ক্যান্সার (পর্ব২১)

Khugesta

বিয়ের পর ১৬ ই অক্টোবর আমাদের চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা । গ্রীন লাইন বাসে চেপে চট্টগ্রামে যাচ্ছি। মাঝপথে মেঘনা নদীতে ফেরি পারাপার, সব মিলিয়ে ১১ থেকে ১২ ঘণ্টার জার্নি।সকাল বেলা নটরডেম কলেজের সামনে থেকে বাসে উঠেছি পৌঁছতে পৌঁছতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত ।

আজ আমি পরেছি রাজশাহী সিল্কের নরম একটি শাড়ি। পাশাপাশি বসে টিংকু আমায় বলল একটি কাহিনী তোমায় জানিয়ে রাখি,”আমাদের পরিবারে সবাই অনেক ফর্সা। এ বাড়ির প্রথম কালো বউ হচ্ছে আমাদের গুঁড়া মা (ছোট চাচী) যাকে পালকী থেকে নামাতে যেয়ে আমার দাদী ফিট হয়ে গিয়েছিল। ছেলের বউ কালো এটা তিনি মেনে নিতে পারেন নি। তুমি তৈরি থাকো যদি তোমাকে দেখে আমার মা ফিট হয়ে যায় মন খারাপ কর না।”

বাকি পথটুকু ভীষণ চিন্তায় ছিলাম সত্যি সত্যি আমার শাশুড়ি কি রিয়েক্ট করেন। শাশুড়ি আমায় দেখে ভীষণ খুশী হলেন। ছোট্ট খাটো একজন মানুষ আমায় জোড় করে টেনে কোলে বসাতে চাইলেন। আমি বললাম আমায় শুকনা দেখালেও ওজন অনেক আপনার কষ্ট হবে মা’ ।

এ কদিন আমার কানে আসতে থাকা কথা ”বউ কালো” র সাথে ”বউ ভীষণ মিষ্টি করে কথা বলে” আসতে থাকলো। যিনিই আমার সাথে কথা বলেন তিনিই মুগ্ধ হয়ে বলেন কি সুন্দর করে কথা বলে মেয়েটি অর্থাৎ আমার বাচন ভঙ্গী,কথা বলার ধরন সবার মন জয় করে নেয় নিমিষেই।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ক’জনার, কারণ আমার মাঝে ট্র্যাডিশনাল বউ বউ ব্যাপারটি নেই। আমি লজ্জা পাচ্ছি না, নতুন বউ হিসেবে আমার ভেতর যে ভীতি থাকার কথা ছিল তাও অনুপস্থিত। আত্মবিশ্বাসী আমাকে ডমিনেট করতে অসুবিধা।

কোন একজন আমাকে বললেন, ”তোমার পরিবার আমাদের ভাইকে ঠকিয়েছে।” আরেকজন বললেন বিয়েতে মাত্র ৪৫ জন বর যাত্রী এলাও করেছে, অথচ চট্টগ্রামের সাধারণ পরিবারের বিয়েতে কয়েক শত বর যাত্রী যায়।

রাজেন্দ্রপুর ক্যান্টনমেন্টে আমার বিয়েই প্রথম। অনেক কষ্ট করে তাড়াহুড়োয় আমার ভাই এরেঞ্জ করেছেন। তা ছাড়া আমার পরিবার আমাদের মাফ করে দিয়ে বিয়েটা মেনে নিয়েছে এতেই আমি বেজায় খুশী।

সব সহ্য করতে পারি কিন্তু নিজ পরিবারের অসম্মান একটুও না। শান্ত স্বরে জবাব দিলাম আমার পরিবার বিয়েটাকে মেনে নিয়েছে, সমাজিকভাবে অসম্মানের হাত থেকে বাঁচিয়েছে এটাই তো বেশী।

এখানে সব চেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ভাষা। ওরা যাই বলে তাই আমার কানে কর্কশ শুনায় । এমনিতেই ভাষা বুঝি না তার উপর দ্রুত গতিতে হরবর করে যা বলে আমার কাছে গালির মত লাগে।আমার সামনে ওরা নিজেরা যে চাঁটগাইয়া ভাষায় কথা বলে সেটাতেও অস্বস্তি হয়।

পুরো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন কর্ণফুলি নদী তীরবর্তী সাগর নদী পাহাড়ের সংগমস্থল বাণিজ্য নগরী চট্টগ্রামের মানুষরা ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্যবসা বাণিজ্যে আগানো আর সচ্ছল বলে ভাবে দেশের মধ্যে তারাই সেরা। অন্য সবাই নোয়াখাইল্লা, বিদেইশসা নতুবা বইঙ্গা (এগুলো মূলত গালি)। অন্য অঞ্চলের মানুষদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে মূলত ছোট করা । তাঁদের কথার আগে গালি ছুটে, গালি দিয়ে কথা বলাটা ওদের এক প্রকারের স্বভাব জাতো দম্ভোক্তি।

আমার শাশুড়ি আমায় বলে দিয়েছেন যখন আমি না বুঝি তখন যেন তাঁকে বাংলায় কথা বলতে অনুরোধ করি।তিনি মাঝে মাঝে পরীক্ষা নেন ”কি বলেছি আমি বলতো।” আমি হেসে বলি ”বুঝিনি।” তিনি অনেকবারে বুঝিয়ে বলেন।

ইন্টারপ্রেটর হিসেবে টিংকুর ভাই-বোনের ছেলে-মেয়েরা আমায় সাহায্য করে। এ বাড়ির ছোট্ট নাহিদ আর আশা (টিংকুর দুই ভাইয়ের দুই মেয়ে) আমার গা ঘেঁষে থাকে সারাক্ষণ।

টিংকু আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে শুনে আমার রুমমেট প্লাস বান্ধবী লায়লা আপা (সুলতানা লায়লা হুসেইন) একদিন শামসুন নাহার হলের মিনা আপাকে (এপির রুমমেট) ডেকে নিয়ে এলেন। মিনা আপা টিংকুর পরিবার নিয়ে অনেক অজানা তথ্য দিলেন। ছোলা আর ডালপুড়ি সঙ্গে চা, রোকেয়া হলের ক্যান্টিনে বসে লায়লা আপা আর মিনা আপা কথা বলছেন আর আমি চুপচাপ শুনছি । লায়লা আপা অনেক চেষ্টা করেছেন বিয়েটা যাতে পরিণতি না পায়।

তাঁর এই উদ্যোগকে অবশ্যই সম্মানের চোখে দেখি কারণ লায়লা আপার নিঃশর্ত শুভকামনা কেবলই আমার প্রতি স্নেহ আর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।আমি এও জানি তাঁর জায়গায় আমি থাকলেও ঠিক একই কাজ করতাম।

২০শে সেপ্টেম্বর বিয়ের আগে যখন মিনা আপার বলা কথাগুলো টিংকুকে জানালাম সে বলল, ”আমার বোনেরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বোন তুমি দেখবে তোমাকে কি পরিমাণ আদর করে।”

টিংকু অনেক বেশী আগানো এবং প্রগতিশীল । আমি ওকে কিছুই জানাতে পারি না যদি আমায় ভুল বুঝে।আমার নিজের সম্মান হানী হবে তখন।

দু একটি কথা যাই বলার চেষ্টা করি, সে আমায় বলে তুমি আমাদের ভাষা রপ্ত করো আগে। আমাদের ভাষা ঠিকমত বুঝো না তুমি।

কিন্তু আমারও সমস্যা আছে। ভাইদের সাথে তাঁদের মত করে মানুষ হয়েছি। আব্বা কোনদিন আমায় রান্না ঘরে ঢুকতে দেননি । দীর্ঘ ৮ বছর হলে থেকেছি, সবার সাথে মিশতে তো পারি কিন্তু শ্বশুর বাড়ির নিয়ম কানুন জানি না। এখানে রান্না ঘরে ঢুকে সাহায্য করতে হবে, সবাইকে খাবার বেড়ে খাওয়াতে হবে, সেবা যত্ন করতে হবে । প্রত্যেককে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে।এসবই আমার অজানা।

কারণ ভাইদের যখন বিয়ে হয়েছে আমি পড়াশুনা আর নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত । জামালপুরের শিক্ষিত পরিবারগুলোতে এতো বিধি নিষেধ নেই । যৌতুকের বালাই নেই। যৌতুক নেওয়া এবং দেওয়া ভীষণ ছোটলোকি অসম্মান জনক একটি ব্যাপার।

কিন্তু আমার কি দোষ, আমাদের জামালপুরের বাসায় ৪ জন কাজের লোক ।বাড়ি পরিষ্কার করতে গাছ পালা ছাঁটতে এবং সামনের মাঠের ঘাস কাটার জন্য আলাদা লোক আছে। একজন রান্না করে অন্যরা তাঁকে সাহায্য সহ অন্য কাজও করে। আম্মা কোনদিনও রান্না ঘরে ঢুকেন না। তা ছাড়া আমার নানার পরিবারে আমার নানী, দুই খালা আর খালার মেয়েরাও কোনদিন রান্না ঘরে ঢুকেনি। ওদের ধারনা ওরা বই পড়বে, গল্প-উপন্যাস পড়বে সন্তান মানুষ করবে কিন্তু রান্নার মত ছোট খাটো কাজে সময় নষ্ট করবে না।

আমার সব আত্মীয়-স্বজনই বৃহত্তর মায়মেনসিংহ ও ঢাকায় থাকে। মামাতো আর খালাতো বোনেরা সবাই উচ্চ শিক্ষিত এবং স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। আম্মার পরিবারে আমার খালু এবং মামারা কেবল উচ্চ শিক্ষিত এমনটি নয় আমার আম্মার মামারাও অনেক শিক্ষিত ।

রান্না না জানার অপরাধ এবং ক্রমাগত অপবাদে মনে হল এতো লেখা পড়া না করে প্রতিদিন রান্না করাই বুঝি ভালো ছিল ।

ঢাকায় ফিরে টিংকু কস্তূরীর বাবুর্চি ওয়াদুদকে নিয়োগ দিল আমাকে রান্না শেখানোর জন্য ।

আমি রান্নায় মনযোগী হলাম। যাই রান্না করি টিংকু বলে মজা হয়েছে খুব। একদিন মাংসের কিমা রান্নায় ভুল করে লবণের বদলে চিনি দিয়ে রান্না করলাম। সেটাও খেয়ে বলল মজা হয়েছে। আমি মুখে তুলে দেখলাম কি বিস্বাদই না হয়েছে এটা কিছুতেই খাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

