Tag: গল্প

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৫)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৫)

    নিস্তব্ধ বাড়িতে বাবার অবাক কণ্ঠস্বর শোনা গেলো,“শেফালী!”

    মা স্থির দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকালো। অসহনীয় যন্ত্রণা তার বুকে। প্রাক্তনকে সম্মান করা ভালো কথা। তাকে ভালোবাসা ভালো কথা। কিন্তু তার উপস্থিতিতে যদি নিজেরই সন্তানের প্রতি অবহেলা শুরু করে, তবে সেটা অন্যায়। ঘোর অন্যায়।

    মা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। এতো যন্ত্রণা উপেক্ষা করে বললো,“সেদিন আমি যা বুঝেছিলাম, যখন শুনলাম সেটা মিথ্যে ছিলো। এক মুহূর্তের জন্য তখন ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। পরক্ষণেই যখন শুনলাম, তুমি পাল্টে গেছো। বিশ্বাস করো, সেদিনের চেয়েও বেশি কষ্ট পেয়েছি। তোমার থেকে এটা আশা করিনি আমি।”

    মায়ের কথার প্রেক্ষিতে বাবা চুপ। কিছুক্ষণ আগেই সবটা জেনেছে। রুদ্র বলেছে সবটা। সে যে নিজের মেয়ের প্রতি অন্যায় করে ফেলবে, বুঝতে পারেনি।

    দীপ্তি কোনদিকে না খেয়াল করে এগিয়ে গেলো বাবার দিকে। মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে বললো,“বাবা!”

    বাবা থমকে গেলেন। একবার দীপ্তির দিকে তাকিয়ে পুনরায় মায়ের দিকে তাকালেন। অবুঝ ভঙ্গিতে তাকালেন।

    মা গম্ভীর কন্ঠে বললো, “বিয়ে করিনি আমি। তোমারই সন্তান।”

    তখন রুদ্র সবটা বললেও, দীপ্তির ব্যাপারটা বলেনি। তাই এখন জানালো,দীপ্তির ঘটনাগুলো। বাবা অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে আছেন আমাদের দিকে।

    ছোটমাকে বেশ অনেকক্ষণ আগেই পুলিশে নিয়ে গেছে। তখন থেকেই মীরা আপু নিজেকে ঘরবন্দী করে নিয়েছে। ভয় পেয়েছে ভীষণ। ড্রইং রুমে আমি, আরহান, রুদ্র, দীপ্তি, মা ও বাবা দাঁড়িয়ে।

    বাবা অপরাধীর মতো মায়ের সামনে মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওভাবেই বললো,“আমাকে কি মাফ করা যায়না?”

    মায়ের স্পষ্ট উত্তর,“না।”

    তৎক্ষণাৎ মা বেরিয়ে গেলো দীপ্তিকে নিয়ে। বাবা আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো। চোখ ছলছল করছে তার। বাবা কখনো আমাদের সামনে কাঁদেনি। অগোচরে কেঁদেছে। আমি অনেকবার লক্ষ্য করেছি মায়ের ফটোফ্রেম সামনে নিয়ে বাবাকে নিজের ঘরে, লুকিয়ে কাঁদতে।

    বাবা আমাকে কিছুই বললেন না। হয়তো বলার কোনো মুখ নেই। আলগোছে নিজের রুমে চলে গেলেন। আরহান ও আমাকে নিয়ে বেরোলেন। পিছে পিছে রুদ্রও এলো।

    বাড়ির বাহিরে দীপ্তি আর মাকে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেলো। আরহান রুদ্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“তুমি উনাদের নিয়ে, উনাদের বাড়িতে যাও। আমরা অন্য গাড়িতে আসছি।”

    রুদ্র “জ্বি স্যার” বলেই মা আর দীপ্তিকে বললো,“আপনারা আমার সাথে আসুন।”

    _____________

    কারো জীবন হুট করেই থমকে যায়, আবার কেউ কেউ জীবনে নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে। তবে বাধা বিপত্তিহীন জীবন কখনোই কেউ পায়না। বিগত আঠারো বছরের সত্য যখন আমার কাছে ক্ষণ মাত্র সময় নিয়ে তৈরি করা মিথ্যে কাহিনী প্রমাণিত হলো, আমি থমকে গিয়েছিলাম। এতকাল আমি আমার মাকে দোষী ভেবে এসেছি। তার জন্য ভীষন রাগ পুষে রেখেছিলাম মনে। কিন্তু…

    কিন্তু, আজ মায়ের প্রতি কোনো ক্রোধ কিংবা অভিযোগ নেই। আমার বাবার প্রতিও আজ রাগ নেই। একসময় প্রচন্ড রাগ হতো। এখন নেই।

    তবে ভাবনার বিষয় হলো, এখন তো আমার সবচেয়ে বেশি রাগ হবার কথা। হচ্ছে না কেনো? তবে কি আমি অতীতের সব ভুলে গেলাম? মা হীনা জীবনের প্রতিটি কষ্ট ভুলে গেলাম?

    হয়তো তাই হয়েছে। তারা নিজেরাও তো ছোটমার খেলার গুটি ছিলো। হয়তো অতীতকে ছাড়িয়ে আজ আমার বর্তমান জিতে গেলো। জীবন যুদ্ধে জিতে গেলাম আমিও।

    আচ্ছা, বাবা কি খুব কষ্ট পেয়েছেন আজ? যদি জীবনটাকে সেই আঠারো বছর আগের দিনে নিয়ে যেতে পারতাম! যদি সেদিন ছোটমা আর বাবার বিয়েতে মাকে দেখতে পেতাম!

    আফসোস করে কী হবে এখন? যা হবার, হয়ে গিয়েছে। এখন আমার উচিত, বাবা মায়ের মধ্যেকার মনোমালিন্য সব দুর করা। আমি করবো এবং পারবোই। আমাকে যে পারতেই হবে।

    খারাপ লাগার এসকল অনুভূতি নিয়ে আমি ড্রাইভ করতে থাকা আরহানের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলাম। একটা মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছি। আরহান উনার কাঁধে আমার স্পর্শ পেতেই দ্রুত ব্রেক কষলেন। স্থির দৃষ্টিতে আমার পানে চেয়ে রইলেন।

    অবুঝ ভঙ্গিতে বললেন,“ঠিক আছো শুকতারা?”

    নীরস মুখে উত্তর দিলাম,“হু.. ঠিক আছি। এভাবে থাকলে আপনার ড্রাইভিং এ সমস্যা হবে?”

    “না, কিন্তু…”

    আরহানকে আর কিছু না বলতে দিয়ে আমি বলে উঠলাম,“তবে থাকি না এভাবে! বড্ড শান্তি পাচ্ছি আমি।”

    আরহান বুঝতে পারলেন। হালকা হেসে আমার কপালে ওষ্ঠের উষ্ণ স্পর্শ এঁকে দিলেন। আবেশে আঁখি পল্লব বুজে ফেললাম। আরহান পুনরায় হেসে “থাকো” বলে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। আমি ওভাবেই চোখ বুজে আছি।

    সত্যিই তো, আমি এখানেই শান্তি পাই। পরম শান্তি।

    ______________

    ক্লান্ত সন্ধ্যেতে একসঙ্গে সবাই মিলে বসে আছি। আরহান বারবার তাগাদা দিচ্ছেন যাবার জন্য। যেনো কিছু থেকে পালাতে চাচ্ছেন। আমার মাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু আরহান থেকে যেতে পারবেন না, আবার আমাকেও রেখে যেতে পারবেন না।

    অবশেষে মাকে বললেন,“আমাদের যাওয়া উচিত এখন।”

    মা দ্রুত বললো,“আজ থেকে যাও না। মেয়েকে পেয়েছি, ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না।”

    আরহান একটু হেসে বললেন,“আসলে, আমার কাজ আছে আর ওকে এখানে রেখে যেতে পারবো না, ভুল বুঝবেন না আপনি।”

    মা উদাস মনে বললো,“আচ্ছা, তবে ডিনারটা আমাদের সাথেই করো। আজ বীনুর জন্য রান্না করবো আমি।”

    কথাটি শেষ করেই মা আরহানের উত্তরের অপেক্ষা না করে কিচেনে ছুটলো। আমি কতো ভাগ্যবতী, এমন স্বামী পেয়েছি আমি। এমন মা পেয়েছি আমি।

    আবারও আড্ডায় মশগুল হলাম আমি দীপ্তি আর রুদ্র। আরহান ফোনে কিছু একটা করে যাচ্ছেন। তখন কলিং বেল বাজায় দীপ্তি “আমি দেখে আসি” বলে উঠে গেলো।

    আমার দৃষ্টি সামনের দিকেই। আমার সামনের সোফায় আরহান বসে আছেন। আর তার পেছনেই দরজা।

    দীপ্তি হাসি মুখে দরজা খুলতেই আমি দরজার ওপাশে ব্ল্যাক টি-শার্ট, ব্ল্যাক জিন্স পরিহিত যুবককে দেখে বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেললাম।

    সে সোজা যখন এদিকে তাকালো চমকের দরুন স্তম্ভিত হয়ে গেলো। হয়তো চোখের ভুল ভাবছে। বার দুয়েক চোখের পাতা এক করলো। পুনরায় আমাকে সামনে দেখে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

    দীপ্তি তৃষ্ণাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললো,“ভেতরে আয় ভাইয়া। এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?”

    দীপ্তির কথা শুনে আরহান ফোন থেকে মাথা তুলে পেছনে তাকালেন। কপাল কুঁচকে ফেললেন আরহান।

    বিড়বিড় করে বললেন,“এর এখনি আসার সময় হলো?”

    তৃষ্ণা একবার দীপ্তির দিকে তাকিয়ে কম্পণরত ঠোঁট দিয়ে উচ্চরণ করলো,“উনি?”

    দীপ্তি হাসি মুখে বললো,“আমার আপু।”

    তৃষ্ণা অবাক চোখে তাকালো আমার দিকে। এগিয়ে এলো এদিকে। ততক্ষণে আমি ও আরহান দাঁড়িয়ে গিয়েছি।

    দীপ্তি হেসে তৃষ্ণাকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। আমাদের সবার মুখেই “হ্যাঁ”, “হুঁ” ছাড়া কিছুই নেই।

    কিছুক্ষণ বাদে দীপ্তি তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে “আমি মাকে বলে আসি, তুই এসেছিস” বলে চলে গেলো।

    আরহান হালকা হেসে বললেন,“আই হোপ, পার্সোনাল প্রবলেম এখানে আসবে না।”

    তৃষ্ণা মৃদু কন্ঠে “হুঁ” বলে সহমত প্রকাশ করলো।

    তৃষ্ণা আরহানের পাশের সোফায় বসে পড়লো। একনজর আমাকে দেখে ফোনে মনোযোগী হলো। এই নজরে হয়তো কিছু চাওয়া ছিলো কিংবা ছিলো না পাওয়া।

    আরহানও আমার সামনের পুনরায় ফোনে মুখ গুঁজে সোফায় বসলেন। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

    মিনিট বাদে মা এলো। এসেই তৃষ্ণার কাছে গিয়ে বললো,“বাবাই, এসেছিস?”

    তৃষ্ণা ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো,“হুঁ…”

    মা এগিয়ে গিয়ে আমার হাত ধরে তৃষ্ণার সামনে নিয়ে দাঁড় করালো। মুখ ভরা হাসি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে তৃষ্ণাকে বললো,“আমার বীনু।”

    তৃষ্ণা মাথা তুলে তাকালো। চোখাচোখি হয়ে গেলো আমাদের। অতঃপর দুজনেই চোখ সরিয়ে নিলাম। তৃষ্ণা মৃদু হাসলো। অনুভূতিহীন হাসি ছিলো এটা।

    ________________

    রাতের খাওয়া শেষে আমাকে নিয়ে দীপ্তি রুমে এলো। এখানে ভালো লাগছে না। কেমন যেনো হাঁসফাঁস লাগছে। হয়তো তৃষ্ণার জন্যেই এমনটা। আমি ভালোবাসা না পাবার যন্ত্রণা বুঝি। আমি ছোটবেলা থেকে পরিবারের ভালোবাসা পাইনি। তাই আমি কখনোই তৃষ্ণার ভালোবাসাকে অসম্মান করতে পারিনা। ইন ফ্যাক্ট করিও না। তবে চোখের সামনে কাউকে এক তরফা ভালোবাসা যন্ত্রণা পেতে দেখলে অস্থির লাগে ভীষণ। যেমনটা এখন লাগছে। সেই যে মায়ের সামনে একবার চোখ তুলে তাকিয়েছিলো, এরপর থেকে আর তাকায়নি। হয়তো মায়া বাড়ানোর প্রচেষ্টা করেনি।

    আমাকে গভীর ভাবনায় ডুবে থাকতে দেখে দীপ্তি মিষ্টি হেসে বললো,“উফফ! বীনুপু! তোমাকে যে কী বলবো! কতো হ্যাপি আমি।”

    “কেনো, কী হয়েছে?”

    “কী হয়েছে মানে? আমার বোনকে পেয়েছি আমি, হ্যাপি হবো না?”

    “ওহ্, আচ্ছা!”

    “হুঁ, তার উপর এতো মিষ্টি আর ভালো একটা বোন। আহা!” —বলেই দীপ্তি আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

    আমিও মিষ্টি হেসে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। মিনিট দশেক পর দীপ্তি বললো, “ছাদে যাবে?”

    আমি একটু ভাবুক ভঙ্গিতে বললাম, “উম… যাওয়া যায়।”

    দুজনেই হেসে দিলাম একসাথে। এরপর ছাদের উদ্দেশ্যে এলাম। প্রথম সিঁড়িতে পা রাখতেই দীপ্তি বললো,“আপু! তুমি যাও, আমি ফোন রেখে এসেছি। নিয়ে আসি।”

    “আচ্ছা।”

    এরপর একাকী ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। শেষ সিঁড়িতে উঠতেই আমি কারো কথা বলার আওয়াজ পেয়ে গেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি আরহান আর তৃষ্ণা রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি দুজনেরই ঐ দূর আকাশে নিবদ্ধ।

    তৃষ্ণা গম্ভীর কণ্ঠে বললো,“আমার পছন্দের সব কিছুই কেনো তোর হয়?”

    “তুই ভুল বলছিস। তোর পছন্দের সব আমার হয়না। আমার সবকিছুই তোর পছন্দ হয়ে যায়।”

    তৃষ্ণা বাঁকা হেসে বললো,“তুই ছিনিয়ে নিস।”

    আরহানও তৃষ্ণার হাসির প্রেক্ষিতে হেসে বললেন,“তোর ভাগ্যে নেই।”

    চলবে…

  • কাঠগোলাপ এবং সে

    কাঠগোলাপ এবং সে

    জীবনে তিক্ততা থাকাটা কি খুব বেশি প্রয়োজন? তিক্ততা না থাকলে এমন কি ক্ষতি হতো?শান্তিপূর্ণ জীবনটা কী এতোটা অমূল্য যে আমার জীবনে ধরা দেয় না?কোনো অপরাধ না করেও আজ অপরাধীর তালিকায় উর্ধ্বে। কেউ হয়তো জানে না তবে আমি জানি ওই এক্সিডেন্টটা আমার জন্য হয়েছে। আমি দায়ী সব কিছুর জন্য।
    আজ আমার জন্য কোনো মায়ের কোল খালি।সেটা আমি কি করে মেনে নিব?আমার জন্য কোনো বাবা তার একমাত্র সন্তান কে হারিয়েছে।এই তিক্তাপূর্ণ সত্য আমি কি করে মেনে নিব?আমার জন্য শুধু মাত্র আমার জন্য কোনো বাবা-মা তাদের সন্তানকে আদর করতে পারছে না,ভালোবাসে কাছে টানতে পারছে না,ছুঁতে পারে না, বাবা-মা ডাক শুনতে পারে না।আমার জন্য।
    নাহ!আমি আর নিতে পারছি না এই তিক্তময় জীবন।আমারও একটু খানি শান্তি প্রয়োজন। খুব।আমারও একটু শান্তিময় তন্দ্রা অবশ্যক।যে তন্দ্রায় আজ নিদ্রিত ইহান।


    তখন আমি সবে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি। কলেজে ভর্তির এক মাস আগেই আমার বড় আপু মুগ্ধতা পালিয়ে যায় কারও সাথে। যার দরুন বাবা আমাকে তার মাথার দিব্যি দিয়ে বলেছিলো যেনো কোনো ছেলের সাথে একটা টু শব্দও না কি। ইহান ছেলেটা প্রাণও দিয়ে দিলো আমার জন্য। আর আমি পাথর হয়ে রইলাম।
    কলেজটা আমার বাসা থেকে বেশ দূরেই ছিলো। আর এই দূরত্বটাই যেন কাল হয়ে দাড়িয়ে ছিলো আমার জীবনে।
    রোজ কলেজে যাওয়া আর কলেজ থেকে বাড়ি ফেরাই ছিলো আমার নিত্য দিনের কর্ম। এই নিত্য দিনের কাজেরই বাধা হয়ে দাড়ায় ইহান।
    ছেলেটা আমার দুই বছরের সিনিয়র ছিলো। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। আমাদের কলেজের পাশের ভার্সিটিতেই পড়তেন। দেখতেও বেশ সুদর্শন। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুল, চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, সর্বদা চেক শার্টে দেখা যেতো তাকে। হঠাৎ একদিন ইহান হূট করে আমার পথ আটকে দাড়ায়। মুচকি হাসি উপহার দিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,
    “নাম কি তোমার?”
    প্রশ্নটা সে স্বাভাবিক ভাবে করলেও আমি স্বাভাবিক থাকতে পারিনি। প্রচন্ড রেগেমেগে তার মুখের উপর জবাব দিয়ে দেই,
    “আমার নাম যাতা আপনাকে কেনো বলব?কে আপনি? প্রেসিডেন্ট নাকি যে নাম বলা লাগবে? লজ্জা করে না রাস্তা ঘাটে মেয়েদের নাম জিজ্ঞেস করে বেরান?……..”
    এরকম নানা কথা আমি তাকে শুনিয়ে যাচ্ছিলাম।
    যেনো অটো হয়ে গেছি। থামার কোনো নাম নিচ্ছি না। আমার বান্ধবীরা আমাকে বার বার থামানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। অতঃপর আমার কথার প্রতিক্রিয়ায় ছেলেটা কিছু বললো না। চলে গেলো। আর আমি তখনও বকবক করেই যাচ্ছি।
    এর মধ্যে বেশ অনেক দিন কেটে গেলো ছেলেটাকে আর দেখিনি। এ কদিনে আমি খুব অনুতপ্ত হলাম । খুব অস্বস্তি কাজ করতে লাগলো। সে তো নামই জিজ্ঞেস করেছে আর আমি এত গুলো কথা শুনিয়ে দিলাম। কাজ টা ঠিক করিনি। আবার এটাও মনে হতো যা করেছি ঠিক করেছি না হয় আরও বেঁকে বসতো।
    সেদিনটা ছিলো মেঘাচ্ছন্ন। কিয়ৎ অন্তর অন্তর কেঁপে উঠছে অম্বর। বাস স্টপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। হঠাৎ দূর থেকেই দেখা মিললো ইহানের। তার হাতে কৃষ্ণচূড়া। খুব দ্রুত রাস্তা পার হচ্ছে। হঠাৎ দেখলাম একটি গাড়ি খুব দ্রুত তার দিকে তেড়ে আসছে। আমার ভিতরটা ধক করে উঠল আজানা এক আতঙ্কে। গাড়িটা খুব দ্রুত গতিতে তার দিকে আসছে আমি পাথরের ন্যায় জমে গেছি। আচমকা গাড়িটা তার খুব কাছে চলে আসে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। গাড়িটা তার উপর চরার আগেই সে খুব সাবধানে সরে দাঁড়ায়। আমার দেহে যেনো প্রান ফিরে আসে। ইহান আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমাকে কতক্ষণ ধরে ডাকছে আমি জানি না। শেষে বাধ্য হয়ে সে আমার বাহুতে মৃদু ধাক্কা দেয়। আমি হুঁশে ফিরে আসি।
    “আর ইউ দেয়ার? আমি অনেকক্ষন ধরে ডাকছি তোমায়। তোমার বাস এসে গেছে।
    তার সরল উক্তি। কন্ঠে যেনো আলাদাই মাধুর্যতা রয়েছে। তার কথাতেই যে কেউ বলে দিতে পারবে ছেলেটা অতন্ত্য সরল-সহজ।
    আমি ইহানের দিকে একপলক তাকিয়ে বাসে চেপে বসি। ইহান পেছন থেকে ডেকেছে। হয়তো কিছু বলার জন্য। আমি সে সুযোগ না দিয়েই চলে আসি। সে জানালা দিয়ে কয়েকবার কৃষ্ণচূড়া ফুল এগিয়ে দিয়েছে। আমি নেই নি। সে বার বার বলছে “এত দিন পরিক্ষা চাপে আসতে পারিনি।রাগ করেছো সে কারনে?” বাস ছেড়ে দিয়েছে আর ইহানও অনেকক্ষণ আমার জানালার পাশে দৌড়ে এসেছে। ইহান দৌড়েও বাসটা ধরতে পারেনি। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে রাস্তায় হাঁটু গেরে বসে পরে।


