Tag: ধারাবাহিক গল্প

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-২৭)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-২৭)

    পলি ডাইনিং টেবিলের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। পুরো একটা বড় খাসি দিয়ে সুন্দর করে ডিশ সাজিয়েছেন রিতা। তিন পদের মাছ, দুই পদের মাংস, সালাদ, সবজি, পোলাও, ডেজার্ট দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়েছেন তিনি।

    কলি বললো দেখেছিস খালার কান্ড! আমাদের নিজের খালা হলেও কি এমন করে আমাদের কেউ করতো!

    রিতা এসে ডাইনিং এ দাঁড়ালেন, বললেন কি রে কলি, কি গল্প হচ্ছে দুই বোন মিলে?
    – খালা এই চার/পাঁচ ঘন্টায় এতো কিছু কখন করলেন?
    – আরে, আমি সব কিছু আগে রান্না করে, বৌভাতে গিয়েছে। রহিম বাবুর্চির দায়িত্ব ছিল, আস্ত খাসি প্রিপিয়ার করা। এটা তোমার খালুর শখ।
    – খালু কোথায়?
    – জামাইয়ের সাথে গল্প করছে। ও তো খুব আড্ডা প্রিয় মানুষ। মুখ বন্ধ করে থাকতে পারে না। বেয়ান সাহেব, তোমার মা, কেন আসলেন না! মন টা খারাপ লাগছে। জাহিদ ও নাকি বাজারে, সাথে শাহিদ ও। জলিও আজ চলে গেল।
    – জলিপা, বিয়ের দিন চলে যেতো। আমরা জোড় করায়, এতো দিন থেকেছে। তার বাড়ীতে নাকি কে মেহমান রেখে আসছে।
    – তোমাদের ভাবী, জাহান, তার নাকি শরীর খারাপ লাগছে। আসবেনা।
    – ওহ।
    – ননদের জামাইয়ের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছে হয়তো। আইরিন, তারিন আসবে।
    – ভালো হয়েছে।

    আবিদ খুব লজ্জা পাচ্ছে, তাদের বড় পরিবার। খুব হিসেব করে চলেন তার আব্বা। এতো পদ সে কখনোই এক সাথে দেখে নি।

    সে খুব আড়ষ্ট হয়ে বসে বসে খাচ্ছে। পলির আজ মনে হচ্ছে সে তার আপন খালার বাসায় খাচ্ছে। কলি, নাহিদ, খালার দুই ছেলে-মেয়ে খুব হৈ চৈ করছে দুলাভাই নিয়ে।

    পলি যে রুমে থাকবে, সেখানে এক গুচ্ছ রজনী গন্ধা খাটের পাশে ফুলদানী তে রেখেছেন রিতা। বিছানায় সাদা রঙের সুন্দর চাদর। গোলাপ ফুল দিয়ে হার্ট সেইপ করে, ভিতরে লিখেছেন এ+পি।

    খাটের পাশে এক জগ পানি, এক টি গ্লাস উল্টো করে পিরিচ দিয়ে রাখা। ওয়াশ রুমে টাওয়াল পর্যন্ত  রাখা।

    পলি শুধু খালাকে দেখছে, আর ভাবছে এই মানুষ কত সৃজনশীল। রজনীগন্ধার সুবাসে মৌ মৌ করছে, পুরো বাড়ী। পলির এই সুগন্ধ খুব পছন্দ। যদিও আবিদের বাসায় কোন খাট সাজানো হয়নি, কিংবা কোন ফুল ও ছিল না। এখানে দেখে, খুব ভালো লাগছে তার।

    সকাল বেলা আকাশী রঙের একটা রাজশাহী সিল্ক শাড়ী এনে  পলিকে দিলেন রিতা। এটা নাকি গত মাসে তিনি, তার দেবর কে দিয়ে আনয়েছেন। একটা তার জন্য,  অন্যটি পলির জন্য। রিতা বললেন আশা করে, তোমার পছন্দ হবে পলি।
    – খালা, আপনি যে কত ভাবে ঋণী করছেন!
    – কি বলো পলি? তোমাদের মতো এতো মিষ্টি দুটি মেয়েকে সবাই খুব আদর করবে। আর পলি, প্রফেসর সাহেবেরব পরিবারের মানুষ একটু হিসেব করে চলেন, তুমি তাদের সাথে মানিয়ে নিবে, এক সময় আস্তে আস্তে তারাও ঠিক হয়ে যাবে।
    – জি খালা।

    রাহেলা বেগম দুই পদের মাংস রাম্না করেছেন, রুই মাছের দোপেয়াজা, চিংড়ি মাছ ভুনা, কই মাছ ভুনা, সবজি, পোলাও, সালাদ সব তিনি রান্না করেছেন। বাজার করেছে জাহিদ। এখন তিনি বেরেস্তার জন্য পেঁয়াজ কাটছেন। ঘড়িতে বারো টা বাজে, এখনই হয়তো পলি জামাই নিয়ে আসবে। কলি ও নেই এখানে। এক হাতে গ্যাসের চুলায় খুব ঝামেলা হয়ে যাচ্ছে তার।

    শারমিন দরজার সামনে এসে বললেন, মা কি এখন পেঁয়াজ কাটছেন? রান্না কি করবেন? একটা সহজ রাস্তা আছে, মোরগ পোলাও করে নিন, সাথে ডিম ভুনা সালাদ। অনেক ভালো হবে। শর্টকাট।
    – আমার রান্না শেষ মা। এখন বেরেস্তার জন্য পেঁয়াজ কাটছি।
    – রান্না শেষ?
    – হ্যা
    – আমার একা একা জিহান কে নিয়ে খুব ঝামেলা হয়ে যায়। ও নেই, এজন্য রাতে ঘুম হয়নি।
    – সমস্যা নাই, মা। রেস্ট নাও।

    শারমিন ঢাকনা খুলে খুলে সব দেখছে। দেখে বললো,
    মা, এতো কিছু করেছেন কেন? কাল দুপুর পর্যন্ত থাকবেন, রাতের রান্নার জন্য রাখতেন কিছু বাজার।
    – না, মা। জাহিদ-শাহিদ সন্ধ্যার পর চলে যাবে। আমি আর নাহিদ কাল সকালে যাবো। আমি, তোমাদের পরিবারের সবাইকে দাওয়াত করেছি আসার জন্য!
    – না, ওরা হয়তো আসবেনা, ব্যস্ত তো অনেক। আম্মা আসবেন বলেছেন।

    আবিদ বসার ঘরে বসে দুধ শরবত খাচ্ছে। পলিকে আকাশী রঙের রাজশাহী সিল্কে দারুন স্নিগ্ধ লাগছে।

    শারমিন এসে বললেন আবিদ ভাই, নাকি আজ থাকবেন না?
    – কাল বাড়ী যাবো ভাবী।
    – আমরা মাছ কবে খাচ্ছি? কখন বাজারে যাচ্ছেন।
    – জি, একটু পরে যাবো।

    রাহেলা বেগম বললেন, না না জামাই এবার থাক, আগামী মাসে এলে বাজার করবে।
    – না, আমি বাজারে যেতাম এখনই।
    – থাক, আজ তো সময় কম।

    আবিদ যেন হাঁফ ছেড়ে বসলো, হয়তো লজ্জায় সে বাজারে যেতে বলেছে। কারণ সে চিন্তা করেছে শ্বশুর বাড়ীতে আগামী মাসে গেলে বড় করে বাজার করবে। এখানে, বাজার করার সময়ই নাই।

    সাহেদা খানম, রান্নাঘরে গিয়ে বললেন, বেয়ান নতুন জামাই কত কেজী মিষ্টি নিয়ে এসেছে?
    – এনেছে অনেক।
    – প্যাকেট দেখছি মাত্র পাঁচ টা, সব কি বিলি করে দিয়েছেন নাকি?

    শারমিন বললো, কিপটা নাম্বার ওয়ান, ফেরা যাত্রায় এসেছে মাছ বাজার নাকি পরে করবে!
    – বলিস কি?

    রাহেলা বেগম বললেন, আমি না করেছি। এখন বাজার এনে, খাওয়ার সময় কোথায়? থাকবেনা যখন থাক। পরবর্তীতে আনবে। আর মিষ্টি পাঁচ কেজী এনেছে, দই দুই পাতিল এনেছে। আর এনে কি করবে?
    – পাড়া-প্রতিবেশী আছে না?
    – আমরা যাদের চিনি, তাদের জন্য অনেক বেশি হয়েছে।

    কলি অবাক হয়ে দেখছে রাহেলা বেগম আজ বেয়ানের সাথে বেশ কড়া হয়ে কথা বলছেন। সাহেদা খানমের মতো মানুষ দের মাঝে মাঝে কথা শোনানোই  উচিত।

    আজকে পলি বিদায়ের সাময় মায়ের গলা জড়িয়ে খুব কান্না করছে, আর বলছে আজ মনে হচ্ছে, বিয়ে করে চলে যাচ্ছি। তুমি আবার কবে আসবে মা, কবে!

