বোধহয়।
    — প্লিজ স্টপ ইট।
    — খুব লাগলো বুঝি?

    ছায়াদের বাসা থেকে ফিরে ভাবছিলাম এলোমেলো অনেক কিছু। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রেক্ষাপটই আলাদা। এখানে শিক্ষার আলো থাকে, নীতিবোধ পরিষ্কার থাকে, মান-অপমানবোধ টন্টনে থাকে। সীমাবদ্ধতা যেমন থাকে তেমনি স্ব-আরোপিত বিধি-নিষেধও থাকে। আর্থিক টানাপোড়েন থাকে কিন্তু সন্তুষ্টিও থাকে। এডজাস্টমেন্ট এদের জীবনে সহজাত। আর দশজনের মত তাদেরও সাধ-আহ্লাদ থাকে। আবেগ অনুভূতিও টইটম্বুর থাকে। এদের জীবনেও প্রেম আসে। কখনও গোপনে, কখনও সিনেমেটিক ধাক্কা মেরে।

    এর মধ্যে অনেকগুলো ঘটনা পর্যায়ক্রমিক ঘটে গেছে। আমার বিসিএস এর নিয়োগপত্র এসেছে। স্বপ্ন পূরণের আনন্দে বাবার চোখে অশ্রু দেখেছি। মা জড়িয়ে ধরে ছোটবেলার মত মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়েছে। গ্রাম জুড়ে আনন্দোৎসব। বাড়ী ভর্তি লোকজনের সমাগম। ছায়া রংপুর মেডিক্যালে সেকেন্ড ইয়ারে উঠেছে। খুশিতে ঘন ঘন ফোন দেয়। লম্বা সময় ধরে কথা বলে। ইদানীং তার কথাবার্তায় ওজন বেড়েছে। সেই সাথে প্রভাব বিস্তারের মনোভাবও। আর কেয়া হুট করেই যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। শুনেছি কানাডা প্রবাসীকে বিয়ে করে কানাডায় চলে গেছে। ভালোই করেছে। এরিমধ্যে বোনের ছেলে হয়েছে। আব্বার স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতিও হয়েছে।
    কাকতালীয়ভাবে আমার পোস্টিং হয়েছে রংপুর ডিসি অফিসে। বাবা-মা বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। মা খেতে দিয়ে পাশে বসে বললো,“ছায়াকে কেমন লাগে”? আমি কিছু না বুঝেই উত্তর দিলাম,“কোন ছায়া”? পরক্ষণেই বুঝতে পেরে বললাম,“কেন, কি হয়েছে”? মা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো,“তোর বাবা জিজ্ঞেস করছিলো। তাই”। বুঝলাম বাবার পছন্দ। পরে আরো শুনলাম উভয় পরিবার এরিমধ্যে গোল টেবিল বৈঠকে বসে প্রাথমিক আলাপ সেরেও রেখেছে। ছায়াও জানে। সে রাজী। হঠাৎই মনে পড়ে গেলো কয়েকদিন আগের কথা। ফোনালাপের এক পর্যায়ে ছায়া আচমকা বলে বসলো,“অবশেষে সব পাখী ঘরে ফিরে”। আমি কিছু না ভেবেই জাস্ট মজা নেওয়ার জন্য বলেছিলাম,“পাখী এখন মগডালে”। ছায়াও কম যায় না। বললো,“ডানা কেটে দিলে ঠিকানা এই হাসপাতালে”।

    তার এই কথার শানে নুযুল এখন বুঝতে পারছি।

  • উঠোন পেরিয়ে আফ্রিকা (পর্ব-১)

    উঠোন পেরিয়ে আফ্রিকা (পর্ব-১)

    হঠাৎ দেখা ডুলুটি লেক

    ভ্রমণ কাহিনীর শুরু কোথা থেকে হওয়া উচিত, যখন গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম তখন থেকে, নাকি যখন থেকে কোথায় যাওয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে তখন থেকে? আমার কাছে মনে হচ্ছে, কিছুটা আগে থেকে শুরু করলে হয়তো ভালো লাগবে। এখন এই কিছুটা আগে মানে কতটুকু আগে সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না।

    আমরা তানজানিয়াতে এসেছি ১৫ দিনের মত হয়েছে। সোহান ১১ মাসের একটা কোর্সে এখানে এসেছে। তার সাথে লেজ হিসাবে আমরাও এখানে আসার সুযোগ পেয়েছি। এখানে এসেই সোহান বেচারা কোর্সের নানারকম চাপে পরে গিয়েছে। প্রতিদিন অন্ধকার ফুরিয়ে যাবার আগে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, ফিরে আসে অন্ধকার নামে যখন। সাপ্তাহিক ছুটি আমাদের জন্য অতি কাংখিত। সেদিন মানে ১৫ তম দিনটা ছিল শুক্রবার, দেশে শুক্রবার ছুটির দিন, আমার কাছে তখনো শুক্রবার মানেই ছুটির গন্ধ; কিন্তু সোহান এখানে অফিস করছে; দেশের ঝলমলে ছুটির দিনের কথা মনে করে মনখারাপ ভাব নিয়েই সারাদিন পার করে; বিকালে ফোন দিলাম,
    —‘কখন আসবা?? শনি, রবি দুইদিন ছুটি পাবা তো? কাজ দিবে না তো’??

    সে জানান দিল, এখনো কিছু দেয় নাই, মনে হয় ছুটি পাব। তার এক ঘন্টা পর ফোন দিয়ে বলে, এসাইনমেন্ট দিছে, এখন আসতে দেরি হবে আর রবিবারও আসতে হবে। এইসব শুনলে, কেমন লাগে!! একদা একটা সময় পার করেছি জেনে, ডিফেন্সের লোকজন ইন্টারমেডিয়েট পাশ। ২০০৯ থেকে তার সাথে বসবাস করে জেনেছি যুদ্ধবিদ্যাও পড়াশোনার কম বড় ক্ষেত্র নয়; আমার পড়াশোনা কোন অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে, তার পড়াশোনা, এখনো চলছে।

    রাত্রি অন্ধকার করে বাসায় ফিরে সোহান; তারপর কোনরকম রাত পার করে সকাল হতেই আমাকে বললো,
    —আজকে অফিসে যাই, এসাইনমেন্টের কাজ আর লেখা শেষ করে একবারে জমা দিয়ে আসি, তাহলে আগামীকাল বেড়াতে যেতে পারবো।

    জামাই অফিসের কাজে বেশি ব্যস্ত থাকলে, বউয়ের চারপাশে অভিমানের বাষ্প ঘুরে বেড়াতে থাকে। কথা বলার কোন ইচ্ছাই হচ্ছিল না, যা খুশি কর গিয়া।

    সেই যে সে অফিস গেল আর আসে না; বিকেলে অভিমানেরা সরে গিয়ে কোথা থেকে মায়ার বাষ্প এসে হাজির হলো। ফোন দিয়ে শুধাই, ‘কখন আসবা, আজকে শনিবার, ছুটির দিন ছিল’। সে বলে ৬০ ভাগ কাজ হইছে, এখনো ৪০ ভাগ কাজ বাকি। এখন চলে আসতেছি বাসায়, রাত জেগে লেখা লাগবে মনে হয়। বাসায় এসে কাহিল বেচারা বলে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে এসাইনমেন্ট কলেজে জমা দিতে হবে। একটা কাজ করি, সকালে সবাই একসাথে বের হয়ে যাবো, কলেজে এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে, বেড়াতে চলে যাবো।

    কিন্তু মেয়ের অনলাইন স্কুল ঈদের পর তার পরদিন থেকেই শুরু হবে। বাংলাদেশের সময় ৯.৩০ টায় কিন্তু তানজানিয়ান সময় ৬.৩০ টায়। আমি বলি, এত অস্থির হওয়া লাগবে না। মেয়ের তো ১০ টায় স্কুল শেষ হবে, মেয়ের ক্লাস শেষ হলেই না হয় বেড়াতে যাই। এর মাঝে তুমি এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে এসো। তখন পর্যন্ত জানি না, আদৌ যেতে পারবো কিনা বা কোথায় যাবো।

    পরদিন ৬ টায় মেয়েকে ঘুম থেকে উঠিয়ে স্কুলের জন্য রেডি করলাম। আর সোহান লেখা শেষ করে চা নাস্তা খেয়ে কলেজে রওনা হলো এসাইনমেন্ট জমা দিতে। আমি মজা করে বলেছিলাম কেউ কি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ওখানে, সকালে জমা দিলা নাকি দেখার জন্য। সে বলে লকার ক্লোজ করে দিবে, পরে আর দেওয়া যাবে না। আমি ঠিক জানি না দুনিয়া এত কঠিন কিনা; সে সারা জীবন তার দুনিয়া এত কঠিন হিসাবেই দেখায় আমাকে।

    সাড়ে নয়টার মাঝেই সে বাসায় চলে আসলো। ছোট মেয়ে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। তাকে খাওয়াতে শুরু করলাম। আমরা রেডি না দেখে, সোহান আবার তার কাজে বসে গেলো। আমরা সব গুছিয়ে রেডি হয়ে, তাকে জানালাম এইবার টেবিল থেকে উঠেন সাহেব। তার বেশিক্ষণ লাগলো না রেডি হতে কিন্তু বাসা থেকে বের হবো কিভাবে চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। সারা বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম কিন্তু পাচ্ছি না। চারজন মিলে চারদিকে খুঁজতেছি কিন্তু নাই চাবি। শেষ আগের দিন বিকালে আমিই দরজা খুলেছি কিন্তু চাবি কই রাখলাম। কি এক যন্ত্রণা, সবসময় ভেজাল একটা লাগবেই। আমি ভয়ে ভয়ে কয়েকবার বলেই ফেললাম দরজা লক না করেই যাই। সোহান কিছু বলে না, চাবি খুঁজেই চলেছে। বুঝলাম দরজা না লাগিয়ে যাবে না।

    বহুত সময় পার করে অবশেষে চাবি খুঁজে পেলাম, মজার ব্যাপার যেখানে সবসময় রাখি সেখানেই ছিল শুধু কিছু একটার নিচে ছিল।

