Tag: গল্প

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৭)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৭)

    এক্সাম শেষ হয়েছে আজ বেশ কিছুদিন হয়ে গেলো। মনটা এই দিন গুলোতে প্রায়শই খারাপ যেতো। চেনা মানুষজনের এমন হুট করে পরিবর্তন যে কারো বুকে ঝড় তুলতে সক্ষম। খুব খারাপ একটা অনুভূতি আমাকে অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করছে। যাদেরকে নিজের ভেবে এসেছিলাম, দুজনের কেউ আমার কাছে নেই এখন। একজন নিরুদ্দেশ তো অন্যজন আমার মুখ অবধি দেখতে নারাজ।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। হয়তো ভার্সিটি লাইফ শেষ হবার আগেই বন্ধু বিচ্ছেদের স্বাদ নেওয়াটা আমার ভাগ্যেই ছিল।

    কিছুক্ষণ ওই দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম এক হাসির রেখার দেখা মিললো। এটা অবশ্যই আরহান এর জন্যই।

    আরহান বলেছিলেন না, ‘ভালোবাসি’ না বলেই ভালোবাসার উপলব্ধি করাবেন! হ্যাঁ! ভালোবাসার সহস্র রং চিনিয়েছেন। উনি যখন হাসেন, ইচ্ছে করে পুরো দুনিয়া ভুলে শুধু এই একটি মানুষের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। আরহান আমাকে নিজ ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া শিখিয়েছেন। সব ভুলে আমি উনার দিকেই তাকিয়ে থাকি। এ দেখার মধ্যে আলাদা এক শান্তি আছে। ভালো লাগা আছে।

    আরহান আমার সাথে রেগে কথা বলেননি কখনো। রাগ দেখাননি।

    ইদানিং আমার কি যেন হয়েছে, রাতে ঘুম আসে না। নির্ঘুম আমি সারাটা রাত ভরে আরহানকে দেখতে থাকি। আরহানের কাছাকাছি এলেই আমার হৃদস্পন্দনগুলো বেড়ে যায়। অন্যরকম কিছু একটা অনুভূত হয়। নাম না জানা একটা টান কাজ করে। আরহানের সামান্য প্রশংসাতেই লজ্জায় আমার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। আরহানকে খানিকক্ষণ না দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাঁসফাঁস করে। দুদিন ধরে শহরের বাইরে আছেন আরহান। আমি আরহানকে দেখতে পাইনি এই দুদিন। তবে যেনো মনে হচ্ছে, কতো জনম উনাকে দেখে চক্ষু তৃষ্ণা মেটাতে পারছি না।

    “উহুম উহুম! ভাবি বুঝি ভাইয়ার বিরহে আকাশের তারা গুনছে?”

    হালকা কেশে নিশা এই কথাটা বলে উঠলো। এতোক্ষণে খেয়াল করলাম, আমার পাশেই নিশা দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক কতক্ষন ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তা জানা নেই আমার। খানিকটা অপ্রস্তুতভাবে হেসে বললাম, “এমা! তুমি! কখন এলে?”

    নিশা হালকা হেসে বললো,“যখন তুমি তারা গুনতে ব্যস্ত ছিলে।”

    লজ্জা লাগছে ভীষন। মেয়েটা কি না কি ভাবলো!

    “ভাবি শোনো না!”

    “হুঁ! বলো।”

    “শাড়ি পরিয়ে দেবে? আমি না! শাড়ি পরতে জানিনা।”

    তীক্ষ্ণ নজরে তাকালাম নিশার পানে। হঠাৎ মাথায় শাড়ি পরার ভূত কোত্থেকে উদয় হলো এর? আমার এরূপ চাহনি দেখে নিশা মেকি হেসে বললো,“এভাবে তাকাও কেনো ভাবি? ভয় লাগে।”

    নিশার ছেলেমানুষী কথা বার্তায় আমিও হেসে ফেললাম।

    ___________________________

    “মা! এসব কি?”

    হাতের ডায়েরিটা দীপ্তি ওর মায়ের দিকে এগিয়ে এই কথাটা বললো। ওর মা একবার ডায়েরির দিকে তাকালো। এরপর আবার দীপ্তির দিকে।

    গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,“তোকে এই শিক্ষা দিইনি আমি। কাউকে না বলে তার জিনিস ধরাটা তোকে শেখাইনি।”

    “দেখো মা! মানছি আমি এটা দেখে অন্যায় করেছি। সেজন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু এখন তোমাকে এর উত্তর দিতে হবে। বলো তুমি। এটা কি?”

    দীপ্তির মা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ আর কি করে লুকোবে? সত্য যে সবটা সামনেই আছে। মৃদু কন্ঠে বললো, “যা জেনেছিস, সবটাই সত্যি।”

    “এসব লুকিয়ে এসেছো কেনো মা? কাউকে বলোনি কেনো?”

    “দুনিয়া অনেক কঠিন। আর দুনিয়ার মানুষ নিষ্ঠুর, পাষাণ। এরা তোর ক্ষততে নুন আর সুখে নজর খুব ভালো করে লাগাতে জানে। কখনো দুর্বলতা প্রকাশ করতে নেই। এরা তোকে ভেঙ্গে চূরে শেষ করে দেবে। আবার তোর আনন্দময় জীবনও এদের সামনে প্রকাশ করবি না। এদের হিংসে হয়। মারাত্মক হিংসে। অতি সহজেই তোর সুখময় জীবনকে ক্ষণস্থায়ী করে দেবে। এদের জন্য শুধু থাকবে কৃত্রিম হাসি। যেটা তোর ঢাল হয়ে দাঁড়াবে। এজন্যই মূলত কিছু জিনিষ অপ্রকাশিত থাকাই শ্রেয়।”

    “তাই বলে তুমি আমাকে বলোনি কেনো মা?”

    দীপ্তির প্রশ্নে তার মা মৃদু হেসে বললো,“কী হতো বলে? পুরনো ঘা তাজা বৈ আর কী’ই বা হতো? যা পেছনে ফেলে এসেছি, তা পেছনেই থাক না! কেনো সেগুলো মনে করে কষ্ট পাবো?”

    মায়ের কথায় দীপ্তি দমে গেলো। পুনরায় একটা কথা মস্তিষ্কে আসতেই বলে ফেললো,“মা! আপু কোথায়?”

    “ওর মামার কাছেই রেখে এসেছিলাম। আমার ভাই ওর খেয়াল রাখায় কোনো রকমের অপূর্ণতা রাখবে না।”

    __________________________

    শাড়ি পরিহিত নিশা নিচে নামতেই ড্রইং রুমে রুদ্রকে বসে থাকতে দেখে মাথা নিচু করে হাসলো। নিশা জানতো রুদ্র আসবে, এজন্যই শাড়ি পরেছে। লজ্জা মাখা মুখশ্রী নিয়ে নিশা এগিয়ে গেলো রুদ্রের দিকে।

    সামনে কারো উপস্থিতির আভাস পেয়ে রুদ্র চোখ তুলে তাকালো। একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলো। সেদিনের কথা ভীষণভাবে মনে পড়লো রুদ্রের। নিশাকে পাবার যেই এক চিলতে আশার আলো দেখেছিলো, তা নিমিষেই অন্ধকার হয়ে গেলো। নিশা যে অন্য কাউকে ভালোবাসে!

    কোনো কথা না বলেই, ফোন কানে নিয়ে উঠে চলে গেলো। এমন ভাব ধরলো যেনো এখানে রুদ্র ব্যতীত অন্য কেউ ছিলো না।

    হাস্যোজ্জ্বল নিশার মুখ নিকষ কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো। চোখ দুটো ছলছল করছে নিশার। এখানে আর একপলক না থেকে দৌঁড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। যার জন্য শাড়ি পরলো, সে যে ফিরেও তাকালো না।

    রাতের খাবার খেতে নিশা যখন নিচের নামলো তখন ওর ফোলা মুখশ্রী দেখেই বুঝে ফেললাম ও কেঁদেছে। কিন্তু কেনো, তা বুঝতে পারলাম না।

    নিশা এসে আমার পাশের চেয়ার টেনে বসলো। ধীরকণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,“কি হয়েছে? চোখ মুখ ফোলা কেনো?”

    অপ্রস্তুত নিশা বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো,“আসলে ভাবি, অবেলায় ঘুমিয়েছিলাম তো! এজন্য।”

    নিশার কথা বিশ্বাসযোগ্য ছিলো না। তবুও আর পাল্টা প্রশ্ন করলাম না।

    আরহানের কথা খুব মনে পড়ছে। খাবার না খেয়ে বার বার নেড়ে যাচ্ছি। খাচ্ছি কম, আরহানকে ভাবছি বেশি। আমাকে এভাবে দেখে মা বললেন, “কিরে মা! খাচ্ছিস না কেনো? কোনো সমস্যা?”

    বেশ গভীর ভাবনায় থাকার দরুন এভাবে ডাকায় চকিতে তাকালাম। মেকি হাসি দিয়ে বললাম,“না মা। তেমন কিছু না। খাচ্ছি।”

    “কি খাচ্ছিস দেখাই যাচ্ছে। নে, এদিকে আয়।”

    পাশের চেয়ারের দিকে ইশারা করে মা এই কথাটি আমাকে বললেন। এগিয়ে গিয়ে সেদিকে বসলাম। মা হালকা হেসে, খাবার মেখে আমার মুখের সামনে তুলে ধরে বললেন,“আমি যদি খাইয়ে দিতে চাই, তবে কি আমার মেয়েটা খাবে?”

    আমি হাসলাম। আরহান একদম উনার মায়ের মতো হয়েছে। এভাবে কথা বলা তো আরহান উনার মায়ের কাছেই শিখেছে।

    পাশ থেকে নিশাও ওর মন খারাপের রেশ সব পাশে রেখে বলে উঠলো,“আজ কেউ নেই বলে, নিজ হাতে খেতে হয়।”

    আমি আর মা নিশার এমন অভিমান মিশ্রিত কথায় হেসে ফেললাম। মা হাসিমুখে বললেন,“তুইও এদিকে আয়।”

    নিশাও এলো। এভাবেই মায়ের হাতে খেয়ে যাচ্ছি। না পাওয়া ইচ্ছেগুলো এভাবেই পূরণ হচ্ছে। মানুষের কোনো ইচ্ছে কখনো অপূর্ণ থাকে না। হয়তো তা আজ পূর্ণতা পাবে, কিংবা শতাব্দী বাদে। হয়তো সেটা বাস্তবে পাবে, কিংবা কল্পনায়। হয়তো সেটা নিজেকে ঘিরে পাবে, কিংবা সামনের মানুষটির মধ্যে নিজেকে দেখে।

    ______________________

    আজ আবারও এই রুমটাতে একা থাকতে হবে। উনার স্মেল আছে, তবে মানুষটাই যে এই রুমে নেই। একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলাম বেডের পাশে। সন্ধ্যায় নিশাকে শাড়ি পরিয়ে দেওয়ার দরুন রুমটা অগোছালো হয়ে আছে। গোছাতে গোছাতেই আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকাতেই ঠোঁটে হাসি চলে এলো।

    এগিয়ে গিয়ে রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে আরহান বললেন,“মিস ইউ শুকতারা…”

    একটা বাক্য! হ্যাঁ! এই একটা বাক্য কারো হৃদপিন্ডের স্পন্দন গতি বাড়াতে সক্ষম। কাতর কণ্ঠস্বর আরহানের। এভাবে কেউ বলে?

    আমাকে চুপ থাকতে দেখে পুনরায় আরহান বললেন,“আচ্ছা সেসব বাদ দাও। খেয়েছো?”

    “হুঁ, আপনি?”

    “হ্যাঁ। কি করছিলে এখন?”

    “এইতো কিছুনা।”

    “ঘুমোবে না? রাত হয়েছে তো অনেক।”

    আরহানকে এবার কি করে বলবো? উনি না থাকলে শান্তিতে দুচোখ এক করতে পারিনা। তবুও বললাম,“হুঁ, ঘুমোবো।”

    “আমার ফিরতে আরো দুদিন লাগবে।”

    রেগে গেলাম আমি আরহানের এই একটি কথায়। উনার তো কাল ফেরার কথা ছিলো। আরো দুদিন মানে?

    ধারালো কন্ঠে বললাম,“সেখানেই থেকে যান। আরো তিনটে বিয়ে করে নিন না! আসতে হবে না আপনার।”

    আরহান হাসলেন। শব্দ করেই হাসলেন। আমি তীব্র রাগে কল কেটে দিলাম। একেতো রাগিয়ে দিলেন, তার উপর হাসছেন!

    কিছুক্ষণ বাদে আরহানের নম্বর থেকে কল এলো। কেটে দিলাম আমি। আবারো এলো। এবারও কেটে দিলাম। তৃতীয় বারের মাথায় কল এলে রিসিভ করে কানে তুলতেই, ওপাশ থেকে আরহান বললেন,“রাগ করবে, রাগ ভাঙ্গাবো। বকবে তুমি? চুপচাপ বকা খাবো। তবুও দূরে যাবার কথা চিন্তা করবে না। এখন আমি কাছে নেই তোমার, চাইলেও নিজের কাছে বেঁধে রাখতে অক্ষম আমি। তাই কল কাটার কথা ভুলেও ভাববে না। বাড়ি ফিরলে না হয় মেরো, আটকাবো না।”

    পুরো কথাটা গম্ভীর ভাবে বললেও শেষ উক্তিটি হেসেই বলেছেন।

    “আচ্ছা এবার ঘুমাও।”

    “হুঁ, আপনিও।”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৬)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৬)

    “ভালোবাসি। মনের মণিকোঠায় ভালোবাসা নামক শব্দের আগমনের আগে থেকেই ভালোবাসি। হ্যাঁ, ভালোবাসি আমি। ভীষন রকমের ভালোবাসি।”

    নিশার ফোনালাপের এটুকু বক্তব্য শুনতেই রুদ্রের হৃদপিন্ডের স্পন্দন পরপর কয়েকটা মিস করে গেলো। যেনো থমকে গেলো সব। প্রিয় মানুষটির মুখে ভালোবাসার শব্দগুলো ভীষণ সুখময় হয়, তবে তা কেবলমাত্র নিজের ক্ষেত্রে। যখন প্রিয় মানুষটি অন্য কাউকে উদ্দেশ্য করে সেই একই শব্দগুলো বলে, তখন তা থেকে বিষক্রিয়া শুরু হয়। যেমনটা এখন হচ্ছে রুদ্রের মনে। পরবর্তী কোনো কথা কানে এলো না রুদ্রের। এক বুক যন্ত্রণা সহিত অতি দ্রুত প্রস্থান করলো সে। ভালো লাগছে না তার। এই দুনিয়ার কিছুই তার ভালো লাগছে না। ভালোবাসায় যে এতো যন্ত্রণা! এটা আগে জানলে কখনো, কোনো মানুষ, কাউকে ভালোবাসার কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবতো না।

    রুদ্রের যাওয়া আসা কোনোটাই টের পেলো না নিশা। সে তো বিশাল ব্যস্ত তার বেস্ট ফ্রেন্ড, রাহার সাথে কথা বলতে।

    “না রে রাহা! রুদ্র ভাইয়া এখনও আমার অনুভূতি বোঝে না। তাকে সত্যি আমি অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।”

    “তুই ভাইয়াকে বলেছিস তোর মনের কথা?”

    “আজব! আমি কেনো বলতে যাবো? আর তাছাড়া উনি তো আমার প্রতি তেমন কিছু ফিলই করে না। যদি ভাইয়াকে বলে দেয় এসব?”

    “থাক! বুঝলাম। তোর দ্বারা কিছুই হবে না।”

    “দেখ! তুই কিন্তু এবার বেশি বাড়াবাড়ি করছিস।”

    এভাবেই চলতে লাগলো রাহা আর নিশার কথা বার্তা।

    _____________________

    বেশ কিছুদিন ধরে রুশীর শরীর খারাপ করছে। খাবারে অনীহা আর দুর্বলতা যেনো দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। এই তো কিছুক্ষণ আগে, রাতের খাবার খেতে পারলো না সে। গা গুলিয়ে এলো। যার দরুন খাবার রেখেই উঠে রুমে চলে আসতে হলো তাকে। শরীরের এমন অবনতি চিন্তায় ফেলছে তাকে। হঠাৎ রুশীর আবার অস্বস্তি লাগা শুরু হলো। বুঝতে পেরেই দ্রুত বেগে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

    ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। শরীর চলছে না আর। এভাবেই রাতে খেতে পারেনি। তার উপর যেটুকু খেয়েছিলো তাও বমি করে এলো। আর পারছে না রুশী। চোখ বুজে এলো।

    সকালে ঘুম ভাঙতেই রুশীর চোখ যায়, তার পাশে শুয়ে থাকা মারুফের দিকে। একজন স্বামীর ঠিক যেই যেই গুন থাকা লাগে, সব আছে। কিন্তু মেয়েরা তো স্বামীর মধ্যে প্রেমিক খুঁজে। যে যত্ন করবে, ভালোবাসবে। রুশী সেরকম কিছু পায়নি। তার স্বামীর কাছ থেকে যা পেয়েছে, সবটাই দায়িত্ব ও কর্তব্য। ভালোবাসা নামক শব্দ থেকে এই সংসারটা একদম অপরিচিত। খাওয়া-পরার দায়িত্ব নিয়েছে তার স্বামী। কিন্তু সুখ কি এতেই সীমাবদ্ধ? অবশ্য রুশী নিজেও তো এখনও তাকে মেনে নিতে পারেনি। প্রথম রাতের মতো যতবার মারুফ কাছে এসেছে, ততবার রুশীর অস্বস্তি হয়েছে। দমবন্ধ হয়ে এসেছে। বার বার ইচ্ছে হয়েছে, যদি চোখটা বন্ধ করলেই সারাজীবনের মতো চোখ বন্ধ হয়ে যেতো!

    চোখ বুজে মনে মনে আওড়ালো,“শরীরের সাথে শরীরের সন্ধি হয়ে কি হবে? যেখানে দুটো মন এখনও দুজনের অজানা আর আলাদা। এটাই তো মুখ্য বিষয়।”

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুশী। এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচা বড্ড কষ্টের। পুনরায় মস্তিষ্কে প্রশ্ন এলো,“আচ্ছা! অয়ন কেমন আছে?”

    হয়তো রুশী ভালো নেই বলেই মস্তিষ্কে এমন প্রশ্ন এলো। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো রুশী। মাথা ঘুরে এলো। পুনরায় বিছানায় বসে পড়লো। এতো দুর্বল লাগছে কেনো?

    _________________

    দেখতে দেখতে দু’সপ্তাহ কেটে গেলো। এই দু’সপ্তাহে আরহান আমাকে পড়াশোনার উপরে রেখেছে। সত্যি বলতে বিরক্ত হয়ে গিয়েছি। মানে, উনার মনে কি দয়া মায়া নেই নাকি?

