Tag: গল্প

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-২)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-২)

    আজ সকালে জাহিদ এসেছে বাসায়, সাথে বস্তা ভর্তি জিনিস পত্র। খুব ভোরে এসে পৌছেছে বাসায়।

    ভাই-বোনের মধ্যে জাহিদ চতুর্থ। জাহিদ এবার ডিগ্রি ২য় বর্ষে পড়ছে। গ্রামে বেশ কয়েকটি টিউশনি পড়ায়, চাকরীর জন্য পড়াশোনা করে যাচ্ছে। য্যাতে ডিগ্রি পাশ করার পর আর বসে থাকতে যেন না হয়। সব মিলিয়ে যা টাকা পায়, তা দিয়ে শাক-লতা পাতা দিয়ে কোন রকম টেনেটুনে সংসার চালায় সে।

    কলি ভাইয়ের একদম পাশে বসে আছে। তার আজ খুব আনন্দ লাগছে মেজ ভাই বেড়াতে আসায়।

    পলি বললো মেজ ভাই এই এতো বড় বস্তায় কি?
    – তেমন কিছু না, সামান্য তরি তারকারি। আর বাদামের টানা, নিমকি, সরিষার তেল। এই টুকটাক কিছু জিনিস।
    – কেন? এতো কষ্ট করে এগুলো আনলে? কত দূরের রাস্তা, এই বস্তা নিয়ে কত কষ্ট হয়েছে।
    – টাকা থাকলে তোদের জন্য আর কিছু জিনিস পত্র কিনে আনতাম।
    – থাক, আর লাগবেনা।
    – ভাইজান কোথায়?
    – ঘুমে।
    – ওহ, এখন সাতটা বাজে মাত্র।

    নাহিদ বললো পলিপা, মেজ ভাইরে চা-বিস্কুট কিছু দেয়! সারা রাত ট্রেন জার্নি করে এসেছে।
    – হ্যা, হ্যা।

    নারে নাহিদ, পলিপা কে কিচ্ছু বলিস না, ও আনতে পারবেনা। ভাবী রাতে মিট সেইফ তালা দিয়ে ঘুমিয়েছে।

    জাহিদ বলছে৷ আরে না। আমার ক্ষিদে নেই। আহে বল, তোদের কলেজ কেমন চলছে।
    – মা কি করছে?
    – সারাদিন তোদের চিন্তা করে। তোরা কি করছিস? এই চিন্তায় অস্থির থাকে মা।
    – আমরা কত দিন বাড়ী যাইনা! ছোট ভাই আর মেজ আপু কি করছে?
    – ভালোই আছে। শাহিদ একবার বলে ডিগ্রিতে ভর্তি হবে, একবার বলে কেরানীর চাকরী হলেও চাকরী করবে। দেখা যাক কি হয়!

    সাঈদ এসে দাঁড়ালেন বললেন কি রে কখন এসেছিস তুই?
    – ভাইজান আধা ঘন্টা হবে।
    – মা কেমন আছে?
    – ভালো আছেন মা।
    – এতো সাত সকালে আসিস কেন? দিনে বের হবি, বিকালে আসবি। রাতে জার্নি করাটা ভালো নয়।
    – জি।
    – আমি নাশতা দিচ্ছি, আর তোরা আস্তে কথা বল, তোর ভাবীর রাতে কেন যেন ঘুম হয়নি। আজ একবার ডাক্তারে নিয়ে যেতে হবে।

    পলি বললো ভাইজান আমি নাশতা বানিয়ে দিচ্ছি।
    – তুই কি নাশতা করবি?
    – রুটি সবজি করি, বা খিচুড়ি।
    – না, না। দরকার নাই ঝামেলার। আমি দিচ্ছি।
    – ভাইজান।
    – না বললাম, আর আস্তে কথা বল।

    কলি বললো মেজ ভাই, ভাইজান ভাবীরে ভয় পায়, যদি রাগ করে এজন্য নিজে নাশতা বানাতে গেল। কি বানাবে আল্লাহ জানেন।
    – থাক, কথা বলিস না। আর আমার এমন সাত সকালে আসা ঠিক হয়নি।
    – অবশ্যই ঠিক হয়েছে।
    – আস্তে কথা বল, পরে ভাইজান রাগ করবে।

    সাঈদ চারটা ডিম সিদ্ধ দিল, চারটা মিডিয়াম সাইজের আলু। তারপরে এগুলি চারটা প্লেটে করে ওদের রুমে নিয়ে গেল। বললো এই জাহিদ তোমরা নাশতা করে নাও। ডিম আর আলু খাও, আর সাথে দুটি করে কাঁচামরিচ খাও। দেখবে খুব ভালো নাশতা হয়েছে। এগুলো হলো খুবই স্বাস্থ্যকর নাশতা।
    – জি ভাইজান। আপনি নেন।
    – আমি একটু পরে খাবো। আর বস্তায় করে শাক-সবজি কেন নিয়ে আসিস? এখানে সবই মিলে। থাকবি কি আজকে?
    – জি, কাল ভোরে রওনা হবো।
    – আচ্ছা। রাতে কথা হবে, এখন যাই।

    কলি বললো ভাইজান, একটু মুড়ি নিয়ে আসি?
    – নিয়ে আয়।
    – মিট সেইফ তালা দেওয়া।
    – হ্যা, তোর ভাবী বলছিল, মারুফা নাকি বিস্কুট চুরি করে খায়, সেজন্য তালা দেওয়া। তোদের খেতে ইচ্ছে করলে ভাবীর কাছে চাবি চেয়ে নিস। উঠুক তোর ভাবী, তখন মুড়ি পাবি।
    – জি ভাইজান।

    সাঈদ রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার পর, পলি বললো এই তোর মুড়ি খাওয়ার এতো শখ কেন?
    – এই আলু আর ডিম সকাল বেলা কেউ খায়?
    – কেউ খায়না, তুই খাবি।

    আচ্ছা, পলি বকিস না, আরেকবার আসার সময় আমি চিড়া মুড়ি বেশি করে নিয়ে আসবো। তোরা তোদের রুমে রেখে খেতে পারবি।
    – না, না। লাগবেনা।

    শারমিন ঘুম থেকে উঠেছেন দশটার সময়, উঠে তিনি মারুফাকে বললেন চা দিতে। তিনি চায়ের কাপ নিয়ে এসে বললেন। আরে, জাহিদ কখন আসলে?
    – ভাবী সকালে।
    – ভালো হয়েছে, তুমি এসেছো। কলি কাল বলছিল ওর নাকি দুটি খাতা আর কি একটা বই লাগবে। এগুলি একটু কিনে দিয়ে যেও। তোমার ভাইজানের সময় নাই একদম!
    – জি ভাবী দিব। আপনার শরীর কেমন?
    – হুম ভালো আছি। বস্তায় কি?
    – আমাদের ক্ষেতের শাক আর সবজি, শাহিদ এর হাতের জিনিস। আর মা সরিষার তেল, বাদামের টানা, আর নিমকি দিয়ে দিয়েছেন।
    – আরে, শাক-সবজি কেন আনলে? এগুলো এখানেই পাওয়া যায়। ভাবলাম মাস্টার দেবর ভাবীর জন্য দই-মিষ্টি নিয়ে আসবে।
    – আপনি দই খাবেন?
    – আনলে খাবো না কেন? আর জাহিদ তুমি এভাবে বস্তায় করে জিনিস আনবেনা প্লিজ। এই পাড়ায় আমার আব্বার খুব পরিচিতি। আমাদের চেনে সবাই। কি বলবে দেখলে।
    – আচ্ছা ভাবী। সমস্যা নাই।
    – আমি একটু রান্নাঘরে যাই, সংসারে কত কাজ আমার!
    – জি ভাবী।

    পলি বললো ভাবী চলেন,আমিও যাই আপনার সাথে।
    – আচ্ছা চলো।

    কলি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, বলছে মেজ ভাই। কবে বাড়ী যাবো আমরা? আব্বা কেন মারা গেল?
    – তুই কাঁদছিস কেন?
    – এখানে আমার একদম ভালো লাগেনা। ভাবী সব সময় খুঁচিয়ে কথা বলে।
    – ভালো রেজাল্ট করে, চাকরি করবি যখন, তখন এসব ভুলে যাবি। এখন আমাদের সময় টা খারাপ, ধৈর্য্য ধর, আর কি করবি?
    – আমার খাতা লাগবেনা।
    – আচ্ছা খাতা আমি কিনে দিব, সমস্যা নাই। কান্দিস না, মা শুনলে কত কষ্ট পাবে। এমনি সন্ধ্যা হলে তোর আর নাহিদের চিন্তা করে, কান্না করে শুধু।

    নাহিদ এখন আগের মতো রাগ করেনা ভাইজান। এই যে এতো দূরের রাস্তা হেঁটে চলে যায়। সাইন্সে পড়ে, কত পড়া। এই যে সকাল আট্টায় যায়, আর দুপুর দেড় টা দুইটা বাজে আসে। এই পুরো সময় কিছুই খায়না। ভাবীর ভালো লাগলে উঠে নাশতা দেয়, নয়তো ভাইজান ডিম সিদ্ধ দেয়, তাই খেয়েই বেড়িয়ে যায় নাহিদ।

    কলি, আমি একটু ভাবীর জন্য দই। আর তোর খাতা নয়ে আসি।
    – একটু সময় বিশ্রাম নাও?
    – না, সমস্যা নাই।

    জাহিদ ভাইরে যাওয়ার সময়, শারমিন বললেন এই জাহিদ তোনার কাছে চল্লিশ টাকা হবে?
    – জি ভাবী হবে।
    – পলির কাছে দিয়ে দাও। আসলে ওদের ভাড়ার জন্য তোনার ভাই একশো টাকার নোট দিয়ে গিয়েছেন। তাই, ভাবলাম তোমার কাছে থাকলে তুমি দিয়ে দাও।
    – আচ্ছা আমি দিচ্ছি।

    পলি কাছে এসে বললো আজ কলেজ যাবো না। তুমি এতো দিন পরে এসেছো।
    – না না। আমি আছি। যা তোরা কলেযে যা। এই নেয় চল্লিশ টাকা। আমার একটু কাজ আছে বাইরে। তোর কিচ্ছু লাগবে?
    – না না।

    জাহিদ রাস্তায় বেড়িয়ে দেখছে পকেটে যা টাকা আছে তাতে দই, আর কলির খাতা আর বই কেনার পরে যে টাকা থাকে, তাতে ট্রেনের একটা স্টেন্ডিং টিকেটের টাকা হবে। আর ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত হেঁটেই যেতে হবে। আবার পরে স্টেশন থেকে বাড়ী ও যেতে হবে হেঁটে। থাক, তবুও ভালো এদের কিছুব প্রয়োজনে টাকা লাগবে।

    ভাবীর অভ্যাস সব সময় ভাইজানের কিছু কেউ কিছু চাইলেই অন্য কারোর উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া। কিন্তু তার কাছে এক টাকার যে কি মূল্য সেটা কি ভাবী বুঝবে! না হয়তো বুঝবেন না।

    জাহিদ রাস্তা দিয়ে হাঁটছে আর ভাবছে এই যে চাকরি তুমি কোথায়? কবে দেখা দিবে? কলি, পলি আর নাহিদ কবে একটা ভালো পজিশনে যাবে? কবে মুক্তি পাবে এই সংসার থেকে! জাহিদ দই কিঞ্চহে আর ভাবছে ভাবীর হয়তো দই পছন্দ না ও হতে পারে। তবুও তিনি যেন খুশি থাকেন তাই চেষ্টা করছে জাহিদ….

