Tag: ধারাবাহিক গল্প

  • লিভিং রুমে স্নেহা (শেষ পর্ব)

    লিভিং রুমে স্নেহা (শেষ পর্ব)

    ফুয়াদের ব্যবসায়িক কাজে বিদেশে যেতে হবে এ সপ্তাহে৷ উপায়ান্তর না দেখে বন্ধু ফয়সালকে কল দিয়ে বললো – দোস্ত, যে ভাবেই হোক আতর আলীকে আনার ব্যাবস্থা কর৷ আমি আর পারছি না৷

    হসপিটালে থাকা কালীন শারীরিক অসুস্থতা ছাড়া স্নেহার সাথে ভয় জনিত আর কোনো ঘটনাই ঘটেনি৷ চার পাঁচটা দিন বেশ ভালোই কাটিয়েছে স্নেহা৷ এ চার পাঁচ দিনে স্নেহা পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে উঠেছে৷ স্নেহাকে বাসায় নিয়ে আসা হোলো৷

    এদিকে ফুয়াদের কথা অনুযায়ী সেই অজপাড়া গাঁও কোদাল কান্দি থেকে আতর আলীকে নিয়ে আসলো ফয়সাল৷ আতর আলীর কাঁধে সবসময় একটা কোদাল থাকে৷ আর সে পরে বড় এক আলখাল্লা৷ সে আলখাল্লার পকেটে থাকে কয়েক রকমের সুগন্ধি আতর৷ এই কারনেই তার গ্রামের নাম কোদাল কান্দি। আর তার নাম আতর আলী৷ সে অনেক মানুষের অনেক বড় বড় সমস্যার সমাধান করেছে৷ তার গ্রামে তার বেশ সুনাম।

    আতর আলী এসেই বাসার সামনে কোদাল দিয়ে বড় একটা গর্ত করলো। স্নেহা হসপিটাল থেকে এসেই বাসার সামনে গর্ত দেখে খুব রাগ হয়ে গেলো৷ রীতিমত চিল্লাচিল্লি শুরু করলো।

    আতর আলী বললো – মনু, ও মনু, চিল্লাইয়া কাম নাইককা৷ হগলডিরে গর্তে ভরমু মুই৷ বহুত কয়ডি ভিত্রে বইয়া রইছে আফনের অফেক্কায়৷ আহেন আহেন৷ আতর আলীর লগে বাটফারি? ছলবো না এসব বাটফারি৷ এত্ত সাহস কারোর নাইক্কা৷

    আতর আলীর কথার ধরন স্নেহার মোটেই পছন্দ হলোনা৷ সে ফুয়াদকে বললো, এই লোকটাকে এক্ষুনি ঘর থেকে বের করো৷ আমার গায়ে ভীষণ জ্বালা করছে৷

    গায়ে জ্বালা করার কারন কিন্তু অন্য৷ আতর আলী এসেছে দুদিন হয়েছে৷ স্নেহা তা জানেনা৷ এরই মধ্যে আতরয়ালী তার কাজ কিছুটা শুরু করে দিয়েছে৷

    স্নেহার খুব কষ্ট হচ্ছে৷ শ্বাস নিতে পারছে না৷ বার বার পানি খাচ্ছে৷ আবার বমিও করছে৷ সমস্ত শরীর তার জ্বালা করছে৷ সে রীতিমতো ছটফট করছে। সে ঘুমাতে চাইছে, কিন্তু ঘুমাতে পারছে না৷ ডাক্তার বলেছে স্নেহাকে কোনো রকম টেনশন দেয়া যাবে না৷ সে অসম্ভব রকম দূর্বল হয়ে গেছে৷

    ফুয়াদের বোন ফারা স্নেহাকে এবং ফুয়াদকে ভীষণ আদর করে৷ স্নেহা ফারাকে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করলো, আপা আমার গা এমন জ্বালা করছে কেনো? কখনও এমনটা হয়নি আমার৷ আপা ওই লোকটা কে? ওই লোকটা আমাকে মেরে ফেলবে৷

    স্নেহার কষ্ট তার কোনো ভাবেই সহ্য হচ্ছে না৷ সে বললো, স্নেহা তুমি ঘুমাও৷ আমি তোমার পাশেই আছি৷ একটুও নড়বো না৷ কিছুক্ষনের মধ্যে স্নেহা ঘুমিয়ে পড়লো৷ বেলা তখন তিনটা৷

    এদিকে আতর আলী সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করছে। স্নেহাদের বাসার কয়েকটা বাসা পরে একটা কবস্থান আছে৷ সেখানে ৭/৮ জনের কবর আছে৷ সেটা কারোর পারিবারিক কবরস্থান৷ আগে থেকে তাদের অনুরোধ করে সে কবরস্থানে একটা আসন তৈরী করা হলো আতর আলীর জন্য৷ আজ রাতে আতর আলী স্নেহার কাছ থেকে সব কথা বের করবে৷ তারপর সারারাত ওই কবরস্থানে গিয়ে বাকী কাজ করবে৷ তবে গত দু-দিনও আতর আলী ওই কবরস্থানেই রাত কাটিয়েছে৷ এমনিতেই আতর আলী বেশীর ভাগ সময় কবরস্থানেই থাকে৷

    আতর আলী বললো, মগ্রিবের আযান ফড়নের লগে লগে আফনেরা হগলতে মেডামরে একা থুইয়া নীচের ছুডো ঘরে গিয়া বইবেন৷ বাকী কাম আমি সামলামু৷ আর ফিরিজের মইধ্যে কিছু মিষ্টি আইননা থুইয়েন৷ আতর আলীর কথা অনুযায়ী তিনটা ছাগল আর ৪০ গজ লাল শালু কাপড় কিনে গর্তে বিছিয়ে রাখা হয়েছে৷

    ফারা বললো, হুজুর স্নেহার শরীরের কোন ক্ষতি হবে না তো?

    আতর আলী ফারার গায়ে আতর ছিটিয়ে দিয়ে বললো, হোনেন। মনে করেন মেডাম আমার নিজে মাইয়ার লাহান৷ কোনো চিন্তা কইরেন না৷

    মাগ্রীবের আযানের সঙ্গে সঙ্গে আতর আলীর কথা অনুযায়ী সবাই গেস্ট রুমে চলে গেলো৷ দোয়া কালাম পড়ছে৷ কিন্তু রুবিনা মেডামের মায়ায় পড়ে সে রুমেই চুপ করে এক কোনায় বসে রইলো৷ আর চুপি চুপি দেখছে স্নেহা কি কি করছে৷

    স্নেহার ঘুম ভাঙলো৷ সে কার সাথে যেন কথা বলছিলো৷ তারপর উঠে সে ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ একটা লাল শাড়ী আগে থেকেই আতর আলীর কথা অনুযায়ী রুমের চেয়ারে রাখা ছিলো৷ স্নেহা সেই শাড়ী পরলো৷ গুনগুন করে গান গাইছে৷ আর কার সাথে যেন ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে খুব সুন্দর করে সাজলো৷ এদিকে মেডামের এসব কান্ড দেখে ভয়ে রুবিনা কাঁপছে৷ স্নেহা আস্তে করে দরজা খুলতেই পেছন ফিরে হাতটাকে লম্বা করে চিপায় রুবিনাকে মাথার উপর একটা লাঠি দিয়ে বাড়ি দিয়ে নীচে লিভিং রুমের দিকে গেলো৷ ঢুকেই সে দেখলো আতর আলী লাল পাগড়ী পরে সোফায় পা তুলে বসে আছে৷ স্নেহা লিভিং রুমে ঢুকতেই আতর আলী তার গায়ে আতর ছিটিয়ে বললো, আমার সামনে এইখানে বস৷ স্নেহা চুপচাপ বসে পড়লো৷

    এবার আতর আলী বললো – তুই কে?

    স্নেহা কিছু বলে না৷

    আতর আলী কোদাল দিয়ে ফ্লোরে একটা কোঁপের মতো দিতেই স্নেহা বলে উঠলো – আমি রাজকুমারী লুইয়ান।

    এখানে কি করিস তুই?

    আমি আমার প্রিয়তম জায়ানকে উদ্ধার করতে এসেছি।

    কিভাবে উদ্ধার করবি তুই? এখানে কোথায় পাবি তুই তোর জায়ানকে?

    স্নেহা অনেক চেষ্টা করছে মনে করতে৷ কিন্তু কোনো ভাবেই পারছে না৷ সে হাউ মাউ কারে কাঁদছে।

    আতর আলী আবারও আতর ছিটালো৷

    এবার স্নেহা চিৎকার করে বলতে শুরু করলো, আমি তার নাম আর বলবো না৷ তার নাম বললে আমার পিতা তাকে মেরে ফেলবে৷ আমি আগে আমার পিতাকে খুন করতে চাই৷ আপনি আমার পিতাকে খুন করেন৷ খুন করেন৷ বলে স্নেহা অজ্ঞান হয়ে পড়লো৷

    আতর আলী আতর ছিটিয়েও জ্ঞান ফেরাতে পারলো না৷ ফুয়াদকে ডাকলো৷

    ফুয়াদ আর ফারা এসে স্নেহার মাথায় পানি দিলো৷ আধ ঘন্টার মধ্যে স্নেহার জ্ঞান ফিরলো৷

    আতর আলী আবার আতর ছিটালো খুব ভালো করে৷ আর চুপ করে বসে দেখতে লাগলো৷ ফুয়াদ আর ফারাও একটু দূরে বসে দেখতে লাগলো।

    লিভিং রুমের এক কর্ণারে ওই ডেকোরেশন পিস গুলো সাজানো ছিলো৷ স্নেহা আস্তে করে গিয়ে কুয়ার মুখের সিন্দুকের ঢাকনা খুলে দিলো৷

    এবার স্নেহা বলতে শুরু করলো, ঘরে মেহমান এসেছে৷ মিষ্টি কই? মিষ্টি আনো। কেউ কিছু দেখতে পেলো না৷ শুধু দেখলো, লিভিং রুমের টেবিলে একে একে মিষ্টি সাজানো হয়ে গেলো৷ একে একে পাঁচ কেজি মিষ্টি শেষও হয়ে গেলো৷ কিন্তু শুধু স্নেহাকে সবাই খেতে দেখেছে। অন্য মিষ্টি কে খেলো, কিভাবে খেলো কেউ কিছুই বুঝে উঠতে পারলো না৷

    এবার স্নেহা গান শুরু করলো, একটা ইংরেজি গান। আর খুব হাঁসছে৷ এ ভাবে বেশ কিছুক্ষন সময় পার হয়ে গেলো৷
    আতর আলীর এত বছরের জীবনে এমন ঘটনা কখনোও দেখেনি৷

    এশার আযান পড়ছে। স্নেহা কান্না শুরু করলো৷ খুব কাঁদছে৷

    আতর আলী আতর ছিটিয়ে এবার স্নেহাকে সে আবার প্রশ্ন করলো, আমি যদি তোর বাপকে খুন করি তবে তুই খুশী হবি?

    লুইয়ান বললো, শুধু আমার বাপ নয়৷ যে আমার প্রিয়কে বন্ধী করেছে তাকে খুন করতে হবে৷

    আতর আলী বললো আচ্ছা করবো৷ তারপর তুই কি দিবি আমাকে?

    লুইয়ান বললো, তুই যা চাস তাই দেবো৷

    আতর আলী বললো, কিছু দিতে হবে না৷ শুধু এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাবি৷ আর কোনোদিন এ বাড়ীর আশপাশেও আসবি না৷

    লুইয়ান বললো – না, আমাকে আমার রাজ্যে পৌঁছে দিতে হবে৷

    আতর আলী বললো, এটা সম্ভব নয়৷

    লুইয়ান তখন বললো, আমাকে একটা নীরব জায়গায় রেখে আসতে পারবি?

    আতর আলী জবাব দিলো হ্যাঁ।

    এবার লুইয়ান বললো আমার বাপকে আমি খুন করবো৷

    আতর আলী বললো – না, আমি খুন করবো৷

    লুইয়ান বললো, এক কোপে খুন করতে পারবে?