    মনে হলো অনেক কিছু পাড়ি দিয়ে অবশেষে গাড়ি নিয়ে বের হতে পারলাম। মাউন্ট মেরুর পাদদেশে আরুশা অদ্ভুত এক সুন্দর শহর যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০০ ফুট উঁচুতে। কিন্তু আপনি যখন শহরে ঘুরে বেড়াবেন তখন আপনার মনে হবে না আপনি পাহাড়ে, পুরোটাই সমতল ভূমি মনে হবে। শহরের যে প্রান্তেই যান না কেন, দেখবেন মাউন্ট মেরু আলাদা রূপ নিয়ে আপনার সাথে ঘুরছে। প্রতিদিনই আমরা মাউন্ট মেরুর রুপে মুগ্ধ হই। সোহানের ভেজাল ছাড়া কোন সাপ্তাহিক ছুটি পাওয়ামাত্রই আমরা মাউন্ট মেরু দেখতে দৌঁড়াবো, ইনশাআল্লাহ। এই শহরের আরেকটা প্রশংসনীয় ব্যাপার হলো অল্প কিছু রাস্তা পরপরই নার্সারি।আমার কাছে তো মনে হয় সারা শহর জুড়ে নার্সারী। আপনার মনে হতে বাধ্য, ফুল গাছ হলেও কয়েকটা গাছ কিনে ফেলি। যেমন আমার মাথাতেও ঘুরছে। নিতান্তই গাছ লালন-পালনে খুবই খারাপ বলে, সোহানকে জোর দিয়ে বলছি না কিছু। গাড়ি এখন আরুশা শহরের একমাত্র গল্ফ কোর্সের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। গল্ফ কোর্সের বাহিরের রাস্তার বহু বছরের পুরানো গাছের দিকে উদাসী চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, গাড়িতে স্পেয়ার চাকা লাগানো। দুইদিন আগে খুব সকালে সোহান কলেজে যাওয়ার সময় খুব ভয়ানক ভাবে গাড়ির টায়ার পাংচার হয়েছে। তখন থেকে স্পেয়ার চাকা গাড়িতে লাগানো। পরে জানতে পারলাম, তাপমাত্রা অনেক বেশি উঠানামা হলে এরকম হতে পারে। আরুশাতে এখন শীতকাল চলছে। সকালে রাতে ভয়ানক ঠান্ডা থাকে, সূর্য উঠলে তাপমাত্রা বাড়ে। তাপমাত্রার উঠানামায় টায়ারের ভেতরের প্রেশারের উঠানামা হয়, প্রেশার কম থাকলে খারাপ দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। এসব জানার পর থেকে আমি খুবই ভয়ে থাকি; সোহান সেই সকালে অফিসে যায়, রাতে আসে; তাই তার আর সময় হয় না ঠিক করার।

    এই বেড়াতে যাওয়ার সময় আমি যদি এটা নিয়ে কিছু বলি, ঝাড়ি খাওয়ার সমূহ চান্স আছে। তাই আমি ঘুরিয়ে সোহানকে বললাম, তোমাকে খুবই সাহসী বলতেই হয়। স্পেয়ার চাকা গাড়িতে লাগিয়ে বউ বাচ্চাসহ ঘুরে বেড়াচ্ছ।

    সে হেসে বলে, ‘সাহসী না বেকুব মানুষ, বেকুব মানুষের সাহস বেশি থাকে।‘ আমি বললাম, ‘আমি এই কথা বললে তো মুখ বেজার হয়ে যাইত তোমার’।

    প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য তখন সে আমাকে জানালো আমরা ডুলুটি লেকে যাচ্ছি। আরুশা থেকে মাত্র ১৪ কি.মি দূরে। যেহেতু আমাদের হাতে সময় বেশি নাই, আমরা এখানে ঘুরে ফিরে বিকালের মাঝে বাসায় চলে আসতে পারবো। মেইন রোড থেকে আমরা শাখা রোডে এখন উঠলাম। আরুশার মেইন রোড খুবই ভালো, বাম-ডানহীন সোজা রাস্তা, কিন্তু শাখা-প্রশাখা রাস্তার অবস্থা বেশি ভাল না, সব মাটির রাস্তা। আগের সপ্তাহে আমরা ঝর্ণা দেখতে গিয়ে, পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে যেতে হয়েছিল। সে অভিজ্ঞতার আলোকে এখন মাটির রাস্তা দেখলেই ভয় লাগে। লেকের ১ কি.মি বাকি থাকতে সোহান বলল, গাড়িটা এখানে রেখে আমরা বাকি রাস্তা হেঁটে যেতে পারি। ড্রাইভার সাহেব এই কথা বললে তখন তো অন্য কিছু বলার অপশন থাকে না। আমার একটু খচখচ লাগছে, গাড়ি এমন রাস্তার পাশে রাখলে কি ভালো দেখায়, অন্য কোন জায়গায় রেখে যেতে পারলে ভালো হতো। ১২ বছর সংসার করে আমি এখন এটুকু বুঝে গেছি এসব বলে আসলে লাভ নাই, মাঝখান থেকে আমার বেড়ানো হবে বেজার মুখে। তারপরও আমার ভাল লাগে নাই এই খানে গাড়ি রাখা, এইটা তো জানানো উচিত; তাই এক/ দুইবার এসব বলে, দুই মেয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই। ছোট মেয়ে নিয়ে বেশি সমস্যা না, সে মনের আনন্দে দৌড়াবে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিবে। সব সমস্যা বড়টাকে নিয়ে, সে হাঁটতে চায় না, পুরোটা সময় প্যানপ্যান করতে থাকবে, আর কত দূর হাঁটতে হবে, পা ব্যথা করতেছে, বাবা কেন গাড়ি নিয়ে আসলো না, ওখানে যাওয়ার কি দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ছোটটাকে নিয়ে সামনে সামনে হাঁটতে থাকলাম। এক তানজানিয়ান বুড়া সাইকেল চালিয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সোহানকে কি কি যেন বললো। ভাষা কিছু বুঝা যায় না। কিন্তু ভাব দেখে মনে হলো, আমাদের দেশের বুড়োরা রাস্তায় কাউকে দেখলে বলে না, ‘কই যাও?? লেকে যাবা?? হ হ সামনেই সামনেই, যাও যাও।‘ আমার দেখে মনে হলো এটাই বলছে। দুসপ্তাহ আফ্রিকায় বসবাস করে আমার মনে হয়েছে, আফ্রিকান মানুষজন সহজ-সরল। সাইজে একটু বড়সড় কিন্তু ওরা মানুষ খারাপ না।

    খানা খন্দ পার হয়ে সোহান বললো, ঝরা এখান দিয়ে তো গাড়ি যাবে, তোমরা সামনে আগাও, আমি গাড়ি নিয়ে আসি।

    আমি ভালো মানুষের মত বললাম, আচ্ছা। নয়তো এখানে আমি তো বলতেই পারতাম, গত সপ্তাহে কি ভয়ানক উঁচুনিচু রাস্তা পার হয়ে পাহাড়ে উঠে গেলা আর এই সপ্তাহে সমতলে একটু কাঁদাপানি দেখে গাড়ি রেখে আসতে হইলো! বয়স হয়েছে তো তাই এখন আর এইসব হাবিজাবি কথা বলি না। আমার সবকিছুতে সেও হুঁ বলে, আমিও তার সব কিছুতে হুঁ বলি।

    সোহান গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে প্রায়, সেবন্তি গাড়ি দেখেই দাঁড়িয়ে গেল, গাড়িতে উঠবে। ছোট মেয়ে উঠবে না, সে হাঁটবে। আমি বললাম লেকে গিয়েও হয়তো হাঁটতে হবে, আগে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে যেও না। সে রাজি হইলো, আমরা সবাই আবার গাড়িতে উঠলাম। এই রাস্তাটা আমাদের গ্রামের মেঠো পথের মত। পার্থক্য হলো চারপাশে অনেক গাছপালা, সূর্য উঠে নাই বলে এক টার মত বাজলেও অনেক ঠান্ডা। চারপাশটা ভেজা ভেজা লাগছে। লেকে পৌঁছানোর ৫ মিনিট আগে সোহানের আবার মনে হলো গাড়ি সাইড করে রেখে যাবে। আমরা আবার গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। সে গাড়ি সাইড করে রেখে আমাদের সাথে, হাঁটা শুরু করলো। অল্প সামনেই একটা ক্যাম্প সাইট দেখতে পেলাম। ভেতরে রেষ্টুরেন্ট আছে। রেষ্টুরেন্টের সামনে শেড দেওয়া বসার জায়গা। লেকের চারপাশে অনেক গাছপালা আর উঁচু উঁচু পাহাড়। লেকের পাড়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকেও বসার জায়গা আছে। আরো অনেক ইউরোপীয় টুরিস্ট ছিল। ওরা খোঁজখবর নিচ্ছিল বোটে করে ঘুরতে কত লাগে। লেকের চারদিকে সরকারি ভাবে ওয়াকওয়ে বানানো। সেখানে হাঁটতে হলে টিকেট কাটা লাগবে। বোটে ঘুরতে আমাদের কাছে জনপ্রতি ৩০ ডলার চাইলো। চারজনের নৌকাভ্রমণ খুবই ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। আমরা ওখান থেকে চলে আসছিলাম, তখন বললো আমাদের জন্য কমিয়ে ২০ ডলারে দিবে। সেটাও তো আমাদের জন্য অনেক হয়ে যায়। সেখান থেকে বের হয়ে হাঁটবো ভাবছিলাম কিন্তু পাশেই আরেকটা কিছুটা সাদামাটা ক্যাম্প সাইট দেখে ওখানে ঢুকে গেলাম। সেখানেও একটা রেষ্টুরেন্ট আছে, রেস্টুরেন্ট দেখলেই আমার বড় মেয়ের চিকেনের ক্ষুধা পায়, আর ছোট মেয়ের ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ক্ষুধা। এখানে খাবার অর্ডার করতে করতে জানতে চাইলাম নৌকায় ঘুরতে কত লাগবে , তানজানিয়ান একটা ছেলে হোসেইন জানালো, পুরোটা ঘুরতে ৮০০০০ শিলিং আর অর্ধেক ঘুরতে ৪০০০০ শিলিং লাগবে। আমাদের জন্য খুবই চমৎকার প্রস্তাব। সোহান তার সাথে কথা বলে সব কিছু ঠিকাঠাক করে গেল গাড়ি ক্যাম্প সাইটে নিয়ে আসতে।

    এতক্ষণে লেকের পাশে একটু শান্তিতে বসতে পারলাম। ডুলুটি লেক হচ্ছে ভল্কানিক ক্রেটার লেক। অগ্নুৎপাতের কারনে পাহাড়টা মাঝখানে গলে দেবে যায়, আর চারদিকে অবশিষ্টাংশ পাহাড় উঁচু পাহাড় হয়ে রয়ে যায়, অনেকটা বেসিনের মত। সোহান বলল তানজানিয়ায় এরকম অসংখ্য ভল্কানিক ক্রেটার আছে। বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে আড়াই মিলিয়ন বছর আগে। আগ্নেয়গিরিগুলো সব মৃত। তবে দুটো নাকি এখনও মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দেয়। উঁচু পাহাড়ে ঘেরা সবুজ ডুলুটি লেকের সামনে দুই বাচ্চা নিয়ে আমি অতি সাধারণ এক বাংলাদেশি মেয়ে বসে আছি। আমি কখনো কল্পনাও করি নাই মহান আল্লাহতায়ালা আমাকে এইখানে আসার সুযোগ করে দিবেন। আমি ফিরে ফিরে শুধু এই লেকের সৃষ্টির সময়টাতে চলে যাচ্ছিলাম। কি ভয়ানক শক্তিমত্তার আস্ফালন চলেছে এখানে!! পৃথিবী তার ভেতরকার যত উত্তাপ, অস্বস্তি, উম্মাদনা বের করে দিয়ে শান্ত-শীতল লেক হয়ে গেল।

