Tag: গল্প

  • মোহ

    মোহ

    মোহ এমন একটা বিষয় যা প্রত্যেকটা মানুষের সাথে এমন ভাবে জড়িত চাইলেই তড়িঘড়ি করে মোহ থেকে বের হওয়া যায় না। তবে মানুষের মোহ কেটে যায়, কিন্তু ততক্ষনে জীবনকে উপভোগ করার মূল সময়টুকু আর থাকে না। অর্থের মোহ মানুষ কে রুপান্তরীত করে আনন্দহীন জড় পদার্থের মতো, আবার মোহ কেটে গেলে মানুষের সময় ফুরিয়ে যায়।

    জাপানি বিষ্ময় বালক উশিনারার কথা বলা যাক, উশিনারা ছিলো জাপানের সবছেয়ে সুন্দর ও সুদর্শন বালক। সৌন্দর্যেই ছিলো তার মোহ।

    একদিন উশিনারা সমূদ্রের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলো, তখন সমূদ্র থেকে এক গভীর শব্দ ভেসে আসলো তার কানে।

    তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, হে উশিনারা তুমি তোমার এ সৌন্দর্য কী অনন্ত করে রাখতে চাও?
    সৌন্দর্যের মোহে মত্ত উশিনারা ক্ষানিক না ভেবেই উত্তর দিলো চাই।
    আমি সারা জীবন এ সৌন্দর্য ও তারুন্য ধরে রাখতে চাই।

    তখনই সমূদ্র থেকে উঠে আসলো অপরুপ সুন্দরী এক সমূদ্র কণ্যা, উশিনারাকে বললো তুমি সৌর্ন্দয্য ধরে রাখতে চাইলে এখনি সমূদ্রের বুকে ঝাপ দাও।

    উশিনারা বাধ্য ছেলের মতো সাথে সাথে ঝাপ দিলো সমূদ্রে, এবং বাস করতে লাগলো অপ্সরী সমূদ্র কন্যাদের সাথে।
    বহুকাল উশিনারা সুন্দরী সমূদ্র কন্যাদের সাথে থেকে পার করে দিয়ে একটা সময় ঠিকই তার মোহ কেটে গেলো, সমূদ্র কন্যাদের সৌর্ন্দয্য তাকে আর মোহিত করছেনা এবং কি নিজের অনন্ত তারুণ্যতা ও আর তাকে ফুলকিত করছে না, একঘেয়েমিত ভরে যাওয়া উশিনারা ভাবলো এক সৌর্ন্দয্য ছাড়া কিছুই সে নিতে পারলো না, জীবন থেকে পৃথিবী থেকে।

    উশিনারা ছট পট করতে লাগলো পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য, সে আর কোন ভাবেই সমূদ্র কন্যাদের সাথে থাকতে চায় না।

    তাই সমূদ্র কন্যাদের সর্দার বললো দেখ উশিনারা তুমি হয়তো বুঝতেই পারোনি কত কাল তুমি এ সমূদ্রে বাস করেছো, তোমার সময়ের কিছুই পৃথিবীতে নেই, তোমাকে চিনতে পারবে এমন একজন ও পৃথিবীতে নেই,
    তুমি ওখানে গিয়ে কি করবে?

    তবু উশিনারা পৃথিবীতে ফিরে আসতে চায়।

    তাকে ফিরেয়ে দেয়া হলো, এবং তাকে একটা ছোট্ট কৌটা দেয়া হলো। বলা হলো এতে তোমার সৌন্দর্য লুকানো আছে।

    উশিনারা পৃথিবীতে ফিরে আসলো, কিন্তু সে আশ্চর্য হলো সে কিছুই চিনতে পারছে না, তাকে ও কেউ চিনছে না, সে ভেবেছিলো তাকে নিয়ে অনেক মাতা মাতি হবে কিন্তু কিচ্ছু হলোনা, কেউ ফিরেই তাকালো না, দুঃখে কষ্টে ক্লান্ত উশিনারা ভাবলো একবার কৌটাটা খুলেই দেখি।

    কৌটা খোলা মাত্রই বার্ধক্য এসে তাকে গ্রাস করলো এবং সে মারা গেলো।

    আউয়াল যাযাবর
    ২৩/০২/২০২২ইং

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৪)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৪)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৪)
    বাসার অবস্থা অপরিবর্তিত। শান্ত। মলির কোন উদ্বেগ নেই। আম্মাও স্বস্তিতে আছে। তবে এর ভবিষ্যৎ কি কেউ জানেনা। যাকে নিয়ে এই উদ্বিগ্নতা আর পেরেশানি সেই সেলিম নির্বিকার। দিব্যি খাচ্ছে-দাচ্ছে, ঘুরছে-ফিরছে। তার তরফ থেকে নতুন কোন প্রপোজাল নেই। মলিও কিছু বলেনা। পাছে সেলিম বাগড়া দিয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে যায়। বড় মামাকে সেলিমের বিষয়ে কিছু বলা যায় না। প্রসঙ্গ তুল্লেই বলেন, “ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। মুদির দোকানও চালাতে পারবে না”। সমস্যা হলো সেলিম নিজেই। তার মিশন, ভিশন অনেক উঁচু। প্রচুর টাকা থাকবে, গাড়ী-বাড়ী থাকবে। সফিসটিকেড বিজনেস থাকবে। সব কিছু টিপটপ হবে। অফিস হবে ওয়েল ডেকোরেটেড। থাকবে মৌ মৌ ফ্রেগরেন্স। কর্মচারীর সংখ্যা যতজনই হোক তারা হবে স্যুটেড-বুটেড। আরো কত কি! স্বপ্ন দেখতে সবারই ভালোই লাগে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই পার্থক্যটুকুই বুঝতে পারছে না সে। মন্দের ভালো হিসেবে সবাই তার এই স্থিতাবস্থা মেনে নিয়েছে। আর কিছু না হোক নতুন করে তো আর কোন ঝামেলার সৃষ্টি হচ্ছে না। ছোট মামার সাথে সব শেয়ার করা যায়। তিনিও চিন্তিত। এখনই একটা কিছু করা জরুরি তিনিও বুঝেন। বললাম, “মামা, ভালো কোন কিছুর ফ্রেঞ্চাইজ খুলে দিলে হয়না”? মামা সায় দিলেন। কিন্তু সেটা কি? এ ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। মলিকে বললাম। বললো, “আপাতত এভাবেই থাক। আগে মাথা থেকে রাতারাতি বড়লোক হওয়ার পোকা বেরোক। তারপর একটা কিছু করা যাবে”। কথাটা নেহায়েত মন্দ বলেনি। উদ্ধারকৃত টাকাগুলো মলির একাউন্টে জমা আছে। অতএব টেনশন কম।

    আমরা মেয়েদেরকে যতই কমজোরি মনে করি তারা ততোটা না। বিশেষত সাংসারিক বুদ্ধিতে তাদের সুক্ষ্মদর্শী বিচার বিশ্লেষণ যাদবের পাটিগণিতের চেয়েও সমৃদ্ধ। আম্মা হাসে। বলে, দু’জনে বসে বসে লুডু খেলে। বুয়া দেখে আর হাসে। আর আম্মার কাছে এসে ধারা বর্ণনা দেয়। কিছুই করার নেই।

    শৈলী রোজ রাতে ফোন দেয়। দীর্ঘক্ষণ কথা বলে। নাছোড়বান্দা। আমি তাকে বাস্তবতায় ফিরিয়ে আনার জন্য বলি, “তোমার বয়স কত”?
    — কেন?
    — এই বয়সটা খুব ইম্পোর্টেন্ট। লাইফের টার্নিং পয়েন্ট
    — জ্ঞান দিচ্ছেন?
    — ধরো তাই
    — আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। জ্ঞানে আমি এত বেশি জ্ঞানিত হয়ে গেছি যে ভার রাখতে পারছিনা
    — বুয়েটে ভর্তির জন্য কিন্তু পড়াশোনা করতে হয় প্রচুর
    — মনে হয়না
    — কেন?
    — আপনাকে দেখে তাই মনে হলো
    — আমার জ্ঞান নেই?
    — ওটুকু ছাড়া আর কিছু নেই
    — আগে ওটুকুই অর্জন করো। চেহারা ছবি ভাল আছে। খুব সহজেই পার হয়ে যাবে
    — আপনার হিংসে হচ্ছে?
    — বারে। হিংসে হবে কেন? তুমি তো আমার অনেক জুনিয়র
    — এতদিন বসে বসে হায়ার ম্যাথ ঘেটে এই সমাধান বের করেছেন?
    — ইনফেচুয়েশন কি জিনিস বুঝো?
    — আপনি কি আমাকে সে পর্যায়ে জ্ঞান করেন?
    — বুয়েটে ভর্তি হও। প্রচুর ছেলে বন্ধু ঘুরঘুর করবে। যোগ্য সাথী পেয়ে যাবে। তখন এসব ইনফেচুয়েশন নিয়ে মনে মনে হাসবা
    — ভালই তো হবে। আপনি তখন জ্বলতে থাকবেন। আপনাকে পিক শেয়ার করবো।

    শৈলীর একটা জিনিস তারিফ না করে উপায় নেই। তার মেধা শক্তি প্রখর। সেন্স অফ আর্টিকুলেশন হাই। এর সাথে লাবণ্যতা আর মাধুর্যতা অতিরিক্ত মাত্রা যোগ করেছে। তার আরেকটি গুণ হলো সম্মোহন শক্তি। আমি ক্রমশঃ পর্যুদস্ত হয়ে যাচ্ছি তার কাছে। আর তখনই জেমির উপর সাংঘাতিক রাগ হয়। অভিমান হয়। জেমি কি তা বুঝে? মাঝে মাঝে মনে হয় আমার এ অতি আবেগ এক পাক্ষিক। এটা যেন আলো অভিমুখী পতঙ্গের এক ধরণের ‘আত্মহনন পথযাত্রা’।

    খাগড়াছড়ি আর ভাল লাগছে না। দেখতে দেখতে ছয় মাস হয়ে গেলো। বিষন্নতা আর নিঃসঙ্গতা পাহাড়ের নিসর্গকে ছাপিয়ে দম বন্ধ করে দিতে চাচ্ছে। চাকরির এই জীবন আমার লক্ষ্যের মধ্যে ছিলো না। মধ্যবিত্ত শিক্ষিত ঘরের ছেলেদের জীবনের ক্যালকুলেশনের ভেতর থাকে অনেক অনেক ডিপেন্ডেবল ভেরিয়েবল্স। এর মধ্যে অন্যতম হলো পরিবারের সেট রুলস। সেলিমের মনের অভিলাষে উচ্চাকাংখা থাকতে পারে, সাধ এবং সাধ্যের মধ্যে ফারাক থাকতে পারে কিন্তু এটাও তো ঠিক সবাই এক পথে হাঁটে না। এক বেগে চলে না। এক বৃত্তে ঘুরেনা। কেউ কেউ বৃত্তের বাইরে গিয়ে স্বপ্নের সম্মিলন ঘটাতে চায়। কেউ কেউ জীবনটাকে গতানুগতিকের বাইরে আলাদা ফ্লেভারে উপভোগ করতে চায়। সংসার সাফল্যের মাপকাঠিতে সব কিছু মাপে। যার পায়ের তলার মাটি যত মজবুত, যার দৌড়ের পরিধি যত ব্যাপক, যার বিত্ত-বৈভবের ব্যালান্স যত বেশি অনুকূল সংসারে সে তত সফল।
    মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছে। এখানে বেশিদিন থাকলে পাগল হয়ে যাবো নির্ঘাত। এখানে যারা সহকর্মী তাদের জীবনের লক্ষ্যই হলো চাকরি, প্রচুর ক্যাশ আর সুন্দরী বৌ। এই নিয়েই তাদের স্বপ্নের দৌড়। তাই তাদের কোন খেদ নেই। কোন টানাপোড়েন নেই। মাথায় কোন পোকা নেই। সংসারে এরাই গুড বয়।

    পাহাড়ে যারা চাকরি বা ব্যবসা বাণিজ্যের খাতিরে বসবাস করে তাদের স্বজন ও সুজন ভাগ্য খুব ভালো। সবাই এই সম্পর্ক ধরে পাহাড়ে ফ্যামিলি ট্যুর দিয়ে যায়। ভালোই লাগে। ঢাকায় থেকেও যাদের সাথে বছরে দেখা সাক্ষাৎ হয়না তাদের সাথেও এখানে আনন্দে কেটে যায় কয়েকদিন। আমি সরকারি চাকুরে না। তাই প্রটোকলের পেরেশানি নেই।। বরং পরিচিত, আপনজন কেউ না এলে পানসে লাগে। ভাবছি আম্মাকে আর মলিকে আসতে বলবো।
    একঘেয়েমি আর নিঃসঙ্গতার মাঝে একমাত্র বৈচিত্র্য হলো শৈলীর ফোন। খেয়ালী মন। যখন তখন ফোন দিয়ে বসে। হয়ত আমাকে রাগাবার জন্যই। নিষেধ করলেও কে শোনে কার কথা? এই একটু আগেই ফোন করে বললো, “আপনি তো আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করেন নি এখনো। অন্য মেয়ে হলে তো ঠিকই সময় নিতেন না”। ভুলেই গিয়েছিলাম। মাত্রই মনে পড়লো। বললাম, “বাজে কথা। আমার লিস্টে বালিকা কম”।
    — কম মানে? যা আছে তা স্পেশাল?
    — আরে না। কথা খালি টেনে অন্যদিকে নিয়ে যাও
    — ক্ষতি কি? পুরুষ মানুষের চরিত্র জানা আছে
    — কি রকম? একাধিক অপশন রাখে
    — আমার সেরকম কেউ নেই
    — গুড। ঢাকায় আসবেন কবে?
    — জানিনা। কেন?
    — সামনে পরীক্ষা। কিছু হেল্প হত।