চলবে…

ক্যান্সার (পর্ব২০)

Khugesta

চলচ্চিত্রে বিয়ে মানে হ্যাপি এন্ডিং আর বাস্তব জীবনে বিয়ে মানে চলচ্চিত্রের শুরু। অনেকবার ভেবেছি সিনেমার মত বাস্তব জীবনটাও যদি ওই বিন্দুতেই থেমে থাকতো ।

১৯৯৩ র ২০ শে সেপ্টেম্বর বিয়ের পরের তিনদিন ঘোরের মধ্যে কাটলো। এই বাসাটায় টেলিভিশনের লাইন টানা নেই। অগত্যা রবিবারে জনপ্রিয় টেলিভিশন সিরিজ নাটক ”কোথাও কেউ নেই” এর শেষ পর্ব দেখার জন্য অন্য একটি বাসায় গেলাম দুজনায়। নাটক শেষে নাটকের শেষ দৃশ্য নিয়ে আবেগ আপ্লুত আমাকে টিংকু বলল, এবার ফোন করে তোমার পরিবারকে বিয়ের কথাটি জানাও।

এর আগেও কয়েকবার বলেছে কিন্তু আমার ভ্রুক্ষেপ নেই , সাফ জবাব যা হয় হবে আমি কিছুতেই জানাতে পারবো না। সে আমাকে বিয়ে করেছে অতএব এর পরের দায়িত্ব তাঁর। সে আমাকে বলল এই যে আমি তোমার পাশে আছি, তোমাকে ছুঁয়ে আছি এইবার ফোন দাও। ভয়ে আমি কাঁদতে শুরু করলাম, কিছুতেই পারবো না আমি। টিংকু আমাকে এক গ্লাস পানি এনে খাওয়ালো। বুঝানোর জন্য বলতে শুরু করল, ”দেখ তুমি যদি না জানাও, আমাকে তোমার পরিবার জেলে ঢুকাবে, মামলা হবে, মান সম্মান আর কিছুই থাকবে না। কথা বলার সময় আমি তোমার হাত ধরে থাকবো একজনকে অন্তত জানাও তোমার বিয়ে হয়েছে।”

ঘণ্টা দুয়েক বুঝানোর পর আমি মেজো ভাইকে ফোন দিয়ে বললাম,” টিংকু ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেছে।” মেজো ভাই বললেন,”টিংকুকে দাও।” মেজো ভাই আর্মি ডাক্তার, রাজেন্দ্রপুরে পোস্টিং । ভাই টিংকুকে বললেন, ”আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করে অন্যায় করেছ, আমার বোনকে কালই আমার বাসায় রেখে যাবে।”

টিংকু পরদিন চলমান সংসদ অধিবেশনে যেয়ে আজম ভাই(মীর্জা আজম) আর হীরা ভাই (তখন জামালপুরের এমপি) কে বলল, মুন্নিকে আমি বিয়ে করেছি ওর পরিবার সামলানোর দায়িত্ব আপনাদের। যদি সবার সামনে আবারও বিয়ে করতে হয় করবো কিন্তু এ বিয়ে ভাঙতে দিব না কিছুতেই।

এর পরের দিন টিংকু আমাকে সঙ্গে নিয়ে রাজেন্দ্রপুরে ভাইয়ের বাসায় গেলো। যাওয়ার সময় রাজলক্ষ্মী থেকে অনেক প্যাকেট মিষ্টি কিনল। ভাবী বলল তোমাকে এতো মিষ্টি লাগছে দেখতে, টিংকু তুমি বেশ হেন্ডসাম মাশাআল্লাহ্‌ ।

বিয়ের দিন ক্ষণ, প্ল্যান, প্রোগ্রাম কোন কিছু যদিও আগে থেকে ঘুণাক্ষরেও জানতাম না তবুও বিয়ে সঙ্ক্রান্ত সমস্ত দোষ আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে অল্প সময়ে টিংকু কথা বলে ইমপ্রেস করে ফেলল আমার ভাই- ভাবীকে। ভাইকে বলল ”আমার কোন দোষ নেই মুন্নি আপনাদের জানাতে নিষেধ করেছে।”

টিংকু চলে যাওয়ার পর ভাই আমার কাছে কৈফিয়ত চাইলেন কেন তাঁদের আমি জানালাম না ? আমি বললাম আমার সবচেয়ে আদরের হচ্ছে অদিতা আর ঈশিতা (আমার দুই ভাইয়ের দুই মেয়ে, ওরা তখন অনেক ছোট) । ওরা যদি টিংকুর মত কোন পাত্রকে বিয়ে করতে চাইত আমি কিছুতেই রাজি হতাম না। কোন সাহসে এই বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলবো, তোমরা এই বিয়েতে কোনদিন রাজী হতে না জানি আমি ।

ঠিক হল রাজেন্দ্রপুরে আবার আমাদের বিয়ে হবে। নতুন করে কাবিন হবে দুই পরিবারের সবার উপস্থিতে। আমাদের পরিবারে উৎসবের আমেজ। ৭ ই অক্টোবর আমার গায়ে হলুদ অনুষ্ঠান। যদিও আমার তিন মামার পরিবার পরিজন সহ আমার দুই খালার ছেলে-মেয়েরাও সবাই ঢাকায় থাকে কিন্তু ছোট মামার দুই কন্যার সাথে আমার সখ্যতা বেশী। ওরা রাজেন্দ্রপুর চলে এসেছে আগে ভাগেই। ছোট মামার ছোট মেয়ে জয়ী তখন ক্লাস সিক্সে পড়ে। ও বলল মুন্নি আপু আজ আমরা ব্যচেলর নাইট করবো।বড় কন্যা কলেজে পড়া লাবনী অনুসন্ধিৎসু প্রশ্ন ”মুন্নি আপু তুমি কি এখনো ব্যচেলর আছ?” আমি কিছু বললাম না কেবল হাসলাম।

আম্মা তো ননস্টপ গালি গালাজের বন্যা ছুটিয়েই যাচ্ছেন। রাতে মেজো ভাই ডেকে বললেন কাল তুমি শ্বশুর বাড়ি যাবে , ”স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে স্বচ্ছতা থাকা জরুরী।একবার বিশ্বাস হারালে তা আর কখনো ফেরত আসে না, স্বামীর সাথে কখনো মিথ্যে বলবে না, আর কোন কথা গোপনও করবে না।”

আম্মা বললেন, ” স্বামীর কাছে অযথাই টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র চাইতে নেই, এতে সম্মান হানী হয়।নিজের সম্মান বাঁচিয়ে চলার দায়িত্ব তোমার নিজের।”

আব্বা বললেন, ”এতো বড় মেয়ে মাস্টার্স পাশ করেছ অথচ সাহস করে বলতে পারলে না ওকে তুমি বিয়ে করতে চাও।”

সবার কথার উত্তরে চুপ থেকে আমি কেবল মাথা নাড়ালাম।

৮ই অক্টোবর যখন পুনর্বার আমাদের বিয়ে হল মনে হল এটা কোন আনন্দ উৎসব নয় আমার চল্লিশা হচ্ছে।সবার কান্না আর মন খারাপ দেখে আমি অধিক শোকে পাথর হয়ে কাঁদতে ভুলে গেলাম। নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হতে লাগল।

আজ বিয়ের দিন, আমি পরেছি লাল বেনারসি, সঙ্গে গা ভর্তি গহনা।গলায় সীতা হার, চেইন লাগানো লম্বা কানের দুল, টিকলি আর মানতাশা আরেক হাত ভর্তি সোনার চুড়ি, এ সবই আম্মার দেওয়া মূলত নানীর গহনার নতুন সংস্করণ ।অনেক আগে থেকেই আমার বিয়ের জন্য তৈরী করা হয়েছিল এলিফেন্ট রোডের জড়োয়া হাউস থেকে। টিংকুও দিয়েছে, আমার ভাইয়েরা আর মামারাও অনেক গহনা দিয়েছে, কাজিনরাও দিয়েছে। কলাবাগানের ”মে ফেয়ার” বিউটিপার্লার থেকে সেজে এসেছি।চাইনিজ এক মহিলার পার্লার, সমস্ত মুখ ময়দার মতো সাদা করে সাজিয়েছে ।তবুও আজ আমার খুশী লাগছে।

টিংকুকে দেখা মাত্র সমস্ত শোক ভুলে নিমিষেই আনন্দিত হলাম আমি। কোন পুরুষ বুঝি এতোটা সুদর্শন হয়। হালকা ঘিয়ে কালার গরদের পাঞ্জাবীর উপর একটি লাল-সাদা তাজা ফুলের মালা তাতেই আমার সারা জীবনের ক্রাশ অমিতাভ বচ্চন ফেল । কি ভীষণ সুদর্শন আর হ্যান্ডসাম দেখাচ্ছে আজ টিংকুকে।

চলবে…

ক্যান্সার (পর্ব১৯)

Khugesta

অনেকে বুদ্ধি দিচ্ছেন চুল হীন মাথা সুন্দর হিজাবে ঢাকো । কেউ কেউ বলছেন ঘোমটা পর। কেউ কেউ আলগা চুলের কথাও বলছেন।

আলগা চুল, সুন্দর হিজাব পরলে যত সুন্দরই লাগুক কোন গুনাহ হবে না।

যদিও সৌদি বাদশাহ মুহম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবে ইতোমধ্যেই হিজাব পরা খানিকটা শিথিল করে দিয়েছেন। তবুও আমাদের দেশে হিজাবের সংখ্যা কেবল বাড়ছেই। ইরানে ২২ বছর বয়সী মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে হিজাব বিরোধী বিক্ষোভ দিন দিন উত্তাল হচ্ছে ।

চুলের সৌন্দর্য ঢাকতে কোনদিন হিজাব পরিনি। আজ খালি মাথা ঢাকতে কেন হিজাব পরব।

নিজের চুলহীন মাথা নিয়ে লজ্জাই বা পেতে হবে কেন, বৃথাই কেন হিজাবের আড়ালে নিজেকে লুকাবো।

আমাকে যারা দেখবেন তাঁদের সমস্যা আমার তো নয়। শুরুতে একটু হয়ত বেখাপ্পা লাগবে হবে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে। তাঁরা মেনে নিতে শিখবেন টাক মাথা পুরুষের মত নারীও আছে।

একটি কথা বার বার ভেবেও কোন কূল কিনারা পাই না তা হচ্ছে, সমস্ত পাপ কেন চুলে যেয়েই ঢুকলো?