    আতর আলী বললো, হ্যাঁ পারবো৷ পারবো৷ তোর সামনে এক কোপে খুন করবো৷

    আতর আলী স্নেহাকে নিয়ে তার বাসার সামনে যে গর্ত করেছে সে গর্তের সামনে নিয়ে গেলো। তারপর একটা ছাগলকে এনে কোদাল দিয়ে এক কোপে কেটে ফেললো৷

    এটা দেখে স্নেহা অজ্ঞান আবার৷ ফুয়াদ আর ফারা এসে স্নেহাকে ধরে রাখলো। আতর আলী বললো, মেডামরে এইখানেই রাহেন৷ হ্যেরে দেখতে দেন৷ হ্যেয় সব দেখতাছে৷

    তার পরপর বাকী দুইটা ছাগলকেও এক কোপে এক কোপে করে কেটে ফেললো কোদাল দিয়ে। চল্লিশ গজ লালশালু কাপড়ে পেঁচিয়ে তিনটা ছাগল নিয়ে ফয়সাল আতর আলীকে নিয়ে কবরস্থানের দিকে রওয়ানা হলো৷ সাথে নিয়ে গেলো গ্রীস থেকে নিয়ে আসা সে ডেকোরেশনের জিনিস গুলো।

    এদিকে কোনোভাবেই স্নেহার জ্ঞান ফিরছে না৷ খাদিজা বুয়া ফারা আর ফুয়াদ মিলে স্নেহাকে তার রুমে নিয়ে আসলো৷ এদিকে সবাই এসে দেখে রুবিনা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে৷ গাড়ী পাঠানো হলো ডাক্তারকে৷ ডাক্তার আসার পর স্নেহাকে কিছু চেকাপ করে বললো যত তাড়াতাড়ি সম্ভব স্নেহাকে নিয়ে যেনো বিদেশে চলে যায়৷ খাদিজা বুয়া রুবিনার মাথায় পানি ঢেলে তাকে জ্ঞান ফিরিয়ে আনলো৷

    ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী স্নেহার জ্ঞান ফিরে আসার আগেই ঘরের সব আলামত ঠিক করে ফেলা হলো। স্নেহার কাপড়ও বদলে দেয়া হলো।

    ঘন্টা খানেক পরে স্নেহার জ্ঞান ফিরলো৷

    জ্ঞান ফিরার পরে স্নেহা ফারাকে দেখে বললো, আপা আপনি কখন এলেন? ওমা ফুয়াদ তুমি আমাকে বলনি কেন যে আপা আসবেন৷ এই দু মাসে স্নেহার সাথে কি কি ঘটেছে তার কিছুই মনে নেই৷

    এক সপ্তাহের মধ্যে স্নেহাকে নিয়ে ফুয়াদ আর ফারা সিঙ্গাপুরে চলে গেলো। এই পুরো নয় মাস স্নেহা আর ফারা সিঙ্গাপুরেই ছিলো৷ ফুয়াদ আসা যাওয়ার মধ্যে ছিলো৷ এর মধ্যে ফুয়াদ গুলশানে একটা বাড়ী কিনে সাজিয়ে নিলো৷
    নয় মাস পর জমজ বাচ্চাদের নিয়ে স্নেহা দেশে ফিরলো৷ তাদের মধ্যে একটা ছেলে আর একটা মেয়ে। গুলশানের বাসার সামনে গাড়ী পার্ক করতে দেখে স্নেহা বললো, ফুয়াদ এ কার বাসায় তুমি আমাদের নিয়ে এলে?

    ফুয়াদ বললো, স্নেহা আমাকে তুমি একটা রাজকুমার আর রাজকুমারী উপহার দিয়েছো। আর আমি তোমায় এ বাড়ী উপহার দিলাম৷

    ফুয়াদের কথায় স্নেহার হঠাৎই মনে পড়লো। ফুয়াদ, আমার এক মেয়ের নাম রাখবো লুইয়ান। আর ছেলের নাম কিন্তু তুমি রাখবে৷ ফুয়াদ বললো, আচ্ছা, ছেলের নাম জায়ান৷

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৫)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৫)

    প্রবাস জীবনে সংসার আর পেশার দ্বন্দ্ব

    হাসি আনন্দের পরিচায়ক এবং সাংঘাতিক সংক্রামক, মোটামুটি সকলেই হাসতে পছন্দ করে। হাসি নিমিষে কষ্ট বিলীন করতে পারে,হোক তা সাময়িক আর আমার হাসি যদি অন্য কারো মুখে মুহূর্তের হাসি আনন্দ এঁকে দিতে পারে তবে সেই হাসি ধন্য। কার জীবনে কষ্ট নেই তবে কষ্টগুলো একান্তই নিজস্ব এবং কোনো কোনো কষ্টকে মস্তিষ্কের এমন কুঠোরে রেখে দিতে হয় যাতে নিজেই তার খোঁজ সহসা না পাওয়া যায়। কষ্টে বুক ফেটে কান্না আসবেই এবং কান্নাটাও স্বাভাবিক মানুষ মাত্রেই। কেউ না কাঁদতে পারলেই বুঝতে হবে তার মানবিক কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু কষ্ট দেখানোর বিষয় নয়, যারা বুঝবার তারা মুখের শব্দে বা চোখের চাহনিতে ঠিকই বুঝে নিবে। আর জীবনে বাবা মা ছাড়াও এমন আর একজন মানুষ থাকাই যথেষট, যাকে কিছুই খুলে বলতে হবে না। আবার যাকে খুলে বলতে হবে- কি কখন কিভাবে কোথা থেকে এবং কেমন করে সে কোনোদিনই কষ্টের পরিমাপ বুঝতে পারবে না, পাশে থাকা দূরের কথা। আমাদের দেশের মেয়েগুলি সাধারণত এক্ষেত্রে বড্ড অসহায় কারণ মেয়েরা জন্মগতভাবেই সংবেদনশীল তাই তারা অন্যের মানবিক চাহিদা নিজ থেকে যেঁচেই পূরণ করে। অন্যদিকে বেশীরভাগ ছেলেদের ছোট থেকেই তৈরী করা হয় শক্ত, আত্মনির্ভর অনেকটা স্বার্থচিন্তক হিসেবে। কারো কান্না দেখলে তাদের দূর্বল মনে হয় আর বেদনার ভাষা না জানলে কিভাবে করবে সমবেদনা পোষণ। আমি তাই বিদেশ বিভুঁই এ ক্রমশ কারণে বা অকারণে হাসতে শিখে গেলাম যা আমার বুকে কষ্টের পরিধি নিয়ত বাড়িয়েই চললো।

    আমি সংসার করছি মন বেঁধে আর প্রচন্ড সফলতার সাথে তাই প্রমার বাবা দুই পার্ট ইউ এস এম এল ই পাশ করলো। তারপর শুরু হলো ক্লিনিকাল পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি। তার ফলে কিছু নতুন মানুষের সাথে যোগাযোগও তৈরী হলো-অবশ্য মূলত প্রমার বাবারই। আমি ঘরের বৌ ই থেকে গেলাম। তবে সুযোগ পেলে প্রমার মুখে এক লোকমা ভাত দিয়ে বা কখনো কখনো রান্না পুড়িয়ে হলেও বইয়ে ডুবে থাকতে পছন্দ করতাম। প্রমার বাবার বন্ধু কে ৩৬ নিপু ভাই আর হ্যাপী ভাবীর সাথে আমাদের সখ্যতা হলো। হ্যাপী ভাবী নামের মর্যাদা রেখে আমার সাথে দুর্দান্ত হাসতে পারতেন। খুব মজার মজার রান্না করতেন তবে পোলাও এর মাঝে কেনো যেনো উনি বুট মিশিয়ে দিতেন তা ছিল আমার বোধ আর আকাঙ্খার বাইরে। মাঝে মাঝে সপ্তাহানতে আমরা বেড়াতে যেতাম দূরে কোনো সমুদ্রতীরে নিপু ভাই ভাবীদের সাথে। উনাদের এক ছেলে ছিল অনিক, খুব কথা বলতে পছন্দ করতো। আমরা বেড়াতে যাবার সময় পাশে বসলে করতো হাজারো প্রশ্ন। একবার বেড়াতে যাবার সময় প্রমা আমি ঠিক বুঝে উঠবার আগেই গাড়িতে বমি করে ফেললো। প্রমার কোনো দিনই মোশন সিকন্যাস ছিল না। ওই প্রথম সে গাড়িতে বমি করলো, আর দশ বৎসরের দুষ্টু অনিক তিন সাড়ে তিন বৎসরের প্রমাকে পুরোটা পথ এ বিষয়ে মজা করেই ত্যক্ত করলো। অনিকের মা হ্যাপী ভাবী যখন গর্ভবতী হলেন , আমাকে বড্ড জ্বালিয়েছেন। হঠাৎ করে বাসায় এসে বলতেন ভাবী আমি কিছু গন্ধ সহ্য করতে পারছি না। আপনি আমার জন্য একটু রান্না করেন তো- পেঁয়াজ রসুন হলুদ মরিচ ধনে জিরার গুঁড়া কিছু দিবেন না।আমি বললাম তো কি দিয়ে রাঁধব? উনি নির্ধিধায় বললেন “শুধু কাঁচা মরিচ”- হায়রে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আর অযাচিতভাবে মানুষকে আপন করে নেবার আমাদের অভ্যেস।

    কে ৩৬ এর প্রমার বাবার আর এক বন্ধু মোদাসসির ভাইদের বাসায়ও আমাদের যাতায়াত আর তাদের সাথে আন্তরিকতা ছিল প্রথম থেকেই। ভাই ভাবী ফর্সা আর তাই তাদের টুকটুকে ফর্সা আর সুন্দর এক ছেলে এক মেয়ে ছিল। আমরা অকল্যানডে মাত্রই বাসা নিয়েছি, বিদেশী পরিবেশে একেবারেই নতুন। আমাদের ছোট্ট টেলিভিশন চলছে, আমি রাত ন’টার দিকে প্রমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বসার রুমে আসতেই প্রমার বাবার উৎকন্ঠিত স্বর শুনতে পেলাম। পৃথিবী তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! আমি টিভির দিকে তাকিয়ে আমারও উৎকন্ঠা লুকোতে পারলাম না। আমি একবার টিভিতে খবর শুনছি,এসটেরয়েড এসে পৃথিবী ধ্বংস করছে, লোকজন সব আতঙ্কিত হয়ে রাস্তায় ছুটাছুটি করছে। আবার জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশ বুঝবার চেষ্টা করছি-শুনশান নিরবতা যেমনটি সবসময়। ওদিকে প্রমার বাবা মা বাবা ভাই বোনদের সাথে কথা শেষ করে মোদাসসির ভাইকে ফোন দিয়েছ। জানিস পৃথিবী যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? “ কি বলিস?জানি না তো! “ সহজ সরল মোদাসসির ভাই তখন বউ বাচ্চাদের নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করেই একেবারে গ্যারেজে অবস্থান নিলেন। অতঃপর প্রমার বাবা নিপু ভাইকে ফোন দিলো ভাগ্যিস। নিপু ভাই তড়িৎ টিভি দেখে বললেন “ তোরা কি পাগল হয়েছিস? এটাতো মুভি!” এখন পর্যন্ত বাচ্চারা সব একত্রিত হলে আমাদের নিয়ে বিশেষ করে মোদাসসির ভাইকে নিয়ে হাসাহাসি করে।