    সকালে ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে একটা হলুদ থ্রি-পিস পরে নিলাম। আজ অনেক দিন পর শাড়ি বাদে অন্য কিছু পরেছি। তাই নিজেকে কেমন যেনো লাগছে নিজের কাছে।

    আয়নায় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই আমিকে দেখছি। কতোটা পাল্টে গিয়েছি আমি! আগে শাড়ি পরতেই হিমশিম খেতাম। আর আজ সেই আমিই শাড়ি ছাড়া অন্য পোশাকে অস্বস্তি বোধ করছি। চেহারায়ও পরিবর্তন এসেছে। হয়তো সুখময় জীবন অতিবাহিত করার পরিণাম এই চেহারায় লক্ষণীয় হয়েছে।

    “শুকতারা! হয়েছে তোমার? যেতে হবে তো নাকি। তার আগে খাওয়াটা মাস্ট।”

    কথাটা শেষ করেই খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে এগিয়ে এলেন আরহান। কাছে এসে আমাকে বসতে বলে, নিজেও আমার সামনে বসে পড়লেন। অতি সন্তর্পনে মুখে তুলে খাওয়াতে লাগলেন।

    আরহানের হাতে খেতে খেতেই প্রশ্ন তুললাম,“আপনি খেয়েছেন?”

    “পরে।”

    “না। পরে কিসের? এখনই খাবেন।”

    আমার কথায় আরহান হাসলেন। ঠিক কি কারণে হাসলেন, তা আমার মস্তিষ্কে ধরেনি। একই প্লেট থেকে আরহানও খাওয়া শুরু করলেন।

    _________________

    আরহান আমার সাথেই ক্যাম্পাসে এসছেন। এখন আমাকে এখানে রেখে চলে যাবেন। আবার এক্সাম শেষ হতেই আমাকে নিতে আসবেন। গাড়ি থেকে আরহান আগে নেমে তারপর আমাকে নামালেন। আমি “বাই” বলে চলে যেতে নিলেই আরহান আমার হাত টেনে ধরলেন। আমি পিছে ফিরলাম। উনি মুচকি হেসে বললেন,“ঠান্ডা মাথায় এক্সাম দিয়ো। যেগুলো পারবে সেগুলো আগে এনসার করবে। কোনো এনসার মনে না পড়লে হাইপার হবে না। অনেক ভালো মতো পড়িয়েছি তোমাকে। সব পারবে তুমি। শুধু মাথা ঠান্ডা রেখো।”

    আরহানের কথা শেষ হতেই আমি “আচ্ছা” বলে চলে আসতে নিলেই, পুনরায় আরহান আটকালেন আমাকে। দুষ্টু হাসি দিয়ে বললেন, “খেয়াল রেখো। আমি তোমার মনে আছি বলে আবার এক্সাম পেপারে আমাকে নিয়ে লিখে এসো না।”

    লজ্জায় গাল দুটো রক্তিম হয়ে এলো। এই লোকটাকে নিয়ে আর পারা যায় না। দ্রুত হাত ছাড়িয়ে ক্যাম্পাসের ভেতরে চলে এলাম।

    কিছুটা এগোতেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এই মেয়েটিকে দেখে চোখ থমকে গেলো আমার। পরনে জলপাই রঙের শাড়ি। স্বর্ণের নাকফুল, চুড়ি। কপাল কুঁচকে এলো। এসব পরে ক্যাম্পাসে এসেছে কেনো রুশী? হন্যে হয়ে এদিক সেদিক কিছু একটা খুঁজে যাচ্ছে। আমাকে দেখেনি এখনও।

    এগিয়ে গেলাম রুশীর দিকে। পেছন থেকে কাঁধে হাত রাখতেই কেঁপে উঠলো রুশী। দ্রুত আমার দিকে ফিরতেই আমি প্রশ্ন করে বসলাম,“এতদিন পর? কই ছিলি তুই?”

    আমাকে দেখে রুশীর চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলেও, আমার প্রশ্নে ওর ভেতরের চাপা রাগ বেরিয়ে আসছে। রুশী রাগী নয়। রাগের ছিটে ফোঁটাও নেই ওর মাঝে। কিন্তু কষ্টের পরিমাণটা যে এতো বেশি হয়ে গিয়েছে! এই কষ্টময় জীবনের জন্য রুশী নিমিষেই আমাকে দোষী সাব্যস্ত করলো। সেদিন যদি আমাকে ও পেতো, তবে কখনোই এই বিয়ে করার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারতো না রুশী। অতিরিক্ত কষ্ট, যন্ত্রণায় রুশী হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলো। যার দরুন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলো। সেই মুহূর্তে আমাকে ওর ভীষণ প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু পায়নি।

    চাপা কন্ঠে বলে উঠলো,“আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য নই।”

    রুশীর উত্তর আমার কাছে সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিলো। কিছুক্ষণ বাদে হেসে ফেললাম।

    “দেখ রুশী। এতদিন বাদে দেখা হচ্ছে। মজা নিস না তো। অয়ন কোথায় এটা বল।”

    আমার এহেন প্রশ্নে রুশীর কণ্ঠের তেজ বেড়ে গেলো। অনেকটা চিল্লিয়েই বলে উঠলো,“মাথা খাস না। সর এখান থেকে। কাজ আছে আমার।”

    চলে গেলো রুশী। এই রুশী একদম আমার অপরিচিত। বিস্মিত, চমকিত আমি চুপচাপ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। রুশী এমন করলো কেনো? আর অয়ন কোথায়? অয়নের নম্বর ডায়াল করলাম। কল দিতেই প্রতিবারের মতো এবারও সুইচ অফ দেখাচ্ছে।

    পুরো ক্যাম্পাস খুঁজে নিলাম অয়নকে। পেলাম না।

    _____________

    এক্সাম দেয়নি অয়ন। নেহার কাছে শুনলাম, আজই নাকি রুশী ক্যাম্পাসে এসেছে। গত তিনমাসে আমার মতো রুশীও আসেনি। আর অয়ন নাকি প্রথম দুইদিন এসেছিলো। এরপর সে ও লাপাত্তা। অনেক কষ্টে অয়নের বাবার নম্বর জোগাড় করলাম।

    ক্যাম্পাসের পেছনের এই বকুল গাছ তলায় এসে দাঁড়ালাম। আরহানের আসতে একটু সময় লাগবে বলে আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। একা একা বেরোতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।

    ফোন বের করে অয়নের বাবার নম্বরে কল লাগলাম। তিনবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কল রিসিভ করলেন একজন মহিলা।

    আমি সালাম দিলাম। ওপাশের মহিলা সালামের জবাব দিলেন। কন্ঠটা কেমন যেনো শোনাচ্ছে। অসুস্থ হয়তো।

    “কাকে চাই?”

    “এটা অয়নের বাবার নম্বর!”

    মহিলাটি “হ্যাঁ” বলেই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো,“কে বলছো?”

    “আমি অয়নের বন্ধু।”

    “ওহ্! কি জন্য ফোন দিয়েছো?”

    “আসলে। অয়নের খোঁজ নিতে। কোথায় আছে ও?”

    কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতায় কাটলো। এরপর তেজী কন্ঠে বললো,“অয়ন তো আমাদের সাথে থাকে না। ওখানেই থাকে। তাহলে তোমরাই তো ভালো জানবে। তাইনা? কলেজে উঠে সেই যে ঝগড়া করে বাড়ি ছাড়লো, এরপর কি আর ফিরেছে? নাকি ফেরাতে পেরেছি আমরা? এই রগচটা ছেলে যে কি করে আমার গর্ভে এলো, জানি না আমি। সত্যি জানিনা। আর তোমাকেও বলছি, এই ছেলের জন্য আর কোনোদিন কল দেবে না।”

    অয়নের মা ছিলো! কল কেটে দিলো অয়নের মা। অয়ন কখনো ওর পরিবারের কথা আমাদের কাছে বলেনি। যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেছে। অয়ন যে অনেকদিন আগে থেকেই পরিবারের সাথে থাকে না, এটা বলেনি। একটা শ্বাস ফেললাম। ছেলেটা গেলো কই! আর রুশীরই বা হলো টা কি? চিন্তিত আমি ওভাবেই বকুল গাছের নিচে বসে পড়লাম।

    _____________________

    দুই ঘণ্টা ধরে হসপিটালের করিডোরে বসে আছে রুশী। কিছুক্ষন আগেই কিছু টেস্ট করিয়েছে। এতদিনের অসুস্থতা ওর কাছে ভালো লক্ষণ লাগছে না। ও নিজেও কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। সিউর হবার জন্যই টেস্ট গুলো করালো।

    রুশীর সবকিছু এলোমেলো লাগছে। কিছু মাস আগেও তো কত ভালো ছিলো! হাসি খুশি ছিলো! সারাক্ষণ ঠোঁটের কোণায় হাসি লেগেই থাকতো। জীবনের মানে তখন তার কাছে কেবল হাসি,আনন্দ,সুখ ছিলো। কষ্ট লাগতো না তো! ওর সামান্য কষ্টতে যে ওর প্রিয় মানুষের বুকে রক্তক্ষরণ হতো। আজ সেই প্রিয় মানুষ নেই। সব উল্টে গিয়েছে রুশীর। হয়তো ক’দিন বাদে স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু না পাবার দীর্ঘশ্বাস নিয়েই আজীবন কাটাতে হবে রুশীর। এক অন্তরীক্ষ কষ্টের সাথে কিছু অপূর্ণতা নিয়েই চলতে হবে বাকিটা জীবন। কান্না পাচ্ছে রুশীর। কিন্তু চোখের জল যে সেই কবেই শুকিয়ে গিয়েছে।

    ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে উচ্চারণ করলো রুশী,“যদি ভাগ্যে তুই না’ই ছিলি, তবে কেনো এলি জীবনে?”

    কিছুক্ষণ বাদে একটা নার্স এগিয়ে এসে বললো,“ম্যাম! ডক্টর আপনাকে ডেকেছে।”

    রুশী এগিয়ে গিয়ে ডক্টরের কেবিনে ঢুকলো।

    _______________

    স্তব্ধ, বিমূঢ় রুশী চুপচাপ বসে আছে নিজের ঘরে। হাতে তার রিপোর্ট। মাথায় ঘুরছে ডক্টরের সেই একটা কথাই। রুশীকে দেখে বিন্দুমাত্র ধারণা করার উপায় নেই যে ও অতিরিক্ত খুশিতে কথা হারিয়ে ফেলেছে নাকি তীব্র কষ্টে বাকশক্তিহীন হয়ে গিয়েছে। হয়তো একটাও না। আবার হয়তো দুটোই। একবার পুনরায় রিপোর্টে দেখে নিলো। নিজের পেটের উপর হাত রাখলো। মুচকি হাসলো। তবে বেশিক্ষণ থাকলো না এই হাসি। মুহূর্তেই নিভে গেলো। চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পরলো। বুকটা হাহাকার করছে রুশীর। ভাগ্য এতো নির্মম কেনো?

    আবারও ডক্টরের কথা মনে পড়লো। যখন সে বলেছিলো, “কংগ্রাচুলেশন মাই ডিয়ার। তুমি মা হতে চলেছো। তোমার প্রেগন্যান্সির আড়াই মাস চলছে।”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৫)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৫)

    “শুকতারা! আর ইউ ওকে?”

    আরহানের আওয়াজে আমার বন্ধরত চোখ মেললাম। পুনরায় একবার জানালার বাইরে তাকালাম।

    কিয়ৎক্ষণ পূর্বে, যেই গাড়িটি আমাদের ফলো করছিলো এবং শুট করছিলো, সেই গাড়িটি খাদে পড়ে যায়। আর বিকট শব্দ হয়। সেই শব্দে চিৎকার করে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলি।

    আরহানের দিকে তাকালাম এবার। অস্থির ভঙ্গিতে বার বার শুধিয়েই যাচ্ছেন, আমি ঠিক আছি কি না!

    “ঠিক আছি। কিন্তু, কি ছিলো এটা?”

    আমার করা প্রশ্নের প্রেক্ষিতে আরহান বললেন,“তৃষ্ণা বাদে যে তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছিলো, এটা তার লোক। আর যে ছিলো, সে তোমাকে মারতে চাচ্ছিলো।”

    “আপনি কি করে বুঝলেন, এটা অন্য কেউ? তৃষ্ণা নয়?”

    আরহান হালকা হেসে বললেন,“তৃষ্ণা যা করবে, সবটাই সামনে। আর ও মারতে চাবে না।”

    আমি আর কিছু বললাম না। এই তিন মাসে এমনটা প্রায়শই ঘটেছে।

    আরহান গাড়ি ঘুরিয়ে নিলেন। মূলত ইচ্ছে করেই আরহান এই পাহাড়ি রাস্তায় এসেছেন। এতো দ্রুত চালিয়েছেন বলে, সেই লোকটা বুঝে উঠতে পারেনি আরহানের পরিকল্পনা। অতঃপর যা হবার হলো।

    _______________________

    আজ অনেকদিন বাদে তৃষ্ণা তার মামনির কাছে যাবে। রেডি হচ্ছে। তৃষ্ণার দুটো বাড়ি। একটাতে ওর মামনি আর বোন থেকে। আর অন্যটা এটা, যেটাতে তৃষ্ণা দুঃখবিলাস করে।

    রেডি হয়ে গাড়ি নিয়ে চলে এলো এবাড়িতে। বাড়িতে ঢুকতেই, কিচেন থেকে তৃষ্ণার মামনি তৃষ্ণাকে দেখে আবেগাপ্লুত হয়ে বলে উঠলো,“বাবাই! তুই এসেছিস!”

    তৃষ্ণা হাসলো। মুচকি হেসে জবাব দিলো, “হ্যাঁ মামনি। ছুটকি কোথায়?”

    “আরে! মেয়েটা কে নিয়ে না আর পারি না! দেখ গিয়ে, এখনও ঘুমোচ্ছে।”

    তৃষ্ণা উৎকন্ঠিত স্বরে বলে উঠলো,“সেসব বাদ দাও তো! আগে এটা বলো, অফিসে যাওনি কেনো আজ?”

    “শরীরটা ভালো লাগছে না রে! তিনদিনের ছুটিতে আছি। সব কাজ ম্যানেজারকে বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি।”

    মামনির কথাটা শেষ হতে না হতেই তৃষ্ণা অস্থির হয়ে গেলো। দ্রুত বেগে মামনির কাছে গিয়ে অগোছালো শব্দে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে তোমার মামনি? বলো নি কেনো? কি হয়েছে?”

    মামনি মুচকি হাসলো। মনে মনে ভাবছে, এই ছেলেটা তার কতো খেয়াল রাখে!

    “তেমন কিছু না। উইকনেসের জন্যই আর কি। বুঝিসই তো। বয়স হয়ে গিয়েছে। আর বাঁচবোই বা ক’দিন!”

    কথাটা শেষ করে সোফায় গিয়ে বসলো মামনি। তৃষ্ণা এগোলো সেদিকে। মামনির সামনে মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে, মামনির দুই হাত নিয়ে নিজের দু গালে রেখে বললো,“তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই মামনি। প্লিজ এভাবে বলো না।”

    তৃষ্ণার চোখদুটো ছলছল করছে। আসলেই যে তৃষ্ণার আর কেউ নেই। তৃষ্ণা তার মামনির কোলে মাথা রাখলো। মামনি, তৃষ্ণার মাথার চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে বললো, “এতোদিন পর এলি যে! মন খারাপ তোর?”

    তৃষ্ণা মাথা তুলে তার মামনির পানে তাকালো। এই একটা মানুষকে কোনো কিছু বলে বোঝানোর প্রয়োজন পড়ে না। সব বুঝে যায়। ম্যাজিক এটা!

    আলতো কন্ঠে “হুঁ” বললো তৃষ্ণা। মামনি আর এই নিয়ে প্রশ্ন তুললো না। কেনোনা তিনি মন খারাপের কারণগুলো জানেন।

    “ভাইয়া! কখন এলি?”

    আওয়াজ পেয়ে সিঁড়ির দিকে তাকালো তৃষ্ণা। দীপ্তিকে দেখেই তৃষ্ণা ঠোঁটের কোন ঘেঁষে লম্বা একটা হাসির রেখা টানলো। মামনি আর দীপ্তি! এই তো তৃষ্ণার পরিবার।

    দীপ্তি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। অনেকটা কাছাকাছি আসতেই তৃষ্ণা বলে উঠলো,“তুই যখন ব্যাঙের মতো নাক ডেকে ঘুমোচ্ছিলি, তখন এসেছি।”

    “ভাইয়া!”

    “ইস রে! চিল্লাচ্ছিস কেন? সবাই তোর মতো তো বয়রা না।”

    “দেখ ভাইয়া! তুই সবসময় আমার সাথে এরকম করে কথা বলবি না।”

    তৃষ্ণা ডোন্ট কেয়ার ভাবে বললো,“অবশ্যই বলবো।”

    দীপ্তি ওর মায়ের কাছে এসে কান্না কান্না ভাবে বললো,“দেখলে মা! তোমার বাবাই সবসময় আমার সাথে কেমন করে কথা বলে!”

    মামনি হাসলো। এই দুইটা এখনও বাচ্চা কালের মতোই ঝগড়া করে।

    “ধুর!আচ্ছা আমি যাই। ফ্রেশ হয়ে আসি।” —বলেই দীপ্তি চলে গেলো।

    “আচ্ছা মামনি! এদিকে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”

    তৃষ্ণার প্রশ্নের প্রেক্ষিতে মামনি বললো,“তোর কাছে আর কি লুকোবো? এতো গুলো বছর পর এই শহরে ফিরেছি তো, এজন্যই আর কি।”

    তৃষ্ণার বলার কোনো শব্দ নেই। তবুও কিছু বলতে হবে। এই মুহূর্তে চুপ থাকাটা মানাবে না। তাই বলে উঠলো,“সেসব বাদ দাও। অফিসে কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? সিলেটের মতোই মানিয়ে নিতে পেরেছো?”

