Tag: ধারাবাহিক গল্প

  • যে কথা হয় নি শোনা (পর্ব-৩)

    যে কথা হয় নি শোনা (পর্ব-৩)

    আজকে ক্লাসে গেলাম না।একদম ভালো লাগছিল না ক্যাম্পাসে বসে আছি।বসে থাকতেই বেশি ভালো লাগছে। বার বার মায়ের কথা মনে হচ্ছে। আহা!মা কত বছর তোমাকে দেখি না।
    কাল অনেক ক্ষন বৃষ্টি তে ভিঁজেছি,মনে হচ্ছে আকাশ পাতাল জ্বর আসছে। মার চেহারা মনে করতে পারি না। জানি না মায়ের চেহারা কেমন। মার শরীরের গন্ধ কেমন। মাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকার স্বাদ কেমন আমার জানা নেই।
    আজকে বার বার ফুপ্পির কথা মনে হচ্ছে। সামনে সপ্তাহে ফুপ্পির কাছে যাব।
    আমার একটা ভয়ংকর দিক সব সময় চোঁখের সামনে ভেসে বেড়ায়। আয়নার মতো স্বচ্ছ। এ দৃশ্য টা আমি কখনো সরাতে পারি না।
    আমি দেখলাম অনুসুর্য এদিকে আসছে।আমাকে বলল,
    ——কিরে দেবযানী আজ ক্লাসে যাস নি কেন, শরীর খারাপ না কি। আজকে ম্যাম চমৎকার করে পড়া বুঝিয়ে দিলো।একদম মগজে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
    ——আচ্ছা আমাকে নোট দিও। আমি না বুঝলে তোমার কাছে বুঝে নিব।
    ——তোর এ স্বভাব টা আর গেলো না তুমি করে বলাটা।
    —— সেটাই তো ভালো তাই না। আর তোমার হাতে সিগারেট কেন? তুমি তো প্রমিজ করেছো আর টাচ করবে না।
    —–অবশ্যই খাব, আমার কথা না শুনলে অবশ্য ই টাচ করবো।
    ——-দেখো অনুসুর্য , আমার ভয়ংকর একটা অতীত আছে। আমার মস্ত বড় একটা ক্ষত আছে।
    —–আমি কোন অতীত চিনি না, জানি না,আমার কাছে বর্তমান ই সব। চল দেবযানী টং চা খাই।
    —–আমি এখন রুমে যাব,আমি একটু রেস্ট করব,বিকেলে গুলিস্তান যাব।একটা টিউশানি আছে সেটা কনফার্ম করতে হবে।
    —–টিউশানি না করলেও চলে তোর।তুই কিছু ভুলে থাকার জন্য টিউশানি করিস আমি জানি।
    আমি আস্তে আস্তে পা বাড়ালাম হলের দিকে।
    অনুসুর্য চিৎকার করে বলল,
    —–আমি এতো কিছু বুঝি না, তোমাকে ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারি না। তুমি কেন আমাকে বুঝতে পারছ না দেবী।


    বিকেলে আমি হাঁটতে লাগলাম, নীল ক্ষেত যাব। একটা বই এর দোকানে যাব।কতগুলো গল্পের বই কিনবো,কবিতার বই ও সাথে।
    একটা গল্প মনে হচ্ছে, এক ভদ্রলোক বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি চাকুরী টা ছেড়ে দেন।পুরাতন বই এর দোকান দেন।সারাক্ষণ বই পড়েন।
    এই ভদ্রলোক এর কি নাম এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে না।আমি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি , আমার পেছনে পেছনে অনুসুর্য আসছে। অনুসুর্য গান ধরলো,
    সেই ভালো সেই ভালো,না হয় না জানো০০০
    অনুসুর্য র গান আমার মাথায় ঘোরপাক করতে লাগলো।
    অনুসুর্য কে বললাম,
    জান এক ভদ্রলোক বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক , চাকুরি বাদ দিয়ে পুরাতন বই এর দোকান দেয়, কিন্তু তার নামটা এ মুহুর্তে মনে হচ্ছে না,তুমি কি এ গল্প টা জান।
    —–+তোমার শরীর খুব খারাপ দেবী, হলে চল।
    আমি বললাম আমি গুলিস্তান যাব , সেখানে টিউশানি টা কনফার্ম করতে হবে। তারপর যাব কাঁটাবন কনকর্ড ভবনের উজানে। আমার বিশেষ দরকার , একজন আমার জন্য অপেক্ষা করবে।

    ক্রমশ ০০০
    শাহানা জেসমিন
    ২১/৮/২২

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৩)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৩)

    দেখতে দেখতে আরো দুই সপ্তাহ কেটে গেলো। এই দুটো সপ্তাহ, আরহানের ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে। আর আমার কেটেছে আরহানের খেয়ালে ডুবে। দিবারাত্রি উনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। দিনগুলো কেমন করে যেনো এগোচ্ছে। খুবই দ্রুত।

    আর সাথে হাজারো অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছি। আরহান পাশে থাকলে আমার হৃদ পিন্ডের স্পন্দন গতি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ঠিক তেমনই দূরে থাকলে নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হয়। তখন বুকের বা পাশের হৃদযন্ত্রের উপস্থিতি বোঝা দায় হয়ে যায়।

    হুট করেই কয়েক মাস আগের কথা মনে পড়লো। কতটা ভয় পেতাম উনাকে! আর এখন! এখনকার আরহানের কথা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে ভালো লাগার মিষ্টি এক হাসি চলে আসে।

    সকালের নিষ্প্রভ রোদ খোলা জানালা দিয়ে মুখে এসে লাগতেই চোখ ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকালাম। আরহান আমার এক হাত নিজের বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন। হাসলাম আমি। উনার বন্ধন থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আরহান নড়েচড়ে উঠলেন। পুনরায় আবার ঘুমে মগ্ন হলেন। আরহানের চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে। হাত এগিয়ে উনার এলোমেলো চুলগুলো আরো খানিকটা অগোছালো করে দিলাম।

    আরহান চোখে বুজে অধর যুগল প্রসারিত করে মিষ্টি হেসে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে উঠলেন,“সুপ্রভাত শুকতারা।”

    “শুভ সকাল…”

    কিছুক্ষণ বাদে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকালেন। আমাকে এক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, “কী ব্যাপার?”

    “কী! কিছুনা।”

    “কিছুনা তো?”

    “না।”

    “আচ্ছা তবে আবার ঘুমোও।”—বলেই আরহান পূর্ব ভঙ্গিতে আমার হাত জড়িয়ে চোখ বুজলেন। মুহূর্তেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলেন।

    আমি হাসছি। এই লোকটার ভালোবাসা সত্যিই আমার ভাগ্যে ছিলো!

    ______________________

    সকালের ব্রেক ফাস্ট শেষে রুমে ঢুকেই দেখি আরহান রেডি হয়ে আছেন এবং কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। না চেয়েও উনার কথা কানে এলো।

    আরহান বলছেন,“বলেছিলাম না! খুব শীঘ্রই দেখা হবে। সব প্রমাণ জোগাড় করা হয়ে গিয়েছে। আর স্বয়ং আপনিও আছেন এখন। সব অপেক্ষার অবসান হবে আজ”।

    আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। কথাটা বুঝে উঠতে পারিনি। আরহানকে প্রশ্ন করলাম, “কী হবে আজ?”

    আরহান পিছু ঘুরে দরজার কাছে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে নম্র কণ্ঠে বললেন,“আমি একটু বাদেই ওকে নিয়ে আসছি। আপনি রেডি থাকুন।”

    উনি ফোন রাখলেন। আমি এগিয়ে গেলাম উনার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে বলুন তো! কোনো সমস্যা?”

    আরহান আমার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিলেন। মৃদু কন্ঠে বললেন,“আজ তোমার লাইফে যেমন একটা খুশির খবর পাবে, তেমনই কষ্টেরও। ইউ হ্যাভ টু বি স্ট্রং শুকতারা।”

    “কী হবে আজ?”

    “গেলেই দেখতে পাবে। রেডি হয়ে নিচে এসো।”

    আরহান প্রস্থান করলেন। হাজার প্রশ্ন মনে নিয়ে আমিও রেডি হতে শুরু করলাম। আমি কষ্ট পাবো, এমন কোনো খবর আমাকে কেনো দেবেন উনি? যতদ্রুত সম্ভব রেডি হয়ে নিচে গেলাম।

    গেটের বাইরে আরহানের গাড়ি দেখে এগিয়ে গিয়ে উনার পাশে বসলাম। আমার বসার সাথে সাথেই আরহান গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

    কিছুদূর অতিক্রম করার পর আমি আরহানকে বললাম,“আমার না টেনশন হচ্ছে। কী যে হবে! আপনি বলছেন ও না।”

    আরহান মৃদু হেসে বললেন,“যা হবে, ঠিকটাই হবে।”

    “বললে কী এমন হবে! যদি না বলারই ছিলো, তবে কেনো আমাকে বললেন, খারাপ খবর পাবো!”

    “খারাপ বললাম কখন?”

    “বলেননি?”

    “নাহ্!”

    “তবে কী বলেছেন?”

    “বলেছি, কষ্টের খবর।”

    বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো। হালকা আওয়াজে “ধুর!” বলেই জানালার বাইরে তাকালাম আমি। এই লোকটা ভীষণ অসভ্য! ওপাশে আরহান আমাকে দেখে মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছেন।

    হুট করেই আরহানের জরুরি কিছু মনে পড়ে গেলো, এমন ভাবে ব্রেক কষলেন। কিছু একটা খুঁজলেন। না পেয়ে রুদ্রকে কল লাগালেন। রুদ্র রিসিভ করতেই, আরহান ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন,“ফাইলগুলো আমার কাবার্ড এ রেখে এসেছি। নিয়ে এসো।”

    ব্যাস! ওপাশে রুদ্রের কিছু বলার আগে যেমন নিজের কথা শুরু করেছিলেন। তেমনই নিজের কথা শেষ হতেই কল কেটে দিলেন।

    ঘন্টাখানেক পর গাড়ি একটা বাড়ির সামনে থামালেন আরহান। প্রথমে নিজে নেমে এরপর এপাশে দরজা খুলে হাত এগিয়ে দিলেন। মুখে উনার বরাবরের মতো মিষ্টি হাসি। তা দেখে আমিও হাসলাম। হাত এগিয়ে উনার হাতে রেখে নেমে এলাম।

    আমাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে অগ্রসর হলেন।

    _______________________

    গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে নিশা রুম থেকে বেরোচ্ছে। এই বয়সী মেয়েদের মন বোঝা বড্ড কঠিন। এই কান্নায় ভেংগে পড়ে তো এই আহ্লাদে নাচতে শুরু করে দেয়।

    রুম থেকে বেরোতেই শক্ত কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগায় নিশা মনে মনে নিজেকে কতোগুলো গালি দিয়ে নেয়। ভেবেছে হয়তো সামনে দেয়াল। বেখেয়ালি ভাবে হাঁটতে গিয়ে এই অবস্থা। কিন্তু না! সামনে তাকাতেই নিশার হৃদপিন্ড থমকে যায়।

    রুদ্র কপাল কুঁচকে নিশার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,‘আমার ভাগ্যে তো নেই তুমি, তবে কেনো সামনে আসো? কেনো প্রতিবার মনের মাঝে ভালোবাসা নামক তুমি হয়ে আগমন ঘটাও?’

    কিন্তু এটা বলা সম্ভব নয় রুদ্রের পক্ষে। এক পলক নিজের মায়াবিনীকে দেখে নিলো। ভাগ্যে না’ই থাকলো, চোখের ক্যানভাসে না হয় থাকুক।

    নিশা রুদ্রের সামনে এলেই কেমন যেনো অসুস্থ অনুভব করে। এই অসুস্থতা, ও রুদ্রের অনুপস্থিতিতেও টের পায়। তখন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না নিশা। প্রতিবারের মতো স্তম্ভিত হয়ে যায়। তবুও বর্তমান সময়ে এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকাটা বড্ড বেমানান লাগার দরুন, কিছু বলা নিশার জন্য আবশ্যক হয়ে গেলো।

    মিনমিনে কন্ঠে নিশা প্রশ্ন করলো,“কেমন আছেন?”

    রুদ্র স্থির চাহনি নিশার পানে আবদ্ধ করে গম্ভীর মুখশ্রীতে ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো,“ভালো।”

    ভদ্রতার খাতিরে যে পুনরায় তাকেও জিজ্ঞেস করতে হবে,‘তুমি কেমন আছো?’ এর মিনিমাম সেন্স রুদ্রের ছিলো না। নিঃশব্দে প্রস্থান ঘটালো।

    নিশা স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে রুদ্রের যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে ভীষন শকে আছে। নিশা বিস্মিত কন্ঠে আওড়ালো, “যাহ বাবা! রুদ্র ভাইয়া, সম্পূর্ণ আমার ভাইয়ার কোয়ালিটি সম্পন্ন হয়ে গেলো দেখছি। একেই বলে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”

    স্তব্ধ নিশাকে এক দৃষ্টিতে স্থির একদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিশার মা নিজ রুম থেকে বেরোতে বেরোতে প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে? কী দেখছিস?”

    নিশা নড়ে চড়ে দাঁড়ালো। মেকি হাসি দিয়ে বললো, “কোথায়? কিছু না তো!”

    “কলেজে যাবি না? যা রেডি হয়ে নে।”

    “আচ্ছা আম্মু।”

    _______________________

    সকাল থেকে মিসেস শেফালী তার বাবাই এর নম্বরে একটার পর একটা কল দিয়েই যাচ্ছেন। ধরছে না ওপাশ থেকে। তেমন কোনো প্রয়োজনে কল দিচ্ছেন না, ছেলেটা কেমন আছে এই খোঁজটার জন্যই এত উতলা হওয়া।

    অষ্টম বার কল দিতেই ওপাশ থেকে তৃষ্ণা কল রিসিভ করলো। মাথা ভার তার। সারারাত কষ্ট লাঘব করতে নেশার সাগরে ডুবে ছিলো। ঘুমিয়েছে ভোরে। এটুকুতে ঘুম হয়নি। বারবার কানের কাছে ফোনের কর্কশ শব্দ হয়ে যাচ্ছে বলে রিসিভ করে কানে তুললো।

    ওপাশ থেকে মিসেস শেফালীর কাতর কণ্ঠস্বরে শুনতে পেলো,“বাবাই! কী হয়েছে তোর? কল ধরছিস না! সকাল থেকেই কল দিয়ে যাচ্ছি তো।”

    “ঘুমোচ্ছিলাম মামনি।”

    “খেয়েছিস সকালে?”

    “না। পরে খাবো।”

    “শোন, তোকে কিছু বলার ছিলো।”

    মিসেস শেফালী উত্তেজিত হয়ে আছেন। তৃষ্ণাকে বলেনি এখনও সে তার মেয়ের খোঁজ পেয়েছে। ভেবেছিলেন, সবটা সমাধান হবার পর বলবেন। যেহেতু আজ সমাধানের শীর্ষে সবটা। তাই জানিয়ে দিতে চাচ্ছেন।

    “আমি, আমার মেয়ের খোঁজ পেয়েছি।”

    তৃষ্ণা শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,“ফাইনালি পেলে! আমি তো সেই আগেই বলেছিলাম, আমাকে বলো। আমি খুঁজে দেবো। তুমি রাজিই ছিলে না।”

    মিসেস শেফালী হালকা হাসলেন। বললেন,“আমি ভুল করে ফেলেছিলাম। আজ সবটা শুধরে নেবো।”

    “আমি কী আজ ঐ বাড়িতে আসবো?”

