Tag: গল্প

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-১০)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-১০)

    নাহিদ সকাল বেলা ভাইয়ের বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। পলি-কলি সব ঠিক ঠাক ভাবে গুছিয়ে দিচ্ছে।

    রাহেলা খানম কৌটায় করে নিজের হাতে বানানো চিড়েরনাড়ু আর তিলের নাড়ু, দিলেন। দুটি কৌটা দিয়ে বললেন, একটা বউমা কে দিবি, আর আরেকটা তোর, পড়তে বসলে ক্ষিদা লাগলে খাবি। কলি-পলি যাওয়ার সময় আরও দিয়ে দিব। বাবা, মন দিয়ে পরীক্ষা দিবি, যেন খুব ভালো ফল আসে।

    নাহিদের চোখ ছলছল, দুই আপা ছাড়া এই প্রথম ভাবীর বাসায় যাচ্ছে সে। খুবই চিন্তা হচ্ছে তার।

    পলি নাহিদের পিঠে হাত রেখে বললো, ভাবী যা দিবে, তাই খাবি। খুব ভালো করে সব বিষয় পড়বি, যেন পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষার কাজে আসে। আর মাথা ঠান্ডা করে পরীক্ষা দিবি।
    – দোয়া করিস আপা।
    – অবশ্যই। আর আমাদের ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট হলে, গঞ্জের দোকানে কল দিস। যেকোনো দিন রেজাল্ট হয়ে যাবে।
    – আচ্ছা জানাবো, তোদের সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস চলছে যাবিনা?
    – আরেকটি চিঠির অপেক্ষা ভাই। তুই খুব ভালো করে পরীক্ষা দিস।
    – হুম।

    নাহিদ কে বিদায় দিয়ে, খুব বেশি কান্নাকাটি করছেন রাহেলা খানম। ছোট ছেলেকে নিয়ে দুঃচিন্তা বরাবরই বেশি করেন রাহেলা।

    নাহিদ ভাইয়ের বাসায় পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। নতুন বাসা না চেনায়, বই খাতা সব নিয়ে ভাবীর বাবার বাসায় গেল নাহিদ।

    শারমিন দরজা খুলেই বললেন চিঠি পেয়েই রওনা হয়েছো বুঝি?
    – ইয়ে মানে, আমার পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে…
    – হ্যা হ্যা জানি জানি। এই আয়মন দরজা আটকে দে, আমি বাসায় যাচ্ছি, আমার আরামের দিন শেষ।
    – ভাবী চাবি দিয়ে দাও, বাসার নাম্বার বললেই হবে, আমি চলে যাবো।
    – না, চলো।

    নাহিদের বেশ লজ্জা লাগছে, আয়মন দরজা খট করে লাগিয়ে দিল,কিন্তু কুশল বিনিময় পর্যন্ত করলো না। ওদের অহংকার আগের মতোই আছে। ভাবী ও খুব বিরক্তি নিয়ে তার সাথে যাচ্ছেন।

    এই বাসার ছোট্ট একটি রুমে নাহিদের থাকার ব্যবস্থা হলো, ড্রয়িং রুমে চাইলে সিংগেল খাটে একজন থাকা যাবে, কিন্তু ভাবীর ধারণা সে হয়তো রুম এলোমেলো করে দিবে, সেজন্য আট ফিট বাই আট ফিটের ছোট্ট রুমে নাহিদের থাকার ব্যবস্থা হলো।

    ঠিক পাঁচ দিন পর, পলি আর কলির ১ম বর্ষের রেজাল্ট হয়েছে পলি দ্বিতীয় বিভাগ, আর কলি প্রথম বিভাগ পেয়েছে।

    শারমিন রেজাল্ট শুনে নাহিদ কে বললো এতো আরামে থেকেও পলি সেকেন্ড ডিভিশন পেল, আমাদের হামিদা বুয়ার ছেলেও ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে।
    – ভাবী, আপনি অনার্সে ভর্তি হবেন নাকি?
    – সংসার করি আগে, আর পড়াশোনা! দুদিন পরেই আবার বাবু হবে।
    – ভাইজান একজন বিসিএস ক্যাডার আর আপনি ইন্টারমিডিয়েট পাশ থাকবেন?
    – নাহিদ বেয়াদবি করবেনা, ছোট মানুষ, ভদ্র ভাবে থাকবে।

    নাহিদের এই কথা বলতে পেরে বেশ শান্তি লাগছে কারণ ভাবী ইন্টারমিডিয়েটে তৃতীয় বিভাগ পেয়েছেন। অথচ পলি আপার রেজাল্ট নিয়ে ঠিকই মজা নিচ্ছেন।
    তিনি নিশ্চয়ই এই ব্যাপারে ভাইজান কে বিচার দিবেন , আবার নিজের সম্মানের কথা ভেবে নাও দিতে পারেন।

    জাহিদ বাজার থেকে বাতাসা কিনে নিল, দুই বোন খবর শুনে গলায় জড়াজড়ি করে হাসছে, আর কলি বলছে আপারে, আমরা পাশ করে ফেলেছি। সত্যি পাশ করে ফেলেছি।

    জাহিদ বলছে ৯৭ সালের পরীক্ষা নাকি কঠিন হয়েছিল, সবাই বলাবলি করছিল, যাক পাশ করে ফেলেছিস শান্তি। আর মাত্র কয়েক বছর কষ্ট করলে গ্রেজুয়েট হয়ে যাবি!
    – তাই যেন হয়, তাই যেন হয়।

    দুই মাস পরে নাহিদ পরীক্ষা শেষ করে বাড়ী আসলো, কিন্তু সাঈদ পলি-কলি যাওয়ার ব্যাপারে এখনো কিছুই জানায় নি। এজন্য দুই বোন বিরাট টেনশনে আছে, তাদের পড়াশোনা হয়তো আর হবেই না, এইটা ভাবছে তারা!

    শারমিনের বাবু হবে এই মাসে, পলি ভাবছে হয়তো বাবু হওয়ার পরই ভাইজান তাদের নিয়ে যাবে। আশায় বুক বেঁধে আছে দুই বোন।

    ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং করার জন্য নাহিদ ঢাকা যাবে, কিন্তু জাহিদ কোন ভাবেই তাকে টাকার জন্য দিতে পারছেনা।

    শেষ পর্যন্ত শাহিদ তার এক বন্ধুর কম্পিউটারের দোকান আছে মতিঝিলে, সেখানে চাকরীর ব্যবস্থা করলো, বেতন সাড়ে তিন হাজার টাকা। এই বেতনে দুই ভাই ডাল-ভাত খেয়ে মেসে থাকতে পারবে কোন রকম।

    শাহিদ সরকারী ডিগ্রি কলেজে ভর্তি হয়েছে কিছু দিন আগে, কিন্তু ক্লাস একদিন ও করেনি, তার চিন্তা এখন নাহিদ কে নিয়ে, সে যেন ভালো জায়গায় চান্স পেতে পারে। সেজন্য সে চিন্তা করছে সে শুধু পরীক্ষার সময় পরীক্ষা দিবে, আর বাকি সময় কম্পিউটারের দোকানে চাকরি করবে, আর নাহিদ এক /দুই টা টিউশনি পেলে টেনেটুনে চলে যাবে।

    দুই ভাই বিদায়ের সময় জাহিদ বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে পাঁচশো টাকা দিল শাহিদ কে। কারণ প্রথম কয়েক দিন তো তাদের চলতে হবে।

    রাহেলা খানম আল্লাহর নামে দুই ছেলেকে বিদায় দিলেন। দুজনের বয়সই কম, কিন্তু এই অবস্থায় তার এছাড়া কোন পথ নেই।

    পরেরদিন গ্রামের বাজারে ফোন আসলো সাঈদের এক ছেলে সন্তান হয়েছে। কিন্তু এই মুহুর্তে পরিবারের কেউ তার ছেলে দেখার জন্য, যাওয়ার দরকার নাই, তিনি যাওয়ার সময় হলে চিঠি দিবেন, বললেন জাহিদ কে।

    খবর শুনে পলি-কলির সময় যাচ্ছেনা কখন ভাতিজার মুখ দেখবে। তাদের বংশের প্রথম সন্তান।

    কলি বার বার বলছে আমার এখনই উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। কি করছে বাবাটা! কার মতো হয়েছে মা?

    রাহেলা খানম বলছেন আমার প্রথম নাতি আমার কেমন লাগছে বল, কেন যে সাঈদ না করে বুঝিনা। আমার কি নাতি দেখতে ইচ্ছে করেনা, সে চিঠি দিবে তখন যাবো!

    জাহিদ বললো ভাতিজারে দেখতে আমার ও মন চায় মা। হয়তো ভাইজান ঝামেলায় আমরা গেলে হয়তো ঝামেলা বাড়বে, তাই না করছে। হাসপাতাল থেকে বাবুকে আনলেই হয়তো চিঠি দিবে। চিন্তা করো না। আচ্ছা মা, আমি যাই দুই কেজী জিলাপি কিনে আনি, সবাইকে দিবে। গরীব চাচা সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতে পারছেনা, জিলাপি মুখ করাই।
    – তোর যেমন অবস্থা, সেভাবেই করতে হবে বাবা। নাতির মুখ দেখে কি দিব, সেই চিন্তা লাগছে এখন!
    – ব্যবস্থা হবে চিন্তা করো না!

    পলি প্রতিদিন দুই/,তিন বার করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে, এই ভেবে, হয়তো ভাইজান চিঠি লিখবেন বাবুকে দেখতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আজ পাঁচ দিন হয়ে গিয়েছে এখনো চিঠি আসেনি। পলির তার ভাতিজাকে দেখার জন্য মন ছটফট করছে, সাথে পড়াশোনা কবে শুরু হবে তার জন্য চিন্তা হচ্ছে, কিন্তু কোন খবরই আসছেনা…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী
    ২৭.১১.২০২১

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৯)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৯)

    সকাল থেকে পলি, তার জামার বড় দাগ টা কোন ভাবেই তুলতে পারছেনা। এটা পরেই আজ জলির বাড়ী দাওয়াতে যাবে সে, এজন্য দাগ তোলার চেষ্টা করেই যাচ্ছে। এই জামা সাঈদের শ্বশুরবাড়ী থেকে উপহার পেয়েছিল পলি। সাদা জামা, কিন্তু ওড়না টা সুতার কাজ করা। খুব যে দামী তা নয়, কিন্তু পরলে বেশ ভালো লাগে, সুতির হলেও মন্দ নয়।

    পলি আবার ও মায়ের কাছে গিয়ে বললো, মা, লেবু দিয়ে অনেক্ক্ষণ জায়গা টায় ঘষাঘষি করলাম, কিন্তু হলুদের দাগ উঠছেনা।
    – অন্য জামা পরে যাবি, এটা বাদ দে।
    – আমার আর কোন ভালো জামা নেই।
    – পলি, আমার এমনি মনটা ভালো লাগছেনা। তুই যা ইচ্ছে কর! এখান থেকে যা।

    জলির বাড়ী যাওয়ার জন্য সাঈদ ছাড়া সবাই রেডি হচ্ছে, সাঈদ বিয়ের দিন ই চলে গিয়েছে। তাদের সাথে আরও যাচ্ছেন, রাহেলা খানমের মেজ ভাই, আর ভাসুর। এই নয়জন মানুষ জলির বাড়ী দাওয়াতে যাচ্ছেন।

    রাহেলা খানম সকাল পর্যন্ত না করছিলেন, তিনি যাবেন না। জাহিদ বললো মা, তুমি জলিপা কে দেখলে শান্তি পাবে, তাছাড়া আরেকদিন যেতে হলে খরচ যোগাড় হবেনা, যাওয়া হবেনা। পরে, অনেক কথার পর রাহেলা খানম যেতে রাজী হলেন।

    রাস্তার পাশেই জলির বাড়ী, টিনের বেড়া দেওয়া দুই রুমের ছোট্ট বাড়ী, এক রুমে শ্বাশুড়ি আর দেবর ননদেরা থাকে, অন্য রুম জলির।

    রুমের মধ্যে একটা খাট আছে, একটা আলমারী, একটা চেয়ার, আর মুখ দেখার জন্য একটা আয়না।