    “হ্যাঁ! প্রথম প্রথম একটু সমস্যা হয়েছিলো। তবে এই তিনমাসে অনেকটা গুছিয়ে নিয়েছি।”

    তিন মাস আগেই তৃষ্ণার মামনি সিলেট থেকে এই ব্যস্ত নগরীতে পুনরায় পা রেখেছেন। যেখানে ফেলে রেখে গিয়েছিলেন ভাগ্যের নিষ্ঠুর এক ইতিহাস। বিগত আঠারো বছর যাবত তিনি সিলেটে থেকে, তৃষ্ণার বাবার সিলেটের অফিস সামলেছেন। নিজেকে ব্যস্ত রাখার এক প্রয়াস এটা। এই শহরে ফিরে আবার এখানকার অফিসে লেগে গিয়েছেন। খালি হাতে বসে থাকা ভীষণ অপছন্দের লাগে, তার কাছে। এখানে আসার কোনো ইচ্ছে ছিলো না। অনিচ্ছে মেশানো হাজারো কারণ ছিলো। তবুও আসতে হয়েছে। এসেছে মূলত দীপ্তির জন্য। মেয়ের ইচ্ছে ছিলো এই শহরেই পড়াশোনা করবে। ইচ্ছে ছিলো নাকি জেদ সেটা দীপ্তিই ভালো জানে। অগত্যা মেয়ের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে আবারও ফিরতে এলো এখানে। যেখান এক কাহিনী অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছিল, হয়তো সেই কাহিনীই সম্পূর্ণ করতে।

    _________________

    শাওয়ার নিয়ে বেরোতেই বেডে বসে থাকা আরহানকে দেখে, সেদিকেই আমার দৃষ্টি থমকে গেলো। ল্যাপটপ কোলে তুলে কিছু একটা করছেন। পূর্ণ মনোযোগ তার সেদিকেই। আমার নজর উনার গভীর নয়ন জোড়ায়। উনার চোখের অগোচরে আমার চোখের ক্যানভাসে উনাকে আঁকছি। মুগ্ধ এই নজরে দেখে যাচ্ছি আমার সামনে থাকা চাঁদকে। যা একান্তই আমার নিজের। মাথা নিচু করে হালকা হাসলাম।

    এখানে আর দাঁড়িয়ে না থেকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এগিয়ে গেলাম। আমার আরহানের পাশে এসে দাঁড়ানোতে আরহান চোখ তুলে তাকালেন। উনার স্থির দৃষ্টি আমার আপাদমস্তক অবলোকন করে নিলো।

    হুট করেই ল্যাপটপটা পাশে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। আমার কাছে এগিয়ে এসে হাত থেকে টাওয়াল নিয়ে বললেন,“চুলগুলোও ঠিক মতো মুছতে পারো না! নাকি আমাকে দিয়ে চুল মোছানোর ধান্দা!”

    কথাটা শেষ করেই হালকা হেসে পুনরায় আবার বললেন,“দেখো! এরকম হলে এতো ভনিতা না করে সরাসরি বলে দিলেই পারো। আমার অবশ্য ভালোই লাগবে।”

    আরহানের এহেন কথায় আমার এতক্ষণের লজ্জা, মুগ্ধতার পরিসমাপ্তি ঘটলো। চোখ বড় বড় করে আয়নাতে, পেছনে দাঁড়িয়ে আমার ভেজাচুলগুলো মুছতে থাকা এই লোকটির দিকে তাকালাম। প্রায়শই আরহান এরকম ভাবে কথা বলে আমাকে লজ্জায় ফেলে দেয়। তবে এখন লজ্জা শরমের ধারের কাছে না গিয়ে মুহূর্তেই আবিষ্কার করে ফেললাম,‘এই লোকটা একটা বিশাল আকারের অসভ্য ও নির্লজ্জ।’ নয়তো কি এভাবে কেউ কথা বলে?

    মনের মাঝে আরো একটা কথা এলো,‘লোকটা ইন্ট্রোভার্টই ভালো ছিলো।’

    “হয়েছে। এখন, এখানে বসে পড়ুন তো শুকতারা।”

    ভেজা টাওয়েলটা পাশে রেখে আমাকে একথা বলে সামনের টুলে বসিয়ে দিলেন আরহান। এক নজর পুনরায় আমাকে দেখে বললেন,“আজ আমার এই মিষ্টি বউকে নিজ হাতে সাজাবো আমি।”

    নাহ্! আর পারলাম না। লজ্জা না পেয়ে আর থাকতেই পারলাম না। আরহানের কথাটা শেষ হতে না হতেই আমার গাল দুটো ঈষৎ রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে। কান দিয়ে যেনো ধোঁয়া বেরোচ্ছে। অজান্তেই ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে গিয়েছে।

    আরহান ড্রয়ার থেকে একটা বক্স বের করলেন। এতে ঝুমকো আছে অনেকগুলো। সবগুলোই আরহানের পছন্দের। কানে পরিয়ে দিলেন সেখান থেকে একজোড়া ঝুমকো। দুই হাত ভরে চুড়ি পড়িয়ে দিলেন। এরপর হাঁটু মুড়ে মেঝেতে আমার ঠিক সামনে বসে পড়লেন। আমার পায়ের দিকে হাত বাড়াতেই আমি পিছিয়ে নিলাম।

    আরহান একটা শ্বাস ফেললেন। বোধহয় বিরক্ত হলেন। পুনরায় আমার পা এগিয়ে নিয়ে, পায়েল পরিয়ে দিলেন। চির কাঙ্ক্ষিত এই স্পর্শগুলোয় অনুভব করছি, যেনো কেউ আমার বুকে ঢেউ তুলে দিচ্ছে। হৃদপিন্ড অস্বাভাবিক। দম হয়তো গলায় আটকে আছে। আমার উন্মাদের মতো হাসফাঁস করতে থাকা অবস্থায়ই আরহানের সজ্জাকার্য পুরন হলো।

    _____________________

    দুপুরের কড়া রোদে ছাদে এসেছে রুশী। ভেজা কাপড় গুলো মেলে দিচ্ছে। ক্ষণে ক্ষণে রুশীর হৃদপিন্ড অচল হয়ে আসে। বার বার রুশী মনে করে, এই যেনো তার শেষ নিশ্বাস। রুশী যে আর আগের রুশী নেই। চঞ্চল, প্রাণোচ্ছল, মিষ্টি রুশী আজ যেনো পাথর বনে গিয়েছে। হাসি নেই রুশীর ঠোঁটে। কান্না গুলোও যেনো শুকিয়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে রুশীর, এই শরীরকে টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলতে। অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ আছে যে এতে। রুশী ভেতরে ভেতরে মরে গিয়েছে। প্রতি ক্ষণে প্রার্থনা করে, যেনো মাটির এই শরীরটাও মাটিতে মিশে যায়। এই ভারী শরীর বহন করতে পারছে না রুশী।

    “কি গো বউ! এতক্ষণ ছাদে কি করো? দুপুরের রান্দুন লাগবো না?”

    দাদী শাশুড়ির ডাক পেয়ে রুশী জোরালো আওয়াজে “আসছি” বলেই দ্রুত নিচে চলে গেলো। এই বাড়ির নিয়ম আছে এটা, সব কাজ করার জন্য লোক থাকলেও, রান্নাটা বাড়ির বউকেই করতে হয়। সেই হিসেবেই রান্নায় লেগে গেলো। যদিও তার শাশুড়ি সবকাজেই সাহায্য করে।

    রান্না শেষ করতেই তার খেয়ালে এলো, সামনে পরীক্ষা। এই সুযোগে যদি একটাবার ছেলেটাকে দেখা যায়!

    দ্রুত পায়ে নিজের রুমে এলো। বন্ধের দিন আজ। তার স্বামী বাড়িতেই আছে। রুমে গিয়ে তার সামনে দাঁড়ালো।

    “শুনছেন! একটা কথা বলার ছিলো।”

    রুশীর আওয়াজ পেয়ে মারুফ ফোন রেখে রুশীর পানে চাইলো। মৃদু স্বরে “বলো” বললো।

    অনুমতি পেয়ে রুশী বললো,“দুই সপ্তাহ বাদে আমার পরীক্ষা আছে। আমি কি পরীক্ষা দিতে পারি?”

    মারুফ সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রতি উত্তর করলো না। মিনিট পাঁচেক ভেবে, বললো,“আচ্ছা।”

    তিনমাসে আজ প্রথম রুশীর ঠোঁটে হাসি এলো। অনেক সূক্ষ্ম হাসি। আগের মতো মিষ্টি হাসতে ভুলে গিয়েছে রুশী। এই হাসিতে কেবল বিষ আছে। না পাওয়ার বিষ।

    ________________________

    সামনে এতগুলো বই দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। মাথা আউলিয়ে যাচ্ছে। আমিতো এই কয়েকমাসে অলসতার দেবী হয়ে গিয়েছি। পড়া লেখা! কিভাবে কি?

    পুনরায় বই থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরহানের দিকে নিক্ষেপ করলাম। আমার অসহায়ত্ব দেখেও আরহানের বেখেয়ালি ভাব, আমার রাগ উঠাচ্ছে। হ্যাঁ! ভীষণ রকমের রাগ হচ্ছে।

    “এগুলো কি?”

    আমি তেজী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম আরহানকে। একই ঢং-এ থেকেই আমাকে বললেন,“বই এগুলো। কেনো দেখতে পাচ্ছো না?”

    আমার আরেকটু কাছে এসে আমাকে ব্যঙ্গ করে বললেন,“বলি চোখেও কি সমস্যা হয়েছে নাকি? আগে বলবে না? চলো ডক্টর দেখাতে হবে।”

    হেসে ফেললেন আরহান। আমার রাগ এখন আকাশচুম্বী। এরকম ভাবে মজা নেয় কেনো এক লোক?

    চিল্লিয়ে বলে উঠলাম,“ইয়ার্কি হচ্ছে এখানে? আমি পড়ালেখা করবো না।”

    “আচ্ছা। নিড রোমান্স, না? ওকে! আ’ম রেডি। কাম।”

    চোখ দুটো বিশালের চেয়েও বিশালাকার ধারণ করলো। লোকটা আস্ত একটা অসভ্য। নয়তো কেউ এভাবে বলে? ধুর! উনার সাথে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। রাগকে রাগ হিসেবে নিলে তো!

    মুখটা অসহায় করে মিনমিনে কন্ঠে বললাম,“দেখুন না! এখন কিভাবে এতো কিছু পড়বো?”

    “সে আমি কিছু জানিনা। অনেক তো গায়ে হাওয়া লাগিয়ে নিশার সাথে নেচে কুঁদে বেড়ালে। সামনে এক্সাম আছে। এখন একটু পড়াশোনা করুন ম্যাম।”

    আরহানের কথায় আর কিছু বললাম না। ঠিকই বললেন। এতদিন পড়া হয়নি। এখন পড়তে হবে তো। সামনেও এক্সাম।

    মুখটায় বিরক্তির ছাপ নিয়ে পড়তে বসলাম। আরহান আমার এরূপ অবস্থা দেখে মিটমিটিয়ে হাসা শুরু করলেন।

    ______________________

    আরহান কিছু কাজের জন্য রুদ্রকে ডেকেছে বাড়িতে। কিছুক্ষণ আগে একটা কল আসায় রুদ্র ছাদে চলে যায়। এখানে এসেই ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা এক অপ্সরীর দিকে নজর থমকে যায়। চাঁদের আলোয় কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে। খোলা চুলগুলো বাতাসের বদৌলতে নেচে উড়ছে। মুখে রয়েছে সেই মোহময় হাসি। হাসার সময় চোখদুটো ছোট ছোট হয়ে যায়। আর বা গালে ডিম্পল পড়ে। আবারো তার দুনিয়া থমকে গেলো এই মায়াবিনীকে দেখে। রুদ্র যেনো হারিয়ে গেলো কোথাও একটা। সেদিনের প্রত্যাখ্যানের কথা ভুলে গিয়ে নিশার দিকে অগ্রসর হলো রুদ্র।

    দুই কদম এগোতেই নিশার বলা একটা কথায় রুদ্রের হৃদপিন্ডে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গেলো। শ্বাস হঠাৎ যেনো আটকে গেলো।

    ফোন কানে নেওয়া নিশা ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটিকে বলছে,“ভালোবাসি। মনের মণিকোঠায় ভালোবাসা নামক শব্দের আগমনের আগে থেকেই ভালোবাসি। হ্যাঁ, ভালোবাসি আমি। ভীষন রকমের ভালোবাসি।”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৪)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৪)

    গাড়ি আবার চলছে। লোকালয় ফেলে অনেকটা দূরে এসে গিয়েছে। তবে অসুস্থ হৃদযন্ত্র আমার এখনও কিছুক্ষণ আগের ঘটনা ভেবে কেঁপে কেঁপে উঠছে। এখনও লজ্জিত মুখশ্রীর রক্তিম আভা যায়নি। তখন যেভাবে সিটের সাথে এঁটে বসেছিলাম। এখনও ঠিক তেমনটি বসে রয়েছি।

    এই তিনমাস আরহানের কাছে থাকা সত্বেও আরহান দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখেই মনের সান্নিধ্য পেতে চেয়েছিলেন। বার বার চোখের সামনে ভেসে আসছে কিছুক্ষণ আগের আরহানের করা সেই কাজটি।

    “গান শুনে আমাকেই ফিল করছিলে? এখন কাছে এলাম। নাও ফিল মি!”

    কথাটি শেষ করেই দু-চোখের পাতায় পরপর দুটো চুমু খেয়েছেন। হৃদপিন্ড আমার কয়েকটা স্পন্দন মিস করে অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গিয়েছিলো। আরহান বাঁকা হেসে সরে গেলেন। এরপর “এটুকুতেই এই অবস্থা! আর তো…” বলেই পুনরায় গাড়ি চালানোতে মনোযোগী হয়েছেন। তখন থেকে এরকম পাথরের ন্যায় বসে আছি। ইশ! কি লজ্জা!

    কিছুক্ষণ বাদেই গাড়িটা একটা গ্রাম্য এলাকায় প্রবেশ করলো। গ্রামের সরু পথ। দুই পাশে সারি সারি গাছ। আরহান এসি অফ করে জানালা খুলে দিলেন। লজ্জা, সংকোচ সব সাইডে ফেলে, এই পরিবেশ উপভোগে মন দিলাম। শহরে থাকা ও বড় হবার মাঝে গ্রামে আসার কোনো সুযোগ পাইনি। জানালার বাইরে মাথা নিলাম। প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম একটা। মিষ্টি একটা সুবাস মিশে আছে এই প্রকৃতিতে। এখানে যানবাহনের কর্কশ আওয়াজ নেই। আছে পাখির মিষ্টি মধুর গান। কি সুন্দর লাগছে!

    বিকেলের শেষ ভাগে এই প্রকৃতি যেনো বধূ বেশে আছে। হালকা লালচে আভা দেখা যাচ্ছে ঐ পশ্চিমাকাশে। মুগ্ধ নয়নে এই গ্রাম্য পরিবেশ উপভোগ করে যাচ্ছি আমি। আর আরহান উপভোগ করছে আমার এই খুশিতে পুলকিত হওয়া নয়ন জোড়া। আমার খুশিতে যেনো উনার পুরো পৃথিবী জ্বলজ্বল করে উঠে। ঠিক তেমন ভেবেই উনিও মুচকি হাসলেন। কিছুটা দূরে এসে গাড়ি থামালেন।

    হুট করে থেমে যেতে দেখে আমি মাথা ঘুরিয়ে আরহানের দিকে তাকালাম। ততক্ষণে আরহান গাড়ি থেকে নেমে পড়েছেন। এপাশে এসে ডোর খুলে আমাকেও নামতে বললেন। অতঃপর নেমে গেলাম আমি।

    আমার ডান হাতটি নিজের বা হাতের মুঠোয় বন্দী করে হাঁটা ধরলেন এই জনমানবহীন শান্ত রাস্তায়। আমিও হাঁটছি। হাঁটতে হাঁটতে একটা নদীর কিনারায় চলে এলাম। একপাশে শুভ্র কাশফুল ফুটে আছে।

    আরহান আমার হাত ছেড়ে গিয়ে নদীর কিনারায়, পানিতে পা ভিজিয়ে বসে পড়লেন। আমি উনার পিছে দাঁড়িয়ে আছি। আরহান মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন।

    “বসে দেখো এখানে। ভালো লাগবে ভীষণ।”

    আরহানের কথায় এগিয়ে গেলাম। শাড়ি নিয়ে পানিতে বসতে সমস্যা হচ্ছে। ভিজে যাবে তো। আরহানকে নিজের সমস্যার কথাটা স্বীকার করলাম।

    আরহান হালকা হেসে বললেন,“তো ভিজুক না!”

    আমিও আর কিছু না বলে বসে পড়লাম। আরহান কিছুক্ষণ বাদে বললেন,“এই জায়গাটা আমার ভীষণ পছন্দের একটা জায়গা। প্রায়শই এখানে আসি। ভাবলাম, তোমাকেও নিজের সব ভালোলাগার সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।”

    পাঁচমিনিট, দশমিনিট করে সময় চলছে। নীরবতার মাঝে এ যেনো একটা প্রশান্তিময় সুখ! আস্তে করে মাথা এলিয়ে দিলাম আরহানের কাঁধে। এই তো! আমার শান্তির স্থান। আর কি লাগে? আরহান হালকা হাসলেন। আমি চোখ বন্ধ করে এই মুহূর্তটা উপভোগ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।

    কিছুক্ষণ বাদে চোখ দুটো খুললাম। মনে হলো সময় খুব একটা হয়নি। কিন্তু এ দেখি গভীর রজনী। আঁখি পল্লব মেলে এই জোৎস্না স্নাত রাতটি অবলোকন করে নিলাম। নদীর এই সচ্ছ পানিতে পূর্ণিমার এই চাঁদটা দেখলাম। মনে মনে বলে উঠলাম,

    “আপনি আর আমি,

    গভীর এক রাত, আছে পূর্ণিমার চাঁদ..

    নির্জন এই পরিবেশে, আমার মাথার নিচে আপনার কাঁধ..

    সাথে জোনাকির ডাক, আমার হাতের ভাঁজে আপনার হাত..!”

    হুট করেই আরহান আমাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলাতেই আরহান আমার হাত ধরে আস্তে আস্তে দৌঁড়াতে লাগলেন। নদীর কিনারায় দৌঁড়িয়ে যাচ্ছে একজন যুবক ও একজন যুবতী। একদম মনে গেঁথে যাবার মতো দৃশ্য।

    বেশ কিছু দুর আসতেই, আরহান পাশ থেকে এক গুচ্ছ কাশফুল হাতে তুলে নিলেন। একটু দুরত্ব বজায় রেখেই হাঁটু ভেঙ্গে বালিতে বসে পড়লেন। মাথা নিচু করে চুপ মেরে রয়েছেন। নিশ্চুপ আমিও আরহানের কথা বলার অপেক্ষায় আছি।

    কিছুক্ষণ বাদে আরহান মাথা তুলে তাকালেন। পূর্ণিমার চাঁদের জোৎস্নায় আরহানের মুখশ্রী কি মায়াবী দেখাচ্ছে! চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে আরহানের। গভীর চক্ষুদ্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছি। এই আরহানকে ভীষণ পছন্দ আমার। ভীষণ!

    কাশফুলগুলো আমার সামনে তুলে ধরে বললেন,

    “পূর্ণিমা রজনীতে, খোলা অন্তরীক্ষের সামনে হাঁটু মুড়ে বসে, এই প্রকৃতিকে সাক্ষী রেখে বলছি, আমার সমস্ত সুখ তোমার নামে বরাদ্দ করে দিলাম। তোমার কষ্টসব অতি সন্তর্পনে নিজের করে নিলাম। ‘ভালোবাসি’ শব্দটা অনেক ছোট। আর বলবো না এটা, যতদিন না তুমি বুঝবে এই ভালোবাসার গভীরতা। ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসার চাদরে মুড়ে রাখবো তোমায়, ভালোবাসার সহস্র রং চেনাবো। মুখে বলা ছাড়া ভালোবাসার উপলব্ধি করাবো। এই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত এভাবেই ভালোবেসে যাবো। পরপারেও শুধু তোমাকেই ভালোবাসা দেবো। গ্রহণ করবে কি আমাকে?”