    “কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে, তোর ঘুম হয়নি। ঘুমিয়ে নে। রাতে চলে আসিস।”

    তৃষ্ণা “আচ্ছা” বলতেই মিসেস শেফালী কল কেটে দিলেন। উচ্চকন্ঠে দীপ্তিকে ডাকলেন,“বাবুন! কই তুই? জলদি নিচে আয় না।”

    দীপ্তি তার মায়ের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে এলো। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে মা? এভাবে ডাকছো কেনো?”

    “এভাবেই। কী করছিস?”

    “কিছুনা মা।”

    মিসেস শেফালী হেসে বললেন,“তোর আপুকে দেখবি?”

    “দেখার কী আছে?”

    পরক্ষণেই আবার বলে উঠলো,“ওয়েট!”

    প্রথমে দীপ্তি খেয়াল করেনি। পরে যখন বুঝতে পারলো, ওর মা কী বলেছে! চকিতে চাইলো তার মায়ের পানে। দীপ্তি এখনও বুঝে উঠতে পারছে না, সে কী শুনেছে?

    তাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “কী বললে তুমি? আমি হয়তো ভুল শুনেছি। আবার বলো।”

    “ঠিকই শুনেছিস। তোর আপুকে দেখবি?”

    দীপ্তি অত্যধিক বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে বললো,“আপু!”

    “হুঁ।”

    “পেয়েছো আপুকে?”

    “হ্যাঁ রে বাবুন।”

    “কোথায় আছে আপু? কবে দেখা করাবে?”

    “এই শহরেই আছে। আর আজ দেখা করাবো। একটু বাদেই চলে আসবে ওরা।”

    দীপ্তি এখনও নিজের বিস্ময় রোধ করতে পারেনি। ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

    তখন কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে মিসেস শেফালী উত্তেজিত হয়ে পড়েন। দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। দরজার বাইরে দিকটা অবলোকন করতেই তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আঠারো বছর! হ্যাঁ! আঠারো বছর পর, আজ সে দেখতে পেলো তার কলিজার টুকরোকে। নিজের আবেগ দমাতে হিমশিম খাচ্ছে। কিছু বলতে পরছে না। বাক্য মিলছে না। কণ্ঠস্বর কোনো শব্দ তৈরি করতে পারছে না।

    কম্পনরত অধর যুগল অনেকখানি সময় নিয়ে উচ্চারণ করলো, “ববীনু!”

    চলবে…

  • যে কথা হয় নি শোনা (পর্ব-২)

    যে কথা হয় নি শোনা (পর্ব-২)

    ম্যাম বললেন,
    ——-কি ব্যাপার বলো তো,আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছো,বিশেষ কোন প্রয়োজন? ক্লাসে পড়া কি বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে? অবশ্য অর্থ নীতি বিষয় একটু ক্রিটিক্যাল আচ্ছা আমি তোমাদের এক্সট্রা ক্লাস নিব বুঝলে।নিরাময় মূলক ক্লাস।
    আমি বললাম,
    ——-জ্বি না ম্যাম , আমি অন্য কাজে এসেছি।
    ——-ও আচ্ছা , কি কাজ অবশ্য ই শুনবো।শোন আমি একজন প্রাইভেট শিক্ষক খুঁজছি।আমার মেয়ে অরুন্ধতী র জন্য। সে মূলত অরুনকে সঙ দেবে,গল্প করবে আর পুরোনো পড়াগুলো রিভাইস করাবে।আসলে পড়ার চেয়ে সঙ্গী দরকার।
    ——–আমি এ কাজটা চাই। আর ম্যাম আপনার লিখা গল্প কবিতা ভিষণ ভালো লাগে।
    ——তাই, আচ্ছা তোমার কি অর্থের বিশেষ প্রয়োজন। আমি সেটারও নোটিশ দিয়েছি। যদি কারো এ বিষয়ে হেল্প লাগে আমি হেল্প করবো সাধ্য মতো। কিন্তু তোমাকে দেখে তো খুব স্বচ্ছল মনে হচ্ছে। তোমার নাম কি?
    ——আমি মুগ্ধ , আমার আর একটা নাম আছে। আমি পৈতৃক নাম পাল্টে ফেলেছি।
    —–কি আশ্চর্য ! তোমার নাম পছন্দ হয় নি? আমার নামও মুগ্ধ কিন্তু এটা তেমন কেই জানে না।
    ——আমাকে আমার ফুপ্পি দেবযানী বলে ডাকে।
    —-তোমার এ নামটাও খুব সুন্দর দেবযানী। আচ্ছা কি জন্য এসেছো আমার কাছে? আর তোমার কোন আপত্তি না থাকলে অরুন্ধতী কে পড়াবে?
    ——জ্বি ম্যাম পড়াবো,আমার কোন আপত্তি নেই। আমি একটা পত্রিকার সম্পাদক। আমি আপনার একটা ইন্টারভিউ নিতে চাই। আপনি গল্প , কবিতা লিখেন।আপনার লিখা আমি খুব পছন্দ করি।
    ——কিন্তু আমি তো ইন্টারভিউ দিই না।
    আমি বললাম, আমার কাছে দিবেন।আমি আপনার সম্পর্কে জানতে চাই।
    ——আচ্ছা এ বিষয়ে আজ কোন কথা বলব না। অন্য দিন কথা হবে, আমি ভেবে চিন্তে জানাবো। আজ আমার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।বিকেলে মিটিং আছে চেয়ারম্যান স্যার এর সঙ্গে স্টাফ মিটিং। আমি খুব বিজি।
    আমি বললাম,
    আজকে আসি ম্যাম, অরুন্ধতী কে বলবেন আমি পড়াব।
    আমি ম্যাম এর চেম্বার থেকে উঠে এলাম।
    আমার বিকেলে ক্লাস আছে কিন্তু করতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে এলাম। মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে তুমুল বৃষ্টি। হোক আজ তুমুল বৃষ্টি, আজ বৃষ্টি তে ভিজবো।
    আজকে একা একা হাঁটবো। একা একা হাঁটার মধ্যে অন্য রকম মজা,আজ হেঁটে হেঁটে যাব পল্লবী,সেখান থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনে। একা অনেক ক্ষন বসে থাকবো।কি শান্তি অসংখ্য বৃক্ষের সঙে কথা বলা একা একা। পাখিদের উড়ে যাওয়া দেখা। এখানে আমার একটা পছন্দের জায়গা আছে।আমি মাঝে মাঝে ই একা একা বসে থাকি।
    বৃষ্টি নামছে এ মুহুর্তে। আমার মনে হলো অরুন্ধতী এ বৃষ্টি র মধ্যে একা একা বসে আছে।সে ম্যাম এর জন্য অপেক্ষা করছে।সে আয়নার সামনে এসে দাড়ালো।সে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।এ বয়সে আয়নায় নিজেকে দেখতে ভিষণ ভালো লাগে। আয়না তে নিজেকে দেখতে এরকম মনে হয় যেনো সে জলের আয়নায় নিজেকে দেখছে। সে ঝুঁকে পড়ে নিজেকে দেখছে।
    আজকে অরুন্ধতী সুন্দর একটা নীল শাড়ি পড়ে আছে।নীল শাড়িতে অসম্ভব রকম সুন্দর লাগছে তাকে। সে হাত ভর্তি নীল কাঁচের চুড়ি পড়েছে। নীল টিপ দিয়েছে।মনে হচ্ছে একটা নীল পরী আকাশ থেকে নেমে এসেছে।
    আমি বৃষ্টি তে ভিজছি, তুমুল বৃষ্টি। আমি অরুন্ধতী কে ডাকলাম এসো দুজনে মিলে বৃষ্টি তে ভিঁজি।
    অরুন্ধতী বলল,
    আমি বৃষ্টি খুব পছন্দ করি, কিন্তু ভিঁজলে আমার টনসিল বাড়ে। আমি বৃষ্টি তে ভিজলে মা রাগ করবে।
    আমি বললাম,
    কিচ্ছু হবে না এসো। তোমাকে বৃষ্টি তে ভিজলে অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগবে নীল মেঘ যেনো তুমি।
    পেছন থেকে আমাকে ডাকলো অনুসুর্য।
    বলল,
    এই মুগ্ধ এরকম করে বৃষ্টি তে ভিজছিস কেন জ্বর আসবে তোর,তোর না টনসিল সমস্যা।
    আমি বললাম,
    হোক টনসিল , আজকে বৃষ্টি তে ভিজতে ভিষন ভালো লাগছে।
    আমার মনে হলো টিনের চালে ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। আমারও অরুন্ধতী র মতো নীল শাড়ি পড়ে ভিজতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার কোন শাড়ি নেই। এবার বন্ধে ফুপ্পি র শাড়ি আনবো।
    অনুসুর্য আবারও ডাকলো,এতো ভিজিস না উঠে আয়।
    আমি তুমুল বৃষ্টি তে ভিজঁছি।

    ক্রমশ ০০০
    ২০/৮/২২
    শাহানা জেসমিন

  • যে কথা হয় নি শোনা (পর্ব-১)

    যে কথা হয় নি শোনা (পর্ব-১)

    আজ বিশ্ব বিদ্যালয়ের অর্থ নীতি ডিপার্টমেন্ট এর প্রথম বর্ষের প্রথম ক্লাস প্রথম দিন মেহ জাবিন ম্যাম এর ক্লাস। আমি মন্ত্র মুগ্ধ হয়ে ম্যাম এর ক্লাস শুনলাম। কি চমৎকার তাঁর কথার ধরন।কি সুন্দর করেই না তিনি গল্প বলেন।অথচ তিনি বাংলা বিষয়ে না, অর্থ নীতি পড়াবেন। তাঁর গল্প একেবারে আমার ভেতরে ছুঁয়ে গেলো।
    ম্যাম খুব পরিপাটি। সুন্দর মাড় দেয়া স্ত্রী করা তাঁতের শাড়ি পরে আছেন। কোন সাজগোছ নেই অথচ মনে হচ্ছে তিনি সেজেগুজে আছেন। তাঁর সব কিছুই ভালো লেগে গেলো আমার। কিন্তু একটা জিনিস আমার খটকা লাগলো তিনি বাম হাতে লিখেন।ডান হাতের একটা আঙুল প্যাচানো নতুন ব্যান্ডেজ দিয়ে।
    আমার বন্ধু তামান্না বলেছে,ম্যাম সব সময় আঙুল প্যাচিয়ে রাখেন নতুন ব্যান্ডেজ দিয়ে। আমিও সেটাই খেয়াল করলাম।
    ম্যাম যখন গল্প বলেন,পুরো ক্লাসই পিনপতন নীরবতা। ক্লাস শেষে তিনি বললেন,
    কাল থেকে তোমাদের ক্লাস চলবে রীতি মতো। আমার ক্লাসে কেউ ফাঁকি দিতে পারবে না।ফাঁকি দিলে তোমরা নিজের ফাঁকিতে পরবে। আজকে গল্প দিয়ে শুরু করলাম । তিনি মিস্টি করে হাসলেন, তারপর চলে গেলেন।
    আমি তার চলে যাওয়া দেখলাম। আমি অনেক ক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। আমি তাকিয়ে থাকলাম যতদূর তাঁকে দেখা যায়।
    বিকেলে ক্যাম্পাসে বসে আছি। ম্যাম এর গল্প টা একবারে আমাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে আছে। তার রেশ এখনো আছে।আমার ভেতরটা কেমন যেন অস্থির লাগছে।চোঁখের সামনে কতগুলো স্মৃতি ভেসে উঠলো।কেমন যেনো স্পষ্ট হয়ে আবার ও অস্পষ্ট হয়ে গেলো। আমি অনেক কিছুই মনে করতে পারি না, আবছা আলোর মতোন লাগে।
    ম্যাম ক্যাম্পাসের ডরমিটরি তে থাকেন।তাঁর সাথে থাকে মেয়ে অরুন্ধতী। কি চমৎকার নাম অরুন্ধতী।
    “দ্য গড অফ স্মল থিংস ” লিখেছেন অরুন্ধতী রায়। বিশ্ব নন্দিত অরুন্ধতী রায় এ বইটির জন্য ১৯৮৭ সালে বুকার পুরস্কার প্রাপ্ত। এ বইটি বেস্ট সেলার।
    জামাল উদ্দিন খাঁয়ের এ বইটি অনুবাদ করেছেন।
    অরুন্ধতী আমার চেয়ে চার কিংবা পাঁচ বছরের ছোট হবে। তামান্না অরুন্ধতী কে প্রাইভেট পড়ায়।
    আমি লেখক অরুন্ধতী রায় এর একটা সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম, খুব সুন্দর লেখিকা কোকঁড়ানো চুল,বয় কাট,। খুব সুন্দর হাসি।ছবিতে দারুণ দেখাচ্ছে।
    আমার কাঁধে হাত রাখলো তামান্না। বলল,
    কি রে আর কতক্ষণ বসে থাকবি।চল হলে যাই। রাত হয়ে এলো।
    আমি তামান্না র সঙ্গে পা বাড়ালাম।
    রাতে একটুও ঘুম হলো না। আজ আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে। আজকের চাঁদ টা একেবারে ই কাছাকাছি। মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ধরা যাবে।
    আমি অনেক ক্ষন জানালার গ্রিল ধরে দাড়িয়ে থাকলাম। ফিনকি দেয়া জোৎস্না । জোৎস্না র ফুল হাত দিয়ে ধরা যাচ্ছে।
    তামান্না আমার জীবনের অনেক গল্প ই জানে। অনেক ছোট থেকে আমি হোস্টেলে থেকে বড় হয়েছি।তখন বয়স কত হবে প্লে তে পড়ি। তখন থেকেই আমি হোস্টেলেই থেকে পড়ি।
    আমাকে টেক কেয়ার করে আমার এক দূর সম্পর্কের ফুপু।আমি ক্লাস সাসপেন্ড হলে কখনো বাবার কাছে যাই না।ফুপুর কাছেই চলে যাই।আগে ফুপ্পি নিতে আসতো। এখন একাই চলাফেরা করি।
    বাবার সঙ্গে আমার কখনো দেখা হয় না। আমি তাকে দেখতে ও চাই না। এক সময় হোস্টেল বাবা আসতো দেখা করতে। বাবাকে দেখলেই চিৎকার শুরু করতাম। এখন বাবা আর আসে না। বাবার চেহারা ভুলে গেছি কিন্তু তার অন্ধকার চেহারা কখনো ভুলবো না।
    আমার এ ফুপু নিঃসন্তান। তিনি জোর করেই আমাকে নিয়ে যান। কারণ আমি তখন প্রচুর কান্না করতাম। ফুপ্পি একটা মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি তে জি এম।
    সেদিন দেখলাম ম্যাম তার মেয়েকে নিয়ে ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন তাঁর ডরমিটরি তে। সাথে তাঁর মেয়ে অরুন্ধতী। খুব সুন্দরী অরুন্ধতী। অবিকল ম্যাম এর মতোই দেখতে। সে ম্যাম এর আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে হাঁটছে। এ দৃশ্য দেখে আমার বুকের ভিতর মোচর দিয়ে উঠলো।
    ~
    আজকে ম্যাম ক্লাস নিলেন আন্তর্জাতিক অর্থ নীতি বিষয়ে। মনেই হলো না যে তিনি পড়াচ্ছেন। মনে হলো তিনি গল্প করছেন। কঠিন বিষয় কি ভাবে যে মস্তিষ্কে ঢুকে গেলো,বুঝতে পারলাম না। আর তিনি মাঝে মাঝে বলেন, —-বুঝতে পেরেছ।
    ম্যাম কে আজ অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগলো, কালো মিশেল ব্লক প্রিন্টের শাড়িতে। চমৎকার মানিয়েছে শাড়িতে। মাঝে মাঝে ভাবি কেন যে মানুষ শাড়ি বাদ দিয়ে অন্য ড্রেস পড়ে।
    তিনি হাতে সাদা কাঁচের চুড়ি পড়েছেন। অথচ কোন শব্দ ই হলো না।রিনিঝিনি চুড়ির শব্দ মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়। কি জাদুকরী কথা , অনেক ক্ষন সে কথার মাধুর্য্য আমাকে ভর করে থাকলো। মাঝে মাঝে তিনি মিস্টি করে হাসলেন। এতো সুন্দর তাঁর হাসি।
    ম্যাম ক্লাস নিয়ে চলে গেলেন তাঁর চেম্বারে। আমি তাঁর পিছু পিছু আসলাম।
    পিওন চাচা আকরাম কে বললাম,
    —চাচা আমি ম্যাম এর সঙ্গে দেখা করতে চাই।
    চাচা বললেন,
    এখন ম্যাডাম রেস্ট করছেন।একটু পরে তাঁর ক্লাস আছে। দেখা করা যাবে না।
    আমি চাচাকে অনেক রিকোয়েস্ট করলাম।বললাম,
    —–আপনি শুধু বলবেন মুগ্ধ নামে একটি মেয়ে দেখা করতে চায়।
    পিওন চাচা ভেতরে আমার কথা বলল,
    আমি স্পষ্ট ই শুনতে পেলাম তিনি বললেন,
    —ওকে ভেতরে আসতে বলো।
    আমি ভেতরে গেলাম।খুব সুন্দর করে তাঁর রুমটা সাজানো। দেয়ালে কতগুলো পেইন্টিং। কতগুলো তৈল চিত্র ঝুলে আছে। আলমিরা, লেবটব,কম্পিউটার সব গোছানো। তাকে তাকে বই সাজানো। অর্থ নীতি র উপর বই গুলো অন্য আলমারিতে। আর একটা আলমারিতে গল্পের বই। রবিন্দ্র গল্প সমগ্র, শরৎচন্দ্রের বই,নজরুল সমগ্র। আরও অনেক বিখ্যাত লেখক এর বই।কতগুলো কবিতার বই।
    আমি ম্যামকে দেখলাম,তিনি বসে আছেন। চশমাটা টেবিলের উপর। খালি চোঁখে তাঁকে অদ্ভুত রকম সুন্দর লাগছে। তাঁর হাতে একটা রেফারেন্স বই। তিনি আমাকে দেখে বললেন,

