Tag: গল্প

  • আমি উৎকোচ—আমার ডাক নাম ঘুষ

    আমি উৎকোচ—আমার ডাক নাম ঘুষ

    কবি কাব্য করিয়া উচ্চারণ করিয়াছেন, মেঘের অনেক রং।

    আমি কবি নহি।

    তবু, কবির কন্ঠে কন্ঠ মিলাইয়া বলিতে হইতেছে, আমার অনেক নাম।

    আমার চলাফেরা, আমার অস্তিত্ব সারা পৃথিবী জুড়িয়া।

    আমি মনুষ্য জাতি কর্তৃক কৃত নিতান্তই ক্ষুদ্র একটি কর্ম।

    আরো পরিষ্কার করিয়া বলিলে বলিতে হয়, আমি মনুষ্যজাতি দ্বারা সম্পাদিত আনন্দ,সুখ,শান্তি প্রদানকারী একটি কর্ম মাত্র।

    আমার সংস্পর্শে একবার যে আসিয়াছে, কেবল সেই-ই জানে, আমার সান্নিধ্য কত মধুর, কত আনন্দময়। তবু, একদল মানুষ আমাকে সহ্য করিতে পারে না।

    তাহারা আয়োজন করিয়া যাহা নহে তাহাই বলিয়া আমাকে গালমন্দ করিয়া থাকে। এমনকি, যাহাদের সুখের জন্য আমি আমার সমস্ত অমিয় সুধা দান করিয়া একা সমস্ত কলঙ্কের বোঝা নিজ স্কন্ধে লইয়া নীলকণ্ঠ হইয়াছি, তাহারাও আমার নিন্দায় মুখর হইয়া থাকে।

    বাঙলাদেশের মতো দেশগুলিতে যে কোনো, বিশেষ করিয়া সরকারী কাজ সুসম্পন্ন করিবার জন্য আমি অত্যাবশ্যকীয়। যে কোনো অফিস হইতে যে কোনো বৈধতার জন্য আমাকে অবৈধভাবে ব্যবহার করা হইতেছে।

    ভূমি অফিসের কোনো দলিল বা সনদপত্র প্রয়োজন, আমাকে ব্যবহার করুন, চব্বিশ হইতে আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে হাতে চলিয়া আসিবে। গ্যাস, বিদুৎ বা জলের সংযোগ দ্রুত দরকার, আমাকে ব্যবহার করুন, মনে হইবে আলাদিনের চেরাগ হইতে স্বয়ং জ্বীন নির্গত হইয়া কাজটি সম্পাদন করিয়াছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য হইতে শুরু করিয়া সর্বত্র আমার সচ্ছন্দ বিচরণ। তবু, এক শ্রেণীর তথাকথিত সুশীল সমাজের মানুষ আমার বিরুদ্ধে সর্বদাই খড়্গহস্ত।

    আমার দুঃখ রাখিবার কোন স্থান নাই। আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন হইতে যে গভীর বেদনা সঞ্চিত করিয়া রাখিয়াছি, অদ্য তাহাই প্রকাশ করিবার প্রয়াসী হইয়াছি।

    পূর্বেই বলিয়াছি, আমার নিজস্ব কোন অস্তিত্ব নাই।

    মানুষের কর্মেই আমার প্রকাশ, আমার অস্তিত্ব।

    সারা পৃথিবী জুড়িয়া মানুষ বিভিন্ন জাতি ও ভাষায় বিভক্ত। আমাকেও বিভিন্ন জাতের মানুষ তাহাদের নিজস্ব ভাষায় আমাকে আহ্বান করিয়া থাকে।

    বাংলা ভাষায় আমার একটি ডাকনাম আছে, আরেকটি ভালো অর্থাৎ পোশাকী নাম আছে।

    আমার ডাকনাম হইলো ‘ঘুষ’। এই নামে আমাকে বাংলাভাষী শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধর্ম বর্ণ লিঙ্গ ভেদে সকলেই ডাকিয়া থাকে। ইহা অনেকটা বাঙালির ‘খোকা’ ‘পটলা’ ‘বাবু’ প্রভৃতি নামের মতোই বড়ই আদরের।

    তবে, যথেচ্ছাচার ব্যবহারে ইহার যে সৌন্দর্য, মাধুর্য তাহা অনেকটাই বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। তবুও, মাতা যখন তাঁহার আদরের সন্তানকে ‘খোকা’ বলিয়া ডাকিয়া উঠেন, তাহা যেমন স্নেহরসে উথলাইয়া উঠে, ক্ষমতার উচ্চশিখরে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাদের ডাকেও সেই তুলনাহীন মাধুর্য এখনও সরবে এবং সগৌরবে উপস্থিত আছে। তাহার মিষ্টতা দুষ্টু লোকেরা নষ্ট করিতে পারে নাই।

    এই বিষয়ে যে কথাটি না বলিলে বাঙালি জাতির প্রতি অন্যায় করা হইবে, তাহা এই যে, ‘ঘুষ’ শব্দটি আদৌ বাংলা শব্দ নহে। ইহা হিন্দি শব্দ।

    আবার, আমার যে পোশাকী ভালো ভদ্রজনোচিত নামটি রহিয়াছে, তাহা হইলো ‘উৎকোচ’। আমার এই নামটি সাধারণতঃ বুদ্ধিজীবী মহলে, কোন শীতাতপনিয়ন্ত্রিত পঞ্চ তারকা বিশিষ্ট পান্থশালায় যখন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়, তখন এই নাম উচ্চারণ করিয়া আমার বিরুদ্ধে যারপরনাই বিষোদগারের স্রোত বহাইয়া দেওয়া হইয়া থাকে।

    অবশ্য ইহাতে অদ্যাবধি আমার কোন ক্ষতি হয় নাই। তবে, আমি যেহেতু সহজ সরল, তাই মনে অনেক ব্যথা অনুভব করি।

    তাই তো অদ্য আমার প্রাণের ভিতরে সঞ্চিত ব্যথা বেদনার কথা প্রকাশ করিতে উদ্যোগী হইয়াছি।

    আমি আবারও জোরালো কন্ঠে বলিতেছি, ঘুষের মতো আমার পোশাকী নাম এই ‘উৎকোচ’ শব্দটিও বাংলা নহে। ইহা সংস্কৃত ভাষা হইতে উদগত হইয়াছে।

    আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটাইতে গিয়া অহেতুক বাঙালি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উপর যে কলঙ্ক কালিমা লেপনের চেষ্টা চলিতেছে, তাহা নিতান্তই দুঃখজনক।

    আমি, উৎকোচ ওরফে ঘুষ, এই ফেসবুকের মাধ্যমে ইহার তীব্র প্রতিবাদ করিতেছি। এই প্রতিবাদ না করায়, কিছু তথাকথিত ‘উন্নত’ দেশে আমাকে বিভিন্ন ভাবে বিকশিত হইতে না দিয়া পঙ্গু করিয়া রাখা হইয়াছে। অনেক দেশে আমাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হইয়াছে। অনেক দেশে আমি বিলুপ্তির পথে। তবে, বাঙলাদেশের মতো অনেক দেশেই আমি সগৌরবে বিরাজমান। তৃতীয় বিশ্বের মহান বিপ্লবী ও সংগ্রামী মানুষেরাই আমাকে অদ্যাবধি সযত্নে লালন পালন করিয়া আসিতেছে। আমি তাহাদের উপর যারপরনাই কৃতজ্ঞ।

    আমাকে ঘুষ অথবা উৎকোচ, যে নামেই ডাকা হউক না কেন, আমার সমস্ত শরীর মধুময়।

    আমার শরীরে চর্ম, মাংস, হাড় বলিয়া কিছুই নাই। মহান সৃষ্টিকর্তা আমাকে মধুর ন্যায় এক প্রকার ঘন অর্ধ তরল বস্তুর মধ্যে অসীম জীবনী শক্তি দিয়া সৃষ্টি করিয়াছেন।

    বিজ্ঞানীরা অনুমান করিয়া থাকেন, সূর্যের পৃষ্ঠদেশের তাপমাত্রা ৫,৬০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু, আমাকে কতো ডিগ্রি তাপমাত্রায় নিক্ষেপ করিলে আমি বিনাশ হইবো, তাহা অনুমান করিবার মতো বুদ্ধি তাহাদের অদ্যাবধি হয় নাই। ইহার জন্য আমি আমার স্রষ্টার কাছে সব সময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিয়া আসিতেছি।

    সারা দুনিয়া জুড়িয়া যার যার নিজস্ব ভাষায় আমার নামকরণ করিয়া আমাকে সাফল্যজনকভাবে ব্যবহার করিয়া আসিতেছি।

    আমার বক্তব্যের স্বপক্ষে প্রমাণ স্বরূপ বিভিন্ন ভাষায় আমার বিভিন্ন নাম আপনাদের সদয় অবগতির জন্য পেশ করিতেছিঃ

    ইংরেজিঃ ব্রাইব,

    ফ্রেঞ্চঃ পোঁত দ্য ভিন,

    ইতালিয়ানঃ কোরোমপেরে,

    জার্মানঃ বেশটেখুং,

    স্প্যানিশঃ সোবোরনো,

    আরবীঃ রাশুয়া,

    উর্দুঃ রিশোয়াত।

    এতো কথা বলিলাম এই জন্য যে, এই পলি বিধৌত উর্বর বঙ্গভুমি হইতে আমাকে উৎখাত করিবার জন্য একদল সজ্জন ব্যক্তি নিরন্তর চেষ্টা করিয়া যাইতেছেন। তাঁহাদের নিকট আমার সনির্বন্ধ নিবেদন, তাঁহারা যেন এ প্রচেষ্টা হইতে নিজেদের নিবৃত্ত রাখেন।

    কারণ, সারা পৃথিবী জুড়িয়াই আমার অস্তিত্ব বিরাজমান। এই দেশের মানুষ সম্পূর্ণ নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ।

    বাংলা ভাষায় আমার নাম পর্যন্ত নাই।

    সুতরাং, আমার জন্য এই সমস্ত বঙ্গ সন্তানদের দায়ী করা মোটেই সমীচীন নহে।

    পরিশেষে, আমার বিনীত নিবেদন এই যে, মহান সৃষ্টিকর্তা আপনাদিগকে আরও অনেক কাজ করিবার অভিপ্রায়ে এই সুন্দর পৃথিবীতে আনয়ন করিয়াছেন। আপনারা সেই সমস্ত কাজে মনোনিবেশ করুন। অহেতুক আমাকে গালিগালাজ করিয়া আপনাদের সুনাম নষ্ট করিবেন না।

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৩২)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৩২)

    “ভাবি! কেমন আছো?”

    কারো মিষ্টি কন্ঠের সুপরিচিত ডাক শুনে ঠোঁটে হাসির রেখা প্রশস্ত করে পিছু মুড়লাম। নিশার মায়াবী মুখশ্রী দেখতেই আমি প্রশ্ন তুললাম,“এতক্ষণে এলে? আসতে এতো দেরি হলো যে?”

    নিশা তার উঁচু পেট হাতে চেপে এগিয়ে এলো এদিকে। আমি ওকে নিয়ে বসিয়ে দিলাম বিছানায়। নিজেও সামনে বসলাম।

    আমার দিকে তাকিয়ে নিশা বললো,“রুদ্র ভীষণ ব্যস্ত গো। ভাইয়ার কিছু কাজের জন্য শহরের বাইরে গেছে। একা ছিলাম তো, এজন্য আসতে দেরি হলো।”

    “সে কি! একা এলে কেনো? আমাকে বলতে। আমি নিয়ে আসতাম।”

    “আমার আসতে কোনো সমস্যা হয়নি ভাবী।”

    “কিন্তু… আচ্ছা রুদ্র ভাইয়া আসবে না?”

    “চলে আসবে সন্ধ্যার আগেই।”

    “আচ্ছা! এখন এটা বলো তো! রুদ্র ভাইয়াকে তোমার সেই ‘ভালোবাসি না, একটুও না’ বলে অত্যাচার করাটা কি এখনও চলছে?”

    নিশা হাসলো। অনেক গুলো মাস সময়ের সাথে পেরিয়েছে। আমাদের সেই পিচ্চি নিশাও মা হতে চলেছে। নয় মাস চলছে। আর আমার সোনার আজ জন্মদিন।

    নিশা জিজ্ঞেস করলো,“আমার কিটিক্যাট কই ভাবি?”

    নিশার কথার প্রেক্ষিতে হাসলাম আমি। আমার সোনাকে নিশা আদর করে ‘কিটিক্যাট’ বলে ডাকে। বিড়ালের বাচ্চার মতো দেখতে হয়েছিলো বলেই নিশার এই উদ্ভট নামের আবিষ্কার। বড্ড আদুরে একটা নাম।

    আমি নিশাকে বললাম,“তোমার ভাইয়ের সাথে আছে।”

    “আচ্ছা! ভাবি!”

    “হুম, বলো।”

    “নাহ্, কিছুনা।”

    আমি জোর করলাম বলতে,“কিছু তো অবশ্যই। বলে ফেলো।”

    “আমার কয়েকদিন ধরে ভীষণ অস্বস্তি লাগছে ভাবি।”

    “কীরকম?”

    “জানিনা। বুঝতে পারিনা। খারাপ লাগে ভীষণ।”

    “ওগুলো কিছু না। প্রেগন্যান্সিতে এরকম হয়। স্বাভাবিক এটা।”

    নিশা মিহি হেসে বললো,“আমার কাছে এটা স্বাভাবিক লাগছে না কেনো ভাবি?”

    “বেশি চিন্তা করছো তুমি। দেখবে, সব ভালোয় ভালোয় হয়ে যাবে।”

    “হুম। তাই যেনো হয়।” —কথাটি বলে, একটু থেমেই আবারও আমাকে ডাকলো, “ভাবি?

    “হ্যাঁ!”

    “আমার কিছু হয়ে গেলে…”

    কথাটি শেষ করতে না দিয়েই বললাম,“বেশি বকছো কিন্তু এবার।”

    নিশা মাথা নিচু করে ফেললো। পেটের উপরে হাত বুলিয়ে নিলো। এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করলো,“আমার অবর্তমানে আমার বাচ্চা একা হয়ে যাবে, তাইনা?”

    আমি বুঝতে পারলাম। আমারও ডেলিভারির আগে এরকম অনেক বাজে চিন্তা মাথায় এসেছিলো। হয়তো ওরও তাই হয়েছে। তাই শান্ত থাকলাম।

    নিশা আবারও বললো,“আচ্ছা, আমি না থাকলে যদি রুদ্র বিয়ে করে নেয়? হাজার হোক, পুরুষ মানুষ তো! স্ত্রীর প্রয়োজন আছে তার সংসারে। আমার বাচ্চা সেখানে ভালো থাকবে তো?”

    মুচকি হেসে বললাম,“কিছু হবে না তোমার। আর তোমার বাচ্চা কখনো একা হবে না। তুমি আছো, আমি আছি। আর সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তোমার কিটিক্যাট আছে।”

    নিশা এখনও উদাস মনে নিজের পেটের দিকে চেয়ে আছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। যেনো কোনো বাচ্চার গায়ে হাত বুলিয়ে তাকে ঘুম পাড়াচ্ছে।

    নিশা ওভাবে তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো, “ভাবি! আমার কি রুদ্রকে বলে দেওয়া উচিত? অনেক তো অভিমানে ছিলাম।”

    আমি নিশার কথা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “কী বলা উচিত?”

    নিশা হেসে বললো,“এই-ই যে! তাকে ভালোবাসি।”

    “হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।”

    নিশা আমার দিকে তাকালো অনেকক্ষণ বাদে। নিজের নিচের ঠোঁট কামড়ে কিছুক্ষণ ভেবে বললো,“তাহলে, কালই বলবো।”

    তখন সেখানে আসলেন আরহান। আমি তাকে দেখে এগিয়ে গেলাম। আরহানের কোল থেকে আমার ঘুমন্ত বাচ্চাটাকে নিজের কোলে জড়িয়ে নিলাম। আরহান মুচকি হেসে এগিয়ে গিয়ে নিশার পাশে বসলেন।

    জিজ্ঞেস করলেন,“কেমন আছো?”

    “ভালো আছি ভাইয়া। তুমি?”

    “ভালো।”

    আর কোনো কথা নেই। আরহান বরাবরই বাকি সবার সাথে কম কথা বলেন। এটা নতুন না। তখনই নিহান আমার কোল থেকে নড়ে চড়ে উঠে কেঁদে দিলো। ছেলের নাম, আরহান ‘নিহান’ রেখেছেন। আমাদের দুজনের নামের সাথে মিলিয়ে।

    এদিকে আমার বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো। সে কী কান্না! অনেক চেষ্টা করছি থামানোর। কিন্তু কে থামে!

    নিশা একটু কষ্ট করে উঠে এলো আমার কাছে। এগিয়ে এসে আমার কোলে থেকেই নিহানকে কান্না থামানোর জন্য বিভিন্ন অদ্ভুত বাক্য, শব্দ উচ্চারণ করতে লাগলো। আর এটা কাজে লেগেও গেলো। কান্না থামিয়ে দু’গাল ভরে হেসে দিলো। দন্তহীন এই হাসিটা ভীষণ সুন্দর!

    নিশা ওভাবেই বললো,“আমার কিটিক্যাট কিন্তু ভীষণ পাজি হয়ে যাচ্ছে।”

    নিহান বুঝলো কি না জানিনা। তবে খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। অস্পষ্ট স্বরে আধো আধো বুলিতে বললো,“মা,মানি, মাম্মানি, মাইই।”

    আমি মুচকি হাসলাম। আমার বাচ্চাটা কী সুন্দর ডাকে! এই বয়সে, কিছু ডাক শিখেছে। যেমন: পাপা,মাম্মা, দাদ্দি, মাম্মানি, মানি, মা, মাই সহ আরো বিভিন্ন শব্দ উচ্চারণ করে, যা একদম অস্পষ্ট। কেটে কুটে কিছু শব্দ বুঝে নিয়েছি।

    _____________________

    সন্ধ্যায় বাড়িতে অনুষ্ঠান। সাজানো হয়েছে ভীষণ সুন্দর ভাবে। নিহানকে দীপ্তির কাছে রেখে আমি রান্নার দিকটা সামলাচ্ছি। আজ অনেকদিন বাদে এলাম রান্না করতে। ছেলের প্রথম জন্মদিন বলে কথা। নিজে না রান্না করলে হয়?

    বাড়িতে আত্মীয়-স্বজনদের অনেকেই এসেছে। তাদের বাচ্চা কাচ্চা সব পুরো বাড়ি দৌঁড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

    কিচেন থেকে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, আরহানের মামাতো ভাইয়ের ছেলে মেয়েরা খেলছে। হুট করেই নজরে একটা সূক্ষ্ম জিনিস বিঁধলো। একটা মেয়ের হাতের জুসের গ্লাস থেকে অর্ধেকটা সিঁড়িতে পড়ে গিয়েছে।

    কেউ পড়ে যেতে পারে এতে। পাশে থেকে হালিমা খালাকে বললাম,“সিঁড়িতে না জুস পড়েছে। একটু ক্লিন করার ব্যবস্থা করুন।”

    “আচ্ছা, একটু পর করছি।”

    পুনরায় সবাই নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে নিজের উপর ভীষণ অবাক হই। কতোটা সাংসারিক হয়ে গিয়েছি আমি! ইশ!

    আরহান এলেন কিচেনে। হালিমা খালাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“গেস্টদের কী লাগবে, একটু দেখে আসুন।”

    হালিমা খালা নিঃশব্দে প্রস্থান করলো। আমি নিজের কাজ করে যাচ্ছি। আরহানকে যেতে না দেখে উনার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কী চাই?”

    “বউ চাই।”

    আরহানের সহজ সরল স্বীকারোক্তি শুনে আমি কপাল কুঁচকালাম। পরপরই হেসে দিলাম। এতে আরহান তেজী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“নিজের বউ চাই। এতে হাসির কী আছে?”

    “বা রে! হাসি পেলে হাসবো না। আপনি এভাবে বউ পাগল হয়ে যাবেন। এও দেখার ছিলো!”