    _______________________

    নিশুতি নিশিতে মাতাল তৃষ্ণা একটার পর একটা বোতল খালি করে যাচ্ছে। কষ্ট বাড়ছে বৈ কমছেই না। খুব করে চাচ্ছে নিজেকে নেশার সাগরে ডুবিয়ে রাখতে। কিন্তু বেঈমান এই নেশাদ্রব্য ওর কোনো প্রকার নেশা তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে না। আগের তৃষ্ণা এই কষ্ট লাঘব করতে, কোনো না কোনো নারীতে মত্ত থাকতো। কিন্তু এই তৃষ্ণা যে তার নয়নতারাকে ‘শেষ নারী তুমিই হবে’ বলে কথা দিয়ে ফেলেছে।

    নির্জন বাড়িতে একা তৃষ্ণা, কষ্টের পাহাড় বুকে নিয়ে চিৎকার করেই যাচ্ছে। কিন্তু শোনার কেউ নেই।

    “এতদিন পর কাউকে দেখে এতো মায়া কাজ করলো। কাউকে মনের মণিকোঠায় জায়গা দেবার সাধ জাগলো। কারো জন্য আমার আসক্তি বদলালো। হাজারো নারীতে আসক্ত আমিটা, সেই এক নারীতে আসক্ত পুরুষ হলো। আজ সেই মানুষটাকে খুঁজতে আমার এতোটা বেগ পোহাতে হচ্ছে! বুকটা পুড়ছে কেনো আমার?”

    চিৎকার করে কথাগুলো বলে দম নিলো তৃষ্ণা। কষ্টের পাল্লা ভারী হয়ে গিয়েছে তার।

    খোলা আকাশের পানে তাকালো। শূন্যে চোখ রেখেই আবারও বলা শুরু করলো,“ছোট থেকেই কষ্ট পাচ্ছি। একাকীত্বের কষ্ট। ড্যাড বিজনেসের কাজে সবসময় বাহিরে থাকতো। তবুও সাধ্যমত সময় দেবার চেষ্টা করতো। ভালোবাসতো খুব আমাকে আমার ড্যাড। আর মম! জানিনা কি পাপ করেছিলাম, মমের ভালোবাসা পাইনি কোনোদিন। অনিশ্চিত কারণ বশত মমের কাছে শুধুই অবহেলা পেয়েছি। কখনো আমার মম অন্য সবার মমের মতো মুখে তুলে খাইয়ে দেয়নি। কখনো আমার সাথে স্কুলে যায়নি। ছোটবেলায় স্কুলে দেখতাম, সবার মম এসে বসে থাকতো, যাবার সময় নিয়ে যেতো। তখন আফসোস করতাম শুধু, কেনো আমার ভাগ্যে সেই সুখ নেই। ধীরে ধীরে এই একাকীত্ব কে সঙ্গী বানিয়ে বড় হতে লাগলাম। দশ বছর বয়সে মামনিকে পেয়েছি আমি। আমাকে জন্ম দেননি। তবে আকাশসম ভালোবাসা দিয়েছেন। পৃথিবীতে যদি কাউকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবেসে থাকি, তবে সেটা আমার মামনি। মমতো বুঝলো না আমাকে। আমি যে ভালোবাসার কাঙাল ছিলাম। এরপর আমার সতেরো বছর বয়সে… ”

    তৃষ্ণা থেমে গেলো। গলা শুকিয়ে এসেছে তৃষ্ণার। পাশ থেকে ওয়াইনের বোতল তুলে নিয়ে গটগট করে পুরোটা শেষ করে ফেললো। কেঁদে ফেললো তৃষ্ণা।

    “কেনো করলে এরকম মম? এরকম না করলে আজ আমারও একটা পরিবার থাকতো। আমাকে এতিম হয়ে থাকতে হতো না মম। কেনো করলে এরকম তুমি?”

    তৃষ্ণা আবারও চুপ মেরে গেলো। এসব মনে করতে চায় না। কষ্ট ছাড়া আর কিছু তো পাবে না। পুনরায় পুরো ধ্যান তার নয়নতারাতে দিয়ে বললো,“আরহানের গোপন সবজায়গায় খুঁজেছি আপনাকে নয়নতারা। আপনি কোথায় আছেন? কোথায় আপনি? আমার কাছে আসুন না। অনেক ভালোবাসবো আপনাকে। অনেক বেশি ভালোবাসবো।”

    তীব্র কষ্ট, যন্ত্রণা ও আফসোসের সুরে গা ভাসিয়ে ফ্লোরে উবু হয়ে পড়ে রইলো নেশাক্ত তৃষ্ণা। তার কষ্ট দেখবে কেবল এই খোলা অন্তরীক্ষ, যার সমপরিমাণ তার কষ্ট।

    ____________________________

    গভীর নিশিথিনি। চাঁদের জোৎস্না গাড়ির খোলা জানালা দিয়ে গায়ে এসে মাখছে। এখনও আমার মনটা বড্ড অশান্ত। আরহানের কিয়ৎক্ষণ আগের সেই ভয়াবহ রকমের কর্মে আমি এখনও হতভম্ব। একটা মানুষ এভাবেও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতে পারে?

    তখন সেখানে আরহানের দিকে তাকিয়েছিলাম অনেকটা সময়। সময় কিভাবে অতিবাহিত হচ্ছিলো, তার বিন্দুমাত্র ধারণা আমার ছিলো না। একসময় আরহান উঠে দাঁড়ালেন। হাতের কাশফুলের গুচ্ছটা এগিয়ে দিলেন আমার দিকে। স্তব্ধতা কাটিয়ে ঠোঁটে প্রশস্ত এক হাসির রেখা টেনে, ফুলগুলো নিলাম।

    আরহানও হাসলেন। প্রাপ্তির হাসি! হুট করেই কি যেনো হয়ে গেলো আরহানের। হাস্যোজ্জ্বল মুখটা গম্ভীর করে নিলেন।

    “আমাকে কতোটা বিশ্বাস করো?”

    আরহানের এমন প্রশ্নে আমার কপাল কুঁচকে এলো। এই প্রশ্নটা এমন সময়ে হঠাৎ কেনো জিজ্ঞেস করলেন? আর মুখ খানা এমন গম্ভীর করেই বা কেনো জিজ্ঞেস করলেন?

    আরহান পুনরায় প্রশ্ন করলেন,“কতোটা করো?”

    এবার আর সময় নিলাম না। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিউত্তর করলাম,“যতোটা ভালোবাসলে চোখ বন্ধ করে পুরোটা জীবন সেই একজনের ইচ্ছেমতো চলা যায়। হয়তো ততোটাই। আমি চিনে গিয়েছি আপনাকে। আপনি কখনো আমার খারাপ চাইবেন না। আপনার প্রতিটি কার্যে কোনো না কোনো ভাবে আমার ভালোটাই লুকিয়ে থাকে।”

    আরহানের গম্ভীর মুখশ্রীতে তখন পুনরায় হাসির রেখার দেখা মিললো। ফুলসহ আমার হাতদুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,“এই বিশ্বাসটা রেখো। শীঘ্রই তুমি, তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যের মুখোমুখি হবে। তখন বিশ্বাস করো আমার কথাগুলো।”

    সেসময় অন্য কোনোকিছু না ভেবে বলে দিয়েছিলাম,“করবো। করতেই হবে। আপনার ভালোবাসার চেয়ে আমার বিশ্বাসের পাল্লা বেশি ভারী।”

    “কি ব্যাপার! চাঁদ পাশে বসে আছে, তবুও তার শুকতারা অন্য কিছুর ধ্যানে মগ্ন। ব্যাপারটা কিন্তু ভীষণ মন্দ।”

    আরহানের কথায় মাত্র হয়ে যাওয়া অতীতের খেয়াল ছেড়ে বর্তমানে মন দিলাম। স্থির দৃষ্টিতে তাকালাম উনার দিকে। পুনরায় এক মোহময় ভাবনায় ডুবে গেলাম। মস্তিষ্কে আরহানের কার্যকলাপগুলো প্রথম থেকে এই পর্যন্ত সব বুলিয়ে নিলাম। সম্পূর্ণ আরহানকে আমার চক্ষুদ্বয় দ্বারা অবলোকন করে নিলাম। ইশ! ভয়ংকর রকমের সুদর্শন এই পুরুষটি আমার! একদম কল্পনাতীত ব্যাপার স্যাপার।

    এরই মাঝে হুট করেই আরহানের গাড়ির স্পিড বেড়ে গেলো অনেক বেশি। শুধু বাড়েনি, আরহানের গাড়ি আঁকাবাঁকা চলছে। একবার এপাশ তো আরেকবার ওপাশ। এতো দ্রুত বেগে চালানোর জন্য আমি অস্থির ভঙ্গিতে আরহানকে বললাম, “অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে তো। আরহান! প্লিজ! ধীরে চালান। ভয় হচ্ছে তো ভীষণ আমার।”

    আরহান বলে উঠলেন,“পেছনে কেউ শুট করছে।”

    আমি সাইড মিরোরে দেখলাম, একটা গাড়ি ফলো করছে আমাদের। কিছুক্ষণ বাদে আমাদের গাড়ির স্পিড আরো বেড়ে গেলো। এরপর হুট করেই গাড়ি থেমে গেলো। থামতে না থামতেই একটা বিকট আওয়াজ কানে এলো, আমিও সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলাম।

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৩)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৩)

    দিন গড়াতে লাগলো। দেখতে দেখতে আজ আমাদের বিয়ের তিন মাস পূর্ণ হলো। এই তিন মাসে আরহান আমাকে পৃথিবীর সমস্ত সুখের সাথে পরিচয় করিয়েছেন। মনের মণিকোঠায় প্রিয় মানুষটির জন্য যেই জায়গাটি থাকে, তা দখল করে নিয়েছেন। সেদিন বলেছিলেন না? ‘ছোট বড় সব সুখের দায়িত্ব নিলাম।’ সত্যি, উনি দায়িত্ব নিয়েছেন। বাবা-মার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো ভীষণ। কিন্তু তারা আমার সাথে কথা বলতে চান না। এই তিনমাসে অনেকের জীবনের অনেক কিছু পাল্টে গিয়েছে।

    এ বাড়িতে আসার প্রথম এক সপ্তাহ, মাহী ছিলো আমাদের সাথে। খুব মিশে গিয়েছিলাম। এতো মিশুক একটা মেয়ে! না মিশে পারা যায়! সপ্তাহ বাদে, ওর মা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো। অগত্যা দুই বোনকে চলে যেতে হয়।

    রুশী আর অয়নকে অনেক মনে পড়েছে। যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু দুজনেরই ফোন অফ পেয়েছি। তাও আবার বার বার!

    তৃষ্ণার ঝামেলার জন্য ভার্সিটিতে যেতে পারিনি। দু সপ্তাহ বাদে এক্সাম শুরু আমার। তখন গেলেই দেখা হবে।

    এরমধ্যে তৃষ্ণা অনেক ভাবে আমাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছে, কিন্তু আরহানের জন্য পারেনি। শুধু তৃষ্ণা না, দেখা গিয়েছে তৃষ্ণা বাদে অন্য আরও একজন আমার ক্ষতি করতে চেয়েছে। আরো একজন আমার ক্ষতির জন্য লোক লাগিয়েছে। কিন্তু আরহান তাকে এখনও ধরতে পারেনি। তাই আমার জন্য বাড়িতে এক্সট্রা সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছে।

    ইদানিং নিশাকে দেখি মন মরা হয়ে থাকতে। রুদ্র খুব একটা এ বাড়িতে আসে না। তবে যখন আসে, দুজন দুজনকে লুকিয়ে যেভাবে দেখে, সেটা আমার চক্ষু এড়ায়নি। সবটা না হলেও, কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছি। আর দিনকে দিন নিশার এই মন মরা ভাবটা বেড়েই চলেছে। এই ব্যাপারে আজ আরহানকে জানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি।

    রুমে বসে নিজের ডায়েরিতে এসব লিখছিলাম। বিয়ের প্রথম মাসে আরহান আমাকে এই ডায়েরি গিফট করেছেন। ভীষণ সুন্দর এই ডায়েরিতে প্রতিদিনের সব ঘটনা লিখে রেখে দেই। আরহানের ব্যাপারে মনের মাঝে যেসব কথা খেলে বেড়ায়, সেসব তো মুখে আনতে পারিনা। তাই এই ডায়েরিতেই লিখে রাখি।

    লেখা শেষ করতে না করতেই আমার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে স্ক্রিনে নামটি দেখতেই ঠোঁটের কোণে হাসি এসে পড়লো। কেনো এলো? সম্পূর্ন অজানা আমার। তবে এটা প্রায়শই হয়।

    রিসিভ করতেই আরহান বলে উঠলেন, “যদি বলি আজ শুকতারাকে নিয়ে তার ব্যক্তিগত চাঁদ ঘুরতে বেরোবে, তবে কি শুকতারা রাজি হবে?”

    আরহানের এমন মিষ্টি ভাবে বলা কথায় আমি হেসে দিলাম। কে বলবে, এতো গম্ভীর একটা মানুষ তার প্রিয়তমার কাছে এতটা মিষ্টি হতে পারে! পরক্ষণেই আরহানের কথা মাথায় ঘুরলো, কি বললেন উনি? ঘুরতে নিয়ে যাবেন? চোখ দুটো বড় বড় হয়ে এলো। এই তিন মাসে উনি আমাকে বাড়ি থেকে বেরোতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছেন। উনি! নিয়ে যাবেন!

    “ঘ’ঘুরতে ন’নিয়ে যাবেন?”

    অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলাম। আরহান হাসলেন। শব্দবিহীন হাসি। তবে আমি অনুভব করে নিলাম।

    “এক্ষুনি রেডি হয়ে নিন তো। আমি ফিরছি। আর শুনুন! পার্পেল কালারে কিন্তু আপনাকে দারুন লাগে।”

    কথাটা শেষ করেই কল কেটে দিলেন। আরহান মাঝে সাঝেই ‘আপনি’ করে বলেন আমাকে। এটা দারুন শোনায় আমার কাছে। এতে দূরত্ব বা অভিমান নেই, আছে প্রিয়মানুষটির প্রতি অগাধ ভালোবাসা। যাই হোক, ভীষণ খুশি লাগছে আমার।

    খুশি মনে রেডি হয়ে নিলাম। পার্পেল কালারের একটা শাড়ি পড়লাম। আমি সবসময় চুল বিনুনী গেঁথে রাখতাম। আজ ইচ্ছে হচ্ছে খুলে রাখতে। তাই করলাম। হাঁটু লম্বা চুলগুলো মুক্ত রেখে দিলাম। কানে ঝুমকো। এক হাতে কাঁচের চুড়ি আর কপালে ছোট্ট একটা টিপ। ব্যাস! রেডি আমি।

    কিছুক্ষণ বাদেই আরহানের কল এলো আবার। রিসিভ করতেই বলে উঠলেন,“রেডি তুমি?”

    “হুঁ”

    “গুড! জলদি নিচে এসো, আমি অপেক্ষা করছি।”

    কল কেটে দিলেন আরহান। নিচে আছেন? এতো জলদি চলে এলেন! আমি তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বেরোলাম। যাবার আগে নিজেকে আরও একবার আয়নায় দেখে নিলাম।

    বেরোনোর সময় ড্রইং রুমে মায়ের সাথে দেখা হলো। মা মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করলেন,“কই যাচ্ছিস মা! আরহান কোথাও যেতে না করে দিয়েছে তো।”

    গাল দুটো রক্তিম হয়ে এসেছে। কিভাবে বলবো,‘আমি আপনার ছেলের সাথেই ঘুরতে বেরোচ্ছি!’। কেমন যেনো লাগছে আমার। এ মা! লজ্জা পাচ্ছি আমি!

    নিজেকে ধাতস্থ করে মাথা নিচু করে মিনমিনে কন্ঠে বললাম,“উনি বাইরে অপেক্ষা করছেন। আসলে, উনিই নিয়ে যাবেন।”

    মা মুচকি হেসে যেতে বললেন। আমিও বেরোলাম।

    বাড়ি থেকে বেরিয়েই দেখি, গেটের বাইরে উনার গাড়ি। দ্রুত পা চালিয়ে গাড়ির কাছে গেলাম। আরহান ড্রাইভিং সিটে বসে আছেন। ফোন কানে, কারো সাথে কথা বলছেন। আমি ডোর খুলে বসে পড়লাম আরহানের পাশে। ডোর খোলার সাউন্ড পেয়ে এদিকে তাকাতেই আরহানের স্থির দৃষ্টি থমকে যায় আমার পানে। ফোনের ওপাশের ব্যক্তি কথা বলেই যাচ্ছে, সেদিকে খেয়াল নেই উনার। আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। মাথা নিচু করে মৃদু হাসলাম।

    আরহান ওপাশের ব্যক্তিকে “আ’ল কল ইউ লেটার” বলেই কল কেটে দিলেন। পুনরায় মুগ্ধ নজরে আমাকে দেখতে লাগলেন।

    “সময়টা এখানেই থমকে যাক। আমার দৃষ্টি স্থির থাকুক আমার প্রিয়মানুষটির উপর। যাকে দেখার সাধ এজনমে মিটবে না।”

    আরহানের এরূপ কথায়, সত্যি যেনো আমার দুনিয়া থমকে গেলো। মানুষটা এতো আবেগী কথা কি করে বলে!

    হালকা করে কেশে উনার মনোযোগ আকর্ষণের ব্যর্থ চেষ্টা করলাম। উনি তো গভীর নজরে উনার শুকতারাকে দেখে যাচ্ছেন।

    “সারাদিন কি এখানেই কাটানোর মতলব এঁটেছেন? যাবেন না?”

    এবার আরহান নড়ে চড়ে বসলেন। বিরক্তির একটা শ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বললেন,“শান্তিতে একটু দেখতেও দেয় না!”

    আমি হেসে দিলাম। আরহান গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

    নিজস্ব গতিতে চলমান গাড়ি, পেছনের সব রাস্তা ফেলে নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে এগিয়ে চলছে। প্রকৃতির প্রতিটি ঘটনা আমাদের কিছু না কিছু শেখায়। যেমন এটা আমাদের বোঝাচ্ছে, ‘অতীত শুধুই পেছনে ফেলে রাখার জিনিস। তবে ফেলে রাখা অতীতকে স্মৃতির পাতায় তুলে রেখে মাঝে মাঝে সেগুলো দেখতে হবে, ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর ভুল গুলো সূক্ষ্ম নজরে অবলোকন করতে হবে। চলমান রাস্তায় সেগুলো শুধরিয়ে নিতে হবে। যেগুলো শুধরাতে পারবে না, সেগুলোর জন্য রয়েছে এক অন্তরীক্ষ দীর্ঘশ্বাস। তবে অতীতকে আকড়ে ধরলে কখনোই গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবে না।’

    কিছুদূর এগোতেই আরহানকে জিজ্ঞেস করলাম,“আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি?