    রাহেলা খানম দেখলেন জলি খাটের উপর বসে আছে সবাইকে দেখে দৌড়ে নেমে সালাম করলো। তারেক ও তিন জন মুরুব্বিকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো।

    রাহেলা খানমের মেয়ের বাড়ী দেখে মনটা কেমন খচখচ করছে। এতো ছোট্ট ঘর। তেমন কোন আসবাব পত্র ও নাই। এরচেয়ে তাদের অবস্থা অনেক উন্নত।

    জলির শ্বাশুড়ি খুব আদর যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন, আর বলছেন বেয়ান আমার খুপরি ঘর, কি করবো বলেন, আমার তারেকের ভালো চাকরী হলে ঘর দিব,আশা করে। আমার সাহেব অল্প বয়েসে মারা গিয়েছেন তিন ছেলে মেয়ে নিয়ে বিরাট বিপদে ছিলাম। আল্লাহ অনেক খানি উদ্ধার করেছেন।

    কলিকে তার মেজ মামা হাত দিয়ে ইশারা করে ডাকলেন,

    কিরে, জলির এমন ফকিন্নি জায়গায় বিয়ে কে ঠিক করলো?
    – ভাইজানের কাছে আলাপ আসছিল।
    – হায়রে! ছেলের শিক্ষা কম, সহায় সম্পত্তি নাই। ঘরে আর ভাই-বোন আছে। কেমনে যে কি করে সাঈদ বুঝিনা। তবে, এরা আন্তরিক আছে, জলির যদি আদর করে তাই শান্তি। আর তো কিচ্ছু করার নাই,এখন।
    – জি মামা।

    কলির ও মন টা খারাপ হচ্ছে মামার কথায়, কিন্তু তারেক দুলাভাই খুব মজার মানুষ, তিনি বেশ রসিকতা করছেন, মিষ্টি পানের ব্যবস্থা করেছেন দুই শালীর জন্য। জলিকেও বেশ পছন্দ হয়েছে, বুঝা যায়!

    জলি আসার সময় পলিকে কানে কানে বললো,
    মাকে বলবি চিন্তা না করতে, উনি মানুষ ভালো, আম্মা, মানে আমার শ্বাশুড়ি ও খুব ভালো। তোর দুলাভাই খুব সুন্দর গান গাইতে পারে। আমার দুঃখ নাই গরীব ঘরে বিয়ে হওয়ায়, উনি মহব্বত করলেই আমি খুশি।

    পলি হাসছে, তার এই বোন সব সময় অল্পতেই খুশি হয়। সে যে ভালো আছে তাই ভালো। মাকে বললে হয়তো তিনিও শান্তি পাবেন।

    এক মাস পরে, সাঈদের চিঠি বাড়ী আসলো, এই চিঠির জন্য তিন ভাই-বোন অপেক্ষা করছে…

    রাহেলা খানম কলিকে চিঠি পড়তে বললেন,

    শ্রদ্ধেয় মা,
    আসসালামু আলাইকুম, আপনি কেমন আছ? আমি ভালো আছি। তোমার বউমার শরীর বেশি ভালো না, বাবা মারা যাওয়ার পর, আরও দুর্বল হয়ে গিয়েছে। আগের বাসা ছেড়ে দিয়েছি। এখন এক বেডের বাসা নিয়েছি, আমার শ্বশুরের বাসার কাছে, যাতে সে সারাদিন মায়ের বাসায় থাকতে পারে। মা, নাহিদ কে আগামী দু/এক দিনের মধ্যে পাঠিয়ে দিও, ওর এইচ.এস.সির পরীক্ষার রুটিন হয়েছে। সে চলে আসুক, এখানে এসে পরীক্ষা দিবে। আর পলি আর কলিকে আরও মাস দুয়েক পরে, কলেজের হলে তুলে দিব, এখন আমার পক্ষে তিন জন কে বাসায় এনে রাখা সম্ভব না। নাহিদ কে পাঠিয়ে দিও আর সাথে দশ কেজী দুধ দিও, জাহানের খাঁটি দুধ খাওয়া দরকার।
    দোয়া রাখবে, নতুন স্যার সুবিধার নয়, যেকোনো দিন ট্রান্সফার হয়ে যেতে পারি।
    ইতি,
    সাঈদ।

    কলির মুখটা একদম মলিন হয়ে গেল, তাদের যাওয়া টা অনিশ্চিত হয়ে গেল। নাহিদ একা একা কেমনে গিয়ে থাকবে? পরীক্ষা কিভাবে দিবে?আলু সিদ্ধ খেয়েই পরীক্ষা দিতে হবে।

    রাহেলা খানম বললেন, কি করবে সে? ঝামেলায় আছে এজন্য নিতে পারছেনা, বই খাতা আছে এখানে বসেই পড়। পরীক্ষা দেরী আছে।
    – মা, তুমি সব জানো না। এজন্য কথা এভাবে বলছো! আমি আমাদের চিন্তা করছি না, নাহিদের চিন্তা করছি।
    – নাহিদ ছেলে মানুষ তার একা থাকতে সমস্যা কি?
    – সমস্যা কি শুনবে?
    – কি সমস্যা শুনি…
    – আমাদের জন্য মাছের লেজ, লেজের সাইডের টুকরা থাকে, নাহিদ কাটা সহ মাছ খেতে পারেনা। আপা, ভাবীকে বলতো আমরা মাছ পছন্দ করিনা, তুমি দুই পিস রেখে দাও মাঝের এক পিস দাও ভাবী। ভাবী বিরক্ত হয়েই দিতেন।
    – মানুষ বেশী তাই…
    – না, সেজন্য না। ভাবী আমাদের থাকা পছন্দ করেন না, নাহিদ ডালের উপরেএ পানি একদিন খেয়েছিল দেখে ভাবী সব ডাল ফেলে দিয়েছেন, বলেছেন এই ডাল আর খাবে না। আপা আর আমি ওকে আগলে রাখি।
    – ও বড় হচ্ছে কলি, দুই দিন পরে ভার্সিটিতে যাবে, তখন একাই থাকবে, ওর নিজের কাজ নিজে করা শিখতে হবে।
    – তুমি কখনোই কারো দোষ দেখো না!
    – যা, নাহিদ কে গিয়ে খবর দেয়, ব্যাগ গুছিয়ে পাঠাতে হবে।
    – কথা ঘুরিয়ে দিলে না?
    – যেটা বলেছি কর।

    কলি চলে যাওয়ার পর, রাহেলা খানমের চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে। এসব কথা শুনলে বুক টা ছিড়ে যায়। কিন্তু তিনি অপারগ ছেলে-মেয়েদের সামনে তিনিও কথায় তাল মেলালে, তারা আর কষ্ট পাবে, তারা যেন ভেতর থেকে শক্ত হয়, তাই তিনি এমন ভাব ধরে থাকেন। সন্তান কষ্টে থাকলে, মায়ের মনের ভেতর কতটুকু কাঁদে সেটা কে বুঝবে!

    রাহেলা খানম ভাবছেন প্রথম তিন সন্তান মারা যাওয়ায় তিনি ভয়ে এতো গুলি সন্তামের জন্ম দিয়েছেন, ভেবেছেন প্রথম তিন জনের মতো বাকীরাও যদি মারা যায় অল্প বয়েসে।

    নয়তো এই ভুল তিনি করতেন না। কবে, যে ছেলে মেয়েরা দিক লাগবে, সে চিন্তায় অস্থির লাগে রাহেলার! কলি-পলির পড়াশোনা আর হবে তো! এটাই এখন বেশি ভাবাচ্ছে রাহেলাকে!

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী
    ২৬.১১.২০২১

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৮)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৮)

    রাহেলা বেগমের স্বর্ণের একটা বালা ছিল, সেই বালা আজ বিক্রি করে, বিয়ের দিনের খাবারের বন্দোবস্ত করলেন । জামাইয়ের জন্য সামান্য কিছু বাজার, আর জলির জন্য দুটি সুতির শাড়িও কিনলেন। মেয়েটার সাথে দুটি নতুন শাড়ী তো যাওয়া দরকার। সাঈদ বলেছেন আসার সময় তিনি দই-মিষ্টি নিয়ে আসবেন, তারই অপেক্ষা করছেন তিনি।

    কলি বিয়ের দুই দিন আগে থেকে, একটা নতুন শাড়ি কেনার জন্য কান্নাকাটি করছে, কিন্তু রাহেলা বেগমের কাছে অবশিষ্ট কিছুই নেই, যে তিনি কলি কে কিছু কিনে দিবেন। শেষ পর্যন্ত জাহিদ দুইটা মেহেদী, লিপিস্টিক আর এক ডজন কাচের চুড়ি দেওয়ায় কিছুটা খুশি হয়েছে কলি।

    বিয়ের আগের দিন জলির মামা শ্বশুর একটা ট্রাংক দিয়ে গেলেন, সাথে পাঁচ কেজী মিষ্টি। তিনি খুবই সাদাসিধা ধরনের।

    রাহেলা খানম কে বললেন, বেয়ান আমার বোনের সংসারে মেয়েকে শক্ত করে দিবেন, কারণ অত্যন্ত টানাটানি করে চলতে হবে। তারেকের বেতন খুবই নিতান্ত, আমিও একজন কেরানী মানুষ, তাই ভাগ্নাকে তেমন সাহায্য করতে পারিনা। আর কিছুই বললেন না তিনি। এক গ্লাস লেবুর শরবত মুখে নিয়েই তিনি বিদায় হলেন।

    কলি-পলি খুব হাসাহাসি করছে ট্রাংক দেখে। তবুও বেশ আগ্রহ করে, দুইবোন ট্রাংক খুললো।

    খুলে একে বারেই হতাশ হয়ে গেল, তিনটা শাড়ী এসেছে,বিয়ের শাড়ীটি লাল টাংগাইলের শাড়ি, জরি সুতার কাজ করা, খুবই কমদামি শাড়ী। বাকি দুটি প্রিন্টের শাড়ি, এক জোড়া কালো ফিতার স্যান্ডেল, একটা রুমাল। শাড়ীর সাথে ব্লাউজ আর ছায়া। বিউটি বক্সে পাউডার, লিপিস্টিক, কাজল, আর আলতা, একটা সোনালী রঙের রঙ করা টিকলি, এক জোড়া চুড়ি, আর একটি চেইন। আর সরিষার দানার মতো ছোট্ট একটা স্বর্ণের নাক ফুল।

    পলি আর কলির খুব মন খারাপ হলো এই জিনিস গুলো দেখে, তাদের ভাবীর বিয়ের বেনারসী ছিল অত্যন্ত সুন্দর ও দামী, এক সেট স্বর্ণের গহনা ছিল। ভাইজান তার তিন শালীর জন্য উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু জলিপার এই কেমন পরিবারে বিয়ে হচ্ছে, দুই শালীর জন্য কিছুই নাই এমন কি বিয়ের শাড়ীটা এমন হালকা, দেখেই কেম যেন লাগছে!

    জলি তবুও খুশি, বিয়ে তো হচ্ছে! কমদামি হোক তবুও নতুন জিনিস তো দিয়েছে।

    রাহেলা বেগম বারান্দার খুঁটি ধরে বসে জাহিদ কে বলছেন, বাবা তোমরা আমার মেয়েকে কোথায় বিয়ে ঠিক করেছো? আজ থেকে পয়তাল্লিশ বছর আগে আমার বিয়ে হয়েছে, তোমার স্কুল শিক্ষক বাবা, তখনই মদলিন শাড়ী বিয়েতে দিয়েছিলেন, তোর দাদীমা দুই সেট গহনা দিয়েছিলেন। আর এই মেয়ের কোথায় বিয়ে হচ্ছে বাবা?
    – আমি তো মা, প্রথমেই তেমন পছন্দ করিনি, তুমি…
    – থাক, আর কথা না। ওর সামনে কিছু বলিস না, কষ্ট পাবে। আল্লাহ যা ভাগ্যে রেখেছেন। তাই হবে….

    রাহেলা বেগম বিয়ের দিনের চিন্তা করছেন সব কিছু ঠিকঠাক হবে তো?ছেলেটা ভালো হবে তো? মেয়েকে সুখী রাখবে তো? সাঈদ কখন আসবে, দই মিষ্টি নিয়ে!