    আমার বাবা মায়ের সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো প্রতিবার বড়জোর মিনিট দুই তিন। উনারা আমাদের বিশেষ করে প্রমার খোঁজ নেন তারপর আমার পড়ালিখার! আমি তেমন সহজ করে জবাব দিতে পারি না। তখন ওভারসিজ ফোনের বিল ছিল কড়া আর মিনিট হিসেবে, কথা বিস্তারিত হতো না। বড়ভাই কাওসার আয়ারল্যান্ডের কর্ক শহরে কাজে নিয়োজিত, কথা হতো মাঝেমধ্যে। নিউজিল্যান্ডের ভিসা রক্ষার্থে ও আবার আসবার প্ল্যান করছে অকল্যানড। আমি একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম “তুই কি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?” ও বললো পারব, কত এবং কিসের জন্য? আমি খুলে বলতেই ভাইয়া সেদিনই এগারো শত ইউ এস ডলার পাঠিয়েছিল – আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ। আমি দুঃসাহসিক কাজটা করেই ফেললাম। তাড়াতাড়ি ইউ এস এম এল এ পার্ট ওয়ান এর ফর্ম ফিলাপ করলাম নইলে পরের মাসে পরীক্ষা দিতে পারতাম না। প্রমার বাবা সেদিন ঘরে ফিরলে সব বলতেই সে বললো” তুমি টাকা পেলে কোথথেকে?” তার গলার স্বরে সেদিন আমি হয়তো নিরাশার স্বাদ পেয়েছিলাম, বা হতে পারে সেটা আমার নিছক কল্পনা।

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৪)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৪)

    বিদেশে আমার প্রথম সংসার

    খেয়াল করেছি মানুষের যখন অল্পতেই তুষ্টি তখন কোন কিছু খুঁজে পেতে বা কিনতে বেগ পেতে হয় না। আমাদের ও অকল্যান্ডে বাসা খুঁজে পেতে মাত্র এক সপ্তাহান্ত লাগল। বাসার ন্যুনতম নির্নায়ক ছিল এটি অকল্যান্ড হাসপাতালের কাছাকাছি হতে হবে যার লাইব্ররীতে প্রমার বাবা পড়তে যেতে পারবে পায়ে হেঁটে এবং সহজেই। দুপুরে ইচ্ছা করলে খেতে বাসায় আসতে পারবে। অন্যটি হলো দুই বেডরুম থাকতে হবে। আমাদের বাসা খোঁজা, পাওয়া, গাড়ী কেনায় তারিক ভাইয়ের সহায়তা অপরিহার্য় ছিল আর তাছাড়াও জুবায়ের ভাই, সায়েক ভাই, বাপ্পী ভাই ,মোমিন, আসিফ আর ফারহান সব সময় সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিতো। পার্নেল অকল্যানডের ‌অন্যতম দামী সাবার্ব বা শহরতলী হলেও মালিকের আমাদের জীবনের গল্প এবং আমরা দু’জন সংগ্রামরত ডাক্তার হওয়াতে ফ্ল্যাটটি আমাদের দিতে একটুকুও কুন্ঠাবোধ করলেন না। উপরন্তু পরে টের পেলাম খুবই কম ভাড়ায় এবং সামান্য নিরাপত্তা চুক্তি স্বরুপ টাকাতে উনি আমাদের বাসাটা দিয়েছেন।

    উনার বয়স হয়তো পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে। উনি দু’ সপ্তাহ পর পর ভাড়া নিতে নিজে আসতেন এবং তখন কিছু খাবার দিলে নিতান্ত মজা করে খেতেন। পরের দিকে অবশ্য রাতের খাবারের সময় আসতেন, রাজনীতি, খেলা পড়াশুনা আত্মীয় স্বজন এসব নিয়ে অনেক অনেক গল্প হতো এবং রাতের খাবার দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করতাম। আমার মনে আছে আমার ডাল রান্না উনার সবথেকে পছন্দ ছিল আর ডেভিড বোয়ি উনার প্রিয় মিউজিশিয়ান ছিল। বন্ধুত্বের কারণেই হোক বা নিজ উদারতা থেকেই হোক উনি দুই বৎসরের উপরের সময় কখনো বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর কথা একবারও বলেননি। আমরা আগাগোড়াই মাত্র দুইশ বিশ ডলার প্রতি সপ্তাহে দিয়ে থেকেছি এবং পুরো নিরাপত্তা চুক্তির টাকা উনি বাড়ি ছাড়বার সময় ফেরত দিয়েছেন। প্রমার বাবার চাকুরী হওয়াতে উনি সাংঘাতিক রকম খুশী হয়েছিলেন।

    আমাদের বাসা নেয়া হলো, প্রয়োজনীয় সাংসারিক জিনিষপত্র কেনা হলো, পুরনো একটা গাড়ীও কেনা হলো- মনে আছে হোল্ডা সিভিক সাদা রঙ্গের। ঢাকা থেকে ড্রাইভিং একটু শিখে আসাতে লাভ হয়েছিল আর তাছাড়া সাহস বেশী থাকাতে অভ্যাস সামান্য ঝালাই করে নিয়েই লার্নার লাইসেন্স নিয়েই আমি ড্রাইভিং শুরু করে দিলাম অকল্যানডে। আমাদের বাসায় আমার বড়ভাইয়ের বন্ধুরা সবাই আর আমার বন্ধুরা প্রায়ই আসতো আর আমাদের নির্ভেজাল আনন্দে গল্প করে সময় কাটতো। আমি পরীক্ষামূলক বিভিন্নরকম রান্না করতাম, মিষ্টি বানাতাম মুড়ি ভাজতাম- ওরা সবাই খেয়ে প্রশংসা করতো আর আমার উৎসাহ আরও বাড়তো। প্রমার বাবা পড়াশুনা করার জন্যে সারাদিন লাইব্রেরি থাকা শুরু করলো আর তার পরেও গ্রুপ করে পড়াশুনা বিভিন্ন বাসায় ঘুরে ঘুরে যার মধ্যে আমাদের টার্ন ও আসতো। যারা আসতো দীনা আপা আর সিনিয়র জুবায়ের ভাই, বুলা ভাবী তাদের মধ্যে অন্যতম।

    আমি নিয়ম মাফিক প্রায় সপ্তাহেই ঝিমা খালার বাড়ী যেতাম, যদিও উনারা মাউনট এলবার্ট থাকতেন,আমাদের থেকে বেশ দূরে। প্রমা খালার ছেলে সানিমের সাথে খেলতে পছন্দ করতো আর আমি পছনদ করতাম খালার সঙ্গ। খালা খালুও আসতেন আমাদের বাসায় মাঝে মধ্যে। আমি তখন বেশ সাংসারিক, নিউজিল্যান্ড সরকার আমাদের একটা ভাতা দিতো তা দিয়ে প্রমার ন্যাপীসহ প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র আগে কিনতাম আর বাকীটাকা দিয়ে বেশ সুন্দর সংসার সামলাতাম। আমার মনে আছে যেদিন আমরা টাকাটা হাতে পেতাম সেদিন ভালোমন্দ খেতে যেতাম। কেন যেন তখন কে এফ সি আমাদের ভীষণ প্রিয় খাবার ছিল। আমার নিত্য কর্ম ছিল প্রমাকে সাথে নিয়ে বাজার করা, লন্ড্রি রুমে গিয়ে কাপড় ধুয়ে ড্রাই করা, রান্না করা, প্রমাকে খাওয়ানো, টয়লেট, গোসল করানো, ঘুম পাড়িয়ে ঘর পরিষ্কার! অতঃপর নিজের যত্ন নেবার সময় হতো খুব কম।

    জাপানী এক প্রবাদ আমি বিশ্বাস করি, তা অনুসারে আমরা সকলেই মুখোশ পরে থাকি তিনটি স্তরে। বাইরের মুখেশটা সুখ বা দুঃখের যা আমরা সবাইকে দেখাতে চাই, দ্বিতীয় মুখোশ খুব কাছের লোকজন জানতে পারে বা দেখতে পারে আর তৃতীয়টি একান্তই নিজের। কিছু গোপনীয় জিনিষ বা কথা সব মানুষেরই অন্তরে লুকায়িত থাকে যা সে কোনেদিনই কারো সাথে হিস্যা নিতে পারে না। আমি এসব তখন না জানলেও নিশ্চিত সুখী এক মুখোশ তখন পরা শুরু করেছিলাম। আসলে প্রমাকে খাওয়াতে বসে বা রান্না চড়িয়ে আমি গ্রেইস এনাটমি বা মুরতাগের মেডিসিন বই নাড়াচাড়া করতাম আর গভীর বিষন্নতায় ভুগতাম। যদি কখনো এ বিষয়ে প্রমার বাবার সাথে আলাপ তুলতাম তবে তা তর্কযুদ্ধে পরিণত হতো। কারণ স্বাভাবিকভাবেই পড়াশুনার ব্যপারে প্রমার বাবার প্রাধান্য পাবার কথা- সে ছেলেমানুষ, বয়সে আমার থেকে অনেক বড় আর সর্বোপরি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও এতো ভালো নয় যে দুজনের পরীক্ষার বিশাল অংকের টাকা আমরা বহন করতে পারব। সুতরাং আমি তখন নিজের পরীক্ষা বা পেশার কথা চিন্তা করা বা তুলা কতটা অযৌক্তিক ছিল তা খুব সহজেই বোধগম্য!! আমি গভীর বিষন্ন আর একাকী দিন যাপন করতে থাকলাম আর তাই আমার হাসি খুশী মুখোশটা ব্যবহারও বেশ জরুরী হয়ে পড়লো।

    চলবে…

  • নিশির প্রবাস (পর্ব-১২)

    নিশির প্রবাস (পর্ব-১২)

    পরের শিফট এ সেন্ডি এলে সেন্ডিকে নিশি জানালো, ওর আওয়ার কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেন্ডি বললো এখন এভাবেই চলবে, পরের সপ্তাহে আরো কমিয়ে দিবে, ( যাতে তুমি নিজ থেকে চলে যাও) – আমি এখন কি করবো? ” তোমার এখন ই নতুন চাকরি খোজা উচিত।” খুব মন খারাপ নিয়ে নিশি কাজ থেকে বের হলো। বাসায় এসে রান্না শেষ করে, সুমন এর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। এই সময় আরিফ এর ফোন এলো, নিশির গলা শুনে হয়তো আন্দাজ করেছে কিছু
    ” কি হয়েছে তোমার? ” – কই কিছু না তো। ” না, সত্যি করে বলো, কালকে আমরা প্রমিজ করেছি শেয়ার করবো সবকিছু” – সত্তিই কিছু হয় নাই, এম্নি।
    “ঠিক বলছো না তুমি”। সুমন আসার সময় হয়েছে,ফোন রাখি,” মিসিং ইউ”। একটু পর সুমন এলো, খাওয়া শেষ করুক, তারপর বলবে, আজ নিশি কিছু খায় নাই, তাই সুমন এর সাথে খেতে বসলো। খাওয়া শেষ করে, নিশি সুমন কে বললো একটা কথা আছে,
    ” নিশি সেইদিনের পুরা ঘটনা সহ আজ আওয়ার কমিয়ে দেওয়ার বিষয়, পুরা টা বললো।(সব টা শুনে সুমন নিশির চুল ধরে, চড় থাপ্পড়, অনেক মারলো, আর বললো “একটা কিস করলে কি তোর সতিত্ত চলে যাইতো?
    আনকালচারড, মুর্খ এর দল।”
    এক সময় মনে হচ্ছিল ও অজ্ঞান হয়ে যাবে। ও পাশের রুমে কাউচ এর উপর যেয়ে শুয়ে অনেক কাদছিলো আর ভাবছিলো, ও সুইসাইড করবে। সকালে উঠে দেখে সুমন কাজে চলে গেছে।
    ও বাথরুম এ আয়নার সামনে গিয়ে দেখে, ওর চোখ ফোলা,যে কেউ দেখে বুঝবে অনেক কান্নাকাটি করেছে, আর গালে, গলায় হাল্কা দাগ। ও বুঝতে পারছে না এই অবস্তায় কাজে যাবে কি করে!! না যেয়ে ও উপায় নাই। সাবওয়ে তে ওকে লোকজন ঘুরে ঘুরে দেখেছিলো। ও চেনঞ্জ করে উপরে যাওয়ার পার, কলিগ দুই তিন জন জিজ্ঞেস করলো।ও বললো শাওয়ার নিতে যেয়ে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলাম।
    গা ব্যাথা করছে, কস্ট হচ্ছে কাজ করতে। ও এখন ফ্রন্ট এ কাজ করে, দম নেওয়ার সময় নেই, রিসিট দেখে সার্ভ করার সময় দেখে সামনে আরিফ ট্রে না নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ও একটু হেসে বললো স্যার ইটস ইউর, আরিফ ট্রে টা নিয়ে সামনের একটা টেবিল এ বসলো, খাচ্ছে না কিছুই, ওর দিকে তাকিয়ে আছে, নিশির অসস্তি লাগছে। একটু পর একটা টিস্যু এনে দিলো এক বয় ( আমি জানতাম something is very wrong, তোমাকে দেখে আমি কথা হারিয়ে ফেলেছি, তুমি তোমার বস কে বলে এখনি বের হয়ে আসো, তুমি না বের হলে আমি সারাদিন এইখানেই বসে থাকবো, তোমার কাজের শেষ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করবো)
    নিশির কাজ করতে খুব কস্ট হচ্ছে, পুরো শরির ব্যথা করছে, মাথে বেথ্যা করছে। ও একসময় মেনুয়েল কে যেয়ে বললো, মেনুয়েল ওকে দেখে, ছুটি দিয়ে দিলো। ও বের হওয়ার সাথে সাথে আরিফ ওর হাত ধরে গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে ওকে বসতে বল্লো। ওর কোন শক্তি নাই কথা বলার।
    “অসুধ কি খেয়েছো? “