    ইহান হয়তো কোনো ভাবে জেনেছে আমার ফুল খুব প্রিয়। তাই সেদিনের পর থেকেই ইহান রোজ আমার জন্য গোলাপ, বেলি, ক্যালেন্ডুলা, জুঁইফুল সব ধরনের ফুল নিয়ে আসতো। যা আমি কখনো চোখে দেখিনি সে ফুলও এনেছে। আমি প্রতিবারই তা ফিরিয়ে দেই। হয় তাকে অপমান করে নয় তাকে এরিয়ে।
    সেদিনও আকাশ মেঘলা ছিলো। মেঘের গর্জনে কেপে উঠছে অম্বর। রাস্তা ঘাটে তেমন লোকজনও নেই। একা একা বাস স্টপে দাঁড়িয়ে আছি প্রায় আধাঘন্টা হবে।আজ বাসটাও আসতে খুব বেশি দেরি করছে। হঠাৎ দেখি ইহান আমার সামনে এসে এক গুচ্ছ কাঠগোলাপ নিয়ে হাজির। ছেলেটা এটাও জেনে গেছে আমার কাঠগোলাপ খুব পছন্দ।
    ইহান কাঠগোলাপ গুলো আমার সামনে তুলো বলতে শুরু করে,
    “অনেক দিন ধরে চেষ্টা করছি তোমাকে ভালোবাসি বলার জন্য কিন্তু প্রতিবারই আমি ব্যর্থ। তবে আজ তোমাকে শুনতে হবে উত্তর যাই হোক। আমার ভালোবাসা গ্রহন করে নেও। তোমার প্রিয় কাঠগোলাপকে সাক্ষী রেখে কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী করে রাখব।”
    এক নিশ্বাসে কথা গুলো বলে দম নেয় ইহান। আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাঁটা ধরলাম সামনে। ইহান আমার পিছু পিছু আসছে আর নানা কথা বলে আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। আমার বিন্দু মাত্র ইচ্ছা নেই এই নির্লজ্জ ছেলের সাথে কথা বলার। এত এত অপমান করি তাও চলে আসে পিছু পিছু।
    সে আমার পিছু ছাড়ছে না আমি বাধ্য হয়ে থেমে যাই। তার মুখোমুখি দাড়াই।
    “সমস্যা কি আপনার বার বার কেনো আমার পিছু নিচ্ছেন? আপনি কি অবুঝ? আমার আপনার প্রতি কেনো আগ্রহ নেই। তাও বেহায়ার মত চলে আসেন আমার পিছু পিছু। নির্লজ্জ ছেলে কোথাকার।”
    আমি বেশ তেজ দেখিয়ে কথা গুলো বলি। খানিকটা চিৎকারও করে ফেলি যার দরুন আশে পাশে পথ যাত্রী আমাদের দিকে লক্ষ্য করছে। ইহান আমার কথার তোয়াক্কা করে বলে,
    “তোমাকে ভালোবাসে যদি বেহায়া হওয়ার প্রয়োজন হয় তবে আমি তাতেই আনন্দিত। স্নিগ্ধা প্লিজ বিশ্বাস করো আমি তোমাকে সত্যি খুব ভালোবাসি। তোমার জন্য নিজের জীবনটাও কোরবান করতে দু’বার ভাব না।”
    ইহানের কম্পিত কন্ঠস্বর। তবে তাতে আমার পাথর হৃদয় একটুও নরম হয়নি। বরং তা কঠোর থেকে কঠিন পাথরে তৈরি হয়ে গেছে।
    “ঠিক আছে তাহলে জীবনই দিয়ে দিন তবু আমার পিছু ছাড়ুন প্লিজ।”
    দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলি। আমার গম্ভীর জবাব। ইহান তাও যেনো দম নিলো না। ফুটপাতের লোক জন আমাদের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে। আমার কাছেও খুব অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে।
    পেছন থেকে হঠাৎ কেউ আমার ডান বাহু চেপে ধরে। খানিক পিছন ফিরেই দেখি ইহান। সে আমার বাহু ধরে কম্পিত কন্ঠে মৃদু আর্তনাদে করে বলে,
    ” প্লিজ….
    ইহান আর কিছু বলতে পারে না তার আগেই আমার মাথায় রক্ত চেপে বসে। আমি ঝাড়া মেরে তার হাতটা আমার বাহু থেকে সরিয়ে নেই। আর নিজের শরীরের সর্ব শক্তি দিয়ে সজোরে তার বক্ষ বরাবর অপ্রস্তুতকর ধাক্কা দিয়ে দেই। ইহান মোটেও প্রস্তুত ছিলো না আমার এহেন কান্ডে।
    আমার ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে ইহান ছিটকে পরে মেইন রাস্তায়। ঠিক সেই সময় একটি বাস ইহান কে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। ছিটকে পরে ইহান।
    চোখের সামনে একটা জলজ্যান্ত ছেলেকে মেরে দিলাম আমি। ইহানকে ধাক্কা দেয়ার পূরো ঘটনাটা আমার মস্তিষ্ক বার বার চারন করছে। আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কি হলো এটা বুঝতো আমার কিছুক্ষণ সময় লাগলে। সম্পূর্ণ রাস্তায় র’ক্তে’র ছড়াছড়ি। ইহনের হাতের কাঠগোলাপটাও তার র’ক্তে মাখামাখি।


    বাসের সাথে ধাক্কা লাগার সাথে সাথে ইহান ছিটকে পরে রাস্তায়। কাঠগোলাপে পাপড়ি গুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাস্তায় পিশে গেছে।ইহানের চশমাটাও ভেঙ্গে চুরমার। আমি বরফের ন্যায় জমে গেছি। ইহান বাসের সাথে ধাক্কা লাগার সাথে সাথেই তার ক্ষত-বিক্ষত দেহটা গিয়ে পরে রডের উপরে। ইহানের এ’ক্সি’ডে’ন্ট হওয়া রাস্তায় কনস্ট্রাকশনের কাজ চলছিলো। সেখানে রডও ছিলো। আর ইহানের দেহটা সেই রডের উপরে ছিটকে পরে আর রড গুলো গেথে যায় ইহনের পিঠে।
    রড গুলো ইহানের পিঠে লেগে বক্ষস্থল ও পেটের অংশ ভেদ করে বেরিয়ে গেছে। মাথা ভর্তি ঝাকড়া চুলগুলো থেকে অনবরত র’ক্ত ঝরছে। সর্বাঙ্গে তার আচরে গেছো। মুখশ্রীর এক পাশ থেঁ’ত’লে গেছে প্রায়। ডান হাতের চামড়া মাংস থেকে আলদা হয়ে গেছে। যেনো কেউ ছুড়ি দিয়ে উপরে ফেলেছে। মোটা জিন্স প্যান্ট ছিঁড়ে আচরে গেছে পা দু’টো। মাথায় আঘাত লাগার দরুন মাথায় ফেটে রক্ত ঝরছে। ভয়ংকর দৃশ্য। ছেলেটা মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছ। আশে পাশে মানুষও ভীর করেছে বেশ। সম্পূর্ণ রাস্তায় র’ক্তে মাখামাখি। আচমকাই বৃষ্টির ফোটা পরতে শুরু করে। ভিজিয়ে দিচ্ছে ইহানের সর্বাঙ্গ। ধুয়ে মুছে যাচ্ছে ইহানের র’ক্তা’ক্ত শরীর। কাঠগোলাপের পাপড়িতে লেগে থাকা র’ক্ত গুলোও ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টি পানিতে। তার সাথে ধুয়ে মুছে যাচ্ছে আমার রঙ্গিন জীবন।
    শেষ পর্যন্ত ছেলেটা তার জীবন কোরবান করে দিলো। ভাবলাও না একটি বার। আমি আর চেয়ে থাকতে পারলাম না। এই নির্মম পরিনতি আমাকে যেনো পাথরে পরিনত করেছে। যেনো অতি শোকে পাথর হয়ে গেছি। জ্ঞান হারিয়ে পরে রইলাম রাস্তায়।
    অতঃপর কাঠগোলাপ এবং সে চিরতরে হারিয়ে গেলো আমার জীবন থেকে।
    মৃত্যু হলো আমার প্রিয় কাঠগোলাপের, মৃত্যু হলো সবচেয়ে অমূল্য অপ্রিয় অজানা কিছুর…………..


    [সত্য ঘটনা অবলম্বনে]

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৪)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৪)

    তেজহীন রোদ। চারিপাশে শীতল বাতাস বয়ে যাচ্ছে। তবুও ঘামছি আমি। শুধু ঘামছি বললে চলবে না। ঘেমে নেয় একাকার হয়ে যাচ্ছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এমনও হয়? যাকে পুরোটা জীবন মৃত বলে আখ্যায়িত করে এসেছি, সে আমার সামনে আজ জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছে। হুট করেই নিজেকে ভীষণ ভারী অনুভূত হলো। শরীরের ভার আমার পা জোড়া সইতে পারছে না। পা ভেঙ্গে আসছে। নিজের ভর রাখতে, আমি হাত এগিয়ে আরহানের বাহু খামচে ধরলাম। দৃষ্টি এখনও আমার সামনেই। আমার সামনের মানুষটা যেমন আমাকে দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছে। ঠিক তেমনই আমি অনুভূতি শূন্য হয়ে পড়েছি।

    নিজেকে বিশ্বাস করতে না পেরে আমি আরহানের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি নিক্ষেপ করলাম। আরহান উপরনিচ মাথা দুলিয়ে আমাকে বোঝালেন, এটাই সত্যি।

    তৎক্ষণাৎ আমার মস্তিষ্কে সেদিনের ঘটনা চলে এলো, যেদিন আমি এই শহরের রাস্তায় মাকে দেখেছিলাম। তখন নিজের চোখের দেখাকে ভুল মনে করে, ভুলে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজ! পুনরায় আমি আবার আমার সামনে তাকালাম।

    অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললাম, “মা!”

    মুহূর্তেই আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দুই হাতে মুখ ঢেকে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কাঁদছি আমিও। তবে নিঃশব্দে।

    “মা! আপু এসেছে?”—প্রশ্নটি করেই দীপ্তি এগিয়ে এলো এদিকে।

    আমিও ততক্ষণে সামনে আরো একজনের উপস্থিতি টের পেলাম। সেদিকে তাকিয়ে আমি আরো বিস্মিত হলাম, যেমনটা দীপ্তি হয়েছে। চমকিত দীপ্তি চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলেছে।

    দীপ্তি আমার দিকে ইশারা করে মাকে প্রশ্ন করলো,“আপু?”

    মা অশ্রুসিক্ত নয়নে দীপ্তির পানে তাকিয়ে মুখে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,“হুঁ।”

    দীপ্তি আর অপেক্ষা করলোনা। তৎক্ষণাৎ দ্রুত বেগে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। দীপ্তিও কেঁদে দিয়েছে। যেমনটা আমি আর মা কাঁদছি। দীপ্তি কেঁদে কেঁদেই বলছে,“জানো বীনুপু? তোমার মতো একটা বোন চাইতাম আমি। আর তুমিই আমার বোন। আমার সত্যিকারের বোন!”

    একের পর এক চমকের দরুন আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি। বোন! আমার বোন!

    দীপ্তি আমাকে ছাড়তেই আমি আর দেরি না করে মায়ের কাছে গেলাম। শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম মা কে। এইতো আমার মা।

    কাঁদতে কাঁদতেই মাকে বললাম, “ক’কোথায় ছিলে মা? জানো ত’তোমাকে ছাড়া আমি ভালো ছিলাম না। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন ছিলো মা!”

    মা ও আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো,“আমাকে মাফ করে দে মা। আমি তোর কাছে অপরাধী।”

    ঘটনা আমার কাছে একদম ঘোলা। অনেকটা স্বপ্নের মতোই লাগছে। তবুও আমি এই স্বপ্ন থেকে বেরোতে চাচ্ছি না।

    আমাকে নিয়ে মা ভেতরে গেলো। আমি এখনও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছি। অপূর্ণতায় ঘেরা জীবনে, হুট করেই অনেক কিছু পেয়ে গেলে যেমনটা লাগে। তেমনটাই লাগছে।

    বাড়িতে ঢুকে ড্রইং রুমের সোফায় আমাকে নিয়ে মা বসলো। আমি মাকে ছাড়িনি। জড়িয়ে ধরেই আছি। যেনো ছেড়ে দিলেই মা হারিয়ে যাবে।

    আমার এই অবস্থা দেখে মা ঠোঁট চেপে কেঁদে যাচ্ছে। আরহান আমার এই কান্না আর সহ্য করতে না পেরে বললেন,“কেউ চলে যায়নি, হারিয়ে ফেলোনি কিছু, যার জন্য এভাবে কাঁদছো। পেয়েছো তুমি। খুশি হও না রে!”

    আমি কান্না থামানোর চেষ্টা করছি। তবুও পারছি না। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, “কোথায় ছিলে মা? আমাকে কেনো একা রেখে গিয়েছিলে!”

    হুট করেই মায়ের কান্না থেমে গেলো। মা ভয় পাচ্ছে। আমার এই প্রশ্নেরই তো ভয় পেয়েছে এই কয়দিন। মায়ের কাছে আমার কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই। মাথা নিচু করে চুপ হয়ে আছে।

    মাকে চুপ থাকতে দেখে আমি আরহানের দিকে তাকালাম। আরহান একবার মাকে দেখে পুনরায় আমার পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে পুরো ঘটনা বলা শুরু করলেন। আমি হতভম্ব হয়ে শুনে যাচ্ছি।

    আরহানের কথা বলা শেষ হতেই দীপ্তি বলা শুরু করলো,“আমি বুঝতেই পারিনি, ভার্সিটির বড় আপু, যাকে নিজের আপুর মতোই ভাবতাম, সে আমারই আপু।”

    সবাই সবার কথা ব্যক্ত করছে। আমি এখনও চুপ হয়ে আছি। কান্না থেমে গিয়েছে অনেকক্ষণ আগে। মাকেও ছেড়েছি বেশ খানিকক্ষণ আগেই। আমার নিস্তব্ধতা দেখে সবার মনে ভয় ছেঁয়ে গেলো। তারাও চুপ হয়ে গেলেন। স্থির দৃষ্টিতে আমার সামনের এই তিনজন আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার চাহনি ফ্লোরে। মাথা নিচু করে বসে আছি।

    অনেকক্ষণ বাদে হালকা কন্ঠে বলে উঠলাম,“আমাকে চাইলেই তো খুঁজে পেতে! তোমার সাথে যা হয়েছে, এতে আমার কী দোষ ছিলো মা?”

    মা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। আমার এমন প্রশ্নের জন্য একদম অপ্রস্তুত ছিলো সে। নিজেকে এক্সপ্লেইন করার বিন্দুমাত্র প্রচেষ্টা করলো না। তবে অনুতপ্ত সে। ভীষণ অনুতপ্ত।

    অস্থির কন্ঠে বলে উঠলো,“আমি বুঝিনি বীনু। আমাকে মাফ করে দে মা।”

    আমি মায়ের দিকে তাকালাম। কাঁদছি না আমি। তবে চোখ ছলছল করছে। আমি মাকে দোষ দিতে পারবো না। তার কোনো দোষ নেই এতে। হয়তো মায়ের জায়গায় থাকলে আমিও এসব ভেবে নিতাম। হয়তো আমিও এমনটাই করতাম।

    ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললাম,“আমি আর কোনো প্রশ্ন করবো না তোমাকে। তোমাকে পেয়েছি আমি, এই অনেক আমার জন্য। এখন অতীতের হিসেব কষতে গেলে আমার বর্তমান নষ্ট হবে।”

    _______________

    বিকালের দিকে চারজন মিলে রওনা হলাম বাবার বাড়ির উদ্দেশ্যে। অপরাধীর অপরাধ একদিন না একদিন প্রকাশ্যে আসে। আর সে তার ন্যায্য শাস্তি পাবেই।

    আজ দুপুরে মা নিজ হাতে খাইয়ে দিয়েছে। সবকিছু সুখময় লাগছে। আমার মতো, আমার মা আর আমার বোনও ভীষণ খুশি আমাকে পেয়ে। তবে জানিনা এই খুশির মেয়াদকাল কতক্ষন।

    গাড়ি দ্রুত গতিতে চলছে। আরহান ড্রাইভ করছেন। আর আমি উনার পাশের সিটে বসে আছি। ঘাড় ঘুরিয়ে আরহানের দিকে তাকালাম। উনি উনার সব কথা রেখে যাচ্ছেন। বিনা প্রত্যাশায়।

    আরহান দৃষ্টি সামনে রেখেই আমাকে বললেন,“আমার ফোন থেকে রুদ্রের নম্বরে কল দাও।”

    উনার ফোন আমার কাছেই ছিলো। কল লাগাতেই আরহান বললেন,“স্পিকারে দাও।”

    আমি দিলাম। ওপাশ থেকে রুদ্র কল রিসিভ করতেই আরহান বললেন,“কতদূর আছো?”

