Tag: গল্প

  • ফিরে আসার পর (পর্ব-১)

    ফিরে আসার পর (পর্ব-১)

    পুকুরের এ পাশটায় পাকা ঘাটের পাশে একটা পাকা বেঞ্চ আছে। শাহেদ সেই কখন থেকে এখানেই বসে আছে। জানালার পাট বন্ধ, তবু ফাঁক গলে আলোর রেখাগুলো বের হয়ে আসছে। কাঠের জানালাগুলো কি আগের মতই আছে নাকি আরও ভেঙে গেছে!

    শাহেদ আনমনে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে ওপাশটা যদি দেখা যেত! কী করছে মিথি এখন?

    হঠাৎ করে এত বছর পর শাহেদকে দেখে তার মনের ভাব কী হতে পারে? সে-কি দূর দূর করে তাড়িয়ে দেবে নাকি কাছে টেনে নেবে? কিছুই জানা নেই তার। অনিশ্চয়তার দোলাচলে তার সময়টা যাচ্ছে।
    খুব ইচ্ছে হচ্ছে বাড়িটা দরজার গিয়ে কড়া নাড়তে। কিন্তু কি এক অদৃশ্য অনুভূতি তাকে আটকে রাখছে পাকা বেঞ্চটির উপর। রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে, ক্লান্ত অবসন্ন মন একটু বিশ্রাম চায়,কিন্তু!!
    পাকা বেঞ্চটি বেশ চওড়া অনায়াসে শোয়া যায়। সাথে থাকা নিত্য ব্যবহার্য কিছু কাপড় ভর্তি ব্যাগটি মাথার নিচে দিয়ে শাহেদ সটান লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ে বেঞ্চটিতে।

    দীর্ঘ জার্নি শেষে অবসাদে ঘুম আসার কথা, কিন্তু ঘুম আসছে না,কোন মুখ নিয়ে সে দাঁড়াবে মিথির সামনে!

    আজ বার বার মনে পড়ছে বিশ বছর আগের কথা।

    শাহেদ তখন সদ্য ভার্সিটি পাশ করে বের হওয়া টগবগে যুবক। এতটা মেধাবী না হলেও মোটামুটি মেধাবী সে ছিল, ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র, কাজেই একটা ভাল সরকারি চাকরির আশায় প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে।

    শাহেদের বাবা টেনেটুনে সচ্ছল, কাজেই ছেলেকে এতদূর পড়াতে তার বেশ বেগ পেতে হয়েছে। তাছাড়া উনার আরও সন্তানাদি রয়েছে, তারাও পড়ছে, কাজেই তার সমস্ত আশা ভরসা ওই শাহেদ। শাহেদের বাবার বন্ধুর ছয় মেয়ে। পাঁচ মেয়েকে ভাল পরিবারেই পাত্রস্থ করেছেন, যেহেতু ছেলে নেই কাজেই ছোট মেয়েকে বিয়ে দিয়ে নিজেদের কাছেই রাখার ইচ্ছে। কাজেই বন্ধুর কাছেই মনের কথা পাড়লেন।

    শাহেদের বাবা প্রথমত ইতস্তত করলেও পরে ছেলের ভবিষ্যৎ ভেবে রাজি হয়ে যান, কারণ বন্ধুর মেয়ের সাথে সম্পত্তি লাভের একটা সুস্পষ্ট ইংগিত তিনি দেখতে পেয়েছিলেন। কাজেই শাহেদের ঘোর অনিচ্ছাসত্তেও বাবার মতের বিরুদ্ধে যাবার সাহস হয় নি,মিথির সাথেই শাহেদের বিয়ে হয়ে গেল।

    শাহেদের বাবার বুদ্ধি বেশ পাকাই ছিল। বিয়ের আগে মিথির বাবা নিজের বাড়িটা ছোট মেয়েকে লিখে দেবেন বলেছিলেন তবে সেটা ভবিষ্যতে। কারণ পুত্রহীন মিথির বাবা-মাকে দেখার দায়িত্ব যে শাহেদকেই নিতে হবে।

    শাহেদের বাবার বায়না ছিল বাড়ি এবং আর যা কিছু আছে তা বিয়ের আগেই লিখে দিতে হবে। যেহেতু মিথির আরও বোন আছে কাজেই অনেক দেন-দরবার শেষে মিথির বাবা বাড়িটা মিথি ও শাহেদের নামে লিখে দিলেন,তবে পূর্ণ মালিকানা পাবে তারা কেবল মিথির বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর।

    বিয়ের পর শাহেদ শ্বশুরবাড়ি উঠে এল অনিচ্ছাসত্ত্বেও।

    মেয়ে হিসেবে মিথি মন্দ নয়, যদিও অন্য বোনদের তুলনায় সে তেমন সুন্দরী নয়। কিন্তু শাহেদ কেন যেন মিথিকে মন থেকে মেনে নিতে পারে না। শাহেদের মন পড়ে থাকে অন্য কোথাও, মিথি বুঝতে পারে। স্বামী স্ত্রীর সব সম্পর্ক বজায় রাখলেও মিথি শত চেষ্টা করেও শাহেদের মন ছুঁতে পারে না যেন। কাছাকাছি থাকা আর একে অন্যকে বুঝতে পারা এক নয়। স্বাভাবিক নারী হৃদয় দিয়ে মিথি কিছু একটার অভাব বুঝতে পারে, কিন্তু কী সেটা তা বুঝতে পারে না।

    শাহেদ দিনরাত বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকে। তার জগৎ আলাদা। একটা চাকরি, ভাল চাকরি তাকে পেতেই হবে। বাহ্যিক দিক থেকে শ্বশুরবাড়ির সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চললেও কেবল মিথির ব্যপারে তার চরম নিঃস্পৃহতা মিথিকে ব্যকুল করে দেয় সময় সময়। প্রাণপনে স্বামীর মন পেতে চেষ্টা চালিয়ে যায় মিথি।

    মিথির একতরফা আকুলতা শাহেদের বিরক্তিকর মনে হয়। তা প্রকাশ করতে এতটুকু দ্বিধা বোধ তার নেই।কেবল শরীরের প্রয়োজন ছাড়া আর কোনও চাহিদায় মিথিকে যেন কাছে টানতে নেই। মিথি তবু আশায় বুক বেধে রাখে, হয়ত একদিন সে শাহেদের মন জয় করতে পারবে।

    খাবার টেবিলে মিথির বাবা শাহেদকে তার ব্যবসা দেখার অনুরোধ করলেন। মিথির বাবা মা দুজনেই অসুস্থ, হার্টের রোগী। এমতাবস্থায় শাহেদের হাতে সবকিছুর ভার দিতে পারলে তিনি যেন কিছুটা নিশ্চিন্ত হন। ব্যবসাটা তেমন বড় নয়, মার্কেটে দুটো কাপড়ের দোকান আছে, ভাল চলছে, শাহেদ কেবল একটু দেখাশোনা করবে।

    “বাবা,আমার এসব ব্যবসা পছন্দ নয়, আমি চাকরি করব। এত লেখাপড়া করে ব্যবসা করব, এ আমার পছন্দ নয়”।

    শাহেদ প্লেটের খাবার দ্রুত শেষ করে রুমে চলে যায়।

    মিথিও পিছু পিছু আসে। “তুমি বাবার কথা রাজি হলেও তো পারতে”– মিথি মৃদু গলায় অনুযোগের সুরে বলে।

    শাহেদ রাগত চোখে মিথির দিকে তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে যায়। দু’দিন ধরে শাহেদের খবর নেই।
    তার গ্রামের বাড়ি, আগের মেসবাড়ি সবখানেই খবর নেয়া হল, কোথাও যায়নি সে।

    দু’দিন পর বাড়ি ফিরল শাহেদ। দুশ্চিন্তায় মিথির কেমন দিন কাটল তা মিথিই জানে কেবল, আর সাথে বাবা-মাও। মিথি শাহেদের কাছে জানতে চায় কোথায় ছিল সে।

    জবাব শাহেদের রাগত উত্তর
    “তোমার কি মনে হয় আমাকে কিনে নিয়েছ তোমরা? আমার যখন যেখানে খুশি যাব, তোমার ইচ্ছে হলে তুমিও যেও”। সটান বিছানায় শাহেদ, একবারও জানতে চাইল না মিথি কেমন আছে।

    মিথির শরীরটা ভাল যায় না, বিয়ের মাসখানেক পরই সে কনসিভ করে। শাহেদের তাতে কোনও মাথা ব্যথা নেই। বরং রাতে যখন তার ঘুম আসে না, যখন তখন বমি আসতে থাকে মহাবিরক্ত হয়ে শাহেদ তাকে অন্য রুমে চলে যেতে বলে। তার ঘুমের নয়তো লেখাপড়ার ব্যঘাত হয়।

    চোখের জল মুছতে মুছতে মিথি অন্য রুমে চলে যায়, কিন্তু শাহেদের এই নিষ্ঠুরতার কথা সে কাউকেই বলতে পারে না।

    চলবে…

  • বিচার

    বিচার

    কাশেমের বাবা যখন যুদ্ধে যায় তখন কাশেমের মা চারমাসের গর্ভবতী। আষাঢ় মাস প্রচন্ড বৃষ্টির রাত
    চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মধ্যে গর্ভবতী স্ত্রী আর বৃদ্ধ বাবা মা বোনেদের রেখে হাশেম মিয়া গ্রামের কয়েক জন যুবকের সাথে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে ঘর থেকে অজানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।

    হাশেমের পিতা ছিলেন কিশোর গঞ্জের প্রত্যান্ত অঞ্চলের কোনো এক গ্রামের মসজিদের ইমাম। চারিদিকে হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত কর্মকাণ্ড দেখে তিনি নিজেই তার একমাত্র ছেলে কে যুদ্ধে পাঠিয়ে দেন। আর সুন্দরী বউমা আর নিজের কন্যা দের নিরাপত্তার জন্য হাওড়ের দিকে তার এক বন্ধুর বাড়ি পাঠিয়ে দেন।

    কিছুদিনের মধ্যে হাশেমের যুদ্ধে যাবার কথা জানাজানি হয়ে গেলে রাজাকার বাহিনী এসে তার ইমাম বাবাকে মেরে ফেলে এবং ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।তার মা কোনো রকমে পালিয়ে বাঁচে।

    যুদ্ধ শেষ হবার আগেই অসম্ভব রূপবতী ফুলজান বেগম একটা সুন্দর পুত্র সন্তান এর জন্ম দেয়।জন্মের পর সেই সন্তান না বাবাকে না দাদাকে দেখতে পায়।একদিন যুদ্ধ শেষ হয়।তারা গ্রামে ফিরে আসে।গ্রামের লোকজন এর সহযোগিতায় পোড়া ঘরবাড়ি কোনো রকম ঠিক ঠাক করে বাস করতে থাকে। আর অপেক্ষা করে হাশেম মিয়ার ফিরে আসার।কিন্তু হায়, অনেকে ই ফিরে আস কিন্তু ফুলজানের হাশেম আর ফিরে আসে না।

    শ্বশুর ও নেই স্বামী ও নেই। এমতাবস্থায় শাশুড়ী অসম্ভব রূপবতী যুবতী বউকে রাখতে না চাইলে ফুলজান বাবার বাড়ি চলে আসে।সেখানে ও অভাব। ছোটো ছোটো ভাই বোন এ ভরা সংসারে সে আর তারছেলে বোঝার উপর শাকের আঁটি হয়ে গেলে বাবা আবার তার বিয়ে দিতে চাইল।ফুলজান রাজি হয় কি করে। তার স্বামী যদি কোনো দিন ফিরে আসে তখন কি হবে তার। তাই সে অন্য কথা ভাবতে চায় না।

    একসময় সে গ্রামের জরিনা খালার সাথে শহরে চলে আসে।ময়মনসিংহ শহরে এক ওসির বাসায়। বছর কয়েক থাকার পর ওদের সাথে দেশের বিভিন্ন জাগায় যায়। একসময় ওসি সাহেব রিটায়ার্ড করে বরিশালে নিজের দেশের বাড়ি চলে যান।ততদিনে বিশ বছর কেটে গেছে। বেতন ও বখশিশের টাকা জমা করে আর কিছু লোন নিয়ে ফুলজান বিবি কাশেম কে একটা রিক্সা কিনে দিয়েছে। দেশের বাড়ি গিয়ে ননদের মেয়ের সাথে সখ করে ছেলে র বিয়ে দিয়ে রেখে এসেছে। কাশেম মিয়া বাপের ভিটায় থেকে রিক্সা চালিয়ে সংসার চালায়।ফুল জান বিবি ঢাকায় সাহেব দের বাসায় থেকে যা আয় করে তা দিয়ে তার চলে যায়। বেতনের টাকা জমায় ছেলে র ভবিষ্যতের জন্য।

    বিভিন্ন বাসায় কাজ করে চলে ফুলজান বিবি ।ভালো লাগলে দুএক বছর থাকে। ভালো না লাগলে দু ছ’মাস থাকে। এভাবে এখন যে বাসায় আছে এখানে প্রায় দুইতিন বছর হয়ে গেছে। সাহেব অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা! অতি সজ্জন সুহৃদয় ব্যাক্তি। খালাম্মা ও খুব ভালো। তাদের একছেলে এক মেয়ে।মেয়ে ডাক্তার হাসবেন্ড এর সাথে অস্ট্রেলিয়ায় থাকে।সে নিজেও ডাক্তার। খুবই ভালো। প্রথমে তার ই বাচ্চা কে দেখভাল করার জন্য কাশেম এর মা কে দুই মাসের জন্য রাখা হয়েছিল। এনাদের ব্যবহার এ মুগ্ধ হয়ে সাহেবের মেয়ে নাতি চলে যাবার পরেও সে পার্মানেন্টলি এবাসায় থেকে যায়।

