Tag: গল্প

  • মৃন্ময়ী (পর্ব-২)

    মৃন্ময়ী (পর্ব-২)

    কেবিন দেখে মৃন্ময়ী বেশ খুশি হলো। সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো। সব থেকে বেশি ভালো লাগলো কাঁচ দিয়ে ঘেরা সুন্দর জানালা।দৃষ্টি সীমা অনেক দূর পযন্ত যাচ্ছে।যদিও বরিশালে বাসে করে যেতে পারত কিন্তু ইচ্ছে করে মৃন্ময়ী জাহাজে করে যাওয়ার কথা চিন্তা করেছে।এতে করে বেশ কিছু অধিক সময় মৃন্ময়ী হাতে পাবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য। মনের মাঝে কত স্মৃতি জমা হয়ে মৃন্ময়ীর মনে ক্রমাগত যুদ্ধ করে চলছে। কত পাহাড় পর্বত চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে আজ এই মৃন্ময়ীর জন্ম হয়েছে।জীবনে কত কিছু বিসর্জন দিতে হয়েছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।কত ঝড় ঝাপটা কঠিন হৃদয়ে বহন করতে হয়েছে।নির্বাসনে দিতে হয়েছে প্রতিনিয়ত নিজের ভালো লাগার মুহুর্ত গুলো কে। তবুও নিজেকে ভাঙ্গতে দেয়নি কখনো। ধীর চিত্ত নিয়ে সর্বদা ঝড়ের মোকাবেলা করেছে। মৃন্ময়ী জানে না বাড়িতে গিয়ে কার কার সাথে দেখা হবে।মা বাবা আদৌ বেঁচে আছে কিনা। সবাই তাকে কিভাবে নিবে জানে না মৃন্ময়ী।তবুও নাড়ীর টানে চলেছে বাড়ি অভিমুখে। ভাবতে ভাবতে কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসল মৃন্ময়ী টের পেল না।জাহাজের হুইসেলের শব্দে আপন জগতে ফিরে আসল।

    রাতে কিছু খাবে না আগেই বলে রাখাতে কেউ আর বিরক্ত করতে এলো না।সাথে কিছু ফল মুল নিয়ে এসেছিল।মৃন্ময়ী তাই খেয়ে নিয়ে ম্যাগাজিন বইটা হাতে নিয়ে বসল।সমানে একের পর এক পৃষ্ঠা উল্টোতে লাগল।কিন্তু ঝাপসা চোখে কোন অক্ষরই মৃন্ময়ী দেখতে পাচ্ছে না। জীবনে মৃন্ময়ী অনেক কঠিন সময়ে ও চোখের জল ফেলেনি। কিন্তু এখন তো আর কান্না করতে হবে না। তবে কেন চোখে জল আসছে।

    মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনের কথা। সব কিছু গুছিয়ে মৃন্ময়ী এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে গেল। রজতের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। মৃন্ময়ীর জেদের কাছে হেরে গিয়ে অবশেষে রাজি হয়েছিল মৃন্ময়ী বিদেশে কেয়ারটেকার এর চাকরি নিয়ে যাবে। আজ সেই ক্ষন উপস্থিত।দুজনের মনেই ঝড় বয়ে যাচ্ছে কি হবে অনাগত দিনগুলো। কিভাবে থাকবে একে অপরকে ফেলে। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন।বাস্তবতা সবাইকে মেনে নিতে হয়।রজত কে ও মেনে নিতে হলো মৃন্ময়ীর বিদেশে চাকরি করার প্রস্তাব।

    বিদেশে কেয়ারটেকার এর চাকরি টা বেশ কয়েকমাস মৃন্ময়ী ভালো ভাবেই করল।একজন বৃদ্ধ মহিলার দেখাশুনা করতে হতো।বেতন ও বেশ ভালোই দিত।বিদেশের চাকরি টা যখন মৃন্ময়ী বেশ খুশি মনে করতে লাগলো তখন হঠাৎ করেই মাস ছয়েক পড়ে মৃন্ময়ীর জীবনে আবার ঝড় আসল।এর মধ্যে অবশ্য রজতের সাথে মৃন্ময়ীর সপ্তাহে দু তিনবার কথা বার্তা হতো। কিছু টাকা জমাতে পারলেই মৃন্ময়ী দেশে ফিরে এসে আবার পড়াশোনা চালিয়ে যাবে এরকম একটা প্ল্যান মৃন্ময়ী করে রেখেছিল।কিন্তু বিধি বাম।ঝড়টি সামলানো মৃন্ময়ী এর জন্য কঠিন হয়ে পড়ল। কারণ যে মহিলার সেবা করত একদিনের জ্বরে সেই মহিলা মারা গেল।মহিলাটির বয়স ও কম ছিল না।তাই জ্বর এর ধাক্কা সামলাতে পারল না।মৃত্যুবরন করে মৃন্ময়ী কে পথে বসিয়ে গেল।বিদেশ বিভুঁই দেশ সাহায্য করার ও কেউ ন। এর মধ্যে বিদেশের মাটিয়ে মৃন্ময়ী আগের চাইতে আরও বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছিল।প্রথমে যে মহিলার সেবা করত সে পরিবারের সবাই ভালো মনের ছিল বলে মৃন্ময়ী কোনদিন অসুবিধায় পড়েনি।কিন্তু মহিলার মৃত্যুর পরে সে চোখে সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো। যেখানেই চাকরির খোঁজে যায় সেখানেই কামুক চাহনি দেখে চাকরি করবে না বলে বাসায় ফেরত আসে।মাস দু মাস চাকরি যোগাড় করতে না পেরে মূলধন খরচ হয়ে যেতে লাগলো। প্রমাদ গুনা শুরু করল মৃন্ময়ী।বেশিদিন এভাবে সেদেশে থাকতে পারবে না।কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।এদিকে রজত ও মৃন্ময়ী কে দেশে ফেরত না এসে সেখানে চেষ্টা চালিয়ে যেতে বলল।

    অবশেষে মৃন্ময়ী মাস চারেক পড়ে মোটামুটি একটা চাকরির সন্ধান পেল।যদিও বেতন আগেরকার মতো নয় তবু ও চালিয়ে নিতে পারবে বলে মৃন্ময়ী চাকরি টা নিয়ে নিল।এই চাকরি টা অবশ্য অন্য রকমের ছিল।আগের চাকরি তে শুধু বৃদ্ধ কে দেখাশুনা করতে হতো কিন্তু এই চাকরি তে সারাদিন ঘরের কাজ করতে হতো। ফলে এত বেশি ক্লান্ত থাকত রজতের সাথে কথা বলার সময় ও কম পেত।ফলে দুজনের সম্পর্কে ভুল বুঝাবুঝি শুরু হতে লাগলো । তবু্ও মৃন্ময়ী সম্পর্ক টা যেন ভেঙে না যায় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যেত।