    রাতের বেলা, সাঈদ অফিস থেকে আসলো বাসায়। রাহেলা বেগম ছেলেকে দেখে বললেন, কি রে তুই?
    – কাল সরকারি বন্ধ, তাই ছুটি। এজন্য এসেছি।
    – আলহামদুলিল্লাহ, দেখা হয়ে গেল।
    – জাহিদ-শাহিদ কোথায়?
    – বাড়ী চলে গিয়েছে। আমি আর নাহিদ কাল যাবো।
    – কলি বাড়ী যাবেনা?
    – কলির মাস্টার্সে ভর্তি হবে।
    – এখন ও রেজাল্ট হওয়ার বাকি, এখন এখানে থেকে কি করবে?
    – যুবায়ের ভাই, থাকতে বলেছেন। টাইপিং এর কাজ শিখেছে, সেখানে কাজে লাগিয়ে দিবেন।
    – মা, আমার তো লজ্জা লাগে, খালুকে, খালাকে যেভাবে প্রতিনিয়ত ডিস্টার্ব করছো তোমরা।
    – বাবা, উনি মন থেকেই আদর করেন।
    – আমি কি আমার শালীর মেয়ের ননদ দের ইচ্ছে করে জায়গা দিতাম, তোমরা করকতে বাধ্য করছো ।

    কলি সাথে সাথে বললো ভাইজান, আমি কাল বাড়ী চলে যাবো। আপনি চিন্তা করবেন না।
    – তুই বড় বেয়াদব হচ্ছিস। বড় দের মাঝে কথা বলিস।

    রাহেলা বেগম নিচের দিকে তাকিয়ে আছেব, কি করবেন তিনি? সত্যি কি তিনি আর তার মেয়েরা রিতা কে বেশি ঝামেলায় ফেলে দিচ্ছেন? নাকি তিনি মন থেকে করছেন? কেন জাহিদ চলে গেল আজ, সবাই এক সাথে কাল গেলেই ভালো হতো। তিনি কি করবেন কলিকে নিয়ে, চিন্তায় পরে গিয়েছেন…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ১৫.০১.২০২২

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-২৬)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-২৬)

    কলি দুই ঘন্টা ধরে কেঁদেই যাচ্ছে, চোখ দুটি লাল হয়ে গিয়েছে। ওড়না দিয়ে বার চোখ মুছে যাচ্ছে কলি।

    রিতা খানম বললেন, এই কলি এরকম কেন কাঁদছো?
    বোন মানেই তো এক বালিশে থাকলেও একদিন এক দেশেও থাকা হয়না। বছর চলে যায়, কাছে বসে গল্প হয়না।
    – আপা।শুধু আমার বোন ছিল না, ছিল আমার অভিভাবক, আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু।
    – বোন বিয়ে হয়েছে রে মা, এটা মানতে হবে। এক কাজ কর, মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হও, আমি নাহিদ আর তুমি তিনজন মিলে পলি কে দেখে আসি। তাহলে, তোমার মন কিছুটা ভালো হবে।

    কলি নিমিষেই দৌড়ে ওয়াশ রুমে চলে গেল। সে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে।

    আবিদের বাসা মানুষ গিজগিজ করছে। কলি৷ তাদের বসার ঘরে সোফায় বসে আছে। আবিদ এসে কথা বলছে সবার সাথে।

    কলি আস্তে করে বললো খালা, আপা কোথায়?
    – একটু অপেক্ষা কর, নতুন বউ।

    আবিদ বললো খালা চলেন ভিতরে, পলি ভিতরের রুমে আছে। নাহিদ চলো?
    – আপনারা যান, আমি আসছি।

    কলি এই কথা শুনেই, দাঁড়িয়ে আবিদের পিছন পিছনে যাওয়া শুরু করলো।

    এল শেইপের বাড়ীটির একদম শেষের ঘর টা পলির। নতুন রুম এটাই, যেটা পলির জন্য তৈরী করা হয়েছে।

    পলি খাটের এক কোনায় বিয়ের সাজেই বসে আছে। কলিকে দেখেই চমকে উঠে, জড়িয়ে ধরেছে। কলি আবারও শুরু করেছে কান্না।

    রিতা খানম বললেন আর আরেক বার কান্না করবে, আমি চলে যাবো। এসেছো বোন কে দেখতে এসেছো, কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাবে, কান্নার জন্য নয়।

    আবিদ বললো তোমরা দুই বোন গল্প কর, আমি বাইরে আছি।
    – না, আপনি থাকেন দুলাভাই?
    – না, আসছি।

    কি রে, চোখ মুখ কান্নাকাটি করে, তো লাল করে ফেলেছিস।
    – তুই তো আনন্দে আছিস আপা, নতুন সবকিছু। আমি তো জানি আমার কেমন লাগছে।
    – আমি আমার সব মানুষ কে ছেড়ে নতুন জায়গায় এসেছি। তাছাড়া এরা সবাই কথা কম বলে, দেখা করে করে, যার যার রুমে চলে গিয়েছে।
    – তাই?
    – এই যে এতো মেহমান কিন্তু কেউ এই রুমে আসছেনা। যার যার গল্প করছে। আমাকে একটু দেখেই চলে যাচ্ছে।
    – আবিদ?
    – উনি রুমে আসছেন, যাচ্ছেন। নতুন জামাই লজ্জা পাচ্ছে।
    – আস্তে আস্তে ঠিক হবে। প্রফেসর সাহেব মানুষ খুব ভালো।

    কলি আস্তে করে বললো আপা, তুই বৌভাতের পরে কি এইখানের বাসায় যাবি, নাকি বাড়ী?
    – কি করে বলি বল? এখনই এগুলো বলি কেমনে? আচ্ছা, কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?

    – না রে আপা, মা চায়, তুই দুলাভাই নিয়ে বাড়ীতে যাবি।
    – ভাবী কিচ্ছু বলেছে?
    – আরে না।

    ট্রে হাতে, আবিদের বোন রুমি এসে রুমে ঢুকলো। বললো আপনারা নাশতা খেয়ে নিন।

    রিতা বেগম বললেন কেমন আছ তুমি?
    – জি ভালো আছি।
    – বসো।
    – না, ঠিক আছে।
    – কিসে পড়?
    – ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিজিক্সে মাস্টার্সে পড়ছি।
    – তুমি কি আবিদের ইমিডিয়েট ছোট?
    – না, আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই, আরিফ ভাই, মেডিকেলে ইন্টার্নশীপ করছে।
    – আচ্ছা।
    – আসি আন্টি, নাশতা করেন।

    পলি দেখলো ট্রে তে এক প্লেটে মিষ্টি, তাতে দুটি চা চামচ দেওয়া। এক গ্লাস পানি, দুটি বাটি।

    মানুষ তিন জন বাটি দুটি, পানির গ্লাস একটি, মিষ্টি কি কেউ চা চামচ দিয়ে খায়? পলি ভাবছে, এরা মেধাবী হয়েছে সত্য, কিন্তু রুচিশীল হয়নি, এমন কি মেহমানদারী ও ঠিক মতো জানে না। এর চেয়ে জলিপার বাড়ীর মানুষ এতো শিক্ষিত না হোক, কিন্তু শিষ্টাচার এদের চেয়ে ভালো জানে।

    কলি বললো আপা, আমি মিষ্টি খাবো না। আমার মন একদম ভালো নেই, বিশ্বাস কর।

    রিতা বললেন কি কলি, তুমি কি পলির মন খারাপ করতে এখানে এসেছো? তবে এক্ষুনি চলো।
    – না খালা, আর আমি কিছুই বলছিনা।

    পলি বললো খালা, মিষ্টি নেন।
    – নিব, নতুন বউ এতো চিন্তা করেনা।

    পলি শোন, শ্বশুর বাড়ী প্র‍থম এক বছর, হলো পরীক্ষা কেন্দ্র, সুতরাং পরীক্ষায় যেমন কোন প্রশ্ন কমন না পড়লেও আনসার করতে হয়। এখানেও তেমন ভালো না লাগলেও সব সুন্দর করে মেনে নিতে হয়, নিজের ভালো গুন গুলি তুলে ধরতে হয়। এক বছর তুমি সবার জন্য কর, সারাজীবন তারা তোমার জন্য করবে, ভালবেসেই দেখো একবার, উজাড় করে ভালবাসা পাবে।
    – জি খালা, অবশ্যই চেষ্টা করবো।
    – আজ আসি। আর ভালো থাকবে, কাল দেখা হবে।

    পলিকে অবাক করে দিয়ে, আবিদ কি সুন্দর একটা পাথর বসানো স্বর্ণের আংটি গিফট করলো, সাথে এক জোড়া গোলাপ।

    পলি মনে মনে খুব খুশি হয়েছে, হায়, এই চুপচাপ মানুষের ভিতরে এতো রোমান্টিকতায় ভরপুর!
    বোঝাই দায়!

    বৌভাতের দিন, সুন্দর করে শামিয়ানা টানানো হয়েছে। পলি কে সুন্দর করে সাজিয়ে দিয়েছে, তার মামী শ্বাশুড়ি। খুব স্নিগ্ধ লাগছিল পলিকে। আবিদ বার বার এসে বৌকে দেখা যাচ্ছিলো। আবিদ কে দেখলেই হাসি লাগছে পলির, লুকিয়ে দেখতে এসে বার বার ধরা পড়ছে সে।

    রাহেলা খানম তার পরিবার, তার ভাইয়ের বউ, সাঈদের শ্বশুর বাড়ীর লোক, তার কিছু কলিগ, আর রিতা খালার পরিবার নিয়ে অনুষ্ঠানে গেলেন। এদিকে তার মাথায় ঘুরছে তারা কি আজ বাড়ী যাবে নাকি?বাসায় যাবেয?