    কিছু না। ওর কপালে হাত দিয়ে দেখলো ওর জর, ও দুইটা ট্যেবলেট দিয়ে বল্লো তোমার রেস্ট দরকার। নিশি পাগলের মতো বলে উঠলো, আমি বাসায় যাব না। (এই মুহুর্তে নিশির মনে হচ্ছিলো কেউ ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখুক) ” আচ্ছা যেও না, কি খেয়েছো” – খেয়েছি। আরিফ একটু দূরে একটা রেস্টুরেন্ট এর সামনে গাড়ি দাড়া করালো, নিশির হাত ধরে বললো “এসো কিছু খাবে” নিশি কিছু বললো না, আরিফ মেনু সামনে দিয়ে বললো “কি খাবে বলো” – স্যুপ, আর কিছু না। আরিফ সি ফুড স্যুপ এর অর্ডার দিলো। ” তুমি কি আমাকে বলবে কাল কি হয়েছিলো? “
    নিশি চুপ করে আছে, কিছু বলতে পারছিলো না, ওর চোখ ছলছল করে করছে। ” আচ্ছা থাক বলো না। হঠাত নিশির হাত দুটি ধরে বললো, “প্লিজ আমাকে হেল্প করো, আমি কিছু করতে পারছি না, কারন তুমি আমাকে কিছু করতে দিচ্ছো না, আমি কাল ফোনে তোমার ভয়েজ এ টের পেয়েছি, কিন্তু আজ তোমাকে দেখে, আমি কি করবো, কি বলবো কিছু বুঝে উঠতে পারছি না “
    — কারো কিছু করার নাই।
    ” কেনো নাই, তুমি আমার সাথে থাকলে আমি অনেক কিছু করতে পারবো, প্লিজ এইটুকু বিশশাস রাখো আমার উপর” – স্যুপ খাই।
    আরিফ ওকে বাচ্চা দের মতো করে স্যুপ খাওয়ালো। তারপর একটু দূরে একটা পার্ক এ নিয়ে গেলো, তখন প্রায় সন্ধা হয়ে আসছে, বেশ ঠান্ডা পড়ছে। একটা বেঞ্চ এ বসলো ওরা। নিশির খুব শরির খারাপ লাগছিলো, শিত ও করছিলো, আরিফ বুঝতে পারলো, উনি আকাশী কালার একটা পুলওভার পরা, উপরে কালো ওভার কোট, সে ওভার কোট টা খুলে নিশির গায়ের উপর দিয়ে দিলো, ওরা পাশাপাশি বসে আছে, ” তোমার কি ইচ্ছা করে না তোমার জীবন টা তোমার মতো করে বাচতে? “
    –আমার ইচ্ছায় কি আসে যায়?
    ” তোমার জীবন কার ইচ্ছায় আসবে যাবে ?”
    নিশি বল্লো আমার শরির টা ভালো লাগছে না। আরিফ নিশির মাথাটা নিজের ঘাড় এ রেখে বললো, একটু রেস্ট নাও। নিশি কিছুক্ষণ সত্তিই ঘুমিয়ে পড়েছিলো। উঠে বললো — সরি, কয়টা বাজে? ” ৬টা, সরি কেনো ” — এই যে আপনাকে কস্ট দিলাম, আপনার ঘাড় ব্যেথা করছে নিশ্চয়ই।
    ” যদি পারতাম ওই সময় টা আমি লক করে দিতাম “
    নিশি বললো চলেন রাত হয়েছে,
    “চলো।” ( আরিফ এর একটা বিষয় নিশির খুব ভালো লাগে, ও কখোনো কিছু নিয়ে চাপাচাপি করে না)
    নিশির বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না, ভোর বেলায় দেখে অনেকেই সাবওয়ে তে ঘুমিয়ে থাকে, মন চাইছে ওখানে যেয়ে ঘুমিয়ে থাকে।
    (দিপ ছিলো শিখা ছিলো, শুধু তুমি ছিলে না বলে) গাড়িতে গান টা রিপিট হচ্ছে। ” তুমি কি এখন একটু বেটার ফিল করছো? ” — হুম অনেক টা। “শোন বাসায় যেয়ে কিন্তু অবশ্যই কিছু খাবে, তারপর ঘুমাবে।”
    নিশি কোন উত্তর দিলো না।
    বাসা চলে আসছে,
    ” ভালো থেকো” — হুম।
    রান্না করতে ইচ্ছা করছে না, কালকের মাংস আছে, ওটাই গরম করে টেবিল এ দিলো,( কি আর হবে, আজ ও না হয় দুই একটা চড় খাবে। প্রেসার কুকার এ ভাত বসিয়ে দিয়ে লাইট অফ করে শুয়ে আছে, ফোন বাজছে, — হ্যালো, ” অইপাশ থেকে চুপ, গান বাজছে
    ( যে আখিতে এতো হাসি লুকানো) নিশি কিছু বলছে না, জানে এটা কার ফোন। ও একটু পর লাইন কেটে দিয়ে শুয়ে পড়লো। সুমন এসে জিজ্ঞেস করলো “এতো তারাতারি শুয়ে পরেছো যে” — খেয়েছো? ( নিশি একটু অবাক হলো, কখোনোই সুমন ওকে খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করে নাই) – খেয়েছি।
    সুমন খেয়ে নিলো, এমনকি কালকের তারকারি যে দিয়েছে সেটা নিয়ে ও কিছু বললো না। ( হয়তো বা কালকের ঘটনার জন্য গিলটি ফিল করছে) খাওয়া শেষ করে সুমন খুব উতফুল্ল গলায় বললো “শোন দুই বেড রমের বাসার কথা বলেছিলাম না, ওটা পেয়ে গেছি, ১ তারিখ শিফট করবো”

    – আচ্ছা।
    এখন নিশি বুঝতে পারছে সুমনের এই অন্যরকম আচরণ এর কারন। দুই বেডরুম এর কথা যখন ই উঠেছে, তখন ই সুমন এভোয়েট করেছে, বা বিরক্তি প্রকাশ করেছে।

    চলবে….

  • লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব -৫)

    লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব -৫)

    বাইরে চিল্লা চিল্লি শুনে সকালে ঘুম ভাঙলো ফুয়াদের। পাশে তাকিয়ে দেখে স্নেহা নেই৷ চিল্লা চিল্লি শুনে ঘুম ভাঙলে এমনিতেই মানুষের মাথা ঠিক থাকে না৷ তারপর আবার স্নেহাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে যা হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে৷ ফুয়াদের গা কাঁপছে৷ সে কোনো ভাবে পা বাড়াতে পারছে না৷ কোনো ভাবে উঠে সে দাঁড়ালো৷ চোখে মুখে পানি দিলো৷ সিড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে সে ভাবছে কি হতে পারে। নীচে নামতেই খাদিজা বুয়ার বিলাপ…

    ও স্যার ও স্যার দেইক্ষা জান মেডামের কি অইছে…

    আর হাত দেখাচ্ছে লিভিং রুমের দিকে৷

    ফুয়াদ লিভিং রুমে ঢুকে তার মাথা খারাপ হয়ে গেলো৷ স্নেহা সাদা শাড়ী পরে বসে কাঁদছে৷ তার দুই হাত থেকে গড় গড় করে রক্ত পড়ছে৷ সারা গায়ে ময়লা। তার এলোমেলো উসকো খুসখো চুলে সব গাছের পাতা আর ময়লা৷ লিভিং রুমের টেবিলের উপর গ্রীস থেকে নিয়ে আসা সে ডেকোরেশন পিস গুলো, যা গতরাতে ফুয়াদ ভেঙে পাউডার করে ফেলেছিলো৷

    ফুয়াদ সব বুঝে ফেললো, পাউডার করা জিনিস যা ছিলো ডাস্টবিনে, তা জোড়াও লেগে গেলো, ঠিকমতো ঘরেও চলে এলো৷ এতো কিছু হয়ে গেলো৷ আজ নিশ্চিত অনেক বিপদ আছে৷

    ফুয়াদ হন্তদন্ত হয়ে স্নেহার দিকে এগিয়ে গেলো৷

    স্নেহা চোখ বড় করে ফুয়াদের দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারা করলো, যেন তার কাছে না যায়৷ ফুয়াদ জিজ্ঞাসা করলোঃ
    তোমার কি হয়েছে স্নেহা তোমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে৷ হাত কেটেছে কিভাবে?

    স্নেহা শুধু গলা গড়গড় করে হুমমমম হুমমম একটা শব্দ করলো, আর চোখ বড় করে ফুয়াদের দিকে রাগি চোখে তাকাচ্ছে৷ তার সমস্ত গা ভিজা৷

    এদিকে রুবিনা বলে উঠলোঃ
    ও স্যার কাছে যাইয়েন না৷ কাছে যাইয়েন না৷ আমাগো মেডামের ভিত্রে আত্মা হান্দাইছে৷ কাছে গেলে ঠাইট মাইরা ফালাইবো৷

    ফুয়াদ খুব ভয় পেয়ে গেলো৷ সে বলে উঠলো, তাহলে এখন আমি কি করবো? তোমরা কিছু বলো৷ এভাবেতো সব রক্ত শেষ হয়ে যাবে৷

    খাদিজা বুয়া আর রুবিনাকে বাইরে নিয়ে এসে বললো, চলো সবাই মিলে এক সাথে ধরি৷ কোনো কথা শুনবো না তোমার মেডামের৷

    সবাই মিলে স্নেহার কাছে যেতেই, স্নেহার সামনে রাখা একটা কাঁচের টেবিল এক হাতে তুলে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললো আর বলতে লাগলো, আজ যদি কেউ কাছে আসিস সর্বনাশ করে ফেলবো৷

    কিন্তু স্নেহার গলার স্বর একটা ছেলে মানুষের মত৷ সবাই ভয়ে পিছে চলে আসলো৷ ফুয়াদ ভেবে পাচ্ছে না স্নেহার গলায় কি হয়েছে!!!

    মূহুর্তের মধ্যে স্নেহা স্নেহার মধ্যে ফিরে এসেছে৷

    সে অবাক হয়ে ফুয়াদকে দেখছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত, খাদিজা বুয়াকে বলছে,
    বুয়া, তুমি রুবিনা এখানে কি করছো? তোমরা সবাই এখানে কি করছো? আমি? হায় আল্লাহ টেবিলটা কে ভেঙেছে?

    ওরা কেউ বুঝে উঠতে পারছিলো না কি করা উচিৎ, কি বলা উচিৎ। আবার স্নেহা বলে উঠলো, এখন কটা বাজে? কোন সময় এখন?