    কথাটা বলে আবারও হেসে দিলাম। আরহান “হাসো হাসো! হাসতে থাকো। দিন আমারও আসবে।” বলেই প্রস্থান করলেন।

    আমি ওভাবেই হেসে যাচ্ছি। লোকটা এতটা ভালোবাসে আমাকে। বলার বাইরে। এইতো সেদিন। আমার লিভার পেইন উঠলো। আমি যতোটা না কষ্ট পেয়েছি, আরহান তার থেকে অনেকগুণ বেশি যন্ত্রণা অনুভব করেছে। সেদিন আরহানের চোখে দ্বিতীয়বার পানি দেখেছি। আমারও নিশার মতো বারবার মনে হচ্ছিলো, এইযে ওটিতে যাচ্ছি। ফিরতে পারবো তো? সেদিন আরহানকে নিষ্পলক দেখে গিয়েছি অনেকক্ষণ। মস্তিষ্কে একটা কথাই বিচরণ করেছিলো, আরহানকে আবার দেখতে পাবো তো! আমার না! উনাকে ছাড়তে ইচ্ছে হয়নি। একটুও না।

    হুট করেই কারো উচ্চকন্ঠে চিৎকারের আওয়াজে আমি চকিতে চাইলাম আওয়াজের উৎসের পানে। স্তব্ধ, হতবিহ্বল আমি ভয়ে জমে গেলাম। পুরো শরীরের লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো। হাতের, কাঁচের বাটিটা গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। বিকট আওয়াজে ভেঙ্গে গেলো। ততক্ষণে বাড়িশুদ্ধ মানুষ সিঁড়ির সামনে জড়ো হয়েছে।

    নিশা কিছুক্ষণ আগেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে গিয়ে পড়ে গিয়েছে। আরহান দ্রুত এগিয়ে গেলো। কোনোকিছু বুঝতে পারছে না। এতক্ষণে নিশার সাদা কুর্তিটা রক্তে রঞ্জিত হয়ে গিয়েছে। আমি এগিয়ে যেতেই আরহান, নিশাকে পাঁজা কোলে তুলে বাড়ির বাইরের দিকে অগ্রসর হলেন।

    এতক্ষণে মা কেঁদে কেটে অস্থির। নিহানকে দীপ্তির কাছে রেখে বাকিরা মিলে নিশাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।

    __________________________

    নিশাকে ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আরহান, আমি ও মা বাইরে পায়চারি করছি। রুদ্রকে খবর দেওয়া হয়েছে, রাস্তায় আছে।

    নিজেকে দোষী লাগছে। কেনো সিঁড়িতে পড়ে থাকা জুস মুছে দিলাম না? আজ গাড়িতে পুরোটা পথ নিশা উল্টা পাল্টা বলে এসেছে। সে বারবার বলছিলো,“আমার কিছু হয়ে গেলে,আমার বাচ্চাকে দেখে রেখো। রুদ্র কই? ও আসবে না? আমি দেখবো তো ওকে।”

    প্রচন্ড যন্ত্রণায় নিশা বারবার রুদ্রের নাম জপছিল। ওকে যখন ওটিতে নিয়ে যাওয়া হলো, ও যেতে চাচ্ছিলো না। চক্ষুদ্বয় চাতক পাখির ন্যায় রুদ্রের সন্ধ্যান করছিলো। কান্না করছিলো নিশা। কাঁদতে কাঁদতে শেষে একটা কথাই বলেছে,“ওকে আর দেখা হলো না আমার।”

    আরহানকে কখনো ভীত হতে দেখিনি আমি। তবে আজ…

    বন্ডে সাইনের সময় উনার হাত কাঁপছিলো। আজ ভীষন অস্থির লাগছে আরহানকে। নিশাকে ওটিতে ঢোকানোর পর থেকে হাঁসফাঁস করছেন আরহান। পুরো করিডোর পায়চারি করছেন। আর মা! উনিতো পূর্ব ভঙ্গিতে কেঁদেই চলেছেন।

    কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই একটা বেঞ্চিতে বসে পড়লো, আমার এক মা অন্য মাকে সামলাচ্ছে। অপেক্ষার প্রহর গুনছি সবাই আর সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করছি।

    দেখতে দেখতে দুই ঘন্টা পেরিয়ে গেলো। ভয়ে হাত পা শিরশির করছে। আজ যেই দুর্ঘটনা ঘটেছে, তাতে যেকোনো কিছু হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে। বারবার আজ সকালের কথা মনে পড়ছে। নিশার বলা সেই কথা গুলো। মেয়েটা বলছিলো, তার অস্থির লাগছে। আমাদের আরো সচেতন হওয়া উচিত ছিলো।

    আমার ভাবনার মাঝেই ওটির দরজা খুলে গেলো। উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রইলাম। ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার আওয়াজে সবার মুখে এক চিলতে হাসির দেখা মিললো। একটা নার্স বাচ্চাটিকে কোলে করে বেরিয়ে এলো।

    আরহান এগিয়ে গেলেন। নার্স, বাচ্চাটিকে আরহানের দিকে দিয়ে বললো,“মেয়ে হয়েছে।”

    আরহানের মুখের হাসি, আরো খানিকটা প্রশস্ত হলো। কিন্তু নার্সের বিষণ্ণ মুখ দেখে আরহানের হাসি থেমে গেলো। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সাহস যুগিয়ে নার্সকে জিজ্ঞেস করলাম,“পেশেন্ট? পেশেন্ট কেমন আছে?”

    নার্স মাথা নিচু করে রইলো। তখন ভেতর থেকে সিনিয়র ডাক্তার বেরিয়ে এলেন। আমাদের সবাইকে একবার দেখে নিলেন। অতঃপর মিহি কন্ঠে বললেন,“উই আর সরি।”

    আরহান কেঁপে উঠলেন। মা অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলেন। আমি স্তব্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছি। আরহান জিজ্ঞেস করলেন,“আর ইউ কিডিং মি?”

    “নো। অনেক ক্রিটিকাল একটা কেইস ছিলো। মা ও বেবির মাঝে যেকোনো একজনকে বাঁচানো যেতো। আমরা তখনই আপনাদের ইনফর্ম করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পেশেন্ট আমাদের রিকুয়েস্ট করলো, যাতে আপনাদের না জানাই, এবং বাচ্চাকে বাঁচাই। আমরা উনার কথা শুনতে চাইনি। কিন্তু.. শেষ মেষ উনার রিকুয়েস্ট এর জন্য বাধ্য হই।”

    আরহান একবার তার কোলে কান্না করতে থাকা বাচ্চা মেয়েটিকে দেখে নিলো। চোখের বাঁধ ভেঙে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছে আরহানের। পরপর এতো ধাক্কা উনার জন্য সহনীয় নয়।

    তখন সেখানে রুদ্র এলো। বড্ড এলোমেলো ও বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। ঘামে পরনের ব্লু শার্টটি শরীরের সাথে চিপকে আছে। আরহান মাথা নিচু করে আছে। রুদ্রের চোখে চোখ মেলাতে পারছে না। রুদ্র এগিয়ে এসে বললো,“আমার নিশা কোথায়?”

    আমরা সবাই পাথরের ন্যায় বসে আছি। রুদ্র আরহানের কোলে বাচ্চা দেখা মাত্রই দ্রুত এগিয়ে সেদিকে গেলো। বাচ্চাটিকে দেখতেই তার ঠোঁটে হাসির দেখা মিললো।

    মিষ্টি হেসে বললো, “মাশাআল্লাহ স্যার! একদম আমার নিশার কপি হয়েছে।”

    তখন অপারেশন থিয়েটার থেকে স্ট্রেচারে করে সাদা কাপড়ে ঢাকা নিশাকে আনা হলো। রুদ্র সেদিকে দেখেনি। আমাকে জিজ্ঞেস করলো,“ম্যাম! নিশা কোথায়? কেমন আছে ও? নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে জানেন? আমার নিশার সবচেয়ে কষ্টের টাইমে আমি ছিলাম না ওর পাশে। এই নিয়ে তো সারাজীবন খোটা দিতে ছাড়বে না।”

    কথাটি বলে রুদ্র হালকা হাসলো। আমি দুই হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে দিলাম। আমার কেনো যেনো নিশার চেয়ে বেশি রুদ্রের জন্য কষ্ট লাগছে। যে চলে গেলো, সে তো গেলোই। কিন্তু যে থেকে গেলো, অপূর্ণতাসহ এই কষ্ট নিয়েই বাকিটা জীবন থাকতে হবে।

    আমার কান্না দেখে রুদ্র কপাল কুঁচকে ফেললো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো, “ও.. ও ঠ..ঠিক আছে?”

    কাঁদতে কাঁদতে মাথা দুই পাশে নেড়ে ‘না’ বোঝালাম। রুদ্র দুই কদম সরে গেলো। কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় ও?”

    ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল, স্ট্রেচার বরাবর ইশারা করে বললাম,“ও.. ঐযে।”

    রুদ্র সাদা কাপড়ে মোড়ানো নিশাকে দেখে দৌঁড়িয়ে সেদিকে গেলো। কিছুটা সামনেই দাঁড়িয়ে গেলো। বার কয়েক হাত এগিয়ে মুখের সামনে থেকে কাপড় সরানোর প্রচেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। কিছুই পারছে না। কেনো পারছে না?

    অনেকক্ষণ বাদে পুনরায় নিশার দিকে হাত এগিয়ে দিলো। কম্পনরত হাত দিয়ে নিশার মুখের কাপড় সরিয়ে ফেললো। নিশার মায়াবী মুখশ্রী দেখতেই রুদ্রের পুরোনো স্মৃতি সব মনে পড়তে লাগলো।

    সেইযে প্রথম দেখা। যখন নিশা বাচ্চা ছিলো। রুদ্র ছিলো কিশোর। সেই কিশোর মনে ভালোলাগার বীজ বোপন করেছিলো নিশা নামক এই মায়াবিনী। সে মায়া তৈরি করেছিলো। ধীরে ধীরে সেই ভালোলাগা, ভালোবাসায় পরিণত হলো। কিন্তু সাধ্যের বাইরে ছিলো নিশা। পাবার আশা সেখানেই দাফন করে দিলো। তারপর একদিন ভালোবাসার মানুষটির চোখে নিজের জন্য অপেক্ষা দেখলো। তার ভালোবাসা পাবার আকাঙ্খা দেখলো। সেদিন রুদ্রের খুশির সীমা ছিলো না। কিন্তু মাঝে অনেক ভুল বোঝাবুঝি হলো। শেষ মেষ নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পেলো। কিন্তু সে শাস্তি দিয়েছে। ভালোবাসি বলেনি। কোনোদিনও ভালোবাসি বলেনি রুদ্রকে।

    হাত এগিয়ে নিশার গালে রাখলো রুদ্র। হেসে হেসে বললো, “এ..এই নিশা। নিশাপাখি আমার। উঠো না। এইযে এসে গেছি তো আমি। জানো, আমাদের বেবি একদম তোমার মত দেখতে হয়েছে। দেখবে না তুমি? এই নিশাপাখি। উঠো না সোনা। আই প্রমিজ, কোনোদিন জ্বালাবো না, বিরক্ত করবো না। প্লিজ উঠো। আচ্ছা, এরপর থেকে তোমার সিরিয়াল দেখার টাইমে খেলা দেখা নিয়ে ঝগড়া করবো না। রান্না যেমনই বানাও, খেয়ে নেবো। যখন যা বলবে, সব মানবো। তোমার সব কথা শুনবো পাখি। প্লিজ উঠে যাও। শাস্তি দিয়ো না আমাকে। আমি বাঁচতে পারবো না তোমাকে ছাড়া। নিশা…”

    কেঁদে দিলো রুদ্র। ছেলে মানুষের কাঁদতে নেই। কিন্তু রুদ্রের চিৎকারে আশে পাশের সব মানুষ ভিড় জমালো। কান্না করলো। মৃত নিশাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,“তোমাকে বলেছিলাম না? তোমাকে পাবার আশা রাখিনি। ছেড়ে যাওয়া সহ্য করতে পারবো না। এটা কেনো করলে? কেনো?”

    রুদ্র কাঁদতে লাগলো। কাঁদছি আমিও। মা সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে। একমাত্র মেয়ের এমন কিছু মানা তার জন্য সহজ না। আরহান যেভাবে ছিলো সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। আরহান সবার সাথে তেমন কথা বলতেন না। তবে আমি দেখেছি, সবার খেয়াল রাখতেন। সবসময়। নিজে না পারলে, আমাকে বলতেন। আর সবচেয়ে বেশি ভালবাসতেন নিজের আদরের বোনকে। লোক দেখানো ছিলো না সেই ভালোবাসা।

    আরহান বাচ্চাটিকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

    রুদ্র পাগলের মতো চিৎকার করে যাচ্ছে। তাকে থামানোর সাধ্য কারো নেই। কীভাবে থামাবে?

    একটা মানুষ ভালোবাসা না পেলে কষ্ট পায়। পেলে খুশি হয়। কিন্তু যে পেয়েও হারিয়ে ফেললো, সে?

    কাউকে না পেলে নিজের অবুঝ মনকে বোঝানো যায়, ‘হয়তো সে আমার না’। কিন্তু একবার তাকে পেয়ে যাবার পর, সে আসক্তি হয়ে যায়। এটা বড্ড অদ্ভুত আসক্তি।

    পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা তো কেবল সে-ই বোঝে, যে নিজের সবচেয়ে প্রিয় কাউকে নিজের করে পেয়েছে, এবং নিজ-চোখের সামনেই তার হারিয়ে যাওয়া দেখেছে। তাকে আমরা কেবল সমবেদনা জানাতে পারি। দম বন্ধকর কষ্ট তো সে-ই পাচ্ছে। ভালোবাসা কখনো হারায় না, তবে হারিয়ে যায় ভালোবাসার সেই প্রিয় মানুষটি। সকল হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার মানুষদের জন্য রয়েছে কেবল ‘দীর্ঘশ্বাস’। আর কিছুই তো করার নেই। অতঃপর তারা রয়ে যাক আজীবন, স্মৃতির পাতায় চোখ বুলিয়ে, বুক চিড়ে বেরিয়ে আসা এক দীর্ঘশ্বাস রূপে।

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৩১)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৩১)

    আয়নায় নিজের আট মাসের উঁচু পেটটা দেখলাম। কীভাবে যে সময় দৌঁড়ায়! সেদিনের শুকনো আমিটা আজ কেমন গলুমোলু হয়ে গিয়েছি। প্রেগন্যান্সির দরুন মুখের উজ্জ্বলতা বেড়েছে অনেক গুণ বেশি। চেহারায় সারাটা ক্ষণ একটা খুশির ঝলক থাকে।

    আজ ছয়মাস পার হলো। হুট করেই সেই ভয়ংকর রাতের কথা মাথায় চলে এলো। আমার উজ্জ্বল মুখশ্রীতে ঘন কালো আঁধার নেমে এলো। আজ তৃষ্ণার মৃত্যুর অর্ধবর্ষ পূর্ণ হলো। সেদিন তৃষ্ণার জন্য আমার ছটফটানির মানেটা বুঝতে অবশ্য আমার বেশ সময় লেগে গিয়েছিল।

    এতটা সময় নিয়ে জানতে পারলাম। একটা মেয়ে… মেয়েদের ব্যাপারটা বলছি, কারণ আমি মেয়ে। ছেলেদেরটা জানিনা। তো বলি, একটা মেয়ে যতই এক পুরুষে আসক্ত হোক না কেনো! যতই একজনকে ভালোবাসুক না কেনো! যখন সে জানবে তাকে কেউ মন থেকে ভালোবাসে; যদি সেই মেয়েটি ভালোবাসার মর্ম বুঝে থাকে, তবে সেই ছেলেটির প্রতি একটু হলেও দুর্বল হবে। এটাই স্বাভাবিক। হাজার হোক, সেই ছেলেটি তো তাকে ভালোবাসে।

    এমনটাই ঘটেছিলো আমার সাথে। তৃষ্ণা! নামটাতেই ছিলো অদ্ভুত এক তৃষ্ণা। যার নীলাভ চক্ষুদ্বয়ে ছিলো অতল দুঃখ-সাগরের গভীরতা। যেকোনো নারীকে ভাসাতে সক্ষম ছিলো সেই নয়ন জোড়া। সেই অধর যুগল ছিলো নেশাক্ত। হাজারো নারী সেই নেশাক্ত ওষ্ঠের হাসিতে মরতো। আর সেই পুরুষটি ছিলো এই আমিতে আসক্ত। তার অতীত নিয়ে ভাববো না। মানুষ ভুল পথে যায়। যেতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার না। তবে সবাই ভুল পথে চলতে চলতে ঠিক পথের সন্ধ্যান পায়না। তৃষ্ণা পেয়েছিলো। ভালো হতে চেয়েছিলো। সঠিক রাস্তা ধরলো। কিছুদূর এগোতেই, জীবন তার কাছ থেকে তার নিশ্বাস কেড়ে নিলো।

    তৃষ্ণার এভাবে মৃত্যুটা মেনে নেওয়া আমার জন্য সহজ ছিলো না। কেননা সে আমাকে বাঁচাতে চেয়েছিলো। সেদিন যে শুট করেছিলো, সে আমাকে মারার উদ্দেশ্যেই করেছিলো। তৃষ্ণা মরতে মরতে, আমাকে এই নতুন জীবন দিয়ে গেলো। আমি তার ঋণ শোধ করতে পারলাম না। সে মরতে মরতেও নিজের ভালোবাসাটা দেখিয়ে দিয়ে গেলো।

    একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। সময় অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। সেদিন আমাকে যে মারতে চেয়েছিলো, তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে এটুকু নিশ্চিত, আমাকে এতদিন যে মারতে চেয়েছিলো, এটা সে ই ছিলো। কিন্তু আমার উপর আর আক্রমণ হয়নি। পুরোপুরি নিরাপদ এখন আমি।

    এই ছয় মাসে আরো একটা ঘটনা ঘটেছে। মাহী মিসিং। বেচারীকে কোনোভাবেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই ছয় মাস সবাই হন্যে হয়ে খুঁজে চলেছে তাকে। পুলিশ দিনরাত তার খোঁজে লেগেই আছে। কোথাও নেই মাহী। ওদিকে লন্ডনে মাহীর মা-বাবার অবস্থা বেহাল। এক মেয়ে সুইসাইড করলো। আর অন্য মেয়ে লাপাত্তা।

    আয়নায় পুনরায় নিজেকে দেখে নিলাম। শাড়ি পরা এখন আমার জন্য একদম নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। পরনে ঢোলা ফ্রক। ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে বিরক্তিকর একটা চেহারা নিয়ে চিরুনিটা উঠিয়ে নিলাম। এখন খুব অলস হয়ে গিয়েছি আমি। একটা কাজ ও নিজে থেকে করতে ইচ্ছে করে না। সব কিছুতেই বিরক্তি লাগে। গাল দুটো ফুলিয়ে আবারও চিরুনিটা নিজের জায়গায় রেখে নিলাম। আঁচড়াবো না। ভালো লাগছে না। মানে, আলসেমি আর কি!

    হুট করেই কোত্থেকে যেনো আরহানের আগমন ঘটলো। মিষ্টি হেসে বললেন,“গুড মর্নিং। উঠে গেছো?”

    “হুম।”

    “ফ্রেশ হয়েছো?”

    “হুম।”

    “মনে মনে আমাকে বকছিলে?”

    “হুম। এই না।”

    আরহান হাসলেন। আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম,“আপনাকে বকতে পারি?”

    মুচকি হেসে বললেন, “টেন্সড তুমি?”

    “একটু।”

    “কী নিয়ে?”

    “ঐযে.. মাহী।”

    সঙ্গে সঙ্গে আরহানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। চোখ দুটো বন্ধ করে নিলেন। সেকেন্ড পাঁচেক পর চোখ খুলে ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি এনে বললেন,“খোঁজ চলছে তো। পেয়ে যাবে।”

    আমি তাকিয়ে রইলাম আরহানের দিকে। আরহান মিষ্টি হেসে, সামনের টুলের দিকে ইশারা করে বললেন,“বসে পড়েন এখানে।”

    অতঃপর আরহান আমার খোঁপা খুলে দিলেন। সামনের চিরুনি ও তেলের বোতল নিয়ে,চুলে তেল লাগিয়ে, আঁচড়িয়ে দিচ্ছেন। আমি স্থির দৃষ্টিতে আয়নায়, আরহানকে দেখে যাচ্ছি। সব শেষে উনি বিনুনী গেঁথে দিলেন। এগুলো আরহানের দৈনন্দিন রুটিনে এসে গিয়েছে।

    শেষ হতেই আরহান বললেন,“ডান। এবার আসো, ব্রেকফাস্ট করবো।”

    “হুম।”

    আমি উঠে দাঁড়াতে নিলেই পেটে হাত রেখে বসে পড়ি। মুখ দিয়ে “আহ্” শব্দ করি। আরহান অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করেন, “কী হয়েছে?”

    ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,“কিক দিয়েছে।”

    ___________________

    মুখে ঝিরিঝিরি পানির ফোঁটা পড়তেই ঘুম উবে যায় রুদ্রের। কপাল কুঁচকে ফেলে। অথচ অধর কোণে মিষ্টি হাসি। চক্ষুদ্বয় বন্ধ রেখেই বললো,“প্রতিদিন এভাবে ঘুম ভাঙানোটা কিন্তু দারুন লাগে।”

    নিশা মিষ্টি হেসে বললো,“আমারও।”

    ভেজা চুলগুলো মুছে টাওয়েলটা ব্যালকনিতে শুকাতে দিয়ে এলো। রুমে ফিরে দেখে, রুদ্র উঠে গিয়েছে। নিশা এগিয়ে গেলো রুদ্রের দিকে। রুদ্র নিশাকে জড়িয়ে ধরে বললো,“হ্যাপি সিক্সথ মান্থস অ্যানিভার্সেরি পিচ্চি।”

    নিশা মুচকি হাসলো। কিন্তু শেষের ‘পিচ্চি’ সম্বধনটা শুনতেই রুদ্রর বুকে থেকে মুখ তুলে বললো,“এই! আপনার এখনো আমাকে পিচ্চি লাগে? ক’দিন বাদে পিচ্চির মা হবো, আর আপনি!”

    রুদ্র হাসলো। বড্ড অদ্ভুত ভাবে হাসলো। চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে গেলো। চাপ দাঁড়ি বিশিষ্ট গাল দুটো অনেকখানি প্রসারিত হলো। অধর যুগল নেড়ে উচ্চারণ করলো,“ভালোবাসি।”

    প্রতিবারের মতো নিশার জবাব,“ভালোবাসি না। একটুও না।”

    এতেও রুদ্রের হাসির রেশ মাত্র কমেনি। ওভাবেই বললো,“আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসো আমাকে।”

    নিশা মাথা নিচু করে হেসে প্রস্থান করলো। এই ছয়মাসে লজ্জা, অভিমান, জড়তার মিশ্রণের ফলে নিশা, রুদ্রকে ‘ভালোবাসি’ কথাটি বলতে পারেনি। এরকমটা প্রায় অনেক সংসারে হয়। ভালোবাসা থাকলেও সেই ভালোবাসার কথা প্রকাশ হয়না অনেক সংসারেই। কিন্তু এদের টুনটুনির সংসারটা একটু ভিন্ন। রুদ্র ক্ষণে ক্ষণে ভালোবাসি বলেই যাচ্ছে। এদিকে নিশা, সে পারছে না। বলছে না। কিংবা চাইছে না বলতে।

    _________________

    “দীপ্তি! মা! আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও তোমাদের সাথে। এখানে থাকবো না আমি।”

    “কিন্তু কেনো?”

    মায়ের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম,“আমার মতো অবলা, নিরীহ মেয়ের প্রতি এভাবে অত্যাচার হচ্ছে এখানে।”

    মা আঁচলের কোণায় মুখ ঢেকে হাসলো। দীপ্তি ঠোঁট চেপে হাসি আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কিন্তু চেষ্টা তো ব্যর্থ! হলো না। ফিক করে হেসে দিলো দীপ্তি। এতে আমি আমার ফোলা গাল দুটো আরো খানিকটা ফুলিয়ে ফেললাম।

    আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আরহান এগুলোতে পাত্তা না দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাবে বললেন, “যতো যা’ই করো না কেনো, কোনো লাভ নেই। চুপচাপ খেয়ে নাও।”

    আমি পুনরায় আরহানের হাতের ফ্রুটসের প্লেটটা দেখলাম। এগুলো কি কম অত্যাচার? সেই শুরু থেকেই এরকমটা করে এসেছেন আমার সাথে। কোনরকমে খেতাম, বাকিটা ফেলে দিতাম। এখন সামনে বসে আছেন সবাই, আর আমাকে খেতে হবে।

    কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললাম, “প্লিইজ!”

