Tag: গল্প

  • উত্তরা টু আজিমপুর – নীতুর জন্য ভালোবাসা

    উত্তরা টু আজিমপুর – নীতুর জন্য ভালোবাসা

    উত্তরা টু আজিমপুর
    নীতুর জন্য ভালোবাসা।
    আনোয়ার হাকিম।

    নীতু বরাবরই ভাল স্টুডেন্ট। আমি মাঝারি মানের। এ নিয়ে নীতুর কোন এলার্জি নেই। আমারও। আমরা একই স্কুলে ও একই কলেজে পড়েছি। আমাদের বাসাও মফস্বল শহরের একই এলাকায় পাশাপাশি ফ্ল্যাটে। নীতুর বাবা সরকারি অফিসার। আর আমার আব্বা ডাক্তার। মূলতঃ কোচিং একাডেমী থেকেই আম্মার সাথে আন্টির পরিচয়। সময়ের সাথে সাথে সেই পরিচয় পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা পেয়েছে। দুই পরিবারের মধ্যে গলায় গলায় খাতির থাকলেও আমাকে নিয়ে আব্বা-আম্মার রাজ্যের ক্ষোভ। আব্বা ডাক্তার আর আম্মা ভার্সিটির উচ্চ শিক্ষিত। তাদের ছেলে মিডিওকার হবে এটা মেনে নিতে তাদের যার পরনাই কষ্ট। নীতুর আব্বা সরকারি অফিসার হলেও নীতুর মা’র শিক্ষা কলেজ অবধি। অথচ তাদের মেয়ে ব্রিলিয়ান্ট। এই সুক্ষ্ম খোঁচা তাদের অন্তরকে অনবরত খোঁচাতে থাকে। আমি তাদের একমাত্র সাবজেক্ট। আব্বা-আম্মার ইচ্ছে ছেলে ডাক্তার হবে। আমারও ইচ্ছে। কিন্তু সেটা প্রকাশ করতে পারিনা। কারণ ট্র্যাক রেকর্ড ভালো না। মনে আছে ক্লাস টেনে পড়ার সময় নীতুর সাথে বই আর নোট বিনিময় হত। সেটা পরিবারের গোচরেই। মেয়েদের বই-খাতা বেশ পরিপাটি আর সুগন্ধযুক্ত হয়। নীতুরও তাই। অন্যদিকে আমারটা যাচ্ছেতাই গোছের। আমার কথা হলো বই-খাতা ব্যবহারের জন্য, সুগন্ধি মাখিয়ে ইস্ত্রী করে পরিপাটি করে রাখার জন্য না।
    এই নিয়ে নীতুর সাথে প্রায়ই ঝগড়া হয়। ঝগড়াটা আমার তরফ থেকে না। নীতু অনেকটা ইচ্ছে করেই করে। বলে, “ ছেলেরা সবাই কি এমন ছন্নছাড়া হয় নাকি”? আমি বুঝি নীতু ঝগড়া শুরু করার পাঁয়তারা করছে। আমি উত্তর দেই না। নীতু ছাদে ঘুরঘুর করছে আর এগাছ-ওগাছ নিরীক্ষণ করছে। উত্তর দিচ্ছি না দেখে প্রসঙ্গ ঘুরালো। বললো, “আমার টব কে ভেঙ্গেছে”? আমি কোন উত্তর দেই না দেখে বললো, “ নিশ্চয় তুমি”? আমি এবার আর কথা না বলে থাকতে পারলাম না। বললাম, “দেখো গায়ে পাড়া দিয়ে ঝগড়া করবা না। আমার এগুলো ভালো লাগেনা”। নীতু হাসে। বলে, “আরে গাধা গায়ে পাড়া না, ওটা হবে পায়ে পাড়া”। আমি তার দিকে কট্মট্ করে তাকালাম। দেখলাম তার চোখে মুখে দুষ্টু হাসির ঝিলিক। বুঝতে কষ্ট হয়না সে আমাকে উত্যক্ত করে মজা পাচ্ছে। আমি ছাদ দেওয়ালের কাছে গিয়ে বললাম, “ মজা নিচ্ছো? আমিও মজা নিতে জানি। তখন টের পাবা”। নীতু হাসিতে গড়াগড়ি যায় আরকি। বললো, “যে আমার বীরপুরুষ। তুমি মজা করতে জানো নাকি”? এরকম উত্তরের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম না।
    আমার প্রতি নীতুর দুর্বলতা আমি প্রথম টের পাই ক্লাস টেনে টেস্ট পরীক্ষার পর। টেস্টে বরাবরের মত নীতু ফার্স্ট। আর আমার পজিশন মাঝামাঝি। সব ভালো ছাত্রেরই কমবেশি আলাদা একটা গরিমা থাকে। নীতুরও আছে। আমি নীতুকে এড়িয়ে চলি দুই কারণে। এক, সে আমার চেয়ে ভালো ছাত্রী, আর আমাদের প্রতিবেশী। আর দুই নম্বর কারণ হলো, তাকে নিয়েই আমার পৌরুষে যত আঘাত। আব্বা-আম্মা সারাক্ষণ খোঁটা দেয়। নীতুর কথা পাড়ে। তার মত রেজাল্ট করতে বলে। তাকে দেখে শিখতে বলে। এস এস সি তে নীতু গোল্ডেন এ প্লাস। আমি জিপিএ ফাইভ। যা হবার তাই হলো। রেজাল্ট বেরোবার বেশ কয়েক মাস আব্বা-আম্মার শোক চলতেই থাকলো। উভয় পরিবারের যাতায়াতে, গেট টুগেদারে এই যাতনার মাত্রা আরো বাড়ে। নীতু আহ্লাদি করে আসর সরগরম করে রাখে। সবাই তাকে তোলা দিয়ে কথা বলে। আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে আব্বা-আম্মাও নীতুর তারিফ করতে থাকে। প্রথম প্রথম আমল না দিলেও পরে বিষয়টা ব্যক্তিত্বের কোথায় যেন খচ্ খচ্ করে। যতই এভয়েড করে চলি নীতুকে সে ততই ঘন ঘন সশরীরে বাসায় এসে নানা প্রসঙ্গ পাড়ে। আব্বা-আম্মা তাকে খুব পছন্দ করে। আর আমি তাকে এড়িয়ে চলি। নীতু বাসায় এলে আমি কাজের অজুহাতে বেরিয়ে যাই। নীতু বুঝতে পারে। বলে, “আজকাল আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছো মনে হচ্ছে”? আমি কোন উত্তর করিনা। দুর্বলের শক্তিই হলো নিরব থাকা। এতে অন্যরা মনে করে ভারি কলসি বাজে কম। অথবা নিভৃতচারী এবসেন্ট মাইন্ডেড প্রফেসর গোছের হবে। নীতু কি ভাবে জানিনা। তবে এই দুয়ের একটাও যে ভাবে না সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারি।
    একদিন কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিক্যাল খাতার ভেতর একটা চিরকুট মিললো। তাতে লেখা “বেশি বেশি ভাব। মাকাল ফল”। আমি হতভম্ব। মানে কি? আমিও কম যাই না। খাতা ফেরত দেওয়ার সময় আমিও চিরকুটে লিখলাম, “মাকাল ফল থেকে দূরে থাকুন। উজ্জ্বল ভবিষ্যতে গড়ুন”। ব্যস! শুরু হয়ে গেলো আমাদের চিরকুট বিনিময় খেলা। আমাদের মধ্যে এত দেখা-সাক্ষাত, ঘনিষ্ঠতা সত্বেও মোবাইল নম্বর বিনিময় হয়নি। আমার সাহস হয়নি নানা কারণে। এমনিতেই মেয়েদের মোবাইল নম্বর চাওয়া অভদ্রতা। আর চাওয়ার পরে যদি না দেয়? তাহলে আত্মসম্মানে লাগবে। মুখ দেখাবো কি করে? অবশ্য নীতুও কোনদিন চায় নি। কেন চায় নি জানিনা। একদিন নোটের কোণায় একটা মোবাইল নম্বর আবিষ্কার করলাম। কার? নীতুর? এক নোট চোদ্দ হাত ঘুরে। কার কে জানে? তবু টুকে রাখলাম।
    রিং দেবো কি দেবো না ভাবতে ভাবতেই তিনদিন কেটে গেলো। নোট ফেরত দেওয়ার সময় মোবাইল নম্বরের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে দিলাম। ভাবলাম সাক্ষাতে নীতু এ প্রসঙ্গটা উঠাতে পারে। তখন বুঝা যাবে এটা কার আর কি উদ্দেশ্যে নোটের গায়ে লেখা? নীতুর এ ব্যাপারে কোন সাড়া নেই। একদিন ছাদে দেখা হতেই গায়ে পড়ে বললাম, “নোটে দেখলাম মোবাইল নম্বর লিখে রেখেছো। কেন? মেয়েদের নম্বর কি কেউ এভাবে লিখে রাখে? বিশেষত যে নোট চোদ্দ হাত ঘুড়ে”? নীতু চমকে উঠলো। বললো, “ তুমি কি রিং দিয়েছো নাকি”? বললাম, “ কেন? কার নম্বর? তোমার না”? নীতু হেসেই মরে যাচ্ছে। বললো, “আরে না না। তুমি একটা হাঁদারাম। ওটা তো আমাদের নতুন বুয়ার নম্বর। আম্মা জরুরি টুকে রাখতে বলায় টুকে রেখেছিলাম। কাটতে ভুলে গেছি। তুমি সত্যিই রিং দিয়েছিলে নাকি”? নিজেকে সামলে নিয়ে ভাব নিয়ে বললাম, “ না। মেয়েদের সাথে আমি ফোনে কথা বলিনা”। নীতু মৃদু হাসলো। বললো, “ বাব্বা! হেবি পাট নিচ্ছো দেখছি। আমি তো ভাবলাম আবেগের ঠ্যালায় ফোন করে বস্ছো”। আমি তাৎক্ষণিক অবজ্ঞা ভরে বললাম, “আমার আর খেয়ে দেয়ে কাম নেই। আবেগের ঠ্যালায় তোমারে ফোন দিমু”। নীতু কিছুটা বিচলিত হলো মনে হলো। মেয়ে মানুষের জেদ বেশি। হয় তর্ক করবে নাহয় পরে দেখে নেওয়ার হুমকি দেবে। দিলোও তাই, “দেখা যাবে। সময়ই সব বলে দেবে”। আমি চমকে উঠলাম। আমি তো মনে মনে চাই নীতুর নম্বর। ফোনে ফোনে কথা বলতে। একদিন লজ্জার মাথা খেয়ে সাহস করে বলেই ফেললাম, “ অত ভং চং না করে নম্বরটা দিলেই তো হয়”। নীতু চাঙ্গা হলো বলে মনে হলো। বললো, “এতই সহজ। খুব তো ভাব নিয়ে থাকেন সারাক্ষণ। বাসায় গেলেন বেরিয়ে যান। আপনার আবেগ নাকি উথলে উঠেনা”?
    এভাবে নীতুর সাথে একান্তে আর গোচরে দেখা-সাক্ষাত আর কথা-বার্তা হতে থাকলো। এইচ এস সি তে অপ্রত্যাশিত রেজাল্ট হলো। দু’জনেই গোল্ডেন। আব্বা-আম্মা খুশিতে দশখান। নীতু উচ্ছ্বসিত। আর আমি টেনশনে। আমি জানি আমার মেডিকেলে চান্স হবেনা। কিন্তু আব্বা-আম্মা যেন এতদিনে আশার আলো দেখতে পেয়েছে। তাদের ছেলে ডাক্তার হবে। আর আমার এক কথা আমি মেডিকেলে পড়বো না। বাসায় এ নিয়ে চরম অশান্তি। তারা ডাক্তারি ছাড়া অন্য কিছু মেনে নেবে না। আমিও মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হবো না। এ কথা নীতুর কানে গেলো। ততদিনে আমাদের ডায়ালগ প্যাটার্ন তুমি থেকে তুই-এ প্রমোশন পেয়েছে। একদিন নীতুর আম্মা বাড়ী এসে কান্নাকাটি করলেন। নীতু নাকি ডাক্তারি পড়বেনা। এ নিয়ে ওদের বাসায় তুমুল বাহাস হচ্ছে। আম্মা বিস্ময়ে হতবাক, আন্টিকে জানালেন আমার কথা। আমি নিজেও হতবাক। নীতু বরাবরই বলে এসেছে সে মেডিকেলেই পড়বে। এবারে না হলে আগামীবার ট্রাই করবে। নীতুকে ছাদে পাওয়া গেল। বললাম, “তুই নাকি পাগলামি করছিস”?
    — তুইও তো করছিস। নীতুর পাল্টা উত্তর।
    — আমার তো ডাক্তারি ‘এইম ইন লাইফে’ ছিলো না। তোর ছিলো। এখন হঠাৎ কি হলো?
    — কিছু হয়নি। মাইন্ড চেইঞ্জ করেছি। তোর কোন সমস্যা?
    — সমস্যা না। তবে কারণটা জানলে ভালো লাগত।
    — জানলে কি করবি?
    — কিছু করতে না পারলেও শুনতে তো পারি।
    — কোন দরকার নাই। নীতুর গলা ভারি। চোখ ছলছল। বললাম, “কি হয়েছে বলবি তো”? নীতু চুপ করে থাকে। আমি যা বুঝার বুঝে গেছি। পরদিন মেডিকেল কোচিংয়ে গিয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম। বাসায় আব্বা-আম্মা মহা খুশি। ছেলের সুমতি হয়েছে। আম্মা খুশির চাপে এই কথা নীতুদের বাসায় গিয়ে ছেড়ে আসলো। একথা শুনে নীতুদের বাসায় তুলকালাম কান্ড ঘটে গেলো। নীতুর জন্য মায়া হলো। নীতুকে মেডিকেল একজামে বসাতে আমি অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাকে না জানিয়ে মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছি। কিন্তু এতে তাদের বাসার পরিবেশ যে এত তিক্ত হবে বুঝতে পারিনি। নীতু পড়েছে মহাবিপদে। সে এখন হঠাৎ করে কোন কারণ ছাড়াই তিন শ’ ষাট ডিগ্রী ঘুরতেও পারছেনা। একদিন ছাদে দেখা হতেই সে জ্বলে উঠলো, “তুই পাইছস কি”? আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, “ মানে কি”?
    — মানে বুঝতাছিস না?
    — না
    — ভন্ড কোথাকার। লায়ার।
    — বুঝলাম না
    — বুঝবি কিভাবে? আমারে তো ডুবাইছস
    — কিভাবে?
    — তোকে রাজী করানোর জন্যই তো আমি এই স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলাম
    — আমিও তো তোকে ফেরাতে এই স্ট্র্যাটেজি নিয়েছি। এখন তুইও এডমিশন নিয়ে নে।
    — তোর মাথা। এখন রাজী হলে আমার লজিক কি হবে?
    — আংকেল-আন্টিকে আমার কথা বলে বলবি ওই হাঁদারাম যদি মেডিকেল কোচিংয়ে ভর্তি হতে পারে তাহলে আমিও হবো।
    — তোর মাথায় তো ঘিলু নাই, গোবরে ভর্তি।
    আমি কথা না বাড়িয়ে বললাম, “তুই তো চান্স পাবিই। আমার চান্স নাই”। নীতু প্রায় কান্না করে বলে উঠলো, “তুই একটা পাষাণ”। নীতু নেমে গেলো নীচে। মাগরিবের আযান চলছে। ছাদ থেকে ব্যস্ত শহরের নাগরিক ম্যুভমেন্ট দেখছি। সবাই ছোটাছুটি করছে। গাড়ীগুলোও। হঠাৎই মনে ঝিলিক মেরে উঠলো গতিই জীবন। আমার নিজের উপর আস্থা কম। কিন্তু নীতুর উজ্জ্বল ভবিষ্যত মহাসড়ক ফেলে বাইলেন বরাবর ছুটবে তা হয় না। ছোট্ট একটা চিরকুটে লিখলাম, “তুই ঠিকই বলেছিলি আমি মাকাল ফল। আমার জন্য হলেও ডিশিসন চেঞ্জ কর প্লিজ। ট্রুলি লাভ ইউ”। কিন্তু কিভাবে তাকে দেবো ভাবছি। নীতু ইদানীং ছাদে কম আসে। বুক পকেটে চিরকুট নিয়ে ওপেক্ষা করি। কিন্তু নীতুর কাছে পৌছাতে পারিনা।
    একদিন আন্টির ডাক পড়লো তাদের বাসায়। তারা বিপর্যস্ত। অনন্যোপায় হয়ে নীতুকে বুঝাতে আমার স্মরণাপন্ন হয়েছেন। এই নাটকের জন্য আমার উপর নীতুর প্রচন্ড রাগ। সামনাসামনি হতেই বললাম, “পাগলামি করো না। তুমি তো ঢাকা মেডিকেলেই চান্স পেয়ে যাবা। আমার তো হবে না আমি জানি”। আন্টিকে বললাম, “ভর্তির টাকা আর ওর ডকুমেন্টগুলো আমাকে দিয়েন। আমি কাল মেডিকেল কোচিংয়ের ফর্ম নিয়ে আসবো”। এই বলে নীতুকে চিরকুটটা হাতে গুঁজে দিয়ে আমি চলে আসলাম। আন্টি খুশি।
    মেডিকেল ভর্তি ফর্ম নিয়ে এসে নীতুকে দিলাম। নীতু একটা বায়োলজী রেফারেন্স বুক ধরিয়ে দিলো। আমার এতে ইন্টারেস্ট কম। সাধারণ বই পড়তেই ইচ্ছে করেনা। আবার রেফারেন্স বুক! তবু বাসায় এনে উল্টেপাল্টে দেখছিলাম। হঠাৎই একটা চিরকুট নীচে পড়ে গেলো। কুড়িয়ে নিয়ে দেখলাম তাতে একটা ফোন নম্বর। নীচে লেখা, লাভ ইউ টু বাবু।