    কথা কিন্তু এখানেই শেষ। কিন্তু কিছুক্ষণ পরই আবার ফোন, “ভালো কথা। এবার দেখলাম আপনি নামাযী হয়েছেন। ছ্যাকা খেয়েছেন নাকি”? বললাম, “কিসের সাথে কিসের তুলনা দিলা”? কথা না বাড়িয়ে রেখে দিলো। বিচলিত হলেও ওর ফোন ভাল লাগে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করে হয়েছে আরেক বিপদ। প্রোফাইল চষে বের করেছে দু’টি নাম। ফারিয়া আর মুমু। এই নিয়ে হাজারো জেরা। জেরা মানে আমার মাথা নষ্ট করা। ফারিয়া আমার কাজিন। যেইনা বলেছি অমনি হাজারো সম্পূরক প্রশ্নের মুখে পড়লাম। আর মুমু আমার ক্লাসমেট। থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। পি এইচ ডি করছে। আর ফিরবে না। জেরার মুখে যেই বলেছি এখনো আনম্যারিড অমনি ধরেই নিয়েছে আমি আসলে বিদেশ পাড়ি দেবো। কোভিডের কারণে সময়ক্ষেপণ করছি আরকি। বুঝতে পারছি বালিকাদের সব কিছু সহজ ভাবে নিতে নেই। এর সুদুরপ্রসারি সাইড ইফেক্ট কি কি হতে পারে তাও ভেবে দেখা জরুরি। আমিও উল্টো প্যাচ দিয়ে বললাম, “এই যে তুমি খামোখা আজেবাজে চিন্তা করছো, এখন তোমাকে আমার লিস্টে দেখে যদি ওরা এরকম জেরা করে”? প্রশ্ন করে বোকা হয়ে গেলাম। ভাবতেও পারিনি এটা এভাবে ব্যাক ফায়ার করবে। শৈলী ঝাঁঝালো কন্ঠে বললো, “এই তো থলের বিড়াল বেড়িয়ে এলো। আমার নাম দেখে ওদের জ্বলবে কেন? তার মানে কুচ কুচ হোতা হ্যায়”।
    — দূর। মহা বিপদে পড়লাম তো
    — বিপদে আপনি পড়বেন কেন? পড়েছি তো আমি
    — কেমনে?
    — “জানিনা” বলে লাইন কেটে দিলো।

    এ যাত্রা বাঁচা গেলো মনে করে হাফ ছাড়ার আগেই আবার ফোন, “ভালো কথা, আপনি কিন্তু আমার সেই প্রশ্নের কোন উত্তর দেন নি”।
    — কোন প্রশ্ন?
    — আপনাকে কি এড্রেস করবো?
    — বলেছি তো। আমি জানিনা
    — তাহলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করি?
    — করো। চুল ছিড়ে দেবে
    — জ্বী না। আম্মু এখন আমার ভক্ত।
    — এত ডেভেলপমেন্ট?
    — হুম্ম। আগে বুয়েটে ভর্তি হয়ে নেই। দেখবেন মজা।
    — কিরকম?
    — লেট টাইম কাম। বা’বাই।

    হেড অফিস থেকে লোকজন আসবে প্রকল্প পরিদর্শনে। জামান ভাই জানালেন, এর উপর নির্ভর করছে নিকট ভবিষ্যতে আমার ঢাকায় ট্রান্সফার। বিষয়ের গুরুত্ব বিবেচনায় সহকর্মীদের নিয়ে লেগে গেলাম কাজে। প্রকল্পের ফিজিক্যাল ভেরিফিকেশন বাড়িয়ে দিলাম। আর আপডেটেশন ও ডকুমেন্টেশনের কাজে লেগে গেলাম। সময় খুব কম। অনেক রাত অবধি কাজ করতে হয়। সাথে যোগ হয়েছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সাইট ভিজিট। জামান ভাই আমাকে এর দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়েছেন। এটা তারও ইজ্জত কা সাওয়াল। আমারও। শৈলীর ফোন আর সেভাবে রিসিভ করা হয়না। ঘটনা বলে যখন তখন ফোন দিতে নিষেধও করেছি। পারতপক্ষে এই তিন চারদিন যেন ফোন না দেয়। কিন্তু কে শুনে কার কথা? বাধ্য হয়ে কেটে দিতে হচ্ছে। জানি এর সুদূরপ্রসারী ভোগান্তি পোহাতে হবে।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৪০)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৪০)

    আজ অনেক যত্ন করে কলিকে খাওয়াচ্ছেন শারমিন। বার বার বলছেন, এই নিজের মনে করে খেও কিন্তু!

    কলি কে দুই টুকরো মাছ জোর করেই দিলেন, কলি খেতে পারছেনা। তবুও বলছেন, পারবে পারবে খাও।

    শারমিন খাওয়ার পর, রান্নাঘরে কলিকে ডেকে বললো, কলি তুমি আমাকে বাঁচাও।
    – কি হয়েছে ভাবী?
    – আমি প্রেগন্যান্ট।
    – আলহামদুলিল্লাহ!
    – জিহানের বয়স কত বল? এখন আরেক টা বাবু, আমি এখন বাবু নিতে চাইনা কলি।
    – কি করবে?
    – আমার ইচ্ছে অন্যরকম ছিল, কিন্তু তোমার ভাই কোন ভাবেই রাজী নন। আল্লাহ দিয়েছেন, কত জনই মা হতে পারেনা। তাই সে, বাবু রাখতে চায়।
    – ঠিকই বলেছেন ভাইজান।
    – এখন, তুমি আমাকে সাহায্য না করলে হবেনা। এখন থেকে তুমি আমার বাসায় থাকবে, আমার একা থাকতে এখন খুব ভয় লাগে।

    কলি এতোক্ষনে ভাবীর আসল রহস্যা ধরতে পারলো। এতো খাতিরের এই হচ্ছে, মূল বিষয়।

    কলি বললো ভাবী, এভাবে মাকে একা ফেলে রেখে আমি আসতো পারবো না।
    -সমস্যা নাই, প্রয়োজন হলে, আম্মাও থাকবেন এখানে। নাহিদ-শাহিদ মেসে চলে গেল।
    – ভাবী, এই মুহুর্তে কিছুই বলতে পারছিনা। বাসায় গিয়ে চিন্তা করে, জানাবো।
    – চিন্তার কি আছে। এই গেস্ট রুমে তুমি থাকবে। শুধু আমার সাথে একজন মানুষ থাকবে, এই আর কি! বুয়া কাজ করবে, আরেকটা মেয়ে আছে, সেও থাকবে। কিন্তু তারা কি আর আপন মানুষ বলো!
    – আম্মার সাথে কথা বলি, পরে জানাচ্ছি।
    – আম্মার কোন সমস্যা হবে না, আমি জানি।

    কলি হাসির রেখা, মুখে এঁকে রুম ত্যাগ করলো! ভাবীর এতো যত্ন আর ভালো রান্নার এই হচ্ছে কারণ!

    পলির শ্বাশুড়ি পলির রুমে এসে বললেন, পলি, আবিদের সাথে আমার সামান্য গোপন কথা আছে। তুমি বাইরে যাবে?
    – জি আম্মা!
    – রাগ করনি তো!
    – কেন? না, না রাগ করিনি।
    – আচ্ছা।

    আবিদের পাশে বসে তিনি ছেলেকে বললেন, আবিদ বেতন আর টিউশনি মিলে যে টাকা আসে, তাতে কি বউ রেখে খাওয়াতে পারবি?
    – কেন হঠাৎ এই প্রশ্ন।
    – যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দে।
    – পরিবার নিয়ে শহরে থাকা, অনেক ঝামেলার। কিন্তু কেন এসব জিজ্ঞেস করছো?
    – পরে বলবো। আর বউমার মাস্টার্সের ক্লাসের দরকার নেই! কি করবে এম.এ পাশ করে? চাকরি করাবি?
    – এটা ওর ইচ্ছে!
    – ওর ইচ্ছে আমি জানি। আচ্ছা যাই, ভাত নামিয়ে আসি।
    – তুমি কেন এসব বললে হঠাৎ?
    – রাতে বলবো, এখন কি কথা হয়েছে, বউমা কে বলার দরকার নাই। আমি যাই।

    পলির অবচেতন মন বারবার ভাবছে শ্বাশুড়ি কি এমন গোপন কথা বলছেন! তিনি বলতেই পারেন। এটা কি তার সম্পর্কে, না অন্যকিছু! তবে, আবিদ তাকে নিজ থেকে কিচ্ছু না বললে সে প্রশ্ন করবেনা। যদিও তার মনে প্রচন্ড কৌতুহল হচ্ছে।

    জলিকে রেখে বড় ছেলের বাসায় দাওয়াতে আসেন নি রাহেলা। তাই শারমিন যত্ন করে শ্বাশুড়ি আর ননদ কে তরকারি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। টিফিন হাতে দিয়ে কলির হাত ধরে বলছেন প্লিজ নেগেটিভ আনসার দিওনা, নয়তো আমার নেগেটিভ কিচ্ছু করতে হবে।

    কলি রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে। শাহিদ আর জাহিদ সামনে হেঁটে যাচ্ছে। রনি দুলাভাই বাড়ীতে চলে গিয়েছে। কলি টিফিন হাতে নিয়ে ভাবছে সে কোন ভাবেই থাকবেনা, তার আগের অভিজ্ঞতা অনেক বেশি তিক্ত! কিন্তু মা কি করবেন, কি করতে বলবেন, তাই নিয়ে খুব চিন্তা করছে সে…..

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৩)
    শৈলীরা এলো। রেস্ট হাউসে পৌছে ফোনও দিলো। আমিও গিয়ে দর্শন দিলাম। তার চোখে মুখে আনন্দের উচ্ছ্বাস আর চোরা দুষ্টুমি। শৈলীর বাবা অমায়িক মানুষ। ভদ্রলোককে এর আগে মাত্র একবার তাদের বাসায় দেখেছিলাম। কথা হয়নি। সে তুলনায় শৈলীর আম্মা এখনো ভাব-গম্ভীর। বিদেশ বিভুঁইয়ে পরিচিত কাউকে পেলে যেমন বোধ হয় এর চেয়ে তার অভিব্যাক্তিতে বিশেষ ব্যাতিক্রম কিছু অনুধাবন করতে পারলাম না । অবশ্য এটা সত্য যে, টিন এজ মেয়ে থাকলে কোন মা-ই কোন তরুণকে সহজ চোখে দেখতে পারেনা। আমার এসব গা সহা হয়ে গেছে। চা-নাস্তা সেরে তারা বেরিয়ে পড়বে। আমি অফিসের দোহাই পাড়লাম। শৈলীর মুখ কাল্সে হয়ে গেল। চোখ দিয়ে আগুন ঠিক্রে বেরোচ্ছে। কায়দা মত পেলে আমাকে ভস্মীভূত করে দেবে এমন ভাব। শৈলীর আব্বা কথা কম বলেন। শুধু বললেন, “অফিসের কাজ হ্যাম্পার করে আমি যেতে বলবো না। যদি যেতে পারো উই উইল বি রাদার হ্যাপী”। শৈলীর আম্মা কোন কথা বললেন না। শৈলী তাঁকে প্রেসারাইজ করছে, “আম্মু, তুমি বললেই স্যার যাবে। বলো না”। যাহোক, পরিস্থিতি বিবেচনায় আমি যাইনি। সিদ্ধান্ত হলো কাল সকালে সাজেক ভ্রমণে আমি তাদের সাথে যাবো। এই নিয়ে শৈলীর সে কি রাগ!