    ক্রমশ ০০০০
    শাহানা জেসমিন
    ১৯/৮/২২

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২২)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২২)

    ভালোবাসি শব্দটা এতটা শ্রুতি মধুর! আমি জানতাম না। বিশেষ করে যদি তা নিজের ব্যক্তিগত মানুষটির মুখনিঃসৃত হয়।

    আরহানের মাত্র বলা ‘ভালোবাসি’ কথাটির দরুন খেই হারিয়ে ফেলেছি আমি। এতক্ষণের লজ্জাবতী এই আমিটা হুট করেই সব ভুলে বলে দিলাম,“আমিও ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।”

    মুহূর্তেই পুনরায় চুপ মেরে গেলাম। চোখ নিচে নামিয়ে ফেললাম। আরহান আমাকে ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন।

    “হঠাৎ এভাবে সাজলে যে!”

    আরহানের প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। কি বলবো আমি? কেনো সেজেছি? গালে লাল আভা দৃশ্যমান। আরহান বুঝে গেলেন।

    হেসে বললেন,“লজ্জাবতী বউ কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দ। ইচ্ছে করে, এভাবেই দেখে যাই তাকে।”

    অজ্ঞাত কারণবশত আমি আরহানের এমন কথা নিতে পারি না। কেমন যেনো হাঁসফাঁস লাগে। বুকের ভেতরের এই ‘হৃদপিন্ড’ নামক বস্তুটি নিজের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য সর্বস্ব দিয়ে কম্পিত হয়। ভেবে রাখা শব্দ সব আওলিয়ে যায়। বাক্য মেলাতে পারিনা। এগুলো কেনো হয়?

    কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। তৎক্ষণাৎ আরহানের পুনরায় এরকম কথা শোনার আগেই প্রসঙ্গ এড়াতে বললাম, “কোথায় গিয়েছিলেন?”

    আরহান চুপ থাকলেন। খানিকক্ষণ বাদে বললেন,“তোমার ছোট খাটো সব ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব নিয়েছি। এবার পাওয়া না পাওয়া সব ফিরিয়ে দেবার দায়িত্ব নিলাম।”

    __________________________

    নিজ রুমে বসে নিশা আধা ঘন্টা যাবৎ কেঁদেই যাচ্ছে। কেনো কাঁদছে তা অজানা ওর কাছে। শুধু একটা জিনিসই জানে, তার বুকের মধ্যেখানে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। হয়তো কিছু না পাবার হাহাকার এটা।

    এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখলো, স্ক্রিনে ‘রাহা’ নামটা ভেসে উঠেছে।

    রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে রাহা বলে উঠলো,“আজ কলেজে আসিসনি কেনো?”

    নিশা কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“কিছু ভাল্লাগেনা রে বইন। প্রেম করার আগেই ছ্যাকা খাইয়া গেলাম গা রে।”

    “তোর আবার কি হলো?”

    “কি হয়নাই এইটা বল। জিবনডা তেজপাতা হইয়া গ্যাছে রে বইন।”—বলেই নিশা আবারও ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো।

    রাহা এবার ধমকের শুরে বললো,“বেশি ঢং করলে ফোন রেখে দেবো। ফটাফট বল কি হয়েছে?”

    নিশা কান্না থামালো। মুখশ্রী ভাব গম্ভীর হয়ে গেলো। কণ্ঠস্বরে কিছুক্ষণ আগের ন্যাকামির রেশ মাত্র নেই। অনুভূতিহীন গলায় বললো,“জানিনা।”

    “জানিস না মানে?”

    “সমস্যাটা কী এটা জানলে সমাধান অনেক আগেই বের করে ফেলতে পারতাম।”

    “সিরিয়াস কিছু নাকি?”

    “হ্যাঁ!”

    “তুই ঠিক আছিস নিশু? শরীর ঠিক আছে তোর?”

    “না। অসুখ করেছে আমার।”

    “মানে? কী হয়েছে?”

    “প্রেমময়ী এক অসুখে গভীর ভাবে আক্রান্ত আমি। এই অসুখের নিবারণ তখনই হবে, যখন সে….”

    নিশা থমকে যায়। রাহা, নিশাকে থেমে যেতে দেখে প্রশ্ন করে,“যখন?”

    “কিছু না। কারণ সে আসবে না। ভালোবাসার রোগাক্রান্ত আমি। একতরফা ভালোবাসার।”

    ________________________

    মিসেস শেফালী অফিস থেকে ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে গেলেন। ড্রইং রুমে দীপ্তি বসেছিলো। তার মাকে এমন ভাবে যেতে দেখে দীপ্তি ও ছুটলো তার পিছু পিছু।

    মিসেস শেফালীকে কিছু খুঁজতে দেখে দীপ্তি পেছন থেকে প্রশ্ন তুলে,“কী খুঁজছো মা?”

    মিসেস শেফালী দ্রুত পেছন ফিরে দেখেন, দীপ্তি দাঁড়িয়ে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে শুধালো,“আমাকে একটু স্পেস দে বাবুন।”

    দীপ্তি “আচ্ছা মা” বলে প্রস্থান করলো। মিসেস শেফালী গিয়ে দরজা লক করে পুনরায় খোঁজ করা শুরু করলেন। ফাইনালি পেলেন। ডায়েরিটা পেলেন। সেদিন দীপ্তি যেই ডায়েরি হাতে নিয়েছিল, এটা সেটাই।

    বসে পড়লেন তিনি। একটা কলম তুলে নিলেন। ডায়েরির বেশ কিছু জায়গায় অভিমান মিশ্রিত বাক্য ছিলো। সবগুলো কেটে যাচ্ছেন তিনি। একটা একটা করে এমন ভাবে কাটছেন, যাতে কি লেখা ছিলো তা বোঝা না যায়।

    বার বার অস্থির ভঙ্গিতে অস্পষ্ট স্বরে বলে যাচ্ছে,“আমি দুঃখিত। আমি অনুতপ্ত। তোমাকে ভুল বোঝার জন্য আমার আঠারোটি বছর অভিশপ্ত।”

    পুনরায় স্মৃতিচারণ করা শুরু করলো আজ দুপুরে আরহানের বলা সেই কথা গুলো।

    আরহান বললো,“আপনি যা জেনেছেন তা আংশিক সত্য। আর আংশিক সত্য,পুরো মিথ্যের চেয়ে ভয়ংকর।”

    মিসেস শেফালী চকিতে চাইলো আরহানের পানে। অবাক ও বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“মানে?”

    “প্রতিটা কাহিনীর দুটো পাতা থাকে। একটা সেটা, যেটা আপনি দেখছেন। আর অন্যটা সেটা, যেটা আপনার চক্ষুগোচর।”

    পুনরায় আরহান মিসেস শেফালীর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা নয়নের পানে তাকিয়ে বললো,“অন্যটা আমি আপনাকে বলছি….

    মিসেস মনিরা, বাসেদ আহমেদের প্রাক্তন ছিলেন। এটা সত্যি ছিলো যে, সে একসময় তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে ভালোবাসতেন এবং তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাননি।

    কিন্তু মিসেস মনিরা বড়লোক ঘরের প্রস্তাব পেয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। আর এদিকে বাসেদ আহমেদ দেবদাস থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

    এরপর আপনার বাবার আর বাসেদ আহমেদের বাবার বন্ধুত্বের রেশ ধরে জোরপূর্বক আপনার সাথে বিয়ে দেয়। অতঃপর সে মুভ অন করতে সক্ষম হয়।আপনার প্রতি তার ভালোবাসার বিন্দুমাত্র মিথ্যে ছিলো না। দ্বিতীয় বার যেভাবে ভালোবাসা যায়! ঠিক সেভাবে আপনাকে ভালোবেসে ফেলে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে দিব্যি চলছিলো তার জীবন।

    নয় বছর পর একদিন শোনা যায়, মিসেস মনিরার হাসব্যান্ড দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মিসেস মনিরা একটা মাত্র সন্তানকে নিয়ে একাকী জীবন কাটাতে না চেয়ে পুনরায় বাসেদ আহমেদের জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছেন। এতে বাসেদ আহমেদ আপনার ও আপনাদের মেয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে, মিসেস মনিরার প্রস্তাব নাকচ করেন।

    এরপর মিসেস মনিরার টার্গেটে পড়ে যান আপনি। সে চেয়েছিলো আপনার কানে বাসেদ আহমেদের নামে বিষ ঢেলে আপনাকে রাস্তা থেকে সরাবে।

    কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। অবশেষে পরিকল্পনা করে আপনাকে শুধু রাস্তা থেকে না, দুনিয়া থেকে সরাবার।

    সেদিন আগে থেকেই আপনার উপর নজর রেখেছিলো মিসেস মনিরা। আপনি সেই রাস্তা অতিক্রম করবেন যখন, তখন সামনে এসে যায়।

    বাকি কাহিনী আপনার জানা নিশ্চয়ই। তারপর আপনার গাড়িটা, মিসেস মনিরা হালকা ধাক্কিয়ে একদম খাদের পাশে এনে রাখে এবং ড্রাইভিং সিটের দরজাটা খুলে রাখে।“

    এটুকু বলে আরহান থামলো। মিসেস শেফালী বললো,“বিয়েটা?”

    “বলছি…”

    “হুঁ…”

    “সেদিন আপনার বাড়িতে না পৌঁছনোর কারণে অনেক খুঁজেছে সবাই আপনাকে। অবশেষে পাহাড়ি রাস্তায় আপনার গাড়ি একদম খাদ ঘেঁষে রাখা দেখে সবাই আন্দাজ করে নেয় আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে। পুলিশ বলে, যদি আপনি বেঁচে থাকেন তবে আপনার বডি পাওয়া যাবে। কিন্তু বডি পাওয়া যায়নি, তাই ধরে নিয়েছে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছেন। আর সেখান থেকে বেঁচে ফেরা অসম্ভব।

    বাসেদ আহমেদ পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলো। অবুঝ বীনিও সেদিন আপনার অপূর্ণতায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদেছে। আপনি ছিলেন না। বাসেদ আহমেদ এমনিতেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তন্মধ্যে বীনিকে সামলানো তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিলো। সেই সুযোগ কাজে লাগালো মিসেস মনিরা।

    বাসেদ আহমেদের নিজের মেয়ের জন্য একটা মা আর মিসেস মনিরার একটা সংসার প্রয়োজন ছিলো। অতঃপর আপনার যাবার কিছুদিন বাদেই ও বাড়িতেই চলে আসেন তিনি।

    মাস খানেক ওভাবে থাকার দরুন বাড়ির বাইরের লোক নানা ধরনের গুজব রটাচ্ছিলো। যেহেতু তাদের বিয়ে হয়নি, তাই এটা স্বাভাবিক। জোরপূর্বক তাকে বিয়েটা করে নিতে হয়।

    আর সেদিনই আপনি এসেছিলেন।”

    “মানে আমার বীনু ওখানে ছিলো?”

    “হুঁ…”

    “মনিরা ওর কোনো ক্ষতি করেনি? মেয়েটা কেমন আছে আমার?”

    আরহান বাঁকা হাসলো। পরপর চোয়াল শক্ত করে বলা শুরু করলো,“প্রথম কয়েকদিন ভালো মতোই ব্যবহার করেছিলো। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যায়। সৎমায়ের নির্যাতন বোঝেন? সেরকম।

    প্রথম কয়েকমাস বীনি তার বাবার ভালোবাসায় নিজের মায়ের অপূর্ণতা বোঝেনি। তবে পুরুষ মানুষ তিনি। ধীরে ধীরে সে নারীতে ঝুঁকে যায়। হাজার হোক, প্রথম ভালোবাসা তো!

    মিসেস মনিরার প্রায় সব কথা তখন বাসেদ বিশ্বাস করা শুরু করেন। এমতাবস্থায় সে বাসেদ আহমেদের ব্রেইন ওয়াশ করে। তাকে বোঝায়, আপনার মৃত্যুর জন্য বীনি দায়ী। সেদিন যদি আপনাকে জোর করে ওর মামার বাড়ি নিয়ে না যেতো, তবে হয়তো আপনি তাদের সাথে থাকতেন।

    এসব কথা বিশ্বাস করে মেয়ের প্রতি অবহেলা শুরু করে দেন উনি। আর বীনির প্রতি নির্যাতন শুরু হয়ে যায়।

    রহিমা খালাকে কোনো কাজ করতে দিতেন না। বাচ্চা বীনিকে দিয়ে সব কাজ করাতেন। এজন্য ওর স্কুল এডমিশান ও অনেক দেরিতে হয়ে যায়। বীনির বাবার জোরাজুরি আর মামার হুমকিতেই পড়া লেখা করতে দেন।

    মা হীনা এক মেয়ের সাথে কি কি ঘটতে পারে, তার সবটাই ঘটেছে ওর সাথে।”

    কথাগুলো শুনে মিসেস শেফালির চোখ দিয়ে অজান্তেই অশ্রুপাত হচ্ছে। সে জানতো না এরকম কিছু। কিন্তু, না চাইতেও সে তার মেয়ের জীবনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    আরহান মিসেস শেফালীকে শান্ত হতে বললো। তখন মিসেস শেফালী প্রশ্ন তুললো,“এসব ঘটনা আপনি কি করে জানেন? বিশেষ করে আমার বীনুর ব্যাপারে?”