    “স্যার! এই তো রাস্তায় আছি। আধা ঘন্টা লাগবে।”

    “ওকে।”

    কল রেখে দিলাম। পেছনে দীপ্তি আর মা বসে আছে। দীপ্তি বিভিন্ন কথা বলেই যাচ্ছে। ছোট থেকে ওর সব ঘটনা, আমার সাথে ওর দেখা হাওয়া, ওর যেনো খুশিতে নাচতে ইচ্ছা করছে।

    মিনিট বিশেক বাদে বাড়িতে চলে এলাম। মা আমাদের পেছনে আছেন। কলিং বেল বাজানোর দুই মিনিট পর ছোট মা দরজা খুললো। দরজার এপাশে আমাকে দেখেই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে ফেললো। আমার দিকে তার দৃষ্টি স্থির ছিলো সেকেন্ড পাঁচেক। অতঃপর আমার ডানে, আরহানকে দেখে তৎক্ষণাৎ ভয়ে ঘামা শুরু করলো। এমন নাজেহাল অবস্থার মানে আমার অজানা। যদি মাকে দেখে এমনটা হতো, তবে মেনে নেওয়া যেতো। কিন্তু মাকে তো দেখেনি।

    কিছুক্ষণ বাদে মা সামনে এলো। আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে যখন ছোটমার দিকে তাকালাম তখন দেখি, ছোটমার চোখ ছানাবড়া। ভয়ে জমে গেছে। কথা বন্ধ হয়ে গেছে। ছোটমা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করলো। তার অবাক মুখশ্রীতে ভয়ের ছাপ দৃশ্যমান। মুখে অস্পষ্ট বুলিতে “ভুত!” কথাটি লেগেই আছে।

    ছোটমায়ের সাথে সাথে আমরাও ঢুকলাম ভেতরে। ছোটমা উচ্চ কণ্ঠে বারবার ডাকছে, “ব’বাসেদ! বাসেদ! ক’কোথায় তুমি?”

    একবার পেছনে আমাদের এগিয়ে আসতে দেখে আবারও ডাকা শুরু করলো, “মীরা! বাঁচা আমাকে। মীরা!”

    বাবা বাইরে বেরিয়ে এলেন। আজ অফিসে যাননি। ছুটির দিন তো! বাইরে এমন হট্টগোল শুনে বললেন, “কী ব্যাপার! কী হয়েছে এখানে?”

    বাবা দেখেনি আমাকে কিংবা মাকে। দৃষ্টি সামনে এগিয়ে দিতেই যখন মায়ের সাথে বাবার চোখাচোখি হয়ে যায়, আঠারো বছর পর! বাবা চোখের চশমা খুলে আবারো পরে নিয়ে অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললেন, “শ’শেফালী!”

    ছোটমা দ্রুত পায়ে বাবার দিকে অগ্রসর হলো। ভীত কণ্ঠে বললো,“কিছু বলছো না কেনো? ভয় করছে আমার।”

    ছোটমায়ের এমন ব্যবহার আমার কাছে পাগলামো ঠেকছে না। দীর্ঘকাল কাউকে মৃত বলে জেনে আসার পর, যদি সে আপনার সামনে জীবন্ত দাঁড়িয়ে থাকে, ব্যাপারটা যে কারো কাছে অবিশ্বাস্য লাগবেই।

    বাবা এখনও চুপ। তবে তার চশমার ভেতর দিকে অশ্রুসজল নয়ন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এদিকে মা ও আবেগ প্রবন হয়ে গেছে। হাজার হোক! কোনো এক সময় দুজন মানুষ একে অপরকে পাগলের মতো ভালবেসেছিলো তো!

    তখন সেখানে আগমন ঘটলো রুদ্রের। সাথে আছে পুলিশ। দুজন মহিলা কনস্টেবল এগিয়ে গিয়ে ছোটমায়ের কাছে যায়। একজন ছোট মায়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিলেন। ছোট মা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে। এক প্রকার চিৎকার করছে। উপস্থিত যেসব মানুষ অতীত সম্পর্কে অজ্ঞাত, তাদের সবার মনেই বিভিন্ন প্রশ্নেরা উঁকি দিচ্ছে।

    তখন মীরা আপুও এলো। বাইরে আমাদের সবাইকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেলো আপু।

    মীরা আপুকে দেখে ছোটমা আতঙ্কিত কন্ঠে বলল, “কী হচ্ছে দেখ! বাঁচা না!”

    মীরা আপু এগিয়ে এলো। ছোটমাকে ছাড়াতে চাইলো। কিন্তু পারছে না।

    ছোট মা, “এসব কী হচ্ছে?’’ জানতে চাইলে আরহান বাঁকা হাসেন। রুদ্র ফটাফট উত্তর দেয়,“স্বর্গের টিকিট কেটে দেওয়া হয়েছে। আরামসে যান।”

    চলবে…

  • সালমা বেগমের খেলনা পুতুলগুলো

    সালমা বেগমের খেলনা পুতুলগুলো

    ( এই গল্পটি ২০ আগস্ট ২০২০- এ পোস্ট করা হয়েছিল।)
    কী আশ্চর্য!
    সালমা বেগমের কান্না দেখে জহীর সাহেবের একটুও খারাপ লাগছে না। বরং এক ধরনের সুখানুভূতি হচ্ছে।
    এটাই কি স্যাডিজম? ধর্ষকামীতা? একজনকে কষ্ট দিয়ে বা একজনের কষ্ট দেখে আনন্দ পাওয়া!
    এটাও তো এক ধরনের মানসিক বিকৃতি।
    জহীর সাহেব মনে করার চেষ্টা করলেন, কবে সালমা বেগম শেষ বারের মতো কেঁদেছে।
    যতোদূর মনে পড়ে, সর্বশেষ কেঁদেছিল ছোট মেয়ের বিয়ের দিন।
    কান্নাটা এতোই তীব্র ছিলো যে, জহীর সাহেব সালমা বেগমকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিস ফিস করে বলেছিলেন, ‘ছিঃ, এমন করে কাঁদছো, লোকে কী বলবে? ভাববে মেয়েকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছো… জামাই পছন্দ হয়নি।‘
    তাও তো সেটা প্রায় ছ’ বছর হয়ে গেল।
    ছোট মেয়ে জামাই সহ অস্ট্রেলিয়াতে যেদিন চলে গেল, সেদিন মন খারাপ করেছিলো সারাদিনই।
    চোখ ছল ছল করেছিলো। আঁচলে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদেওছিল। কিন্তু হাউমাউ করে কান্না আর কাঁদেনি।
    এই সাত বছরের মধ্যে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু কান্নাটা চোখে পড়েনি।
    আজ রীতিমতো বিছানায় উবু হয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদছে সালমা বেগম।
    তাঁর ছাই রঙের চুল পিঠের ওপর দিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কোমর পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। জহীর সাহেব খুব ধীরে ধীরে স্ত্রীর পাশে বসলেন। মৃদু ভাবে পিঠের ওপর ছড়িয়ে থাকা চুলের ওপর হাত বুলাতে লাগলেন। কান্নার দমকে সালমা বেগমের সমস্ত শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
    কতোদিন এতো মৃদুভাবে, এতো আদর করে স্ত্রীকে স্পর্শ করেননি। আগের মতো ঝগড়া বিবাদ, মান-অভিমান আর নেই।
    জহীর সাহেবের ছেষট্টি, সালমা বেগমের ষাট।
    আর সাতদিন পরেই সালমার জন্মদিন।
    এই দিনটা জহীর সাহেবই সব সময় মনে করেন।
    কোথা থেকে বেলিফুলের মালা জোগাড় করেন, তারপর সালমার হাতে দিতে দিতে হাসি হাসি মুখে বলেন, ‘ভরা বাদর মাহ ভাদর…’।
    সব কিছু খ্রিষ্টাব্দে গণনা করলেও সালমার জন্ম দিন পাঁচ ভাদ্র বঙ্গাব্দেই করেন।
    সালমা ‘কী যে করো না এই বুড়ো বয়সে’ বললেও মনে মনে খুশির জোয়ারে ভাসতে থাকে। প্রতিদানে সালমা বেগমও এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক করে একটা চুমুও দিয়ে দেন জহীরকে।
    সালমা বেগম কট্টর না হলেও বেশ রক্ষণশীল।
    আগেও নামায রোযা সহ ধর্মীয় সব আচার অনুষ্ঠানই পালন করতো। কিন্তু, যতো বয়স বেড়েছে, ততোই যেন পরিবর্তিত হয়েছে সালমা বেগম।
    একদিন তো হিজাব আর বুরকা দেখে জহীর সাহেব অবাক। এতোটাই অবাক হয়েছেন, যে নীরব প্রশ্ন ভরা চোখে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন।
    সালমা বুঝতে পেরে হাসতে হাসতে বললো, ‘কী করবো বলো, পুরুষ মানুষ যতোদিন মানুষ না হচ্ছে ততোদিন এই ব্যবস্থা…’।
    জহীর বললো, ‘তুমি বুরকা হিজাব পড়বে…!’
    অবশ্য তিনি আপত্তিও করেননি।
    একবার সালমা অসুস্থ হয়ে পড়লে ডাক্তার পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিলো, ‘পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ছেন, ঠিক আছে। কিন্তু রাত জেগে বেতের তাহাজ্জুদ পড়ার দরকার নাই। এই ইবাদত হাইপারটেনশনের রুগীর জন্য নয়…।‘
    কিন্তু, গভীর রাতে নামায পড়া সালমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। ধীরে ধীরে পরিবর্তনটা বেশ মোটা দাগেই চোখে পড়তে শুরু করলো।
    জহিরের বন্ধুরা এলে আগের মতো আর সপ্রতিভভাবে সালমা সামনে আসে না। চা-নাস্তা তৈরি করে ভেতর থেকে ডাক দেয়, ‘একটু শুনে যাও…’।
    জহির বন্ধুদের কাছ থেকে উঠে আসে। জহীরকে অবাক করে দিয়ে সালমা বলে, ‘চা হয়ে গেছে। নিয়ে যাও।‘
    জহির খানিকক্ষণ সালমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কেন, তুমি যাবে না? আসো, কথা বলো…ওরা সব আমার অফিস কলিগ…’
    -না, আমার ভালো লাগছে না।‘ বলে শাড়ির আঁচল উড়িয়ে চলে যায় সালমা।
    জহির বেশ বুঝতে পারছে সালমা ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে।
    শুধু যে চিন্তাভাবনায়, তা নয়, আবেগের দিক থেকেও অনেকটাই রক্ষণশীল সালমা। নিজে নিজেই হেসে ওঠেন জহীর। আবেগ আবার রক্ষণশীল হয় কেমন করে?
    আবার নিজেই নিজেকে সমর্থন জানান বেশ জোরালো ভাবে। হয়, হয়! আবেগও রক্ষণশীল হয়।
    তা না হলে ত্রিশ বছর ধরে মেয়েদের স্মৃতি ধরে রেখেছেন যে ভাবে, সেটা খুব অনুভূতিপ্রবণ রক্ষণশীল মানুষ ছাড়া আর কারো পক্ষে সম্ভব নয়।
    সেই ছোট বেলায় যূথী আর বীথি, দুই মেয়ের জন্য যতো পুতুল কিনেছিলেন, তার অনেকগুলোই এখনো সংরক্ষণ করছে গভীর আবেগে।
    যূথী আর বীথি পিঠোপিঠি দুই বোন, সালমা বেগমের দুই কন্যা।
    সালমার এক ডাক্তার খালাম্মা বলেছিলেন, ‘বাচ্চা নিলে দেরী করিস না। আর নিলে প্রথমটার তিন-চার বছর পরে দ্বিতীয়টাও নিস। ছোট থাকা অবস্থায় দুটোই মানুষ হয়ে যাবে একসাথে। আর বাচ্চা দুটোও সঙ্গী পাবে।‘
    সত্যি সত্যি তাই হয়েছে। ওদের লালন পালন করতে সুবিধাই হয়েছে।
    বড়টার জামা ছোটটার ওপর চালিয়ে দিয়েছে।
    দুই মেয়ের কাঁথা কাপড় একসাথে ধোয়া হয়ে গেছে।
    একজনের জন্য খেলনা কিনে এনে যূথীকে বলেছে, ‘তুমি তো বড়। ও দেখো কতো ছোট। কথা বলতে শিখলেই তোমাকে আপু বলবে। আপুরা ছোটদের নিজের জিনিস দিয়ে দেয়…।‘
    সাড়ে তিন বছরের যূথী নিজেকে বড় ভেবে খুব খুশী হতো। সদ্যোজাত ছোট বোনটাকে ওর সব কিছুই দিতে চাইতো।
    পরে অবশ্য দুই বোন আরেকটু বড় হয়ে গেলে এই সুবিধাটা পাওয়া যেতো না।
    বীথি নুতন পুরাতনের পার্থক্য বুঝে গিয়েছিলো। যূথীও নিজের ভোগ্য জিনিসের মায়া সহজে ছাড়তে চাইতো না।
    তখন, কোনো কিছু কিনতে গেলে একসাথে দুজনের জন্যই কিনতে হয়েছে।
    সেই চাবি দেওয়া নাচুনে রাজকন্যা, টেডি বিয়ার, ডলফিন, এমনকি বান্দরবানে বেড়াতে গিয়ে এক মার্মা শিল্পীর তৈরী কাঠের ‘উপজাতীয় রমণী’ দুটা কিনতে হয়েছিলো। ছিলো একটা। শেষ পর্যন্ত অর্ডার দিয়ে, বান্দরবানে আরো তিনদিন অবস্থান বাড়িয়ে আরেকটা কাঠের ওপর খোদাই করা পিঠে ঝুড়ি বাঁধা স্বাস্থ্যবতী ‘উপজাতীয় রমনী’ নিয়ে আসতে হয়েছিলো।
    সেই মেয়েরা এখন নেই। একজন স্বামীর সাথে কানাডায়, আরেকজন অস্ট্রেলিয়ায়।
    কিন্তু, তাদের খেলনা পুতুলগুলো সালমা পরম যত্নে রেখে দিয়েছে।
    দু’তিনদিন পর পর কাপড় দিয়ে মোছে। কী সব ‘ফার্নিচার ক্লিনার’ কিনে আনে। সে সব দিয়ে কাঠের পুতুলগুলো মোছে। বেশ চক চক করে। বোঝা যায় না জিনিসগুলো এতো পুরনো!
    ছোট্ট বসার ঘরটাতে দুই মেয়ের ছোটবেলার খেলনা সামগ্রী সব সাজিয়ে রেখেছে। দুটো শোকেসে জায়গা হয়নি, তাই কিছু দেয়ালে, এমন কি দরজায় পর্যন্ত ঝুলিয়ে রেখেছে।
    মাঝে মাঝে জহীর সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেছে, ‘আরে, তুমি ঘরটাকে কী বানালে? পুতুলের মিউজিয়াম নাকি দোকান?‘
    সালমাও গলায় বেশ ঝাঁজ নিয়ে বলেছে, ‘কেন মিউজিয়াম কি খারাপ জিনিস? নিষিদ্ধ কিছু? আর যদি দোকান বলো, তো দোকানই…! তবে, টাকা দিয়ে এসব কেনার সামর্থ্য কারো হবে না। এসব বিক্রি হয় না। ’
    জহীর এ নিয়ে আর কথা বাড়ায়নি। সালমার মধ্যে একধরনের শিশুসুলভ সরলতা আছে যা তাকে মুগ্ধ করে।
    কিন্তু, আজ কী এমন হলো যে সালমা বেগম ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন?
    মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে নিজের মুখটাকে সালমার ডান কানে ছোঁয়ালেন জহীর সাহেব।
    এক সময় সালমাকে আদর করে মাঝের ‘ল’ বাদ দিয়ে ‘শামা’ বলে ডাকতো।
    ফিস ফিস করে সেই পুরনো স্বরে বললেন,‘শামা, লক্ষ্মীটি, কী হয়েছে বলবে? আমি কি কোনো ভাবে তোমাকে কষ্ট দিয়েছি…?’
    মতিন, জহীরের স্কুলবন্ধু, গতকাল হঠাৎ এসে হাজির। কার কাছ থেকে যেনো ঠিকানা জোগাড় করেছে।
    বহু বছর বাদে দুই বন্ধুর দেখা।
    প্রথমে তো মতিনকে চিনতেই পারেনি জহীর।
    মতিনের মাথা ভরা শুভ্র চুল, মুখ ভরা শুভ্র দাড়ি, পরনে পায়ের গোড়ালি ছোঁয়া জোব্বা।
    জহির বসার ঘর থেকেই ডেকে উঠলো, ‘সালমা, দেখে যাও, কে এসেছে…’।
    সালমা এলো না। কিন্তু দুই বন্ধুর গল্পে কোনো ভাঁটা পড়লো না। আলাপের এক পর্যায়ে মতিন বলে উঠলো, ‘আরে জহীর, এ তুই কী করেছিস?’
    -কেন? কী করেছি?’ জহীরের প্রশ্নে বিস্ময়।
    -আরে, সারা ঘরে মানুষ-পাখি-মাছের মূর্তি! এ ঘরে তো নামায হবে না রে…! তোর এখানে তো নামায পড়া যাবে না…’
    জহীর তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে মতিনের যুক্তি খণ্ডন করার চেষ্টা করলো। কিন্তু, মতীন কোরান ও হাদিস থেকে বিভিন্ন সূত্র উল্লেখ করতে থাকলো যে, একটু পরেই সে চুপ হয়ে গেল।
    অসহায়ের মতো স্কুল বন্ধুর কথা নি:শব্দে শুনে যেতে থাকলো, ‘এসব একেবারেই নাযায়েজ। হারাম। এ ঘরে তো ফেরেশতা আসবে না। আরে জহীর, তুই নামায পড়িস কেমন করে? তওবা করে এসব ফেলে দে… ‘ ।
    জহীর জানে, আমাদের দেশের মানুষের কথা বলার সময় মাত্রা জ্ঞান, স্থান-কাল-পাত্র বোধ থাকে না। তার বিশ্বাস থেকে অনর্গল কথা বলে যায়। এতে কেউ মানসিকভাবে আহত হচ্ছে কি না, তা বিবেচনায় রাখে না। সে যেটুকু জানে, সেটাই চূড়ান্ত, সেটাই শেষ জানা মনে করে। এর অন্য কোনো ব্যাখ্যা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যক্তি বিশেষের নির্দোষ আবেগ অনুভূতির কোনো কানা কড়ি মূল্যও ওদের কাছে নেই।
    কান্না ভেজা মুখটা সালমা তুললো।
    চোখের জলে সারা মুখে কাঁচা পাকা চুলগুলো লেপ্টে আছে।
    মতিনের কথাগুলোই কি অনেকদিন বাদে সালমাকে কাঁদালো?
    জহির স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে সালমার কান্নার কারণটা বোঝার চেষ্টা করছে।

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৩)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৩)

    দেখতে দেখতে আরো দুই সপ্তাহ কেটে গেলো। এই দুটো সপ্তাহ, আরহানের ভীষণ ব্যস্ততায় কেটেছে। আর আমার কেটেছে আরহানের খেয়ালে ডুবে। দিবারাত্রি উনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে। দিনগুলো কেমন করে যেনো এগোচ্ছে। খুবই দ্রুত।

    আর সাথে হাজারো অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছি। আরহান পাশে থাকলে আমার হৃদ পিন্ডের স্পন্দন গতি অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ঠিক তেমনই দূরে থাকলে নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হয়। তখন বুকের বা পাশের হৃদযন্ত্রের উপস্থিতি বোঝা দায় হয়ে যায়।

    হুট করেই কয়েক মাস আগের কথা মনে পড়লো। কতটা ভয় পেতাম উনাকে! আর এখন! এখনকার আরহানের কথা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে ভালো লাগার মিষ্টি এক হাসি চলে আসে।

    সকালের নিষ্প্রভ রোদ খোলা জানালা দিয়ে মুখে এসে লাগতেই চোখ ঘুরিয়ে ডান পাশে তাকালাম। আরহান আমার এক হাত নিজের বুকে জড়িয়ে শুয়ে আছেন। হাসলাম আমি। উনার বন্ধন থেকে হাত ছাড়িয়ে নিলাম। আরহান নড়েচড়ে উঠলেন। পুনরায় আবার ঘুমে মগ্ন হলেন। আরহানের চুলগুলো কপালে লেপ্টে আছে। হাত এগিয়ে উনার এলোমেলো চুলগুলো আরো খানিকটা অগোছালো করে দিলাম।

    আরহান চোখে বুজে অধর যুগল প্রসারিত করে মিষ্টি হেসে ঘুমু ঘুমু কন্ঠে বলে উঠলেন,“সুপ্রভাত শুকতারা।”

    “শুভ সকাল…”

    কিছুক্ষণ বাদে চোখ পিটপিট করে আমার দিকে তাকালেন। আমাকে এক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললেন, “কী ব্যাপার?”