  • আজিমপুর টু উত্তরা – মেঘে মেঘে অনেক বেলা

    আজিমপুর টু উত্তরা – মেঘে মেঘে অনেক বেলা

    আজিমপুর টু উত্তরা
    মেঘে মেঘে অনেক বেলা।
    আনোয়ার হাকিম।

    আমি যখন অভ্যন্তরীণ এয়ারপোর্টে গিয়ে পৌছলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ইউস-বাংলা কাউন্টারে হন্তদন্ত হয়ে গিয়ে যেই বলেছি আমি এই ফ্লাইটের প্যাসেঞ্জার অমনি ওখানকার দুই তিন জন ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লো। একজন বললো, “স্যার, উই আর এংসাসলি ওয়্যটিং ফর ইউ”। আরেকজন বললো, “পারহেপস ইটস টু লেট”। আরেকজন ওয়াকি টকিতে কি যেন বলছে। আমার সাথে হ্যান্ড লাগেজ ছাড়া কিছু নেই। ওরা আমাকে পারলে পাঁজাকোলা করে প্যাসেঞ্জার’স গেইটের সামনে দাঁড়ানো কারে তুলে দিল। আমি সাতপ্যাচ ঘুরে অবশেষে গমনোদ্যত সেই ক্রাফটে গিয়ে উঠলাম। এয়ার হোস্টেসের মুখে শুষ্ক অভ্যর্থনা। বুঝলাম তারাও অসন্তুষ্ট। আমাকে সীট দেখিয়ে দিলেন। আমার সীট জানালার পাশে। মন পুলকিত হলো। দেখতে দেখতে চিটাগাং যাওয়া যাবে। উপর থেকে নীচের মাটির জনপদকে দেখার মজাই আলাদা। আর মেঘেদের ভীড়ে হারিয়ে যাওয়াও রোমাঞ্চকর। জানালার পাশের সীটে এক ভদ্রমহিলা বসে আছেন। তিনি ধরেই নিয়েছেন এই সীট ফাঁকা যাচ্ছে। আমার দিকে চোখ মেলে তাকালেন। ভদ্রমহিলা অসম্ভব সুন্দরী। ভদ্রতা করে সীট ছেড়ে দেওয়ার আয়োজন করলেন। আমিও মওকা পেয়ে সৌজন্যতার পরাকাষ্ঠা দেখালাম। তিনি বিগলিত হয়ে ‘থ্যাংক ইউ’ জানালেন। আমি সীট বেল্ট বেঁধে বসলাম। ক্রাফ্ট টারমাক বরাবর চলা শুরু করে দিয়েছে। টেক অফ করা পর্যন্ত আমি দোয়া দরুদ যত জানি তা-ই আওড়াতে থাকলাম। জীবন কা সাওয়াল, তাই। এত কিছুর মধ্যে মোবাইল সুইচড অফ করতে ভুলে গিয়েছি। এয়ার হোস্টেস মিহি গলায় সতর্ক করে গেলো। টেক অফ করার কিছুক্ষণের মধ্যেই প্লেন উপরে স্ট্যাবল হলো। পেপার পড়ছি। ভদ্রমহিলা কানে হেডফোন দিয়ে চোখ বুঁজে কি যেন শুনছে। তাতে আমার কি? তবে আমার একটু অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। তার পারফিউমের তেজী গন্ধে আমার মাথা স্টাক হয়ে যাচ্ছে। শ্বাস নিতে কষ্টই হচ্ছে। বিমান আকাশে ভাসছে। ঢাকা-চিটাগাং ফ্লাইট টাইম পঞ্চাশ মিনিট। দেখতে দেখতে কেটে যায়। যাচ্ছি একটা সেমিনার এটেন্ড করতে। এনভায়রনমেন্ট এর উপর। দুইদিনের সেমিনার। আমি সরকারের মানে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। মূলত এটি একটি বিদেশি এনজিও কর্তৃক আয়োজিত দেশি-বিদেশি এনজিও ও সরকারি পার্টনার অর্গানাইজেশন নিয়ে অনুষ্ঠিতব্য সেমিনার। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে র‍্যাডিসন ব্লু হোটেলে। এর আগে ওটাতে থাকা হয়নি। তবে পাশের সার্কিট হাউজে থেকেছি অনেকবার। এই অবসরে ওদের দেওয়া ফাইল ফোল্ডার খুলে স্কেজিওল দেখছিলাম। “এক্সকিউজ মি” বলে পাশের সুন্দরী কিছুটা বিস্ময় নিয়ে বললেন, “আপনিও কি আমাদের সেমিনার এটেন্ড করতে যাচ্ছেন”? আমি বুঝেও না বুঝার ভান করে বললাম, “কোন সেমিনার, ম্যাডাম”? সুন্দরী ফাইল ফোল্ডারের দিকে তার দৃষ্টি ছুঁড়ে মারলো। আমি সহজ হয়ে বললাম, “আপনিও”?
    — জ্বী। তার উত্তর।
    — কোথায় আছেন আপনি? আমার কৌতুহল।
    — এই তো আপনার পাশে ।
    — না মানে, মিনিস্ট্রির কেউ?
    — কেন মিনিস্ট্রি ছাড়া আর কেউ থাকতে পারেনা?
    — স্যরি, আই ডোন্ট মিন লাইক দেট।
    — আমি একটি বিদেশি এনজিওতে আছি। সুন্দরী সহজ হলো।
    — সো নাইস টু মিট ইউ
    — মি টু। আজই ব্যাক করবেন?
    — উহু কাল লাস্ট ফ্লাইটে। আপনি?
    — আমিও
    — গুড। আমি জোশের ঠ্যালায় বলে ফেললাম।
    — গুড কেন?
    — বাহরে দেখা হলো, গন্তব্য এক, উদ্দেশ্য এক, ফেরত যাত্রাও এক। সবই তো এক।
    — সব বলতে
    — এই তো। এগুলোই। রেডিসনেই থাকবেন তো?
    — হ্যা। আপনিও?
    — জ্বী। এখন দেখলেন তো সব এক
    — আর কি কি এক?
    — আপাতত এটুকুই। রেস্ট ইজ ইয়েট টু নো।
    কথা চালাচালি এটুকুই। সুন্দরী পানি খেলো। সেই খাওয়াতেও যেন আর্ট আছে। খাতির জমানোর জন্য বললাম, “দিস ইজ মাই কার্ড। মে আই হেভ ইওরস”? “সিওর, হোয়াই নট। ইটস মাই প্লেজার।”? তার উত্তর। ভিজিটিং কার্ডটা উল্টে পাল্টে দেখলাম। ডঃ তনু শবনম। সিনিয়র কনসালটেন্ট (কনজারভেশন)। চমৎকার নাম। একেবারে ষোল আনা বাঙ্গালী নাম। সুন্দরীও আমার কার্ডটা নেড়েচেড়ে দেখলো। মুচকি হেসে বললো, “এখন বুঝেছি কেন মিনিস্ট্রির লোক ভেবেছিলেন আমাকে”? “আমরা লীড মিনিস্ট্রি, তাই পার্টনার মিনিস্ট্রির অনেকেরই আসার কথা, তাই ওরকমই ভেবেছিলাম”। আমার সরল স্বীকারোক্তি। “হয়ত আছে। আপনি তো আরেকটু হলে ফ্লাইটই মিস করছিলেন”। সুন্দরীর কথায় খানিকটা লজ্জাই পেলাম। সুন্দরী এবার আলাপ জমানোর ভঙ্গীতে বললো, “থাকেন কোথায়”? “উত্তরা” আমার জবাব শুনে অবাক হয়ে পরক্ষণেই মৃদু হেসে বললো, “কথায় বলেনা, মক্কার মানুষ হজ্জ্ব পায়না”। আমি কোন এক্সকিউজ দিলাম না। বললাম, “হুম্ম। ব্যাপারটা অনেকটা সেরকমই”। এরিমধ্যে পাইলটের ঘোষণা এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা চিটাগাং হযরত শাহ আমানত বিমানবন্দরে নামতে যাচ্ছি। গ্রাউন্ড টেম্পারেচার গুড। ওয়েদার সানি। আমাদের সেমিনার রেজিস্ট্রেশন সাড়ে দশটায়। ইনাগোরেশন এগারোটায়। এখন প্রায় সাড়ে আটটা। পতেঙ্গা থেকে রেডিসন অনেক দূর। তবে এরমধ্যেই পৌছানো সম্ভব। মন্ত্রী মহোদয় উদ্বোধন করবেন। বিমানবন্দরে আমাদের অধিদপ্তরের লোকজন ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সৌজন্যতা করে বললাম, “গাড়ী আছে। আমার সাথে যেতে পারবেন”। “নো থ্যাংক্স। আই হেভ ট্রান্সপোর্ট রাইট ওভার দেয়ার”। শবনমের উত্তর। আমি অভ্যর্থিত হয়ে ভি আই পি লাউঞ্জের দিকে অগ্রসর হলাম। একবার মনে হলো, সৌজন্যতা করে হলেও বলি তাকে লাউঞ্জ দিয়ে বেরোতে। কিন্তু একেক জনের পার্সোনালিটি একেক রকম হয়। হয়ত অন্যভাবে নেবে। তাই চুপ থাকলাম। তবে উত্তেজনা মনের মধ্যে কিলবিল করছে। অন্তত সে তো দেখে গেছে, বুঝেও গেছে যে, আমি ভি আই পি। আমার জন্য এয়ারপোর্টে লোকজন ফুলের তোড়া নিয়ে অপেক্ষা করে। আর আমার যাতায়াত পথ ভি আইপি লাউঞ্জ দিয়ে।
    যথারীতি রেজিষ্ট্রেশন ইত্যাদি সেরে নির্ধারিত আসনে বসেছি। শবনমের সাথে দেখা। সেই হাসি। সেই হাই, হ্যালো। সোনালী চুল দুলিয়ে কাছে এসে বললো, “স্ন্যাক্স নিয়েছেন? ওইদিকে কর্ণারের টেবিলে আছে”। “মন্দ বলেন নি। চলেন কফি খাই”। স্ন্যাক্স খেতে খেতে আলাপ। পরিচিত অনেকের সাথে দেখা। ঢাকায় থাকলেও অনেকের সাথে দেখা হয়না অনেকদিন। পার্টিসিপেন্টদের বেশিরভাগই মহিলা। আজকাল মহিলাদের সরব উপস্থিতি সর্বত্র। একদিন একথা সহকর্মী লুবনাকে বলেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গ বারুদ জ্বলার মত জ্বলে উঠে, “জ্বলে নাকি”? আমি হাসতে হাসতে বললাম, “জ্বলে তো। খুব জ্বলে। হৃদয়ে ক্ষরণ হয়”। এই উত্তরে লুবনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললো, “সে কি রকম? অনেকের জ্বলে। মেয়েদের এগিয়ে আসা মেনে নিতে পারেনা। তাদের জ্বলতেই পারে। কিন্তু হৃদয়ে ক্ষরণ হয় কেন”? ভাবছি কি উত্তর দেওয়া যায়? সিরিয়াস হলে জেন্ডার এলার্জির তকমা গায়ে লেগে যেতে পারে। তাই কথার মোড় ঘুড়িয়ে দিয়ে বললাম, “ম্যাডাম, সর্বত্র এত এত ডানা কাটা পরী দেখলে চোখ ঝলসে যায়, মন পোড়ে, আর কোনটা রেখে কোনটা ধরির দ্যোতনায় পরে যাই”। লুবনা সিরিয়াস হতে গিয়েও হেসে উঠলো, বললো, “বেশির ভাগ পুরুষের চোখ খারাপ। মন কুশ্রী। আর মানসিকতা অতি নিম্ন মানের”। কথা দোষের না। ঠিকই আছে। তবে পুরুষ জাত নিয়ে কথা বলায় লাগলো। বললাম, “ম্যাডাম, এত সেজে গুজে চোখের সামনে ডানা কাটা পরী হয়ে ঘুরলে পুরুষের চোখের ওয়াইপার কতক্ষণ বন্ধ রাখা যায় বলুন তো। আর চোখের সাথে মনের ইন্দ্রিয়গত ইনবিল্ট বন্ডেজ আছে। এতে পুরুষেরই ক্ষতি। গুনাহর পাহাড় সুউচ্চ হয়”। লুবনা খুব মন দিয়ে নিরীক্ষণ করলো। বললো, “কি যে আমার সুফী পুরুষ এক একজন? দেখা আছে। আপনি কথা বলেন কাটাকাটা। তবে মধুর প্রলেপ দিয়ে। যে কেউ ইনক্লাইন্ড হতে বাধ্য”। এভাবেই লুবনার সাথে ঘনিষ্ঠতা। এক সাথে চাকরি। সেমিনার চেয়ারে বসে এসব কিসব আজেবাজে ভাবছি। উদ্বোধনী পর্বের বক্তৃতা চলছে। মন্ত্রী মহোদয় প্রধান অতিথি। সেমিনারের সাবজেক্ট এনভায়রনমেন্ট হলেও মন্ত্রীর তোষামোদিতে সবাই যাচ্ছেতাই বলে যাচ্ছে। দেশি-বিদেশি এনজিওরাও কম যায় না। বাণিজ্যে লক্ষীর বসতি। সবই গিভ এন্ড টেক এর খেলা।
    প্রথম দিনের কার্যক্রম শেষ। সন্ধ্যায় পতেঙ্গায় বিমান বন্দরের কাছে বোট ক্লাবে স্ন্যাক্স ও ডিনার। সাথে সান্ধ্য ও রাত্রিকালীন সৈকত ভিউ ফ্রি। সবাই দল বেধে গেলাম। শবনমকে দেখলাম মহিলা মহলে। বার কয়েক চোখাচোখি হলো। তার ভাবসাব নির্লিপ্ত। মনটা খানিকটা আহত হলো। পরক্ষণেই লজ্জা পেলাম। কোথাকার কোন মেয়ে আজই প্রথম ফ্লাইটে পরিচয়। তার সংগ চাহিদা কি সংগত? অন্য কলিগ ও পরিচিতজনদের সাথে কথা বলছি আর চোখ রাখছি শবনমের ম্যুভমেন্টে। কালো ড্রেসে তাকে আরো গর্জিয়াস লাগছে। হঠাৎ তাকে আবিষ্কার করলাম একগাদা ইয়াং ডেলিগেটের সাথে। কিছু নেভী অফিসারকেও দেখলাম সেখানে। হাসির হল্লাতে শবনমকে দেখলাম স্যাটেলাইটের মত আলো ছড়াচ্ছে। বুকের খুব ভেতরে পৌরুষ হিংসা থেকে থেকে ফালি ফালি করে দিচ্ছে। লুবনার কথা মনে পড়লো। লুবনাকে নিয়েও এমন হয়েছিলো। কোন পুরুষ তার সাথে কথা বললে লাগত, বস ডেকে পাঠালে মেজাজ বিগড়ে যেত। দেরি হলে গোস্যা হত। এর ছাপ পড়ত তার সাথে আচরণে। একদিন খুলেই বললাম, “আজকাল অফিসে দেখছি তোমার অনেক ফ্যান-ফলোয়ার হয়েছে”।
    — যেমন? লুবনার কৌতুহল।
    — এই যে সবাই তোলা দিয়ে তোমার সাথে মাখো মাখো হয়ে কথা বলে।
    — তো
    — কাজ ফেলে প্রায় সময়েই নানা ছুঁতোয় আলাপের আয়োজন করে
    — তো
    — বসও দেখছি আজকাল ঘন ঘন ডাকে
    — তো
    — এই তো এসব দেখছি আরকি।
    — জ্বলে?
    — জ্বলে তো
    — কেন?
    — জানিনা
    — এত কিছু নিয়ে ভাবো?
    — না, শুধু তোমাকে নিয়েই ভাবি
    — ভাবা বন্ধ করে দাও। দেখবে সব স্বাভাবিক লাগছে।
    — পারছিনা তো
    — ডাক্তার দেখাও। নইলে হার্ট উইক হয়ে যাবে।
    সেমিনারে টেকনিক্যাল বিষয় নিয়ে পান্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা চলছে। বেশিরভাগ লোকই ঘুমুচ্ছে। আজ ফেরার দিন। তাই, সব কিছুই কিছুটা ঢিলেঢালা। আমারও ঝিমুনি ভাব এসেছিলো। লুবনা আর শবনমকে নিয়ে ভাবাভাবিতে সে ভাব অনেকটাই কেটে গেছে। শবনমকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছেনা। ওয়াশরুমে যাবার উছিলা করে দেখে এলাম চারপাশ। কোথাও নেই। আশ্চর্য।
    সেমিনার শেষ। যে যার স্কেজিউল মত ফ্লাইট ধরতে চলে যাচ্ছে। আমার ফ্লাইট রাত সাড়ে সাতটায়। পাঁচটা নাগাদ রওনা হয়ে গেলাম। সাথে স্থানীয় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা আছে। প্রটোকলের দায়িত্বে। ফ্লাইট আধাঘন্টা ডিলে। ভি আই পি লাউঞ্জে বসে আছি। টিভি মনিটরে ফ্লাইট অপারেশন স্কেজিউল দেখাচ্ছে। শবনমের কথা মনে হলো। তারও এই ফ্লাইটে যাওয়ার কথা। হয়ত এই এয়ারপোর্টেই আছে কোথাও। ক্রাফটে দেখা হলো। এবার আর একসাথে সীট পড়েনি। আমি তার অন্যপ্রান্তে। শবনমের পাশে একজনকে দেখলাম। সেমিনারে তাকে দেখেছি বলে মনে হলো না। আরো দেখলাম তারা বেশ হাস্যোজ্জ্বল ম্যুডে আছে। আমার সেই প্রাচীন ব্যামো পেয়ে বসলো। জীবনানন্দীয় উপলব্ধি মাথায় ভর করলো। কি এমন কথা তার সাথে? ভেবে পাচ্ছিনা। পরক্ষণেই মনে হলো কিসের মধ্যে কি! এতসব আবোল তাবোল ভাবছি কেন? লুবনার কথা মনে পড়লো। একদিন বলেছিলাম, “এত ভাল, ভালো না”।
    — কি?
    — বললাম সবার কাছে ভালো থাকার চেষ্টা ভালো না
    — মানে কি? লুবনার বিস্ফোরণ
    — এই যে সবাই তোমার সঙ্গ পেতে মেতে উঠেছে
    — আশ্চর্য! এতে তোমার কি?
    — কিছু না। ইটস লুক ওড
    — দিস ইজ টু মাচ। কান্ট বিয়ার। ইউ নীড আ পার্মানেন্ট সায়াক্রিয়াট্রিস্ট। শেষের কথা দিয়ে সে কিসের ইঙ্গিত করলো বুঝলাম না।
    ফ্লাইট মাঝ আকাশে। এখনো সেই ছেলে আর শবনম ননস্টপ হাস্যালাপ করে যাচ্ছে। এত হাসির কারণ কি? মাঝেমধ্যে চোখাচোখি হয়েছে। থতমত খেয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি। সামনে পেপার মেলে ধরা। চোখ সেখানে নিবদ্ধ। কিন্তু মন পড়ে আছে শবনমে।
    চিটাগাং-ঢাকা ফ্লাইট যেন এই উঠা আর এই নামা। নামার সময় দেখা হলো। সেই ছেলে শবনমের বডি গার্ডের দায়িত্ব পালন করছে। কাছে গিয়ে বললাম, “সি ইউ সুন। টিল দেন বেস্ট অফ লাক”। সেই কথার প্রেক্ষিতেই শবনম সেই বডিগার্ডকে পরিচয় করিয়ে দিলো, “মিট মাই বেস্ট ফ্রেন্ড কামার জামান। নেভাল অফিসার”। ভদ্রতাসূচক হাই-হ্যালো হলো। গা জ্বলে যাচ্ছে। মন পুড়ে ছাড়খাড়। নিজেকে সামলে নিয়ে গাড়ীতে গিয়ে বসলাম। বুঝলাম লুবনার কথাই ঠিক। মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। আমার এখন লুবনার মত একজনের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা জরুরী হয়ে পড়েছে।