    রোদ উঠেছে, রোদ উঠলেই সেটা তীব্র হয়ে যায়। গরম কাপড় খুলে ফেলতে হচ্ছে। প্লাস্টিকের টেবিলের উপর জড়ো করে রেখে দিলাম। বাচ্চারা বিরক্ত করছে। লেকের পাড়ের মাটিতে তারা নানারকম পোকা খুঁজে পাচ্ছে। ছোট মেয়ে পা মাটিতে ফেলতেই পারছে না আর বড় মেয়ে এক কুকুরের ভয়ে সেঁটিয়ে আছে। তাদের বাবা এসে বকা দেওয়ার চেষ্টা করছে, এত ভয় পাওয়ার কি আছে?? যথারীতি তার বকাঝকায় কোন কাজ হচ্ছে না, মেয়েরা আতংকিত হয়ে রয়েছে। অন্য পাশে একটু পাকা মত জায়গা ছিল, মেয়েদের নিয়ে সেখানে গিয়ে বসার পর তারা ঠান্ডা হলো। হোসেইন এসে জানালো চিকেন দিতে দেরি হবে। আমরা বললাম কোন সমস্যা নাই, নৌকাভ্রমণ শেষ করে চিকেন খাওয়া যাবে। আপাতত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিলেই হবে। সোহান মেয়েদের পাখি দেখাচ্ছে, আমরা যেখানে বসেছি তার খুব কাছেই বড় একটা মাছ রাঙ্গা পাখি বার বার ঘুরে ঘুরে আসছিল। বাবা মেয়েরা মহা উৎসাহে পাখি দেখা শুরু করলো।

    ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে গেলো। এ কয়দিন তানজানিয়ান বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে খেয়ে মনে হলো ওরা খাবারে লবণ কম দেয়। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইতে একদম লবণ দেয় না। লবণ নিজেরা দিয়ে খেতে হয়। এখানে অনেক বানর গাছের ডালে ডালে লাফাচ্ছে। নৌকায় ঘুরার সময় অতিরিক্ত কাপড়গুলো লেকের পাড়ে রেখে যাওয়ার সাহস হলো না, সোহান গাড়িতে রেখে আসলো। হোসেইন নৌকা চালাবে। চার সিটের নৌকা, মেয়েরা তাদের পছন্দমত জায়গায় বসে গেল।

    লেকের পাড় ঘেঁষে নৌকা চলছে। এত গাছপালা যে লেকের পাড়ে যে ওয়াকওয়ে আছে সেটা বোঝা যায় না। আমি হোসেইনকে জিগ্যেস করলাম, ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় কি লেক দেখা যায়, আমি তো কোন রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। যেখানে গাছপালা একটু হালকা হয়ে আসে, সেখান দিয়ে লেক দেখা যায় জানালো সে। সোহান বললো আরেকদিন আসা লাগবে হাঁটার জন্য। হোসেইন জানালো ৪ কিমি এর মত ওয়াকওয়ে। টিকেট কাটতে লোকালদের জন্য লাগবে ২০০০ শিলিং আর টুরিস্টদের জন্য লাগবে ২৩০০০ শিলিং। ১০০০ শিলিং ৩৬ টাকার মত। সব জায়গাতেই টুরিস্টদের কাছে থেকে এত পয়সা নেওয়া হয়, খুব খারাপ দুনিয়া!!

    মাথা উঁচু করে পাহাড় দেখছিলাম। পাহাড়ের উপরের বাড়িগুলো ছোট ছোট দেখা যাচ্ছে। ঐ উপর থেকে লেকটা কেমন দেখা যায় সেটাও যদি দেখা যেত! পাহাড়ের উপর চোখে পড়ার মতো সুন্দর একটা বাড়ি দেখা গেল, সেটা এক জার্মান ভদ্রলোকের বাড়ি। তানজানিয়ান সরকার তাকে এই বাড়ি দিয়েছেন। পরে গুগল করে জানলাম ১৯৫৯ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট গোরংগোরো ক্রেটার সংরক্ষণের কাজে তার অবদানের জন্য খুশি হয়ে তানজানিয়ান সরকার তাকে এই বাড়ি উপহার দিয়েছে। ওখানে তাকালে এরকম একটা বাড়ির লোভ আপনারও হবে। সোহান অবশ্য এখানে বাড়ি বানাতে খরচ কেমন হবে হোসেইনের সাথে হিসাব-নিকাশ করে জানান দিলো, এখানে সে একটা বাড়ি কিনতে পারবে; আমি বললাম, শুধু দেশ থেকে প্রতিবছর এত টাকা খরচ করে সে বাড়ি দেখতে আসা হবে না আমাদের।

    লেকের পানি একদম সবুজ কিন্তু টলটলে পরিস্কার। আমাদের সামনেই একটা আফ্রিকান মেছো ঈগল বড় একটা মাছ শিকার করে দ্রুত নিয়ে গেলো। হোসেইন ধীর গতিতেই নৌকা বাই ছিল আর সোহানের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। এই লেকে সাঁতার কাটা এবং মাছ ধরা নিষেধ। লেকটি ভি-শেপ, মাঝখানে বেশ গভীর; প্রায় ১৫০ মিটারের মত বলে জানাল হোসেইন। লেকটি পাড় থেকে ধীরে ধীরে মাঝ বরাবর গভীর হয়ে গিয়েছে। সারাবছরই লেকে এমন পানি থাকে, ভূ-গর্ভস্থ পানি আর সারাবছরের বৃষ্টিপাত লেকের পানির উৎস। লেকের পানির উপরেই যে গাছপালা তাতে অনেক বাবুই পাখির বাসা দেখতে পেলাম। এছাড়া বড় পুরানো একটা গাছের উপর দেখলাম বিশাল বড় একটা পাখির বাসা। সোহান জানালো এটা হামার কপ পাখির বাসা। অনেক প্যাপিরাস গাছ; ঐ যে ছোট বেলায় পড়েছিলাম আমরা, প্যাপিরাস গাছ থেকেই কাগজের উৎপত্তি। ঝোপের নিচ দিয়ে পানকৌড়ি আর ডাহুক পাখি ঘুরছিল, মানুষের সাড়া পেয়ে লুকিয়ে গেলো।

    সোহান কথায় কথায় হোসেইনকে জানালো আমি সোহেলী ভাষা শিখছি। আমি কটমট চোখে সোহানের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার চোখের সাইজ খুব খারাপ, হাসলে বেশির ভাগ সময় চোখ বন্ধ হয়ে যায়। তাই কটমট তাকানো, বাসার লোক ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। হোসেন খুবই আগ্রহ সহকারে আমার দিকে তাকালো। আমার তখন ‘হাবারি’ ছাড়া কিছু মনে পড়ছে না। হাবারি মানে হলো হাই বা হ্যালো। আরও বলতে পারলাম, ‘মিমি নি সুরাইয়া’আমার নাম সুরাইয়া, ‘নাইস টু মিট ইউ’ শিখেছিলাম কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না, শুধু শেষের ‘না উইয়ে উইয়ে’ মনে পড়ছিল। হোসেইন নতুন একটা শব্দ শিখালো, ‘পোলে’ সহেলি ভাষায় অর্থ দুঃখিত কিন্তু ‘পোলে পোলে’ অর্থ ধীরে। এছাড়া কারিবু মানে হলো স্বাগতম, আসানতে মানে ধন্যবাদ, আসানতে সানা মানে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    লেকের পাড় দিয়ে চলতে চলতে লেকের মাঝখানে চলে আসলাম, এখন মাঝ বরাবর আমাদের ফিরিয়ে নিবে ঘাটে। ততক্ষণে সূর্যের আলো চলে গিয়েছে, সূর্যের আলো চলে গেলেই এত পিনপিন করা ঠান্ডা লাগে,মেয়েদের জন্য টেনশন লাগছিল, গরম কাপড় তো সব রেখে এসেছি। এতক্ষণ এত ধীরে চলছিল নৌকা, লেকের মাঝখানে দিয়ে ফেরার পথ দেখে মনে হলো নৌকা বেয়ে এই পথ পাড়ি দিতে তো রাত নেমে যাবে। কিন্তু আসলে বেশিক্ষণ লাগেনি। আমি শুধু পাহাড়ের উপর তাকাই আর ভাবি, ওখান থেকে লেকটা না জানি কত সুন্দর দেখায়, একটু যদি দেখা যেত; আহা! আমার যদি থাকত পাখির চোখ।

    আমরা ঘাটে চলে আসলাম। দিন শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু নীল আকাশের রঙয়ে লেকের সবুজ পানিও নীল হয়ে গিয়েছে। ফিরে যাওয়ার আগে, আমি আর সোহান শুধু ছবি তুলছিলাম। ক্যামেরাবন্দী প্রতিটা ছবি অপরূপ লাগছিল। মেয়েরা বাবামায়ের এই ছবি তোলার আতিশয্যে অতিশয় বিরক্ত হচ্ছিল। অর্ডার করা চিকেন প্যাকেট করে দিল হোসেইন। সেটা নিয়ে, মেয়েদের গাড়িতে তুলে, আবার ফেরার পথ ধরলাম।

    আহ শান্তি!! তিন/চার ঘণ্টার ডুলুটি লেকের এই ভ্রমণ মনকে চড়ুই পাখির মত চঞ্চল করে দিল। আবার কবে কোথায় যেতে পারবো, তা তো জানি না। ততদিন পর্যন্ত ডুলুটি লেকই না হয় মনের আঙিনায় ফিরে ফিরে আসুক।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-২)

    আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-২)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    লজিং মাস্টার
    আনোয়ার হাকিম

    পর্ব-২
    আরেকটা বিপদ আচমকা যুক্ত হলো। এই চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ীর একটিতে যে আমার সহপাঠী কেয়ারা ভাড়া থাকে তা আমার জানা ছিলো না। আমি মেয়েদের এড়িয়ে চলি। তবে সব সময় পারিও না। ভাল ছাত্রের তকমা থাকায় সহপাঠীরা পাঠোদ্ধারের জন্য আসত। তাদের মধ্যে মেয়েরাই একটু বেশি। এদের বিভিন্ন ছল, বিভিন্ন আবদার। সবই বুঝি কিন্তু মেধাবীর স্বীকৃতির ঘ্রাণ সুমিষ্ট বোধ হওয়ায় এড়িয়ে যেতেও মন সায় দেয় না।