    “কী! কিছুনা।”

    “কিছুনা তো?”

    “না।”

    “আচ্ছা তবে আবার ঘুমোও।”—বলেই আরহান পূর্ব ভঙ্গিতে আমার হাত জড়িয়ে চোখ বুজলেন। মুহূর্তেই ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলেন।

    আমি হাসছি। এই লোকটার ভালোবাসা সত্যিই আমার ভাগ্যে ছিলো!

    ______________________

    সকালের ব্রেক ফাস্ট শেষে রুমে ঢুকেই দেখি আরহান রেডি হয়ে আছেন এবং কারো সাথে ফোনে কথা বলছেন। না চেয়েও উনার কথা কানে এলো।

    আরহান বলছেন,“বলেছিলাম না! খুব শীঘ্রই দেখা হবে। সব প্রমাণ জোগাড় করা হয়ে গিয়েছে। আর স্বয়ং আপনিও আছেন এখন। সব অপেক্ষার অবসান হবে আজ”।

    আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। কথাটা বুঝে উঠতে পারিনি। আরহানকে প্রশ্ন করলাম, “কী হবে আজ?”

    আরহান পিছু ঘুরে দরজার কাছে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফোনের ওপাশের ব্যক্তিকে নম্র কণ্ঠে বললেন,“আমি একটু বাদেই ওকে নিয়ে আসছি। আপনি রেডি থাকুন।”

    উনি ফোন রাখলেন। আমি এগিয়ে গেলাম উনার দিকে। জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে বলুন তো! কোনো সমস্যা?”

    আরহান আমার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দী করে নিলেন। মৃদু কন্ঠে বললেন,“আজ তোমার লাইফে যেমন একটা খুশির খবর পাবে, তেমনই কষ্টেরও। ইউ হ্যাভ টু বি স্ট্রং শুকতারা।”

    “কী হবে আজ?”

    “গেলেই দেখতে পাবে। রেডি হয়ে নিচে এসো।”

    আরহান প্রস্থান করলেন। হাজার প্রশ্ন মনে নিয়ে আমিও রেডি হতে শুরু করলাম। আমি কষ্ট পাবো, এমন কোনো খবর আমাকে কেনো দেবেন উনি? যতদ্রুত সম্ভব রেডি হয়ে নিচে গেলাম।

    গেটের বাইরে আরহানের গাড়ি দেখে এগিয়ে গিয়ে উনার পাশে বসলাম। আমার বসার সাথে সাথেই আরহান গাড়ি স্টার্ট দিলেন।

    কিছুদূর অতিক্রম করার পর আমি আরহানকে বললাম,“আমার না টেনশন হচ্ছে। কী যে হবে! আপনি বলছেন ও না।”

    আরহান মৃদু হেসে বললেন,“যা হবে, ঠিকটাই হবে।”

    “বললে কী এমন হবে! যদি না বলারই ছিলো, তবে কেনো আমাকে বললেন, খারাপ খবর পাবো!”

    “খারাপ বললাম কখন?”

    “বলেননি?”

    “নাহ্!”

    “তবে কী বলেছেন?”

    “বলেছি, কষ্টের খবর।”

    বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো। হালকা আওয়াজে “ধুর!” বলেই জানালার বাইরে তাকালাম আমি। এই লোকটা ভীষণ অসভ্য! ওপাশে আরহান আমাকে দেখে মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছেন।

    হুট করেই আরহানের জরুরি কিছু মনে পড়ে গেলো, এমন ভাবে ব্রেক কষলেন। কিছু একটা খুঁজলেন। না পেয়ে রুদ্রকে কল লাগালেন। রুদ্র রিসিভ করতেই, আরহান ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বললেন,“ফাইলগুলো আমার কাবার্ড এ রেখে এসেছি। নিয়ে এসো।”

    ব্যাস! ওপাশে রুদ্রের কিছু বলার আগে যেমন নিজের কথা শুরু করেছিলেন। তেমনই নিজের কথা শেষ হতেই কল কেটে দিলেন।

    ঘন্টাখানেক পর গাড়ি একটা বাড়ির সামনে থামালেন আরহান। প্রথমে নিজে নেমে এরপর এপাশে দরজা খুলে হাত এগিয়ে দিলেন। মুখে উনার বরাবরের মতো মিষ্টি হাসি। তা দেখে আমিও হাসলাম। হাত এগিয়ে উনার হাতে রেখে নেমে এলাম।

    আমাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরের দিকে অগ্রসর হলেন।

    _______________________

    গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে নিশা রুম থেকে বেরোচ্ছে। এই বয়সী মেয়েদের মন বোঝা বড্ড কঠিন। এই কান্নায় ভেংগে পড়ে তো এই আহ্লাদে নাচতে শুরু করে দেয়।

    রুম থেকে বেরোতেই শক্ত কিছু একটার সাথে ধাক্কা লাগায় নিশা মনে মনে নিজেকে কতোগুলো গালি দিয়ে নেয়। ভেবেছে হয়তো সামনে দেয়াল। বেখেয়ালি ভাবে হাঁটতে গিয়ে এই অবস্থা। কিন্তু না! সামনে তাকাতেই নিশার হৃদপিন্ড থমকে যায়।

    রুদ্র কপাল কুঁচকে নিশার দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবছে,‘আমার ভাগ্যে তো নেই তুমি, তবে কেনো সামনে আসো? কেনো প্রতিবার মনের মাঝে ভালোবাসা নামক তুমি হয়ে আগমন ঘটাও?’

    কিন্তু এটা বলা সম্ভব নয় রুদ্রের পক্ষে। এক পলক নিজের মায়াবিনীকে দেখে নিলো। ভাগ্যে না’ই থাকলো, চোখের ক্যানভাসে না হয় থাকুক।

    নিশা রুদ্রের সামনে এলেই কেমন যেনো অসুস্থ অনুভব করে। এই অসুস্থতা, ও রুদ্রের অনুপস্থিতিতেও টের পায়। তখন নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারে না নিশা। প্রতিবারের মতো স্তম্ভিত হয়ে যায়। তবুও বর্তমান সময়ে এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকাটা বড্ড বেমানান লাগার দরুন, কিছু বলা নিশার জন্য আবশ্যক হয়ে গেলো।

    মিনমিনে কন্ঠে নিশা প্রশ্ন করলো,“কেমন আছেন?”

    রুদ্র স্থির চাহনি নিশার পানে আবদ্ধ করে গম্ভীর মুখশ্রীতে ভাবলেশহীনভাবে উত্তর দিলো,“ভালো।”

    ভদ্রতার খাতিরে যে পুনরায় তাকেও জিজ্ঞেস করতে হবে,‘তুমি কেমন আছো?’ এর মিনিমাম সেন্স রুদ্রের ছিলো না। নিঃশব্দে প্রস্থান ঘটালো।

    নিশা স্তব্ধ, বিমূঢ় হয়ে রুদ্রের যাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে ভীষন শকে আছে। নিশা বিস্মিত কন্ঠে আওড়ালো, “যাহ বাবা! রুদ্র ভাইয়া, সম্পূর্ণ আমার ভাইয়ার কোয়ালিটি সম্পন্ন হয়ে গেলো দেখছি। একেই বলে সঙ্গ দোষে লোহা ভাসে।”

    স্তব্ধ নিশাকে এক দৃষ্টিতে স্থির একদিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিশার মা নিজ রুম থেকে বেরোতে বেরোতে প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে? কী দেখছিস?”

    নিশা নড়ে চড়ে দাঁড়ালো। মেকি হাসি দিয়ে বললো, “কোথায়? কিছু না তো!”

    “কলেজে যাবি না? যা রেডি হয়ে নে।”

    “আচ্ছা আম্মু।”

    _______________________

    সকাল থেকে মিসেস শেফালী তার বাবাই এর নম্বরে একটার পর একটা কল দিয়েই যাচ্ছেন। ধরছে না ওপাশ থেকে। তেমন কোনো প্রয়োজনে কল দিচ্ছেন না, ছেলেটা কেমন আছে এই খোঁজটার জন্যই এত উতলা হওয়া।

    অষ্টম বার কল দিতেই ওপাশ থেকে তৃষ্ণা কল রিসিভ করলো। মাথা ভার তার। সারারাত কষ্ট লাঘব করতে নেশার সাগরে ডুবে ছিলো। ঘুমিয়েছে ভোরে। এটুকুতে ঘুম হয়নি। বারবার কানের কাছে ফোনের কর্কশ শব্দ হয়ে যাচ্ছে বলে রিসিভ করে কানে তুললো।

    ওপাশ থেকে মিসেস শেফালীর কাতর কণ্ঠস্বরে শুনতে পেলো,“বাবাই! কী হয়েছে তোর? কল ধরছিস না! সকাল থেকেই কল দিয়ে যাচ্ছি তো।”

    “ঘুমোচ্ছিলাম মামনি।”

    “খেয়েছিস সকালে?”

    “না। পরে খাবো।”

    “শোন, তোকে কিছু বলার ছিলো।”

    মিসেস শেফালী উত্তেজিত হয়ে আছেন। তৃষ্ণাকে বলেনি এখনও সে তার মেয়ের খোঁজ পেয়েছে। ভেবেছিলেন, সবটা সমাধান হবার পর বলবেন। যেহেতু আজ সমাধানের শীর্ষে সবটা। তাই জানিয়ে দিতে চাচ্ছেন।

    “আমি, আমার মেয়ের খোঁজ পেয়েছি।”

    তৃষ্ণা শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,“ফাইনালি পেলে! আমি তো সেই আগেই বলেছিলাম, আমাকে বলো। আমি খুঁজে দেবো। তুমি রাজিই ছিলে না।”

    মিসেস শেফালী হালকা হাসলেন। বললেন,“আমি ভুল করে ফেলেছিলাম। আজ সবটা শুধরে নেবো।”

    “আমি কী আজ ঐ বাড়িতে আসবো?”

    “কণ্ঠ শুনে বোঝা যাচ্ছে, তোর ঘুম হয়নি। ঘুমিয়ে নে। রাতে চলে আসিস।”

    তৃষ্ণা “আচ্ছা” বলতেই মিসেস শেফালী কল কেটে দিলেন। উচ্চকন্ঠে দীপ্তিকে ডাকলেন,“বাবুন! কই তুই? জলদি নিচে আয় না।”

    দীপ্তি তার মায়ের ডাকে হন্তদন্ত হয়ে নিচে এলো। অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “কী হয়েছে মা? এভাবে ডাকছো কেনো?”

    “এভাবেই। কী করছিস?”

    “কিছুনা মা।”

    মিসেস শেফালী হেসে বললেন,“তোর আপুকে দেখবি?”

    “দেখার কী আছে?”

    পরক্ষণেই আবার বলে উঠলো,“ওয়েট!”

    প্রথমে দীপ্তি খেয়াল করেনি। পরে যখন বুঝতে পারলো, ওর মা কী বলেছে! চকিতে চাইলো তার মায়ের পানে। দীপ্তি এখনও বুঝে উঠতে পারছে না, সে কী শুনেছে?

    তাই পুনরায় জিজ্ঞেস করলো, “কী বললে তুমি? আমি হয়তো ভুল শুনেছি। আবার বলো।”

    “ঠিকই শুনেছিস। তোর আপুকে দেখবি?”

    দীপ্তি অত্যধিক বিস্ময়ে জড়ীভূত হয়ে বললো,“আপু!”

    “হুঁ।”

    “পেয়েছো আপুকে?”

    “হ্যাঁ রে বাবুন।”

    “কোথায় আছে আপু? কবে দেখা করাবে?”

    “এই শহরেই আছে। আর আজ দেখা করাবো। একটু বাদেই চলে আসবে ওরা।”

    দীপ্তি এখনও নিজের বিস্ময় রোধ করতে পারেনি। ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

    তখন কলিং বেলের আওয়াজ পেয়ে মিসেস শেফালী উত্তেজিত হয়ে পড়েন। দ্রুত গতিতে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললেন। দরজার বাইরে দিকটা অবলোকন করতেই তার চোখ দিয়ে এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আঠারো বছর! হ্যাঁ! আঠারো বছর পর, আজ সে দেখতে পেলো তার কলিজার টুকরোকে। নিজের আবেগ দমাতে হিমশিম খাচ্ছে। কিছু বলতে পরছে না। বাক্য মিলছে না। কণ্ঠস্বর কোনো শব্দ তৈরি করতে পারছে না।

    কম্পনরত অধর যুগল অনেকখানি সময় নিয়ে উচ্চারণ করলো, “ববীনু!”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২২)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২২)

    ভালোবাসি শব্দটা এতটা শ্রুতি মধুর! আমি জানতাম না। বিশেষ করে যদি তা নিজের ব্যক্তিগত মানুষটির মুখনিঃসৃত হয়।

    আরহানের মাত্র বলা ‘ভালোবাসি’ কথাটির দরুন খেই হারিয়ে ফেলেছি আমি। এতক্ষণের লজ্জাবতী এই আমিটা হুট করেই সব ভুলে বলে দিলাম,“আমিও ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।”

    মুহূর্তেই পুনরায় চুপ মেরে গেলাম। চোখ নিচে নামিয়ে ফেললাম। আরহান আমাকে ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন।

    “হঠাৎ এভাবে সাজলে যে!”

    আরহানের প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। কি বলবো আমি? কেনো সেজেছি? গালে লাল আভা দৃশ্যমান। আরহান বুঝে গেলেন।

    হেসে বললেন,“লজ্জাবতী বউ কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দ। ইচ্ছে করে, এভাবেই দেখে যাই তাকে।”

    অজ্ঞাত কারণবশত আমি আরহানের এমন কথা নিতে পারি না। কেমন যেনো হাঁসফাঁস লাগে। বুকের ভেতরের এই ‘হৃদপিন্ড’ নামক বস্তুটি নিজের উপস্থিতি বোঝানোর জন্য সর্বস্ব দিয়ে কম্পিত হয়। ভেবে রাখা শব্দ সব আওলিয়ে যায়। বাক্য মেলাতে পারিনা। এগুলো কেনো হয়?

    কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম। তৎক্ষণাৎ আরহানের পুনরায় এরকম কথা শোনার আগেই প্রসঙ্গ এড়াতে বললাম, “কোথায় গিয়েছিলেন?”

    আরহান চুপ থাকলেন। খানিকক্ষণ বাদে বললেন,“তোমার ছোট খাটো সব ইচ্ছে পূরণের দায়িত্ব নিয়েছি। এবার পাওয়া না পাওয়া সব ফিরিয়ে দেবার দায়িত্ব নিলাম।”

    __________________________

    নিজ রুমে বসে নিশা আধা ঘন্টা যাবৎ কেঁদেই যাচ্ছে। কেনো কাঁদছে তা অজানা ওর কাছে। শুধু একটা জিনিসই জানে, তার বুকের মধ্যেখানে প্রচণ্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। হয়তো কিছু না পাবার হাহাকার এটা।

    এমন সময় তার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখলো, স্ক্রিনে ‘রাহা’ নামটা ভেসে উঠেছে।

    রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে রাহা বলে উঠলো,“আজ কলেজে আসিসনি কেনো?”

    নিশা কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“কিছু ভাল্লাগেনা রে বইন। প্রেম করার আগেই ছ্যাকা খাইয়া গেলাম গা রে।”

    “তোর আবার কি হলো?”

    “কি হয়নাই এইটা বল। জিবনডা তেজপাতা হইয়া গ্যাছে রে বইন।”—বলেই নিশা আবারও ন্যাকা কান্না শুরু করে দিলো।

    রাহা এবার ধমকের শুরে বললো,“বেশি ঢং করলে ফোন রেখে দেবো। ফটাফট বল কি হয়েছে?”

    নিশা কান্না থামালো। মুখশ্রী ভাব গম্ভীর হয়ে গেলো। কণ্ঠস্বরে কিছুক্ষণ আগের ন্যাকামির রেশ মাত্র নেই। অনুভূতিহীন গলায় বললো,“জানিনা।”

    “জানিস না মানে?”

    “সমস্যাটা কী এটা জানলে সমাধান অনেক আগেই বের করে ফেলতে পারতাম।”

    “সিরিয়াস কিছু নাকি?”

    “হ্যাঁ!”

    “তুই ঠিক আছিস নিশু? শরীর ঠিক আছে তোর?”

    “না। অসুখ করেছে আমার।”

    “মানে? কী হয়েছে?”

    “প্রেমময়ী এক অসুখে গভীর ভাবে আক্রান্ত আমি। এই অসুখের নিবারণ তখনই হবে, যখন সে….”

    নিশা থমকে যায়। রাহা, নিশাকে থেমে যেতে দেখে প্রশ্ন করে,“যখন?”

    “কিছু না। কারণ সে আসবে না। ভালোবাসার রোগাক্রান্ত আমি। একতরফা ভালোবাসার।”

    ________________________

    মিসেস শেফালী অফিস থেকে ফিরে সোজা নিজের রুমে চলে গেলেন। ড্রইং রুমে দীপ্তি বসেছিলো। তার মাকে এমন ভাবে যেতে দেখে দীপ্তি ও ছুটলো তার পিছু পিছু।

    মিসেস শেফালীকে কিছু খুঁজতে দেখে দীপ্তি পেছন থেকে প্রশ্ন তুলে,“কী খুঁজছো মা?”