  • উঠোন পেরিয়ে আফ্রিকা (পর্ব-১)

    উঠোন পেরিয়ে আফ্রিকা (পর্ব-১)

    হঠাৎ দেখা ডুলুটি লেক

    ভ্রমণ কাহিনীর শুরু কোথা থেকে হওয়া উচিত, যখন গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম তখন থেকে, নাকি যখন থেকে কোথায় যাওয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে তখন থেকে? আমার কাছে মনে হচ্ছে, কিছুটা আগে থেকে শুরু করলে হয়তো ভালো লাগবে। এখন এই কিছুটা আগে মানে কতটুকু আগে সেটাও ঠিক বুঝতে পারছি না।

    আমরা তানজানিয়াতে এসেছি ১৫ দিনের মত হয়েছে। সোহান ১১ মাসের একটা কোর্সে এখানে এসেছে। তার সাথে লেজ হিসাবে আমরাও এখানে আসার সুযোগ পেয়েছি। এখানে এসেই সোহান বেচারা কোর্সের নানারকম চাপে পরে গিয়েছে। প্রতিদিন অন্ধকার ফুরিয়ে যাবার আগে বাসা থেকে বের হয়ে যায়, ফিরে আসে অন্ধকার নামে যখন। সাপ্তাহিক ছুটি আমাদের জন্য অতি কাংখিত। সেদিন মানে ১৫ তম দিনটা ছিল শুক্রবার, দেশে শুক্রবার ছুটির দিন, আমার কাছে তখনো শুক্রবার মানেই ছুটির গন্ধ; কিন্তু সোহান এখানে অফিস করছে; দেশের ঝলমলে ছুটির দিনের কথা মনে করে মনখারাপ ভাব নিয়েই সারাদিন পার করে; বিকালে ফোন দিলাম,
    —‘কখন আসবা?? শনি, রবি দুইদিন ছুটি পাবা তো? কাজ দিবে না তো’??

    সে জানান দিল, এখনো কিছু দেয় নাই, মনে হয় ছুটি পাব। তার এক ঘন্টা পর ফোন দিয়ে বলে, এসাইনমেন্ট দিছে, এখন আসতে দেরি হবে আর রবিবারও আসতে হবে। এইসব শুনলে, কেমন লাগে!! একদা একটা সময় পার করেছি জেনে, ডিফেন্সের লোকজন ইন্টারমেডিয়েট পাশ। ২০০৯ থেকে তার সাথে বসবাস করে জেনেছি যুদ্ধবিদ্যাও পড়াশোনার কম বড় ক্ষেত্র নয়; আমার পড়াশোনা কোন অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে, তার পড়াশোনা, এখনো চলছে।

    রাত্রি অন্ধকার করে বাসায় ফিরে সোহান; তারপর কোনরকম রাত পার করে সকাল হতেই আমাকে বললো,
    —আজকে অফিসে যাই, এসাইনমেন্টের কাজ আর লেখা শেষ করে একবারে জমা দিয়ে আসি, তাহলে আগামীকাল বেড়াতে যেতে পারবো।

    জামাই অফিসের কাজে বেশি ব্যস্ত থাকলে, বউয়ের চারপাশে অভিমানের বাষ্প ঘুরে বেড়াতে থাকে। কথা বলার কোন ইচ্ছাই হচ্ছিল না, যা খুশি কর গিয়া।

    সেই যে সে অফিস গেল আর আসে না; বিকেলে অভিমানেরা সরে গিয়ে কোথা থেকে মায়ার বাষ্প এসে হাজির হলো। ফোন দিয়ে শুধাই, ‘কখন আসবা, আজকে শনিবার, ছুটির দিন ছিল’। সে বলে ৬০ ভাগ কাজ হইছে, এখনো ৪০ ভাগ কাজ বাকি। এখন চলে আসতেছি বাসায়, রাত জেগে লেখা লাগবে মনে হয়। বাসায় এসে কাহিল বেচারা বলে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে এসাইনমেন্ট কলেজে জমা দিতে হবে। একটা কাজ করি, সকালে সবাই একসাথে বের হয়ে যাবো, কলেজে এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে, বেড়াতে চলে যাবো।

    কিন্তু মেয়ের অনলাইন স্কুল ঈদের পর তার পরদিন থেকেই শুরু হবে। বাংলাদেশের সময় ৯.৩০ টায় কিন্তু তানজানিয়ান সময় ৬.৩০ টায়। আমি বলি, এত অস্থির হওয়া লাগবে না। মেয়ের তো ১০ টায় স্কুল শেষ হবে, মেয়ের ক্লাস শেষ হলেই না হয় বেড়াতে যাই। এর মাঝে তুমি এসাইনমেন্ট জমা দিয়ে এসো। তখন পর্যন্ত জানি না, আদৌ যেতে পারবো কিনা বা কোথায় যাবো।

    পরদিন ৬ টায় মেয়েকে ঘুম থেকে উঠিয়ে স্কুলের জন্য রেডি করলাম। আর সোহান লেখা শেষ করে চা নাস্তা খেয়ে কলেজে রওনা হলো এসাইনমেন্ট জমা দিতে। আমি মজা করে বলেছিলাম কেউ কি তোমার জন্য অপেক্ষা করছে ওখানে, সকালে জমা দিলা নাকি দেখার জন্য। সে বলে লকার ক্লোজ করে দিবে, পরে আর দেওয়া যাবে না। আমি ঠিক জানি না দুনিয়া এত কঠিন কিনা; সে সারা জীবন তার দুনিয়া এত কঠিন হিসাবেই দেখায় আমাকে।

    সাড়ে নয়টার মাঝেই সে বাসায় চলে আসলো। ছোট মেয়ে মাত্র ঘুম থেকে উঠেছে। তাকে খাওয়াতে শুরু করলাম। আমরা রেডি না দেখে, সোহান আবার তার কাজে বসে গেলো। আমরা সব গুছিয়ে রেডি হয়ে, তাকে জানালাম এইবার টেবিল থেকে উঠেন সাহেব। তার বেশিক্ষণ লাগলো না রেডি হতে কিন্তু বাসা থেকে বের হবো কিভাবে চাবি খুঁজে পাচ্ছি না। সারা বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগলাম কিন্তু পাচ্ছি না। চারজন মিলে চারদিকে খুঁজতেছি কিন্তু নাই চাবি। শেষ আগের দিন বিকালে আমিই দরজা খুলেছি কিন্তু চাবি কই রাখলাম। কি এক যন্ত্রণা, সবসময় ভেজাল একটা লাগবেই। আমি ভয়ে ভয়ে কয়েকবার বলেই ফেললাম দরজা লক না করেই যাই। সোহান কিছু বলে না, চাবি খুঁজেই চলেছে। বুঝলাম দরজা না লাগিয়ে যাবে না।

    বহুত সময় পার করে অবশেষে চাবি খুঁজে পেলাম, মজার ব্যাপার যেখানে সবসময় রাখি সেখানেই ছিল শুধু কিছু একটার নিচে ছিল।

    মনে হলো অনেক কিছু পাড়ি দিয়ে অবশেষে গাড়ি নিয়ে বের হতে পারলাম। মাউন্ট মেরুর পাদদেশে আরুশা অদ্ভুত এক সুন্দর শহর যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০০০ ফুট উঁচুতে। কিন্তু আপনি যখন শহরে ঘুরে বেড়াবেন তখন আপনার মনে হবে না আপনি পাহাড়ে, পুরোটাই সমতল ভূমি মনে হবে। শহরের যে প্রান্তেই যান না কেন, দেখবেন মাউন্ট মেরু আলাদা রূপ নিয়ে আপনার সাথে ঘুরছে। প্রতিদিনই আমরা মাউন্ট মেরুর রুপে মুগ্ধ হই। সোহানের ভেজাল ছাড়া কোন সাপ্তাহিক ছুটি পাওয়ামাত্রই আমরা মাউন্ট মেরু দেখতে দৌঁড়াবো, ইনশাআল্লাহ। এই শহরের আরেকটা প্রশংসনীয় ব্যাপার হলো অল্প কিছু রাস্তা পরপরই নার্সারি।আমার কাছে তো মনে হয় সারা শহর জুড়ে নার্সারী। আপনার মনে হতে বাধ্য, ফুল গাছ হলেও কয়েকটা গাছ কিনে ফেলি। যেমন আমার মাথাতেও ঘুরছে। নিতান্তই গাছ লালন-পালনে খুবই খারাপ বলে, সোহানকে জোর দিয়ে বলছি না কিছু। গাড়ি এখন আরুশা শহরের একমাত্র গল্ফ কোর্সের পাশ দিয়ে যাচ্ছে। গল্ফ কোর্সের বাহিরের রাস্তার বহু বছরের পুরানো গাছের দিকে উদাসী চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে পড়ল, গাড়িতে স্পেয়ার চাকা লাগানো। দুইদিন আগে খুব সকালে সোহান কলেজে যাওয়ার সময় খুব ভয়ানক ভাবে গাড়ির টায়ার পাংচার হয়েছে। তখন থেকে স্পেয়ার চাকা গাড়িতে লাগানো। পরে জানতে পারলাম, তাপমাত্রা অনেক বেশি উঠানামা হলে এরকম হতে পারে। আরুশাতে এখন শীতকাল চলছে। সকালে রাতে ভয়ানক ঠান্ডা থাকে, সূর্য উঠলে তাপমাত্রা বাড়ে। তাপমাত্রার উঠানামায় টায়ারের ভেতরের প্রেশারের উঠানামা হয়, প্রেশার কম থাকলে খারাপ দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। এসব জানার পর থেকে আমি খুবই ভয়ে থাকি; সোহান সেই সকালে অফিসে যায়, রাতে আসে; তাই তার আর সময় হয় না ঠিক করার।

    এই বেড়াতে যাওয়ার সময় আমি যদি এটা নিয়ে কিছু বলি, ঝাড়ি খাওয়ার সমূহ চান্স আছে। তাই আমি ঘুরিয়ে সোহানকে বললাম, তোমাকে খুবই সাহসী বলতেই হয়। স্পেয়ার চাকা গাড়িতে লাগিয়ে বউ বাচ্চাসহ ঘুরে বেড়াচ্ছ।

    সে হেসে বলে, ‘সাহসী না বেকুব মানুষ, বেকুব মানুষের সাহস বেশি থাকে।‘ আমি বললাম, ‘আমি এই কথা বললে তো মুখ বেজার হয়ে যাইত তোমার’।

    প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য তখন সে আমাকে জানালো আমরা ডুলুটি লেকে যাচ্ছি। আরুশা থেকে মাত্র ১৪ কি.মি দূরে। যেহেতু আমাদের হাতে সময় বেশি নাই, আমরা এখানে ঘুরে ফিরে বিকালের মাঝে বাসায় চলে আসতে পারবো। মেইন রোড থেকে আমরা শাখা রোডে এখন উঠলাম। আরুশার মেইন রোড খুবই ভালো, বাম-ডানহীন সোজা রাস্তা, কিন্তু শাখা-প্রশাখা রাস্তার অবস্থা বেশি ভাল না, সব মাটির রাস্তা। আগের সপ্তাহে আমরা ঝর্ণা দেখতে গিয়ে, পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে যেতে হয়েছিল। সে অভিজ্ঞতার আলোকে এখন মাটির রাস্তা দেখলেই ভয় লাগে। লেকের ১ কি.মি বাকি থাকতে সোহান বলল, গাড়িটা এখানে রেখে আমরা বাকি রাস্তা হেঁটে যেতে পারি। ড্রাইভার সাহেব এই কথা বললে তখন তো অন্য কিছু বলার অপশন থাকে না। আমার একটু খচখচ লাগছে, গাড়ি এমন রাস্তার পাশে রাখলে কি ভালো দেখায়, অন্য কোন জায়গায় রেখে যেতে পারলে ভালো হতো। ১২ বছর সংসার করে আমি এখন এটুকু বুঝে গেছি এসব বলে আসলে লাভ নাই, মাঝখান থেকে আমার বেড়ানো হবে বেজার মুখে। তারপরও আমার ভাল লাগে নাই এই খানে গাড়ি রাখা, এইটা তো জানানো উচিত; তাই এক/ দুইবার এসব বলে, দুই মেয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করলাম তার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই। ছোট মেয়ে নিয়ে বেশি সমস্যা না, সে মনের আনন্দে দৌড়াবে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার জন্য পোজ দিবে। সব সমস্যা বড়টাকে নিয়ে, সে হাঁটতে চায় না, পুরোটা সময় প্যানপ্যান করতে থাকবে, আর কত দূর হাঁটতে হবে, পা ব্যথা করতেছে, বাবা কেন গাড়ি নিয়ে আসলো না, ওখানে যাওয়ার কি দরকার ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ছোটটাকে নিয়ে সামনে সামনে হাঁটতে থাকলাম। এক তানজানিয়ান বুড়া সাইকেল চালিয়ে পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সোহানকে কি কি যেন বললো। ভাষা কিছু বুঝা যায় না। কিন্তু ভাব দেখে মনে হলো, আমাদের দেশের বুড়োরা রাস্তায় কাউকে দেখলে বলে না, ‘কই যাও?? লেকে যাবা?? হ হ সামনেই সামনেই, যাও যাও।‘ আমার দেখে মনে হলো এটাই বলছে। দুসপ্তাহ আফ্রিকায় বসবাস করে আমার মনে হয়েছে, আফ্রিকান মানুষজন সহজ-সরল। সাইজে একটু বড়সড় কিন্তু ওরা মানুষ খারাপ না।

    খানা খন্দ পার হয়ে সোহান বললো, ঝরা এখান দিয়ে তো গাড়ি যাবে, তোমরা সামনে আগাও, আমি গাড়ি নিয়ে আসি।

    আমি ভালো মানুষের মত বললাম, আচ্ছা। নয়তো এখানে আমি তো বলতেই পারতাম, গত সপ্তাহে কি ভয়ানক উঁচুনিচু রাস্তা পার হয়ে পাহাড়ে উঠে গেলা আর এই সপ্তাহে সমতলে একটু কাঁদাপানি দেখে গাড়ি রেখে আসতে হইলো! বয়স হয়েছে তো তাই এখন আর এইসব হাবিজাবি কথা বলি না। আমার সবকিছুতে সেও হুঁ বলে, আমিও তার সব কিছুতে হুঁ বলি।