    বড় যাত্রী আসলেন সব মিলিয়ে পনেরো জন। তারেক দেখতে ফর্সা, লম্বা, চেহারা ও খুব সুন্দর। কিন্তু ততো টা স্মার্ট নয়। সাদা একটা পাঞ্জাবি পরেছে সাথে ঘিয়া রঙের পাগড়ী।

    কলি জামাই দেখে এসে বললো, আপা, শেরোওয়ানী ছাড়া বিয়ে করতে চলে এসেছে! কি আজব। শুনেছি আব্বাও নাকি শেরোওয়ানি পরেও বিয়ে করতে গিয়েছিলেন।
    – তুই চুপ থাক, দয়া করে। দেখতে খারাপ না, এটা নিয়ে শান্তিতে থাক।

    সাঈদ বড় যাত্রীর আসার কিছুক্ষণ আগে বাড়ীতে এসেছেন, দই মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। শারমিনের দুটি পুরোনো শাড়ি, জলির জন্য। জলি তাতেই বেশ খুশি।

    বর যাত্রী সবাই, খুবই নরমাল পোষাকে এসেছে,মনে হচ্ছেনা, বিয়ে বাড়ী এসেছে।

    এই লাল টাংগাইল শাড়ীতে জলিকে বেশ স্নিগ্ধ লাগছে। শ্যানলা হলেও চোখ দুটি ভীষন মায়াবী। বিয়ে নিয়ে জলির কোন অভিযোগ নেই, বিয়ে হচ্ছে তাতেই সে খুশি। কারণ এই কয়েক বছরে আত্নীয় স্বজন আর পরিবারের মানুষের কথা শুনতে শুনতে এক্কে বারে নাজেহাল অবস্থা জলির। তাই, বিয়ে হচ্ছে এটা নিয়েই খুশি জলি।

    রাহেলা খানম, সাঈদ যে ডেকে বললেন বাবা, এদের সংসারে আমার মেয়ে থাকতে পারবে তো?
    – মা, জা্হান যদি সুন্দরী শিক্ষিত ধনী হয়েও আমার মতো গরীব ছেলেকে মানতে পারে৷ তবে এরা কেন পারবেনা?
    – না, সেটা বলিনি বাবা। জামাই একটু সুন্দর হয়ে আসার দরকার ছিল না?
    – কিসের সুন্দর, জলির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তাই আলহামদুলিল্লাহ বলো। এখনো পলি আর কলি বাকী।
    – বউ কেমন আছে?
    – আছে ভালো। আমি জলিকে বিদায় দিয়েই, রওনা হবো। তাড়াতাড়ি সব কাজ শেষ করো।
    – আজ থেকে যাও বাবা।
    – কত ঝামেলা ফেলে আসছি মা, সেটা আমিই শুধু এখন থাকতে পারবো৷ না!

    বিদায় বেলা মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে খুব কান্নাকাটি করছে জলি। সে সারাদিন মায়ের সাথে সাথে থেকে সব কাজ করতো। মায়ের সাথে তারা অন্য রকম এক প্রশান্তির সম্পর্ক আছে।

    রাহেলা খানমের মেয়ে বিদায়ের পর,চিন্তায় পাগল পাগল লাগছে! তার বুকের ভিতরে যেন ঝড় বইছে। ভেতর যেন ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে।

    কলি আর পলির মন খুব খারাপ হয়ে আছে। কোন প্রকার আনন্দ ছাড়াই এই বাড়ীর বড় কন্যার বিয়ে হয়ে গেল, ভাবা যায়!

    যাওয়ার সময় তারেকের মামা, পরের দিন তারেকের বাড়ী যাওয়ার দাওয়াত দিয়ে গেলেন, পুরো পরিবার কে।

    সাঈদ যাওয়ার আগে মাকে ডেকে বললো, সব সময় মা, সাঈদ সাঈদ করো। তোমার পলির জন্য কেমন ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসলো, ছেলের বউ আছে বলে সে রাজী হয়নি।
    – না বাবা, এটা ভালো করেছে। বউ আছে সংসারে, তাহলে কেন বিয়ে দিবে? আমার এরকম জামাই পছন্দ না।
    – এজন্য বলেছি, আমি তোমার পলির বিয়েতে আর নাই।
    – রাগ কর কেন বাবা? ওরা তোমারই বোন।
    – রাগ করছিনা, আমি যাচ্ছি। আর এই এক হাজার টাকা রাখো, কাল মিষ্টি নিয়ে দাওয়াতে যেও, আমি আজ যাই।
    – সাবধানে যেও, গঞ্জে একটা ফোন দিও, শাহিদ কে রাতে পাঠাবো।
    – তুমি সাবধানে থাকবে, আসছি।

    কলি মায়ের পাশে এসে বললো, মা, দুলাভাই এমন কিপটা গেইটে মাত্র পাঁচশো টাকা দিয়েছে।
    – থাক, এসব নিয়ে কথা বলার দরকার নাই।
    – কাল কে কি সব যাবো আমরা?
    – কাল আসুক, দেখি। আমারে একটু তেল আর পানি মিক্স করে মাথায় দিয়ে দেয়, শরীর টা ভালো লাগছেনা।
    – লেবুর শরবত দিব?
    – না। তেল-পানি নিয়ে আয়।

    রাহেলা খানমের চিন্তায় কিছুই ভালো লাগছেনা, এই সহজ সরল মেয়েটা এই ঘরে গিয়ে সুখী হবে তো! জামাই কি তাকে সুখী করবে!

    তিনি বার বার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছেন আর মনে মনে বলছেন সাঈদের আব্বা এই ভবের সংসারে, আমাকে একলা রেখে কেন চলে গেলে? আমি যে আর পারছিনা! আমার মেয়ের চিন্তায় কিছই ভালো লাগছেনা, কাকে কি বলবো, সবই আমার পোড়া কপাল। আল্লাহ মেয়েকে সুখী করুন, আর কিছু চাওয়ার নাই…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী
    ২২.১১.২০২১

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৭)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৭)

    পলির মা, সৈয়দা রাহেলা বেগম বটিতে বসে, লাউ কাটছেন, আজকে তিনি লাউ দিয়ে তিন পদ রান্না করবেন। এজন্য আলাদা আলদা বাটিতে লাউ রাখছেন। লাউয়ের খোসার সাথে একটা আলু দিয়ে, লাউয়ের খোসা ভাজি করবেন, লাউ দিয়ে মশুরের ডাল দিয়ে ঝোল, আর লাউয়ের বিচি দিয়ে ভর্তা।

    গত তিন দিন ধরে নিরামিষ চলছে এই বাড়ীতে, জাহিদের হাত পুরোপুরি খালি, তাই মাছ বাজার করার মতো টাকা হাতে নেই৷ তবে, আজ কিছু টাকা পেলে, হয়তো সন্ধ্যায় কিছু মাছ আনতে পারে, এটা সকালেই মাকে বলেছে জাহিদ।

    পলি, কলি আর নাহিদ এসে মাকে জড়িয়ে ধরলো। ফাতেমা খানম বটি নিচে নামিয়ে রাখলেন। তিনি বেশি হতবাক হয়েছেন দেখে।

    তিনি জানেন, শারমিনের বাবা মারা গিয়েছেন। সাঈদ নিজে ফোন করেছে গ্রামের দোকানে। কিন্তু এটাও বলেছে এখন আসার দরকার নাই। যেহেতু খবর দিয়েছে মারা যাওয়ার পরের দিন, তাই পরে যাওয়ার জন্যই বলেছে সাঈদ।

    মা, কেমন আছ তুমি?
    – ভালো আছি বাবা। তোরা কখন রওনা হয়েছিস?
    – আজকে সকাল ছয়টার ট্রেনে।
    – আর এখন দুপুর দেড়টা বাজে।
    – রাস্তায় কিছু খেয়েছিস?

    কলি বললো মা, আমরা রাস্তায় বাসায় কিছুই খাইনি, এখন কিচ্ছু দাও, ক্ষুধা লাগছে।
    – হ্যা, হ্যা। এই শাহিদ গাছ থেকে দুইটা লেবু দে, শরবত করে দেই। আগে ঠান্ডা হ, আমি তরকারি বসাই।
    – এখনো রান্না কর নি?
    – এক হাতে এই সংসারের কাজ করতে হয়।
    – মা, জলিপা কোথায়?
    – এক বউল কাপড় নিয়ে ধুইতে গিয়েছে পুকুর পাড়ে, একদম গোসল করে আসবে। ওরে এক কাজ দিলে, কাজ শেষ করতে তিন ঘন্টা লাগে। না করলো পড়াশোনা, না পারে কাজ। আচ্ছা, শোন আমার বউমা কি করছে?
    – কান্নাকাটি করছে!
    – বাপ নাই যার, দুনিয়া অন্ধকার তার। বেয়ান আর বাকি মেয়েরা ভালো আছে? আর আমাই সাঈদ?
    – সবাই ভালো আছে।
    – আচ্ছা, যা আগে তোরা মুখ হাত ধুয়ে নে, পরে কথা বলবো।

    মুখ হাত ধুয়ে, রান্নাঘরে পলি এসে মায়ের পাশে এসে বসলো,

    মা, তুমি কেমন আছ?
    – আলহামদুলিল্লাহ। আমি ভাবছিলাম এই মাসের শেষে বউমারে দেখতে যাবো, মেয়েটার বাবা মারা গেল, আবার পোয়াতি ও হইছে। এখনই যাইতাম, সাঈদ না করলো, এখন সত্য কথা ভাড়ার টাকাও হাতে নাই। গেলে আরও সাঈদের জন্য ঝামেলা তাই যাইনি।
    – ভালো করেছো। ভাইজান, এখন ঝামেলায়। খালুজানের জায়গায় নতুন বস আসবে! তাই, আমাদের পাঠিয়ে দিয়েছে, কয়েকদিন বাড়ীতে থাকতে।
    – আল্লাহ তাড়াতাড়ি আমার বাচ্চারে ঝামেলা মুক্ত করুন।
    – মা,
    – জলিপার বিয়ে দিবা না?
    – এই শ্যামলা মেয়েরে কে বিয়ে করবে? না আছে রুপ না আছে বিদ্যা!
    – ভাইজান, আমার জন্য বিয়ের পাত্র নিয়ে আসে। এদিকে জলিপা বাকি।
    – ভাইজানের নখের বুদ্ধি কি তোদের আছে? নিশ্চয়ই ভালো পেয়েছে তাই নিয়ে আসছে।

    পলি আর কথা বললো না, কারণ সাঈদ তার মায়ের অতি আদরের সন্তান, তিনি তার কথা খারাপ কিছুই শুনতে পারেন না। এর পিছনে কারণ একটাই সাঈদ এর আফে আরও তিন সন্তানের মৃত্যু। সাঈদ তার যক্ষের ধন। এজন্যই তার এতো গুলি ছেলে-মেয়ে। তিনি ভেবেছিলেন, আগের তিন জনের মতো এরাও হয়তো বাঁচবেনা। সন্তানের জন্য পাগল ছিলেন রাহেলা।

    নাহিদ মায়ের শাড়ীতে মুখ মুছে বলছে, মা এতো মজা করে কেমনে রান্না কর গো?
    – কি এতো মজা হইছে? নিরামিষ রান্না।
    – আমার কাছে অমৃত। কতদিন পর এতো আরাম করে খেলাম।

    কলি, পলির দিকে তাকিয়ে আছে, কারণ টা সত্যি। গত কয়েক মাসে, এতো যত্ন নিয়ে কেউ তাদের খাওয়ায় নি। মায়ের এমন যত্ন ভালবাসায় নুন ভাত ও ঘি ভাত লাগছে।

    জলি বার বার বলছে, আমার যে কি আনন্দ লাগছে, আমরা তিন বইন একসাথে, কত্ত দিন পর। আজকে সারা রাত গল্প করবো।

    রাহেলা বেগম তিন ছেলে-মেয়েকে বললেন, তোমরা বাড়ীতে একটু সময় ও জলির কথায় নষ্ট করবেনা। বই খাতা নিয়ে পড়বে। এই সময় আর আসবেনা। ওর শুধু গল্প, আর আড্ডা, কাজ নাই তো।