    একদিন শীতের বিকেলে দুরন্ত বিপ্লবকে বশে আনবার প্রয়াসে ব্যাট বল খেলছিলাম। প্রশস্ত ছাদের এক কোণায় শুকনো কাপড় নেওয়ার নাম করে ছায়ার ছায়া ঘুরঘুর করছে। এমন সময় অকস্মাৎ কেয়া এসে হাজির। আমাকে দেখে সে সশব্দে এমন আবেগ প্রকাশ করলো যেন পারলে সিনেমার নায়িকার মত দু’হাত প্রশস্ত করে বাহুলগ্না হয়। সেই আবহসংগীতসহ দৃশ্য ছায়া’র নজরে এলো। শীতের বিকেল টুপ করে ছাদে সন্ধ্যার আগমনী ছায়া ফেললো। একটু পরেই মাগরিবের আযান দেবে। এরপর রুটিন মোতাবেক দুরন্তকে ঘন্টাখানেক সাইজ করার দায়িত্ব। দুরন্ত বিপ্লবকে বিদায় করলাম। ছায়া বিস্ময়ের ঘোর অমানিশা নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো। বাকি থাকলাম আমি আর কেয়া। কেয়ার সে কি আনন্দ! সন্ধ্যায় আমাকে কেয়াদের বাসায় যেতেই হবে এই তার বায়না। কোন কথাই সে শুনবে না। মান-সম্মানের বিষয়টি বরাবরই আমার প্রায়োরিটি লিস্টের শীর্ষে থাকে। শীতের এই কাল সন্ধ্যায় সহপাঠী কেয়ার সাথে কেউ এভাবে দেখলে কি থেকে কি ভেবে বসে থাকবে কে জানে? আর তার সাথে কি এমন কথা থাকতে পারে যে অধিককাল চলতে পারে? বলে রাখা ভালো কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে তো বটেই পুরো কলেজেই হাতেগোনা নীলাঞ্জনা টাইপের মধ্যে সে অন্যতমা। কেয়া ভালো আবৃত্তি করে, ভাল গান গায়। কলেজের প্রতিযোগিতায় এ দুই বিভাগে সে চ্যাম্পিয়ন।
    এরুপ বিব্রতকর ও ইতস্ততবিক্ষিপ্ত অবস্থায় লক্ষ্য করলাম ছায়া দুরন্ত বিপ্লবকে নিয়ে ছাদে কি খুঁজতে যেন ফিরে এলো। বুঝলাম কেয়ার উপস্থিতি চাক্ষুষ করতেই তার এই অনাবশ্যক আগমন। মাগরিবের আযান চলছে। আমি কেয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সন্ধ্যার পর তাদের বাসায় যাবো এই ওয়াদা কবুল করতে বাধ্য হলাম। কেয়া নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পর ছায়ার আর থাকার আবশ্যকতা নেই। দেখলাম আমার এ ভাবনা যথার্থ। হাসিও পেলো। বাবার মুখটা ভেসে উঠলো। বিসিএস আর ম্যাজিস্ট্রেট ভিন্ন আমার আর কোন এজেন্ডা নেই। থাকতে পারেনা। থাকা উচিত না। সন্ধ্যার পর কেয়াদের বাসায় গেলাম। কেয়ার আম্মা অত্যন্ত শান্ত-শিষ্ট। তার বাবা সরকারি কর্মকর্তা। রাশভারি। তাই বাসায় থাকলেও তাঁর দর্শন মিলেনি। কেয়া তাদের একমাত্র সন্তান। কেয়াকে এতই উচ্ছ্বল লাগলো যা আগে কোনদিন দেখিনি। বুঝলাম তার মনে প্রচুর আনন্দ খেলা করছে। আর মননে কি খেলছে তা জানার সাধ্য নাই। এদিকে ঘটেছে আরেক বিপত্তি। কেয়াদের বাসায় অপরিকল্পিত এই সৌজন্য সাক্ষাতে যাওয়ার খবর দুরন্ত বিপ্লবকে জানাতে ভুলে গেছি। এই নিয়ে কারো অনুযোগ নেই। কিন্তু বিষয়টি যে ছায়ার মনঃপূত হয়নি তা বুঝতে বাকি থাকলো না।

    বিসিএস এর প্রিপারেশন জোরেশোরে চলছে। আমার কাছে মাস্টার্সের চেয়ে এটাই এখন টপ প্রায়োরিটি। কলেজ বন্ধ। ঘন ঘন বাড়ী না গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বাবার তাগাদা অব্যাহত। এরকম একদিনে বসে বসে ভাবছিলাম অনেক কিছু। জীবনের রঙ কিরুপ? উদ্ভট এ জিজ্ঞাসা মননে মগজে কেন এলো বুঝে উঠতে পারলাম না। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় মনে হলো জীবনের রঙ স্বচ্ছ প্রিজম কাঁচে আলোর প্রতিসরণের মত। যেভাবে আলো ফেলবেন ঠিক সে বরাবর অগ্রসর হবে না। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।

    দুরন্ত বিপ্লবকে বশীভূত করার প্ল্যান প্রাথমিক ভাবে ক্লিক করেছে। আমি তার সার্বক্ষণিক খেলা বিষয়ক সাথী। বিশেষত ক্রিকেটের। এভাবে সে হয়ে উঠেছে আমার অনুরক্ত ভক্ত। আমার চূড়ান্ত প্ল্যানও কাজ করেছে এক শর্তে। বিকেলে ক্রিকেট, নো ইন্টারফেরেন্স। আর বাকী সময় পড়ালেখা, নো ছলচাতুরী। এক্ষেত্রে আমাকে প্রায়ই নানা উপলক্ষ্য তৈরি করে প্রাইজ হিসেবে কিছু ইনভেস্ট করতে হয়। মানুষের সামনে টার্গেট না থাকলে জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে মৃগী রুগীর মত ভীমড়ি খেতে থাকে। ইংরেজী আর অংকে সে কাঁচা। ভালো করলেই পুরষ্কার মিলবে এমন ঘোষণায় কাজ হলো চমৎকার। আন্টি ডেকে পাঠালেন। বাসায় ঢুকতেই পোলাও পোলাও গন্ধ। বুঝলাম আজ রীচ ফুড হবে। কলিং বেল টিপতে দেরি কিন্তু দরোজা খুলতে সময় লাগলো না। ছায়া দাঁড়িয়ে। ছায়ার সাথে আমার কথা হয়না তেমন। সেও বলেনা। কিন্তু মুখটা দুখু দুখু করে রাখে। যাদের মুখশ্রী সুশ্রী তাদের এরকম দুখু দুখু মুখ আলাদা বিভা ছড়ায়। বললাম, “ভালো আছো”? সোজা উত্তর না দিয়ে বললো, “আসেন। ভেতরে এসে বসেন”। আন্টি এলেন। তারিফ করলেন। ছায়া যে দরোজার আশপাশ দিয়ে অযথা যাতায়াত করছে টের পাচ্ছি। দুরন্ত বিপ্লব এলো। আন্টি উঠে গেলেন। বললাম, “এবার অংকটাকে কুপোকাত করতে হবে”। বিপ্লব মাথা নাড়লো। আচমকা বলে ফেললো, “আপু অংকে আমার চেয়েও কাঁচা”। আমি বললাম, “কে বললো? তুমি বুঝলা কেমনে”? ছায়া দরোজার পাশেই ছিলো। বললো, “বিপ্লব এদিকে আয়”। বিপ্লব গেলো না। মুচকি হেসে বললো, “ধরা খেয়ে আপু লজ্জা পেয়েছে”। যাহোক, একদিন ছাদে ছায়াকে পেলাম। সাজুগুজু করে এ সময় ছাদে আসার কোন অর্থ নেই। বললাম, “তোমাকে তো ছাদে এখন কম দেখি”।
    — ঠিকই আসি। আপনিই দেখেন না। ছায়ার ত্বরিত উত্তর।
    — সে কি রকম? আমি তো ছাদেই বাস করি।
    — কেয়া আপু আছে না?
    রোগের লক্ষ্মণ ধরা পড়েছিলো আগেই। আজ এর কারণ জানা গেল। বললাম, “কেয়ার সাথে তোমার কি? সে তোমার সিনিয়র আর আমার ক্লাসমেট”। ছায়া নিরুত্তর থাকলো। বললাম, “পড়াশোনা কেমন চলছে”?
    — পড়াশোনা ভালো লাগেনা
    — তাহলে কি ভালো লাগে?
    — জানিনা।
    — বাহ। কিছুই ভালো লাগেনা?
    — লাগে
    — সেটা কি?
    — বলা যাবে না।
    সিঁড়িতে কেয়ার কথা শুনে বলে উঠলো, “ওই যে আপনার প্রিয় বান্ধবী আসছে”। বলেই নেমে গেল। কেয়া এলো। ছায়া নেমে গেলো। ছাদ থেকে কাপড় নিতে নিতে কেয়া বললো, “লজিং মাস্টার ভালো আছেন”? আঁতে ঘা লাগলেও নিছক দুষ্টুমী ভেবে পাল্টা মিসাইল ছুঁড়ে দিলাম, “কেন জ্বলছে নাকি”?
    — হুম্ম। খুব জ্বলে। জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছি। কি করছো?
    — বিসিএস প্রিপারেশন
    — প্রিপারেশন না ছাই। ওই মেয়ে সারাক্ষণ তোমার চতুর্দিকে ঘুরঘুর করে কেন? যখনই ছাদে আসি তখনই দেখি
    — এ তোমার ভারি অন্যায়
    — বাহ। খুব দরদ দেখছি তার জন্য
    — লিভ ইট। তোমার খবর কি?
    — খবর ভালো না
    — কেন? কি হয়েছে?
    — বিয়ের কথা হচ্ছে
    — ভালো তো। পাত্র কি করে?
    — বিসিএস ক্যাডার
    — বাহ। ঝুলে পড়ো
    — অত সহজ না। না করে দিয়েছি
    — কেন? চয়েস আছে নাকি?
    — আছে তো।
    — তাহলে তাকেই করে ফেলো
    — সমস্যা আছে
    — কি সমস্যা?
    — সে তো কেলাস টাইপের। সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকে। আর ইদানীং বালিকা নিয়ে।

    তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। আমি আহত হলাম। বললাম, “এ তোমার ভুল ধারণা”। “পুরুষ মানুষদের চেনা আছে” বলে কেয়া চলে গেলো। কি চেনা আছে বুঝলাম না। বাবা-মা’র কথা মনে হলো। আমি কি টার্গেট থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি? দুরন্ত বিপ্লবের রেজাল্টের অভাবিত উন্নতি হলো। এই দেখে আন্টির আবদার ছায়াকে শুধু ম্যাথটা একটু দেখিয়ে দিতে হবে। বিসিএস প্রিপারেশনের দোহাই পেড়েও কিছু হলো না। রোজ এক ঘন্টা করে ফ্ল্যাটে গিয়ে ম্যাথ বুঝাতে হলো। এতে আমি মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্ধ। ছায়া উৎফুল্ল। আমি যত সিরিয়াস। ছায়া তত অমনোযোগী। সিলেবাসের বাইরেই তার মনযোগ বেশি। আমাকে ঘিড়ে তার প্রচুর কিওরিসিটি। খালি গল্প করতে আর কথা বলতে চায়। আমার শংকা বাড়তে থাকলো। অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে পাগলামী স্বভাব প্রকট হয়। যাকে কাছে পায় তাকেই পছন্দ হয়। ভালো লাগে। ক্ষণিকের মোহ আরকি। বাবার বন্ধুর মেয়ে। একটু সন্দেহ বা কোন ঘটনা ঘটলে আমার জীবন যতটুকু না চৌচির হবে তার চেয়ে বেশি হবে বাবা-মা’র। যেদিন থেকে এই পার্ট টাইম ডিউটি খাটছি সেদিন থেকে কেয়ার ম্যুড অফ। আমার কোনই ভূমিকা নেই কোন কিছুতে। অথচ উভর পক্ষের মামলায় আমি একমাত্র আসামী।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-১)

    আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-১)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    লজিং মাস্টার
    আনোয়ার হাকিম

    পর্ব-১
    আমার বিপদ অবর্ণনীয়। অসহনীয়ও বটে। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি গ্রামদেশে জায়গীর মাস্টারের শেষ পরিণতি হয় ঘর জামাই হিসেবে। প্রাইভেট টিউটরের সাথে ছাত্রীর প্রেম অবশ্যম্ভাবী। আর সহপাঠীর সাথে প্রেম কাহিনী সর্বজন বিদিত। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একেক জনের কপালে একেক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে থাকে। আর তার পরিণতিও একেক রকম হয়ে থাকে। কিন্তু একসাথে এই ত্রিশংকু অবস্থা কারো জীবনে নাযিল হয়েছে বলে শুনিনি। আমার হয়েছে সেই দশা।