    সোহান গাড়ি নিয়ে চলে এসেছে প্রায়, সেবন্তি গাড়ি দেখেই দাঁড়িয়ে গেল, গাড়িতে উঠবে। ছোট মেয়ে উঠবে না, সে হাঁটবে। আমি বললাম লেকে গিয়েও হয়তো হাঁটতে হবে, আগে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে যেও না। সে রাজি হইলো, আমরা সবাই আবার গাড়িতে উঠলাম। এই রাস্তাটা আমাদের গ্রামের মেঠো পথের মত। পার্থক্য হলো চারপাশে অনেক গাছপালা, সূর্য উঠে নাই বলে এক টার মত বাজলেও অনেক ঠান্ডা। চারপাশটা ভেজা ভেজা লাগছে। লেকে পৌঁছানোর ৫ মিনিট আগে সোহানের আবার মনে হলো গাড়ি সাইড করে রেখে যাবে। আমরা আবার গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। সে গাড়ি সাইড করে রেখে আমাদের সাথে, হাঁটা শুরু করলো। অল্প সামনেই একটা ক্যাম্প সাইট দেখতে পেলাম। ভেতরে রেষ্টুরেন্ট আছে। রেষ্টুরেন্টের সামনে শেড দেওয়া বসার জায়গা। লেকের চারপাশে অনেক গাছপালা আর উঁচু উঁচু পাহাড়। লেকের পাড়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকেও বসার জায়গা আছে। আরো অনেক ইউরোপীয় টুরিস্ট ছিল। ওরা খোঁজখবর নিচ্ছিল বোটে করে ঘুরতে কত লাগে। লেকের চারদিকে সরকারি ভাবে ওয়াকওয়ে বানানো। সেখানে হাঁটতে হলে টিকেট কাটা লাগবে। বোটে ঘুরতে আমাদের কাছে জনপ্রতি ৩০ ডলার চাইলো। চারজনের নৌকাভ্রমণ খুবই ব্যয়বহুল হয়ে যাবে। আমরা ওখান থেকে চলে আসছিলাম, তখন বললো আমাদের জন্য কমিয়ে ২০ ডলারে দিবে। সেটাও তো আমাদের জন্য অনেক হয়ে যায়। সেখান থেকে বের হয়ে হাঁটবো ভাবছিলাম কিন্তু পাশেই আরেকটা কিছুটা সাদামাটা ক্যাম্প সাইট দেখে ওখানে ঢুকে গেলাম। সেখানেও একটা রেষ্টুরেন্ট আছে, রেস্টুরেন্ট দেখলেই আমার বড় মেয়ের চিকেনের ক্ষুধা পায়, আর ছোট মেয়ের ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের ক্ষুধা। এখানে খাবার অর্ডার করতে করতে জানতে চাইলাম নৌকায় ঘুরতে কত লাগবে , তানজানিয়ান একটা ছেলে হোসেইন জানালো, পুরোটা ঘুরতে ৮০০০০ শিলিং আর অর্ধেক ঘুরতে ৪০০০০ শিলিং লাগবে। আমাদের জন্য খুবই চমৎকার প্রস্তাব। সোহান তার সাথে কথা বলে সব কিছু ঠিকাঠাক করে গেল গাড়ি ক্যাম্প সাইটে নিয়ে আসতে।

    এতক্ষণে লেকের পাশে একটু শান্তিতে বসতে পারলাম। ডুলুটি লেক হচ্ছে ভল্কানিক ক্রেটার লেক। অগ্নুৎপাতের কারনে পাহাড়টা মাঝখানে গলে দেবে যায়, আর চারদিকে অবশিষ্টাংশ পাহাড় উঁচু পাহাড় হয়ে রয়ে যায়, অনেকটা বেসিনের মত। সোহান বলল তানজানিয়ায় এরকম অসংখ্য ভল্কানিক ক্রেটার আছে। বেশির ভাগই তৈরি হয়েছে আড়াই মিলিয়ন বছর আগে। আগ্নেয়গিরিগুলো সব মৃত। তবে দুটো নাকি এখনও মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি দেয়। উঁচু পাহাড়ে ঘেরা সবুজ ডুলুটি লেকের সামনে দুই বাচ্চা নিয়ে আমি অতি সাধারণ এক বাংলাদেশি মেয়ে বসে আছি। আমি কখনো কল্পনাও করি নাই মহান আল্লাহতায়ালা আমাকে এইখানে আসার সুযোগ করে দিবেন। আমি ফিরে ফিরে শুধু এই লেকের সৃষ্টির সময়টাতে চলে যাচ্ছিলাম। কি ভয়ানক শক্তিমত্তার আস্ফালন চলেছে এখানে!! পৃথিবী তার ভেতরকার যত উত্তাপ, অস্বস্তি, উম্মাদনা বের করে দিয়ে শান্ত-শীতল লেক হয়ে গেল।

    রোদ উঠেছে, রোদ উঠলেই সেটা তীব্র হয়ে যায়। গরম কাপড় খুলে ফেলতে হচ্ছে। প্লাস্টিকের টেবিলের উপর জড়ো করে রেখে দিলাম। বাচ্চারা বিরক্ত করছে। লেকের পাড়ের মাটিতে তারা নানারকম পোকা খুঁজে পাচ্ছে। ছোট মেয়ে পা মাটিতে ফেলতেই পারছে না আর বড় মেয়ে এক কুকুরের ভয়ে সেঁটিয়ে আছে। তাদের বাবা এসে বকা দেওয়ার চেষ্টা করছে, এত ভয় পাওয়ার কি আছে?? যথারীতি তার বকাঝকায় কোন কাজ হচ্ছে না, মেয়েরা আতংকিত হয়ে রয়েছে। অন্য পাশে একটু পাকা মত জায়গা ছিল, মেয়েদের নিয়ে সেখানে গিয়ে বসার পর তারা ঠান্ডা হলো। হোসেইন এসে জানালো চিকেন দিতে দেরি হবে। আমরা বললাম কোন সমস্যা নাই, নৌকাভ্রমণ শেষ করে চিকেন খাওয়া যাবে। আপাতত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিলেই হবে। সোহান মেয়েদের পাখি দেখাচ্ছে, আমরা যেখানে বসেছি তার খুব কাছেই বড় একটা মাছ রাঙ্গা পাখি বার বার ঘুরে ঘুরে আসছিল। বাবা মেয়েরা মহা উৎসাহে পাখি দেখা শুরু করলো।

    ফ্রেঞ্চ ফ্রাই দিয়ে গেলো। এ কয়দিন তানজানিয়ান বিভিন্ন রেষ্টুরেন্টে খেয়ে মনে হলো ওরা খাবারে লবণ কম দেয়। ফ্রেঞ্চ ফ্রাইতে একদম লবণ দেয় না। লবণ নিজেরা দিয়ে খেতে হয়। এখানে অনেক বানর গাছের ডালে ডালে লাফাচ্ছে। নৌকায় ঘুরার সময় অতিরিক্ত কাপড়গুলো লেকের পাড়ে রেখে যাওয়ার সাহস হলো না, সোহান গাড়িতে রেখে আসলো। হোসেইন নৌকা চালাবে। চার সিটের নৌকা, মেয়েরা তাদের পছন্দমত জায়গায় বসে গেল।

    লেকের পাড় ঘেঁষে নৌকা চলছে। এত গাছপালা যে লেকের পাড়ে যে ওয়াকওয়ে আছে সেটা বোঝা যায় না। আমি হোসেইনকে জিগ্যেস করলাম, ওয়াকওয়ে দিয়ে হাঁটার সময় কি লেক দেখা যায়, আমি তো কোন রাস্তা দেখতে পাচ্ছি না। যেখানে গাছপালা একটু হালকা হয়ে আসে, সেখান দিয়ে লেক দেখা যায় জানালো সে। সোহান বললো আরেকদিন আসা লাগবে হাঁটার জন্য। হোসেইন জানালো ৪ কিমি এর মত ওয়াকওয়ে। টিকেট কাটতে লোকালদের জন্য লাগবে ২০০০ শিলিং আর টুরিস্টদের জন্য লাগবে ২৩০০০ শিলিং। ১০০০ শিলিং ৩৬ টাকার মত। সব জায়গাতেই টুরিস্টদের কাছে থেকে এত পয়সা নেওয়া হয়, খুব খারাপ দুনিয়া!!

    মাথা উঁচু করে পাহাড় দেখছিলাম। পাহাড়ের উপরের বাড়িগুলো ছোট ছোট দেখা যাচ্ছে। ঐ উপর থেকে লেকটা কেমন দেখা যায় সেটাও যদি দেখা যেত! পাহাড়ের উপর চোখে পড়ার মতো সুন্দর একটা বাড়ি দেখা গেল, সেটা এক জার্মান ভদ্রলোকের বাড়ি। তানজানিয়ান সরকার তাকে এই বাড়ি দিয়েছেন। পরে গুগল করে জানলাম ১৯৫৯ সালে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট গোরংগোরো ক্রেটার সংরক্ষণের কাজে তার অবদানের জন্য খুশি হয়ে তানজানিয়ান সরকার তাকে এই বাড়ি উপহার দিয়েছে। ওখানে তাকালে এরকম একটা বাড়ির লোভ আপনারও হবে। সোহান অবশ্য এখানে বাড়ি বানাতে খরচ কেমন হবে হোসেইনের সাথে হিসাব-নিকাশ করে জানান দিলো, এখানে সে একটা বাড়ি কিনতে পারবে; আমি বললাম, শুধু দেশ থেকে প্রতিবছর এত টাকা খরচ করে সে বাড়ি দেখতে আসা হবে না আমাদের।

    লেকের পানি একদম সবুজ কিন্তু টলটলে পরিস্কার। আমাদের সামনেই একটা আফ্রিকান মেছো ঈগল বড় একটা মাছ শিকার করে দ্রুত নিয়ে গেলো। হোসেইন ধীর গতিতেই নৌকা বাই ছিল আর সোহানের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। এই লেকে সাঁতার কাটা এবং মাছ ধরা নিষেধ। লেকটি ভি-শেপ, মাঝখানে বেশ গভীর; প্রায় ১৫০ মিটারের মত বলে জানাল হোসেইন। লেকটি পাড় থেকে ধীরে ধীরে মাঝ বরাবর গভীর হয়ে গিয়েছে। সারাবছরই লেকে এমন পানি থাকে, ভূ-গর্ভস্থ পানি আর সারাবছরের বৃষ্টিপাত লেকের পানির উৎস। লেকের পানির উপরেই যে গাছপালা তাতে অনেক বাবুই পাখির বাসা দেখতে পেলাম। এছাড়া বড় পুরানো একটা গাছের উপর দেখলাম বিশাল বড় একটা পাখির বাসা। সোহান জানালো এটা হামার কপ পাখির বাসা। অনেক প্যাপিরাস গাছ; ঐ যে ছোট বেলায় পড়েছিলাম আমরা, প্যাপিরাস গাছ থেকেই কাগজের উৎপত্তি। ঝোপের নিচ দিয়ে পানকৌড়ি আর ডাহুক পাখি ঘুরছিল, মানুষের সাড়া পেয়ে লুকিয়ে গেলো।

    সোহান কথায় কথায় হোসেইনকে জানালো আমি সোহেলী ভাষা শিখছি। আমি কটমট চোখে সোহানের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু আমার চোখের সাইজ খুব খারাপ, হাসলে বেশির ভাগ সময় চোখ বন্ধ হয়ে যায়। তাই কটমট তাকানো, বাসার লোক ছাড়া কেউ বুঝতে পারে না। হোসেন খুবই আগ্রহ সহকারে আমার দিকে তাকালো। আমার তখন ‘হাবারি’ ছাড়া কিছু মনে পড়ছে না। হাবারি মানে হলো হাই বা হ্যালো। আরও বলতে পারলাম, ‘মিমি নি সুরাইয়া’আমার নাম সুরাইয়া, ‘নাইস টু মিট ইউ’ শিখেছিলাম কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না, শুধু শেষের ‘না উইয়ে উইয়ে’ মনে পড়ছিল। হোসেইন নতুন একটা শব্দ শিখালো, ‘পোলে’ সহেলি ভাষায় অর্থ দুঃখিত কিন্তু ‘পোলে পোলে’ অর্থ ধীরে। এছাড়া কারিবু মানে হলো স্বাগতম, আসানতে মানে ধন্যবাদ, আসানতে সানা মানে অসংখ্য ধন্যবাদ।

    লেকের পাড় দিয়ে চলতে চলতে লেকের মাঝখানে চলে আসলাম, এখন মাঝ বরাবর আমাদের ফিরিয়ে নিবে ঘাটে। ততক্ষণে সূর্যের আলো চলে গিয়েছে, সূর্যের আলো চলে গেলেই এত পিনপিন করা ঠান্ডা লাগে,মেয়েদের জন্য টেনশন লাগছিল, গরম কাপড় তো সব রেখে এসেছি। এতক্ষণ এত ধীরে চলছিল নৌকা, লেকের মাঝখানে দিয়ে ফেরার পথ দেখে মনে হলো নৌকা বেয়ে এই পথ পাড়ি দিতে তো রাত নেমে যাবে। কিন্তু আসলে বেশিক্ষণ লাগেনি। আমি শুধু পাহাড়ের উপর তাকাই আর ভাবি, ওখান থেকে লেকটা না জানি কত সুন্দর দেখায়, একটু যদি দেখা যেত; আহা! আমার যদি থাকত পাখির চোখ।

    আমরা ঘাটে চলে আসলাম। দিন শেষ হয়ে যায়নি কিন্তু নীল আকাশের রঙয়ে লেকের সবুজ পানিও নীল হয়ে গিয়েছে। ফিরে যাওয়ার আগে, আমি আর সোহান শুধু ছবি তুলছিলাম। ক্যামেরাবন্দী প্রতিটা ছবি অপরূপ লাগছিল। মেয়েরা বাবামায়ের এই ছবি তোলার আতিশয্যে অতিশয় বিরক্ত হচ্ছিল। অর্ডার করা চিকেন প্যাকেট করে দিল হোসেইন। সেটা নিয়ে, মেয়েদের গাড়িতে তুলে, আবার ফেরার পথ ধরলাম।

    আহ শান্তি!! তিন/চার ঘণ্টার ডুলুটি লেকের এই ভ্রমণ মনকে চড়ুই পাখির মত চঞ্চল করে দিল। আবার কবে কোথায় যেতে পারবো, তা তো জানি না। ততদিন পর্যন্ত ডুলুটি লেকই না হয় মনের আঙিনায় ফিরে ফিরে আসুক।

    চলবে…

  • সুন্দরবনের গল্প

    সুন্দরবনের গল্প

    “আপনি তো দেখি মাঝে মাঝেই জঙ্গলে ঘুরেন ফিরেন। তা দু’ একটা গল্প শোনান না দেখি”
    ভারী ঝামেলায় পড়ে যাই। জঙ্গল তো শখে বেড়াবার জায়গা নয়। এই যেমন গতবার সুন্দরবনে গিয়ে মহা ফ্যাঁকড়া হয়েছিলো। শীত আর কুয়াশায় সব ঢাকা। সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না মোটেও, পাখ পাখালি দেখবো কোত্থেকে? লঞ্চশুদ্ধু মানুষের মুখ বেজার। সকালের সাফারি না হলে তো দিনটাই মাটি। আমার কিন্তু বেশ লেগেছিলো। কুয়াশায় ঢাকা চারপাশ। চরাচরে অদ্ভুত নিঃস্তব্ধতা। লঞ্চ অ্যাংকর করবার পরে সবাই যে যার মতন ডেকে ব্রেকফাস্ট সারছে, আর আমি চায়ের কাপ হাতে ব্রীজে চলে এসেছি। কুয়াশা খানিকটা পাতলা হয়েছে এখন। প্রথম আলোর মিঠে ফলাটা হয়ত খানিক বাদেই শিশিরে ভেজা গাছের পাতায় পড়ে ঝিকিয়ে উঠবে। নিঃস্তব্ধতা ভেঙ্গে কুয়াশার আড়াল থেকে একটা বনমোরগ ডেকে উঠলো। আহাঃ ঢাকার এই ইঁট পাথরের পাঁজায় অমন অনুভূতি কি আসবে? জঙ্গল তো অনুভূতির ব্যাপার। এখানে গল্প আসবে কোত্থেকে? মনের কোনে আঁতিপাঁতি করে খুঁজলাম। নাঃ তেমন কোন গল্প নেই। তবে দু’ একটা ঘটনা যে নেই তা বলবো না। যারা জঙ্গল ভালোবাসেন তারা লেখা ধরে এগোতে পারেন।

    ঘটনাটা সুন্দরবনেরই,শরণখোলা রেঞ্জের। মাত্রই জঙ্গলে দীর্ঘ, ক্লান্তিকর হাইকিং সেরে, নাকে মুখে কিছু গুঁজে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। এমন সময় দলনেতা হাঁক দিলেন, টাইগার টিলার দিকে একটা “ছোট্ট হাঁটা” দেবার জন্য। যারা আজ দুপুরে জঙ্গলে হাইকিং মিস করেছেন তাদের জন্য। আমি ঐ দলে পড়ি না, তবুও দলনেতার অনুরোধে রাজী হয়ে গেলাম। যাই হোক, বোট যখন আমাদের ঘাটে নামিয়ে দিলো তখন বিকেল ঢলে এসেছে। হঠাৎ মনে পড়লো আমার আসরের নামাজ তখনও পড়া হয়নি। কেউ একজন বুদ্ধি বাতলে দিলো, সামনেই চাঁদপাই রেঞ্জের বিট অফিস। ওখানে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা না থেকেই যায় না। সন্ধ্যের খানিকটা মুখেই নেমেছি, হিসেব করে দেখলাম কোনোভাবেই নামাজ শেষ করে দলের বাকীদের সাথে “ছোট্ট হাঁটা” শেষ করে মগরেবের আগে ফিরতে পারবো না।

    তথাস্তু!
    দলনেতা নিপাট ভদ্রলোক। আমাকে আশ্বস্ত করলেন ফেরার পথে তিনি আমাকে তুলে নিয়ে যাবেন। সুতরাং দলের সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমি বিট অফিসের দিকে পা বাড়ালাম।
    জঙ্গলের বিট অফিস যেমন হয় আর কি, পুরনো নোনাধরা দেয়াল। বহু বছরের সাইক্লোন আর জলচ্ছ্বাসের ক্ষতচিহ্ন বহন করে চলেছে। কাঠের জানালার কবাট আর মরচেধরা শিক দেখলে সহজেই বয়স অনুমান করা যায়। বারান্দায় চোঙ্গামুখো এক লোক বিড়ি ফুঁকছিলো। ওযুর জায়গাটা কোথায় জিজ্ঞেস করতেই আপাদমস্তক ভালো করে দেখে উত্তর দিলো, “ওযুর তো কাছাকাছি তেমন কোনো জায়গা নেই। তবে নাক বরাবর পশ্চিমে গিয়ে উত্তরের জঙ্গলে ঢুকবেন। ওখানে বড় একটা দীঘি আছে”।