    রাতে ওদের সাথে আবার দেখা। স্থানীয় রেস্তোরাঁয় শৈলীর ভালো রেজাল্টের জন্য দেওয়া প্রতিশ্রুত ট্রিটের ব্যবস্থা করলাম। শৈলীর আব্বা খুব উঁচু মাপের মানুষ। পড়াশোনা অগাধ। আলাপ করলেই বুঝা যায়। আমাদের আলাপের মাঝে শৈলী যেন প্রাণের স্পন্দন। শৈলীর আম্মাও গাম্ভীর্যের খোলস আস্তে আস্তে সরিয়ে নিচ্ছেন। বাসার খোঁজখবর নিলেন। ঢাকায় গেলে বাসায় যেতে বললেন। আরো বললেন, “শৈলীর খুব ইচ্ছে বুয়েটে পড়বে। আর্কিটেক্ট হবে। সারাদিন আঁকা জোকা করে। জানিনা কি হয় শেষমেশ”? সুযোগ পেয়ে আলাপ জমাতে বললাম, “আন্টি, চিন্তা করবেন না। শৈলী খুব ভাল স্টুডেন্ট। রেজাল্ট ভালো। ড্রয়িং আর ডিজাইন সেন্সও খুব ভালো। হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ”। শৈলী পেছনে দাঁড়িয়ে থেকে সব উপভোগ করছে।

    আমাদের সাজেক যাত্রার শুরুতেই খানিকটা বিপর্যয় হলো। যে গাড়ী উন্নয়ন বোর্ড থেকে দেওয়া হয়েছে সেটাতে সমস্যা দেখা দিয়েছে। মবিল পড়ে যাচ্ছে। কোনক্রমেই বন্ধ করা যাচ্ছেনা। সেটা পাল্টে আরেকটা আসতে বিলম্ব হলো। প্রায় চার ঘন্টা লেগে গেলো সাজেক যেতে। পথে কয়েক জায়গায় নেমে ঘুরাঘুরি আর ফটো স্যুট। হেলিপ্যাডে পৌছামাত্র আচমকা কোথা থেকে এক রাশ ভারী মেঘ বৃষ্টি বয়ে নিয়ে এলো। তাতে আমাদের পরিধেয় কাপড় বেশ খানিকটা ভিজে গেলেও এই দুর্লভ প্রাপ্তিতে আমার আর শৈলীর খুব মজা হলো। শৈলীর আব্বা বললেন, “এই মেঘ, এই বারিষ আল্লাহর রহমত আমাদের জন্য। ঠান্ডা লেগে না গেলেই হয়”। তাঁর মুখে ‘বারিষ’ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর লাগলো। আন্টি ব্যাপারটাকে ট্যুরিস্ট ম্যুডেই নিলেন। সব মিলিয়ে খুব ভাল লাগলো। এর আগে জামান ভাই ও অন্য কলিগরা সহ এসেছিলাম। তখন মেঘ, বৃষ্টির এমন রোমান্স দেখিনি। শৈলীর স্ফুর্তি অপরিসীম। সে কি থেকে কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। দুপুরে সেনাবাহিনীর রেস্টহাউজ কাম রেস্তোরাঁয় লাঞ্চ হলো। ফেরার আগে আবারো এদিক সেদিক ঘোরাফেরা। এবার আর আংকেল-আন্টি সাথে এলেন না। শৈলীকে এভাবে ছেড়ে দেবেন ভাবতেও পারিনি। আমি নির্লিপ্ত ভাব দেখালেও শৈলীর আনন্দ দেখে কে? হাঁটতে হাঁটতে বললো, “জায়গাটা এত্ত সুন্দর কল্পনাও করা যায় না”। আমি কথার পৃষ্ঠে কথা যোগ করলাম, “আজ তোমাদের লাকটাই ভালো”।
    — যেমন? শৈলীর ঝটপট প্রশ্ন।
    — এই আসা মাত্রই এক খন্ড মেঘ আর এক রাশ বৃষ্টির খেলা হয়ে গেলো
    — হুম্ম। আপনার ভালো লাগেনি?
    — হুম্ম। খুউব। এর আগে যেদিন এসেছিলাম সেদিন মেঘ থাকলেও বৃষ্টির দেখা মেলেনি
    — দেখলেন তো আমি এলাম আর মেঘ-বৃষ্টিতে ভিজিয়ে দিয়ে গেলাম
    — তোমার আব্বা- আম্মাও বেশ এনজয় করেছেন। আন্টি তো আজ বেশ ইজি হয়ে গেছেন
    — আরো হবে। জাস্ট কীপ ওয়াচিং।

    এর দ্বারা কি বুঝালো বুঝিনি। ব্যাখ্যা দাবী করে সামনাসামনি লজ্জা পাওয়ার মত বোকামীর কোন অর্থ হয়না। বললাম, “এখন যেতে হবে”। “দূর ছাই, কেন যে সময় এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যায়”? আমি বললাম,“নেক্সট টাইম এলে এখানে এক রাত থেকো। সান রাইজ আর সান সেট নাকি অপূর্ব দেখায়”। “আপনি থাকলে আবার আসবো” শৈলীর উত্তর। এবারের দেখায় শৈলীকে প্যারাগন বিউটি বলে মনে হলো। এমনিতেই সে চোখে পড়ার মত সুন্দরী। বললাম, “আন্টি তোমাকে নিয়ে সারাক্ষণ টেনশনে থাকেন”।
    — কেন? শৈলীর কৌতুহল।
    — তুমি খুব সুন্দর, তাই
    — সত্যি বলছেন?
    — আমার বলার অপেক্ষা রাখেনা। এখানকার সব ছেলেই তোমাকে হা করে দেখছে
    — আপনিও দেখেন?
    — কি বলছো? তোমার সাথে কি আমার সে সম্পর্ক?
    — তাহলে কি সম্পর্ক?
    — জানিনা।
    — এই তো ভাববাচ্যে চলে গেলেন। আমি কিন্তু আপনাকে আর স্যার টার বলতে পারবো না।
    — কে বলেছে বলতে?
    — তাহলে কি বলবো?
    — আমি কি জানি?
    — তাহলে আম্মুকে জিজ্ঞেস করবো কি বলবো? আর বলবো আপনি স্যার বলতে মানা করেছেন। এই বলে সে চক্ষু কুঞ্চিত করে দুষ্টু হাসিতে আরো অপূর্বা হয়ে উঠলো। লজ্জায় আমি লা জবাব। টিন এজ বালিকাদের একটু গুরুত্ব দিলেই হয়েছে। কি থেকে কি করবে, কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে যাবে কেউ জানেনা।

    শৈলীকে পেয়ে জেমিকে ভুলে যাই নি। তবে প্রচন্ড জেদ জমে আছে জেমির উপর। এটা কোনক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না যে প্রযুক্তির এ যুগে একটিবারের জন্যও যোগাযোগ করা যায়না। ভাবনাতে ছেদ ঘটিয়ে শৈলী আচমকা প্রশ্ন করে, “একটা প্রশ্ন করবো? একান্ত ব্যাক্তিগত”।
    — করো
    — ডু ইউ হেভ এনি ফেসিনেশন টু এনি ওয়ান?
    — মানে?
    — মানে মানে করবেন না। আপনি ঠিকই বুঝেছেন হোয়াট আই ওয়ানা নো
    — ডু ইউ হেভ এনি? আমার পাল্টা প্রশ্ন।
    — ইয়েস আই ডু। বাট হু কেয়ারস?
    — লিভ ইট
    দেখলাম শৈলীর মুখাবয়ব জুড়ে হতাশার কালো মেঘ নেমে এলো। ম্যুড অফ হয়ে গেলো। আমরা খাগড়াছড়ির পথে অগ্রসর হলাম।

    রাতের ডিনার রেস্ট হাউসেই হলো। খাওয়ার পর শৈলী হাঁটবে। আংকেল-আন্টি খানিকটা সঙ্গ দিলেন। শৈলী ‘ওয়াকিং ফর ডায়েটিং’ এর মত দ্রুত লয়ে হাঁটছে। সাথে আমি। নীচে কালচে পাহাড়ের খাদ। সাথে এক দঙ্গল গাছপালা। দূরে খাগড়াছড়ি শহর। লাল-নীল বাতির ঝিলিক। রাতের পাখীদের ডাক শোনা যাচ্ছে। তক্ষকের ডাক ভীতি ধরালো। শৈলী পারলে আমাকে জাপটে ধরে। আমি বললাম, “সো ফার সো গুড। লেটস টেক এ ইউ টার্ন”। তাদেরকে উপরে উঠিয়ে দিয়ে আমি বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে মোবাইলে নিউজ ফিড দেখছিলাম। শৈলীর ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। সাথে ফোন, “কাল আমরা আলুটিলা কেভ দেখতে যাবো”
    — আংকেল-আন্টিও যাবেন?
    — উনারা না গেলে আপনার সুবিধে হয়?
    — না, তা কেন হবে? ওখানে যেতে হলে খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নামতে উঠতে হবে।
    — আপনি নামতে পারবেন কিনা তাই বলেন
    –পারবোনা কেন?
    — আপনি যে ভীতুর ডিম। এজন্যই আপনার কিছু নেই
    — কিভাবে বুঝলা?
    — মেয়েরা সব বুঝে।
    — তাই?
    — হুম্ম।
    — আচ্ছা থাকো তুমি তোমার বুঝাবুঝি নিয়ে। আমি এখন ঘুমাবো
    — জ্বী না। আজ রাতে আর ঘুমুতে দিচ্ছিনা আপনাকে।

    শৈলীর সাথে এ কথা সে কথায় অনেক রাত হয়ে গেছে। সকালে উঠতে তাই দেরি হয়ে গেল। আলুটিলার কাহিনী অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আগেরবার এলেও আমি কেভ দেখতে নামিনি। সেখানে যেতে হলে কিছু প্রস্তুতি লাগে। আমাদের সেগুলো ছিলো না। হাতে সময়ও ছিলো না। এবার অন্তত পায়ে কেডস আর পড়নে ট্র্যাক স্যুট আছে। শৈলীরও। এ সাজে তাকে দেখবো ভাবিনি। আসলে কিছু মেয়ে আছে যাদেরকে আটপৌরে কাপড়েও মেনকা লাগে। শৈলীও তাই। মশাল হাতে কেভ এর ভেতর অগ্রসর হচ্ছি অন্যদেরকে অনুসরণ করে। শৈলী এক হাতে আমার এক হাত ধরে রেখেছে। নীচে ছড়ার পানি। তার নীচে বিভিন্ন সাইজের পাথর। হঠাৎই স্লিপ কেটে ভারসাম্যহীন হয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি অপ্রস্তুত। বললাম, “আমি না ধরলে তো চিৎপটাং খেতা”। “ জ্বী না। এত বাহাদুরী নিয়েন না। আমি তো ইচ্ছে করেই ওটা করেছি। আপনি বুদ্ধু। বুঝতে পারেন নি” বলে সে কি হাসি শৈলীর! আমি আরেকবার লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে গেলাম।

    শৈলীদেরকে বিদায় দিতে সত্যি খুব কষ্ট হচ্ছিলো। কারণ কি? অনেক চিন্তা করেছি। কিছু উত্তরও দাঁড় করিয়েছি। কিন্তু যুতসই হয়ে উঠেনি কোনটাই। তবে কি শৈলীর ‘স্মৃতি ছাপ’ হৃদয়ের প্যান্ডুলামে দোলা দিয়ে গেলো?

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১২)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১২)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১২)
    জামান ভাইয়ের এখন রমরমা অবস্থা। হেড অফিসে তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। এরিমধ্যে বিদেশেও ঘুরে এসেছেন। আরেকটি প্রকল্পের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যাক্তির দায়িত্বও পেতে যাচ্ছেন। বললাম, “ভাই বিয়ে করে ফেলেন এখন”। তিনি হাসলেন। বললেন, “দেখা যাক”। তার এই ‘দেখা যাক’ শব্দটা কানে বাজলো। বিয়ের বিষয়টি যিনি তার ডিকশনারী থেকে বাদ দিয়ে ফেলেছিলেন তিনি এখন তা যুক্ত করতে চাচ্ছেন বলে মনে হলো। বললাম, “ভাই, পুরোনো বিষয়ে নতুন কোন ডেভেলপমেন্ট আছে কি”? হাসলেন। বললেন, “ওয়েট এন্ড সি”। আমি আগামাথা কিছু না বুঝেই তাকে অগ্রীম শুভেচ্ছা জানিয়ে রাখলাম। ঢাকায় যাওয়ার পর জীবন যাত্রায় কি-রুপ পরিবর্তন হয়েছে জিজ্ঞাসা করলাম। বললেন, “গতি বেড়েছে। পলিউশন ডাইজেস্ট করতে হচ্ছে। আর কি যেন নেই বোধ হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে এরকম ছিলো না। একধরনের নির্জনতা ছিল। তবে ‘নেই নেই’ ক্ষেদ ছিলো না। যা ছিলো তা একান্ত ব্যক্তিগত শূন্যতা”।

    তার পর্যবেক্ষণ যথার্থ। নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত আমাদের কাছে পাহাড়, নদী, বন শ্বাস ফেলার উপযুক্ত জায়গা। চারিদিকের এই নিসর্গ আর এই পিন্ পতন নিরবতার মাঝেও পাখপাখালি আর ঝর্ণাধারার চাঞ্চল্য কাউকে বিরক্ত না করে মনোহারী রুপ নিয়ে বসে আছে। ভাল লাগে চুপ করে শুয়ে, বসে সময় কাটাতে, দৃষ্টি প্রসারিত করে চক্ষু শীতল করতে। হাঁটু জলে নেমেও ঝর্ণাধারায় অবগাহনে অশেষ তৃপ্তি বোধ হয়। চারিদিকের সুনির্মল বায়ু পাহাড়ের চূড়ায় ধাক্কা খেয়ে কোথা থেকে যেন একরাশ স্নিগ্ধতা নিয়ে আসে। তাতে প্রাণ জুড়ায়। মন হারায়। আবার কাউকে বিষন্নতা গ্রাস করে। পাহাড়ে, সমুদ্রে, বনে একাকী জীবনযাপনে, পরিভ্রমণে তুষ্টি মেলেনা। কেবলই মনে হয় ‘কি যেন নেই’, ‘কি যেন নেই’? জেমি নেই। নির্জনতার এই প্রহর তাই আর কাটেনা। প্রতিদিন একঘেয়েমিতে পেয়ে বসেছে। আর রাত হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ।