    সব চিন্তা দূর হয়ে গেল পলির হাসি মাখা মুখ দেখে, আবিদ তাদের খুব যত্ন নিচ্ছে। প্রফেসর সাহেব বার বার সবার খোঁজ নিচ্ছেন।

    কলি এসে বলছে আপা, আজ তোকে বিয়ের দিনের চেয়েও বেশি স্নিগ্ধ লাগছে। দুলাভাই লোকটা ভালই মনে হচ্ছে।

    শারমিন এসে পলির পাশে বসে বললো , আম্মা তোমাকে ফার্নিচার দিয়েছেন, বললে না তো!
    – আম্মা দেন নি ভাবী, আমার শ্বশুর বানিয়েছেন।
    – তাই?.
    – হ্যা,, এবং এই রুম সাথে এটাচ বাথরুম বানিয়েছেন নতুন করে।
    – ভালো, ভালো।

    শারমিন ঘুরে ঘুরে দেখছেন তাদের বাড়ী। এতো ঝকঝকে না হলেও বেশ ভালো তাদের বাড়ী।

    খাওয়া দাওয়ার পরে, রাহেলা খানম বললেন, বেয়াই সাহেব, আমার মেয়ে-জামাই কবে আমার বাড়ী যাবে?
    – দুই দিন গিয়ে থাকার মতো সময় ছেলের নাই, ছুটি কম।
    – আমি তো আমার বাড়ীতে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম।
    – আগানী মাসে ছটিতে এলে, বাড়ী যাবে। আমার মা, গ্রামে থাকেন। এখানে আসার মতো শক্তি নেই। নাতি বউ দেখবেন, আশা করেছেন। আমি পড়শু দিন যাবো, গ্রামে সব আত্নীয়রা আসবেন।আগামীকাল আপনাদের বাসায় যাবে, সারাদিন থেকে সন্ধ্যায় চলে আসবে। কথা দিলাম, আগামী মাসে আসলে দিন চারেক থেকে আসবে, বউমা আর আবিদ।

    শারমিন সাথে সাথে বললেন আগামী মাসে কিন্তু অবশ্যই দিতে হবে।
    – হ্যা। মা, অবশ্যই দিব।

    রিতা বললেন, বেয়াই সাহেব, আমি কিন্তু উকিল মা, আমি আজ আমার মেয়েকে আমার বাসায় নিয়ে যাবো।
    – আজ সারাদিন কত প্রকার ঝুট ঝামেলা গিয়েছে, আজ রেস্ট নিবে। কাল…
    – নতুন বর কনের সময়ই তো এখন ঘুরার। আপনার বেয়াই তো আমাকে নিয়ে বৌভাতের রাতে কক্সবাজার গিয়েছিলেন।
    – আচ্ছা ঠিক আছে, আপনার উকিল মেয়ে আপনি নিয়ে যান।

    শারমিন বললো খালা, কাল দুপুরে কিন্তু আমার ননদ বাসায় পাঠিয়ে দিও।
    – দেখা যাক।

    কিছু কিছু সময় অনেক কিছু না হলেই ভালো হয়। এই মুহুর্তে বাড়ী যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই, পলি গিয়ে থাকবে, শারমিনের ও পছন্দ নয়। যাক, আল্লাহ ভালো একটা ব্যবস্থা করেছেন।

    যতই দিন যাচ্ছে, ততই রিতা বেগমের কাছে ঋণী হয়ে যাচ্ছেন, রাহেলা। পলি আজ যেতে না পারলে মন টা কত খারাপ হয়ে যেতো। কি সুন্দর ব্যবস্থা হয়ে গেল।

    রাহেলা খানম মনে মনে জাহিদ কে খুঁজছেন, এখান থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পরই জাহিদ কে বাজারে পাঠাতে হবে, কালকের আয়োজনের জন্য। মেয়েকে দেখে, জামাই দেখে খুব আনন্দ লাগছে রাহেলার। কিন্তু এখন মন অন্য জায়গায় আছে, কি ভাবে সুন্দর করে করা যায় কালকের দিন টি, এই চিন্তা লাগছে তার….

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ১৩.০১.২০২২

  • সময় একমাস (শেষ পর্ব-৬)

    সময় একমাস (শেষ পর্ব-৬)

    ভয়ে দিশেহারা হয়ে রোজি চিৎকার করে উঠল, ভুত! ভুত!
    বখতিয়ারের হাতের লাঠি পড়ে গেল । চোখ তুলে তাকা্লো, সেই চোখে আলো জ্বলছে ।
    দুজনে দৌড় মেরে পাশ কাটিয়ে চলে গেল । কিছুটা পথ পেরিয়ে আসার পর দেখল সামনে তারকাটার বেড়া। পেছন ফিরে তাকালো মঈন । দেখতে পেল অনিতা শহীদ, বখতিয়ার আরো অনেকে হাত বাড়িয়ে ওদের পেছন পেছন আসছে।
    মঈন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমাকে মের না শহীদ ভাই, আমাকে ক্ষমা কর।
    শহীদ বলল, তোমাকে ক্ষ্মা করা যাবে না ”
    ” আমি তো তোমাদের কোনো ক্ষতি করিনি ।”
    ” তুমি আমাদের পরিচয় জেনে ফেলেছ। তোমাদের মরতে হবে।”
    ” না শহীদ ভাই, এভাবে আমাদের মেরনা ”
    ওরা এগিয়ে আসছে । রোজি বলল, শিগগির তার কাটা পার হয়ে হয়ে যান।
    মঈন তারকাটা পেরিয়ে যাবার চেস্টা করল। হঠাৎ কে যেন ওদের ধাক্কা মারল। মঈন পড়ে গেল তার কাটার ওপর। রোজি হুমড়ি খেয়ে পড়ল মঈনের শরীরের ওপর। মঈন চিৎকার করে উঠল।
    রোজির হাত ছিলে গেছে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে বলল, তাড়াতাড়ি উঠুন।
    মঈন বলল, আমার চোখ—–
    ” কি হয়েছে আপনার চোখে ”
    ” আমার চোখে তারকাটা ঢুকে গেছে ”
    ” উহ মা, এখন কি হবে ”
    ” আমি অন্ধ হয়ে গেছি রোজি ”
    ” না , এ কিছুতেই হতে পারে না।”
    মঈন আর পালাবার চেস্টা করে না । দুহাতে চোখ চেপে ধরে সে কাঁদছে। শহীদ , বখতিয়ার, অনিতা সবাই হাসছে। প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে সেই হাসি। এগিয়ে আসছে ওরা । এক পা দুই পা করে।
    হঠাৎ টর্চের আলো পড়ল রোজির শরীরে। কারা যেন আসছে। সেই টর্চের আলোয় দেখতে পেল প্রেতাত্মারা বাতাসে মিলিয়ে গেছে। কারো কোনো সাড়া নেই।
    আলো জ্বালিয়ে বুয়া এলো । মঈনের চোখ গড়িয়ে আসা রক্ত দেখে সে বিস্মিত হয়ে বলল, কি হইছে ভাইজান। আপনার চোখে রক্ত ক্যান ?
    মঈন উত্তর দিল না। সে অনুভবে বুঝতে পারে দূরে দাঁড়িয়ে আছে জ্যোতিষী মা। তিনি স্নেহময়ী কন্ঠে বলছেন , ভাগ্যকে কেউ বদলাতে পারেনা বাছা । যা লেখা আছে ঘটবেই। এক মিনিট আগেও না এক মিনিট পরেও না।

    সমাপ্ত

  • সময় একমাস (পর্ব-৫)

    সময় একমাস (পর্ব-৫)

    মঈন দৌড় শুরু করল। মরন পন দৌড় ।কতটা পথ যে দৌড়ে এসেছে সে দিকে খেয়াল নেই। ওর পেছন পেছন কে যেন আসছে। দেখার মত সাহস নেই। এখনো সাঁকোর কাছে আসতে পারেনি । অথচ আসবার সময় সাঁকো থেকে বিল বেশি দূর মনে হয় নি। সে কি ভুল পথে এসেছে?
    মঈন আর দৌড়াতে পারছে না। তার খুব ক্লান্ত লাগছে। হাঁপানি রুগিদের মতো করে শ্বাস টানছে। ঘামে ভিজে গেছে শরীর। একটু পানি প্রয়োজন, একটু বাতাস প্রয়োজন। মঈন মাটিতে শুয়ে পড়ল। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। কে যেন ওর কাঁধে হাত রাখল । চমকে উঠে মঈন বলল, প্লিজ অনিতা আমাকে মেরোনা , আমাকে —–
    কথা শেষ করার আগেই দেখল হারিকেন হাতে পাহারাদার বখতিয়ার দাঁড়িয়ে আছে । নতুন আশায় , ভালোলাগায় মনটা ভরে গেলো।
    মঈন বলল, তুমি হঠাৎ কোথায় গিয়েছিলে?
    ” আমি কোথাও যাই নি”
    “যাওনি মানে কি ?’
    ” আমি বাড়িতেই ছিলাম ”
    ” কিন্তু আমি, তুমি আর অনিতা একসাথে বিল পর্যন্ত গিয়েছিলাম ”
    ” আমি কোথাও যাইনি সার ”
    ” আমি এখন কোথায় ? ?
    ” মাঠে ”
    ” মাঠে মানে কি ? আমার স্পস্ট মনে আছে আমি সাঁকো পেরিয়ে অনেক পথ গিয়েছিলাম । বাড়ি কতদুর বখতিয়ার ?’
    “ঐ তো বাড়ি’
    সব কিছু অবিশ্বাস্য লাগছে। মঈন বুঝতে পারছে না কিছুই। ঘরে এসে পানি খেয়ে শুয়ে পড়ল । বিছানায় শুয়ে মনে হলো জ্বর আসছে। প্রচন্ড ভয় পেলে জ্বর আসে। পাঁচ দিন সেই জ্বর থাকল ।বুয়া বেশ যত্ন করেছে এই পাঁচদিন ।
    শেষ বিকেলে বারান্দায় বসে আছে মঈন। শরীর এখনো ক্লান্ত । বুয়া এক কাপ চা মঈনের হাতে দিয়ে বলল, ভাইজান , আপনি আর কয়দিন থাকবেন ?
    ” জানিনা। ”
    ” আপনি বলেছিলেন একমাস থাকবেন । আজ একমাস শেষ হলো ”
    বুকের ভেতর উত্তেজনা অনুভব করে মঈন। তারমানে আজকের দিনটা পার করতে পারলেই তার বিপদ কেটে যাবে। মঈন চেয়ার ছেড়ে পায়চারি করতে শুরু করে। দূরে তাকাতেই দেখল একটি মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অনেকটা চেনা চেনা লাগছে । মঈন এক পা দু পা করে কাছে এলো। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি কি রোজি ? দবির চাচার মেয়ে ?
    মেয়েটি বলল, জি । আপনাকে তো জিনতে পারলাম না
    ” আমি মঈন। ঢাকায় থাকি। চাকরি করি আল আরাফাহ ইসলামী ব্যংকে । আমি এই গ্রামেরই ছেলে। এই বাংলোতে আছি ।
    রোজি অবাক হয়ে বলল, এই বাংলোতে ?
    “জি , চমকে উঠলেন কেন ? ”
    ” কারন আছে। আপনি আমার দিকে একবার ভালোভাবে তাকান ”
    “কেন ?’
    ” পরে বলছি ”
    রোজি চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে তো মানুষই মনে হচ্ছে । কিন্তু এই ভুতুড়ে বাড়িতে আপনি একা কিভাবে আছেন ?
    ” ভুতুড়ে বাড়ি মানে কি ? ”
    ” শহীদ ভাই মারা যাবার পর এই বাড়ি ভুতদের দখলে চলে যায় ”
    “শহীদ ভাই মারা গেছে মানে কি ? ”
    ” কেন আপনারা জানেন না । প্রায় এক বছর হলো উনি মারা গেছেন। বাবা আপনাদের চিঠি লিখে জানিয়েছিল । আপনারা কি সেই চিঠি পাননি ? ”
    ” রোজি, আপনি এসব কি বলছেন । শহীদ ভাই মারা যাবে কেন । সেতো এখনো এই বাংলোতে আমার সাথেই থাকে । পাহারাদার বখতিয়ার, বুয়াও থাকে ।”
    ” বিশ্বাস করেন শহীদ, বখতিয়ার দুজনেই ডাকাতের হাতে মারা গেছে । আপনি এখনি আমার সাথে চলুন আমাদের বাড়িতে । সেখানে
    আজ রাত থেকে কালকেই ঢাকা চলে যাবেন ।”
    রোজির পায়ের দিকে তাকালো মঈন । ওর পা মাটি স্পর্শ করে আছে । একে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু মন থেকে দ্বিধা কাটেনা । সেই দ্বিধা নিয়ে ঘরে এলো । দ্রুত ব্যাগ গুছিয়ে নিয়ে প্যান্ট পরলো। অভ্যাস বসত ডাকল, শহীদ ভাই ?
    সাথে সাথেই উত্তর এলো , জে
    রোজি কাছে সরে এলো ভয়ে। খামচি মেরে মঈনের হাত ধরে আছে। মঈন ভাবল বড্ড ভুল হয়ে গেছে। শহীদ সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
    মঈন বলল, আমার জুতো জোড়া বের করে দাও ।
    শহীদ নীচু হয়ে জুতো বের করছে। নীচ থেকে লুঙ্গী সামান্য সরে যেতেই দেখল শহীদের পা শুন্যে ভাসছে। রোজি মুখ চেপে রেখেছে নিজের। চিৎকার করা যাবেনা । ভয়ার্ত চোখে মঈনের দিলে তাকালো। মঈন এতক্ষনে বুঝল কেন শহীদ নীচু করে লুঙ্গী পরে। তাহলে তো বখতিয়ারও —— !!
    কিসের যেন শব্দ হচ্ছে। পাথরের ওপর লোহা ঘষলে যেমন শব্দ হয় অনেকটা সেরকম। কেউ কি অস্ত্র ধার দিচ্ছে? মঈন কোনো কথা না বলে জুতো পরতে শুরু করল। যত দ্রুত সম্ভব এই ভুতুড়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে । উত্তেজনায়, ভয়ে ওর হাত পা কাঁপছে । জুতোর ফিতে লাগাতে গিয়ে দেখল ফিতে নেই।
    রোজি ফিস ফিস করে বলল, তাড়াতাড়ি করেন ।
    ” ফিতে খুজে পাচ্ছি না ”
    ” তাহলে ফিতে ছাড়ায় চলেন ”
    মঈনের হাত ধরে টান দিল রোজি। আর এক মুহূর্ত এই বাংলোতে নয়। বাইরে এসে দেখল বখতিয়ার বারান্দায় বসে আছে। সে মেঝে থেকে শুন্যে বসে আছে। সে মানুষ নয় । সে যেন এক লম্বা চওড়া দৈত্য । মঈন কে দেখে সে দাড়ালো, লুঙ্গিতে ওর পা ঢাকলো। ওকে পাশ কাটিয়ে ওরা দুজন এগিয়ে গেল। কয়েক পা এগোতেই মঈন চমকে উঠল । তার শরীর কাঁপছে । কারন সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিলের সেই মেয়ে অনিতা।