    “গেলেই বুঝবে।”

    আমি আর এই নিয়ে প্রশ্ন করলাম না। যেহেতু উনি বলেছেন, গেলেই বুঝবো। তবে তাই হোক।

    তখনই নিশার কথা মাথায় এলো। আরহানকে জানাতে হবে।

    “শুনছেন!”

    আরহান সামনে তাকিয়েই উত্তর দিলেন,“হুঁ!”

    “কিছু বলতে চাই।”

    “বলো..”

    “কিছুদিন যাবত লক্ষ্য করছি নিশা কেমন যেনো মন মরা হয়ে থাকে।”

    আরহানের মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম না। সেভাবেই বললো, “হ্যাঁ! তাই কি হয়েছে?”

    “আচ্ছা আপনি বোনের ব্যাপারে এতোটা উদাসীন কেনো বলুন তো! কিছু বলছি তো আমি আপনাকে?”

    আরহান হালকা হাসলেন। যেনো সব জানেন উনি। ঠোঁটে হাসির রেখা এঁকেই বললেন,“আচ্ছা! আমার বউয়ের দেখি রাগ ও আছে! সেইযে বিয়ের পরেরদিন রেগেছিলে। এরপর আজ। ভাল্লাগলো। এভাবে রাগতে পারো। শরীর ভালো থাকে।”

    আসলেই, আমি এই তিনমাসে আর উনার সাথে রেগে কথা বলিনি। রাগ আসেইনি। তবে আজ উনার মুখে ‘বউ’ কথাটি শুনে কেমন যেনো একটা ফিলিংস এলো। আচ্ছা হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো কেনো? হৃদপিন্ড অসুস্থ হয়ে গেলো বুঝি!

    কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। বললাম,“আপনি কি আমার কথা শুনবেন না?”

    “হু, হু, শুনবো। বউয়ের কথা না শুনে উপায় আছে? বলতে থাকো।”

    আবারো একটু রাগ হলো। এভাবে বলার কি আছে? ইদানিং আমার রাগটাও বেড়ে যাচ্ছে। হয়তো রাগ ভাঙ্গানোর গ্যারান্টি আছে বলেই এই রাগের উৎপত্তি। নয়তো, ছোট মা বা আপুর উপরও কখনো রাগ আসেনি।

    “আমার মনে হচ্ছে, নিশা আর রুদ্র ভাইয়া একে অপরকে পছন্দ করে।”

    আরহান এবারও স্বাভাবিক। কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না বলে, কপাল কুঁচকে এলো। জিজ্ঞেস করলাম,“এতো বড় একটা কথার প্রেক্ষিতে আপনার কি কিছুই বলার নেই?”

    “নাহ্! কারণ আমি জানি এটা।”

    অবাক, বিস্মিত আমি চোখ বড় বড় করে ফেলেছি মুহূর্তেই। জানেন মানে?

    আর কোনো কথা হলো না। আরহান সামনে তাকিয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন। আর আমি নিঃসংকচে উনাকে দেখে যাচ্ছি। আমার ব্যক্তিগত চাঁদকে দেখে যাচ্ছি আমি। নিস্তব্ধতার মাঝেই আরহান একটা গান ছেড়ে দিলো।

    ওরে ইচ্ছে করে বুকের ভিতর, লুকিয়ে রাখি তারে।

    যেনো না পারে সে যেতে, আমায় কোনদিনও ছেড়ে।

    আমি এই জগতে তারে ছাড়া, থাকবো নারে থাকবো না।

    তারে এক জনমে ভালোবেসে, ভরবে না মন ভরবে না।

    আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি

    ওরে এই না ভুবন ছাড়তে হবে, দুইদিন আগে পরে।

    বিধি একই সঙ্গে রেখো মোদের,একই মাটির ঘরে।

    আমি এই না ঘরে থাকতে একা,পারবো নারে পারবো না।

    তারে এক জনমে ভালোবেসে,ভরবে না মন ভরবে না।

    আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি,এই চোখ দুটো মাটি খেয়ো না।

    আমি মরে গেলেও তারে দেখার সাধ, মিটবে না গো মিটবে না।

    তারে এক জনমে ভালোবেসে,ভরবে না মন ভরবে না।

    আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি….

    গানটা গিয়ে সোজা বুকের বা পাশটায় আঘাত হানলো। কি আছে এতে? ভালোবাসা! নিশ্বাসের বেগ বেড়ে চলেছে। হৃদপিন্ড! এ তো ভীষণ অসুস্থ হয়ে গিয়েছে।

    এরই মাঝে আরহান হুট করেই গাড়ি থামিয়ে দিলেন। সিটবেল্ট খুলে তড়িৎ বেগে আমার কাছে এসে পড়লেন। আমার সিটের দুই পাশে হাত রাখলেন। দূরত্ব আরো খানিকটা ঘুচিয়ে বললেন,“গান শুনে আমাকেই ফিল করছিলে? এখন কাছে এলাম। নাও ফিল মি!”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১২)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১২)

    “সঙ্গীহীন নাকি কেউ বাঁচতে পারে না। নিঃসঙ্গতা একটা মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ। আমি এই অভিশাপের সম্মুখীন হয়েছিলাম। এতো বছরের অভিশাপ কাটিয়ে ভার্সিটি লাইফে আসার পর কিছু ফ্রেন্ড পেয়েছিলাম। তখন নিজেকে নিঃসন্দেহে ভাগ্যবতী মনে হয়েছিলো। এমন ফ্রেন্ড ক’জন পায়! রুশী আর অয়ন মিলে আমাকে এতগুলো বছরের না পাওয়া সব ভালোবাসা দিয়েছিলো।

    আপন জনের অপূর্ণতা পূরণ করেছিলো তারা দু’জন মিলে। নিজের কথা বলার জন্য মানুষ পেয়ে গিয়েছিলাম আমিও।

    ভবিষ্যতে যে আমার জন্য এর চেয়েও ভালো কিছু ছিলো, তা আমি জানতাম না। আমার এতগুলো বছরের পাওয়া সবচেয়ে সেরা উপহার হচ্ছে আরহান। কখনো ভাবিনি, আমাকেও কেউ এতোটা ভালোবাসবে। আমারও অন্য সবার মতো এতো সুন্দর একটা পরিবার থাকবে।”

    কথাগুলো বলে মুচকি হাসলাম। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সাঁঝ আকাশ দেখছি। আজ দু’দিন হলো এই বাড়িতে এসেছি। আরহান প্রায় সময়ই বাড়ির বাহিরে থাকে। সারাটাদিন নিশা আমার সাথেই থাকে। যেনো কেউ কড়া আদেশ দিয়ে রেখেছে, আমাকে কাছ ছাড়া করা যাবে না। রূপ আপু, আমাকে যতোটা সম্ভব এড়িয়েই চলে। দেখা হলেই কেমন যেনো মুখ বাঁকিয়ে ফেলে, যা আমার নজর এড়ায় না।

    “ভাবি! এখানে দাঁড়িয়ে আছো তুমি! আমি তোমাকে পুরো বাড়ি খুঁজে ফেলেছিলাম।”

    নিশার আওয়াজ পেয়ে পেছন দিকে তাকালাম। মুখে তার মুচকি হাসি। এই দু’দিনে যতটুকু চিনেছি, তাতে বুঝেছি মেয়েটা ভিষণ চঞ্চল ও মিশুক। ভীষণ মনে ধরেছে এই দু’দিনেই।

    আমি হেসে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে।

    “এতো খুঁজছিলে কেনো বলো তো!”

    আমার কথায় নিশা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। কিছু বলতে চেয়েও বললো না। তখনই আমার ফোন বাজখাই আওয়াজে বেজে উঠলো। কাল আরহান কিনে দিয়েছেন এটা। ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম আরহান কল করেছেন।

    রিসিভ করতেই ওপাস থেকে আরহান বলে উঠলেন,“এতক্ষণ ধরে কল দিচ্ছিলাম, সাউন্ড কানে যায়নি নাকি? কই ছিলে তুমি? তোমাকে নাকি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? আচ্ছা, তোমাকে না বারবার বলেছি সব সময় নিশার সাথে থাকবে। আমাকে টেনশনে না ফেললে তুমি শান্তি পাও না তাই না?”

    “আসলে এরকম না। আমিতো ব্যালকনিতেই ছিলাম।”

    “সে যেখানেই থাকো না কেনো, নিশাকে কাছে রাখবে। সবসময়।”

    আমি মৃদু কন্ঠে “আচ্ছা” বললাম। আরহান কল কেটে দিল। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এর আগের বারোটা মিসড কল স্ক্রিনে ভেসে আসছে। সবগুলো আরহানের নাম্বার থেকে এসেছে। আমি যে এতটাই গভীর খেয়ালে ছিলাম, আরহানের কলের শব্দ অবধি আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি।

    নিশা এখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমার কথা বলা শেষ হতে দেখে, নিশা বলে উঠলো,“ভাবি! চলো নিচে যাই, মা ডেকেছে।”

    নিচে এসে দেখলাম রুপ আপু সোফায় বসে আছে। আমাকে এখানে আসতে দেখে আপু নিঃশব্দে প্রস্থান করলো। আমি ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেললাম। বুঝিনা রূপ আপুর আমাকে নিয়ে এত সমস্যা কিসের?

    আমি এগিয়ে গিয়ে মায়ের কাছে বসলাম। মুচকি হাসলেন মা। সামনে একটা বক্স রয়েছে। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,“এটা আমার শাশুড়ি মা আমাকে দিয়েছিল। তোমার জন্য যত্ন করে রেখেছিলাম। এখন থেকে এটা তোমার।”

    বক্সটি খুলে দেখি সেখানে বেশ কিছু গহনা রয়েছে। নিতে নাকোচ করে উঠলাম। আমার এমনিতেই এসব ভারী গহনা পছন্দ না। অপ্রস্তুত লাগে নিজেকে।

    “মা এগুলো এতবছর আপনার কাছে ছিল, আপনার কাছেই রাখুন না। আমি এগুলো সামলাতে পারবো না।”

    মা জোর করেই দিয়ে দিলেন। বললেন,“অধিকার আছে তোমার এতে।”

    _________________________

    বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। পাখিরা সব নিজ নিজ নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। আর আমি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তাদের আনাগোনা দেখছি। আরহান এসেছেন কিছুক্ষণ আগেই। ফ্রেশ হয়ে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আজ আরহানের প্রতি ভয় হচ্ছে না। কোনো সংকোচ নেই। যা আছে তা হচ্ছে লজ্জা। এভাবে এত জলদি কেউ আমার মনে স্থান নিয়ে নেবে, ভাবিনি আমি। পিনপতন নীরবতার মাঝে যেনো আমার হৃদযন্ত্র উচ্চস্বরে বেজে যাচ্ছে।

    কিছুক্ষণ বাদে আরহান নিস্তব্ধতা কাটিয়ে বলে উঠলেন,“কখনো ভুল বোঝোনা আমায়। আমি তোমার ভালোর জন্যেই সব করছি।”

    আমি ভ্রু কুঁচকে আরহানের দিকে তাকালাম। কি ভুল করেছেন উনি! আমাকে ব্ল্যাকমেইল করে বিয়ে করেছেন, এটা ভুল? তবে বলবো আপনি কোনো ভুল করেননি। “ভালোবাসায় সব জায়েজ” কথাটিতে বিশ্বাসী আমি। আর আপনার ভালোবাসাটাও বিশ্বাস করি।

    আমি হয়তো মেনে নিতাম না সম্পর্কটা। কিন্তু, আরহান আমার সামান্য ক্ষতি করেননি। উল্টো আমাকে না পাওয়া অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন। একজন মা দিয়েছেন। একজন ছোট বোন দিয়েছেন। আর আমার আকাশের চাঁদ দিয়েছেন। ব্যক্তিগত চাঁদ। মেনে না নেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। হয়তো মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগবে। এই যা!

    আরহান আবারও চুপ মেরে গেলেন। নিশার কাছ থেকে শুনেছি, আরহান নাকি কথা কম বলেন। তবে আমার সাথে অনেক কথা বলেছেন। কেনো?

    মনের প্রশ্নটা মুখে এনে ফেললাম,“আপনি আমার সাথে এতো কথা বলেন, অথচ বাকিদের সাথে কেনো বলেননা?”

    “মনের ভাব ব্যাক্ত করার সঠিক ঠিকানা পেয়েছি বলে।”

    বড্ড ভারী ও কঠিন একটা বাক্য। অবুঝ চোখে তাকালাম আরহানের পানে। আমার এরূপ চাহনি দেখে হাসলেন আরহান। কি সুন্দর সেই হাসি! উনার এই হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকালে যে কোনো নারী মন হারাবে। হয়তো আমিও…

    ___________________

    দুদিন ধরে ঘরবন্দী রুশী। নিজ ইচ্ছেতেই বেরোচ্ছে না ঘর থেকে। চুপচাপ থাকা যেনো স্বভাব হয়ে গিয়েছে। সেদিন ভার্সিটি থেকে ফিরে সোজা বীনির বাড়ি এসেছিলো রুশী। কিন্তু বীনিকে পায়নি। বীনির ছোট মা বলেও নি বীনি কোথায় আছে। রুশী খুব করে বীনিকে সেই মুহূর্তে কাছে চেয়েছিলো। কিন্তু পায়নি। তখন থেকেই নির্বাক হয়ে নিজ কক্ষে বসে আছে। এর মধ্যে রুশীর মা এসে খাইয়ে দিয়ে যায়। রুশী প্রায়শই তার মায়ের দিকে করুন চাহনি নিক্ষেপ করে। এই চাহনির মানেটা বুঝলো না তার মা।

    জীবনের মানে এখন তার কাছে মৃত্যু। যে মরে যায়, সে বেঁচে যায়। যে বেঁচে থাকে, সে প্রতি মুহূর্তে তিলে তিলে মরতে থাকে। রুশী মরছে। প্রতিটি মুহূর্তে মরণ যন্ত্রণা অনুভব করছে। এর মধ্যে একবার ভেবেছিলো, ওর বাবাকে অয়নের কথা বলবে। কিন্তু কিভাবে বলবে, সে তার বেস্ট ফ্রেন্ডকে ভালোবাসে, যে এখনও বাপের টাকায় ঘুরে, ফিরে, খায়, পড়ে। যে প্রতিষ্ঠিত না, মাত্র অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে। তার বাবা মা তো কাঁধ থেকে বোঝা সরাতে চাচ্ছে।

    বার বার রুশীর মনে পড়ছে অয়নকে। সেই পুরোনো স্মৃতি গুলোকে। আবারো কেঁদে দিলো রুশী। কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো,“ধিক্কার জানাই নিজেকে। ভালোবাসতে বাসতে সীমাহীন ভালোবাসা দিয়ে ফেললাম, তবুও মুখ ফুটে তাকে ভালোবাসি বলতে পারলাম না। তার আগেই হারিয়ে গেলো সে, হারিয়ে গেলাম আমি। দুজন দুজনার চেয়ে বহুদূরে। বড্ড দেরি করে ফেললাম আমি।”

    __________________

    ডোর নক করার সাউন্ড পেয়ে আরহান দেখতে গেলো। সাথে আমিও গেলাম। দরজা খুলতেই সেখানে নিশার হাস্যোজ্বল মুখটা দেখতে পেলাম। মেয়েটা এমনিতে হাসি খুশি। তবে এখন যেনো, এক্সট্রা হাসি নিয়ে রেখেছে ঠোঁটে।

    আরহান ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে?”

    “ভাইয়া! মাহী আপু এসেছে। জলদি নিচে এসো তোমরা।”

    নিশা কথাটা বলেই চলে গেলো। আরহানের চেহারায় ও একটা খুশির ভাব এসেছে। আমি জানিনা মাহী কে। তবে যতটুকু মনে হচ্ছে, এদের খুব কাছের কেউ হবে হয়তো। জিজ্ঞেস করলাম আরহানকে,“মাহী কে?”

    “আমার চাচাতো বোন। খুব ভালো মনের। কারো কষ্ট দেখতে পারে না, আবার খুব সহজেই সবার সাথে মিশতে পারে।”

    “চাচাতো! আপনার কি আরো চাচা আছে?”

    আরহান “না” বলেই আবার বললেন, “রূপের ছোট বোন ও।”

    আমি এবার বেশ জোড়ে সোরেই “কিহ!” বলে উঠলাম। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। না হবার সবচেয়ে বড় কারণটা হচ্ছে, বড় বোনকে দেখলেই বিরক্তিতে সবার কপাল কুঁচকে আসে, আবার ছোটটাকে দেখলেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। একদম অবিশ্বাস্য!

    আরহান আবারও হাসলেন। বললেন, “রূপ খারাপ না। আমাকে ভালোবাসে বলে তোমাকে সহ্য করতে পারে না। এইটুকুই।”

    আমি জানতাম না এটা। বুঝতেও পারিনি। তবে ভালোবাসা না পাবার কষ্টটা অনুভব করতে পারছি। আমিওতো পরিবারের ভালোবাসা পাইনি।

    “এখন নিচে চলো।”—বলেই আরহান আমার একহাত নিজের হাতের ভাজে নিলেন। বলার প্রয়োজন বোধ করেননি। এটাই হয়তো অধিকার বোধ। হাতের দিকে তাকিয়ে আরহানের পিছু পিছু যাচ্ছি। আমি উনার বড় বড় পায়ের সাথে পা মিলিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছি কই? শেষমেষ বলেই ফেললাম,“একটু ধীরে হাঁটুন না!”

    আরহান থেমে গেলেন। এরপর ধীরপায়ে হাঁটা দিলেন। আমিও এলাম।

    একটা অন্যরকম শান্তি অনুভব করছি। এখন মনের মাঝে একটা কথায় আসছে,“এই সময়টা এখানেই থমকে গেলে পারতো। পথটা আরো একটু দীর্ঘ হলেও পারতো।”

    “ভাইয়া! ভালো আছো?”

    মাহীর প্রশ্নে আরহান মৃদু কন্ঠে “হুঁ” বললেন। মাহী এবার আমার দিকে তাকালো। আমি এক পলকে মেয়েটিকে অবলোকন করে নিলাম। পরনে লং কুর্তি, সাদা রঙের। ফরসা গায়ের রং। কানে ছোট ঝুমকা, কপালে কালো টিপ। লম্বা চুলগুলো খুলে রাখা। চেহারায় বাঙালি ভাব দৃশ্যমান । রূপ আপুকে দেখেই বিদেশি বোঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু মাহী পুরো আলাদা।

    আমাকে কিছুক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলো। হঠাৎ ঠোঁটে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,“তুমি ভাবি!”