    এসব কথা চিন্তা করতে করতে মৃন্ময়ীর এক্টুখানি চোখ লেগে এসেছিল।কিন্তু জাহাজের অধিক মাত্রায় দুলুনিতে তন্দ্রা ভেঙে গেল । বুজতে পারল না জাহাজের কি সমস্যা হলো। কিছুক্ষণ বাইরে মানুষের কথা বলার শব্দ পেল।এরপর সব চুপচাপ। সবাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে।ঘুমুতে পারছে না শুধু মৃন্ময়ী।বাড়িতে পা দেওয়ার পর সবাই কিভাবে মৃন্ময়ী কে গ্রহণ করবে বুঝতে পারছে না।সে ও কি বলে কথা শুরু করবে সেটা এখনো চিন্তা করেনি। পরশুদিন ম্যাগাজিন হাতে পাওয়ার পরে এবং দুপুরের সেই টেলিফোনে খবর টা পাওয়ার পরেই মৃন্ময়ী সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল সে বাড়ি যাবে। রাস্তাঘাট ও নিশ্চয়ই অনেক বদলে গেছে।অবশ্য এ নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই।নিজের গ্রামের নাম তো জানে।জিজ্ঞেস করতে করতে পৌঁছে যাওয়া যাবে। সে নিয়ে ভাবনা নেই।এসব চিন্তা করতে করতে আবার চোখ লেগে আসল।

    ঘন্টা খানেক ঘুমানোর পড়ে মৃন্ময়ীর আবার ঘুম ভেংগে গেল।অবশ্য এবার ঘুম ভাংগলো সেই বিভীষিকাময় স্বপ্নটা দেখে।সেই রাতের পর থেকেই মাঝে মাঝে স্বপ্ন দেখে মৃন্ময়ীর ঘুম ভেংগে যায়।স্বপ্নে দেখে মৃন্ময়ী দৌড়াচ্ছে আর পিছনে নরখাদক প্রায় ধরে ফেলছে মৃন্ময়ী কে।এর পরই ঘুম ভেংগে যায়।আর মৃন্ময়ী আহত পাখির মতো থিরথির করে কাঁপতে থাকে। স্বপ্নে মৃন্ময়ী কে ধরার আগে ঘুম ভেংগে গেলে ও সেদিন কিন্তু নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি মৃন্ময়ী। তার সমস্ত সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছিল মালিক তার পত্নীর অনুপস্থিতিতে। এখনো মনে উঠলে মৃন্ময়ী নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না।এরপর থেকে মৃন্ময়ীর উপর অত্যাচার নিত্য ঘটতে থাকল।অবশেষে মৃন্ময়ী বিদেশে থাকার কথা আর চিন্তা করতে পারল না। দেশে ফিরে আসল প্রায় শুন্য হাতে।

    মৃন্ময়ীর উপর অত্যাচার এর কথা রজত কে বলার পরে রজত মৃন্ময়ী কে তার একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য করতে পারবে না বলে সরাসরি জানিয়ে দিল।দিশেহারা মৃন্ময়ী কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না।বারবার মনকে বুঝাতে লাগলো হেরে যাবে না। আকাশ ছোঁয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছিল তার সব কিছু শেষ হয়ে গেলে ও সে নতুন করে আবার উঠে দাঁড়ানোর দৃঢ প্রত্যয় মনের মাঝে বাঁচিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ানোর ইচ্ছেকে ব্যক্ত করল দৃঢ মনোবলের সাথে। দেশে এসে মৃন্ময়ী কমদামি একটা হোটেলে উঠল দু চারদিনের জন্য। কারণ বিদেশ থেকে আসার সাথে সাথে তো বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে না। তাই দেশে আসার পরদিন থেকে মৃন্ময়ী চাকরি এবং বাসা দুটোই হন্যে হয়ে খোঁজা শুরু করল।

    চলবে…

  • মৃন্ময়ী (পর্ব-১)

    মৃন্ময়ী (পর্ব-১)

    মিস মৃন্ময়ী মিত্র এই নামেই টিকেট কাটা হয়েছে। চেক করে দেখুন তো একবার।কোন কেবিন আমার নামে বুকিং দেওয়া আছে? খুব অবজ্ঞা করে চেকার চোখ তুলে কন্ঠস্বরের অধিকারী কে দেখতে গিয়ে মারাত্মক ভাবে ভ্যাবাচেকা খেয়ে চেয়ার থেকে পড়ে যেতে গিয়ে কষ্ট করে নিজেকে সামলে নিল।আনমনেই চেকার নিজের হাতে ছোট্ট করে চিমটি কাটল।তার সামনে অপরুপ সুন্দরী, মার্জিত, স্মার্ট, গাম্ভীর্য পুর্ণ রমণী কে দেখতে পেয়ে কিছুক্ষণের জন্য চেকার মিজান বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। হঠাৎ করেই মিজান তোতলাতে তোতলাতে বলল, জ্বী ম্যাডাম দে খ ছি।

    বুকিং খাতা বের করে চেক করতেই নামটা দেখে চেকার মিজান আর একবার চমকে উঠলো। তার সামনে কিনা নামকরা বিশাল গার্মেন্টস শিল্পের মালিক মৃন্ময়ী মিত্র দাঁড়িয়ে আছে। মিজান নিজেকে স্থির করতে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে সামনে রাখা গ্লাসের পানিটা এক নিশ্বাসে ঢক ঢক করে খেয়ে একটু স্থিমিত হয়ে নিজেই ম্যাডামের ট্রলি ব্যাগটা নিয়ে সামনে এগোতে লাগলো। মৃন্ময়ী কিছু না বলে চেকারের পিছন পিছন যেতে লাগলো। ১০৫ নাম্বার রুমের সামনে এসে মিজান ম্যাডাম কে দাঁড়াতে বলে নিজে রুমের ভিতরে গিয়ে সব কিছু ঠিক আছে কিনা নিজে একবার চেক করে নিল। সবগুলো একবার ভালো করে চেক করে সন্তষ্ট চিত্তে ম্যাডাম কে ভিতরে যেতে বলে চাবিটা মৃন্ময়ীর হাতে দিয়ে প্রস্থান করল।

    মৃন্ময়ী অফিস বাসা কাউকে জানায়নি।নিজেই টিকেট করেছে। নিজের গ্রামের বাড়ি যাবে বলে। অবশ্য বাসায় যে কাউকে বলতে হবে সে রকম নিকট জন বলতে মৃন্ময়ীর কেউ নেই।গোটা চারেক চাকর বাকর আর বৃদ্ধ ধর্ম পিতা।এ কয়জন কে নিয়ে মৃন্ময়ীর জগৎ। তাই কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করল না মৃন্ময়ী। শুধু বাসার প্রধান কেয়ারটেকার কে বলল সে কয়েকদিনের জন্য গার্মেন্টস এর কাজে বিদেশ যাচ্ছে। প্রায় সময় মৃন্ময়ী বিদেশে আসা যাওয়া করে। তাই এই নিয়ে কার ও তেমন ভাবান্তর হয়নি কারো মধ্যে।