    খালুর একমাত্র ছেলে বউ এবাড়িতেই থাকে।উপরের তলায় তাদের আলাদা সংসার। ছেলে প্রাইভেট চাকরি করে আর বউ ইঞ্জিনিয়ার।সমাজ সেবা ও করেন। নিজের অফিস আছে। এহেন উচ্চশিক্ষিত বউ বড়োই বদমেজাজি।নিজেরা প্রেম করে বিয়ে করেছে।প্রথমে বাবা মা রাজি না থাকলেও পরে বাধ্য হয়ে আশ্রয় দিয়েছেন নিজ বাড়িতে। কিন্তু বউমার ঔদ্ধত্য পূর্ণ আচরণে তারা সর্বদা ভীত-সন্ত্রস্ত থাকেন।

    বিশেষ করে কাজের লোকেরা। মালি থেকে দারোয়ান সবাই। ছোটো ছোটো কাজের মেয়েদের তো অত্যাচারের উপর রাখে।

    বউমা’টি প্রেগন্যান্ট। শ্বশুর শাশুড়ী অস্ট্রেলিয়ায় মেয়ের কাছে বেড়াতে গেছে। মেয়ের ডাক্তারি কি একটা পরীক্ষা তাই মেয়ের বাচ্চা সামলাতেই তাদের ওখানে যাওয়া।বউমা এর ডেলিভারির আগেই তারা চলে আসবেন। আর কাশেমের মা মুরুব্বি তো আছে ই।তাছাড়া তারা যতদিন না আসেন ততদিনের জন্য বউমা র মাকেও এনে রেখে গেছেন।

    সময় টা এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে।সেদিন শুক্রবার দিন ছিলো দেশের থেকে খালাম্মার বোন আর বোন জামাই তাদের ছেলে আরমান কে নিয়ে ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে এসেছে। ভাইয়া বাজার থেকে বিশাল এক মাছ নিয়ে এসেছে। খুব মজা করে রান্না করা হয়েছে,মুরগী ও অন্যান্য তরকারি ও আছে। মেহমানের প্লেটে মাছ দিতে গিয়ে কাশেমের মা এর হাত ফস্কে মাছ টা সহ চামচ টা হাত থেকে পড়ে যায়। লজ্জা ও ভয়ে কাশেমের মা হাসি মুখে দোষ স্বীকার করে জায়গাটা পরিস্কার করতে যাই, ঠিক তখুনি সাহেবের ছেলের অন্তঃসত্ত্বা বউটি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় এবং ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে। গালিগালাজ এর মধ্যে একসময় তাকে বলে লাথি দিয়ে তিন তলার থেকে নিচে ফেলে দিবে। বাড়ির মেহমানের সামনে নিজের কন্যাসম একজনের কাছে এইধরনের অপমানজনক কথা শুনে কাশেমের মা সহ মেহমানরা সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। টেবিল ভর্তি খাবার পড়ে থাকে কারোর আর সে খাবার মুখে ওঠে না।কাশেমের মা লজ্জায় দৌঁড়ে রান্না ঘরে পালিয়ে বাঁচে মেহমানরা বিভিন্ন বাহানা বানিয়ে উঠে চলে যায়।

    বিকেলে ডাক্তার দেখাতে গিয়ে মেহমানরা একেবারে বাইরে থেকে খেয়েই আসেন।সে রাতে তারা তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। মাঝরাতে শুনতে পায় কাশেমের মা এর কান্না মিশ্রিত বিলাপ! ঘুম ভেংগে যায়। সারারাত কাশেমের মা বিলাপ করে করে আল্লাহর কাছে বিচার দেয়।আল্লাহ যেন এর একটা বিচার করেন। উচিৎ বিচার।

    একজন নিখোঁজ মুক্তি যোদ্ধার বউ হিসেবে এতোদিন সবাই তাকে যথেষ্ট সন্মান দিয়ে এসেছে। এমন কি এবাড়ির খালাম্মা খালুজান ও তাকে যথেষ্ট সন্মান করেন।তাই এখনো এখানে থাকা। কিন্তু আজকের পরে আর সম্ভব নয়। এখানে এভাবে থাকা র চেয়ে ভিক্ষা চেয়ে খাওয়া ও ভালো। খালাম্মা খালুজান আসলে এতো কথা সে বলতে পারবে না, আর এতোদিন থাকাও সম্ভব নয়। তাই সে একটা সিদ্ধান্ত নেয়।

    সকালে উঠে কেউ আর কাশেমের মা কে খুঁজে পায়না। এর বিশ বাইশ দিন পরে জরুরি ভিত্তি তে বাড়ির কর্তা গিন্নীকে দেশে ফিরে আসতে হয়। কেননা হঠাৎ করেই সময়ের আগেই বউমাটিকে হসপিটালে নেয়া হয়। সেখানে সিজারিয়ান এর মাধ্যমে বধুটি একটি বিকলাঙ্গ মৃত সন্তান জন্ম দেয়।

    ফাতেমা হোসেন
    ৯ই মার্চ, ২০২২ইং

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২০)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২০)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (২০)
    কেবলমাত্র অসুস্থ হলেই সবার জীবনবোধ জাগ্রত হয়। মনে হয় দুনিয়াবি জীবন খেল তামাশা মাত্র। যে ঔজ্জ্বল্যের মোহে আমরা প্রাণান্তকর দৌড়ঝাঁপ করি দিন শেষে তা অধরাই থেকে যায়। দৌড়ের মাইল পোস্টটা কেবল সামনে সরে যায়। পৃথিবীর সকল সুস্থ মানুষকেই মনে হয় সবচেয়ে ভাগ্যবান। আর নিজেকে জীবন যুদ্ধে পরাস্ত সৈনিক বলে মনে হয়। ইমাম সাহেবের কথা খুব বেশি মনে পড়ছে। এক বয়ানে তিনি বলেছিলেন সুস্থতা যেমন আল্লাহর নিয়ামত তেমনি অসুস্থতাও। সুস্থতা মহান আল্লাহর নিয়ামত এটা সহজবোধ্য। তাই বলে অসুস্থতাও? তিনি ব্যাখ্যা করলেন। অসুস্থ হলে আমরা সুস্থতার মজা উপলব্ধি করতে পারি। অসুস্থ হলে আমরা সৃষ্টিকর্তাকে যেমন প্রতি পদে পদে স্মরণ করে থাকি তেমনি তাঁর কাছে উপুর্যুপরি মিনতিও করে থাকি। যে যতটুকু পারি এবাদত-বন্দেগীতে, তাওবা-এস্তেগফারে মশগুল হয়ে পড়ি। অথচ সুস্থ থাকলে, এত গভীরভাবে কোনদিনই আমল করা হয়ে উঠেনা। সত্যিই তো! অসুস্থতাও তো একপ্রকার নিয়ামত। আর অসুস্থ হলেই মানুষ নানাবিধ বিষয় নিয়ে সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে। চারপাশের অতি আপনজনের ছোট খাটো বিষয়গুলোও তখন প্রকট হয়ে দেখা দেয়।

    ঢাকায় যাওয়া বিশেষ জরুরি হয়ে পড়েছে। নিউরো ডাক্তারের ফলো আপ ভিজিটের আগেই কাউন্সেলিং করা দরকার। তৌহিদের কল্যাণে তার পরিচিত দুরসম্পর্কীয় আত্মীয় সায়ক্রিয়াট্রিস্টের কাছে বুকিং দেওয়া হয়েছে। মোট ছয় সেশন দিতে হবে। প্রগ্রেস ভালো হলে চারেই শেষ হতে পারে। প্রথম দিন ব্রিফিং এন্ড ইনফরমেশন কালেক্টিং। প্রতিদিন এক দেড় ঘন্টার সেশন। এ ধরণের কাউন্সেলিং এর কথা শুনেছি। কিন্তু নিকটজন কেউ করেছে শুনিনি। না শুনলেও, কেন জানি নেগেটিভ একটা ইমপ্রেশন মননে-মগজে ছায়াপাত করে আছে। এরা নাকি ম্যাসমারিজম জানে। নীলাভ আলোতে বসিয়ে কি-সব বলে কয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়। তারপর রুগী আপন মনে তার ভেতরগত ব্যাথার অকথিত কাহিনী গড়গড় করে বলে যায়। সায়ক্রিট্রিস্ট তার নিজের উত্তর পাওয়ার জন্য নিজেও কিছু প্রশ্ন করে সেগুলো বের করে আনে। এগুলো রহস্যোপন্যাস বা গল্প-কাহিনী, সিনেমা ইত্যাদি দেখে-শুনে জেনেছি। প্রথম দিন তৌহিদকে নিয়েই সায়ক্রিয়াট্রিস্টের চেম্বারে গেলাম। চেম্বারের সামনে কয়েকজন বসা। সবাই চুপচাপ। তবে তাদের চোখের নড়াচড়া পাগল পাগল টাইপের মনে হলো। ভয় ঢুকে গেলো মনে। কাউকে কাউকে পায়চারি করতেও দেখলাম। মনে হয় ভেতরে প্রবল স্যুনামী হচ্ছে। কাউকে দেখলাম আত্মীয় স্বজনরা ঘিড়ে ধরে বসে আছে। আমার কেমন যেন ভয় ভয় করছে। তৌহিদ সাথে থাকায় কিছুটা ভরসা পাচ্ছি। কতক্ষণ পর আমার ডাক এলো। রুমে ঢুকলাম। সাদা এপ্রোন পড়া একজন এসে আমার চৌদ্দ গুষ্ঠির কুষ্ঠি টুকে নিয়ে গেল। রুমে আমি একা। আলো কম। এসির বাতাস যথেষ্ট বলে মনে হলো না। কিছুক্ষণ পর সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এলেন। ডিটেক্টিভ টাইপের প্রশ্ন করা শুরু করলেন। আমার কাছে তাকেই উদ্ভ্রান্তের মত মনে হলো। মধ্যবয়সী। মুখে হাসির বালাই নেই। চোখ পানসে। কথা বলেন আর হাতের কলম কিছুক্ষণ পর পর নাকে ঠেকান। হয়ত এটা তার বদ অভ্যেস। আমাকে কেন কাউন্সেলিংয়ের জন্য প্রেসক্রাইব করা হয়েছে আমি জানিনা। আমি তো পাগল না। মাথার বিষয়টা আগের চেয়ে অনেক ইমপ্রুভ করেছে। মনে মনে ধরেই নিয়েছি উনি আমার ভেতরের কথা বের করে মাথার ব্যামোর উৎস খুঁজবেন। আমি নার্ভ টান টান করে তার মুখোমুখি বসা। তিনি শুরু করলেন, “কিছু বলুন”।
    — কি বলবো? ডেসপারেট ভঙ্গিতে আমার উত্তর।
    — যা মনে চায়
    — মন জানতে চাচ্ছে, আমাকে এখানে কেন রেফার করা হয়েছে?
    — যিনি রেফার করেছেন উনাকে জিজ্ঞেস করেন নি?
    — প্রফেসররা রোগীর কথা শুনে না
    — গুড। তো বলুন কি জানতে চান?
    — মনোরোগ নিয়ে বলুন।
    — পরিসংখ্যান অনুসারে পৃথিবীতে প্রতি চারজনের একজন মানুষই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত।
    — তাহলে এতে উদ্বেগের কি আছে?
    — কিছু অদ্ভুত, রহস্যময় আর বিরল মানসিক রোগ আছে পৃথিবীতে, যেগুলোর কথা আমাদের বেশিরভাগ মানুষেরই অজানা।
    — ভেরি ইন্টারেস্টিং।
    — এই যেমন ধরুন ফিলোফোবিয়া। যারা প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে বা ভালোবাসার মানুষের কাছে প্রতারণার শিকার হয়ে জীবনে আর কখনোই প্রেমের সম্পর্কে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আবার এমনও কিছু মানুষ আছে, যারা এরকম কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন না হয়েও কখনোই প্রেম করতে চায় না। প্রেম সংক্রান্ত এই ভীতি কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। এটি একটি রোগ। পৃথিবীতে প্রায় প্রতি দু’শ মানুষে একজন এই রোগে আক্রান্ত।
    — আমি এই ক্যাটাগরিতে পড়িনা। বরং আমার প্রেম রোগ আছে মনে হয়। আমি তার কথার মধ্যেই উত্তর দিলাম।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট নিরুত্তাপ ভাব নিয়ে আমাকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করছেন। আমি এখন পর্যন্ত শক্ত অবস্থানেই আছি। কাগজের টোকা দেখে শান্ত কন্ঠে বললেন, “আপনি বলতে চাচ্ছেন আপনি প্রেমিক পুরুষ”? “ঠিক সেরকম না” আমার ঝটপট উত্তর। তিনি হাতের কলম নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “কেন আপনার এমন মনে হয়”?
    — জানিনা
    — কি করেন?
    — চাকরি
    — কতদিন হলো?
    — দুই
    — দুই মানে কি?
    — বছর
    — পড়াশোনা?
    — ইঞ্জিনিয়ারিং
    — কোথায়?
    — বুয়েট।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট পানসে চোখ খানিকটা বড় করে তাকালেন। তারপর হাতের কলম আবার নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “ গুড। প্রেম করেছেন”?
    — জানিনা
    — জানেন না কেন?
    — কনফিউজড
    — ক্যান ইউ এক্সপ্লেইন ফারদার? বিশেষ কাউকে পছন্দ আছে? মুখ ফুটে তাকে বলতে পারছেন না?
    — আছে
    — তিনি কি করেন? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড
    — ম্যারিড।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এবার নড়েচড়ে বসলেন। হাতের কলম নাকের ডগায় ঠেকিয়ে বললেন, “পরকীয়া”?
    — ডোন্ট নো।
    — বিয়ে করে ফেলুন
    — প্রবলেম আছে
    — যেমন?
    — ডোন্ট হেভ এনি কানেকশন রাইট নাউ
    — কেন?
    — আই থিংক ইটস এ ডেড ইস্যু রাইট নাউ। লিভ ইট।
    সায়ক্রিয়াট্রিস্ট এখনো বরফ শীতল। কিছু কিছু নোট নিচ্ছেন। আর হাতের কলম নাকের ডগায় ঘন ঘন ঠেকাচ্ছেন। তাকে আরো অনুসন্ধিচ্ছু মনে হলো। বললেন, “লিভ ইট। লেট’স প্রগ্রেস। মানসিক দুরাবস্থার অন্য অবস্থাগুলো হচ্ছে প্যারিস সিনড্রোম, এরোটোম্যানিয়া, ক্লেপটোম্যানিয়া, অ্যাপটেমনোফিলিয়া,পেডোফিলিয়া, নেক্রোফিলিয়া—-