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী
    ০৭.১১.২০২১

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৬)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৬)

    পালমার্সটন নর্থ যাত্রা আর বন্ধুত্ব

    ভাগ্যটা বিধাতা নিজেই তৈরী করে দেন, এতে কারো কোনো হাত নেই। আমার মতে সকলের জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ,রিজিক এমনকি কে কোথায় কখন কি করবে সব কিছুই পূর্বনির্ধারিত। আর আমরা কি কষ্টই না করছি প্রতিমুহূর্ত সেই রম্যনাটকে অভিনয় করতে গিয়ে। কেউ ধনী কেউ গরীব কেউ সক্ষম কেউ অক্ষম কেউ উদার কেউবা কৃপণের ভূমিকায় নিরলস পরিশ্রম করে চলেছি। এতো এতো ধনী পৃথিবীতে থাকতেও যেখানে মাত্র একজন ধনী পৃথিবীর সকল ক্ষুধা নিবারণ করতে পারে সেখানে প্রতি মিনিটে ক্ষুধায় কতজন মারা যাচ্ছে। অনেকেই যখন বলে দেখো দেখো আমি নিজ পরিশ্রমে নিজ শক্তিতে এতোদূর এসেছি আর এতো বড় হতে পেরেছি- আমি তখন মনে মনে হাসি আর বলি সবই তাঁর ইচ্ছে।

    আমি ইউ এস এম এল এ পার্ট ওয়ানের ফর্ম জমা দিয়ে মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকলাম। পড়াশুনা তেমন হয়নি, সারাদিন ঘর সংসার প্রমাকে দেখাশুনায় সময় পার হয়ে যায়। তারপর যখন পড়তে বসি চিন্তা আর অবসন্নতা মনকে ছেয়ে ধরে। ঘুম পায়,ভীষণ ঘুম পায়। মাঝে মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি আর স্বপ্নে দেখি আমি সবার শেষে পরীক্ষার হলে পৌঁছেছি ততক্ষণে সবার লিখা প্রায় শেষ। অথবা আমি যেগুলো জিনিষ রিভাইজ করে আসতে পারিনি সেগুলো সব প্রশ্নপত্রে আর আমি কিছুই পারছি না। সময় সময় অবশ্য ঘুমের মধ্যে আমি দেখি পাতার পর পাতা আমি পড়ে ফেলছি, হঠাৎ ঘুম ভাঙলে চেষ্টা করি দেখিতো যা পড়লাম তার কিছু মনে আছে কিনা! আমার কারো সাথে জোট করে পড়বার সৌভাগ্য হলো না বা একদিনও লাইব্রেরিতে যাওয়া হলো না। আমি প্রমাকে খাওয়াই আর পড়ি, রান্না করি আর পড়ি, সকল কাজে প্রমা আর বই আমার সঙ্গী। তবু আমি এক হীনমন্যতায় ভুগতে থাকলাম যদি আমি পাশ করতে না পারি? চুরি করে ফর্ম জমা দেবার সাজাটা ঠিক মিলবে আর সহজে জীবনে পরীক্ষার কথা তুলতে পারব কিনা সন্দেহ।

    আল্লাহর অশেষ রহমতে পরীক্ষা আমার মন্দ হলো না আর রেজাল্ট ও তদ্রুপ বেশ ভালোই পেলাম। ওমন নম্বর দুই চারজন পেয়েছে হয়তোবা। আমার মনে দৃঢ়তা চলে আসল যে কোনো উপায়েই আমাকে পড়াশুনা চালিয়েই যেতে হবে আর কর্মক্ষেত্রে যোগদান করতে হবে। আমি শুধু শুধু বাংলাদেশর সবচাইতে ভালো মেডিক্যাল কলেজ থেকে সন্মানের সাথে পাশ করে আসিনি। ইতোমধ্যে প্রমার বাবা ক্লিনিক্যাল পরীক্ষা পাশ করে চাকুরী যোগাড় করে ফেলল পালমার্সটন নর্থ নামের এক শহরে। আমাদের সেখানেই দ্রুত যেতে হবে আর আমি বুঝে গেলাম আমার সংগ্রাম তখন থেকে বাড়বে বৈ কমবে না। আমাদের বাসার যৎসামান্য ফার্নিচার বিক্রি করে দিলাম আর বাকী জিনিষগুলো যারা আসবাবপত্র কিনল তাদের এমনিতেই দিয়ে দিলাম। প্যসিফিক আইল্যনড এর যুগল তাতে দারুন খুশী হলো। আমি আমার স্বামীর বেতনের সংবাদ শুনে ওখানে নতুন জিনিষপত্র কিনে ভালমতন বাসা সাজানোর পরিকল্পনা মনে মনে করে ফেললাম। ওখানে হাসপাতালের দুই বেডরুমের একটা বাসা আমাদের জন্য বরাদ্দ করে রাখা হয়েছিল।

    তবে আমাদের মনে সামান্য দুশ্চিন্তা হতে শুরু করলো গাড়ির ব্যপারে। আমরা আমাদের পুরনো হোনডা সিভিক গাড়িতে সাত আট ঘন্টা দূরযাত্রায় পরিবহন করে ঝুঁকিমুক্ত পৌঁছাতে পারব কিন এব্যপারে সন্দেহ জাগলো। এর পরিপ্রক্ষিতে আমার সদয় বন্ধু মোমিন আমাদের অতদূরের শহর পর্যন্ত সঙ্গ দিতে রাজী হলো এবং কথা হলো ও দুই একদিন পালমারসটন নর্থ থেকেই আবার অকল্যনডে ফিরে আসবে। আমি প্রমা, তার বাবা আর মোমিন যথারীতি সকাল সকাল রওনা করলাম। সাথে ছিল গাড়ি ভর্তি নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল। অনেকটা পথ গাড়ি ভালোই চললো তবে শেষরক্ষা হলো না। এখানে বলে রাখা ভালো যে নিউজিল্যান্ডের প্রায় সব শহরে যাবার পথই বেশ দূর্গম আর পাহাড়ী। একবার চূড়োয় উঠতে হয় বেশ খানিকটা উপর আবার নামতে হয় ঢাল বেয়ে আর এরকম চক্রাকারে চলতেই থাকে। আমরা দুপুরে মধ্যাহ্ন ভোজন সারলাম আর বেশ খানিকটা পথ তারপর ভালোমতনই এগুলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন প্রায় রাত নেমে এসেছে তখন গাড়ি উচ্চগামী পথে আওয়াজ দিতে শুরু করলো যে তার কষ্ট হচ্ছে। তারপর আর বেশীক্ষণ লাগল না/একেবারে নির্জন এক পাহাড়ী জঙ্গলা জায়হায় গিয়ে গাড়ি পুরোই মারা গেলো। আশপাশটা ঘুটঘুটে অন্ধকার পূরোই অরণ্য, জনমানব বা বাড়িঘরের অস্তিত্ব নেই। সেইযুগে সেলফোনের তেমন প্রচলন ছিল না বিধায় আমাদের বা মোমিনের সেই সুবিধাও নেই।

    ভয়ে আমার আত্মা প্রায় খাঁচা ছাড়া, ছোট্ট তিন বৎসরের প্রমাসহ অত রাতে আমরা কি বিপদেই না পড়লাম। এই বুঝি দূর্ধর্ষ ডাকাত বা ছিনতাইকারী আমাদের ধরলো! মোমিন সাহস করে বললো “ঐ দূরে প্রায় এক দেড় কিলোমিটার তো হবেই আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। ওটা নিশ্চিত কারো বাড়ি, আমি এগিয়ে দেখি কাউকে পাই কিনা। রশীদ ভাই আপনি থাকেন ওদের সাথে।” বেচারা কষ্ট করে কতক্ষণ তা বলতে পারব না পাহাড়ী পথে হেঁটে হেঁটে যেই বাড়ির আঙিনায় পৌঁছেছে। ওমনি বিশাল এক কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ও ভাবল বাঁচার আর উপায় নেই, কুকুরের আক্রমণেই শেষমেষ মৃত্যু। ওর প্রাণপন চিৎকারে বাড়ির মালিক এক মহিলা অবশেষে বেরিয়ে এলো। মোমিন আমাদের বিপদটা বুঝিয়ে বলে একটা ফোন করতে চাইলে মহিলা তা করতে দিলো। অবশেষে আবার অতটা পথ অন্ধকারে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে ফিরে এলো। আমাদের অতঃপর পালমার্সটন থেকে প্রমার বাবার দুই বন্ধু মোখলেস ভাই আর শরীফ ভাই নিতে আসলেন । আমি আবার নিশ্বাস নিলাম তখন। উনাদের হাসিমুখ ভুলবার নয়। জানতে পারলাম আমরা বুলস শহরের কাছাকাছি ছিলাম। ওখানে এক জিপির নাকি প্লেন আর হেলিকপটার আছে। তাতে করে আমরা বাকী পথ যেতে পারতাম! আমরা বাকীটা পথ গাড়িতে বসে মোমিনের লোমহর্ষক কাহিনী শুনতে থাকলাম। আমি ভাবলাম জীবনে কোনো কোনো বন্ধুর একদিনের অবদানের জন্যেই আজীবন সেই বন্ধুর কাছে ঋণ থেকে যায় যা কোনোদিন শোধ করবার নয় । ভালো থাকুক মোমিন আর তার সংসার। ভালো থাকুক বন্ধুতব ..ভালো থাকুক মানবতা।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-১)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-১)

    কলি এই নিয়ে তিনবার ভাবীর রুমে গেল। তিনি হাত ইশারা করে বলছেন, এখান থেকে চলে যেতে, পরে আসতে। এই দিকে কলির কলেজ যাওয়ার দেরী হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভাবী ফোনে কথা বলেই যাচ্ছেন।

    কলি এবার রুমে এসে তার বোন পলিকে বললো আপা, বাদ দেয় আজ কলেজ যাবো না। ভাবী ইচ্ছে করেই এসব করছে যাতে, আজ কলেজ যাওয়ার রিকশা ভাড়া টা না দিতে হয়।
    – তাহলে চল, হেঁটে রওনা দেই।
    – তুই কি পাগল হয়েছিস আপা?তিন কিলোমিটার দূরে কলেজ, কেমনে যাবো?
    – তাহলে অপেক্ষা কর!
    – আচ্ছা আপা, ভাইজান কি সকালে আমাদের হাতে চল্লিশ টাকা দিয়ে যেতে পারেনা? প্রতিদিন ভাবীর হাত থেকে চেয়ে নিতে হয়!
    – এটা ভাবীর সংসার কলি। আর ভাইজান আমাদের টাকা দেন, এটা ভাবী পছন্দ করেন না।

    কলির ভাবী, শারমিন জাহান, খুব অহংকারী একজন মানুষ। অহংকারের কারণ অনেক গুলোর মধ্যে প্রধান কারণ হলো উনার বাবা শফিক সাহেব, জেলা কৃষি কর্মকর্তা। তাছাড়া বাবার ছয়তলা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে শহরের মধ্যেখানে, চার বোনের মধ্যে শারমিন সবার বড়, এবং আদরের। বাকি তিন বোনের মধ্যে আইরিন কলেজে, এবার এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিবে। তারিন পড়ছে ক্লাস টেনে, ছোট বোন আয়মন ক্লাস সেভেনে।

    অন্যদিকে শারমিনের স্বামী, সৈয়দ সাঈদুজ্জামান হলেন কৃষি অধিদপ্তরের একজন অফিসার। ভদ্র এবং মেধাবী সাঈদ কে শফিক সাহেবের বেশ পছন্দ হয়। তাই তিনি সরাসরি সাঈদ কে নিজের কক্ষে ডেকে নিয়ে বলেন সাঈদ তুমি কি আমার মেয়েকে বিয়ে করবে?