    ভয়ে ভয়ে ফুয়াদ বললো, এখন সকাল স্নেহা। সকাল আটটা বাজে৷ তুমি কেমন আছো?
    এতক্ষনে স্নেহা সব বুঝে ফেলেছে, তার সাথে কি কি হয়েছে৷ সঙ্গে সঙ্গে স্নেহা বলে উঠলো, আমি সরি ফুয়াদ৷ আমি সরি৷

    ফুয়াদ এগিয়ে এসে স্নেহার হাত ধরলো৷ সরি বলছো কেন স্নেহা? তার হাত ধরে ফুয়াদ দেখে, পুরো আঠালো ময়লা৷ গা থেকে গন্ধ বের হচ্ছে৷ পুরো গা ভিজে চুবচুবা৷ মুখে ময়লা লেগে আছে৷ রক্ত আর ময়লা দিয়ে আর সাদা শাড়ী আর সাদা নেই৷ কিন্তু ফুয়াদ বুঝে উঠতে পারছে না ওর কি বলা উচিৎ।

    স্নেহা বললোঃ
    আমি যাই৷ গোসল করে আসি৷ বলতে বলতে স্নেহা মাথা ঘুরে পড়ে গেলো৷ সবাই মিলে ধরে স্নেহাকে রুমে নিয়ে আসলো৷

    ফুয়াদ বলে উঠলো স্নেহা তোমার হসপিটাল যেতে হবে৷ তোমাকে ভাল ভাবে ড্রেসিং করাতে হবে৷

    রুবিনা স্নেহাকে সাওয়ারে নিয়ে গেলো৷ ফুয়াদ খুব ভয় পাচ্ছে৷ আবার কি হয়। আর বসে বসে ভাবছে, স্নেহা যখন অন্য রকম হয়ে যায় তখন তার গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যায়৷ ঘাড় নাড়ায় অন্য ভাবে যেন রোবট৷ জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনা যায়৷ তারপর কিছু একটা জিনিস ভাঙে৷ তার কয়েক সেকেন্ড পরেই স্বাভাবিক হয়ে যায়৷ সে সব সময় সাদা শাড়ী পরে তখন আর ভিজে চুবচুবা হয়ে যায়৷

    কোনো ভাবে সাওয়ার শেষে বাথরোব পরিয়ে স্নেহাকে বের করে আনলো রুবিনা৷ স্নেহা বলছে, ফুয়াদ আমার ভীষণ মাথা ব্যাথা হচ্ছে৷ সব আঙুল, সব নক কেটে গেছে৷ পিঠেও মনে হয় কেটেছে৷

    ফুয়াদ বলে উঠলো, বল কি!!! পিঠে কেটেছে মানে?

    স্নেহা বললো, ডাস্টবিনের ভেতরে অনেক কাঁচের টুকরো ছিলো তো৷

    রুবিনা বললো পিঠের পেছনে ছোট ছোট কাঁচের টুকরো ঢুকে আছে৷

    ফুয়াদের চোখ পড়লো স্নেহার হাতের কনুইয়ের উপর। কনুইয়ের ঠিক উপরে আর্ম্পিডের একটা জায়গা থেকে গর্ত হয়ে মাংস উঠে গেছে৷ সেখানে ময়লা চাপা লেগে একটু একটু রক্ত চুইয়ে চুইয়ে বের হচ্ছে৷ ফুয়াদ স্নেহাকে টেনে বেসিনে নিয়ে সে জায়গায় একটু পানি স্প্রে করে দেয়৷ আর সঙ্গে সঙ্গে ফুলকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করেছে৷ তাড়াতাড়ি কটন দিয়ে চেপে ধরে বললো, স্নেহা একটা মেক্সি পরে কোনো ভাবে ওড়না পেচিয়ে হাসপাতালে চলো৷ একটা এক্সট্রা কাপড় ব্যাগে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলো৷ আর ভাবছে ডাক্তার যদি জানতে চায়, তবে কি বলবে৷ হঠাৎ তার মনে পড়লো তার বন্ধু ডাঃ আশফাক চৌধুরীর কথা৷ সে স্কয়ার হসপিটালেই বসে৷ সে রেডিও প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টে আছে৷ তাকে কল করে স্কয়ার হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে এসে সব ব্যাবস্থা করতে বললো৷ প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগলো সব ড্রেসিং এবং ট্রিটমেন্ট শেষ হতে৷ হাতের দু জায়গায় স্টিচ লেগেছে৷ টিটেনাস ইনজেকশন ও দিতে হলো৷ মাথায়ও ভীষণ আঘাত লেগেছে৷ ডাক্তার স্নেহাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কেমন করে এমন ব্যাথা পেলো৷ স্নেহা বললো সে জানেনা৷ ডাক্তার আশফাককে ফুয়াদ আগেই মেসেজ পাঠিয়ে রিকোয়েস্ট করেছিলো যেন কোন প্রশ্ন না করে কেউ স্নেহাকে৷

    এদিকে স্নেহার যে পরিমান ব্লিডিং হলো, তাতে সে প্রচন্ড দূর্বল হয়ে পড়েছে৷ ডাক্তার বললো, এ অবস্থায় স্নেহাকে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন। এবং সে যে পরিমার দূর্বল হয়েছে, তার আরও কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষার প্রয়োজন৷ এমতাবস্থায় স্নেহাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে৷

    স্নেহাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো৷ তার নানা রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা চলছে৷ সিটি স্কেন করে ধরা পড়লো তার মাথার স্কাল্প ইনজিউর্ড৷ এদিকে ডাক্তার বললো, Sneha is pregnant with twin baby. And she is in very critical conditions.

    এসব শুনে ফুয়াদের মাথা খারাপ হয়ে গেলো৷ সে ভেবে কুল পাচ্ছে না কি করবে৷ ফুয়াদের বোন থাকে ঢাকার উয়ারিতে৷ তাড়াতাড়ি বোনকে খবর দিলো৷

    এদিকে তার ব্যাবসাহিক কাজে তাকে বিদেশে যেতে হবে এ সপ্তাহে৷ উপায়ান্তর না দেখে বন্ধু ফয়সালকে কল দিয়ে বললো দোস্ত, যে ভাবেই হোক তোর আতর আলীকে আনার ব্যাবস্থা কর৷ আমি আর পারছি না৷

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৩)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৩)

    মাউন্ট মঙ্গানুয়ি শহর আর আমাদের প্রথম বাসা

    নিউজিল্যান্ডর জনসংখ্যা অত্যন্ত কম জেনেই সেখানে গিয়েছিলাম। তবুও রাস্তায় বের হলে অস্বাভাবিক রকমের অস্বস্তি বোধ হতো যেনো কোথাও কেউ নেই। রাস্তা ঘাটে কাউকে তো দেখা যেতোই না, বাড়িগুলোও মনে হতো জনশূন্য কেমন নিশ্চুপ! বাচ্চাদের চিৎকার, বড়দের চেঁতামেচি বা কুকুরের ঘেউ ঘেউ কিছুই নেই। হাঁটতে বের হলে কেমন গা ছমছম করা ভুতূড়ে অনুভব! প্রথম দিকে গাড়ি না কেনার ফলে আমাদের হেঁটে বা বাসে চলাচল করতে হতো।আমি নিশ্চিত আমাদের দেখেও ওদেশীরা অদ্ভুত ভাবতো প্রথম প্রথম কেনোনা ওরা ঘুরতো হাল্কা পোশাকে আর আমরা ভারী লম্বা জ্যাকেট পরেও শীতে কাঁপতাম। প্রমাকে নিতাম স্ট্রলারে আর প্রমা খুব তাড়াতাড়ি তার বেল্ট খুলে ফেলা শিখে গেলো এবং সময় সুযোগ মতন খুলে ফেলতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করতো না। বিশেষ করে বাজারে বা শপিং মলে গেলে তাকে বসানো আমার দায় হয়ে পড়তো আর এটা সেটা দিয়ে ট্রলি বোঝাই করে ফেলতো সেগুলো জায়গামত রাখা আমার আর একটা বাড়তি কাজ ছিল।

    আমরা, মূলত প্রমার বাবা সিদ্ধান্তে আসতে পারছিল না থাকবে না ফিরে যাবে দেশে। বিশেষ করে যেসব ডাক্তারদের সাথে দেখা হতো কবীর লোজে আর তার বাইরেও সবাইকেই বেশ হতাশ মনে হলো চাকুরীতে ঢুকার ব্যপারে। কারণ তাদের কাছে মনে হয়েছিল ওখানে (USMLE)আমেরিকার রেজিস্ট্রেশন, (IELTS) ইংরেজী পরীক্ষা পাশ করবার পরও ওদের ক্লিনিকাল পরীক্ষা পাশ করতে হতো কাজ করার জন্য। বাঙ্গালী ডাক্তারদের মনে হয়েছিল কাজে প্রবেশ করবার পদ্ধতি কৃত্রিমভাবে বিদেশী ডাক্তারদের জন্যে কঠিন করে রাখা হয়েছে। আমাদের খালা খালু( আম্মার চাচাতো বোন) পার্শবর্তী সুন্দর সমুদ্রপাড়ের এক শহরে থাকতেন। আমরা কিছুটা সময় কিনার জন্যে আর তাদের সাথে দেখা করে উপদেশ নেবার জন্যে কয়েক সপ্তাহের জন্যে সেই শহরে দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে থেকেছিলাম। আপনজনদের দেখলে কার না ভালো লাগে? তদুপরি ঝিমা খালা ছিলেন ‌অত্যন্ত হাসিখুশী সদালাপী বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। উনাকে সবাই পছন্দ করতো আর সারাদিন কাজের পরে উনার বসার ঘরে অনেক গল্প জমতো। গল্প করতে দারুন মজা লাগতো ঠিকই আর উনার রান্নাও বেশ মজা করে কতদিন খেয়েছি। বিশেষ করে দেশী মুরগীর মতন হার্ড চিকেন রান্না উনার অনেক মজা হতো। খালুও অনেক অতিথিবৎসল ভালো মানুষ তবে উনি কথা অনেক কম বলতেন। আমি খেয়াল করেছি দাম্পত্য জীবনে একজন কথা বেশী বললে অন্যজন কথা কমই বলে থাকে বা সুযোগ পায় না। ঝিমা খালার ভাষ্য অনুযায়ী খালা রাগ করলে নাকি খালু খুশী হতেন কারণ তার সাথে আর কথা না বলে চুপচাপ থাকতে পারবেন।

    আরও বেশকিছু বাঙ্গালী ডাক্তার,ইনজিনিয়ার, ডেনটিসট, এগ্রিকালচারিসট সহ অনেক প্রফেশনাল ঐ শহরে থাকতেন এবং কেনো যেন সারাদিন বাগানে অড জব করতেন। তাদের মধ্যে তখনো পরীক্ষা দেবার,ডাক্তারী বা প্রফেশনাল কাজ করবার উৎসাহ আর মানসিকতা তৈরী হয়নি।আনন্দের সাথে বলতে পারি পরে প্রায় সকলেই নিজ নিজ পেশায় কাজে নিয়জিত হয়েছেন। ওখানে আমাদের সাথে সখ্যতা হয়েছিল ডেনটিসট ববি ভাই ডেইজি ভাবীর সাথে যাদের সাথে পরে বহু বৎসর অকল্যানডে একসাথে কাটিয়েছি। খুবই ভালো মনের এবং এখন পর্যন্ত আমার প্রিয় দু’জন মানুষ শেলী ভাবী আখতার ভাইয়ের সাথেও ওখানে পরিচয়। আর ব্যচেলর তারিক ভাইয়ের কথা না বললেই নয়, উনি নিজ উৎসাহে আমাদের যে কি পরিমান সাহায্য করেছেন তা কোনোদিন ভুলবার নয়। উনি এবং অন্যান্য বড়ভাই আর আমার তিন বন্ধু আসিফ মোমিন আর ফারহান না থাকলে প্রথমদিকে আমাদের প্রবাসজীবন যন্ত্রণাদায়ক হতো কোনোই সন্দেহ নেই।