    আমার মাথা আর কাজ করছে না। শরীর অবশ হয়ে আসছে। যখন হুঁশ হলো তখন দেখি সেই নিরামিষ সায়ক্রিয়াট্রিস্ট নেই। সিস্টার টাইপের একজন বললেন, “আপনি এখন আসতে পারেন। আপনার নেক্সট সেশন-ডেট কার্ডে লেখা আছে”। বের হয়ে দেখি তৌহিদ বসা। এগিয়ে এসে বললো, “এতক্ষণ কি করলো”? বললাম, “জানিনা । তবে এখন অনেকটাই হাল্কা বোধ করছি”। এভাবে চারদিন সেই সায়ক্রিয়াট্রিস্টের মুখোমুখি হলাম। শেষ দিন সেশন শেষে কিছুটা হেসে বললেন, “ইয়াং ম্যান। বিলিভ ইন ইওরসেলফ। সুন্দরীদের ভালো লাগবেই। পুরুষের সহজাত বৈশিষ্ট্যই এটি। নাথিং রঙ ইন ইট। ডু হোয়াটেভার ইউ ওয়ান্ট টু ডু। বাট ইউ পজেস সাম পিকিউলারিটিজ অলসো। ভেরি সিমিলিয়ার টু সো মেনি। বাই দা ওয়ে হু ইজ সাবরিনা”? আমি চমকে উঠলাম। সাবরিনার কথা এলো কিভাবে? বললাম, “হাও কাম ইউ নো হার”? তিনি হাসলেন। সে হাসিতে অনুসন্ধিচ্ছা নেই, নেই উদ্বিগ্নতা। আছে উদ্ঘাটনের আনন্দ। বললেন, “গেট ম্যারিড সুন এন্ড বি হ্যাপী। ডোন্ট বোদার হোয়াট আদার্স উইল সে”।
    মনটা যেন আজ পিওর অক্সিজেনে ওয়াশ করা হয়েছে। মাথা সুন্দর কাজ করছে। শরীরে ক্লান্তি নেই। তৌহিদকে বললাম, “ব্যাটা সায়ক্রিয়াট্রিস্ট খাসা চীজ। চাঙ্গা করে দিয়েছে। ফিলিং ড্যাম বেটার”। তৌহিদ হাসলো। বললো, “বাসায় চলো। খালাম্মার সাথে আলাপ আছে। তোমার বিয়ে জরুরি”। “কাকে? সাবরিনাকে”? মুখ ফসকে বেরিয়ে এলো। তৌহিদ আশ্চর্য হয়ে বললো, “কাকে মানে? এতদিন জানতাম জেমি আর শৈলী। আর এখন সাবরিনা এলো কোত্থেকে”? আমি চট করে বাধা দিয়ে বললাম, “লিভ ইট। ফিলিং আনইজি নাও”। তৌহিদকে আর বাসা পর্যন্ত নিয়ে এলাম না। কি থেকে কি বলে পরিস্থিতি আরো সংকটাপন্ন করে তুলবে কে জানে?

    খাবার টেবিলে আম্মাকে খুব খুশি খুশি লাগছে। মলির ইডিডি দিন-দশেক এর মধ্যেই। হয়ত সে কারণেই নানী হওয়ার আনন্দে। হঠাৎই বলে বসলো, “সাবরিনা টা কে”? আমি যেন আকাশ থেকে পড়েছি। পরক্ষণেই বললাম, “কেন, কি হয়েছে”? আম্মা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “বল না”? সেলিম সামনে থেকে সরে গেলো। মলি এসে যোগ দিলো। আমার বুঝতে বাকি নেই যে বাসায় ইত্যবসরে সাবরিনা বিষয়ে গবেষণা হয়ে গেছে। তৌহিদই সেলিমকে বলে দিয়েছে। পরিস্থিতি নরমাল করার জন্য বললাম, “মামার অফিসে চাকরি করে”। বুঝতে পারলাম আম্মার আশার টিউব লাইট জ্বলে উঠেছে। বললো, “কথা হয় ওর সাথে”? উত্তরে বললাম, “হাই- হ্যালো হয়েছে। তাও মামার অফিসেই”। “তোর পছন্দ হয়েছে”? আম্মার স্ট্রেট ড্রাইভ। আমি ব্যাকফুটে গিয়ে বললাম, “যে কারোরই পছন্দ হবে”। আম্মা কি বুঝলো কে জানে? কথা এখানেই শেষ। মলি খুশি। সেলিম দরোজার পাশ থেকে সরে ভেতরে চলে গেলো। জানি আম্মা এখনই ছোট মামাকে ফোন দেবে। আমি রুমে গিয়ে কাপড়চোপড় গুছাতে লাগলাম। কাল ভোরে খাগড়াছড়ি যেতে হবে।

    চলবে…

  • শিরোনামহীন শিরোনাম

    শিরোনামহীন শিরোনাম

    গতকাল সন্ধ্যায় রাজবাটি বাজারে সুন্দরী এক মহিলাকে কামারের দোকানে অর্ডার দেয়া ছুরি নিতে দেখলাম ; সাথে বডিগার্ড হিসেবে আরেক মধ্যবয়সী মহিলাও আছেন ৷ যাহোক, ভদ্রমহিলা অল্পবিস্তর পরিচিত হওয়ায় ছুরি কেনার কারণ জানতে চাইলে উনি সাংসারিক বিবিধ কাজের কথা তুলে ধরলেন ৷ বিষয়টির এখানেই একটি সুন্দর সমাপ্তি ঘটে যাচ্ছিল এবং আমি যথারীতি প্রতিদিনের হাঁটাহাঁটি শুরু করতেই পেছনে চিৎকার চেঁচামেচিতে ফিরে দেখি ওনার হাসবেন্ড ছুরি দিতে বিক্রেতাকে নিষেধ করছেন আর ভদ্রমহিলা সমানে তার স্বামীকে ধাক্কাচ্ছেন – ৷ এতক্ষণে কৌতুহলী জনতা প্রায় চারিদিক ঘিরে ধরে উপভোগ্য দৃশ্যটি উপভোগ করতে লাগলেন- ৷ অনেক শোরগোলের মাঝে এটুকু বুঝা গেল যে, ছুরিটা পারিবারিকভাবে নিরাপদ নয় মোটেই এবং ছুরির ভয়ে বেচারা ভদ্রলোক প্রতিদিন বেশ ঝুঁকি নিয়েই বসবাস করছেন- ৷

    নানানজনের নানান কথায় লোকজনের ভিড় জমে গেল- ৷ মুরুব্বী শ্রেণীর দুয়েকজন বিষয়টির সুরাহা করতে আপাততঃ ছুরিটা দোকানদারকেই রেখে দিতে বললেন- ৷ কিন্তু স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া এবং কথা কাটাকাটিতে জানা গেলো উভয়েই দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিয়ের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ ৷ ভদ্রমহিলাকে জানতাম কিন্তু এটা যে ওনার দ্বিতীয় বা তৃতীয় স্বামী তা জানতাম না – ৷ আর স্বামীটি স্ত্রী পরিত্যাক্ত একজন ডিড-রাইটার ৷ এনারা উভয়েই কবে যে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন এটা আমার জানা ছিলো না – ৷ এসব ওনাদের নিতান্তই পারিবারিক ব্যাপার বলে এড়িয়ে যাওয়া যেত কিন্তু কানাকানি শুনলাম ইতিপূর্বে দু’তিনবার এই ভদ্রমহিলা কর্তৃক কর্তন প্রচেষ্টা হয়েছিল এবং অর্ধকর্তিত বেচারা স্বামীটাকে কয়েকবার হাসপাতালেও যেতে হয়েছিলো ৷ প্রতিবেশিদের হস্তক্ষেপে বিষয়গুলো আর যাহোক আদালত পর্যন্ত গড়ায়নি- ৷

    আমার নিয়মিত হাঁটাহাঁটি আর হলোই না ৷ কেমন যেন একটা অবসাদ আতঙ্কে শরীর ও মন হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল – ৷ মনে পড়লো আমার বাসাতেও নতুন-পুরনো মিলে বেশ কয়েকটি ছুরি তো আছেই ৷ এরমধ্যে জঙধরা আছে দুটি ৷ বিভৎস একটা ভাবনায় কুঁকড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা আমার-৷ পারিবারিক ঝামেলা কার না সংসারে থাকে -! তা বলে কর্তন জাতীয় মানসিকতা -! মাঝেমাঝেই খবরে এসব দূরদূরান্তে ঘটে বলে জানা যায় এবং আমরা তাচ্ছিল্য ভেবে উড়িয়েও দিই ৷ কিন্তু এসব ঘটনা এখন যে পাড়া-পড়শীদের মাঝে এসে গেছে ; আরতো হালকা করে দেখবার সুযোগ নেই – ৷ কী এ্যাক্টা অবস্থা, ভাবা যায়-!

    আমরা নিয়মিত কিছু আড্ডাবাজ মানুষ যেমন সাদেকুল ভাই, ইদ্রিস সাহেব, প্রেমহরি বাবু প্রমুখ চায়ের দোকানে বসে এবংবিধ বিষয়াবলি নিয়ে আলোচনায় ব্যতিব্যস্ত তবে এটুকু পরিষ্কার উপলব্ধি হলো সকলেই পারিবারিকভাবে নিজেদেরকে যথারীতি অনিরাপদ ভাবছেন তাই আলোচনা অন্যান্য দিনের মতো জমজমাট আর হলো না -৷ সাধারণতঃ এসবক্ষেত্রে নিজস্ব সম্বলটুকুর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয় এবং অজান্তেই নিজের কম্পিত হস্তদ্বয় তাকে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখতে মরিয়া হয়ে ওঠে-৷
    তথাপি মানুষ ভালো থাকুক ; দম্পতিরা ভালোবাসার মাঝেই থাকুন এমনই প্রত্যাশা করি – ৷

    বাসব রায়

  • সীমাবদ্ধতায় নারী

    সীমাবদ্ধতায় নারী

    একজন নারী। পাঁচ ছয় বছর বয়স পর্যন্ত অনেক আদরের। যখন আট নয় এ পা দিল মা বলল, এভাবে দাঁড়াবেনা

    এভাবে হাঁটবে না। ওভাবে কথা বলবে না। এভাবে খাবে, ওভাবে নয়। যদি সে জানতে চায়, কেন? মা বলতো, তুমি মেয়ে মানুষ। তোমাকে জীবনের অনেক কঠিন কঠিন সময় পার করতে হবে। সবাইকে খুশী রাখতে হবে। সে বলে, কেন মা? তাহলে আমি কিভাবে খুশী থাকবো? মা বলেন, তুমি মেয়ে মানুষ। নিজের খুশীর কথা চিন্তা করা মেয়ে মানুষের কাজ নয়। সে বলতো কেন মা? মা বলতেন তোমার বিয়ে হবে৷ একদিন পরের বাড়ী যেতে হবে। সবাইকে তোমার খুশী রাখতে হবে। সবাইকে খুশী রাখতে পারলে তুমিও খুশী থাকবে। আর এটাই মেয়েদের জীবন।

    সে ভাবতো আরেকটু বড় হয়ে নেই। বিয়ের পরে হয়তো আমি সবাইকে খুশী করে ফেলবো। নিজের একটা সংসার হবে। বাহঃ কি মজা৷ তার বিয়ে হবে৷ স্বামী হবে তার বন্ধু। আর বন্ধু থাকবে মানেইতো মজা। দুজন মিলে সিনেমা দেখবো শপিং… ইশশশ কি মজা। কত স্বপ্ন, কত্ত কত স্বপ্ন।

    সময় এলো। বিয়ে হল। মা শিখিয়েছেন, খুশী রাখতে। চেষ্টায় নেমে পড়লো সে… দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়। দেখে এতো আরও কঠিন জীবন! কেউ খুশী হয় না বা হলেও তা কেউ বলে না৷ আর তাই সেও খুশী নেই। এখন তো স্বামী, শশুর, শাশুড়ী, ননদ, ভাশুর আরও কত সম্পর্কে জড়িয়ে গেল সে। সবার খুশীর খেয়াল রাখতে হয় তাকে৷ সে তখন ভাবে, সবার খুশীর মাঝে আমার খুশী বুঝি একেবারেই তুচ্ছ। এখন তার মনে প্রশ্ন… খুশী? হুমহ্… সে আবার কি?