    মিসেস শেফালী দ্রুত পেছন ফিরে দেখেন, দীপ্তি দাঁড়িয়ে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে শুধালো,“আমাকে একটু স্পেস দে বাবুন।”

    দীপ্তি “আচ্ছা মা” বলে প্রস্থান করলো। মিসেস শেফালী গিয়ে দরজা লক করে পুনরায় খোঁজ করা শুরু করলেন। ফাইনালি পেলেন। ডায়েরিটা পেলেন। সেদিন দীপ্তি যেই ডায়েরি হাতে নিয়েছিল, এটা সেটাই।

    বসে পড়লেন তিনি। একটা কলম তুলে নিলেন। ডায়েরির বেশ কিছু জায়গায় অভিমান মিশ্রিত বাক্য ছিলো। সবগুলো কেটে যাচ্ছেন তিনি। একটা একটা করে এমন ভাবে কাটছেন, যাতে কি লেখা ছিলো তা বোঝা না যায়।

    বার বার অস্থির ভঙ্গিতে অস্পষ্ট স্বরে বলে যাচ্ছে,“আমি দুঃখিত। আমি অনুতপ্ত। তোমাকে ভুল বোঝার জন্য আমার আঠারোটি বছর অভিশপ্ত।”

    পুনরায় স্মৃতিচারণ করা শুরু করলো আজ দুপুরে আরহানের বলা সেই কথা গুলো।

    আরহান বললো,“আপনি যা জেনেছেন তা আংশিক সত্য। আর আংশিক সত্য,পুরো মিথ্যের চেয়ে ভয়ংকর।”

    মিসেস শেফালী চকিতে চাইলো আরহানের পানে। অবাক ও বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“মানে?”

    “প্রতিটা কাহিনীর দুটো পাতা থাকে। একটা সেটা, যেটা আপনি দেখছেন। আর অন্যটা সেটা, যেটা আপনার চক্ষুগোচর।”

    পুনরায় আরহান মিসেস শেফালীর ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকা নয়নের পানে তাকিয়ে বললো,“অন্যটা আমি আপনাকে বলছি….

    মিসেস মনিরা, বাসেদ আহমেদের প্রাক্তন ছিলেন। এটা সত্যি ছিলো যে, সে একসময় তার প্রাক্তন প্রেমিকাকে ভালোবাসতেন এবং তাকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাননি।

    কিন্তু মিসেস মনিরা বড়লোক ঘরের প্রস্তাব পেয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। আর এদিকে বাসেদ আহমেদ দেবদাস থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

    এরপর আপনার বাবার আর বাসেদ আহমেদের বাবার বন্ধুত্বের রেশ ধরে জোরপূর্বক আপনার সাথে বিয়ে দেয়। অতঃপর সে মুভ অন করতে সক্ষম হয়।আপনার প্রতি তার ভালোবাসার বিন্দুমাত্র মিথ্যে ছিলো না। দ্বিতীয় বার যেভাবে ভালোবাসা যায়! ঠিক সেভাবে আপনাকে ভালোবেসে ফেলে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে দিব্যি চলছিলো তার জীবন।

    নয় বছর পর একদিন শোনা যায়, মিসেস মনিরার হাসব্যান্ড দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মিসেস মনিরা একটা মাত্র সন্তানকে নিয়ে একাকী জীবন কাটাতে না চেয়ে পুনরায় বাসেদ আহমেদের জীবনে ফিরে আসতে চেয়েছেন। এতে বাসেদ আহমেদ আপনার ও আপনাদের মেয়ের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে, মিসেস মনিরার প্রস্তাব নাকচ করেন।

    এরপর মিসেস মনিরার টার্গেটে পড়ে যান আপনি। সে চেয়েছিলো আপনার কানে বাসেদ আহমেদের নামে বিষ ঢেলে আপনাকে রাস্তা থেকে সরাবে।

    কিন্তু সে ব্যর্থ হলো। অবশেষে পরিকল্পনা করে আপনাকে শুধু রাস্তা থেকে না, দুনিয়া থেকে সরাবার।

    সেদিন আগে থেকেই আপনার উপর নজর রেখেছিলো মিসেস মনিরা। আপনি সেই রাস্তা অতিক্রম করবেন যখন, তখন সামনে এসে যায়।

    বাকি কাহিনী আপনার জানা নিশ্চয়ই। তারপর আপনার গাড়িটা, মিসেস মনিরা হালকা ধাক্কিয়ে একদম খাদের পাশে এনে রাখে এবং ড্রাইভিং সিটের দরজাটা খুলে রাখে।“

    এটুকু বলে আরহান থামলো। মিসেস শেফালী বললো,“বিয়েটা?”

    “বলছি…”

    “হুঁ…”

    “সেদিন আপনার বাড়িতে না পৌঁছনোর কারণে অনেক খুঁজেছে সবাই আপনাকে। অবশেষে পাহাড়ি রাস্তায় আপনার গাড়ি একদম খাদ ঘেঁষে রাখা দেখে সবাই আন্দাজ করে নেয় আপনার এক্সিডেন্ট হয়েছে। পুলিশ বলে, যদি আপনি বেঁচে থাকেন তবে আপনার বডি পাওয়া যাবে। কিন্তু বডি পাওয়া যায়নি, তাই ধরে নিয়েছে পাহাড় থেকে পড়ে গিয়েছেন। আর সেখান থেকে বেঁচে ফেরা অসম্ভব।

    বাসেদ আহমেদ পাগল প্রায় হয়ে গিয়েছিলো। অবুঝ বীনিও সেদিন আপনার অপূর্ণতায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কেঁদেছে। আপনি ছিলেন না। বাসেদ আহমেদ এমনিতেই ভেঙ্গে পড়েছিলেন। তন্মধ্যে বীনিকে সামলানো তার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছিলো। সেই সুযোগ কাজে লাগালো মিসেস মনিরা।

    বাসেদ আহমেদের নিজের মেয়ের জন্য একটা মা আর মিসেস মনিরার একটা সংসার প্রয়োজন ছিলো। অতঃপর আপনার যাবার কিছুদিন বাদেই ও বাড়িতেই চলে আসেন তিনি।

    মাস খানেক ওভাবে থাকার দরুন বাড়ির বাইরের লোক নানা ধরনের গুজব রটাচ্ছিলো। যেহেতু তাদের বিয়ে হয়নি, তাই এটা স্বাভাবিক। জোরপূর্বক তাকে বিয়েটা করে নিতে হয়।

    আর সেদিনই আপনি এসেছিলেন।”

    “মানে আমার বীনু ওখানে ছিলো?”

    “হুঁ…”

    “মনিরা ওর কোনো ক্ষতি করেনি? মেয়েটা কেমন আছে আমার?”

    আরহান বাঁকা হাসলো। পরপর চোয়াল শক্ত করে বলা শুরু করলো,“প্রথম কয়েকদিন ভালো মতোই ব্যবহার করেছিলো। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয়ে যায়। সৎমায়ের নির্যাতন বোঝেন? সেরকম।

    প্রথম কয়েকমাস বীনি তার বাবার ভালোবাসায় নিজের মায়ের অপূর্ণতা বোঝেনি। তবে পুরুষ মানুষ তিনি। ধীরে ধীরে সে নারীতে ঝুঁকে যায়। হাজার হোক, প্রথম ভালোবাসা তো!

    মিসেস মনিরার প্রায় সব কথা তখন বাসেদ বিশ্বাস করা শুরু করেন। এমতাবস্থায় সে বাসেদ আহমেদের ব্রেইন ওয়াশ করে। তাকে বোঝায়, আপনার মৃত্যুর জন্য বীনি দায়ী। সেদিন যদি আপনাকে জোর করে ওর মামার বাড়ি নিয়ে না যেতো, তবে হয়তো আপনি তাদের সাথে থাকতেন।

    এসব কথা বিশ্বাস করে মেয়ের প্রতি অবহেলা শুরু করে দেন উনি। আর বীনির প্রতি নির্যাতন শুরু হয়ে যায়।

    রহিমা খালাকে কোনো কাজ করতে দিতেন না। বাচ্চা বীনিকে দিয়ে সব কাজ করাতেন। এজন্য ওর স্কুল এডমিশান ও অনেক দেরিতে হয়ে যায়। বীনির বাবার জোরাজুরি আর মামার হুমকিতেই পড়া লেখা করতে দেন।

    মা হীনা এক মেয়ের সাথে কি কি ঘটতে পারে, তার সবটাই ঘটেছে ওর সাথে।”

    কথাগুলো শুনে মিসেস শেফালির চোখ দিয়ে অজান্তেই অশ্রুপাত হচ্ছে। সে জানতো না এরকম কিছু। কিন্তু, না চাইতেও সে তার মেয়ের জীবনের অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

    আরহান মিসেস শেফালীকে শান্ত হতে বললো। তখন মিসেস শেফালী প্রশ্ন তুললো,“এসব ঘটনা আপনি কি করে জানেন? বিশেষ করে আমার বীনুর ব্যাপারে?”

    আরহান হালকা হেসে বললো,“কারণ আমি বীনির লিগ্যাল হাসব্যান্ড।”

    মিসেস শেফালী চমকিত হলেন। আরহান আবারও বললেন, “বীনিকে আমি পছন্দ করি দুইবছর ধরে। কিন্তু একটা সমস্যার কারণে তৎক্ষণাৎ বিয়ে করতে পারিনি। সমস্যার রেশ কাটিয়ে উঠার পর যখন বিয়ের প্রপোজাল পাঠাই, তখন না করে দেয় মিসেস মনিরা।

    ঘটনার আগা গোড়া বুঝতে না পেরে সেদিনই খোঁজ চালাই। পাড়া প্রতিবেশী ও পুরনো মেইড, রহিমা খালার কাছে। উনাকে খুঁজতেও অনেক সমস্যা হয়েছিলো। এরপর প্রতিবেশীর কাছে কিছু ঘটনা জানি, আর বাকিটা রহিমা খালার কাছে। শুনেছি আপনার চলে যাবার বছর যেতে না যেতেই ব্যবসায় বিশাল বড় লস খান বাসেদ আহমেদ। এতে করে, বাসেদ আহমেদ তার এতো বছরে গড়ে তোলা নিজস্ব সব প্রপার্টি হারিয়ে ফেলেন। বাদ বাকি বেচে ছিলো তার পৈতৃক সম্পত্তি, যার একাংশও তার নামে ছিলো না।

    তবুও একটা ঘটনা আমার কাছে ক্লিয়ার ছিলো না। যদি বীনিকে তারা বোঝাই মনে করে, তবে বিয়ে দিয়ে দিলেই তো পারে। কেনো দিতে চায়নি? এজন্য আরো খোঁজ লাগিয়ে দেখি, আপনার শ্বশুর মশাই, তার সম্পত্তির সবটাই আপনার নামে উইল করে গিয়েছেন। এবং আপনার অবর্তমানে তা আপনার মেয়ে, তার পঁচিশ তম জন্মদিনে পাবে। এই পদক্ষেপ নেবার পেছনেও একটা কাহিনী ছিলো। সেটা হচ্ছে, বাসেদ আহমেদ আপনাকে বিয়ে করতে চায়নি। জোর করে বিয়ে দেবার দরুন যাতে আপনার সাথে কোনোরূপ অনাচার করতে না পারে, এজন্য তার প্রপার্টি সব আপনার নামে লিখে গিয়েছেন।

    এজন্য মিসেস মনিরা আর যাই করুক, বীনিকে মারেনি বা অন্য কিছু করেনি।

    এরপর আমি যেদিন তার কুকর্মের কিচ্ছা-কাহিনী জানতে পারি, সেদিনই মিসেস মনিরা আর তার আদরের মেয়েকে ছোট্ট একটা পানিশমেন্ট দিই। তবে তারা আরো ডিসার্ভ করে।

    কয়েকদিন যেতেই সব ঘটনা পরিষ্কার হয় এবং আমি জানতে পারি, সেদিন অনেক খোঁজার পরও আপনার বডি পাওয়া যায়নি। কৌতূহল দমাতে না পেরে আমি সেদিনের সব ঘটনা জানার চেষ্টা করি। তখন আমি জানতে পারি, আপনি বেঁচে আছেন এবং আমি আপনাকে খোঁজা শুরু করি। তখন বীনিকে আমি বিয়ে করে নিই। তাদের পারমিশন ছাড়াই। ঐ ফ্যামিলিতে রাখার আর ইচ্ছে হয়নি আমার।

    এরপর আপনাকে পেলাম।’’

    “আচ্ছা, আমার বীনু এখন কেমন আছে?”

    “সুখে আছে।”

    মিসেস শেফালী অধরযুগল প্রসারিত করে হেসে বললেন,“আমার মেয়েকে এখন দেখতে পাবো?”

    “না..”

    আরহানের কথার প্রেক্ষিতে মিসেস শেফালীর মুখশ্রীতে ঘন কালো আঁধারের দেখা মিললো। মিনমিনে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,“আমার শাস্তি এটা?”

    “না, আমি চাইনা বীনি আপনাকে ভুল বুঝুক। সময় মতো আপনার সাথে দেখা করাবো।” —কথাটি বলেই আরহান উঠে দাঁড়ালো। পুনরায় বললো,“জলদি দেখা হবে আবারও। আসছি।”

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    এটুকু স্মৃতিচারণ করে মিসেস শেফালী পুনরায় কান্নায় মনোযোগী হলেন। আজ তার একটা ভুলের জন্য তার কলিজার টুকরো মেয়ে, বীনিকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।

    মুখ ফুটে বলে উঠলো,“আমাকে মাফ করবি তো তুই বীনু?”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২১)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২১)

    “আজ থেকে আঠারো বছর আগের ঘটনা….

    এই চট্টগ্রামেই থাকতাম। আমার বীনুর বয়স তখন সবে পাঁচ। পিচ্চি মেয়েটা গুটি গুটি পায়ে পুরো বাড়ি দৌঁড়িয়ে বেড়াতো। বড্ড চঞ্চল মেয়ে ছিলো আমার। সারাক্ষণ মামা বাড়ি, মামা বাড়ি করেই থাকতো। অবশ্য ওর মামাবাড়ি বেশি দূরেও ছিলো না। গাড়িতে চল্লিশ মিনিটের রাস্তা।

    সে মাসে প্রায়শই ল্যান্ড লাইনে একটা কল আসতো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আমার স্বামী, বাসেদ আহমেদের নামে কেউ একজন যা তা বলতো। আমি ভীষণ ভালোবাসতাম বাসেদকে। পারিবারিক ভাবে বিয়ে হলেও ভালোবাসায় কমতি ছিলো না। তাই কখনো টেলিফোনের ওপাশের ব্যক্তির কথা শুনে বাসেদকে সন্দেহ করিনি।

    তখন ছিলো বর্ষা কাল। সকাল থেকে গুরি গুরি বৃষ্টি। আর এদিকে বীনুও মামাবাড়ি যাবার জন্য কান্না জুড়ে বসেছে। অগত্যা বাড়ির গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম।

    কিন্তু, আমার মন সেদিন বড্ড কু গাচ্ছিলো। ঐ বাড়িতে শান্তি পাচ্ছিলাম না। অশান্ত এই মনকে বোঝাতে না পেরে, বাড়ি ফেরার পথ নিলাম। বৃষ্টি থেমে যেতেই বিকেলের দিকে বেরোলাম।

    বাসেদ আমাকে ড্রাইভিং শিখিয়েছিলো। এজন্য একাই চলে এসেছিলাম। মাঝ রাস্তায় হুট করেই গাড়ির সামনে কারো উপস্থিতি লক্ষ্য করে ব্রেক কষলাম।

    পাহাড়ি রাস্তা ছিলো। একটা মেয়েকে আমার গাড়ির সামনে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম।

    মনের মাঝে একটা কথাই ছিলো,‘সুইসাইড করতে এসেছে নাকি এই মেয়েটি?’

    জোরপূর্বক গাড়ি থেকে বেরোলাম। বেরোতেই মেয়েটা আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো। মস্তিষ্কে অনেক কথারা এসে ভীড় জমাচ্ছে।

    নিস্তব্ধতার মাঝেই সেই মেয়েটির কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম,’তোমার সাথে কথা আছে।’

    মুহূর্তেই অবাক বনে গেলাম। আমায় চেনে?

    ‘কী কথা?’

    ‘বাসেদকে ছেড়ে দিচ্ছো না কেনো?’

    ‘আজব! আপনি কে? আর বাসেদকে ছেড়ে দিতে বলছেন কেনো?’

    ‘তোমার স্বামী আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। শুধু তোমার জন্য আমাকে গ্রহণ করতে পারছে না।’

    এমন কথা ল্যান্ডলাইনের সেই মেয়েটি বারবার বলতো। তবে কি এই সেই? মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেলো। রেগে গেলাম ভীষণ ভাবে।

    তেজ মিশ্রিত কন্ঠে বললাম,‘আমি বাসেদকে চিনি। এসব বানোয়াট কথা অন্য কাউকে গিয়ে বলুন না।’

    ‘ওহ্! বুঝেছি। এভাবে নিজ থেকে সরবে না। তোমার জন্য আরো একটা রাস্তা আছে।’

    পাহাড়ি সরু রাস্তায় ছিলাম। হুট করে আমার হাত ধরে টেনে একদম কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিলো। আকস্মিক এমন আক্রমণ আমি বুঝতে পারিনি।

    মহিলাটি বাঁকা হাসলো। পুনরায় বললো,‘বাসেদকে ছেড়ে যাবি নাকি এই দুনিয়া ছাড়ার ব্যবস্থা করে দেবো?’

    ‘দেখুন আপনি ভুল করছেন। বাসেদ আপনাকে না, আমাকে ভালোবাসে। আমাদের মেয়ে আছে। আপনি এরকম করবেন না। দোহায় লাগে, ছেড়ে দিন।’

    ‘ওকে, ছেড়ে দিলাম।’—বলেই আমার হাত ছেড়ে আমাকে ধাক্কা দিলো। নিচে গড়িয়ে যাচ্ছিলাম আমি।“

    এটুকু বলে মিসেস শেফালী থামলেন। পাশ থেকে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে পুরো গ্লাস পানি পান করলেন। পুরনো স্মৃতি গুলো যখন নিজের বর্তমানে প্রভাব ফেলে, হয়তো তখন সবার অবস্থা মিসেস শেফালির মতোই নাজেহাল হয়।

    আরহান প্রশ্ন তুললো,“এরপর? পাহাড় থেকে ফেলার পরও?”