    রাতে যথারীতি শৈলীর ফোন, “স্যার, কি করছেন”?
    — কিছুনা। শুয়ে আছি
    — শুয়ে কি করছেন
    — আকাশের তারা দেখছি
    — তারার মধ্যে এত কি আছে দেখার?
    — কেন? অসুবিধে কি?
    — অসুবিধে কিছু নাই। তবে লক্ষ্মণ ভাল মনে হচ্ছেনা
    — কেন?
    — জিনিয়াস আর পাগলরাই তারা দেখে, গুনে, নিরীক্ষা করে
    — আমি পাগল না
    — তাই বলে জিনিয়াসও না
    — কথা প্যাচাচ্ছো। আসল কথা বলো। কেন ফোন দিয়েছো? কি যেন সারপ্রাইজ দিবে বলেছিলা
    — আমরা পরশু ভোরে খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবো
    — হঠাৎ? তাও আবার খাগড়াছড়ি?
    — বারে। আমার রেজাল্ট বেরিয়েছে না। এরপর তো ভর্তি যুদ্ধ।
    — কোন হোটেলে বুকিং দিয়েছো?
    — হোটেল না। রেস্ট হাউস। আব্বুর এক পরিচিত উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি করেন। তাদের রেস্ট হাউসে।
    — ভাল
    — আপনি হবেন আমাদের গাইড
    — আমার অফিস আছে। তাছাড়া তোমার আম্মার সামনে আমি ইজি না
    — সেগুলো ফাইনাল হয়ে গেছে। সাজেক যাবো। আর কোথায় যাওয়া যায় আপনি ঠিক করে রাখবেন। আব্বুকে
    বলেছি। আব্বু রাজী।
    — আচ্ছা দেখা যাবে।
    — জ্বী, এবার আমার পাওনা আদায় করে ছাড়বো
    — মানে কি?
    — এলেই টের পাবেন
    — বাড়াবাড়ি দেখলে আমি থাকবোই না। ছুটি নিয়ে ঢাকা চলে যাবো
    — ভয় পেলেন? ভীতুর ডিম।

    এই একই কথা জেমিও বলতো। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ফোন রেখে দিলাম। আচ্ছা বিপদেই পরা গেল দেখছি।
    ঢাকা বাসার অবস্থা নরমাল। কারফিউট তুলে নেওয়া হয়েছে। সেলিম এখন ড্রয়িং আর ডাইনিং রুম অবধি বিচরণ করে। আম্মার সাথে বেশ কথাবার্তাও বলে। কফি বানিয়ে খাওয়ায়। মাঝে মধ্যে তার স্পেশাল রেসিপিও ট্রাই করে। আম্মার মতে ওর নাকি অনেক গুণ। আমি হাসি আর শংকিত হই এই ভেবে যে, আবার না গায়েব হয়ে যায়। বড় মামার উদ্যোগে স্থানীয় থানার সহায়তায় টাকা পয়সা দেনা-পাওনার বেশ অগ্রগতি হচ্ছে। সাভারের দোকানের সালামী বাবদ দেওয়া টাকার সিংহ ভাগ ফেরত পাওয়া গেছে। বাকীটা আর পাওয়া যাবে না। থানার মামলায় দু’পক্ষের আপোষরফা হয়েছে। তবে আদালতের এখতিয়ার বিধায় সময় লাগছে এই যা। টাকা আদায়ে আমার চাচাত ভাইয়েরা পলিটিক্যালি দারুন ভূমিকা রেখেছে। আজকাল এই তরিকা খুব কার্যকর। সব শুনে খুব খুশি খুশি লাগছে। আম্মার চিন্তা তবু যায় না।

    সবার সবকিছুই গোছগাছ হয়ে যাচ্ছে। আমারই সব অনিষ্পন্ন রয়ে গেছে। জেমিকে খুব ফিল করছি। ফোন বন্ধ। একমাত্র উপায় ইলমা। আমার এই ছাত্রীটি কেন যে এত বৈরি হয়ে গেলো আজো বুঝে উঠতে পারিনি। একদিন রিক্সায় করে ঘুরতে নিয়ে যায়নি বলেই এত বৈরিতা? এত ছোট মেয়ে কখন যে ভেতরে ভেতরে এত ম্যাচিওরড হয়ে উঠেছে বুঝতে পারিনি। যা থাকে কপালে বলে ফোন দিলাম। রিং হলো। ইলমাই ধরলো, “কেমন আছেন”? প্রথমেই ‘স্যার’ শব্দটা উচ্চারিত না হওয়ায় মনটায় খট্কা বাধলো। বললাম, “কেমন আছো”?
    — যেমন রেখেছেন। ইলমার নৈর্ব্যক্তিক উত্তর।
    — বাসার সবাই ভাল?
    — স্পেসিফিক কার সম্মন্ধে জানতে চাচ্ছেন
    — এই ধরো সবাই। তোমার আব্বা-আম্মা
    — উনারা ভাল নেই
    — কেন?
    — তা আপনিই ভাল জানেন
    — মানে?
    — আম্মু আপনাকে ফোন দিতে নিষেধ করেছে না?
    — সে তো জেমিকে করতে নিষেধ করেছেন
    — বলেন কি জানতে চান?
    — তুমি ভাল আছো?
    — জ্বী। যদিও জানি সেটা আপনার উদ্দেশ্য না ।
    — তা না হলে ফোন দিলাম কেন?
    — আপুকে পাচ্ছেন না তাই। পেলে করতেন না
    — তাই?
    — অবশ্যই। আপু অসুস্থ। আন্ডার ট্রিটমেন্ট
    — কেন কি হয়েছে?
    — তাও আপনি ভাল জানেন। আর হ্যা, আপনাকে বলতে ভুলেই গেছি দুলাভাই দেশে এসেছেন। একটু সুস্থ হলেই
    আপুকে কানাডা নিয়ে যাবেন।
    — আচ্ছা।
    — আর ফোন না দিলেই খুশি হবো। আম্মু জানলে আমাকে ছাড়বেনা।

    মনটাকে আর কিছুতেই প্রবোধ দিতে পারছিনা। বুকের ঠিক মাঝখানে কাঁটা বিধার মত অনবরত খচ্ খচ্ করছে। জেমির উপর খুব রাগ হচ্ছে। একটি বারের জন্যও কি ফোন দেওয়া যায়না? অথবা ম্যাসেজ টেক্সট করা যায় না? নাকি কানাডার বাতাস তাকে দুলিয়ে দিয়েছে? জানিনা। এরকম ভাবতেও কষ্ট হয়। স্বস্তির কোন জায়গা নেই যেখানে গিয়ে হাল্কা হওয়া যায়।

    এশার নামায জামাতে আদায় শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসলাম। অপরাপর মুসুল্লীরাও গোল হয়ে বসেছে। স্বল্প বয়ান হবে। আজকের বয়ান আত্মহত্যা ও পরকীয়া নিয়ে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আবার শোনার আগ্রহও হচ্ছে। এক চিত্রনায়কের শ্বশুরের লাইভে এসে আত্মহত্যা প্রসঙ্গে বয়ান চলছে। হতাশা, অস্থিরতা, আস্থাহীনতা এবং ধর্ম ও ভাল মানুষের সহবতহীনতা থেকেই মানুষজন এ ধরণের চরম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ভদ্রলোকের কলেমার জ্ঞান ছিলো, আত্মহত্যা যে কবীরা গুনাহ তার জ্ঞানও ছিলো কিন্তু পরিণতি কত মর্মান্তিক। আখেরের ফয়সালা আল্লাহ্ই ভাল জানেন। আত্মহত্যার আরেকটি কারণ হলো প্রেম, নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশা, ব্যাভিচার ও পরকীয়া। ইমাম সাহেব কোরআন, হাদীসের রেফারেন্স দিয়ে ব্যাখ্যা করছেন। সবই জানা কথা। তবু মানুষ ভুল করে। ভুল পথে আকৃষ্ট হয়। বয়ান শেষে হুজুরের কথা, “যুবক ভাই যারা আছেন, তাদেরকে বলি। কাউকে ভাল লাগলে শরিয়াহ্ মতে বিয়ে করে ফেলুন। শয়তানের ওয়াস্ ওয়াসায় পড়বেন না”। কথাগুলো শোনার সময় হুজুরের চোখাচোখি হতেই চোখ নামিয়ে নিলাম। বয়ান শেষে সবাই সালাম বিনিময় আর মুসাফাহা করে যে যার মত চলে যাচ্ছে। আমিও এগিয়ে গিয়ে করলাম। হাত তালুবন্দী রেখে বললেন, “বাবাজী, এখন কেমন আছেন”? বললাম, “আলহাম্দুলিল্লাহ”। তিনি হাত ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন আর বলছেন, “আসেন। আল্লাহ্ কিসমতে যা রেখেছেন তা দিয়ে একসাথে খানা খেয়ে নেই”। বসবো না বসবোনা করেও বসতে হলো।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৯)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৯)

    পলি এই শহরে কিছুই চিনেনা। একা একা কোথায় গিয়ে কল দিবে! তাই বাড়ীওয়ালা খালার কাছে গেল। তিনি বসে বসে উলের সুতা দিকে যেন কি বুনছিলেন।

    খালা আসতে পারি?
    – হ্যা। এসো।
    – আমি একটা ফোন দিতে চেয়েছিলাম, আমার শ্বাশুড়ির কাছে। কাছাকাছি ফোনের দোকান কোথায় আছে খালা?
    – তোমার একদম কাছাকাছি আছে।
    – কোথায়?
    – আমার বেড রুমে, আমার বাসায় ল্যান্ড ফোন আছে। ছেলে-মেয়েরা সারাক্ষণ কল দে।
    – আমি বাইরে কোথাও থেকে করে নিব।
    – আরে, মেয়ে যাও, করে নাও। কোন সমস্যা নেই।

    পলির আর এতো কিছু ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছেনা। তাই সে, ফোনে নাম্বার ডায়াল করলো। রিং বেজে যাচ্ছে, এখনো কেউ ধরছেনা।

    দ্বিতীয় বার চেষ্টার পরে ফোন ধরলেন প্রফেসর সাহেব।

    আসসালামু আলাইকুম আব্বা, আমি পলি।
    – ওয়াকাইকুম আসসালাম।
    – কেমন আছেন?
    – ভালো আছি। এখন কলেজে যাবো।
    – আম্মা কোথায়?
    – ভালো আছে সে। আর কিছু বলবে?
    – আম্মা কি রান্নাঘরে?
    – হ্যা। কথা বলবে?
    – জি আব্বা।
    – দুই মিনিট পরে কল দাও। আমি ডেকে দিচ্ছি।
    – জি।

    দুই মিনিট পরে পলি আরও পাঁচ বার চেষ্টা করলো, কিন্তু আর লাইন পাওয়া গেলনা। বার বার ই লাইন কেটে যাচ্ছে। পলি আগেই জানতো, এই ল্যান্ড ফোন বিশেষ সুবিধার নয়, প্রায়ই নষ্ট থাকে।

    পলি বসার ঘরে গিয়ে বললো, খালা এক মিনিট কথা বলে, আবার কল দিলাম, আর যাচ্ছেনা।
    – একটু পরে, আবার দিও।
    – জি আচ্ছা। আসি খালা।
    – বসো। মন খারাপ নাকি? কেমন চুপ করে আছ?
    – না না।
    – থাকবা আর কয়েকদিন?
    – জানিনা খালা, ও চলে যেতে বলছে। হয়তো কাল/পড়শু চলে যাবো।
    – এই ব্যাপার! মন টা খারাপ?
    – না, মন খারাপ না।
    – শোনো, বিয়ের প্রথম তিন/চার বছর এই ধরনের খারাপ লাগা, খুব বেশি পরিমাণে থাকে, বেবি হয়ে গেলে দেখবে খারাপ লাগা আস্তে আস্তে কমে যাবে। আর তুমি যাবে কেন? এখানেই থাকো। এই সময় গুলি আর ফিরে আসেনা।
    – দেখি খালা!
    – আমাদের মানুষ জন সব উলটা পাল্টা কাজ করে। নতুন বউকে ছেলের সাথে না দিয়ে নিজের কাছে রাখার চেষ্টা করে। কিন্তু বিয়ের পর পর ছেলে বউ একসাথে থাকবে, সম্পর্ক মজবুত হবে, এটাই সুন্দর। এটা তারা চায়না। তুমি এখানেই থেকো।
    – জি খালা দেখি!