    ইতোমধ্যে আমার ভাই কাওসারের আয়ারল্যানডের কর্ক শহরে কাজ পেয়ে যাবার সংবাদ পেয়ে একই সাথে আনন্দিত আর দুঃখিত হলাম। ও যাবার আগে মাউন্ট মঙ্গানুয়ি শহরে আসলে আমি শহরটি ঘুরে দেখালাম। ছেলেরা সারাদিন বাগানে কাজ করতে যেতো আর আমার সারাদিন কাটতো রাননা করে , প্রমাকে খাবার গোসল করানো আর ঘুম পাড়ানোতে, কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে আর ঘর পরিষ্কার করে। যে কাজই আমি করতাম প্রমা আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকতো, কোলে করেই বেশীরভাগ কাজ করতে হতো আর না হলে আমার কাপড় ধরে থাকতো।আমি এমনকি গোসল করতেও পারতাম না- বুঝতে পারতাম ওর ভয় যেনো ও আর কাউকেই জীবন থেকে হারাতে চায় না! যেনো আমিও কোথায় হারিয়ে যাব আর সকলের মত। আমি রীতিমত হতাশায় ভুগতে শুরু করলাম যে জীবনে আর কোনোদিন কি ডাক্তারী পেশায় যেতে পারব না?! ভাইয়ার কাজের ব্যপারটা অবশ্য আমাদের উজ্জীবিত করলো অকল্যানডে ফিরে আসবার জন্যে আর পড়াশুনা শুরু করবার জন্যে।
    একদিন প্রমাকে স্ট্রলারে নিয়ে ভাইয়ার সাথে শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরে সাংসারিক বাজার শেষে মাত্র ফিরলাম। দরজার লক খুলে ঢুকে বন্ধ করতে গিয়ে স্লাইডিং দরজা আমার হাতে বেশ জোরে এসে ধাক্কা দিল। আমি প্রচন্ড ব্যথায় আঁতকে উঠলাম, তারপর মনে নেই। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে দেখি আমি মেঝেতে আর ভাইয়া আমার চোখেমুখে পানি দিচ্ছে। ভাবলাম হায়রে বিদেশ! ভাবলাম ভাইয়া যদি সাথে না থাকতো আমার প্রমার তখন কি হতো?! পুরো শহর ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই! চারিদিকে শূন্যতা।

    চলবে…

  • নিশির প্রবাস (পর্ব-১১)

    নিশির প্রবাস (পর্ব-১১)

    নিশি কাজে গিয়ে দেখলো সব ঠিকঠাক,(গতকালের ঘটনায় ও একটু ভয়ে ভয়ে ছিলো, একবার ভাবছিলো সুমন কে বলবে, ভালো হয়েছে বলে নাই) মেনুয়েল এর সাথে একবার দেখা হলো,ও উইশ করলো,মেনুয়াল ও মাথা নেড়ে রিপ্লাই দিলো।
    আজ ও বিকালে আরিফ সাহেব এলো, পেমেন্ট দিলো, হাসি বিনিময় হলো, পেমেন্ট দিলো, এক কাপ কফি নিলো, অনেকক্ষন বসে বসে খেলো, চলে গেলো, কোন টিস্যু নেই আজ।
    বাসায় গিয়ে নিশি দেখলো একটা শপিং ব্যাগ এ অনেক কিছু,, সুমনকে জিজ্ঞেস করে জানলো এক ভদ্রলোক বাংলাদেশ এ যাবে, তাদের বাসার লোক জন দের জন্য এই গিফট। একবার সুমন ওকে বললো ও না, ওর ও তো ইচ্ছা করে ওর ভাই, ভাতিজা দের কিছু পাঠাতে। (আর জিনিষ গুলি ওদের ই বাসায় যাবে, কারন সুমন এর ভাই রা কেউ বাংলাদেশ এ থাকে না, তাই ওরা গ্রামের বাড়িতে মুভ করেছে) ও কিছু বললো না, ঝামেলা ভালো লাগে না ওর। নিশি একটা ছোট বক্স এ ওর কাটা চুল গুলি দিয়ে দিলো, রেপিং পেপার দিয়ে ভালো করে রেপ করে মুখ আটকে দিলো। উপরে আম্মার নাম লিখে দিলো। সুমন কে দিয়ে বললো এটা কাইন্ডলি আম্মা কে দিতে বইলো। ” কি এটাতে” – আমার চুল গুলি। ” এই গুলি পাঠাচ্ছো কেনো? “

    কাটা চুল , মরার পর যার চুল তার সাথে কবরে দিয়ে দিতে হয়, তাই।
    “আজাইরা কথা”।
    আজ নিশির ডে অফ, আরিফ সাহেব এর সাথে বসবে আজ, কি বলতে চায় দেখা যাক। ও ফোন করলো আরিফ কে, – আজ কি আপনি ফ্রি আছেন? ” কখন কোথায় বলো” – আমি আজ ফ্রি, কিন্তু এখানে আমি তো তেমন কোন জায়গা চিনি না, আর কোথায় কোন বাংগালি দেখে ফেলে সেই ভয় এ আছি। ” রিলাক্স প্লিজ, তুমি ১২ টায়
    লা লুইস এর সামনে দাড়াও আমি তোমাকে পিক করছি” – তারপর, কোথায় যাবো? “যেখানে তোমাকে কোন বাংগালি দেখবে না। আমি চাই না তোমার মনে কোন ভয় কাজ করুক”।
    উনি আসলেন সময় মতো, গাড়িতে উঠে শুনতে পেলো বাংলা গান বাজছে, ” কেমন আছো তুমি” ভালো আছি। – আপনি বাংলা গান খুব ভালোবাসেন? ” হুম, কারন আমি বাংগালি, হিন্দি ও শুনি, কম ‘ তুমি কোনটা শুনতে চাও? ” – আমার কোন ইচ্ছা নেই, আপনার যেটা ইচ্ছা। “কেনো তোমার কোন ইচ্ছা নেই? ” – নেই,এটার আবার কেনো কি? আরিফ টিপে গান চেঞ্জ করলো, ইংলিশ গান, নিশি চুপ করেই আছে, ওর তো কোন ইচ্ছা নেই। “তোমার একটা ইচ্ছার কথা বলো” – আমার কোন ইচ্ছা নেই। “একটা”, নিশি আনমনে উত্তর দিলো – আমার দেশে চলে যেতে ইচ্ছা করছে। আরিফ নিশির দিকে তাকালো, কিছু বললো না। গান চেঞ্জ করে দিলো,
    ( তুমি একজন ই শুধু বন্ধু আমার), আপনার প্রিয় শিল্পি কে? ” উনাদের সবার গান ই আমার ভালো লাগে, মান্নাদে, শচিন দেব, সতিনাথ,…..” শহর থেকে দূরে একটা জায়গায় থামলো ওরা, লেক, পার্ক,সুন্দুর একটা জায়গা ।” খিদা লেগেছে” – না, আমি দেরিতে ব্রেকফাস্ট করেছি। ” এখানে রেস্টুরেন্ট ও আছে, এখানে বসবে” – হ্যা বসা যায়। ওরা একটা সুন্দুর জায়গায় বসলো। – বলুন কি বলতে চান?
    আরিফ চুপ করে আছে, একটু আনমনা মনে হচ্ছে, আকাশ, গাছ পালা দেখছে, আর ফাকে ফাকে নিশির দিকে তাকাচ্ছে।
    ” জানো তোমাকে যেদিন আমি প্রথম দেখেছি, আমি জানতাম না তুমি কারো বউ, ভেবেছিলাম কারো মেয়ে, অন্য কোন স্টেট থেকে নিউইয়র্ক বেড়াতে এসেছে, সেইরাত আমি সারারাত শুধু তোমায় ভেবেছি, আমি এই মেয়ে টাকেই এতোদিন খুজছিলাম মনে মনে, স্ট্রাইপ স্কার্ট, রেড শার্ট, মাথা ঝাকিয়ে ঝাকিয়ে এর ওর সাথে কথা বলছে, পরদিন যখন জিজ্ঞেস করে জানলাম, আমার বুকের ভিতর কেমন একটা অনুভুতি হয়েছিলো আমি বোঝাতে পারবো না, কিন্ত আমি তোমাকে হারাতে চাই না “

    মানে কি? আপনি তো জানেন আমি ম্যারেড।
    ” এইজন্য ই বন্ধুত্ত চাই “

    কেমন বন্ধুত্ত? কপাল কুচকে নিশি জিজ্ঞেস করে।
    ” শেয়ারিং, কেয়ারিং, ফিল ফর ইচ আদার”
    ( নিশি এতো কঠিন কথা বুঝে না) – কি শেয়ারিং? কি ফিল করার আছে?
    “তোমার ভালো লাগা, খারাপ লাগা, আনদ্দ, দুঃখ, কস্ট, অনুভুতি সব”

    আর ফিলিং?
    “একটা মানুষ এর সাথে যখন তোমার বন্ধুত্ত হবে তুমি তার জন্য ফিল করবা না? যেমন আমার সাথে যদি তোমার বন্ধুত্ত হয়, তুমি যদি শুনো আমার খুব শরির খারাপ, তোমার খারাপ লাগবে না? আমি প্রতিদিন তোমাকে ফোন দিই, একদিন দিলাম না, তুমি মনে করবা না, আজ কেনো ফোন দিলো না, কোন বিপদ হলো কিনা? ” – হুম।
    ” আমি বন্ধুত্তের হাত বাড়িয়েছি, আমাকে ফিরিয়ে দিও না প্লিজ, আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না,
    আগলে রাখবো”।
    লাস্ট এর কথাটার নিশির বুকে কেমন একটা অনুভুতি হলো

    আগলে রাখবো।
    নিশি বললো আমার খিদা পেয়েছে, ” চলো, কি খাবে? কি ধরনের খাবার তুমি পছন্দ করো?”

    একটা হলেই হয়। ইটালিয়ান একটা রেস্টুরেন্ট এ গেলো, ওকে জিজ্ঞেস করে করে অর্ডার দিলো, প্রন লাইক করে কিনা? প্রন সুসি, আরো কতো কি। ” তোমরা কয় ভাই বোন?”

    দুই ভাই আর আমি সবার ছোট। “তারমানে তুমি একমাত্র মেয়ে” -হুম। আচ্ছা তোমার পেরেন্ট এতো তাড়াতাড়ি তোমার বিয়ে দিয়েছেন কেনো? অবশ্য ভালো হয়েছে, না হলে তোমার দেখা পেতাম না”

    নিশি বিস্তারিত বললো কিভাবে ওর বিয়ে হয়েছে।
    খাবার এর সময় আরিফ খুব যত্ন করে এটা এভাবে খেলে মজা লাগবে, ওটার সাথে এটা খাও, মজা লাগবে,(নিশির হঠাত খুব মন খারাপ লাগছিলো, আম্মার কথা মনে পরছিলো)।
    “আইসক্রিম খাবে ” – না, আর কিছু খেতে পারবো না।
    “জানো পুরর্নিমার রাতে এই পার্ক টা এতো অপরুপ লাগে, ভিষন সুন্দুর”

    আপনি পুরর্নিমা বোঝেন?
    “কেন আমাকে কি তোমার অন্য গ্রহের মানুষ মনে হয়? পুরর্নিমর রাতে আমি একা একা খোলা জায়গায় যাই, অনেক রাত অব্দি থাকি”

    আমারা পুরর্নিমার রাতে সব ভাই বোন রা ( চাচাত, ফুপাত) মিলে ছাদে অনেক রাত অব্দি থাকতাম, অনেক মজা করতাম।
    “এই পুরর্নিমার সন্ধায় আসবে আমার সাথে?”
    — কাজ এর উপর ডিপেন্ড।
    ফেরার সময় রাস্তায় গাড়ি দার করিয়ে, আইসক্রিম কিনলো,” কিছুদিন পর খুব ঠান্ড পরে যাবে, আর খেতে পারবে না”
    ড্রপ করার করার সময় আরিফ বললো
    “আমার উপর কি ভরশা করা যায় না?”