    শেফালী বেগম আরহানের দিকে তাকিয়ে পুনরায় বলা শুরু করলেন,“ভাগ্য! ভাগ্য চেনো? সেটাই।

    আমাকে পাহাড়ের চূড়া থেকে ফেলে দিলেও, সে জানতো না, ওপাশে খানিকটা নিচেই পাহাড়ের গা ঘেঁষে একটা রাস্তা আছে। বেশি নিচে ছিলো না বলে বেঁচে গিয়েছিলাম।

    ঠিক তখনই ভারী বর্ষণ শুরু হয়। সে আর কিছু না করেই চলে যায়।

    মাথায় আঘাত পেয়েছিলাম ভীষণ। সেই রাস্তা দিয়ে আশরাফ ভাই যাচ্ছিলেন। আমাকে ওরকম অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে, সাহায্য করেন। পার্শ্ববর্তী হসপিটালে এডমিট করেন।

    জানেন? সেদিন আমার জীবনের দ্বিতীয় খুশির আগমনের কথা জানতে পারি। আমার প্রথম খুশি আমার বীনু ছিলো। আর দ্বিতীয় খুশি বাবুন।

    সেদিন ডাক্তার আমাকে জানায়, আমি পুনরায় মা হতে চলেছি। এতো কষ্টের ভীড়েও সেদিন হেসেছিলাম আমি। আশরাফ ভাই সেই ক’দিন আমার পুরো খেয়াল রেখেছেন, যেমনটা আমার নিজের ভাই হলে রাখতেন।

    প্রায় দুই মাসের মতো হসপিটালে ছিলাম আমি। উপর থেকে পড়ায়, তেমন চোট না পেলেও, মাথায়, হাতে আর পায়ে বেশ ব্যাথা পেয়েছিলাম। পায়েরটা মারাত্মক ছিলো।

    ডাক্তারের একটা কথা এখনও আমার কানে বাজে,‘ইট’স মিরাকেল। নয়তো এরকম কেসে বেবি বাঁচে না।’

    দুই মাসে কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আমার একটা দোষ ছিলো। টেলিফোন নম্বর মনে রাখতে পারতাম না। সেজন্য সবসময় একটা ডায়েরি সাথে নিয়ে ঘুরতাম, ওটাতে সবার নম্বর থাকতো।

    সেবার আমার কাছে কিছুই ছিলো না।

    দুইমাস বাদে আশরাফ ভাই আমাকে উনার বাড়িতে নিয়ে যান, দু’দিন থাকার উদ্দেশ্যে। সেখানে তানিয়া আপা আমাকে পছন্দ করতেন না। তবে, আশরাফ ভাইয়ের দশ বছর বয়সী ছেলেটা দুদিনেই আমাকে আপন করে নেয়। আমি বুঝে যাই, ভালোবাসার বড্ড অভাব সেই বাচ্চাটার।

    দুদিন বাদে, আশরাফ ভাই আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে দেবার উদ্দেশ্যে এলেন। বাড়ির সামনে তাকাতেই আমি বড়সড় একটা ঝটকা খাই। নিজ চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

    কি অদ্ভুত! মানলাম, আমি সবার কাছে মৃত। কিন্তু বাসেদ? সে কি করে এতো জলদি আমাকে ভুলে নতুন জীবন শুরু করতে গেলো?

    গেটের উপর বিশাল আকারে সাইনবোর্ডে লেখা আছে,‘বাসেদ ওয়েডস মনিরা…’

    পাশে থেকে একজন মহিলার কথা কানে এলো,‘হুননিডে, বউ ইভার আস্ট বছরের একগুয়া মেইপুয়া আচে।’

    (শুনলাম, বউএর নাকি আট বছরের একটা মেয়ে আছে।)

    অন্যজন বললো,‘তুই জানো না কন বেডির কথা কইর? মনত ন পড়ের? আগে এই ঘরত আইতো যে? বাসেদের বান্ধবী আছিল দে।’

    (তুমি জানো না কার কথা বলি? মনে পড়ে? আগে এই বাড়িতে প্রায় আসতো যেই মেয়ে। বাসেদের বান্ধবী লাগতো)

    ‘বেডি ইভার আগের টুন সম্পর্ক আচিল ল?’

    (মানে আগে থেকেই সম্পর্ক ছিলো?)

    ‘হ! আইয়ো হুইনি বাসেদ মাইয়া ইভার লাই বিয়া ন গরে, ইতের বাপে পরে দি যাই শেফালির লি বিয়া করাই দিইয়ে।’

    (হ্যাঁ! শুনেছি বাসেদ নাকি এই মেয়ের জন্য বিয়ে করতে চায়নি। এই মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়, পরে ওর আব্বা জোর করে শেফালির সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো।)

    আর কিছু শোনার প্রয়োজন মনে করলাম না। ধরে নিলাম, মেয়েটা আমাকে যা বলেছিলো, সত্যি বলেছিলো। বোরখা পরিহিত ছিলাম বলে, কেউ চিনতে পারেনি আমাকে।

    ভাগ্যের উপর তাচ্ছিল্যের এক হাসি হেসে আশরাফ ভাইয়ের সাথে প্রস্থান করলাম। রওনা দিলাম বীনুর মামার বাড়ি।

    কিন্তু….

    সেদিন বাড়িতে পৌঁছতেই দেখি ঐ বাড়ি ফাঁকা। শুধু ঐ বাড়ি না। আশে পাশের প্রায় সব বাড়িই ফাঁকা। সরকার নাকি ওখানে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ করবে, এজন্য কলোনী খালি করিয়েছে।

    বুক ভরা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। এখন আমার বীনুকে কোথায় পাবো? মাথায় কিছুই আসছিলো না। একসাথে এতো ঝটকা আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়ে উঠছিলো না।

    আশরাফ ভাই তখন আমাকে উনার বাসায় নিয়ে যান। সেখানে সেই বাচ্চা ছেলের চোখের মনি হয়ে উঠি। মিষ্টি করে আমাকে মামনি ডাকে। ধীরে ধীরে আমার বাবাইটার বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাই আমি।

    কিছুদিন বাদেই আশরাফ ভাই পরিবার সহ সিলেট শিফট করেন। আমিও তাদের সাথেই সেখানে চলে যাই।

    নিজেকে যাতে বোঝা মনে না হয়, এজন্য আশরাফ ভাইয়ের অফিসে কাজে লেগে যাই। শুরু করি বাবুনকে নিয়ে নতুন জীবন।

    সিলেট থাকতে থাকতে আমার বাবুন বড় হতে লাগলো। বাবুন থার্ড স্ট্যান্ডার্ডে ছিলো যখন, তখন একটা দুর্ঘটনায় আশরাফ ভাই আর তানিয়া আপা মারা যান।

    বাবাই একরোখা হয়ে যায়। হুট করেই অনেক পরিবর্তন পাই বাবাইয়ের মাঝে। চোখে সবসময় কোনো এক আগুন জ্বলতো, যা ওর বুকটা পুড়িয়ে দিচ্ছে।

    ধীরে ধীরে সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। আশরাফ ভাইয়ের ছেলেটা তখন থেকে আমার ছেলে হয়ে গেলো।

    বীনুকে ওর মামার কাছে রেখে এসেছিলাম বলে নিশ্চিন্ত মনে ছিলাম আমি। তবুও বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে হয়েছে। কিন্তু, যেই শহর জুড়ে বিশ্বাস ঘাতকতা ছেঁয়ে ছিলো, সেই শহরের হাওয়া সহ্য হতো না।

    চার মাস আগে, বাবুন হুট করেই বলে ফেলে, ও চবিতে পড়বে। আমি মানা করে দেই। তাই ও গিয়ে ওর ভাইকে বলে। অগত্যা ওদের জোরাজুরিতে ফিরতেই হলো। আশরাফ ভাই ছাড়া কেউ আমার অতীত জানতো না। বড় হবার পর বাবাই জেনে যায়, আমিও ধোঁকা খেয়েছি, এই শহর থেকে। আর কিছুদিন আগে বাবুন আমার ডায়েরি পড়ে জেনে যায় সবটাই।”

    মিসেস শেফালী কথা শেষ করেন। এটুকুই তো কাহিনী। কেটে ছেটে এটুকুই তো আছে।

    এতক্ষণ গভীর মনোযোগে সবটা শোনার পর আরহান বললেন,“মিসেস মনিরা ডাবল গেইম খেলেছেন।”

    মিসেস শেফালী চকিতে চাইলেন। উনার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে আরহান বললেন,“আপনি যা জেনেছেন, তা ছিলো আংশিক সত্যি। পুরো মিথ্যের চেয়ে আংশিক সত্যি বেশি ভয়ংকর।”

    _____________________

    “ভালোবাসা! পৃথিবীর সবচেয়ে সুখময় অনুভূতি কোনটা যদি আমায় জিজ্ঞেস করা হতো! তবে কোনো সময় ব্যয় না করে নির্দ্বিধায় বলে দিতাম, এটা ভালোবাসা। ভালোবাসার উপলব্ধির পূর্বকাল থেকেই সুখ অনুভব করা যায়। আর প্রতিক্ষণ মনটা উত্তেজিত হয়ে থাকে। কখন আমার প্রিয় মানুষটি আমার নেত্র সম্মুখে আসবে, দুচোখ ভরে দেখবো। আর…. হ্যাঁ! ভীষন লজ্জা পাবো।”

    ডায়েরিতে এটুকু লিখে মুচকি মুচকি হাসা শুরু করে দিলাম। অবশেষে মনের ভালোবাসা মুখে নিয়ে এলাম। দুপুরের দিকে যে, আরহানকে বললাম। এরপর থেকে আর আরহানের সামনেই আসিনি। কেমন যেনো অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। উনি কাছে এলেই সব কথা আওলিয়ে যাচ্ছে।

    খুব ইচ্ছে হচ্ছে একটু সাজতে। আচ্ছা! আরহান যদি বাড়ি ফিরে দেখেন, তার বউ তার জন্য সেজে বসে আছে, তখন আরহানের মুখখানা কেমন দেখাবে? বিস্মিত হবেন নিশ্চয়ই!

    হালকা হেসে কাবার্ড থেকে একটা গোলাপী সুতির শাড়ি পরে নিলাম। সাথে কালো ব্লাউস। আয়নায় এক ফাঁকে কোমরের এই বেলী চেইন দেখে নিলাম। মাথা নিচু করে হাসলাম। সেদিন আরহান স্বীকার করেছেন, এটা উনিই দিয়েছিলেন।

    চোখে গাঢ় কাজল আর ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। কপালে ছোট্ট কালো টিপ আর চুল খোঁপা করে নিলাম।

    হুট করেই পেছন থেকে কারো আলিঙ্গনে আমি স্তব্ধ, পাথর বনে গেলাম। শরীরের থরথর কাঁপুনি আমার বিস্মিত হবার বহিঃপ্রকাশ। কানের কাছে কারো ওষ্ঠের স্পর্শ পেলাম। সর্বাঙ্গে শিহরন ছেয়ে যাচ্ছে।

    ফিসফিসিয়ে বললেন,“ভালোবাসি শুকতারা…”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২০)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২০)

    ফটোফ্রেম সামনে রেখে ফ্লোরে বসে আছে তৃষ্ণা। গম্ভীর মুখশ্রী রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে। সামনের এই ছবিতে আছে তৃষ্ণার মম, ড্যাড ও তৃষ্ণা। একবার পুরো ছবিতে হাত বুলিয়ে নিলো। অধর যুগল কম্পিত হয়ে বলে উঠলো,“আজ আমারও একটা পরিবার থাকতো। আজ আমিও ভালোবাসা পেতাম। ভাগ্য প্রতিবার আমার সর্বস্ব ছিনিয়ে না নিলেও পারতো।”

    দশ বছর আগে…….

    একদিন তৃষ্ণা কলেজ থেকে ফিরেছিলো। উদাস মুখ তার। সেদিন কলেজে প্যারেন্টস মিটিং ছিলো, কিন্তু তৃষ্ণার গার্ডিয়ান যায়নি। ওর সব ফ্রেন্ডসদের বাবা মা এসেছিলো। শুধু তৃষ্ণার কেউ যায়নি।

    সেদিন ওর মামনি বাড়িতে ছিলো না। দীপ্তির সাথে ওর স্কুলে ছিলো বিধায় বাড়িতে শুধু ওর মম-ড্যাড ও সার্ভেন্টস ছিলো। সার্ভেন্টস সব নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত।

    তৃষ্ণার রুমের আগেই ওর মম-ড্যাড এর রুম পড়ে বিধায়, তাদের রুম ক্রস করেই নিজের রুমে যেতে হয়। সেভাবেই যাচ্ছিলো।

    হঠাৎ কারো উচ্চ কণ্ঠস্বর শুনতে পেয়ে পা জোড়া সেখানেই থমকে যায়। না চাইতেও ভেতরের কিছু কথা কানে আসে। ভেজানো দরজার ফাঁক দিয়ে তৃষ্ণা ভেতরে দেখতেই ওর চোখ দুটো বড় বড় হয়ে যায়। নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না তৃষ্ণা।

    ওর ড্যাড ওর মমকে থাপ্পড় মারলো। ওর ড্যাড এই জীবনে কোনদিন ওর মমের গায়ে হাত তোলেনি। সেই আজ…

    লুকিয়ে কথা শোনা ঠিক না। তবে চমকিত তৃষ্ণা এখন হতভম্ব হয়ে আছে।

    ভেতরে ওর ড্যাড, আশরাফ সরকার বললো,“আমি তোমার থেকে এসব আশা করিনি তানিয়া।”

    হাতের কিছু ছবি, যেগুলোতে তৃষ্ণার মম, তানিয়ার আর একটা অপরিচিত লোকের অন্তরঙ্গ মুহুর্ত ক্যাপচার করা আছে, সেগুলো মুখের উপর ছুড়ে ফেলে বললো,“এগুলো দেখো। আরো কিছু বলার আছে তোমার?”

    অবশেষে উপায় না পেয়ে তানিয়া বলে ফেললো, “হ্যাঁ। এগুলো সত্যি। সব সত্যি।”

    সঙ্গে সঙ্গে আশরাফ, তানিয়াকে আবারও থাপ্পড় মারলো।

    “ছিঃ! তোমার এতো বড় একটা ছেলে আছে। তবুও?”

    “এই তুমি কোন সাহসে আমার গায়ে হাত তোলো? আর আমার যা ইচ্ছে তাই করবো আমি। ইট’স মাই লাইফ।”

    “তুমি বাড়াবাড়ি করছো তানিয়া।”

    “বাড়াবাড়ি আমি না, তুমি করছো। তোমাকে বিয়ে করার পর থেকে আমার সখ-আহ্লাদ সব ভেস্তে গিয়েছে। আমার জীবনটা নরক হয়ে গিয়েছে। সব কিছুতেই ছেলে ছেলে করো। আমার জাস্ট ঐ ছেলেকে সহ্য হয়না। আমাকে আমার মতো থাকতে দাও তো আশরাফ।”

    আশরাফ অবিশ্বাস্য কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“তুমি কি আদৌ মা? কি করে নিজের ছেলেকে নিয়ে এভাবে বলো? বাচ্চা হলে তার দায়িত্ব নিতে হয়, খেয়াল রাখতে হয়, নজরে নজরে রাখতে হয়। এটাকে বন্দী জীবন বলে না।”

    “আমার কাছে এটাই বন্দী জীবন।”

    “আর এই লোকটার কাহিনী কি? এসব কি তানিয়া?”

    “আমি তোমাকে বলতে বাধ্য নই।”

    রাগী আশরাফের রাগ তুঙ্গে উঠে গেলো। আর এদিকে তানিয়াও কম না । দুজনের কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে তানিয়া পাশে ফলের ঝুড়ি থেকে ছুরি নিয়ে সোজা আশরাফের পেট বরাবর আঘাত করে। মুহূর্তে এমন আক্রমণের জন্য আশরাফ সরকার পেটে হাত রেখে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে।

    দরজায় দাঁড়িয়ে নিজের প্রাণ প্রিয় ড্যাডের এমন অবস্থা দেখে চিৎকার দেয় তৃষ্ণা। তখন তানিয়া মাথা ঘুরিয়ে দরজার সামনে তৃষ্ণাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য তানিয়ার এখন কোনো কিছু খেয়াল নেই। প্রমাণ লুকোনোর তাগিদে হাতের ছুরি নিয়ে তৃষ্ণার দিকে অগ্রসর করে। তৃষ্ণা ওর দিকে এগোতে থাকা তানিয়ার মধ্যে নিজের মমকে নয়, নিজের ড্যাড এর খুনিকে দেখতে পাচ্ছে। যখনই তানিয়া ছুরিকাঘাত করতে যাবে, তখনই তৃষ্ণা ওর পাশের ফুলদানি সোজা ওর মমের মাথায় মারে। সঙ্গে সঙ্গে তানিয়া মাথায় হাত রেখে মেঝেতে পড়ে যায়।

    তৃষ্ণা হুঁশে আসে। সতেরো বছর বয়সী তৃষ্ণার নেত্র সম্মুখে এখন ভেসে আছে তার মম ও ড্যাড এর লাশ। সেদিন তৃষ্ণা কান্না করেনি। একটুও না। শুধু বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিলো। সে যে নিঃস্ব হয়ে গেলো। এতিম হয়ে গেলো তৃষ্ণা।

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    তৃষ্ণার মামনির বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছিলো। এমনিতে এই বাড়ি নিরব থাকে সবসময়। তবে আজ তার কাছে এই নিরবতাটা ভয়ংকর লাগছে। দীপ্তিকে রুমে দিয়ে সে তৃষ্ণার রুমের দিকে রওনা হলো।

    তৃষ্ণার মম-ড্যাডের রুমের সামনে পৌঁছতেই তার পা জোড়া থমকে যায়। খোলা দরজার মুখ বরাবর তাকাতেই এই বিধ্বস্ত পরিবারকে দেখে সে চোখ বড় বড় করে ফেলে। রক্তাক্ত আশরাফ আর তানিয়ার লাশের মাঝ বরাবর তৃষ্ণা পাথরের ন্যায় বসে আছে।

    তৃষ্ণার কাছে যেতেই সে তার মামনির দিকে চোখ তুলে তাকায়। নীলাভ চক্ষুদ্বয় ভয়ংকর লাগছিলো। সময় নিয়ে একে একে পুরো ঘটনা খুলে বলে তৃষ্ণা। সবটা শোনার পর, তার মামনি তৃষ্ণার দ্বারা খুন করার ব্যপারের সবগুলো প্রমাণ নষ্ট করে দেয়। অবশেষে সে রাতে পুলিশ এলে বলা হয়, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তৃতীয় ব্যক্তির আগমনের জন্য তারা একে অপরকে আঘাত করে। সেদিন তৃষ্ণার, ওর নিজের মমকে খুন করার ব্যাপারে ওর মামনি ব্যতীত আর কেউ জানতে পারে না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ধামাচাপা পড়ে যায়।

    সেবার খবরের কাগজে ছাপা হয়েছিলো,“বিশিষ্ট শিল্পপতি আশরাফ সরকার, তার সহধর্মিণী তানিয়ার পরকীয়ার ব্যাপারে জানতে পারায়, দুজনের মধ্যে হাতাহাতি হয়। অবশেষে স্বামী ও স্ত্রী, দুজন দুজনার দ্বারা আঘাত প্রাপ্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে।”

    অতঃপর এতিম তৃষ্ণার জীবনে ওর মায়ের মতো মামনি থাকা সত্বেও, সে চলে যায় বাজে দিকে। নেশা দ্রব্য তার নিত্যদিনের সাথী ও সুন্দরী রমণী তার আসক্তি হয়ে যায়। একবুক কষ্ট নিয়ে গানের দিকে ঝুঁকে যায়। আর সেই লোকটি, যার সাথে তার মমের একটা সম্পর্ক ছিলো। অবৈধ সম্পর্ক ছিলো অবশ্য। তাকে পরপারে পাঠানোর মাধ্যমে মাফিয়া কিংডমে প্রবেশ হয় তৃষ্ণার।

    কোনো একদিন নেশাদ্রব্য পাচারের সময় আরহান, তৃষ্ণার গ্যাংকে ধরে ফেলে। এই থেকে শুরু হয় শত্রুতা।

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    অতীতের পৃষ্ঠায় চোখ বুলিয়ে নিয়ে তৃষ্ণা এখন হাঁপাচ্ছে । বড্ড ভয়ংকর ছিলো তার কাছে, নিজের মম-ড্যাডকে ওমন অবস্থায় দেখা। তৃষ্ণা পাশ থেকে একটা ছুরি নিয়ে, ফ্রেমের বা পাশে, ওর মমের ছবিতে আঘাত করে। ফ্রেমের কাঁচ ভেঙ্গে যায়। ঐ কাঁচের উপর দিয়ে তৃষ্ণা ওর মমের মুখশ্রীতে হাত বুলায়। ভাঙ্গা কাঁচ হাতে লাগায়, রক্ত বের হয়ে ছবিতে, তানিয়ার মুখের উপর লাগে। তৃষ্ণার ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে হাতে। এর চেয়েও অধিক যন্ত্রণা অনুভূত হচ্ছে বুকে। তৃষ্ণা হাসলো।

    উচ্চস্বরে হেসে বললো,“আমার সব কিছু ছিনিয়ে নিলে তুমি মম। তুমি খুনি। শুধু ড্যাডের না। আমার সুখের ও। তাই তোমার মুখের উপর এই রঙটা খুব মানায়। এটাই মানায় তোমার সাথে।”

    ____________________________

    “সত্যি ভালোবাসো আমায়?”