যাক আপাতত আমার চুল নেই তাই ভাবনাও নেই।

এখন নিশ্চয়ই কেউ বলবে না, ”আপা আপনার হিজাব কোথায়?”

দেশটাকে মাঝে মাঝে ভীষণ অচেনা মনে হয়।

ভালো থেকো প্রিয় স্বদেশ আমার প্রিয় মাতৃভুমি।

চলবে…

ক্যান্সার (পর্ব১৮)

Khugesta

২০১০ এ আমার স্বামীর ক্যান্সার ধরা পরার পর থেকে জানার চেষ্টা করেছি এই ব্যাধিটি কেন হয় ?

ক্যান্সার হচ্ছে মানবদেহের কোষের পরিবর্তিত রূপ, এক ধরনের জেনেটিক মিউটেশন। প্রতিটি মানুষের শরীরেই নাকি ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা ৬% । শুনেছি প্রাত্তাহিক জীবন যাপন প্রণালী এই রোগের সম্ভাবনা কে নিয়ন্ত্রণ করে।

গত ১১ বছর যাবত চেষ্টা করেছি এই রোগ থেকে দূরে থাকার। বাসায় রেডমিট আনা বন্ধ করা সহ চেষ্টা করেছি স্বাস্থ্যকর জীবন যাপনের। খাদ্যাভ্যাসে কত কিছু বাদ দিয়েছি আবার অনেক কিছু নতুন করে সংযোগও করেছি।

কিন্তু কোন ফাঁকে শরীরের অলিন্দ গলে ঢুকে গেলো ঠিকই । আমার স্বামী সবসময় কানে লাগিয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলত বিধায় ধারনা হল মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন কারণ হতে পারে। আমাদের বাসার সবাই স্পিকার অন করে কথা বলি।

কিন্তু এবার ক্যানাডা থেকে ফেরার পর রাতের বেলা শুয়ে শুয়ে ইউটিউব দেখতাম কয়েক ঘণ্টা। তবে কি আমার ক্যান্সারটাও মোবাইল ফোনের রেডিয়েশন থেকেই ?

বুকের উপড়েই হাতে ধরা থাকতো তো !

জানি না ঠিক।

মনের ভেতর কত শত প্রশ্ন যে উঁকি দিয়ে যায় তাঁর কি কোন ঠিক আছে নাকি সঠিক ব্যাখ্যা আছে ?

যতবার আয়নায় চোখ পরছে চুলহীন নিজেকে অচেনা লাগছে তবে মন খারাপ হচ্ছে না এক ফোঁটাও । পৃথিবীতে আমাদের সময়কাল নির্ধারিত। ভেবে লাভ নেই।

জীবনের প্রতিটি বাঁকে উপলব্ধি করেছি আমি বিধাতার ইচ্ছার কাছে জিম্মি। জীবনে অনেক কিছু চেয়েছি যা পাইনি, আবার এতো বেশী কিছু পেয়েছি যার কল্পনাও আমি হয়ত করিনি কোনদিন।

একদিন চার দেওয়ালের মাঝে কত অনাদর,অবহেলা,উপেক্ষা সয়েছি। আবার বাইরের জগতে মানুষের শ্রদ্ধা-সম্মান, ভালবাসাও তো কম পাইনি ।

সৃষ্টিকর্তা কোন না কোন ভাবে মানুষের সঠিক প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দেন ।

এক জীবনে কত শত বর্ণের অভিজ্ঞতার সমাহার।

মাঝে মাঝে আনমনেই ভাবি মায়া-মমতা ঘেরা পরিবারের প্রচণ্ড আদুরে কন্যার জীবন কি এতোটাই কঠিন হওয়ার কথা ছিল ?

নাকি মাত্রাতিরিক্ত ভালোত্ব আর ভদ্রতাই তাঁর জীবনে কাল হল ???

চলবে..

ক্যান্সার (পর্ব১৭)

Khegusta

পৃথিবীতে কোন কোন মানুষ কেবল বেঁচে থাকার জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞ হয় আবার কেউ কেউ আনন্দ উল্লাসে তাঁকে ভুলে থাকে।

কিছু কিছু মানুষের জীবনে কেবলই বেদনা আর না পাওয়া আবার কিছু কিছু মানুষের ঝুলি ভর্তি কেবলই জয় জয়কার।
পৃথিবীতে দুই ধরনের মানুষ আছেন বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী। যারা অবিশ্বাসী বা নাস্তিক তাঁরা আল্লাহ্‌, খোদা,ভগবান বা গডে বিশ্বাসী নন কেবলই প্রকৃতিতে বিশ্বাস করেন। যা প্রকারন্তরে বিশ্বাসেরই নামান্তর, কেবল ভাষাটা আলাদা। তাঁরা বলেন প্রকৃতির প্রতিশোধ, তাঁর নিজস্ব হিসাব আর আমরা বিশ্বাসীরা বলি আল্লাহ্‌র ইচ্ছা কিংবা তাঁর বিচার।

ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতা বলে কষ্ট, বেদনা আর না পাওয়াটাও এক ধরনের পাওয়া যা তোমাকে পরিশুদ্ধ করে জীবনকে পরিপূর্ণ রূপে বুঝতে সাহায্য করে।প্রকারন্তরে যা আল্লাহ্‌র নৈকট্য লাভের সহায়ক ।

২০০৫ এ হজ্ব করতে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে ৩রা জানুয়ারিতে বিশাল এক কার এক্সিডেন্টের কবলে পরি। এক্সিডেন্টে আমার মুখের এক পাশ জানালার ভাঙ্গা কাঁচ ঢুকে ক্ষত বিক্ষত করে। অনেক ঘণ্টা আমি অচেতন থাকি। জ্ঞান ফিরলে বুক পিঠ হাত পা সহ পুরো শরীরে ব্যথা। যখন আয়নার সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম নিজের কুৎসিত রূপ দেখে চমকে উঠলাম।এর থেকে বুঝি বা মৃত্যুও ভালো ছিল।

আমার শাশুড়ি সহ টিংকুর পুরো পরিবার হজ্বে যাচ্ছে। ওর মেজো বোন বললেন ”অসুস্থ মুন্নি সঙ্গে যাওয়া মানে আমাদের সকলের হজ্বে ডিস্টার্ব হওয়া।” কিন্তু টিংকু নাছোড় বান্দা আমাকে হজ্বে নিয়েই যাবে। ওর কথা হচ্ছে আমাকে সঙ্গে না নিয়ে গেলে মানুষ আমাকে অপবাদ দিবে ”আল্লাহ্‌ আমার হজ্ব কবুল করেননি।” আমি আহত হব, মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পরবো।

হজ্বের উদ্দেশ্যে মদিনায় যাওয়ার পর মনে হল না আসাটাই বুঝি ভালো ছিল। গায়ে ভীষণ জ্বর, বুকে পিঠে প্রচণ্ড ব্যথা। কিছু খেতেও পারছি না, বিন্দুমাত্র নড়াচড়াও না। ওরা সবাই মসজিদে নববিতে নামাজ পড়তে যায় আর আমি বিছানায় শুয়ে নামাজ আদায় করি। সাতদিনে অনেকটা সুস্থ হয়ে গেলাম।আমিও মসজিদে যেয়ে নামাজ আদায় করা শুরু করলাম।
একদিন মসজিদে এক পাকিস্তানী মহিলা চেহারায় আঘাত দেখে কারণ সুধালেন, সব শুনে তিনি বললেন, ”তুমি কত ভাগ্যবতী, স্বয়ং আল্লাহ্‌ তোমাকে পরিশুদ্ধ করে এখানে এনেছেন, মনোযোগ সহকারে মন প্রাণ ঢেলে যাতে তুমি হজ্ব পালন করতে পারো, দোয়া করতে পারো তাঁর ব্যবস্থা করেছেন, নিশ্চয়ই তুমি তাঁর প্রিয় বান্দা, তোমাকে তিনি অনেক ভালো না বাসলে এই অবস্থায় কোনদিন আনতেন না এখানে।” তাঁর কথা শুনে আমি কাঁদতে লাগলাম।
সত্যিই তো মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছি।

জীবন-মৃত্যুর এই অনিশ্চয়তায় জীবনকে যতটা বুঝা যায় তোতোটা আর কোন কিছুতেই নয়।

মক্কায় যখন মূল হজ্ব পালন করতে গেলাম তখন আমি প্রায় পুরপুরি সুস্থ। যখনই কাবা শরিফে যাই জমজমের পানি দিয়ে মুখ ধুই আর আল্লাহ্‌র কাছে করুনা ভিক্ষা করি।এখানে এসে পরিবারের অনেকেই অসুস্থ হলেন কিন্তু মিনা আরাফাত ময়দান সহ প্রতিটি জায়গায় আমি পরিপূর্ণ সুস্থতায় ভালো ভাবে হজ্ব পালন করতে পারলাম । হজ্ব শেষে আশ্চর্য জনক ভাবে আমার মুখের ক্ষতগুলো অনেকটাই সেরে গেলো।

এই ঘটনাটি যতবার ভেবেছি ততোবারই মনে হয়েছে হজ্বের আগে এক্সিডেন্ট আমাকে কনসেন্ট্রেশন এনে দিয়েছে। মানসিকভাবে পরিবর্তিত আমাকে কষ্ট সহিষ্ণু আর ধীরতা সহকারে মূলত বিচক্ষণ করেছে। আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে সৌন্দর্য এবং জীবন ক্ষণস্থায়ী, যে কোন মুহূর্তে যার পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে।

২০১০ এ আকস্মাৎ টিংকুর ব্রেইন ক্যান্সার আর তাঁর মৃত্যুতে মনোজগতে তোলপার করে ফেলেছে, অনেক বেশী মানবিক করেছে, জীবনকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। বুঝতে শিখিয়েছে পৃথিবীতে বিরুদ্ধ শক্তির সাথে লড়তে হবে একাই।চারিদিকে লোভী মানুষের মাঝে টিকে থাকা সহজ নয়, এই কষ্ট সাধ্য ব্যাপারটিকেও সহজে মেনে নিয়েই পথ চলতে হয় ।

টিংকুর কাছ থেকেও আমার শিখার কোন শেষ নেই। মাত্র ৪ বছর বয়সী পিতৃ হারা টিংকু জানতেনও না, বুঝতেনও না যে স্বামীরও অনেক দায়িত্ব থাকে। কিন্তু মানুষ হিসেবে টিংকুর তুলনা কেবলই টিংকু।