    “কোনো কথা না। চুপচাপ খাও।”

    প্লেটটা নিয়ে মুখ ফুলিয়ে খাওয়া শুরু করে দিলাম। মা আর দীপ্তি মাঝে মাঝেই এই বাড়িতে আসে। আজও এসেছে। এখন জেদ ধরে বসেছি, আমি এখানে থাকবো না। কিন্তু একেতো আমার মা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে না, তার উপর আরহান আমাকে যেতে দেবে না। এরা কেউ আমার কথা শোনে না।

    ___________________

    গভীর নিস্তব্ধ রাত। আরহান আজ অনেক দিন বাদে, পুনরায় তার ফ্যাক্টরির পুরনো গোডাউনে পদার্পণ করলেন। বেশ অনেকগুলো কক্ষ আছে এখানে। তন্মধ্যে সর্বশেষ কক্ষটির অবস্থা সবচেয়ে নাজেহাল। অন্ধকারের গভীরতা সেখানে সবচেয়ে বেশি। আলোর রেশ মাত্র পৌঁছতে অক্ষম সেই কক্ষে। দেয়াল গুলো ক্ষয় হয়ে প্রায় ভেঙ্গে গিয়েছে। ধুলোবালির একটা আস্তানা।

    প্রবেশ পথে আরহানের সাথে তার বিশ্বস্ত কর্মচারী আবদুলের দেখা হয়। কালো রঙের হুডি, প্যান্ট, ক্যাপ, মাস্ক, গ্লাস, গ্লাভস, পরিহিত আরহানকে দেখে আবদুলের বুঝতে বেগ পোহাতে হয়নি যে এটা তার বস। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। মাস্ক ও গ্লাসের ভেতরে রয়েছে আরহানের গম্ভীর মুখশ্রী।

    আরহান রাগী কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “টেল মি অ্যাবাউট হার কন্ডিশন।”

    শান্ত, নিস্তব্ধ ফ্লোরে আরহানের ভারী কণ্ঠ দেয়ালে দেয়ালে বেজে উঠলো। গার্ডসরা সব সটাং মেরে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে গেলো। এক চুল নড়াচড়া বন্ধ তাদের।

    আবদুল মাথা নিচুরত অবস্থায় বলা শুরু করলো,“কোনো কথা বলেনা সে। আপনার কথা মতো দিনে এক বেলা খাবার দিচ্ছি মাত্র। তাও কোনো হেল-দোল নেই। চুপচাপ খেয়ে নেয়। এই মেয়ে একটা সাইকো স্যার।”

    “লাইট অন করে দাও।”

    আরহান ভীষণ শান্ত এখন। তার চেয়েও শান্ত তার কণ্ঠস্বর। হাতের ইশারায় আবদুলকে নিজের কাজে যেতে বলে গতিশীল পা জোড়া নিয়ে গেলো সোজা রাস্তায়, একদম শেষ কক্ষে। যেটা আঁধার। যেটায় এখন রয়েছে এই কাহিনীর সবচেয়ে গভীর সত্যিটা।

    কক্ষের প্রবেশ দোর খুলতেই একটা আওয়াজ তৈরি হলো দরজার দ্বারা। অন্ধকার কক্ষ মুহূর্তেই আলোকিত হয়ে গেলো। কক্ষের শেষ প্রান্তে, এক কোণায় হাঁটু মুড়ে বসে আছে একজন তরুণী। মাথা নিচু। কারো আসার আওয়াজ তার শ্রবণ ইন্দ্রীয় অবদি পৌঁছেছে, তবে সে তার মনে মাথা তুলে তাকানোর ইচ্ছে পোষণ করেনি। যেভাবে ছিলো, সেভাবেই বসে রইলো। আরহান তার সামনে গিয়ে কক্ষের মাঝ বরাবর রাখা চেয়ারে বসে পড়লো।

    শান্ত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,“কেনো করলে এমনটা?”

    চেনা কণ্ঠ পেয়ে মেয়েটি ফট করে মুখ তুললো। চুলগুলো জট বেঁধে আছে। পরনে ছয় মাস আগের সেই জামাটা প্রায় নষ্ট হয়ে, গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। সেই মিষ্টি চেহারাটা ভয়ংকর রকমের হয়ে আছে। চোখ দুটো লাল। গাল ভেঙ্গে এসেছে। পুরো শরীর ময়লার আবরণে ঢেকে আছে। বাজে একটা স্মেল আসছে তার দিক থেকে। জীর্ণশীর্ণ অবস্থা মাহীর।

    আরহান তাতে ভ্রুক্ষেপ না করে পুনরায় প্রশ্ন তুললো, “হুয়াই?”

    মাহী শান্ত। ভীষণ শান্ত। চোখ সরালো আরহানের পানে থেকে। ফ্লোরে দৃষ্টি রেখে মৃদু হাসলো। এরপর হাসির রেখা বড় করলো। হালকা শব্দ করে হাসলো। সেই শব্দ বাড়তে লাগলো। অতঃপর উচ্চ শব্দে হাসা শুরু করলো।

    আরহানের রাগ বাড়ছে। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“বলবে?”

    মাহী হাসি থামালো। হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফিসফিসিয়ে বললো,“তোমাকে বলতে পারি। কিন্তু প্রমিজ করতে হবে, কাউকে বলবে না।”

    মাহীর এমন বাচ্চামো স্বরে কথা শুনে আরহান ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। মাহী আবার বলা শুরু করলো,“আমি তো ঐ ছেলেকে মারতে চাইনি। ঐ মেয়েকে মারতে চেয়েছি। বীনি! বীনিকে মারতে চেয়েছি।”

    “এটা জানি। কিন্তু কেনো? ও তোমার ক্ষতি করেনি।”

    মাহীর মুখের হাসি উবে গেলো। চেহারায় ভয়ঙ্কর রাগের রেশ লক্ষ্য করা গেলো। তেজী কন্ঠে বললো,“করেছে। করেছে ও।”

    কথাটা বলে কেঁদে দিলো মাহী। কাঁদতে কাঁদতেই বললো, “ও আমার কাছ থেকে আমার প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।”

    আরহান ফট করে দাঁড়িয়ে গেলো। দ্রুত ও অস্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“প্রাণ কেড়ে নিয়েছে মানে?”

    “মানে ওর জন্যই তো আমি আমার আরহানকে পেলাম না।”

    “আমি কবে তোমার ছিলাম? কীসব বলছো?”

    মাহী কান্না থামিয়ে পুনরায় হেসে দিলো। হাসতে হাসতে বললো,“আরে বুদ্ধু। আমি তোমাকে কখন বললাম? আমি তো আমার প্রাণ, আমার আরহানের কথা বলছি।”

    “আমিই তো আরহান।”

    “এই পঁচা ছেলে! নিজেকে আমার আরহান বলছো কেনো? মেরে দেবো। একদম মেরে দেবো তোমাকে। সবার মতো।”

    কথাটা বলে মাহী তেড়ে আসলো আরহানের দিকে। আরহান সেকেন্ডের মাঝেই মাহীর সিচুয়েশন বুঝে নিয়েছে। তাই আর অপেক্ষা না করে বললো,“আমি মজা করছি। আমি আরহান নই।”

    এতে মাহীর রাগ না কমলেও শান্ত হয়েছে। আবারো নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো। কোণার সেই জায়গাটাতেই। জোড়ে জোড়ে কয়েকটা শ্বাস ছাড়লো। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো যে!

    আরহান এসব লক্ষ্য করে বুঝলো, মাহী মানসিক ভাবে অনেকটা অসুস্থ হয়ে আছে।

    মাহী ফ্লোরে তাকিয়ে নিচুকণ্ঠে বললো,“তুমি পঁচা। তোমাকে কিছু বলবো না।”

    আরহান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,“আরহানকে চাই?”

    মাহী চোখ তুলে আরহানকে দেখে বললো,“এনে দেবে ওকে?”

    “আগে বলো, কেনো এমনটা করলে?”

    মাহী আবারও হাসলো। হাসি যেনো থামছেই না। হাসতে হাসতেই বললো,“আরহানকে ভালোবাসি। সেই ছোট্ট থেকেই ভালোবাসি।”

    এরপর নিজের দুই হাত ছড়িয়ে বললো,“এত্ত গুলো ভালোবাসি।”

    আরহান অবিশ্বাস্য চাহনিতে মাহীকে দেখে যাচ্ছে। মাহী পুনরায় বলা শুরু করলো,“তারপর একদিন দিভাই আমাকে এসে বলে, সে নাকি আমার আরহানকে ভালোবাসে। সেদিন জানো? অনেক কেঁদেছিলাম। এরপর দেখি আমার আরহান ওকে পাত্তা দেয়না। সে কী খুশি আমার! সবসময় আরহানের ইচ্ছে মতোই থাকি। ওর না! বাঙালি কালচার পছন্দ খুব। এজন্য সবসময় সেভাবেই থাকতাম। এভাবেই চলছিল দিন। ভেবেছিলাম, মমকে বলবো, আমি আরহানকে বিয়ে করতে চাই। তারপর বিয়েও করে নেবো, কিন্তু!”

    মাহী থামলো। রাগে ওর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। দুই হাত এগিয়ে ফ্লোর খামচে ধরে বললো,“সেদিন দিভাই কল দিয়ে বললো, আমার আরহান নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে। আমি সহ্য করতে পারিনি। যেখানে,আরহানকে আমি আমার বোনকেও দিতে চাইনি, সেখানে অন্য কাউকে কিভাবে দেই? সেদিন দিভাইকে শুধু এটা কথাই বলেছিলাম,‘আরহানকে অন্য কারো হতে দেওয়ার মতো দয়ালু আমি নই’। এরপর যতো দ্রুত পেরেছি, বিডি ব্যাক করেছি। এসে দেখি দিভাই রেগে গিয়ে বললো,‘আমার আরহানকে নাকি শেষ করে দেবে’। ওকে থামানোর জন্য বুঝিয়েছি, আরহান অন্য কাউকে ভালোবাসে। তার সাথেই হ্যাপি থাকবে। ও যেনো এসব না ঢুকে। এতে আমার দুটো লাভ হয়েছে। একেতো দিভাই আমার রাস্তা থেকে সরলো, দ্বিতীয়ত আমার আরহানকে কিছু করবে না। তারপর আমি আরহান আর বীনিকে আলাদা করতে চাইলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম, ভুল বোঝাবুঝি ক্রিয়েট করবো। কিন্তু ওদের মধ্যেকার ভালোবাসা দেখে সেটার সম্ভাবনা পেলাম না। কিন্তু… আমার আরহানকে অন্য কাউকে কী করে দিয়ে দেই? অনেক প্ল্যান কষলাম, বীনিকে সরানোর। কিছু করার আগেই আমাকে লন্ডন ব্যাক করতে হলো, মম অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলো কি না!”

    কথাটা শেষ করে মাহী অদ্ভুত ভাবে হাসলো। এরপর বললো,“কিন্তু আমি দমে যাইনি। সেখানে থেকেও বীনির উপর নজর রেখেছি। ওকে মারার অনেক প্ল্যান করেছি। কিন্তু আমার আরহানটা ওকে এতো ভালোবাসতো! সব প্ল্যান ফেইল হয়ে যেতো।

    বীনির বাবা মারা গেলো যেদিন, সেদিনও আমার লোকই বীনির উপর অ্যাটাক করেছে। কিন্তু! আরহান বাঁচিয়ে নিলো আবার। সেদিন জানো? একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছিলো। অনেক বাজে ঘটনা। এমন ঘটনার জন্য অপ্রস্তুত ছিলাম আমি। শুনবে কি?”

    আরহান উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মাহী মুখে হাত রেখে ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, “দিভাই জেনে গেলো, আমি এসব করছি। দিভাই মুখে যতো যা’ই বলুক না কেন! কিছু করতে পারতো না। ভীতু ছিলো কি না! তাই তো আমাকে এসব করতে না করলো। আমি সেদিন উত্তেজিত হয়ে আমার আরহানের ব্যাপারে সব ফিলিংস জানিয়ে ফেলেছিলাম। এসব শুনে দিভাই আমাকে ঘৃণা করলো। এক প্রকার কথা কাটাকাটি চললো। সব মিটিয়েও নিয়েছিলাম। তারপর দেখি ও লুকিয়ে তোমাকে কল দিয়েছে। আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। শাস্তি তো পেতেই হতো। সে রাতে আবার মম-ড্যাড বাসায় ছিলো না। তাই….”

    মাহী উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। আরহান অবুঝ দৃষ্টিতে মাহীর পানে তাকিয়ে বললেন,“মেরে দিলে?”

    মাহী হাসি থামিয়ে বললো,“হ্যাঁ। আমাকে কেউ ধোঁকা দেবে, আর তাকে ছেড়ে দেবো? অনেক ঠান্ডা মাথায় ওকে খুন করতে হয়েছে। এমনিতে বিষন্নতায় ছিলো ও, তাই প্রি প্ল্যানড মার্ডারকে, সুইসাইড কেইস বানিয়ে ফেলতে বেগ পোহাতে হয়নি। তারপর এভাবেই চলছিলো। আবারো বীনিকে মারার জন্য আদা জল খেয়ে নেমে পড়লাম মাঠে। কিন্তু….যখন শুনলাম ও প্রেগন্যান্ট! আর পারলাম না। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। চলে এলাম। জুনিয়রকে নিয়ে খেলতেই। কিন্তু পারলাম কই? কোত্থেকে ঐ তৃষ্ণা বাঁচিয়ে দিলো। নয়তো আজ বীনি টপকে যেতো। আর আমার আরহানকেও আমি আবার পেয়ে যেতাম।”

    এসব শুনে আরহান শান্ত আছে। অতিরিক্ত রাগে তো আরহান অতীব মাত্রায় শান্ত হয়ে পড়ে। তেমনটাই হয়েছে। চোখ বন্ধ করলো। মাহী যেভাবে বসে ছিলো, সেভাবেই রইলো।

    আরহান উঠে দাঁড়ালো। চোয়াল শক্ত তার। অথচ মুখে হাসি। নম্র কন্ঠে মাহীর উদ্দেশ্যে বললেন,“ইউ ডোন্ট হ্যাভ দ্য রাইট টু লিভ।”

    “এই কই যাচ্ছো? আমার আরহানকে দিয়ে যাবে না?”

    নিঃশব্দে প্রস্থান ঘটালেন আরহান। গাড়িতে উঠে একজনকে কল দিলেন। ওপাশ থেকে কল রিসিভ করতেই আরহান বললেন,“গোডাউনে আগুন লাগিয়ে দাও।”

    “স্যার! ঐ মেয়েটা?”

    “পুড়ে যাক।”

    কল কেটে দিলো। আপনমনে বললেন,“আরহানকে ভালোবাসে! তাহলে পুড়তে থাকুক। যতো পুড়বে, ভালোবাসা খাঁটি হবে। আরহান আবার ভেজাল জিনিস পছন্দ করে না।”

    কথাটি বলেই বাঁকা হাসলেন। কাহিনীর সমাপ্তি নেই, তবে… এই গেইমের সমাপ্তি ঘটলো। কারণ, গেইমার নিজেই মরে গেলো।

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৩০)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-৩০)

    ঘরোয়া ভাবে বিয়ের কথা হলেও, পুরো বাড়ি আলোকসজ্জায় সজ্জিত হয়েছে। তেমন মানুষকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। এখানে থাকা আত্মীয়দের বলা হয়েছে। আর আমার মা ও দীপ্তিকে। আমার ভাবনায় একটা কথাই আসছে, উনাদের আত্মীয় এতো কেনো? পুরো বাড়ি মানুষে গিজগিজ করছে। আরহানের মেয়ে কাজিন এসেছে অনেকেই। তাদের কাজ একটাই, হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই তাকে নিয়ে নিজেদের মাঝে আলোচনা করা। রাত থেকেই তাদের এসব কার্যক্রম চালু আছে। কাল রাতেই এসেছে অনেকে।

    কিছুক্ষন বাদেই বিয়ে। তৈরি হয়ে নিচ্ছি। ম্যাজেন্টা কালারের একটা কাতান শাড়ি পরে নিলাম। সাথে গোল্ডের অর্নামেন্টস। চুলগুলো খোঁপা বেঁধে নিলাম। কাজল লাগানোর সময় আরহান ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমি আরহানকে একবার দেখে পুনরায় নিজ কার্যে মনোযোগী হলাম।

    “শাড়ি পরেছো কেনো?”

    আরহানের কথা কানে যেতেই কপাল কুঁচকে ফেললাম। শাড়ি পরেছি কেনো মানে? কী বলছেন উনি? বিয়ে বাড়ি, আর শাড়ি পরবো না?

    আমি বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলাম,“শাড়ি পরতে পারবো না?”

    আরহানের সোজা কথা,“না।”

    “কিন্তু কেনো?”

    “এই সময়ে শাড়ি পরা উচিত না তোমার। পড়ে গেলে?”

    “আরে! পড়বো না তো।”

    “দেখো! আমি এই রিস্ক নিতে পারবো না।”

    “এই! আর কোনো প্রেগন্যান্ট মহিলা শাড়ি পরে না?”

    “আবারও বলছি। সবাই তোমার মতো বউ পায়না। তোমাকে কোনোমতে হারা…”

    আরহান এটুকু বলে থেমে গেলেন।

    একটা শুকনো ঢোক গিলে বললেন,“তুমি অনেক আদুরে আমার কাছে। তোমার জন্য সবসময় এক্সট্রা কেয়ার থাকবে।”

    “আচ্ছা। আপনিতো আছেনই, আমাকে সামলানোর জন্য। কিছুই হবে না।”

    “কিন্তু, শাড়ি..”

    আমি আরহানের হাত ধরে অনুনয়ের সুরে বললাম, “প্লিইজ..”

    “আচ্ছা। তবে সারাক্ষণ আমার সাথেই থাকবে।”

    ______________________

    তৈরি হয়ে নিশার রুমে গেলাম। লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা পরিহিত নিশাকে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। তার মায়াবী মুখশ্রীতে আজ যেনো মায়া অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছে। কী সুন্দর লাগছে! পাশে পার্লারের কিছু মেয়েরা ওকে সাজিয়ে দিচ্ছে। আর কিছু কাজিনরা নিজেরা নিজেদের মতো সাজছে, গল্প করছে।

    আমি এগিয়ে গিয়ে নিশার পাশে দাঁড়ালাম। নিশা আমাকে ওর পাশে আসতে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। নিশার অধর কোণে হাসি দেখে আমারও ঠোঁটে হাসির রেখার দেখা মিললো। ভালোবাসাকে পূর্ণতা পেতে দেখা কতোটা শান্তির!

    তখনই অয়ন ও রুশীর কথা মনে পড়লো। সবকিছু ঠিক থাকলে এই পূর্ণতা ওদেরও ভালোবাসায় ও পেতো। মনটা বিষন্নতায় ছেঁয়ে গেলো। অয়নের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি আর। অনেক খুঁজেছি। আরহানকে বলেছি। সেও পায়নি। একটা মানুষ এভাবে কী করে হারিয়ে যায়?। ভার্সিটির সেই দিনগুলো খুব মিস করছি। একটা সময় কতো আনন্দে ছিলাম। আলাদা হবার কথা কল্পনাও করিনি। তবে আলাদা হওয়াটা নিয়তিতে লেখা ছিলো। কিন্তু এভাবেই আর এতো জলদি! এটা মেনে নেওয়া খানিকটা কষ্টের।

    সম্পূর্ণ সাজানো শেষ হলে নিশা উঠে দাঁড়ালো। আমি নিশার আপাদমস্তক অবলোকন করে নিলাম। একটা মেয়েকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে, যখন সে বউ সাজে।

    “ভাবী! আমাকে কেমন লাগছে?”

    নিশার কথাটা শুনে মুচকি হেসে বললাম, “পাগলকরা সুন্দর লাগছে।”

    নিশা মাথা নিচু করে হাসলো। লজ্জা পাচ্ছে হয়তো। তখন রুমে মা প্রবেশ করলেন। নিশাকে দেখে বললেন, “মাশাআল্লাহ! আজ আমার মেয়েকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো আকাশ থেকে চাঁদ এসে নেমেছে। কারো যেনো নজর না লাগে!”

    কথাটা বলে মা নিজের চোখের নিচের কাজল এক আঙ্গুলে নিয়ে নিশার কানের পেছনে লাগিয়ে দিলেন। পরমুহুর্তে একই কাজ আমার সাথেও করলেন।

    আমি ভ্রু কুঁচকে ফেলতেই মা বললো,“আজ আমার দুটো মেয়েকেই অনেক সুন্দর লাগছে। তোরা সুখী হ মা।”

    মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলাম মাকে। নিশাও মাকে জড়িয়ে ধরলো। মায়ের চোখের কার্নিশে অশ্রুকণা। হ্যাঁ! প্রতিটি মেয়ের বিয়েতেই মায়ের চোখ ভেজা থাকে। এটা নতুন না। বলা যায়, প্রাচীন কাল থেকে প্রচলিত একটা রীতি এটা।

    ________________________

    একটা মেয়ের বিয়েতে, সবচেয়ে বেশি খাটতে হয় তার ভাইয়ের। কাজের জন্য হাজারো লোক থাকলেও, সেই ভাই কোনো ফুরসৎ পায়না। যেমনটা আরহান পাচ্ছেন না। প্রচুর কাজ। সবাই সবটা করলেও, সেসব আরহানকে দেখতে হচ্ছে। সেজন্য আমাকে সময় দিতে পারছেন না। তবে হ্যাঁ! এতেও উনার শাসনের বিন্দুমাত্র অবসান ঘটেনি। আমাকে মায়ের সাথে বসিয়ে রেখেছেন। কড়া হুকুম আছে উনার। এখান থেকে এক পাও এদিক সেদিক সরা যাবে না।

    একটু বাদে আরহান এলেন। হাতে জ্যুসের গ্লাস। আমার দিকে এগিয়ে বললেন,“টায়ার্ড লাগছে? ড্রিংক ইট। বেটার ফিল করবে।”

    আমি গ্লাসটা হাতে নিয়ে মাকে উদ্দেশ্য করে বললাম,“মা! আপনার ছেলে ওভার পজেসিভ হয়ে যাচ্ছে, দেখুন। মাত্রই তো এসেছি।”

    মা মুচকি হেসে বললেন,“ঠিকই করছে আমার ছেলে। সবসময় তোমার সাইট নিই বলে এটা ভেবো না, এখনও নেবো। চুপচাপ এটা খেয়ে নাও।”

    আমিও ঠোঁট উল্টিয়ে অসহায় ভাব নিয়ে ,“মা-ছেলে একদম একরকম” বলে গ্লাসে চুমুক দিলাম।

    আরহান হালকা হেসে, পুনরায় নিজের কাজ করতে চলে গেলেন। তখন সেখানে আসলো মা আর দীপ্তি। আমি উঠে দীপ্তিকে জড়িয়ে ধরলাম। মা আমার কাছে এসে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করলো। এরপর আমার দুই মা মিলে কিছুক্ষণ গল্প করলো। দীপ্তি বউ দেখবে বলে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো, সাথে আমার মা-ও।

    বেশি কাউকে ইনভাইট করা হয়নি, তবুও ভালোই মানুষ এসেছে। এদের মধ্যে এক কোনে আমার চোখ আটকে গেলো। কালো পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটিকে দেখে চোখ বড়-সড় হয়ে গেলো। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম। কিছুক্ষণ বাদেই চোখের আড়াল হয়ে গেলো।

    মাকে জিজ্ঞেস করলাম,“মা! তৃষ্ণা এসেছে?”