    সাঈদ বেশ অবাক হলো এই কথাটি শুনে! কারণ শফিক সাহেবের মেয়ে এই বার মাত্র ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছে। তাছাড়া সাঈদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা সুবিধার নয়, সাত ভাই-বোনের সংসার। স্কুল শিক্ষক বাবার সামান্য পেনশন আর তার বেতনের টাকার কিছু অংশে কোন রকম টেনেটুনে চলে সংসার। সেখানে তিনি হঠাৎ করে সাঈদকে কেন পছন্দ করলেন? এটা সাঈদ কোনভাবেই মেলাতে পারছেনা। তাছাড়া বয়স বত্রিশ হয়ে গেলেও সাঈদ বিয়ের ভাবনা এখনো ভাবেনি।

    সাঈদ বললো আমার মা-বাবার কাছে আপনি প্রস্তাব দিয়ে দেখতে পারেন, তাছাড়া আমার পরিবারের আমি বড়।
    – আমি গত মাসে তোমার বাড়ী দেখে এসেছি।

    সাঈদ আরও অবাক হয়, তার বাড়ী দেখেও তিনি পছন্দ করেছেন! কারণ তাদের বাড়ীর অবস্থা তেমন সুবিধার নয়, বহু বছর বাড়ীর মেরামত হয়না। দুই কক্ষের টিনের একটা বাড়ী। যদিও গ্রামে সৈয়দ বাড়ীর আলাদা সুনাম আছে।

    মাস দুয়েকের মধ্যে বিয়ে হয়ে যায় সাঈদের। বিয়ের পরে, শ্বশুড়ের বাসার পাশেই একটা বাড়ী ভাড়া নেয় সাঈদ। আর তার দুই বোন কলি আর পলি কে এনে ভর্তি করিয়ে দেয়, সরকারি মহিলা কলেজে। আর ছোট ভাই নাহিদ এস.এস.সি পাশ করার পর, ঢাকার কলেজে চান্স পেলেও টাকার হিসেব মিলাতে না পেরে তাকেও সরকারী কলেজে একাদশ শ্রেনীতে ভর্তি করে দেয় সাঈদ।

    বিয়ের তিন মাস পরেই সাঈদের বাবা স্ট্রোক করে মারা যান, তার মা রাহেলা বেগম বাকি তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে বাড়ীতেই থাকেন। স্বামীর পেনশন আর মেজ ছেলের টিউশনিতে চলছে সংসার। বিয়ের পর থেকে সাঈদ টাকা দিতে একদম পারছেনা। পলি, কলি আর নাহিদ কে সাঈদ, তার বাসায় রেখে পড়ার সুযোগ দিয়েছেন তাতেই খুব খুশি রাহেলা বেগম।

    কলি জামা কাপড় বদলে বসে আছে, মন খারাপ করে। পলি এখনো কাপড় পরেই আছে। শারমিন এসে রুমে ঢুকে বললেন, কি কলি? বার বার রুমে যাচ্ছিলে কেন? মামীর সাথে কথা বলছিলাম।
    – ভাবী,
    – কি?
    – ভাড়ার জন্য…
    – দুই বোন গল্প করতে করতে হেঁটে হেঁটে চলে যাবে। প্রতিদিন রিকশা করে যেয়ে কি লাভ?

    কলি তখন বললো আজ আর যাবো না ভাবী, থাক ভাড়া লাগবেনা।
    – ওহ, তাইতো কলেজে প্রতিদিন গিয়ে কি করবে? অনার্সে কেউ রেগুলার কলেজ যায় নাকি!
    – জি ভাবী।

    পলি আসো আমি মুরগী রান্না করবো, আমার একটু ঝামেলা হয়ে যায়, তুমি দেখিয়ে দিবে।
    – কাপড় টা বদলে আসি?
    – আচ্ছা। তাড়াতাড়ি এসো।

    পলি, ভাবী যাওয়ার সাথে সাথে বললো এই কলি কেন বললি আজ যাবিনা? এখনো গেলে আরও দুটি ক্লাস করা যেতো।
    – শোন, আপা আমি তোর মতো এতো বেহায়া না, দেখেছিস ভাবী চল্লিশ টাকা বেঁচে যাওয়ায় কি খুশি হয়েছে।
    – আমি বেহায়া না হলে, তিন বার আব্বা আমার পড়া বাদ দিলেন। এখন দুই বছর গ্যাপ দিয়ে তোর সাথে অনার্সে ভর্তি হই?
    – যা, যা। মুরগী রান্না কর।
    – মন খারাপ করিস না, কাল কলেজ যাবো। এখন পারলে একটু পড়। নাহিদ আসবে কখন?
    – জানিনা।

    পলি রান্না ঘরে দাঁড়িয়ে আছে, আর বলছে হলুদ দুই চামচ দেন ভাবী, মরিচ দুই চামচ দেন। পলি যেভাবে বলছে সেভাবেই রান্না করছে শারমিন। সে রান্নার কিছুই পারেনা। ঘরের কাজের মেয়ে মারুফা ফিক করে হেসে বললো মামী দেহি কিচ্ছু ফারেনা।
    – তুই হাসিস কেন? একদম চড় দিমু।
    – আইচ্ছা হাসতাছিনা।

    নাহিদ ঠিক দুপুর একটায় বাসায় এসে ঢুকলো, এসেই কলি কে বললো ছোট আপু যা, কিছু খাবার নিয়ে আয়। খুব ক্ষিধা লাগছে, পেট মুচড়ে যাচ্ছে।
    – রান্না শেষ হয়নি।

    এর মধ্যে পলি এসে বললো কি রে তুই চলে এসেছিস দেখছি।
    – আপা, পারলে কিছু খাবার দেয়, ক্ষিধা লাগছে। বিস্কুট মুড়ি, খই। যা থাকে নিয়ে আয়।

    পলি রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো ভাবী নেই।মারুফা বসে বসে লেবু কাটছে।

    কি রে মারুফা মিট সেইফে তালা দিল কে? বিস্কুট নিতে চেয়েছিলাম।
    – মামী দিয়েছে তালা।
    – ওহ। আচ্ছা।

    পলি রুমে গিয়ে বললো, নাহিদ কিচ্ছু নাই রে।
    – কিছুই নাই?
    – না।

    কলি বললো কেন কাল দেখলাম ভাইজান, এক প্যাকেট বিস্কুট, চানাচুর আর মুড়ি এনেছে। এগুলো শেষ হয়ে গেল?
    – হ্যা।

    নাহিদ শোন, গত কাল কিছুদূর হেঁটে রিকশায় আসায় ৫ টাকা কম ভাড়া দিয়েছিলাম। এই নেয় পাঁচ টাকা, মোড়ের দোকান থেকে একটা বনরুটি খেয়ে আয়।
    – না, থাক। একটু পরে ভাত খেয়ে নিব।
    – ভাত, এখনো ভাবী বসায় নি। তরকারি হচ্ছে।
    – তাহলে দেয়, বন রুটি খেয়ে আসি।

    নাহিদ যাওয়ার পর পলি বললো ভাবী মিটসেইফ তালা দিয়ে রেখেছে।
    – কেন আমরা সব খেয়ে নিব এজন্য?
    – সেটা জানিনা।
    – তুই বুঝেও চুপ করে থাকিস। আর শোন ইচ্ছে করে ভাত সবার শেষে রান্না করে। যাতে, আমরা আগে নিয়ে খেতে না পারি।
    – কলি, মা কি বলেছে ভুলে গিয়েছিস? মা বলেছে চুপ করে থাকতে, এটা ভাবীর সংসার।
    থাকছিস, খাচ্ছিস এটাই বেশি।
    – আমাদের ভাইজানের তো টাকা।
    – ভাইজান এখন বিবাহিত, সুতরাং তার সংসার এটা। আমি ভাত বসাতে পারি কিনা, দেখি। পাগলার ক্ষিদে লাগছে।
    – আপা, তুই বড় মিথ্যুক। কাল কখন রিকশাওয়ালা পাঁচ টাকা কম নিল?
    – এটা না বললে নাহিদ টাকা নিতো না। এজন্য বলেছি। আচ্ছা আমি যাই।

    পলি ভাত বসানোর পরে শারমিন এসে বললেন মাত্র দেড়টা বাজে, এখন ভাত বসিয়ে দিলে? তোমার ভাইজান আসে চারটায়, আমি তার সাথে খাই। আমি ঠান্ডা ভাত খেতে পারিনা।

    পলি ভাতের বলকের উঠা দেখছে আর ভাবছে, কবে মেজ ভাইজানের চাকরী হবে? বড় আপার বিয়ে হবে? তাদের পড়াশোনা শেষ হবে? কত দিন ভাবীর সংসারের আগাছা হয়ে থাকতে হবে? বাবা কেন এতো তাড়াতাড়ি মরে গেলে!

    নাহিদ পিছন থেকে এসে বলছে, তাড়াতাড়ি ভাত রান্না শেষ কর, গোসল করেই খাবো।

    পলি ভাবছে নিজে নিজে ভাত নিলে, ভাবী যদি রাগ করে? মুরগীর কোন পিস নাহিদ কে দিবে? কাচের প্লেটে ভাত বাড়লে কি ভাবী রাগ করবে? একদৃষ্টিতে দূরের মাটের দিকে তাকিয়ে কত কিছু ভাবছে পলি…..

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৫)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৫)

    প্রবাস জীবনে সংসার আর পেশার দ্বন্দ্ব

    হাসি আনন্দের পরিচায়ক এবং সাংঘাতিক সংক্রামক, মোটামুটি সকলেই হাসতে পছন্দ করে। হাসি নিমিষে কষ্ট বিলীন করতে পারে,হোক তা সাময়িক আর আমার হাসি যদি অন্য কারো মুখে মুহূর্তের হাসি আনন্দ এঁকে দিতে পারে তবে সেই হাসি ধন্য। কার জীবনে কষ্ট নেই তবে কষ্টগুলো একান্তই নিজস্ব এবং কোনো কোনো কষ্টকে মস্তিষ্কের এমন কুঠোরে রেখে দিতে হয় যাতে নিজেই তার খোঁজ সহসা না পাওয়া যায়। কষ্টে বুক ফেটে কান্না আসবেই এবং কান্নাটাও স্বাভাবিক মানুষ মাত্রেই। কেউ না কাঁদতে পারলেই বুঝতে হবে তার মানবিক কোনো সমস্যা আছে। কিন্তু কষ্ট দেখানোর বিষয় নয়, যারা বুঝবার তারা মুখের শব্দে বা চোখের চাহনিতে ঠিকই বুঝে নিবে। আর জীবনে বাবা মা ছাড়াও এমন আর একজন মানুষ থাকাই যথেষট, যাকে কিছুই খুলে বলতে হবে না। আবার যাকে খুলে বলতে হবে- কি কখন কিভাবে কোথা থেকে এবং কেমন করে সে কোনোদিনই কষ্টের পরিমাপ বুঝতে পারবে না, পাশে থাকা দূরের কথা। আমাদের দেশের মেয়েগুলি সাধারণত এক্ষেত্রে বড্ড অসহায় কারণ মেয়েরা জন্মগতভাবেই সংবেদনশীল তাই তারা অন্যের মানবিক চাহিদা নিজ থেকে যেঁচেই পূরণ করে। অন্যদিকে বেশীরভাগ ছেলেদের ছোট থেকেই তৈরী করা হয় শক্ত, আত্মনির্ভর অনেকটা স্বার্থচিন্তক হিসেবে। কারো কান্না দেখলে তাদের দূর্বল মনে হয় আর বেদনার ভাষা না জানলে কিভাবে করবে সমবেদনা পোষণ। আমি তাই বিদেশ বিভুঁই এ ক্রমশ কারণে বা অকারণে হাসতে শিখে গেলাম যা আমার বুকে কষ্টের পরিধি নিয়ত বাড়িয়েই চললো।