    আমি তো না বলি নাই।
    নামার সময় ও ধন্যবাদ দিলো, আরিফ কে দেখেই বোঝা গেলো এই ধন্যবাদ বলাতেই উনি খুব খুশি।
    অনেক দিন পর অনেক ভালো একটা দিন কাটলো আজ।
    সুমন আজ ও বললো দুই বেড রুমের একটা ফ্লাট দেখতে হবে, সময় ই পাচ্ছি না। ( নিশি কে শোনানো)
    আজ কাজের জায়গায় উইকলি রুটিন দিবে, ওরা যেটা করে কাজে গিয়ে সবচেয়ে প্রথম দেখে কার ডিউটি কখন, আর কতো আওয়ার।
    নিশি নিজের চোখ কে বিশশাস করাতে পারছিলো না, ওর যেখানে প্রতি সপ্তাহে আওয়ার – এভারেজ ৫২/৫৪ ঘন্টা দিতো, এই সপ্তাহে মাত্র ৩০ ঘন্টা!!
    চেঞ্জ করে উপরে গিয়ে দেখলো ক্যাশ এ ও অন্য একজন।
    ও বুঝলো সেদিন মেনুয়েল এর সাথে ওই আচরণ এর মুল্য।
    জানে না সামনে কি অপেক্ষা করছে!!

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-২)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-২)

    অকল্যানড পৌঁছানো এবং প্রথম রান্না

    নিউজিল্যান্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণা অতটা স্বচ্ছ ছিলনা। জানতাম দেশটি ভেড়া,গরু সমৃদ্ধ এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাবারের জন্য বিখ্যাত। তবে ভুল ধারণা একটা ছিল যেটা হলো ডাক্তার হিসেবে চাকুরী সহজে মিলবার- কত যে ভুল সে ধারণা পরে সেটা বুঝেছি। আমার বড়ভাই তখন মাত্র মাস দুয়েক হলো সেখানে গিয়েছে। তার পরামর্শেই অবশ্য আমাদের ওখানকার ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করা। সেসময় সে এবং তার কয়েকজন ব্যাচেলর বন্ধু মিলে মেস এর মতন করে থাকতো। নিজেরাই রান্না বাননা সংসার করতো, পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে অড জবও করতে হতো তাদের।মোটামুটি সবাই পূর্বপরিচিত আমার মেডিক্যালেরই, দুই একজন অন্য মেডিক্যাল কলেজের কিন্তু সকলেই আমার এক বৎসরের সিনিয়র এবং বড় ভাইয়ের ব্যাচমেট। যাবার আগেই আমরা সায়েক ভাইয়ের রান্না বিশেষ করে গরুর মাংস রান্নার সুখ্যাতির খবর জেনে গিয়েছিলাম এবং পরবর্তীতে সেই অতীব সুস্বাদু মাংস খাবার সৌভাগ্যও হয়েছিল।

    আমরা লম্বা ভ্রমণের পর প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে দুপুরবেলা অকল্যানড এয়ারপোর্টে পৌঁছুলাম। প্রমা শান্ত ছিল বলে বাঁচা তবে খারাপ লাগছিল ওকে দেখে, অনেকটাই বিভ্রান্ত আর আমাদের কোল ছাড়ছিল না।ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস পার হতে মোটেই সময় লাগল না।ছোট্ট এয়ারপোর্ট দেখে যদিও আশাহত হয়েছিলাম, বড়ভাই কাওসার আর সায়েক ভাইয়ের হাসিমুখ উঁকি দিতে দেখে বেশ আশ্বস্ত বোধ করলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সায়েক ভাইয়ের বড়বোন লাভলী আপার বাসায় মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য। উনি অনেক কিছু আয়োজন করেছিলেন আর হাসিমুখে আপ্যায়ন আর অনেক যত্ন করে খাইয়েছিলেন। সেটা ছিল আমাদের নিউজিল্যান্ডর প্রথম খাবার, জীবনে কোনোদিন ভুলবার নয়।আপনাদের জন্যে সবসময় মন থেকে দোয়া।

    এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো গ্রোসারী শপিং এ অর্থাৎ ঘর সংসারে এই মূহুর্তে যা যা প্রয়োজন আর পরদিন থেকে খাবার রান্না আয়োজনের জন্য কি কি জরুরী তা কিনবার জন্য। সবথেকে প্রয়োজনীয় ছিল প্রমার খাবার, ন্যাপী এগুলো কিনে নেয়া। আমরা সেগুলো সারার পর আমাদের জন্যে ভাড়া করা সাময়িক বাসস্থানে পৌঁছে দিলেন ভাইয়া আর সায়েক ভাই। ওটা কবীর লোজ নামে পরিচিত ছিল আর মোটামুটি সব বাঙালীরাই অকল্যানড আসলে নাকি সেখানেই অস্থায়ী ভাবে ভাড়া থাকতেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজ নিজ বাসস্থান ঠিক করে নেন। বিশাল এক পুরোনো ধাঁচের বাড়িতে ঢুকলেও আমাকে দেখানো হলো স্টোর রুমের চাইতে সামান্য বড় একটা রুম। আমাদের তিনজনের জন্যে মেঝের উপর মেট্রেস পেতে বিছানা করা। পাশে দিয়ে জায়গা নেই বললেই চলে আর বেশ উপরে ছোট্ট একটা জানালা। আমার কেমন যেনো গুদাম ঘর মনে হতে থাকলো আর দম আটকে আসতে থাকলো।

    কবীর ভাবী হাসিমুখে এগিয়ে আসলেন, বললেন অন্য একটি পরিবার বড় রুমটাতে আছেন বলে আমাদের এখানেই আয়োজন করেছেন আর আমার যখন যা প্রয়োজন বা বুঝতে পারব না তা যেন উনাকে জিজ্ঞেস করতে পিছপা না হই। উনার বেহেস্তী হাসিমুখ দেখে আমি অনেকটাই আশ্বস্ত হলাম যেন বড় বোন যা আমার কোনোদিন ছিল না। আজ লজ্জা বোধ হচ্ছে উনার নামটা বলতে পারছি না বলে যেহেতু আমরা সবাই নিজ পরিচয়ের চাইতে হাসব্যানডের পরিচয়ে পরিচিত থাকতেই স্বাচ্ছন্দ বেধ করি। উনার দুই ছেলে সামি আর সাদী আর উনি প্রমাকে ভীষণ আদর করতেন। উনি প্রমাকে দেখলেই আদর করে জিজ্ঞেস করতেন কি খাবে? প্রমা তড়িৎ উত্তর দিত শসা খাব আর উনি হেসে কুটিকুটি হতেন। আর সামি সাদীর বয়স সম্ভবত তের চৌদ্দ ছিল। ওরাও প্রমাকে খুব আদর করতো আর বেশ ক’দিনেই আমার অনুরাগী হয়ে পড়লো।প্রমাকে ধরে, স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে আমার কিছু জিনিষ এনে দিয়ে আমার উপকার করতো অনেক। আমি রান্না করলে তাকিয়ে থাকতো- বলতো “মা দেখো আনটি কিভাবে পেঁয়াজ কাটছে, একেবারে সেফের মতন।” কবীর ভাবী আবার হেসে কুটিকুটি হতেন আর বলতেন “যে ছুরি ধরতেই পারে না সে আবার সেফের মতন পেঁয়াজ কাটে কেমন করে?” আমাকে আড়াল করে বলতেন “ওরা দু’জনই তোমার ফ্যান বুঝলে, খুব পছন্দ করে তোমাকে।”

    প্রথম দিন বিকেলেই উনি রান্না ঘরের সবকিছু আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। উনার হাঁড়ি বাসন কোথায় থাকে, লবন চিনি কোথায় থাকে এবং ব্যবহারের অনুমতি দিতে ভুললেন না। অবশ্য সে রাতে উনি উনার রান্না করা খাবার আমাদের যত্ন করে খাইয়েছিলেন। আমি উনাকে কোনোদিনই ভুলব না, আরও যত্ন করে অনেক অনেক দোয়া করব।শুনেছি সাদী ডেনটিসট আর সামি ইনজিনিয়ার হয়েছে। নিশ্চিত বিয়ে সাদী করেছে, ওদের জন্যেও মন থেকে অনেক দোয়া চলে আসে।

    সেই বিকেলে আমি প্রমার জন্যে দুধসুজি রান্না করে খাওয়ালাম, বিদেশে এই প্রথম।খেতে একদম চাচ্ছিল না, কান্না করছিল কিন্তু ওই যে আমার জোর করা স্বভাব তাই ছাড়ছিলাম না। আর কোনোদিন এমনকি দাওয়াতে গেলেও ওকে না খাইয়ে আমি খেতাম না। সবাই বলতো “আপনি কেনো ঠান্ডা খাবার খান? আগে নিজে খান তারপর ওকে খাওয়ান।” আমার তা সইতো না আর তাছাড়া মনে হতো ওর ক্ষুধা জেনে আমি কেমন করে খাই? যাই হোক খাবার পুরোটা না শেষ হতেই সে বমি করে দিল। আমার চোখ দিয়ে সমানে জল গড়াচ্ছিল-কার্পেট পরিষ্কার করব,নাকি খাবার আবার রেঁধে খাওয়াব। কার্পেটে যদি দাগ পড়ে যায়! কবীর ভাবী হঠাৎ হাজির, বললেন চিন্তা কোরোনা পুরোনো কার্পেট দাগ পড়লে অসুবিধা নেই, পরে পরিষ্কার করলেও চলবে। অতঃপর সুজি মুখে দিয়ে চোখ বড় বড় করে হেসে ফেলে বললেন “ তুমি তো দেখি সুজিতে চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছো। ভাগ্যিস প্রমা বমি করেছে নইলে তো বিপদ হতে পারতো!”

    চলবে…

  • লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব-৪)

    লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব-৪)

    সকালে ঘুম ভাঙলো স্নেহার। সারা গায়ে প্রচন্ড ব্যাথা৷ কেন এমন ব্যাথা হচ্ছে সারা গায়ে। পাশে তাকিয়ে দেখে ফুয়াদ ঘুমাচ্ছে৷ কেন যেন আজ ফুয়াদের জন্য খুব খারাপ লাগছে৷ সে ভেবেছিলো ফুয়াদকে না জানিয়েই তার সব সমস্যার সমাধান করে নেবে৷ কিন্তু সে কোনো ভাবেই পারছে না৷ সে চায়নি ফুয়াদকে কোনোভাবে বিরক্ত করতে৷ এসব তাহলে কেন হচ্ছে তার সাথে? ভাবতে ভাবতে তার চোখ পড়লো, টেবিলে রাখা গ্রীস থেকে কেনা ডেকোরেশন পিস গুলোর দিকে৷ তার মনে পড়ে গেলো যে গল্পটা শুনেছিলো, সে গল্পটা ছিলো এমন।

    এক দেশে ছিলো এক অত্যাচারী রাজা আর এক নিরীহ রানী৷ তাদের ছিলো এক কন্যা সন্তান (রাজকুমারী)৷ সে রাজকুমারী খুবই সুন্দরী ছিলো৷ দূর দূরান্ত থেকে সে রাজ কন্যাকে দেখতে আসতো বিভিন্ন দেশের রাজকুমার। কিন্তু রাজা অত্যাচারী ছিল বলে, সে রাজকুমারীকে বিয়ে করার সাহস কারোর ছিলো না৷ এদিকে প্রতি সপ্তাহে রাজকুমারী শিকারে যেতো৷ সেখানে এক শিকারীর সাথে রাজকুমারীর পরিচয় হয়৷ এবং তাদেএ মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ রাজাকে তা বলার সাহস শিকারীর ছিলো না৷ তাই সে এবং রাজকুমারী মিলে সিদ্ধান্ত নিলো তারা এ রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাবে৷ শিকারী রাজকুমারীকে নিয়ে পালাতে গিয়ে রাজার সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে যায়৷ রাজা তাকে শাস্তি সরূপ একটি লোহার সিন্দুকে বন্ধি করে জলকুপের পাশের সুরঙ্গের ভেতরে ফেলে দেয়৷ এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারী সহ রাজা রানী এবং পুরো রাজসিংহাসন পাথর হয়ে যায়। আর শিকারীর মা পুত্রের সন্ধানে এসে কুয়ার পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে একসময়ে অন্ধ হয়ে পড়ে এবং সে ও একটা পাথরের মুর্তিতে পরিনত হয়৷