    ছোটবেলা থেকেই ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ায় বাবার বিশেষ দৃষ্টিতে পড়লাম। সাথে অসীম ছাড়। আম্মা সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন। কারো কুনজরে যেন বিদ্ধ না হই সেজন্য মাঝে মধ্যেই আচমকা জড়িয়ে ধরে দোয়া-দরুদ পড়ে বিশাল বিশাল ফু দিতেন। ছোট ছিলাম। পরীক্ষা বা টেনশনের কিছু হলে আমিও আম্মার কাছে গিয়ে ফু দাবী করতাম। জুনিয়র স্কলারশীপেও গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম গ্রেডে বৃত্তি পেলাম। বাবার প্রত্যাশা বাড়তে থাকলো। মুখে সুখের হাসিও ঝিলিক দিতে থাকলো। পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন আর সহপাঠীদের কাছে বলা যায় হিরো বনে গেলাম। বাবা উপজেলা সদরের ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। রোজ রোজ সাইকেলে প্যাডেল চেপে আসা-যাওয়া করতাম। মাধ্যমিকেও ভালো রেজাল্ট হলো। পাল্লা দিয়ে অপত্য স্নেহও বাড়তে থাকলো।

    শহরের ভালো কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম। সেখানে গিয়ে অভিজ্ঞতা হলো বিচিত্র। পড়াশোনার বাইরে আমার অন্য ধান্ধা নাই। সহপাঠীদের সমীহ যেমন পাই তেমনি মশকরাও সহ্য করতে হয়। কলেজের কো-এডুকেশনে খাপ খাইয়ে নিতে তাই অনেক কোশেশ করতে হয়েছে। এখনো পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারিনি। কলেজ জুড়ে মেধাবীর তকমা পেলাম বটে কিন্তু ইনোসেন্ট আর হাবাগোবার মিশ্রণজাত এক ধরণের খোঁচাও খেতে হত প্রায়ই। বাবার বড় আশা আমি বিসিএস দেবো। ম্যাজিস্ট্রেট হবো। ডিসি হবো। গ্রামের বেসরকারি স্কুলের মাস্টার হিসেবে এটাই তাঁর সর্বোচ্চ আশা।

    আমাদের আর্থিক অবস্থা কখনোই স্বচ্ছল ছিলো না। এর যাতনা আমি যতটা টের পেতাম, বাবা-মা ভোগ করতেন ততোধিক। আমরা এক ভাই এক বোন। বোনটি বড়। রুপে ও গুণে সে অদ্বিতীয়া। একদিন তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসলো। বাবা নিমরাজী হলেও মা গোঁ ধরলো। তাঁর বক্তব্য মেয়ে মানুষের জন্য ইন্টার পাশই যথেষ্ট। ছেলে সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। সম্পর্কীয় এক মামা এই প্রস্তাব এনেছেন। বলাচলে একরকম জোর করেই বিয়ের কথা প্রায় পাকা হয় হয়। শুভস্য শীঘ্রম বলে একটা কথা আছে। এটা আর কিছুর ক্ষেত্রে না হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গ্রামদেশে এটাই সর্বজন মানিত। এমন অবস্থায় আমার বুক ঠেলে কেন জানি থেকে থেকে কান্না আসতে থাকলো। বোনের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনা। একবার একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে রাজী কিনা। ছোট ভাইয়ের কাছে এতদসম্পর্কীয় কথা বলতে লজ্জা হলেও এক পর্যায়ে কাছে এসে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “রাফি, আমি এখনই বিয়ে করতে চাইনা”। তার এ কথাটা বুকে যেন শাবল মারলো। কিছু একটা করা জরুরি জ্ঞান করে বাবাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম, “বাবা, আপু এখন বিয়েতে রাজী না। আপনি শক্ত থাকেন। আম্মাকে আমি ম্যানেজ করবো”। বাবা বিস্মিত চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কথা তো প্রায় পাকা হওয়ার পথে”। ছোট চাচা চালাক চতুর টাইপের। নিঃসন্তান। আমাদের দু’জনকে সন্তানবৎ আদর করেন। তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হলাম। তিনিই মজলিশে চমৎকার বোমা ফাটালেন, “মেয়ে ডিগ্রী কমপ্লিট করতে চায়। লেখাপড়ায় মা শা আল্লাহ ভালো। তাই আমরা পরে পারিবারিক ভাবে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাদেরকে জানাবো”। তাঁর এ বক্তব্যে আলোকোজ্জ্বল প্যান্ডেল যেন সহসাই নিষ্প্রভ হয়ে গেলো। অতিথিরা লা জবাব হয়ে ফিরে গেলো। আম্মা আমার উপর, তারচেয়েও বেশি ছোট চাচার উপর নাখোশ হলেন। তাঁর মুখ ভার দেখে আমি গলায় জড়িয়ে ধরে বললাম, “আম্মা, আমি কি কোনদিন তোমাদের অবাধ্য হয়েছি”? আম্মা চোখ তুলে আমাকে জড়ায়ে ধরে বললো, “বাবারে, মেয়ে হওয়ার কষ্ট তুই কি বুঝবি”? সত্যিই আমি অতশত বুঝি না। আমার প্রতি বাবা-মা’র অগাধ আস্থা। তাদের ধারণা আমি জ্ঞানে-গরীমায় তাদের চেয়ে ঢের ভালো বুঝি। এজন্য এ যাত্রা বোন পরিত্রাণ পেলো। তাঁর খুশি খুশি ভাব দেখে আমার নিজেকে সফল বলে মনে হলো। এরপরের কাহিনী আরো করুণ। স্কুল থেকে সাইকেল চেপে বাড়ী ফেরার পথে বাবা পিচ্ছিল রাস্তায় অন্যমনস্কতার কারণে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথায় আঘাত পেলেন। তাঁর চিকিৎসা ইত্যাদিতে বিস্তর টাকা খরচ হলো। জমি যা ছিলো তার প্রায় অর্ধেক বিক্রি করতে হলো। আর বাকি অর্ধেক বন্ধক রাখা হলো।

    সংসারের এরুপ আর্থিক অবস্থার মধ্যে আমি জেলা শহরের কলেজে অনার্সেই ভর্তি হয়ে গেলাম। বাবা খুব মর্মাহত হলেন। তাঁর পক্ষে এর চেয়ে ভালো কিছু করা যে সম্ভব না তা তিনিও ভালো জানেন। যদিও তাঁর সাধ ছিলো ভিন্ন। ভালো মান নিয়ে অনার্স পাস করলাম। বাবা একদিন কাছে ডেকে বললেন, “বাবা, মাস্টার্স করো অসুবিধা নাই। তবে বিসিএস এর প্রিপারেশনও চালিয়ে যাও”। আমি বিস্ময়ে এই প্রথম তাঁর কাছে জানতে চাইলাম বিসিএস করলে বিশেষ কি হবে? বাবা বললেন, “ম্যাজিস্ট্রেট হবা”। ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটির সাথে পাবলিক পরীক্ষার সময় পরীক্ষা হলে বার কয়েক পরিচয় হয়েছে। তাকে নিয়ে হেড স্যার থেকে প্রিন্সিপালসহ সবাই তটস্থ থাকত। তোষামোদে ব্যস্ত থাকত। এর বেশি কিছু উত্তাপ অনুভব করতাম না।

    ছোটবেলা হতে কোনদিনই বাবা-মা’র কথার অবাধ্য হইনি। মূলত তাদের কাছে আমার কোন বেয়ারা বা বাড়তি আবদারও ছিলো না। বিনিময়ে সংসারের ভারি ভারি সিদ্ধান্তের সময় আমার শলা-পরামর্শ বিশেষ মর্যাদা পেতে থাকলো। সে যাহোক, বোনের বিয়ের সে পাত্র সম্মন্ধে একদিন খবর এলো যে আগে সে গোপনে বিয়ে করেছিলো। ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে। সে ঘরে তার সন্তানও আছে। এ খবর শুনা মাত্র বাবা-মা আমাকে সংসারের সকল ভালো-মন্দের জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্বভার অর্পণ করলেন। আমার কাঁধ ভারি হলো। বয়স আন্দাজে আমার চলাফেরায় ভারিক্কি চাল ভর করলো। তবে বাবার ওই এক কথা বিসিএস দিতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেট হতে হবে। শক্ত হৃদয় বলে কোন কালেই আমার খ্যাতি ছিলো না। এই ফেরে পড়ে এখন তা আরো কোমল হলো।

    একদিন জেলা সদর থেকে ফিরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বাবা বললেন, “সব ফাইনাল করে এলাম। এখন থেকে শুধু পড়াশোনা করবা। টাকার কথা চিন্তা করবা না। প্রয়োজনে আরো এক কানি ক্ষেত বিক্রি করবো”। আমার কান্না পেলো। পুরুষ মানুষের কান্না করতে নেই। চেপে বুক ভারি করাই রেওয়াজ। তাই করলাম। আর মনে মনে পণ করলাম বাবার খায়েস পূরণই আমার একমাত্র কাজ। আমার জন্য বাবা তাঁর বন্ধুর বাসার চিলে কোঠায় অব্যবহৃত এক রুম যৎসামান্য মাসোয়ারার বিনিময়ে রফা করলেন। বাক্সপেটরা সমেত একদিন আমাকে নিয়ে তার দ্বারোদঘাটনও করলেন। বাবার সে বন্ধুর সাথে, তার পরিবারের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিলেন। আন্টির প্রতিটি কথাতেই যেন মায়ার প্রলেপ মাখা। প্রারম্ভিক পর্যায়েই স্বস্তি বোধ হলো। তাদের এক ছেলে। ছোট। নাম বিপ্লব। ক্লাস টেনে উঠেছে। অবসম্ভব চঞ্চল। ছাত্র ভালো তবে পড়াশোনা বাদে আর সব কিছুতেই পজিটিভ। আমি তাকে দুরন্ত বিপ্লব বলে ডাকি। তাদের আরেক মেয়ে। বড়। নাম ছায়া। পারিবারিক প্রথম পরিচয় পর্বে পাশের রুমের দরোজার কাছে কারো ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিকে নজর পরায় সেই ছায়াকে চকিতে মিলিয়ে যেতেও দেখলাম। বুঝে নিতে কষ্ট হলো না যে সেই ছায়া ছায়া’র ছিলো। ছায়া এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বাবার সেই বন্ধু প্রাইভেট কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। অত্যন্ত সজ্জন, অমায়িক। বাবার সাথে তাঁর জেন্টেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট হলো, তাঁর দুরন্ত বিপ্লব-কে পড়াশোনার ক্রিজে ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাট-বল হাতে ক্রিকেট ক্রিজে সে ইতোমধ্যেই অলরাউন্ডার হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। দুরন্ত বিপ্লবের সূত্রেই আমার প্রাইভেট পড়ানোর ইনিংসের সূচনা হলো। অন্যদিকে তিন বেলা আহারের ব্যবস্থাও তাদের বাসা থেকে গ্যারান্টেড সাব্যস্ত হলো। আর এর মাধ্যমে আমার লজিং মাস্টারের যাত্রাও শুরু হলো। ভাগ্য ভালো যে ছায়ার পড়াশোনার দায়িত্ব স্কন্ধে চাপেনি।

    চলবে…

  • ফিরে আসার পর (পর্ব-৪)

    ফিরে আসার পর (পর্ব-৪)

    শাহেদ চলে যাবার পর মিথি মুষড়ে পড়েছিল ঠিক কিন্তু মেয়ে দুটোর কথা ভেবে নিজেকে সামলে নেয়। শাহেদ মিথিকে পছন্দ না করুক, মেয়ে দুটো তো কোনও অপরাধ করে নাই। শাহেদ একটা খোঁজ নিতে পারত কোনও একদিন, না তাও নয়। এমনকি নিজের বাবা-মায়ের খোঁজও রাখেনি শাহেদ। এজন্য অনেক সময় নিজেকেই দায়ী মনে হয় মিথির। বিয়ের পর মিথি চেষ্টা করেছে শাহেদের মন জয় করতে, পারেনি।

    শাহেদ কেন চলে গেল? রানুকে ভালবেসে বিয়ে করেছে, এ খবর মিথি, শাহেদের বাবা সবাই পেয়েছে।

    ভালবাসার এতটাই শক্তি যে নিজের সন্তান ফেলে চলে যাওয়া যায়!