    আমি সংসার করছি মন বেঁধে আর প্রচন্ড সফলতার সাথে তাই প্রমার বাবা দুই পার্ট ইউ এস এম এল ই পাশ করলো। তারপর শুরু হলো ক্লিনিকাল পরীক্ষা দেবার প্রস্তুতি। তার ফলে কিছু নতুন মানুষের সাথে যোগাযোগও তৈরী হলো-অবশ্য মূলত প্রমার বাবারই। আমি ঘরের বৌ ই থেকে গেলাম। তবে সুযোগ পেলে প্রমার মুখে এক লোকমা ভাত দিয়ে বা কখনো কখনো রান্না পুড়িয়ে হলেও বইয়ে ডুবে থাকতে পছন্দ করতাম। প্রমার বাবার বন্ধু কে ৩৬ নিপু ভাই আর হ্যাপী ভাবীর সাথে আমাদের সখ্যতা হলো। হ্যাপী ভাবী নামের মর্যাদা রেখে আমার সাথে দুর্দান্ত হাসতে পারতেন। খুব মজার মজার রান্না করতেন তবে পোলাও এর মাঝে কেনো যেনো উনি বুট মিশিয়ে দিতেন তা ছিল আমার বোধ আর আকাঙ্খার বাইরে। মাঝে মাঝে সপ্তাহানতে আমরা বেড়াতে যেতাম দূরে কোনো সমুদ্রতীরে নিপু ভাই ভাবীদের সাথে। উনাদের এক ছেলে ছিল অনিক, খুব কথা বলতে পছন্দ করতো। আমরা বেড়াতে যাবার সময় পাশে বসলে করতো হাজারো প্রশ্ন। একবার বেড়াতে যাবার সময় প্রমা আমি ঠিক বুঝে উঠবার আগেই গাড়িতে বমি করে ফেললো। প্রমার কোনো দিনই মোশন সিকন্যাস ছিল না। ওই প্রথম সে গাড়িতে বমি করলো, আর দশ বৎসরের দুষ্টু অনিক তিন সাড়ে তিন বৎসরের প্রমাকে পুরোটা পথ এ বিষয়ে মজা করেই ত্যক্ত করলো। অনিকের মা হ্যাপী ভাবী যখন গর্ভবতী হলেন , আমাকে বড্ড জ্বালিয়েছেন। হঠাৎ করে বাসায় এসে বলতেন ভাবী আমি কিছু গন্ধ সহ্য করতে পারছি না। আপনি আমার জন্য একটু রান্না করেন তো- পেঁয়াজ রসুন হলুদ মরিচ ধনে জিরার গুঁড়া কিছু দিবেন না।আমি বললাম তো কি দিয়ে রাঁধব? উনি নির্ধিধায় বললেন “শুধু কাঁচা মরিচ”- হায়রে হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো আর অযাচিতভাবে মানুষকে আপন করে নেবার আমাদের অভ্যেস।

    কে ৩৬ এর প্রমার বাবার আর এক বন্ধু মোদাসসির ভাইদের বাসায়ও আমাদের যাতায়াত আর তাদের সাথে আন্তরিকতা ছিল প্রথম থেকেই। ভাই ভাবী ফর্সা আর তাই তাদের টুকটুকে ফর্সা আর সুন্দর এক ছেলে এক মেয়ে ছিল। আমরা অকল্যানডে মাত্রই বাসা নিয়েছি, বিদেশী পরিবেশে একেবারেই নতুন। আমাদের ছোট্ট টেলিভিশন চলছে, আমি রাত ন’টার দিকে প্রমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে বসার রুমে আসতেই প্রমার বাবার উৎকন্ঠিত স্বর শুনতে পেলাম। পৃথিবী তো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে! আমি টিভির দিকে তাকিয়ে আমারও উৎকন্ঠা লুকোতে পারলাম না। আমি একবার টিভিতে খবর শুনছি,এসটেরয়েড এসে পৃথিবী ধ্বংস করছে, লোকজন সব আতঙ্কিত হয়ে রাস্তায় ছুটাছুটি করছে। আবার জানালা দিয়ে বাইরের পরিবেশ বুঝবার চেষ্টা করছি-শুনশান নিরবতা যেমনটি সবসময়। ওদিকে প্রমার বাবা মা বাবা ভাই বোনদের সাথে কথা শেষ করে মোদাসসির ভাইকে ফোন দিয়েছ। জানিস পৃথিবী যে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে? “ কি বলিস?জানি না তো! “ সহজ সরল মোদাসসির ভাই তখন বউ বাচ্চাদের নিয়ে কোনো প্রশ্ন না করেই একেবারে গ্যারেজে অবস্থান নিলেন। অতঃপর প্রমার বাবা নিপু ভাইকে ফোন দিলো ভাগ্যিস। নিপু ভাই তড়িৎ টিভি দেখে বললেন “ তোরা কি পাগল হয়েছিস? এটাতো মুভি!” এখন পর্যন্ত বাচ্চারা সব একত্রিত হলে আমাদের নিয়ে বিশেষ করে মোদাসসির ভাইকে নিয়ে হাসাহাসি করে।

    আমার বাবা মায়ের সাথে প্রায় প্রতিদিনই কথা হতো প্রতিবার বড়জোর মিনিট দুই তিন। উনারা আমাদের বিশেষ করে প্রমার খোঁজ নেন তারপর আমার পড়ালিখার! আমি তেমন সহজ করে জবাব দিতে পারি না। তখন ওভারসিজ ফোনের বিল ছিল কড়া আর মিনিট হিসেবে, কথা বিস্তারিত হতো না। বড়ভাই কাওসার আয়ারল্যান্ডের কর্ক শহরে কাজে নিয়োজিত, কথা হতো মাঝেমধ্যে। নিউজিল্যান্ডের ভিসা রক্ষার্থে ও আবার আসবার প্ল্যান করছে অকল্যানড। আমি একদিন সাহস করে বলেই ফেললাম “তুই কি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতে পারবি?” ও বললো পারব, কত এবং কিসের জন্য? আমি খুলে বলতেই ভাইয়া সেদিনই এগারো শত ইউ এস ডলার পাঠিয়েছিল – আমি তার জন্য কৃতজ্ঞ। আমি দুঃসাহসিক কাজটা করেই ফেললাম। তাড়াতাড়ি ইউ এস এম এল এ পার্ট ওয়ান এর ফর্ম ফিলাপ করলাম নইলে পরের মাসে পরীক্ষা দিতে পারতাম না। প্রমার বাবা সেদিন ঘরে ফিরলে সব বলতেই সে বললো” তুমি টাকা পেলে কোথথেকে?” তার গলার স্বরে সেদিন আমি হয়তো নিরাশার স্বাদ পেয়েছিলাম, বা হতে পারে সেটা আমার নিছক কল্পনা।

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৪)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৪)

    বিদেশে আমার প্রথম সংসার

    খেয়াল করেছি মানুষের যখন অল্পতেই তুষ্টি তখন কোন কিছু খুঁজে পেতে বা কিনতে বেগ পেতে হয় না। আমাদের ও অকল্যান্ডে বাসা খুঁজে পেতে মাত্র এক সপ্তাহান্ত লাগল। বাসার ন্যুনতম নির্নায়ক ছিল এটি অকল্যান্ড হাসপাতালের কাছাকাছি হতে হবে যার লাইব্ররীতে প্রমার বাবা পড়তে যেতে পারবে পায়ে হেঁটে এবং সহজেই। দুপুরে ইচ্ছা করলে খেতে বাসায় আসতে পারবে। অন্যটি হলো দুই বেডরুম থাকতে হবে। আমাদের বাসা খোঁজা, পাওয়া, গাড়ী কেনায় তারিক ভাইয়ের সহায়তা অপরিহার্য় ছিল আর তাছাড়াও জুবায়ের ভাই, সায়েক ভাই, বাপ্পী ভাই ,মোমিন, আসিফ আর ফারহান সব সময় সাহায্যর হাত বাড়িয়ে দিতো। পার্নেল অকল্যানডের ‌অন্যতম দামী সাবার্ব বা শহরতলী হলেও মালিকের আমাদের জীবনের গল্প এবং আমরা দু’জন সংগ্রামরত ডাক্তার হওয়াতে ফ্ল্যাটটি আমাদের দিতে একটুকুও কুন্ঠাবোধ করলেন না। উপরন্তু পরে টের পেলাম খুবই কম ভাড়ায় এবং সামান্য নিরাপত্তা চুক্তি স্বরুপ টাকাতে উনি আমাদের বাসাটা দিয়েছেন।

    উনার বয়স হয়তো পয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মধ্যে হবে। উনি দু’ সপ্তাহ পর পর ভাড়া নিতে নিজে আসতেন এবং তখন কিছু খাবার দিলে নিতান্ত মজা করে খেতেন। পরের দিকে অবশ্য রাতের খাবারের সময় আসতেন, রাজনীতি, খেলা পড়াশুনা আত্মীয় স্বজন এসব নিয়ে অনেক অনেক গল্প হতো এবং রাতের খাবার দিয়ে তাকে আপ্যায়ন করতাম। আমার মনে আছে আমার ডাল রান্না উনার সবথেকে পছন্দ ছিল আর ডেভিড বোয়ি উনার প্রিয় মিউজিশিয়ান ছিল। বন্ধুত্বের কারণেই হোক বা নিজ উদারতা থেকেই হোক উনি দুই বৎসরের উপরের সময় কখনো বাড়ি ভাড়া বাড়ানোর কথা একবারও বলেননি। আমরা আগাগোড়াই মাত্র দুইশ বিশ ডলার প্রতি সপ্তাহে দিয়ে থেকেছি এবং পুরো নিরাপত্তা চুক্তির টাকা উনি বাড়ি ছাড়বার সময় ফেরত দিয়েছেন। প্রমার বাবার চাকুরী হওয়াতে উনি সাংঘাতিক রকম খুশী হয়েছিলেন।

    আমাদের বাসা নেয়া হলো, প্রয়োজনীয় সাংসারিক জিনিষপত্র কেনা হলো, পুরনো একটা গাড়ীও কেনা হলো- মনে আছে হোল্ডা সিভিক সাদা রঙ্গের। ঢাকা থেকে ড্রাইভিং একটু শিখে আসাতে লাভ হয়েছিল আর তাছাড়া সাহস বেশী থাকাতে অভ্যাস সামান্য ঝালাই করে নিয়েই লার্নার লাইসেন্স নিয়েই আমি ড্রাইভিং শুরু করে দিলাম অকল্যানডে। আমাদের বাসায় আমার বড়ভাইয়ের বন্ধুরা সবাই আর আমার বন্ধুরা প্রায়ই আসতো আর আমাদের নির্ভেজাল আনন্দে গল্প করে সময় কাটতো। আমি পরীক্ষামূলক বিভিন্নরকম রান্না করতাম, মিষ্টি বানাতাম মুড়ি ভাজতাম- ওরা সবাই খেয়ে প্রশংসা করতো আর আমার উৎসাহ আরও বাড়তো। প্রমার বাবা পড়াশুনা করার জন্যে সারাদিন লাইব্রেরি থাকা শুরু করলো আর তার পরেও গ্রুপ করে পড়াশুনা বিভিন্ন বাসায় ঘুরে ঘুরে যার মধ্যে আমাদের টার্ন ও আসতো। যারা আসতো দীনা আপা আর সিনিয়র জুবায়ের ভাই, বুলা ভাবী তাদের মধ্যে অন্যতম।