    স্নেহার নিয়ে আসা সে জিনিসগুলো সে কুয়ার পানি ব্যাবহার করেই বানানো৷ এটা জেনেই সে এ জিনিসপত্র কিনেছে৷

    হঠাৎ স্নেহার মাথায় এলো তাহলে এগুলোর জন্যই তার এসব সমস্যা হচ্ছে৷ সে ভাবছে সে এগুলো আজই ফেলে দেবে৷

    এরই মাঝে ফুয়াদের ঘুম ভেঙে গেলো৷ পাশে স্নেহাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, স্নেহা তোমার শরীর কেমন এখন? স্নেহার কপালে হাত দিয়ে দেখে, জ্বরে স্নেহার গা পুড়ে যাচ্ছে৷ তাড়াতাড়ি উঠে খাদিজা বুয়াকে ডেকে তার মাথায় পানি দিলো৷ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো৷ ডাক্তার সব শুনে তাকে মানসিক ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন৷ স্নেহাকে বাসায় ড্রপ দিয়ে ওষুধ খাইয়ে ঘুমাতে বলে ফুয়াদ অফিসে চলে গেলো৷

    সন্ধ্যায় স্নেহার ঘুম ভাঙলো। ঘুম ভাঙতেই স্নেহার চোখ গিয়ে পড়লো আবারও ওই টেবিলের দিকে৷ সে ভাবছে, এক্ষুনি সে টেবিলের ওই জিনিসপত্র ফেলে দেবে বাইরে৷

    একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে সে খুব ভয়ে ভয়ে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে টেবিলে রাখা রাজপ্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ খুব মন দিয়ে সে রাজকুমারীর চেহারার দিকে তাকাতেই দেখলো, রাজকুমারীর চোখ থেকে দু-ফোটা রক্ত ঝরে পড়েছে৷ এবার স্নেহা চেয়ারে বসলো৷ সে এখন দেখছে রাজকুমারী তাকে কিছু বলতে চাইছে৷ স্নেহারও দু-চোখ বেয়ে পানি পড়ছে৷

    এরই মধ্যে ফুয়াদ স্নেহার পেছনে এসে দাঁড়ালো৷ দেখে স্নেহা কাঁদছে৷

    কি হলো স্নেহা, তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে তোমার? কেন এমন করে কাঁদছো?

    ফুয়াদের কথা শুনে স্নেহা আরও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো৷ সে কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছে না৷

    ফুয়াদ স্নেহাকে ধরে বিছানায় এনে বসালো৷ ডাক্তারের কথা অনুযায়ী তাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে শুইয়ে দিলো৷

    রুবিনাকে স্নেহার পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো, আমি একটু আসছি৷ তুমি মেডামের পাশে বসে থাকো৷

    নীচে বন্ধু ফয়সাল এসেছে৷ তার সাথে স্নেহার ব্যাপারে কথা বলার জন্য। ফয়সাল একজন হুজুরের নাম বললো, নাম আতর আলী৷ সে নাকি অনেক জ্বিন পরী এসবের কাজ করে৷ বরিশালের এক অজপাড়াগাঁও তে থাকে৷ কোদালকান্দি গ্রামের পানিডুবা পাড়ায়৷ ফুয়াদ আর ফয়সাল স্নেহাকে সেখানে নিয়ে যাবার প্ল্যান করছিলো এবং সে সব নিয়ে আলোচনা করছিলো।

    রাত প্রায় আটটা বাজে তখন৷ মেডামকে ঘুমাতে দেখে রুবিনা ভাবলো এখানে আর বসে না থেকে মেডাম ঘুমাতে থাকুক, এই ফাঁকে সে কিছু কাজ সেরে আসবে৷ রুবিনা রুম থেকে বের হয়ে গেলো৷

    স্নেহা উঠে রাজপ্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷

    রাজকুমারী হাত বাড়াতেই স্নেহা তার হাত ধরলো৷ সে রাজকুমারীর সাথে রাজপ্রাসাদের ভেতরে ঢুকলো৷ আস্তে আস্তে করে কুয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ হঠাৎ সে দেখে কুয়ার ভেতর থেকে বিভৎস চেহারার কে যেনো তাকে ডাকছে৷ ভীষণ ভয় পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে রাজকুমারী নেই৷ তার পেছনে একটা গলা কাটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে৷ ভয়ে সে বিকট চিতকার করে উঠলো। তার চিৎকার শুনে ফুয়াদ দৌড়ে এসে দেখে স্নেহা জানালার গ্রীলের বাইরে হাত দিয়ে ঝুলে আছে৷ হাত বাড়িয়ে ফুয়াদ তাকে ধরে উপরে উঠিয়ে আনলো৷ স্নেহার পুরো শরীর থর থর করে কাঁপছে৷ ভিজে চুবচুবা হয়ে গেছে৷ ফুয়াদ অনেক যত্নসহকারে স্নেহাকে গোসল করিয়ে কাপড় বদলে বিছানায় এনে বসালো৷ এখন স্নেহা বলছে ফুয়াদ, আমি রাজকুমারীর কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিনা৷ রাজকুমারীকে বাঁচাও৷ ওই রাজকুমারী বেঁচে আছে৷ ওই শিকারী বেঁচে আছে৷ ফুয়াদ প্লিজ ওদের রক্ষা করো৷ বলতে বলতে স্নেহা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে৷

    এখন ফুয়াদ ভাবলো, এই জিনিসগুলো যত সমস্যার কারন৷ একটা প্যাকেটে সব গুলো জিনিস নিয়ে ফুয়াদ নীচে গিয়ে সব টুকরো টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো৷ রাতে খাবার খেয়ে সবাই শুয়ে পড়লো৷

    বাইরে চিল্লা চিল্লি শুনে সকালে ঘুম ভাঙলো ফুয়াদের।

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-১)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-১)

    আমাদের নিউজিল্যান্ড যাত্রা

    জীবন অতীব সুন্দর, বেঁচে থাকাটাই আজকাল চরম ভাগ্যের ব্যপার। দুঃখ কষ্ট হাসি আনন্দ নিয়েই জীবন তবে আনন্দ পেতে যদিও মানুষ ভালবাসে তা মস্তিষ্কে বহুদিন ধরে ধারণ করে রাখতে পারে না। ‌অনেক সময় অতীতে চোখ বুলালে সুখময় দিনগুলো সহজে নজরে আসে না। কিন্তু কষ্টের মধ্যে পড়লে অতঃপর মনে হয় আহা, কি সুন্দরই না অতীতের দিনগুলি ছিলো। উল্টোদিকে দুঃখ-কষ্ট মননে,মগজে প্রচন্ড আর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। মানুষ ওসব সহজে ভুলতে পারে না এবং সংগত কারণেই।প্রতিটি দুঃখ কষ্ট মানুষকে জীবন সম্পর্কে দারুন সব শিক্ষা দিয়ে যায় যা প্ররবর্তী জীবনে পথ চলাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। জানিনা জীবনের গল্প আনন্দে বা কষ্টে থাকার সময় বলা ভালো তবে এটা সত্যি মানুষ আনন্দে থাকলে স্মৃতি রোমন্থন করবার সময় সহসা পায় না।

    বড়কন্যা রাতের খাবারের সময় জিজ্ঞেস করলো তোমরা যখন প্রথম দেশ ছাড়লে মানে নিউজিল্যান্ড গেলে তার গল্প করো। অবশ্য আমাকে বলেনি তবু আমার মনে কত কিছু যে নাড়া দিলো। কোথা থেকে শুরু করব আর কোথায় শেষ?! আমার বয়স কম, মাত্র মা হয়েছি। দেশে থাকতে মা হবার আনন্দ অপার আর কাজ অত্যন্ত কম। বড়কন্যাকে মূলত দেখাশুনা করতো আমার মা মানে তার নানী, উপরন্তু নানাভাই ও কম যেতো না, সাথে খালা মামা। দাদা দাদী ফুপুদের থেকেও সে আদর কাড়তে পারতো নিঃসন্দেহে তবে আমাদের বাড়িতে প্রমা ছিলো প্রথম নাতনী। তার রাজত্ব ছিলো সর্বক্ষেত্রে আর প্রমার বাবার পোস্টগ্রেজুয়েশন পড়ালিখায় যাতে ব্যঘাত না ঘটে সে কারণে আমাকে বাচ্চা হবার সময় এবং তারপরও মাস ছয়েক বাবার বাড়িতেই থাকতে হয়েছিল। বড় নাতি বিধায় নানা নানুর ভালবাসা ছিল অপরিসীম আর প্রমারও টান নির্দিধায় বোধগম্য হতো।

    প্রমার জন্মের সময় আমরা ইমিগ্রেশন পেলেও প্রায় এক বৎসর দ্বিধাদ্বন্দ্বে কাটিয়ে দিলাম। কারণ ছিল প্রমার বাবার সরকারী চাকুরী। অবশেষ যখন সিদ্ধান্তে আসলাম যে যাব তখন খেয়াল করলাম আমাদের হাতে পয়সাকড়ি একেবারেই কম। আমি মাত্রই ইনটার্নশীপ শেষ করেছি আর প্রমার বাবা কয়েক বৎসর ইউনিয়ন জেলায় কাজ করবার পর ঢাকা মেডিক্যালে সি এ এবং রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করেছে। সংসার চালিয়ে সঞ্চয় করবার সুযোগ বা ইচ্ছা কোনোটাই তখন আমাদের ছিল না। কিছুটা অপরিপক্ক মানসিকতা নিয়ে কিভাবে যেনো মাত্র ১৪০০ ইউ এস ডলার হাতে নিয়েই আর পরিবার পরিজন সবাইকে ছেড়ে ছোট্ট এক বৎসরের প্রমাকে কোলে করে ভাঙ্গা মন নিয়ে ১৯৯৬ সনের অক্টোবর মাসে আমরা নিউজিল্যান্ডের বড় শহর অকল্যানডের উদ্দেশে রওনা করলাম। যদিও সেদিন চোখের জল মুছেছিলাম নিজের অজান্তেই কিন্তু বুকে আশারও কোনো কমতি ছিল না ভবিষ্যত সম্পর্কে। একটা কথা না বললেই নয় যে যাবার পূর্বে প্রস্তুতি স্বরুপ আমার লম্বা চুলগুলো কেটে ছোটো করে ফেললাম যাতে যত্ন নিতে কষ্ট না হয়। দেশের বাইরে সংসারের সব কাজ করে নিজের চুলের যত্ন নেবার সময় পাওয়া যাবে না এটা যেনো কিভাবে তখন মাথায় এসেছিল।

    আমাদের বিদায় দিতে আমার বাবা মায়ের যতটা কষ্ট হয়েছিল সেদিন, আমি নিশ্চিত প্রমাকে ছাড়তে তাদের ঢের বেশী কষ্ট হয়েছিল। প্রমা কথা শিখেছিল খুব তাড়াতাড়ি এবং তখন সে পুরোপুরি বাক্য সহকারে বাংলা বলতো। আমি বোধকরি খাওয়া নিয়ে বেশী জোরাজুরি করতাম বিধায় ওর প্রথম কয়েকটি বাক্যের মধ্যা একটি ছিল “ আর দিও না।” কি খাবে জিজ্ঞেস করলে বলতো” শশা খাব।” সে চৌদ্দ ঘন্টার পুরো পথই নানা নানু আর খালাকে খুঁজে কাটিয়ে দিলো। কোনো সাদা চুলের বয়ষক ভদ্রলোক দেখলেই চিৎকার করে ডাক দিতে থাকলো “নানাভাই?!!”

    চলবে…