    মায়ের শিক্ষা অনুযায়ী সম্ভ্রাম্ত পরিবারের মেয়েরা সংসারকে টিকিয়ে রাখতে শিখে।

    তাই তখন তাকে নিজের শুধু খুশী নয়,
    হাসি মুখে দুঃখকেও বরণ করে নিতে হয়।

    তার মা তাকে শিখিয়ে দেয় তোমার কোন কষ্ট হলেও তুমি কাউকে তা বুঝতে দিও না৷ কোন ভাবেই সংসার ভাঙা যাবে না৷ নিজের মাকে দেখে সে মা হবার স্বপ্নও দেখতো৷ মা হতে গিয়ে যে কত কষ্ট তা ও সে দেখেছে৷ আর তাই মায়ের কথা মত তখন চলে তার শুধু টিকে থাকার লড়াই।

    কারন হয়তো ততদিনে সে মা হয়ে গেছে। পিছে রেখে এসেছে, তার স্বজন। পরিবারের চাপে তাকে মেনে নিতে হয় সব অন্যায় শাসন। পিছে ফিরে তাকানোর কোন পথ নেই। নেই কোন সময়। বাবার বাড়ী থেকে নিয়ে এসেছে যেন বড় একটা দায়িত্বের বোঝা। সে দায়িত্ব পালন করতে হবে পুংখানু পুংখ ভাবে। কারোর মনে কষ্ট দেয়া যাবে না। নিজে কষ্ট পেলেও কোন ভাবে কারোর মনে আঘাত দেয়ার কোন সুযোগ নেই। এটা তার মায়ের শিক্ষা।

    আস্তে আস্তে পরিবার বড় হতে চলল।
    ভারী হতে লাগল তার দায়িত্বের বোঝাটি। কোন আদর ভালবাসা পাওয়ার চিন্তাও তখন সে আর করতে পারেনা। এখন তাকে বেঁচে থাকতে হবে। তার স্বামী আর সন্তানদের জন্য। চলে শুধু বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই।

    সে নারী
    মেয়ে থেকে বৌ, বৌ থেকে আরও কত কি সম্পর্কে জড়িয়ে তারপর মা। আবার আশায় বুক বাঁধে। সন্তান বড় হয়ে তাকে তেমন করে ভালবাসবে। যেমন করে সে তার সন্তানকে ভালবেসে আঁকড়ে রেখেছে।
    রাতের পর রাত না ঘুমিয়ে তাকে আদরে আদরে ঘুম পাড়িয়েছে। তার অসুস্থতায় রাতের পর রাত জেগে সেবা করেছে, যেমনটি শিখেছে সে তার মাকে দেখে৷ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কত আদরে যত্নে নিজ হাতে সন্তানদের বড় করেছে।

    এখন বড় হয়েছে সন্তান। মায়ের দায়িত্ব পালনে কোন রকম ত্রুটি না রাখা মা.. সে নারী হয়ে ভাবে এবার বুঝি কেউ তাকে ভালবাসবে। তার চাওয়া গুলো আর ইচ্ছা অনিচ্ছা গুলো বুঝবে। মা অসুস্থ্য হলে সন্তানরা অস্থির হয়ে যাবে, যেমন করে সে নিজে তার মায়ের জন্য অস্থির হয়ে যেতো৷ যেমন করে সে তার মায়ের সেবা করতো, তারা তেমন করে সেবা করবে ডাঃ এর কাছে ছুটোছুটি করবে। কিন্তু নিয়তির নির্মম পরিহাস, যুগ পালটে গেছে৷ আর তাই হয়তো তার সে স্বপ্নও ধূলিস্বাৎ হয়ে যায়। তার জীবনে সেই সুন্দর সময়টি আর আসে না৷

    নারীর দ্বায়িত্বের কোন শেষ নেই৷
    আর তাই তাঁকে আবার আরেকটা দায়িত্বে পড়ে যেতে হয়…
    যা হয়তো আবারও অন্য কারোর
    চাপিয়ে দেয়া দায়িত্ব…
    শত দায়িত্ব পালন করলেও তাকে বার বার পরিবরের কাছে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়৷ তা সবার কথায় বা কাজে তারা প্রমাণ করে দেয়… এমনকি কখনো তারা ভাবে এই নারীতো কোন কিছুই করেনি, করেছে সারাজীবন শুধুই রান্না বা ঘরের কাজ। আর এটাইতো নারীদেরই কাজ৷ তারা ভাবে শুধু কিছু টাকা ব্যয় করলেইতো এসব সুবিধা গুলো পাওয়া যেতে পারতো। আরও কত কি। আবার সে নারী যদি কর্মজীবিও হয়, তবুও সব ঘরের দায়িত্ব থেকে শুরু করে সন্তানদের লালন পালন সবই শুধু তাকেই পালন করতে হয়৷ তবুও সে নারী তার মায়ের উত্তম শিক্ষার সন্মান রেখে নিজের শত ব্যাথা ভুলে গিয়ে আবারও খুশী রাখার কাজে লেগে পড়ে। ততদিনে অবশ্য তা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে যায়৷

    তারপর সে নারী আবার আরেকটা নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। তখন এ সম্পর্কটা তার কাছে জীবনের সব চাইতে দামী সম্পর্ক হয়ে যায়। সন্তানদের সন্তান। আর এ সম্পর্কের কাছে সে নারীর কোনই চাহিদা থাকেনা। সে শুধু বেঁচে থাকতে চায়। সে সম্পর্ককে ভালবাসা দিয়ে আগলে ধরে রাখবার জন্য। তখন সে নারী তার সে ভালবাসা দেবার জন্য পেছনের শত কষ্টকেও বুকে পাথর চাপা দিয়ে দেয়। সে শুধু অপেক্ষায় থাকে কখন সেই মুখ গুলো তার সামনে পাবে। তাদের ছুঁয়ে দেখবে। প্রাণ ভরে আদর ভালবাসা দেবে।

    আচ্ছা…
    কেউ কি কখনো জানতে চেয়েছে?
    হে নারী তুমি এজীবনে কি কি পেয়েছো?
    আর কি কি হারিয়েছো?
    কেউকি জানতে চেয়েছে, এতটা বছর পার করেছো কিভাবে?
    তোমার জীবন গল্পটা কি হে নারী?
    জেনে কি হবে???
    সে একজন নারী, তার আবার কি জীবন গল্প?
    তার আবার এত ভালবাসা পাবার কি আছে?
    তার আবার নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছের কি আছে?
    না… না কেউ জানতে চায় নি৷
    চাইবেও না৷
    সে শুধুমাত্র একজন নারী।
    তার ভালোবাসা পাবার কোনই প্রয়োজন নেই৷
    অনেক প্রতিভা আছে।
    কিন্তু বিকাশে বাধ্যবাধকতা আছে বা
    নেই প্রকাশের সুযোগ।
    কখনো তার স্বামীর বাঁধা, কখনো তার শশুর কূলের, কখনো সন্তানদের,
    কখনো সমাজের…
    তার ভালো লাগা আর ইচ্ছে গুলো শুধু অন্যের ভাল লাগার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে যায়। তার নিজস্ব কোন সত্বা ইচ্ছে বা পরিচিতি থাকতে নেই।
    আর কি প্রয়োজন আছে বলার???
    কেন? কিসের অপরাধে?
    কেউ কি বলতে পারবে?
    যে নারী সয়ে গেছে সব জ্বালা
    সব ব্যাথা, সে কি শুধু নীরবে
    সবার আড়ালে চোখের অশ্রু মোছন করবে???
    এ কেমন সমাজ?
    এ কেমন ত্যাগ?
    কেউকি বলতে পারবে???
    এর শেষ কবে হবে???

    হ্যাঁ, যুগের অনেক পরিবর্তন হয়েছে৷ তবে সব নারী না হলেও বেশীর ভাগ নারীই অকোপটে কিছু না কিছু অন্যায়ের সন্মূখীন হয়েছে বা হচ্ছে৷ আর তাই হয়তো নারী দিবস বলে একটা দিন ধার্য্য হয়েছে৷ তবে এ দিবসের কারণে সেইসব নারীদের জীবনে কোন পরিবর্তন না আসলেও ভবিষ্যৎ প্রযন্ম হয়তো নারীদের কিছুটা হলেও সন্মান দিতে শিখছে বা শিখবে।

    পৃথিবীর সব নারীদের উৎসর্গ করলাম আমার এ লিখাটি৷

    ৩১শে অক্টোবর ২০২০
    রাত ২:৩০

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৪৪)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৪৪)

    জাহিদ কলিকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে বাসায় ফিরছে, রাহেলা বেগম ঘরবাড়ি ঠিকঠাক মতো পরিষ্কার করছেন। নাহিদ মাকে সাহায্য করছে। আগামীকাল কলিকে দেখতে আসবে ছেলেপক্ষ।

    রাহেলা বেগম নাহিদ কে বললেন, এই নাহিদ সাঈদের বাসায় কলিকে দেখালে কেমন হয়?
    – অত্যন্ত খারাপ হয়।
    – তুই এইভাবে কথা বলিস কেন?
    – মা, কলিপাকে এইখানে এই অবস্থায় দেখে নিলেই ভালো। সারাজীবন তো আর ভাইজানের বাসায় নিয়ে যেতে পারবেনা।
    – আমার ভয় হয়, যদি আবার এই বিয়েটাও ভেঙে যায়।
    – এতো দুঃচিন্তা কেন কর!
    – আমার মেয়ে, তাই চিন্তা ও বেশি। মেয়ের মায়ের চিন্তা ছাড়া উপায় আছে!
    – যত্তসব উল্টা-পাল্টা চিন্তা।

    কলি আর সাঈদ বাসায় আসতে আসতে ঘড়িতে প্রায় ছয়টা বেজে গেল। ক্লান্তিতে দুজনের মুখ কালো হয়ে গিয়েছে।

    রাহেলা বেগম লেবুর শরবত দিয়ে বললেন, মুখ হাত ধুয়ে এসে, শরবত টা খেয়ে নে তোরা! জাহিদ কে বার বার বললাম, দেরী করিস না, তবুও দুই দিন দেরী করে গেলি, এখন মেয়েটার চেহারা কালো হয়ে আছে।
    – মা, আমি স্কুলে গিয়ে ছুটি নিয়ে তবে গেলাম, এরকম কি যাওয়া যায়? বিনা ছুটিতে? আর আজ রেস্ট নিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।

    নাহিদ বললো কি রে কলিপা কোথায় কোথায় ঘুরেছিস বল? কক্সবাজারে গিয়েছিস নাকি?

    কলি জাহিদের দিকে তাকিয়ে আছে, জাহিদ পলির বাসার কথা সব জেনেছে কলির মুখে।

    জাহিদ বললো ও ওর দুলাভাই নিয়ে ঘুরেছে, তুই কলির জামাই নিয়ে ঘুরবি। এখন কালকের কি কি বাজার লাগবে, লিখে নে। দুইভাই গিয়ে নিয়ে আসি।
    – তুমি রেস্ট নাও, আমি নিয়ে আসি।
    – একটু অপেক্ষা কর, আমি সাথে যাবো, ভাইজান কে বলতে হবে।
    – তুমি ভাইজান কে বলতে যাও, আমি বাজারে যাই।

    রাহেলা বললেন নাহিদ যে কেন এমন করে বুঝিনা বাবা। কি যে জেদি হচ্ছে দিন দিন।
    – ও দুঃখ পেয়েছে বেশি, তাই এমন করে। ছোট মানুষ।

    কলি দুপুরের পর থেকে সেই ছেলের ছবি মাথায় নিয়ে বসে আছে। দেখতে ভীষণ স্মার্ট ছেলেটি। বিয়ে হলে খারাপ হবেনা অবশ্য! আজ কি পছন্দ করবে? নাকি আজ ও চলে যাবে।

    বিকাল চারটার দিকে, রুমি খালা ছেলেপক্ষ নিয়ে এলেন, তিনি এসে তাদের কে ছোট রুমে রেখে, ভিতরে গেলেন।

    রাহেলা বেগম নাশতা রেডি করে রেখেছেন, তিনি সব একে একে নিয়ে গেলেন। নাহিদ ও সাহায্য করছে, এবং সার্ভ করে দিচ্ছে।

    নাহিদ এক ফাঁকে এসে বললো আপারে, তুই আফ্রিকান দের বাড়ী যাচ্ছিস।
    – মোটেও না, ছেলে আমি দেখেছি ফর্সা সুন্দর।
    – এখানে সব কালো মামুষ এসেছে।
    – তাহলে ছেলে আজ আসেনি। কনফার্ম।

    রুমি রান্নাঘরে এসে বললেন আপা শোনো, আমি তোমাদের না জানিয়ে নিয়ে এসেছি। এই ছেলে আগের ছেলে পক্ষ না। আগে যারা এসেছিল তারা না করে দিয়েছে, কলি তাদের নিয়ে আসায়।
    – আগে বললি না কেন?
    – তুমি মন খারাপ করবে তাই। যাই হউক এই ছেলে জগন্নাথ থেকে এম.এ করেছে। সিটি করপকরপোরেশনে চাকরি করে। ভালো চাকরি, দুই ভাই। ছোট জন ও চাকরি করে, দুই বোন বিবাহিত। শুধু সমস্যা একটা।
    – আবার কি সমস্যা?
    – ছেলে একটু কালো। কিন্তু ছেলে ভালো। আমি চাই আপা, তুমি য্রন মত দাও।
    – আচ্ছা দেখি আগে।

    কলিকে রুমে নেওয়ার আগে, রুমি এক মিনিটে শুধু বললেন এই ছেলে, আগের জন নয়। আর শুধু চেহারা দেখবিনা, মন দেখবি।

    কলি রুমে গিয়ে দেখে সবাই কুচকুচে কালো। রুমি পরিচয় করিয়ে দিলেন, এই পাত্র জুয়েল খান।

    কলি এক ঝটকায় দেখেই মাথা ঘুরিয়ে গিয়েছে। ছিপছিপে কালো চেহারা, মাথায় চুল কম, লাল একটা পাঞ্জাবী গায়ে দিয়ে এসেছে। কেমন যেন হ য ব র ল লাগছে। এই ছেলে? কেমনে বিয়ে করবে,মতকে আল্লাহ বাঁচাও।

    রাহেলা বেগমের ছেলে পছন্দ হয়নি, কালো সমস্যা না, কিন্তু এতো হেংলা ছেলে,বয়স এবং এই পরিবারের কালো।

    কিছুক্ষণ কথা বলার পর, ছেলের ফুপু বললেন, আলহামদুলিল্লাহ আমাদের মেয়ে পছন্দ হয়েছে, যদি সম্ভব হয়, আজ রাতেই কাবিন করে ফেলতে চাই। পরে, মাস দুয়েক পরে অনুষ্ঠান!