    আমি মাথা দুলিয়ে “হ্যাঁ” বললাম। হুট করেই মাহী আমাকে জড়িয়ে ধরলো। আমি হতভম্ব বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মাহী আমাকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে বললো,“তোমাকে ভালো লেগেছে আমার। আর আমার যাদেরকে ভালো লাগে, তাদেরকে নিজের কাছের মানুষ ভাবি। তুমিও আজ থেকে আমার কাছের।”

    আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। বাংলা ও একদম স্পষ্ট। রূপ আপু আর মাহী সম্পূর্ণ আলাদা। আসলেই আলাদা।

    ওদিকে রূপ আপু আমাদের দেখে হুট করেই রেগে গেলো। মাহীর হাতটা ধরে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো,“এতো দূর থেকে এসেছে, ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিক। পরে কথা হবে।”

    “কি দিভাই! এখানে আনলি কেনো আমাকে?”

    মাহীর প্রশ্নের প্রেক্ষিতে রূপ ওকে ধমকিয়ে বলে উঠলো,“তুই এখানে ওদের আলাদা করতে এসেছিস নাকি আমার থেকে ওকে আলাদা করতে?”

    মাহী কিছু বলতে যাবে, তার আগেই রূপ পুনরায় বলে উঠলো,“আরহানকে যে করেই হোক, আমার হতেই হবে।”

    “দেখ দিভাই! ভাগ্যে বিশ্বাসী হ। ভাইয়া তোর ভাগ্যে নেই। তাছাড়া তুই তো ওকে ভালোবেসেছিস। আর ভাইয়া ঐ মেয়েটিকে। ভালোবাসার মানুষটি ভালো থাকুক, এই তো চাওয়া, তাইনা? সে যেখানেই, যার কাছেই ভালো থাকুক।”

    চিল্লিয়ে উঠলো রূপ,“আরহানকে আমার চাই’ই চাই। আমি ওকে অন্য কারোর হতে দেখতে পারবো না। এজন্য যদি আরহানকেই শেষ করতে হয়, করে দেবো।”

    মাহী থমকে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে বলে উঠলো,“এসব ভুলে যা। ভাইয়া আর ভাবির মাঝে ঝামেলা ক্রিয়েট করিস না। ভাইয়ার ক্ষতি করিস না। আগেই ওয়ার্ন করে দিচ্ছি। নাহলে খারাপ হয়ে যাবে।”

    ___________________

    দুদিন ধরে সমস্ত লোক লাগিয়ে তৃষ্ণা হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছে বীনিকে। শহরের একটা কোণাও বাদ রাখেনি। এমনকি শহরের বাইরেও লোক পাঠিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। হঠাৎ তৃষ্ণার মস্তিষ্কে এলো, আরহান লুকিয়েছে? ওর বাড়ির ঐ মেয়েটা কি বীনি ছিলো?

    সম্ভাবনা ৫০% আছে।

    এখন গভীর রাত। ঘড়িতে বাজে রাত দেড়টা। এমন সময় আরহানের নম্বরে কল এলো। আমিই আগে জাগনা পেলাম। আরহান কে হালকা ধাক্কিয়ে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে উঠলাম,“আপনার ফোন বাজছে। দেখুন না!”

    আরহান একটু বিরক্ত হয়ে ফোনটা রিসিভ করলো। আননৌন নম্বর। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো, “বীনিকে তোর কাছে লুকিয়ে রেখেছিস তাইনা? ভালোয় ভালোয় ফিরিয়ে দে। আমার জিনিস আমার কি করে রাখতে হয় জানা আছে। ফিরিয়ে দে।”

    “হ্যাঁ! ও আমার কাছে। নাও, ইউ ক্যান ডু হোয়াট এভার ইউ ওয়ান্ট।”

    চলবে…

  • আজও সেই ঘুম ভাঙেনি

    আজও সেই ঘুম ভাঙেনি

    গ্রীষ্ম বর্ষা শরত হেমন্ত শীত ও বসন্ত। প্রতিটা ঋতু আমাদের মনে এক ভালো লাগার অনুভূতি জাগায়। আবার সেই ঋতুই আবার পরিবর্তনের সময় আমাদের সর্দি কাশি জ্বর নানা রকমের অসুখেও ফেলে। সীমারও এর ব্যতিক্রম হলো না। গ্রীষ্মের পর এলো বর্ষা। সীমার মনেও এলো এক অনুভূতি। বর্ষার ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটা হাতে নিয়ে অন্যরকম ভালো লাগা অনুভব করে। বৃষ্টিতে ভিজে সে এক অজানা স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায়।

    বিকেল থেকে সীমার মাথা ব্যাথা শুরু হয়। তারপর গা গরম হতে শুরু করে। রাত যত বাড়তে থাকে সীমার জ্বরও বাড়তে থাকে। এতো রাতে কোন ডাক্তার নেই। সীমা বেহুশ হয়ে যায়। মাঝে মধ্যে জ্ঞান ফেরে। সে দেখতে পায় সীমার মা মাথা পানি ঢালছে, কাঁদছে আর আল্লাহকে ডাকছে। সকাল হওয়ার সাথে সাথে সীমার আব্বা মাইক্রো ভাড়া করলেন। মাকে বললেন, শহরের ভালো কোন ডাক্তার দেখাতে। সেদিন ছিল হরতাল। গাড়ির মলিক ভয়ে ভয়ে পাঠালেন।

    রাস্তা ফাঁকা। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু সীমার আজ সেই বৃষ্টি ভালো লাগছে না। তার শীত লাগছে। সীমার এক ফুফাতো ভাইয়ের বাসায় তারা উঠলো। সীমার ভাই বললেন রাস্তায় কোন সমস্যা হয়নি তো। সীমার মা বললেন, না সমস্যা হয়নি। ডাক্তাররা সাধারণত তিনটা চারটার দিকে চেম্বারে বসেন। সীমার ভাই শহরের সেই নামি-দামি ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন। গায়ে চাদর জড়িয়ে সীমা মায়ের হাত ধরে কাপতে কাপতে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকছে। ঢুকতেই সীমার চোখ পড়লো ডাক্তারের দিকে। মনে হচ্ছিল এটা ওর আঁকানো ছবি। সীমা কাছে গিয়ে বসলো। ডাক্তার সবকিছু শোনার পর সীমার কপালে হাত দিয়ে জ্বরের অবস্থা নিশ্চিত করলেন। সীমার তখন রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী গল্পের সেই উক্তি মনে হলো,
    “আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম। কাহাকে পাইলাম।”

    সীমার জ্বর সেরে গেল। কিছু সীমার আর ভালো লাগে না। বৃষ্টিতে একা ভিজতে আর ভালো লাগে না। সেই একটাই ছবি একটাই সুর ভেসে আসে। এখন কেমন লাগছে? সীমা তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্রী। সীমার সামান্য সর্দি কাশি হলেই সে ছুটে যেত ডাক্তারের কাছে। অনেক দূরের রাস্তা হওয়ায় বেশি একটা সে আসতে পারতো না। তারপর আবার টাকা পয়সার ঝামেলা আছে। সত্যি সত্যিই সীমার একদিন প্রচুর পেট ব্যাথা শুরু হলো। সীমা ওর সেই পছন্দের ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার সীমার পেট দেখতে দেখতে তিনিও কিছু সময়ের জন্য হারিয়ে গেলেন। সীমার যেন সমস্ত শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছ। হঠাৎ সীমা ভীতু হয়ে গেল। সীমা এতোটা ভাবে নি। সীমা বাধা দিল। সেইও থামে গেল। পরিস্থিতি তেমন খারাপ হয়নি। সীমা বাসায় চলে যায়। কিন্তু সীমার চিন্তা বেড়ে গেল। সে রাতে আর ঘুমোতে পারে না। পড়ার টেবিলে মন বসে না। প্রেসক্রিপসনে ডাক্তারের নম্বর দেখে ফোন দেয়। ডাক্তার বললেন কে? সীমা,আমি সীমা। ডাক্তার আর কথা না বলে ফোন রিসিভ করে রেখে দেয়। মিনিটে সাত টাকা বিল উঠছে আবার কথাও বলছে না। সীমা ফোন কেটে দেয়। আর কোন দিনও ফোন দেয় নি। কিন্তু সীমা তাকে ভোলেনি।

    সীমা যখন বিএ পড়ে তখন সীমার পরিবার সীমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। সীমা ভাগ্যকে মেনে নেয় খুব সহজেই। সীমার একট সন্তানও হয়। সীমা আবার অসুস্থ হয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়। সীমা যে ওয়াডে ভর্তি হয় সেখানে ডাক্তারের রাউন্ড দেওয়া হয়ে গেছে। অন্য ওয়ার্ডে নিয়ে সীমাকে ডাক্তার দেখানো হয়। পরদিন সীমা চাদর টেনে শুয়ে আছে। এমন সময় কে যেন বলল ডাক্তার আসছে। সীমা কোন সাড়া দিলো না। আবার একজন বলে উঠল দেখি চাদরটা সরান তো। সীমার বুক কেঁপে উঠল। তাড়াতাড়ি করে সীমা চাদর সরিয়ে মুখ বের করে উঁকি দেয়। সীমার চোখ আটকে গেল। দুজন দুজনের দিকে কিছু সময় এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। সীমা পুরো চাদরটা সরিয়ে ফেললো। তারপর সীমা বলল,কেমন আছেন? ডাক্তার বললেন তু..তুমি কি আমার কাছে গেছিলা? সীমা মাথা নেড়ে উত্তর দেয়। ডাক্তার আবার বললেন, কবে? সীমা উত্তর দিতে গিয়ে কেঁদে ফেলে। তার গলা দিয়ে আর কথা বের হলো না।

    ডাক্তার শান্ত করার চেষ্টায় ব্যথ হলে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে যায়। কিছু দিন চিকিৎসার পর সীমা সুস্থ হয়ে যায়। ডাক্তার সীমার গালে আদরের ভঙ্গিতে দুইটা থাপ্পড় মারে। তারপর আবার সীমার গালে হাত রেখে চোখ দেখে। সীমা তখনো স্বাভাবিকই ছিল। কিন্তু ডাক্তার যখন আবার গালে হাত রেখে চোখ দেখলেন ততক্ষণে সীমা নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে যায়।

    সেই যে সীমা ঘুমিয়ে গেছে আজও সেই ঘুম ভাঙেনি। আজও সে স্বপ্ন দেখে।

    ©মুন্নী

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১১)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১১)

    “স্যার! শফিকুর! এইডা তো শফিকুর!”

    আশিকের কথায় তৃষ্ণা চিনতে পারলো, তার সামনের টুকরো টুকরো এই লাশটিকে। কিছুক্ষণ আগের পাঠানো গিফট বক্সটি খুলতেই সেটাতে শফিকুরকে আবিষ্কার করলো, যার শরীরের প্রতিটি অঙ্গ আলাদা আলাদা করে বক্সটিতে ফেলে রাখা। রক্তাক্ত মাথাটি মিনিট খানেক অবলোকন করতেই আশিক বুঝে গেলো এটা শফিকুর।

    বক্সটির বাইরে একটা চিরকুট, স্কচটেপ দিয়ে লাগানো। হাত বাড়িয়ে খুলে নিলো তৃষ্ণা। গোটা অক্ষরে লেখা,“স্টে ইন ইউর লিমিটস তৃষ্ণা..”।

    তৃষ্ণা, আরহানের খোঁজ নেবার জন্য এটাকে পাঠিয়েছিলো। সর্বশেষ খবর পেয়েছিলো, আরহানের বাড়িতে একটা মেয়ে আছে। কিন্তু সেটা কে? তা জানানোর আগেই আরহান যা করার করে ফেলেছে।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৃষ্ণা। অন্য কিছুর মুডে নেই। হালকা কণ্ঠে আশিককে বললো,“এটাকে সরানোর ব্যবস্থা করো।”

    আশিক “ওকে বস” বলেই বক্সটি নিয়ে প্রস্থান করলো। হুট করে প্রথমে এমন কিছু দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলো আশিক। স্বাভাবিক হয়েছে এখন।

    তৃষ্ণা পুনরায় ব্যালকনিতে গেলো। পাশ থেকে গিটার তুলে, ডিভানে বসে গিটারে সুর তুলে গাওয়া শুরু করলো,

    “একা বসে তুমি,

    দেখছো কি একই আকাশ?

    দিন শেষে তার তারাগুলো দিবে দেখা।

    মেঘে ঢাকা তারার আলো,

    দেখে থাকো তুমি, দেখো ভালো

    হয়তো তার মাঝে খুঁজে পাবে আমায়।

    সেই দিনে,

    এক গানে এক গল্পকারের গল্প খুঁজে পাবে

    খুঁজে পাবেনা সে গল্পকার,

    দিনগুলো, খুঁজে পাবে গানের প্রতিটা ছন্দে

    শুনতে পাবে মৃত মানুষের চিৎকার।

    আমার দেহখান,

    নিওনা শ্মশান, এমনিতেও পুড়ে গেছি।

    আমার, সব স্মৃতি,

    ভুলোনা তোমরা, যা ফেলে গেছি।

    দেহ পাশে কেহ কেঁদো না,

    গল্পগুলো রেখো অজানা,

    গানখানা থেকে খুঁজে নিও মোর সে গল্প।

    যাতে লিখা হাজার কষ্ট,

    নিজেকে ভেবে নিতাম এক শ্রেষ্ঠ,

    যার প্রতিপদে জীবন বিচ্ছেদের স্বপ্ন”

    থেমে গেলো তৃষ্ণা। চক্ষুদ্বয় এক করলো। আজ অনেক দিন পর খুব করে তার মাকে মনে পড়ছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছে, স্বাভাবিক একট মানুষের ন্যায় হতে। কিন্তু তার জিবনটা কেনো এতো কষ্টে ভরা?

    তৃষ্ণা চোখ খুলে তাকালো। কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আলগোছে মুছে নিলো তৃষ্ণা। অবাধ্য মন বার বার চাচ্ছে, তার নয়নতারাকে যেখান থেকে হোক, তুলে নিজের কাছে আনতে। তৃষ্ণার কি যেনো হয়ে গেলো, ফট করে উঠে দাঁড়ালো। মন কে সায় দিয়ে বললো,“আপনি আমার, নয়তো আর কারোর না।”

    _______________________

    ভোর হতেই বন্ধরত চোখ দুটো খুলে গেলো। চোখ জ্বলছে ভীষন। ঘুম হয়নি রাতে। হবে কি করে? আরহান যেভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে, ঠিকমতো শ্বাস ও নিতে পারছি না। আর সরাতেও পারছি না। আরেকবার চেষ্টা করি!

    অনেক কষ্ট করে আরহানকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। বুকে হাত রেখে একটা শ্বাস ফেললাম। এক পলক আবারও আরহানকে দেখে নিলাম। উবু হয়ে শুয়ে আছে আরহান। চুলগুলো কপালে লেপ্টে রয়েছে। অধরযুগল কিঞ্চিৎ ফাঁকা। আনমনে হেসে তার কাছে গিয়ে বসলাম। ডান হাত এগোলাম, চুলে রাখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু পারছি না। অস্ফুট স্বরে “ধ্যাৎ!” বলে উঠে গেলাম।

    শাওয়ার নিয়ে এসে দেখি, আরহান এখনও ওভাবেই শুয়ে আছে। বাপ রে! এতো ঘুম!

    ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে নীল রঙ্গা চুড়ি পরে নিলাম। পরনের শাড়িটাও খয়েরী পাড়ের নীল শাড়ি। কপালে ছোট্ট একটা টিপ, একজোড়া ঝুমকো আর সবশেষে পায়েল পরে নিলাম। নিজেকে আয়নায় দেখতেই মনে হলো, বিয়ে হলে বুঝি মেয়েদের আগের থেকে সুন্দর লাগে!

    আরহান এখনও ঘুমোচ্ছে। উনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে রুম থেকে বেরোলাম। আজ, আরহানের জন্য কিছু রান্না করবো। আরহান নিজেও অনেক ভালো রান্না পারে, তা এই দুদিনে অনেক ভালো করেই বুঝে গিয়েছি।

    _____________________

    ক্যাম্পাসের পেছনের দিকের বকুল ফুল গাছের নিকট রুশীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। হাতে এক গুচ্ছ কাঠগোলাপ। রুশীর ভীষণ পছন্দের। অয়ন ভেবে রেখেছে, আজ যে করেই হোক প্রপোজ করবেই। প্র্যাকটিস করছে অয়ন। বারবার করেই যাচ্ছে। পারছে না। ছেলেরাও বুঝি এতোটা নার্ভাস হয়!

    শেষ বার প্র্যাকটিস করতে যাবে, তখনই রুশী এসেছে। এটা বুঝতে পেরেই হাতের কাঠগোলাপসহ হাত পেছনে লুকোলো। এরপর রুশীর দিকে স্থির চাহনি তে তাকালো। । এই নয়নে রয়েছে একরাশ মুগ্ধতা। হঠাৎ ভ্রু কুঁচকে গেলো অয়নের। ওর ভাবনায় একটাই কথা আসছে,“মেয়েটির মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেনো? চোখ দুটো এমন লাল কেনো?”

    অয়নের চাহনি দেখে রুশীর বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। কি করে পারবে এই ছেলেকে কষ্ট দিতে?

    রুশী অয়নের দিকে অগ্রসর হলো। রুশীকে এগোতে দেখে অয়ন মুচকি হেসে এগিয়ে আসলো। দুজন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। একজনের হাতে এক গুচ্ছ কাঠগোলাপ, তো অন্যজনের হাতে বিয়ের কার্ড।

    “তোকে কিছু বলার আছে।”

    একই সাথে দুজনেই এই বাক্যটি উচ্চারিত করলো। শুধু পার্থক্য এখানেই যে, একজনের কন্ঠে প্রবল আনন্দ আর অন্যজনের, তীব্র কষ্ট।

    অয়ন হাসলো। রুশী চুপ মেরে গেলো। অয়ন বললো,“আমি আগে বলতে চাই।”

    রুশী জেদ ধরলো। কথাটি আগে রুশী বলবে। কেননা সে জানে, অয়নের মুখ থেকে ভালোবাসাময় কিছু শুনলে ও আর নিজেকে কঠোর রাখতে পারবে না। রুশীর জেদের কাছে অয়নকে হার মানতেই হলো। ঠোঁটে মিষ্টি হাসির রেখা বজায় রেখেই বললো,“ঠিক আছে, বল। এতদিন অপেক্ষা করেছি, এটুকুও পারবো।”

    রুশী কেঁপে উঠলো। পারছে না রুশী। নিজেকে সামলাতে পারছে না। নিষ্ঠুর হতে পারছে না রুশী। অয়ন কথাটি বলার জন্য তাগাদা দিতেই রুশী চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো। বড় বড় দুটো শ্বাস টানলো। নিজেকে ধাতস্থ করে হাতের কার্ডটি অয়নের দিকে এগিয়ে দিয়েই বলে ফেললো,“এক সপ্তাহ বাদে আমার বিয়ে। আসিস।”

    অয়ন থমকে গেলো। পেছনে লুকোনো হাতের কাঠগোলাপ গুচ্ছ মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। দুকদম পিছিয়ে গেলো। স্তব্ধ, নিরুত্তর অয়নের চাহনিতে রয়েছে ঘোর অবিশ্বাস। অয়নের হৃদযন্ত্র কার্যক্রম বন্ধ করে দিলো। শ্বাস আটকে আসছে। মনে হচ্ছে কেউ ওর বুক চিরে, হৃদপিন্ড বের করে নিয়েছে।

    রুশী চোখ খুলে ফেললো এবার। শেষবারের মতো দুটো ভালোবাসার মানুষের চক্ষুদ্বয় এক হলো। অয়ন এতটাই অবাক হয়েছে যে, আজ রুশীর চোখে এই গভীর ভালোবাসার অনুভব করতে পারছে না।

    কম্পণরত অধর যুগল হালকা প্রসারিত করে অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলো, “ত’তুই ম’মিথ্যে বলছিস আ’আমায়, ত’তাইনা?”