    চলবে…

  • সময় একমাস (পর্ব-৪)

    সময় একমাস (পর্ব-৪)

    মঈন বলল, কে , কে ওখানে ?
    ” আমাকে বাঁচান ভাই ” মেয়েটি কাতর কন্ঠে বলল।
    মঈনের মন দয়ায় ভরা । মেয়েটিকে বাঁচাতে সে বাইরে চলে এলো । আজ কোনো পচা গন্ধ পাচ্ছে না । আগরবাতি জ্বালানোর গন্ধ পাচ্ছে। রাতে নিশ্চয় বুয়া জ্বালিয়েছে , ভাবে মঈন।
    মেয়েটি আবার বলল, আমাকে বাঁচান ভাই
    ” কি হয়েছে বলুন তো ”
    ” কাজ শেষে বাড়ি যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দুজন লোক আমার পিছু নেয় ”
    ” আপনি কি কাজ করেন ।”
    ” আমি নার্স , হাসপাতালে চাকরি করি ”
    ” সরি, আপনার পোষাক দেখেই বোঝা উচিত ছিল, কিন্তু হাসপাতালের পথ ছেড়ে এদিকে কেন ?”
    ” ভয়ে দৌড় দিয়ে কোন দিকে যে এসে পড়েছি খেয়াল করিনি ”
    ” আপনার নাম কি ”
    ” অনিতা ”
    ” আমি আপনার জন্য কি করতে পারি ?”
    ” আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন ”
    ” আপনি থাকেন কোথায় ?’
    ” কলিগ্রাম ”
    “সেতো অনেক দূর ”
    ” আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিন ভাই ”
    ” আপনি বরং এক কাজ করেন। আজ রাতটা এখানেই থেকে যান। কাল সকালে আপনি নিজেই চলে যেতে পারবেন ”
    “বাড়ির সবাই চিন্তা করবে ”
    ” কিন্তু এতো রাতে যাওয়া কি ঠিক হবে ?”
    ” এই উপকারটুকু করে দিন ভাই ”
    পাহারাদার কে সাথে নিয়ে মঈন আমবাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটছে। কিছুটা পথ আসার পর ওরা ধান ক্ষেতের আইল ধরে চলা শুরু করল ।
    অনিতা বলল, সামনে একটা সাঁকো পড়বে। বাঁশের সাঁকো । পার হতে পারবেন তো ?
    ” জ্বি পারব ”
    মুখে জোর দিয়ে বললেও পায়ের তলা শির শির করে উঠল। জীবনে সাঁকো পার হয় নি । মঈন সাঁকোর কাছে এসে দাঁড়ালো । ছোট্ট খাল বারো চৌদ্দ ফুট লম্বা। খাল পানিশুন্য , আগাছায় ভরা ।
    মঈন ডাকল, পাহারাদার ?
    ” জে সার ”
    “তুমি হারিকেন নিয়ে ওপারে যাও ”
    ” আচ্ছা ”
    ” শোনো ”
    ” বলেন ”
    ” লুঙ্গিটা উচু করে পর, পড়ে যাবে ”
    ” পড়ব না ।অভ্যেস আছে ”
    শহীদ ও এই কথা বলেছিল । এই গ্রামের নতুন ফ্যাশন মনে হয় । পাহারাদার পার হতেই মঈন বলল, অনিতা আপনি এবার পার হয়ে যান ”
    অনিতা বলল, আপনি আগে যান ।
    মহাবিপদ । সেই বিপদ নিয়ে একসময় সাঁকোর মাঝামাঝি চলে এলো মঈন। কিসের যেন শব্দ হচ্ছে- ছলাৎ , ছলাৎ । ঢাল বেয়ে পানি নেমে যাওয়ার শব্দের মতো । নীচু হয়ে তাকাতেই দেখল খাল পানিতে ভরা। পরিস্কার পানি । মঈন চোখে হাত দিল। অন্ধ হওয়ার কথা আছে ভাগ্যে । এখন থেকেই কি কম দেখতে শুরু করেছে ? দ্বিতীয় বার তাকাল। পানিই দেখতে পাচ্ছে। অথচ এই খালে কিছুক্ষন আগেও পানি ছিল না ।
    গাছপালা নড়তে শুরু করেছে। বাতাস নেই। বাতাস থাকলে ওর শরীরেও লাগত। তাহলে কেন নড়ছে ? গাছের ওপর জ্বল জ্বল করে কি যেন জ্বলছে । মঈনের আর যেতে ইচ্ছে করছে না ।
    অনিতা বলল, কি ব্যাপার দাঁড়িয়ে গেলেন কেন ?
    ” ভাবছি ”
    ” কি ভাবছেন ?”‘
    ” না না কিছু না, আমি ঠিক আছি ”
    সাঁকো পার হতেই অনিতা বলল, এবার এই নৌকায় করে আমাদের গ্রামে যেতে হবে । আপনি আগে উঠুন ।
    মঈন বলল, আপনি আগে উঠুন
    ” তাহলে হারিকেন সরান ”
    ” আলো না থাকলে পড়ে যাবেন ”
    ” পড়ব না ”
    হারিকেন নিয়ে পাহারাদার দাঁড়িয়ে থাকল । অনিতা নৌকায় উঠল । মঈন নৌকায় উঠার জন্য পাটাতনে ডান পা রাখল। ওর শরীর গুলিয়ে উঠল সেই সাথে। কোথা থেকে যেন আতরের গন্ধ আসছে। আশে পাশে কোনো শ্মশান আছে কিনা জানা নেই। বাম পা উঠাতে গিয়েই থেমে গেল । সে খুব ভয় পেল । হারিকেনের আবছা আলোয় দেখতে পেল অনিতা শুন্যে ভাসছে। ওর পা নৌকা স্পর্শ করে নেই।
    মঈন দুই পা পিছিয়ে এসে ডাকল, পাহারাদার , পাহারাদার ।
    কোনো সাড়া নেই। পেছনে তাকিয়ে দেখল পাহারাদার নেই । হারিকেন মাটিতে রাখা । সামনে তাকিয়ে দেখল অনিতা হাসছে। শব্দ করে হাসছে। ওর শরীরে নার্সের পোষাক নেই । শাড়ি পরে আছে। চুলগুলো বাতাসে উড়ছে সেই সাথে শাড়ির আচল। ওর শরীরে এক ধরনের আলো। সেই আলোতে দেখতে পেল মঈনের সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে অনিতা নয়। সে একটা কঙ্কাল অথবা ভুত । সেই কঙ্কাল টা হাত বাড়িয়ে ওর দিকেই আসছে।