    আমি নিয়ম মাফিক প্রায় সপ্তাহেই ঝিমা খালার বাড়ী যেতাম, যদিও উনারা মাউনট এলবার্ট থাকতেন,আমাদের থেকে বেশ দূরে। প্রমা খালার ছেলে সানিমের সাথে খেলতে পছন্দ করতো আর আমি পছনদ করতাম খালার সঙ্গ। খালা খালুও আসতেন আমাদের বাসায় মাঝে মধ্যে। আমি তখন বেশ সাংসারিক, নিউজিল্যান্ড সরকার আমাদের একটা ভাতা দিতো তা দিয়ে প্রমার ন্যাপীসহ প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র আগে কিনতাম আর বাকীটাকা দিয়ে বেশ সুন্দর সংসার সামলাতাম। আমার মনে আছে যেদিন আমরা টাকাটা হাতে পেতাম সেদিন ভালোমন্দ খেতে যেতাম। কেন যেন তখন কে এফ সি আমাদের ভীষণ প্রিয় খাবার ছিল। আমার নিত্য কর্ম ছিল প্রমাকে সাথে নিয়ে বাজার করা, লন্ড্রি রুমে গিয়ে কাপড় ধুয়ে ড্রাই করা, রান্না করা, প্রমাকে খাওয়ানো, টয়লেট, গোসল করানো, ঘুম পাড়িয়ে ঘর পরিষ্কার! অতঃপর নিজের যত্ন নেবার সময় হতো খুব কম।

    জাপানী এক প্রবাদ আমি বিশ্বাস করি, তা অনুসারে আমরা সকলেই মুখোশ পরে থাকি তিনটি স্তরে। বাইরের মুখেশটা সুখ বা দুঃখের যা আমরা সবাইকে দেখাতে চাই, দ্বিতীয় মুখোশ খুব কাছের লোকজন জানতে পারে বা দেখতে পারে আর তৃতীয়টি একান্তই নিজের। কিছু গোপনীয় জিনিষ বা কথা সব মানুষেরই অন্তরে লুকায়িত থাকে যা সে কোনেদিনই কারো সাথে হিস্যা নিতে পারে না। আমি এসব তখন না জানলেও নিশ্চিত সুখী এক মুখোশ তখন পরা শুরু করেছিলাম। আসলে প্রমাকে খাওয়াতে বসে বা রান্না চড়িয়ে আমি গ্রেইস এনাটমি বা মুরতাগের মেডিসিন বই নাড়াচাড়া করতাম আর গভীর বিষন্নতায় ভুগতাম। যদি কখনো এ বিষয়ে প্রমার বাবার সাথে আলাপ তুলতাম তবে তা তর্কযুদ্ধে পরিণত হতো। কারণ স্বাভাবিকভাবেই পড়াশুনার ব্যপারে প্রমার বাবার প্রাধান্য পাবার কথা- সে ছেলেমানুষ, বয়সে আমার থেকে অনেক বড় আর সর্বোপরি আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও এতো ভালো নয় যে দুজনের পরীক্ষার বিশাল অংকের টাকা আমরা বহন করতে পারব। সুতরাং আমি তখন নিজের পরীক্ষা বা পেশার কথা চিন্তা করা বা তুলা কতটা অযৌক্তিক ছিল তা খুব সহজেই বোধগম্য!! আমি গভীর বিষন্ন আর একাকী দিন যাপন করতে থাকলাম আর তাই আমার হাসি খুশী মুখোশটা ব্যবহারও বেশ জরুরী হয়ে পড়লো।

    চলবে…

  • লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব -৫)

    লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব -৫)

    বাইরে চিল্লা চিল্লি শুনে সকালে ঘুম ভাঙলো ফুয়াদের। পাশে তাকিয়ে দেখে স্নেহা নেই৷ চিল্লা চিল্লি শুনে ঘুম ভাঙলে এমনিতেই মানুষের মাথা ঠিক থাকে না৷ তারপর আবার স্নেহাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে যা হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরে৷ ফুয়াদের গা কাঁপছে৷ সে কোনো ভাবে পা বাড়াতে পারছে না৷ কোনো ভাবে উঠে সে দাঁড়ালো৷ চোখে মুখে পানি দিলো৷ সিড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে সে ভাবছে কি হতে পারে। নীচে নামতেই খাদিজা বুয়ার বিলাপ…

    ও স্যার ও স্যার দেইক্ষা জান মেডামের কি অইছে…

    আর হাত দেখাচ্ছে লিভিং রুমের দিকে৷

    ফুয়াদ লিভিং রুমে ঢুকে তার মাথা খারাপ হয়ে গেলো৷ স্নেহা সাদা শাড়ী পরে বসে কাঁদছে৷ তার দুই হাত থেকে গড় গড় করে রক্ত পড়ছে৷ সারা গায়ে ময়লা। তার এলোমেলো উসকো খুসখো চুলে সব গাছের পাতা আর ময়লা৷ লিভিং রুমের টেবিলের উপর গ্রীস থেকে নিয়ে আসা সে ডেকোরেশন পিস গুলো, যা গতরাতে ফুয়াদ ভেঙে পাউডার করে ফেলেছিলো৷

    ফুয়াদ সব বুঝে ফেললো, পাউডার করা জিনিস যা ছিলো ডাস্টবিনে, তা জোড়াও লেগে গেলো, ঠিকমতো ঘরেও চলে এলো৷ এতো কিছু হয়ে গেলো৷ আজ নিশ্চিত অনেক বিপদ আছে৷

    ফুয়াদ হন্তদন্ত হয়ে স্নেহার দিকে এগিয়ে গেলো৷

    স্নেহা চোখ বড় করে ফুয়াদের দিকে আঙ্গুল উঠিয়ে ইশারা করলো, যেন তার কাছে না যায়৷ ফুয়াদ জিজ্ঞাসা করলোঃ
    তোমার কি হয়েছে স্নেহা তোমার হাত থেকে রক্ত পড়ছে৷ হাত কেটেছে কিভাবে?

    স্নেহা শুধু গলা গড়গড় করে হুমমমম হুমমম একটা শব্দ করলো, আর চোখ বড় করে ফুয়াদের দিকে রাগি চোখে তাকাচ্ছে৷ তার সমস্ত গা ভিজা৷

    এদিকে রুবিনা বলে উঠলোঃ
    ও স্যার কাছে যাইয়েন না৷ কাছে যাইয়েন না৷ আমাগো মেডামের ভিত্রে আত্মা হান্দাইছে৷ কাছে গেলে ঠাইট মাইরা ফালাইবো৷

    ফুয়াদ খুব ভয় পেয়ে গেলো৷ সে বলে উঠলো, তাহলে এখন আমি কি করবো? তোমরা কিছু বলো৷ এভাবেতো সব রক্ত শেষ হয়ে যাবে৷

    খাদিজা বুয়া আর রুবিনাকে বাইরে নিয়ে এসে বললো, চলো সবাই মিলে এক সাথে ধরি৷ কোনো কথা শুনবো না তোমার মেডামের৷

    সবাই মিলে স্নেহার কাছে যেতেই, স্নেহার সামনে রাখা একটা কাঁচের টেবিল এক হাতে তুলে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললো আর বলতে লাগলো, আজ যদি কেউ কাছে আসিস সর্বনাশ করে ফেলবো৷

    কিন্তু স্নেহার গলার স্বর একটা ছেলে মানুষের মত৷ সবাই ভয়ে পিছে চলে আসলো৷ ফুয়াদ ভেবে পাচ্ছে না স্নেহার গলায় কি হয়েছে!!!

    মূহুর্তের মধ্যে স্নেহা স্নেহার মধ্যে ফিরে এসেছে৷

    সে অবাক হয়ে ফুয়াদকে দেখছে মাথা থেকে পা পর্যন্ত, খাদিজা বুয়াকে বলছে,
    বুয়া, তুমি রুবিনা এখানে কি করছো? তোমরা সবাই এখানে কি করছো? আমি? হায় আল্লাহ টেবিলটা কে ভেঙেছে?

    ওরা কেউ বুঝে উঠতে পারছিলো না কি করা উচিৎ, কি বলা উচিৎ। আবার স্নেহা বলে উঠলো, এখন কটা বাজে? কোন সময় এখন?

    ভয়ে ভয়ে ফুয়াদ বললো, এখন সকাল স্নেহা। সকাল আটটা বাজে৷ তুমি কেমন আছো?
    এতক্ষনে স্নেহা সব বুঝে ফেলেছে, তার সাথে কি কি হয়েছে৷ সঙ্গে সঙ্গে স্নেহা বলে উঠলো, আমি সরি ফুয়াদ৷ আমি সরি৷

    ফুয়াদ এগিয়ে এসে স্নেহার হাত ধরলো৷ সরি বলছো কেন স্নেহা? তার হাত ধরে ফুয়াদ দেখে, পুরো আঠালো ময়লা৷ গা থেকে গন্ধ বের হচ্ছে৷ পুরো গা ভিজে চুবচুবা৷ মুখে ময়লা লেগে আছে৷ রক্ত আর ময়লা দিয়ে আর সাদা শাড়ী আর সাদা নেই৷ কিন্তু ফুয়াদ বুঝে উঠতে পারছে না ওর কি বলা উচিৎ।

    স্নেহা বললোঃ
    আমি যাই৷ গোসল করে আসি৷ বলতে বলতে স্নেহা মাথা ঘুরে পড়ে গেলো৷ সবাই মিলে ধরে স্নেহাকে রুমে নিয়ে আসলো৷

    ফুয়াদ বলে উঠলো স্নেহা তোমার হসপিটাল যেতে হবে৷ তোমাকে ভাল ভাবে ড্রেসিং করাতে হবে৷

    রুবিনা স্নেহাকে সাওয়ারে নিয়ে গেলো৷ ফুয়াদ খুব ভয় পাচ্ছে৷ আবার কি হয়। আর বসে বসে ভাবছে, স্নেহা যখন অন্য রকম হয়ে যায় তখন তার গলার স্বর পরিবর্তন হয়ে যায়৷ ঘাড় নাড়ায় অন্য ভাবে যেন রোবট৷ জোরে জোরে শ্বাস নেয়ার শব্দ শুনা যায়৷ তারপর কিছু একটা জিনিস ভাঙে৷ তার কয়েক সেকেন্ড পরেই স্বাভাবিক হয়ে যায়৷ সে সব সময় সাদা শাড়ী পরে তখন আর ভিজে চুবচুবা হয়ে যায়৷

    কোনো ভাবে সাওয়ার শেষে বাথরোব পরিয়ে স্নেহাকে বের করে আনলো রুবিনা৷ স্নেহা বলছে, ফুয়াদ আমার ভীষণ মাথা ব্যাথা হচ্ছে৷ সব আঙুল, সব নক কেটে গেছে৷ পিঠেও মনে হয় কেটেছে৷

    ফুয়াদ বলে উঠলো, বল কি!!! পিঠে কেটেছে মানে?