    পলি আর কিছুই বলেনি, থাক কি হবে আর বলে! নিজের সংসারের কথা বাইরে না গেলেই ভালো। আর সে যখন চায়না, আর এখানে থাকবেনা। সেই দম বন্ধ করা যায়গায় আবার যেতে হবে।

    রাহেলা বেগম রোদের মধ্যে নাতিকে ভালো করে তেল মাখিয়ে দিচ্ছেন। সে বড় বড় চোখ করে নানীর দিকে তাকিয়ে আছে। রাহেলা বেগম বাবুর সাথে কত কিছু গল্প করছেন, সে যেন সব বুঝতে পারছে। আজ শুক্রবার, সব ছেলেরা বাসায়। জলির জামাই, রনি ও আছে, সে আজ বিকেলে বাড়ি যাবে। গত রাত সে তার মামার বাসায় গিয়েছিল, আজ সকালে এসেছে। ছেলেকে দেখে বাড়ী যাবে।

    সাঈদ একটা ব্যাগে করে কিছু সবজি নিয়ে এসেছে। ব্যাগ টি রান্না ঘরে নিয়ে রেখে, মায়ের পাশে এসে বসলো।

    মা কেমন আছ?
    – ভালো আছি বাবা।
    – আমার ছেলেকে এভাবে আদর করে দিলেনা, কোন দিন!
    – সুযোগ পাইনি বাবা, না হয় দিতাম।
    – এখন আরেকটা সুযোগ আসছে মা! তুমি আবার দাদী হবে।
    – আলহামদুলিল্লাহ! খুব খুশির সংবাদ।
    – কাল টেস্টের রিপোর্ট আসছে।
    – জিহান ভাই কি করছে?
    – সারাঘর মাথায় করে রাখছে, আর তোমার বউমা তার পিছনে পিছনে দৌড় দিচ্ছে।
    – মেয়েটার যত্ন নিস।

    রনি এসে সালাম দিয়ে বসে তার মামাতো ভাইয়ের প্রস্তাব আবার সাঈদ কে বলছে এখন।

    রাহেলা বেগম আড় চোখে জামাইকে দেখছেন বিরক্তিকর দৃষ্টি নিয়ে।

    সাঈদ সাথে সাথে বললো না,না। এতো অল্প শিক্ষিত ছেলের কাছে কলিকে বিয়ে দিব না। ও এম.এ পাশ করুক দেখি কি করা যায়!
    – ভাইজান, আপনি একবার আমার মামার বাড়ীখানা দেখে আসবেন, চলেন। না করতে পারবেন না।
    – রনি, থাক। ওর বিয়ে এখন না, কিছুদিন পরেই দিব।

    নাহিদ রুমে বসে সব কথা শুনে বেশ অবাক হচ্ছেন, ভাইজান তো এরকম না করার মানুষ না। বোনেদের বিদায় দিলেই তিনি শান্তি! আর ধনী ছেলে হলে, তো আর কথা নেই। নিশ্চয়ই এর ভিতরে কি একটা ঝামেলা আছে। কিছুক্ষণ পরে হয়তো ধরা যাবে

    সাঈদ বললেন মা, আজ দুপুরে আর রাতে আমার বাসায় খাবে, জলির জামাই সহ দাওয়াত।
    – দুপুরের রান্না শেষ। আর জলি এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয়নি। আরেকবার জামাই আসলে, নিয়ে যাবো।
    – না না। আমি সব বাজার করে দিয়ে এসেছি। জলির খাবার পাঠিয়ে দিব, সবাই দুপুরে আমার বাসায় খাবে।
    – আমি আর জলি যাবো না। আর রাতে না, শুধু দুপুরেই খাবে।
    – না, তোমাকে যেতেই হবে। শাহিদ-নাহিদ খেয়ে চলে আসবে, জলির পাশে বসবে এসে।
    – আচ্ছা দেখি বাবা।
    – আর দেখা-দেখি নাই। আমি যাচ্ছি।

    কলি আস্তে করে নাহিদ কে বললো কিরে তুই অংক মিলাতে পারছিস?
    – তুই পেরেছিস?
    – আমি তো অংকে কাঁচা।
    – আমি দাওয়াতে নাই, আমি বাসায় ডাল-ভাত খাবো। তোরা যা!
    – আমার ও ইচ্ছে নেই। কি উদ্দেশ্য আছে কে জানে।

    পলি গতকাল রাতে শ্বশুর বাড়ী এসে পৌছেছে। মন খুব একটা ভালো নেই, থাক তার যখন ইচ্ছে নেই জোড় করে তো আর থাকা যায়না!

    পলি গিয়ে রান্নাঘরে দেখছে, শ্বাশুড়ি তার সেই আলু ভর্তা মাখিয়ে নিচ্ছেন।

    পলি সেদিন অনেকক্ষণ ফোনের পাশে বসেছিলাম। আর ফোন দিলেনা?
    – লাইন পাইনি আম্মা।
    – ওহ। আচ্ছা শোন, আরেকটা খবর তোমার ডাক্তার দেবর, এখনো ইন্টার্ণশিপে রয়েছে, কিন্তু মেয়ে পছন্দ করে ফেলেছে। এই মেয়েকে ছাড়া নাকি সে বাঁচবেনা। কত যন্ত্রনা!
    – ওহ!
    – এখন, তোমার শ্বশুর বলেছিলেন, ছোট খাটো অনুষ্ঠান করে বউ তুলে আনবে। বউ এম.বি.এ পাশ করেছে, ওর সম বয়েসী। বউ তুলে ওদের কি একটা বাসা ভাড়া করে দিয়ে আসবেন। তারা টুনাটুনি থাকুক।
    – এটাই ভালো। তাদের মতো করে, সংসার ঘুছিয়ে নিক।
    – ভালো হয়েছে। আম্মা কিছু সাহায্য করি?
    – না, কিছুই লাগবেনা। তুমি আবিদের কাছে যাও, দেখো কিছু লাগে কিনা!

    পলি রুমে এসেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এই জীবনে জোড় যার মুল্লুক তার। তার দেবর এখনো চাকরি করেনা, তবুও বউ নিয়ে তার মতো করে বাসায় থাকবে। বড় ভাসুর ও থাকছেন। শুধু সেই থাকতে পারবেনা। কারণ আবিদ কিছুই বলতে চায়না, সে চুপচাপ থাকে, তার স্বল্প আয় সেজন্য হয়তো। পলি, চিন্তা করলো, এই পৃথিবীতে কেউ মনের কষ্টের খবর রাখেনা। এইখানে সবাই যার যার ব্যস্ত, অচেনা জায়গা এতো খারাপ লাগে তবুও থাকতে হবে! কারণ তার যে তীব্র কষ্ট আছে, দেখা যায়না। সুতরাং তার কোন কষ্ট নেই, এটাই প্রমানিত।

    রাহেলা বেগম আর নাহিদ ছাড়া সবাই দাওয়াতে যাচ্ছে। রাহেলা বেগম নাতি আর মেয়ের কাছে থেকেছেন। রাহেলা বেগম অনেক জোড় করেও নাহিদ কে পাঠাতে পারেন নি। তার এক কথা আমার ঘি ভাত হজম হয়না মা, আমাকে ছেড়ে দাও।

    কলি ঘরে ঢুকতেই দেখলো পোলেয়ার গন্ধে সারা বাড়ী মৌ মৌ করছে। ঘরে আরও অতিথি আছেন, সাহেদা বেগম এসেছেন সাথে আইরিন আর তারিন।

    সাহেদা বেগম দেখেই বলছেন, কি গো কেমন আছ? আমার জামাই তো তোমাদের বাসায় নিয়ে গেল না।
    – আজ চলে আসেন খালাম্মা।
    – আজ বিকেলে আমি বাসায় চলে যাবো।

    শারমিন কলিকে ডেকে নিয়ে রান্নাঘরে সব রান্না দেখিয়ে বলছেন, দেখো সব ঠিক আছে?
    – জি ভাবী।
    – একটু টেস্ট করে দেখো।
    – ঘ্রান ভালো আসছে, মজা হয়েছে।
    – আরে, নাও দেখো।

    কলির মাথায় কিছুই ঢুকছেনা হঠাৎ করে ভাবীর এই ব্যবহার তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলছে! এরকম খাতিরের পিছনে কি কোন কাহিনী কি আছে! নাকি ভাবী সত্যি ভালো হয়ে গিয়েছেন, কিছুই বুঝতে পারছেনা কলি…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ১৯.০২.২০২২

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১১)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১১)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১১)
    সেলিম স্বেচ্ছায় আত্মসমর্পণ করায় দুশ্চিন্তা কিছুটা লাঘব হলেও খাগড়াছড়িতে তার আবির্ভাবে খুব একটা স্বস্তি পাচ্ছিনা। প্রথমত বোনের হাসবেন্ড হিসেবে রুমমেটরা হাই-হ্যালো, খায়-খাতির ইত্যাদিতে বেশ কাটিয়ে দিচ্ছে। তাতে সমস্যা নাই। কিন্তু কখন কি বেফাঁস বলে বসে তারও ভরসা নাই। দ্বিতীয়ত তার সাথে কাজের কথা বলতে পারছিনা। সারাদিন থাকি অফিসে। সন্ধ্যার পর বাসায়। সেখানে অন্য রুমমেটরাও থাকে। থাকে বাবুর্চিও। ক্রান্তিকালীন সাংসারিক আলাপ আলোচনা , বিশেষত সার্কাস টাইপের সম্ভাব্য হাই ভোল্টেজ ডায়ালগ করার মত পরিবেশও পাচ্ছিনা। বাইরে ঘুরার নাম করে রাতে রেস্তোরাঁয় বসেও বিশেষ সুবিধে হচ্ছেনা। প্রশ্ন করলে মিনিট দুই পর এক শব্দে দ্ব্যর্থবোধক উত্তর আসে। স্পষ্ট করতে সম্পূরক প্রশ্ন করতে হয় তিনটা। বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তরে পাশ কেটে যায় বা নিরুত্তর থাকে। মেজাজ ধরে রাখা কঠিন।তার আসল মোটিভ কি তাও জানতে পারছিনা।
    সারাদিন বাসায় থেকে লম্বা লম্বা ঘুম দিচ্ছে। ভাবছি বলে কয়ে বাসায় পাঠিয়ে দেই। যদিও এতে অবস্থার আরো অবনতি হবে। সেও যেতে রাজী না। আম্মাও ঢাকা বাসায় তার এন্ট্রিতে রাজী না। মলি বাসায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করে দিয়েছে। বড় মামা পিস্তল শানাচ্ছেন। তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই।মান-সম্মান বলেও তো একটা কথা আছে। সমস্যা হয়েছে, সেলিম কোনভাবেই তাদের বাড়ীতে যাবেনা। তার কোন আত্মীয়ের বাসাতেও না। ফোনে মলিকে পাওয়া যায় না। আম্মাকে বলে দিয়েছে আমাদের দু’জনের কারো সাথে কথা বলবে না। তার মেজাজ গরম,কেন আমি সেলিমকে জামাই আদর করে জায়গা দিয়েছি? সেলিমকে বললাম ফোন দিতে। কান ধরে এমন ভাব করলো যেন এর চেয়ে ডাইরেক্ট কনডেম সেলে কারাবাসে যাওয়াও তার জন্য সহজ। বললাম, “তোমার মোবাইল কই”? উত্তর শুনে আমি হাসবো না কান্না করবো নাকি ঠাস করে দু’গালে দু চড় মারবো বুঝতে পারছিনা। মোবাইল নেই। নেই মানে নেই। এই এক উত্তর। তাহলে গেল কোথায়? এ প্রশ্নের উত্তর বের করা সম্ভব হয়নি। ধরে নিয়েছি, হয় ছিনতাই হয়েছে, নয়ত বিক্রী করে পুঁজির ক্রাইসিস মিটাচ্ছে। আম্মাকে আর ছোট মামাকে অনেক বলে কয়ে ম্যানেজ করলাম। আমার চাকরি ও মান-ইজ্জতের খাতিরে হলেও তাকে এখান থেকে অন্যত্র শিফট করা দরকার। হাজার পাঁচেক টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে তাকে নাইট কোচে তুলে দিলাম। সাময়িক সমাধান হলো বলে কিছুটা স্বস্তি পেলেও হঠাৎ মনে হলো সে যদি বাসায় না গিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে আবার ঘাপটি মারে? এতক্ষণ মাথা ঝিম্ ঝিম্ করছিলো আর এখন প্রচন্ড ব্যাথা করা শুরু করে দিয়েছে। কোন ফ্যামিলিতে এরকম এক পিস থাকলেই যথেষ্ট। এক জেনারেশনে আর শান্তির মুখ দেখা লাগবেনা। ওকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় এসেই মনে হলো ছোট মামাকে বলি ভোরে তাকে যেন রাসেল স্কোয়ারের কাউন্টার থেকে এসকর্ট করে নিয়ে বাসায় হাওলা করে দেয়। ছোট মামা শুনে হাসলেন। বললেন, “বড্ড বিপদেই পড়া গেল দেখছি তাকে নিয়ে”।বড় মামা হলে ফোনেই শাউটিং করা শুরু করে দিতেন।