    পুনরায় চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো রুশী। অয়নের এই নয়নের পানে তাকানোর সাধ্য নেই ওর। ও যে অন্যায় করলো। ভারী অন্যায় হয়ে গেলো ওর দ্বারা।

    “আমি তোর সাথে এ বিষয়ে মজা করতে যাবো কেনো? বিয়ের তো বয়সও হয়ে গিয়েছে আমার। তাছাড়া ছেলে দেখতে শুনতে ভালো। টাকা পয়সাও কম নেই। রাজি না হবার প্রশ্নই আসে না।”

    কথাটি শেষ করে, অয়নের হাতে কার্ডটি দিয়েই রুশী দৌড়িয়ে চলে গেলো। একটি বারও পেছনে তাকায়নি। তাকালে হয়তো এভাবে যাওয়ার ক্ষমতা পেতো না।

    অয়ন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছে না কিছু। ওর গোটা দুনিয়া থমকে গেলো। রুশী নজরের বাইরে যেতেই অয়নের হাঁটু ভেঙ্গে এলো। বসে পড়লো। কার্ডটি গিয়ে ফুলগুলোর পাশে পড়ে রইলো।

    হাত এগিয়ে মাটিতে রাখলো।

    ছেলে মানুষের নাকি কাঁদতে নেই। কিন্তু এখন যে অয়নের বুক ফেঁটে কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর প্রয়াস চালাচ্ছে অয়ন।

    “তোর সাথে আমার প্রণয় হলো না।

    একসাথে হাতে হাত রেখে বাকিটা জীবনের পথ চলা হলো না।

    পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে, সারা অঙ্গেতে মেঘ মেখে, সূর্যোদয় দেখা হলো না।

    সন্ধ্যের আগ মুহূর্তে, নদীর কিনারায় পানিতে পা ভিজিয়ে, হাঁটতে হাঁটতে সূর্যাস্ত দেখা হলো না।

    কোনদিন আর নিজেকে তোর বর্ষণ সঙ্গী হিসেবে দেখা হলো না।

    বিকেলে টংয়ের দোকানে বসে, জীবনের বাকি গল্প সাজাতে সাজাতে হিসেব বিহীন চায়ের কাপ খালি করা হলো না।

    কোন এক সন্ধ্যেতে, এই শহরের রাস্তায়, তোর সাথে মাইলের পর মাইল হাঁটা হলো না।

    তোর পা, আলতাতে রাঙিয়ে দেওয়ার সৌভাগ্য আর হলো না।

    কোন এক পূর্ণিমা রজনীতে, তোর সাথে আর চন্দ্রবিলাস হলো না।

    তোর মন খারাপের দিনে, মন ভালো করার মেডিসিন হয়ে আর আসা হলো না।

    তোর সমস্ত কষ্ট শুষে নিয়ে, তোর সুখের একমাত্র কারণ হওয়া হলো না।

    তোকে আমার ঘরের ঘরনি হিসেবে আর দেখা হলো না।

    তোর মিষ্টি চেহারায় আমার নামের লজ্জা দেখা হলো না।

    আমার সারাটা জীবন তোর নামে করে দেওয়া হলো না।

    আর…

    তোর জীবনের একমাত্র পুরুষ হওয়া হলো না রে রুশী।”

    অয়ন থেমে গেলো। বুক ভরে একটা শ্বাস নিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা কন্ঠে বলে উঠলো,“এই ধরণীর বুকে একসাথে পুরোটা জনম আমাদের নিজস্ব হলো না।এতো না হওয়ার মাঝে সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তি হচ্ছে, তুই আমার হলি না।”

    __________________________

    ব্যস্ত এক নগরী। রাস্তা সম্পূর্ণ যানবাহন দ্বারা পরিপূর্ন। জ্যামে আটকে আছি আমি আর আরহান। বিকেলে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু আরহান কিসের যেন ব্যস্ততা দেখিয়ে আমাকে সকালেই নিয়ে এলো। কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই ঢাকার এই জ্যামে পড়তে হয়েছে আমাদের। জানালা দিয়ে বাইরে দেখে যাচ্ছি। হুট করে আমার চোখ দুটো থমকে গেলো সামনের ওই গাড়ির দিকে। স্তব্ধ আমি, চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি সেদিকে। বিশ্বাস করতে ভীষণ বেগ পোহাতে হচ্ছে আমায়। মৃত মানুষ কি করে সামনে এসে দাঁড়াতে পারে! মা!

    আমি আরহানকে কিছু বলতে যাবো, তার আগেই জ্যাম ছেড়ে দিলো। সামনে দেখা ওই মানুষটিকে, চোখের ভ্রম মনে করে বাদ দিয়ে দিলাম।

    কিছুটা পথ অতিক্রম করতেই আবারো জ্যামে পড়লাম। পাশের ফুলের দোকানের দিকে চোখ গেলো। শুভ্র ফুলে আমার আকর্ষণ সেই আগে থেকেই। বিশেষ করে, বেলি ফুলে। সামনে কতগুলো বেলি ফুলের মালা ঝোলানো আছে। তবে আমাকে ছোটবেলা থেকে শুধু এসব দেখেই আসতে হয়েছে। একবার দেখেই চোখ ফিরিয়ে নিলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।

    হঠাৎ দেখলাম আরহান গাড়ি থেকে নেমে গেলেন। আরহানের যাওয়ার পথ অনুসরণ করে দেখলাম, আরহান ওই ফুলের দোকানের কাছে চলে গেলেন।

    কিছুক্ষণ বাদে ফিরে এলেন উনি। হাতে কতগুলো বেলি ফুলের মালা। ভ্রু কুঁচকে আরহানের দিকে তাকালাম। আমার পাশে বসে মিষ্টি হেসে আরহান আমাকে বললেন, “তোমার ছোট বড় সব ইচ্ছের দায়িত্ব আমি নিলাম।”

    বাড়িতে পৌঁছতে ঘন্টা দুয়েকের মতো লাগলো। কলিং বেল বাজাতেই, দরজা খুললো মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে। আমাকে আর আরহানকে দেখেই, চোখ দুটো কেমন যেনো বড় করে নিলো। দু কদম পিছিয়ে জোরে জোরে ‘মা’ বলে চিৎকার করতে লাগলো। কিছুক্ষণ বাদে অর্ধবয়স্ক একজন মহিলা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলেন। পরনে তার সাদা শাড়ি। সামনের চুলগুলোতে হালকা পাঁক ধরেছে। চেহারাটা দেখেই কেমন যেন পরিচিত লাগলো। পাশে ঘুরে আরহানকে দেখলাম একবার। হ্যাঁ! আরহানের চেহারার সাথে উনার চেহারার বেশ কিছু মিল লক্ষ্য করলাম। মানে কি উনিই আমার শাশুড়ি মা?

    আরহানের মা দ্রুত পায়ে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। একবার আমাকে দেখে আরহানের দিকে তাকিয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ওটা বউমা!”

    আরহান আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু কন্ঠে “হুঁ” বললেন। আরহানের মা খুশি মনে আমাদেরকে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন। সেখানে গিয়েই ড্রয়িং রুমে বসে থাকা আরও একটা মেয়েকে দেখলাম। যতদূর জানি আরহানের বাড়িতে উনার মা আর বোন ছাড়া কেউ থাকে না। তবে এ কে?

    আরহান আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে সোফায় বসে থাকা এই নারীকে দেখে বরাবরের মতোই ভ্রু কুঁচকে ফেললো।

    নিশা আমার দিকে এগিয়ে এলো। ঠোঁট ভরা হাসি নিয়ে বললো,“ভাবি! কি মিষ্টি গো তুমি! আমি নিশা। তোমার একমাত্র সুইটসি, কিউটসি ননদীনি।”

    আমি হেসে দিলাম নিশার এরকম ভাবে কথা বলায়। এর মাঝে আরহানের মা আমার কাছে এগিয়ে এলেন। আমার চিবুকে হাত রেখে আরহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মাশা আল্লাহ! কি মিষ্টি আর লক্ষ্মী একটা মেয়ে এনেছিস তুই আমার জন্য। কি ভাগ্যবতী আমি! আজ থেকে আমার দু দুটো মেয়ে।”

    আবেগী হয়ে পড়লাম আমি। মা নেই আমার। উনার মাঝে নিজের মাকে দেখতে পাচ্ছি। আজ আমার মা বেঁচে থাকলে হয়তো এমন ভাবে ভালবাসতেন আমাকে। ঠোঁট ভেঙ্গে কান্না এসে গেলো। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলাম। আরহানের মা ও আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন,“এই পাগলী মেয়ে! কাঁদছিস কেনো?”

    “আসলে ওর মা নেই।”

    আরহানের এমন কথায় আরহানের মা ওনাকে ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,“কে বলেছে ওর মা নেই? আমি কি মরে গিয়েছি নাকি?”

    আরহান সবার অগোচরে তৃপ্তির এক হাসি হাসলেন। অন্যদিকে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে সোফায় বসে থাকা রূপ। এগিয়ে এলো রূপ। আমি ততক্ষণে আরহানের মাকে ছেড়ে দাঁড়িয়েছি। রূপ কাছে এসে বললো, “হাই! আমি আরহান বেই…”

    রূপের আর কিছু বলার আগেই নিশা ওর হয়ে বললো, “ও! ও হচ্ছে রূপ আপু। আমাদের চাচাতো বোন। কিছুদিন আগেই দেশে এসেছে।”

    আমি “ওহ্ আচ্ছা” বলতেই আরহান আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“মাত্র বাইরে থেকে এসেছো। এখন ফ্রেশ হয়ে নেবে চলো।”

    আমিও সবার সাথেই কথা বলে আরহানের পিছু পিছু আরহানের রুমে ঢুকলাম। এই রূপকে আমার তেমন একটা সুবিধার লাগলো না।

    রুমে ঢুকেই আমার চোখ চড়ক গাছ। পুরো রুমে আমার ছবি। রুমটি সাজানো হয়েছে আমার পছন্দের সাদা রঙে। মধ্যে ঠিক সামনের দেয়ালটিতে লাল রঙের একটা বিশাল পর্দা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। আরহান ফ্রেশ হবার জন্য ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। আমি এগিয়ে গেলাম এই পর্দা বরাবর। লাল রংয়ের এই পর্দা সরাতেই, নিজের বিশাল এক ছবি আবিষ্কার করলাম।

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১০)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১০)

    রুশী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে নিজের রুমে। মাথা নিচু। চাহনি ফ্লোরে। মস্তিষ্কে কিছু মানুষের স্বার্থপরতা আর মনে রয়েছে ভালোবাসার উপলব্ধির আগেই ইতি বিষয়ক যন্ত্রণা। বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে রুশীর।

    সামনে দাড়িয়ে আছে রুশীর মা ও বাবা। চাহনি স্থির তাদের। কোনো আফসোস নেই। যেনো তারা কোনো অন্যায় করেনি। তবুও নিজেকে এক্সপ্লেইন করার জন্য রুশীর বাবা বলে উঠলেন,“আমরা কি তোর খারাপ চাই মা? যা করছি এতে তো তোর ভালোই হবে।”

    রুশী ছলছল নয়নে তার বাবার পানে তাকালো। চোখ দুটো ভয়ঙ্কর রকমের লাল হয়ে আছে। ইতিমধ্যে রুশীর সমস্ত মুখশ্রী লাল হয়ে গিয়েছে। চুল গুলো এলোমেলো। এ যেনো রুশীর বিধ্বস্ত এক রূপ।

    মেয়ের এমন অবস্থা দেখেও তাদের খুব একটা সমস্যা হলো না। ভাবলো, হয়তো তাদের ছেড়ে যাওয়ার জন্য মন কেমন করছে রুশীর। ব্যাপারটা এই পর্যন্তই রাখলো তারা।

    “আমাকে নিয়ে ড’ডিল করলে তোমরা? তোমাদের বন্ধুত্বের জন্য আ’আমাকে নিয়ে ডিল করে ফেললে? আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না? আ’আমি তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছি, ন’না?”

    কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে কথাগুলো বলতে বলতে রুশীর চোখের বাঁধ ভেঙে নোনা পানি গড়িয়ে পড়লো। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর প্রয়াস চালাচ্ছে।

    রুশীর মা এতে একটু রেগে গিয়েই বললো,“এতো রিয়েক্ট করার কি আছে রুশী? বিয়ে কি কেউ করে না নাকি?”

    “তাই বলে আমাকে জানাবেই না?”

    রুশীর প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে ওর বাবা মা। রুশীর বাবা কিছু বলতে যাবে, তার আগেই ওর মা ওর বাবাকে থামিয়ে বলে উঠলো,“এতো কষ্ট করে মানুষ করেছি তোকে আমরা। এইটুকু অধিকার নেই তোর উপর?”

    হুট করেই রুশী থমকে গেলো। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে একবার ওর বাবা মাকে দেখে নিলো। এতোটা আশা করেনি।

    রুশীর মা পুনরায় বললো,“দেখ! ছেলে আর ছেলের পরিবার সব দিক থেকেই ভালো। টাকা পয়সায়ও কমতি নেই।”

    রুশী হাসলো। তাচ্ছিল্যের এক হাসি হাসলো। পুনরায় ফ্লোরে তাকালো। বাবা মা তার কাছ থেকে মুক্তি চাচ্ছে। দিয়ে দেবে কি? নাকি নিজের সুখটা বেছে নেবে? সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে রুশী। বুকে কেমন যেনো এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। কিছু পাবার আগেই হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা বড্ড পোড়ায়। রুশীর স্থির দৃষ্টি ফ্লোরে সীমাবদ্ধ রেখেই বললো,“আমি রাজি।”

    রুশীর বাবা মা খুশিতে গদগদ হয়ে গেল। কথাটা রুশীর জন্য বলা এতোটা সহজ ছিলো না। কিন্তু, বাবা মায়ের উপর বোঝা হয়ে থাকতে চায়নি রুশী। তাই তো নিজেকে বলি দিলো।

    রুশীর বাবা মুচকি হেসে ওর মাথায় হাত রেখে বললো, “ভুল বুঝিস না রে মা। বাবা মা তাদের সন্তানের খারাপ কোনোদিনও চায় না। একদিন এই সিদ্ধান্তের জন্য সবচেয়ে বেশি তুই’ই খুশি হবি।”

    রুশী নিরুত্তর হয়ে বসে আছে। যেনো এক পাথর হয়ে গিয়েছে। রুশীর মা মুখে হাসির রেখা প্রশস্ত করে বললো,“তাহলে মারুফ ভাইকে কল দিয়ে বলে দাও, তাড়াতাড়ি বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে।”

    রুশীর বাবাও খুশি মনে হন্তদন্ত হয়ে রুম থেকে বেরোলো, তার কলেজ জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধুকে খবর দিতে। সাথে রুশীর মা ও গেলো।

    যাবার সময় রুশীর মা দরজাটা টেনে দিয়ে গেলো। সেই শব্দ হবার সাথে সাথেই রুশী চোখ দুটো বন্ধ করে ফেললো। কার্নিশ বেয়ে পুনরায় অশ্রুধারা বইছে। রুশী বাকরুদ্ধ। কি বলবে এখন? কি’ই বা বলার আছে? কি’ই বা করার আছে? ধপ করে বেড থেকে ফ্লোরে বসে পড়লো। বন্ধরত নয়ন এখন তার মুখ বিচরণ করছে, যাকে দেখলে রুশীর সুখ লাগতো। ধন্য হতো চক্ষুদ্বয়। ভাবনায় পুরনো দিনের সেসকল কথা ভেসে আসছে, যা ছিলো রুশীর একান্ত প্রিয়জনকে ঘিরে।

    অয়ন! ছেলেটা কখনো বলেনি, কতোটা ভালোবেসেছে। চুপ থেকেই ভালোবাসার সহস্র রঙের সাথে পরিচয় করিয়েছে। ভালোবাসতে শিখিয়েছে। একদম গোপনে।

    আবারো খানিকটা হাসলো রুশী। ছেলেটা পাগল ছিলো রুশীর জন্য। ওকে ছাড়াতো অয়ন থাকতেই পারতো না। রুশীর সামান্য কষ্টও সহ্য করার ক্ষমতা ছিলো না। একটু কিছুতেই কি রিয়েক্টই না করে ফেলতো। সেখানে…

    ফট করে চোখ মেললো রুশী। অয়ন যদি এসব জেনে যায়? ও তো খুন করে ফেলবে সবাইকে। বা দিকে তাকাতেই, আয়নায় নিজের এই বিধ্বস্ত রূপ দেখে ভয় পেয়ে গেলো। তার অয়ন তো তার তিল পরিমাণ কষ্টও সহ্য করতে পারে না। এভাবে দেখলে নিশ্চয়ই অনেক কষ্ট পাবে অয়ন। তড়িঘড়ি করে শাড়ির আঁচলের শেষাংশ দিয়ে লেপ্টে যাওয়া কাজল মুছে ফেললো। এলো মেলো চুলগুলো হাত দিয়ে গোছানোর চেষ্টা করলো। পুরোপুরি না হলেও খানিকটা সফল হলো। অশ্রুভেজা চোখে নিজেকে আয়নায় দেখে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি আনার চেষ্টা করলো। হাসলো। তৎক্ষণাৎ হাউমাউ করে কেঁদে দিলো।

    কান্না মিশ্রিত কন্ঠে উচ্চারণ করলো,“তোকে খুব ভালোবাসি অয়ন। খুব ভালোবাসি।”

    কিছুক্ষণ কান্না করতে করতে হঠাৎ শ্বাস কষ্ট শুরু হলো রুশীর। হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,“যাকে ঘিরে আমার পুরো পৃথিবী ছিলো, আজ এই পৃথিবীতে সে আমার জন্য নিষিদ্ধ।”

    ____________________

    পিটপিট করে চোখ মেললাম। রুমে লাইট অন করা। রাত্রির শেষ প্রহর চলছে। চক্ষুদ্বয় সিলিংয়ে নিবদ্ধ থাকতেই চোখের সামনে গতকাল রাতের সেই দৃশ্য ভেসে এলো। তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ালাম। পুরো শরীর ঘেমে যাচ্ছে। পুনরায় কালকের ঘটনা ভাবনায় আসতেই, সর্বাঙ্গে ঘিনঘিনে একটা ব্যাপার জন্ম নিলো।

    মুহূর্তেই আরহান এর কথা মাথায় এলো। আরহান কোথায়? ঠিক আছেন তো উনি? এতো কষ্ট সহ্য করে অবশেষে ভালোবাসার সুখ পেয়েছি। তাও আবার অসীম ভালোবাসা। আরহানকে না চাইতেও মনের কোঠায় স্থান দিয়ে দিয়েছি। আমাদের মতো মানুষদের জন্য যদি কেউ সামান্য কিছু করে, আমরা তাদের জন্য জান দিয়ে দেই। এখানে তো আরহান ভালো বেসেছে আমাকে। উনাকে কি দেওয়া যায়? এই চিন্তা করাটা সামান্য ব্যাপার এখানে।

    তখনই ওয়াশরুম থেকে আরহান বেরোলেন। উনাকে সুস্থ থাকতে দেখে দৌঁড়ে ছুটে গেলাম উনার কাছে। জড়িয়ে ধরলাম।

    ঘটনার আকস্মিকতায় আরহান কিছুটা পিছিয়ে গেলেন। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। মিনিট খানেক সময় লাগলো এই ঘটনা বুঝতে। বুঝতে পারতেই খেয়াল করলেন আমি কাঁপছি। শরীর আমার অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে। আরহান আমাকে আলিঙ্গন করে নিলেন। ডান হাত আমার মাথার পেছনের চুলে হাত বুলোচ্ছে। মিহি কণ্ঠে বললেন, “কাঁপছো কেনো শুকতারা? কিছু হয়নি। সব ঠিক আছে তো।”

    উনার এমন আদরমাখা কন্ঠে আমি আবেগী হয়ে বেশ জোরেশোরেই কেঁদে দিলাম। অস্থির হয়ে পড়লেন আরহান। ইতিমধ্যে আমার চুলের পেছনে উনার হাতের বিচরণ থেমে গিয়েছে। আমাকে নিজের বুকে থেকে উঠিয়ে আমার দুই গালে হাত রাখলেন। ব্যাস্ত ভঙ্গীতে বললেন,“হুশ! হুশ! কাঁদে না। আমি আছি তো।”

    কথাটি শেষ করেই আরহান আমার কপালে চুমু খেলেন। আবেশে চোখ বুজে নিলাম। আরহান পুনরায় জড়িয়ে নিলেন আমাকে। আমি উনার বুকে মুখ গুজে অস্ফুট স্বরে বললাম,“আমি ভেবেছিলাম আপনার সাথে কেউ উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলেছে। আমার তো আপনি ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু ঐ লাশ…!”