    সপ্তাহে খানেক পরে, জাহিদ এসে মায়ের কাছে রান্নাঘরে বসে বললো, মা জলিপার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব ভাইজানের কাছে গিয়েছে। ভাইজান কল দিলেন, ছেলে পাশের গ্রামের।
    – সাঈদ কি বলে?
    – ভাইজান তো বলছে দিয়ে দিতে।
    – কি করে ছেলে?
    – বিস্কুট কোম্পানিতে চাকরি করে, বেতন খুবই সামান্য, ছেলে দেখতে ভালো। কিন্তু বাড়ীর অবস্থা সুবিধার নয়, টিনের বেড়ার এক চালা ঘর। ডাল-ভাত খেতে পারবে, কোন মতে। তাদের অবস্থা তেমন ভালো নয়, তাই তারা ১০/১২ জন মানুষ এসে, আপাকে কাবিন করে নিয়ে যাবে।
    – কাবিন করে?
    – ভাইজান এজন্য রাজী, বিয়েতে খরচ নাই।
    – মেয়েরে কিছু দিব না?
    – তাদের ঘরে জায়গা নাই, তারা স্পষ্ট না করে দিয়েছে। তারাও তেমন কিছুই দিতে পারবেনা। ও মা, এতো হত দরিদ্র পরিবারে কি জলিপা সুখী হবে?
    – বয়স ২৭ পার হয়েছে, শিক্ষা নাই। এইট পর্যন্ত পড়ছে, বাপ নাই, দেখতে ও শ্যামলা। ওর কি যোগ্যতা আছে?
    – মা, আরেক বার ভাববে?
    – সাঈদ যখন ভালো বলেছে, তবে ভালোই হবে। সাঈদ কোন দিন আসবে?
    – বিয়ের দিন আসবে, ওই দিন ই চলে যাবে। ভাবীর নাকি শরীর ভালো না, তাছাড়া আরও নাকি সমস্যা আছে।
    – বুঝলাম।

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী
    ২১.১১.২০২১

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৬)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৬)

    সন্ধ্যার পরে সাঈদ বসার ঘরে পলি, কলি এবং নাহিদ কে জরুরি ভিত্তিতে ডাকলেন।

    পলি জানে এই জরুরি সভার কারণ কি! কিন্তু তার মেজাজ খারাপ সাহেদা খানম কে দেখে, তিনি কেন পারিবারিক সকল বিষয়ে থাকবেন!

    পলি, এখানে বস।
    – জি ভাইজান।
    – এই যে, তোরা তিন জন আমার এখানে থাকিস, আলাদা বাসা নিয়ে দেখো তিন জনের খরচ কত আসে? তুই, এতো ভালবাসা দেখাতে পারিস, আর ভাই-বোনের জন্য একজন বিবাহিত পুরুষ কে বিয়ে করতে নারাজ। তোর জন্য তোর পুরো পরিবার উঠে দাঁড়াতে পারতো।
    – ভাইজান, আপনি আমাকে মাফ করে দিন।
    – আমি লজ্জায় মরে যাই, আমি কত বড় মুখ করে বলেছি, আমার পলি আমার কথা রাখবে, আর তুই!

    সাহেদা খানম বললেন, বাবা তুমি যেরকম চিন্তা কর, সবাই সেভাবে ভাবে না।
    – জি আম্মা। ঠিক বলেছেন। আচ্ছা, যা তুই, তোদের বিয়ের আলাপে আমি আর নাই।
    – সাঈদ, পলির গরীব ছেলে পছন্দ, তোমাদের অফিসের কেরানী সুহেল কে কি তার পছন্দ হয়?

    পলি কিছু না বলে উঠে চলে গেল। যে অফিসের সবচেয়ে বড় অফিসার, তার ভাবীর বাবা। একজন সিনিয়র অফিসার তার বড় ভাই, আর সেই অফিসের কেরানীর জন্য তার বিয়ের আলাপ হচ্ছে!

    সাঈদ কলিকে, বললো দেখেসিস? তোর বোনের অবস্থা।
    – ভাইজান কেরানীর সাথে বিয়ে হলে, অফিসার হয়ে, কেরানীকে ভগ্নীপতি বলতে পারবেন?
    – এই, যা এখান থেকে, আর কথা বলিস না। আমার মাথা ধরেছে, যা।

    পলি রুমে এসে বললো, আমার বিয়ের জন্য এতো উতলা হওয়ার কি আছে? ভাইজানের চেয়ে খালাম্মা বেশি আগ্রহী।

    রাতে সাহেদা খানম বিরক্তি নিয়ে বললেন, দেখবো, কোন রাজপুত্র তোমাদের নিয়ে যায়। এখনো সময় আছে, রাজী হও।
    – খালাম্মা, আল্লাহ যা কপালে রেখেছেন। তাই হবে।

    সাহেদা খানম মেয়ের রুমে এসে বললেন, সাঈদ, তোমার শ্বশুর তোমার লন্ডনের ট্রেনিং এর জন্য প্রস্তাব রেডি করেছেন। লন্ডন একটা ট্রেনিং করলে অনেক টাকা ও হবে, জাহান কে নিয়ে ঘুরতে ও পারবে।
    – জি আম্মা।
    – তুমি চিন্তা করবেনা, আরো ছয় বছর তোমার আব্বার চাকরি আছে, শুধু কাজ করবে, মন দিয়ে।
    – দোয়া রাখবেন।
    – আমার ছেলে সন্তান নেই, তুমি তো আমার ছেলে।
    আজ আমি আসি, রাত অনেক হলো। শুধু শুধু সময় নষ্ট করলাম।
    – রাগ করবেন না আম্মা।
    – না বাবা। আচ্ছা চলো, গেইট খুলে দিবে।
    -জি।

    রাত তিন টার দিকে কলিং বেল বাজছে, পলির ঘুম ভেঙে গেল, প্রথমবারের আওয়াজে। কিন্তু সবাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বারান্দায় যেতেও ভয় লাগছে।
    আবারও কলিং বেল বাজছে।

    পলি আস্তে করে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলো, শারমিন দের বাড়ীর দারোয়ান হারিস মিয়া,গেইটে দাঁড়িয়ে কলিং বেল দিচ্ছে।

    পলির যেন বুক ধক করে উঠলো। কারণ শারমিন দের বাসায় টেলিফোন আছে। বাড়ীর কোন খারাপ সংবাদ আসে নি তো!

    পলি এবার ভাইজানের দরজায় নক করছে। কারণ ভাইজানের রুম ভিতরের দিকে। হয়তো আওয়াজ কানে যাচ্ছেনা।

    তিন বার নক করার পর, খুব বিরক্ত হয়ে শারমিন দরজা খুললেন।
    – কি?
    – কলিং বেল বাজছে ভাবী।
    – তোমার পাগল ভাই কি রাতের ট্রেনে চলে এসেছে?

    খুব বিরক্তি ভাব নিয়ে, শারমিন রুমের ভিতরে গিয়ে বললেন, তোমার ভাই বোনের কমন সেন্স এতো কম, রাত তিন টার সময় বেল দিচ্ছে।

    সাঈদ বললেন, কে রে পলি?
    – ভাইজান হারিস মিয়া, অনবরত বেল বাজাচ্ছে।
    – হারিস মিয়া?
    – জি ভাইজান, বাড়ীর কিছু হয়নি তো!
    – কি হবে? চল, দেখি।

    সাঈদ দরজা খুলতেই হারিস মিয়া বলছেন, দুলাভাই আফনে জলদি ছলেন, খালুজান রে নিয়া সদরে যাইতাছে। হেয় বেহুশের মতো। আফনেরা দরজা খুলেন না ক্যারে?
    – কি হয়েছে আব্বার।
    – ঘামতাছে, এম্বুলেন্স কইরা নিয়া গেছে, এম্বুলেন্স আইনা। আপনি আফামনিরে নিয়া জলদি চলেন।
    – আচ্ছা, দাঁড়াও আমি আসছি।

    সাঈদ রুমে আসার পর শারমিন বলছেন, আমি প্রেগন্যান্ট সাঈদ এরকম ঘুম ভেঙে গেল, কেমন লাগে? এরা বুঝেনা কেন?
    – জাহান আব্বাকে নিয়ে সদরে গিয়েছেন, জলদি করে চলো।হারিস মিয়া আসছে।
    -.কি?আমার আব্বার কি হয়েছে?
    – জানি না, তুমি চলো।

    পলি, কলি, নাহিদ তিন জনই বললো ভাইজান আমরা কি আসবো?
    – না, থাক। আমি যাই, তোরা দোয়া করিস।

    শারমিন হাউমাউ করে কাঁদছেন, আর বলছেন আমার আব্বার কি হয়েছে। আমার আব্বা বেঁচে আছেন তো!
    ও আব্বা গো….

    পলির কেমন বুকের ভেতর ফেটে যাচ্ছে, শুধু আল্লাহর কাছে বলছে, আল্লাহ ভাবীর বাবাকে বাঁচিয়ে দিন, এই দুনিয়া এতিম দের জন্য খুব কষ্টের।

    কলি বলছে, আপারে খালুজানের কি হলো?
    – জানিনা রে!
    – খালুজান অত্যন্ত ভালো মানুষ।
    – আল্লাহ তারে সুস্থ করুক।

    আমাদের আব্বা নানাভাই কে দেখতে গিয়ে হার্ট এট্যাক করে মারা গেলেন। আল্লাহ যেন খালুকে বাঁচিয়ে দেন। চারটা মেয়ের জন্য হলেও খালুকে বাঁচিয়ে দেন।

    তিন ভাই-বোন সারা রাত জেগে আছে, আর চিন্তা করছে, কি হচ্ছে খালুর। ফযরের আযানের পর, পলি বললো, নাহিদ চল, ভাবীদের বাসায় গিয়ে দেখে আসি?
    – না রে আপা, থাক। এখন না, আরেক্টু ভোর হউক, বাসা একা রেখে গেলে, ভাইজান বকাবকি করবেন।
    – আচ্ছা আরও আধা ঘন্টা দেখি।

    সাতটার দিকে, কলি আর পলি দুই বোন শারমিন দের বাসায় গেল। বাড়ীর সামনে অনেক মানুষ, পলির মন কেমন যেন খচ করে উঠলো।

    বাড়ীর ভেতরে যেতেই দেখলো, ফরিদ উদ্দীনের লাশ বসার ঘরের খাটে রাখা। পলির যেন ভেতর ফেটে কান্না আসতে লাগলো।

    ভিতরে যেতেই শারমিন চিৎকার করে বললেন পলি, আমার আব্বা নাই রে! আমার আব্বা চলে গিয়েছেন।

    শারমিন, আইরিন বার বার কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। পলি ভাবীর মুখে বার বার পানি দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে। তার কোলে মাথা রেখে দিয়েছে। ভাবীর মুখ টা দেখে খুব মায়া লাগছে।

    পলির মনে এতো কষ্ট লাগছে ভাবীর জন্য! ছোট্ট আয়মন বার বার গিয়ে বাবার মুখ দেখছে! আর কান্নাকাটি করছে।

    সাহেদা খানম শুধু বিলাপ করে বলছেন, রাতে মানুষ টা সুস্থ ছিল, দেড়টার দিকে বললো আমার শরীর ঘামছে খুব৷ আমাকে সদর হাসপাতালে নিয়ে যাও, রাস্তা যাওয়ার সময় শুধু একবার বললেন, সাহেদা আমার, চার মেয়েকে দেখে রাখবে, সাঈদ কে তোমার ছেলে করে রেখে গেলাম। এই শেষ কথা, ডাক্তার যাওয়ার পরে বললেন, রাস্তায় তিনি মারা গিয়েছেন। কেন আমাকে এভাবে একা রেখে চলে গেলে জাহানের আব্বা?

    ফরিদ উদ্দীনের মারা যাওয়ার দুদিন পর, সাঈদ পলিকে বাড়ী যাওয়ার ভাড়ার টাকা দিয়ে বললেন, পলি তোরা বাড়ীতে চলে যা, আমি চিঠি লিখলে, আবার আসিস। এখন আমি ওদের বাসায়, অফিসে সব দিকে দৌড়াতে হচ্ছে। আব্বার জায়গায় কে আসবে, তা নিয়ে দুঃচিন্তা আছে।
    – জি ভাইজান।
    – আমি চিঠি লিখলে, তবে আসিস।

    পলি আর কলি ব্যাগ গুছিয়ে, বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা হলো, কবে আসবে কে জানে! তবে আবার নিজের চিন্তার চেয়ে খালুজানের জন্য কেমন যেন কষ্ট হচ্ছে। এভাবেও মানুষ মারা যায়?