    আরহান হালকা হেসে বললো,“কারণ আমি বীনির লিগ্যাল হাসব্যান্ড।”

    মিসেস শেফালী চমকিত হলেন। আরহান আবারও বললেন, “বীনিকে আমি পছন্দ করি দুইবছর ধরে। কিন্তু একটা সমস্যার কারণে তৎক্ষণাৎ বিয়ে করতে পারিনি। সমস্যার রেশ কাটিয়ে উঠার পর যখন বিয়ের প্রপোজাল পাঠাই, তখন না করে দেয় মিসেস মনিরা।

    ঘটনার আগা গোড়া বুঝতে না পেরে সেদিনই খোঁজ চালাই। পাড়া প্রতিবেশী ও পুরনো মেইড, রহিমা খালার কাছে। উনাকে খুঁজতেও অনেক সমস্যা হয়েছিলো। এরপর প্রতিবেশীর কাছে কিছু ঘটনা জানি, আর বাকিটা রহিমা খালার কাছে। শুনেছি আপনার চলে যাবার বছর যেতে না যেতেই ব্যবসায় বিশাল বড় লস খান বাসেদ আহমেদ। এতে করে, বাসেদ আহমেদ তার এতো বছরে গড়ে তোলা নিজস্ব সব প্রপার্টি হারিয়ে ফেলেন। বাদ বাকি বেচে ছিলো তার পৈতৃক সম্পত্তি, যার একাংশও তার নামে ছিলো না।

    তবুও একটা ঘটনা আমার কাছে ক্লিয়ার ছিলো না। যদি বীনিকে তারা বোঝাই মনে করে, তবে বিয়ে দিয়ে দিলেই তো পারে। কেনো দিতে চায়নি? এজন্য আরো খোঁজ লাগিয়ে দেখি, আপনার শ্বশুর মশাই, তার সম্পত্তির সবটাই আপনার নামে উইল করে গিয়েছেন। এবং আপনার অবর্তমানে তা আপনার মেয়ে, তার পঁচিশ তম জন্মদিনে পাবে। এই পদক্ষেপ নেবার পেছনেও একটা কাহিনী ছিলো। সেটা হচ্ছে, বাসেদ আহমেদ আপনাকে বিয়ে করতে চায়নি। জোর করে বিয়ে দেবার দরুন যাতে আপনার সাথে কোনোরূপ অনাচার করতে না পারে, এজন্য তার প্রপার্টি সব আপনার নামে লিখে গিয়েছেন।

    এজন্য মিসেস মনিরা আর যাই করুক, বীনিকে মারেনি বা অন্য কিছু করেনি।

    এরপর আমি যেদিন তার কুকর্মের কিচ্ছা-কাহিনী জানতে পারি, সেদিনই মিসেস মনিরা আর তার আদরের মেয়েকে ছোট্ট একটা পানিশমেন্ট দিই। তবে তারা আরো ডিসার্ভ করে।

    কয়েকদিন যেতেই সব ঘটনা পরিষ্কার হয় এবং আমি জানতে পারি, সেদিন অনেক খোঁজার পরও আপনার বডি পাওয়া যায়নি। কৌতূহল দমাতে না পেরে আমি সেদিনের সব ঘটনা জানার চেষ্টা করি। তখন আমি জানতে পারি, আপনি বেঁচে আছেন এবং আমি আপনাকে খোঁজা শুরু করি। তখন বীনিকে আমি বিয়ে করে নিই। তাদের পারমিশন ছাড়াই। ঐ ফ্যামিলিতে রাখার আর ইচ্ছে হয়নি আমার।

    এরপর আপনাকে পেলাম।’’

    “আচ্ছা, আমার বীনু এখন কেমন আছে?”

    “সুখে আছে।”

    মিসেস শেফালী অধরযুগল প্রসারিত করে হেসে বললেন,“আমার মেয়েকে এখন দেখতে পাবো?”

    “না..”

    আরহানের কথার প্রেক্ষিতে মিসেস শেফালীর মুখশ্রীতে ঘন কালো আঁধারের দেখা মিললো। মিনমিনে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,“আমার শাস্তি এটা?”

    “না, আমি চাইনা বীনি আপনাকে ভুল বুঝুক। সময় মতো আপনার সাথে দেখা করাবো।” —কথাটি বলেই আরহান উঠে দাঁড়ালো। পুনরায় বললো,“জলদি দেখা হবে আবারও। আসছি।”

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    এটুকু স্মৃতিচারণ করে মিসেস শেফালী পুনরায় কান্নায় মনোযোগী হলেন। আজ তার একটা ভুলের জন্য তার কলিজার টুকরো মেয়ে, বীনিকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।

    মুখ ফুটে বলে উঠলো,“আমাকে মাফ করবি তো তুই বীনু?”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২১)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২১)

    “আজ থেকে আঠারো বছর আগের ঘটনা….

    এই চট্টগ্রামেই থাকতাম। আমার বীনুর বয়স তখন সবে পাঁচ। পিচ্চি মেয়েটা গুটি গুটি পায়ে পুরো বাড়ি দৌঁড়িয়ে বেড়াতো। বড্ড চঞ্চল মেয়ে ছিলো আমার। সারাক্ষণ মামা বাড়ি, মামা বাড়ি করেই থাকতো। অবশ্য ওর মামাবাড়ি বেশি দূরেও ছিলো না। গাড়িতে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা।

    সে মাসে প্রায়শই ল্যান্ড লাইনে একটা কল আসতো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আমার স্বামী, বাসেদ আহমেদের নামে কেউ একজন যা তা বলতো। আমি ভীষণ ভালোবাসতাম বাসেদকে। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও ভালোবাসায় কমতি ছিলো না। তাই কখনো টেলিফোনের ওপাশের ব্যক্তির কথা শুনে বাসেদকে সন্দেহ করিনি।

    তখন ছিলো বর্ষা কাল। সকাল থেকে গুরি গুরি বৃষ্টি। আর এদিকে বীনুও মামাবাড়ি যাবার জন্য কান্না জুড়ে বসেছে। অগত্যা বাড়ির গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম।

    কিন্তু, আমার মন সেদিন বড্ড কু গাচ্ছিলো। ঐ বাড়িতে শান্তি পাচ্ছিলাম না। অশান্ত এই মনকে বোঝাতে না পেরে, বাড়ি ফেরার পথ নিলাম। বৃষ্টি থেমে যেতেই বিকেলের দিকে বেরোলাম।

    বাসেদ আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছিলো। এজন্য একাই চলে এসেছিলাম। মাঝ রাস্তায় হুট করেই গাড়ির সামনে কারো উপস্থিতি লক্ষ্য করে ব্রেক কষলাম।

    পাহাড়ি রাস্তা ছিলো। একটা মেয়েকে আমার গাড়ির সামনে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম।

    মনের মাঝে একটা কথাই ছিলো,‘সুইসাইড করতে এসেছে নাকি এই মেয়েটি?’

    জোরপূর্বক গাড়ি থেকে বেরোলাম। বেরোতেই মেয়েটা আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। মস্তিষ্কে অনেক কথারা এসে ভীড় জমাচ্ছে।

    নিস্তব্ধতার মাঝেই সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,’তোমার সাথে কথা আছে।’

    মুহূর্তেই অবাক বনে গেলাম। আমায় চেনে?

    ‘কী কথা?’

    ‘বাসেদকে ছেড়ে দিচ্ছো না কেনো?’

    ‘আজব! আপনি কে? আর বাসেদকে ছেড়ে দিতে বলছেন কেনো?’

    ‘তোমার স্বামী আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। শুধু তোমার জন্য আমাকে গ্রহণ করতে পারছে না।’

    এমন কথা ল্যান্ডলাইনের সেই মেয়েটি বারবার বলতো। তবে কি এই সেই? মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো। রেগে গেলাম ভীষণ ভাবে।

    তেজ মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,‘আমি বাসেদকে চিনি। এসব বানোয়াট কথা অন্য কাউকে গিয়ে বলুন না।’

    ‘ওহ্! বুঝেছি। এভাবে নিজ থেকে সরবে না। তোমার জন্য আরো একটা রাস্তা আছে।’

    পাহাড়ি সরু রাস্তায় ছিলাম। হুট করে আমার হাত ধরে টেনে একদম কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিলো। আকস্মিক এমন আক্রমণ আমি বুঝতে পারিনি।

    মহিলাটি বাঁকা হাসলো। পুনরায় বললো,‘বাসেদকে ছেড়ে যাবি নাকি এই দুনিয়া ছাড়ার ব্যবস্থা করে দেবো?’

    ‘দেখুন আপনি ভুল করছেন। বাসেদ আপনাকে না, আমাকে ভালোবাসে। আমাদের মেয়ে আছে। আপনি এরকম করবেন না। দোহায় লাগে, ছেড়ে দিন।’

    ‘ওকে, ছেড়ে দিলাম।’—বলেই আমার হাত ছেড়ে আমাকে ধাক্কা দিলো। নিচে গড়িয়ে যাচ্ছিলাম আমি।“

    এটুকু বলে মিসেস শেফালী থামলেন। পাশ থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পুরো গ্লাস পানি পান করলেন। পুরনো স্মৃতি গুলো যখন নিজের বর্তমানে প্রভাব ফেলে, হয়তো তখন সবার অবস্থা মিসেস শেফালির মতোই নাজেহাল হয়।

    আরহান প্রশ্ন তুললো,“এরপর? পাহাড় থেকে ফেলার পরও?”

    শেফালী বেগম আরহানের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলা শুরু করলেন,“ভাগ্য! ভাগ্য চেনো? সেটাই।

    আমাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিলেও, সে জানতো না, ওপাশে খানিকটা নিচেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটা রাস্তা আছে। বেশি নিচে ছিলো না বলে বেঁচে গিয়েছিলাম।

    ঠিক তখনই ভারী বর্ষণ শুরু হয়। সে আর কিছু না করেই চলে যায়।

    মাথায় আঘাত পেয়েছিলাম ভীষণ। সেই রাস্তা দিয়ে আশরাফ ভাই যাচ্ছিলেন। আমাকে ওরকম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, সাহায্য করেন। পার্শ্ববর্তী হসপিটালে এডমিট করেন।

    জানেন? সেদিন আমার জীবনের দ্বিতীয় খুশির আগমনের কথা জানতে পারি। আমার প্রথম খুশি আমার বীনু ছিলো। আর দ্বিতীয় খুশি বাবুন।

    সেদিন ডাক্তার আমাকে জানায়, আমি পুনরায় মা হতে চলেছি। এতো কষ্টের ভীড়েও সেদিন হেসেছিলাম আমি। আশরাফ ভাই সেই ক’দিন আমার পুরো খেয়াল রেখেছেন, যেমনটা আমার নিজের ভাই হলে রাখতেন।

    প্রায় দুই মাসের মতো হসপিটালে ছিলাম আমি। উপর থেকে পড়ায়, তেমন চোট না পেলেও, মাথায়, হাতে আর পায়ে বেশ ব্যাথা পেয়েছিলাম। পায়েরটা মারাত্মক ছিলো।

    ডাক্তারের একটা কথা এখনও আমার কানে বাজে,‘ইট’স মিরাকেল। নয়তো এরকম কেসে বেবি বাঁচে না।’

    দুই মাসে কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমার একটা দোষ ছিলো। টেলিফোন নম্বর মনে রাখতে পারতাম না। সেজন্য সবসময় একটা ডায়েরি সাথে নিয়ে ঘুরতাম, ওটাতে সবার নম্বর থাকতো।

    সেবার আমার কাছে কিছুই ছিলো না।

    দুইমাস বাদে আশরাফ ভাই আমাকে উনার বাড়িতে নিয়ে যান, দু’দিন থাকার উদ্দেশ্যে। সেখানে তানিয়া আপা আমাকে পছন্দ করতেন না। তবে, আশরাফ ভাইয়ের দশ বছর বয়সী ছেলেটা দুদিনেই আমাকে আপন করে নেয়। আমি বুঝে যাই, ভালোবাসার বড্ড অভাব সেই বাচ্চাটার।

    দুদিন বাদে, আশরাফ ভাই আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে এলেন। বাড়ির সামনে তাকাতেই আমি বড়সড় একটা ঝটকা খাই। নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

    কি অদ্ভুত! মানলাম, আমি সবার কাছে মৃত। কিন্তু বাসেদ? সে কি করে এতো জলদি আমাকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে গেলো?

    গেটের উপর বিশাল আকারে সাইনবোর্ডে লেখা আছে,‘বাসেদ ওয়েডস মনিরা…’

    পাশে থেকে একজন মহিলার কথা কানে এলো,‘হুননিডে, বউ ইভার আস্ট বছরের একগুয়া মেইপুয়া আচে।’

    (শুনলাম, বউএর নাকি আট বছরের একটা মেয়ে আছে।)

    অন্যজন বললো,‘তুই জানো না কন বেডির কথা কইর? মনত ন পড়ের? আগে এই ঘরত আইতো যে? বাসেদের বান্ধবী আছিল দে।’

    (তুমি জানো না কার কথা বলি? মনে পড়ে? আগে এই বাড়িতে প্রায় আসতো যেই মেয়ে। বাসেদের বান্ধবী লাগতো)

    ‘বেডি ইভার আগের টুন সম্পর্ক আচিল ল?’

    (মানে আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো?)

    ‘হ! আইয়ো হুইনি বাসেদ মাইয়া ইভার লাই বিয়া ন গরে, ইতের বাপে পরে দি যাই শেফালির লি বিয়া করাই দিইয়ে।’

    (হ্যাঁ! শুনেছি বাসেদ নাকি এই মেয়ের জন্য বিয়ে করতে চায়নি। এই মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়, পরে ওর আব্বা জোর করে শেফালির সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো।)

    আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করলাম না। ধরে নিলাম, মেয়েটা আমাকে যা বলেছিলো, সত্যি বলেছিলো। বোরখা পরিহিত ছিলাম বলে, কেউ চিনতে পারেনি আমাকে।

    ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্যের এক হাসি হেসে আশরাফ ভাইয়ের সাথে প্রস্থান করলাম। রওনা দিলাম বীনুর মামার বাড়ি।

    কিন্তু….