    সূর্যাস্তের বড় একটা বাকী নেই। নদীতে কুয়াশা নামছে। আমি তড়িঘড়ি পা চালালাম। দীঘি খুঁজে পেতে অসুবিধে হলো না। বিট অফিস থেকে খুব একটা দুরে নয়। সূর্যের আলো গাছের মাথায় উঠে গেছে। নীচের ঝোপঝাড় গুলোয় সাঁঝের আঁধার। ঝিঁঝির ডাকে একদম সরগরম পুকুরপাড়! আমি পাঁক-কাঁদা এড়িয়ে কিভাবে ওযু সারবো ভাবছিলাম। শাণ বাঁধানো ঘাট মতন আছে একটা, এক কালে হয়তো ব্যবহারযোগ্য ছিলো। কালের বিবর্তনে সিমেন্ট আর ইঁটের বড় একটা চাঙড় ছাড়া ওর আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। বিপজ্জনক ভাবে একপাশে কাত হয়ে আছে। ওখানে ভারসাম্য রেখে ওযু করাটাও রীতিমতো কসরতের ব্যাপার। সময় অল্প, যা থাকে কপালে ভেবে আমি ওযু করতে লেগে গেলাম। কুমির থাকবে না জানি, কিন্তু বিকট দর্শন মনিটর লিজার্ডের ব্যাপারে আমার এলার্জি আছে। যতই নিরীহ হোক, আমি এদের হাত থেকে দশ হাত দূরে থাকতে চাই। উঁহু, ভূল হলো। পঞ্চাশ হাত হলেই বরং ভালো। একবার ক্লোজ শট নেবার জন্য কাছাকাছি গিয়েছিলাম। ভীষণ অলস আর শ্লথ গিরগিটি টার কাছাকাছি যেতেই কি ভয়ংকর দ্রুত ছুটে হারিয়ে গেলো নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ঐ জিনিস পঞ্চাশ হাত দূরে থাকাই কাম্য। ছোট আকারের কচুরিপানায় ভরা পুকুর। একহাতে ওরই খানিকটা ঠেলে সরিয়ে জায়গা করে নিলাম। যেই না মুখে পানি দিয়েছি ওমনি আমার অস্বস্তি হতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ ঠাহর করবার চেষ্টা করলাম, কিসে অস্বস্তি হচ্ছে! কেউ কি আড়াল থেকে আমার দিকে নজর রাখছে? সূর্য ডুবে যাবে পনেরো/কুড়ি মিনিটের মধ্যেই। বাঘের জেগে ওঠার সময়। তাহলে কি কোন বাঘ ঝোপের আড়াল থেকে আমার ওপর নজর রাখছে? খেয়াল হলো ঝিঁঝিঁর ডাক বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ নীরবতার জন্যই কি অস্বস্তি হচ্ছে?

    কিন্তু ঝিঁঝিঁর ডাক হঠাৎ বন্ধ হলোই বা কেন? আশেপাশে ভালো করে লক্ষ্য করলাম। নিস্তব্ধ জলা, ঝোপঝাড় আর বনভূমি। খানিক আগেও এ ডাল, ও ডালে কয়েকটা কাঠবেড়ালী লাফাচ্ছিলো। শীতের শেষ, কয়েকটা কাজলচোখ বেনেবউয়ের ডাকও শোনা যাচ্ছিলো, এখন সেটাও বন্ধ। অবশ্য বাঘ আড়াল নিয়ে থাকলে সেটা দেখার মতন চোখ আমার হয় নি। অগত্যা কেউ আমাকে চুপিসারে লক্ষ্য করছে এমন অস্বস্তি নিয়েই ওযু সারতে হলো।

    ফেরার পথে কোন অঘটন ঘটলো না। নামাজ শেষে বিট অফিসার চায়ের নিমন্ত্রণ করলেন। ভদ্রলোক সদালাপী। নাকের নীচে নিরীহ দর্শন পাতলা একজোড়া গোঁফ ঝুলছে। চেহারায় বিট অফিসের মতোই বহু বছরের অভিজ্ঞতার ছাপ। শরণখোলায় বছর পাঁচেক আগে পোস্টিং হয়েছে। পরনে হাফহাতা শার্ট আর লুঙ্গি। চায়ের ফরমায়েশ দেবার মিনিটখানেকের মধ্যেই চা হাজির। পায়ের ওপর পা তুলে আয়েশ করে সিগারেট ধরালেন ভদ্রলোক। চা-সিগারেট-আড্ডা চললো একসাথেই। জঙ্গলের আড্ডায় নতুনদের যা হয় আর কি। অবধারিতভাবেই বাঘের প্রসঙ্গ এসে পড়ে।

    আমারও ব্যতিক্রম হলো না। জিজ্ঞেস করে বসলাম।
    : বাঘ দেখেছেন?
    ভদ্রলোক নিরাসক্ত হাসি দিলেন।
    : বাঘ কিভাবে দেখবো বলুন? আমাদের ডিউটি সন্ধ্যায় শেষ আর তার ডিউটি সন্ধ্যার পরেই শুরু। দিনের বেলায় মাঝে সাঝে বেরোয় বটে, কিন্তু এত ডেন্স কাভার নিয়ে থাকে যে আপনার দশফুটের মধ্যে চলে এলেও টের পাবেন না।

    আশ্চর্য হলাম।
    : এত লম্বা চাকরি জীবনে একবারও দেখেন নি?
    ভদ্রলোক চওড়া হাসি দিলেন।
    : আপনি দেখছি সাংবাদিকদের মতই নাছোড়বান্দা। বাঘের কথা উঠলে লোকজন প্রশ্ন করেই যেতে থাকে। আমিও চুপচাপ হ্যাঁ, হুঁ এর মধ্যেই সেরে ফেলি।

    বাঘের রাজত্বে থাকি, না দেখে উপায় কি বলুন?

    সুন্দরবনে বাঘ দেখা রীতিমতো দুরহ ব্যাপার। বাঘ দেখার ঘটনা জানার কৌতূহল আছে ষোলআনাই, এদিকে মগরেবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। অভিজ্ঞতায় দেখেছি বাঘ দেখেছে এমন ঘটনা কেউ রসিয়ে বলতে চায় না। পেট থেকে কথা বের করবার জন্য নানান কসরত করতে হয়, নিতান্তই ঝক্কির ব্যাপার। বরং আমার মতন যারা দেখেন নি তারাই ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ঢোল বানায়।

    ভদ্রলোক বাঘের ব্যাপারে নিতান্তই বেরসিক। শেষ চেষ্টা চালালাম।
    : এই বিটে তাহলে বাঘ বড় একটা দেখা যায় না, কি বলেন?
    : যায় বৈ কি! ওই যে টাইগার টিলা আছে, ওখানেই একটা বাঘিনী আছে। গত বছরই দুটো বাচ্চা দিয়েছে।

    এই তো পরশুদিনের ঘটনা। চোরাচালানিরা গাছ কাটছে এমন একটা খবর পেয়ে আমরা রেকি করতে গেলাম। আমরা মানে আমি, আমার এসিস্ট্যান্ট আর দুইজন বনরক্ষী। টাইগার টিলার কাছাকাছি পৌঁছে আমরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে খোঁজ করছি ঠিক এই সময় কানে তালা লাগানো ভয়ংকর গর্জনে হৃদকম্পন বন্ধ হবার যোগাড়। একজন বনরক্ষীকে দেখলাম পাগলপারা হয়ে ছুটে আসছে। আমি কোনরকমে একটা ব্ল্যাংক ফায়ার করেই দে ছুট। পেছন পেছন দু’জন বনরক্ষী।

    একদম ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়। একদম এই বীট অফিসে এসেই থেমেছি। ভাবতে পারেন?
    : আর আপনার এসিস্ট্যান্ট?
    : বলছি……. ভদ্রলোক পানের ফরমায়েশ দিয়েছিলেন বোধকরি। একজন পান দিয়ে গিয়েছিলো।
    সেটার ভেতরে কতটা চুন আর সুপুরি আছে সেটা নিয়ে খানিকটা বেগড়বাই করে পানের খিলি মুখে চালান দিয়ে আবার শুরু করলেন…. মুক্তার সাহেব (কাল্পনিক নাম) যে আমাদের সাথে নেই সেটা একটু পরেই টের পেলাম। ভয়ও লাগলো, কারণ বাঘে তাড়া করলে তাকে বিট করে আমাদের পক্ষে পালিয়ে আসা সম্ভব না। যদি না সে অলরেডি কাউকে ধরে থাকে। মুক্তার সাহেব কি ধরা পড়লো কি না সেই টেনশনে আমি অস্থির। আবারও টাইগার টিলায় যেয়ে বাঘের মুখে পড়ার ইচ্ছে নেই কারও। কিন্তু অবস্থা এমন যে যেতেই হবে। কাজেই আবারও রওনা দিলাম। এবারে তিনজনই একসাথে। একটু পর পর চেঁচিয়ে মুক্তার সাহেবের নাম ধরে ডাকছি, আর কান পেতে শুনছি কোন সাড়া পাওয়া যায় কি না। এভাবেই চললো খোঁজ। আমি মোটামুটি আধঘন্টার মধ্যেই শিওর হয়ে গেলাম মুক্তার সাহেবের কপাল খারাপ। এখন বীট অফিসে ফিরে গিয়ে লোকজন যোগাড় করে আসতে হবে। এই সময় আমার কানে হালকা আওয়াজ এলো, কে যেন ডাকছে। সবাইকে চুপ করতে বলে আবারও কান পাতলাম। মুক্তার সাহেবই।

    গল্পের এই সময় পাশের রুমে কালো মতন এক ভদ্রলোক যাচ্ছিলেন, হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন। খালি গা, গায়ে গামছা দেখে অনুমান করলাম গোসল সেরে এসেছেন। গল্পের মাঝখানে ফোঁড়ন দিলেন ভদ্রলোক,
    : স্যার, আমি কিন্তু আপনাদের মতন পালিয়ে যাই নি। গাছে উঠে বসে ছিলাম। আপনারা যেই দৌড়টা দিলেন। হা হা হা।

    অনুমান করলাম ইনিই মুক্তার সাহেব। বীট অফিসার ভদ্রলোক একটু উঠে বারান্দার জানালা দিয়ে পানের পিক ফেললেন, তারপর দাঁত বের করে হেসে বললেন,
    : তুমি মিঁয়া যেই ভয় দেখাইলা! আমি তো ভাবছিলাম কিছু হয়ে গেলে ভাবীকে কিভাবে কথাটা বলবো….

    আমার দিকে তাকিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন….. এই যে ইনিই মুক্তার সাহেব। নাও মুক্তার মিঁয়া, তোমার গল্প বলো ভাইজানরে।

    তারপর একগাল হেসে উঠে যেতে যেতে বললেন, আমাকে আজকে মাফ করতে হবে ভাই, আমাদের পেট্রোল করার বোটটার বেহাল দশা, একটু দেখে দিতে বলছে ক’দিন ধরেই। ডকে দেবো নাকি জোড়াতালি দিয়েই চলবে একটা ডিসিশান নিতে হবে….
    : স্যার ওর আয়ু শেষ, আপনাকে আগেও বলছি…

    মুক্তার সাহেবকে কপট রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেলেন বীট অফিসার ভদ্রলোক। যাবার আগে বললেন, তুমি তো মিঁয়া বইলাই খালাস। বাজেটে না থাকলে কিভাবে ডকে দিবো? নিজের পকেট থিকা?!…

    মুক্তার সাহেব অমায়িক মানুষ। চা খেয়েছি কি না জিজ্ঞেস করলেন, খালি কাপ দেখেই বোঝার কথা যদিও। মগরেবের নামাজে যাবেন, অনুমতি চাইলেন।

    আমিও নামাজ পড়বো, ওঠার সময়ও হয়ে এসেছে।

    বিদায় নিলাম। সাবধানে ফেরার উপদেশ দিলেন ভদ্রলোক।
    : বাঘ তো এদিকে আসে না, কি বলেন?….আমি নিশ্চিত হতে চাইলাম।
    : প্রায়ই জল খেতে আসে এখানে। বাচ্চা সহ, উত্তরে যেই বড় দীঘিটা আছে না? ওখানে।
    আঁতকে উঠলাম। ওখানেই একটু আগে ওযু সেরেছিলাম।
    : একা ফিরতে পারবেন তো?

    সাঁঝের আঁধার নেমে গেছে। যদিও আমার দলনেতা বন্ধু আমাকে তুলে নিয়ে যাবেন বলেছিলেন। তার এত দেরি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এত লোক ম্যানেজ করতে গিয়ে ভুলে যাওয়াও দোষের কিছু নয়। মুক্তার সাহেবের কথা আমার অহমে লাগলো। হাত নেড়ে বললাম ঘাট তো কাছেই, আমার অসুবিধে হবে না। নামাজ শেষে যখন বীট অফিস থেকে বেরোলাম তখন চাঁদের আলো ছাড়া দ্বিতীয় কোন আলো নেই। সামনেই এক পশলা জঙ্গল। বাঘ যদি ওখানে গুঁড়ি মেরে পড়ে থাকে আমার বাপেরও বোঝার সাধ্যি নেই। নদীর তীর ঘেঁষেই ফিরবো ঠিক করলাম। সেদিন কিভাবে একা একা ঐ রাস্তা দিয়ে ফিরেছিলাম এবং অন্ধকার মাড়িয়ে আধঘন্টা পরে আবারও বীট অফিসে ফিরে এসেছিলাম সে আরেক কাহিনী।

    আজকে আপাতত এইটুকুনই থাক।

    পরিব্রাজক
    কটকা, শরণখোলা রেঞ্জ, সুন্দরবন
    ডিসেম্বর, ২০২০

  • আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-২)

    আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-২)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    লজিং মাস্টার
    আনোয়ার হাকিম

    পর্ব-২
    আরেকটা বিপদ আচমকা যুক্ত হলো। এই চারতলা ফ্ল্যাট বাড়ীর একটিতে যে আমার সহপাঠী কেয়ারা ভাড়া থাকে তা আমার জানা ছিলো না। আমি মেয়েদের এড়িয়ে চলি। তবে সব সময় পারিও না। ভাল ছাত্রের তকমা থাকায় সহপাঠীরা পাঠোদ্ধারের জন্য আসত। তাদের মধ্যে মেয়েরাই একটু বেশি। এদের বিভিন্ন ছল, বিভিন্ন আবদার। সবই বুঝি কিন্তু মেধাবীর স্বীকৃতির ঘ্রাণ সুমিষ্ট বোধ হওয়ায় এড়িয়ে যেতেও মন সায় দেয় না।

    একদিন শীতের বিকেলে দুরন্ত বিপ্লবকে বশে আনবার প্রয়াসে ব্যাট বল খেলছিলাম। প্রশস্ত ছাদের এক কোণায় শুকনো কাপড় নেওয়ার নাম করে ছায়ার ছায়া ঘুরঘুর করছে। এমন সময় অকস্মাৎ কেয়া এসে হাজির। আমাকে দেখে সে সশব্দে এমন আবেগ প্রকাশ করলো যেন পারলে সিনেমার নায়িকার মত দু’হাত প্রশস্ত করে বাহুলগ্না হয়। সেই আবহসংগীতসহ দৃশ্য ছায়া’র নজরে এলো। শীতের বিকেল টুপ করে ছাদে সন্ধ্যার আগমনী ছায়া ফেললো। একটু পরেই মাগরিবের আযান দেবে। এরপর রুটিন মোতাবেক দুরন্তকে ঘন্টাখানেক সাইজ করার দায়িত্ব। দুরন্ত বিপ্লবকে বিদায় করলাম। ছায়া বিস্ময়ের ঘোর অমানিশা নিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো। বাকি থাকলাম আমি আর কেয়া। কেয়ার সে কি আনন্দ! সন্ধ্যায় আমাকে কেয়াদের বাসায় যেতেই হবে এই তার বায়না। কোন কথাই সে শুনবে না। মান-সম্মানের বিষয়টি বরাবরই আমার প্রায়োরিটি লিস্টের শীর্ষে থাকে। শীতের এই কাল সন্ধ্যায় সহপাঠী কেয়ার সাথে কেউ এভাবে দেখলে কি থেকে কি ভেবে বসে থাকবে কে জানে? আর তার সাথে কি এমন কথা থাকতে পারে যে অধিককাল চলতে পারে? বলে রাখা ভালো কলেজের সহপাঠীদের মধ্যে তো বটেই পুরো কলেজেই হাতেগোনা নীলাঞ্জনা টাইপের মধ্যে সে অন্যতমা। কেয়া ভালো আবৃত্তি করে, ভাল গান গায়। কলেজের প্রতিযোগিতায় এ দুই বিভাগে সে চ্যাম্পিয়ন।
    এরুপ বিব্রতকর ও ইতস্ততবিক্ষিপ্ত অবস্থায় লক্ষ্য করলাম ছায়া দুরন্ত বিপ্লবকে নিয়ে ছাদে কি খুঁজতে যেন ফিরে এলো। বুঝলাম কেয়ার উপস্থিতি চাক্ষুষ করতেই তার এই অনাবশ্যক আগমন। মাগরিবের আযান চলছে। আমি কেয়ার কাছ থেকে বিদায় নিলাম। সন্ধ্যার পর তাদের বাসায় যাবো এই ওয়াদা কবুল করতে বাধ্য হলাম। কেয়া নিষ্ক্রান্ত হওয়ার পর ছায়ার আর থাকার আবশ্যকতা নেই। দেখলাম আমার এ ভাবনা যথার্থ। হাসিও পেলো। বাবার মুখটা ভেসে উঠলো। বিসিএস আর ম্যাজিস্ট্রেট ভিন্ন আমার আর কোন এজেন্ডা নেই। থাকতে পারেনা। থাকা উচিত না। সন্ধ্যার পর কেয়াদের বাসায় গেলাম। কেয়ার আম্মা অত্যন্ত শান্ত-শিষ্ট। তার বাবা সরকারি কর্মকর্তা। রাশভারি। তাই বাসায় থাকলেও তাঁর দর্শন মিলেনি। কেয়া তাদের একমাত্র সন্তান। কেয়াকে এতই উচ্ছ্বল লাগলো যা আগে কোনদিন দেখিনি। বুঝলাম তার মনে প্রচুর আনন্দ খেলা করছে। আর মননে কি খেলছে তা জানার সাধ্য নাই। এদিকে ঘটেছে আরেক বিপত্তি। কেয়াদের বাসায় অপরিকল্পিত এই সৌজন্য সাক্ষাতে যাওয়ার খবর দুরন্ত বিপ্লবকে জানাতে ভুলে গেছি। এই নিয়ে কারো অনুযোগ নেই। কিন্তু বিষয়টি যে ছায়ার মনঃপূত হয়নি তা বুঝতে বাকি থাকলো না।