    “হ্যাঁ। ওকে আসতে বলেছি আমি। আমার আরেকটা ছেলে ও। ওকে ছাড়া মেয়ের বিয়ে দিই কী করে বল?”

    খানিকটা শান্ত হয়ে বললাম “ওহ্ আচ্ছা”। হুট করেই কেউ একজন পেছন থেকে আমার চোখের উপর হাত রাখলো।

    আমি তার হাতের উপর হাত ছুঁয়ে বললাম,“কে?”

    “গেস করো।”

    “উম…. কে?”

    “ভাবতে থাকো।”

    আমি ভাবতে লাগলাম। সেকেন্ড পাঁচেক পরেই মাথায় এলো। সঙ্গে সঙ্গে ঠোঁটে হাসির রেখা এলিয়ে বললাম,“মাহী?”

    আমার চোখ ছেড়ে দিলো। সামনে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে মুঁচকি হেসে বললো, ইয়েস! আমার সুইট ভাবী।”

    “কখন এলে তুমি?”

    “মাত্রই এসেছি।”

    “তুমি নাকি নিশার বিয়েতে আসতে চাও নি?”

    “তা অবশ্য চাইনি। কিন্তু আরো একটা গুড নিউজ পেলাম। না এসে থাকতে পারি? তুমি তো আর বললে না, নতুন মেহমান আসছে। নাহলে আগেই চলে আসতাম।”

    “আরে! খেয়াল ছিলো না বুঝলে?”

    “যাই হোক! তোমার খেয়াল না-ই থাকতে পারে। আমি আবার তোমার ব্যাপারে সব খোঁজ-খবর রাখি।”

    “তাই?”

    “হ্যাঁ। দেখলে না! জুনিয়র আসার খবর পেয়ে আর থাকতে পারলাম না সেখানে। চলে এলাম জুনিয়রকে নিয়ে খেলতে।”

    কথাটি বলে মাহী হাসলো। আমিও হাসলাম। এতো মিষ্টি এই মেয়েটি! কারো সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করে না। কখনো রাগ করে না। কখনো কাউকে কটূক্তি করে না। বাইরে থেকে পারফেক্ট একটা মেয়ে বলা যায়। তবে, কে জানে? অন্তরে কী আছে?

    _____________________

    বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। নিশার বিদায় হয়েছে বেশ অনেক্ষণ আগে। রুদ্র একটা এপার্টমেন্ট কিনেছে, নিজের জমানো টাকায়। বর্তমানে সেটায় উঠেছে। আরহান এতে আটকায়নি। প্রতিটি মেয়ের একটা সুখের কুঁড়েঘর থাকা উচিত। যেটাতে কেবল সে আর তার স্বামী থাকবে। তবে বিদায়ের সময় নিশার কান্না দেখে আরহান নিজেকে আটকাতে পারেনি। সকলের অগোচরে যে উনি, উনার চোখের পানি মুছে নিয়েছিলেন, তা আমার নজর এড়ায়নি। মা কেঁদেছেন। কেঁদেছি আমিও। একটা বছরে অনেক মায়ায় জড়িয়েছিল মেয়েটা। এতোটা ভালোবাসা আমি ছোট থেকে পাইনি। তাই কষ্টটা বেশি লেগেছে।

    আজ মেহমানরা সবাই থেকে যাবে। সবার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। সন্ধায় আমি রুমে গিয়ে আরহানকে সেখানে বসে থাকতে দেখলাম। আজ কিছু জিজ্ঞেস করার আছে আমার। সব কাহিনী এভাবেই এগোতে পারেনা। কিছু রহস্য উন্মোচন প্রয়োজন। সব খোলাসা না-ই হলো, আংশিক হোক!

    আমাকে রুমে প্রবেশ করতে দেখে আরহান মুচকি হাসলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম আরহানকে,“মন খারাপ?”

    “তোমার থেকে আর কী লুকোবো? হ্যাঁ। খারাপ একটু।”

    “আচ্ছা। এককাজ করা যায়। ওদেরকে কয়দিন বাদে এই বাড়িতেই নিয়ে আসি।”

    “না। এটা ঠিক হবে না।”

    “কেনো?”

    “কারণ এটা ওর সংসার না।”

    “ওখানে একা থাকতে ভালো লাগবে না তো নিশার।”

    “ওর যখনই একা লাগবে, ও চলে আসবে। কিন্তু পার্মানেন্টলি না।”

    “আচ্ছা।”

    কিছুক্ষণ চুপ রইলাম দুজনেই। খানিকক্ষণ বাদে আমি আরহানকে ডাকলাম,“শুনেছেন?”

    আরহান আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,“বলো।”

    “কিছু জানার ছিলো।”

    “কী?”

    “তৃষ্ণার ব্যাপারে…”

    এটা বলতে অবশ্য বেশ ইতস্তত বোধ করছিলাম। বলার পর আরহান চুপ রইলেন।

    এরপর বললেন,“আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল ও। ছোট থেকে একসাথে বড় হয়েছি। একসাথে পড়াশোনা করেছি। খেলাধূলার সঙ্গী ছিলো ও। আমাদের বাবারাও বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলেন। সেই হিসেবে আমাদের ফ্রেন্ডশিপ আরো গাঢ় হয়েছে। ছোটবেলায় একটা জিনিস লক্ষ্য করেছিলাম। সেটা হচ্ছে, আমার আর ওর পছন্দ এক। এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে। আমরা প্রায়ই একসাথে শপিং করতে যেতাম। এমনও হয়েছে, কোনো শার্ট সেই মলে লাস্ট পিস আছে, আর আমার পছন্দ এবং আমি কিনেও নিয়েছি। সেটা ওর লাগবেই। সেটা ছাড়া ওর আর কিছুই পছন্দ হয়না। আমার যেকোনো খেলনা ওর পছন্দ হয়ে যায়। যেকোনো না! সব। আমার সবকিছু ওর পছন্দ হয়ে যায়। শুধু মাত্র জামাকাপড় কিংবা খেলনার ক্ষেত্রে এরকমটা হয়নি। হয়েছে মানুষের ক্ষেত্রেও। ছোট থাকতে, একদম ছোট থাকতে আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করতাম। হাই স্কুলে পড়তাম আমি তখন। আর মেয়েটা আমার স্কুলের অপজিটের একটা প্রাইমারি স্কুলে। খুব সম্ভবত ক্লাস টু’তে পড়তো। সবসময় দুই ঝুঁটি করতো। ছোট মুখটা, ঘন লম্বা চুল দিয়ে ঢেকে থাকতো। বড্ড মিষ্টি ছিলো। যে কেউ, একবার দেখলে, দ্বিতীয়বার দেখতে বাধ্য থাকতো। দুর্ভাগ্য বসত সেই মেয়েকে ওরও পছন্দ হয়ে যায়। এই নিয়ে ওর আর আমার মাঝে কম ঝামেলা হয়নি। বোঝো! সেই বয়সে একটা মেয়েকে নিয়েও ঝগড়া হয়েছে।”

    আরহান হাসলেন। এটুকু বলে থামতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম,“এরপর মেয়েটি?”

    “এরপর আর তাকে খুঁজে পাইনি। হয়তো স্কুল চেঞ্জ করেছে। তবে জানো? সেই মেয়েটি আর তোমার মাঝে, অদ্ভুত কিছু মিল লক্ষ্য করেছি আমি। তোমাদের ফেসকাটিং একরকম। আর মায়াও। এই! রেগে যেয়ো না শুকতারা। কম্পেয়ার করছি না একদম। জাস্ট বলছি।”

    আমি বিস্মিত চোখে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম,“কোন স্কুলে পড়তেন।”

    আরহান স্কুলের নাম বলতেই আমি মিষ্টি হেসে বললাম,“এরপর? একটা মেয়েকে নিয়েই এতো দূরত্ব?”

    “নাহ্।”

    “তবে?”

    “এরপর আবার দুজন সেই মেয়েটিকে ভুলে এগিয়ে যাই। যতো যাই হোক, দুজনের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম। তারপর আশরাফ আঙ্কেল আর তানিয়া আন্টি মারা যায়। দুজনের মৃত্যু অনেক রহস্যময় ভাবে হয়েছে। সেদিন কলেজে গার্ডিয়ান মিটিং ছিলো। শেষ হতেই ফ্যামিলি সহ লং ট্রিপে গিয়েছিলাম। ছুটি ছিলো তো কিছুদিন! এজন্যই। কয়েকদিন বাদে আঙ্কেল-আন্টির খবর পেয়েছিলাম। পেয়ে যখন সেই বাড়িতে গেলাম, তৃষ্ণা ছিলো না। ওকে অনেক খুঁজেছি। আর পাইনি।”

    আরহান থেমে গেলেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম,“তাহলে শত্রু কী করে হলো?”

    “অনেক বছর পর দেখা হয়। এক মাদক ব্যবসায়ী রূপে ওকে দেখে আমি অবাক বনে যাই। তারপর ওকে সিঙ্গার হিসেবে দেখি। তিনটি চেহারা নিয়ে ঘুরছে তৃষ্ণা। মানুষের দুটো মুখোশ থাকে। একটা সবাইকে দেখায়, আর অন্যটা গোপন থাকে। কেউ দেখতে পারেনা সেটা। কিন্তু ওর তিনটা। একটা সবাইকে দেখায়, সিঙ্গার তৃষ্ণা; একটা গোপনে করে যায়, মাফিয়া তৃষ; আর একটা সেই তৃষ্ণা, যাকে সে হারিয়ে ফেলেছে। মনের ভেতরে লুকিয়ে রেখেছে। তোমাকে ভালবেসেছিলো ওর মনের ভেতরে লুকোনো তৃষ্ণা। এজন্যইতো, তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো জানতেই ছেড়ে দিলো। ওর সাথে আমার ঝামেলার শুরুটা হয়, আমি ওকে বলি, এসব ছেড়ে দিতে। সে তা ছাড়ে না। উল্টো আমার রাস্তার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ওর নারী আসক্তি আর ড্রাগ সাপ্লাই দিনকে দিন বাড়তেই থাকে। আর এদিকে আমাদের শত্রুতাও। কেনোনা আমিও এসবে ওর বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছি।”

    আমি স্তব্ধ রইলাম। সম্পর্ক তৈরি করতে অনেক কাঠ-খর পোড়াতে হয়। কিন্তু! ভাঙ্গার জন্য এক মুহূর্তই যথেষ্ট। আরহান হুট করেই মুচকি হাসলেন। আমি সেই হাসির মানে না বুঝে, অবুঝ দৃষ্টিতে উনার পানে তাকালাম।

    আরহান তা দেখে বললেন,“কিছুদিন হলো তৃষ্ণা এসব ছেড়ে দিয়েছে। আর আমি খুব জলদি আমাদের মধ্যেকার রেষারেষি সব মিটিয়ে নেবো।”

    এমন একটা খুশির সংবাদ শুনে আমার মুখেও হাসি চলে এলো। মুচকি হেসে বললাম,“যদি কিছু মনে না করেন, আপনাকে একটা নিউজ দেবার ছিলো।”

    আরহান কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী?”

    আমি আরহানের আরো নিকটবর্তী হলাম। কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম,“যদি বলি, সেই মেয়েটা আমিই, তবে কী মেনে নেবেন আমাকে?”

    আরহান চোখ দুটো বড় করে ফেললেন। হয়তো কিছুই বুঝতে পারছেন না। আমি উনার খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি বিশিষ্ট গালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিলাম। সেকেন্ড পাঁচেক সময়কাল এই উষ্ণ পরশ বিদ্যমান ছিলো। এরপর একটু দূরে সরে হাসতে হাসতে বললাম,“আমিই। আপনাদের দুজনের জন্যেই বাবা আমাকে স্কুল চেঞ্জ করিয়েছিলেন।”

    __________________________

    প্রায় রাত হয়ে এসেছে। বাড়ি ভর্তি মানুষ। আমার কেমন যেনো অস্বস্তি লাগছিলো। তাই হাওয়া খেতে বাড়ির পেছনের দিকটায় এলাম। চারিপাশে শীতল বাতাস। কিছুদূর এগোতেই আমি থেমে গেলাম। সামনে তৃষ্ণা দাঁড়িয়ে। আমি চলে যেতে উদ্যত হলাম। কিন্তু তৃষ্ণা আমাকে তার আগেই দেখে ফেললো।

    উঁচু কন্ঠে ডাক দিলো,“শুনেন!”

    আমি পিছু ঘুরে তাকাতেই তৃষ্ণা বললো,“আপনি এসেছিলেন, এখানে থাকেন। আমি যাচ্ছি।”

    “না। সমস্যা নেই। আপনি থাকুন।”

    তৃষ্ণা হালকা হেসে বললো,“আপনার সাথে কিছু কথা বলার ছিলো। বলতে পারি?”

    আমার ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। তবুও ঠোঁটে জোরপূর্বক হাসি এনে বললাম,“হুম।”

    এগিয়ে গেলাম তৃষ্ণার দিকে। দুই হাতের দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালাম। তৃষ্ণা মাথা নিচু করে বললো,“আপনার সাথে যা করেছি, তা অন্যায়। মনে রাগ পুষে রাখবেন না।”

    আমি তৃষ্ণার কথায় স্বাভাবিক হলাম। মন থেকে হেসে বললাম,“সমস্যা নেই। আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন, এই অনেক। সবাই পারে না এটা।”

    তৃষ্ণা চোখ তুলে তাকালো। চোখাচোখি হলো আমাদের। হুট করেই তৃষ্ণার দৃষ্টি আমার পেছনে চলে গেলো। ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করলো কিছু। বুঝতে পেরেই আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো। বিকট এক শব্দ কানে এলো। চোখ মুখ কুঁচকে ফেললাম। ধাক্কাটা আলতো করে দেবার কারনে আমি পড়ে যাইনি।

    কিছুক্ষণ বাদে চোখ খুলে দেখলাম, তৃষ্ণা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। লাইটের মৃদু আলোয় তার রক্তে ভেজা শরীর দৃশ্যমান। আমি এমন কিছু দেখা মাত্রই অস্থির হয়ে পড়েছি। ছুটে গেলাম তৃষ্ণার কাছে। সে এখনও তাকিয়ে। আমাকে দেখে হালকা হাসলো। মুখ দিয়ে রক্তবমি হচ্ছে। সেভাবেই হাসছে। নীলাভ চক্ষুদ্বয় রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। কী ভয়ঙ্কর! আমি কান্না করে দিলাম।

    তৃষ্ণার এক হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কান্না করছি। মাথা কাজ করছে না। কী করবো এখন?

    তৃষ্ণা তার অন্য হাতটি উঠালো অনেক কষ্টে। কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে আমার হাতের মুঠো শক্ত করে ধরলো। আমার দুই হাতে রক্ত। এতো রক্ত! অনেক কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই তৃষ্ণার!

    কিছুক্ষণ বাদে তৃষ্ণা সব কষ্ট হজম করে বললো, “আ..আমি ধন্য ন..নয়ন..নয়নতারা। আপনার স্পর্শ প…পেয়েছি। আমি ধন্য।”

    আমি ঠোঁট চেপে কান্না থামিয়ে বললাম,“আপনার কষ্ট হচ্ছে! কষ্ট হচ্ছে? এই? কী করবো আমি? কী করবো? বলে দিন না! আপনার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছি না। আমারও হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। কী করবো আমি? বলে দিন না!”

    আমার অগোছালো, এলোমেলো কথা শুনে তৃষ্ণার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। আমি এতো উতলা হচ্ছি কেনো জানিনা!

    তৃষ্ণা আমার হাত দুটোতে নিজের হাতের বল প্রয়োগ করলো। বন্ধন জোরালো করলো। যেনো কেউ উনাকে ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তৃষ্ণা যেতে চাচ্ছে না।

    কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “ইশ! কী ভাগ্য আমার। প্রিয় ম..মানুষটি উতলা হচ্ছে আমার জন্য। কীযে খুশির! আগে জানলে, অনেক আ..আগেই মরতাম নয়নতারা। আ..আমি আমার প্র..প্রমিজ ব্রেক করলাম নয়নতারা। আবারও ব…বললাম আপনাকে। ভা..ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি। ম..মরতে মরতে ভালোবাসি। আমার মিথ্যেয় ঘ..ঘেরা জীবনের, এক…মাত্র সত্যি আপনি। ভালো…বাসি আপনাকে।”

    তৃষ্ণা থেমে গেলো। শুধু তৃষ্ণা না। পুরো প্রকৃতি থমকে গেলো। গড়িয়ে পড়লো আমার চোখের শেষ বিন্দু জল। নিভে গেলো একটা জীবন। যেই জিবনটা ছিলো অপ্রাপ্তিতে ঘেরা। কার জন্য নিভলো? অবশ্যই আমার জন্য। জীবনযুদ্ধে হেরে গেলো। নাহ্! জিতে গেলো। কেননা সে ভালবেসেছে। ভালোবেসে মরেছে। ভালোবাসায় জিতেছে।

    চারিপাশে সবকিছু অসহ্য লাগছে। কেউ নেই কেনো? আমার মুখ দিয়ে শব্দ আসছে না কেনো? কথা বলতে পারছি না কেনো? চিৎকার করতে চাচ্ছি। পারছি না কেনো? এতো অস্বস্তিকর অনুভূতি! পুরো শরীর অবশ হয়ে গেলো কি!

    অনেকটা সময় বাদে আমার গলায় স্বর এলো। সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার দিয়ে দুমড়ে কেঁদে উঠলাম। আরহানসহ বাড়িসুদ্ধ লোক বাড়ির পেছনে চলে এলো, যেখানে আলগোছে শুয়ে আছে তৃষ্ণা, থম মেরে বসে আছি আমি। আরহান তৃষ্ণাকে মাটিতে লুটিয়ে থাকতে দেখে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তার পা জোড়া ওখানেই থমকে গেলো। মাটি যেনো আরহানের পা-কে সেখানে আটকে রেখেছে। আমি এক দৃষ্টিতে তৃষ্ণার চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। যা খোলা আছে। শক্ত করে ধরে রাখা হাতের বাঁধন আরো জোড়ালো হয়েছে।

    আমার শাশুড়ি মা এসব দেখে দৌঁড়ে তৃষ্ণার কাছে এসে কেঁদে দিলেন। আমার মা সেখানেই “বাবাই” বলে নিচু কণ্ঠে বুলি আওড়ালো। তাও চুপ হয়ে গেলো। মা নিজেও গড়িয়ে পড়লো মাটিতে। আশেপাশের সবাই মাকে ধরলো। সেন্সলেস হয়ে গিয়েছে।

    দীপ্তি চুপ করে তৃষ্ণার পাশে বসলো। অনুভূতিহীন গলায় জিজ্ঞেস করলো,“ভাইয়া?”

    কারো কোনো রাও না পেয়ে দীপ্তি হেসে দিয়ে বললো,“আরে তোমরা সিরিয়াস হয়ো না। ভাইয়া মজা করছে। এরকম আগে থেকেই করে। যা দুষ্ট না!”

    তারপর তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললো,“দেখ ভাইয়া! সবাই সত্যি মনে করছে। মা কিন্তু এবার সেন্সলেস হয়ে গেছে। জলদি ওঠ। নাহলে কিন্তু তোর সব ব্ল্যাক আউটফিট পুড়িয়ে দেবো এবার। ভাইয়া ওঠ।”

    এটুকু বলে দীপ্তি ধীরকণ্ঠে বললো,“এতেও হচ্ছে না!”

    তারপর সবার দিকে তাকালো। নিজের ভাইকে আবারও দেখে বললো,“ভাইয়া! এবার কিন্তু কেঁদে দেবো। তোর ছুটকি কেঁদে দেবে। তুই না আমার কান্না সহ্য করতে পারিস না! ভাইয়া ওঠ।”

    দীপ্তি কেঁদে দিলো। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,“ভাইয়া! ওঠ না! দোহায় লাগে। মজা ভালো লাগছে না। ওঠ প্লিজ।”

    মাকে উদ্দেশ্য করে বললো,“আন্টি আপনি বলেননা উঠতে। আপনার কথা শুনবে। ও উঠছে না কেনো?”

    মা আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে দিলো। আমি তৃষ্ণার খোলা নীলাভ চোখের দিকে দেখে যাচ্ছি আর একনজর আশেপাশে দেখে নিচ্ছি। আরহান এখনও ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।

    কিছুক্ষণ বাদে আমি আরহানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালাম। আরহানও তার নজর তৃষ্ণার পানে থেকে সরিয়ে আমার পানে ঠেকালেন। সেকেন্ড যেতেই হন্তদন্ত হয়ে তৃষ্ণার পাশে এসে হাঁটু মুড়ে বসলেন। মা সরে, জায়গা দিলো।

    অস্থির কন্ঠে বললেন,“হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। সরো তোমরা।”

    আরহান তৃষ্ণার পেশীবহুল শরীর অনেক কষ্টে কাঁধে তুললেন। যেতে নিলেই কিছু একটা বেঁধে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, আমার হাত তৃষ্ণার হাতের মুঠোয়। আমি ছাড়াতে চাইলাম। পারছি না। একটুও পারছি না। মা হেল্প করলো। তবুও হচ্ছে না। কেনো হচ্ছে না?