সৃষ্টিকর্তা বিপদ দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন আর অসুখ দিয়ে পরিশুদ্ধ করেন। তাঁর নির্দেশিত কাজের উপযোগী করে গড়ে তুলেন। যাকে তিনি পছন্দ করেন তাঁকেই তিনি উপযুক্ত হিসেবে বেছে নেন।

এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে অসুস্থ অনেকেই লিখেছেন তাঁদের অসুস্থতাকে চারিপাশের মানুষ অভিশাপ বলেছেন।বলেছেন কোন না কোন মন্দ কাজের ফলস্বরূপ তাঁদের এই শাস্তি। এই সমাজের কিছু অসৎ এবং মূর্খ লোক তাঁদের মন্দ বলে মজা লুটছেন।

কিন্তু আমি বিশ্বাস করি এটা কেবলই পিউরিফাই বা পরিশুদ্ধের পথে হাঁটা।

এই শুদ্ধতা মানে কেবলই নামাজ, রোজা হজ্ব জাকাত নয় এই শুদ্ধতা মানে হচ্ছে মানুষ হিসেবে দায়িত্ব পালন।
দীর্ঘ এই চিকিৎসা প্রক্রিয়া শেষে আমি নিশ্চয়ই আগের থেকে বেশী কষ্ট সহিষ্ণু হব, মানবিক হব, স্থির হব, অপরের বিপদে ঝাঁপিয়ে পরে সাহায্য করব। প্রতিদিন নিজেকে একটু একটু করে ভাঙবো আবার নতুন করে গড়ে তুলবো, ভালো থেকে ভালোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকবো।

মহান সৃষ্টিকর্তা অবশ্যই তাঁর সৃষ্টিকে ভালবাসেন এবং সমস্ত দুঃসময়ে তিনি তাঁর পাশে থাকেন। স্রস্টা তাঁর সৃষ্টিকে ছেড়ে যেতে পারেন না কিছুতেই।

চলবে…

ক্যান্সার (পর্ব১৬)

Khugesta

আজ অনেকদিন পর একনাগাড়ে ৭ ঘণ্টা ঘুমাতে পারলাম। ঘুম ভেঙ্গে এক অপার ভালো লাগা। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় ভুল হচ্ছে ”মানুষ নিজের আয়নায় অন্যকে দেখে।” নিজের চাওয়া-পাওয়া মিলিয়ে অন্যকে হিসেব করে।

মানুষ এমন এক প্রাণী যাকে বীজগণিতের অংকের মত ফর্মুলায় ফেলে মিলানো যায় না। কাউকে কাউকে হয়তো যায় কিন্তু সবাইকে নয়। অন্য একজনের হিসেব নিকেশ চাওয়া পাওয়া অপর একজনের মত নাও হতে পারে।

একই সময়ে পৃথিবীর অপর প্রান্তে থাকা অসুস্থ এক বন্ধুর সাথে কথা হল। যে কিনা শুধু মাত্র ”কেমন আছ” বললেই ক্ষেপে যায়। তাঁর কথা হচ্ছে ”আমি অসুস্থ এই কথাটি বার বার মনে করিয়ে দিতে হবে কেন? তা ছাড়া তোমরা তো সবাই আনন্দ ফুর্তিতে আছ আমাকে অযথাই জিজ্ঞেস করে কষ্ট দিচ্ছ কেন ?

দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যবধান থাকা স্বাভাবিক। আমরা বুঝতে চাই না চেতনে অবচেতনে আমরা কেবল নিজের পরিবার নয় সমাজেও ছাপ রেখে যাচ্ছি।

আমার সুস্থতা-অসুস্থতায় অন্য কারো কিছু যায় আসে না। কিন্তু অসুস্থ যারা আছেন কিংবা ভবিষ্যতে একই ট্রমার ভেতর দিয়ে যাদের যেতে হবে তাঁদের জন্য আমি অবশ্যই উদাহারন।

তাঁরা আর একাকীত্বে ভুগবে না, অভিশাপও ভাববে না। ভেবে কষ্ট পাবে না ”একা আমিই কেন?” জানবে অসুখ হওয়ার জন্য মূলত কোন কারণ লাগে না।

আমি অসুস্থ জানার পর চারিপাশের একই ব্যাধিতে আক্রান্ত অনেকে তাঁদের নিজেদের অসুস্থতার খবর জানিয়েছেন, ভরসা দিয়েছেন। এখন আর নিজেকে একা মনে হচ্ছে না। আমাদের দেশের অনেক বড় এক রাজনৈতিক নেত্রীও এই রোগে আক্রান্ত অথচ আমাদের তাঁরা জানতেও দেননি।

অনেকে বলেন আপা সমাজের চিন্তা বাদ দেন । কিভাবে বাদ দিবো ? অন্যের জন্য পথ কে সহজ করার দায়িত্ব নিয়েই মূলত আমাদের জন্ম হয়। বড় কোন কাজের দায়িত্ব পাইনি ছোট ছোট কাজ গুলোই না হয় করে যাই।

সমাজ সংস্কারের দায়িত্ব কারো একার নয় আমাদের সবার। কত কাজ বাকি রয়ে গেলো। কত কুসংস্কার নারীর জন্য অবমাননাকর কত প্রথা রয়ে গেছ আজও।

বেশীর ভাগ মানুষই ভাবে আমি সয়েছি তুমি সইলে ক্ষতি কি ? আমি ভাবি যে কষ্ট আমি সয়েছি তোমায় সইতে দিবো না কিছুতেই।

বিধবা মহিলাদের জন্য কত কি যে করার ছিল। অল্প বয়সে বিধবা নারী মানেই যেন অসহায় আর অন্য নারী-পুরুষের অপবাদের বস্তু। পুরুষরা ভাবে আহা একা আছে অথচ আমি ভোগ করতে পারছি না আর নারীরা পুরুষের এই মনোভাব বুঝে বলেই ইনসিকিউরিটিতে ভুগে।

তবে কাউকে বিন্দুমাত্র ছাড় দেইনি আমি। মুখ বন্ধ করা জবাব দিয়েছি সবসময়।

টিংকু টিজ করে বলত ”মুন্নি এতো নরম কোমল কাউকে কষ্ট দিতে পারে না, জবাই করে দিবে কিন্তু এক ফোঁটা রক্তও ঝরবে না।”

সমালোচনার তোপে বলতে ছাড়িনি ”তোমরা শো কলড হাঁই সোসাইটির শরীর সর্বস্ব মহিলারা সাজিয়ে গুঁজিয়ে মূলত নিজেদের পণ্য বানাও, ফট ফট ইংরেজি বলে নিজেকে বাহবা দাও অথচ তোমাদের মাথা ভর্তি যে গোবর সে খবর জানো না। যতই প্রসাধন চর্চিত হও তোমাদের ঈর্ষা আর হৃদয়ের কদর্যতা ঢাকতে পারনা কিছু দিয়েই।”

আমার লেখার ভীষণ ভক্ত আর সবচেয়ে বড় সমালোচক হচ্ছে আমার কন্যা শ্রেয়া। ফটিকের অনভিপ্রেত ঘটনাটি সামনে আনতে ও’ই আমায় অনুপ্রাণিত করেছে। এখনকার আধুনিক কন্যারা অনেক বেশী সাহসী আর স্পষ্টভাষী।

আমার পুত্র আর কন্যাদের বান্ধবীরা যখন বলে ” অ্যান্টি আমি আপনার মত হতে চাই,” আবেগে আপ্লুত হয়ে বলি, ”আমার তো এক হৃদয় ছাড়া আর কিছু নেই তোমরা আমার থেকে অনেক অনেক বেশী বড় হবে।”

কিমোর প্রভাবে মাথা থেকে চুল উঠে যাওয়ার খবর শুনে চট্টগ্রাম থেকে জাকির ভাই ফোন দিয়ে বললেন এটা কি তোমার জন্য বড় কোন বিষয় সেই তরুণী বেলাতেই চুল ন্যাড়ে করেছ এখন তো কোন ব্যাপারই না। দুজনেই হাসতে থাকলাম।
প্রায় ২৬ বছর আগে ২৭ বছর বয়সী এক তরুণী ন্যাড়ে মাথা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর শ্বশুর বাড়ির সবাই তাঁকে কখনো পাগল কখনো বোকা বলে উপহাস করছে।শান্ত মেয়েটি কারো কথার জবাব দিচ্ছে না, কোন প্রতিবাদও না, নত মুখে কেবলই হাসছে। নরম, কোমল, মিষ্টি হাসি।

আমার কোমর ছাপানো লম্বা চুল। এতো বেশী সোজা আর সিল্কি যে হাত খোঁপা খুলে যায় একটু পর পর। টিংকুর সাথে ঝগড়ার এক পর্যায়ে একদিন খোঁপায় হাত দিল আর নির্বাক আমি চুপ হয়ে গেলাম। টিংকু ধরে নিল এটা আমাকে চুপ করানোর অস্র ।

এক দিন, দুই দিন, তিন দিন।আজ টিংকু বাইরে চলে গেছে আর আমি সেলুন থেকে নাপিত ডেকে এনেছি। বললাম, আমার টাইফয়েড চুলটা ন্যাড়া করে দিন।এতো সুন্দর চুল, নাপিত হাতে ধরে বসে আছে কিন্তু কাটতে পারছে না। জোরে এক ধমক লাগিয়ে দিলাম, ”কাটুন।” নাপিত খুর বের করলেন ।

এতো বছর পর আজ আবারও নাপিত ডাকতে পাঠিয়েছি। আজ মিথ্যে নয় সত্যি সত্যিই আমি অসুস্থ, চুল ন্যাড়া করতে হবে।

চলবে…

ক্যান্সার (পর্ব১৫)

Khugesta

অসুখটা কমন পরে গেছে বিধায় টিংকুকে মনে পরছে অবিরত। ব্রেইন ক্যান্সারে আক্রান্ত ওর জীবনের শেষের দুমাস অচেতন ছিল। আসলে কষ্ট কমানোর জন্য ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হত। ওর বন্ধু পপসি ভাই বললেন, ” পারমিশন দাও কেমো আর রক্ত না দেওয়ার। বি-নিগেটিভ, এতো রেয়ার গ্রুপের রক্তের প্লাজমা নষ্ট করছ কেন, কিসের আশায়।”