    বিসিএস এর প্রিপারেশন জোরেশোরে চলছে। আমার কাছে মাস্টার্সের চেয়ে এটাই এখন টপ প্রায়োরিটি। কলেজ বন্ধ। ঘন ঘন বাড়ী না গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগী হতে বাবার তাগাদা অব্যাহত। এরকম একদিনে বসে বসে ভাবছিলাম অনেক কিছু। জীবনের রঙ কিরুপ? উদ্ভট এ জিজ্ঞাসা মননে মগজে কেন এলো বুঝে উঠতে পারলাম না। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় মনে হলো জীবনের রঙ স্বচ্ছ প্রিজম কাঁচে আলোর প্রতিসরণের মত। যেভাবে আলো ফেলবেন ঠিক সে বরাবর অগ্রসর হবে না। মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক।

    দুরন্ত বিপ্লবকে বশীভূত করার প্ল্যান প্রাথমিক ভাবে ক্লিক করেছে। আমি তার সার্বক্ষণিক খেলা বিষয়ক সাথী। বিশেষত ক্রিকেটের। এভাবে সে হয়ে উঠেছে আমার অনুরক্ত ভক্ত। আমার চূড়ান্ত প্ল্যানও কাজ করেছে এক শর্তে। বিকেলে ক্রিকেট, নো ইন্টারফেরেন্স। আর বাকী সময় পড়ালেখা, নো ছলচাতুরী। এক্ষেত্রে আমাকে প্রায়ই নানা উপলক্ষ্য তৈরি করে প্রাইজ হিসেবে কিছু ইনভেস্ট করতে হয়। মানুষের সামনে টার্গেট না থাকলে জীবন উদ্দেশ্যহীন হয়ে মৃগী রুগীর মত ভীমড়ি খেতে থাকে। ইংরেজী আর অংকে সে কাঁচা। ভালো করলেই পুরষ্কার মিলবে এমন ঘোষণায় কাজ হলো চমৎকার। আন্টি ডেকে পাঠালেন। বাসায় ঢুকতেই পোলাও পোলাও গন্ধ। বুঝলাম আজ রীচ ফুড হবে। কলিং বেল টিপতে দেরি কিন্তু দরোজা খুলতে সময় লাগলো না। ছায়া দাঁড়িয়ে। ছায়ার সাথে আমার কথা হয়না তেমন। সেও বলেনা। কিন্তু মুখটা দুখু দুখু করে রাখে। যাদের মুখশ্রী সুশ্রী তাদের এরকম দুখু দুখু মুখ আলাদা বিভা ছড়ায়। বললাম, “ভালো আছো”? সোজা উত্তর না দিয়ে বললো, “আসেন। ভেতরে এসে বসেন”। আন্টি এলেন। তারিফ করলেন। ছায়া যে দরোজার আশপাশ দিয়ে অযথা যাতায়াত করছে টের পাচ্ছি। দুরন্ত বিপ্লব এলো। আন্টি উঠে গেলেন। বললাম, “এবার অংকটাকে কুপোকাত করতে হবে”। বিপ্লব মাথা নাড়লো। আচমকা বলে ফেললো, “আপু অংকে আমার চেয়েও কাঁচা”। আমি বললাম, “কে বললো? তুমি বুঝলা কেমনে”? ছায়া দরোজার পাশেই ছিলো। বললো, “বিপ্লব এদিকে আয়”। বিপ্লব গেলো না। মুচকি হেসে বললো, “ধরা খেয়ে আপু লজ্জা পেয়েছে”। যাহোক, একদিন ছাদে ছায়াকে পেলাম। সাজুগুজু করে এ সময় ছাদে আসার কোন অর্থ নেই। বললাম, “তোমাকে তো ছাদে এখন কম দেখি”।
    — ঠিকই আসি। আপনিই দেখেন না। ছায়ার ত্বরিত উত্তর।
    — সে কি রকম? আমি তো ছাদেই বাস করি।
    — কেয়া আপু আছে না?
    রোগের লক্ষ্মণ ধরা পড়েছিলো আগেই। আজ এর কারণ জানা গেল। বললাম, “কেয়ার সাথে তোমার কি? সে তোমার সিনিয়র আর আমার ক্লাসমেট”। ছায়া নিরুত্তর থাকলো। বললাম, “পড়াশোনা কেমন চলছে”?
    — পড়াশোনা ভালো লাগেনা
    — তাহলে কি ভালো লাগে?
    — জানিনা।
    — বাহ। কিছুই ভালো লাগেনা?
    — লাগে
    — সেটা কি?
    — বলা যাবে না।
    সিঁড়িতে কেয়ার কথা শুনে বলে উঠলো, “ওই যে আপনার প্রিয় বান্ধবী আসছে”। বলেই নেমে গেল। কেয়া এলো। ছায়া নেমে গেলো। ছাদ থেকে কাপড় নিতে নিতে কেয়া বললো, “লজিং মাস্টার ভালো আছেন”? আঁতে ঘা লাগলেও নিছক দুষ্টুমী ভেবে পাল্টা মিসাইল ছুঁড়ে দিলাম, “কেন জ্বলছে নাকি”?
    — হুম্ম। খুব জ্বলে। জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাচ্ছি। কি করছো?
    — বিসিএস প্রিপারেশন
    — প্রিপারেশন না ছাই। ওই মেয়ে সারাক্ষণ তোমার চতুর্দিকে ঘুরঘুর করে কেন? যখনই ছাদে আসি তখনই দেখি
    — এ তোমার ভারি অন্যায়
    — বাহ। খুব দরদ দেখছি তার জন্য
    — লিভ ইট। তোমার খবর কি?
    — খবর ভালো না
    — কেন? কি হয়েছে?
    — বিয়ের কথা হচ্ছে
    — ভালো তো। পাত্র কি করে?
    — বিসিএস ক্যাডার
    — বাহ। ঝুলে পড়ো
    — অত সহজ না। না করে দিয়েছি
    — কেন? চয়েস আছে নাকি?
    — আছে তো।
    — তাহলে তাকেই করে ফেলো
    — সমস্যা আছে
    — কি সমস্যা?
    — সে তো কেলাস টাইপের। সারাদিন বই নিয়ে পড়ে থাকে। আর ইদানীং বালিকা নিয়ে।

    তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। আমি আহত হলাম। বললাম, “এ তোমার ভুল ধারণা”। “পুরুষ মানুষদের চেনা আছে” বলে কেয়া চলে গেলো। কি চেনা আছে বুঝলাম না। বাবা-মা’র কথা মনে হলো। আমি কি টার্গেট থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছি? দুরন্ত বিপ্লবের রেজাল্টের অভাবিত উন্নতি হলো। এই দেখে আন্টির আবদার ছায়াকে শুধু ম্যাথটা একটু দেখিয়ে দিতে হবে। বিসিএস প্রিপারেশনের দোহাই পেড়েও কিছু হলো না। রোজ এক ঘন্টা করে ফ্ল্যাটে গিয়ে ম্যাথ বুঝাতে হলো। এতে আমি মনে মনে কিছুটা ক্ষুব্ধ। ছায়া উৎফুল্ল। আমি যত সিরিয়াস। ছায়া তত অমনোযোগী। সিলেবাসের বাইরেই তার মনযোগ বেশি। আমাকে ঘিড়ে তার প্রচুর কিওরিসিটি। খালি গল্প করতে আর কথা বলতে চায়। আমার শংকা বাড়তে থাকলো। অল্প বয়সী মেয়েদের মধ্যে পাগলামী স্বভাব প্রকট হয়। যাকে কাছে পায় তাকেই পছন্দ হয়। ভালো লাগে। ক্ষণিকের মোহ আরকি। বাবার বন্ধুর মেয়ে। একটু সন্দেহ বা কোন ঘটনা ঘটলে আমার জীবন যতটুকু না চৌচির হবে তার চেয়ে বেশি হবে বাবা-মা’র। যেদিন থেকে এই পার্ট টাইম ডিউটি খাটছি সেদিন থেকে কেয়ার ম্যুড অফ। আমার কোনই ভূমিকা নেই কোন কিছুতে। অথচ উভর পক্ষের মামলায় আমি একমাত্র আসামী।

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-১)

    আজিমপুর টু উত্তরা – লজিং মাস্টার (পর্ব-১)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    লজিং মাস্টার
    আনোয়ার হাকিম

    পর্ব-১
    আমার বিপদ অবর্ণনীয়। অসহনীয়ও বটে। ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছি গ্রামদেশে জায়গীর মাস্টারের শেষ পরিণতি হয় ঘর জামাই হিসেবে। প্রাইভেট টিউটরের সাথে ছাত্রীর প্রেম অবশ্যম্ভাবী। আর সহপাঠীর সাথে প্রেম কাহিনী সর্বজন বিদিত। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে একেক জনের কপালে একেক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়ে থাকে। আর তার পরিণতিও একেক রকম হয়ে থাকে। কিন্তু একসাথে এই ত্রিশংকু অবস্থা কারো জীবনে নাযিল হয়েছে বলে শুনিনি। আমার হয়েছে সেই দশা।

    ছোটবেলা থেকেই ছাত্র হিসেবে ভালো ছিলাম। গ্রামের স্কুল থেকে প্রাইমারি বৃত্তি পরীক্ষায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ায় বাবার বিশেষ দৃষ্টিতে পড়লাম। সাথে অসীম ছাড়। আম্মা সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখতেন। কারো কুনজরে যেন বিদ্ধ না হই সেজন্য মাঝে মধ্যেই আচমকা জড়িয়ে ধরে দোয়া-দরুদ পড়ে বিশাল বিশাল ফু দিতেন। ছোট ছিলাম। পরীক্ষা বা টেনশনের কিছু হলে আমিও আম্মার কাছে গিয়ে ফু দাবী করতাম। জুনিয়র স্কলারশীপেও গ্রামের স্কুল থেকে প্রথম গ্রেডে বৃত্তি পেলাম। বাবার প্রত্যাশা বাড়তে থাকলো। মুখে সুখের হাসিও ঝিলিক দিতে থাকলো। পাড়া-প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন আর সহপাঠীদের কাছে বলা যায় হিরো বনে গেলাম। বাবা উপজেলা সদরের ভালো স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। রোজ রোজ সাইকেলে প্যাডেল চেপে আসা-যাওয়া করতাম। মাধ্যমিকেও ভালো রেজাল্ট হলো। পাল্লা দিয়ে অপত্য স্নেহও বাড়তে থাকলো।

    শহরের ভালো কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হলাম। সেখানে গিয়ে অভিজ্ঞতা হলো বিচিত্র। পড়াশোনার বাইরে আমার অন্য ধান্ধা নাই। সহপাঠীদের সমীহ যেমন পাই তেমনি মশকরাও সহ্য করতে হয়। কলেজের কো-এডুকেশনে খাপ খাইয়ে নিতে তাই অনেক কোশেশ করতে হয়েছে। এখনো পুরোপুরি ধাতস্থ হতে পারিনি। কলেজ জুড়ে মেধাবীর তকমা পেলাম বটে কিন্তু ইনোসেন্ট আর হাবাগোবার মিশ্রণজাত এক ধরণের খোঁচাও খেতে হত প্রায়ই। বাবার বড় আশা আমি বিসিএস দেবো। ম্যাজিস্ট্রেট হবো। ডিসি হবো। গ্রামের বেসরকারি স্কুলের মাস্টার হিসেবে এটাই তাঁর সর্বোচ্চ আশা।

    আমাদের আর্থিক অবস্থা কখনোই স্বচ্ছল ছিলো না। এর যাতনা আমি যতটা টের পেতাম, বাবা-মা ভোগ করতেন ততোধিক। আমরা এক ভাই এক বোন। বোনটি বড়। রুপে ও গুণে সে অদ্বিতীয়া। একদিন তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসলো। বাবা নিমরাজী হলেও মা গোঁ ধরলো। তাঁর বক্তব্য মেয়ে মানুষের জন্য ইন্টার পাশই যথেষ্ট। ছেলে সরকারি ইঞ্জিনিয়ার। সম্পর্কীয় এক মামা এই প্রস্তাব এনেছেন। বলাচলে একরকম জোর করেই বিয়ের কথা প্রায় পাকা হয় হয়। শুভস্য শীঘ্রম বলে একটা কথা আছে। এটা আর কিছুর ক্ষেত্রে না হলেও বিয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। গ্রামদেশে এটাই সর্বজন মানিত। এমন অবস্থায় আমার বুক ঠেলে কেন জানি থেকে থেকে কান্না আসতে থাকলো। বোনের মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারিনা। একবার একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম সে রাজী কিনা। ছোট ভাইয়ের কাছে এতদসম্পর্কীয় কথা বলতে লজ্জা হলেও এক পর্যায়ে কাছে এসে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “রাফি, আমি এখনই বিয়ে করতে চাইনা”। তার এ কথাটা বুকে যেন শাবল মারলো। কিছু একটা করা জরুরি জ্ঞান করে বাবাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললাম, “বাবা, আপু এখন বিয়েতে রাজী না। আপনি শক্ত থাকেন। আম্মাকে আমি ম্যানেজ করবো”। বাবা বিস্মিত চোখে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, “কথা তো প্রায় পাকা হওয়ার পথে”। ছোট চাচা চালাক চতুর টাইপের। নিঃসন্তান। আমাদের দু’জনকে সন্তানবৎ আদর করেন। তাঁকে বুঝাতে সক্ষম হলাম। তিনিই মজলিশে চমৎকার বোমা ফাটালেন, “মেয়ে ডিগ্রী কমপ্লিট করতে চায়। লেখাপড়ায় মা শা আল্লাহ ভালো। তাই আমরা পরে পারিবারিক ভাবে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাদেরকে জানাবো”। তাঁর এ বক্তব্যে আলোকোজ্জ্বল প্যান্ডেল যেন সহসাই নিষ্প্রভ হয়ে গেলো। অতিথিরা লা জবাব হয়ে ফিরে গেলো। আম্মা আমার উপর, তারচেয়েও বেশি ছোট চাচার উপর নাখোশ হলেন। তাঁর মুখ ভার দেখে আমি গলায় জড়িয়ে ধরে বললাম, “আম্মা, আমি কি কোনদিন তোমাদের অবাধ্য হয়েছি”? আম্মা চোখ তুলে আমাকে জড়ায়ে ধরে বললো, “বাবারে, মেয়ে হওয়ার কষ্ট তুই কি বুঝবি”? সত্যিই আমি অতশত বুঝি না। আমার প্রতি বাবা-মা’র অগাধ আস্থা। তাদের ধারণা আমি জ্ঞানে-গরীমায় তাদের চেয়ে ঢের ভালো বুঝি। এজন্য এ যাত্রা বোন পরিত্রাণ পেলো। তাঁর খুশি খুশি ভাব দেখে আমার নিজেকে সফল বলে মনে হলো। এরপরের কাহিনী আরো করুণ। স্কুল থেকে সাইকেল চেপে বাড়ী ফেরার পথে বাবা পিচ্ছিল রাস্তায় অন্যমনস্কতার কারণে বিদ্যুতের খুঁটির সাথে ধাক্কা খেয়ে মাথায় আঘাত পেলেন। তাঁর চিকিৎসা ইত্যাদিতে বিস্তর টাকা খরচ হলো। জমি যা ছিলো তার প্রায় অর্ধেক বিক্রি করতে হলো। আর বাকি অর্ধেক বন্ধক রাখা হলো।

    সংসারের এরুপ আর্থিক অবস্থার মধ্যে আমি জেলা শহরের কলেজে অনার্সেই ভর্তি হয়ে গেলাম। বাবা খুব মর্মাহত হলেন। তাঁর পক্ষে এর চেয়ে ভালো কিছু করা যে সম্ভব না তা তিনিও ভালো জানেন। যদিও তাঁর সাধ ছিলো ভিন্ন। ভালো মান নিয়ে অনার্স পাস করলাম। বাবা একদিন কাছে ডেকে বললেন, “বাবা, মাস্টার্স করো অসুবিধা নাই। তবে বিসিএস এর প্রিপারেশনও চালিয়ে যাও”। আমি বিস্ময়ে এই প্রথম তাঁর কাছে জানতে চাইলাম বিসিএস করলে বিশেষ কি হবে? বাবা বললেন, “ম্যাজিস্ট্রেট হবা”। ম্যাজিস্ট্রেট শব্দটির সাথে পাবলিক পরীক্ষার সময় পরীক্ষা হলে বার কয়েক পরিচয় হয়েছে। তাকে নিয়ে হেড স্যার থেকে প্রিন্সিপালসহ সবাই তটস্থ থাকত। তোষামোদে ব্যস্ত থাকত। এর বেশি কিছু উত্তাপ অনুভব করতাম না।