    মৃত্যু নাকি সবার কাছ থেকে সবকিছু ছিনিয়ে নেয়। অথচ তৃষ্ণা পেলো। ভালোবাসা পেলো। একচোখে তার মৃত্যু ছিলো, আর অন্য চোখে তার জন্য আমার অস্থিরতা। দুটো একসাথে দেখতে পেলো। শান্তি পেলো। কিছু পেয়েতো দুনিয়া ত্যাগ করলো। এই বা কয়জন পায়?

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৯)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৯)

    আরহান সেই যে চুপ মেরেছেন। এরপর থেকে আর মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করেননি। অতিরিক্ত খুশিতে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে কি? আমি বুঝে উঠতে পারছি না। কিছুতো বলা উচিত। অনুভূতি ব্যক্ত করা উচিত উনার। করছেন না কেনো? কথা বলুক না! এরকমটা কেমন যেনো লাগছে আমার কাছে!

    দরদর করে ঘামছি আমি। আরহান কি তবে খুশি না? এই সন্তান কি অনাকাঙ্ক্ষিত? কিছু বলতে পারছি না আমি। যেমনটা উনি আমার পানে তাকিয়ে আছেন, আমিও স্থির নেত্রে উনার পানে তাকিয়ে আছি। দৃষ্টি হেরফের হচ্ছে না।

    এখন আমার মনে ভয় ঢুকে গেলো। যেই না আমি ধরে নেবো আরহান খুশি না, ঠিক সেই মুহূর্তেই আরহান আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছেন উনি। বুকের মাঝে লুকিয়ে ফেলতে চাচ্ছেন হয়তো। কোনো কথা নেই কারো মুখে।

    খানিকক্ষণ বাদে নিজের কাঁধে ভেজা অনুভব করলাম। কিছুক্ষন ভাবতেই বুঝে নিলাম। বিস্মিত হলাম। আরহান কাঁদছেন। উনি কাঁদছেন?

    আমি আরহানকে ছাড়িয়ে উঠতে গেলে আরহান পুনরায় আমাকে উনার বুকে চেপে ধরলেন।

    আচ্ছা, উনি কেনো কাঁদছেন? আমার কষ্ট হচ্ছে যে! উনি বুঝতে পারেন না? উনার চোখের অশ্রুপাত আমার বুকের রক্তক্ষরণের সমান। কষ্ট হয় তো!

    আমাকে নিজের বুকের মাঝে আবদ্ধ রেখেই আরহান বললেন,“জীবনের সবচেয়ে বড় খুশি দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ তোমাকে।”

    আরহানের এই কথাটির দরুন বুকের মাঝে শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। এতক্ষণের নেতিবাচক চিন্তা ভাবনা ঝেড়ে আমিও খুশি হয়ে গেলাম। খুশির পরিমাণ সেই পর্যায়ে উঠে গেলো, যেখানে উঠলে চোখ অশ্রুসজল হয়ে আসে। পূর্ণতা পাচ্ছে আমাদের ভালোবাসা।

    আরহানকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,“আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি চাঁদ।”

    “ভালোবাসার চেয়েও ভালোবাসি। অভ্যেস হয়ে গিয়েছো তুমি আমার। অদ্ভুত এক আসক্তি হয়ে গিয়েছো।”

    ______________________

    বিকেলের শেষ ভাগ। প্রকৃতি অশান্ত। তবে শুধু বাইরের টা। বাড়ির ভেতরে পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। কারণ একটাই। আরহান। উনি সবাইকে একসাথে ডেকেছেন, এর মানে নিশ্চয়ই আলাদা কিছু।

    দীপ্তি কিছুক্ষণ আগেই বাড়ি চলে গিয়েছে। সকালে মা এসেছিলো। মায়ের সাথেই গিয়েছে। বিকেল হতেই আরহান রুদ্রকে এই বাড়িতে ডেকে নিয়েছেন। এখন ড্রইং রুমে মা, রুদ্র, নিশা আর আমি বসে আছি। আরহান এখানে নেই। চলে আসবেন।

    নিশা এই নিয়ে তেরো বারের মতো জিজ্ঞেস করলো,“ভাইয়া কেনো ডেকেছে ভাবি? আমার ভয় করছে তো! বলো না।”

    বরাবরের মতোই উত্তরে ঠোঁট উল্টিয়ে বলছি,“জানিনা।”

    এদিকে মা নিশ্চিন্তে বসে আছে। রুদ্রও নিশার বিপরীত সোফায় বসে আছে। একদম চুপ হয়ে। যেনো সে কথা বলতে জানেই না। ওহ্ হ্যাঁ! জানে তো। “হ্যাঁ! হুঁ।”

    এভাবেই চলছে। তখন আরহান আসলেন। এতক্ষণের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আরহান আমার পাশে বসলেন। তিন সিটের এই সোফায়, আরহান আর নিশার মাঝে আমি বসে আছি।

    নিস্তব্ধতার মাঝে আরহান মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য হালকা কাশলেন। চার জোড়া উৎসুক চাহনি আরহানের পানে এসে ঠেকলো। সবার নজরের মধ্যমণি এখন আরহান।

    সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে আরহান রুদ্রের দিকে দৃষ্টি স্থির করলেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,“আমি চাই তুমি নিশাকে বিয়ে করো।”

    রুদ্র বিষম খেলো। বিস্মিত হলো নিশাও। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে নিশা দ্রুত সামনের পানির গ্লাসটা রুদ্রের দিকে এগিয়ে দিলো। রুদ্র এরকম কথার জন্য একদম প্রস্তুত ছিলো না।

    কিছুক্ষণ ভাবলো সে। কী ভাবলো সে নিজেই জানে। রয়ে সয়ে আরহানের বলা কথার জবাবে বললো,“স্যার আমি এই বিয়ে করতে পারবো না।”

    রুদ্রের জড়তা নিয়ে বলা স্পষ্ট কথাতে নিশা ঘোর অবিশ্বাসের চাহনি নিক্ষেপ করলো। আমি নিশার দিকে তাকালাম। কিছুক্ষণ আগের হাস্যোজ্জ্বল মুখের মেয়েটির চোখজোড়া ছলছল করছে। নিশার ফর্সা মুখশ্রী মুহূর্তেই রক্তিম বর্ন ধারণ করেছে।

    আরহান নিশাকে দেখে চোয়াল শক্ত করে রুদ্রকে বললেন,“তোমার কাছে পারমিশন চাইনি। আমার ডিসিশন জানিয়েছি।”

    রুদ্র পুনরায় নম্র কন্ঠে সাবলীল ভাষায় বললো,“স্যার আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। বিয়ে ছেলে খেলা না। আপনার বোনেরও মত থাকা আবশ্যক এখানে।”

    আরহান কণ্ঠে তেজী ভাব বিদ্যমান রেখেই বললেন,“তোমাদের প্রাইভেটলী কথা বলা উচিত।”

    এরপর আরহান নিশাকে বললো,“ছাদে গিয়ে কথা সেরে নাও। ফ্রেশ এয়ারে মনটাও ভালো হয়ে যাবে।”

    উনার কথায় কী ছিলো জানা নেই। শেষোক্ত কথাটি হয়তো শ্লেষপূর্ন ছিলো।

    ____________________

    ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা দুই প্রেমিক প্রেমিকার মাঝে বিরাজ করছে এক থমথমে পরিবেশ। হুট করেই রুদ্রের বলা কথায় নিশা অস্থির-উত্তেজিত হয়ে উঠলো। নিশার স্থির মেজাজকে বিগড়ে দেবার জন্যে রুদ্রের এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিলো।

    “তুমি স্যারকে সোজা বলে দাও, বিয়ে করবে না।”

    নিশার মস্তিষ্কে একটা কথা নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো। বিয়ে করবে না! মানে কী? কী সমস্যা? নিশার তো কোনো আপত্তি নেই। তবে কেনো বলবে, বিয়ে করবে না?

    রাগে নিশার বাচ্চাসুলোভ চেহারায় ভয়ঙ্কর এক রেশ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গম্ভীর মুখশ্রীতে উত্তেজিত কন্ঠে নিশা প্রশ্ন করলো,“আমি কেনো না করবো?”

    রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ রইলো। তার মনের কথা তো একমাত্র সে নিজেই জানে! সময় নিয়ে উত্তর দিলো,“বিয়েতে তো আপত্তি তোমারই আছে। আর আমি বললে, স্যার শুনবে না আমার কথা।”

    নিশা চোখ বড় বড় করে বিস্ময় নিয়ে তাকালো। আপত্তি! তৎক্ষণাৎ উত্তর দিলো,“আপনাকে কে বলেছে আমার এই বিয়েতে আপত্তি আছে?”

    “তুমি আমাকে পছন্দ করো না, এটাতে বুঝে নিয়েছি।”

    নিশা অবাক-তাজ্জব বনে গেলো। সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি যখন বলে ‘তুমি আমাকে পছন্দ করো না’, সেটা যে কারো জন্যই চরম বিস্ময়ের।

    কম্পনরত ঠোঁট দ্বারা বুলি আওড়ালো,“আমি যে আপনাকে অপছন্দ করি, এই মহান বাক্য খানা কোত্থেকে শুনেছেন, জানতে পারি?”

    “সব কথা শুনতে হয়? কিছু বুঝেও নেওয়া হয়। তাও আবার, যদি সেই মানুষটা সব বুঝিয়ে বলে।”

    “ওয়েট! কী থেকে কী বুঝেছেন একটু বলে ধন্য করেন আমাকে। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে এবার।”

    অতঃপর রুদ্র নিশাকে শুরু থেকে সবটা বললো। এমনকি এও বললো, বছর খানেক আগে চিঠিটা সে দিয়েছে।

    নিশার নিষ্পাপ মুখশ্রী ক্রোধে পরিপূর্ন হয়ে গেলো। নাকের ডগা লাল হয়ে গেলো। ফুঁসতে ফুঁসতে বললো,“আপনাকে আসলেই আমার বিয়ে করা উচিৎ না। আমার ভাগ্যটাই খারাপ। শালার এমন এক ভাগ্য পেলাম, যাকে ভালোবাসি, তার ভালোবাসা পেয়েও এতকাল সিঙ্গেল সিঙ্গেল করে চিল্লিয়ে, নাকের জল চোখের জল এক করলাম।”

    রুদ্র এতক্ষণ স্বাভাবিক ছিলো। নিজেকে এই এক বছরে ঠিক করে নিয়েছে সে। কিন্তু নিশার এই ‘যাকে ভালোবাসি’ কথাটি দ্বারা রুদ্রের মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে নিউরনে এক অদ্ভুত শিহরন খেলে গেলো।

    অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলো, “ভা… ভালো… ভালোবাসো?”

    নিশা চিৎকার দিয়ে বললো,“না, বাসিনা। একটুও ভালো বাসিনা। কিন্তু এমন কোনো দিন নেই, আমি আপনার অবহেলায় কান্না করিনি। আপনাকে আমি ভালোবাসি না। কষ্ট দিয়েছেন আপনি আমাকে।”

    রুদ্র নিজের ভুল বুঝতে পেলো। অনুতপ্ত হলো। তবুও ঘটনা গুলো নিজের কাছে পরিষ্কার করার জন্য নিশাকে জিজ্ঞেস করলো,“সেদিন কালো ড্রেস কেনো পরেছিলে?”

    নিশা হুট করেই কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,“আমি মনে করেছি চিঠিটা অন্য কেউ দিয়েছে। আপনি সেরকম কিছু কোনোদিন ইশারা করেননি আমাকে। আর তাছাড়া, এও ভেবেছিলাম, যদি আপনি দিয়ে থাকেন, তাহলে আমার কালো পরায় অবাক হবেন। কষ্ট পাবেন। আমি বুঝে নেবো। আর তখন বলে দেবো। কিন্তু আপনি তো….”

    “সেদিন ছাদে কাকে ‘ভালোবাসি’ বলেছিলে তুমি?”

    নিশা একটু ভাবলো। মনে পড়তেই বললো, “রাহাকে আপনার কথাই বলছিলাম। আর আপনি এটা নিয়েও!”

    অতীতের পাতায় দুজনেই একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। দুজনেই দুজনের জায়গায় ঠিক ছিলো। পার্থক্য ছিলো শুধু দৃষ্টিভঙ্গির। এমনটা প্রায়শই হয়ে থাকে। আমাদের জীবনের প্রতিটি ঘটনায় এমন হয়। আমি ঠিক, তার মানে এই নয় যে, আমার সামনের জন ভুল। হয়তো তার চোখে জিনিসটা অন্যরকম। জীবনের মানে তার কাছে অন্য কিছু।

    রুদ্রের কাছে সবটা পরিষ্কার হলো। মুহূর্তেই মুচকি হাসি ধরা দিলো তার অধর কোণে। এই ভেবে যে, তার পিচ্চিও তাকে ভালোবাসে। অনেক ভালোবাসে। নয়তো চোখের পানির মতো এতো মূল্যবান বস্তু, যার তার জন্য ঝরে না।

    অধিকার ফলালো রুদ্র। ভালোবাসার অধিকার। তার পিচ্চিকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো। নিশা ছুটতে চাচ্ছিলো। কিন্তু রুদ্রের পেশীবহুল শরীরের কাছে নিশাকে হার মানতে হলো।

    কান্না ভেজা স্বরে বললো ,“সামান্য ভুল বোঝাবুঝি কষ্টের স্মৃতি উপহার বৈ কিছুই দিতে পারে না।”

    খানিকটা থেমে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বললো,“যদি কালকে ভাইয়াকে আমাদের ব্যাপারে না বলতাম তবে হয়তো আপনি সারাজীবন…..”

    নিশাকে থামিয়ে দিলো রুদ্র,“হুশ! আর না। ভালোবাসি নিশাপাখি।”

    “ভালোবাসি না। একটুও না।”

    নিশার কথায় রুদ্র হাসলো। মুচকি হেসে নিজের বুকে থেকে তুলে, চোখে চোখ রেখে বললো,“আমার চেয়েও বেশি বাসো।”

    পরমুহুর্তে কিছু ভেবে বললো,“আচ্ছা, স্যারকে কি বিয়ের কথা তুমি বলেছো?”

    “আমি শুধু বলেছি আপনাকে ভালোবাসি। আর কিছু বলিনি। তবে ভাইয়া সত্যি বেস্ট!”

    “নিশাপাখি!”

    “এই আপনি এই নামে ডাকছেন কেনো?”

    “প্রশ্ন ছিলো একটা।”

    “বলে ধন্য করুন!”

    “একটা জিনিস খেয়াল করেছি, জানো?”

    “আপনি না বললে কি আমি দৈব ভাবে জানতে পারবো?”

    “বলছি।”

    “বলেন না!”

    “তুমি ঝগড়ুটে হয়ে গেছো।”

    “কিঃ!”

    “হ্যাঁ! নাহলে আগে তো কথা বলতে গিয়ে কাঁপুনি শুরু হয়ে যেতো তোমার। আর এখন!”

    কথাটি বলেই রুদ্র বাঁকা হাসলো। নিশা রাগ করতে চেয়েও করলো না। আজ সত্যিই সে কাঁপেনি। এক্সাইটমেন্ট এর জন্য উল্টা পাল্টা অনেক বকেছে। কিন্তু এখন আর পারছে না। অবশেষে না সব পেলো!

    নিশা মনে মনে ভাবছে, “সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায়না। আমারটা পেলো। আমি কতো ভাগ্যবতী!”

    নিশার ভাবনার মাঝেই রুদ্রের গম্ভীর ও থমথমে আওয়াজ শুনতে পেলো। সে বললো,“আমাকে ছেড়ে যাবার দুঃসাহস করো না। তোমাকে পাবার আশা রাখিনি। কিন্তু পেয়েও হারানোটা মোটেও সহনীয় হবে না আমার জন্য। আমার কথাটা মাথায় রেখো।”

    রুদ্রের এই কথার গভীরতা বুঝতে পেরে নিশা বললো,“কক্ষনো ছেড়ে যাবো না। আই প্রমিজ। মৃত্যুর আগ অবদি আমি আপনার।”

    হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর বাক্য এটাই,‘আমি আপনার’।

    ______________________

    অবশেষে এই সপ্তাহের শেষে রুদ্র নিশার বিয়ে ঠিক হলো। পারিবারিক ভাবে হবে। যেহেতু রূপ আপু মারা গিয়েছে বছর হয়নি, সেহেতু অনুষ্ঠানিকতা সাজে না। আরহানের কাছে জানতে পেলাম, কাল ছাদের ডেকোরেশন আরহান আর নিশা মিলে করেছে। আর তখন নিশা, আরহানকে রুদ্রের ব্যাপারে বলেছে। আর আজ সকালে আরহান, মাকে সবটা জানিয়েছে। এজন্যই তো তখন মা নিশ্চিন্তে ছিলেন।

    সব ভালো কাটছে। তবে অত্যাচার শুরু হয়ে গিয়েছে আমার উপর। আরহান আমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে জানতে না জানতেই কঠোর হয়ে গিয়েছেন। উঠতে বসতে শাসন করেন। রাতে খেতে পারছিলাম না। তবুও জোর করে, ইন ফ্যাক্ট ইমোশনাল ব্ল্যাক মেইল করে খাইয়েছেন। কতো খারাপ!

    ভাবনার মাঝে দরজা খোলার আওয়াজে সেদিকে তাকালাম। আরহানকে দেখে অন্য সব দিন হলে খুশি হতাম। কিন্তু আজ কান্না পাচ্ছে। কেননা তার হাতে দুধের গ্লাস। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে মুখ দ্বারা ‘চ’ উচ্চারণ করলাম।

    আরহান এগিয়ে এসে বললেন,“এসব করে লাভ নেই। ড্রিংক ইট কুইকলি।”

    আমি আরহানের পানে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। তা দেখে আরহান গম্ভীর মুখশ্রী ধারণ করে বললেন,“লাভ নেই।”

    একরাশ বিরক্তি নিয়ে গ্লাস হাতে নিলাম। এই লোকটা আসলেই খারাপ। ভীষণ খারাপ। নিশ্বাস বন্ধ করে এক চুমুকে শেষ করলাম।

    শেষ হতেই আরহান মুচকি হেসে “গুড গার্ল” বললেন। বিরক্তির সপ্তম আকাশে আছি আমি। মানে কী! বাচ্চা আমি? এভাবে বলার কী আছে এতে?

    অভিমানে গালদুটো ফুলিয়ে অন্যদিকে তাকালাম। আরহান নিঃশব্দে হেসে আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন,“রাত হয়েছে। শুয়ে পড়। এই সময়ে বেশি রাত জাগা ঠিক না।”

    জানিনা কেনো! প্রচন্ড রাগ-অভিমান থাকা সত্বেও, আমি আরহানের কথা না শুনে থাকতে পারিনা। উনার কথা শুনলে, আলাদা এক শান্তি পাই। তাই আমিও শুয়ে পড়লাম। এইযে এখন পাচ্ছি। এ যেনো পরম শান্তি।

    _________________________

    গভীর নিস্তব্ধ রাতে কারো বিড়বিড় করে আওড়ানো আওয়াজে ঘুম ভেংগে গেলো। জাগ্রত হয়েও চোখ দুটো বন্ধ আমার। অনুভব করলাম আমার পেটের উপর কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।

    আরো গভীর মনোযোগ দিতেই কথার শব্দ পরিষ্কার হলো আমার কাছে,“জুনিয়র! মাম্মামকে কষ্ট দেবে না একদম। এইতো কয়েকটা মাস লক্ষ্মী হয়ে থাকো। এরপর যতো জ্বালানোর, আমাকে জ্বালিয়ো। তোমার মাম্মাম নিজেই এখনও পিচ্চি। বেশি লাফালাফি করো না। কেমন? তোমার মাম্মামের কষ্ট হলে যে তোমার পাপা সহ্য করতে পারবে না। লক্ষ্মীটির মতো থেকো। পাপা লাভস ইউ জুনিয়র।”

    কথাটি শেষ করেই আরহান আমার পেটে চুমু খেলেন। নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে। কল্পনায় চলে আসছে, এইতো আমার একটা ছেলে থাকবে। একদম আরহানের মতো। যার হাসি আমার সব কষ্ট ভুলিয়ে দেবে। আধো আধো কন্ঠে আমাকে ‘মাম্মাম’ বলে ডাকবে। ইশ!

    আরহান আমার পাশে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লেন। আমি আরহানকে বললাম,“এতো ভালোবাসেন কেনো?”

    আরহান দ্রুত উঠে বসলেন। জিজ্ঞেস করলেন,“ঘুম ভেংগে গেল? কোনো সমস্যা হচ্ছে? পেটে ব্যাথা? কোমর ব্যাথা? পা ব্যাথা? বমি পাচ্ছে? কী হয়েছে?”

    আমি আশ্বস্ত করতে বললাম,“দম নিন আপনি। ঠিক আছি আমি। আপনাকে কথা বলতে শুনে জেগে গিয়েছি।”

    আরহান অপরাধীর মতো, মিনমিনে কন্ঠে বললেন,“সরি শুকতারা। আমার শব্দ করা উচিত হয়নি। এক্সট্রিমলি সরি।”

    বিরক্তিতে “উফ!” শব্দ করলাম। আরহান অস্থির হয়ে প্রশ্ন করলেন, “কী হয়েছে? ব্যাথা করছে কোথাও?”

    “না! ব্যাথা না। আপনি এবার অতিরিক্ত করছেন। প্রেগন্যান্ট কি আর কারো বউ হয়না?”

    “হয়, তবে তোমার মতো বউ কেউ পায়না। অনেক আদুরে তুমি। তোমার জন্য এক্সট্রা আদর বরাদ্দ থাকবে অল টাইম।”

    “আচ্ছা বুঝলাম। এবার ঘুমান।”

    আরহান শুয়ে পড়লেন, আমাকে পূর্ব ভঙ্গিতে জড়িয়ে ধরেই।

    কিছুক্ষণ বাদে বললেন,“শুকতারা শোনো!”

    মুচকি হেসে বললাম,“ভালোবাসি।”

    আরহান বিস্মিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,“কিভাবে বুঝলে এটা বলবো?”