    আরহানের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শুনে খেয়ালে এলো আমি কি বলেছি। এতক্ষণ আরহানের কথায় কষ্ট লাগলেও এখন লজ্জা লাগছে। এভাবে কিভাবে বলে দিতে পারলাম?

    লজ্জায় ইতিমধ্যে আমার গালে রক্তিম আভা ছেয়ে গিয়েছে। প্রসঙ্গ এড়াতে অন্য কিছু বলা সম্ভব না এখন। তাই সম্পূর্ণ আরহানকে এড়াতেই প্রস্থান করার সিদ্ধান্ত নিলাম।

    ভাবনা মাফিক যেতে নিলেই, আরহান আমার হাত ধরে টেনে পুনরায় নিজের সামনে দাঁড় করালেন।

    “শুকতারা? ডু ইউ লাভ মি? সিরিয়াসলি?”

    আরহানের কণ্ঠস্বর শুনে বোঝা যাচ্ছে, উনি চমকেছেন। পুনরায় মুখশ্রী ভাব গম্ভীর করে বললেন,“তৃষ্ণার হাত থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যে বলেছিলে নাকি?”

    আমার এতক্ষণের লাজুক ভাবটাও উনার মুখশ্রীর সঙ্গে পাল্টে গেলো। উনি ভুল বুঝছেন তো। আমি ভালোবাসি উনাকে। কিন্তু মুখ ফুঁটে বলবো কি করে?

    আরহান পুনরায় বললেন,“জানো আমার অবস্থা কি হয়ে গিয়েছিলো? একেতো আমি এই শহরে ছিলাম না। তার উপর রাতে ওরকম একটা ঘটনা। মাথা নস্ট হয়ে গিয়েছিলো আমার। কিভাবে যে পুরোটা পথ এসেছি আমি, তোমাকে বোঝাতে পারবো না। আমার সব লোক লাগিয়ে তোমাকে খুঁজেছি। কিন্তু…. আই এম সরি শুকতারা। আমার আরো সতর্ক হওয়া উচিত ছিলো।”

    মিনিট খানেক আরহানকে দেখে আমি উনার হাতের বন্ধন থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। বেড সাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা নোট প্যাড আর একটা কলম নিয়ে কিছু লিখলাম। এরপর আরহানের হাতে দিয়ে দ্রুত পায়ে রুম ত্যাগ করলাম।

    আরহান কাগজের লেখা গুলো পড়ে হাসলেন। প্রাপ্তির এক হাসি হাসলেন।

    সেখানে লেখা ছিলো,“আপনাকে ভালোবাসি কি না বলতে পারবো না। শুধু বলতে পারবো‚ আমার কাছে ভালোবাসার সংজ্ঞা মানেই আপনি।”

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    ________________________

    এতো দিন অনেক খোঁজ করার পর অবশেষে আরহান তাকে পেলো। মাত্র রুদ্রের কল আসায় আরহান রুদ্রের বলা এড্রেসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। এই চারদিন সিলেটে ছিলো আরহান। সিলেটে যাবার মূল উদ্দেশ্য সেই মানুষটাই ছিলো।

    অতঃপর রুদ্রের বলা এড্রেসের সামনে পৌঁছতেই আরহান চোখ দুটো বড় বড় করে ফেলে। কারণ সে এখন ‘টি এস ইন্ডাস্ট্রিজ’ এর মেইন অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

    দ্রুত পায়ে অফিসের ভেতরে ঢুকলো। গার্ডস এতে কোনো ঝামেলা করেনি। কারণ সে এখানে ‘দ্যা মাফিয়া কিং এ.এ.কে’ নামে আসেনি। এসেছে আরহান পরিচয়ে।

    ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে আরহান মনে মনে বললো,“পৃথিবী আসলেই গোল। যাকে এতদিন ধরে এতো দূর দূরান্তে খুঁজে এলাম, সে আমার কাছাকাছিই ছিলো।”

    ভেতরে ঢুকে একজনকে জিজ্ঞেস করলো,“মিসেস শেফালী আহমেদ এর কেবিন কোনটা?”

    লোকটি বললো,“ম্যামের কেবিন, থার্ড ফ্লোরের একদম শেষের দিকে।”

    আরহান আবারও সেদিকে গেলো। কেবিনের সামনে পৌঁছিয়ে ডোর নক করতেই ওপাশ থেকে “কাম” বলায়, আরহান প্রবেশ করলো।

    একটা আধ বয়স্ক মহিলা বসে বসে কিছু ফাইলস চেক করছে। আরহান এগিয়ে গিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পড়লো।

    মহিলাটি একবার আরহানের দিকে তাকিয়ে পুনরায় নিজের কাজে মনোযোগী হয়ে বললো,“কি প্রয়োজন?”

    “আপনাকে।”

    “কেনো?”

    “অতীত জানতে চাই।”

    মহিলাটি থমকে গেলো। হুট করেই মাথার ভেতর পুরনো সব ঘটনা এসে জড়ো হয়। আরহানের দিকে চোখ তুলে তাকায়। এবার আর চোখ সরায়না।

    জিজ্ঞেস করলো, “আপনাকে কেনো বলতে যাবো?”

    “অতীত যখন বর্তমান নষ্ট করতে আসে, তখন সেই অতীতকে আগে নষ্ট করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন সেই অতীত জানা। তাই এসেছি।”

    আরহানের কথায় মহিলাটি কেমন যেনো হাসফাঁস করা শুরু করলো। ভেবেছিলো তার অতীতের সমাপ্তি সেখানেই হয়েছে। কিন্তু না, সে আবারও তার দরজায় করাঘাত করলো।

    “আমি আপনাকে কিছু বলতে বাধ্য নই।”

    আরহান জানতো, এতো ইজিলি সবটা জানতে পারবে না। তাই বিদ্রুপ স্বরে বললো, “মেয়ে বেঁচে আছে নাকি মরে গিয়েছে, এটা জানতে চান না?”

    “মানে?”

    মহিলাটির সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করা প্রশ্নে আরহান হাসলো। ঠোঁটের হাসির রেখা বিদ্যমান রেখেই বললো,“আগে আপনি বলুন। এরপর আমি বলছি..”

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৯)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৯)

    সকালের মৃদু আলো চোখে পড়তেই পিটপিট করে চোখ খুললাম। মাথা ভার লাগছে ভীষণ। কিছুক্ষণ বসে থাকতেই হুট করেই মনে পড়লো কাল রাতের কথা। লোকটা আরহানের কথা বলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করিয়েছে। শেষবার যখন জিজ্ঞেস করলাম,“কি হচ্ছে এটা?”

    লোকটা বাঁকা হেসে “ধোঁকা” বলেই আমার মুখের সামনে কিছু একটা স্প্রে করলো। এরপর… এরপর কি হয়েছিলো? উফফ! মনে পড়ছে না কেনো?

    তখনই রুমে প্রবেশ করলো একটা মহিলা। আমাকে বললো,“ম্যাম! আপনি উঠে পড়েছেন? ফ্রেশ হয়ে নিচে চলুন ব্রেকফাস্ট করতে। স্যার ডেকেছেন।”

    মহিলাটি এই বাড়ির মেইড হবে হয়তো। কেনো যেনো প্রচুর রাগ হচ্ছে। তবুও শান্ত কন্ঠে বললাম,“আপনার স্যারকে ডাকুন।”

    মহিলাটি “আচ্ছা” বলেই সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

    কিছুক্ষণ বাদেই রুম নক করার সাউন্ড পেলাম। ততক্ষণে আমি বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়েছি। ওপাশের লোকটি ভেতরে ঢুকতেই আমি তাকালাম।

    নীলাভ চক্ষু দ্বয়ের এই সুদর্শন পুরুষকে দেখতেই মনে পড়লো ভার্সিটির নবীন বরণের দিনের কথা। মনে পড়ে গেলো, সেদিন রুদ্রের সাথে আরহানের সেই কথাগুলো। চোখ দুটো বড় বড় করে মুখ ফুটে উচ্চারণ করলাম,“তৃষ্ণা!”

    তৃষ্ণা মাথা নিচু করে হালকা হাসলো। এরপর বললো,“ইয়াহ! আই এম।”

    হুট করেই রাগ এবং বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে এলো আমার। সাথে ভয়ের সংমিশ্রণ আছেই। আমাকে ধোঁকা দিয়ে তুলে আনলো! কিছু করবে না তো আবার!

    “দ’দেখুন! আপনি আমাকে এখানে এনেছেন কেনো?”

    তৃষ্ণার সহজসরল স্বীকারোক্তি,“ভালোবাসি তাই..”

    ভয় ক্রমশ বেড়েই চলেছে। তবুও নিজেকে শান্ত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে বলে উঠলাম,“ভালো হচ্ছে না, আরহান জানতে পারলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে।”

    ডোন্ট কেয়ার ভাবে জবাব দিলো,“আপনাকে অনেক ভালোবাসি আমি। আরহান আপনাকে ভালোবাসে কি না জানিনা, তবে আপনাকে আমার মতো এতো ভালোবাসতে পারবে না কেউ।”

    আমি ভালোবাসায় বড্ড ভয় পাই। এর চেয়ে সুখের কিছু নেই, আবার এর চেয়ে যন্ত্রণার কিছু হতে পারে না। এর চেয়ে বড় পুরষ্কার কেউ পায়নি। এর চেয়ে ধারালো অস্ত্র এখনও তৈরি হয়নি। হালকা আওয়াজে বললাম,“যেতে দিন আমাকে।”

    “কিন্তু কেনো?”

    “কারণ আমি আপনাকে ভালোবাসি না।”

    “আপনি শুধু পাশে থাকবেন, আমার একার ভালোবাসাই আমাদের দুজনের জন্য যথেষ্ট।”

    “পাগল হয়ে গিয়েছেন আপনি? আমি বললাম তো ভালোবাসি না আপনাকে।”

    তৃষ্ণার কণ্ঠস্বর হঠাৎ পরিবর্তন হলো। মাঝে তীব্র এক রাগের আভাস পাওয়া গেলো। বললো,“আমাকে মেনে নিলে সমস্যা কি? বারবার বলছি তো, আপনাকে ভালোবাসি আমি।”

    আমি ভীত হয়ে বললাম,“আরহানের সাথে আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে,এটা জানেন?”

    তৃষ্ণা একই কন্ঠে রাগের তেজ বাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ! ও সবসময় আমার সব কিছু ছিনিয়ে নিতে চায়, আমাকে হারাতে চায়। এজন্যই আপনাকে বিয়ে করেছে। কিন্তু আমি আরহানের কাছে হারতে পারলেও, আপনাকে হারাতে রাজি নই নয়নতারা।”

    “ভুল। উনি আপনার কাছ থেকে আমাকে ছিনিয়ে নিতে চায়নি। বরং আপনার কাছ থেকে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছে। আপনি তো সেদিন প্রথম দেখলেন আমাকে। আর আরহান! সে দুই বছর আগে থেকেই ভালোবাসে আমাকে।”

    তৃষ্ণার কপাল কুঁচকে এলো। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে জোরপূর্বক হেসে বললো,“সে বাসুক। আপনি তো বাসেন না। তাই না? আর আপনার বিয়ে হয়েছে তো কি হয়েছে? বাচ্চার মা হলেও আমার আপনাকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই।”

    “আপনি ভুল করছেন।”

    “ভালোবাসা যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে আমি এমন সহস্র ভুল করতে রাজি আছি।”

    স্থির চাহনি ফ্লোরে নিক্ষেপ করে বললাম,“আমি আরহানকে ভালোবাসি।”

    কিভাবে বললাম জানিনা। তবে, বলে ফেললাম। আর অনুভব করলাম, এটা সত্যি।

    সামনে তৃষ্ণার নীল চক্ষুর দিকে তাকাতেই বুঝতে পারলাম, তৃষ্ণা এরকম কথার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বললো,“সে ইট এগেইন…”

    এতক্ষণের ভয় ভীতি সব ভুলে পুনরায় বললাম,“ভালোবাসি আরহানকে।”

    গম্ভীর তৃষ্ণার মুখশ্রী রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো। দুই হাত দিয়ে নিজের মাথার চুল গুলো খামচে ধরে মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বুলি আওড়ালো, “শিট! এবারও… এবারও…”

    চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো। মিনিট পাঁচেক পর চোখ খুললো। যেনো এই পাঁচ মিনিটে পুরনো অনেক কিছু কল্পনা করে নিলো।

    আমার দিকে তাকালো তৃষ্ণা। এগিয়ে এলো খানিকটা। আমি দূরত্ব বজায় রাখতে সঙ্গে সঙ্গে পিছিয়ে গেলাম।

    আমার এমন করা দেখে তৃষ্ণা নিজেও দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে দুই হাত হালকা সামনে তুলে বললো,“ভয় পাবেন না। আমি কাছে আসছি না।”

    শান্ত কন্ঠে এরকম কথায় ভয় কমলো। তবে গেলো না।

    তৃষ্ণা পুনরায় বললো,“কিছু বলতে চাই। আই প্রমিজ, এটাই শেষ বার।”

    আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে তৃষ্ণা আমার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নজর ফ্লোরেই সীমাবদ্ধ রেখেই বললো, “জীবন আমাকে কিছু দিতে পারেনি। আমার পাওয়া জিনিসগুলো ছিনিয়েই নিয়েছে শুধু। তন্মধ্যে সবচেয়ে আকাঙ্খিত আপনি। জীবন সেই আপনিটাকেই আমার হতে দিলো না। এর জন্য রয়েছে শুধুই আফসোস!”

    তৃষ্ণা হাঁটু মুড়ে আমার সামনে ফ্লোরে বসে পড়লো। নজর ফ্লোরেই সীমাবদ্ধ রেখে বললো,“আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি। আমার মিথ্যায় ঘেরা জীবনের একটি মাত্র সত্যি, আপনাকে ভালোবাসি।”

    আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি। তৃষ্ণা পকেট থেকে ফোন বের করে কাকে যেনো কল দিয়ে বললো,“ম্যামকে বাড়ি দিয়ে এসো।”

    এরপর আমার দিকে তাকালো। এই চোখে অনেক কিছু আছে। যা আমাকে কিছু বলতে চায়। কিন্তু, আমি জানতে চাই না।

    তখন তৃষ্ণা হালকা হাসলো। বড্ড অদ্ভুত এক হাসি ছিলো। বললো,“বাইরে গাড়ি রাখা আছে। আমার লোক, আপনাকে সেইফলি আপনার বাড়ি দিয়ে আসবে।”

    আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম না। পাশেই আমার ফোন রাখা ছিলো। নিয়ে জলদি বেরিয়ে পড়লাম।

    ___________________

    বাড়ি ফিরতে ফিরতে তখন বেলা এগারোটা বেজে গেলো। বাড়িতে আমাকে ঢুকতে দেখেই মা পা জোড়া গতিশীল করে এগিয়ে এলেন। আপাদমস্তক দেখে জড়িয়ে ধরলেন আমাকে।

    এরপর আমাকে ছেড়ে কান্নাভেজা কন্ঠে বললেন,“তুই কোথায় চলে গিয়েছিলি? ঠিক আছিস মা? আরহান তোকে বাড়ি থেকে বেরোতে না করে দিয়েছিলো না? কেনো গিয়েছিলি?”

    মুহূর্তেই আরহানের কথা মাথায় আসায় জিজ্ঞেস করলাম,“আমি তো ঠিক আছি। তবে আরহান! উনি কোথায়?”

    “তোকে খুঁজতে বেরিয়েছে।” —বলেই মা উচ্চকন্ঠে নিশাকে ডাকলেন। নিশা এসে আমাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো।

    কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“ভাবি! কোথায় ছিলে তুমি? জানো ভাইয়া তোমাকে খুঁজতে খুঁজতেই পাগল হয়ে গিয়েছে। এতোটা কাতর অবস্থায় ভাইয়াকে কখনো দেখিনি।”

    মা নিশাকে বললেন,“আরহানকে কল দিয়ে বল, বীনি বাড়ি ফিরেছে।”

    নিশা তখনই আরহানকে কল দিলো।

    নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে নিলাম। মাথাটা ব্যাথা করছে। হঠাৎ সেখানে আরহান প্রবেশ করলেন। দ্রুত পায়ে আমার কাছে এগিয়ে এসে তড়িৎ গতিতে জড়িয়ে ধরলেন। অপ্রস্তুত আমি এখন আরহানের বুকে। উনার হৃদস্পন্দন শুনতে পাচ্ছি। হৃদপিন্ড অনেক দ্রুত স্পন্দিত হচ্ছে। যেখানে আমার হৃদযন্ত্র থমকে গিয়েছে।

    “এখন… এখন আমি বেঁচে গেলাম। আরেকটু হলে, সত্যিই মরে যেতাম।”

    কাতর ও অস্থির কণ্ঠস্বর আরহানের। বুকটা ধুক করে উঠলো। সত্যি তো! আরহান আমাকে অনেক খুঁজেছেন। উনার এই অস্থিরতা তো আমারই জন্য।

    মিনিট দশেক পর আমাকে ছাড়লেন। এতক্ষণ মুখ লুকোনো থাকলেও, এখন চেহারায় লজ্জার রেশ ফুটে উঠেছে। আরহান আমার এই লাজে রাঙা মুখের পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,“না করেছিলাম না? বাড়ি থেকে বেরোতে নিষেধ করেছিলাম না? কেনো বেরোলে?”

    চকিতে চাইলাম আরহানের পানে। আরহান আমার সাথে কখনোই রাগ দেখাননি। আজ প্রথম উনার কন্ঠে এমন তেজ লক্ষ্য করাতে স্থির নয়নে তাকিয়ে রয়েছি। এতে আরহানের রাগ বাড়লো বৈ কমলো না। আমার দুই বাহুতে ঝাঁকিয়ে বললো,“কিছু জিজ্ঞেস করেছি না? আজ যদি ঐ তৃষ্ণা কিছু করে দিতো?”