    ছোটবেলা হতে কোনদিনই বাবা-মা’র কথার অবাধ্য হইনি। মূলত তাদের কাছে আমার কোন বেয়ারা বা বাড়তি আবদারও ছিলো না। বিনিময়ে সংসারের ভারি ভারি সিদ্ধান্তের সময় আমার শলা-পরামর্শ বিশেষ মর্যাদা পেতে থাকলো। সে যাহোক, বোনের বিয়ের সে পাত্র সম্মন্ধে একদিন খবর এলো যে আগে সে গোপনে বিয়ে করেছিলো। ছাড়াছাড়িও হয়ে গেছে। সে ঘরে তার সন্তানও আছে। এ খবর শুনা মাত্র বাবা-মা আমাকে সংসারের সকল ভালো-মন্দের জিম্মাদার হিসেবে দায়িত্বভার অর্পণ করলেন। আমার কাঁধ ভারি হলো। বয়স আন্দাজে আমার চলাফেরায় ভারিক্কি চাল ভর করলো। তবে বাবার ওই এক কথা বিসিএস দিতে হবে, ম্যাজিস্ট্রেট হতে হবে। শক্ত হৃদয় বলে কোন কালেই আমার খ্যাতি ছিলো না। এই ফেরে পড়ে এখন তা আরো কোমল হলো।

    একদিন জেলা সদর থেকে ফিরে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে বাবা বললেন, “সব ফাইনাল করে এলাম। এখন থেকে শুধু পড়াশোনা করবা। টাকার কথা চিন্তা করবা না। প্রয়োজনে আরো এক কানি ক্ষেত বিক্রি করবো”। আমার কান্না পেলো। পুরুষ মানুষের কান্না করতে নেই। চেপে বুক ভারি করাই রেওয়াজ। তাই করলাম। আর মনে মনে পণ করলাম বাবার খায়েস পূরণই আমার একমাত্র কাজ। আমার জন্য বাবা তাঁর বন্ধুর বাসার চিলে কোঠায় অব্যবহৃত এক রুম যৎসামান্য মাসোয়ারার বিনিময়ে রফা করলেন। বাক্সপেটরা সমেত একদিন আমাকে নিয়ে তার দ্বারোদঘাটনও করলেন। বাবার সে বন্ধুর সাথে, তার পরিবারের সাথে পরিচয়ও করিয়ে দিলেন। আন্টির প্রতিটি কথাতেই যেন মায়ার প্রলেপ মাখা। প্রারম্ভিক পর্যায়েই স্বস্তি বোধ হলো। তাদের এক ছেলে। ছোট। নাম বিপ্লব। ক্লাস টেনে উঠেছে। অবসম্ভব চঞ্চল। ছাত্র ভালো তবে পড়াশোনা বাদে আর সব কিছুতেই পজিটিভ। আমি তাকে দুরন্ত বিপ্লব বলে ডাকি। তাদের আরেক মেয়ে। বড়। নাম ছায়া। পারিবারিক প্রথম পরিচয় পর্বে পাশের রুমের দরোজার কাছে কারো ছায়া দেখতে পেয়েছিলাম। সেদিকে নজর পরায় সেই ছায়াকে চকিতে মিলিয়ে যেতেও দেখলাম। বুঝে নিতে কষ্ট হলো না যে সেই ছায়া ছায়া’র ছিলো। ছায়া এবার উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে। বাবার সেই বন্ধু প্রাইভেট কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক। অত্যন্ত সজ্জন, অমায়িক। বাবার সাথে তাঁর জেন্টেলমেন্ট এগ্রিমেন্ট হলো, তাঁর দুরন্ত বিপ্লব-কে পড়াশোনার ক্রিজে ফিরিয়ে আনতে হবে। ব্যাট-বল হাতে ক্রিকেট ক্রিজে সে ইতোমধ্যেই অলরাউন্ডার হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। দুরন্ত বিপ্লবের সূত্রেই আমার প্রাইভেট পড়ানোর ইনিংসের সূচনা হলো। অন্যদিকে তিন বেলা আহারের ব্যবস্থাও তাদের বাসা থেকে গ্যারান্টেড সাব্যস্ত হলো। আর এর মাধ্যমে আমার লজিং মাস্টারের যাত্রাও শুরু হলো। ভাগ্য ভালো যে ছায়ার পড়াশোনার দায়িত্ব স্কন্ধে চাপেনি।

    চলবে…

  • রঙ্গীলা বায়স্কোপ

    রঙ্গীলা বায়স্কোপ

    ছোটবেলায় বায়স্কোপ বলিয়া একটি শব্দ ও বিনোদনের উপকরণ বড়ই কৌতুহল উদ্দীপক ও মজাদার ছিলো। সিনেমা বা বায়স্কোপ যাহাই বলি না কেন ইহা যে নাচে-গানে, হর্ষে-বিষাদে, রঙ্গ-রসে ভরপুর হইবে ইহা বিলক্ষণ বুঝিতাম। কৈশোরে সিনেমাহলে গিয়া সিনেমা দেখা সাবালকত্বের লক্ষ্মণ বলিয়া অতি শাসনের কবলে পড়িত। শিশুতোষ সিনেমা হইলে ভিন্নকথা। তবে কিশোরদের সিনেমা দর্শন মোটা দাগে শুধু অপছন্দনীয়ই নয় গুরুতর অপরাধ বলিয়া গন্য হইত। ইহার বিকল্প হিসাবে বায়স্কোপ নামধারী একটি বাক্স রঙ্গীলা বিনোদনের জনপ্রিয় মাধ্যম হইয়া উঠিলো। ইহার বাহক এই বাক্স লইয়া গ্রাম-গ্রামান্তরে, শহরের অলিতে-গলিতে, বড় রাস্তার মোড়ে মোড়ে, হাটে-ঘাটে, খেলার মাঠে-মেলার মাঠে ঘাঁটি গাড়িত। সকল বয়সী মানবের ইহাতে সমান কৌতুহল ও আগ্রহ ছিলো। সেই বাক্সে বড় বড় ফোকড় থাকিত। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সেই ফোকড়ে চোখ মেলিয়া ভিতরে চলমান বাদ্য সহবতে রঙ্গীন বিনোদন চিত্রে বুঁদ হইত।

    আজকাল ইহাদের আর দেখা যায় না বলিলেই চলে। বোধকরি মোবাইলের সর্বগ্রাসী ভূমিকায় এখনকার কিশোররাও ইহাতে আর আকুল-ব্যাকুল হইবেনা। আরো সত্যি করিয়া বলিলে ইহারা এই বায়স্কোপ বাক্সটিকে যাদুর বাক্স বলিয়াই ভ্রম করিবে। আর বয়ষ্করা মোবাইলে ইহার চাইতে ঢের বেশি রকমারি লাইভ শো দেখা যায় বলিয়া মোটেই আগ্রহী হইবেনা। তাই আগেকার সেই বায়স্কোপ বাক্স এখন আর মোটেই সহজলভ্য নয়।

    সিনেমার অবস্থাও তদ্রুপ। অরুচি, কুরুচি, বস্তাপচা কাহিনী নির্ভর এবং গলা ছিলা মোরগের মত ভাঁড় টাইপের ভাঁড়ামিতে ভরপুর অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের শব্দ ও চিত্র প্রক্ষেপন যন্ত্রের অত্যাচারে আক্রান্ত হইতে এখন আর কেহ হলমুখী হয়না। একদার এই রঙ্গীলা দুনিয়ায় ধ্বস নামিয়াছে। কিন্তু ইহাদের অবর্তমানে বিনোদন প্রিয় পাবলিকের কিন্তু কোনই ক্ষতি হয়নাই। বরং গাঁটের ট্যাকা খরচ করিয়া অখাদ্য গলাধঃকরণের যন্ত্রণা হইতে মুক্তি পাইয়াছে। বিনিময়ে দেশময় ওপেন স্কয়ারে পয়সা ছাড়াই নিত্য নতুন লাইভ রঙ্গ দেখিয়া বেশুমার আনন্দ পাইতেছে। বায়স্কোপ বাক্সের সূত্রাধারের বলার ঢংয়েই বলি। দেখুন তো রঙ্গীলা চিত্রগুলো স্পষ্ট দেখা যাইতেছে কি-না?

    এই যে দেখুন কি সুন্দর, নাচিতেছে একদল বান্দর। আজব চেয়ারে আজ শিপুণ তো কাল সায়েদ, চলিতেছে খেলা নিরন্তর। এই যে দেখুন পরীর মত পরী, ভেতরে তার জমাট আঁধার, বাইরে তার রুপের বাহার, বড়ই চমৎকার। রঙ্গে ভরা রঙ্গ দেখিয়া, পাবলিক দেখুন মুখ বাকাইয়া, রসনার চোখ ঠাটায়, বুদ্ধিজীবী মন রাঙ্গায়, সাংবাদিকেরা গন্ধ ছড়ায়।

    কার বৌ কে কব্জা করে, লাইভে এসে কে কান্না করে, কার গর্ভে কার ভ্রুণ, এই তর্কে সাংবাদিকদের হচ্ছেনা ঘুম। আত্মহত্যার হিড়িক বাড়ছে। কথায় কথায় রশি নিচ্ছে, নিজের মাথায় বুলেট ছুড়ছে, লাইভে এসে নাটক করছে, আত্মহত্যার প্রসার হচ্ছে, পত্রিকাগুলো ছবিসহ ক্যাপশন দিচ্ছে।

    করোনাকালে সব অচল, বানিজ্য মেলা কত প্রবল, বই মেলায় সবাই সচল ! সব কিছুই চলছে ভালো, শিক্ষায়তনে নাই আলো। বিয়ে-শাদী, পার্টি-আড্ডা, ক্লাব-পাব রমরমা। এরি মাঝে সাকিব ভেলকি, বিসিবিও কম কি? খেললো কিছুক্ষণ টি-টুয়েন্টি। শেষে এসে হাসিমুখের সন্ধি-চুক্তি।

    এর মাঝে খবর এলো, ঘাপটি মেরে হারিস ছিলো, মাহমুদুর নাম নিয়ে ছিলো, এই নামে এন আই ডিও ছিলো, এগারো বছর দেশেই ছিলো, রাজধানীতেই তার কবর হলো। গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক সচল ছিলো, সবাই খুব ব্যস্ত ছিলো, নিচ্ছিদ্র সব ব্যবস্থা ছিলো, এখন শুনি অনেকের সেখানে যাতায়াতও ছিলো। কি থেকে যে কি হলো? খবর শুনে সবাই যেন উঠে বসলো।

    এরিমধ্যে ঢেউ এলো, বাজার সেরকম গরম হলো। এই যে দেখেন তেলেসমাতি কায়কারবার, ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ায়, তারাই আবার মিটিং বসায়। তত্ত্ব-তালাশে কমিটি বানায়। সেই কমিটি যুক্তি দেখায়। কর্তারা সবাই সাফাই গায়। ক্রয় ক্ষমতার ইনডেক্স দেখায়। তাইনা দেখে শাক-সব্জী দেমাগ দেখায়। সোয়াবিন তেলও চোখ পাকায়। টিসিবির ট্রাক ভীড় বাড়ায়।

    মিটিং বসে উপায় খুঁজতে, সবাই পৌছে ঐক্যমতে, যা হবার হয়ে গেছে, বাড়বেনা দাম আর রমযান মাসে। ব্যবসা যা হবার হয়ে গেছে, যুক্তি তো একটা সামনেই আছে। দেখছেন না রাশিয়া ফাল পাড়ছে? ইউক্রেন কেমন চিপায় পড়েছে, বাইডেন এখন ইউটার্ন নিয়েছে? দূরে দাঁড়িয়ে শিং পেন কেমন মুচকি হাসছে?
    এবার দেশে সানি এলো, তাবত সাংবাদিক হুমড়ি খেলো, তলে তলে সবাই গেলো, কেউ বললো জাত গেলো, কর্তা বললো কেমনে এলো? ইমিগ্রেশন এলার্ট ছিলো, লায়নি এসে পোস্ট দিলো, তার সাথে অনেকেই ছিলো, দেশের দিঘী-পুকুর সব যোগ দিলো। নাচ হলো, গানও হলো, খানাপিনা, মৌজ-মাস্তি সবই হলো।

    সরকারি ভ্যাট বিযুক্ত হলো। সোয়াবিন স্বস্তি পেলো। সব্জী বাজার উঁচুই রইলো। সব কিছু আড়াল হলো। রঙ্গ ভরা দুনিয়াতে, চলছে সার্কাস অবিরত।

    কথার কথা বাজে কথা, সেই কথাটিও ফুরালো, নটে গাছটিও মুরালো।

  • পথের দুঃখ দিলেম তোমায় গো এমন ভাগ্যহত

    পথের দুঃখ দিলেম তোমায় গো এমন ভাগ্যহত

    বয়সে নবীন বা অধঃস্তন কাউকে নাম ধরে ডাকলে খুশি হয়, সে নিজেকে আপনার ভাবে কারণ মানুষের কাছে প্রিয় তার নাম; নাম দিয়ে সে প্রকাশিত। যে কাউকে ভুল নাম ধরে সম্বোধন করলে সে রাগ করে। উর্ধ্বতন কাউকেও যথাযথ সম্মানসহ নাম ধরে সম্বোধন করলে তিনি প্রকাশিত হওয়ার আনন্দে খুশী-ই হন। পৃথিবীর সকল সৃষ্টির মাঝেই প্রকাশিত হওয়ার ইচ্ছে আছে, আকুলতা আছে।

    যার বোধগম্য মৌখিক ভাষা নেই, সেই প্রকৃতিরও নিজেকে প্রকাশের ইচ্ছে আছে, এবং প্রকাশক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় বিভিন্ন উপায়ে। নদীর কথা নেই, কলকল তান আছে। মেঘের কথা নেই, গুরুগম্ভীর পিলে চমকানো গর্জন আছে। ঝরা পাতার ভাষা নেই, মচমচে শব্দ আছে। ফুলের আছে গন্ধ, মশার আছে ভনভন। সর্বত্রই নিজের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার প্রবণতা, “আমি আছি, আমি আছি”। কোথাও বৃষ্টি হলে কাছাকাছি সেই বৃষ্টির ঘ্রাণ পৌঁছে যায়, কারো বাড়ী সুস্বাদু ব্যঞ্জন তৈরী হলে তার ঘ্রাণ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এর মানে হল, প্রকৃতিতে থাকা প্রতিটি বস্তু-ই তার উপস্থিতি জানান দেয়।

    মানুষের মাঝেও নিজেকে প্রকাশের আকুলতা আছে তুমুল। সবাই চায় নিজের সেরাটা অন্যে দেখুক, অন্যে তার প্রশংসা করুক। যে মেয়ে ছোটবেলা থেকে জেনে এসেছে সে অপরূপা, সে নিজেকে আরো গুছিয়ে রাখে, যে মেয়ের চুল ঘনকালো, সে তার চুলকে আরো যত্ন নিয়ে খোঁপা বেঁধে রাখে। কেউ কথায়, কেউ লেখায় নিজেকে প্রকাশ করে। কেউ ঝগড়া করে, কেউ গীবত করে, কেউ নিজেকে মৌন রাখে। এসবই তার নিজস্ব প্রকাশের ধরণ। কেউ চাইলেই অন্যের মতন হয় না, স্বীয় বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল প্রত্যেকে।

    পৃথিবীতে মানুষ হল সেরা প্রাণী, কারণ তার তথ্য আদান-প্রদান বিস্ময়কর ক্ষমতা। একমাত্র জড়বুদ্ধি সম্পন্ন ছাড়া বাদ বাকী সব মানুষের মেধা এক, তবে সেই মেধাকে কাজে লাগানোর ইচ্ছে সবার এক নয়। মানুষের নাগালের ভিতরে সে যা ইচ্ছে করবে তাই করতে পারে। আন্তরিক ইচ্ছে সফল হবার স্তম্ভ। সেই ইচ্ছেটা সবার এক থাকে না, অনেক ইচ্ছে মরে যায় অনেক কারণে।

    পৃথিবীর ইতিহাসে সফল তাঁরাই যারা সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেননি। যত বাঁধা তত তা ডিঙানোর জেদ, ইচ্ছে থাকে। যার সবকিছু আছে, প্রকাশের রাস্তা তার করায়ত্তে, নতুন করে প্রকাশ হওয়ার আর কিছু নেই তার। যার প্রকাশে, নিজের অস্তিত্ব প্রকাশ বিপন্ন, সেই তা কাটিয়ে উঠার নিরন্তর প্রচেষ্টা চালায়।

    জীবনের পথ কণ্টকাকীর্ণ বেশীর ভাগ মানুষের জন্য, এই বেশীর ভাগ মানুষের স্বার্থত্যাগের ফলে, এই দল থেকেই বেরিয়ে আসে সফল মানুষেরা। প্রকাশিত হয় নতুন আলো ছড়িয়ে।

    যদি মানুষ নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে না পারত, তবে বুক ফেটে অঘটন ঘটত। অধিক শোকে, বা সুখে মানুষ আকস্মিক তার প্রকাশ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে তখন সে বোবা হয়ে যায়, এমনকি জীবন নাশের আশঙ্কাও থাকে।

    তাই অকপটে প্রথমে নিজের কথা নিজেকেই না হয় বলুন, নিজেকে প্রকাশ করুন আর প্রানখুলে হাসুন। পৃথিবীটা ততটা দুঃখের নয় যতটা আমরা ভাবি, ততটা দুঃসহ বোঝা নয় যা আমরা নিজেরাই তৈরী করি।