    এতটা বছর পরে প্রায় পঁচিশ বছর হবে নিজ গ্রামের বাড়ি বরিশাল থেকে ঢাকায় এসে ভর্তি হয়েছিল ঢাকা ভার্সিটি তে।সে অব্দি আর বাড়ি মুখো হয়নি মৃন্ময়ী। কিভাবেই বা হবে।সেদিন মৃন্ময়ী এক প্রকার কাউকে না জানিয়ে রাতের গভীরে বাড়ি থেকে একপ্রকার পালিয়ে এসেছিল। আকাশ ছোঁয়া স্বপ্ন ছিল তার। লেখাপড়া শিখে একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে।মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে মৃন্ময়ী ভাই বোনদের মধ্যে তৃতীয় ছিল।বড় বোনের এস এস সি পাশ করেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।মধ্যে খানে ভাই।এরপর মৃন্ময়ী। মৃন্ময়ী এর পরে আরও তিন জন ভাইবোন আছে।দেখতে শুনতে সবাই বেশ সুন্দর বলা যায়।উজ্জ্বল রং চোখ, খাঁড়া নাক সব মিলিয়ে সবাই মা বাবার মতোই সুন্দর হয়েছিল।তাইতো একটু বড়ো হতে না হতেই ঘটক বাড়ির মধ্যে বিয়ের জন্য আনাগোনা করতে লাগলো। মৃন্ময়ী অনেক জোর করে এইস এস সি পযন্ত বিয়েটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল।এরপর আর পরিবারের সাথে লেখাপড়া করার জিদ বজায় রাখতে না পারায় সেদিন মৃন্ময়ী রাতের অন্ধকারে ঘর ছাড়া হলো সামান্য কিছু পুঁজি নিয়ে।

    অজানা শহরে এসে মৃন্ময়ী অনেক কষ্টে তার ছোট বেলার বান্ধবীর ঠিকানা খুঁজে বের করল।বাড়ি থেকে আসার সময় সে ঠিকানা টা অনেক কষ্টে সংগ্রহ করেছিল বান্ধবীর মায়ের থেকে। ভাগ্যে ভালো ছিল মৃন্ময়ীর বাসা খুঁজে নিতে বেগ পেতে হলোনা। তবে মৃন্ময়ীর বান্ধবী সেদিন মৃন্ময়ী কে দেখে খুব বেশি খুশি হতে পারেনি।একান্নবর্তী পরিবারের বউ হয়ে মৃন্ময়ী কে সাহায্য করার দুঃসাহস সে দেখাতে সমর্থ ছিল না। তাই তো নিজের কাছে মৃন্ময়ী কে দু দিনের বেশি রাখতে পারল না।অবশ্য এই দুদিনেই বান্ধবী তার দেবর রজত কে দিয়ে মৃন্ময়ী এর জন্য হোস্টেলে থাকার সু বন্দোবস্ত করেছিল।রজত ও অবশ্য বউদির বান্ধবীর জন্য কিছু সহযোগিতা করতে বিরক্ত প্রকাশ করেনি।বউদির সুন্দরী বান্ধবী বলে কথা। তাই অতি সহজে মৃন্ময়ী থাকার একটা ঠিকানা পেয়ে গেল রজতের সাহায্যে।

    কয়েক মাস নিশ্চিন্তে চলতে পারার মতো টাকা আর মায়ের একটা গলার হার মৃন্ময়ী সাথে করে নিয়ে এসেছিল।ভেবেছিল চাকরি করবে পাশাপাশি লেখাপড়া চালিয়ে যাবে।ভালো একটা ভার্সিটি তে মৃন্ময়ী ভর্তি হয়ে গেল।চাকরি পেতে বেশ বেগ পেতে দেখে সহপাঠীরাই কয়েকটি টিউশনি যোগার করে দিয়েছিল।।সব দিক দিয়েই মৃন্ময়ীর সৌভাগ্য ছিল বলে অনায়াসে ভার্সিটি তে ভর্তি টিউশনি পাওয়া কোন কিছুতেই আটকালো না। তদুপরি রজতের মতো একজন ভালো বন্ধু জুটলো। যে কিনা সব কাজেই মৃন্ময়ী কে সাহায্য করতে পিছ পা হতো না। অবশ্য রজত ও ভালো স্টুডেন্ট ছিল। সে মাস্টার্স শেষ পর্বে আছে।একই ভার্সিটি তে। তাই ধীরে ধীরে মৃন্ময়ী আর রজতের মধ্যে সুন্দর একটা সম্পর্ক তৈরি হতে লাগলো। এত বড় বিশাল শহরে এক প্রকার গার্ডিয়ান এর মতো ও রজত মৃন্ময়ীর সব কিছু দেখাশোনা করত। ধীরে ধীরে মৃন্ময়ী ও রজতের মধ্যে গভীর প্রণয়ের সূত্রপাত হতে বেশি সময় লাগলো না।

    মানুষের জীবন সব সময় ভালো যায় না। মৃন্ময়ীর জীবনে হঠাৎ করে ঝড় নেমে আসল। কঠিন পরিশ্রম করতে গিয়ে কঠিন অসুখে পড়ল মৃন্ময়ী। কয়েক মাস অসুখের সাথে যুদ্ধ করে মৃন্ময়ী সুস্থ হলো বটে কিন্তু এর মধ্যে তার যা কিছু টাকা জমিয়েছিল তা তলানিতে এসে টেঁকল। টিউশনি সব একে একে চলে গেল।মাত্র দেড় বছর ভার্সিটি তে পড়ে পরবর্তী লেখাপড়া চালানোর মতো তার আর টাকা পয়সা রইল না।কিছুদিন হন্যে হয়ে অফিসের দ্বারে দ্বারে চাকরি খোঁজে বেড়াতে লাগল।কিন্তু কিছুতেই কোন কিছু যোগাড় করতে পারছিল না।এদিকে রজতের ও এখন পযন্ত চাকরি হয়নি যে সে মৃন্ময়ী কে সাহায্য সহযোগিতা করবে।মৃন্ময়ী জানে রজত তাকে অনেক বেশি ভালবাসে।মৃন্ময়ী ও রজত কে নিজের চাইতে বেশি ভালবাসে। তাইতো সে রজতের সাহায্যে করতে না পারাকে খারাপ ভাবে নিল না।

    এভাবে কতদিন আর চলতে পারবে ভাবতে ভাবতে মৃন্ময়ী যখন প্রায় ভেঙে পড়ছিল সে সময় পেপারে এক বিজ্ঞাপন এ নজর পড়ল। বিদেশে কিছু মেয়ে কেয়ারটেকার হিসেবে নিয়ে যাচ্ছে এক এজেন্সি। ভালো বেতন দেবে সাথে থাকা খাওয়া ফ্রী এবং নিয়ে যাওয়ার সমস্ত খরচ অফিস বহন করবে। মৃন্ময়ী এই বিজ্ঞাপন দেখে আর কোন কিছু চিন্তা করা ভুলে গেল।কারণ সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। পরিবার তাকে ত্যাগ করেছে।এমতাবস্থায় সে বাড়ি ও ফিরে যেতে পারছে না।তাই রজত কে বুঝিয়ে শুনিয়ে বিদেশে চলে যাওয়ার ব্যাবস্থা করে ফেলল মৃন্ময়ী।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩১)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩১)

    রাহেলা বেগম সিঁড়ি উঠে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেলেন, নাহিদ মাকে ভেতরে নিয়েই, টেবিলে রাখা গ্লাসের শরবত হাতে দিয়ে দিল, এবং বললো, মা খাও।

    রাহেলা বেগম, বললেন বাবা আগে একটু বসি, দম নিই। শরবত খাচ্ছি।
    – সিঁড়ি উঠতে বেশি কষ্ট হয়ে গিয়েছে?
    – বয়স হয়েছে বাবা, এটাই সমস্যা। সিঁড়ির জন্য না। এই কলি, সব ব্যাগ উঠেছে ঠিক মতো?
    – হ্যা, মেজ ভাই আছেন, শাহিদ ও আছে সমস্যা নাই, কিরে নাহিদ শরবত আমাকে দিবি না?
    – হ্যা, তোর জন্য আছে।

    কলি শরবত মুখে দিয়ে বললো কি রে কি দিয়েছিস? এতো তিতা লাগছে কেন?
    – তুই শুধু ভুল ধরিস। মা, তুমি বলো শরবত কি তিতা হয়েছে?