    রাহেলা বেগমের একদম ভালো লাগেনি, কলি কি ভাবছে কে জানে, সাঈদের ফোনে কল যাচ্ছেনা। সাঈদ আসলে সহজেই সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন। কলি কি রাজী হবে? আর এতো অল্প সময়ে কি করবেন, কিছুই বুঝতে পারছেন না তিনি। সব জেনে মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে….

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৯)
    সাবরিনার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, বলা চলে পালিয়ে এসে পড়লাম আরেক বিপদে। রাজউকের কাগজপত্র ফেলে এসেছি তার টেবিলে। আসার সময় উঠতে গিয়ে টেবিলের সাথে হোচট খাওয়াতেই এই বিভ্রাট হয়েছে। অনেকটা পথ যাওয়ার পর মামা ফোন করে জানালেন। বললেন নিয়ে যেতে। আমি মরে গেলেও যাবো না। সাবরিনার কাছে আজ আচ্ছামত নাকাল হয়েছি। প্রেস্টিজ পাংচার যা হওয়ার হয়েছে। এবার গেলে টায়ার টিউবও যাবে। মামাকে বললাম অনেক দূর চলে এসেছি। প্রচন্ড জ্যাম। তার কাছেই যেন রেখে দেয়।

    এবার ঢাকায় এসে দারুণ অস্বস্তিতে কাটছে। বাসার পরিবেশ থমথমে। সবাই আমার সাথে ডিফেন্সিভ খেলছে। আগ বাড়িয়ে কেউ কিছু বলেনা। মনে হলো দুই শূন্য ভোটে আমার বিরুদ্ধে সাধারণ পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব পাশ হয়ে গেছে। এখন স্বল্প পরিসরে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। হয়ত নিকট ভবিষ্যতে আরো বড় আকারে নিষেধাজ্ঞা আসবে। আমার ভোটাধিকার নেই। সেলিম কৌশলগত কারণে ভোটদানে বিরত। তার সাথেই টুক টাক কথা হয়। তবে তারও গা ছাড়া গা ছাড়া ভাব দেখলাম। রাতে খাবার টেবিলে আম্মাকে পেলাম। কাছে গিয়ে বসলাম। আম্মা উঠে গেলো। যাওয়ার সময় বলে গেলো, “টেবিলে সব দেওয়া আছে”। আমি পথ আগলে বললাম, “এরকম করছো কেন? কি হয়েছে খুলে বলো”। আম্মা চোখ বড় বড় করে তাকালো। বহুদিন এভাবে তাকায় নি। বুঝলাম তার মেজাজ সপ্তমে। বললাম, “তোমরা যা ভাবছো ব্যাপারটা আসলে ওরকম না”। “তাহলে কি রকম”? আম্মার পাল্টা প্রশ্ন। এ সময় সাঁড়াশি আক্রমণের অভিপ্রায়ে মলি রুম থেকে বের হয়ে এলো। সেও এই বিতর্কে যোগ দেবে আমি নিশ্চিত। বললাম, “কাল সকালে আলাপ করা যাবে”।

    মাথার অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ডাক্তার দেখাতে ভয় হয়। রাজ্যের আজেবাজে চিন্তা আসে। ব্রেণ টিউমার হয়নি তো? নিজেই শিউরে উঠলাম। এত অস্থিরতা নিয়ে পৃথিবীতে আর কেউ আছে কিনা জানিনা। হেসে খেলে জীবনটা তো ভালোই কাটছিলো। আম্মার ঘ্যানরঘ্যানরের কারণে বাধ্য হয়ে টিউশনি নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম টিউশনি করবো আর মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীতে ট্রাই করবো। সেই টিউশনি করতে গিয়েই পড়েছি বিপদে। ইলমাকে পড়াতে গিয়ে জেমিতে আটকে গেছি। ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি কোন বিবাহিতার সাথে এভাবে জড়িয়ে যাবো। শৈলীকে পড়াতে গিয়ে কক্ষণো তার উড়ুউড়ু মনের সাথে তাল মিলাইনি। এখন তার সরব, নিরব নড়াচড়া দোলা দিয়ে যায়। মাল্টিন্যাশনালে চাকরির ইচ্ছে থাকলেও হুট করেই ইন্টারন্যাশনালে হয়ে গেলো। মাঝখান দিয়ে সেলিমের সাপলুডু খেলায় সবাই উপুর্যুপরি পেরেশান আর নাস্তানাবুদ হয়েছি। থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাচারিও হয়েছে। অন্যদিকে সুখের খবরও হয়েছে। মলি এখন সন্তান সম্ভবা।

    জামান ভাই সেই মডেল কন্যাকে নিয়ে আর কোন কথা বলেন নি। মনে হয় তার চয়েস আছে বা অন্য কোন এক্সপেক্টেশন আছে। আমারও আর ঢাকায় বদলীর খবর হয়নি। জামান ভাই এখন বিদেশে। ইউ এন ডিপি ডেলিগেশনের সাথে। ছোট মামা প্রমোশন পেয়ে আগারগাঁও অফিসে বদলী হয়েছেন। সাবরিনার সাথে দেখা হওয়ার চ্যাপ্টার ক্লোজ। তবু মাঝে মাঝে তার উচ্ছ্বল স্মৃতিতে মুগ্ধ না হয়ে পারিনা। সবার চাপে আর নিজের শারিরীক অবস্থার কারণে ডাক্তারের স্মরণাপন্ন হতে হয়েছে। হাজারো টেস্ট। এম আর আই পর্যন্ত করতে হয়েছে। একগাদা ওষুধ দিয়েছে। মুড়ির মত তা তিন বেলা ভাগ করে খাই। বেশির ভাগই যে নার্ভ রিলাক্সেসন সংক্রান্ত বুঝি। সারাক্ষণ তন্দ্রালু ভাব লেগেই আছে। প্রথমে মেডিসিনের ডাক্তার দেখিয়েছি। এক পর্যায়ে তিনি নিউরোকে রেফার করলেন। তার কথা বার্তা, হাব ভাব দেখে শুনে গা ছম্ ছম্ করে উঠে। যতটা না মুখে বলেন তার চেয়ে বেশি চোখে মুখে চিন্তার রেখা ফুটিয়ে তুলেন। অফিস থেকে লম্বা ছুটি নিয়েছি। বলা চলে নিতে বাধ্য হয়েছি। দিনে দিনে ওয়েট লস হচ্ছে। এম আর আই রিপোর্ট খারাপ না। তবে বাসার কেউই স্পষ্ট করে কিছু বলেনা। মাঝে মধ্যে মুখ ঠেলে বমি আসে। মাথাটা সারাক্ষণ ঝিম্ ঝিম্ করতেই থাকে। কখনো কখনো চিন্ চিন্ করে। আর কানে অনবরত ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ লেগেই আছে।

    আম্মার চোখ ভেজা থাকে। ছোট মামার সাথে পরামর্শ করেন। বড় মামা এসে দেখে যান। আর বলেন, “সুস্থ হলে বিয়ে করিয়ে দাও। নাওয়া-খাওয়ার ঠিক নেই। স্থিরতা দরকার”। মামাদের তত্ত্বাবধানে মাল্টিন্যাশনালে সেলিমের একটা চাকরি হয়েছে। যদিও চাকরিতে তার আপত্তি। কিন্তু পিতৃত্বের জোয়াল কাঁধে চাপায় রাজী হয়েছে। মলি খুব খুশি। সাত মাস চলছে। নবাগতের আগমনে আম্মার মুখ জুড়ে সুখের হাসি লেগে আছে। এখন মলির সেবাতেও তাকে সময় দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে আমাকে নিয়েও সারাক্ষণ উৎকন্ঠায় থাকতে হচ্ছে। ওষুধে বেশ কাজ হয়েছে। আগের চেয়ে অনেকটাই স্বস্তি বোধ করছি। মাথার ঝিম্, ঝিম্, চিন্ চিন্ ভাবটা অনেকটাই লাঘব হয়ে এসেছে। কিন্তু কানের ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকটা রয়েই গেছে। চাকরি বাঁচাতে খাগড়াছড়ি যেতে হচ্ছে। সব শুনে জামান ভাই হায়ার লেভেলে আলাপ করে ব্যবস্থা নেবেন বলে আশ্বাস দিলেন। আমার একা একা খাগড়াছড়ি যেতে ভয় করছে। সাথে যাওয়ার কেউ নেই। সেলিম যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু মলির কথা ভেবে আমিই না করেছি। শেষ পর্যন্ত সেলিমের গ্রামের দুঃসম্পর্কের এক কাজিনকে ম্যানেজ করা হলো। এও বা কম কি? ডাক্তারদের অভিমত আমার কাউন্সেলিং জরুরি। নার্ভের উপর বেশ চাপ পড়েছে। গল ব্লাডারের অবস্থাও ভাল না।

    খাগড়াছড়িতে গিয়ে পৌছলাম প্রায় সন্ধ্যায়। মাগরিবের নামাযটা পড়ে চা নাস্তা খাচ্ছি এমন সময় ম্যাসেঞ্জারে টুং করে শব্দ হলো। খুলে দেখি শৈলীর নক। অনেক দিন পর। এক ছেলের সাথে হাস্যোজ্জ্বল কিছু ছবি। কোন ক্যাপশন নেই। বুঝতে কষ্ট হলোনা যে বুয়েটে সে খুব ভালো আছে। উইশ করতে গিয়ে দেখলাম আমি ব্লকড। ভালোই হয়েছে। একে একে নিভিছে দেউটি। চা খেতে গিয়ে আমার প্রেসার হঠাৎ বেড়ে গেলো। সহকর্মীরা ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। টেস্ট রিপোর্ট আর মেডিকেশন দেখে বললেন, “নার্ভাসনেস থেকে এমন হয়েছে। টেনশন থেকে গ্যাস শ্যুট করেছে। ভেতরে অস্থিরতা আছে। স্টেবল হতে সময় নেবে। কোন চাপ নেওয়া যাবে না”।

    এখন আর ফিল্ড ভিজিটে যাই না। অফিসে বসেই রিপোর্ট রিটার্নের কাজ করি। রাত্রি ভীতি পেয়ে বসেছে। সেলিমের কাজিনকে সাথে নিয়ে ঘুমাই। বড় ভালো ছেলে। ইন্টার পর্যন্ত পড়ে আর এগোতে পারেনি। আর্থিক স্বচ্ছলতা ভালো না। ক্ষেত খলা করে খায়। তার নাম হালিম। তার আন্তরিকতার ফিরতি দেওয়া সম্ভব না। জানিনা আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন কিনা? তিনি যেন হালিমের জন্য হালাল রুজির ব্যবস্থা করে দেন। রুজিতে বরকত দান করেন। হালিম এখন আমার জীবন চলার পথে অন্যতম বন্ধুস্থানীয় হয়ে গেছে। জানিনা আমার এই রাত্রি ভীতি, মনের স্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে? আর হালিমই বা ক্ষেত খলা ছেড়ে কতদিন আমার সাথে থাকবে?

    হালিমকে নিয়েই মাগরিব আর এশার নামায মসজিদে গিয়ে পড়ি। হালিম পাক্কা নামাযী। ফজরও মিস নেই। আমি পারিনা। আফসোস হয়। সময় গড়িয়ে যায় আমার বদলীর আদেশ আর হয়না। হেড অফিসের সুপিরিয়র পজিশনে রদবদল হওয়ায় সব ক্ষেত্রে এখন স্থিতাবস্থা নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। জামান ভাই লেগে আছেন। কিছুতেই ব্যাটে বলে হচ্ছেনা। ইমাম সাহেব আমাকে দেখে খুব পেরেশানীতে পড়ে গেলেন। সুরা পড়ে ঝাড়ফুঁক দিলেন। বললেন, “বাবাজী, সারাক্ষণ তাওবা-এস্তেগফার পড়বেন। আল্লাহর কাছে খালেস নিয়তে মাফ চাইবেন। ইন শা আল্লাহ ভালো হয়ে যাবেন”। তাঁর এই কথাতে মনের জোর বেড়ে গেলো অনেক। কানে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ অনেকটাই কমে গেছে। মাথাটাও আগের চেয়ে ভালো মনে হচ্ছে। নিয়ম করে নামায শেষে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসি। নানা কথা শুনি। তাঁকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষদের একজন বলে মনে হয়। হালিমকে ছেড়ে দিতে হবে। বাড়ী থেকে তার ডাক এসেছে। এখন নিজের উপর কিছুটা আস্থা পাচ্ছি। তাকে বিদায় দিয়ে দরোজা খোলা রেখে বাবুর্চিকে বললাম ডাইনিংয়ে এসে শু’তে।