    সেদিন বাড়িতে পৌঁছতেই দেখি ঐ বাড়ি ফাঁকা। শুধু ঐ বাড়ি না। আশে পাশের প্রায় সব বাড়িই ফাঁকা। সরকার নাকি ওখানে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করবে, এজন্য কলোনী খালি করিয়েছে।

    বুক ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এখন আমার বীনুকে কোথায় পাবো? মাথায় কিছুই আসছিলো না। একসাথে এতো ঝটকা আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছিলো না।

    আশরাফ ভাই তখন আমাকে উনার বাসায় নিয়ে যান। সেখানে সেই বাচ্চা ছেলের চোখের মনি হয়ে উঠি। মিষ্টি করে আমাকে মামনি ডাকে। ধীরে ধীরে আমার বাবাইটার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাই আমি।

    কিছুদিন বাদেই আশরাফ ভাই পরিবার সহ সিলেট শিফট করেন। আমিও তাদের সাথেই সেখানে চলে যাই।

    নিজেকে যাতে বোঝা মনে না হয়, এজন্য আশরাফ ভাইয়ের অফিসে কাজে লেগে যাই। শুরু করি বাবুনকে নিয়ে নতুন জীবন।

    সিলেট থাকতে থাকতে আমার বাবুন বড় হতে লাগলো। বাবুন থার্ড স্ট্যান্ডার্ডে ছিলো যখন, তখন একটা দুর্ঘটনায় আশরাফ ভাই আর তানিয়া আপা মারা যান।

    বাবাই একরোখা হয়ে যায়। হুট করেই অনেক পরিবর্তন পাই বাবাইয়ের মাঝে। চোখে সবসময় কোনো এক আগুন জ্বলতো, যা ওর বুকটা পুড়িয়ে দিচ্ছে।

    ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। আশরাফ ভাইয়ের ছেলেটা তখন থেকে আমার ছেলে হয়ে গেলো।

    বীনুকে ওর মামার কাছে রেখে এসেছিলাম বলে নিশ্চিন্ত মনে ছিলাম আমি। তবুও বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু, যেই শহর জুড়ে বিশ্বাস ঘাতকতা ছেঁয়ে ছিলো, সেই শহরের হাওয়া সহ্য হতো না।

    চার মাস আগে, বাবুন হুট করেই বলে ফেলে, ও চবিতে পড়বে। আমি মানা করে দেই। তাই ও গিয়ে ওর ভাইকে বলে। অগত্যা ওদের জোরাজুরিতে ফিরতেই হলো। আশরাফ ভাই ছাড়া কেউ আমার অতীত জানতো না। বড় হবার পর বাবাই জেনে যায়, আমিও ধোঁকা খেয়েছি, এই শহর থেকে। আর কিছুদিন আগে বাবুন আমার ডায়েরি পড়ে জেনে যায় সবটাই।”

    মিসেস শেফালী কথা শেষ করেন। এটুকুই তো কাহিনী। কেটে ছেটে এটুকুই তো আছে।

    এতক্ষণ গভীর মনোযোগে সবটা শোনার পর আরহান বললেন,“মিসেস মনিরা ডাবল গেইম খেলেছেন।”

    মিসেস শেফালী চকিতে চাইলেন। উনার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে আরহান বললেন,“আপনি যা জেনেছেন, তা ছিলো আংশিক সত্যি। পুরো মিথ্যের চেয়ে আংশিক সত্যি বেশি ভয়ংকর।”

    _____________________

    “ভালোবাসা! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখময় অনুভূতি কোনটা যদি আমায় জিজ্ঞেস করা হতো! তবে কোনো সময় ব্যয় না করে নির্দ্বিধায় বলে দিতাম, এটা ভালোবাসা। ভালোবাসার উপলব্ধির পূর্বকাল থেকেই সুখ অনুভব করা যায়। আর প্রতিক্ষণ মনটা উত্তেজিত হয়ে থাকে। কখন আমার প্রিয় মানুষটি আমার নেত্র সম্মুখে আসবে, দুচোখ ভরে দেখবো। আর…. হ্যাঁ! ভীষন লজ্জা পাবো।”

    ডায়েরিতে এটুকু লিখে মুচকি মুচকি হাসা শুরু করে দিলাম। অবশেষে মনের ভালোবাসা মুখে নিয়ে এলাম। দুপুরের দিকে যে, আরহানকে বললাম। এরপর থেকে আর আরহানের সামনেই আসিনি। কেমন যেনো অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। উনি কাছে এলেই সব কথা আওলিয়ে যাচ্ছে।

    খুব ইচ্ছে হচ্ছে একটু সাজতে। আচ্ছা! আরহান যদি বাড়ি ফিরে দেখেন, তার বউ তার জন্য সেজে বসে আছে, তখন আরহানের মুখখানা কেমন দেখাবে? বিস্মিত হবেন নিশ্চয়ই!

    হালকা হেসে কাবার্ড থেকে একটা গোলাপী সুতির শাড়ি পরে নিলাম। সাথে কালো ব্লাউস। আয়নায় এক ফাঁকে কোমরের এই বেলী চেইন দেখে নিলাম। মাথা নিচু করে হাসলাম। সেদিন আরহান স্বীকার করেছেন, এটা উনিই দিয়েছিলেন।

    চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর চুল খোঁপা করে নিলাম।

    হুট করেই পেছন থেকে কারো আলিঙ্গনে আমি স্তব্ধ, পাথর বনে গেলাম। শরীরের থরথর কাঁপুনি আমার বিস্মিত হবার বহিঃপ্রকাশ। কানের কাছে কারো ওষ্ঠের স্পর্শ পেলাম। সর্বাঙ্গে শিহরন ছেয়ে যাচ্ছে।

    ফিসফিসিয়ে বললেন,“ভালোবাসি শুকতারা…”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২০)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২০)

    ফটোফ্রেম সামনে রেখে ফ্লোরে বসে আছে তৃষ্ণা। গম্ভীর মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সামনের এই ছবিতে আছে তৃষ্ণার মম, ড্যাড ও তৃষ্ণা। একবার পুরো ছবিতে হাত বুলিয়ে নিলো। অধর যুগল কম্পিত হয়ে বলে উঠলো,“আজ আমারও একটা পরিবার থাকতো। আজ আমিও ভালোবাসা পেতাম। ভাগ্য প্রতিবার আমার সর্বস্ব ছিনিয়ে না নিলেও পারতো।”

    দশ বছর আগে…….

    একদিন তৃষ্ণা কলেজ থেকে ফিরেছিলো। উদাস মুখ তার। সেদিন কলেজে প্যারেন্টস মিটিং ছিলো, কিন্তু তৃষ্ণার গার্ডিয়ান যায়নি। ওর সব ফ্রেন্ডসদের বাবা মা এসেছিলো। শুধু তৃষ্ণার কেউ যায়নি।

    সেদিন ওর মামনি বাড়িতে ছিলো না। দীপ্তির সাথে ওর স্কুলে ছিলো বিধায় বাড়িতে শুধু ওর মম-ড্যাড ও সার্ভেন্টস ছিলো। সার্ভেন্টস সব নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।

    তৃষ্ণার রুমের আগেই ওর মম-ড্যাড এর রুম পড়ে বিধায়, তাদের রুম ক্রস করেই নিজের রুমে যেতে হয়। সেভাবেই যাচ্ছিলো।

    হঠাৎ কারো উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পা জোড়া সেখানেই থমকে যায়। না চাইতেও ভেতরের কিছু কথা কানে আসে। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে তৃষ্ণা ভেতরে দেখতেই ওর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না তৃষ্ণা।

    ওর ড্যাড ওর মমকে থাপ্পড় মারলো। ওর ড্যাড এই জীবনে কোনদিন ওর মমের গায়ে হাত তোলেনি। সেই আজ…

    লুকিয়ে কথা শোনা ঠিক না। তবে চমকিত তৃষ্ণা এখন হতভম্ব হয়ে আছে।

    ভেতরে ওর ড্যাড, আশরাফ সরকার বললো,“আমি তোমার থেকে এসব আশা করিনি তানিয়া।”

    হাতের কিছু ছবি, যেগুলোতে তৃষ্ণার মম, তানিয়ার আর একটা অপরিচিত লোকের অন্তরঙ্গ মুহুর্ত ক্যাপচার করা আছে, সেগুলো মুখের উপর ছুড়ে ফেলে বললো,“এগুলো দেখো। আরো কিছু বলার আছে তোমার?”

    অবশেষে উপায় না পেয়ে তানিয়া বলে ফেললো, “হ্যাঁ। এগুলো সত্যি। সব সত্যি।”

    সঙ্গে সঙ্গে আশরাফ, তানিয়াকে আবারও থাপ্পড় মারলো।

    “ছিঃ! তোমার এতো বড় একটা ছেলে আছে। তবুও?”

    “এই তুমি কোন সাহসে আমার গায়ে হাত তোলো? আর আমার যা ইচ্ছে তাই করবো আমি। ইট’স মাই লাইফ।”

    “তুমি বাড়াবাড়ি করছো তানিয়া।”

    “বাড়াবাড়ি আমি না, তুমি করছো। তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে আমার সখ-আহ্লাদ সব ভেস্তে গিয়েছে। আমার জীবনটা নরক হয়ে গিয়েছে। সব কিছুতেই ছেলে ছেলে করো। আমার জাস্ট ঐ ছেলেকে সহ্য হয়না। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও তো আশরাফ।”

    আশরাফ অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি কি আদৌ মা? কি করে নিজের ছেলেকে নিয়ে এভাবে বলো? বাচ্চা হলে তার দায়িত্ব নিতে হয়, খেয়াল রাখতে হয়, নজরে নজরে রাখতে হয়। এটাকে বন্দী জীবন বলে না।”

    “আমার কাছে এটাই বন্দী জীবন।”

    “আর এই লোকটার কাহিনী কি? এসব কি তানিয়া?”

    “আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই।”

    রাগী আশরাফের রাগ তুঙ্গে উঠে গেলো। আর এদিকে তানিয়াও কম না । দুজনের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তানিয়া পাশে ফলের ঝুড়ি থেকে ছুরি নিয়ে সোজা আশরাফের পেট বরাবর আঘাত করে। মুহূর্তে এমন আক্রমণের জন্য আশরাফ সরকার পেটে হাত রেখে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে।

    দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের প্রাণ প্রিয় ড্যাডের এমন অবস্থা দেখে চিৎকার দেয় তৃষ্ণা। তখন তানিয়া মাথা ঘুরিয়ে দরজার সামনে তৃষ্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য তানিয়ার এখন কোনো কিছু খেয়াল নেই। প্রমাণ লুকোনোর তাগিদে হাতের ছুরি নিয়ে তৃষ্ণার দিকে অগ্রসর করে। তৃষ্ণা ওর দিকে এগোতে থাকা তানিয়ার মধ্যে নিজের মমকে নয়, নিজের ড্যাড এর খুনিকে দেখতে পাচ্ছে। যখনই তানিয়া ছুরিকাঘাত করতে যাবে, তখনই তৃষ্ণা ওর পাশের ফুলদানি সোজা ওর মমের মাথায় মারে। সঙ্গে সঙ্গে তানিয়া মাথায় হাত রেখে মেঝেতে পড়ে যায়।

    তৃষ্ণা হুঁশে আসে। সতেরো বছর বয়সী তৃষ্ণার নেত্র সম্মুখে এখন ভেসে আছে তার মম ও ড্যাড এর লাশ। সেদিন তৃষ্ণা কান্না করেনি। একটুও না। শুধু বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। সে যে নিঃস্ব হয়ে গেলো। এতিম হয়ে গেলো তৃষ্ণা।

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    তৃষ্ণার মামনির বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো। এমনিতে এই বাড়ি নিরব থাকে সবসময়। তবে আজ তার কাছে এই নিরবতাটা ভয়ংকর লাগছে। দীপ্তিকে রুমে দিয়ে সে তৃষ্ণার রুমের দিকে রওনা হলো।

    তৃষ্ণার মম-ড্যাডের রুমের সামনে পৌঁছতেই তার পা জোড়া থমকে যায়। খোলা দরজার মুখ বরাবর তাকাতেই এই বিধ্বস্ত পরিবারকে দেখে সে চোখ বড় বড় করে ফেলে। রক্তাক্ত আশরাফ আর তানিয়ার লাশের মাঝ বরাবর তৃষ্ণা পাথরের ন্যায় বসে আছে।

    তৃষ্ণার কাছে যেতেই সে তার মামনির দিকে চোখ তুলে তাকায়। নীলাভ চক্ষুদ্বয় ভয়ংকর লাগছিলো। সময় নিয়ে একে একে পুরো ঘটনা খুলে বলে তৃষ্ণা। সবটা শোনার পর, তার মামনি তৃষ্ণার দ্বারা খুন করার ব্যপারের সবগুলো প্রমাণ নষ্ট করে দেয়। অবশেষে সে রাতে পুলিশ এলে বলা হয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির আগমনের জন্য তারা একে অপরকে আঘাত করে। সেদিন তৃষ্ণার, ওর নিজের মমকে খুন করার ব্যাপারে ওর মামনি ব্যতীত আর কেউ জানতে পারে না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ধামাচাপা পড়ে যায়।

    সেবার খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিলো,“বিশিষ্ট শিল্পপতি আশরাফ সরকার, তার সহধর্মিণী তানিয়ার পরকীয়ার ব্যাপারে জানতে পারায়, দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। অবশেষে স্বামী ও স্ত্রী, দুজন দুজনার দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে।”

    অতঃপর এতিম তৃষ্ণার জীবনে ওর মায়ের মতো মামনি থাকা সত্বেও, সে চলে যায় বাজে দিকে। নেশা দ্রব্য তার নিত্যদিনের সাথী ও সুন্দরী রমণী তার আসক্তি হয়ে যায়। একবুক কষ্ট নিয়ে গানের দিকে ঝুঁকে যায়। আর সেই লোকটি, যার সাথে তার মমের একটা সম্পর্ক ছিলো। অবৈধ সম্পর্ক ছিলো অবশ্য। তাকে পরপারে পাঠানোর মাধ্যমে মাফিয়া কিংডমে প্রবেশ হয় তৃষ্ণার।

    কোনো একদিন নেশাদ্রব্য পাচারের সময় আরহান, তৃষ্ণার গ্যাংকে ধরে ফেলে। এই থেকে শুরু হয় শত্রুতা।

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    অতীতের পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে তৃষ্ণা এখন হাঁপাচ্ছে । বড্ড ভয়ংকর ছিলো তার কাছে, নিজের মম-ড্যাডকে ওমন অবস্থায় দেখা। তৃষ্ণা পাশ থেকে একটা ছুরি নিয়ে, ফ্রেমের বা পাশে, ওর মমের ছবিতে আঘাত করে। ফ্রেমের কাঁচ ভেঙ্গে যায়। ঐ কাঁচের উপর দিয়ে তৃষ্ণা ওর মমের মুখশ্রীতে হাত বুলায়। ভাঙ্গা কাঁচ হাতে লাগায়, রক্ত বের হয়ে ছবিতে, তানিয়ার মুখের উপর লাগে। তৃষ্ণার ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে হাতে। এর চেয়েও অধিক যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে বুকে। তৃষ্ণা হাসলো।

    উচ্চস্বরে হেসে বললো,“আমার সব কিছু ছিনিয়ে নিলে তুমি মম। তুমি খুনি। শুধু ড্যাডের না। আমার সুখের ও। তাই তোমার মুখের উপর এই রঙটা খুব মানায়। এটাই মানায় তোমার সাথে।”

    ____________________________

    “সত্যি ভালোবাসো আমায়?”

    আরহানের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শুনে খেয়ালে এলো আমি কি বলেছি। এতক্ষণ আরহানের কথায় কষ্ট লাগলেও এখন লজ্জা লাগছে। এভাবে কিভাবে বলে দিতে পারলাম?

    লজ্জায় ইতিমধ্যে আমার গালে রক্তিম আভা ছেয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গ এড়াতে অন্য কিছু বলা সম্ভব না এখন। তাই সম্পূর্ণ আরহানকে এড়াতেই প্রস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

    ভাবনা মাফিক যেতে নিলেই, আরহান আমার হাত ধরে টেনে পুনরায় নিজের সামনে দাঁড় করালেন।

    “শুকতারা? ডু ইউ লাভ মি? সিরিয়াসলি?”

    আরহানের কণ্ঠস্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে, উনি চমকেছেন। পুনরায় মুখশ্রী ভাব গম্ভীর করে বললেন,“তৃষ্ণার হাত থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যে বলেছিলে নাকি?”

    আমার এতক্ষণের লাজুক ভাবটাও উনার মুখশ্রীর সঙ্গে পাল্টে গেলো। উনি ভুল বুঝছেন তো। আমি ভালোবাসি উনাকে। কিন্তু মুখ ফুঁটে বলবো কি করে?