    রাহেলা বেগম বলছেন, লেবু বেশি চিপলে এরকম তিতা হয়, এটা সমস্যা নাই। তুই বানিয়ে রেখেছিস, তাই ভালো।

    রাহেলা বেগম ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন, আর বলছেন আমরা পাগলা, কত বড় হয়ে গিয়েছে।
    – মা, বাসা তোমার পছন্দ হয়েছে।
    – হয়েছে।
    – ছাদের উপর দেখে, সমস্যা নাই তো?
    – এ জন্যেই পছন্দ। রোদ-বৃষ্টি শরীরে লাগবে তাই শান্তি। আলো বাতাস ও আছে।
    – গরম একটু বেশি হবে।
    – সমস্যা নাই, ফ্যান তো আছেই।
    – যাক, এখন শান্তি।
    – নাহিদ, বাড়ীতে থাকতে সাঈদ কে দুই দিন কল দিলাম, অফিসের বাইরে ছিল।
    – আমি কল দিব আজকে?
    – তুই না, জাহিদ কে কলে দিতে বলবি। আর পলিকেও বাবা একটা কল দিস।
    – পলিপার বাসার ল্যান্ড লাইনে কল যাচ্ছেনা। চিঠি লিখে দিব।
    – হ্যা, তাই দে।

    পলির মন টা ভীষন খারাপ হয়ে থাকে, এতো একলা লাগে সারাদিন! নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। মনে হয় খাঁচায় বন্দি পাখির মতো ছটফট করে মন। নতুন বিবাহিত একটা মেয়ের শ্বশুর বাড়ীতে একা মন টিকানো অনেক কষ্ট৷ এছাড়া এই বাসার সব হয় নিয়ম মতো। সকালের ম্যানু টা সেট করা, আলু ভর্তা, ভাত, ডাল। প্রতিদিন ভাত খেতে একদম রুচিতে আসেনা পলির। তার বাড়ীর কারোরই কি তার কথা মনে পড়েনা! এক বারের জন্য কেউ আসেনি! পলির মন ভীষন খারাপ হয়ে আছে। ননদ কে পড়তে দিলেও সে ও তেমন পড়তে আগ্রহ দেখায় না।

    পলি রান্না ঘরে গিয়ে বললো আম্মা, আজ আমি রুটি-সবজি করি?
    – বউ, মানুষ ১৩ জন, ৩৯ টা রুটি করা লাগবে। এতো সবজি এখন কাটবে কে? এরা উঠতি বয়েসী ছেলে-মেয়ে পেটে ক্ষিদা বেশি।
    – খিচুড়ি করি?
    – না, থাক। তোমার শ্বশুর পছন্দ করেন না। তোমার মতো আমার ও প্রথম প্রথম খারাপ লাগতো এই শর্টকাট ম্যানু দেখে, এখন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি।
    – জি।
    – তোমার শ্বশুর বলেন সকালে, ভাত খেলে, নাকি সারাদিনের জন্য পেট ঠান্ডা, পেট ঠান্ডা মানে মাথাও শীতল বরফের মতো ঠান্ডা। তার যুক্তি ভালো, কিন্তু ঘটনা হলো সে হিসেব করে কদম ফেলে মা। এতো গুলি ছেলে-মেয়ের পড়ার খরচ, এই বাড়ীর লোন, তার ও কিচ্ছু করার নেই মা। আবিদ কি চিঠি দিয়েছে আর? ল্যান্ড লাইন টাও নষ্ট।
    – না, আম্মা। গত সপ্তাহে দিয়েছিল।
    – ছেলে আমার খুবই ভালো। চিন্তার কারণ নেই। যাও তুমি রুমে যাও, আমার আলু সিদ্ধ আর ভাত শেষ। এখন শুধু ভাত বসাবো।
    – , আমি আলু ভর্তা করি?
    – বললাম তো রান্না সারাজীবনই করতে হবে। এখন আরাম কর, কয় দিন।
    – আম্মা করি।
    – আচ্ছা আগামী মাসের এক তারিখ থেকে তোমার রান্না শুরু এখন, যাও।

    পলির তার শ্বাশুড়ির কথায় মন সব সময় কিঞ্চিৎ হলেও ভালো হয়। কি মায়াভরা কন্ঠ। তবে প্রফেসর সাহেব দারুন হিসাবী মানুষ, দুপুরেও তিনি শর্ট ম্যানু দেন। মাছ /মাংস, সবজি, ভাত। রাতেও একই রকম থাকে। সন্ধ্যায় কোন খাবার নাই। অথচ তার মায়ের এই হতদরিদ্র সংসারে, পড়তে নসার আগে, চিড়া, মুড়ি, খৈ কিংবা বড়া করে দিতেন। পলি খাতা কলম নিয়ে বসলো, মায়ের কাছে আজ সে অনেক লম্বা চিঠি লিখবে!

    সাঈদ ফোন ধরেই বললো ওয়ালাইকুম আসসালাম। জাহিদ নাকি?
    – জি ভাইজান, কেমন আছেন।
    – ভালো আছি। মা কেমন আছেন?
    – মা ভালো আছেন। জিহান কেমন আছে?
    – নতুন হাঁটা শিখেছে, খুব চঞ্চল হয়েছে। আমিও আছি দৌড়ের উপর।
    – নাহিদ মাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছে।
    – ছোট খালাম্মার বাসায় নাকি? আমিও আজ রাতে অফিসের কাজে ঢাকা আসছি। ভালো হয়েছে খালাম্মার বাসায় যাবো।
    – ভাইজান, নাহিদ আর শাহিদ মিলে বাসা নিয়েছে উত্তর মুগদা।
    – কি? বাসা নিয়েছে? এতো বড়লোক হলো কবে? তাহলে ইনকাম ভালোই হচ্ছে। মা তো একবার জানালেন না!
    – আপনি অফিসে ছিলেন না। কল দিয়েছিলেন। আপনাকে বাসার লোকেশন দিচ্ছি, উত্তর মুগদা, ২ নম্বর গলির মুখে হাসি ভেরাইটিজ স্টোরের ঠিক উলটা পাশের গলির শেষ মাথায় তিন তলা বাসা। বাসার নম্বর ২৮৯/১
    – মুগদা কে যাবে? আমার ট্রেনিং ফার্মগেট। গ্রীনরোড খালাম্মার বাসা। তাই ভেবেছিলাম উঠবো।
    – নতুন বাসা দেখে যান।
    – নাহ, তোরা এখন বড় হয়েছিস, আমাকে কিছু জানানোর প্রয়োজন মনে করিস না! ভালো। রাখি রে। আমার ছেলে কান্নাকাটি করছে।