পপসি ভাই কেবল টিংকুর বন্ধু নয় আমাদের বড় আপনজন। কেউ সাহস পাচ্ছে না এই জন্য পপসি ভাইকে দিয়ে বলিয়েছে। এই ডিসিশন দেওয়া মানে টিংকুর মৃত্যুকে দ্রুত আমন্ত্রণ জানানো। আমি বললাম ওর বাচ্চাদের জানান। আমার ভাই বললেন পাগল নাকি ওরা এতো ছোট এই মানসিক প্রেশার ওদের দিবে কেন । তবে ওর মা’কে জানান, ভাই-বোনদের জানান। পপসি ভাই বললেন এই কষ্ট আর কাউকে দিও না মুন্নি তুমি একা নাও।

সবচেয়ে প্রিয় আর আপন মানুষের মৃত্যুর ডিসিশন আমার দিতে হল।

বাসায় ফিরে আমার নিজের মায়ের সাথে চিৎকার করলাম, খারাপ ব্যাবহার করলাম অযথাই।আসলে ডিসিশনের এই ট্রমা নিতে পারছিলাম না আমি।

অচেতন থাকলেও নিয়মিত চুল ছেঁটে দিতাম, দাঁড়ি ক্লিন শেভ করাতাম।কারণ হচ্ছে মেয়েটা এতো ছোট ও যেন বড় হয়ে পিতার চেহারা পরিষ্কার মনে করতে পারে। চুল আর দাঁড়ির আড়ালে যেন এলোমেলো হয়ে না যায়।

এখন আমি নিয়মিত চুল ছোট করছি। কারণ কেমোর প্রভাবে চুল পরা শুরু হয়ে গেছে। হাতের তালুতে চামড়া উঠছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন ধীরে ধীরে সমস্ত চুল নাই হয়ে যাবে।

আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য আমার দুই সন্তান, ড্রাইভার জাহিদ আর আজিজও চুল নেড়ে করতে চেয়েছে। কিন্তু ওদেরকে বলেছি তোমাদের সুন্দর চুল নিজের চুল হীনতার কষ্টকে ভুলিয়ে দিবে।

ক্যান্সারের খবরটা আমি শুরুতে সবাইকে হাসি মুখেই দিতে চেয়েছি। মৃত্যু শাশ্বত চিরন্তন । অযথাই কাঁদব কেন !

যাকেই বলি সেই বলে মিথ্যে বলছ । শিখা ভাবি বাসায় এলেন, আমায় হাসি- খুশী আর স্বাভাবিক আড্ডার আবহে দেখে বললেন তোমার অপারেশনের জায়গাটা আমায় দেখাবে। আমি বললাম নয় কেন এ পর্যন্ত কত জনকে দেখাতে হয়েছে, লজ্জা আর দ্বিধা এখানে নির্বাসিত। তবুও সন্দেহ যায় না, আবারও বললেন সত্যিই তোমার ক্যান্সার ? হাসতে হাসতে বললাম হে রে বাবা।

লাইলুন আপা বড় এক বাস্কেট ভর্তি ফল পাঠিয়ে দিলেন । ফোনে ধন্যবাদ জানাতে না জানাতেই বললেন আমার শরীরটা অনেক খারাপ মুন্নি, নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হচ্ছে কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে হয় না।

জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কত কিছু যে শেখার আছে। নিজে এতোটা অসুস্থ অথচ আমার জন্য উপহার পাঠাতে ভুলেন নি। আমি বললাম ”আপা আমরা আর কতদিন বাঁচবো জানা নেই। মন যা চাইবে তাই খাবে । ঢাকা ক্লাবে খাবার অর্ডার করে গাড়ি পাঠিয়ে দিবে । প্রয়োজনে ১০০ টাকার জিনিস ১০০০ টাকা পরবে, ওই হিসাব তোমার জন্য নয়।কারণ এখন টাকার থেকে সময় অনেক বেশী মূল্যবান।”

আমার পাশের বাসার বান্ধবী কলি খাবার পাঠিয়েছে। খেতে বসে মনে হল দীর্ঘদিন বুঝি উপোস ছিলাম, গোগ্রাসে খেলাম।

ধানমণ্ডির বান্ধবী মুনিরা সহ অনেকেই বলেছেন কেবল বলবে হাসপাতালে খাওয়া হাজির। আমি হাসি আর বলি তোমরা আমাকে মোটা বানিয়ে ফেলবে।

কত জন কত কথা বলেন সাহস দেন।

পান্না ভাই ফোন দিলেন। টিংকুর চিকিৎসাকালীন সিঙ্গাপুরে থাকার সময় পান্না ভাই আর ওনার স্ত্রী বাঁধন আপা আমাদের কি লাগবে না লাগবে খেয়াল রেখেছেন সবসময়। দীর্ঘ দিন ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে কয়েক বছর আগে হেরে গেছেন বাঁধন আপাও । আপার ছোট বোনেরও শুনেছি একই রোগ। আমার এই কষ্ট উনি না বুঝলে আর কে বুঝবে।

হাসতে হাসতে পান্না ভাইকে বললাম তোমার সাথে আমার ন্যূনতম প্রেমও হল না অথচ রোগটা হল ঠিকই। পান্না ভাই বললেন ফাজলামো করে আমাকে হাসাতে চাচ্ছ ভেতরে ভেতরে তোমার কান্না আমি বুঝতে পারছি না ভবছ ?

বাঁধন আপার অসুখের সময়ের অজানা কথাগুলো আলোচনা করতে করতেই পান্না ভাই কান্নায় ভেঙ্গে পরলেন। স্ত্রীর প্রতি স্বামীর এই তীব্র ভালবাসা খুব কম মেয়ের ভাগ্যেই জোটে । বাঁধন আপা নিঃসন্দেহে তুমি অনেক ভাগ্যবতী।

এভাবে বেদনা জাগাতে হয় না পান্না ভাই।আজ তুমি আমায় কাঁদিয়েই ছাড়লে।

চলবে…

ক্যান্সার (পর্ব১৪)

Khugesta

কদিন থেকে আমার ভীষণ মন খারাপ। জামালপুর গেলাম। আমাদের পরিবারে সবাই সবার বন্ধু। অনেক দিক থেকে আমার অনেক স্বাধীনতা এখানে। সবচেয়ে বড় স্বস্তির জায়গা ”আম্মা।” আম্মাকে আমি সব কিছু বলতে পারি।

বললাম আম্মা, ”আমার মন খারাপ ইঞ্জিনিয়ার তো বিয়া কইরা ফালাইলো।”

আম্মা বললেন, ” মা হারা ছেলেটার দোষ কি, তুমি ওরে বেশী কষ্ট দিছ, মাও(আহমেদ সাইদ মাও) আর আসফিয়া (তাঁর স্ত্রী) তো অনেকবারই ওর সাথে বিয়ার কথা কইছে, তাগিদ দিছে , তুমিই তো পরীক্ষা আর থিসিসের অজুহাতে কেবলই পিছাইলা । ডাঃ মাও ভাই তখন চাকরী সূত্রে জামালপুর থাকতেন। কয়দিন ছাত্রলীগের নেতায় তোমারে ডিস্টার্ব করল, সে আর কত সইবে ।”

আম্মা আমাকে এবার সাবধান করে বললেন, ”এইবার তুমি টিংকুর কথা বেশী গল্প করতাছ, তুমি অবিবাহিত মেয়ে, মায়ায় ভর্তি নরম মন, স্পর্শ কাতর। অভিজ্ঞ ওই পোলা তোমারে পটাইয়া ফেলব।ওর সাথে দূরত্ব মেইনটেইন কর আর মিশবা না।”

আমি ঢাকায় ফিরে এলাম। অ্যাপ্লাইড কেমেস্ট্রির এক বড় ভাই বললেন কাল রাতে তোমায় দেখেছি ”তুমহারি অমৃতা” (শবানা আজমির পত্র নাটক) দেখতে গিয়েছিলে । আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম প্রশ্নই উঠে না। ছেলেটি আবারও বলল তবে আমি কাকে দেখলাম ?

বিকেল বেলা টিংকু ভাই এলেন আমরা দুজন পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের বিল্ডিং এর সামনের সিরিতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মুখোমুখি বসে কথা বলছি। গোটা কার্জন হলের এই বিল্ডিং টা সবচেয়ে বেশী সুন্দর,আবার একই সাথে ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর বলার কারণ হচ্ছে এখানে বসে আমাদের সব পরীক্ষা সম্পন্ন করতে হয়।

তিনি জানালেন ”তুমহারি অমৃতা” দেখতে গিয়েছিলেন । হাসতে হাসতে বললাম সঙ্গে নিশ্চয়ই গার্ল ফ্রেন্ড ছিল । অপ্রস্তুত টিংকু ভাই এবার পাল্টা প্রশ্ন করলেন কে বলছে তোমাকে ? আমি হাসতে হাসতে উত্তর দিলাম কার্জন হলের অনেক ইয়াং টিচার ভাবছে আপনি বুঝি আমার প্রেমিক একই সাথে ডাবল গেম খেলছেন। আমরা ভালো বন্ধু কিন্তু বন্ধুত্বটা সবাই বুঝে না।প্রশ্ন করলাম কে সেই নারী? টিংকু ভাই লজ্জা পেলেন কিন্তু উত্তর দিলেন না। আমি নিশ্চিত তাঁর অন্য কোন নারীর সাথে সম্পর্ক চলছে।

বন্ধুত্ব হচ্ছে লেনদেন বিহীন এক সম্পর্ক যেখানে কোন প্রত্যাশা ছাড়া একে অপরের শুভ চিন্তক।

টিংকু ভাই প্রায় প্রতিদিন আমাকে চিঠি লিখেন। বেশীরভাগ চিঠিই হতাশা, স্বপ্ন হীনতা আর বেদনায় নীল।

আমি মাঝে মাঝে উত্তর লেখি কিন্তু ঠিক চিঠির মত করে লেখি না। আমার মনে অবিশ্বাস জন্মেছে তিনি অন্যদের দেখাবেন প্লাস তাঁর কাছে চিঠি থাকুক চাই না আমি। রাফ করার জন্য নিউজ প্রিন্টের কাগজ। সেই কাগজে উত্তর লেখি। বেশীরভাগ চিঠিতেই ফুল ফল লতা পাতার ছবি আঁকি । এই যেমন ধূমায়িত চায়ের পেয়ালা এঁকে লিখলাম আমি এখন চা খাচ্ছি আপনি খাবেন ? আপনার মন আজ কেমন আছে ? আপনার বাসায় ছোট ভাইরা কি করছে ? সেই সময় চলতে থাকা টেলিভিশন সিরিজ নাটক ”কোথাও কেউ নেই” এর কোন সিনটা ভালো লেগছে এসব লেখি। এই চিঠিতে প্রেমিকা ভাবার কোন অবকাশ রাখি না । আমার হাতের লেখা ভীষণ খারাপ যে কেউ দেখলে ভাববে বুঝিবা স্কুলের গণ্ডী পার হইনি। সম্বোধনে লেখি শ্রদ্ধেয় টিংকু ভাই ইতিতে লেখি স্নেহের মুন্নি ।