    স্নেহা বললো, ডাস্টবিনের ভেতরে অনেক কাঁচের টুকরো ছিলো তো৷

    রুবিনা বললো পিঠের পেছনে ছোট ছোট কাঁচের টুকরো ঢুকে আছে৷

    ফুয়াদের চোখ পড়লো স্নেহার হাতের কনুইয়ের উপর। কনুইয়ের ঠিক উপরে আর্ম্পিডের একটা জায়গা থেকে গর্ত হয়ে মাংস উঠে গেছে৷ সেখানে ময়লা চাপা লেগে একটু একটু রক্ত চুইয়ে চুইয়ে বের হচ্ছে৷ ফুয়াদ স্নেহাকে টেনে বেসিনে নিয়ে সে জায়গায় একটু পানি স্প্রে করে দেয়৷ আর সঙ্গে সঙ্গে ফুলকি দিয়ে রক্ত বের হওয়া শুরু করেছে৷ তাড়াতাড়ি কটন দিয়ে চেপে ধরে বললো, স্নেহা একটা মেক্সি পরে কোনো ভাবে ওড়না পেচিয়ে হাসপাতালে চলো৷ একটা এক্সট্রা কাপড় ব্যাগে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওয়ানা হলো৷ আর ভাবছে ডাক্তার যদি জানতে চায়, তবে কি বলবে৷ হঠাৎ তার মনে পড়লো তার বন্ধু ডাঃ আশফাক চৌধুরীর কথা৷ সে স্কয়ার হসপিটালেই বসে৷ সে রেডিও প্যাথলজি ডিপার্টমেন্টে আছে৷ তাকে কল করে স্কয়ার হসপিটালের ইমার্জেন্সিতে এসে সব ব্যাবস্থা করতে বললো৷ প্রায় ঘন্টা দুয়েক লাগলো সব ড্রেসিং এবং ট্রিটমেন্ট শেষ হতে৷ হাতের দু জায়গায় স্টিচ লেগেছে৷ টিটেনাস ইনজেকশন ও দিতে হলো৷ মাথায়ও ভীষণ আঘাত লেগেছে৷ ডাক্তার স্নেহাকে জিজ্ঞেস করেছিলো কেমন করে এমন ব্যাথা পেলো৷ স্নেহা বললো সে জানেনা৷ ডাক্তার আশফাককে ফুয়াদ আগেই মেসেজ পাঠিয়ে রিকোয়েস্ট করেছিলো যেন কোন প্রশ্ন না করে কেউ স্নেহাকে৷

    এদিকে স্নেহার যে পরিমান ব্লিডিং হলো, তাতে সে প্রচন্ড দূর্বল হয়ে পড়েছে৷ ডাক্তার বললো, এ অবস্থায় স্নেহাকে রক্ত দেয়ার প্রয়োজন। এবং সে যে পরিমার দূর্বল হয়েছে, তার আরও কিছু পরীক্ষা নিরিক্ষার প্রয়োজন৷ এমতাবস্থায় স্নেহাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে৷

    স্নেহাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো৷ তার নানা রকম পরীক্ষা নিরিক্ষা চলছে৷ সিটি স্কেন করে ধরা পড়লো তার মাথার স্কাল্প ইনজিউর্ড৷ এদিকে ডাক্তার বললো, Sneha is pregnant with twin baby. And she is in very critical conditions.

    এসব শুনে ফুয়াদের মাথা খারাপ হয়ে গেলো৷ সে ভেবে কুল পাচ্ছে না কি করবে৷ ফুয়াদের বোন থাকে ঢাকার উয়ারিতে৷ তাড়াতাড়ি বোনকে খবর দিলো৷

    এদিকে তার ব্যাবসাহিক কাজে তাকে বিদেশে যেতে হবে এ সপ্তাহে৷ উপায়ান্তর না দেখে বন্ধু ফয়সালকে কল দিয়ে বললো দোস্ত, যে ভাবেই হোক তোর আতর আলীকে আনার ব্যাবস্থা কর৷ আমি আর পারছি না৷

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৩)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৩)

    মাউন্ট মঙ্গানুয়ি শহর আর আমাদের প্রথম বাসা

    নিউজিল্যান্ডর জনসংখ্যা অত্যন্ত কম জেনেই সেখানে গিয়েছিলাম। তবুও রাস্তায় বের হলে অস্বাভাবিক রকমের অস্বস্তি বোধ হতো যেনো কোথাও কেউ নেই। রাস্তা ঘাটে কাউকে তো দেখা যেতোই না, বাড়িগুলোও মনে হতো জনশূন্য কেমন নিশ্চুপ! বাচ্চাদের চিৎকার, বড়দের চেঁতামেচি বা কুকুরের ঘেউ ঘেউ কিছুই নেই। হাঁটতে বের হলে কেমন গা ছমছম করা ভুতূড়ে অনুভব! প্রথম দিকে গাড়ি না কেনার ফলে আমাদের হেঁটে বা বাসে চলাচল করতে হতো।আমি নিশ্চিত আমাদের দেখেও ওদেশীরা অদ্ভুত ভাবতো প্রথম প্রথম কেনোনা ওরা ঘুরতো হাল্কা পোশাকে আর আমরা ভারী লম্বা জ্যাকেট পরেও শীতে কাঁপতাম। প্রমাকে নিতাম স্ট্রলারে আর প্রমা খুব তাড়াতাড়ি তার বেল্ট খুলে ফেলা শিখে গেলো এবং সময় সুযোগ মতন খুলে ফেলতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করতো না। বিশেষ করে বাজারে বা শপিং মলে গেলে তাকে বসানো আমার দায় হয়ে পড়তো আর এটা সেটা দিয়ে ট্রলি বোঝাই করে ফেলতো সেগুলো জায়গামত রাখা আমার আর একটা বাড়তি কাজ ছিল।

    আমরা, মূলত প্রমার বাবা সিদ্ধান্তে আসতে পারছিল না থাকবে না ফিরে যাবে দেশে। বিশেষ করে যেসব ডাক্তারদের সাথে দেখা হতো কবীর লোজে আর তার বাইরেও সবাইকেই বেশ হতাশ মনে হলো চাকুরীতে ঢুকার ব্যপারে। কারণ তাদের কাছে মনে হয়েছিল ওখানে (USMLE)আমেরিকার রেজিস্ট্রেশন, (IELTS) ইংরেজী পরীক্ষা পাশ করবার পরও ওদের ক্লিনিকাল পরীক্ষা পাশ করতে হতো কাজ করার জন্য। বাঙ্গালী ডাক্তারদের মনে হয়েছিল কাজে প্রবেশ করবার পদ্ধতি কৃত্রিমভাবে বিদেশী ডাক্তারদের জন্যে কঠিন করে রাখা হয়েছে। আমাদের খালা খালু( আম্মার চাচাতো বোন) পার্শবর্তী সুন্দর সমুদ্রপাড়ের এক শহরে থাকতেন। আমরা কিছুটা সময় কিনার জন্যে আর তাদের সাথে দেখা করে উপদেশ নেবার জন্যে কয়েক সপ্তাহের জন্যে সেই শহরে দুই রুমের একটা ফ্ল্যাটে থেকেছিলাম। আপনজনদের দেখলে কার না ভালো লাগে? তদুপরি ঝিমা খালা ছিলেন ‌অত্যন্ত হাসিখুশী সদালাপী বন্ধুবৎসল একজন মানুষ। উনাকে সবাই পছন্দ করতো আর সারাদিন কাজের পরে উনার বসার ঘরে অনেক গল্প জমতো। গল্প করতে দারুন মজা লাগতো ঠিকই আর উনার রান্নাও বেশ মজা করে কতদিন খেয়েছি। বিশেষ করে দেশী মুরগীর মতন হার্ড চিকেন রান্না উনার অনেক মজা হতো। খালুও অনেক অতিথিবৎসল ভালো মানুষ তবে উনি কথা অনেক কম বলতেন। আমি খেয়াল করেছি দাম্পত্য জীবনে একজন কথা বেশী বললে অন্যজন কথা কমই বলে থাকে বা সুযোগ পায় না। ঝিমা খালার ভাষ্য অনুযায়ী খালা রাগ করলে নাকি খালু খুশী হতেন কারণ তার সাথে আর কথা না বলে চুপচাপ থাকতে পারবেন।

    আরও বেশকিছু বাঙ্গালী ডাক্তার,ইনজিনিয়ার, ডেনটিসট, এগ্রিকালচারিসট সহ অনেক প্রফেশনাল ঐ শহরে থাকতেন এবং কেনো যেন সারাদিন বাগানে অড জব করতেন। তাদের মধ্যে তখনো পরীক্ষা দেবার,ডাক্তারী বা প্রফেশনাল কাজ করবার উৎসাহ আর মানসিকতা তৈরী হয়নি।আনন্দের সাথে বলতে পারি পরে প্রায় সকলেই নিজ নিজ পেশায় কাজে নিয়জিত হয়েছেন। ওখানে আমাদের সাথে সখ্যতা হয়েছিল ডেনটিসট ববি ভাই ডেইজি ভাবীর সাথে যাদের সাথে পরে বহু বৎসর অকল্যানডে একসাথে কাটিয়েছি। খুবই ভালো মনের এবং এখন পর্যন্ত আমার প্রিয় দু’জন মানুষ শেলী ভাবী আখতার ভাইয়ের সাথেও ওখানে পরিচয়। আর ব্যচেলর তারিক ভাইয়ের কথা না বললেই নয়, উনি নিজ উৎসাহে আমাদের যে কি পরিমান সাহায্য করেছেন তা কোনোদিন ভুলবার নয়। উনি এবং অন্যান্য বড়ভাই আর আমার তিন বন্ধু আসিফ মোমিন আর ফারহান না থাকলে প্রথমদিকে আমাদের প্রবাসজীবন যন্ত্রণাদায়ক হতো কোনোই সন্দেহ নেই।

    ইতোমধ্যে আমার ভাই কাওসারের আয়ারল্যানডের কর্ক শহরে কাজ পেয়ে যাবার সংবাদ পেয়ে একই সাথে আনন্দিত আর দুঃখিত হলাম। ও যাবার আগে মাউন্ট মঙ্গানুয়ি শহরে আসলে আমি শহরটি ঘুরে দেখালাম। ছেলেরা সারাদিন বাগানে কাজ করতে যেতো আর আমার সারাদিন কাটতো রাননা করে , প্রমাকে খাবার গোসল করানো আর ঘুম পাড়ানোতে, কাপড় ধুয়ে শুকিয়ে আর ঘর পরিষ্কার করে। যে কাজই আমি করতাম প্রমা আমাকে আঁকড়ে ধরে থাকতো, কোলে করেই বেশীরভাগ কাজ করতে হতো আর না হলে আমার কাপড় ধরে থাকতো।আমি এমনকি গোসল করতেও পারতাম না- বুঝতে পারতাম ওর ভয় যেনো ও আর কাউকেই জীবন থেকে হারাতে চায় না! যেনো আমিও কোথায় হারিয়ে যাব আর সকলের মত। আমি রীতিমত হতাশায় ভুগতে শুরু করলাম যে জীবনে আর কোনোদিন কি ডাক্তারী পেশায় যেতে পারব না?! ভাইয়ার কাজের ব্যপারটা অবশ্য আমাদের উজ্জীবিত করলো অকল্যানডে ফিরে আসবার জন্যে আর পড়াশুনা শুরু করবার জন্যে।
    একদিন প্রমাকে স্ট্রলারে নিয়ে ভাইয়ার সাথে শহর হেঁটে হেঁটে ঘুরে সাংসারিক বাজার শেষে মাত্র ফিরলাম। দরজার লক খুলে ঢুকে বন্ধ করতে গিয়ে স্লাইডিং দরজা আমার হাতে বেশ জোরে এসে ধাক্কা দিল। আমি প্রচন্ড ব্যথায় আঁতকে উঠলাম, তারপর মনে নেই। কিছুক্ষণ পরে জ্ঞান ফিরে দেখি আমি মেঝেতে আর ভাইয়া আমার চোখেমুখে পানি দিচ্ছে। ভাবলাম হায়রে বিদেশ! ভাবলাম ভাইয়া যদি সাথে না থাকতো আমার প্রমার তখন কি হতো?! পুরো শহর ফাঁকা, কেউ কোথাও নেই! চারিদিকে শূন্যতা।

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-২)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-২)