    সাঈদ খট করে ফোন রেখে দিলেন। জাহিদের ও আর কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। কি এক আজব মানুষ, সব কিছুতেই দোষ ধরেন।

    জাহিদ দুটি পাটি, দুটি বেতের মোড়া, এক জোড়া বালিশ, কিছু শুকনো খাবার কিনে নিয়ে বাসায় গেল।

    রাহেলা বেগম বললেন কি দরকার বাবা এতো কিছু কেনার। টেবিল নাই, পাটি বিছিয়ে তো ভাত খাবে নাকি! মা, আমি সকালে রওনা হবো, কিছু দরকার লাগলে বলো।
    – কিচ্ছু লাগবেনা। সাঈদ কে কল দিয়েছিস?
    – দিয়েছি। ভালো আছে। এই শাহিদ তুই পড়শু খিলগাঁও সরকারি কলেজে মাস্টার্স আছে কিনা খোঁজ নিবি।
    – মেজ ভাই, আপার যে মার্ক্স তাতে খিলগাও হবে নাকি?
    – খোঁজ নিয়ে দেখ। নাহিদ কোথায়?
    – কয়েল আনতে নিচে গিয়েছে। মশারী কেনা হয়নি।
    – ওহ।

    কলি এসে বললো মেজ ভাই মেজাজ এতো চড়া কেন? ভাইজান কিছু বলেছে নাকি?
    – আরে না।
    – আমি জানি, ভাইজান কখনোই সুন্দর করে কিছু বলবেনা।
    – বেশি বুঝার দরকার নাই। দোয়া কর যেন মাস্টার্সে এ চান্স হয় আশপাশে। নয়তো একা একা পারবি এই ঢাকা শহরে চলতে? এখানে পলি ও নাই, রিতা খালাম্মাও নাই। দুনিয়া অনেক কঠিন এখানে। এতো হেসে খেলে জীবন যাবেনা। দোয়া কর, আর বেশি করে পড়।

    পলি মুখ কালো করে বসে আছে, জাহিদ কখনোই এরকম কঠিন হয়ে কথা বলেনা। জাহিদের মন খারাপ লাগছে কেন অযথা বকতে গেল! কি করবে ভাইজানের কথায় মন টা খারাপ হয়ে আছে। ইচ্ছে করেই প্রসঙ্গ বদলেছে সে, নয়তো কলি বুঝলে মাকে বলবে, তিনিও কষ্ট পাবেন।

    পলি তিন পৃষ্টার চিঠি লিখে শেষ করেছে। শেষ লাইন লিখেছে, যদি আমাকে এসে এই সপ্তাহে কেউ বাড়ীতে না নেয়, আমি একাই রওনা হবো, এই বলে দিলাম…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ২৭.০১.২০২২