বিরক্ত হয়ে টিংকু ভাই বললেন তুমি দেখি ভালো করে চিঠিও লিখতে জানো না।তুমি কি এতোই ফকির তোমার একটি রাইটিং প্যাড কেনারও টাকা নেই। আমি হাসতে হাসতে জবাব দিলাম আমি তো সাহিত্যের ছাত্রী নই বিজ্ঞানের ছাত্রী। আমি অংক বুঝি, অ্যাকশন-রিঅ্যাকশন বুঝি, সমীকরণ বুঝি কিন্তু সুন্দর চিঠি লিখতে পারি না।

চিঠির উত্তর দেওয়ার কারণ হচ্ছে সম্পূর্ণ বিষাদে ডুবে থাকা মানুষটা যেন কষ্টের কথা বলে নিজেকে হালকা করতে পারে। আমি তাঁকে সাহায্য করতে চাই ।

একদিন বিকেলে মাঠে বসে বাদাম খেতে খেতে জানালেন ইকবাল (হুইপ ইকবালুর রহিম) বলেছে ” মুন্নির গলাটা রাজ হাঁসের মত অহংকারী কিন্তু কার্জন হলে সময় নষ্ট করে লাভ নেই ও আপনাকে বিয়ে করবে না। ইকবাল ভাই আমার অল্প সিনিয়র। দিনাজপুরের তহু, ডেইজী সহ ছোট বড় আমরা মাঝে মাঝে কলা ভবনের মাঠে আড্ডায় মেতে উঠি। আমাদের সম্পর্কটা নিখাদ বন্ধুত্বের।

আমি বললাম কি আশ্চর্য বিয়ের প্রশ্ন আসছে কেন ? তা ছাড়া আপনার তো গার্লফ্রেন্ড আছে । বেইলী রোডে খাবারের দোকানে চটপটি খেতে আপনাদের দেখা গেছে । রিকশার হুড ফেলে হাসসজ্জল আপনারা একসাথে সেখানে খেতে গেছেন।

টিংকু ভাই খানিকটা অপ্রস্তুত হলেন কিন্তু সামলে নিলেন ।

সেশন জ্যামের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন প্রায় ৩০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী একসাথে । হলে যারা থাকে ক্যাম্পাসের মধ্যেই ঘুর ঘুর করে। এখানে সংবাদ পাওয়া মোটেও কষ্ট সাধ্য নয়। উপরন্তু আমি মিশুক প্রকৃতির আমাকে সাবধান করা শুভ চিন্তকের অভাব নেই।

আমি ব্যস্ত আমার থিসিস পেপার রেডি করা নিয়ে। টিংকু ভাই বললেন আনন্দ প্রিন্টার্সে রাব্বানি জাব্বার ভাইয়ের প্রেসে প্রিন্ট করিয়ে দিচ্ছি নটরডেমের পাশে এখানে আসো ।বার বার বললাম দরকার নেই আমি নিজেই করে নিতে পারব কিন্তু তিনি নাছোড় বান্দা।

হঠাৎ একদিন বললেন আমার বোনরা সবাই ঢাকায় তুমি ওদের সাথে দেখা করবে মুন্নি ? আমি বললাম আমি কেন দেখা করবো ? তিনি বললেন তুমি আমার ভালো বন্ধু একারণেই না হয় দেখা করলে । আমি বললাম ওনারা আমাকে পাত্রী হিসেবে ভাবছেন না তো ? তিনি বললেন ভাবলেই ক্ষতি কি এটলিস্ট আমার জন্য পাত্রী দেখা বন্ধ হবে।ওরা পাত্রী দেখে দেখে আমার ইজ্জত সম্মান শেষ করে ফেলছে সেটা অন্তত বন্ধ হবে। আমি বললাম আপনার চটপটি খাওয়া গার্লফ্রেন্ডের সাথে কি ব্রেকআপ হইছে ? আপনার কি গার্লফ্রেন্ড একটা, নাকি একাধিক ?

টিংকু ভাইয়ের পরিবার দেখার আগ্রহ আমারও আছে। যাই দেখে আসি অসুবিধা কি । ডাসের সামনে সবাই এসেছে । আমি একটি মাড় ছাড়া ত্যানা শাড়ি শরীরে পেঁচিয়ে নিলাম।

আম্মা প্রায়ই পাত্র নতুবা পাত্রের পরিবার পাঠায়, তাঁদের সাথে দেখা করে কথা বলা আমার জন্য বাধ্যতামূলক। এই অসম্মান জনক কাজটিকে আমি খুব একটা পাত্তা দেই না। গত আট বছরে এটা আমার অভ্যস্ততায় পরিণত হয়েছে বিধায় নতুন কিছু নয়। আম্মাকে অনেক বলেও বুঝাতে পারি না পড়াশুনা শেষ করার আগে বিয়ে করলে রসায়নের মত কঠিন বিষয় সমাপ্ত করা সম্ভব নয়।আবার বিয়ের জন্য আম্মা কখনো জোড় করেননি এটাও সত্য।

বিকেল বেলা টিংকু ভাই দেখা করতে এসেছেন । তিনি আজ পদার্থ বিজ্ঞান ভবনের সামনের অল্প উঁচু রেলিং এর উপর বসেছেন, আমি দাঁড়িয়ে কথা বলছি । আমি বললাম আপনি কোনদিন বলেননি আপনার পরিবারের সবাই বোরকা পরেন । তিনি বললেন তোমার পরতে হবে না। আমি বললাম আমার পরিবার কোনদিন আপনার সাথে আমার বিয়ে মেনে নিবে না। তা ছাড়া আপনার গার্ল ফ্রেন্ড আছে আমি নিশ্চিত।

তিনি বললেন তোমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে চাই। আমি বললাম আমাকে মেরে কুটি কুটি করে ব্রহ্মপুত্র নদীতে ভাসিয়ে দিবে তবুও আপনার সাথে বিয়ে দিবে না কোনদিন।

তিনি বললেন প্রস্তাব পাঠিয়েই দেখি আমি বললাম অহেতুক আমার জীবনটাকে অসহ্য করে ফেলেন না আপনি। আমাকে ওরা বাসা থেকেই বের হতে দিবে না , জামালপুরেই আটকে রাখবে। আমার আম্মা ভীষণ জেদি আর রাগী, মেরে ফাটিয়ে দিবে।

অনেকদিন আর তাঁর সাথে কোন যোগাযোগ নেই। তিনি চট্টগ্রামের ফোন নাম্বার পাঠিয়ে বলেছেন আমি যেন অবশ্যই তাঁকে টেলিফোন করি। ১৯ শে সেপ্টেম্বর আমার ভাইভা পরীক্ষা শেষে ফরেন মিনিস্ট্রিতে লায়লা আপার অফিসে যেয়ে ফোন দিয়ে বললাম,কাল সকাল সাড়ে সাতটার তিস্তা ট্রেনে চেপে জামালপুর চলে যাচ্ছি। টিংকু ভাই বললেন কালই যাবে কিন্তু টিকেট টা একটু চেঞ্জ করে নাও। সকালে না যেয়ে বিকেলে যাও। সকালে আমি ঢাকায় ফিরবো আমার বাসায় কোনদিন আসনি একবার এসে অন্তত দেখে যাও। অভয় দিয়ে বললেন, ভয় পেও না বাসায় আমি একা থাকবো না টিটন আর রাজ্জাকও থাকবে। কাজের লোকও আছে।

বাসায় যাবো একা ! কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। কিন্তু উনি আমার সাথে কোনদিন অপ্রীতিকর কোন আচরণ করেননি। পুটু মনিকে বললাম আমার সঙ্গে চল।পুটু বলল ওর আজ মিডটার্ম পরীক্ষা সাথে যাওয়া সম্ভব নয়। সাহস করে বের হলাম সকাল ঠিক দশটায় ।আজ আমার পরনে সাদা একটি সূতির শাড়ি।

২৬ পুরানা পলটনের ৪ তলা, সেরিনা এপার্টমেন্টে ঢুকে আমি ‘থ’ বনে গেছি । রাজ্জাক, টিটন তো আছেই কিন্তু আরও আছে মগ বাজারের কাজী সাহেব। শাহিন ভাই (জাস্টিস ওবাইদুল হাসান শাহিন) আর এনায়েত ভাই (জাস্টিস এনায়েতুর রহিম) । বিয়ে পড়ানোর জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন। অথচ কাল ঘুণাক্ষরেও আমায় বলেন নি।

বিয়ের আয়োজন দেখে আমি স্তব্ধ, কোন কথা বলতে পারছি না। পাশের রুমে টিংকু ভাই আমাকে রাজী করানোর চেষ্টা করছেন। তিনি বলছেন তুমি আমাকে পছন্দ কর না, আমি বললাম করি, তিনি বলছেন ভালোবাসো না আমি বললাম হয়তো ভালোও বাসি কিন্তু পছন্দ করা আর বিয়ে করা কিছুতেই এক নয়, আমার আব্বা-আম্মা হার্ট ফেইল করবেন । আমি কিছুতেই আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না।

বললাম আপনার ”তুমহারি অমৃতা” দেখতে যাওয়া গার্ল ফ্রেন্ড কই?

বেইলি রোডে চটপটি খেতে যাওয়া গার্ল ফ্রেন্ড কই ?

তাঁদের যেয়ে বিয়ে করেন, আমি কেন ?