    আরহান পুনরায় বললেন,“জানো আমার অবস্থা কি হয়ে গিয়েছিলো? একেতো আমি এই শহরে ছিলাম না। তার উপর রাতে ওরকম একটা ঘটনা। মাথা নস্ট হয়ে গিয়েছিলো আমার। কিভাবে যে পুরোটা পথ এসেছি আমি, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। আমার সব লোক লাগিয়ে তোমাকে খুঁজেছি। কিন্তু…. আই এম সরি শুকতারা। আমার আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো।”

    মিনিট খানেক আরহানকে দেখে আমি উনার হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নোট প্যাড আর একটা কলম নিয়ে কিছু লিখলাম। এরপর আরহানের হাতে দিয়ে দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করলাম।

    আরহান কাগজের লেখা গুলো পড়ে হাসলেন। প্রাপ্তির এক হাসি হাসলেন।

    সেখানে লেখা ছিলো,“আপনাকে ভালোবাসি কি না বলতে পারবো না। শুধু বলতে পারবো‚ আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা মানেই আপনি।”

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    ________________________

    এতো দিন অনেক খোঁজ করার পর অবশেষে আরহান তাকে পেলো। মাত্র রুদ্রের কল আসায় আরহান রুদ্রের বলা এড্রেসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এই চারদিন সিলেটে ছিলো আরহান। সিলেটে যাবার মূল উদ্দেশ্য সেই মানুষটাই ছিলো।

    অতঃপর রুদ্রের বলা এড্রেসের সামনে পৌঁছতেই আরহান চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলে। কারণ সে এখন ‘টি এস ইন্ডাস্ট্রিজ’ এর মেইন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

    দ্রুত পায়ে অফিসের ভেতরে ঢুকলো। গার্ডস এতে কোনো ঝামেলা করেনি। কারণ সে এখানে ‘দ্যা মাফিয়া কিং এ.এ.কে’ নামে আসেনি। এসেছে আরহান পরিচয়ে।

    ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আরহান মনে মনে বললো,“পৃথিবী আসলেই গোল। যাকে এতদিন ধরে এতো দূর দূরান্তে খুঁজে এলাম, সে আমার কাছাকাছিই ছিলো।”

    ভেতরে ঢুকে একজনকে জিজ্ঞেস করলো,“মিসেস শেফালী আহমেদ এর কেবিন কোনটা?”

    লোকটি বললো,“ম্যামের কেবিন, থার্ড ফ্লোরের একদম শেষের দিকে।”

    আরহান আবারও সেদিকে গেলো। কেবিনের সামনে পৌঁছিয়ে ডোর নক করতেই ওপাশ থেকে “কাম” বলায়, আরহান প্রবেশ করলো।

    একটা আধ বয়স্ক মহিলা বসে বসে কিছু ফাইলস চেক করছে। আরহান এগিয়ে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পড়লো।

    মহিলাটি একবার আরহানের দিকে তাকিয়ে পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগী হয়ে বললো,“কি প্রয়োজন?”

    “আপনাকে।”

    “কেনো?”

    “অতীত জানতে চাই।”

    মহিলাটি থমকে গেলো। হুট করেই মাথার ভেতর পুরনো সব ঘটনা এসে জড়ো হয়। আরহানের দিকে চোখ তুলে তাকায়। এবার আর চোখ সরায়না।

    জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে কেনো বলতে যাবো?”

    “অতীত যখন বর্তমান নষ্ট করতে আসে, তখন সেই অতীতকে আগে নষ্ট করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন সেই অতীত জানা। তাই এসেছি।”

    আরহানের কথায় মহিলাটি কেমন যেনো হাসফাঁস করা শুরু করলো। ভেবেছিলো তার অতীতের সমাপ্তি সেখানেই হয়েছে। কিন্তু না, সে আবারও তার দরজায় করাঘাত করলো।

    “আমি আপনাকে কিছু বলতে বাধ্য নই।”

    আরহান জানতো, এতো ইজিলি সবটা জানতে পারবে না। তাই বিদ্রুপ স্বরে বললো, “মেয়ে বেঁচে আছে নাকি মরে গিয়েছে, এটা জানতে চান না?”

    “মানে?”

    মহিলাটির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করা প্রশ্নে আরহান হাসলো। ঠোঁটের হাসির রেখা বিদ্যমান রেখেই বললো,“আগে আপনি বলুন। এরপর আমি বলছি..”

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৯)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৯)

    সকালের মৃদু আলো চোখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুললাম। মাথা ভার লাগছে ভীষণ। কিছুক্ষণ বসে থাকতেই হুট করেই মনে পড়লো কাল রাতের কথা। লোকটা আরহানের কথা বলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করিয়েছে। শেষবার যখন জিজ্ঞেস করলাম,“কি হচ্ছে এটা?”

    লোকটা বাঁকা হেসে “ধোঁকা” বলেই আমার মুখের সামনে কিছু একটা স্প্রে করলো। এরপর… এরপর কি হয়েছিলো? উফফ! মনে পড়ছে না কেনো?

    তখনই রুমে প্রবেশ করলো একটা মহিলা। আমাকে বললো,“ম্যাম! আপনি উঠে পড়েছেন? ফ্রেশ হয়ে নিচে চলুন ব্রেকফাস্ট করতে। স্যার ডেকেছেন।”

    মহিলাটি এই বাড়ির মেইড হবে হয়তো। কেনো যেনো প্রচুর রাগ হচ্ছে। তবুও শান্ত কন্ঠে বললাম,“আপনার স্যারকে ডাকুন।”

    মহিলাটি “আচ্ছা” বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

    কিছুক্ষণ বাদেই রুম নক করার সাউন্ড পেলাম। ততক্ষণে আমি বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি। ওপাশের লোকটি ভেতরে ঢুকতেই আমি তাকালাম।

    নীলাভ চক্ষু দ্বয়ের এই সুদর্শন পুরুষকে দেখতেই মনে পড়লো ভার্সিটির নবীন বরণের দিনের কথা। মনে পড়ে গেলো, সেদিন রুদ্রের সাথে আরহানের সেই কথাগুলো। চোখ দুটো বড় বড় করে মুখ ফুটে উচ্চারণ করলাম,“তৃষ্ণা!”

    তৃষ্ণা মাথা নিচু করে হালকা হাসলো। এরপর বললো,“ইয়াহ! আই এম।”

    হুট করেই রাগ এবং বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো আমার। সাথে ভয়ের সংমিশ্রণ আছেই। আমাকে ধোঁকা দিয়ে তুলে আনলো! কিছু করবে না তো আবার!

    “দ’দেখুন! আপনি আমাকে এখানে এনেছেন কেনো?”

    তৃষ্ণার সহজসরল স্বীকারোক্তি,“ভালোবাসি তাই..”

    ভয় ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে বলে উঠলাম,“ভালো হচ্ছে না, আরহান জানতে পারলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে।”

    ডোন্ট কেয়ার ভাবে জবাব দিলো,“আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি। আরহান আপনাকে ভালোবাসে কি না জানিনা, তবে আপনাকে আমার মতো এতো ভালোবাসতে পারবে না কেউ।”

    আমি ভালোবাসায় বড্ড ভয় পাই। এর চেয়ে সুখের কিছু নেই, আবার এর চেয়ে যন্ত্রণার কিছু হতে পারে না। এর চেয়ে বড় পুরষ্কার কেউ পায়নি। এর চেয়ে ধারালো অস্ত্র এখনও তৈরি হয়নি। হালকা আওয়াজে বললাম,“যেতে দিন আমাকে।”

    “কিন্তু কেনো?”

    “কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

    “আপনি শুধু পাশে থাকবেন, আমার একার ভালোবাসাই আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট।”

    “পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি? আমি বললাম তো ভালোবাসি না আপনাকে।”

    তৃষ্ণার কণ্ঠস্বর হঠাৎ পরিবর্তন হলো। মাঝে তীব্র এক রাগের আভাস পাওয়া গেলো। বললো,“আমাকে মেনে নিলে সমস্যা কি? বারবার বলছি তো, আপনাকে ভালোবাসি আমি।”

    আমি ভীত হয়ে বললাম,“আরহানের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে,এটা জানেন?”

    তৃষ্ণা একই কন্ঠে রাগের তেজ বাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ! ও সবসময় আমার সব কিছু ছিনিয়ে নিতে চায়, আমাকে হারাতে চায়। এজন্যই আপনাকে বিয়ে করেছে। কিন্তু আমি আরহানের কাছে হারতে পারলেও, আপনাকে হারাতে রাজি নই নয়নতারা।”

    “ভুল। উনি আপনার কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিতে চায়নি। বরং আপনার কাছ থেকে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছে। আপনি তো সেদিন প্রথম দেখলেন আমাকে। আর আরহান! সে দুই বছর আগে থেকেই ভালোবাসে আমাকে।”

    তৃষ্ণার কপাল কুঁচকে এলো। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে জোরপূর্বক হেসে বললো,“সে বাসুক। আপনি তো বাসেন না। তাই না? আর আপনার বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? বাচ্চার মা হলেও আমার আপনাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।”

    “আপনি ভুল করছেন।”

    “ভালোবাসা যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে আমি এমন সহস্র ভুল করতে রাজি আছি।”

    স্থির চাহনি ফ্লোরে নিক্ষেপ করে বললাম,“আমি আরহানকে ভালোবাসি।”

    কিভাবে বললাম জানিনা। তবে, বলে ফেললাম। আর অনুভব করলাম, এটা সত্যি।

    সামনে তৃষ্ণার নীল চক্ষুর দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, তৃষ্ণা এরকম কথার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,“সে ইট এগেইন…”

    এতক্ষণের ভয় ভীতি সব ভুলে পুনরায় বললাম,“ভালোবাসি আরহানকে।”

    গম্ভীর তৃষ্ণার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। দুই হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল গুলো খামচে ধরে মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বুলি আওড়ালো, “শিট! এবারও… এবারও…”

    চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। মিনিট পাঁচেক পর চোখ খুললো। যেনো এই পাঁচ মিনিটে পুরনো অনেক কিছু কল্পনা করে নিলো।

    আমার দিকে তাকালো তৃষ্ণা। এগিয়ে এলো খানিকটা। আমি দূরত্ব বজায় রাখতে সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেলাম।

    আমার এমন করা দেখে তৃষ্ণা নিজেও দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে দুই হাত হালকা সামনে তুলে বললো,“ভয় পাবেন না। আমি কাছে আসছি না।”

    শান্ত কন্ঠে এরকম কথায় ভয় কমলো। তবে গেলো না।

    তৃষ্ণা পুনরায় বললো,“কিছু বলতে চাই। আই প্রমিজ, এটাই শেষ বার।”

    আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে তৃষ্ণা আমার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নজর ফ্লোরেই সীমাবদ্ধ রেখেই বললো, “জীবন আমাকে কিছু দিতে পারেনি। আমার পাওয়া জিনিসগুলো ছিনিয়েই নিয়েছে শুধু। তন্মধ্যে সবচেয়ে আকাঙ্খিত আপনি। জীবন সেই আপনিটাকেই আমার হতে দিলো না। এর জন্য রয়েছে শুধুই আফসোস!”

    তৃষ্ণা হাঁটু মুড়ে আমার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নজর ফ্লোরেই সীমাবদ্ধ রেখে বললো,“আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার মিথ্যায় ঘেরা জীবনের একটি মাত্র সত্যি, আপনাকে ভালোবাসি।”

    আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। তৃষ্ণা পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেনো কল দিয়ে বললো,“ম্যামকে বাড়ি দিয়ে এসো।”

    এরপর আমার দিকে তাকালো। এই চোখে অনেক কিছু আছে। যা আমাকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু, আমি জানতে চাই না।

    তখন তৃষ্ণা হালকা হাসলো। বড্ড অদ্ভুত এক হাসি ছিলো। বললো,“বাইরে গাড়ি রাখা আছে। আমার লোক, আপনাকে সেইফলি আপনার বাড়ি দিয়ে আসবে।”

    আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম না। পাশেই আমার ফোন রাখা ছিলো। নিয়ে জলদি বেরিয়ে পড়লাম।

    ___________________

    বাড়ি ফিরতে ফিরতে তখন বেলা এগারোটা বেজে গেলো। বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেখেই মা পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে এলেন। আপাদমস্তক দেখে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।

    এরপর আমাকে ছেড়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,“তুই কোথায় চলে গিয়েছিলি? ঠিক আছিস মা? আরহান তোকে বাড়ি থেকে বেরোতে না করে দিয়েছিলো না? কেনো গিয়েছিলি?”

    মুহূর্তেই আরহানের কথা মাথায় আসায় জিজ্ঞেস করলাম,“আমি তো ঠিক আছি। তবে আরহান! উনি কোথায়?”

    “তোকে খুঁজতে বেরিয়েছে।” —বলেই মা উচ্চকন্ঠে নিশাকে ডাকলেন। নিশা এসে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।

    কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“ভাবি! কোথায় ছিলে তুমি? জানো ভাইয়া তোমাকে খুঁজতে খুঁজতেই পাগল হয়ে গিয়েছে। এতোটা কাতর অবস্থায় ভাইয়াকে কখনো দেখিনি।”

    মা নিশাকে বললেন,“আরহানকে কল দিয়ে বল, বীনি বাড়ি ফিরেছে।”

    নিশা তখনই আরহানকে কল দিলো।

    নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিলাম। মাথাটা ব্যাথা করছে। হঠাৎ সেখানে আরহান প্রবেশ করলেন। দ্রুত পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে তড়িৎ গতিতে জড়িয়ে ধরলেন। অপ্রস্তুত আমি এখন আরহানের বুকে। উনার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। হৃদপিন্ড অনেক দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। যেখানে আমার হৃদযন্ত্র থমকে গিয়েছে।

    “এখন… এখন আমি বেঁচে গেলাম। আরেকটু হলে, সত্যিই মরে যেতাম।”

    কাতর ও অস্থির কণ্ঠস্বর আরহানের। বুকটা ধুক করে উঠলো। সত্যি তো! আরহান আমাকে অনেক খুঁজেছেন। উনার এই অস্থিরতা তো আমারই জন্য।

    মিনিট দশেক পর আমাকে ছাড়লেন। এতক্ষণ মুখ লুকোনো থাকলেও, এখন চেহারায় লজ্জার রেশ ফুটে উঠেছে। আরহান আমার এই লাজে রাঙা মুখের পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,“না করেছিলাম না? বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করেছিলাম না? কেনো বেরোলে?”

    চকিতে চাইলাম আরহানের পানে। আরহান আমার সাথে কখনোই রাগ দেখাননি। আজ প্রথম উনার কন্ঠে এমন তেজ লক্ষ্য করাতে স্থির নয়নে তাকিয়ে রয়েছি। এতে আরহানের রাগ বাড়লো বৈ কমলো না। আমার দুই বাহুতে ঝাঁকিয়ে বললো,“কিছু জিজ্ঞেস করেছি না? আজ যদি ঐ তৃষ্ণা কিছু করে দিতো?”

    কেঁপে উঠলাম। সাথে ভয় ও পেয়ে গেলাম। এই আরহানকে চিনিনা আমি।

    “স্পিক আপ..”

    আবারও কেঁপে উঠলাম। আরহান এই রাগ নিয়ে কখনো কথা বলেননি আমার সাথে। তাই আর সময় অপচয় না করে ব্যক্ত করলাম,“তৃষ্ণা বলেছিলো আপনার ক্ষতি করে দিবে। এজন্য গিয়েছিলাম।”

    “আর তাই তুমি বিশ্বাস করে নিলে? এতোটা গাঁধা কী করে হলে? বাড়িতে কাউকে না বলে চলে গেলে!”