  • আজিমপুর টু উত্তরা –  ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৩)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৩)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (৩)
    অনেক ঘোরাঘুরির পর জেমিদের কাজটা অবশেষে হয়ে গেছে। এই অছিলায় জেমির সাথে ঘোরাঘুরিও হয়েছে বেশ। সিটি কর্পোরেশনের পেপারস গুলো প্রকিওর করে জেমির হাতে দিতেই উষ্ণ অভিবাদন পেলাম,“ থ্যাংকস। এই তো দায়িত্ববান হতে শিখছো”। এর দ্বারা জেমি কি বুঝাতে চাইলো বুজে উঠতে পারলাম না। বললাম, “ কেন?”
    — বাহ। যেচে দায়িত্ব নিলে। মানে দায়িত্ব নেওয়ার ছুতো করে মোবাইল নম্বর নিলে।
    — হুম্ম
    — হুম্ম কি?
    — কিচ্ছু না
    — আজকাল দেখা না করেই ছাত্রীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছো যে
    — ভাবছি কাল থেকে আর সেটাও করবো না
    — মানে কি?
    — টিউশনি ফিউশনি ভাল লাগছেনা
    — কি ভাল লাগে?
    — কিচ্ছু না
    — মেয়েদের মোবাইল নম্বর নিতে ভাল লাগে?
    — সেটা ছিল মারাত্মক ভুল
    — ভুল কেন? কাজের জন্যই তো নিয়েছিলে। অন্য কোন উদ্দেশ্য ছিল নাকি?
    — বললাম তো ভুল হয়ে গেছে
    — মোটেই না
    — কেন?
    — একদিন না একদিন আমিও তোমার নম্বরটা নিতাম
    — কেন?
    — তোমার মত ভুল করে। কাজের বাহানায়
    — লাভ কি?
    — ক্ষতিই বা কি?
    এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। সব প্রশ্নের উত্তর তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়াও যায়না। লাভ ক্ষতির হিসেব চুলোয় যাক। এর পর থেকে জেমির সাথে ঘনিষ্ঠতা আরো বেড়েছে। সিটি কর্পোরেশনের কাজের উসিলায় ছুতোনাতা করে বাসা থেকে বেরিয়ে পরাই এখন জেমির রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাহন হিসেবে রিক্সাতেই আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য। ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে ফিক্স হতে প্রথমে জড়তা থাকলেও এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দিনে দিনে জেমি আরো জেম হয়ে উঠছে। চেহারায় রোশনাই বেড়েছে। এমনিতেই সে বেশ সুন্দর। প্রেমেতে জড়ালে মেয়েরা নাকি উর্বশী, অপ্সরা, মেনকা হয়ে উঠে। তার সান্নিধ্য এক সময় অধরা মনে হলেও এখন তা অতি বাস্তব। আমাদের কোন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকলেও অজানা কোথায় যে ভেসে যাচ্ছি এক সাথে সেটা বুঝতে পারছি ঠিকই। সম্পর্ক গাঢ় হলে কোত্থেকে যেন ‘কুচ পরোয়া নেহি’ জাতীয় সাহসও ভর করে।
    একদিন দুপুরে ফোন এলো। জেমির। পাঁচটায় আলিয়ঁস ফ্রসেজ এর সামনে থাকতে হবে। ফ্রেঞ্চ ফেস্টিভেল চলছে সেখানে। আজ দু’টো ফ্রেঞ্চ শর্ট ফিল্ম দেখাবে। জেমি সেখানকার মেম্বার। বেশ খানিকটা আগেই সেখানে গিয়ে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। চারিদিক আলোকিত করে, বাতাসে সুগন্ধি ছড়িয়ে দীপিকা পাডুকোন এসে হাজির হলেন। আজ তার পড়নে নীল সাদা কম্বিনেশন কামিজ। একই রংয়ের মাস্ক। সাথে ম্যাচিং ওড়না। গলায় পেচানো। মেয়েদের এই বিষয়টা দেখার মত। কি বিবাহিত, কি অবিবাহিত সবারই এক স্টাইল। ম্যাচিং। বেছে বেছে ঠিকই যোগাড় করে নেয় সব। নীচ তলার ক্যাফেতে গিয়ে বসলাম। কফির অর্ডার হলো। সাথে স্যান্ডউইচ। বুঝলাম জেমি সেখানে পরিচিত। খানিকক্ষণ হাই হ্যালো করলো অনেকের সাথে। আমি এর আগে এখানে আসিনি। তাই জড়তা বোধ হচ্ছে। “আন ইজি লাগছে”? জেমির কথায় সোজা হয়ে বসলাম। “ভীতুর ডিম” বলে স্যান্ডউইচের দিকে ইশারা করে বললো, “এই সাহস নিয়ে প্রেম করবা কেমনে”? জেমি চোখ টিপে হাসলো। হয়ত মজাই পেল। আমি আরো কূঁকড়ে গেলাম। ছ’টায় শুরু হলো সেই কাংখিত শর্ট ফিল্ম। একেকটি চল্লিশ মিনিট করে। মাঝে দশ মিনিটের শর্ট ব্রেক। দু’টো ফিল্মই লাভ স্টোরি বেইজড। সাব টাইটেল ইংরেজীতে। আমি আবার সাব টাইটেল ফলো করতে পারিনা। ফলো করতে গেলে অনেক সীন মিস হয়ে যায়। বেশ কিছু একান্ত ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত আছে তাতে। হল রুম অন্ধকার। অন্য যুগলরা কি করছে জানিনা। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। শো শেষে জেমির দিকে তাকাতে লজ্জা পাচ্ছিলাম। বের হয়ে ধানমন্ডি লেকের দিকে যাচ্ছি। জেমিই নিরবতা ভাঙ্গলো, “ভালো লাগেনি”?
    — হুম্ম। মাথা নাড়লাম।
    — তাতো বুঝতেই পারছি। গুডি বয় ।
    এর দ্বারা সে কি মিন করলো বুঝতে পারিনি। হঠাৎই ডান হাতটা চেপে ধরে বললো, “দেখি পালস কত”? আমি বাধা দিলেও কাজ হয়নি। বললো, “সেকি! হার্ট এটাক হবে তো মনে হচ্ছে”। পরক্ষণেই বললো,”নো প্রবলেম। এভরি থিং উইল বি ওকে ইন ডিউ কোর্স অফ টাইম”। আমি নির্বাক।
    আরেকদিনের কথা মনে পড়ছে। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরে গেলাম দু’জনে। লোক শিল্পের মেলা হচ্ছে। সেটা একটা উছিলা মাত্র। ঘুরে ঘুরে দেখছি আর কথা বলছি। এমন সময় হঠাৎই তৌহিদের আবির্ভাব। আমি এড়িয়ে যেতে চাইলেও এতটাই সামনাসামনি যে পার পাওয়া গেল না। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললাম, “আমার ফ্রেন্ড। প্রাইভেট ফার্মে আছে”। এরপরেই আটকে গেলাম। হুট করেই জেমি বলে বসলো, “আর আমার পরিচয় ”? বিব্রত করার জন্য এই এক মিশাইলই যথেষ্ট। বললাম, “ ও হ্যা, তাইতো। ইনি আমার ছাত্রীর বড় বোন। আমাদের নেইবার”। কথাগুলো বলে নিজেই বোকা হয়ে গেলাম। সব জায়গায় সব সময় সত্য কথন ঠিক না। তা অজস্র সম্পূরক প্রশ্নের জন্ম দেয়। মনে মনে উপলব্ধি করলাম আজ কপালে খারাপী আছে। তৌহিদ ছেড়ে দেবেনা। একান্তে দেখা হলে এর নাড়ি নক্ষত্র বের করে ছাড়বে। আর জেমির ক্রুজ ক্ষেপনাস্ত্র তো তাক করা আছেই। যাহোক, জাদুঘর প্রাঙ্গণে গরম গরম ভাপা পিঠা তৈরি হচ্ছে। সবাই খাচ্ছে। আমরাও গিয়ে দাঁড়ালাম। তৌহিদ সমাদারে ওস্তাদ। জেমির সাথে খুব সহজেই ভাব জমিয়ে নিলো। সেখানেই দেখা হলো আরেক বন্ধু লালনের সাথে। সেও এসেছে তার জিএফ কে নিয়ে। তাদের সম্পর্ক বহুদিনের। বন্ধু মহলে এই নিয়ে অনেক কথা আছে। পরিবেশ জমজমাট আর আনন্দঘন হলেও আমি প্রমাদ গুনছি আবোল তাবোল অনেক কিছু কল্পনা করে। এক সময় বিদায়ের পালা এলো। আমি তৌহিদের সাথে থেকে যাবো। জেমিকে বলতেই চোখে চোখে এমন ভাবে তাকালো যে কি করবো বুঝে উঠতে পারছি না। শুধু শুনলাম, “ভিতুর ডিম। লজ্জা লাগছে? ভয় পাচ্ছো”? যাহোক, তৌহিদ বিদায় নিয়ে চলে গেল। লালন তার জি এফ কে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। আমি জেমিকে অনুসরণ করতে থাকলাম। সেদিনের পর থেকে দু’দিন জেমি কোন যোগাযোগ করেনি। ফোন করেও পাওয়া যায় নি। একদিন আচম্বিত ফোন করলো। বললাম, “ফোন ধরো না কেন? কোন প্রবলেম”?
    — প্রবলেমই তো
    — কি রকম?
    — ভেবে দেখলাম, যে ছেলে পরিচয় দিতে লজ্জা পায় তার সাথে এই ‘সম্পর্কে’র নাম কি?
    — মানে?
    — মানে মানে করবা না। আমি কি বলতে চেয়েছি তুমি ঠিকই বুঝতে পারছো
    — উহু। তুমি বলো।
    — আচ্ছা রাখছি। লেবেন চুস খাও গিয়ে।
    আমার হাসি পেলো। বুঝলাম। জেমি তার সম্পর্কের একটা আইডেনটিটি চাচ্ছে। হাওয়া যখন অনুকূলে বয় তখন সারাকাল বসন্তকাল বলে মনে হয়। আমারও হয়েছে তাই। কাউকে কি সিম্পটন ধরে ধরে বোঝাতে হবে এখন বসন্তকাল চলছে?