    “কারণ ভালোবাসি।”

    চলবে…

  • আমার প্রিয় ডাইরি

    আমার প্রিয় ডাইরি

    [আমার এবং আমার ডাইরির অনুভূতি কথন]
    প্রায় বহুদিন হলো আমার প্রিয় ডাইরিটা হাতে নেই না। তাতে পরম আবেশে হাত বুলাই না, তাতে নিজের সুপ্ত অনুভূতির, আবেগময় ভালোবাসা প্রকাশ করা হয় না। অনলাইন যুগ তো তাই আর ডাইরিটা কে সময়ই দেয়া হয় না। টেবিলে বসেছি। হঠাৎ ডাইরির পানে দৃষ্টি জোড়া আবদ্ধ হয়। মনে হলো কত অভিযোগই না করছে সে আমায় নিয়ে। বারংবার মন বলছে ডাইরিটা আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। চাপা অভিমানে অভিযোগ তুলছে,
    -“আমায় ভুলে গেছিস তুই। তাই না? খুব ঠুনকো হয়ে গেছি তোর কাছে? যে আমাকে তুই এত ভালোবাসাতি। তাকে আজ ছোঁয়া তো দূর একবার চোখ তুলে দেখছিসও না। হ্যাঁ রে! তোর যান্ত্রিক জীবনটা কি আমার থেকেও সুখময়, আনন্দময়? তো যান্ত্রিক জগতের মানুষ গুলো কি বুঝে তোর অনুভূতি? আমার মত করে? যে আমিটা কে মূহুর্তে মূহুর্তে জড়িয়ে ধরে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতি, প্রাপ্তির এক তৃপ্তিময় প্রশান্তি নিয়ে কলিজায় জড়িয়ে ঘুমিয়ে পরতি। যার গায়ে কলমের আঁচড় না তুললে তোর মনে ঝড়েরা তান্ডব করতো। তার দিকে আজ ফিরেও তাকাস না। খুব ঠুনকো হয়ে গেছি না রে তোর যান্ত্রিক জীবনে?

    টেবিলের এক কোনে এলেমেলো বই-খাতার ভিড়ে অবহেলায় পরে আছে আমার প্রিয় ডাইরি। আমার লেখনীর প্রথম ধাপ। সেই ডাইরিটাই আজ অবহেলিত। তাও আমার কাছে।

    ধুলোবালির এক বিস্তর আস্তরে ঢেকে গেছে। এক সময় ডাইরিটা আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ছিলো আজ সে আমার সঙ্গে আড়ি করে ধুলো-বালিকেই প্রিয় বন্ধু করে নিয়েছে। এক সময় যে ডাইরিটা বুকে জড়িয়ে, দুবাহু দিয়ে আঁকড়ে ধরে বসো থাকতাম, মিট মিট করে হাসতাম, কল্পনা জল্পনা করতাম হাজার কবিতা উপন্যাসের। তাকে আজ জড়িয়ে জাপ্টে আছে ধুলোবালি। আচ্ছা! আমি যে তাকে ছুই না, তার গায়ে কল্পনার জাল বুনি না সে কি রাগ করেছে আমর উপর? হয়তো করেছে। করবে নাই বা কেনো? তাকে যে আমি অবহেলা করে ফেলে দিয়েছি ধুলোবালিময় দুনিয়ায়।

    আচ্ছা! ডাইরি তুই কি আমার উপর রাগ করেছিস? নাকি অভিমান? তোর রাগ, অভিমান কি করে ভাঙ্গাই বলতো? ভাবিস না তোকে ভুলে গেছি। তুই ছাড়া আমার চলে নাকি বল? তুই-ই তো আমাকে নিয়ে এসেছিলি তোর রাজ্যে। তোর রাজ্যের নেশায় পরে গেছি রে। তোকে কি করে ভুলি বলতো? ব্যস্ততায় তোর গায়ে কলমের আঁচড় তোলা হয় না। তোর সাথে আমার আবেগ, অনুভূতির ভাব প্রকাশ করা হয় না। তাই বলে তুই রাগ করিস না। তুই নিজেই তো হাজার বাস্তবতার সাক্ষী। এমন কেউ আছে রে যে তোর সাথে নিজ অনুভূতি প্রকাশ করে না? এই যে আমাকে দেখ। কত আবেগ, কত অনুভূতি, কত দুঃখ, কত সুখ, কত আনন্দ, কত স্বপ্ন সব! সব তোর সাথে ভাগ করি। তাও কি তুই তোর অভিমান নিয়ে থাকবি? তুই তো আমার প্রিয় ডাইরি। আমার অনুভূতির আস্ত এক ভান্ডার। আমার ভালোবাসাময় আবেগ। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। জানি তুই আমার উপর রাগ করতেই পারিস না। হ্যাঁ! অভিমান করেছিস তো? তা আমি জানি। তোর মনে যে আমার জন্য অভিমানের পাহাড় বেঁধেছিস তাও আমি জানি।

    তোর কাছে তো আমি খোলা পাতা, বিস্তর তারাময় আকাশ। তুই তো আমার অনুভূতির অন্তরাল। তাও কি অভিমান করে থাকবি? তুই না আমার প্রিয় ডাইরি, আমার বেস্ট ফ্রেন্ড, আমার অনুভূতির অন্তরাল।

    জানি তো কি ভাবছিস। তুই কথা বলতে পারিস না, আমার মত নিজ অনুভূতি গুলোও কলমের আঁচড়ে আমার অন্তরালে প্রকাশ করতে পারিস না। তাই বলে তোর অভিযোগ আমি বুঝবো না? তা বলে কি তোকে অবহেলা রেখেছি? তোর অভিমান, অভিযোগ, অনূভুতি বুঝি না ভেবেছিস? কি করে পারলি? এমনটা ভাবতে? আমি তোর গায়ে অনুভূতি প্রকাশ করি তাই তুই আমার সকল অনুভূতি সঙ্গে পরিচিত। তুই প্রকাশ করতে পারিস না বলে কি আমিও বুঝবো না। বল? তুই যেমন আমার অনুভূতি গুলে বুঝিস, অনুভব করিস। ঠিক তেমনি আমিও তোর সকল অনুভূতি অনুভব করতে পারি। কারন তুই যে আমার প্রিয় ডাইরি।

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৮)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৮)

    দেখতেই দেখতে আজ অনেকগুলো মাস পেরিয়ে গেলো। সময় যেনো ছুটছে হাওয়ার বেগে। দিনগুলো কাটছে, নাহ্! দৌড়চ্ছে। আজ ছয় মাস পেরিয়ে গেলো। আর সবচেয়ে মজাদার ব্যাপার হচ্ছে, আর তিনদিন বাদেই আরহান আর আমার বিয়ের প্রথম বছর পূর্ণ হবে।

    এইতো সেদিন! সেদিন না আরহান আমাকে জোর করে, ভয় দেখিয়ে বিয়ে করলো! এতো দ্রুত সময় পেরিয়ে যায়! কেউ একজন বলেছিলো, সুখের সময় নাকি হাওয়ার বেগে ফুরোয়। সে আসলেই সত্যিই বলেছিলো।

    হুট করেই মন খারাপ ছেয়ে গেলো। আজ বাবা নেই, ছয় মাস হয়ে গেলো। সাথে নেই, রূপ আপু। সে কেনো সুইসাইড করেছে, কেউ জানে না। অনেক চেষ্টার পরেও কোনো কারণের খোঁজ পাওয়া যায়নি। অবশ্য মাহী বলেছিলো, রূপ আপু নাকি অনেক ডিপ্রেসড ছিলো। আসল কারণ হিসেবে এটাও ফাঁস হয়েছে, রূপ আপু আরহানকে পাগলের মতো ভালোবাসতো। হ্যাঁ! পাগলের মতোই। সে যেমনই ছিলো, তার ভালোবাসা যে খাঁটি ছিলো। তা বুঝতে পারা কারোর জন্যই কষ্টসাধ্য হয়নি।

    কথায় আছে, প্রেম মানুষকে যেমনটা শক্তিশালী চরিত্রের অধিকারী বানায়; ঠিক তেমনই, সময় পড়লে ছ্যাঁচড়া হওয়াটাও শিখিয়ে দেয়। অতীব সুন্দর ভাবে।

    ছোট মায়ের সাত বছরের জেল হয়েছে। তবে তার অপরাধের শাস্তি আরো কাম্য ছিলো। তার জন্যই বিগত আঠারোটি বছর আমাদের নষ্ট হয়েছে। আমি তাকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবো না।

    এদিকে মীরা আপু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। সে এতো কিছু সইতে পারেনি। এখন মানসিক হাসপাতালে আছে। সে ঠিক হবে কবে? এই আশায় কেউ বসে নেই। তার যে আসলেই কেউ নেই। তার মামার বাড়ির সবাই আগেই সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। আর তার আসল বাবার বাড়ি থেকে তো চলেই এসেছে। সেখানে কোনো দাম নেই।

    কিছুদিন আগে রুশীর একটা মেয়ে সন্তান হয়েছে। নাম রেখেছে অরু। পরিবারের সবার সাথে নিজের মেয়েকে নিয়ে দিন ভালোই কাটছে। আমাকে প্রায়শই ভিডিও কল দেয়। বাড়ি থেকে বিনা প্রয়োজনে বের হবার সুযোগ নেই ওর। এদিকে আমিও যেতে পারবো না। তাই কলেই কথা হচ্ছে।

    অয়নের এখনও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। জলজ্যান্ত একটা মানুষ হুট করেই এভাবে গুম হয়ে গেলো, এটা কল্পনাতীত ব্যাপার লাগে আমার কাছে।

    এই কয় মাসে আমি তৃষ্ণা সম্পর্কে আমার মা ও শাশুড়ি মায়ের কাছে জেনেছি। শাশুড়ি মা বলেছিলেন,“স্কুল ও কলেজ লাইফে তৃষ্ণা আরহানের বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো। একে অপরের কলিজা বলা যেতো। প্রখর মেধাবী ছিলো দুজনেই।

    দুজনের ভাবনা চিন্তাও এক ছিলো। কিন্তু তৃষ্ণার একটু ফ্যামিলি প্রবলেম ছিলো। এরপর একদিন কলেজ থেকে বাড়ি গিয়েছিলো। পরেরদিন শুনি, তৃষ্ণার বাবা-মা মারা গিয়েছে। সেদিন ওদের বাড়িতে গিয়ে আর ওকে খুঁজে পাইনি। শুনেছি ওরা, ওখান থেকে চলে গিয়েছে। কোথায় গিয়েছে! তা জানতে পারিনি।”

    এরপর আমার মায়ের কাছে শুনেছি সেই ভয়ংকর অতীত। সেদিনের ঘটনা। তৃষ্ণার ঘটনা। এসব শুনে সত্যিই ভীষণ খারাপ লেগেছে। আসলেই, একটা গল্পের,অনেক পর্ব থাকে। প্রতিটি পর্ব, একটার সাথে অন্যটা কানেকটেড। এক পর্ব মিস গেলে, গল্পের মানেটা আমাদের কাছে অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। জীবনটাও কোনো গল্পের চেয়ে কম না।

    আমি সব মিলিয়ে তৃষ্ণার জীবনের গল্প জেনেছি। প্রতিটি পর্ব মিলিয়ে জেনেছি। একটা মানুষ কখনোই খারাপ পথে যায়না। সময় ও পরিস্থিতি সবটা করিয়ে দেয়।

    ভাবতে ভাবতেই আরহানের নম্বর থেকে কল এলো। এখন বাজে রাত এগারোটা। আরহান কিছু কাজে দেশের বাহিরে গিয়েছেন বেশ কয়েকদিন হলো। মন খারাপ করেছে আমার। তবে সব মানিয়ে নিয়েছি আমি। আরহান আমার কাছে না থেকেও যেনো সারাটা ক্ষণ আমার পাশেই আছে। এইযে বুকের বা পাশে যেই যন্ত্রটা আছে, সেটা আমাকে আরহানের উপস্থিতির আভাস দেয়।

    মুচকি হেসে ফোন তুলে কানে নিলাম। আরহান শুরুতেই জিজ্ঞেস করলেন, “খেয়েছো রাতে?”

    “হুম। আপনি?”

    “এখন এখানে কেবল বিকেল পাঁচটা।”

    “ওহ্, হুম। কী করছেন?”

    “শুকতারাকে তার চাঁদ গভীর ভাবে মিস করছে।”

    “এমা! তাই? তবে চাঁদ আর তারা তো একই আকাশে থাকে। এতো ডিপলি মিস করছে কেনো?”

    “হুম। তবে নয়নে নয়নে সাক্ষাৎ হচ্ছে না। সাক্ষাৎকারের সময়টুকুতে যখন শুকতারার অবাধ্য-অগোছালো চুলগুলো মুখের সামনে এসে বিরক্ত করবে, সেটা গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে, চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দেওয়া হচ্ছে না।”

    “এটা আপনার ফ্যাভারিট স্টাইল বুঝি?”—ভাবুক ভঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম।

    “হুম, বলতে পারেন।”

    আরহানের কথাটা বলতেই আমি তাকে ডাকলাম,“আচ্ছা শুনছেন!”

    “বলো, শুনছি।”

    “আসবেন কবে?”

    আরহান ওপাশ থেকে হাসলেন। শব্দহীন হাসি। তবে অজ্ঞাত কারণবশত বুঝতে পেলাম, উনি হাসছেন। জিজ্ঞেস করবো? কেনো হাসছেন?

    আমার জিজ্ঞেস করার আগেই আরহান বললেন,“মিস করছিলে বুঝি?”

    হুট করেই হৃদপিন্ড কেঁপে উঠলো। শূন্যতা অনুভব করলো। সারাদিন দিব্যি চলছিলো আমার। তবে হঠাৎ এমন কেনো?

    লজ্জা পেয়েছি। হ্যাঁ লজ্জারই কথা।

    তবুও মুখ ফুটে বললাম,“মিস করছি কি না জানিনা, তবে অনুভব করছি। প্রখর ভাবে।”

    “প্রিয় মানুষের অনুপস্থিতি, তাকে অনুভব করায় শুকতারা। আমিও করছি। যেমনটা তুমি করছো, তার চেয়েও কয়েক গুন বেশি। তোমার ভাষায় ‘প্রখর ভাবে’। বুঝতে পারছো কি?”

    _______________________

    ইদানিং শরীরটা বেশ খারাপ যাচ্ছে। দুর্বলতা দিনকে দিন অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করছে। আজিব স্মেল ভালো লাগছে। খাবার খেতে ইচ্ছে হয় না। আবার অসময়ে অনেক উল্টা পাল্টা খাবারের বায়না ধরে বসি। আমার এসব বায়না এখন নিশা সামাল দিচ্ছে। গতমাসে পিরিয়ডও মিস গিয়েছে। সব লক্ষণ আমার কাছে একটা জিনিস বোঝাচ্ছে। যদি সত্যি তাই হয়?

    ভেবেই আমি লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠলাম। আরহান আসবেন কালকে। পাশ হাতড়িয়ে ফোন নিলাম। এখন বাজে সকাল নয়টা। আগে কতো সকালে উঠতাম! আর এখন কী অলস হয়ে গিয়েছি!

    দীপ্তির নম্বর ডায়াল করলাম। কল রিসিভ করতেই জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় আছিস?”

    সময়ের বিবর্তনে আমাদের সম্পর্ক আগের চেয়ে অনেক ভালো হয়ে গিয়েছে। এখন ওকে আমি ‘তুই’ সম্বোধন করি, আর দীপ্তিও করে।

    দীপ্তি বললো,“এইতো বাড়ি আছি।”

    “মা কী করছে?”

    “মা অফিসে আছে রে। খেয়েছিস আপু?”

    “আর খাওয়া! উঠিইনি। আসবি না?”

    এই কয়মাসে, দীপ্তি যেনো বেশির ভাগ সময় এই বাড়িতেই, আমার সাথে কাটিয়েছে। আমি জানতাম বোন মানে তার বেস্ট ফ্রেন্ড। সে ছোট থেকে সাথে থাকে। আমাদের ক্রাইম পার্টনার হয়। সেজন্য আমাদের সব জানে। কিন্তু আমি একটা জিনিস ভুল ভাবতাম। ছোট থেকে একসাথে থাকাটা জরুরি নয়। এটা দীপ্তি বুঝিয়েছে। এই ছয়মাসে আমার সাথে ওর এমন একটা সম্পর্ক হয়েছে, কেউ বুঝতেই পারবে না, আমাদের পরিচয় মাত্র কয়েক মাসের।

    দীপ্তি হালকা হেসে বললো,“হ্যাঁ, আসবো তো।”

    “কখন আসবি?”

    “এইতো, আর দুই ঘণ্টার মতো।”

    আমি “আচ্ছা” বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকলাম। এরপর বললাম, “শোন না!”

    “হুম। বল।”

    “আসার সময় একটা প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে আসিস।”

    ___________________

    নিস্তব্দ, কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে বসে আছি আমি। মুখে কথা নেই। এদিকে সামনে দীপ্তি একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। কেনো এটা আনলাম, কী হয়েছে? ইত্যাদি প্রশ্ন ওর মুখে লেগেই আছে। অথচ আমার বলার কোনো ভাষা নেই।

    মস্তিষ্কে অনেক কথারা ভিড় জমাচ্ছে। অথচ শব্দগুলো মুখে আসছে না। সব আওলিয়ে যাচ্ছে। আমার জীবনের মোড় ঘুরেছে।

    হাতের প্রেগন্যান্সি কিটটা দীপ্তির দিকে এগিয়ে দিলাম। লাল দাগ দুটো জ্বলজ্বল করছে। হাতে নিয়ে তা দেখতেই দীপ্তি চকিতে চাইলো। আমার চোখ ছলছল করছে। এক ফোঁটা, দুই ফোঁটা করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কম্পণরত হাতটা নিজের পেটের উপর রাখলাম। একবার নিজের পেটের দিকে তাকিয়ে, পুনরায় দীপ্তির দিকে তাকালাম।

    “আমি মা হবো? আমিই?”

    কাঁপা কাঁপা গলায় প্রশ্নটি করে ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে দিলাম। এ যেনো পরম সুখের এক কান্না।

    দীপ্তি স্থির কিছুক্ষণ কিটের দিকে তাকিয়ে হুট করেই মুখ উজ্জ্বল করে ফেললো। খুশিতে নাচতে শুরু করলো আমাকে নিয়ে। তারপর আমাকে ছেড়ে মাকে কল দিলো।

    রিসিভ করতেই বললো,“মা! তুমি নানুমা হতে যাচ্ছ।”

    ওপাশের মায়ের কথা আর শুনলো না। ফোন রেখেই রুমের বাইরে ছুটলো। ওর চিৎকারে মা-নিশাও ওখানে চলে এলো। আমিও এগিয়ে গেলাম। দীপ্তি উত্তেজিত কন্ঠে বললো,“খালামণি হবো। খালামণি হবো আমি।”

    _________________

    এখন বাজে রাত এগারোটা চল্লিশ। বাড়ির সবাই আমার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে জানার পর থেকে আমার ব্যাপারে আরো সচেতন হয়ে উঠেছে। রূপ আপুর মৃত্যুতে যেমন বাড়িতে শোক ছেয়ে গিয়েছিলো, জুনিয়রের আগমনের সংবাদে এখন শোকের রেশ মাত্র নেই।

    তন্মধ্যে আমি এক ভয়াবহ কাজ করে ফেলেছি। এই বিশাল এক নিউজটা আমি আরহানের কাছ থেকে লুকিয়েছি। কাউকে বলতে নিষেধ করেছি। কাল, যখন আরহান আসবে, তখন আমি নিজেই তাকে বলবো এটা।

    আচ্ছা কীভাবে বলবো? বলতে পারবো? উনি সামনে থাকলেই আমি উত্তেজিত হয়ে পড়ি। কথা বলতে পারিনা। কিছুই পারিনা আমি। মূর্তি বনে যাই।

    তখন সেখানে নিশা এলো। এই বাড়িতে সবাই তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে নেয়। সে হিসেবে নিশাও। আজ হয়তো আমার কাছে থাকবে। দীপ্তি অনেক হৈ হুল্লোড় করে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। এখন বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।

    নিশা এগিয়ে এসে ডাকলো,“ভাবি!”

    আমি মুচকি হেসে বললাম,“হুম!”

    “ছাদে চলো।”

    “এখন? এই টাইমে?”

    নিশা মেকি হেসে, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বললো,“রাতের বাতাস অনেক ভালো। চলো যাই।”

    আমি আর কিছু বললাম না। ওর সাথেই ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। শেষ সিঁড়িতে এসে খেয়াল করলাম, নিশা আমার সাথে নেই। বেশ অন্ধকার। এখন নিচে যেতে গেলে, পড়ে যাবো। এজন্য ছাদের দিকে অগ্রসর হলাম।

    সম্পূর্ন অন্ধকার ছাদ দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। লাইট জ্বালানো নেই কেনো? কিছুদূর এগোতেই আমার পেছনে কারো অস্তিত্ব পেলাম।

    আমি দ্রুত বেগে পিছু ঘুরতে গেলাম। তার আগেই সম্পূর্ণ ছাদ আলোকিত হয়ে গেলো। চারিপাশে দেখে বিস্ময়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। পুরো ছাদ ডেকোরেশন করা। এসব কে করলো? কেনো করলো?

    সবকিছু ভাবনাতেই হুট করেই কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেলো।

    “৩…২….১..”

    শেষ হতেই সম্পূর্ণ আকাশ জ্বল জ্বল করে উঠলো। বিস্ময়ে সেদিকেই তাকিয়ে আছি। পেছনের মানুষটি তখন আরো কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালো। আমার কাঁধে থুতনী ঠেকিয়ে বললো,“হ্যাপি এনিভার্সারি শুকতারা।”

    আমি আরহানের আওয়াজ পেয়ে দ্রুত উনার দিকে ফিরলাম। আমাকে উনার দিকে তাকাতে দেখেই, আরহান মুচকি হেসে বলা শুরু করলো,“আমার জীবনে আসার জন্য ধন্যবাদ। আমার জীবনকে ঠিক এভাবেই আলোকিত করার জন্য ধন্যবাদ। আমাকে ভালোবাসার জন্যেও।”

    আমার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললেন,“এই হাত কখনো ছাড়বো না, আই প্রমিজ।”

    আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না, কী হচ্ছে! উনার তো কাল আসার কথা! তবে আজ কী করছেন? এতো ভেবেও কিছু পেলাম না। খানিকটা সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলাম।

    মুহূর্তেই মাথায় এলো, আরহানকে জানাতে হবে। কীভাবে জানাবো?