    কলি ট্রেনে বসে বললো, আপা, ভাইজান কি ভাবীদের বাসায় উঠে যাবে?
    – জানিনা রে! এসব চিন্তা করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা।
    – আমরা কি মাস খানেক পরে আসবো?
    – তাও জানিনা।

    পলির মন ভাবছে, ইশ আমরা কত অসহায়, কলি আর নাহিদের মন শুধু ভাবছে,আর প্রশ্ন করছে, তাদের পড়াশোনা হবে তো! ভাইজান চিঠি লিখবেন তো!
    পলি আবার ও দুই ভাই বোন কে দেখছে, আর তাদের ভাবনা নিয়েও ভাবছে…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী
    ১৯.১১.২০২১

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৮)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৮)

    পালমার্সটন নর্থে বসবাস আর বাস ভ্রমণ

    সভ্যতা মানুষকে যতটুকু দেয় তার চাইতে ঢের বেশী কেড়েই নেয়। অন্তত আমার সেরকমই ধারণা। এই যেমন মায়া মমতা ভালবাসা সবই হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে সভ্যতা আর করে ফেলেছে সহজলভ্য। মাত্র একদিন মা দিবসে মা’কে ভালবাসা জানাবো একদিন বাবা দিবসে তাঁকে কৃতজ্ঞতা জানাবো, জন্মদিনে বন্ধুকে মনে করে শুভেচ্ছা জানাতে ভুলবো না।অন্য সবদিন সে আমার মনে নাই বা থাকলো – কি যায় আসে তাতে! বিবাহ বার্ষিকীতে একদিন ঘটা করে অনুষ্ঠান করবো আর তাতেই প্রমাণিত হবে জগতের কাছে যে আমরা কতটা সুখী। নিজের অন্তরে অনুভবের চাইতে আজকাল লোক দেখানো কৃত্রিম প্রকাশ মানুষের মাঝে তুমুলভাবে বেড়ে গেছে আর সাথে সাথে টান পড়ছে ভালবাসার। এর অভাবে কিছু মানুষ মারা যাচ্ছে আর কিছু বিভ্রান্ত হয়ে নকলের মুখোশ পরে ভুল ভালবাসা বিকোচ্ছে।আমি এখনো মামুলী তাই প্রতিদিন আমার জন্যে মা দিবস বাবা দিবস বন্ধু দিবস আর ভালবাসা আমার প্রতি মূহুর্তের ‌অলংকার। অনেকে বলে থাকেন ভুল মানুষে আর ভুল জায়গায় ভালবেসে নিজেকে নিঃস্ব করতে নেই। আমি বলি ভালবাসার কোন ভুল নেই, কোনো ভুল মানুষ নেই আর তাতে শুধু দিনে দিনে সমৃদ্ধই হওয়া যায় তবে তা প্রকৃত ভালবাসা হওয়া চাই।

    প্রমার বাবার চাকুরীর পর পালমার্সটন নর্থে প্রথম বিবাহ বার্ষিকিতে কেন জানি আমার একটা হীরের আংটির শখ হয়েছিলো। পরে অবশ্য হীরের অনেক গহনাই কেনা হয়েছে জন্মদিনে আর বিবাহ বার্ষিকিতে তবে সেগুলো আমার চাকরী শুরুর পর এবং সংগত কারণেই তা দু’জনের টাকায়। আমরা একদিন দোকানে গেলাম এবং মোটামুটি সামর্থের মধ্যে তিন পাথরের একটা আংটি সে কিনে দিয়েছিল। আমার কাছে ঐ আংটি বা তার দামের চাইতেও মুহূর্তটি বড় ছিল আর তা এখনো সতেজ হয়ে বুকে আছে। এজন্যে উপহার কিনবার আর দেবার সময়টুকু যথাসম্ভব সুন্দর করে তোলা আমাদের দায়িত্ব। সেই সুন্দর মুহূর্ত তখন আরও অনেক অভিনব মুহূর্তর জন্ম দিতে পারে।

    পালমার্সটন নর্থে আমাদের বেশ ভালো সময় কাটতে থাকলো। ‌কম সংখ্যক বাঙ্গালী কোনো শহরে থাকলে সবাই সবাইকে চিনে আর সবার সাথেই মিশে। ঈদে সব বাসায় যেতে হবে, সবাই আসবে আমার বাসায়। সে এক অন্যরকম মজা। আমরা দু’জনই ওখানকার সংগঠন মানোওয়াটো বাঙ্গালী সমিতিতে সক্রিয় হলাম। আমি সাংস্কৃতিক দিকে আর প্রমার বাবা সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিলো। আমরা বেশ কয়েকটি অনুষ্ঠানে ‌অংশগ্রহণ করলাম করলাম আর তাতে বহু বৎসর ধরে জড়িত এবং সম্ভবত সংগঠনের উদ্যোক্তরা সন্ধ্যা বৌদি আর চ্যাটার্জি দাদা ছিলেন কেন্দ্রবিনদু। তাছাড়াও হুদা ভাই বৌদি, মামুন ভাই জলি ওনাদের বেশ মনে পড়ে।

    আমি যতটুকু পারি ঘরে বসে পড়াশুনা করেই ইউ এস এম এল এ দ্বিতীয় পর্ব দেবার সিদ্ধান্তে নিলাম। তার জন্যে সুদূর অকল্যানড যেতে হবে। আমি মা অতএব ছোট্ট প্রমার দায় আমারই আর প্রমার বাবা রেজিস্ট্রারের দায়িত্বশীল পদে থাকবার জন্যে তার পক্ষে কোনোই ছুটি নেয়া সম্ভব হলো না আমার পরীক্ষা উপলক্ষে। তবে সে আমাদের জন্যে বাসের টিকিট কেটে দিয়েছিল আর সকাল সকাল কাজে যাবার আগে বাসে তুলে দিয়েছিল। আমি তখন বুঝতে পারিনি মোটেই চার বৎসরের ছোট্ট প্রমাকে নিয়ে আট নয় ঘন্টা বাস জার্নির পরিনাম। আর তারপর আত্মীয়ের বাসায় তাকে রেখে পরদিনই সারাটাদিন পরীক্ষা দেবার দুঃসাহস আমি কেমন করে করেছিলাম। প্রমা মা আমার শান্ত স্বভাবের তাই কান্নাকাটি করতো না। তাই বলে আমি ওর প্রতিটা কষ্টের অনুভব বুঝেছি আর আজ অবদি মনে রেখেছি। বলাই বাহুল্য প্রমার তো না ই আমারও এর আগে বাসে এতত বড় ভ্রমণের কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।

    চার ঘন্টা পর বাস একটা ছোট্ট শহরের রেস্টুরেন্টে থামল দুপুরের খাবার আর টয়লেটের কাজ সারবার জন্যে। প্রমার মুখ ততক্ষণে শুকিয়ে গেছে, ক্ষুধায়, জার্নিতে আর পেশাবের বেগে। আমি দেখলাম লোকজনের বিশাল লাইন রেস্টুরেন্টের সামনে তাই আমি ওকে প্রথম টয়লেট সারিয়ে আনতে গেলাম। ফিরে এসে খাবার পেতে বড্ড দেরী হয়ে গেলো। যখন প্রমার হট চিপস আর খাবার নিয়ে বসলাম তখনই হলো বাস ছাড়বার উপক্রম। আমি কিছুটা মুখে দিয়ে আমার খাবারটা নির্দবিধায় ফেলে দিলাম আর প্রমার চিপস গুলো হাতে নিয়ে বাসে উঠতে গেলাম। বাস ড্রাইভার ভীষণই বিরক্তির সাথে আমাকে নোটিশটা দেখালো যেখানে পরিষ্কার লিখা আছে শুধুমাত্র পানি ছাড়া অন্য কোনো খাদ্য বা পানীয় নিয়ে বাসে উঠা নিষেধ। আমি প্রমার চিপস, কমলার রস ফেলে দিয়ে অশ্রুসজল চোখে বাসে উঠেছিলাম আর ভেবেছিলাম এ কোন দেশে আসলাম যেখানকার মানুষ এতো বর্ণবাদী।

    আমার পুরো ভ্রমণে একবারও মনে হয়নি যে সে তার কাজ রুটিন মাফিক করে গিয়েছিল। আমাকে আঘাত করবার জন্যে তার আলাদা কোনো ইচ্ছেই ছিল না। আমি পরদিনই হয়তো তাকে মাফ করে দিয়েছি কিন্তু আজ অবধি ক্ষতটা লালন করছি।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৫)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৫)

    পলির সামনে একজোড়া চোখ উৎসুক হয়ে থাকিয়ে আছে, পলি কি উত্তর দিবে, তার অপেক্ষায়।

    পলি বললো এই মুহুর্তে আমি কিছু বলতে চাইনা, আমি একটু ভেবে আমার ভাইজানের কাছে বলবো।
    – আপনি কি আমাকে না করে দিচ্ছেন?
    – একদম না, আমি একটু ভাবতে চাই, এতো টুকু।
    – বুঝলাম। আমি কিন্তু আপনাকে মহারাণী করে রাখবো।

    পলি কোন উত্তর না দিয়ে, মুখে একটা হাসির রেখে এঁকে দিল।
    – আচ্ছা, আপনার কি কিছু জানার আছে?
    – না, আপনি তো সব বলে দিয়েছেন। আমি কি ভিতরে যেতে পারি?
    – অবশ্যই। আশা করছি পজেটিভ আনসার দিবেন।

    পলি আবারও হাসি হাসি চেহারা করে উঠে ভিতরে গেল।

    সাঈদ বেশ খুশি খুশি চেহারা নিয়ে তাদের বিদায় দিলেন। এবং যাওয়ার সময় বললেন, ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি আবার দেখা হবে।

    পলি রুমে এসে কলিকে বললো কলি আমি জানি আমি শ্যামলা, আমার পড়ায় তিন বছর গ্যাপ আছে। বয়স বাইশ তেইশ হয়ে গিয়েছে, তাই বলে কি আমি বিবাহিত একজন কে বিয়ে করবো?
    – কেন? এমন রাজপুত্র এর মতো ছেলে দেখতে আসছে, তুই বিবাহিত কাউকে বিয়ে করবি কেন?
    – এই লোক বিবাহিত, বাচ্চা হয়না, তাই আমাজে বিয়ে করতে চাই।
    – কি বলছিস পলিপা?
    – তুই কিছু বলিস নি?
    – আমি কি বলবো? আমার মনে হচ্ছে বাড়ী চলে যাই। এখানে একদম মন বসছে না রে।
    – তুই আজ এসব বলছিস?

    পলি ওয়াশ রুমে গিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে আর ভাবছে ইশ কপাল টা কেন এরকম?

    দুই চোখ বেয়ে পানি পরেই যাচ্ছে পলির। গলায় যেন কে চাপ দয়ে ধরেছে, বুক চিন চিন করে ব্যাথা করছে।

    রাতের বেলা, সাহেদা খানম বললেন, বাবা জি পলিরে ডাকো কথা বলি।
    – ও আর কি বলবে?
    – না, না। তবুও ডাকো।

    বসার ঘরের সোফায় সাহেদা খানম বসেছেন, তার ঠিক উল্টো দিকের সোফায় বসেছে সাঈদ। পলি দাঁড়িয়ে আছে।

    সাঈদ বললেন, পলি তোর রাজ কপাল রে! তোর কপালের জোড়ে জাহিদ আর শাহিদের ভাগ্য ঘুরে যাবে। আম্মা কি যে শান্তি লাগছে আজ!
    – ভাইজান, আমি এই বিয়ে করবো না। আপনি আমাকে একজন ভালো লোকের কাছে বিয়ে দেন সে যেন অবিবাহিত আর ভালো মানুষ হয়। সে গরীব হোক দুঃখ নেই।
    – গরীব হোক, ভাইয়ের আশ্রয়ে আছিস, দুনিয়ার অবস্থা কি বুঝবি তুই? গরীব ছেলে বিয়ে করবি। এই তোরা এতো স্বার্থপর কেন রে? এই আমি বড় হয়ে কি ভুল করলাম? যে তোদের সবার দায়িত্ব আমি নিব?