আমি অঝোরে কাঁদতে লাগলাম।

অনুনয় করে বুঝিয়ে বললাম কয়েক মাস পর বিসিএস পরীক্ষা দিতে ঢাকায় ফিরবো তা ছাড়া সামনের মাসেই আসছি তখন না হয় আমরা বিয়ে করবো।

এই মুহূর্তে আমি কিছুতেই তৈরি নয় এই বিয়ের জন্য ।

আমার কান্না শেষ হওয়া মাত্র টিংকু ভাই কান্না শুরু করলেন।

তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচবো না মুন্নি।

আজ তুমি চলে গেলে এক মাস, এক বছর নয় কোনদিন আর ফিরে আসবে না আমি নিশ্চিত জানি।

দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো বুঝে গেছি বিয়ে না করে বের হতে পারবো না কিছুতেই। বাথরুমে ঢুকে কপালের টিপ খুলে আয়নায় লাগালাম, হাতের তালু দিয়ে চোখের কিনারের কাজলটুকু মুছে ফেললাম, কানের ছোট্ট রুপার দুল, হাতে পরা লাল রেশমি চুড়িও খুলে ফেললাম।

এই বিয়েতে বাবা-মায়ের আশীর্বাদ নেই, কোন আনন্দ- উল্লাস নেই । বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা হই হল্লা, কন্যাদান, উৎসব মুখরতা কিচ্ছু নেই।

সামাজিক এবং পারিবারিক ভাবে বিয়েতে যে সম্মান, আদর, তৃপ্তি আর গুরুত্ব সবকিছুই এখানে অনুপস্থিত।

বিয়ের লাল বেনারসি, দু হাতে ভরে মেহেদী, গায়ে হলুদ আর পুরো শরীরে তাজা ফুলের মালা নেই । ন্যূনতম একটি নতুন শাড়িও নেই।

বিয়ে, আনুষ্ঠানিকতা আর সাঁজ নিয়ে প্রতিটি মেয়ের অনেক রোম্যান্টিক স্বপ্ন থাকে। সেই সব স্বপ্নগুলো চোখের সামনে একটি একটি করে ঝরে পরছে আর আমি নিঃশব্দে কাঁদছি ।

বিয়ে মানে বিশ্বাস, নির্ভরতা আর ভালবাসার আশ্রয়। বিয়ে মানে বাঁধ ভাঙ্গা খুশীর জোয়ার। কিন্তু আমার বিয়ে তো অন্য আর দশটা বিয়ের মত নয়।এ বিয়েতে খুশী কই, আনন্দ কই, নির্ভরতা কই, বিশ্বাস আর ভালবাসাই বা কই ?

ভবিষ্যৎ জীবনে এতো বড় চ্যালেঞ্জ, ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা আর স্বপ্ন ভঙ্গের অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে কেবলই।

ওজু করে মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে বললাম আমি রাজী, কাজী সাহেব কে ডাকুন।

ভীষণ খুশী হয়ে হাসি হাসি মুখ করে টিংকু ভাই জিজ্ঞেস করলেন কাবিন কত হবে ?

মনের ভেতরে থাকা অসহায়ত্ব, তীব্র ক্ষোভ আর হতাশা বুঝি বেরিয়ে আসতে চাইল। অভিমানকে আড়াল করে ঠাণ্ডা গলায় বললাম, ”এক টাকাও না, আমি আপনাকে মাগনা বিয়ে করবো।”

চলবে…

( ছবিটি এপ্রিল ১৯৯৪ এর )

ক্যান্সার (পর্ব১৩)

Khugesta

আজও সকাল ৮ টাতেই ল্যাবে ঢুকেছি । কিন্তু কাজে মন বসছে না কিছুতেই। কেমন একটা অপরাধ বোধ ভেতর থেকে বার বার আহত করছে।

দুপুর তিনটায় হলের ডাইনিংরুম বন্ধ হয়ে যায় ।আর সন্ধ্যা সাত টায় হলের গেইট। সময়ের এক ঘণ্টা আগেই হলে ফিরে আনমনে ডায়নিং এর পাশের কয়েন বক্সটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। রিং বাজার সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো হ্যালো। একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললাম ”আমি দুঃখিত টিংকু ভাই।”

টিংকু ভাই বললেন, ”তুমিও আমাকেই অপরাধী বানিয়ে দিলে? একবার জানতেও চাইলে না কেন, কি হয়েছিল সেদিন।”

এর পর হাউমাউ করে কান্না । পুরুষের এমন কান্নার সাথে পরিচিত নই, কেমন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলাম। কান্না থামিয়ে একটু পর বললেন আমার সাথে এখন একটু দেখা করতে পারবে ?

আমি বললাম আপনি হলের গেটে আসবেন ?

তিনি বললেন, ”না মানুষ অযথাই তোমাকে ভুল বুঝবে।” ঝটপট নিউমার্কেটের বইয়ের দোকানে আসো । ১০ মিনিট যেতে লাগবে, ১০ মিনিট বইয়ের দোকানে ঘুরবে তারপর ১০ মিনিটে ফিরবে। ৭ টা বাজার আগেই ফিরতে পারবে।

নিউ মার্কেট আর নীল ক্ষেতের বইয়ের দোকান আমার প্রিয় জায়গা । মাসের খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে প্রায়ই বই কিনতে যাই।ওখানে না যাওয়ার কোন কারণ নেই।

নিউ মার্কেটে বইয়ের দোকানে ঘুরছি। হঠাৎ পেছন থেকে টিংকু ভাই এসে বললেন চল আজ তোমাকে আমি বই কিনে দিব । উত্তরে বললাম আমি তো নিবো না। তিনি বললেন বিনিময়ে তুমিও আমাকে একটি বই উপহার দিবে।

টিংকু ভাই আমাকে সমরেস মজুমদারের বিখ্যাত ট্রিলজি উপন্যাস উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ উপহার দিতে চাইলেন কিন্তু আমার এগুলো পড়া হয়ে গেছে।

আমি পছন্দ করলাম হুমায়ুন আজাদের ”নারী।”

বইটিতে তিনি আবুল হাসানের পংক্তি থেকে ধার করে লিখলেন –

” প্রিয়তম পাতাগুলি ঝরে যাবে

মনেও রাখবে না আমি কে ছিলাম, কী ছিলাম

কেন আমি সংসারী না হয়ে খুব রাগ করে হয়েছি সন্ন্যাসী

হয়েছি হিরণদাহ, হয়েছি বিজনব্যথা, হয়েছি আগুন!”

নীচে লিখলেন প্রিয় মুন্নিকে ডাঃ জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু।

এবার তাঁর বই পছন্দের পালা। এতো এতো বইয়ের ভিড়ে শামসুল হকের ”আমি বাসি তুমি বাসতো” বইটি বেছে নিয়ে বললেন আমি এটা নিবো কিছু একটা লিখে দাও। বইয়ের নাম দেখে আমার কেঁদে ফেলার অবস্থা এই বইয়ের পেজে আমার নাম আমি কি ভাবে লিখবো ! না লিখে উপায় নেই। অতঃপর লিখলাম ”টিংকু মানে নরম কোমল শিশুর ছায়া।” শ্রদ্ধেয় টিংকু ভাইকে স্নেহের মুন্নি ।

১৯৯৩ এর বই মেলায় টিংকু ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল আচমকাই । তাঁর সাথে কে কে ছিল মনে নেই, আমার সাথে ছিল ছাত্রলীগের আনিস (বর্তমানে আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য)। সেদিন তিনি আমায় উপহার দিয়েছিলেন খলিল জিব্রানের ”The Prophet” । বইয়ের পাতায় লিখেছিলেন ”Only the skay is your limit dear Munni” তারপর তারিখ দিয়ে তাঁর নাম।”

ঘটক হিসেবে টিংকু ভাইয়ের আবির্ভাবের আগে ঘটকের তালিকায় তদানীন্তন ছাত্রলীগ নেতা সুজন ভাই, আনসারি ভাই, অসীম দা, কামাল ভাই সহ অনেক পরিচিত মুখের সাথে আমার আদরের ছোট ভাই আনিসও ছিল।

আনিসের সাথে পরদিন সন্ধ্যায় কার্জন হল ফিরতি আমার দেখা। আনিস অবাক চোখে বলল ”শামসুল হকের বইডা তো তুমি আমার লগে কিনসিলা কিন্তু ওই বইয়ে তাঁর অটোগ্রাফ ছিল, টিংকু ভাই রে যে বইডা দিছ হেইডায় তো সেই অটোগ্রাফ নাই। কাহিনী কি কও দেহি ।”

তাঁর মানে টিংকু ভাই আমার কাছ থেকে ওই নামের বই কিনে নিয়ে এখন সবাইকে দেখাচ্ছে ! অপমানে আমার ভীষণ কান্না পেলো।

বেশ কিছুদিন তাঁর দেখা নেই ।

সারাদিন আমার ঠিকানা অর্গানিক কেমিস্ট্রি ল্যাব। কার্জন হলের মূল ফটক বন্ধ করার আগে আমার খোঁজ নিতে হবে আমি আছি কি নেই মশিউজ্জামান স্যারের নির্দেশ । ডিপার্টমেন্টের চাবিও মাঝে মধ্যে আমার কাছে থাকে। হলে পারমিশন নেওয়া আছে দেরী হলে অসুবিধা নেই। নিলুফার ম্যাডাম প্রভোস্টের কাছ থেকে এই পারমিশন নিয়ে দিয়েছেন। দেরী হলে একটু পর পর দারোয়ান রা এসে দেখে যায় বলে ঠিক আছেন আপা? কিছু কি লাগব?

ভর সন্ধ্যায় একদিন হঠাৎ টিংকু ভাইয়ের আগমন। এই সময়টা মূলত প্রেমিক প্রেমিকাদের জন্য। চারিদিকে প্রেমিক যুগল । কার্জন হল থেকে হেঁটে হেঁটে ফেরার পথে বললেন ”আমি ইন্ডিয়া গেসিলাম তোমার জন্য একটা শাড়ি আনছি।”

রাগত স্বরে বললাম এক বই ই আপনি সবাইকে দেখাইছেন এখন আবার শাড়ি নিবো, কক্ষনো না। আমার কাছ থেকে বিনা পারমিশনে শাড়ি কিনছেন কেন? শাড়ি সবার কাছ থেকে নিতে নেই। আমি তো নিবোই না।

পাশ দিয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে একটি ছেলে হেঁটে যাচ্ছিল তাঁর কাছ থেকে লাইটার নিয়ে বললেন আমি এক্ষণই জ্বালাইয়া দিব। ধুঁয়া উঠবে। এইখানে পোলাপান, দারোয়ান সবাই তোমাকে চিনে, তুমিই এখন সিনিয়র। সিন করতে না চাইলে শাড়িটা ব্যাগে ঢুকাও, জলদী।

শাড়িটা নিয়ে কোন কথা না বলে রিকশা ডেকে চলে যাওয়ার আগে বলে দিলাম কোনদিন পরব না আমি।

পরদিন বেহায়া লোকটা আবারও এসেছে। হাসতে হাসতে বলছে কালকের ব্যাবহারের জন্য দুঃখিত। তাঁর মাঝে এমন এক সম্মোহনী শক্তি ছিল না হেসে উপায় নেই। হাসতে হাসতেই কত গল্প। এতদিনে সে জেনে গেছে এটা আমার হলে ফেরার সময়। হাসতে হাসতেই বলে ফেললেন, ”তোমার ইঞ্জিনিয়ারকে বাদ দিয়ে আমাকেই বিয়ে করছো না কেন ?”