    পা উঁচু করে দাঁড়ালাম। আরহানের হাতটি আমার পেটে রেখে উনার কানে বললাম,“শুভ বিবাহ বার্ষিকী আমার সন্তানের বাবা।”

    তারপর একটু সরে গেলাম। আরহান বিস্মিত চোখে তাকিয়ে আছে। হয়তো বুঝে নিয়েছেন। আরহানের চোখে চোখ রেখে বললাম,“উই’ল বি প্যারেন্টস। জুনিয়র আসছে।”

    চলবে…

  • একজন ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী

    একজন ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী

    একজন ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী, আমার অনেক বন্ধুরা ও আমি
    ওঁর নাম ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী, আমি বলি দিদি, ইন্দ্রাণীদি।
    ফেসবুকে পরিচয়। এখনও দেখা হয়নি। এমন কি কথাও হয়নি।
    অথচ, আমার মতো এক অভাজনের লেখায় সুর দিয়েছেন, কন্ঠ দিয়েছেন।
    ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী কলকাতার মানুষ। বছর দুয়েক ধরে পারিবারিক কারণে আমেরিকায় অবস্থান করছেন, ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে।
    ফেসবুকের দেয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া আমার একটা কবিতা পড়ে ইন্দ্রাণীদি মন্তব্য করলেন, এতে সুরারোপ করা যেতে পারে।
    ঢাকার এক অতিসাধারণ শখের লিখিয়ের লেখা, তাতে সুর করছেন, কন্ঠ দিচ্ছেন কলকাতার একজন গুণীজন! এবং সেই সুর সৃষ্টি হচ্ছে আমেরিকার পশ্চিম তীর, প্রশান্ত মহাসাগরের হাওয়ায় হাওয়ায়! যে দুজনের এখনও দেখা হয়নি, কথা হয়নি!
    সত্যিই, এই পৃথিবীতে কতোই না বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে !
    ইন্দ্রাণীদির এই ছোট্ট মন্তব্যটুকুই আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে গেলো আমার ধূসর হয়ে যাওয়া শৈশবে।
    ফেসবুক নিয়ে অনেক তীর্যক মন্তব্য শুনেছি। অনেক বরেণ্য ব্যক্তি নৈতিক কারণে ফেসবুক থেকে দূরে থাকেন এবং থাকার পরামর্শ দেন।
    কিন্তু, ফেসবুক না থাকলে আমার এই ষাট পেরুনো বয়সে এতো বন্ধু পেতাম না, এটাও তো সত্যি। এটাও তো সত্যি, পেতাম না ইন্দ্রাণীদিকেও!
    চমৎকার গান করেন ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী। মূলতঃ উচ্চাঙ্গ, রবীন্দ্র ও নজরুল। পাশাপাশি রাগপ্রধানসহ বিভিন্ন আঙ্গিকের গান। আকাশবাণী কলকাতা ও দূরদর্শনের নিয়মিত শিল্পী। এ পর্যন্ত তাঁর পাঁচটি গানের সিডি প্রকাশ হয়েছে। আগ্রহীরা ইউটিউবে ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর গান শুনতে পাবেন।
    ইন্দ্রাণী চক্রবর্তীর উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতগুরু পন্ডিত অরুণ ভাদুড়ী, রবীন্দ্রসঙ্গীতে শিক্ষাগুরু সুচিত্রা মিত্র। সঙ্গীত জগতের এই দুই দিকপাল আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবে, তাঁদের আলোকচ্ছটায় যে কয়েকজন সৌভাগ্যবান উদ্ভাসিত হয়েছেন, ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী তাঁদেরই একজন।
    সেই ১৯৬১-৬২ সাল। কতোই আর বয়স। পাঁচ-ছয় বছর বয়স।
    ভুলে গিয়েছি অনেক কিছুই।
    ভুলিনি ধূসর হয়ে যাওয়া সেই স্মৃতি।
    ঢাকার মালিবাগের বাসায় প্রতিবেশীদের অনেকেই এসেছে কলের গানের গান শুনতে। আমি কলের গানের বাড়ির ছেলে বলে সব থেকে কাছে গিয়ে কলের গান রাখা টেবিলে হাত রেখে দাঁড়িয়ে গান শোনার সুবিধাভোগী! অন্যেরা একটু দূরে। শিশুসুলভ এক ধরণের গর্ব ও আনন্দ আমাকে কি উদ্বেল করতো?
    মেজো ভাই পিনের ছোট্ট শক্ত কাগজের বাক্সটা থেকে পিন বের করছে, কুকুরের ছবি সম্বলিত কালো গোল রেকর্ড একটা করে শেষ হলে নুতন পিন লাগিয়ে দিচ্ছে বাচ্চা হাতির মতো কলের গানের শুঁড়ের মাথায়! অনুরোধ অনুযায়ী রেকর্ড পাল্টে যাচ্ছে। মোটা কাগজের প্যাকেটে একটার পর একটা করে সাজানো আছে রেকর্ডগুলো।
    কখনো হেমন্তের কন্ঠে, ‘শান্ত নদীটি যেনো পটে আঁকা ছবিটি…’, কখনো জগন্ময়ের কন্ঠ, ‘তুমি আজ কতো দূরে…’!
    তখন সেই পাঁচ ছয় বছরের শিশু মনে কি এমন কোনো ইচ্ছা হয়েছিলো, ‘আহা, আমিও যদি এমন গান গাইতে পারতাম! আহা, আমিও যদি এমন গান লিখতে পারতাম!’
    দৃশ্যতঃ এমন ভাবনা শিশুমনে জেগে ওঠার কথা নয়। শিশু মন শুধু মুগ্ধ হয়, বিস্মিত হয়।
    কিন্তু মনোবিজ্ঞানীরা অবচেতন মনের জগত আবিষ্কার করলেন। সে এক বিস্ময়কর জগত। আমৃত্যু অজানাই থেকে যায় সেই অবচেতন মনের গহীনে বসবাস করা বৈচিত্র্যময় রঙিন আবেগগুলোর কথা!
    তখন কি ঘুনাক্ষরেও জানতাম, ষাট বছর পরে, ২০২২ সালে আমি ক্লান্ত শ্রান্ত এক প্রবীণ, ফেসবুক নামক এক অদ্ভুত মাধ্যমে মনের ভেতর জমে থাকা নানান কথা নিয়ে গল্প লেখার চেষ্টা করবো? চেষ্টা করবো কবিতা লেখার?
    ১৯৭০ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবী জুড়ে ব্রাজিল থেকে নেপাল পর্যন্ত অনেক ‘পেন ফ্রেন্ড’ ছিলো। মুক্তি যুদ্ধে সব চিঠিপত্র ঠিকানা হারিয়ে গেলেও কিছু কিছু নাম এখনও মনে আছে।
    ব্রাজিলের জোয়েল মোরেইরা, অস্ট্রিয়ার মেইডল রোম্যান, অস্ট্রেলিয়ার (কুইন্সল্যান্ড) জন কোলে, ডাব্লু এ কাল্টহার্ড, কানাডার (কুইবেক) ড্যানিয়েল প্যাটিগ্রু, ভারতের (মাদ্রাজ) কোকিলা গুরুস্বামী ও পি থানগাপ্পান(কোয়েম্বাটুর), নেপালের অনুপ শ্রেষ্ঠাচারিয়া, সিলনের (শ্রীলঙ্কা) বনী টেইলর, আমেরিকার (ডেট্রয়েট, মিশিগান) বেভারলি কান্ট্রিম্যান, চেকোস্লোভাকিয়ার মাডলো জান, জাপানের চেইকো ফুগিমাকি,…… আরও অনেক!
    যুদ্ধে হারিয়েছি আমার স্মৃতি বিজড়িত শৈশব!
    উদ্ভ্রান্ত যৌবনের আরেক যুদ্ধে হারিয়েছি দিক নিশানা!
    জীবনের শেষ বেলায় অলস সময় কাটাতে গিয়ে নুতন করে আবার পাওয়া গেলো বন্ধু!
    ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী তেমনই একজন।
    কারও কারও ভালো লাগবে, এই ভেবেই সব বন্ধুদের জন্য গানটি ছেড়ে দিলাম ফেসবুকের হাওয়ায় হাওয়ায়…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৭)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৭)

    “আপনাকে ক্ষমা করার একটা সুযোগ দিলেন না বাবা?”

    কথাটি বলেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। আরহান এতো মানুষের ভীড়েও আমার মুখখানি তার বুকের মাঝে আগলে ধরলেন। আমাকে শান্ত করার উদ্দেশ্যে উনার বলা আশ্বাস বাক্য,“হুশ! কেঁদো না। উনার হায়াত এটুকুই ছিলো। এটা তোমাকে মানতেই হবে।”

    আমি কান্না থামিয়ে দিলাম। আরহানের দিকে আশা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,“বাবাকে ফেরানোর আর কোনো উপায় নেই?”

    পরপর আমার গলা কেঁপে উঠলো। কণ্ঠ ভিজে এলো। কান্না ভেজা স্বরে মায়ের দিকে আঙুল তুলে বললাম,“মা কি তবে সব পেয়েও হারিয়ে ফেললো? দেখেন না! কিভাবে নির্বাক বসে আছে?”

    আমি মার কাছে এগিয়ে গেলাম। উৎকন্ঠিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলাম, “ও মা! মা! তুমি কাঁদছো না কেনো?”

    মায়ের নিষ্প্রাণ নয়ন আমার পানে এসে ঠেকলো। বুক কেঁপে উঠলো আমার। আমি কিছু বলতে পারলাম না আর। যেনো সে তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দ্বারা আমাকে চুপ করিয়ে দিলো।

    আজ সকালে খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই মীরা আপুর কল এলো। এই একটা কলে যেনো আমার দুনিয়া থমকে গেলো। মীরা আপুর কল দেখে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মীরা আপুর কান্না ভেজা স্বরে বলা,“আব্বু আর নেই” কথাটি যেনো আমার দম আটকে দিলো। এসে শুনলাম, কালকের অতিরিক্ত স্ট্রেসে বাবা রাতেই স্ট্রোক করেছেন। সকালে অফিসে যায়নি দেখে মীরা আপু বাবাকে ডাকতে এসেছিলো। কিন্তু বাবা আর উঠেনি।

    নিজেকে ভীষণ দায়ী মনে হচ্ছে আমার। আজ আমি চাইলেই সব ঠিক রাখতে পারতাম। কাল যদি বাবার সাথে একটু কথা বলতাম! যদি বাবার চিন্তার বোঝাটা একটু কমাতে পারতাম! কান্নারা সব আজ আমার সাথে সখ্যতা করতে এসেছে। এতকালের না পাওয়া সব একসাথে পেয়ে যাওয়াতে আমার খুশি উপচে পড়ছিলো গতকাল। ভাগ্য বড্ড নিষ্ঠুর। এই আমাকে সব ফিরিয়ে দিলো, তো এক নিমিষেই সব ধূলিসাৎ করে দিলো। আশা, কল্পনা সব ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিলো।

    আমার বাবার সাথে আমার সখ্যতা ছিলো সেই ছোট্টবেলায়। এরপর! এরপরের কথা নাইবা বললাম। কিন্তু উচ্চাকাঙ্ক্ষা যে আমার জন্য নিষিদ্ধ, তা পুনরায় প্রমাণিত হলো। হ্যাঁ, আমার জীবনের আঠারোটি বছর আমার বাবার জন্য নষ্ট হয়েছিলো। কিন্তু, একসময় যার হাতের কনিষ্ঠ আঙ্গুল ধরে চলতে চলতে, সর্বশেষে আমি এই ধরার বুকে স্বকীয় কদম একাকী রাখতে শিখেছি, তার অবর্তমানতা কী করে মেনে নেবো? মানতে পারছি না।

    একবার চোখ তুলে মায়ের পাশে বসে থাকা দীপ্তিকে দেখলাম। মনে পড়ে গেলো কালকের দিনটা। দীপ্তি যখন বাবার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রথম ‘বাবা’ বলে সম্বোধন করেছিলো! তখন ওর চোখ দুটি ছলছল করে উঠেছিলো। একটা মেয়ের তার বাবার সাথে কাটানো অনেক স্মৃতি থাকে। আমি পেয়েছিলাম এমন কিছু স্মৃতি, যা ভুলতে চাইতাম বারবার। অন্যদিকে আমার বোনটার স্মৃতি তৈরির আগেই সব শেষ হয়ে গেলো।

    মুহূর্তেই বুকটা অনেক ভারী অনুভূত হলো। চিনচিন এক ব্যাথা হচ্ছে। আমার ডান পাশে আরহান দাঁড়িয়ে ছিলেন। উনি নিশ্চুপ হয়ে আছেন। হয়তো আমাকে সান্তনা দেবার আর কোনো ভাষা উনার জানা নেই। আবারও বিছানায় আমার বাবার মৃত দেহকে দেখে নিলাম। পাশে মা আর দীপ্তি বসে। মীরা আপুও কান্না করছে না। কেমন ‘থ’ মেরে বসে আছে। কষ্ট লাগছে আপুর জন্য। সে কাল নিজের মাকে হারালো, আজ বাবাকে।

    ___________________

    যোহরের ওয়াক্তে বাবার দাফন কার্য সম্পন্ন হবে। বাড়ির সামনে খাটিয়ায় বাবার লাশ রাখা আছে। সাধারণত মরা বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে। কিন্তু এই বাড়িতে কেউ কাঁদছে না। সব যেনো পাথর বনে গিয়েছে। এদিকে মা! সে তো এক দৃষ্টিতে বাবাকে দেখেই যাচ্ছে।

    পুরো বাড়ি ভর্তি মানুষ। মামারাও এসেছে। মামা যখন মাকে দেখলো! সে নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছে। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়েছে। পরমুহুর্তে আরহান তাকে সবটা বুঝিয়ে বলেছে।

    আমি শক্ত করে আরহানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছি। বুক ভারী করার মতো কিছু অনুভূতি অনেক বাজে ভাবে গ্রাস করে ফেলছে আমাকে। মাথা তুলে আরহানের দিকে তাকালাম। উচ্চতায় আমি আরহানের কাঁধ অবদি। চোখাচোখির জন্য দৃষ্টি উঁচুতে রাখা আবশ্যক।

    উপরোক্ত পন্থা অনুসরণ করে আমি আরহানের দিকে তাকালাম। আরহান আমার দিকে তাকাতেই জিজ্ঞেস করলাম,“সব উল্টে পাল্টে গেলো। এবার কী হবে?”

    আরহান নম্র কণ্ঠে বললেন,“সৃষ্টিকর্তা সবচেয়ে উত্তম পরিকল্পনাকারী।”

    আমি আর কিছু বলতে যাবো তখনই আরহান আমার হাত ধরে দ্রুত গতিতে আমাকে সরিয়ে দিলেন। ততক্ষণে আমি খেয়াল করলাম, আমার পেছনের কাঁচের জানালার কিছুটা অংশ ভেঙ্গে গিয়েছে। শব্দে ইতিমধ্যে এখানকার সবার দৃষ্টি এদিকেই। আরহান আমাকে “আন্টির পাশে দাঁড়িয়ে থাকো” বলেই সোজা বরাবর রাস্তায় ছুটলেন। ততক্ষণে কালো মুখোশ পরিহিত লোকটা দৃষ্টিগোচর হয়ে গিয়েছে।

    আরহান ফিরে এলেন। আকস্মিক ঘটনায় আমি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুই আমার অবুঝ মস্তিষ্কে ঠেকছে না। আরহান আমার নিকটবর্তী হলেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হলো এটা?”

    আরহান পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে আমার প্রশ্নের জবাবে বললেন, “সাম ওয়ান ওয়ান্টেড টু শুট ইউ…”

    ফোনে রুদ্রকে কল দিয়ে বললেন,“অ্যারেঞ্জ টাইট সিকিউরিটি হেয়ার, কুইকলি।”

    মস্তিষ্কে পুরনো ঘটনা চলে এলো। নতুন না। প্রায়শই হয় এটা। কেউ আমাকে মারতে চায়। এবার বাবার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তখন পুলিশের সাথে আগমন ঘটলো ছোট মায়ের। একদিনেই চোখ মুখ শুকিয়ে গিয়েছে তার। পরনে সাদা শাড়ি। মীরা আপু ছোটমাকে দেখেই হামলে পড়লো তার উপর। কাঁদতে কাঁদতে বললো, “আ’আম্মু! আমি একা হয়ে গেলাম তো! তুমিও নেই। আব্বুও চলে গেলো আমাকে ছেড়ে।”

    মীরা আপু বাবার সন্তান না হলেও, প্রচুর আদর পেয়েছে। শুরুতেই একবার বলেছিলাম না! নিজ বাড়িতে আমি চাকরানীর মতো ছিলাম। রাজ করতো সৎবোন। বাবা অনেক আদর করতেন আপুকে।

    এদিকে আমার শাশুড়ি মা ও নিশাও এসে গিয়েছে। কিছুক্ষন বাদে রুদ্র ও এলো। রুদ্র এসেই আরহানের কাছে এগিয়ে এলো। মুখ ফুটে “স্যার!” বলতেই আরহান থামিয়ে দিলেন। নিশাকে ডেকে বললেন, “স্টে উইথ ইউর সিস্টার-ইন-ল”

    এরপর রুদ্রকে নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। নিশা আমার কাছে এসে শান্তনা দেবার চেষ্টা করতে লাগলো। কিন্তু পারছে না। হচ্ছে না ওর দ্বারা। কিছু মানুষ আছে, যারা অল্পতেই কেঁদে দেয়। কারো কান্না দেখলেই কেঁদে ফেলে। কারোর কষ্ট সহ্য করতে পারে না। নিশা ঐ ধরনের মানুষ। আমাকে কী শান্তনা দেবে! উল্টো নিজে কান্না করে বসেছে।

    শাশুড়ি মা এগিয়ে গিয়ে আমার মায়ের কাছে গেলেন। মাকে সান্তনা দিতে লাগলেন। তখন সেখানে আগমন ঘটলো তৃষ্ণার। আমার সামনে দিয়ে সোজা মায়ের কাছে চলে গেলো। কোথাও খেয়াল নেই তার। আশেপাশের কিচ্ছুটি ভাবছে না। মায়ের সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো। তার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিলো।

    খানিক সময় বাদে বললো,“সে তোমাকে একসময় প্রচুর ভালো বেসেছিলো। হয়তো সময়ের সাথে সেই ভালোবাসায় দূরত্ব বেড়েছিলো। কিন্তু তুমি তো জানোই, সে তোমাকে কতো ভালো বেসেছে! আর কিছু না হোক, সেই ভালোবাসা টুকু মনে রেখো। এতকালের সব দূরত্ব চুকিয়ে শেষ বারের মতো কেঁদে নাও মামনি। সে তোমাকে ভালোবাসতো, বিশ্বাস করো খুব ভালোবাসতো।”

    তৃষ্ণার কথা টুকু শেষ হতেই মা শব্দ করে কেঁদে ফেললো। ঠোঁট উল্টে কান্না থামানোর প্রচেষ্টা করে বললো, “ও আমাকে ভালোবাসতো?”

    তৃষ্ণার নীরস উত্তর,“হু।”

    মা আবারও কেঁদে দিয়ে বললো,“তাহলে কেনো ছেড়ে গেলো? আমি কী খুব খারাপ? আগেও তো রাগ করতাম আমি। ও আমাকে মানানোর জন্য কতো কিছু করতো! আজ কেনো করলো না?”

    মা আর কিছু বলতে পারছে না। কথাগুলো গলায় আটকে গিয়েছে। কিছুটা সময় নিয়ে আবারও বলা শুরু করলো, “মানলাম আমার এবারের রাগটা অনেক বেশি ছিলো। কিন্তু ও একটু চেষ্টা করলেই তো এই রাগ গলে যেতো। আমি তো শুধু ওকে একটু শাস্তি দিতে চেয়েছিলাম।”

    তৃষ্ণা বড় একটা শ্বাস নিয়ে বললো,“সবসময় জীবন আমাদের পরিকল্পনা মাফিক চলে না মামনি।”

    মা হাউমাউ করে কেঁদে বললো,“তাই বলে উল্টো আমাকেই শাস্তি দিলো? এতটা সেলফিশ ও? নিজে এই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না বলে, নিজেরটার সাথে এক্সট্রা কষ্ট আমাকে দিয়ে চলে গেলো। একবারও আমার কথা ভাবলো না? আমি এই কষ্ট নিতে পারবো কী পারবো না?”

    “কেউ তার সহ্যের অতিরিক্ত কষ্ট পায়না। নিজেকে সামলে নাও। তোমার সেই একটি মানুষ ছাড়াও দীপ্তি আর আমি আছি। তোমার আরো একটা মেয়ে আছে।”

    তৃষ্ণার কথা শেষ হতেই পাশ থেকে আমার শাশুড়ি মা বলে উঠলো, “তৃষ!”

    তৃষ্ণা মাথা ঘুরিয়ে ডাক অনুসরণ করে সেদিকে তাকালো। নীলাভ নয়ন জোড়া দেখেই শাশুড়ি মা আবেগে আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলো। এদিকে তৃষ্ণাও।

    কিছুক্ষণ বাদে মা, তৃষ্ণাকে ছেড়ে বললেন,“কই ছিলি তুই? তোকে কতো খুঁজেছি জানিস? হঠাৎ সেদিন কলেজ থেকে ফিরে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিলি? তোকে আর পেলাম না কেনো?”

    তৃষ্ণা মিষ্টি হেসে বললো,“সিলেট চলে গিয়েছিলাম আন্টি। কয়েকমাস আগেই ফিরেছি।”

    “আরহানের সাথে দেখা করেছিস?”

    “ওর সাথে দেখা না করে থাকতে পারবো? করেছি।”

    _________________

    দাফনের কাজ শেষ। সবাই বাড়িতে অনুভূতি শূন্য হয়ে বসে আছি। কারো মুখে শব্দ নেই। ছোটমাকেও পুলিশ পুনরায় নিয়ে গিয়েছে। মীরা আপু সেন্সলেস হয়ে আছে। দীপ্তি, মাকে জড়িয়ে ধরে আছে। আমি এক কোনায় আরহানের পাশে বসে আছি।

    নিস্তব্ধ বাড়ির মাঝে হুট করেই আরহানের ফোন বিকট শব্দ করে বেজে উঠে। আমি তাকালাম আরহানের দিকে। হোয়াটস অ্যাপে কল এসেছে। স্ক্রিনে ‘রূপ’ নামটা ভেসে উঠেছে। এই কয়েক মাসে রূপ আপুর কোনো কল আসেনি। আজ হঠাৎ! আরহান রিসিভ করতে যাবে, তখনই কেটে গেলো। হয়তো জরুরি, এটা মনে করে আরহান কল ব্যাক করলো। ঢুকলো না। অতঃপর নাম্বারে কল দিলো, নট রিচেবল এলো। কপাল কুঁচকে ফেললো আরহান। এই না কল দিলো!