    সাহেদা খানম বললেন, আহা! তুমি বকাবকি করছো কেন? ও কি বুঝে নাকি সব। পলি তুমি কাল খালাম্মার সাথে চলো। তুমি তাদের বাড়ীঘর দেখবে, সব কিছু দেখে তুমি না করতে পারবে না।

    কলি তখন বললো তাহলে আইরিন কে বিয়ে দিয়ে দেন খালা ওই লোকের সাথে, আমার আপার চেয়ে আইরিন আরও বেশি সুন্দরী।

    সাঈদ চিৎকার করে উঠলেন বেয়াদব, তোর সাহস কম না, তুই তর্ক করিস। যা, তুই আমার চোখের সামনে থেকে যা। এদের আচরণ দেখে আমি অবাক হয়ে যাই। কি মনে করে কি তারা? আমি জানি, আমি কি চিন্তায় দিন পার করি। আর তারা কি করছে।

    সাহেদা খানম বললেন, বাবা তুমি রাগ কর না। ও ছোট মানুষ বুঝে কি? আমি আমার চার মেয়ের জন্য যে সম্পত্তি রেখে যাবো। তারা অনায়েসে এক জীবন বসে বসে কাটিয়ে দিতে পারবে। পলি তুমি রুমে যাও, তাড়াহুড়ো তে ডিসিশন নেওয়া অন্যায়। তুমি আরেকদিন চিন্তা কর, কাল বিকালে আমাকে জানিও। তোমার ভাই, তোমাদের ভালোর জন্য সব করে।

    পলি রুমে এসে দেখে কলি ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

    কি হয়েছে তোর?
    – ভাইজান কি রকম ধমক দিল! তার শালীরা সোনার টুকরা, আর আমরা কাগজের ময়লা?
    – চুপ, আর কথা না। আল্লাহ আমাদের কপালে যা রেখেছেন তাই হবে।

    নাহিদ বললো, আপা তোরা ভালো করে পড়, আমি ভালো কোথাও চান্স পেলে তোদের নিয়ে ছোট্ট এক রুমের বাসায় উঠে যাবো। টিউশনি করে চালিয়ে নিব সংসার।
    – তুই পড়, তোর এসব নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই।

    পরের দিন সকালে, দুই বোন কলেজে যাওয়ার সময়, তাদের চোখে পড়লো, সেই সাদা বাড়িটি। কি সুন্দর করে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি।

    সেই বাড়ীর গেইটে এক সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন, বয়স ত্রিশ হয়নি হয়তো। অদ্ভুত এক মায়া ভরা দৃষ্টি।

    তিনি হুট করে পিছন থেকে ডাক দিলেন, আপনি কি পলি?
    – জি।
    – আমি মিসেস ইমদাদ মির্জা। আপনার এক কপি ছবি সাহেদা খালাম্মা দিয়েছিলেন, তাই চিনতে পেরেছি।
    – ভালো আছেন আপা?
    – জি।
    – আজ কলেজে যাচ্ছি, অন্য একদিন কথা হবে।
    – আচ্ছা। আমিও হাঁটতে বের হয়ে ছিলাম, বাসায় যাচ্ছি এখন।
    – যাচ্ছি, ভালো থাকবেন।

    পলির এতো মায়া লাগছে ঈশিতাকে দেখে, এতো মায়াবী চেহারার মাঝেও চোখে কালি পরে গিয়েছে। বোঝাই যায়, রাতে তার ঘুম হয়নি। এখন সকাল দশটার সময় তিনি হাঁটতে অবশ্যই বের হোন নি, হয়তো দাঁড়িয়ে ছিলেন, এক নজর পলিকে দেখবেন বলে। কত খারাপ হয়তো তার লাগছে। সন্তান জন্ম দেওয়াই কি সব? সম্পর্কের কি কোন দাম নেই? এতো টাকা পয়সা কিন্তু সুখ নেই ঈশিতার মনে।

    পলি বিকালে এসে শারমিন কে বললো, ভাবী আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা। পড়াটা শেষ করি। আমাকে দয়া করে বিয়ের জন্য চাপ দিবেনা। আমি তোমার হাত ধরে মাফ চাই।
    – আমার আম্মা বেশি ভালমানুষ, তাই নিজের খেয়ে অন্যের উপকারে লাগেন।
    – ভাবী।
    – আমি এসব জানিনা, তুমি তোমার ভাইকে বলিও।
    – খালাম্না কে তুমি বলিও ভাবী।
    – আম্মা, আজ আসেন নি। কলি কাল আইরিন কে বিয়ে দেওয়ার কথা বলে! কত দুঃসাহস।
    – বুঝেনি ভাবী। তুমি প্লিজ বুঝিয়ে বলো।
    – পলি, আমার মাথা ধরেছে, তুমি যাও। আর তুমি তোমার ভাইকে বলিও, এখন যাও তুমি।

    পলি রুমে এসে ভাবছে কি করবে সে? ভাইজান কি তার কথা রাখবে? নাকি সাহেদার কথার জালে ফেঁসে যাবে! আর চিন্তা করতেই ভালো লাগছেনা…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী
    ১৫.১১.২০২১

  • প্রবাস জীবন (পর্ব-৭)

    প্রবাস জীবন (পর্ব-৭)

    পালমার্সটন নর্থ আগমন আর বন্ধুত্ব

    সময় বয়ে যায় নদীর স্রোতের মতন আর তাতে হাজার লক্ষ কোটি ঢেউ তুল্য মূহুর্ত তৈরী হয়। প্রতিটি মুহূর্ত একসময় মূল্যবান স্মৃতি হয়ে মনের পাতায় আঁকা হয়ে যায়। যে কেউ যখন খুশী তা সাদা কাগজে এঁকে দিতে পারে এবং তা দেখতে হবে অনিন্দ সুন্দর- আমি হলফ করে বলে দিতে পারি। আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে যাবার পরে নিতে এসেছেন প্রমার বাবার দুই বন্ধু মোখলেস ভাই আর শরীফ ভাই বুলস শহরের কাছাকাছি একটি গ্রাম থেকে। আমি আর প্রমা পূর্বপরিচিত মোখলেস ওরফে মুকুল ভাইয়ের গাড়িতে উঠেছি।বুঝতে পারলাম উনি সাংঘাতিক সাবধানি চালক।মোটরওয়েতে একশো কিলোমিটর বাঁধা থাকলে উনার গাড়ির স্পিডোমিটারের কাঁটা নিরানব্বই এ থাকে। অতঃপর অবশ্য বেশ রাতে নয়টা সাড়ে নয়টায় উনার বাসায় পৌঁছি। উনার বউ কামরুন আবার বন্ধু সিলেট মেডিক্যাল কলেজের ব্যাচমেট। অকল্যানডে ওরা থাকতে আমাদের তাই বেশ যাতায়াত ছিল। ক্ষুধার্ত আমরা কামরুনের হাতের সুস্বাদু রান্না গোগ্রসে গিলে ফেললাম। তারপর ডেসার্ট খেতে খেতে প্রমার বাবার আরেক ঢাকা কলেজের বন্ধু শরীফ ভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে গেলাম। অমায়িক ভদ্রলোক তখন পালমার্সটন নর্থ ইউনিভার্সিটির এসিসট্যানট প্রফেসর। আমরা খাবার দাবার শেষে আমাদের জন্যে বরাদ্দ করা বাসায় গিয়ে উঠলাম।

    ঐ শহরে তখন আমাদের মেডিক্যাল কলেজেরই বড়ভাই জামিল ভাই কাজ করতেন আর অদূরে পরিবারসহ থাকতেন। মাসখানেক পরেই চাকুরী সুবাদে একই মেডিক্যালের মহিউদ্দিন ভাই পরিবারসহ এসে উপস্তিত হলেন। অবশ্য আমাদের থাকার শেষের দিতে ঢাকা মেডিক্যালের আলী ভাই আর আরেফীন ভাই মিলি আপারাও এসেছিলেন। শহরটি তখন মোটামুটি ঢাকা মেডিক্যাল এলামনাই হয়ে গেলো। আমাদের তখন ছিল স্বর্ণযুগ। অবশ্য তখন সেই সুখের উপর একটা ছায়া পড়ে থাকতো আমার পরীক্ষাগুলোর চিন্তা আর চাকুরীতে ঢুকা। প্রমার বাবা পালনার্সটন নর্থ হাসপাতালে কাজ শুরু করবার পর সুনাম অর্জনের জন্য যা কিছু করা প্রয়োজন করা শুরু করলো। হাসপাতালে কাজের পরেও থেকে যাওয়া, নিখুঁতভাবে কাজ শেষ করা এসবের পরে তাকে মাস দু’য়েকর মধ্যেই প্রমোশন দিয়ে রেজিস্ট্রার বানানো হলো। স্বাভাবিকভাই কাজের চাপ তখন আরও বাড়লো এবং সে কাজের পরে লাইব্রেরিতে যাওয়া শুরু করলো ফেলোশীপ পরীক্ষা দেবার আকাঙ্খায়। আমার আশা প্রত্যাশাগুলো আমি বুকের মাঝেতে লুকিয়ে জীবন উপভোগ করা শুরু করলাম। তবে সকল সাংসারিক সামাজিক কাজের মধ্যেও আমি পড়াশুনা চালিয়ে গেছি।

    সবার প্রথম চাকুরী আর আর্থিক স্বচ্ছলতার কারণে স্বামীরা এবং ভাবীরাও বেশ ফুরফুরে মেজাজে থাকতেন। বিকেলে আমরা মেয়েরা লোপা ভাবী, লাকী ভাবী, কামরুন আর আমি হাঁটতে বের হতাম। আর আমাদের বাচ্চারাও একসাথে খেলাধূলা করতো। তখনই ঠিক হয়ে যেতো সেই রাতে কার বাসায় আমরা সবাই রাতের আহার সারবো। কোনো কোনো দিন এমন হয়েছে যে আমরা শুধু আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজি দিয়েই উদোর পুর্তি করেছি। ভাবী বা আমি হয়তো সেটুকু করবার সময়ই পেয়েছি কিন্তু ওগুলো আমাদের কাছে অমৃত মনে হতো আর আন্তরিকতা ছিল অতুলনীয়।গল্পে গল্পে হাসিতে আনন্দে সন্ধ্যা রাত কাটিয়ে দিতাম । ওই সময় ঠিক করে নিতাম আমরা কে কে এবং কোন সপ্তাহানতে কাছের কোন শহরে বেড়াতে যাব। দলবেঁধে বেড়াতে যাবার আনন্দ অপরিসীম। একসাথে যাত্রা, চা জলপানি খাওয়া, প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা আবার হঠাৎ হঠাৎ অন্য শহরে পরিচিত বন্ধু ডাক্তার পরিবারে হামলা দেয়া। আমাদের বাচ্চাগুলোও খুব মজা করতো একমাত্র মুকুল ভাই কামরুন এর ছেলে তাহমীদ ছাড়া। ওর বয়স মাত্র তখন দেড় দুই বৎসর আর ওর মা ওর খাবার নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকতো। আর তাহমিদের জিদও তখন অনেকটা কলা কেনো ছিললে বুঁজে দাও এমনটাই ছিল। আমরা অবশ্য সবাই মুকুল ভাই কাজে থাকলে কামরুনকে সাহায্য করবার চেষ্টা করতাম। আজ ও ইনজিনিয়ার হিসেবে কাজ করছে, বাকী বাচ্চাগুলোর বেশীর ভাগেরই বিয় আর বাচ্চা কাচচা ও হয়ে গেছে- কি আশ্চর্য। মন থেকে সব বাচ্চাগুলোর জন্যে অনেক দোয়া আসে, ভালো থেকো তোমরা সবাই।