    খুব ভোরে উঠে মনে হলো সেলিম যদি অন্য কোন মতলবে বাসায় না যাবার জন্য আরামবাগ স্টপেজে নেমে পড়ে? ছোট মামাকে বললাম। কথা সত্য। তাকে আরামবাগ কাউন্টারে ব্যাগ হাতে নামতে দেখা গেল। “এখানে কেন” জিজ্ঞেস করতেই তার উত্তর “এখানে এক বন্ধুর বাসায় দেখা করে পরে যেতাম। কিছু টাকা পাই ওর কাছে”। মামা তাকে কোন সুযোগ না দিয়েই গাড়ীতে উঠিয়ে সোজা বাসায় আম্মার হাওলা করে দিয়েছেন। এর পরের কাহিনী নাটকীয়। নারকীয়ও। প্রথমত মলি ঘুমে ছিলো। রুমের দরোজা লকড। দ্বিতীয়ত কারফিউ ব্রেক করে সে হাজির হয়েছে। তাই ঘুম থেকে তুলে ফেরারী আসামীকে তার সামনে হাজির করালে সাংঘাতিক বিপদ ঘটতে পারে। তার আপাতত ঠিকানা আমার রুম। এভাবেই আম্মা ব্যবস্থা করে তার জন্য নাস্তা তৈরি করতে কিচেনে ঢুকেছে। কিছুক্ষণ পর তুমুল হট্টগোলে আম্মা কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে দেখে সেলিম আমার রুমে নেই। মলির রুম লকড। রুমের ভেতর মলির গলা চড়ানো বাংলা সিনেমার হাইভোল্টেজ নন স্টপ মনোলগ বর্ষণ চলছে। আর কোন কন্ঠ শোনা যাচ্ছে না। আম্মা চুলা নিভিয়ে বুয়াকে বিদায় দিয়ে বিছানায়। আমি অসহায়।

    ঘন্টাখানেক পর বাসার খবর নিতে ফোন দিলাম। বললাম, “বাসার পরিবেশ এখন কেমন”?আম্মা এমন একটা ভাব করলো যেন “অল কোয়ায়েট অন দা ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট”। আমি বললাম, “কেমনে কি হলো”? আম্মা হেসে বললো, “দুটোই তো পাগল। এই ফাটাফাটি, এই মাখামাখি। দেখলাম মলি নিজে নাস্তা বানিয়ে রুমে বসে দু’জনে মিলে খেলো”। বিস্ময়ে আমি হতবাক। পরক্ষণেই ভাবলাম, এরই নাম প্রেম। মানুষের ভুল হতে পারে, দোষ থাকতেই পারে, বিচ্যুতিও হতে পারে। কিন্তু সাচ্চা প্রেম সব কিছু মানিয়ে নিয়ে এগিয়ে চলে।

    হঠাৎই শৈলীর ফোন, “স্যার,দারুণ সারপ্রাইজ আছে। রাতে ফোন দেবো। ধইরেন”। আমার ইচ্ছে অনিচ্ছের তোয়াক্কা না করে ফোন রেখে দিলো। কিসের সারপ্রাইজ? আর এখনই বা বলা গেল না কেন? টিন এজ বালিকাদের বুঝা খুব কঠিন। এদের মনের ব্যারোমিটারের ভেতর পারদ থাকেনা। থাকে ঈথার। সেই ঈথারে উল্টো পাল্টা ঢেউ লাগলেই মনের নাচন শুরু হয়ে যায়। তখন কাউকে ভালবেসে দিল ফানাফানা, নয়ত তুই-তুকারি থেকে যাচ্ছেতাই। কিন্তু আমাদের তো সে সম্পর্ক না। মাথা ঝিম ঝিম করছে। মানুষকে আল্লাহ যে কত শক্তপোক্ত করে সৃষ্টি করেছেন তা বহুর্মুখী অবস্থায় পড়ে এখন বুঝছি।

    একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। পড়াবার এক ফাঁকে শৈলিকে বেশ আনমোনা দেখে বলেছিলাম, “কি ব্যাপার? পড়ায় মনে নেই যে। কী ভাবছো”? বল পয়েন্ট কামড়াতে কামড়াতে দুষ্টুমাখা হাসিতে বললো, “শুনবেন”? মাথা নাড়লাম। বললো, “না থাক। আপনি লজ্জা পাবেন”।

    — কেন? লজ্জা পাবো কেন? আমার প্রশ্ন।
    — কাল রাতে একটা স্বপ্ন দেখেছি
    — আর এখন পড়ালেখা বাদ দিয়ে বসে বসে সেটাই ভাবছো?
    — হুম্ম
    — বেশ তো। পাগল আর কাকে বলে
    — পাগলই তো
    — কে?
    — কে আর? আমি। তবে আপনিও
    — আমি কিভাবে?
    — পাগলদের পরিপূর্ণ সেন্স থাকেনা
    — তোমার আছে?
    — না। তাই তো ঝামেলা
    — তা কি স্বপ্ন দেখলা?
    — দেখলাম, আমি আর আপনি কোথায় যেন গেছি। সমুদ্রও আছে। আবার পাহাড়, জঙ্গলও আছে।
    — তারপর?
    — জঙ্গল পেড়িয়ে ছড়া পাড় হতে গিয়ে পড়েছি সমস্যায়
    — কি সমস্যা?
    — ছোট্ট ডিঙ্গীতে করে পেরোতে হবে
    — এতে সমস্যা কি?
    — সেখানেই তো সমস্যা। আপনি সেই ডিঙ্গীতে কিছুতেই উঠতে চাচ্ছেন না।
    — তারপর?
    — তারপর আর কি? আপনি ধমক দিয়ে বললেন, কই, লিখছোনা কেন? অমনি স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল।

    শৈলীর এই স্বপ্নের অর্থ কি আমি বুঝি। কিন্তু আসকারা পেয়ে যাবে ভেবে বললাম, “স্বপ্নে তোমার সাথে ওটা আমি না অন্য কেউ ছিল। আজেবাজে চিন্তা বাদ দাও। এভাবে আনমোনা হলে আমি চলে যাবো কিন্তু”। শৈলী এতে মর্মাহত হলো। রাতে শৈলী আবার ফোন দিলো। সাধারণত বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া ফোন দেয় না। তবে পরীক্ষার আগে কোন কিছু ক্লিয়ার করার জন্য রাতে এর আগেও কয়েকবার ফোন দিয়েছে। ধরলাম, “বলো,কি বলবা”?

    — স্যরি
    — কেন?
    — দু’কারণে
    — যেমন
    — আপনাকে আজ পাগল বলেছি।
    — লিভ ইট। আর কোন কারণ?
    — আমার স্বপ্নটা মাথা থেকে সরাতে পারছিনা
    — কেন?
    — জানিনা
    — আজেবাজে স্বপ্নের কোন মানে হয়না। খেয়ে ঘুমিয়ে পরো। সব ঠিক হয়ে যাবে।
    — আপনি স্বপ্নটাকে তো পাত্তাই দিলেন না।
    — এনাফ ইজ এনাফ। জাস্ট স্টপ ইট।
    কথাগুলো শৈলীর মোটেই মনপুত হলোনা। বললো, “স্বপ্নটা মোটেই আজেবাজে ছিলো না। আপনিই আজেবাজে ভাবছেন”।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৮)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৮)

    পলি সকাল থেকে মন খারাপ করে বসে আছে। কারণ আবিদ এক কথাই বার বার বলছে, এভাবে এখানে থাকা ঠিক হবেনা। আমি এভাবে, আব্বা-আম্মাকে কষ্ট দিতে পারবো না।

    পলি কান্নাকাটি করে, হালকা হতে ইচ্ছে করছে। আবিদ চুপচাপ ভদ্র ছেলে, মাঝারি ধরণের চাকরি। সামন্য টাকা বেতন আর চার/পাঁচ টা টিউশনি করে, চলে যাবে সংসার। কিন্তু সে একদম দায়িত্ব ছাড়া কিছুই বুঝেনা, আবেগ নেই বললেই চলে। সে আজ একমাস হয়েছে এখানে, শখ করে একদিন এক কাপ চা খেতে পর্যন্ত নিয়ে যায়নি! সে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে। তবুও সারাদিন অপেক্ষা করেই থাকতে ইচ্ছে হয়। এই ছোট্ট রুমের মায়ায় সারাক্ষণ বন্দি থাকতে ইচ্ছে হয়।

    আবিদ স্কুলে যাওয়ার সময়, মুখ বেশ কালো করে বললো, পলি গুছিয়ে রাখবে সব, কাল সকালেই রওনা হবো।

    পলি আর কিছুই বলেনি, বলতে ইচ্ছে হয়নি। মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক। তার স্বপ্ন ছিল একজন মানুষ থাকে পাগলের মতো ভালবাসবে, খুব সকালে দুজন মিলে হাত ধরাধরি করে রাস্তায় হাঁটবে। ইচ্ছে হলে ছুটির দিনের বিকালে শাড়ী পরে রিকশা করে ঘুরবে! এক গুচ্ছ বেলী ফুল নিয়ে হয়তো সারপ্রাইজ দিবে। কিন্তু আবিদ সম্পূর্ণ বিপরীত, চুপচাপ একজন মানুষ। ঘুরতে যাওয়ার বিন্দু মাত্র আগ্রহ তার নেই। তবুও সে আবিদ কে প্রান ভরে ভালবাসে। আজ খুব রাগ লাগছে, শ্বশুরের বাসায় যেতে মন একদম মানছেনা। একদম না।

    দুপুরের খাওয়ার পর জলির পাশে বসে আছে রনি। বললো আমার মামাতো ভাই কে কি পছন্দ হয়নি কলির?
    – কলিকে, কিছুই জানানো হয়নি। আজ মেজ ভাই আসবে, আসলে বুঝে জানাবেন।
    – এতো বোঝার কি আছে জলি? ব্যবসা করে, নিজেদের ফ্ল্যাট কিনেছে। বড় মামার বাড়ীতে বিশাল সম্পদ। একটাই ছেলে।
    – আমার তো ওকে অনেক পছন্দ কিন্তু, ভাইদের মতামত এখানে অনেক বেশি জরুরি।
    – ওর, কলিকে পছন্দ হয়েছে।
    – ভালো সংবাদ

    জাহিদ এসেই ভাগ্নেকে কোলে নিয়ে আদর করছে। আহা! আমাদের বড় ভাগ্নে, তাই না মা?
    – হ্যা। ভাগ্নের মুখ দেখ তোর মতো।
    – তাই নাকি?
    – ভাগ্নের জন্য কি এনেছিস?
    – অনেক কিছু….. মা, প্রচন্ড ক্ষুদার্ত দুই ভাই, খাবার দাও।

    বড় খাটে, জলি তার ছেলে, আর রাহেলা বেগমের জন্য জায়গা করা হয়েছে। পলি নিচে কাঁথা বিছিয়ে জায়গা করছে। ছোট রুমের খাটে, রনিকে একাই দেওয়া হয়েছে। সে বার বার নাহিদ কে ডাকছে। কিন্তু নাহিদের বেশ লজ্জা লাগছে, এভাবে গাদাগাদি করে থাকবে, তার চেয়ে নিচেই ভালো।

    জাহিদ ১৮০ টাকা দিয়ে একটা মশারি কিনে এনেছে। এনে, মাকে দিল।
    – এটা কি জন্য?
    – আমরা তিন ভাই ছাদে, শুয়ে পরবো। নিচে থাকবে পাটি, আর দুইটা পিড়ি দিবে, তার উপর কাপড় বিছিয়ে শুয়ে যাবো।
    – কি বলিস এসব?
    – মা, এখন হালকা শীত পরছে, সমস্যা নাই। মশার সমস্যা সমাধান। আর পিঁড়ি পেতে ঘুমানো আমার পুরনো অভ্যাস।
    – সাঈদের বাসায় রুম গুলি খালি পরে আছে।
    – আমাদের এই বিশাল ছাদ খালি পরে আছে। জামাই মানুষ এসেছে, সে বেশি কথা শুনলে, কষ্ট পাবে।
    – ছোট রএর নিচে জায়গা কর।
    – এখানে একজনের জায়গা হবে, আর নাহিদ ও এখানে থাকতে চায়, থাক। দুলাভাই আরাম করে ঘুম দিক।
    – আর তুই?
    – যে জার্নি আজ হয়েছে, শুধু চোখ বন্ধ করলেই শেষ।

    রাহেলা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,একে বুঝানো একে বারেই সম্ভব না। কেমন করে এই খোলা আকাশের নিচে রাতে থাকবে তিন ছেলে।

    রাতে তিন ভাই মিলে কুটকুট করে গল্প করছে। নাহিদ বলছে মেজ ভাই, কলিপার বিয়ের আলাপক আসছে?
    – এখন কিসের বিয়ে। এম.এ পাশ করা বেশি জরুরি।
    – দুলাভাইয়ের মামাতো ভাই, বিশাল বড় লোক।
    – বিশাল বড় লোক কলিকে বিয়ে করতে চায়, এখানে ঘাপলা আছে।
    – না, কোন ঝামেলা নাই।
    – ভাই, অনেক বেশি ক্লান্ত আজ, শাহিদ সাহেব এখনই নাক ডাকছেন৷ আমাকেও নাক ডাকতে দে।
    – ভাইজানের মন উদার থাকলে আজ এভাবে থাকতে হতো না।
    – সব সময় মাথায় রাখবি, সব কাজের পিছনে ভালো কোন কিছু আছে। এখন ঘুমাই, সকালে কথা বলবো। মশারীর ফাঁক দিয়ে মশা বাবু গুন গুন করছেন। কি যে বিশ্রি সে সুর।
    – হুম। অত্যন্ত বেসুরা। ঘুমাও মেজ ভাই।.