    চলবে…

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-২)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (২)
    ব্যাংক পর্ব শেষ করে সিটি কর্পোরেশনে গিয়ে যখন পৌছলাম তখন লাঞ্চ পিরিয়ড চলছে। অফিসের লাঞ্চ পিরিয়ড কখন শুরু হয় আর কতক্ষণ পর্যন্ত চলে তার টাইম টেবিল কাগজে আছে, প্র্যাক্টিসে নেই। যার কাছে কাজ তিনি চেয়ারে নেই। হঠাৎই চোখে পড়লো দূরে চেয়ারে বসে আছে ইলমার বড় বোন জেমি। পরনে হলুদ প্রিন্টেড কামিজ। ম্যাচ করা মাস্ক। সাথে সাদা ওড়না গলায় পেচানো। চুল হাল্কা সোনালী কালার করা। কানে দুল, সরু লতার মত । হাসি বিনিময় করে বললাম, “কতক্ষণ ধরে এখানে”?
    — প্রায় ঘন্টাখানেক।
    — কেন?
    — নতুন ফ্ল্যাটের হোল্ডিং খুলবো।
    — কি বলছে এখানকার লোকজন?
    — যিনি করবেন তিনি নেই। কোথায় যেন গেছেন। এই এসে পড়বে বলছে সবাই। কিন্তু আসছেন না।
    — এই হচ্ছে আমাদের অফিস কালচার।
    — কি রকম?
    — এই যে নামায আর লাঞ্চের নাম করে বারোটা থেকে তিনটা পর্যন্ত কাউকেই পাওয়া যায়না।
    জেমি প্রসঙ্গ পাল্টালো, “ছাত্রীর পড়াশোনা কেমন চলছে”?
    — সে তো আপনিই ভাল বলতে পারবেন।
    — ইলমা তো তোমার গুণে মুগ্ধ
    — আর আপনি? কথাচ্ছলে মুখ ফসকে বেরিয়ে যেতেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলাম। জেমি চোখটা ঈষৎ বড় করে কেমন করে যেন তাকালো। কি যেন ভাবলো। তার পর বললো, “তোমার কি মনে হয়”?
    — জানিনা। স্যরি, বেয়ারা প্রশ্ন হয়ে গেল। রিয়েলি স্যরি।
    এমন সময় অফিসের রেভেনিউ সেকশনের সেই ভদ্রলোক এলেন। এসেই চরম বিরক্ত। কোথাও কেউ কোন কাজ করেনা। কাউকে ডেস্কে পাওয়া যায়না ইত্যাদি খিস্তি আওড়াতে থাকলেন। আমি থ মেরে শুনছিলাম তার কথা আর ভাবছিলাম সেই প্রবচনের কথা, একি কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে? যাহোক, আমার কাজটা হলো। কিন্তু জেমির কাজ হলো না। কিছু পেপার শর্ট আছে। সেগুলো নিয়ে পরে আসতে হবে। জেমির মুখ কালো। আমার আলো। ভদ্রলোক নামাযের উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। বসে থাকা বৃথা। বললাম, “এখন কি করবেন”?
    — বুঝতে পারছিনা
    — দু’টো কাগজ লাগবে। তারপর অন্য কথা।
    — সে তো শুনলামই। ঝামেলাই দেখছি।
    — কেন? ঝামেলা কেন?
    — এই যে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে
    — কাউকে দিয়ে করিয়ে নেবেন
    — সেরকম কেউ তো নেই এগুলো করার মত
    — আমি করে দিতে পারি
    — তুমি মিছেমিছি করতে যাবে কেন
    — মিছেমিছি করবো বলিনি তো
    — তো
    — কন্ডিশন আছে। আমি বললাম।
    — আমারো একটা কন্ডিশন আছে। জেমির পাল্টা উত্তর।
    — কি?
    — এখন থেকে তুমি করে বলবে। জেমি দুষ্টু হাসিতে, চোখের ফাঁসিতে আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “সে পরে দেখা যাবে”।
    আমার অন্তরাত্মা ধক করে উঠলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রিয়দর্শিনী, প্রিয়ংবদা জেমি আমার উপর দশ মনি বস্তা চাপিয়ে দিয়ে সিঁড়ি ভাঙ্গতে লাগলো। আমি তার পিছু পিছু। নীচে তার গাড়ী প্রস্তুত। গাড়ীতে চেপে ইশারায় উঠতে বললো। ইতস্তত করতে দেখে বললো, “ভয় পাচ্ছো? বাসায় নামিয়ে দেবো তো”। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত চেপে বসলাম। ড্রাইভারকে কি যেন বললো বুঝতে পারলাম না। গাড়ী এসে থামলো ধানমন্ডির ‘পাইন উড’ রেস্তোরাঁয়। জেমির সাথে আজকের এই কাকতালীয় সাক্ষাৎ ও তার পরবর্তী অগ্রগতি অবিশ্বাস্যকর। খাবার খেতে খেতে বললো, “ভয় পাচ্ছো? কেউ দেখে ফেললে জাত যাবে”?
    — কই নাতো।
    — সে তো ভালই বুঝতে পারছি
    — ইটস ওকে
    — মোটেই ওকে না। ছাত্রীর সামনে তো টাইগার ভাব দেখাও
    — আপনি তো ছাত্রী না
    — আবার আপনি?
    — আন ইজি লাগছে
    — লাগুক। যতক্ষণ আমার সাথে আছো ততক্ষণ ভেবে নাও রিমান্ডে আছো
    — রিমান্ডে কাউকে খেতে দেয়? জানতাম না
    — বাহ। এই তো কনফিডেন্স লেভেল হাই হচ্ছে। বাকীটাও হয়ে যাবে
    — কি হবে?
    খাবার চলে এসেছে। কেতাদুরস্ত হয়ে কোন বিবাহিতা মহিলার সাথে একান্তে কোনদিন খাইনি। তাই গলা দিয়ে নামছে না।
    বাসায় এসে দেখি বড় মামা হাজির। রিটায়ার্ড জেনারেল। রাশভারি। গোঁফধারী। সম্পর্কে মামা হলেও সম্পর্ক জাহাঁবাজ বসের মত। পারতপক্ষে আমি তাঁর মুখোমুখি হইনা। আম্মার মুখ কালো। বড় মামা গম্ভীর। কাগজগুলো আম্মাকে বুঝিয়ে দিয়ে রুমের দিকে যেতেই বড় মামার সাউন্ড সিস্টেম সশব্দে গর্জে উঠলো, “দাঁড়াও”। মিলিটারি কায়দায় কুইক মার্চের পর হল্টের মত শোনালো। আমি দাঁড়ালাম। বললেন, “বসো”। আমি চেয়ার টেনে বসলাম। তাতে মেঝেতে শব্দ হলো। তিনি বিরক্ত হলেন। এটিকেট আর ম্যানার সম্মন্ধে কিছু ছবক দিলেন। কর্কশ ঠেকলেও এক কান দিয়ে শুনে অন্য কান দিয়ে বের করে দিলাম। তবে তাঁর শেষ কথাটা কানে গিয়ে ঢুকলো কিন্তু বেরোলো না। অনবরত ইকো হতে থাকলো, “তুমি নাকি এ বাড়ী বন্ধক দিয়ে ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে বিজনেস করবে”? চুপ করে রইলাম। লোন নেওয়ার কোন পরিকল্পনাই আমার ছিলনা কোন দিন। আম্মাকে জব্দ করার জন্য ফান করে বলেছিলাম মাত্র। চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হলো। বড় মামা অবশ্য শোনার লোক না। কমান্ড করাই তাঁর কাজ। তাঁর কথাই যেন শেষ কথা। আর এজন্যই আমি তাঁকে এড়িয়ে চলি। কপালের ফেরে আজ সেই টাইগারের মুখোমুখি হয়েছি। নিরবতা ভেঙ্গে মেঘ ডমরু নাদে বললেন, “ওসব কল্পনা টল্পনা ছাড়ো। নো বন্ধক, নো লোন, নো বিজনেস। ওকে? ট্রাই টু গেট আ জব ইমিডিয়েটলি”। এই বলে বড় মামা বিদায় নিলেন। আমি আম্মার দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে বললাম, “মামারে ভাড়া কইরা আনছো? আমি চাকরি করুম না। বিজনেসই করুম”। আম্মাও কম না। জেনারেলের বোন। তাই গলা চড়িয়ে বললেন, “টাকা পাবি কই”?
    — লোন নিমু
    — কে দেবে তোকে লোন “?
    আমি মওকা পেয়ে গেলাম। বললাম, “ যারে বিয়া করুম সেই দেবে”?
    — সে কে?
    — এক বাচ্চার মা।
    এই কথা বলা শেষ। আম্মার বড় মামাকে মোবাইল করাও শুরু। দু’জনের কি আলাপ হলো জানিনা। বাসার আবহাওয়া সেই থেকে থমথমে। বিকেলে শৈলীকে পড়াতে যাওয়ার কথা। মেজাজ চড়ে আছে। তাই, কমফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। গোল্লায় যাক সব।