    কেঁপে উঠলাম। সাথে ভয় ও পেয়ে গেলাম। এই আরহানকে চিনিনা আমি।

    “স্পিক আপ..”

    আবারও কেঁপে উঠলাম। আরহান এই রাগ নিয়ে কখনো কথা বলেননি আমার সাথে। তাই আর সময় অপচয় না করে ব্যক্ত করলাম,“তৃষ্ণা বলেছিলো আপনার ক্ষতি করে দিবে। এজন্য গিয়েছিলাম।”

    “আর তাই তুমি বিশ্বাস করে নিলে? এতোটা গাঁধা কী করে হলে? বাড়িতে কাউকে না বলে চলে গেলে!”

    আমি অশ্রুসজল নেত্রে চেয়ে রইলাম। কী করে ভাবতাম তখন অতো কিছু? তৃষ্ণা যে আরহানের ক্ষতির কথা বলছিলো।

    আরহান কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করলেন। বেড সাইড টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে খেলেন।

    হুট করেই আরহান তাকালেন আমার দিকে। চাহনিতে অন্য কিছু রয়েছে।

    অবাক স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,“আমার ক্ষতি করে দেবে বলে তুমি গিয়েছিলে?”

    “হুঁ..”

    “কেনো?”

    আমিতো এখনও আরহানের নতুন রূপ দেখতে পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে আছি। তাই অতো কিছু না ভেবে উত্তর করে যাচ্ছি। কিন্তু শেষের এই ‘কেনো’ টা আমাকে বোঝালো আরহান আমার মুখ থেকে কথা বের করতে চাচ্ছে।

    আমি চুপ হয়ে গেলাম।

    আরহান পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন,“তৃষ্ণার কাছ থেকে পালিয়ে আসলে কী করে? যতদূর ওকে চিনি, ওর হাত থেকে পালানো অসম্ভব।”

    “পালাইনি।”

    আরহান সজোরে বলে উঠলেন, “হোয়াট?”

    কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় বললেন,“না পালালে এলে কি করে? এখন আবার এটা বলো না যে তৃষ্ণা নিজেই তোমাকে ফেরত পাঠিয়েছে। কারণ এটা সম্ভব নয়।”

    “তৃষ্ণা নিজেই আমাকে ফেরত পাঠিয়েছে।”

    আরহান অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বললেন,“ইম্পসিবল….”

    “জানিনা আমি কিছুই। তবে আমার কোনো ক্ষতি করেননি উনি। ইন ফ্যাক্ট আমার হাত অবদি ছুঁয়ে দেখেননি। সকালে জ্ঞান ফিরতেই তৃষ্ণা আমাকে বলে, উনি আমাকে ভালোবাসেন….”

    “এক মিনিট! তৃষ্ণা তোমাকে ভালোবাসে?”

    “উনি তো তাই বললেন।”

    আরহান কপালে হাত রেখে আস্তে বুলি আওড়ালেন, “ওহ্ গড! সেই আগে থেকেই ওর কেনো আমার জিনিসটাই পছন্দ হওয়া লাগে!

    আরহান আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,“ভালোবাসে! তাহলে তোমাকে ছেড়ে দিলো কেনো?”

    “কারণ আমি বলেছি, আমি উনাকে ভালোবাসি না।”

    “শুধু এজন্যেই ছেড়ে দিলো?”

    “নাহ্!”

    “তবে?”

    “আমি বলে দিয়েছি,‘আমি আরহানকে ভালোবাসি’। তাই ছেড়ে দিলো।”

    “সত্যি ভালোবাসো আমায়?”

    আরহানের বিস্মিত কণ্ঠস্বর শুনে খেয়ালে এলো আমি কী বলেছি।

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৮)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-১৮)

    সকালে ফোনের কলিং টিউনে ঘুম ভেংগে যায় আমার। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আননৌন নাম্বার থেকে একটা কল এসছে। এতো সকালে আমাকে কে কল দেবে?

    কৌতুহল নিয়ে ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ ভেসে এলো, “স’সরি বীনু। রিয়েলি ভেরি সরি।”

    কান্না ভেজা কণ্ঠস্বরটা চিনতে আমার বিন্দু মাত্র সমস্যা হয়নি। এটা রুশী। মনের মাঝে অনেকগুলো প্রশ্ন চলে এলো। সেদিনের ব্যবহার, রাগ, কথা না বলা এসব কি ছিলো?

    আমার কিছু বলার আগেই রুশী কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলো,“আমাকে মাফ করে দে বীনু। তিন মাস আগে আমার লাইফ পুরোটা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গিয়েছে রে। আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”

    সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত এই খবরটা শুনে মুহূর্তেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম আমি। কি বলছে রুশী এটা! বিয়ে? তবে অয়ন কোথায় আছে? অয়ন না ওকে ভালোবাসতো! রুশীও তো অয়নকে ভালোবাসে।

    “কি হয়েছে, খুলে বল।”

    রুশী একে একে সব কথা খুলে বললো। অয়নকে ছেড়ে চলে আসা, মারুফকে বিয়ে করা পর্যন্ত সবটা বললো। আমি নিশ্চুপ থেকে রুশীর কথা শুনলাম। নিজেকে দায়ী মনে হচ্ছে এসবের জন্য। কেনো সেদিন ওর পাশে ছিলাম না আমি?

    আমার নিস্তব্ধতার মাঝেই রুশী বলে উঠলো,, আ’ আমি প্রেগন্যান্ট বীনু।”

    অবাক হলাম না। বিয়ে হয়েছে, প্রেগন্যান্ট হওয়াটা স্বাভাবিক। অবাক হলে বরং ব্যাপারটা অস্বাভাবিক লাগতো। খুব করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছে,‘সেদিন বলেছিলাম, দেরি হয়ে যাবে। শুনলি না আমার কথা।’ কিন্তু এটা বলা যাবে না এখন। মেয়েটা অনেক বাজে একটা পরিস্থিতির মধ্যে আছে।

    তাই বললাম,“বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে তোর, তার উপর তুই মা হতে চলেছিস। যদি ব্যাপারটা শুধু বিয়ে অবদিই থাকতো, তবে আমি যে করেই হোক, তোকে ডিভোর্স দিইয়ে অয়নের কাছে দিয়ে আসতাম। কিন্তু, তোর বাচ্চা! ও তো কোনো দোষ করেনি তাইনা? দেখ, আমি জোর করছি না। জাস্ট বলছি তোকে। পারলে নিজেকে এই সংসারেই গুছিয়ে নে। আর কারো জন্য না হলেও, তোর সন্তানের জন্য নতুন একটা জীবন শুরু কর।”

    তারপর আরো কিছুক্ষণ কথা হলো রুশীর সাথে। অয়নের এভাবে হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো আমার কাছে।

    এখন, একসাথে কাটানো সেই দিনগুলোর কথা মনে হচ্ছে খুব। অয়ন যখন ক্যাম্পাসের পেছনের ঐ বকুল ফুল গাছতলায় বসে গান গাইতো, তখন রুশী কেমন মুগ্ধ নজরে দেখে যেতো! আর অয়নের অব্যক্ত সকল কথার ভীড়ে একটা এটাও ছিলো,“রুশী! আমার সব গান তোকে ডেডিকেট করে গাই আমি।”

    আচ্ছা! সবাই তো সত্যিকারের ভালোবাসতে পারেনা। তবে যারা পারে, তাদের ভালোবাসা কেনো পূর্ণতা পায় না? অয়ন, রুশীকে কতটা ভালোবাসতো তা আমি জানি। আমি এ ও জানি, রুশী ওকে কতোটা ভালোবাসতো। ওদের একসাথে কাটানো প্রতিটি স্মৃতির সাক্ষী আমি নিজেই। ভাগ্য এরকম নিষ্ঠুরতা না দেখালেও পারতো।

    ________________________

    নিজ বাড়িতে চিন্তিত তৃষ্ণা একাকী বসে রয়েছে তৃষ্ণা। তার নয়নতারাকে এখনও খুঁজে চলছে। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার আরহানের বাড়িতেও খোঁজ করেছে। কিন্তু টাইট সিকিউরিটির দরুন পারেনি। এখন তৃষ্ণার আরো বেশি সন্দেহ হচ্ছে ঐ বাড়ি নিয়ে। হয়তো সেখানেই আছে তার নয়নতারা।

    ভালো লাগছে না তৃষ্ণার কিছু। এতো অপূর্ণতা নিয়ে একটা মানুষ কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে?

    কিছুক্ষণ বাদে তৃষ্ণার নম্বরে তার একটা লোকের কল এলো। রিসিভ করতেই বললো,“বস! আপনি ঠিকই ধরেছেন। ম্যাম ওখানেই আছে। কিন্তু…”

    “কি?”

    “ঐ বাড়িতে যাওয়া অসম্ভব।”

    তৃষ্ণা কিছু একটা ভাবলো। তৃষ্ণাকে চুপ থাকতে দেখে, ফোনের ওপাশের ব্যক্তি বলে উঠলো,“এবার কি করবো স্যার?”

    “অনেক কিছুই করবো। আমরা যেতে পারবো না, তবে কাউকে বাড়ি থেকে বের করা অতোটাও কঠিন হবে না।”

    কথাটা বলে বাঁকা হাসলো তৃষ্ণা। খুব জলদি তার নয়নতারাকে পেয়ে যাবে।

    কল কেটে দিয়ে বললো,“আপনাকে আমি শুধু পছন্দ করি না, শুধু মায়ায় জড়াইনি। ভালোবেসেছি আপনাকে। অন্যরকম ভালোবেসেছি। যেই ভালোবাসায়, আমি দৃষ্টিহীন হয়ে গেলেও, চোখের ক্যানভাসে আপনি থাকবেন। আমার হৃদ স্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলেও, হৃদযন্ত্রে আপনারই বসত থাকবে। যেই ভালোবাসায়, এই তৃষ্ণা নিঃস্ব হয়ে গেলেও, তার একমাত্র সম্বলে, তার কল্পনায় আপনার অস্তিত্ব প্রতি ক্ষণে অনুভূত হবে। আমি আপনাকে সেই রকম ভালোবাসি নয়নতারা।”

    তৃষ্ণা থেমে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ রইলো। মন থেকে যা চেয়েছে তৃষ্ণা, তা কি আদৌ পেয়েছে? হঠাৎ অস্থির হয়ে গেলো। কাতর কণ্ঠস্বরে শুধালো,“আপনাকে পাবো তো? আমি নিজের পছন্দের সবকিছু ছিনিয়ে নিতে জানি। বাই হুক অর বাই ক্রুক। কিন্তু…. আমি আপনাকে নিয়ে কোনো গেইম খেলতে পারবো না।”

    _________________

    গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে আমি নিজ রুমে বসে আছি। ভাবনাটা অবশ্যই আরহানকে ঘিরেই। অবশেষে উনার দুদিন পূর্ণ হলো। আজ আসবেন। আমি অভিমান নিয়েই উনার অপেক্ষায় বসে আছি। এতো অভিমান কখনো কারো প্রতি আসেনি আমার।

    ফোনে আচমকা মেসেজের শব্দ একটু ঘাবড়ে গেলাম। হাতে নিয়ে দেখি আরহানের মেসেজ,“কি করো?”

    আমি লিখে দিলাম,“কিছু না।”

    ওপাশ থেকে আবারও মেসেজ এলো,“মন খারাপ?”

    “জানিনা..”

    “রাগ করেছো?”

    “না…”

    “অভিমান?”

    “হুঁ”

    আরহান খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে আবারও মেসেজ পাঠালেন,“তবে তো হয়েই গেলো।”

    ভ্রু কুচকে ফেললাম। কী হলো আবার? জিজ্ঞেস করলাম,“কী?”

    “ভালোবাসা….”

    “কিভাবে?”

    “ভালো না বাসলে অভিমান আসে না।”

    মেসেজটা দেখার সাথে সাথেই আমার হৃদস্পন্দন পরপর কয়েকটা মিস করে আবারও অস্বাভাবিক হারে বাড়তে লাগলো। কেমন যেনো লাগছে আমার! আমি গভীর ভাবনায় পড়ে গেলাম। সত্যি কি তাই? আরহানের শেষ মেসেজের আর কোনো প্রতিউত্তর করলাম না। ফোন রেখে দিলাম। ব্যালকনিতে গিয়ে এই গোধূলি বেলাটা উপভোগ করতে চাচ্ছি। কিন্তু আরহানের শেষ কথাটায় আর এদিকে মন দিতে পারছি না। আমি কি সত্যি উনাকে ভালো বেসে ফেলেছি?

    অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে না বিধায়,নিশার রুমে চলে এলাম।

    ডোর নক করতেই নিশা খুলে দিলো। মিষ্টি হেসে বললো,“আরে ভাবি তুমি! আমি মাত্রই তোমার কাছে যাচ্ছিলাম। ভালো হলো এসেছো। ভেতরে এসো।”

    আমি এগিয়ে গিয়ে বসলাম। হঠাৎ মনে হলো, আজ নিশার সাথে সরাসরি এই বিষয়ে কথা বলা প্রয়োজন।

    নিশা আমার পাশে বসতেই জিজ্ঞেস করলাম,“ভালোবাসার মানে কী তোমার কাছে নিশা?”

    আমার হুট করে এভাবে করা প্রশ্নে নিশা খানিকটা বিস্মিত হলো।

    “হঠাৎ এটা জিজ্ঞেস করছো যে!”

    “আহা! বলো না!”

    “আচ্ছা। বলছি।”

    “হুঁ”

    “প্রথম দেখায় যদি কাউকে দেখে জানার আগ্রহ জন্মায়, এরপর তার সম্পর্কে এ টু জেড জেনে যখন বিশ্বাস-অবিশ্বাস নামক শব্দগুলো চলে আসে, ধীরে ধীরে তার প্রতি মায়া কাজ করা শুরু করে, তাকে নিজের কাছাকাছি দেখলে শান্তি অনুভূত হয়ে, অন্য কারো পাশে দেখলে বুকে যন্ত্রণা হয়, সারাজীবন নিজের করে না পেলেও চোখের সামনে দেখার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়, তবে এই অনুভূতি গুলোর নামই হচ্ছে ভালোবাসা।”

    ভালোবাসা! তাই কি! নিশা এখন ভালোবাসার গভীর খেয়ালে ডুবে আছে। হয়তো ভাবছে তার ভালোবাসার মানুষটির ভালোবাসা নিয়েই। জিজ্ঞেস করে বসলাম,“কাউকে ভালোবেসেছো?”

    বেখেয়ালি নিশা ভুলে বলে ফেলে, “হ্যাঁ। ভীষণ ভালো বেসেছি।”

    পরক্ষণেই নিশার খেয়ালে এলো, ও কি বলেছে। তাই সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্ত করলো,“ইয়ে মানে না।”

    আমি হাসলাম। নিশার চিবুকে হাত রেখে বললাম,“রুদ্র ভাইয়াকে কতটা ভালোবাসো?”

    নিশা চমকালো। মুখশ্রীতেই ওর চমকের রেশ ফুটে উঠেছে। আমি আবারও মুচকি হাসলাম।

    নিশা কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,“তাকে ভালোবাসতে বাসতে দুনিয়া থমকে যাবে, তবুও তৃষ্ণা মিটবে না।”

    ________________________

    অস্থির হয়ে নিজের রুমে পায়চারি করছি। আরহানকে কল দিচ্ছি, রিসিভ করছেন না। একটু আগেই আমার নম্বরে মেসেজ এলো,“আরহানকে বাঁচাতে চাইলে ***ঠিকানায় চলে আসুন।”

    জাস্ট এই একটা মেসেজ। এই একটা মেসেজে আমার শ্বাস আটকে ফেলতে সক্ষম। অনেকক্ষণ ধরে আরহানের নম্বরে ট্রাই করেই যাচ্ছি।

    পুনরায় সেই নম্বর থেকে আবারও মেসেজ এলো,“আরহানকে মেরে দেবো?”

    সাথে সাথে রিপ্লাই করলাম,“নাহ্! আসছি আমি।”

    আবারো মেসেজ এলো,“একা আসবেন, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাঁচ মিনিট দূরত্বে আমার গাড়ি আছে, ওটাতে চলে আসবেন। আর খবরদার, কাউকে জানালে কিন্তু আরহান যাবে…..”

    মাথায় আর কোনো কিছু না এনে এভাবেই বেরিয়ে পড়লাম। এতোটা অস্থির কখনো লাগেনি আমার।

    বেরোনোর সময় মা, নিশা দুজনেই নিজের রুমে থাকায় আমাকে কেউ দেখেনি। তবে বিপত্তি বাঁধলো গেইটের কাছে এসে। গার্ড আমাকে বের হতেই দিচ্ছে না। সামনের একজন বললো,“ম্যাম! স্যার আপনাকে বাহিরে যেতে না করেছেন। আপনার কিছু প্রয়োজন হলে, আমাদের বলুন।”

    এদের কিভাবে বলি! যেতে হবে আমার। আমার আরহান বিপদে আছে

    আরহানের যদি কিছু হয়ে যায়! কম্পিত কন্ঠে বললাম,“আ’আমাকে যেতে দিন। আরহান ন’নিজেই যেতে বলেছে।”

    তাও আমাকে যেতে দিচ্ছে না উনারা। প্রচুর বিরক্তি নিয়ে উনাদের চাকরির হুমকি দিয়ে বের হলাম। বের হতে অবশ্য অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে। কিন্তু এখন আমার মূল লক্ষ্য আরহান।

    অতিরিক্ত টেনশনে থাকায় আমার মাথায় পেইন শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছুদূর যেতেই, ফাঁকা রাস্তায় একটা ব্ল্যাক মাইক্রো দেখে এগিয়ে গেলাম। আমি যেতেই দরজা খুলে গেলো। পেছনে একজন বসা আছে, আমাকে ইশারা করলো তার পাশে বসতে। এগিয়ে গিয়ে সেখানে বসে পাশের লোকটিকে অবলোকন করে নিলাম। সম্পূর্ণ কালো পোশাক পরা, মুখ গ্লাস-মাস্ক দিয়ে ঢাকা। আমাকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই লোকটি মাস্ক খুললো।

    অস্থির আমি, আরহানের চিন্তায় অবস্থা নাজেহাল হয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম,“আরহান কোথায় আছে?”

    তখনই আমার ফোন বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখি আরহান কল দিয়েছেন। কপাল কুঁচকে এলো। রিসিভ করতেই পাশের লোকটি ফোন নিয়ে লাউডস্পিকারে দিলো।

    আরহানের চিন্তিত কণ্ঠস্বরে শোনা গেলো,“কি হয়েছে? এতো কল দিয়েছো যে? আমি ফোনের কাছে ছিলাম না তখন। তুমি ঠিক আছো তো?”

    পাশের লোকটি “এখন থেকে ঠিক থাকবে”—বলে কল কেটে দিয়ে ফোন সুইচ অফ করে দিলো।

    আমি বড়বড় চোখ করে এই লোকটির দিকে তাকালাম। হালকা চেনা চেনা ঠেকলো। ততক্ষণে গাড়ি চলা শুরু হয়ে গিয়েছে।

    রেগে চিল্লিয়ে বললাম,”কী হচ্ছে এটা?”

    লোকটি বাঁকা হেসে বললো,“ধোঁকা…”

    চলবে…