    চলবে…

  • সময় একমাস (পর্ব-৩)

    সময় একমাস (পর্ব-৩)

    মঈন উপন্যাস পড়ছে। এখানে আসার সময় অনেক গুলো বই এনেছিল। কাজ নেই তাই সারাক্ষন বই পড়ে। বই পড়তে পড়তে ওর চা খাওয়ার খুব ইচ্ছে হলো ।বুয়াকে ডাকতে যাওয়ার আগেই সে একটি শব্দ শুনতে পেল। মনে হচ্ছে কে যেন টিনের চালে ঢিল মারছে। একটা দুইটা তিনটা। ওদের বাংলো গ্রাম থেকে বেশ দূরে। রাতে এদিকে কেউ আসে না। বাংলোর চারপাশ তারকাটা দিয়ে ঘেরা। তার কাটা ঘেষে লাগানো আছে নারিকেল গাছ। এতো রাতে ঢিল মেরে কেউ নারিকেল পাড়বে না।
    মঈন ডাকল , শহীদ ভাই?
    অন্য প্রান্ত থেকে আওয়াজ এলো, জে
    প্রায় সাথে সাথেই উত্তর এলো । বয়স্ক মানুষ রাত জেগে কি করে ? এর আগেও যতবার ডেকেছে সাথে সাথেই উত্তর এসেছে। বকা দিতে হবে। নিশাচর প্রানী হলে চলবে না।
    ” শহীদ ভাই টিনে ঢিল মারে কে? ”
    ” কেউ না ”
    ” তাহলে কিসের শব্দ ”
    “জানিনা ”
    ” তুমি কি কানে কম শোনো আজকাল ”
    ” জে না ”
    “তুমি বাইরে গিয়ে দেখে এসো ”
    ” দেখতাছি ”
    দরজা খোলার শব্দ হলো। শহীদ এখন কি করবে জানার দরকার নেই। উপন্যাস বেশ জম জমাট। গতিশীল কাহিনী। পড়ার মাঝখানে ঝামেলা করলে খুব বিরক্ত লাগে । পড়তে শুরু করল। দুই পাতা পড়েছে মাত্র । এমন সময় আবার ঝামেলা শুরু হলো। জানালার পাশ দিয়ে চার পাচজনের হেটে যাওয়ার শব্দ হচ্ছে। শুকনো পাতার ওপর পায়ের চাপ। মচ মচ করে পাতা ভাঙ্গার আওয়াজ আসছে। মঈন খাটের ওপর বসল। এখন কেউ হাটছে না। মনে হচ্ছে সবাই মিলে নাচছে ।এরা কারা?
    মঈন দরজা খুলে বাইরে এলো । শহীদের ঘর বন্ধ। তাকে ডাকল না। আস্তে আস্তে ঘরের পেছনে এলো । থেমে গেল নাচ। কেউ নেই। এর মানে কি ? হঠাত নাকে পচা গন্ধ এলো । চেপে ধরল নাক । একটু একটু করে সামনে এগুচ্ছে। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এভাবে যাওয়াটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। মঈন থেমে গেল। এবার সে জাল ফেলার শব্দ পাচ্ছে। আশে পাশে কোনো পুকুর নেই । অনেক দূরে বিল আছে। বিলে জাল ফেলার শব্দ এতোদূর থেকে শোনা যাবে না। সামনে এগুতে আর সাহস হলো না। ফিরে যাওয়া উচিত। আচমকা পায়ে কি যেন ঠেকল । পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল নিজেকে। গন্ধটা এখন তীব্র হচ্ছে । নাক চেপে ঘরে এলো।
    মঈন ডাকল , বুয়া
    বুয়া কাছে এসে বলল, ভাইজান কিছু বলবেন?
    ” রাতে তুমি কোনো শব্দ পাও ”
    ” কিসের শব্দ ভাইজান? ”
    ” টিনের চালে ঢিল মারার শব্দ, জাল ফেলার শব্দ?”
    ” না ভাই জান ”
    ” রাতে কারা যেন ঘরের পাশ দিয়ে হেটে যায় । আমি দরজা খুলে কাউকে দেখতে পাই না ”
    ” ভাই জান , সারাদিন কাজ করে ঘুমালে সেই ঘুম আর সহজে ভাঙ্গে না। মরার মতো ঘুমাই শব্দ পাব কেমনে ”
    ” ঠিক আছে তুমি যাও ”
    “রাতে একজন পাহারাদার রাখেন ভাই জান, দেখবেন কেউ আসবে না ”
    বুয়ার কথা মতো একজন পাহারাদার রাখল । দুই দিন বেশ ভালই গেলো। কিন্তু তৃতীয় দিনে শুরু হলো সেই উতপাত। কে যেন ওর জানালায় টোকা দিচ্ছে।
    মঈন বিছানায় শুয়েই বলল, কে?
    কোনো জবাব এলো না । বিরক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করল। রাতে কেউ ঘুম ভাঙ্গালে খুব রাগ হয়। জানালায় আবার টোকা পড়ল। পর পর দুই বার। মঈন জানালা খুলল । হারিকেন হাতে নিয়ে বাইরে উকি দিল। একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে জড়োসড়ো হয়ে । আবছা আলোয় ভালো মতো চেহারা বোঝা যায় না । এতো রাতে মেয়েটি কি চায়?

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-২৫)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-২৫)

    রিতা খানম শারমিনকে তার ছেলে সহ নিজে রেডি করছেন। ছেলের কি কি লাগবে, সব ব্যাগে গুছিয়ে দিচ্ছেন। তিনি শারমিন কে বললেন, একটা সুন্দর দেখে শাড়ি নে, বিয়েতে পরবি, আর আরেকটা নে, ওয়ালিমায় পড়ার জন্য।

    শারমিন বার বার বলছে, আন্টিমনি, আম্মা বাইরে, এখন আম্মাকে না বলে, ওই বাসায় চলে গেলে, আম্মা রাগ করবেন।
    – সংসার তোর না তোর মায়ের?
    – এখন, বাচ্চা নিয়ে একা ঝামেলা হয়ে যাবে খালা।
    – তুই বড় বউ, তোর বাসায় তোর ননদের বিয়ে, আর তুই যাবি কাল সকালে?
    – আম্মা, না করছেন।
    – দেখ, সাঈদ ও আজ অফিস থেকে এসে কষ্ট পাবে, তুই চল, তোর কোন অসুবিধা হবেনা।
    – আম্মা, কিন্তু রাগ করবেন।
    – এই বড়পা কি কখনো তার এই বাসা ছেড়ে কোথাও গিয়ে থেকেছে? আর তুই? চল, আমি গাড়ী দিয়ে নামিয়ে দিয়ে আসবো, চল। আর বাচ্চা রাখার জন্য মানুষের অভাব হবে নাকি!

    রিতা খানম, শারমিন কে নিয়ে তার বাসায় গেলেন, রুমের তালা দেখে রিতা বললেন, কি রে? তোর রুমে কি আছে, মনি মুক্তা?
    – সেইফটির একটা ব্যাপার আছে খালা।
    – ছোট লোক ছাড়া কেউ ঘরে মানুষ রেখে তালা দিয়ে রুম লক করেনা। যা হয়েছে বাদ দে। ননদের বিয়ে হৈ চৈ কর, বাচ্চা তার দাদীর কাছে দে, দেখবি তিনি কত আনন্দে নিয়ে রাখেন।

    হলুদের জন্য ছোট্ট স্টেইজ করা হয়েছে। গাদা ফুলের গহনায় পলি কে খুব সুন্দর লাগছে।

    রিতা খানম বললেন কি রে, তোদের স্পিকার নাই? এটা কি বিয়ে বাড়ী নাকি? কোন হৈ চৈ নাই। আনন্দ কর সবাই।

    রাহেলা খানম কে রিতা রান্নাঘরে গিয়ে বললেন, বেয়ান, জলির জামাই, তার আত্নীয়, আপনার ভাইয়ের বউ, সবাইকে আমি রাতে নিয়ে যাবো। আপনি চিন্তা মুক্ত থাকেন। আমার উনি, একটু পরে আসবেন, সবাইকে নিয়ে যাবেন দুই বারে।
    – না, বেয়ান। এখানে, হয়ে যাবে।
    – হবেনা, আমি জানি। আমার অনেক বড় বাসা, সমস্যা নাই। বিপদের জন্য তো আত্নীয়-স্বজন।
    – আমার মেয়েরা আপনার খুব ভক্ত! আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ আমি।
    – আমরা দুইজন ও মেয়ে দুটিকে খুব পছন্দ করি। কৃতজ্ঞতার কি আছে!