ভীষণ রেগে যেয়ে দৃঢ়ভাবে বললাম এসব কথা পছন্দ করছি না আমি একদম। আমার গলায় এমন কিছু ছিল যা তাঁকে আহত করলো। নিচু গলায় আদ্র স্বরে বললেন, ”আমি জানি আমার যোগ্যতা নেই তোমাকে বিয়ের প্রপোজ করার।”

আমার কেমন মায়া হল।

একদিন রাতে হাউস টিউটরদের রুম থেকে ডাক এসেছে ফোন এটেইন করার জন্য। বন্যায় কক্সেসবাজার আঁটকে আছেন তিনি।বলছেন তোমায় দেখতে না পেয়ে দম বন্ধ হয়ে আসছে মুন্নি। লাইনে ডিস্টার্ব তাড়াতাড়ি ছেড়ে দিয়ে বাঁচলাম।

আমার থিসিস পেপার জমা দিতে আর মাত্র একমাস বাকি।তারপরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ আমার মুক্তি। টিংকু ভাইয়ের সাথে আর কোনদিন গাড়ী চড়ে বেড়াতে যাইনি, ক্যাম্পাসের বাইরেও না, এক রিকশায়ও উঠিনি কোনদিন। পুলসিরাতের মত বড় সাবধানে পথ হেঁটেছি।

ফোন দিয়ে বললাম আমায় আজ লং ড্রাইভে নিয়ে যাবেন টিংকু ভাই।খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, ”আসছি।”

গাড়ী ছুটছে, ক্যাসেটে গান বাজছে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ”কোন কারণে তোমার কি আজ খুব মন খারাপ?”

সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালাম। চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। আমি বললাম, ”আজ আমার ইঞ্জিনিয়ারের বিয়ে।”

গাড়ী সজোরে ব্রেক কষলেন, কিন্তু ধাক্কা খেলেন নাকি খুশী হলেন ঠিক বুঝলাম না। আমার হাতের উপর আলতো ছোঁয়া লাগিয়ে বললেন মন খারাপ করো না।ফিরতি পথে সাহাবাগের ফুলের দোকান থেকে বিশাল এক গোলাপের তোড়া কিনে দিলেন।

কদিন পর রুমে পত্র এলো । এরপর আসতেই থাকলো। প্রথম দিকের চিঠিগুলো বিষণ্ণতায় ভরা কিন্তু পরেরগুলো যেন এক একটি কবিতা। মানুষ এতো মেধাবী হয় এতো সুন্দর লিখতে পারে কি করে !

চলবে…

ক্যান্সার (পর্ব১২)

Khugesta

রোকেয়া হল মেইন বিল্ডিং ৪৬ এ আমার রুমমেট তখন লায়লা আপা। মানে বর্তমানে পোল্যান্ডের অ্যাম্বাসেডর সুলতানা লায়লা হোসেইন। লায়লা আপার সাথে আমার সম্পর্ক বোন আর বান্ধবীর থেকে একটু বেশী। দুজন দুজনের কাছে পেটের কথা না বললে যেন ভাত হজম হয় না। সারারাত জেগে দুজনে আড্ডা দেই আর গান শুনি ।

লায়লা আপাকে বললাম, টিংকু ভাইয়ের সাথে কাল চা খেতে যাবো সকালে। সঙ্গে সঙ্গে লায়লা আপা বললেন, ”অসম্ভব কিছুতেই আমি যেতে দিবো না তোমাকে।বুঝতে পারছ না মুন্নি তুমি বিপদে পরবে।”

লায়লা আপার কথা শিরোধার্য । সকালে চা খেতে গেলাম না। এমন কি টিংকু ভাইয়ের সাথে কোন প্রকার যোগাযোগ করারও চেষ্টা করলাম না।

বেশ কিছুদিন পর আমার ল্যাবে হঠাৎ হন্তদন্ত টিংকুভাই এসে হাজির। বললেন ক্ষমা চাইতে এসেছি, সেদিন সকালে আসতে পারিনি বলে। লায়লা আপার পরামর্শ মত এবার আমি মেপে মেপে কথা বললাম, মেপে মেপে হাসলাম।

ল্যাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ করছি আর টিংকু ভাই আমার পাশে উঁচু টুলটাতে বসে কথা বলছেন । মশিউজ্জামান স্যারকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে বললেন আপনার ছাত্রীর কাছে একটু প্রয়োজনে এসেছি। স্যার আর টিংকু ভাই দুজন দুজনের পূর্ব পরিচিত। স্যার স্বভাব সুলভ হালকা হাসি টেনে গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললেন আমার ছাত্রীর গন্তব্য বহুদূর। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছে সবে মাত্র, আসল পড়াশুনায় ঢুকবে এখন, বিদেশ থেকে বড় বড় ডিগ্রী আনবে।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবে নতুবা বৈজ্ঞানিক হবে।

স্যার চলে যাওয়ার পর টিংকু ভাই বললেন, ” যতই লেখা পড়ার কথা বল আমি জানি দুদিন পর তোমার বিয়ে হয়ে যাবে।আমার সাথে তোমার হয়তো কোনদিনই দেখা হবে না আর, কিন্তু যখন চায়ের পেয়ালা হাতে নিবে তখনই আমাকে মনে পরবে। তখন আফসোসের চেয়ে আগামীকাল সকালে চল একসাথে চা খাই।”

আজ লায়লা আপা নেই, রুমে আমি একা। ফজর নামাজ শেষে কতক্ষণ পায়চারী করলাম।হেঁটে হেঁটে একবার ভাবি যাবো আরেকবার ভাবি যাবো না। অবশেষে কাপড় পরে টিএসসির সামনে এসে দাঁড়ালাম। নীল রঙের গাড়ির ভেতরে টিংকু ভাই বসে আছেন । বললাম বাইরে আসেন হেঁটে হেঁটে চা খেতে যাবো, ওখান থেকে কার্জন হল।আপনি রিকশা নিয়ে ফিরে আসবেন।

টিংকু ভাই নামতে না নামতেই বৃষ্টি শুরু হল।তিনি বললেন বৃষ্টি শেষ হওয়া পর্যন্ত গাড়িতে বসে অপেক্ষা করি। ভাবার সুযোগ নেই কারণ আমি ভিজে যাচ্ছি।তিনি বললেন চল ক্যাম্পাসের চারিপাশ ঘুরে আসি । এতো বৃষ্টি বাইরের কিছুই দেখা যাচ্ছে না । কিন্তু কোথায় ক্যাম্পাস, গাড়ি চলছে এয়ারপোর্ট রোড ধরে ফাঁকা রাস্তায়।

ভীষণ ভয় পেয়ে বললাম ফিরে চলুন, আমাকে ক্যাম্পাসে নামানোর আগে গাড়ি থামাবেন না প্লিজ । এতো বৃষ্টিতে গাড়ি এক্সিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা কারণ সামনে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে, আমি সীটের সাথে সেঁটে বসে আছি। রাস্তার পাশে গাড়ি চলা হঠাৎ থামিয়ে বললেন গান শুনবে, গান শুনলে তোমার ভালো লাগবে। আমি কোনমতে সম্মতি সূচক মাথা নাড়ালাম। তিনি ছাড়লেন সুমনের গান — প্রথমত আমি তোমাকে চাই, দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই, তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই —- । এই গানের অর্থ আমি বুঝি কিন্তু কোন কথা বলছি না, তাঁর দিকে তাকাচ্ছিও না।নীচের দিকে তাকিয়ে কোনোমতে বললাম, ”আপনি জানেন তো কদিন পর আমার বিয়ে, সব ঠিকঠাক।”

কোন কিছু না বলে তিনি গাড়িতে স্টার্ট দিলেন। কারো মুখে কোন কথা নেই। তিনি আমার দিকে তাকাচ্ছেন না আর। সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। গাড়িতে বেজে চলেছে সুমনের ক্যাসেট। হঠাৎ জেনি কাবাব ঘরের সামনে গাড়ি পার্ক করে বললেন নামো তোমাকে চা খাওয়াই। ততোক্ষণে বৃষ্টি ধরে এসেছে। চা খেতে খেতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার লক্ষে কথা বলা শুরু করলাম ।

টিংকু ভাই তাঁর জীবনের প্রচণ্ড হতাশা আর কষ্টের কথা বললেন, একাকীত্বের কথা বললেন। বললেন প্রতিদিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে মনে হয় না ভাঙ্গলেই বুঝি ভালো ছিল, পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা প্রতি মুহূর্তে প্রচণ্ড কষ্টসাধ্য মনে হয় ।রুবেল, রাজ্জাক, টিটন, কল্লোল সহ আরও অনেকে পালাক্রমে ভালবেসে তাঁর সঙ্গে থাকে কেবলই তাঁকে আগলে রাখার জন্য।

কোন কিছু চিন্তা না করেই বলে ফেললাম, ”এসব কিছুর জন্য আপনিই তো দায়ী।”

রেগে গেলে নাকি কষ্ট পেলে চোখ লাল হয় ! এখন তাঁর চোখ দুটো জবা ফুলের মত টকটকে লাল, মনে হচ্ছে বুঝিবা রক্ত ঝরবে। কোন উত্তর না দিয়ে বললেন চল ফিরি।

গাড়ি এবার ফিরতে শুরু করলো, দুজনেই নিশ্চুপ। পুরো রাস্তায় কোন কথা হল না, কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছিও না। কার্জন হলে নামার আগে ক্যাসেটটি হাতে দিয়ে বললেন, আমাকে সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।বিন্দুমাত্র অপেক্ষা না করে গাড়ি ঘুরিয়ে সাঁ করে চলে গেলেন।

ভীষণ খারাপ লাগছে সরাসরি আঘাত দিয়ে এভাবে বলাটা কি ঠিক হল ?

চলবে…