    হঠাৎ ঐ লাশের কথা মনে পড়তেই আমি বুকে থেকে মুখ তুলে তাকালাম আরহানের পানে। শুধালাম,“ঐটা কে ছিলো? কার লাশ? কে খুন করলো? আর এখানে! এখানে তো রক্ত ছিলো।”

    শেষ কথাটি, তর্জনী আঙ্গুল ফ্লোরের দিকে ইশারা করে বলেছি।

    আরহান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন,“কিসের রক্ত?”

    “এখানেই তো ছিলো, দেখেন নি?”

    “আমিতো কোনো রক্ত দেখতে পেলাম না। আমি এখানেই বেডে শুয়ে ছিলাম। তোমার চিৎকার শুনে এদিকে তাকিয়ে দেখি, তুমি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছো।”

    আমি অবাক। শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়লাম,“কেউ ছিলো না! সত্যি?”

    “হয়তো অনেক চিন্তিত তুমি। এজন্যই এমনটা হচ্ছে তোমার সাথে। এতো টেনশন করো না। আমি আছি তো। চলো, ঘুমোবে।”

    আমি আসলেই চিন্তিত। আর কোনো প্রশ্ন করলাম না।

    বিছানায়, উল্টা দিকে ঘুরে শুয়ে আছি। শুয়েছি ঘণ্টা খানেক হবে হয়তো। ঘুম আসছে না। হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকিয়ে আছে আমার দিকে। পেছনে ঘুরতেই, ড্রিম লাইটের আবছা আলোয় আরহানকে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে লক্ষ্য করলাম। চাহনি স্থির। আমি চোখ ছোট ছোট করে জিজ্ঞেস করলাম, “ঘুমোননি?”

    “নাহ্! আসছে না।”

    “আমারও না।”

    “একটা কথা বলি শুকতারা?”

    উনার, আমাকে এই শুকতারা বলে ডাকাটা এতো ভালো লাগে! বলে বোঝাতে পারবো না। উনাকে কথাটা বলার সুযোগ দিতে আমি “হুঁ” বললাম।

    “ক্যান আই হাগ ইউ?”

    আরহানের নিঃসংকোচে করা এমন আবদারে আমি থম মেরে গেলাম। আমার উত্তরের অপেক্ষা না করেই উনি দূরত্ব ঘুচিয়ে নিলেন। উনার উষ্ণ আলিঙ্গনে আমিও গুটিশুটি মেরে রইলাম। আরহান আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,“ভীষণ ভালোবাসি শুকতারা।”

    _____________________

    ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে একটার পর একটা সিগারেটের প্যাকেট খালি করে যাচ্ছে তৃষ্ণা। এই নিয়ে তৃতীয় প্যাকেটটা খুলতেই সেখানে আশিকের আগমন।

    “স্যার! আপনের নামে পার্সেল আইসে।”

    তৃষ্ণা একবার আশিকের দিকে তাকালো। তারপর আগের মতো আকাশে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,“পাঠিয়ে দাও রুমে।”

    আশিক চলে গেলো। মিনিট পাঁচেক পর, বিশাল আকৃতির একটা বক্স নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তৃষ্ণা এতো বড় বক্স দেখতেই কপাল কুঁচকে ফেললো।

    আনবক্স করতেই সেখানে আশিক চিৎকার করে লাফিয়ে উঠলো।

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৯)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৯)

    “স্যার, তৃষ্ণা আদা জল খেয়ে ম্যামের খোঁজ পাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।”

    রুদ্রের এই কথায় পুরো বাড়িতে এক থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে। আরহান চিন্তায় পড়ে গেলো। এর চেয়েও বেশি পড়েছে ভয়ে। তার শুকতারাকে হারানোর ভয়ে। আরহান যথেষ্ট ভয়ানক, হিংস্র। কিন্তু এর চেয়েও বেশি হিংস্রতা রয়েছে তৃষ্ণার মধ্যে। আরহান চাইলে, অনেক আগেই তৃষ্ণাকে শেষ করে দিতে পারতো। কিন্তু উদ্দেশ্য তার হারানোর। মেরে ফেলা নয়।

    আর এদিকে আমি ভাবছি, আমাকে কেনো খুঁজছে? আর তৃষ্ণা নামটা শোনা শোনা লাগছে। কিন্তু কোথায় শুনেছি?

    আরহান নিজের ভাবনার মাঝে একবার পেছনে ঘুরলেন। আমাকে এভাবে থম মেরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে ভীত হয়ে পড়লেন।

    আমি উনাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। ঠিক আরহানের সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন তুললাম,“কে তৃষ্ণা? কেনো খুঁজছে আমাকে?”

    আরহান দুটো শ্বাস ফেললেন। হয়তো সবটা বলার জন্য নিজেকে একটু প্রস্তুত করে নিলেন। আমার চোখে চোখ রেখে বলা শুরু করলেন,“সেদিন তোমার ভার্সিটিতে একটা ছেলে এসেছিলো না? সিঙ্গার! এই সেই তৃষ্ণা।”

    তৎক্ষণাৎ আমার চোখে ভেসে এলো নীলাভ চক্ষুদ্বয়ের অধিকারী সুদর্শন সেই পুরুষটি। নেশাক্ত নয়নে কিভাবে যেনো আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে ইনি আমার খোঁজ কেনো করছেন?

    আমার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে আরহান পুনরায় বলা শুরু করলেন,“তৃষ্ণা নারী আসক্ত। যাকে একবার চোখে ধরে, তাকেই ওর চাই। আর যে নারী একবার ওর চোখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে, সে নিজ থেকে ধরা দেয়। আমার সবচেয়ে বড় শত্রু তৃষ্ণা। আর আমার দুর্বলতা তুমি। তৃষ্ণা আমাকে হারানোর জন্য যেকোনো পর্যায়ে নামতে পারে। আমার দুর্বলতায় আঘাত হানতে পারে। তাই যতোটা সম্ভব তোমাকে আমি গোপন রাখতাম। কিন্তু সেদিন ভার্সিটিতে সেই নজর তোমার উপর পড়ে গেলো। তাই তো নিয়ে এলাম তোমাকে। আর এজন্য আমি একটুও অনুতপ্ত নই।”

    আরহান খুব কৌশলে উনার শত্রুতার আসল ব্যাপারটা লুকিয়ে গেলেন। উনার কাজগুলো সে আমাকে জানাতে চায় না। হয়তো ভাবছেন, উনার শুকতারা এসব জেনে গেলে উনাকে আর মেনে নেবে না।

    আমি স্তব্ধ দাড়িয়ে কথা শুনছি। এর মাঝে রুদ্র তার স্যারকে বলে বিদায় নিলো। আরহান আমাকে বললেন,“এবাড়িতে আর থাকা যাবে না। আমি সারাদিন থাকি না। আর বাড়িতে সার্ভেন্ট ছাড়া কেউ নেই ও। তৃষ্ণা যেকোনো সীমায় পৌঁছে যেতে পারে। কাল বিকেলেই বাড়ি যাবো আমরা। তোমার শ্বশুর বাড়ি।”

    আরহান আমার হাতে, তার হাতের ব্যাগটি দিয়ে বললেন,“ভেবেছিলাম এখানে থাকবো বেশ কয়েকদিন। তাই এগুলো আনিয়েছিলাম। কোথাও মেয়েলি কিছু পছন্দ হলেই তোমার জন্য নিয়ে নিতাম। ভাবতাম,এই জিনিসটার আসল সৌন্দর্য তখনই আসবে, যখন আমার শুকতারার গায়ে জড়াবে।”

    চলে গেলেন আরহান। আমি উনার ভালোবাসায় মুগ্ধ। এতটা ভালোবাসা আমার জন্য ছিলো? পরক্ষণেই আমি ভাবনায় পড়ে গেলাম। বেশ গম্ভীর হয়ে ভেবে চলেছি,“দুনিয়াতে কি মেয়ে মানুষের অভাব পড়েছিলো?”

    হাতের ব্যাগের দিকে একপলক তাকালাম। গিয়ে সোফায় বসে এটা খুললাম। ভেতরে আরো কয়েকটা বক্স আছে। এগুলোও খুললাম। একটাতে কিছু জোড়া নূপুর। একটাতে কাঁচের চুড়ি অনেক কালারের। একটাতে বেশ কয়েক রকমের ঝুমকা। মানে সাজ-সজ্জার প্রায় সবই আছে এখানে। ঠোঁটের কোণ ঘেঁষে অজান্তেই হাসি চলে এলো।

    _________________________

    “কে আপনি? আর এখানে কাকে চাই?”

    বাবা, তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে কথাটি বললেন। তৃষ্ণা বাঁকা হাসলো। ড্রয়িং রুমের সিঙ্গেল সোফায়, পায়ের উপর পা তুলে আয়েসি ভঙ্গিতে বাবার মুখোমুখি বসে আছে। ঠিক সামনে বাবার পাশে ছোট মা ও মীরা আপুও বসে আছে।

    তৃষ্ণা রসাত্মক গলায় বললো,“আরে শ্বশুর আব্বা! জামাই প্রথম বার বাড়িতে এসেছে, আর আপনি অ্যাপায়ন না করে প্রশ্ন তুলে যাচ্ছেন! নট ফেয়ার শ্বশুর আব্বা।”

    বাড়ির সকলের চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছে। তৃষ্ণার কথার আগা গোড়া, মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে সবার। ছোটমা আর বাবা এবার মীরা আপুর দিকে তাকালো। আপু দুজনের এভাবে তাকানো দেখেই ফটাফট বলে দিলো,“আমি চিনি না। সত্যি বলছি। চিনি না।”

    তৃষ্ণা হেসে দিয়ে বললো,“আরে বড়টা না। ছোট মেয়ের জামাই আমি।”

    সঙ্গে সঙ্গে বাবা বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। ছোটমার পুরনো কিছু মনে পড়তেই শুকনো ঢোক গিললেন। একই অবস্থা মীরা আপুরও।

    সবার এমন অবস্থা দেখে তৃষ্ণা আন্দাজ করতে পারলো না ব্যাপারটা কি। ভ্রু কুচকে নিলো।

    বিরক্তিকর ভঙ্গিতে বললো,“হবু। হইনি এখনও।”

    বাবা ফুস করে আটকিয়ে রাখা শ্বাস ছাড়লেন। বড়জোর বাঁচলেন। তবুও মনের মাঝে প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করে ফেললো,“সম্পর্কে ছিলো ও আপনার সাথে?”

    তৃষ্ণা মৃদু আওয়াজে বললো,“না, ওকে আমার ভালো লেগেছে। এজন্য বিয়ে করতে চাই। আর আমি যা চাই, তা না পেলে ছিনিয়ে নেই। এখন ভালোয় ভালোয় বলে দিন ও কোথায়। নয়তো আপনাদের সাথে কি করবো ভাবতেই পারছেন!”

    শেষোক্ত কথাটি বলার সময় হাতের গানটি দিয়ে নিজের অন্য হাতে স্লাইড করলো তৃষ্ণা। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে সবার। ছোটমা মনে মনে বলছে,“কি সাংঘাতিক মেয়েরে বাবা! নাগর যুটিয়েছেও এমন। একজন ছাদ থেকে ফেলে দেয়, কিডন্যাপ করে আটকিয়ে রেখে বিয়ে করে নেয়। তো অন্যজন সোজা মারার হুমকি দেয়।”

    বাবা খানিকটা কেশে সোজা গলায় বলে দিলেন,“ওর বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”

    তৃষ্ণা দাড়িয়ে পড়লো। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে আওড়ালো, “হোয়াট!”

    ___________________

    রুশী তৈরি হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে নিলো। সময়টা সন্ধ্যে। মাথাটা বা দিকে ঘুরিয়ে জানালার বাইরের পশ্চিমাকাশের দিকে একপলক তাকিয়ে বললো,“তোর নামে আমার আঙিনায় সহস্র সন্ধ্যে নামুক। যেখানে থাকবি তুই, থাকবো আমি। থাকবে আমাদের খুনসুঁটি। থাকবে তোর যত্ন। থাকবে আমার খামখেয়ালিপনা। থাকবে কিছু ভালোলাগা। আর থাকবে ভালোবা… নাহ্! আর কিছু না। আমার শুধু তুই থাকলেই চলবে।”

    মুচকি হাসি দিয়ে পুনরায় নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নিলো। কল্পনায় আঁকলো অয়নকে নিয়ে কিছু প্রতিচ্ছবি। প্রায়শই করে এটা। এই যে, এখন ভাবছে, রুশী এখানে দাঁড়িয়ে আয়নায় নিজেকে দেখছে। পাশে দাঁড়িয়ে অয়ন, মুগ্ধ নজরে রুশীকে দেখে যাচ্ছে। অয়নের সে কি চাহনি! চোখের মধ্যে কি আছে ওর? ভাবতেই লজ্জায় রুশীর ফরসা গাল দুটো লাল হয়ে এলো।

    তখনই রুমে ঢুকলো রুশীর মা। রুশীকে উদ্দেশ্য করে বললো,“তৈরি হয়ে নিয়েছিস?”

    রুশী মৃদু হেসে “হুঁ” বললো।

    রুশীর মা একবার রুশীকে ভালো করে দেখে নিলো। মনে মনে বললো,“আমার মেয়েটা এতো সুন্দর! মায়ের নজর লেগে যাবে না তো আবার!”

    নিজের চোখের নিচ থেকে একটা আঙ্গুলে কাজল ভরিয়ে নিয়ে রুশীর কানের পিছে লাগিয়ে দিলো। রুশী তার মায়ের এমন কাজে খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। রুশীর মা পুনরায় মুগ্ধ নজরে নিজের মেয়েকে দেখলো।

    খানিকক্ষণ বাদে বলে উঠলো,“নিচে আয় এখন।”

    রুশী “আচ্ছা” বলে নিচে এলো ওর মায়ের সাথেই। এসেই সোফায় বসে থাকা দুজন বয়স্ক পুরুষ আর মহিলার সাথে একটা মেয়ে ও একটা ছেলে দেখলো। আন্দাজ করে নিলো, এই বয়স্ক মানুষ দুটি রুশীর বাবার বন্ধু ও বন্ধুর বউ আর এরা তাদের ছেলে মেয়ে। মেয়েটি রুশীর ছোট হবে।

    রুশী ভদ্রতার খাতিরে হালকা হেসে সালাম দিলো। মহিলাটি সালামের জবাব দিয়ে উঠে এসে রুশীর পাশে দাঁড়ালো। মৃদু হেসে রুশীর থুতনিতে হাত রেখে বললো, “মাশাআল্লাহ! মেয়েতো ভারী মিষ্টি। আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে।”

    _____________________

    রাত অনেকটা বেজে গিয়েছে। খেয়ে দেয়ে ছাদে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আমি ছোট থেকেই কাজের মধ্যে থেকেই এসেছি। কিন্তু এখানে এসে আর কিছুই করতে পারছি না। না আছে ভার্সিটি, আছে পড়ালেখা আর না আছে বাড়ির কাজ। ভীষন বোরিং লাগছে। হয়তো কাল ওবাড়িতে যাবার পর আর এমন লাগবে না।

    আরহান রুমে আছে। অফিসে না গিয়ে বাড়িতে বসেই কাজগুলো করছে। এদিকে এখন আমার ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা শুরু করলাম।

    পুরো বাড়ি পিনপতন নীরবতা পালন করছে। তার মধ্যে আমার হাঁটার শব্দে আমি নিজেই ভয় পেয়ে যাচ্ছি। শব্দটা বেশ জোরালো ঠেকছে।

    রুমের সামনে গিয়ে দেখলাম, দরজা হালকা খোলা। ধাক্কা দিতেই একটু শব্দ করে পুরোপুরি খুলে গেলো। আর সামনে মেঝের দিকে তাকাতেই আমার চোখ দুটো বড়সড় হয়ে গেলো। ভয়ে থরথর করে শরীর কাঁপছে। মুহূর্তেই ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গিয়েছি। অস্ফুট স্বরে “মা! মা!” বুলি আওড়াচ্ছি।

    আমার চোখের সামনে একটা লাশ উবু হয়ে পড়ে আছে। আর চারিপাশে রক্তের বন্যা। মিনিট দুয়েক যেতেই, শরীরের সম্পূর্ণ শক্তি খরচ করে চিৎকার করে উঠলাম। সেখানেই সেন্সলেস হয়ে পড়ে গেলাম আমি।

    চলবে…