    আমরা আশেপাশের সব শহরে মোটামুটি ঘুরতাম, নিউ প্লি মাউথ, ওয়েলিংটন, ওয়াঙগানুই এদের মধ্যে অন্যতম। ওযাঙগানুই শহরে আমাদের খুব প্রিয় বড়ভাই শহীদ ভাই ভাবী তাদের দুই কন্যা নিয়ে থাকতেন হাসপাতালে কাজের সুবাদে। শহীদ ভাই মানুষ হিসেবে ছিলেন অতুলনীয় – ধার্মিক বন্ধুবৎসল আর অমায়িক। উনাদের ওখানে হামলা দিতাম প্রায়শই আর ভাবী আমাদের মজাদার ইরানি কুইজিন খাওয়াতেন খুব যত্ন করে। পরে অবশ্য অকল্যানড থাকাকালীন উনাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক আরও গাঢ় হয়েছিল। উনার ছোট মেয়ে সুমাইয়া আমার প্রমার সমবয়সী আর বন্ধুত্বও ছিল ওদের মধ্যে। কয়েক বৎসর আগে ভাই আর ভাবী মেয়েদেরকে অকল্যানড রেখে ওমরাহ করতে গেলেন। ওমরাহ সুন্দর ভাবে শেষ করবার পরে ওনারা এক আত্মীয়ের সাথে দেখা করার জন্য মরক্কোতে গেলেন। ওখানে হোটেলে রাতে ভাবীর হঠাৎ মৃত্যু হলো। কোনো রকম অসুস্থতা ছাড়াই উনার আকস্মিক মৃত্যুতে আমরা সবাই হতভমভ হয়ে গেলাম। ভাইকে সূদুর মরক্কোতেই একা একা শোক বহন করতে হলো আর ভাবীর পোস্টমর্টেম সহ লাশ নিয়ে দেশে ফিরাও একা করতে হলো। আল্লাহ এমনই পরীক্ষার মধ্যে মানুষকে ফেলে দেন যা শুনে বিশবাস করাও মাঝে মধ্যে কঠিন। শুনেছি বড় মেয়ে সাদিয়ার বিয়ে হয়েছে। আল্লাহ ওকে অনেক অনেক সুখী রাখুন। আর আমার মনের পর্দায় ভাবীর হাস্যোজজবল সুন্দর মুখচছবি আজীবন থাকুক যাতে আমি দোয়া করতে পারি আল্লাহ তায়ালা তাকে চির শান্তিতে রেখেছেন।

    মানুষের জীবন আনন্দের আর তার মাঝেই কষ্ট লুকিয়ে থাকে নাকি ঠিক তার উল্টোটা আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৪)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৪)

    সাঈদ সকালে উঠে হাঁটাহাঁটি করছেন বারান্দায়, চেহারায় বেশ চিন্তার ছাপ। পলি দুই বার দেখেও কথা বলে নি। কারণ ভাইজান তাদের সাথে প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথা বলেন না।

    এবার সাঈদ পলিকে দেখে বললেন, এই পলি এদিকে আয়।
    – জি ভাইজান।
    – কি যে যন্ত্রণায় পড়লাম, আমি! তুই বুদ্ধি দেয়।
    – ভাইজান, আপনি যা ভালো মনে করেন, করবেন। আমি কি বলবো?
    – আচ্ছা, যা, তুই রুমে যা।
    – চা দিব ভাইজান।
    – না।

    সাঈদ অফিসে যাওয়ার পরে, শ্বশুর চেম্বারে ডাকলেন,
    – আসসালামু আলাইকুম।
    – জামাই, জাহান কেমন আছে?
    – ভালো আছে।
    – ওকে সপ্তাহ খানেকের জন্য আমার বাসায়, দিও। এখন তো তার বিশ্রামের প্র‍য়োজন।
    – জি।
    – আর, এর পরে তোমার শ্বাশুড়ি সকাল-বিকাল দেখে আসবে। যেহেতু মেয়েটা অসুস্থ।
    – জি, আব্বা।
    – সব কিছুতে জি জি বলবেনা, তুমি বুদ্ধিমান ছেলে, মাঝে মাঝে প্রসংগে কথা বলবে।
    – জি বলবো।

    সাঈদ যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, কারণ এতো দিন বউয়ের সাথে, শ্বশুর বাড়ী থাকা, বেশ ঝামেলার। এটা থেকে মুক্তি পেয়ে বেশ আনন্দ লাগছে তার।

    বিকেল বেলা সাঈদ বউকে বুঝিয়ে বললো সব, এবং তার বাবা ও কি বলেছেন সেটাও বললো।

    তখন শারমিন, বললো তাহলে আমি এখন আর যাবো না। তুমি থাকবেনা কেন? সব আমি বুঝি। তোমার মতো মানুষের বিয়ের কোন যোগ্যতা নেই, নিজের বউয়ের যত্ন নিতে পারো না। আলাদা কেয়ার নিতে সমস্যা! নিবেই বা কেমনে ঘরভর্তি মানুষ। আমার কি কোন প্রাইভেসি আছে এই বাসায়? আমার আব্বা আমাকে বুঝলেন না, কি দেখে যে তোমার সাথে বিয়ে দিলেন! সেটাই মেলাতে পারিনা। এখন আবার নিজের মেমেকে বাসায় যেতে বারণ করছেন।
    – জাহান।
    – প্লিজ, চুপ থাকো। একদম কথা বলবেনা।

    তখন কলিং বেল বেজে উঠেছে, সাঈদ বললো জাহান প্লিজ, একটু চুপ করবে, দেখি কে আসছে!
    – আমি কাউকে ভয় পাইনা, চুপ কেন করবো?

    পলি ভাইয়ের রুমে এসে বললো, ভাইজান খালুজান এসেছেন, ভাবীর আব্বা। বসার ঘরে বসেছেন।
    – যা, আমরা আসছি।

    জাহান, আব্বা এসেছেন, চলো।
    – তুমি যাও, আমি আসছি।
    – চলো…
    – বললাম তো আসছি।

    বাবার সাথে অনেক মান-অভিমান পরে, তিনি বললেন মা, তুমি একটা ঘরের বড় বউ, তুমি তোমার সংসার ছেড়ে গেলে চলবে? তোমার আম্মা এখন থেকে সকালে আসবেন সাঈদ আসার পরে যাবেন, তুমি আর মন খারাপ করে থাকবেনা।

    শারমিনের মন কিছুটা শান্ত হলো, বাবার কথার অবাধ্য সে হয় না, কিন্তু অভিমান ভিতরে রয়ে গেল।

    একসপ্তাহ বাবার বাড়ী থাকার প্ল্যান বাদ দিল শারমিন, মা প্রতিদিন আসবেন, তাতেই সে অনেকটা সন্তুষ্ট।

    এখন প্রতিদিন সাহিদা খানম সকাল দশটার দিকে, মেয়ের বাসায় চলে আসেন। এবং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়ের পছন্দের রান্না বুয়া কে করতে বলেন। শারমিনের এখন রান্নার কোন চিন্তা নেই।

    সাহিদা বেগম সাঈদ কে বললেন, আমার আজ তোমার সাথে কিছু আলাপ আছে। তাই আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকলাম বাবা।
    – জি আম্মা বলুন।
    – পলি খুব ভালো মেয়ে। ওর জন্য আমার কাছে, বিয়ের একটা আলাপ আছে।
    – আম্মা, এখন বিয়ে দেওয়ায় মতো আমার অবস্থা নাই।
    – আরে, তুমি শুধু খাইয়ে দিবে, প্রয়োজনে ছেলে পক্ষ সেই টাকাও দিবে।
    – এই শ্যামলা মেয়েটাকে কে এমন করে নিবে।
    – আরে, নিবে। আমাদের পাশের বাসার যে, মির্জা সাহেব আছেন, ওনার ছেলে মির্জা ইমদাদের জন্য প্রস্তাব এসেছে আমার কাছে
    – ওরা কত্ত বড় লোক। এই লাইনের সব কটি বাস তাদের। তারা কেন?
    – আহা! এতো কেন কেন করো কেন? আমি ওদের আজ রাত আট্টায় চায়ের দাওয়াত দিয়েছি। তোমার আপত্তি আছে?
    – না, না। কিন্তু…
    – আর কিন্তু না।আমি পলির সাথে কথা বলছি।
    – জি।

    পলির রুমে গিয়ে সাহিদা বললেন, এই পলি তুমি তো রাজ কপাল নিয়ে জন্মেছ দেখছি।
    – কি যে বলেন খালাম্মা।
    – মির্জা ইমদাদের জন্য তোনাকে পছন্দ করেছে। আমার কাছে প্রস্তাব এসেছে। আজই দেখতে আসবে।
    – উনি কে? আর এখন বিয়ে?
    – আরে, কপালে হাত দেও, তিনবার।
    – খালাম্মা, এখন ভাইজান এই অবস্থায় নেই….
    – কোন কথা নেই, তুমি জাহানের একটা শাড়ি পরে রেডি হও। ছেলে রাজপুত্র, বাইশ টা বাসের মালিক। কি নেই ছেলের। তুমি রেডি হও, যাতে তোমাকে পছন্দ করে।

    কলি বার বার বলছে, পলিপা ভাবীর মা তোর বিয়ের জন্য এমন করছে কেন?
    – জানিনা রে!
    – যদি মির্জা বাড়ীতে বিয়ে হয়, তবে খুব ভালো হবে। কারণ ওদের তিন তলা সাদা বাড়িটি কি সুন্দর লাগে। খোদাই করে লিখা, “মির্জা বাড়ী”
    – চুপ থাক।
    – তুমি লজ্জা মরে যাচ্ছ কেন?
    – তুই চুপ থাক বললাম।
    – আচ্ছা চুপ।

    পলি বার বার চিন্তা করে কিছুই মেলাতে পারছেনা, তার চেহারা মিষ্টি, কিন্তু গায়ের রঙ চাপা। সুন্দরী কিংবা রুপবতী না হলেও সে মায়াবতী। তবে কেন তাকে? আর যদি হয়, তাহলে কি সত্যি তার সংসার হবে? তার ভাই-বোন গুলিকে কি, সে দেখতে পারবে! এই কয়েক মিনিটে কত কিছু ভাবছে পলি। এই সংসারের মানুষ টা কি তার আপন হবে!

    ঠিক আট্টায় সত্যি সত্যি মির্জা বাড়ীর তিন সদস্য তাদের বাসায় আসলেন,পাঁচ কেজি মিষ্টি নিয়ে। মির্জা ইমদাদের মা, মিসেস জেবা সিদ্দিকা, খুবই সুন্দর পরিপাটি হয়ে এসেছেন। গা ভর্তি গহনা চিক চিক করছে, স্যুট পরে বসেছেন মির্জা ইমদাদ, শ্যমলা হলেও বেশ মায়াবী চেহারা। পাত্রের বাবা মির্জা সাহেব সাদা ধবধবে পাঞ্জাবি পরে আছেন। পলি চারদিক দেখছে আর ভাবছে! এটা সত্যি?

    মিসেস জেবা সিদ্দিকা, পলিকে বললেন, ভারী মিষ্টি মেয়ে তুমি। আমি সাহিদা ভাবীর সাথে সব আলাপ করেছি মা, তুমি ইমদাদের সাথে কথা বলো, আমি আজ আংটি পরিয়ে দিয়ে যাবো।

    পলির বুক ধড়ফড় করছে, কিন্তু ইমদাদ সাহেব খুব সুন্দর করে কথা বলছেন। পলি মুগ্ধ হয়ে শুনছে।

    হঠাৎ ইমদাদ সাহেব বললেন, মিস পলি আমার বউ ঈশিতা খুব ভালো মেয়ে, এতো রুপবতী মেয়ে, আমি খুব কম দেখেছি। কিন্তু আল্লাহ সবাইকে সব দেন না,একটা কিছু কমতিতে রাখেন। তার সেই কম জিনিস টা হলো, সে মা হতে পারছেনা। আমার বয়স চল্লিশ প্লাস হয়েছে, আমি আমার বাবার একমাত্র ছেলে। তাই আমি দ্বিতীয় বিবাহের জন্য চিন্তা করেছি। আমি দশ বছরেও বাবা ডাক শুনতে পারিনি। আপনি কি আমাকে একটা বাবু দিবেন? আমি আপনার কোন কিছুর অপূর্ণতা রাখবো না। সাহিদা আন্টি বলছেন আপনার পরিবারে সমস্যা, আমি আপনার দুই ভাইকে জব দিয়ে দিব। তারা ভালো করে চলতে পারবে। শুধু আপনি আমাকে বাবা ডাক শোনাবেন।

    পলির যেন হঠাৎ করে সব হ য ব র ল লাগছে। কি বলছে এই লোক, সে এতোই খারাপ যে, একুশ বছর বয়েসে সে, একজন বিবাহিত পুরুষ কে বিয়ে করবে, শুধু সন্তান জন্মদানের জন্য! তার ভাইজান তার পরিবার তার জন্য টাকার জন্য এমন বিয়ের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল!