    এখন আর কারো কথা মনে করতে চাই না। শৈলী তার আপন ভুবন বেছে নিয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। সময় ও স্রোত মানুষের মত ভুল করেনা। জেমির কথা চিন্তাতেও আনতে চাইনা। তার প্রতি মায়ার চেয়ে ঘৃণাই বেশি। সাবরিনার কথা মনে হয় মাঝে মাঝে। বিশেষত তার উচ্ছ্বলতা আর সহাস্য বদন ঈর্ষনীয়। আমার মনে হয় স্বাভাবিক জীবনে আর ফিরে আসা সম্ভব হবে না। নিজের উপর আস্থা কমে গেছে। পৃথিবীটাকে বিবর্ণ মনে হয়। কোথাও এতটুকু ছায়া নেই, শীতলতা নেই। সর্বত্র ধুসর-উসর মরুময়তা। কোথাও সতেজ বৃক্ষ নেই, আছে মরু ক্যাকটাস। অবিকল সাবরিনার অফিস চেম্বারে রাখা বনসাই ক্যাকটাসের মত।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৮)
    মন অশান্ত। শান্ত হবে কবে? সারাক্ষণ এই এক চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খায় । একা থাকলে বা রাতের নির্জনতায় এই চিন্তা আরো বেয়ারা হয়ে উঠে। এর সাথে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে বিয়ের উৎপাত। আম্মা ফোন করলেই এক কথা বলে। আমি রেসপন্স করিনা বলে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে আমি এখনো সেই কিউটির মা জেমিকে নিয়েই পড়ে আছি। বিরক্ত হয়ে একদিন বললো, “কোথাকার কোন মেয়ে, কার বৌ দেখে পাগল হয়েছে। আর ঐ মেয়েই বা কেমন অসভ্য। কি জানি বাপু আমি এসব চিন্তাও করতে পারিনা। এই ছিলো আমার কপালে। বুড়োকালে এগুলোও হজম করতে হচ্ছে”? কতক্ষণ চুপ করে থেকে বললো,“শোন্, ঐ মেয়েকে নিয়ে যদি কিছু করিস্ তাহলে আমাদের সাথে তোর আর কোন সম্পর্ক থাকবেনা। মান-ইজ্জত তো সব যেতে বসেছে”। আমি কোন উত্তর দেই না। দেওয়ার মত কিছু নেইও। আম্মা ইদানীং নিজে না করে মলিকে দিয়ে ফোন করায়। মলিও একদিন ধুম্ করে বলে বসলো, “তোমার সেই কিউটির মা’র নম্বর দাও তো”। আমি বিস্ময়ে হতবাক। বললাম, “কেন? কি হয়েছে”?
    — ফোন দেবো। কথা বলবো। প্রয়োজনে বাড়ী বয়ে কথা শুনিয়ে আসবো। মলির ঝাঁঝালো কন্ঠ।
    — হঠাৎ ক্ষ্যাপলি কেন?
    — ডিসগাস্টিং। শুনলেও গা ঘিন্ ঘিন্ করে
    — শুনিস না। আমার উত্তর
    — সেলিম জেনে গেছে।
    — কিভাবে?
    — তোমার সাথে আম্মার ফোন আলাপে। শ্বশুর বাড়ীতে আমার মুখ আর থাকলো না
    — কবে ছিলো? সেলিম যা করেছে উল্টো তাদেরই মুখ থাকার কথা না। তুইও তো কম কাহিনী করে বিয়েটা করিস নি। বলামাত্রই মলি ফোন রেখে দিলো। তার শ্বশুরবাড়ী নিয়ে কিছু বলা যাবে না। সেলিমকে নিয়েও না। জানি বেশ কয়দিন লাগবে এই অবস্থা কাটাতে।

    জেমি সম্মন্ধে আমিও ত্যক্ত। হতাশ। আগের সেই মোহের বিপরীতে ঘৃণা বোধ হচ্ছে আজকাল। বরং শৈলীর প্রজাপতি নৃত্য মাঝেমধ্যে দোলা জাগায়। জানি এটারও ভবিষ্যত নেই। তৌহিদকে খুলে বললাম। হেসে কুটি কুটি হয়ে দম নিয়ে বললো, “তোমার চোখের আর মনের অসুখ হয়েছে। যাকেই দেখো তাকেই ভালো লাগে। এক ধরণের মানসিক বৈকল্যও বলতে পারো। ডাক্তার দেখাও। বলো তো পাত্রী দেখি”। আমি চমকে উঠলাম। সত্যিই তো। মানসিক কিছু সমস্যা নিশ্চয় হচ্ছে। তা না হলে বিবাহিতা জেমি, অসম শৈলী এদেরকে নিয়ে অযথা সময় নষ্ট করছি কেন? জামান ভাইও দেখালেন ডানা কাটা পরী, মডেল। আজকাল মাথা প্রায়ই ঝিম্ঝিম্ করে। প্রথমে ফাঁকা ফাঁকা লাগে। পরে চিন্ চিন্ করে। তারপর ক্লান্তি বোধ হয়। খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকায় বদলীর বিষয়টাও চাপা পড়ে গেছে। দেখতে দেখতে পাহাড়ে দেড় বছরেরও বেশি হয়ে গেলো। দম বন্ধ হয়ে আসছে এখানে। আমার জন্য অতি নির্জনতা যেমন দুর্বিষহ তেমনি অতি মুখরতাও অসহ্যকর। আমি মাঝারি গোছের জীবন যাপনে সিদ্ধ। সুন্দরীদের ভালো লাগে কিন্তু তাদের সাহচার্যে ভয়। স্বভাবে ভীতু ও স্বল্পবাক হলেও সাহসী ও উচ্ছ্বল প্রাণ সুন্দরীদের ভালো লাগে। কিন্তু এ কেমন অদ্ভুত বৈপরীত্য! জামান ভাইকে ফোন দিলাম। বললাম, “ভাই, হাঁপিয়ে উঠেছি। আর কতদিন”?
    — বদলী? আপাতত বন্ধ। ম্যানেজমেন্ট ডিসিশন।
    — আমি তাহলে মরেই যাবো
    — পাগলামী করো না। ঐদিন যে মেয়েটাকে দেখিয়েছিলাম সে ব্যাপারে কিছু বললে না তো
    — ভাই, আমি মাফ চাই। আমার মাথা কাজ করছে না। পারলে এখান থেকে আমাকে নিয়ে যান।
    — পাগলামি করো না। মেয়ের বায়োডাটা পাঠাবো?
    — ভাই, কিছুই বুঝে উঠতে পারছিনা।

    জামান ভাই কি বুঝলেন জানিনা। ফোন রেখে দিলেন। মনে হচ্ছে আরেক দায়বদ্ধতায় জড়িয়ে পড়ছি। জামান ভাইয়ের সাথে সেই মডেল কন্যাকে নিয়ে আগামীতে হয়ত মন কষাকষি হবে। আমার ঢাকার বদলীও ঝুলে যেতে পারে। আমার ভেতরের মনোরোগ আবার চাগা দিয়ে উঠতে চাচ্ছে। মাথা আর নিতে পারছেনা।

    অসময়ে আম্মার ফোন। বাসায় ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট থেকে নোটিশ এসেছে। এবারের রিটার্ন এখনো জমা প্রদান করা হয়নি। ট্যাক্স রিটার্ন হয় আম্মার নামে। আমাদের এক পরিচিত উকিল চাচা আছেন। তিনি প্রতি বছর আম্মার সাথে আলাপ করে রিটার্ন দাখিল করেন। এবার পারিবারিক ঝামেলার কারণে আম্মা খেয়াল করেনি। আর উকিল চাচাও খবর করেন নি। এখন উপায়? উকিল চাচাকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছেনা। ফোন লাগাতার বন্ধ। তিনি বসেন শ্যামলীতে। এমন তো কোনোবার হয়না। করোনার মধ্যে অবশ্য তার সাথে যোগাযোগও হয়নি। উনি বেঁচে আছেন নাকি মারা গেছেন তাও জানিনা। ইনকাম ট্যাক্স দপ্তর সম্মন্ধে সাধারণ ট্যাক্সপেয়িদের দারুণ ভীতি কাজ করে। বেছে বেছে মধ্যবিত্ত শ্রেনীর ফাইল নিয়ে টানাহেঁচড়া করে। অথচ কোটি কোটি টাকা যারা ফাঁকি দেয় তাদের কিছু হয়েছে বলে শুনিনি। হলেও আন্ডার হ্যান্ড ট্রানজেকশনে দফারফা হয়ে যায়। ছোট মামার স্মরণাপন্ন হওয়া ভিন্ন কোন পথ নাই। মামা সার্কেল কমিশনারকে বিস্তারিত বলে একটা টাইম পিটিশনের ব্যবস্থা করেছেন। স্বস্তি পাওয়া গেল। কিন্তু মাথার উপর ঘন্টা ঝুলেই রইলো।

    বহুদিন পর উকিল সাহেবকে পেয়ে ভালোই লাগলো। তবে সাথে নতুন উপদ্রব যোগ হলো। আলাপের শেষে এসে বললেন, “বাবাজী, আপনার অবস্থা কি”? বললাম, “আলহামদুলিল্লাহ”। তিনি আরো পরিষ্কার করে বললেন, “আপনার রিটার্ন দিয়েছেন তো”? আমি আকাশ থেকে পড়লাম, “আমার আবার কিসের রিটার্ন”? উকিল সাহেব বেশ রসিক। এখন অবশ্য করোনার খোঁচা খেয়ে অনেকটা দুর্বল হয়ে গেছেন। বললেন, “চাকরি করলে রিটার্ন দিতে হবে। আর আপনি তো মা শা আল্লাহ ভাল চাকরিই করেন”। বললাম, “অফিস তো সেলারি থেকে ট্যাক্স কেটে রেখেছে”। “খুব ভালো করেছে। এখন সেই কাগজ পত্র দিয়ে আপনার নামে নতুন ফাইল খুলতে হবে”। বুঝলাম কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমারই খেয়াল করা উচিত ছিলো। বললাম, “চাচা, টাকার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি মেইলে কাগজপত্র পাঠাচ্ছি। আপনি ফাইল ওপেন করে রিটার্ন দাখিল করার ব্যবস্থা করেন”। উকিল চাচা টাকার কথা শুনে গদ্ গদ্ হয়ে গেলেন। দেশের মানুষ। আব্বার পরিচিত ছিলো। বিশ্বস্তও।

    মতিঝিলে তৌহিদের অফিস। তাকে নিয়ে রাজউকে যাবো কাজে। ঐ অফিসের কথা শুনলেই আমার আত্মা থেকে থেকে চমকে উঠে। অগনিত লোকের আনাগোনা। কারো কোন উচ্চবাচ্য নেই। কার কি ব্যাথা, কার কত খসলো জানার উপায় নেই। রেফারেন্স নিয়ে কোন কাজে গেছেন তো আপনার পদে পদে বিপদ। এটা নাই, ওটা লাগবে। এভাবে হবেনা। আজ সম্ভব না। কাগজগুলো অস্পষ্ট ফেয়ার কপি দিতে হবে। আর যেই মাত্র দফারফা হয়ে গেল আপনি বুঝবেন সরকারি অফিস কত আন্তরিক। কাজ হচ্ছে ‘ফেল কড়ি ধরো পোয়া’ গতিতে। তৌহিদ পোড় খেতে খেতে এখন সিজনড। সেকশনের পিওন দেখামাত্রই দৌড়ে আসে। ঠান্ডা গরম কি খাবে জিজ্ঞেস করে। তার মাধ্যমেই আমাদের উত্তরা প্লটের রেজিস্ট্রেশন কাজ শুরু হলো। আমাকে সালাম দিয়ে পিওন বললো, “স্যার, নাকে তেল দিয়ে ঘুমান। সব দায়িত্ব আমার। ফোন দিলে এসে কাগজ নিয়ে যাবেন”। শুনেই সুখ লাগলো। পকেট যতই ফাঁকা হোক। সেই তৌহিদকে নিয়ে লালনের কাছে গেলাম। পুরান ঢাকার ইমামগঞ্জে তার অফিস। ইনসিওরেন্স কোম্পানীর এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। কাজও ছিলো। আমাদের পুরোনো গাড়ীটার ইনসিওরেন্স রিনিউ করাতে হবে। বরাবর সে-ই করে দেয়। বললো এখন আর লাগবেনা। বিস্মিত হলাম। বললাম, “পুলিশের ছত্রিশ বাহানার এক বাহানা এই ইনসিওরেন্স পেপার। লাগবেনা মানে”? জানলাম, থার্ড পার্টি ইনসিওরেন্সের এখন আর প্রয়োজন নেই। পুলিশও আর দেখতে চাইবেনা। তার অফিসেই লাঞ্চ হলো। কথা প্রসঙ্গে তৌহিদই প্রসঙ্গটা তুললো। লালন থতমত খেয়ে বললো, “লিভ ইট। যে যাবার সে চলে গেছে। বাট কুডন্ট নো হোয়াই”?। লালনের গার্ল ফ্রেন্ড চার বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে হুট করেই বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়েছে কানাডা প্রবাসী এক জনের সাথে। নিজেকে বাঁচাতে সে কথা ঘুড়িয়ে ফোকাস ফেললো আমার উপর। নাচুনে কাঠি তৌহিদ সরব হয়ে উঠলো। টিপ্পনী কেটে বললো, “উনার দীপিকা পাডুকোন ফেসিনেশন রোগ হয়েছে”। লালন হাসলো। সে হাসিতে তাচ্ছিল্য বা রঙ্গ জাতীয় কিছু বোধ হলো না। যা বুঝলাম তা হলো সবই কপালের লিখন। লালনের ওখান থেকে বের হয়ে তৌহিদ চলে গেলো তার অফিসে। আর আমি উদ্দেশ্যবিহীন হাঁটতে থাকলাম।