    ফযরের নামায পরে, একটা মোড়া নিয়ে ছেলেদের পাশে এসে বসেছেন রাহেলা। তিন পুত্র আরাম করে ঘুমাচ্ছে। নাহিদ পিঁড়ি থেকে মাথা নামিয়ে নিজের হাতের উপর শুয়ে আছে। রাহেলা রুমে গিয়ে, এবার নিজের বালিশ টা নাহিদের মাথায় দিলেন। আরও দুটি বালিশ কেনা দরকার।

    ভোর ছয়টার দিকে চোখে রোদ লাগতেই জাহিদ উঠে বসে পরলো, বেশ গরম লাগছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, রাহেলা বেগম মাথার কাছে বসে ছিলেন। হাতে পাখা, বাতাস করছেন।

    তুমি কখন এসেছো?
    — একটু আগে। তুমি ঘুমাও মা! তোমার হাই প্রেশার।
    – আমার সূর্য উঠলে কখনো ঘুম লাগেনা আর। বাবা, কলির জন্য জামাই বিয়ের আলাপ নিয়ে আসছে। কিন্তু এখন বিয়ে দেওয়ার দরকার নাই।
    – তাইতো। দুলাভাইয়ের কি হয়?
    – মামাতো ভাই। ঢাকায় নাকি অনেক বড় ব্যবসা। সমস্যা একটাই ছেলে ম্যাট্রিক পাশ।
    – আমার বোন দুই দিন পর মাস্টার্স পাশ করবে।
    – আমি তো বিয়েই এখন দিব না। তাই আর আগ্রহ দেখাই নাই। মেয়েদের কপাল কার কোথায় কে জানে! শিক্ষা কম বলার দরকার কি? উত্তর একটাই এখন বিয়ে দিব না।
    – হ্যা।
    – আমি খিচুড়ি বসাই। জামাই এসেছে।

    জলি ছেলেকে নিয়ে রোদে বসে আছে। যাতে চগেলের জন্ডিজ না হয়। দুই মামা দুই দিকে বসে আছে।

    রাহেলা বেগম বললেন দেখেছিস মেজ মামাজি কত জামা নিয়ে এসেছে?
    – হ্যা মা। আর জাম লাগবেই না।
    – এখন আর কি লাগবে, বল? আমি তো কিছু দিলাম না।
    – না, তুমি কি দিবা, তোমার দোয়াই আসল। তার দাদী নাকি রুপার চেইন, আংটি কিনেছেন। অবস্থা গরীব কিন্তু মন অনেক বড়।
    – হুম।
    – আমার বড় ননদের ছেলে চার আনার চেইন দিয়েছেন। আমার শ্বাশুরির নাতি-পুতির প্রতি স্নেহ বেশি।
    – থাক, তুই। আমি জাহিদের সাথে কিছু আলাপ করি।
    – মা, কলির বিয়ের টাও।
    – হুম।

    রাহেলা বেগম আসতে আসতে চিন্তা করছেন তিনি সোনার চেইন কোথায় পাবেন? কে দিবে তাকে টাকা।

    জাহিদ মায়ের পাশে বসে বললো মা, জলিপার পছন্দ হয়েছে কাপড়?
    – হ্যা।
    – আমার হাত একদম খালি। বেতন পেয়ে নেসের ভাড়া, খাবার খরচ দিয়ে, সব নিয়ে এসেছি। এসব কিনে টাকা মাত্র ছয় হাজার রয়েছে। এই মাস চলবে কেমন করে। এই মাসেই শাহিদের ফরন ফিলাপ।
    – চিন্তা কর না, আল্লাহ ব্যবস্থা করবেন।

    রাহেলা বেগম ছেলেকে স্বর্ণ চেইনের কথা বলার সাহস পেলেন না। জাহিদের হাত টাকা নাই, মানে বল নাই। কেমনে করে কি করবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না, তিনি। তার সহজ সরল জলি কি মাতের এই পরিস্থিতি বুঝবে!

    পলি শেষ পর্যন্ত যাওয়া তিন দিন পিছিয়েছে। কিন্তু থাকা হবেনা আর, এটা বেশ জোরালো ভাবে বলেছে আবিদ। পলি আজ চিন্তা করছে, আবিদ যাওয়ার পর, শ্বাশুরিকে কল দিবে। যদি ল্যান্ডলাইন ঠিক হয়, তিনি কথা বলবেন। তবে, সব শুনে কি তিনি রাজী হবেন না কষ্ট পাবেন! আনিদ বেড়িয়ে যাচ্ছে, পলি ফোনে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু পরবর্তী কি হবে, সেটা সে জানেনা, তবে৷ সে শেষ চেষ্টা করবেই, এবং এতে কিনহবে সেটা জানেনা….

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ১৬.০২.২০২২

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১০)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১০)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১০)
    শেষ পর্যন্ত জামান ভাইয়ের ঢাকায় বদলীর আদেশ হয়েছে। হেড অফিসে। এতে আমার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। কারণ দুটি। এক, বদলী হয়ে ঢাকাতেই যাচ্ছেন তিনি। তাই দেখা সাক্ষাতের সুযোগ থেকেই যাচ্ছে। দুই, চান্স পেলেই তিনি আমাকে টান দেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন। একদিকে সাময়িক বিচ্ছেদ। অন্যদিকে মিলনের সম্ভাবনা।

    জামান ভাই নিয়ে আমার কৌতুহলের এখনো সমাপ্তি হয়নি। শুধু এটুকু বুঝতে পেরেছি যে তার এই বিরহ যাতনার মূলে আছে ওয়ান সাইডেড লাভ। আর এটুকুও আঁচ করতে পেরেছি যে সেই ভদ্রমহিলা এখনো অকৃতদার। বিত্ত বৈভবে উচ্চ আর চিত্ত বিলাসে মত্ত সেই ভদ্র মহিলার পারিবারিক অবস্থা নাকি হাই ফাই। জামান ভাইদের ফ্যামিলির সাথে নাকি যায় না। যতই বিদায়ের সময় ঘনিয়ে আসছে ততই একাকীত্বের ঢেউ আছড়ে পড়ছে। ক্রাশ প্রোগ্রামের মত করে এরিমধ্যে ঘুরে এসেছি সাজেকসহ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। এই প্রথম চাক্ষুষ করলাম, বলাচলে, উপলব্ধি করলাম, নিঃসর্গের কোন অস্থিরতা নেই, কোন উচ্চবাচ্য নেই। সর্বত্র সবুজের সমারোহ, পাখ-পাখালীর পদচারণা, কল-কুঞ্জন। ঝর্ণা আর ছড়ার কুলকুল রব ও নিরবধি বয়ে চলা। আর রয়েছে উপত্যকার বন্ধুরতার সাথে মানুষের প্রাকৃতিক মিতালী। জামান ভাইকে আমরা সহকর্মীরা রাতের কোচে তুলে দিলাম। বিদায়ী হাত তুলতে গিয়ে চোখের জল টুপ করে ঝরে পড়লো। ভাগ্যিস রাত। কেউ দেখেনি কারো অশ্রুপাত। বুকের ভেতর অশান্ত মহাসাগর। সেই রাতে আর ঘুম এলো না। জামান ভাইকে যতই ভুলে থাকার চেষ্টা করছি ততই তা বলগ দিয়ে উপচে পড়ার মত উথলে উঠছে। এভাবেই ফজরের আযান হলো। আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম। ঘুম হতে নামায উত্তম।

    মনটাতে বিদ্যুৎ শক দিয়ে গেল। নিজেকে বড় বেশি অপরাধী মনে হলো। মহান আল্লাহতায়ালা দিনকে করেছেন রাতের অধীন। আর রাতকে রেখেছেন প্রশান্তির জন্য। ঘুম হলো তাঁর তরফ থেকে প্রদত্ত প্রকৃষ্ট নিয়ামত। আবার ঘুম হতে উত্তম হলো এই ফজরের সালাত। এরই আহ্বান এড়িয়ে যেতে সাহস হলো না । কবে কোনদিন ফজরের সালাত সময়মত পড়েছি মনে করতে পারছিনা। জামাতে তো নয়ই। ওযু করে গেইটে তালা মেরে ঘুটঘুটে অন্ধকারে মসজিদের দিকে পা বাড়ালাম। আজ এই প্রথম মনে হলো আমি যথার্থই অসহায়। আত্মসমর্পণ ভিন্ন শান্তির বিকল্প পথ আমার জানা নেই। নামায শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসলাম। বললাম, “রাতে ঘুম হচ্ছেনা। ডাক্তারের পরামর্শ মতে ওষুধ খাচ্ছি। কিন্তু কাজ হচ্ছেনা”। ইমাম সাহেব শুনলেন। শান্ত কন্ঠে বললেন, “পেরেশানি থাকবেই। সবর আর সালাতের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা করেন। দেখবেন শান্তি পাবেন”। বাসায় ফিরছি। ততক্ষণে চারিদিক আলোকিত হয়ে গেছে। প্রকৃতিও নিদ্রা শেষে আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠেছে। মনে প্রশান্তির হিমবাহ বইছে।

    শৈলীর ফোন। অপ্রত্যাশিত। ধরলাম। আজ তার এইচ এস সি রেজাল্ট বেরিয়েছে। সে যথাকাম্য গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। দারুণ খুশি। বললো, “ স্যার, আপনি তো ফোন করে উইশও করলেন না একবার”।
    — আসলে আজই যে রেজাল্ট বেরিয়েছে কাজের চাপে তা খেয়াল করিনি। স্যরি
    — স্যরি বললেই তো হবে না
    — তাহলে
    — ঢাকায় এলে আমাদের বাসায় আসতে হবে
    — আমি তো ঢাকায় কম যাই
    — এখন বেশি বেশি আসবেন
    — কেন?
    — বারে! আমি বুয়েটে ভর্তি হতে চাই যে
    — সে জন্য ভাল করে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করো। সেখানে ভর্তি হও
    — তাতো হবোই। তবু আপনাকে চাই।
    — সে পরে দেখা যাবে
    — সে হবে না। আপনি পরে আর আসবেন না
    — কেন?
    — আপনার বিয়ের দাওয়াতও তো দিলেন না
    — আমি বিয়ে করেছি তোমাকে কে বললো?
    — করেন নি? আল্লাহ বাচাইছে
    — মানে কি?
    — মানে কিচ্ছু না। এত মানে মানে করেন কেন?
    — তুমিই তো কি সব আবোলতাবোল বলছো
    — মোটেই আবোলতাবোল না। তাছাড়া আমার ট্রিট তো পাওনা হয়ে গেছে।
    — কিসের ট্রিট?
    — বাহরে! মনে নাই? ভাল রেজাল্ট করলে ট্রিট দেবেন বলেছিলেন।
    — হুম্ম।
    — ঘাবড়ে গেলেন?
    — না, তা কেন?
    — আচ্ছা রাখি। ভাল থাকবেন। এখন থেকে প্রতিদিন ফোন দেবো। ধরবেন কিন্তু।