    পলি কি উত্তর দিবে, বুঝতে একদম পারছেনা। শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ কি ভিজে যাচ্ছে কি না তাও যেন টের পাচ্ছেনা পলি…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী
    ১২.১১.২০২১

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩)

    তিন বার কলিং বেল দিল পলি, কিন্তু ভেতর থেকে কোন আওয়াজ নেই। কলি ভাবছে, কি হলো বাসায়? কোন সমস্যা হয়নি তো?

    পলি আবার কলিংবেল দিল, তখন হঠাৎ খেয়াল হলো বারান্দার গ্রিলে ভেতর থেকে তালা দেওয়া। তবে কি ভাবী বাসায় নেই?

    কলি বললো কি রে আপা? আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো?
    – এতো অস্থির হয়ে যাস কেন?
    – দশ মিনিট হবে দাঁড়িয়ে আছি। সেই সকালে এক সিদ্ধ ডিম খেয়ে বেড়িয়েছি। কত টুক এনার্জি থাকে আর?
    – আহা! আমিও তো। দাঁড়া ভাবী বোধহয় ঘুমাচ্ছে।
    – মারুফা?

    এর মধ্যে পাশের বাসার মহিলা বললেন,
    পলি শোন, ভাবী আমার কাছে চাবি দিয়ে গিয়েছেন। উনি সম্ভবত খালাম্মার বাসায় গিয়েছেন।
    – ওহ। আমিও তাই ভাবছি।
    – ধন্যবাদ ভাবী। চাবি টা দেওয়ার জন্য।

    পলি তালা খুলে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার জন্য ওয়াশ রুমে যাওয়ার সময় দেখলো, ভাবীর রুমে বিশাল তালা দেওয়া। কি অদ্ভুত! পলির মন টা কেমন যেন খচ করে উঠলো। ভাবী এখনো তাদের আপন করতে পারেন নি। তাই বিশ্বাস ও হয়তো করতে পারেন না।

    কলি ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে রান্না ঘরের দিক গেল, ক্ষিদায় কেমন অস্থির লাগছে কলির। ঘড়িতে দুইটার উপরে বাজে।

    কলি রান্নাঘর থেকে মন খারাপ করে এসে বললো,
    আপা, ভাবী কিচ্ছু রান্না করেনি। আমরা তিন জন কি খাবো এখন?
    – কি?
    – হুম। আমার সত্যি খুব কান্না পাচ্ছে আপা। আমি বাড়ী চলে যাবো। নুন ভাত খাবো। আমার আর সহ্য হয়না।
    – আচ্ছা, আমি ভাত বসিয়ে দিচ্ছি।
    – ভাত কি দিয়ে খাবি? ফ্রিজ তালা দেওয়া।
    – সমস্যা নাই, আলু ভাজি করছি। পাগলা ও চলে আসবে। তুই রেস্ট নেয়, আমি দিচ্ছি।
    – না, আমি আলু কেটে দিব।
    – আয়, তাহলে।

    কলির দুচোখ বেয়ে পানি পরছে, আচ্ছা আপা আজ যদি আব্বা বেঁচে থাকতেন, কিংবা ভালো কোন চাকরি করতেন। তাহলে কি আমরা এভাবে না খেয়ে কলেজে যেতাম? নাকি এসে এভাবে খালি পাতিল পেতাম!
    – যা হয়নি, তা নিয়ে আর চিন্তা করে কি হবে? পড়াশোনা ঠিক মতো কর। যাতে নিজেই নিজের টা করতে পারিস। আচ্ছা দাঁড়া একটু ডাল বসাই।
    – ডাল ভাবী নিজের রুমের খাটের নিচে রাখে। তার রুমে বিশাল বড় তালা দেওয়া।

    পলি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্না করছে। ভাই বোন যেন এক্টু ভাত খেতে পারে, তাই, রান্না করছে পলি।

    বিকালের শেষ দিকে, শারমিন বাসায় এলেন, সাঈদের বাইকে চেপে। পলির দেখেই রাগ লাগলো।

    বাসায় খুব স্বাভাবিক ভাবে ঢুকে, নিজের রুমে গেল শারমিন। পলি পিছনে পিছনে গিয়ে বললো ভাবী তুমি কোথায় গিয়েছিলে?
    – আরে, সকালের পরে, মন টা খুব একা একা লাগছিল। তাই, আম্মার ওই খানে গিয়েছিলাম। আর পরে আমাদের দারোয়ান কে দিয়ে খবর পাঠালাম, আব্বার সাথে যেন তোমার ভাই এসে, আমাদের বাসায় দুপুর খেতে আসে।
    – মারুফা?
    – আম্মাকে বলেছি, বিকালে পাঠিয়ে দিতে। আমি তোমার ভাইয়ের বাইকে চলে এলাম। হাঁটতে ভালো লাগেনা।

    সাঈদ বললেন কি রে? তোর মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?
    – এমনি ভাইজান।

    কলি পিছন থেকে এসে বললো, ভাইজান আমরা কলেজ থেকে এসে একটু ভাত ও পাইনি। ভাবী কিচ্ছু রান্না করেনি। তাছাড়া সব তালা দেওয়া, কিভাবে রান্না করবো।

    সাঈদ বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললো, জাহান, তুমি রান্না করে গেলে না?
    – আমি তো বললাম, আমার ভালো লাগছিল না, তাই আম্মার বাসায় গিয়েছি।
    – ওরা কি খাবে? তাহলে?
    – আমি এতো কিছু চিন্তা করতে পারিনা, আর কলি তুমি বেশি কথা কেন বলো? ফ্রিজের চাবি ফ্রিজের উপরেই রাখা ছিল, খুঁজলে অবশ্যই পেতে।

    পলি বললো, কলি তুই রুমে যা। কথা বলিস কেন? ভাবী সমস্যা নাই। আমি আলু ভাজি করে খেয়েছি। তুমি রেস্ট নাও।

    সাঈদ বললেন একদিন একটু কষ্ট কর তোরা, সেতো সারাক্ষণই সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একদিন খারাপ লাগাটাই স্বাভাবিক।
    – জি ভাইজান।

    পলি রুমে এসে কলিকে অনেক বকাবকি করছে, কেন সে পন্ডিতি কথা বলে, কথা শোনে। ভাবী বার বার বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি তাদের থাকাটা পছন্দ করছেন না। নয়তো নিজে রান্না করে যান নি, অথচ কত সহজ ভাবে বলে দিলেন! যেন কিছুঅঅ হয়নি।
    ইশ কবে শেষ হবে পড়াশোনা!

    আজ শারমিনের মা, সাহিদা খানম দুই পাতিল মিষ্টি নিয়ে, বাসায় এলেন। যেহেতু আজ শুক্রবার তাই সাঈদ বাসায়। বিকালের শেষের দিকে সাহিদা খানম ছোট মেয়েকে নিয়ে এই বাসায় এসেছেন।

    পলি সামনে এসে সালাম দিয়ে এসেছে। তিনি তেমন গুরুত্ব দেন নি। কারণ তিনি এদের এখানে থাকা পছন্দ করেন না।

    সাহিদা খানম বসার ঘরে বসে বললেন, বাবা সাঈদ, আমি তোমার কাছে, একটা কাজে এসেছি।
    – জি আম্মা, বলেন।
    – আমার জাহান, হচ্ছে আমার দুনিয়া। আমার বড় মেয়ে। এখন পড়শু দিন যে, খুশির সংবাদ শুনেছি। আমার ঘুম হারাম হয়ে গিয়েছে। আমার ছোট্ট জাহানের বাবু হবে।
    – আম্মা, আপনি শুধু দোয়া করবেন। আমি জাহানের কোন ত্রুটি হতে দিব না।
    – না বাবা। আমি শুধু দোয়া করলে কিভাবে হবে? আমার মেয়ে, আমারই সব চিন্তা। আমি চাই বাবা, তুমি আর জাহান আমাদের বাসায় থাকো। আমি আমার মেয়েরে চোখে চোখে রাখবো।
    – আম্মা, আমি এভাবে যেতে পারিনা। বাসায় আমার তিন ভাই বোন আছে। আর মানুষ কি বলবে!
    – তোমার তিন ভাই বোনের সেবা করতে করতেই তো আমার মেয়েটা ক্লান্ত। আমি বাবা কোন রকম ঝুঁকি নিতে চাইনা। আমি আজই আমার জাহান কে বাসায় নিয়ে যাবো।
    – আচ্ছা আমি দেখি।

    কলি এসে বলছে এই আপা, আমাদের ঘরে বাবু আসবে। আমাদের ভাইজানের বাবু। ইশ আমি কি যে আদর করবো!
    – তোকে কে বললো?
    – শুনলাম, খালাম্মা বলছেন। আমি বাবু হবে শুনেই দৌড়ে এসেছি। বাকি কথা আর শুনিনি।
    – কি যে শুনেছিস, আল্লাহ জানেন। বাবু হলে, ভাবী আমাদের অবশ্যই জানাতেন।

    পলি গিয়ে দেখলো শারমিন তার রুমেই বসে আছেন,ছোট বোনের সাথে গল্প করছেন।

    ভাবী, আমরা নাকি ফুপু হচ্ছি?
    – কে বললো?
    – খালাম্মা। ভাইজান কে বলছেন শুনলাম।
    – হ্যা। গত পড়শু দিন টেস্ট পজেটিভ আসছে।
    – অভিনন্দন ভাবী , আমরা আজ খুব খুশি। বললে না কেন?
    – এমনি! আর পরে বলতাম।
    – আচ্ছা ভাবী আমি আসি, দেখি খালাম্মার কিছু লাগে কিনা!
    – না, থাক। আম্মা নাকি ওর সাথে কি কথা বলবে, এজন্য আমাকে যেতেও নিষেধ করেছে, যেও না।
    – আচ্ছা।

    পলির খুব আনন্দ লাগছে, ভাইজানের বাবু হবে। এই বংশের প্রথম সন্তান। এই নিয়ে ভাবতেই বেশ আনন্দ লাগছে।

    সন্ধ্যার পরে, শারমিন শুধু তার মাকে বলেই যাচ্ছেন, না আমি সাঈদ ছাড়া একা যাবো না।
    – জাহান, তুই কি এখানে থেকে একা মরবি?
    – আমি কি বলেছি, এখানে থাকবো? সাঈদ সহ যাবো।

    সাঈদ বার বার বলছেন, জাহান আমি বলছি তো আমি প্রতিদিন অফিস থেকে আসার সময় ঘুরে আসবো। আর এভাবে তোমাদের বাসায় থাকাটা শোভন হয়না।
    – তাহলে, আমি যাচ্ছিনা।

    অনেক কথার পর, সাঈদ শ্বাশুড়ি কে বললেন আম্মা, আপনি আমাকে একটা রাত ভাবতে দেন। আমি আপনাকে ভেবে জানাচ্ছি।
    – তুমি বাবা নিজের বাচ্চার কথা একটু ভাববে, এই আশা আমি করতে পারি।
    – জি আম্মা, অবশ্যই।

    পলি আর কলির এসব শুনে মন টা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। ভাবীর সব যত্ন তারা করবে, পলি ভেবে রেখেছে, এখন থেকে সে রান্না করবে, বাকি কাজ রহিমা বুয়া আর মারুফা তো করেই। তবু ভাবী বাসায় থাকলে ঘর টা পরিপূর্ণ লাগবে, তারা ভাবীর যত্ন ঠিক নিতে পারবে, কেন যে খালাম্মা এমন করছেন! কে জানে।

    আবার আরেক চিন্তাও মাথায় ভর করেছে,যদি ভাইজান ভাবীর সাথে সত্যি চলে যান, তবে তাদের কি হবে? তখন কি তিনি তাদের জন্য বাসা রাখবেন? তাদের খরচ কিংবা বাজার এগুলো করবেন? কি হবে তাদের, এই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে তিন ভাই-বোন,কারণ এখন তাদের কত রকম চিন্তা, তাদের এই বিশাল পৃথিবীতে দেখার মতো কেউ নেই, ভাইজানই একমাত্র ছাদ, তিনি সরে গেলে তাদের কি হবে, তারা নিজেই জানেনা…

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী
    ০৯.১১.২০২১