    আবিদের বাসা থেকে সামান্য আগে, কন্যার জিনিস পত্র এসেছে।

    রিতা খানম খুলে খুলে সবাইকে দেখিয়ে দিচ্ছেন।

    বিয়ের শাড়ি টি মেরুন রঙের খুব সুন্দর বেনারসি শাড়ি। সাথে মেরুন রঙের ওড়না! ওয়ালিমার জন্য একটা সোনালী রঙের জরি সুতার কাজ করা কাতান শাড়ি। হলুদের জন্য একটি সুতির শাড়ী, আর আরেকটা শাড়ি এসেছে, সুতির। সাথে আছে দুই জোড়া স্যান্ডেল, কসমেটিক্স, আর সামান্য ওরনামেন্টস।

    সবাই বলাবলি করছে, মাত্র চারটি শাড়ি দিয়েছে, ওয়ালিমার শাড়ীটাও তেমন দামী নয়। আর গিফট হিসেবে এসেছে, রাহেলা খানমের জন্য শাড়ি, আর কলির জন্য জামা। আর কোন গিফট আসে নি।

    আবিদের মামা এই সব জিনিস নিয়ে এসেছেন, তিনি রিতা খানম কে বললেন, ভাবী আপনি তো আর আমাদের আগের পরিচিত মানুষ, স্বর্ণ আপনাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি। স্বর্ণ খুবই সামান্য, কারণ আবিদ নিজের টাকা দিয়ে বিয়ে করছে, দুলাভাই শুধু ওয়ালিমায় খরচ করবেন। শিক্ষক ছেলে, সব বাজার করে, স্বর্ণের জন্য তেমন টাকা রাখতে পারেনি।
    – সমস্যা নেই ভাই। যা আছে তা দিন।
    – এক টা চেইন আর লকেট, এক জোড়া ঝুমকা, আর ছোট্ট একটা আংটি।
    – আলহামদুলিল্লাহ! ছেলে নিজে এতো টুকু করতে পেরেছে, অনেক বেশি।

    শারমিন বিরক্ত হয়ে বললেন, কি গো পলি ভাইজানের সাথে রাগ দেখাও শুধু, দেখেছো কি দিল তোমার জামাই? দিবে কেমনে? টাকা থাকলে তো দিবে।

    পলি খুব শক্ত হয়ে বলছে, আমি মানুষ কে দেখে বিয়েতে রাজী হয়েছে, টাকা পয়সা দেখে নয় ভাবী।

    শারমিন আর কোন কিছু বললেন না।

    সাঈদ রাতের বেলা, মায়ের হাতে দশ হাজার টাকা দিয়ে বললো, এই টাকা তুমি যেকোনো কাজে লাগিয়ে দিও, আমার পক্ষে এর চেয়ে বেশি দেওয়া সম্ভব নয়।
    – যা দিয়েছো, অনেক। আর লাগবেনা, দেওয়া। দোয়া কর, বোনের জন্য।

    বিয়ের দিন পলিকে মেরুন বেনারসিতে খুন সুন্দর লাগছিল, মায়ের বানানো গহনা গুলিতে খুব চিক চিক করছে নতুন বউকে। এতো গহনা দেখে, ছেলে পক্ষের সবাই খুব প্রশংসা করছে।

    আবিদ পড়েছে সোনালী রঙের শেরওয়ানি, তাকেও বেশ সুন্দ লাগছে, মাথার মেরুন পাগড়ীতে বেশি সুন্দর লাগছে। কলি দুলাভাইয়ের সাথে খুব আনন্দ করছে। তিন ভাই আত্নীয়দের খুব যত্ন করছে, যাতে বোনের যেন কোন সম্মান নষ্ট না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখছে।

    বিদায়ের সময় কলি বোনের গলা জড়িয়ে হাউমাউ করে কান্না শুরু করেছে, আর বার বার বলছে, আমার আপা ছাড়া আমি কোন দিন থাকিনি, এখন কেমন করে থাকবো রে আপা! কিভাবে থাকবো!

    পলি ও বোনের গলায় শক্ত করে জটিয়ে দজরে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।

    বিদায়ের পর যেন, চারিদিক নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কলি বিছানায় শুয়ে শুয়ে কান্না করেই যাচ্ছে। কান্না করতে করতে, বালিশ ভিজিয়ে দিচ্ছে।

    রিতা খানম বাসায় এসে বললেন বেয়ান, আগামীকাল তো ওয়ালিমা। এখন মেয়ে কে কি ওয়ালিমা থেকে এই বাসায় নিয়ে আসবেন?

    শারমিন সাথে সাথে বললো না, খালা। পলির জামাই, ফিরানীতে বাড়ীতে যাবে। শ্বশুর বাড়ী দেখবেনা? এখানে এসে কি মজা পাবে?
    – কি বলিস তুই? এরা এখানে, বাড়ীতে হঠাৎ আয়োজন করবেন কিভাবে?
    – দুদিন পরেই যাবে, কিন্তু বাড়ীতে গেলে আনন্দ হবে তাই না মা?

    রাহেলা খানম বললেন হ্যা, মা। দেখি কি করি। তিনি, বুঝতে পারছেন, শারমিন তার বাসায় আর কোন ঝামেলা হোক একদম পছন্দ করছেন না। এখন বাড়ীতে গিয়ে আবার নতুন করে কিভাবে কি আয়োজন করবেন, তাই নিয়ে ভাবছেন রাহেলা। এই মুহুর্তে কি নতুন জামাই বাড়ী যেতে রাজী হবে? ইশ কি যে এক ঝামেলায় পড়েছেন তিনি! কি করবেন, বুঝতে পারছেন না….

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ০৯.০১.২০২২

  • সময় একমাস (পর্ব-২)

    সময় একমাস (পর্ব-২)

    বাড়িতে এসে মঈন ব্যাগ গোছাতে শুরু করে। এই শহরে সে থাকবে না । রাতের বাসেই রওনা হয়ে গেল। গ্রামে পৌছাতে ছয় ঘন্টা লাগে । বাস স্টপেজ থেকে কিছুটা পথ রিকশায় , কিছুটা পথ হেটে যেতে হয় । মঈন ভোর বেলা বাস থেকে নেমে হাটা শুরু করল। বাসে আসতে ভয় পেয়েছিল কিন্তু হেটে যেতে ভয় লাগছে না। হেঁটে গেলে দুর্ঘটনা ঘটবে না। বাংলোর কেয়ারটেকারকে খবর দেয়া হয় নি। তার জন্য এই গ্রামে রাত জেগে বসে থাকবে এরকম কোনো আশা নেই।
    মঈনের ধারনা ভুল। কেয়ারটেকার বসে আছে দরজার গোড়ায়। কেয়ার টেকারের নাম শহীদ। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। মঈনকে দেখে দরজা খুলে দিল।
    মঈন একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি আমাকে কোনো প্রশ্ন করলে না শহীদ ভাই।
    কেয়ারটেকার বলল, আপনি ভালো আছেন মঈন ভাই ?
    ” হ্যা ভালো আছি। তোমার কন্ঠ এরকম লাগছে কেন ? ”
    ” ঠান্ডা লাগছিল । এখনো ভালো হয় নি । আপনি ঘরে গিয়ে বসেন আমি নাস্তার ব্যবস্থা করছি ”
    “শহীদ ভাই ”
    “জে ”
    তুমি লুঙ্গিটা উচু করে পর। পায়ে বেধে পড়ে যাবে তো ”
    “পড়ব না। অভ্যেস হয়ে গেছে ”
    মঈন হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে নাস্তা সেরে বিছানায় শুয়ে পড়ল। সারা রাতের ক্লান্তির কারনে অল্প সময়েই ঘুমিয়ে পড়ল। সেই ঘুম ভাঙল দুপুরে ।
    মঈন বাইরে এলো । কেয়ারটেকার কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না । রান্না ঘরে বুয়া রান্না করছে। মাংশের ঘ্রান পাচ্ছে মঈন। গোসল সেরে মাংশ ভাত খেয়ে বসে বসে বই পড়ল মঈন। কিন্তু কেয়ার টেকারের দেখা নেই। বুয়াও জানে না কোথায় গেছে। কেয়ার টেকার এলো সন্ধ্যা বেলা। ঘরে হারিকেন জ্বালিয়ে দিল। এখানে এখনো বিদ্যুৎ এসে পৌঁছায়নি । মঈন বলল, শহীদ ভাই, সারাদিন কোথায় ছিলে ?
    “বাড়িতেই ছিলাম”
    “সারা বাড়ি খুজেও তোমাকে পাই নি। আর তুমি বলছ এখানেই ছিলে?”
    “আমাকে খুজবেন না। দরকার হলে ডাক দেবেন। আমি চলে আসব ”
    মঈনের খটকা লাগে। কেমন যেন বদলে গেছে শহীদ। তার চাল চলন , কথা বার্তা কেমন যেন অন্য রকম ।
    মঈন বলল, তুমি মাথা নীচু করে কথা বলছ কেন ?
    ” কোনো কারন নাই ”
    ” হারিকেন নিয়ে আমার কাছে এসো ”
    ” কি করবেন?”
    ” তোমার চোখ দেখব ”
    ” চোখ দেখার দরকার নাই। আমি ভালো আছি ”
    ” তুমি আমার কাছে এসো ”
    চমকে উঠল মঈন। শহীদের চোখ রক্ত লাল। মনির অংশ ফাঁকা । সেখানে ক্ষীন আলো জ্বলছে বলে মনে হলো ।ভালোভাবে দেখার সাহস হলো না। হারিকেন নামিয়ে মঈন বলল, তোমার চোখের এই অবস্থা কেন ?
    ” লোকজন ভীষন মারধর করছিল ”
    ” কেন ?”
    ” ওরা ঘরের জিনিষ চুরি করতে এসেছিল ”
    ” চোখের সাথে তোমার মারধরের কি সম্পর্ক ?”
    ” আমি বাধা দিছিলাম ”
    ” সব কথা এক সাথে বলছ না কেন ?”
    ” আমি এখন যাই , মেলা কাজ আছে ”
    ” যাবে মানে ? এই টাকা গুলো রাখো । কাল ডাক্তারের কাছে গিয়ে চোখ দেখাবে । ওষুধ কিনবে । এই চোখ যেন আমাকে আর দেখতে না হয় ”
    চোখ দেখেও মঈন কিছু বুঝল না। অনেক দিনের কেয়ার টেকার। মনে কোনো সন্দেহ এলো না। সন্দেহ করলে ঘটনা হয়ত বদলে যেতে পারত । ভাগ্য হয়ত বদলে যেতে পারত।

    চলবে…

  • সময় একমাস (পর্ব-১)

    সময় একমাস (পর্ব-১)