    শৈলীর আচরণ আরো ডেসপারেট হয়েছে বলে মনে হলো। আমার এই ছাত্রীটি দেখতে যেমন অসম্ভব সুন্দর তেমনি দারুণ চটপটে। সারাক্ষণ বকরবকর করবে। বিশেষত আমি পড়াতে গেলে তার কথার চোটে আর প্রশ্নের ঠেলায় আমার নাভিশ্বাস উঠে যেত। শৈলী দুষ্টুমী মাখা হাসিতে মজা লুটতো। পরক্ষণেই বলত, “স্যার, মনে কষ্ট পেয়েছেন”?
    — কেন? আমার প্রশ্ন।
    — এই যে আপনাকে এত বিরক্ত করি। পড়া বাদ দিয়ে আপনার সাথে অন্য প্রসঙ্গে আলাপ করতেই থাকি। অথচ
    জানি আপনি এসব পছন্দ করেন না।
    — তাহলে করো কেন?
    — ভাল লাগে। আপনি রাগ করেন। সেটা দেখতে খুব ভাল লাগে।
    — আর কি ভাল লাগে?
    — আপনার দেওয়া হোম ওয়ার্ক করেও মিথ্যা বলি
    — কেন?
    — আপনার রিয়েকশন দেখতে।
    — কি দেখতে পাও?
    — আপনার রিয়েকশনে মাশাল্লাহ একটা ভাব আছে।
    — তাই নাকি?
    — হুম্ম। আপনাকে তাই আমার খুব খুব ভাল লাগে। লাভ ইউ।
    আমার অন্তরাত্মা শিউরে উঠে। ছোটবেলায় গল্প-কাহিনী, সিনেমা-নাটকে টিউশন মাস্টারের প্রেম কাহিনী এবং পরিণতিতে ঘর জামাইয়ের চিত্র ভেসে উঠলো। ধমকের সুরে বললাম, “ওসব আজেবাজে চিন্তা বাদ দাও। নইলে কাল থেকে আমি আর আসবো না”। অমনি তার চোখ ছলছল করে উঠলো। অভিমান প্রকাশের জড়তা চোখে মুখে স্পষ্ট। আমার কেমন যেন মায়া হলো। এ বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে সাময়িক এই ইনফেচুয়েশন ভাব থাকা স্বাভাবিক। আজ শৈলীর এই খুশির খবরে টিউটর হিসেবে নিজেকে খুব গর্বিত ও খুশি খুশি লাগছে। তার বাবা মায়ের ইচ্ছে মেয়ে ডাক্তার হবে। আর শৈলীর ইচ্ছে সে ইঞ্জিনিয়ার হবে। তাও আবার বুয়েটের। কেন? আমি বুয়েটিয়ান বলে? বালিকাদের কোন আচরণই সিরিয়াসলি নিতে নেই। যদিও তাদের আচরণে একটা অবিনাশী প্লব্যতা থাকে।

    একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। বাসায় কেউ নেই। কাজের বুয়া ছাড়া। আমি বুঝতে পারিনি। শৈলী সেদিন অন্যরকম উচ্ছল। পড়াতে খেয়াল নেই। যত মনোযোগ আমাতে। বললাম, “তুমি যে এমন করো আমার টিউশনি টা তো চলে যাবে”।
    — যাবে না
    — কেন?
    — বাবা আপনাকে পছন্দ করেন
    — কেন?
    — আমার রেজাল্ট ভাল হচ্ছে। আমি বাবাকে আপনার ব্যাপারে সার্টিফাই করেছি
    — আর তোমার আম্মা?
    — আম্মার কথা ছেড়ে দেন। খালি পাহারা দেয়
    — কেন?
    — এই আপনার সাথে যদি ইয়ে হয়ে যায়
    — সেজন্যই তো বলছি, পড়ায় মন দাও
    — দূর, খালি পড়া আর পড়া। ভাল্লাগেনা।
    বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় শৈলীকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলেছিলাম যদি রেজাল্ট ভাল হয় তাহলে ট্রিট দেবো। এ কথা শুনে পারলে সে লাফ দেয়। তার মা হন্তদন্ত হয়ে আসে। আমি লজ্জায় হতভম্ব হয়ে পড়ি। শৈলীই সে যাত্রা সামলে নেয়। সেদিনের সেই নেহায়েত উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলা কথার কথা আজ আর ফিরিয়ে নিতে পারলাম না।

    সেলিমের খোঁজ এখনো মেলেনি। মলির মানসিক অবস্থা খুব খারাপ। বাসায় কোন প্রাণ নেই। যা আছে তা গোরস্থানের শুন শান নিরবতা। এখানে থেকে আমার করার কিছু নেই। মামারা খোঁজ খবর করছেন। যে নিজে থেকে নিরুদ্দেশ থাকে তাকে খুঁজে বের করা খুব সহজ না।

    পড়ন্ত বিকেল। অফিসে বসে আছি । ভাবছি অনেক কিছু। এলোমেলো। জীবন বৈচিত্র্যময় জানি। তাই বলে এত বৈচিত্র্যের প্রয়োজন আছে কি? দুঃখ না থাকলে সুখ কি জিনিস তার গুরুত্ব বুঝা যেত না, সেটা ঠিক। তাই বলে অতলান্ত দুঃখের খুব বেশি প্রয়োজন আছে কি? হঠাৎই ভুত দেখার মত চমকে উঠি। টেবিলের সামনে ব্যাগ হাতে উসকোখুসকো চেহারা নিয়ে মাথা নিচু করে সেলিম দাঁড়িয়ে আছে। ভুত দেখছি না তো? সেলিমই ধপাস করে চেয়ারে বসে বিলাপের সুরে নিম্নস্বরে বললো, “ভাইজান, পৃথিবীতে আমার আর যাওয়ার জায়গা নাই। মাটির নীচে ছাড়া”। আমি নিখোঁজ ব্যাক্তির সন্ধান প্রাপ্তির আনন্দে, অবিমৃষ্যকারী এক ব্যাক্তির প্রতি দারুণ ক্রোধে ও ছোট হয়ে আসা পৃথিবীর একজন সেলিমের স্বীকারোক্তিসহ নিঃশর্ত আত্মসমর্পনের মায়া মায়া মুখের দিকে চেয়ে নির্বাক থাকলাম কিছুক্ষণ। পৃথিবীর বৈচিত্র্য নিয়ে ভাবছিলাম অনেক কিছু। এর চূড়ান্ত প্রমাণ আমার সামনে এ মুহুর্তে হাজির। বললাম, “খাওয়া-দাওয়া হয়েছে কিছু”? মাথা নীচু করে নিরুত্তর থাকলো। বুঝলাম হয়নি। বাসায় নিয়ে এলাম। বাবুর্চিকে পাঠালাম খাবার আনতে। বোনকে চমকে দেওয়ার উত্তাপে ফোন দিলাম। আম্মা ধরে বললো, “সকাল থেকে ওর শরীর খারাপ। প্রেসার খুবই লো। শরীর দুর্বল। খাওয়া-দাওয়া নাই। আবোলতাবোল বকছে। ডাক্তার ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। ঘুমুচ্ছে”। আম্মাকে সেলিমের কথা বললাম। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেলিমের উপর নতুন করে মায়ার বদলে ক্রোধ বাড়তে লাগলো। বৈচিত্র্যের রঙ বোধহয় ক্ষণে ক্ষণে এভাবেই বদলায়।

    চলবে…

  • একটি খোলা চিঠি (পর্ব-১)

    একটি খোলা চিঠি (পর্ব-১)

    (পাঠিয়েছিলাম আমার ভালোবাসার মানুষটিকে এক বছর আগে একটি খোলা চিঠি। তার ঠিকানা আমার জানা ছিলো না,’এফবি’কে দিয়েছি পৌঁছে দেয়ার জন্য। “এফবি”খুঁজে না পেয়ে আজ ফেরত দিয়ে বলেছে আরেকবার পাঠিয়ে দাও চিঠি তোমার বন্ধুকে। তাই ইচ্ছেকে সাথে রেখে আরেকবার পাঠিয়ে দিলাম)

    (অনেক দিন ধরে ভেবেছি আমার প্রিয় বন্ধুটিকে চিঠি লিখে দেবো, বলে রাখবো কিছু না বলা কথা। এখন তো ডাকযোগে তেমন চিঠি চলাচল করেনা তাই খোলা চিঠি লিখে ছেড়ে দেয়ার ইচ্ছে, হয়তো কোনো একদিন, কোনো একসময় তার কাছে পৌঁছে যাবে। ইচ্ছে করলে পাঠক আপনারা কিছু উত্তর লিখে দিতে পারেন।’বন্ধু’ আমার ভাবনার মানুষ )

    “প্রিয়বরেষু বন্ধু আমার”,
    কেমন আছো জানিনা,যদিও জানার ইচ্ছেগুলো এখন তেমনভাবে নাড়া দেয়না।তবুও কেনো হঠাৎই তোমার অস্তিত্ব, তোমার স্মৃতি বারবার জানার ইচ্ছে জাগিয়ে তোলে কেমন আছো তুমি? কোথায় কিভাবে, খুব সুখে, অসুখে, খুব যত্নে, অযত্নে, খুব ভালো, মন্দে।

    মাঝে মাঝে নিজের কাছে প্রশ্ন রাখি, আমাদের মধ্যে কী কোনো কাতর অনুনয়, কোনো বোধ, কোনো সুখ জাগানিয়া, বুকের নিতল গভীরে কোনো চিনচিন ব্যাথা,দীর্ঘশ্বাসের স্পর্শ অনুভব ছিলো? ছিলো কী পাওয়ার তীব্র দহন,ভালোবাসার ভুল বুঝাবুঝির খুনসুটি।

    হয়তো সবই ছিলো, তা নাহলে এতো সময় গড়িয়ে যাওয়ার পর তোমাকে লিখতে ইচ্ছে হলো কেনো?

    তোমাকে জানার, পাওয়ার আকুল প্রচন্ডতা কেনো বলো।

    আজকাল ভাবনারা বড্ড এলোমেলো হয়ে গেছে আমার। তোমার কথা মনে হলে বেসামাল হয়ে যায় ইচ্ছের তাবৎ ঘরদোর,বিছানাপত্র,গৃহস্থালি।

    জানালাগুলো খুলেই রাখি সকাল দুপুর, বিকেল, রাত অব্দি।কখনো নিজেই বন্ধ হয়ে যায়। পর্দাগুলো টানটান হয়ে থাকে।

    বন্ধু আমার, আজ লিখতে ইচ্ছে করে তোমার কিছু ফেলে রাখা স্মৃতির চাদরে জড়িয়ে কিছু অনুপম মুগ্ধতার, সুখময় চমৎকার ভালোবাসার প্রিয় কথা।

    সেদিন ছিলো পূর্ণ জোছনার জোয়ার, থৈ থৈ আলোর জল। তুমি দেখিয়েছিলে তোমার চোখে আমাকে আলোর স্নানের পূর্ণতা,ভাসতে শিখিয়েছিলে ঝিলিমিলি তারার আকাশে। রেখেছিলে পুরো বিশ্বাস গোপন সমর্পণে। আমার শ্বাস, চোখ,স্পর্শ,গুছিয়ে নিয়ে দেখিয়েছো অপার স্বপ্নের জলের ভাসান। বলেছো ভয় কী আমিই তো তোমার ইচ্ছের ঈশ্বর।

    সকালের স্নিগ্ধ আলোয় দেখেছি তুমি রহস্যময় একটি অলৌকিক মায়ার বাগানে হেঁটে যাচ্ছো নক্ষত্রের সহস্র রুপোলী মেঘের পাটাতনে। হিম বরফে ডুবে যেতে থাকে আমার শরীর,বরফে আগুন জ্বেলে উষ্ণতা নিতে থাকি। আমি ক্লান্ত, বিষাদগ্রস্থ, আমি পেতে চাই তোমার আবাহন। চিৎকার করে ডেকে বলি প্রিয়তম মানুষ আমার তুমি ফিরে এসো,ফিরে এসো তোমার ভালোবাসার নির্সগে।তুমি অহংকারী ফিরিয়ে দিয়েছো আমাকে। আমার সমূহ আকুলতা, অপেক্ষা,তছনছ করে প্রত্যাখ্যান করেছো।

    তারপর–গড়িয়ে গিয়েছে ঢের সময় হয়নি দেখা তোমার সাথে আমার,হয়নি কোনো বুঝাবুঝি, ভুলে গেছি লেনদেনের হিসেব নিকেশ।জলের সমুদ্রে ভেসে ভেসে অপেক্ষা করেছি অযুত,নিযুত, সহস্র কোটি দ্রাঘিমা।
    আমি ঘর থেকে বেঘর হতে থাকি,ভুলে যেতে থাকি পুজোর সকল মন্ত্র।কষ্টগুলো আগুনের ফুল হতে
    থাকে নিঃশব্দে ডুকরে কেঁদে যায়, আমি আমার আমাকে দাহ করি। শ্বাসে -প্রশ্বাসে শুধু তোমাকে
    চাই। ঘুমে,স্বপ্নে,জেগে,শ্বাসে,প্রশ্বাসে রাখি পাওয়ার প্রণয় আবহে,আকাঙ্ক্ষার নির্মোহ,নির্লোভ আকুতিতে।

    সুজন বন্ধু আমার, এখন সময়গুলো কারুশিল্পের মতো বুকের জমিনে কেটে কেটে বসিয়ে দেয় নানান ছাপ।কখনো চকিতে শুনি তোমার ডাক, বিস্ময়ে ফিরে দেখি তোমার মোহন আলোময় তোলপাড় করা সম্মোহনী দুটো চোখ। আমি ছুটতে থাকি তোমার চোখে চোখ রেখে মুগ্ধ হতে। হয়না আমার পাওয়া, তুমি বড্ড কৃপণ,দাপুটে অহংকারে ফিরিয়ে দাও আমার আমাকে।আমি পলে পলে মরে যাই তোমার অপেক্ষার প্রহর গুনে গুনে।

    আমি তোমাকে পেতে চাই বন্ধু আমার, তোমাকে পেতে চাই,সহস্রবার মরে মরে শুধু তোমাকেই পেতে চাই।
    আজ লেখার এখানেই ইতি টানছি প্রিয়তম বন্ধু আমার। ফেরত চিঠির অপেক্ষায় থাকি, থেকো ভালোবাসায় বন্ধু।

    চলবে…