    আমি অশ্রুসজল নেত্রে চেয়ে রইলাম। কী করে ভাবতাম তখন অতো কিছু? তৃষ্ণা যে আরহানের ক্ষতির কথা বলছিলো।

    আরহান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলেন। বেড সাইড টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেলেন।

    হুট করেই আরহান তাকালেন আমার দিকে। চাহনিতে অন্য কিছু রয়েছে।

    অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“আমার ক্ষতি করে দেবে বলে তুমি গিয়েছিলে?”

    “হুঁ..”

    “কেনো?”

    আমিতো এখনও আরহানের নতুন রূপ দেখতে পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে আছি। তাই অতো কিছু না ভেবে উত্তর করে যাচ্ছি। কিন্তু শেষের এই ‘কেনো’ টা আমাকে বোঝালো আরহান আমার মুখ থেকে কথা বের করতে চাচ্ছে।

    আমি চুপ হয়ে গেলাম।

    আরহান পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,“তৃষ্ণার কাছ থেকে পালিয়ে আসলে কী করে? যতদূর ওকে চিনি, ওর হাত থেকে পালানো অসম্ভব।”

    “পালাইনি।”

    আরহান সজোরে বলে উঠলেন, “হোয়াট?”

    কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বললেন,“না পালালে এলে কি করে? এখন আবার এটা বলো না যে তৃষ্ণা নিজেই তোমাকে ফেরত পাঠিয়েছে। কারণ এটা সম্ভব নয়।”

    “তৃষ্ণা নিজেই আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে।”

    আরহান অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললেন,“ইম্পসিবল….”

    “জানিনা আমি কিছুই। তবে আমার কোনো ক্ষতি করেননি উনি। ইন ফ্যাক্ট আমার হাত অবদি ছুঁয়ে দেখেননি। সকালে জ্ঞান ফিরতেই তৃষ্ণা আমাকে বলে, উনি আমাকে ভালোবাসেন….”

    “এক মিনিট! তৃষ্ণা তোমাকে ভালোবাসে?”

    “উনি তো তাই বললেন।”

    আরহান কপালে হাত রেখে আস্তে বুলি আওড়ালেন, “ওহ্ গড! সেই আগে থেকেই ওর কেনো আমার জিনিসটাই পছন্দ হওয়া লাগে!

    আরহান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,“ভালোবাসে! তাহলে তোমাকে ছেড়ে দিলো কেনো?”

    “কারণ আমি বলেছি, আমি উনাকে ভালোবাসি না।”

    “শুধু এজন্যেই ছেড়ে দিলো?”

    “নাহ্!”

    “তবে?”

    “আমি বলে দিয়েছি,‘আমি আরহানকে ভালোবাসি’। তাই ছেড়ে দিলো।”

    “সত্যি ভালোবাসো আমায়?”

    আরহানের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শুনে খেয়ালে এলো আমি কী বলেছি।

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৮)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৮)

    সকালে ফোনের কলিং টিউনে ঘুম ভেংগে যায় আমার। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আননৌন নাম্বার থেকে একটা কল এসছে। এতো সকালে আমাকে কে কল দেবে?

    কৌতুহল নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ ভেসে এলো, “স’সরি বীনু। রিয়েলি ভেরি সরি।”

    কান্না ভেজা কণ্ঠস্বরটা চিনতে আমার বিন্দু মাত্র সমস্যা হয়নি। এটা রুশী। মনের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্ন চলে এলো। সেদিনের ব্যবহার, রাগ, কথা না বলা এসব কি ছিলো?

    আমার কিছু বলার আগেই রুশী কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলো,“আমাকে মাফ করে দে বীনু। তিন মাস আগে আমার লাইফ পুরোটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে রে। আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”

    সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এই খবরটা শুনে মুহূর্তেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি। কি বলছে রুশী এটা! বিয়ে? তবে অয়ন কোথায় আছে? অয়ন না ওকে ভালোবাসতো! রুশীও তো অয়নকে ভালোবাসে।

    “কি হয়েছে, খুলে বল।”

    রুশী একে একে সব কথা খুলে বললো। অয়নকে ছেড়ে চলে আসা, মারুফকে বিয়ে করা পর্যন্ত সবটা বললো। আমি নিশ্চুপ থেকে রুশীর কথা শুনলাম। নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে এসবের জন্য। কেনো সেদিন ওর পাশে ছিলাম না আমি?

    আমার নিস্তব্ধতার মাঝেই রুশী বলে উঠলো,, আ’ আমি প্রেগন্যান্ট বীনু।”

    অবাক হলাম না। বিয়ে হয়েছে, প্রেগন্যান্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। অবাক হলে বরং ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগতো। খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,‘সেদিন বলেছিলাম, দেরি হয়ে যাবে। শুনলি না আমার কথা।’ কিন্তু এটা বলা যাবে না এখন। মেয়েটা অনেক বাজে একটা পরিস্থিতির মধ্যে আছে।

    তাই বললাম,“বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে তোর, তার উপর তুই মা হতে চলেছিস। যদি ব্যাপারটা শুধু বিয়ে অবদিই থাকতো, তবে আমি যে করেই হোক, তোকে ডিভোর্স দিইয়ে অয়নের কাছে দিয়ে আসতাম। কিন্তু, তোর বাচ্চা! ও তো কোনো দোষ করেনি তাইনা? দেখ, আমি জোর করছি না। জাস্ট বলছি তোকে। পারলে নিজেকে এই সংসারেই গুছিয়ে নে। আর কারো জন্য না হলেও, তোর সন্তানের জন্য নতুন একটা জীবন শুরু কর।”

    তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা হলো রুশীর সাথে। অয়নের এভাবে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো আমার কাছে।

    এখন, একসাথে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা মনে হচ্ছে খুব। অয়ন যখন ক্যাম্পাসের পেছনের ঐ বকুল ফুল গাছতলায় বসে গান গাইতো, তখন রুশী কেমন মুগ্ধ নজরে দেখে যেতো! আর অয়নের অব্যক্ত সকল কথার ভীড়ে একটা এটাও ছিলো,“রুশী! আমার সব গান তোকে ডেডিকেট করে গাই আমি।”

    আচ্ছা! সবাই তো সত্যিকারের ভালোবাসতে পারেনা। তবে যারা পারে, তাদের ভালোবাসা কেনো পূর্ণতা পায় না? অয়ন, রুশীকে কতটা ভালোবাসতো তা আমি জানি। আমি এ ও জানি, রুশী ওকে কতোটা ভালোবাসতো। ওদের একসাথে কাটানো প্রতিটি স্মৃতির সাক্ষী আমি নিজেই। ভাগ্য এরকম নিষ্ঠুরতা না দেখালেও পারতো।

    ________________________

    নিজ বাড়িতে চিন্তিত তৃষ্ণা একাকী বসে রয়েছে তৃষ্ণা। তার নয়নতারাকে এখনও খুঁজে চলছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার আরহানের বাড়িতেও খোঁজ করেছে। কিন্তু টাইট সিকিউরিটির দরুন পারেনি। এখন তৃষ্ণার আরো বেশি সন্দেহ হচ্ছে ঐ বাড়ি নিয়ে। হয়তো সেখানেই আছে তার নয়নতারা।

    ভালো লাগছে না তৃষ্ণার কিছু। এতো অপূর্ণতা নিয়ে একটা মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে?

    কিছুক্ষণ বাদে তৃষ্ণার নম্বরে তার একটা লোকের কল এলো। রিসিভ করতেই বললো,“বস! আপনি ঠিকই ধরেছেন। ম্যাম ওখানেই আছে। কিন্তু…”

    “কি?”

    “ঐ বাড়িতে যাওয়া অসম্ভব।”

    তৃষ্ণা কিছু একটা ভাবলো। তৃষ্ণাকে চুপ থাকতে দেখে, ফোনের ওপাশের ব্যক্তি বলে উঠলো,“এবার কি করবো স্যার?”

    “অনেক কিছুই করবো। আমরা যেতে পারবো না, তবে কাউকে বাড়ি থেকে বের করা অতোটাও কঠিন হবে না।”

    কথাটা বলে বাঁকা হাসলো তৃষ্ণা। খুব জলদি তার নয়নতারাকে পেয়ে যাবে।

    কল কেটে দিয়ে বললো,“আপনাকে আমি শুধু পছন্দ করি না, শুধু মায়ায় জড়াইনি। ভালোবেসেছি আপনাকে। অন্যরকম ভালোবেসেছি। যেই ভালোবাসায়, আমি দৃষ্টিহীন হয়ে গেলেও, চোখের ক্যানভাসে আপনি থাকবেন। আমার হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলেও, হৃদযন্ত্রে আপনারই বসত থাকবে। যেই ভালোবাসায়, এই তৃষ্ণা নিঃস্ব হয়ে গেলেও, তার একমাত্র সম্বলে, তার কল্পনায় আপনার অস্তিত্ব প্রতি ক্ষণে অনুভূত হবে। আমি আপনাকে সেই রকম ভালোবাসি নয়নতারা।”

    তৃষ্ণা থেমে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ রইলো। মন থেকে যা চেয়েছে তৃষ্ণা, তা কি আদৌ পেয়েছে? হঠাৎ অস্থির হয়ে গেলো। কাতর কণ্ঠস্বরে শুধালো,“আপনাকে পাবো তো? আমি নিজের পছন্দের সবকিছু ছিনিয়ে নিতে জানি। বাই হুক অর বাই ক্রুক। কিন্তু…. আমি আপনাকে নিয়ে কোনো গেইম খেলতে পারবো না।”

    _________________

    গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে আমি নিজ রুমে বসে আছি। ভাবনাটা অবশ্যই আরহানকে ঘিরেই। অবশেষে উনার দুদিন পূর্ণ হলো। আজ আসবেন। আমি অভিমান নিয়েই উনার অপেক্ষায় বসে আছি। এতো অভিমান কখনো কারো প্রতি আসেনি আমার।

    ফোনে আচমকা মেসেজের শব্দ একটু ঘাবড়ে গেলাম। হাতে নিয়ে দেখি আরহানের মেসেজ,“কি করো?”

    আমি লিখে দিলাম,“কিছু না।”

    ওপাশ থেকে আবারও মেসেজ এলো,“মন খারাপ?”

    “জানিনা..”

    “রাগ করেছো?”

    “না…”

    “অভিমান?”

    “হুঁ”

    আরহান খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবারও মেসেজ পাঠালেন,“তবে তো হয়েই গেলো।”

    ভ্রু কুচকে ফেললাম। কী হলো আবার? জিজ্ঞেস করলাম,“কী?”

    “ভালোবাসা….”

    “কিভাবে?”

    “ভালো না বাসলে অভিমান আসে না।”

    মেসেজটা দেখার সাথে সাথেই আমার হৃদস্পন্দন পরপর কয়েকটা মিস করে আবারও অস্বাভাবিক হারে বাড়তে লাগলো। কেমন যেনো লাগছে আমার! আমি গভীর ভাবনায় পড়ে গেলাম। সত্যি কি তাই? আরহানের শেষ মেসেজের আর কোনো প্রতিউত্তর করলাম না। ফোন রেখে দিলাম। ব্যালকনিতে গিয়ে এই গোধূলি বেলাটা উপভোগ করতে চাচ্ছি। কিন্তু আরহানের শেষ কথাটায় আর এদিকে মন দিতে পারছি না। আমি কি সত্যি উনাকে ভালো বেসে ফেলেছি?

    অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না বিধায়,নিশার রুমে চলে এলাম।

    ডোর নক করতেই নিশা খুলে দিলো। মিষ্টি হেসে বললো,“আরে ভাবি তুমি! আমি মাত্রই তোমার কাছে যাচ্ছিলাম। ভালো হলো এসেছো। ভেতরে এসো।”

    আমি এগিয়ে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ মনে হলো, আজ নিশার সাথে সরাসরি এই বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন।

    নিশা আমার পাশে বসতেই জিজ্ঞেস করলাম,“ভালোবাসার মানে কী তোমার কাছে নিশা?”

    আমার হুট করে এভাবে করা প্রশ্নে নিশা খানিকটা বিস্মিত হলো।

    “হঠাৎ এটা জিজ্ঞেস করছো যে!”

    “আহা! বলো না!”

    “আচ্ছা। বলছি।”

    “হুঁ”

    “প্রথম দেখায় যদি কাউকে দেখে জানার আগ্রহ জন্মায়, এরপর তার সম্পর্কে এ টু জেড জেনে যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাস নামক শব্দগুলো চলে আসে, ধীরে ধীরে তার প্রতি মায়া কাজ করা শুরু করে, তাকে নিজের কাছাকাছি দেখলে শান্তি অনুভূত হয়ে, অন্য কারো পাশে দেখলে বুকে যন্ত্রণা হয়, সারাজীবন নিজের করে না পেলেও চোখের সামনে দেখার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, তবে এই অনুভূতি গুলোর নামই হচ্ছে ভালোবাসা।”

    ভালোবাসা! তাই কি! নিশা এখন ভালোবাসার গভীর খেয়ালে ডুবে আছে। হয়তো ভাবছে তার ভালোবাসার মানুষটির ভালোবাসা নিয়েই। জিজ্ঞেস করে বসলাম,“কাউকে ভালোবেসেছো?”

    বেখেয়ালি নিশা ভুলে বলে ফেলে, “হ্যাঁ। ভীষণ ভালো বেসেছি।”

    পরক্ষণেই নিশার খেয়ালে এলো, ও কি বলেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করলো,“ইয়ে মানে না।”

    আমি হাসলাম। নিশার চিবুকে হাত রেখে বললাম,“রুদ্র ভাইয়াকে কতটা ভালোবাসো?”

    নিশা চমকালো। মুখশ্রীতেই ওর চমকের রেশ ফুটে উঠেছে। আমি আবারও মুচকি হাসলাম।

    নিশা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,“তাকে ভালোবাসতে বাসতে দুনিয়া থমকে যাবে, তবুও তৃষ্ণা মিটবে না।”

    ________________________

    অস্থির হয়ে নিজের রুমে পায়চারি করছি। আরহানকে কল দিচ্ছি, রিসিভ করছেন না। একটু আগেই আমার নম্বরে মেসেজ এলো,“আরহানকে বাঁচাতে চাইলে ***ঠিকানায় চলে আসুন।”

    জাস্ট এই একটা মেসেজ। এই একটা মেসেজে আমার শ্বাস আটকে ফেলতে সক্ষম। অনেকক্ষণ ধরে আরহানের নম্বরে ট্রাই করেই যাচ্ছি।

    পুনরায় সেই নম্বর থেকে আবারও মেসেজ এলো,“আরহানকে মেরে দেবো?”

    সাথে সাথে রিপ্লাই করলাম,“নাহ্! আসছি আমি।”

    আবারো মেসেজ এলো,“একা আসবেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাঁচ মিনিট দূরত্বে আমার গাড়ি আছে, ওটাতে চলে আসবেন। আর খবরদার, কাউকে জানালে কিন্তু আরহান যাবে…..”