    জটাধারী বৃদ্ধা , বয়স আশির মতো । তিনি মঈনের হাত দেখে ভাগ্য গননার চেস্টা করছেন। বয়স বেশি হওয়ার কারনে তিনি আজকাল চোখে ভালো দেখেন না । কিন্তু মঈনের হাত দেখে তার চোখ বড় হয়ে গেল। হাতটা ছেড়ে দিয়ে বৃদ্ধা বললেন, যা বাছা, চলে যা।
    মঈন বলল, কেন জ্যোতিষী মা?
    ” আজ আমার মন ভালো নেই”
    ” আপনি যদি খারাপ কিছু দেখে থাকেন আমাকে বলেন। আমি ভয় পাব না ”
    ” তুই অন্য দিন আসিস”
    ” না , আজকেই বলতে হবে ”
    ” জিদ করিস না বাছা, চলে যা ”
    ” না শুনে আমি যাবই না ”
    ” আমি বলতে পারবনা ”
    “আপনাকে বলতেই হবে কি আছে আমার ভাগ্যে ”
    বৃদ্ধা কথা বললেন না। চোখ দিয়ে আজকার পানি পড়ে। হাত দিয়ে পানি মুছে বললেন, চোখে কম দেখি বাছা, গণনায় ভুল হয়ে যায়।
    মঈন বলল , বেশ আরেকবার দেখেন ”
    বৃদ্ধা মঈনের হাত নিজের হাতে নিলেন। ম্যাগনিফাইং গ্লাস রাখলেন হাতের ওপর। রেখাগুলো এখন স্পস্ট । শনি লেগেছে কপালে । রাহুর প্রভাব বেশি। কিভাবে এমন হলো তিনি বুঝতে পারছেন না। মনে হচ্ছে কেউ যেন ইচ্ছে করে ভাগ্য রেখা বদলে দিয়েছে। তার হাত এখন কাপছে। চোখ থেকে এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল মঈনের হাতে। তিনি অচেনা যুবকের জন্য এক ধরনের ভালোবাসা অনুভব করছেন।
    মঈন বলল, কি ব্যাপার জ্যোতিষী মা আপনার চোখে পানি কেন?
    বৃদ্ধা বলল, তুই চলে যা বাছা । আমি তোর ভাগ্য বলতে পারব না।
    ” কেন মা? আমার ভাগ্য কি খুব খারাপ? ”
    “হ্যা ”
    “তবুও বলেন?”
    “শুনে কি হবে?”
    ” সাবধান হব। আমি ভাগ্যাকে বদলাতে চেস্টা করব ”
    ” ভাগ্য কে কেউ বদলাতে পারে না । যা লেখা আছে তাই ঘটবে। একমিনিট আগেও না এক মিনিট পরেও না ”
    “আপনি বলেন , আমি প্রমান করে দেব ভাগ্য বদলানো যায়”
    জ্যোতিষী মা করুনার হাসি হেসে বললেন , আজ থেকে এক মাসের মধ্যে তুই অন্ধ হয়ে যাবি।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তর –  আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো (সূচনা পর্ব)

    আজিমপুর টু উত্তর – আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো (সূচনা পর্ব)

    • আজিমপুর টু উত্তরা।
    • আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো।
    • আনোয়ার হাকিম।