    অকল্যানড পৌঁছানো এবং প্রথম রান্না

    নিউজিল্যান্ড সম্পর্কে আমাদের ধারণা অতটা স্বচ্ছ ছিলনা। জানতাম দেশটি ভেড়া,গরু সমৃদ্ধ এবং দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত খাবারের জন্য বিখ্যাত। তবে ভুল ধারণা একটা ছিল যেটা হলো ডাক্তার হিসেবে চাকুরী সহজে মিলবার- কত যে ভুল সে ধারণা পরে সেটা বুঝেছি। আমার বড়ভাই তখন মাত্র মাস দুয়েক হলো সেখানে গিয়েছে। তার পরামর্শেই অবশ্য আমাদের ওখানকার ইমিগ্রেশনের জন্য আবেদন করা। সেসময় সে এবং তার কয়েকজন ব্যাচেলর বন্ধু মিলে মেস এর মতন করে থাকতো। নিজেরাই রান্না বাননা সংসার করতো, পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে অড জবও করতে হতো তাদের।মোটামুটি সবাই পূর্বপরিচিত আমার মেডিক্যালেরই, দুই একজন অন্য মেডিক্যাল কলেজের কিন্তু সকলেই আমার এক বৎসরের সিনিয়র এবং বড় ভাইয়ের ব্যাচমেট। যাবার আগেই আমরা সায়েক ভাইয়ের রান্না বিশেষ করে গরুর মাংস রান্নার সুখ্যাতির খবর জেনে গিয়েছিলাম এবং পরবর্তীতে সেই অতীব সুস্বাদু মাংস খাবার সৌভাগ্যও হয়েছিল।

    আমরা লম্বা ভ্রমণের পর প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে দুপুরবেলা অকল্যানড এয়ারপোর্টে পৌঁছুলাম। প্রমা শান্ত ছিল বলে বাঁচা তবে খারাপ লাগছিল ওকে দেখে, অনেকটাই বিভ্রান্ত আর আমাদের কোল ছাড়ছিল না।ইমিগ্রেশন আর কাস্টমস পার হতে মোটেই সময় লাগল না।ছোট্ট এয়ারপোর্ট দেখে যদিও আশাহত হয়েছিলাম, বড়ভাই কাওসার আর সায়েক ভাইয়ের হাসিমুখ উঁকি দিতে দেখে বেশ আশ্বস্ত বোধ করলাম। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো সায়েক ভাইয়ের বড়বোন লাভলী আপার বাসায় মধ্যাহ্ন ভোজের জন্য। উনি অনেক কিছু আয়োজন করেছিলেন আর হাসিমুখে আপ্যায়ন আর অনেক যত্ন করে খাইয়েছিলেন। সেটা ছিল আমাদের নিউজিল্যান্ডর প্রথম খাবার, জীবনে কোনোদিন ভুলবার নয়।আপনাদের জন্যে সবসময় মন থেকে দোয়া।

    এরপর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো গ্রোসারী শপিং এ অর্থাৎ ঘর সংসারে এই মূহুর্তে যা যা প্রয়োজন আর পরদিন থেকে খাবার রান্না আয়োজনের জন্য কি কি জরুরী তা কিনবার জন্য। সবথেকে প্রয়োজনীয় ছিল প্রমার খাবার, ন্যাপী এগুলো কিনে নেয়া। আমরা সেগুলো সারার পর আমাদের জন্যে ভাড়া করা সাময়িক বাসস্থানে পৌঁছে দিলেন ভাইয়া আর সায়েক ভাই। ওটা কবীর লোজ নামে পরিচিত ছিল আর মোটামুটি সব বাঙালীরাই অকল্যানড আসলে নাকি সেখানেই অস্থায়ী ভাবে ভাড়া থাকতেন যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা নিজ নিজ বাসস্থান ঠিক করে নেন। বিশাল এক পুরোনো ধাঁচের বাড়িতে ঢুকলেও আমাকে দেখানো হলো স্টোর রুমের চাইতে সামান্য বড় একটা রুম। আমাদের তিনজনের জন্যে মেঝের উপর মেট্রেস পেতে বিছানা করা। পাশে দিয়ে জায়গা নেই বললেই চলে আর বেশ উপরে ছোট্ট একটা জানালা। আমার কেমন যেনো গুদাম ঘর মনে হতে থাকলো আর দম আটকে আসতে থাকলো।

    কবীর ভাবী হাসিমুখে এগিয়ে আসলেন, বললেন অন্য একটি পরিবার বড় রুমটাতে আছেন বলে আমাদের এখানেই আয়োজন করেছেন আর আমার যখন যা প্রয়োজন বা বুঝতে পারব না তা যেন উনাকে জিজ্ঞেস করতে পিছপা না হই। উনার বেহেস্তী হাসিমুখ দেখে আমি অনেকটাই আশ্বস্ত হলাম যেন বড় বোন যা আমার কোনোদিন ছিল না। আজ লজ্জা বোধ হচ্ছে উনার নামটা বলতে পারছি না বলে যেহেতু আমরা সবাই নিজ পরিচয়ের চাইতে হাসব্যানডের পরিচয়ে পরিচিত থাকতেই স্বাচ্ছন্দ বেধ করি। উনার দুই ছেলে সামি আর সাদী আর উনি প্রমাকে ভীষণ আদর করতেন। উনি প্রমাকে দেখলেই আদর করে জিজ্ঞেস করতেন কি খাবে? প্রমা তড়িৎ উত্তর দিত শসা খাব আর উনি হেসে কুটিকুটি হতেন। আর সামি সাদীর বয়স সম্ভবত তের চৌদ্দ ছিল। ওরাও প্রমাকে খুব আদর করতো আর বেশ ক’দিনেই আমার অনুরাগী হয়ে পড়লো।প্রমাকে ধরে, স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে আমার কিছু জিনিষ এনে দিয়ে আমার উপকার করতো অনেক। আমি রান্না করলে তাকিয়ে থাকতো- বলতো “মা দেখো আনটি কিভাবে পেঁয়াজ কাটছে, একেবারে সেফের মতন।” কবীর ভাবী আবার হেসে কুটিকুটি হতেন আর বলতেন “যে ছুরি ধরতেই পারে না সে আবার সেফের মতন পেঁয়াজ কাটে কেমন করে?” আমাকে আড়াল করে বলতেন “ওরা দু’জনই তোমার ফ্যান বুঝলে, খুব পছন্দ করে তোমাকে।”

    প্রথম দিন বিকেলেই উনি রান্না ঘরের সবকিছু আমাকে বুঝিয়ে দিলেন। উনার হাঁড়ি বাসন কোথায় থাকে, লবন চিনি কোথায় থাকে এবং ব্যবহারের অনুমতি দিতে ভুললেন না। অবশ্য সে রাতে উনি উনার রান্না করা খাবার আমাদের যত্ন করে খাইয়েছিলেন। আমি উনাকে কোনোদিনই ভুলব না, আরও যত্ন করে অনেক অনেক দোয়া করব।শুনেছি সাদী ডেনটিসট আর সামি ইনজিনিয়ার হয়েছে। নিশ্চিত বিয়ে সাদী করেছে, ওদের জন্যেও মন থেকে অনেক দোয়া চলে আসে।

    সেই বিকেলে আমি প্রমার জন্যে দুধসুজি রান্না করে খাওয়ালাম, বিদেশে এই প্রথম।খেতে একদম চাচ্ছিল না, কান্না করছিল কিন্তু ওই যে আমার জোর করা স্বভাব তাই ছাড়ছিলাম না। আর কোনোদিন এমনকি দাওয়াতে গেলেও ওকে না খাইয়ে আমি খেতাম না। সবাই বলতো “আপনি কেনো ঠান্ডা খাবার খান? আগে নিজে খান তারপর ওকে খাওয়ান।” আমার তা সইতো না আর তাছাড়া মনে হতো ওর ক্ষুধা জেনে আমি কেমন করে খাই? যাই হোক খাবার পুরোটা না শেষ হতেই সে বমি করে দিল। আমার চোখ দিয়ে সমানে জল গড়াচ্ছিল-কার্পেট পরিষ্কার করব,নাকি খাবার আবার রেঁধে খাওয়াব। কার্পেটে যদি দাগ পড়ে যায়! কবীর ভাবী হঠাৎ হাজির, বললেন চিন্তা কোরোনা পুরোনো কার্পেট দাগ পড়লে অসুবিধা নেই, পরে পরিষ্কার করলেও চলবে। অতঃপর সুজি মুখে দিয়ে চোখ বড় বড় করে হেসে ফেলে বললেন “ তুমি তো দেখি সুজিতে চিনির বদলে লবণ দিয়ে ফেলেছো। ভাগ্যিস প্রমা বমি করেছে নইলে তো বিপদ হতে পারতো!”

    চলবে…

  • লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব-৪)

    লিভিং রুমে স্নেহা (পর্ব-৪)

    সকালে ঘুম ভাঙলো স্নেহার। সারা গায়ে প্রচন্ড ব্যাথা৷ কেন এমন ব্যাথা হচ্ছে সারা গায়ে। পাশে তাকিয়ে দেখে ফুয়াদ ঘুমাচ্ছে৷ কেন যেন আজ ফুয়াদের জন্য খুব খারাপ লাগছে৷ সে ভেবেছিলো ফুয়াদকে না জানিয়েই তার সব সমস্যার সমাধান করে নেবে৷ কিন্তু সে কোনো ভাবেই পারছে না৷ সে চায়নি ফুয়াদকে কোনোভাবে বিরক্ত করতে৷ এসব তাহলে কেন হচ্ছে তার সাথে? ভাবতে ভাবতে তার চোখ পড়লো, টেবিলে রাখা গ্রীস থেকে কেনা ডেকোরেশন পিস গুলোর দিকে৷ তার মনে পড়ে গেলো যে গল্পটা শুনেছিলো, সে গল্পটা ছিলো এমন।

    এক দেশে ছিলো এক অত্যাচারী রাজা আর এক নিরীহ রানী৷ তাদের ছিলো এক কন্যা সন্তান (রাজকুমারী)৷ সে রাজকুমারী খুবই সুন্দরী ছিলো৷ দূর দূরান্ত থেকে সে রাজ কন্যাকে দেখতে আসতো বিভিন্ন দেশের রাজকুমার। কিন্তু রাজা অত্যাচারী ছিল বলে, সে রাজকুমারীকে বিয়ে করার সাহস কারোর ছিলো না৷ এদিকে প্রতি সপ্তাহে রাজকুমারী শিকারে যেতো৷ সেখানে এক শিকারীর সাথে রাজকুমারীর পরিচয় হয়৷ এবং তাদেএ মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷ রাজাকে তা বলার সাহস শিকারীর ছিলো না৷ তাই সে এবং রাজকুমারী মিলে সিদ্ধান্ত নিলো তারা এ রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যাবে৷ শিকারী রাজকুমারীকে নিয়ে পালাতে গিয়ে রাজার সৈন্যদের হাতে ধরা পড়ে যায়৷ রাজা তাকে শাস্তি সরূপ একটি লোহার সিন্দুকে বন্ধি করে জলকুপের পাশের সুরঙ্গের ভেতরে ফেলে দেয়৷ এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে রাজকুমারী সহ রাজা রানী এবং পুরো রাজসিংহাসন পাথর হয়ে যায়। আর শিকারীর মা পুত্রের সন্ধানে এসে কুয়ার পাশে বসে কাঁদতে কাঁদতে একসময়ে অন্ধ হয়ে পড়ে এবং সে ও একটা পাথরের মুর্তিতে পরিনত হয়৷

    স্নেহার নিয়ে আসা সে জিনিসগুলো সে কুয়ার পানি ব্যাবহার করেই বানানো৷ এটা জেনেই সে এ জিনিসপত্র কিনেছে৷

    হঠাৎ স্নেহার মাথায় এলো তাহলে এগুলোর জন্যই তার এসব সমস্যা হচ্ছে৷ সে ভাবছে সে এগুলো আজই ফেলে দেবে৷