    পৃথিবীটা আসলেই খুব সুন্দর, শুধু সুন্দর রাখতে জানতে হয়।

    ~রুবি বিনতে মনোয়ার

  • কালুখালি জংশন: হারিয়ে যাওয়া বাজীকরের সন্ধানে

    কালুখালি জংশন: হারিয়ে যাওয়া বাজীকরের সন্ধানে

    ভাটিয়াপাড়া টু রাজবাড়ী ভায়া কালুখালীর এই ট্রেন দিনে দুবার আসা যাওয়া করে। এদিকের ষ্টেশনগুলো ছিল দেখার মতন। সবগুলো প্রায় একই প্যাটার্ণের। দেশ স্বাধীনের অনেক বছর পরেও ষ্টেশনের টয়লেটের সামনে হিন্দি এবং উর্দুতে মহিলা- পুরুষ “সৌচাগার” লেখা সাইনবোর্ড দেখা গেছে। এমনকি রেল ক্রসিং EPR লেখা থাকতো। গতীর জন্য এই ট্রেনের বদনাম ছিল আর যাত্রীর সাথে মিলিয়ে হকারের সংখ্যা প্রায় কাছাকাছি।

    বাবার সাথে বছর তিনেক যাতায়াত করে সব মুখস্ত । নিয়মিত বিরতি দিয়ে আমি একাই এখন এই ট্রেনের যাত্রী। হাইস্কুলে পা দেওয়ার আগেই একা একা যাতায়াতের হাতে খড়ি হয়ে গেছে। তখন মানি অর্ডারের যুগ হলেও মাসের শেষে মাইনের টাকা নিয়ে বাড়ি যাওয়ার কাজ আমি আনন্দের সাথে করতাম। একে ট্রেন ভ্রমনের আনন্দ আর সাথে টাকা খরচ করার স্বাধীনতা।

    ভেড়ামারা থেকে কাশিয়ানী যেতে দুবার ট্রেন বদল, মানে সাকুল্যে তিনখানা ট্রেন। ভেড়ামারা থেকে পোড়াদহ, এখান থেকে গোয়ালন্দ মেইল ধরে কালুখালী জংশনে নেমে রাজবাড়ি থেকে আসা ভাটিয়াপাড়াগামী ট্রেন ধরে তবেই গন্তব্য। সেবার মাস মাইনের টাকা পকেটে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে ঠিক মত কালুখালী এসে বাধলো বিপত্তি, ট্রেন লেট।

    সময় কাটানোর জন্য এটা ওটা খাই, পুরো প্লাটফর্মের এমাথা ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছি। এক যায়গায় মজমা শুরু হয়েছে। ঔষুধ ফষুদ বেচা বিক্রির কায়দাটা বেশ ভালোই লাগে দেখতে। দাড়িয়ে পড়লাম একেবারে সামনের সারিতে। না ঔষুধ, দাতের মাজন কিছুনা। একটা ছোট ছেলেকে চাদর দিয়ে ঢেকে পেটের মধ্যে ছুরি চালিয়ে দিয়েছে। ছেলেটা চিৎকার করে কাঁদছে। কিছুক্ষন আগে একে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। এরই মধ্যে রক্তারক্তি কান্ড।এ আবার কি খেলা- কে জানে?

    আর ছুরি চালানো লোকটা সবার কাছে টাকা চাইছে দুই টাকা এক টাকা। যে যা পারেন এই ছেলেটার চিকিৎসার জন্য। বুঝলাম না, নিজেই ছুরি মেরে আবার মানুষের কাছে টাকা চাইছে কোন আক্কেলে? ভয় দেখাচ্ছে টাকা না দিলে পকেটে আগুন লেগে যাবে।আমি দশ টাকার একটা নোট বের করে দিলাম। তিনি আট টাকা ফেরত দিলেন।

    সবাইকে বললেন, টাকা না দিয়ে গেলে নাকি অজ্ঞান হয়ে যাবে। পাশে একজন ধুপ কর মাটিতে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গেলো। আমার পকেটে অনেকগুলো পাচ শত টাকার নোট। মাইনের টাকা বাড়িতে কিভাবে নেবো- যদি আগুন লেগে যায়। আর অজ্ঞান হয়ে গেলে? লোকটা ক্রমাগত ভয় দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে দুএকজন অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। উনি ঘুরে ঘুরে সবার কাছ থেকে এক টাকা দুই টাকা নিচ্ছেন। কাছে আসতেই পকেটের সব টাকা লোকটার হাতে দিয়ে দিলাম। মধ্য আশির দশকে দুই হাজার টাকা-মানে অনেক টাকা।

    লোকটা টাকা হাতে নিয়ে দেখে বললেন “তুমি কিছুক্ষন আগে দশ টাকা দিলে-আমি আট টাকা ফেরত দিলাম না?

    আমি বললাম হ্যাঁ,

    তাহলে আবার দিচ্ছ কেন, আর দরকার নাই। বলে টাকাগুলো নিজের কাছে রেখে দিয়ে বললেন “এখানে দাঁড়াও কোনো ভয় নাই।

    আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। আস্তে আস্তে মজমা শেষ, ট্রেনের হুইশেল শোনা গেলো। চাদরের নীচের ছুরি খাওয়া ছেলেটা দিব্যি হেসে হেসে পাউরুটি আর মিষ্টি চিবোচ্ছে। তাহলে এতক্ষন যা হয়েছে সব ভাওতা, মিথ্যে?

    এবার বাজীকর লোকটা আমার কাধে হাত দিয়ে বলল “ভাইডি,আমরা মানুষের কাছে কথা বেচে খাই,এই ধান্ধা করে পেট চালাই। এক-দুই টাকার বেশি আমরা নেই না। তুমি এত টাকা পাইছো কই?

    আমি বললাম- আব্বার বেতনের টাকা বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।

    -এতটুকু মানুষ একা একা,সাথে এতগুলো টাকা দিয়ে পাঠানো ঠিক হয় নাই

    আমি বললাম “আমি অনেকদিন ধরেই একা একা চলাচল করি।

    ট্রেন এসে পড়লো। বাজীকর লোকটা আমাকে গার্ডের রুমে নিয়ে-বললেন “বড় বাবু, এই ছেলেটা কাশিয়ানী যাবে। কাছে অনেকগুলো টাকা। অনেক মানুষ দেখেও ফেলেছে। পুরো বিত্তান্ত শুনিয়ে বললেন “ছেলেটাকে আপনি সাথে নিয়ে যান। একা একা কোথায় কে মেরে টাকাগুলো কেড়ে নেয়।

    বড় বাবু বললেন- টিকিট আছে। আমি বললাম “জি আমি হাফ টিকিট করি, সব সময়।

    ট্রেনের ছাড়ার সময় লোকটা বলল “ভাইডি ভালোভাবে বাড়ি গিয়ে টাকাগুলো মায়ের হাতে দিও, আর আমাদের মত বাজীকরদের কথায় এমন বোকামী করোনা। পেটের জন্য কত মিথ্যা বলি। আমরা তো ভালো মানুষ না।

    ট্রেন চলতে শুরু করে। এত ভালো কথার পরেও লোকটাকে সেদিন নিষ্ঠুর মনে হয়েছিলো।

    তারপর অজস্রবার এই ট্রেন, কালুখালি জংশন পেরোই। সেদিনের সেই ছুরি খাওয়া ছেলেটির বয়স আমার মতই বেড়েছে। বাজিকর বেঁচে আছে কিনা, থাকলে বয়স পেরিয়েছে অনেক। কালুখালী ষ্টেশনে নেমে প্রতিবার খুঁজি। নাম ধরে নয়,রেলের ধারে,প্লাটফর্মের আনাচে কানাচে। নাই কোনোদিন আর তাকে দেখিনি।

    দীর্ঘদিন এই লাইনের ট্রেন বন্ধ হয়ে আবার চালু হয়েছে। পুরনো দুজন হকার এখনো জীবিত আছে। যাদের আমি দশ বছর বয়স থেকে চিনি। এখনো নতুন হকার আসে, নোতুন মোড়কের পসরা নিয়ে।

    কিন্তু সেদিনের সেই বই বিক্রেতা,ছন্দ কবিতা পড়ে যে বই বিক্রি করতো। বৃদ্ধ ঘোলাটে চশমায় পেছনে দড়ি বেঁধে চেঁচাত ‘রামদিয়ের রাম বাবুর মটকা। আয়নাল মিয়ার পান,ট্রেনের কামরার এক পাশ থেকে অন্যপাশে যার সুঘ্রাণ ছড়াতো। আরও কত মুখ।

    আর সে বাজীকর? আমি তার অসংখ্য মিথ্যে কথার চাইতে তার মহানুভবতাকেই মনে রেখেছি। তার টাকার দরকার ছিলো, সে লোভী ছিলো না। আমি কোনোদিন্ সেই বাজীকরকে দেখিনি,আজও খুঁজি নিতান্ত একজন সৎ মানুষকে। যাকে কোনদিনও বলা হবে না- আমি আপনার কথা মনে রেখেছি, আপনি আসলেই ভালো মানুষ।

  • ফিরে আসার পর (পর্ব-২)

    ফিরে আসার পর (পর্ব-২)

    শাহেদের যেহেতু কোনও চাকরি ছিল না, কাজেই মিথির বাবা বিয়ের পর পরই তার নামে ব্যাংক একাউন্ট খুলে মাসে মাসে নির্দিষ্ট অংকের টাকা হাতখরচের জন্য রেখে দিতেন। শাহেদ সে টাকা খরচ করতো। মিথির শরীর দিন দিন দুর্বল হতে থাকে, শাহেদের এ ব্যপারে কোনও মাথাব্যথা ছিল না, বরং বিরক্ত লাগত। মিথি রাত হলে পাশের রুমে চলে যেত। মিথির মনে ক্ষীণ আশা ছিল, হয়ত তার স্বামী তাকে শরীরের অবস্থা জানতে চাইবে, তার জন্য ভালমন্দ এটা সেটা আনবে।কিন্তু বাস্তবে এ ধরণের কোনও ঘটনাই ঘটল না। মিথির তখন কেবল মনে হত, বাচ্চা হওয়ার পর নিশ্চয়ই শাহেদ আর এমন থাকবে না।

    এভাবেই মিথির ডেলিভারির দিন এগিয়ে আসল। শাহেদ এরই মাঝে সরকারি একটি চাকরীতে রিটেনে এলাউ হয়েছে। আজ তার ভাইবা, কাজেই একদিকে মিথির হাসপাতালে যাওয়া আর আরেকদিকে শাহেদের ভাইবা দিতে যাওয়া। মিথির নর্মাল ডেলিভারি সম্ভব হল না, সিজারিয়ান অপারেশন করে জমজ কন্যা সন্তানের মা হল সে। মিথির পাশে তার মা বাবা,বোন বোনজামাই ছিলেন, শাহেদ ছিল না।

    মিথির মা নাতনীদের নখ চুল কেটে দিলেন, গোসল দিলেন, আজ সাতদিন হয়। খবর পেয়ে শাহেদের বাবা মাও এলেন। শাহেদ এলো এর একদিন পর।

    কোথায় ছিল সে এতদিন, উত্তর নাই। শাহেদ মেয়েদের মুখ দেখে মিথির দিকে তাকিয়ে বললো, একসাথে দুই মেয়ের কি দরকার ছিল!

    মিথি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, শাহেদ তার রুমে চলে যায়। এর ঠিক এক মাস পর শাহেদের সরকারি চাকরিটা হয়ে যায়। শাহেদ এখন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। তার পোস্টিং অন্য জেলায় কাজেই সে ওখানেই চলে যাবে।

    অসংখ্য প্রশ্নবোধক চিহ্নে জর্জরিত মিথির চিন্তাক্লিষ্ট মুখ কেবল দেখল শাহেদের নিস্পৃহ চলে যাওয়া।
    মিথি একদিন শাহেদকে বলেছিল, ‘আপনার যদি এতটাই অমত ছিল তবে বিয়ে করেছিলেন কেন? মেয়েদের দিকেও আপনি ফিরে তাকান না?’-

    জবাবে শাহেদ নিষ্ঠুর এক বক্র হাসি উপহার দিয়েছিল।
    শাহেদ চলে যাওয়ার পর মিথি অপেক্ষা করেছিল শাহেদ ফোন দিবে, না দেয়নি,নাম্বারও আগেরটা নেই। শাহেদ যেন হারিয়েই গেল মিথির জীবন থেকে।

    কলকল হাসিতে শাহেদ চমকে তাকায়। রানু ওর ভাইবোনদের নিয়ে আনন্দে মেতে আছে। নীল শাড়িতে রানুকে আজ আরও বেশি সুন্দর লাগছে,৷ ইচ্ছে করছে ওর পাশে যায়, ওদের সাথে আড্ডায় মেতে উঠে।
    কষ্টে সেই ইচ্ছেকে দমন করে শাহেদ। রানু হয়ত বিষয়টা পছন্দ নাও করতে পারে। রানুর পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব অনেক বেশি শাহেদের কাছে।

    আসলে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে শাহেদ বড় হয়েছে অনেক টানাপোড়েনের মাঝে। মনের মাঝে বড় স্বপ্ন ছিল, স্বপ্ন পূরণের জন্য যা যা করতে হয়েছে শাহেদ তাই করেছে নির্দ্বিধায়। সে মস্ত বড় অফিসার হয়েছে, আরাধ্যা রানুকে পেয়েছে।

    যদিও রানুর বিষয়টি শাহেদের কাছে দুর্বোধ্য অনেক, রানু তাকে কতটা ভালবাসে কিংবা আদৌ ভালবাসে কি না সে বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারে না শাহেদ। তারপরও রানুর মত মেয়ে তার স্ত্রী, যা বন্ধুমহলে ঈর্ষার কারণ, তার শ্বশুরবাড়িও অনেকের ঈর্ষার কারণ, শাহেদের মহাতৃপ্তি ওই এক জায়গায়।
    রানু শাহেদের জুনিয়র ছিল। ভার্সিটিতে এমন কোনও ছেলে বোধহয় তখন কম ছিল যে রানুর সাথে একটু কথা বলতে পারলে ধন্য হত না।

    গ্রাম থেকে আসা শাহেদের চোখে রানু ছিল স্বপ্নের রাণী। রানুর চোখে পড়ার জন্যই শাহেদ ভাল প্রোগ্রামে যুক্ত রাখত নিজেকে, সবচেয়ে ভাল রেজাল্ট করার চেষ্টা করত। অবশেষে রানুর চোখে সে ধরা পড়েছিল বটে। তবে রানু শাহেদের প্রেমে পড়ে নাই। রানুর সুবিধা অসুবিধায় শাহেদ দৌড়ে যেত। সেরকমই একবার রানুর এক মামার জন্য নিজের রক্ত দিয়েছিল শাহেদ, গ্রুপটা ছিল রেয়ার। কাজেই সে সূত্রে রানুর কাছাকাছি আসার সুযোগ পায় শাহেদ। এরপর থেকে চিনাজোঁকের মতই রানুর পিছে লেগেছিল শাহেদ।

    রানুর বাবা তখন বড় কর্মকর্তা, দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, কাজেই রানু তাচ্ছিল্যের সাথে বলেছিল তুমি আগে আমার যোগ্য হও, তারপর ভেবে দেখব। শর্ত মেনেই রানুর সাথে শাহেদের সম্পর্ক, কিছুটা দূরত্ব ছিল সেই দূরত্ব আজও আছে কিনা শাহেদ বুঝতে পারে না।

    বাবার মন রাখতে গিয়ে শাহেদ বিয়ে করেছিল বটে, তবে সেসব শাহেদ মনে করতে চায় না, বাবার বাড়ির কারও সাথে শাহেদ সম্পর্কও রাখে না। শাহেদের জীবন এখন কেবলই রানুময়।

    শেষ যখন শাহেদ বের হয়ে এসেছিল — তারপর ঝাড়া দু’বছর লেগেছিল শাহেদের নিজেকে গুছাতে, রানুর উপযুক্ত হতে। শাহেদ হিসেব করে মনে মনে রানুর সাথে তার পাঁচ বছরের সংসার চলছে। রানু হাসছে, শাহেদ মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে, রানু সেই আগের মতই আছে।

    শহর থেকে কিছুটা দূরে নতুন একতলা বাড়িটা। বাড়ির কাজ চলছে পুরোদমে। শাহেদ তৃপ্তি নিয়ে দেখে, এই প্রথম সে একটা দামী উপহার রানুকে দিতে যাচ্ছে সে।যদিও রানুর কোনও শখ সে অপূর্ণ রাখেনি। কিন্তু এই যে বাড়িটা শাহেদ রানুর নামে করে দিচ্ছে রানু খুশি হবে, তার শ্বশুরবাড়ির লোকজনও নিশ্চয়ই খুশি হবে।

    বিবাহিত জীবনে রানুর কোনও দুঃখ নেই, বরং শাহেদ না চাইতেই সব দেয়, একটু বেশিই দেয়। রানুর কেবল মাঝে মাঝে একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিড়ে বেরিয়ে আসে।

    বিয়ের দশ বছর হতে চলল তাদের কোনও সন্তান নেই। রানু এ বিষয়টা কৌশলে এড়িয়ে যায়। কারণ সে জানে শাহেদ আগে বিয়ে করেছিল যদিও ওদের সাথে শাহেদের কোনও যোগাযোগ নেই। আর এও জানে যে শাহেদের জমজ দুটো কন্যা সন্তান আছে। কাজেই শাহেদের কোনও দোষ নেই, দোষ থাকলে রানুর। রানু নিজেই ভাবে তার নিজেরই মনে হয় মা হবার ক্ষমতা নেই। তার নিজেরই দোষ,কাজেই সে নিজে থেকে চুপ থাকে,শাহেদও কিছু বলে না। রানুর সংসারের সাথে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সম্পর্ক নেই, কাজেই তাকে কথা শুনানোরও কেউ নেই।

    চলবে…