    মিথি শুনেছে, রানুর বাবা মস্ত বড়লোক, অনেক বড় কর্মকর্তা। সেই তুলনায় মিথির বাবার তেমন লেখাপড়া ছিল না, উনি ব্যবসায়ী মানুষ, ব্যবসাই করেছেন তাও কোনও বড় ব্যবসা নয়। সমাজে তেমন বড় পরিচয় নেই মিথির বাবার। তবে কি শাহেদ এই পরিচয়টাই খুঁজেছে! যে পরিচয় তাকে আরও বড় করে তুলবে, আরও প্রতিষ্ঠিত করবে! হয়ত! মিথি এসব ভাবত খুব আগে।

    যে মানুষ তার দিকে ফিরেই তাকাল না, তার কথা মিথি আজকাল ভাবে না। মেয়েদুটোকে নিয়েই তার জগৎ।

    মিথির শ্বশুর, শাহেদের বাবা মিথির ওখানেই নাতনিদের সাথে থাকেন। দেবর ননদেরা আসে, সবার সাথে মিথির সুসম্পর্ক। শাহেদ তাকে ফেলে চলে গেছে কিন্তু মিথি কাউকেই ফেলে দেয়নি।

    মেয়েদুটো যেন কখনও নিজেদের অসহায় না ভাবে সেজন্য মিথি শ্বশুরকে এখানেই রাখে। মিথির মেয়েরা জ্ঞান হবার পরে তাদের বাবাকে খুঁজেছে।

    মিথির সাথে শাহেদের ঘটনা তাদের দুই পরিবার ছাড়া বাকি সবার কাছে অস্পষ্ট, সবাই জানে শাহেদ সরকারি চাকরি করে। আর মিথির শাহেদের বিষয়টাতে এতটাই নির্মোহ থাকে যে তাকে ঘাটাতে কেউ সাহস পায় না।মিথি তার বাবার ব্যবসা দেখাশোনা করে, ব্যবসা আরও কিছুটা বাড়িয়েছে সে।আত্মীয়স্বজনের মুখের কথা বন্ধ রাখার জন্য সে কারও সাথে তেমন যোগাযোগ রাখে না। মিথির জমজ মেয়েদের নাম মেঘ আর পাখি।

    তারা তাদের বাবার কথা যখন জানতে চাইত মায়ের কাছে, মা বলত তাদের বাবা দূরে চাকরি করে, ছুটি পেলে আসবে। এরপর মেয়ে দুটো বলত, সবার ছুটি হয় তাদের বাবা কি ছুটি পায় না? মিথি বলত তাদের বাবা সবার চেয়ে অন্য রকম চাকরি করে, হয়ত কোনও একদিন ছুটি পাবে তারপর আসবে।

    মেয়ে দুটো অনুভব করত যে তাদের মা বাবার বিষয়ে বেশি কথা বলতে চায় না, কাজেই তারাও আর মিথিকে কিছু জিজ্ঞেস করত না। শাহেদের বাবা, তাদের দাদুও বলতেন বাবা ছুটি পেলে আসবেন। মিথি আর তার মেয়েদের সবচেয়ে বড় শক্তি শাহেদের বাবা, কাজেই তাদের দিন খারাপ কাটছিল না।

    কেবল বিশেষ কিছু দিন এলে মেয়ে দুটোর মুখ মলিন হয়ে যেত, যেন জোর করেই ওরা হাসত আর মিশত সবার সাথে।

    রানুর ব্যস্ততার শেষ নেই। এটা ওটা, সংসারে কত কিছু থাকে। বাড়িটা কমপ্লিট হয়ে গেছে। এবার ওঠার পালা।

    সারাদিন যায় গুছাতে। রানুর মনে বেশ আনন্দ খেলে যায়। শাহেদের রুচি আছে বেশ। অনেক অনেক টাকা খরচ হয়েছে বাড়িটা তৈরি করতে গিয়ে। অত্যাধুনিক সব ফিটিংস বাড়িটিতে। রানু হিসেব করে তাদের বিয়ের প্রায় এগারো বছর হতে চলল।

    শাহেদের রুমটাতে রানু এসেছে। শাহেদের আলমিরা খুলল। জরুরী কাগজপত্রগুলো আলাদা রাখতে হবে।নয়ত হারিয়ে যেতে পারে। সামনের ড্রয়ারে ভেতরের ড্রয়ারের চাবি ছিল। রানু চাবি দিয়ে ড্রয়ারটা খুলে কাগজ আর ফাইলগুলো আলাদা লাগেজে ভরছে। হঠাৎ একটা ফাইলে রানুর চোখ আটকে গেল। ফাইলটা কৌতুহল বশত সে খুললো।

    রানু অবিশ্বাস্য চোখ বিস্ফোরিত হল। এ কেমন করে সম্ভব! শাহেদ এতবড় সত্যটা এতবছর ধরে কী করে লুকিয়ে রাখল? বুকের ভেতরটা রানুর দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। অসহায়ের মত সে নির্জীব হয়ে বসে রইল।

    চলবে…

  • কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-৫)

    কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিন সমুদ্র দর্শন (পর্ব-৫)

    পরদিন ভোর সাড়ে চারটায় এলার্মের শব্দে ঘুম ভাংলে তাড়াতাড়ি করে শাওয়ার নিয়ে নামাজ পড়ে নির্ধারিত পোশাক পরে রেডি হয়ে সাড়ে পাঁচটা নাগাদ নিচে নেমে এলাম। সবাই একত্রিত হল যখন তখন ঘড়ির কাঁটায় পুরোপুরি ছ’টা বাজে।ড্রাইভার সাহেব অনুমতি নিয়ে বাসে স্টার্ট দিলেন।

    বাস চলতে লাগলো টেকনাফ এর উদ্দেশ্যে। ভিতরে তখন মিস্টি সুরে মেহেদি হাসানের গজল বাজছে।বসন্তের প্রায় শেষের দিকে হালকা গরমে জানালা দিয়ে বাইরে থেকে ভেসে আসা বাউরি বাতাসে দেহ মন জুড়িয়ে গেল।আগের দিনের অক্লান্ত জার্নি আর নির্ঘুম রাতের রেশ তখনও কাটেনি। অল্পক্ষণের মধ্যে একে একে মহিলা ও বাচ্চারা কোনো কোনো ভাই সবাই ঘুমিয়ে পড়লো।

    এই যাত্রায় আমরা আর কাপল কাপল বসলাম না। যার যার খুশি মতো বসলাম।আমি একটু ঘুমায় আবার জেগে উঠি আতংকে!বেসামাল হয়ে নাক ডেকে ফেললাম নাতো!

    কক্সবাজার- টেকনাফ এর নির্জন পিচঢালা পথ বেয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা! এই রুটে রাস্তার ধারের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করতে করতে যাচ্ছি আর মনে মনে মহান সৃষ্টিকর্তার শুকরিয়া আদায় করছি!

    একটা দীর্ঘ রাস্তা কুয়াশাচ্ছন্ন হয়েছিল। একটু দূরের কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না।জায়গা টির নাম ও মনে রাখতে পারিনি। এর ই মাঝে বাসের মধ্যে ব্রেকফাস্ট দেয়া হলে সবাই মিলে খেয়ে গল্প গুজবে মেতে উঠলাম!

    যথা সময়ে বাস টেকনাফ এ এসে উপস্থিত হলো।একে একে আমরা সবাই নিচে নেমে আসলাম।মহিলারা সবাই অরেঞ্জ আর ক্রিম কম্বিনেশনে জামা, আর পুরুষেরা অরেঞ্জ কালার টি শার্ট! অবশ্য আমার হাসবেন্ড একটা হলুদ রঙের আড়ং এর হাফ হাতা শার্ট পরেছিলেন। এটা অবশ্য তাঁকে আমি একটা বসন্ত উদযাপন প্রোগ্রাম এ গান গাইবার জন্য কিনে দিয়েছিলাম,কাকতালীয় ভাবে অন্য ভাই দের সাথে কেমন করে জানি মিলে গিয়েছিল।

    ছেলেরা ব্ল্যাক টিশার্ট আর জিন্স। এটা একটা টিম দেখে সবাই বুঝতে পারছিল।অবশ্য বাস থেকে নামার পর জাহাজে উঠার সময় আরেক টা নীল দল সম্ভবত রংপুরের হবে দেখেছিলাম। আর একটা সবুজ দল। তবে আমাদের দলটি ছিল বড়ো।

    এখানে একটা নির্দিষ্ট স্থানে আমাদের রিজার্ভ বাস কে রেখে আমরা যার যার প্রাকৃতিক কাজ শেষ করে আস্তে আস্তে সবাই আবার জাহাজে গিয়ে উঠে বসলাম ।একটু পরেই যাত্রা শুরু হল।
    প্রথমে আমরা মহিলারা সবাই নিচতলায় বসলাম, আমি কতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বাইরেটা দেখছিলাম। ছবি (ওখানে যেয়ে ছবি তোলার জন্যই নতুন মোবাইল কিনেছিলাম)তুলছিলাম।একসময় বাম দিকের জানালার কাছে গিয়ে বসলাম। কি সুন্দর দৃশ্য! গাংচিলেরা উড়ে উড়ে যাচ্ছে। আবার জানালার কাছে চলে আসছে।কেউ কেউ খাবার ছুড়ে দিচ্ছে আর ওরা কুইকাই আওয়াজ করে উড়ে এসে ছো মেরে নিয়ে যাচ্ছে!আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে ভিডিও করতে অসুবিধা হচ্ছিল,তাই জানালার বাইরে হাত বাড়িয়ে তুলছিলাম।ভয় ও হচ্ছিল। একসময় ভাইয়ারা এসে ভাবিদের নিয়ে গেলেন। আমি চুপচাপ ওখানে বসেছিলাম।ছেলে কে ডেকে বললাম, “দেখ তোর বাবার কান্ড আর আংকেল দের।” ও বল্লো, “তুমি আমার সাথে এস,বাবাকে তো চেনই।তারউপর একটা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে গেছে। উনি এখনো ট্রমায় আছেন।”

    ছেলে গিয়ে কিছু বলেছিল কি ন জানিনা উনি নিজে এসে আমাকে একরকম জোর করেই দোতলায় নিয়ে গেলেন। বসালেন গল্প করতে লাগলেন।এই কদিনে এই প্রথম সমুদ্র যাত্রায় উনি স্বাভাবিক হলেন।