    আরহানের মা আমাকে, দীপ্তিকে, তৃষ্ণাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,“তোরা খেয়ে নে। এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবি তো।”

    পুনরায় নিশা,রুদ্র আর আরহানকেও বললেন,“তোরাও আয়।”

    কারো খাবার পরিস্থিতি নেই। তবুও জোর করেই খেতে গেলাম। মায়ের দিকে তাকালাম একবার। সে এখনও কেঁদে যাচ্ছে। প্লেটে খাবার বেড়ে, মায়ের কাছে গেলাম।

    মা আমার উপস্থিতি পেয়ে মাথা উঁচু করে তাকালো। আমি জিজ্ঞেস করলাম,“খাবে না?”

    “ইচ্ছে করছে না।”

    “আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

    ___________________________

    রাতেই এই বাড়িতে ফিরেছি। মা আমাকে আরহানের সাথেই পাঠিয়ে দিলো। আজ মায়ের কাছে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে এই পরিস্থিতিতে আরহান ছাড়া আর কেউ সামলাতে পারবে না দেখে পাঠিয়ে দিলো। উদাস মন নিয়ে চলে এলাম। পুরোটা রাস্তা থেমে থেমে কেঁদে এসেছি।

    রাতে আরহান অনেক জোর করেই খাইয়ে দিয়েছেন। পুরোটা রাত আমার নির্ঘুম কাটলো। শেষ হতে চাচ্ছে না এই রাত। আর ঘুমও আসছে না। রাতের শেষ ভাগে আরহানের ফোন বেজে উঠলো। নির্ঘুম আমিটার সাথে জেগে ছিলেন আরহানও। পাশ হাতড়িয়ে ফোন রিসিভ করে কানে তুলতেই আরহান মুখশ্রীর ভাব পাল্টে গেলো। অনেক বাজে কোনো খবর পেয়েছে, এমন।

    পুরো ঘটনার আগা গোড়া না বুঝে আমি আরহানকে জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”

    “রূপ সুইসাইড করেছে।”

    চলবে…

  • অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৬)

    অদ্ভুত আসক্তি (পর্ব-২৬)

    “আপনারা কবে থেকে একে অপরকে চেনেন?”

    নিস্তব্ধ ও শান্ত প্রকৃতির মাঝে মনে ক্রোধ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন ব্যক্তি আমার উক্ত কথাটি শ্রবণ করা মাত্রই আলগোছে পিছে মুড়লো। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একবার দুজন দুজনের মুখ চাইলো। আরহান এগিয়ে এলেন আমার দিকে। তৃষ্ণা পুনরায় আকাশের পানে তাকালো।

    আরহান আমার কাছে এসে ভাবলেশহীন কন্ঠে উত্তর দিলো, “ছোট থেকে।”

    আমার করা প্রশ্নের উত্তর পেয়ে আবারও প্রশ্ন করলাম, “কীভাবে?”

    নিজের শত্রু, সবচেয়ে বড় শত্রুর সাথে প্রকৃতি বিলাসেরর মানেটা আমার কাছে একদম অপরিষ্কার। এজন্যই এই প্রশ্ন করা।

    আরহান পুনরায় বললেন,“এক সময়ের প্রিয় বন্ধু ছিলো সে।”

    এটুকু বলে থেমে, আবারও বললেন,“বর্তমানের প্রিয় শত্রু।”

    আমি অবুঝ চোখে তাকিয়ে রইলাম। প্রিয় বন্ধু কী করে প্রিয় শত্রু হতে পারে? আর শত্রু কারোর প্রিয় কী করেই বা হয়?

    আমাকে চুপ থাকতে দেখে আরহান বললেন,“এবার আমাদের ফিরতে হবে।”

    আমি রয়ে সয়ে উত্তর দিলাম,“হুঁ।”

    একবার তৃষ্ণার দিকে তাকালাম। তখনই তৃষ্ণা তার দৃষ্টি আকাশপান থেকে সরিয়ে আমার পানে ঠেকালো। নীলাভ নয়নজুড়ে ছেঁয়ে আছে অপ্রাপ্তি। আমাদের আজ তৃতীয় বারের মতো চোখাচোখি হলো। বাড়িতে ঢোকার সময় একবার, মা যখন আমাকে তৃষ্ণার সাথে পরিচয় করালো তখন একবার, আর এই একবার। প্রতিবার নয়নে নয়নে সাক্ষাৎকার খুব একটা সময়ের ছিলো না। এবারের টা ছিলো।

    তৃষ্ণা ওভাবেই তাকিয়ে রইলো। চোখ সরাইনি আমিও। তৃষ্ণা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলছে, যা আমার শ্রবণ ইন্দ্রীয় অবধি পৌঁছচ্ছে না।

    আরহান একবার আমার দিকে আর একবার তৃষ্ণার দিকে তাকালেন। আমার হাত ধরে হালকা হেসে বললেন,“দেরি হচ্ছে শুকতারা।”

    আমি এতক্ষন তৃষ্ণার দিকে তাকিয়েছিলাম খেয়াল করিনি। আরহান একদিন ঠিকই বলেছিলেন, এই চোখের দিকে কেউ একবার তাকালে অন্য কিছুর খেয়াল থাকে না।

    আমি আরহানের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বললাম,“চলুন।”

    সিঁড়ি বেয়ে নামতেই সেখানে দীপ্তি চলে এলো। আমাকে নিচে চলে আসতে দেখে প্রশ্ন ছুড়লো,“চলে এলে যে এখনই?”

    “উই আর গেটিং লেট। নাও, উই হ্যাভ টু গো।” —কথাটি বলেই আমাকে নিয়ে মায়ের কাছে চলে এলেন।

    __________________

    আরহান ড্রাইভ করছেন। আমি উনার পাশে। গাড়িতে দুজনই আছি। রুদ্র নিজে যেই গাড়ি নিয়ে এসেছিলো, সেটায় করে আলাদা গিয়েছে। মায়ের কাছ থেকে আসতে ইচ্ছে হচ্ছিলো না। অন্যদিকে তৃষ্ণা ছিলো বিধায় আরহান যতদ্রুত সম্ভব আমাকে নিয়ে এসেছেন। তৃষ্ণার সাথে আর দেখা হয়নি। ছাদ থেকে আসেইনি আর।

    তৃষ্ণার জন্য আমার ভীষণ মায়া হয়। তার এতো খারাপ কাজের কথা শুনেও, আমি তাকে ঘৃণার চোখে দেখতে পারিনা। হয়তো তার মনেও ভালোবাসার উপলব্ধি রয়েছে বলেই, আমার তার প্রতি এমন অনুভূতি হয়।

    শুনেছি একটা মেয়ে তার চোখেই বার বার হারিয়ে যায়, যার কাছে তার মনটাই হেরে বসে আছে। শুধু তারই চোখের মুগ্ধতায় ডুবে যায়। দিবা রাত্রি বিভোর হয়ে, একমাত্র তার চোখেই নিজের গোটা দুনিয়া দেখতে পায়।

    সত্যি বলতে আমি তৃষ্ণার চোখে হারিয়ে গিয়েছিলাম। তবে এটা মুগ্ধতা নিয়ে নয়। তার চোখে আমি আকাশসম কষ্ট দেখতে পেয়েছি। সেই কষ্টের ছিটে ফোঁটা আমিও উপলব্ধি করতে পেরেছি। কীসের জোরে! জানা নেই।

    আমার দৃষ্টি জানালার বাইরে। মৃদু হাওয়া বইছে। এসি অফ ও জানালার কাঁচ নামানো। একটা দিনে হুট করেই কতো কিছু ঘটে গেলো। শীতল বাতাস আমার চোখ মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। আরো প্রবল ভাবে অনুভব করার জন্য চোখ বুঁজে ফেললাম।

    মিনিট খানেক বাদে চোখ খুলে আরহানের দিকে তাকালাম। সর্বপ্রথম চোখ গিয়ে ঠেকলো আরহানের চোখে। ভালোবাসার মানুষটির চোখে হারিয়ে যাওয়াটা নাকি প্রচুর শান্তির। সেই লক্ষ্যে আমিও হারিয়ে যেতে উদ্যত হলাম। মিষ্টি হেসে তাকিয়ে রইলাম। নিষ্পলক ভাবে তাকিয়ে তার চোখের গভীরতায় হারিয়েই গেলাম।

    বেশ খানিকক্ষণ বাদে কানে কারো কথা এলো। আরো একটু খেয়াল করতেই মস্তিষ্কে ধারণ করলাম এটা আরহানের কণ্ঠস্বর।

    ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে সামনে দেখলাম আরহান স্টেয়ারিং এর উপর হাতের কনুই রেখে, সেই হাতের উপর মাথা ঠেকিয়ে আমারই দিকে তাকিয়ে আছে।

    আমি হকচকিয়ে উঠলাম। খানিকটা নড়ে চড়ে বসে বুঝলাম, গাড়িটা থেমে আছে। জিজ্ঞেস করলাম আরহানকে,“ওভাবে তাকিয়ে কী দেখছেন?”

    “প্রিয় মানুষটির, প্রিয় অঙ্গের দিকে তাকিয়ে, এই অপ্রিয় আমিকে তার প্রিয় হিসেবে দেখছি।”

    অবুঝ আমিটা কিছুটা সময় নিয়ে আরহানের এই কথাটা নিয়ে গবেষণা চালালাম।বুঝতে পেরে লাজুক হাসলাম আমি। তাতে আরহান তার অপর হাতটা নিজের বুকের বা পাশে রেখে, ঠোঁটে হাসির রেখা প্রশস্ত করে বললেন,“এই হাসিতেই খুন হয়েছি।”

    কিছু কিছু পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যেখানে লাজুক ভঙ্গিতে আর থাকা যায়না। পেট ফেটে হাসি চলে আসে। যেমনটা আমার এখন হচ্ছে। অতিরিক্ত লজ্জায় হাসি পাচ্ছে। ঠোঁট কামড়ে হাসি থামানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছি।

    আরহান তা দেখে বললেন,“অনেকক্ষণ ধরে ডেকে চলেছিলাম তো! এখন কি এখানেই থাকবেন মহারানী? নাকি আমার রাজ্যে আপনার প্রবেশ হবে?”

    আমি মুচকি হেসে বললাম, “ওহ্ হ্যাঁ! যেতে তো হবেই। চলুন।”

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    বাড়িতে প্রবেশ করতেই সামনে নিশাকে দেখতে পেলাম। নিশা আমাদের দেখে এগিয়ে এলো। জিজ্ঞেস করলো,“এসে গিয়েছো তোমরা! ফ্রেশ হয়ে এসো, খাবার সার্ভ করছি আমি।”

    আরহান জবাবে বললেন,“খেয়ে এসেছি আমরা।”

    “ওহ্ আচ্ছা।”

    আরহান জিজ্ঞেস করলেন,“তুমি খেয়েছো?”

    নিশা, আরহানের করা প্রশ্নে চমকিত হলো। আরহান আগ বাড়িয়ে কথা বলেনা। আজ বলছে। মনে মনে নিশার খুশি যেনো উপচে পড়ছে।

    মুচকি হেসে জবাব দিলো, “হ্যাঁ ভাইয়া। খেয়েছি।”

    “মা? খেয়েছে?”

    “হ্যাঁ ভাইয়া।”

    “ঔষধ!”

    “নিয়েছে ভাইয়া। টেনশন করো না, সব হয়েছে। মা এখন ঘুমোচ্ছে। অর্ধেক ঘুম, ঘুমিয়েও নিয়েছে হয়তো।”

    শেষোক্ত কথাটি বলে নিশা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তাতে আরহানও মুচকি হাসলো। আরহানকে কখনোই এভাবে কথা বলতে দেখিনি কারো সাথে। আজ যে নিশার সত্যি খুব খুশি লাগছে। তা ওর চোখের কার্নিশ ঘেঁষে দৃশ্যমান অশ্রুকণা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

    ​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​​

    _____________________

    রাতের মধ্যভাগ। ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল আজ। আরহান শাওয়ার নিচ্ছেন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ও ঘুমনোর আগে উনি শাওয়ার নেন। তবে একটা জিনিসে আমি সত্যিই বিস্মিত হই, একটা ছেলের শাওয়ার নিতে এতো সময় লাগে!

    আরহানের সাথে কাটানো সব সময়গুলো নিয়ে ভাবছি। উনার সাথে এখনও আমার কোনো খারাপ স্মৃতি তৈরি হয়নি। যা হয়েছে সবটাই অসম্ভব ভালোলাগার এবং সাথে রয়েছে অপ্রত্যাশিত ভালোবাসা।

    মুচকি হাসলাম। চেঞ্জ করার উদ্দেশ্যে কাবার্ডের নিকট এলাম। কাবার্ড খুলে একটা একটা করে শাড়ি দেখে যাচ্ছি। কোনটা পরবো?

    এমন সময় এক কোনা থেকে সাদা রঙের কিছু একটা নিচে পড়লো। আরহানের কোনো কিছুই আমি ধরিনা। আমার মতে সবারই ব্যক্তিগত কিছু ব্যাপার গুলো থেকেই থাকে, সেগুলোতে আমাদের ঢোকা উচিত নয়। সম্মুখে পড়ায় নিচু হয়ে হাতে তুলতেই খেয়াল করলাম, আরহানের টিশার্ট এটা।

    শুভ্র রঙ্গা টিশার্টটা মুচকি হেসে বুকে জড়িয়ে নিলাম। এতে আরহানের শরীরের ঘ্রাণ মিশে আছে। হুট করেই একটা কোনায় আমার দৃষ্টি ঠেকলো। লক্ষ্য করলাম সেই কোনায় রেশম সুতোয় ছোট্ট করে অ্যালফাবেট ‘A’ লেখা।

    কিছু সময় এমন হয়, যখন মনে হয় এই জিনিসটা, একই ভাবে আমার সাথে এর আগেও ঘটেছে। তখন অনেক মনে করার চেষ্টা করেও মনে আসে না

    হুট করেই মস্তিষ্কে সেই দিনের কথা চলে এলো। সেই খুন! হিংস্রতা! রক্ত! সব মনে পড়তেই বিস্ময়ে, শঙ্কায় হতবিহ্বল অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হাতে এখনও আরহানের টি শার্ট।

    আরহান! নাহ্! আরহান হতে পারে না। একই রকমের ডিজাইন অনেক কিছুতেই হতে পারে। তাও, মস্তিষ্কে ধরতে পারছি না কিছুই। ভাবনা সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

    তখনই ওয়াশরুম থেকে বেরোলেন আরহান। আমাকে নীরস ভঙ্গিতে মাথা নত হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এলেন।

    আমার সামনে এসে দাঁড়াতেই আমি মাথা উঁচু করে তাকালাম। আমার মুখে কোনো ত্রাস, ক্রোধ, গাম্ভীর্য, অভিমান, অভিযোগ কিছুই নেই।

    হাতের টিশার্ট এগিয়ে বললাম,“এটা আপনার?”

    “হ্যাঁ।”

    “এই ডিজাইন?” —লাল রঙ্গা সুতোয় লেখা ‘A’ কে উদ্দেশ্য করে বললাম।

    আরহান মৃদু হেসে বললেন,“আরে এটা! এই লোগো তো আমার আগের বেশির ভাগ হোয়াইট ফেব্রিকেই ছিলো। আমার অফিসের প্রিভিয়াস লোগো ছিলো এটা।”

    “এরকম লোগো আর কারো কাছে থাকতে পারে?”

    “একদমই না।”

    আমার মাথা ঘুরে এলো। হাত থেকে টিশার্ট পড়ে গেলো। অবিশ্বাস্য নয়নে আরহানের দিকে তাকালাম। আরহান আমার এমন অবস্থার কারণ বুঝতে পারছেন না। এগিয়ে এলেন আমার দিকে।

    আমি দৃষ্টি সরালাম। নিজের মনকে বুঝ দিচ্ছি, সেদিন সেই খুন অন্য কেউ করেছে হয়তো। হয়তো কোনো ভাবে আরহানের হ্যাঙ্কি সেই রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এই সকল কিছু আমার কাছে কাকতালীয় ঠেকছে না।

    সব ভুলে সেই ঘটনার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করার জন্য যখনই উদ্যত হলাম, তখনই আরহান আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,“আমাকে বিশ্বাস করো?”

    আরহানের চোখের মাঝে আমার দৃষ্টি স্থির রইলো। যে কাউকে হিপনোটাইজ করতে সক্ষম। আমিও হয়ে গেলাম। নজর আরহানের নয়ন জোড়াতেই সীমাবদ্ধ রেখে বললাম,“নিঃসন্দেহে।”

    আরহান পুনরায় প্রশ্ন করলেন,“আমাকে কতটা বিশ্বাস করো?”

    মস্তিষ্কে প্রথম যেই উত্তরটা ছিলো সেটা বললাম, “যতটা বিশ্বাস করলে চোখ বন্ধ করে পুরোটা জীবন সেই একজনের কথা মতোই চলা যায়।”

    আরহান হাসলেন। সেই দিনের মতো আবারও বললেন,“এই বিশ্বাসটাই রেখো।”

    কথাটি শেষ করতেই লোড শেডিং হয়ে গেলো। চারিপাশে অন্ধকার। বাহিরের ল্যাম্পপোস্টের আলো আসছে। তবে তার দরুন কেবল এই অন্ধকারের গভীরতা বোঝা যাচ্ছে। আরহান আমার হাত ধরে ব্যালকনির দিকে অগ্রসর হলেন। আমার যেনো কী হলো! আমিও বিনা কথায় উনার পিছু পিছু ব্যালকনিতে গেলাম।

    ব্যালকনির গ্রিলের উপর এক হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। আমার ঠিক পাশেই আরহান। চারিপাশে শীতল বাতাস বইছে। কিছুক্ষণ আগের সেই ভয়ের রেশ মাত্র নেই। হুট করেই এক দমকা হাওয়া সাথে করে কিছু বারিধারা নিয়ে আগমন ঘটালো। সব ভুলে এই বর্ষণের রাতে প্রকৃতি বিলাসে মত্ত হয়েছি দুজন। ঘুম যেনো আমাদের দুজনের চোখের জন্য নিষিদ্ধ এক বস্তু হয়ে গিয়েছে।

    বৃষ্টির ছিটে আমার চোখ মুখ ছুঁয়ে দিচ্ছে। এতক্ষণ বাইরে তাকালেও আরহানকে দেখতে চাওয়ার ইচ্ছেতে উনার দিকে মুখ ফিরালাম। চোখাচোখি হয়ে গেলো। উনিও আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। নেশাক্ত নয়ন তার। অধর কোণে নেই কোনো হাসি। বড্ড গম্ভীর তার মুখশ্রী। তা দেখেই আমার বুকটা ধুক করে উঠলো। নিস্তেজ ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হয়তো কিছু অনর্থ ঘটানোর জন্যই এই ধারার পতন।

    আবেদনময়ী এই প্রকৃতিতে আরহানের নেশাক্ত নয়ন জোড়া আমার হৃদ যন্ত্রের অসুস্থ হয়ে যাবার মুখ্য কারণ হয়ে দাঁড়ালো। স্থির আরহান হুট করেই তার পা জোড়া গতিশীল করে আমার দিকে এগোলেন। মাঝে ইঞ্চির গ্যাপ রেখে থেমে গেলেন। শ্বাস গুলো মিলে যেনো এক হয়ে যাচ্ছে। হয়তো এক হবার সময় এসেই গিয়েছে।

    ডান হাত এগিয়ে আমার বা পাশের এক গাছি চুল কানের পিঠে গুঁজে দিলেন। অধরযুগল কানের নিকটবর্তী রেখে ফিসফিসিয়ে বললেন,“ভালোবাসো?”

    আরহানের ঠোঁটের উষ্ণ স্পর্শ, ‘ভালোবাসো?’ প্রশ্নটি করার সময় বারবার আমার কানে এসে লাগছিলো। সমগ্র শরীরে অদ্ভুত, অচেনা, ভালোলাগার এক শিহরণ ছেয়ে গেলো। চেয়েও কিছু বলতে পারছি না। শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেলো। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা আমার। ঝড় যেমন বাইরে বইছে, তেমনই আমার অন্তরেও। অশান্ত এই মনটা যেনো এখনই তার কাঙ্খিত কিছুর সান্নিধ্য পেতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। লাজুক ও ভীরু মুখশ্রী নিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি।

    আমাকে নিশ্চুপ দেখে আরহান সরে গেলেন। নিজের সামনে উনার অনুপস্থিতির আভাস পেয়ে চট করে চোখ খুললাম। আরহান মৃদু কন্ঠে,“আমি বেশি করে ফেলছি হয়তো” বলেই চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন।

    দ্রুত উনার হাত ধরে ফেললাম। আরহান আমার দিকে তাকাতেই আমি কম্পনরত অধর যুগল দ্বারা অতীব কষ্টে উচ্চারণ করলাম এই মধুর শব্দটি, “ভ’ভালো.. ভালোবাসি।”

    “সত্যি?”

    আরহানকে আজ বাধা দেবার ক্ষমতা আমার নেই। মাথা নিচু করে লাজুক হাসলাম। আরহান উনার জবাব পেয়ে এগিয়ে এলেন। আমার দুই গালে নিজের হাত এলিয়ে দিয়ে আমার মুখখানা নিজের দিকে তুলে ধরলেন। আমার নয়ন জোড়াকে নিজের গহীন দৃষ্টিতে প্রতীয়মান অনল দ্বারা ভস্ম করে বললেন,“নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসি তোমায় শুকতারা।”

    দূরত্ব ঘুচিয়ে আমার সবচেয়ে কাছে চলে এলেন। ওষ্ঠের সাথে ওষ্ঠ মিলিত হলো। সময় যেনো থমকে গেলো। হৃদয়ের অন্তঃস্থলের ঘূর্ণিঝড়টি নিমিষেই বারিধারায় পরিণত হলো। অতঃপর আরহান আমাকে পাজো কোলে নিয়ে আলগোছে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রুমে প্রবেশ করলেন।

    আজ বাঁধা দেবার কেউ নেই। প্রকৃতিও আজ চাচ্ছে যেনো এমনটাই হয়। বৃষ্টির তেজ বাড়ছে তো বাড়ছেই। রুমের ভেতরেও দুজন ভালোবাসার মানুষ ভিজতে চলেছে এক বৃষ্টিতে। সমগ্র প্রকৃতি সাক্ষী রইলো। আজ দুজন ভালোবাসার মানুষ এক হতে যাচ্ছে। এক সুখময় বৃষ্টিতে ভিজতে যাচ্ছে।

    চলবে…