    মৌমিতার এক কথা। তার পক্ষে আমার সাথে আর এভাবে রিলেশন টেনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তার এ অনুযোগ নতুন কিছু না। এর আগেও বহুবার এরকম অভিযোগ এনে সে সব ধরণের যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। আবার কিছুদিন পর যেচে এসে কান ঝালাপালা করা শুরু করে দিয়েছে। তাই এবারের হুমকিকে বরাবরের মত আমলে নেইনি। ভেবেছিলাম কিছু দিন গেলেই পাখী ফিরে আসবে। কিন্তু এবারের বিরতি ঢের প্রলম্বিত হচ্ছে। ফোনে তাকে পাওয়া যাবেনা জানি। ম্যাসেঞ্জার, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপেও পাওয়া যাচ্ছেনা। যাবে কি করে? আমি তো ব্লক লিস্টেড।
    অফিসের কাজে মন নেই। ক’দিন যাবত অফিসের পরিবেশও ভাল না। নতুন বস এসেছেন। এসেই আগেকার সব কিছু খারাপ, তাই পরিত্যাজ্য শ্লোগানে সবাই পেরেশানির মধ্যে আছি। আগের বস ব্যবহারে চামার প্রকৃতির হলেও কারো উপর কলম প্রয়োগ করেন নি। এই বস দেখতে আগের জনের চেয়ে পরিপাটি, পোষাকে-আশাকে ও কাজে-কর্মে। কিন্তু কথায় কথায় কলম ধরতেও ওস্তাদ। কয়েকটা চামচা জুটেছে তাঁর সাথে। পুরো অফিসটাকে সার্কাস্টিক করে তুলেছে। আমার সাথে বসের প্রথম সাক্ষাৎ মোটেই সুখকর ছিলনা। বসের সালাম মানে অবশ্যপালনীয় সাক্ষাত। টুক করে অস্ফুট স্বরে সালাম ঠুকতেই তাঁর কোপানলে পড়লাম, “সালাম দিলা না ঢুস মারলা?” আমি অপ্রস্তুত। ‘স্যরি’ বলে নিষ্পত্তি করতে গিয়ে পড়লাম আরো ভেজালে। ম্যানার আর এটিকেট সম্মন্ধে লম্বা লেকচার শুনলাম। বলাচলে ক্লাউন বনে গেলাম। চামচারা চারপাশ আলোকিত করে বসে আছে। তাদের মুখে আমার প্রতি পরিহাস আর বসের প্রতি কৃতজ্ঞতার বত্রিশ দন্তের এক্সিবিশন। মেজাজ তিরিক্ষি। কিন্তু করার কিছু নেই। চাকরি বলে কথা। করিডোরে আরো কয়েকজনের সাথে দেখা। তাদেরও মুখ কালো। তাদেরও অভিজ্ঞতা সুখকর নয়। অফিসে এক ধরণের অস্বস্তি ও রাখঢাক ভাব। এমন সময় মৌমিতার ফোন, কই তুমি?
    — অফিসে
    — এখনই বের হও
    — কেন?
    — এত কৈফিয়ত দিতে পারবো না
    — নতুন বস। মার্শাল ল’ চলছে
    — সে তোমার বস। আমার না
    — তো
    — আমি ওসব বুঝিনা। বের হও আমি অপেক্ষা করছি।
    — এ মুহুর্তে অফিস লিভ করা যাবে না। তুমি আসো
    — আমি পারবো না। আসবে কিনা বলো
    — বললাম তো সম্ভব না
    — ঠিক আছে।
    কথা বলতে গিয়ে দেখি লাইন নেই।
    মৌমিতার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাত আকস্মিক। সবেমাত্র চাকরিতে যোগ দিয়েছি। সরকারি চাকরি। বাবার পছন্দের। আমারও। চাকুরীজীবিদের জন্য বছর শেষে বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন নেওয়ার নিয়ম। সবাই দুই প্রস্থ ফর্ম নিয়ে ঢাকা মেডিক্যালে ছুটছে স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রতিবেদন সংগ্রহ করতে। সে এক এলাহী কান্ড। নির্ধারিত প্রফেসরের চেম্বারের সামনে লম্বা লাইন। একজন কর্মচারী সেগুলো জমা নিচ্ছে। আমি একজনের রেফারেন্সে গিয়ে পড়লাম বিপদে। কর্মচারীটা আমার দিকে কিভাবে যেন দৃকপাত করলো। আমি এর কারণ বুঝে উঠতে পারলাম না। দেখলাম ‘আগে আসলে আগে পাবেন’ নিয়মের ব্যাতিক্রম ঘটিয়ে অনেকেই বিজয়ের হাসি হেসে চলে যাচ্ছে। বুঝলাম নগদানগদি কারবারের ক্যাটালিস্ট কাজ করছে। আমার এতে আপত্তি। প্রায় ঘন্টাখানেক পর আমার ডাক পড়লো। নির্ধারিত রুমে ঢুকেই পড়লাম জেরার মুখে। এক লেডি ডক্টর বসে আছেন। মুখ না তুলেই বললেন, “হাইট কত সেন্টি”? আমি চেয়ার টেনে বসে পড়লাম। বললাম, “ভুলে গেছি”। লেডি ডক্টর মুখ তুলে তাকালেন। বললেন,”কি বললেন”? বললাম, “ভুলে গেছি”। বিস্ফারিত চোখ মেলে শব্দ বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বললেন, “মানে”? আমি স্থির হয়ে বললাম, “বমি আসছে। মাথা ঘোড়াচ্ছে”।
    — প্রেসার আছে? তার প্রশ্ন
    — জানিনা। মাপিনি কোন দিন
    — ডায়াবেটিস?
    — জানিনা
    — বড় ধরনের কোন অসুখ?
    — জানিনা।
    লেডি ডক্টর আশ্চর্যবোধক চিহ্ন চোখে-মুখে, কপালে ফুটিয়ে তুলে কলিং বেল চাপলেন। পিওন এলো। ফরমগুলো এগিয়ে দিয়ে বললেন, “উনাকে নিয়ে গিয়ে এগুলো করিয়ে আনেন”। আমি অসহায়ের মত সেই পিওনকে অনুসরণ করলাম। রুম থেকে বেরোতে গিয়ে পিছু ফিরে জিজ্ঞেস করলাম, “ম্যাম, আমার কি সাংঘাতিক কিছু হয়েছে”? লেডি ডক্টর এবার হেসে উঠলেন। বললেন, “যান তো”। আমার মন কেন জানি নেচে উঠলো। যাকগে সেসব। হাইট, প্রেসার ইত্যাদি মেপে আবার ফিরে এলাম সেই ম্যাম এর রুমে। দেখলাম তিনি সিঙ্গারা খাচ্ছেন। সামনে ছোট্ট ফ্লাক্স। চায়ের। বললেন, “হয়েছে?” ফরমগুলো উল্টেপাল্টে দেখলেন। তারপর ইনিশিয়াল দিয়ে পিওনের হাতে দিয়ে বললেন সাথে যান।
    ফর্ম হাতে অফিসে পৌছা মাত্রই ফোন। আন নোন নম্বর। ধরলাম। সেই লেডি ডক্টরের। ভুলো মনে তার টেবিলে আমার ফোল্ডার ফেলে এসেছি। ফোল্ডারেই আমার মোবাইল নম্বর ছিল। মন ইউরেকা উত্তেজনায় থেকে থেকে নেচে উঠছে। ভাবছিলাম এইসব অনেক কিছু। আবারো বসের সালাম।
    রাতে ব্যালকনিতে বসে নচিকেতার গান শুনছিলামঃ হাজারো কবিতা, বেকার সবই তা। তার কথা কেউ বলেনা। সে প্রথম প্রেম আমার, নীলাঞ্জনা। আমি নীলাঞ্জনাকে পেয়ে গেছি। সে উত্তেজনাতেই মন নেচে উঠছে, কি থেকে কি করি এই অস্থিরতায় পেয়ে বসেছে। দ্বিধা চেপে রেখে ফোন দিলাম। রিং হলো। রিসিভ হলোনা। গান শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে গেছি খেয়াল নেই। সকালে নাস্তার টেবিলে মোবাইলে ম্যাসেজ চেক করতে গিয়ে দেখি ক্ষুদে বার্তাঃ এত রাত জেগে কি করেন? শরীর খারাপ হয়ে যাবে- মৌমিতা। খুশীতে লাফ দিতে মন চাইলো। আম্মা সামনে বসে থাকায় চেয়ারেই দৃঢ় হয়ে বসে থাকলাম। তবে ভেতরে তুমুল আলোড়ন শুরু হয়ে গেছে। অফিসে গিয়ে রিং দিলাম। অনেক ক্ষণ পর রিসিভ হলো, “বলেন”।
    — অসুখ- বিসুখ রাত বিরেতেই হয়।
    — কি হয়েছে?
    — বুক চিন চিন করছে
    — কবে থেকে
    — এই তো কয়েক দিন থেকে
    — ডাক্তার দেখান
    — সেজন্যই তো ফোন দিয়েছিলাম। ধরেন নি। ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল জাতীয় যদি হত
    — কথা তো ভালই জানেন দেখছি
    — এপয়েন্টমেন্ট কি হবে?
    — কিসের?
    — ডাক্তারের
    — যাকে দেখাবেন তার চেম্বারে যান। কন্টাক্ট করেন
    — আপনাকেই তো দেখাতে চাই
    — দেখাতে না দেখতে?
    — দু’টোই
    — দু’টোর কোনটাই হবে না।
    — কেন?
    — প্রথমত আমি হার্টের ডাক্তার না। আর দ্বিতীয়ত আমি চিড়িয়া না যে দ্রষ্টব্য হবো।
    এভাবেই মৌমিতা আমার নিত্যদিনের দ্রষ্টব্য হয়ে উঠে। আমাদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই বেশি। তবু জমে ভাল। আমি আবেগী। মৌমিতা সারাক্ষণ অপারেশনের সিজার হাতে ফোর ফোরটি ভোল্টের মত। আমার ভাল লাগে। সুন্দরীদের দেমাগ থাকে জানি। আর এই দেমাগই তাদের রাগের পাওয়ার হাউস। রাগলে মৌমিতার গাল দু’টো আরো রক্তাভ হয়। একটু ফোলা ফোলা ভাব থাকে। চোখে আলাদা তেজ প্রস্ফুটিত হয়। আমি আরো রাগাই। মৌমিতা ফিক করে হেসে উঠে , কখনো চুপ মেরে বসে থাকে।
    তার সাথে বিপত্তির শুরু আমার এক মহিলা কলিগকে নিয়ে। নাম শমরিতা। ঘটনার শুরু এক ট্যুরে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। অফিসের কাজে তার সাথে যেতে হয়েছিল বান্দরবান। দু’দিনের জন্য। কথা প্রসঙ্গে আর ছবি শেয়ার করার আহাম্মকির কারণে বিষয়টি যে মৌমিতার কাছে সন্দেহের প্রশ্নবোধক ট্যাগ হয়ে উঠবে বুঝতে পারিনি। সেই থেকেই থেকে থেকে এই অন-অফ খেলা। চরম বিপত্তি বাধে বসুন্ধরা সিটিতে গিয়ে। শমরিতার কিছু কেনাকাটা আছে ওখানে। আমারও একটা মোবাইল সেট কেনা দরকার। অফিসের গাড়ীর সুবিধা পাওয়ায় দু’জন একসাথে গিয়েছি সেখানে। মোবাইল সেট কিনতে গিয়েই দেখা হয়ে গেল মৌমিতার সাথে। আনুষ্ঠানিক পরিচয় পর্বে কুশল বিনিময় হলেও বিষয়টা যে পরে কুরুক্ষেত্র বাধাবে তা আঁচ করতে পেরে ক্রমাগত ঢোক গিলতে থাকলাম। মৌমিতা তাড়া আছে বলে বলা চলে ইচ্ছে করেই চলে গেল দ্রুত। আমি কিছু বুঝতে না দিলেও আর সহজ করতে পারছিলাম না নিজেকে। মোবাইল সেট আর কেনা হয়নি সেদিন। এরপর যথারীতি মৌমিতার ফোন বন্ধ। খোলা থাকলেও রিং দিলে ধরেনা। একদিন পেয়ে গেলাম হঠাৎ। বললাম, ফোন ধরোনা কেন?
    — ধরতেই হবে, এমন বাধ্যবাধকতা কি আছে?
    — এরকম বলছো কেন?
    — কি বলবে বলো, আমি ওয়ার্ডে রাউন্ডে যাবো
    — দেখা করতে চাই
    — কেন? কলিগ আছে না? তাকেই তো সারাক্ষণ দেখছো। তাকেই দেখে রেখো। রাখছি।
    জানি শমরিতা ফোবিয়ায় তাকে পেয়ে বসেছে। নারী যতই স্বাবলম্বী হোক, যতই আয় রোজগারি হোক যতই উদার আর উচ্চ শিক্ষিত হোক এই একটি জায়গায় তার সন্দেহ, ভয়, আর হিংসা তাকে সাধারণ নারী পর্যায়ে নামিয়ে আনে। কই, আমি তো শার্লক হোমস সেজে কখনো ভাবিনি তার পুরুষ কলিগদের সাথে তার কি সম্পর্ক? আদৌ কারো সাথে কোন সম্পর্ক আছে কিনা? পাগলের মত তার চেম্বারে গিয়েছি। পাইনি। ওয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছি। প্রফেসর রাউন্ডে আছে তাই ঢুকিনি। মৌমিতা আর বের হয়নি। এভাবেই যোগাযোগহীন চলছে অনেক দিন। এরকম অবস্থায় মানুষের আচরণে অস্বাভাবিকতা ধরা পড়ে, যা সে নিজেও বুঝতে পারেনা। নিকটজনেরা পারে। আম্মার চোখ ফাঁকি দেওয়া কঠিন। তাঁর নানারুপ তত্ত্বতালাশে আমি বেজায় বিরক্ত। এরমধ্যে শুরু হয়েছে পাত্রী দেখার তাগিদ। তাঁর জানাশোনা এক মেয়ে আছে। পাবলিক ভার্সিটির লেকচারার। দেখতে অপরুপা। একহারা গড়ন। বাবা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার। ঢাকায় বাড়ী, গাড়ী সবই আছে। এক বাপের একমাত্র সন্তান। বলা চলে রাজকন্যা। পাত্রী হিসেবে দশে দশ দেওয়া যায়। কিন্তু মৌমিতা আলাদা। তার রেটিং একান্তই মনের। মনের এই অবস্থায় শমরিতার টেক কেয়ার আরো বেড়ে গেছে। বাসা থেকে নানান খাবার নিয়ে আসে। দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত দেয়। এগারোটায় চা খেতে খেতে আলাপও হয়। শমরিতা কি তার পরিধি বাড়াচ্ছে? বুঝতে পারিনা। এমনিতে সে খুব সুন্দর, জড়তাহীন। উদার। এক ধরণের মেয়ে আছে যাদের দেখলেই দিনটা ভাল হয়ে যায়। একটু হাসলেই মনে হয় শীতের সূর্য একটু দিলখোলা হয়েছে। একদিন এমনই এক চা চক্রে অফিসে বসেই নানা আলাপ চলছিলো। হঠাৎই গম্ভীর হয়ে শমরিতা বলে, “একটা কথার ঠিক ঠাক উত্তর দিবে?”
    — বলো
    — তোমার কি কিছু হয়েছে?
    — না তো
    — সে তো বুঝতেই পারছি। আচ্ছা, বাই দা ওয়ে, সেদিনের সেই মহিলাটা কে ছিল?
    — লেডি ডক্টর
    — ব্যস, এটুকুই?
    — তো
    — তুমি কি কিছু আড়াল করছো?
    — না তো
    — উনি সেদিন ওভাবে হুট করে চলে গেলেন যে
    — আমি কি করে বলবো?
    — আর ইউ ইন আ রিলেশন উইথ হার
    — ডোন্ট নো।
    সেদিনের পর থেকে শমরিতা বেশ ফরমাল। হাই- হ্যালোতে আমাদের নিত্যদিন দেখা হয়, কথা হয়। রাখঢাক হয়। চোখাচোখি হয়। তার মুখের ভাষা বুঝি। শমরিতার কি তবে অন্য কোন চিন্তা ছিল? তার সেই স্বতঃস্ফূর্ততা আর আগের মত নেই।
    এদিকে আম্মার চাপ ক্রমশঃ বাড়ছে। তিনি প্রায় একরকম কথা দিয়েই ফেলেছেন সেই লেকচারার পাত্রীর বাবা-মা’কে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কোন ভাবেই মৌমিতাকে রীচ করতে পারছিনা। মেডিকেলে গিয়ে জানতে পারলাম, মৌমিতা এখন আর সেখানে পোস্টেড নেই। এম আর সিপি করতে ইংল্যান্ড চলে গেছে বেশ ক’দিন আগে। মাথাটা চক্কর মেরে উঠলো। এবার সত্যি সত্যিই বমি বমি লাগছে। মনে হয় সুগার লেভেল নেমে গেছে। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।
    অফিস এখন আর কোনভাবেই আকর্ষণ করেনা আমাকে। শমরিতার মধ্যেও আগের সেই স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। পাত্রী পক্ষ দ্রুত এগোচ্ছে। আম্মা তার চেয়ে বেশি। আমি ততোধিক ব্যাক ফুটে।
    হঠাৎই হোয়াটসঅ্যাপে মৃদু গুঞ্জন তুলে মৌমিতার ক্ষুদে বার্তাঃ আমি তো ভালো না, ভালো নিয়েই থেকো।

    চলবে…