    চলবে…

    ফাতেমা হোসেন
    ১৪/৩/২০২২

  • ফিরে আসার পর (পর্ব-৩)

    ফিরে আসার পর (পর্ব-৩)

    আজ শাহেদের ছুটির দিন ছিল কাজেই নাস্তা শেষ করেই সে বাড়ির কাজ দেখতে চলে গেছে। মাঝে মাঝে রানুও যায়, তবে আজ তার যেতে ইচ্ছে করেনি। ওই যে একটা আগুন জ্বলছে, সেটাই তাকে পুড়াচ্ছে, সেটাই তাকে ভাবাচ্ছে।

    রানুর বাবা পদস্থ মানুষ ছিলেন, শাহেদ সে সুযোগটা পুরোদমেই নিয়েছে। নিজের বাবার বাড়ি আর বিশেষ করে মিথির থেকে বহুদূরে থাকার ইচ্ছে থেকে সে বরাবর শ্বশুরবাড়ির এলাকা ও এর আশেপাশেই পোস্টিং নিয়েছে। রানুর নামে বাড়িটাও করছে শ্বশুরের এলাকায়। এমন নয় যে শ্বশুরবাড়ি থেকে সে আর্থিক কোনও সাহায্য পেয়েছে বরং রানুর ভায়েরা যখন ব্যবসায় বড় ধরনের মার খায়, শাহেদই কুলিয়ে উঠতে সাহায্য করেছিল, শাহেদের নিজের ভায়েরা কী করছে সে খবর নেবার গরজ যদিও সে কোনও দিন অনুভব করেনি।

    এই যে এত এত পাওয়া, শাহেদের ভালমানুষি রানুর প্রতি, রানু সবসময় এতে কিন্তু খুঁজে পায়, তবে রানু বেশি ঝামেলা করে না কখনও। আজ একটা কথা রানুর থেকে থেকে মনে আসছে, সে কিছুতেই মন থেকে সেটা দূর করতে পারছে না। শাহেদ আসুক, আজ শাহেদকে জবাব দিতেই হবে।

    সারাদিন বাড়ির কাজ দেখাশোনা শেষে শাহেদ ক্লান্ত হয়েই বাড়ি ফিরেছিল। গোসল শেষে ডাইনিং এ বসে আছে সে, বুয়া ভাত দিবে। রানু কোথায় কে জানে, শাহেদ রানুর খোঁজ নেয়, সে খেয়েছে কি না।
    হঠাৎ করেই রানুর গলা শুনতে পেল শাহেদ।
    ‘তুমি এলে!’

    ভাত মুখে দিতে দিতে শাহেদ বলে, ‘খেয়েছ’? রানু তার জবাব দেয় না। অপেক্ষা করে কখন শাহেদের খাওয়া শেষ হবে। শাহেদ খাবার শেষ করে নিজের রুমে যায়।রানুও পিছু পিছু, শাহেদ রানুকে দেখে চমকে উঠে, কারণ বহুদিন হয় রানু তার রুমে আসেই না। কেন আসে না সে প্রশ্ন শাহেদ করে না।
    ‘কিছু বলবে’?
    ‘কেন’?
    শাহেদ কী ভেবে উত্তর দেয়, ‘না, আমার রুমে তো তুমি আজকাল আসো-ই না’।
    ‘আসি না, তোমার কল্পনায় যারা থাকে, তাদের সেই সাথে তোমার ব্যঘাত ঘটাই না’।
    একটু কঠিন স্বরে রানু উত্তর দেয়।
    শাহেদ কোনও জবাব দেয় না। রানুর রাগ লাগে, এ নিশ্চয়ই তার আগের বউ আর মেয়েদের কথা ভাবে, নইলে কোনও উত্তর কেন দেয় না!
    ‘তোমার মেয়ে দুটোর নামে বাড়িটা দিলে পারতে, আমাদের তো সন্তান নেই’।
    রানুর কথায় শাহেদ জ্বলে উঠে ভেতরে ভেতরে, কিন্তু জবাব দেয় না।
    ‘কী হল! উত্তর দাও না কেন?’
    শাহেদ এবার ধীরে উত্তর দেয়, ‘রানু! তুমি জানো যে ওদের ব্যপারে আমার কোনও মাথাব্যথা নেই, কেন এসব বিষয় নিয়ে কথা বল?’
    ‘মাথাব্যথা নেই কিনা আছে কে জানে তোমার মনের খবর! ওরা তোমার মেয়ে’।
    শাহেদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
    ‘রানু তুমি জানো তোমাকে আমি ভালবাসতাম, বাবার ইচ্ছেয় বিয়েটা হয়েছিল, ওতে আমার সায় ছিল না।আমি তো কেবল চাকরি হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম।চাকরিটা হতেই সব ফেলে তোমার কাছে চলে এসেছি।সবই তুমি জানো’।
    ‘বাহ! সাধু সাধু! মিথির সাথে তোমার কোনও সম্পর্ক গড়ে উঠে নি!’
    রানুর শ্লেষ মাখা কণ্ঠে শাহেদ ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়।
    ‘বিশ্বাস কর রানু,মিথিকে আমি স্ত্রী মর্যাদা দিইনি, ওকে আমি সহ্যই করতে পারতাম না’।
    ‘খুব ভাল। তোমার মেয়ে দুটো হল কী করে! মিথিকে তুমি স্ত্রীর মর্যাদা দাওনি, তাকে তুমি সহ্য করতে পারো নাই, তবে মেয়ে দুটো তোমার তাহলে নয়! যাকে সহ্যই করতে পারতে না, তার কাছেও নিশ্চয়ই তুমি যাওনি!আর এখন তোমার পরিচয়েই নিশ্চয়ই ওরা বড় হচ্ছে’।
    আজ শাহেদের কী হল! ঠাস করে রানুর গালে সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিল।

    দেড়দিনও হয়নি রানু বাবার বাসায় এসেছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শাহেদের এমন জিদ, এখন পর্যন্ত একটা ফোনও করেনি। রানুর এখানে ভাল লাগছে না মোটেই। প্রথম ধাক্কাটা আসে বাসায় ঢোকার পর মায়ের কাছ থেকে –
    ‘কীরে রানু! এই অসময়ে! জামাইর সাথে কোনও ঝামেলা’!
    রানু বিরক্ত হয়ে উত্তর দিয়েছিল
    ‘কেন! আমার কী এখানে আসতে নেই’!
    রানুর মা থতমত খেয়ে বলেন
    ‘নারে কখনও এভাবে আসিসনি তো’
    রানু কোনও উত্তর না দিয়ে তার রুমে চলে যায়। এ বাড়িতে মোট চার তলা। একতলায় কিচেন, ড্রয়িং, বাড়ির বাড়তি লোকদের থাকার জায়গা আর গেস্ট রুম। দুতলায় মা বাবা, বোন আর রানুর রুম, কাছের আত্মীয়দের জন্য আরেকটা গেস্টরুম। তিনতলা আর চারতলায় রানুর দুই ভাই।
    বিয়ের পর রানু হাতে গোনা দুই তিনদিন থেকেছে তার রুমে। বরাবর শাহেদের সাথে এসে সারাদিন থেকেই চলে যায়। কখনও আর সেভাবে থাকা হয়নি।

    মায়ের পর শুরু হয় ইন্টারভিউ একে একে, বোন ভাই বাবা — সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে রানুকে কেন সে এখানে আসল। বিয়ের পর বাবার বাড়ি কি আসলেই পর হয়ে যায়! একটু নিঃশ্বাস নিতেও আসা যাবে না! সবচেয়ে বিরক্তিকর বিন্তি খালা, ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিচ্ছে রানুকে। যে বিন্তি খালা একদম নিজের দরকার ছাড়া কাউকে ফোন দেন না, সেই তিনি প্রতি ঘন্টায় একবার করে ফোন দিচ্ছেন। মুখে দরদ কিন্তু গলায় আনন্দ চেপে রাখতে যেন পারছেন না।

    উনার প্রথম ফোনটা এমন ছিল-
    ‘হ্যাঁ রে রানু শুনলাম বাবার বাড়ি এসেছিস’!
    ‘তো! কী হয়েছে’!
    ‘না রে জানিসই তো তোদের কোনও দুঃসংবাদে স্থির থাকতে পারি না’।
    ‘খালা আমার কোনও দুঃসংবাদ হয় নাই’।
    রানু লাইন কেটে দেয়।
    ঠিক ঘন্টাখানেক পরেই-
    ‘হ্যাঁ রে রানু! জামাই তোকে খুব মারধর করেছে’!
    ‘কি সব বল খালা! মারধর করবে কেন’?
    ‘আহারে বয়স কী আর এমনে এমনে হয়েছে! বুঝি সব বুঝি। দাঁড়া এমন বুদ্ধি আঁটবো, আমি চলে আসি একটু সবর কর’।
    রানুর রাগে পা থেকে মাথা অবধি জ্বলতে থাকে।
    ‘তোমার এসে কাজ নেই, তুমি এসব খবর কই পাও? যত্তসব’।
    ‘তোদের ধ্যৈর্য কম। সবাই বলাবলি করছে’।

    রানু শেষ পর্যন্ত আর শুনে না, লাইন কেটে দেয়। সেই বিন্তি খালা এই দেড়দিনে রঙিয়ে চঙিয়ে ঘটনাকে কতদূর যে নিলেন, শাহেদকে জেলের ভাত পর্যন্ত ইতিমধ্যেই ফোনের মধ্য দিয়েই খাওয়ালেন। উফ্ অসহ্য! বিন্তি খালা মায়ের দূরসম্পর্কের বোন। নানা ছুঁতোয় এ বাড়িতে আসেন। রানুর মা এই বোনটিকে প্রচুর সাহায্য করেন, কিন্তু ইনি কানা বালতির মত, যতই দেওয়া হোক উনার অভাব দূর হয় না। আবার রানুদের কোনও দুঃসংবাদে ইনিই আনন্দে নেচে উঠেন। কী যে অসহ্য লাগে রানুর। আর রানুর ভাবীরা মুখে কিছু বলে না, বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন আর মুখের রহস্যময় হাসিটা রানু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। সবমিলিয়ে রানুর আর এক মুহূর্ত এখানে থাকতে মন চাইছে না। যত যাই হোক নিজের স্বামীর ঘরটাই যে বিয়ের পর সবচেয়ে নিজের রানু সেটা যেন তিলে তিলে বুঝতে পারছে। কিন্তু শাহেদ যা করছে তাও তো রানু মেনে নিতে পারছে না। সে কি পারত না একটা ফোন দিয়ে অন্তত রানুর খোঁজ নিতে!
    দুনিয়টা খুব স্বার্থপর, হঠাৎ করেই রানুর মনে হল। আজ একটা সন্তান থাকলে তার উছিলায়ও রানু তার সংসারে ফিরে যেতে পারত। রানুর মনটা এত খারাপ হতে লাগল, বেঁচে থাকাটাই এখন অসহ্য লাগছে।
    কী করবে সে এখন!