    মাথায় আর কোনো কিছু না এনে এভাবেই বেরিয়ে পড়লাম। এতোটা অস্থির কখনো লাগেনি আমার।

    বেরোনোর সময় মা, নিশা দুজনেই নিজের রুমে থাকায় আমাকে কেউ দেখেনি। তবে বিপত্তি বাঁধলো গেইটের কাছে এসে। গার্ড আমাকে বের হতেই দিচ্ছে না। সামনের একজন বললো,“ম্যাম! স্যার আপনাকে বাহিরে যেতে না করেছেন। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে, আমাদের বলুন।”

    এদের কিভাবে বলি! যেতে হবে আমার। আমার আরহান বিপদে আছে

    আরহানের যদি কিছু হয়ে যায়! কম্পিত কন্ঠে বললাম,“আ’আমাকে যেতে দিন। আরহান ন’নিজেই যেতে বলেছে।”

    তাও আমাকে যেতে দিচ্ছে না উনারা। প্রচুর বিরক্তি নিয়ে উনাদের চাকরির হুমকি দিয়ে বের হলাম। বের হতে অবশ্য অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমার মূল লক্ষ্য আরহান।

    অতিরিক্ত টেনশনে থাকায় আমার মাথায় পেইন শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছুদূর যেতেই, ফাঁকা রাস্তায় একটা ব্ল্যাক মাইক্রো দেখে এগিয়ে গেলাম। আমি যেতেই দরজা খুলে গেলো। পেছনে একজন বসা আছে, আমাকে ইশারা করলো তার পাশে বসতে। এগিয়ে গিয়ে সেখানে বসে পাশের লোকটিকে অবলোকন করে নিলাম। সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরা, মুখ গ্লাস-মাস্ক দিয়ে ঢাকা। আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই লোকটি মাস্ক খুললো।

    অস্থির আমি, আরহানের চিন্তায় অবস্থা নাজেহাল হয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম,“আরহান কোথায় আছে?”

    তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখি আরহান কল দিয়েছেন। কপাল কুঁচকে এলো। রিসিভ করতেই পাশের লোকটি ফোন নিয়ে লাউডস্পিকারে দিলো।

    আরহানের চিন্তিত কণ্ঠস্বরে শোনা গেলো,“কি হয়েছে? এতো কল দিয়েছো যে? আমি ফোনের কাছে ছিলাম না তখন। তুমি ঠিক আছো তো?”

    পাশের লোকটি “এখন থেকে ঠিক থাকবে”—বলে কল কেটে দিয়ে ফোন সুইচ অফ করে দিলো।

    আমি বড়বড় চোখ করে এই লোকটির দিকে তাকালাম। হালকা চেনা চেনা ঠেকলো। ততক্ষণে গাড়ি চলা শুরু হয়ে গিয়েছে।

    রেগে চিল্লিয়ে বললাম,”কী হচ্ছে এটা?”

    লোকটি বাঁকা হেসে বললো,“ধোঁকা…”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৭)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৭)

    এক্সাম শেষ হয়েছে আজ বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো। মনটা এই দিন গুলোতে প্রায়শই খারাপ যেতো। চেনা মানুষজনের এমন হুট করে পরিবর্তন যে কারো বুকে ঝড় তুলতে সক্ষম। খুব খারাপ একটা অনুভূতি আমাকে অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করছে। যাদেরকে নিজের ভেবে এসেছিলাম, দুজনের কেউ আমার কাছে নেই এখন। একজন নিরুদ্দেশ তো অন্যজন আমার মুখ অবধি দেখতে নারাজ।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হয়তো ভার্সিটি লাইফ শেষ হবার আগেই বন্ধু বিচ্ছেদের স্বাদ নেওয়াটা আমার ভাগ্যেই ছিল।

    কিছুক্ষণ ওই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম এক হাসির রেখার দেখা মিললো। এটা অবশ্যই আরহান এর জন্যই।

    আরহান বলেছিলেন না, ‘ভালোবাসি’ না বলেই ভালোবাসার উপলব্ধি করাবেন! হ্যাঁ! ভালোবাসার সহস্র রং চিনিয়েছেন। উনি যখন হাসেন, ইচ্ছে করে পুরো দুনিয়া ভুলে শুধু এই একটি মানুষের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। আরহান আমাকে নিজ ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া শিখিয়েছেন। সব ভুলে আমি উনার দিকেই তাকিয়ে থাকি। এ দেখার মধ্যে আলাদা এক শান্তি আছে। ভালো লাগা আছে।

    আরহান আমার সাথে রেগে কথা বলেননি কখনো। রাগ দেখাননি।

    ইদানিং আমার কি যেন হয়েছে, রাতে ঘুম আসে না। নির্ঘুম আমি সারাটা রাত ভরে আরহানকে দেখতে থাকি। আরহানের কাছাকাছি এলেই আমার হৃদস্পন্দনগুলো বেড়ে যায়। অন্যরকম কিছু একটা অনুভূত হয়। নাম না জানা একটা টান কাজ করে। আরহানের সামান্য প্রশংসাতেই লজ্জায় আমার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। আরহানকে খানিকক্ষণ না দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাঁসফাঁস করে। দুদিন ধরে শহরের বাইরে আছেন আরহান। আমি আরহানকে দেখতে পাইনি এই দুদিন। তবে যেনো মনে হচ্ছে, কতো জনম উনাকে দেখে চক্ষু তৃষ্ণা মেটাতে পারছি না।

    “উহুম উহুম! ভাবি বুঝি ভাইয়ার বিরহে আকাশের তারা গুনছে?”

    হালকা কেশে নিশা এই কথাটা বলে উঠলো। এতোক্ষণে খেয়াল করলাম, আমার পাশেই নিশা দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কতক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তা জানা নেই আমার। খানিকটা অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললাম, “এমা! তুমি! কখন এলে?”

    নিশা হালকা হেসে বললো,“যখন তুমি তারা গুনতে ব্যস্ত ছিলে।”

    লজ্জা লাগছে ভীষন। মেয়েটা কি না কি ভাবলো!

    “ভাবি শোনো না!”

    “হুঁ! বলো।”

    “শাড়ি পরিয়ে দেবে? আমি না! শাড়ি পরতে জানিনা।”

    তীক্ষ্ণ নজরে তাকালাম নিশার পানে। হঠাৎ মাথায় শাড়ি পরার ভূত কোত্থেকে উদয় হলো এর? আমার এরূপ চাহনি দেখে নিশা মেকি হেসে বললো,“এভাবে তাকাও কেনো ভাবি? ভয় লাগে।”

    নিশার ছেলেমানুষী কথা বার্তায় আমিও হেসে ফেললাম।

    ___________________________

    “মা! এসব কি?”

    হাতের ডায়েরিটা দীপ্তি ওর মায়ের দিকে এগিয়ে এই কথাটা বললো। ওর মা একবার ডায়েরির দিকে তাকালো। এরপর আবার দীপ্তির দিকে।

    গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,“তোকে এই শিক্ষা দিইনি আমি। কাউকে না বলে তার জিনিস ধরাটা তোকে শেখাইনি।”

    “দেখো মা! মানছি আমি এটা দেখে অন্যায় করেছি। সেজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু এখন তোমাকে এর উত্তর দিতে হবে। বলো তুমি। এটা কি?”

    দীপ্তির মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ আর কি করে লুকোবে? সত্য যে সবটা সামনেই আছে। মৃদু কন্ঠে বললো, “যা জেনেছিস, সবটাই সত্যি।”

    “এসব লুকিয়ে এসেছো কেনো মা? কাউকে বলোনি কেনো?”

    “দুনিয়া অনেক কঠিন। আর দুনিয়ার মানুষ নিষ্ঠুর, পাষাণ। এরা তোর ক্ষততে নুন আর সুখে নজর খুব ভালো করে লাগাতে জানে। কখনো দুর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। এরা তোকে ভেঙ্গে চূরে শেষ করে দেবে। আবার তোর আনন্দময় জীবনও এদের সামনে প্রকাশ করবি না। এদের হিংসে হয়। মারাত্মক হিংসে। অতি সহজেই তোর সুখময় জীবনকে ক্ষণস্থায়ী করে দেবে। এদের জন্য শুধু থাকবে কৃত্রিম হাসি। যেটা তোর ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। এজন্যই মূলত কিছু জিনিষ অপ্রকাশিত থাকাই শ্রেয়।”

    “তাই বলে তুমি আমাকে বলোনি কেনো মা?”

    দীপ্তির প্রশ্নে তার মা মৃদু হেসে বললো,“কী হতো বলে? পুরনো ঘা তাজা বৈ আর কী’ই বা হতো? যা পেছনে ফেলে এসেছি, তা পেছনেই থাক না! কেনো সেগুলো মনে করে কষ্ট পাবো?”

    মায়ের কথায় দীপ্তি দমে গেলো। পুনরায় একটা কথা মস্তিষ্কে আসতেই বলে ফেললো,“মা! আপু কোথায়?”

    “ওর মামার কাছেই রেখে এসেছিলাম। আমার ভাই ওর খেয়াল রাখায় কোনো রকমের অপূর্ণতা রাখবে না।”

    __________________________

    শাড়ি পরিহিত নিশা নিচে নামতেই ড্রইং রুমে রুদ্রকে বসে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে হাসলো। নিশা জানতো রুদ্র আসবে, এজন্যই শাড়ি পরেছে। লজ্জা মাখা মুখশ্রী নিয়ে নিশা এগিয়ে গেলো রুদ্রের দিকে।

    সামনে কারো উপস্থিতির আভাস পেয়ে রুদ্র চোখ তুলে তাকালো। একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। সেদিনের কথা ভীষণভাবে মনে পড়লো রুদ্রের। নিশাকে পাবার যেই এক চিলতে আশার আলো দেখেছিলো, তা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেলো। নিশা যে অন্য কাউকে ভালোবাসে!

    কোনো কথা না বলেই, ফোন কানে নিয়ে উঠে চলে গেলো। এমন ভাব ধরলো যেনো এখানে রুদ্র ব্যতীত অন্য কেউ ছিলো না।

    হাস্যোজ্জ্বল নিশার মুখ নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। চোখ দুটো ছলছল করছে নিশার। এখানে আর একপলক না থেকে দৌঁড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। যার জন্য শাড়ি পরলো, সে যে ফিরেও তাকালো না।

    রাতের খাবার খেতে নিশা যখন নিচের নামলো তখন ওর ফোলা মুখশ্রী দেখেই বুঝে ফেললাম ও কেঁদেছে। কিন্তু কেনো, তা বুঝতে পারলাম না।

    নিশা এসে আমার পাশের চেয়ার টেনে বসলো। ধীরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,“কি হয়েছে? চোখ মুখ ফোলা কেনো?”

    অপ্রস্তুত নিশা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,“আসলে ভাবি, অবেলায় ঘুমিয়েছিলাম তো! এজন্য।”

    নিশার কথা বিশ্বাসযোগ্য ছিলো না। তবুও আর পাল্টা প্রশ্ন করলাম না।

    আরহানের কথা খুব মনে পড়ছে। খাবার না খেয়ে বার বার নেড়ে যাচ্ছি। খাচ্ছি কম, আরহানকে ভাবছি বেশি। আমাকে এভাবে দেখে মা বললেন, “কিরে মা! খাচ্ছিস না কেনো? কোনো সমস্যা?”

    বেশ গভীর ভাবনায় থাকার দরুন এভাবে ডাকায় চকিতে তাকালাম। মেকি হাসি দিয়ে বললাম,“না মা। তেমন কিছু না। খাচ্ছি।”

    “কি খাচ্ছিস দেখাই যাচ্ছে। নে, এদিকে আয়।”

    পাশের চেয়ারের দিকে ইশারা করে মা এই কথাটি আমাকে বললেন। এগিয়ে গিয়ে সেদিকে বসলাম। মা হালকা হেসে, খাবার মেখে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন,“আমি যদি খাইয়ে দিতে চাই, তবে কি আমার মেয়েটা খাবে?”

    আমি হাসলাম। আরহান একদম উনার মায়ের মতো হয়েছে। এভাবে কথা বলা তো আরহান উনার মায়ের কাছেই শিখেছে।

    পাশ থেকে নিশাও ওর মন খারাপের রেশ সব পাশে রেখে বলে উঠলো,“আজ কেউ নেই বলে, নিজ হাতে খেতে হয়।”

    আমি আর মা নিশার এমন অভিমান মিশ্রিত কথায় হেসে ফেললাম। মা হাসিমুখে বললেন,“তুইও এদিকে আয়।”

    নিশাও এলো। এভাবেই মায়ের হাতে খেয়ে যাচ্ছি। না পাওয়া ইচ্ছেগুলো এভাবেই পূরণ হচ্ছে। মানুষের কোনো ইচ্ছে কখনো অপূর্ণ থাকে না। হয়তো তা আজ পূর্ণতা পাবে, কিংবা শতাব্দী বাদে। হয়তো সেটা বাস্তবে পাবে, কিংবা কল্পনায়। হয়তো সেটা নিজেকে ঘিরে পাবে, কিংবা সামনের মানুষটির মধ্যে নিজেকে দেখে।

    ______________________

    আজ আবারও এই রুমটাতে একা থাকতে হবে। উনার স্মেল আছে, তবে মানুষটাই যে এই রুমে নেই। একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম বেডের পাশে। সন্ধ্যায় নিশাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার দরুন রুমটা অগোছালো হয়ে আছে। গোছাতে গোছাতেই আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকাতেই ঠোঁটে হাসি চলে এলো।

    এগিয়ে গিয়ে রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে আরহান বললেন,“মিস ইউ শুকতারা…”

    একটা বাক্য! হ্যাঁ! এই একটা বাক্য কারো হৃদপিন্ডের স্পন্দন গতি বাড়াতে সক্ষম। কাতর কণ্ঠস্বর আরহানের। এভাবে কেউ বলে?

    আমাকে চুপ থাকতে দেখে পুনরায় আরহান বললেন,“আচ্ছা সেসব বাদ দাও। খেয়েছো?”

    “হুঁ, আপনি?”

    “হ্যাঁ। কি করছিলে এখন?”

    “এইতো কিছুনা।”

    “ঘুমোবে না? রাত হয়েছে তো অনেক।”

    আরহানকে এবার কি করে বলবো? উনি না থাকলে শান্তিতে দুচোখ এক করতে পারিনা। তবুও বললাম,“হুঁ, ঘুমোবো।”

    “আমার ফিরতে আরো দুদিন লাগবে।”

    রেগে গেলাম আমি আরহানের এই একটি কথায়। উনার তো কাল ফেরার কথা ছিলো। আরো দুদিন মানে?

    ধারালো কন্ঠে বললাম,“সেখানেই থেকে যান। আরো তিনটে বিয়ে করে নিন না! আসতে হবে না আপনার।”

    আরহান হাসলেন। শব্দ করেই হাসলেন। আমি তীব্র রাগে কল কেটে দিলাম। একেতো রাগিয়ে দিলেন, তার উপর হাসছেন!

    কিছুক্ষণ বাদে আরহানের নম্বর থেকে কল এলো। কেটে দিলাম আমি। আবারো এলো। এবারও কেটে দিলাম। তৃতীয় বারের মাথায় কল এলে রিসিভ করে কানে তুলতেই, ওপাশ থেকে আরহান বললেন,“রাগ করবে, রাগ ভাঙ্গাবো। বকবে তুমি? চুপচাপ বকা খাবো। তবুও দূরে যাবার কথা চিন্তা করবে না। এখন আমি কাছে নেই তোমার, চাইলেও নিজের কাছে বেঁধে রাখতে অক্ষম আমি। তাই কল কাটার কথা ভুলেও ভাববে না। বাড়ি ফিরলে না হয় মেরো, আটকাবো না।”

    পুরো কথাটা গম্ভীর ভাবে বললেও শেষ উক্তিটি হেসেই বলেছেন।

    “আচ্ছা এবার ঘুমাও।”

    “হুঁ, আপনিও।”

    চলবে…