    হঠাৎই মামার অফিসের কথা মনে হলো। অফিসে গিয়ে দেখলাম মামা নেই। মফস্বল গেছেন। তাই পিওনও আসেনি। ফিরে যাচ্ছিলাম। করিডোরে সেই উচ্ছ্বল প্রিয়দর্শিনী সাবরিনার সাথে দেখা। লাস্যময়ী সাবরিনা দেখামাত্রই ফোঁড়ন কাটলেন,“মামা নেই জেনেও ভাগ্নে অফিসে যে”? তাইতো। পরশু আলাপকালে মামা বলেছিলেন দু’দিন তিনি চিটাগাং থাকবেন অফিসের কাজে। লজ্জায় আমার মাথা হেট হয়ে গেলো। কোন মন্ত্র বলে কিসের নেশায় কিসের আশায় এলাম বুঝে উঠতে পারলাম না। “স্যরি, ভুলে গেছিলাম। এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। তাই ঢু মারতেই এসেছি”। সাবরিনা চোখ ঈষৎ কুঁচকে বললেন, “তাই নাকি? এদিকে প্রায়ই আসেন নাকি? কই এতদিন তো টের পেলাম না”। আমার সেই ডায়ালগের কথা মনে পরে গেলোঃ হে ধরণী, দ্বিধা হও। পরক্ষণেই মনে হলো ধরণী দু’ভাগ হওয়ার চান্স নেই। আমিই বরং পাংচার হয়ে গেছি। সাবরিনাই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে বললেন, “আসেন। আমার রুমে আসেন। এক কাপ চা বা কফি খেয়ে যান। নাকি এখন আর রুচি নেই”? সত্যি আমার রুচি হাওয়া হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বললাম, “পানি খাবো”। সাবরিনা হাসলো,“সিওর”। সাবরিনার রুমটা ছোট কিন্তু পরিপাটি। চেয়ারের পাশে ফাইল কেবিনেটের উপর ক্যাকটাসের বনসাই। টেবিলে ছোট্ট পারিজাত ফুলের শোভা। বললেন এটা তার বাসার ছাদ বাগানের ফুল। পানি খেলাম। গুগলী ফেস করার আগেই কেটে পড়া উত্তম ভেবে উঠতে যাবো তখন ইশারা করে বসতে বললেন “এসেই যখন পড়েছেন তখন আলাপ করি। আপনার সম্মন্ধে জানি”। আমি ঢোক গিললাম। আমার স্বভাবে দু’ধরণের চরিত্রের মিশ্রণ আছে আমি জানি। মনোবিজ্ঞানীরা এদেরকে বলে এম্বিভার্ট। এরা খানিকটা ইন্ট্রোভার্ট আর খানিকটা এক্সট্রোভার্ট টাইপের হয়ে থাকে। পালাবার উপায় খুঁজছি। সাবরিনা নিরবতা ভাঙ্গলো, “কি ভাবছেন”?
    — এখন উঠবো
    — ভয় পাচ্ছেন?
    — উহু
    — পথ ভুল করে যখন এসেই পড়েছেন তখন আলাপ করি। স্যার নেই, তাই হাতে কাজও নেই।
    — আমার অন্য কাজ আছে
    — কি কাজ?
    — জানিনা
    — এই যে বললেন অন্য কাজ আছে
    — বাসায় যাবো
    — যাবেন তো অবশ্যই। আপনাকে কে বেধে রাখছে? তবে একসাথে লাঞ্চ করি আগে
    — জ্বীনা। থ্যাংকস
    — লাঞ্চ করেন না নাকি?
    — করি তো
    — তো এখন করলে দোষ কিসে?

    আমি এক প্রকার ছেলেমানুষী করেই উঠে পড়লাম। উঠতে গিয়ে টেবিলের পায়ায় হোচট খেলাম। সাবরিনা হাসলো। বললো, “একা বাসায় যেতে পারবেন তো”? জানি মজা নিচ্ছে। এখনো ধরণী দু’ভাগ হচ্ছেনা। কোন মতে বেরিয়ে নীচে নেমে এলাম। ভাবছি এই মেয়ে এত প্রিয়দর্শিনী, এত প্রিয়ভাষিণী কেন? পেটে খিদে তবু মন ফুরফুরে। এটা কি মনোরোগের লক্ষ্মণ?

    চলব…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৭)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১৭)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (১৭)
    জামান ভাইয়ের স্বপ্ন সাধ পূরণ হয়েছে। করোনার কারণে সীমিত পরিসরে ওয়েডিং রিসিপশনের আয়োজন করা হয়েছে সেনাকুঞ্জে। ভাবীর বড় ভাই মেজর জেনারেল। বিত্ত বৈভবে তারা যে অতি উচ্চে তা আয়োজন দেখেই বুঝা গেলো। জামান ভাইয়ের তরফ থেকে ভালোবাসা একতরফা হলেও ভাবী নিমরাজি ছিলেন বরাবর। তার ভয় ছিলো ফ্যামিলি থেকে মেনে নেবে কিনা? যাহোক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তবেই এই মেল বন্ধন সম্ভব হয়েছে।

    হাজার পাঁচেক টাকা মূল্যমানের প্রাইজ বন্ড তোফা হিসেবে নিয়ে গিয়ে বেওকুফ বনে গেলাম। উপহার গ্রহণের কোন ব্যবস্থাই নেই। জামান ভাইকে বলে ধমক খেলাম। আমাদের জন্য রিজার্ভ টেবিলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সাধারণত বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি যাই না। যদিও যাই প্রথম ব্যাচেই বসে পড়ি। এতে সুবিধে অনেক। প্রথমতঃ বিয়ের অনুষ্ঠানে সময়মত কেউ গিয়ে পৌছায়না। ঢাকা শহরের যানজট আর মহিলাদের সাজুগুজু ইত্যাদির কারণে সম্ভবও হয়ে উঠেনা। তাই বিয়ে বাড়ীর আমেজ পুরোপুরি জমে উঠেনা। তখন পরিচিতদের সাথে নিরিবিলি পরিবেশে হাই-হ্যালো করা যায়। দ্বিতীয়তঃ প্রথম ব্যাচের খাবার টেবিলে যে পরিচ্ছন্নতা ও খাবারের স্মেল, ফ্রেশনেস আর পরিবেশনার দক্ষতা যেরুপ থাকে পরবর্তী ব্যাচে তা সে পরিমাণে পাওয়া যায় না। তৃতীয়তঃ খাওয়া শেষে পান বা কফি হাতে বাকী পরিচিত অভ্যাগতদের সাথে জমিয়ে আড্ডা দেওয়া যায়। চতুর্থতঃ ব্যাচেলরদের জন্য এই দীর্ঘ সময়টা খুব কাজে লাগে। পাত্রী তালাশে। এ যেন পাত্রীর হাট। একটার চেয়ে আরেকটা সুন্দর। তবে বিভ্রান্ত হতে হয় প্রায় এক রকম সাজ আর উচ্চমাত্রার প্লাস্টিক পেইন্ট এর কারুকাজ দেখে। এর মাঝেও রয়েছে হিন্দী সিরিয়ালের প্রভাব। জামান ভাই ঘুরে ঘুরে সব খোঁজ নিচ্ছেন। কানের কাছে এসে বললেন, “খেয়ে দেখা করো”। আমাদের খাবার শেষ হওয়ার আগেই চেয়ারের পিছনে এসে প্রায় সবাই পরবর্তী রাউন্ডের জন্য দাঁড়িয়ে গেছে। সাউন্ড সিস্টেমে হিন্দী আর বাংলা ব্যান্ডের গান উচ্চগ্রামে বাজছে। বুঝলাম জামান ভাইয়ের নিয়ন্ত্রণ এখানে অনুপস্থিত। ভাবছি এখনো কি জামান ভাই রাতের খাবারের পর পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গান জারি রাখতে পারবেন? পরক্ষণেই হাসি পেল। কি যা তা ভাবছি।

    এবার বিদায়ের পালা। জামান ভাইয়ের সামনাসামনি হতেই কাঁধে হাত রেখে কোণায় নিয়ে গিয়ে একটি মেয়েকে দেখিয়ে বললেন, “ভালো করে দেখো। পছন্দ হলে আলাপ করা যাবে। বাবা এয়ার ফোর্সে উপরের লেভেলে আছে। একমাত্র মেয়ে। নর্থ সাউথে বিবিএ পড়ছে”। আমি দেখলাম। বিস্তারিত শুনে আর মেয়েটিকে দেখে আমার রীতিমত অস্বস্তি ও ভয় ধরে গেলো। অস্বস্তি এ কারণে যে আমার মাথায় এখন জেমি ভার্সেস শৈলীর আনফিনিসড ড্রামা চলছে। আর ভয় এ কারণে যে, অতি বিত্তবানদের আমি বরাবরই এড়িয়ে চলি। তাদের কন্যাদেরকে তো অতি অবশ্যই। এদের চিন্তা-ভাবনা, আবদার-চাহিদা আর দৌড়াদৌড়ির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারার মত ছেলে আমি না। জামান ভাই হেসে বললেন, “ঘাবড়াও মাত। মেয়ে মডেলিং করে। নাটকেও ঝোঁক আছে”। আমি ঘন ঘন ঢোক গিললাম। তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসা মাত্রই আম্মার ফোন, “তাড়াতাড়ি আয়। আমরা মলিকে নিয়ে ল্যাব এইড হাসপাতালে। মাথা ঘুড়ে পড়ে গেছিলো”। বুকে প্রচন্ড একটা শক্ খেলাম। সেলিম আবার কোনো অঘটন ঘটায়নি তো? আম্মা কিছু বললেন না। বললেন, “কিছু টেস্ট দিয়েছে। এখন সেটাই করাচ্ছি”। অজানা আশংকায় মনটা থেকে থেকে খামচাখামচি করছে।

    ল্যাব এইডে আর যাওয়া লাগেনি। সোজা বাসায় গিয়ে শুনি মলি সন্তান সম্ভবা। আম্মা খুশি। সেলিম আরো। আমারও খুব আনন্দ হলো। আমি মামা হতে যাচ্ছি। হঠাৎই আব্বার কথা মনে পড়লো। আব্বা আজ বেঁচে থাকলে কি থেকে কি যে করতেন অনুমানও করা যায় না। ছোট মামা ফোনে খোঁজ নিলেন। শেষে বললেন, “সেলিমের এখন কিছু একটা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তুমি কাল হক্কানী সাহেবের সাথে দেখা করে আমার অফিস হয়ে যেও”। ঠিকই তো। সেলিমের এখন কিছু একটা করা অতি অবশ্যই দরকার। মলির মেন্টাল সাপোর্টের জন্য এটা হবে অনেক উপকারী। সেলিমের জন্য মায়া হলো। হতভাগার এসবে খেয়াল নেই। মলির জন্য কেন জানি কান্নাই পাচ্ছে। বকাবাদ্য করি, রাগারাগি করি যা-ই করি ছোট বোন বলেই করি। ক্ষেপাবার জন্যও করি। হয়ত একটু বেশিই করে ফেলি।

    হক্কানী সাহেবের অফিসে গিয়ে তাঁকে পাইনি। ব্যস্ত মানুষ। বললেন, মঙ্গলবার লাঞ্চের পর যেতে। তাঁর অধস্তন এক ভদ্রলোক সব কিছু বুঝালেন। কফি খাওয়ালেন। আর উপদেশ দিয়ে বললেন, “যিনি এটা করতে চাচ্ছেন বা করবেন তাকে অবশ্যই হার্ড ওয়ার্কিং হতে হবে আর লেগে থাকতে হবে। আর নিজের বিজনেস টেকনিক কাজে লাগাতে হবে”। তার কথা শুনছিলাম আর সেলিমের সাথে মিলিয়ে নিতে গিয়ে হতাশ হচ্ছিলাম। এর কোন গুণই ওর মধ্যে নেই। আছে উচ্চাভিলাস আর তাড়াতাড়ি বড়লোক হওয়ার উদগ্র বাসনা। টেকনিক বলে কিছু নেই, যা আছে তাও খাটায় না। আবার বেশি বুঝতে গিয়ে লেজে গোবরে করে বাসায় এসে মলির আঁচল ধরে শুয়ে থাকে। আশ্চর্য। পুরুষ মানুষ এমন হয় চিন্তা করতেও কষ্ট হয়।

    হক্কানী সাহেবের অফিস থেকে বেরিয়ে মামার অফিসে গেলাম। মামা নেই। বসতে বলেছেন। পিওন বসিয়ে দিয়ে কফি দিয়ে গেল। খাওয়ার উদ্রেক হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ আগেই খেয়েছি। বসে বসে উইন্ড স্ক্রীণ দিয়ে ঢাকা শহর দেখছি। গলি পথে একই রাস্তায় ঠেলা চলছে। রিক্সা, লেগুনা, মাইক্রো, পিক আপ, কভার্ড ভ্যান, কুরিয়ারের কার্গো, কার, জীপসহ রকমারি যানবাহন ছুটোছুটি করছে। এর ফাঁক গলে হাজার হাজার মানুষ কিলবিল করছে। ধুলো আর কালো ধোঁয়ায় মানুষগুলোর মুখাবয়বে আলাদা পলেস্তারা পড়েছে যেন। এর সাথে রয়েছে তীব্র হর্ন। ট্রাফিক আছে। তবে জায়গামত না। টংয়ে দাঁড়িয়ে পান-বিড়ি খাচ্ছে আর পাবলিকের সাথে কথা বলছে। ভাবটা এমন যে, অনিয়মই যেখানে স্বাভাবিক সেখানে নিয়মের শাসনে গতি বাধা গ্রস্থ করে কি হবে?