    রানুর পড়া শেষ হলে পরেই শাহেদের সাথে বিয়ে হয়ে যায়। ওর বান্ধবীরা প্রায় সবাই যেখানে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, চাকরি করছে রানু সেখানে কিছুই করার চেষ্টা করেনি। বাবার সংসারে অঢেল প্রাচুর্যে বড় হয়েছে, বিয়ের পরও প্রাচুর্যেই আছে। কিন্তু রানুর কেন যেন মনে হচ্ছে প্রতিটি মেয়েরই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা উচিত। এখন তো চাকরির বয়সও শেষ।

    ওদিকে বিন্তি খালা আজ আসছে। রানুর ভাল লাগছে না কিছুতেই। ঘটনা কোনদিকে মোড় নেবে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

    কখন রানু মোবাইলটা হাতে নিয়ে শাহেদের নাম্বারটাতেই ডায়াল করল, বলতে পারে না।
    ওপাশ থেকে শাহেদের কণ্ঠ, ‘গাড়ি পাঠিয়ে দেব’?
    রানুর বুক থেকে জমানো দীর্ঘশ্বাসটা বের হয়ে আসল যেন।
    ‘না, তুমিও আসো’
    শাহেদ বলে, ‘ওকে, আমিও আসছি’।
    বিন্তি খালা যখন এল তখন রানু শাহেদকে নিয়ে খাবার টেবিলে। মা, ভাবীরা আজ অতিরিক্ত খাতির করছে শাহেদকে। রানুর চেয়ে যেন শাহেদই বেশি যত্ন পাওয়ার দাবীদার। অথচ এই শাহেদকে রানুর বড়লোক ভাবীরা কখনও আলাদা যত্ন করেছে কি না রানুর মনে পড়ে না।

    কারণটা যে রানুর এ বাড়িতে চলে আসা, রানু সেটা ভালই বুঝতে পারছে। এখন ভালোয় ভালোয় শাহেদ রানুকে নিয়ে গেলেই যেন সবাই হাফ ছেড়ে বাঁচে।

    বিন্তি খালা শাহেদ আর রানুকে খাবার টেবিলে একসাথে খেতে দেখে যেন আকাশ থেকে পড়লেন। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ হতাশ।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৪৫)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৪৫)

    পাত্র রুমিকে ডেকে নিয়ে বললেন সব কিছুর আগে তিনি কলির সাথে আলাদা ভাবে কিছু কথা বলতে চান। রুমি কলিকেনিয়ে সামনে রুমে আসলেন।

    রুমি খালা কলিকে বসিয়ে দিয়ে, রুম থেকে চলে গেলেন।

    কলি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে,কিছুই বলছেনা।

    জুয়েল বললো আমি জুয়েল, কেমন আছেন আপনি?
    – ভালো আছি।
    – দেখুন আমার মা, একদম ছোট্ট বয়েসে মারা গিয়েছেন। বোনেদের বিয়ে হয়েছে, ভাই ও জবের কারণে ঢাকার বাহিরে থাকে। আর আব্বাও বিয়ে করেছেন আবার। তাই, আমি বিয়ে করলে, আপনাকে নিয়ে সংসার শুরু করবো। এতো কিছু বলার একটাই কারণ আমার এই আত্নীয় স্বজন আমাকে আরেকবার সময় দিবেনা। তারা অনেক ব্যস্ত। তাহলে আমরা আজকে কাবিন নিয়ে ভাববো, আর যদি আপনার কোন সমস্যা, আমাকে নিয়ে থাকে বলতে পারেন। আমি গোপন রাখবো। আমি বকবক করছি দেখছি!
    – বলুন, সমস্যা নেই।
    -আমি অবশ্যই একটা বড় করে অনুষ্ঠান করতে চাই। কিন্তু অল্প কয়েকদিন পর। তখন আমি আপনি মিলে শপিং গুলি করতে পারবো। অন্য কাউকে আসা লাগবেনা। আচ্ছা, এতো ইতিহাস বলে কি হবে। আপনার কি কোন সমস্যা আছে আমাকে নিয়ে? যাকলে বলে দিতে পারেন আমি কষ্ঠ পাবো না।
    হ্যা একটা সমস্যা থাকতে পারে, কারণ আমি এতো ফর্সা নই, আমি আবার নিজেকে কখনোই কালো বলতে চাইনা, কারণ আমার চেয়ে অনেক কালো অনেক দেশে আছে, তাইনা?

    কলি কিছুই বলছেনা, তবে কথা গুলি শুনছে। চমৎকার করে গুছিয়ে বলতে পারেন ইনি।

    দেখুন কলি মধ্যেবিত্ত পরিবারের অঢেল অর্থ থাকেনা, কিন্তু অঢেল সুখ থাকে। কারণ ছোট ছোট বিষয়েই তারা সুখ খুঁজে পান। আমি একজন স্বল্প বেতনের কর্মকর্তা, এখন হয়তো দুই কামরার বাসায় আপনাকে নিয়ে উঠবো। তবে, সুখ এবং শান্তি দুটি যেন এক সুতোয় থাকে, সেজন্য চেষ্টা করে যাবো। এই মুহুর্তে কাবিন হয়ে গেলে, মাস খানেক পর আপনাকে তুলে নিব। আর এই এক মাস না হয় বাকের ভাইয়ের প্রেমিকা মুনার মতো বাসা বাড়ী খুঁজে খুঁজে সব ঠিকঠাক করলাম। আহা! কিছুতো বলুন।
    – জি বলছি।
    – বলুন প্লিজ। আর যদিন্সমস্যা থাকে, তবে আমার এই আত্নীয়দের সময় আমি, নষ্ট করতে চাইনা, নয়তো পরেরবার তাদের সময় হয়তো আমার জন্য থাকবেনা!

    কলির কেন যেন এই মানুষ টার কথার জাদুতে আটকে আছে। ভরাট কন্ঠে এতো সুন্দর করে কথা বলেন! ইনি কি সত্যি অনেক সুখী করবেন তাকে! তবে, এই ভরাট কন্ঠে কলি নামটা শুনতে বেশ মধুর লাগছে। আর কালো আর ফর্সা শুধু চামড়ার ব্যাপার, মন অন্য এক জিনিস! শারমিন ভাবীর রঙ ফর্সা কিন্তু মনটা কত্ত অন্ধকার!

    কলি হঠাৎ বলে দিল, আজকে আর কথা বলার দরকার নাই।
    – হুম।
    – কাবিনের পরে কথা বলি আপনার সাথে, আসছি!

    কলি, থ্যাংক ইউ। আপনি অনেক মজার একজন মানুষ, মাত্রই ভয় পাওয়ার কথা বলে হার্ট বিট ফার্স্ট করে দিয়ে, আবার শুভ কথা বলে হার্ট বিট নরমাল করে দিলেন।
    – তাই?
    – জি, এবং আপনি ভীষণ মায়াবতী।
    – আসছি আমি!
    – শুনুন, বিয়ের শাড়ী কি রঙ কিনবো?
    – আজ আপনি পছন্দ করে কিনে নিন। পরের অনুষ্ঠানে দুজন মিলে কিনবো। আসছি।

    কলি রুমের ভিতরে এসে ভাবছে, সে এতো গুলি কথা কেমনে বলে দিয়ে আসলো! যাক, কিছুটা হালকা লাগছে তার। মানুষ টা ভালোই হবে, বিয়ে হলে, মায়ের ও প্রশান্তি হবে।

    রাহেলা বেগম কলিকে বললো মা, থাক তোর যখন পছন্দ হয়নি, এই বিয়ের দরকার নেই। তোর সুখ হচ্ছে আমার সকল সুখ। আমি রুমিকে বলে দিচ্ছি, দরকার নাই বিয়ের, ও তাদের কে যেন না করে দেয়।

    এই কথা শেষ করেই রাহেলা উঠে চলে গেলেন, কলি পিছন থেকে ডাকবে ভেবেও আর ডাকতে পারেনি। কলি আস্তে করে উঠে মায়ের সামনে যেতেই,

    রুমি বললেন, আপা আলহামদুলিল্লাহ! তোমার বুদ্ধিমতী মেয়ে মত দিয়েছে। ছেলে বললো আজ রাতেই কাবিন হবে।

    কলি হেসে রুমের দিকে গেল, রাহেলা বেগম মেয়ের হাসিমুখ দেখে চোখে শান্তি পেলেন।

    রাহেলা বললেন রুমি আংটি পরিয়ে যাক, এভাবে একদিনে বিয়ে হয় নাকি? জলি, পলি নাই। কত কষ্ট পাবে, তাছাড়া সাঈদ এখনো আসেনি।

    সাঈদের কথা বাদ দাও, ও আসতে আসতে সেহরি খাওয়ার সময় হয়ে যাবে।
    – এভাবে কি বিয়ে হয়? ছেলের খোঁজ নেওয়া হয়নি, আত্নীয় স্বজন আছেন। আমার ভাইয়েরা আছে।
    – আপা শোন, ছেলেটির মা নেই, বাবা থেকো ও নেই। এখন মামা,চাচারা যারা আসছেন তারা বলছেন আরেকদিন তারা আসতে পারবেনা। আজ ছোট করে কাবিন হয়ে যাক, আর মাস খানেক পরে বড় করে অনুষ্ঠান করবে। আর ছেলের গ্যারান্টি আমি নিজে।

    – জাহিদের সাথে পরামর্শ করি। আমার মাথা কাজ করছেনা।
    – আমার কাছে হাজার দশেক টাকা আছে, খাবারের ব্যবস্থা কর। আর জামাইয়ের আংটি। ও দরকার নিজিস বাকীটা জাহিদ কে ম্যানেজ করতে বলো।
    – দেখছি!

    রুমি খালা কলির রুমে গিয়ে বললেন, কি রে জেনে বুঝে মত দিয়েছিস তো।
    – জি খালা
    – জুয়েল খুব ভালো ছেলে, গত বছর এম.এ পাশ করেছে। তোর বছর খানেকের বড় হবে। চমৎকার আবৃত্তি করে, খুব ভালো ছেলে।

    কলির খুব অশান্তি লাগছে, আজ কি সে এখানে থাকবে! এতো তাড়াতাড়ি তার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কেমন যেন লাগছে সব।

    ছেলেপক্ষ সব বাজার করতে চলে গেল। তখন সাঈদ এসে শুরু করলেন চিৎকার। ভালো করে না জেনে কাবিন করবে কেন? রুমি খালা কতটুকু চিনে? জলি-,পলির ও এমন অবস্থায় বিয়ে দিয়ে কিরকম আর্থিক কষ্ঠে যাচ্ছে। এই ছেলে কি চাকরি করে, কত বেতন পায়, না জেনেই কাবিন করার প্রস্তুতি নিয়ে নিলে!

    রাহেলা বেগম বারবার বলছেন বাবা, তোর জন্য অনেক অপেক্ষা করে আমরা মতামত দিয়েছি। আর এখন ওর ভাগ্য যেমন, তেমনই হবে। আর ঝামেলা করিস না তো!

    তবুও কথা বলেই যাচ্ছেন সাঈদ…

    জাহিদ-নাহিদ বাজারে, রুমিখালা ছেলে পক্ষের সাথে বাজার করতে গিয়েছেন। বাসায় শুধু কলি আর রাহেলা বেগম। এদিকে, সাঈদ শুরু করেছেন অশান্তি!

    কলির শুধু মনে হচ্ছে ভাইজান কি নতুন করে আবার ঝামেলা সৃষ্টি করবেন? শুভ কাজ কি ঠিকমতো হবে? নাকি ঝামেলার সৃষ্টি হয়ে যাবে। বিয়ে নিয়ে চিন্তা না করে, বিয়ে হবে কিনা, তাই নিয়ে চিন্তা করছে কলি…

    চলবে…