    এরই মাঝে ফুয়াদের ঘুম ভেঙে গেলো৷ পাশে স্নেহাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো, স্নেহা তোমার শরীর কেমন এখন? স্নেহার কপালে হাত দিয়ে দেখে, জ্বরে স্নেহার গা পুড়ে যাচ্ছে৷ তাড়াতাড়ি উঠে খাদিজা বুয়াকে ডেকে তার মাথায় পানি দিলো৷ ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলো৷ ডাক্তার সব শুনে তাকে মানসিক ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দিলেন৷ স্নেহাকে বাসায় ড্রপ দিয়ে ওষুধ খাইয়ে ঘুমাতে বলে ফুয়াদ অফিসে চলে গেলো৷

    সন্ধ্যায় স্নেহার ঘুম ভাঙলো। ঘুম ভাঙতেই স্নেহার চোখ গিয়ে পড়লো আবারও ওই টেবিলের দিকে৷ সে ভাবছে, এক্ষুনি সে টেবিলের ওই জিনিসপত্র ফেলে দেবে বাইরে৷

    একটা প্যাকেট হাতে নিয়ে সে খুব ভয়ে ভয়ে বিছানা থেকে উঠে গিয়ে টেবিলে রাখা রাজপ্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ খুব মন দিয়ে সে রাজকুমারীর চেহারার দিকে তাকাতেই দেখলো, রাজকুমারীর চোখ থেকে দু-ফোটা রক্ত ঝরে পড়েছে৷ এবার স্নেহা চেয়ারে বসলো৷ সে এখন দেখছে রাজকুমারী তাকে কিছু বলতে চাইছে৷ স্নেহারও দু-চোখ বেয়ে পানি পড়ছে৷

    এরই মধ্যে ফুয়াদ স্নেহার পেছনে এসে দাঁড়ালো৷ দেখে স্নেহা কাঁদছে৷

    কি হলো স্নেহা, তুমি কাঁদছো কেন? কি হয়েছে তোমার? কেন এমন করে কাঁদছো?

    ফুয়াদের কথা শুনে স্নেহা আরও ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলো৷ সে কিছুতেই নিজেকে থামাতে পারছে না৷

    ফুয়াদ স্নেহাকে ধরে বিছানায় এনে বসালো৷ ডাক্তারের কথা অনুযায়ী তাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে শুইয়ে দিলো৷

    রুবিনাকে স্নেহার পাশে বসিয়ে দিয়ে বললো, আমি একটু আসছি৷ তুমি মেডামের পাশে বসে থাকো৷

    নীচে বন্ধু ফয়সাল এসেছে৷ তার সাথে স্নেহার ব্যাপারে কথা বলার জন্য। ফয়সাল একজন হুজুরের নাম বললো, নাম আতর আলী৷ সে নাকি অনেক জ্বিন পরী এসবের কাজ করে৷ বরিশালের এক অজপাড়াগাঁও তে থাকে৷ কোদালকান্দি গ্রামের পানিডুবা পাড়ায়৷ ফুয়াদ আর ফয়সাল স্নেহাকে সেখানে নিয়ে যাবার প্ল্যান করছিলো এবং সে সব নিয়ে আলোচনা করছিলো।

    রাত প্রায় আটটা বাজে তখন৷ মেডামকে ঘুমাতে দেখে রুবিনা ভাবলো এখানে আর বসে না থেকে মেডাম ঘুমাতে থাকুক, এই ফাঁকে সে কিছু কাজ সেরে আসবে৷ রুবিনা রুম থেকে বের হয়ে গেলো৷

    স্নেহা উঠে রাজপ্রাসাদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷

    রাজকুমারী হাত বাড়াতেই স্নেহা তার হাত ধরলো৷ সে রাজকুমারীর সাথে রাজপ্রাসাদের ভেতরে ঢুকলো৷ আস্তে আস্তে করে কুয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো৷ হঠাৎ সে দেখে কুয়ার ভেতর থেকে বিভৎস চেহারার কে যেনো তাকে ডাকছে৷ ভীষণ ভয় পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে রাজকুমারী নেই৷ তার পেছনে একটা গলা কাটা মানুষ দাঁড়িয়ে আছে৷ ভয়ে সে বিকট চিতকার করে উঠলো। তার চিৎকার শুনে ফুয়াদ দৌড়ে এসে দেখে স্নেহা জানালার গ্রীলের বাইরে হাত দিয়ে ঝুলে আছে৷ হাত বাড়িয়ে ফুয়াদ তাকে ধরে উপরে উঠিয়ে আনলো৷ স্নেহার পুরো শরীর থর থর করে কাঁপছে৷ ভিজে চুবচুবা হয়ে গেছে৷ ফুয়াদ অনেক যত্নসহকারে স্নেহাকে গোসল করিয়ে কাপড় বদলে বিছানায় এনে বসালো৷ এখন স্নেহা বলছে ফুয়াদ, আমি রাজকুমারীর কষ্ট আর সহ্য করতে পারছিনা৷ রাজকুমারীকে বাঁচাও৷ ওই রাজকুমারী বেঁচে আছে৷ ওই শিকারী বেঁচে আছে৷ ফুয়াদ প্লিজ ওদের রক্ষা করো৷ বলতে বলতে স্নেহা আবার ঘুমিয়ে পড়েছে৷

    এখন ফুয়াদ ভাবলো, এই জিনিসগুলো যত সমস্যার কারন৷ একটা প্যাকেটে সব গুলো জিনিস নিয়ে ফুয়াদ নীচে গিয়ে সব টুকরো টুকরো করে ডাস্টবিনে ফেলে দিলো৷ রাতে খাবার খেয়ে সবাই শুয়ে পড়লো৷

    বাইরে চিল্লা চিল্লি শুনে সকালে ঘুম ভাঙলো ফুয়াদের।

    চলবে…

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-১)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-১)

    আমাদের নিউজিল্যান্ড যাত্রা

    জীবন অতীব সুন্দর, বেঁচে থাকাটাই আজকাল চরম ভাগ্যের ব্যপার। দুঃখ কষ্ট হাসি আনন্দ নিয়েই জীবন তবে আনন্দ পেতে যদিও মানুষ ভালবাসে তা মস্তিষ্কে বহুদিন ধরে ধারণ করে রাখতে পারে না। ‌অনেক সময় অতীতে চোখ বুলালে সুখময় দিনগুলো সহজে নজরে আসে না। কিন্তু কষ্টের মধ্যে পড়লে অতঃপর মনে হয় আহা, কি সুন্দরই না অতীতের দিনগুলি ছিলো। উল্টোদিকে দুঃখ-কষ্ট মননে,মগজে প্রচন্ড আর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। মানুষ ওসব সহজে ভুলতে পারে না এবং সংগত কারণেই।প্রতিটি দুঃখ কষ্ট মানুষকে জীবন সম্পর্কে দারুন সব শিক্ষা দিয়ে যায় যা প্ররবর্তী জীবনে পথ চলাতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। জানিনা জীবনের গল্প আনন্দে বা কষ্টে থাকার সময় বলা ভালো তবে এটা সত্যি মানুষ আনন্দে থাকলে স্মৃতি রোমন্থন করবার সময় সহসা পায় না।

    বড়কন্যা রাতের খাবারের সময় জিজ্ঞেস করলো তোমরা যখন প্রথম দেশ ছাড়লে মানে নিউজিল্যান্ড গেলে তার গল্প করো। অবশ্য আমাকে বলেনি তবু আমার মনে কত কিছু যে নাড়া দিলো। কোথা থেকে শুরু করব আর কোথায় শেষ?! আমার বয়স কম, মাত্র মা হয়েছি। দেশে থাকতে মা হবার আনন্দ অপার আর কাজ অত্যন্ত কম। বড়কন্যাকে মূলত দেখাশুনা করতো আমার মা মানে তার নানী, উপরন্তু নানাভাই ও কম যেতো না, সাথে খালা মামা। দাদা দাদী ফুপুদের থেকেও সে আদর কাড়তে পারতো নিঃসন্দেহে তবে আমাদের বাড়িতে প্রমা ছিলো প্রথম নাতনী। তার রাজত্ব ছিলো সর্বক্ষেত্রে আর প্রমার বাবার পোস্টগ্রেজুয়েশন পড়ালিখায় যাতে ব্যঘাত না ঘটে সে কারণে আমাকে বাচ্চা হবার সময় এবং তারপরও মাস ছয়েক বাবার বাড়িতেই থাকতে হয়েছিল। বড় নাতি বিধায় নানা নানুর ভালবাসা ছিল অপরিসীম আর প্রমারও টান নির্দিধায় বোধগম্য হতো।

    প্রমার জন্মের সময় আমরা ইমিগ্রেশন পেলেও প্রায় এক বৎসর দ্বিধাদ্বন্দ্বে কাটিয়ে দিলাম। কারণ ছিল প্রমার বাবার সরকারী চাকুরী। অবশেষ যখন সিদ্ধান্তে আসলাম যে যাব তখন খেয়াল করলাম আমাদের হাতে পয়সাকড়ি একেবারেই কম। আমি মাত্রই ইনটার্নশীপ শেষ করেছি আর প্রমার বাবা কয়েক বৎসর ইউনিয়ন জেলায় কাজ করবার পর ঢাকা মেডিক্যালে সি এ এবং রেজিস্ট্রার হিসেবে কাজ করেছে। সংসার চালিয়ে সঞ্চয় করবার সুযোগ বা ইচ্ছা কোনোটাই তখন আমাদের ছিল না। কিছুটা অপরিপক্ক মানসিকতা নিয়ে কিভাবে যেনো মাত্র ১৪০০ ইউ এস ডলার হাতে নিয়েই আর পরিবার পরিজন সবাইকে ছেড়ে ছোট্ট এক বৎসরের প্রমাকে কোলে করে ভাঙ্গা মন নিয়ে ১৯৯৬ সনের অক্টোবর মাসে আমরা নিউজিল্যান্ডের বড় শহর অকল্যানডের উদ্দেশে রওনা করলাম। যদিও সেদিন চোখের জল মুছেছিলাম নিজের অজান্তেই কিন্তু বুকে আশারও কোনো কমতি ছিল না ভবিষ্যত সম্পর্কে। একটা কথা না বললেই নয় যে যাবার পূর্বে প্রস্তুতি স্বরুপ আমার লম্বা চুলগুলো কেটে ছোটো করে ফেললাম যাতে যত্ন নিতে কষ্ট না হয়। দেশের বাইরে সংসারের সব কাজ করে নিজের চুলের যত্ন নেবার সময় পাওয়া যাবে না এটা যেনো কিভাবে তখন মাথায় এসেছিল।

    আমাদের বিদায় দিতে আমার বাবা মায়ের যতটা কষ্ট হয়েছিল সেদিন, আমি নিশ্চিত প্রমাকে ছাড়তে তাদের ঢের বেশী কষ্ট হয়েছিল। প্রমা কথা শিখেছিল খুব তাড়াতাড়ি এবং তখন সে পুরোপুরি বাক্য সহকারে বাংলা বলতো। আমি বোধকরি খাওয়া নিয়ে বেশী জোরাজুরি করতাম বিধায় ওর প্রথম কয়েকটি বাক্যের মধ্যা একটি ছিল “ আর দিও না।” কি খাবে জিজ্ঞেস করলে বলতো” শশা খাব।” সে চৌদ্দ ঘন্টার পুরো পথই নানা নানু আর খালাকে খুঁজে কাটিয়ে দিলো। কোনো সাদা চুলের বয়ষক ভদ্রলোক দেখলেই চিৎকার করে ডাক দিতে থাকলো “নানাভাই?!!”

    চলবে…