    সাবরিনা মৌ মৌ গন্ধ ছড়িয়ে এলো। বললো, “স্যরি, স্যার বলে গিয়েছিলেন আপনি আসবেন। পিওনকে বলেও রেখেছি আপনি আসলে যেন খবর দেয়। ভুলে গেছে। স্যরি”। সাবরিনার মুখে ‘স্যরি’ শুনতে অদ্ভুত ভাল লাগলো। হঠাৎই মনে প্রশ্নের উদয় হলো, সাবরিনারা কেন চাকরি করে? এরকম মাথা খারাপ করা সুন্দরীদের কারো অধীনে দেখলে খারাপ লাগে। বস্তুত এরা স্বামীর অধীনেও থাকার মত না। স্বামীরাই চন্দ্রমুখ দর্শনে মোহাবিষ্ট থেকে এদের অনুশাসনে তুষ্ট থাকে। এরা আসলেই নায়িকা হওয়ার মত। সারাক্ষণ মেনকা হয়ে থাকবে। ফ্যান ফলোয়াররা ঘুরঘুর করবে। মিডিয়া এদের নিয়ে সত্য-মিথ্যার মিশাল দিয়ে চটকদার গসিপ বানাবে। পাবলিক সেগুলো গাঁটের পয়সা খরচ করে এমবি কিনে পড়বে, দেখবে। প্রধান সড়কের মোড়ে মোড়ে দ্রষ্টব্য স্থানে তাদের বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ড দ্যুতি ছড়াবে। “কফি খাচ্ছেন না যে” সাবরিনার কথায় ভাবালুতা কাটলো। নড়েচড়ে বসলাম। বললাম, “খেতে ইচ্ছে করছে না”।
    — সেদিন না বললেন খাগড়াছড়ি গিয়ে কফি খোর হয়েছেন? সাবরিনার গুগলি।
    — একটু আগেই খেয়েছি। আমার ততোধিক তরল উত্তর।
    — ঢাকায় পোস্টিং হবে না
    — কেন?
    — না, এমনি। সবাই তো ঢাকাতেই থাকতে চায়
    — ইচ্ছে তো হয়। সব ইচ্ছে কি পূরণ হয়?
    — আর কি ইচ্ছে হয়?
    — আছে অনেক কিছুই। কোনটা বলবো? তার চেয়ে আপনার সম্মন্ধে কিছু শুনি। আপনি বলুন।
    — আমার সম্মন্ধে? আমি সেলিব্রেটি নাকি?
    — মোর দেন দ্যাট
    — তাই নাকি? বুয়েটিয়ানরা দেখছি ইট পাথরের বাইরেও দৃষ্টি দেয়। সাবরিনা মুচকি হাসলো। সে হাসিতে দুষ্টুমির চিহ্ন সুস্পষ্ট। বললাম, “থাকেন কোথায়”?
    — কাছেই। সেগুন বাগিচায়।
    — বাসায় আর কে কে আছেন?
    — ফ্যামিলি আছে
    — ফ্যামিলিতে কে কে আছেন?
    — কি মনে হয়?
    — কিছুই মনে হয়না
    — তাহলে জানতে চাচ্ছেন যে?

    এমন সময় মামা এলেন। সাবরিনা সৌজন্যতা শেষে বিদায় হলো। হক্কানী সাহেবের প্রপোজাল নিয়ে আলাপ হলো। বললাম সেলিমের জন্য এটা মোটেই উপযোগী না। মামাও মাথা নাড়লেন। লাঞ্চ করালেন। এরি মধ্যে শৈলীর ফোন। ঘন ঘন বেজে চলেছে। ফোন সাইলেন্ট করে রেখেছি। শুধু শুধু জটিলতা বাড়াতে চাচ্ছিনা। ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’? সাবরিনা কাজের জন্য আবার এলো। মৃদু হাসি বিনিময় হলো। আমার কাজ শেষ। তবু উঠতে ইচ্ছে করছেনা। এই বয়সেই কি গতি জড়তায় পেয়ে বসলো নাকি অন্যকিছু? অফিস থেকে বেরোবার পথে করিডোরে ব্যস্তসমস্ত সাবরিনার সাথে দেখা। হাসি বিনিময়ে বললো, “আবার আসবেন। আপনি খুব ইন্টারেস্টিং”। আমার লিফট এসে গেছে। অভ্যন্তরে প্রবেশ করা ভিন্ন আর কোন পথ খোলা নাই।

    চলবে…

  • ললাট লিখন (পর্ব-২)

    ললাট লিখন (পর্ব-২)

    আরশী বেশ কিছুক্ষণ ছবিটা পর্যবেক্ষণ করলো। ছবি থেকে রঙ গুলো দেওয়াল বেয়ে নেমে আসতে শুরু করেছে। হয়তো অতিরিক্ত রঙের ব‍্যবহারের জন্য এমন হচ্ছে। আরশী ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে ঐতিহ্যের দিকে তাকালো। ছেলেটা সেই আগের মতোই ঘুমে অচেতন। দেওয়ালের ছবিটা যে ওই এঁকেছে এতে কোনো সন্দেহ হচ্ছে না কিন্তু ছেলেটাতো বোবা কথা বলতে পারেনা ওর দ্বারা এতো সুন্দর নিখুঁত কাজ আদো কি সম্ভব? কথাগুলো ভেবে ও হাটতে হাটতে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। রুম থেকে মন মাতানো ফুলের সুগন্ধি ভেসে আসছে। নানা রকমের ফুলের সমাহার। ঘরটাকে ঘর না ফুলের দোকান বলে মনে হচ্ছে। এসবের আদো দরকার ছিল বলে ওর মনে হয় না। লোকটা এসবের মানে বুঝলে কথা ছিল। আরশীর এখন আর কান্না পাচ্ছে না। কষ্ট গুলো হৃদয় দিয়ে তেমন করে অনুভব করতে পারছে না। এই বাড়িতে কে কে আছে ওর তার কিছুই জানেনা।

    এখন ভোররাত,কিছুক্ষণের মধ্যেই মসজিদে আজান হবে। কথাটা ভেবে ও আড়মোড়া দিতেই ঘাড়ে তীব্র ব‍্যাথা অনুভব করলো। ও হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখল সেখানে সামান্য একটা ছিদ্র আর সেই ছিদ্র দিয়ে হালকা রক্ত বের হচ্ছে। হঠাৎ করেই ওর সেই স্বপ্নের কথা মনে হলো। সত্যিই কি ওটা স্বপ্ন ছিল নাকি বাস্তব? প্রশ্নটা মনে হতেই ওর গা ছমছম করে উঠলো। আরশী আর বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। তাড়াতাড়ি রুমে আসতে গিয়ে বাধলো বিপত্তি। রুমের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ করা। আরশী কয়েকবার দরজা ধাক্কা দিলো কিন্তু কেউ খুললো না। তবে ভেতর থেকে হাতে ক্লাব দেবার আওয়াজ হচ্ছে। মানে ঐতিহ্য ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে মজা নিচ্ছে। আরশীর বিরক্তি লাগলো। হাবাগোবা দেখলে কী হবে পাজির পা ঝাড়া। ও মনে মনে আচ্ছা রকম বকা দিলো। তবুও মনকে শান্ত রেখে দরজায় হাত রেখে বলল,

    শুনছেন,দরজা খোঁলেন আমি ভেতরে আসবো।
    আরশীর আওয়াজ প্রতিধ্বনি করে ফিরে আসলো কিন্তু কোনো উত্তর আসলো না। বরং লাইট বন্ধ করে নীরব হয়ে গেলো। আরশী বিরক্তি নিয়ে বলল,
    এদের দ্বারা এসবই সম্ভব। ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় দেই।

    আরশী ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে দরজার পাশে হেলান দিয়ে বসে থাকলো। কপাল চাপড়াতে মন চাইছে। ইচ্ছে করছে কপালে কেটে দেখতে সেখানে সুখের বিন্দু বিসর্গ আছে কিনা। বাকীরাতটুকু ও জেগেই কাটিয়ে দিলো। অনেক ঘুমিয়েছে এখন আর ঘুম আসবে না। লোকটা বোকা কিন্তু ভীষণ রকমের ফাজিল। এগুলোকে সকাল বিকাল নিয়ম করে থাপ্পড় দিলে সোজা হয়। আদর পেয়ে মাথায় উঠে বসে আছে। আরশী বিড়বিড় করে কথাগুলো বলল। ও কিছুইতেই নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না। ওর সহজে রাগ হয়না আবার একবার হলে থামাতে চাইনা। কিন্তু এখানে রাগ করেই বা কি হবে। কথায় বলে শশুর বাড়ি না জমের বাড়ি। দাঁতে দাঁত চেপে সহ‍্য করতে হবে। ওর ভাবতে ভাবতেই দুর থেকে ফজরের আজানের সুর ভেসে আসলো। দূরে গেটের সামনে কুকুর ডাকছে। আরশী সেখানেই ঠাই বসে আছে। নামাজ পড়তে হবে কিন্তু ভেতরে যাবে কিভাবে? আজান শেষে চারদিকে নিস্তব্ধতা নেমে আসলো। আরশী এবার পাশ ফিরে দরজায় হাত রাখলো আর ওমনি দরজা খুলে গেলো। ওর আর অপেক্ষা করলো না তাড়াতাড়ি দরজা খুলে ভেতরে গিয়ে দেখলো ঐতিহ্য সেখানে নেই। লোকটা গেলো কোথায় ভেবে ও বাথরুম চেক করলো কিন্তু সেখানেও কেউ নেই। ও লাইট জ্বালিয়ে নিয়ে ঘরটাকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে থাকলো। ঘরে আসবাবপত্র বলতে সোফা, একটা খাট,ড্রেসিং টেবিল আর ছোট একটা আলমারি আছে। ও দেখতে দেখতে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে অবাক হলো কারণ সেখানে কোনো ছবি নেই। শূন্য নীল দেওয়ালটা ঝকঝক করছে। আরশীর চোখ কপালে উঠে গেলো। তাহলে কি তখন ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখেছিল? জীবন্ত স্বপ্ন নাকি বাস্তব? ও এসব ভাবতে ভাবতে নামাজ শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আসলো। আরশী একপা দুপা করে নিচে নেমে আসলো। নীল রঙের ড্রিম লাইট জ্বলছে। বিশাল বড় ডাইনিং রুমটা কেমন মরুভুমির মতো ধু ধু করছে টেবিল ছাড়া কোনো আসবাবপত্র নেই। বড়লোক বাড়ির ডাইনিং রুম সাধারণ এমন হয়না। চারদিকে দামি দামি আসবাবপত্র থাকবে লাইন করে সোফা থাকবে কিন্তু এখানে কিছুই নেই। আরশীর কৌতূহল বেড়েই চলেছে। ও সাবধানে পা টিপে টিপে মাঝামাঝি আসতেই রান্নাঘর থেকে আওয়াজ আসলো,

    বউমা এদিকে আসো।

    রাত্রী আলো আধারের মধ্যে হঠাৎ আওয়াজ শুনে চমকে উঠে পা পিছলে পড়ে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো। রান্নাঘরে অন্ধকারের মধ্যে মোমবাতি জ্বালিয়ে ওর শাশুড়ি কিছু একটা তৈরী করছে। আরশী পাশে গিয়ে জিঞ্জাসা করলো,

    আম্মা এতো ভোর সকালে আপনি রান্না করছেন?
    ঐতিহ্যের ক্ষুধা পাইছে। কাল বিকালে খেয়েছিল আর খাওয়া হয়নি।। মারে আমার ছেলেটার বুদ্ধি খুবই কম কখন কি করে ঠিক পাইনা।রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছে এখন জেগে উঠেই খাইতে চাইছে। তোমাকে ঘরে পাঠিয়ে ওকে কতবার বলেছি তোমার সঙ্গে ঘুমাতে কিন্তু ছেলেটা কিছুতেই রাজি হলো না। তোমাকে একা থাকতে হলো কিছু মনে করোনা মা। তুমি দেখো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আমারও তো সখ করে নাতি নাতনির মুখ দেখে কবরে যায়। বংশের বাতি জ্বলুক। আমার জন্য তোমার জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেলো।

    শাশুড়ির গলা থেকে আক্ষেপ ঝরে জরে পড়ছে কিন্তু একটা কথা আরশীর কানের মধ্যে ঝনঝন করে বেজে উঠলো। গতকাল রাতে ঐতিহ্য ওর ঘরেই ছিল ও নিজের চোখে দেখেছে এবং বেলকনির ঘটনাটা চোখের সামনে এখনো ভাসছে তাহলে উনি বললেন কেনো ঐতিহ্য ওর ঘরে আসেনি? আরশী ভাবলো ওর শোনায় ভুল ছিল তাই দ্বিতীয়বার আবারও জিঞ্জাসা করলো,

    আম্মা উনি আমার ঘরে আসলেন না কেনো?
    আসলে তুমি নতুন তো তাই ও তোমাকে ভয় পাচ্ছে। তুমি ভেবো না দিনদিন পরিচিত হয়ে যাবে তখন দেখবে সব ঠিক হয়ে গেছে।
    না আম্মা সমস্যা হয়নি। আম্মা আমি কি আপনাকে সাহায্য করবো? আর আপনি লাইট থাকতে এমন অন্ধকারের মোমবাতি জ্বালিয়ে রান্না করছেন কেনো?
    ছেলেটা আলো খুব একটা পছন্দ করে না।
    উনি এখন কোথায়?
    আমার ঘরে। তুমি নিজের রুমে যাও আমি রান্না শেষ করে যাচ্ছি।
    আরশী কথা বলে নিজের রুমে দিকে পা বাড়ালো। হাঁটতে হাঁটতে সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই পাশের রুম থেকে আওয়াজ আসলো। আরশী সেদিন এগিয়ে গিয়ে দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলো ওর শশুর মশাই ঐতিহ্যের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর ছেলটা ঘুমের মধ্যেই শব্দ করছে। ওখানে দাঁড়িয়ে ও আর সময় নষ্ট করলো না। মাথাটা কেমন ঘুরছে। গতকাল রাতের বিষয়গুলো মাথার মধ্যে কেমন ঘুরপাক খাচ্ছে। আরশী নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ভেতরে আসতে আসতে খেয়াল করলো বেলকনির দরজা খোঁলা। খোলা দরজা দিয়ে বাতাস এসে পর্দা উড়ছে আর সেখানে একজন ছেলের ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। আরশীর শরীর বেঁয়ে ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেলে। ওর মনে প্রশ্ন জাগলো ওখানে দাঁড়িয়ে আছে কে?

    চলবে…