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩০)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩০)

    জাহিদ দুপুরে খাওয়ার পর থেকে মায়ের খাটেই বসে আছে। রাহেলা বেগম, পান মুখে দিয়েছেন।

    রাহেলা বেগম বললেন বাবা রওনা হ, পরে দেরী হয়ে যাবে, যেতে।
    – মা, আব্বার যে চাকরি ছিল, তার সাথে যদি তুমি চাকরি করতে, কেমন হতো?
    – কিসের মধ্যে, কি প্রশ্ন করিস?
    – আচ্ছা বলো।
    – ভালো হতো, আর্থিক কষ্ট কম হতো। তবে, চাকরি করলে, তোদের ঠিক মতো যত্ন করতে পারতাম না!
    – ভালো হতো, তাইতো?
    – তুই ঝেড়ে কাশ দে, কি হয়েছে বল।
    – মা, আমি চাইনা আমার বোনেরা এই আর্থিক কষ্ট করুক। তুমি কলিকে নিয়ে ঢাকায় যাও, ও মাস্টার্স করুক।
    – ঢাকা যাবো পাগল নাকি?
    – শাহিদ তোমাকে না বলে, বাসা নিয়েছে।
    – ও কোথায়? ওকে এতো বড় সাহস কে দিয়েছে?
    – মা, ওকে জলির বাড়ী ইলিশ মাছ দিয়ে পাঠিয়েছি।
    – ঘুষ দিচ্ছিস আমাকে?
    – মা, জলি কি আমার বোন না? তুমি মা, রাজী হও। এতো বড় বাড়ীতে তুমি কলিকে নিয়ে থাকো। আমার রাত হলে, চিন্তায় অস্থির লাগে।
    – আল্লাহ ভরসা।
    – মা, সাবধানে থাকতে হবে। আজ যদি নাহিদ-শাহিদ ঢাকায় বাজে আড্ডায় চলে যায়, তখন? তুমি কাছে থাকলে ওরাও ভালো থাকবে।
    – আমার ছেলেরা কেন খারাপ হবে?

    জাহিদ তিন ঘন্টা বোঝানোর পর রাহেলা বেগম সম্মতি দিলেন, তিনি ঢাকা যাবেন। তবে, এখন না। আগামী সপ্তাহে, জাহিদ যে নিয়ে তিনি যাবেন।

    কলি খবর শুনে খুব খুশি যাক, পড়াশোনা হবে। সবাই ছোট্ট করে হলেও এক সাথে থাকা হবে।

    জলি ইলিশ পেয়ে খুবই খুশি, সে নিজে রান্না করে, ভাইকে দুপুরে খাইয়ে দিয়েছে। আসার সময়, নাহিদ কে ছোট্ট চিরকুট দিয়ে দিয়েছে। এবং বলেছে,
    সোনাভাই, তুই এটা পড়বিনা, মা কে দিবি।

    নাহিদ বাড়ী পৌছে, খবর শুনে খুবই খুশি হলো। রাহেলা বেগম নাহিদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কি রে আমার শাহজাদা পুত্র, মাকে না জানিয়ে বাসা নিয়ে নিস, এতো বড়ভয়ে গিয়েছিস।

    নাহিদ সাথে সাথে বললো, মা জলিপা কি চিঠি দিয়েছে, তোমাকে। খুব নাকি জরুরী।
    – কি জন্য চিঠি?
    – জরুরি, অনেক। তুমি পড়, আমি আসছি একটু।

    রাহেলা বেগম বললেন, কলি তুই চিঠি পড়, আমি চোখ দিয়ে ভালো দেখিনা এখন।

    মা,
    আমার জন্য দোয়া করবে, বেশি বেশি। তুমি নানি হবে। আমাকে দেখতে আসিও মা।
    ইতি,
    জলি।

    কলি চিৎকার করে উঠে বললো ও মা আমি প্রথম বার খালামনি হবো। আহা, কি মজা হবে। ইশ!
    – আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ আমার জলিকে ভালো রেখো। আমি আমার এই মেয়েকে এই অবস্থায় রেখে কেমনে ঢাকা যাই!

    নাহিদ সেদিন রাতেই ঢাকা চলে গেল, যাওয়ার সময় বাড়ী থেকে কিছু হাড়ি-পাতিল, বাসন, কলির কাপড় সহ দরকারী কিছু জিনিস নাহিদ নিয়ে গেল।

    নাহিদ ঢাকায় গিয়েই, টিউশনির বেতন দিয়ে, জানালার পর্দা কিনলো, একটা সিলিং ফ্যান। রান্নাঘরের জন্য একটা সেলফ।

    জাহিদ এক সপ্তাহ পড়ে, এসে মাকে নিয়ে সব রেডি করছে, শাহিদ এসেছে সাহায্য করতে। আগের দিন রাতে জলিকে দেখে এসেছেন রাহেলা। জলির মন খুব খারাপ, তাকে একা রেখে চলে যাচ্ছেন মা।

    রাহেলা বেগম বলছেন, আমার এই বাড়ী ছেড়ে আমার যেতে একদম মন মানেনা বাবা। আমি তো তোর বাবার হাত ধরে এসেছিলাম। আজ এই বাড়ী এরকম শূন্য করে চলে যাবো। তোর আব্বা হয়তো কত কষ্ট পাচ্ছেন।
    – মা, আমার কি এই বাড়ী ছেড়ে ভালো লাগে? কিন্তু থাকতে হয়। এটাই বাস্তবতা।
    – আমি এতো কিছু বুঝিনা বাপ।

    রাহেলা বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেদে যাচ্ছেন। কেমন করে থাকবেন তিনি এই বাড়ী ছাড়া!

    সন্ধ্যার পরে, এক ট্রাকে করে শাহিদ ঢাকার বাড়ীর নিচে এসে নামলো। জাহিদ কলি আর মাকে নিয়ে ট্রেনে করে আসছে।

    নাহিদ আরও একজন মিস্ত্রি রেখেছিল জিনিস পত্র উঠাতে। জিনিসপত্র তেমন কিছুই না, একটা খাট, একটা আলনা, তিন টা ট্রাংক আর একটা পড়ার টেবিল। আর কিছু বস্তায় কিছু টুকিটাকি বাসন কোসন।

    নাহিদের ভেতর আনন্দে ভরে যাচ্ছে, সে সব কিছু সুন্দর করে সেটিং করছে। যদি জিনিস গুলো পুরনো তারপর ও সুন্দর করে রাখছে সে।

    ট্রাক বিদায় দিয়েই, রুম ভালো করে ঝাড়ু দিয়েছে নাহিদ। রান্নাঘরে গিয়ে লেবু দিয়ে শরবত বানাচ্ছে।

    শাহিদ বললো কি রে খালি পেটে কি শুধু শরবত দিবি? রান্না করেছিস কিছু?
    – রান্নাঘরে আয় দেখ।

    শাহিদ দেখলো, নাহিদ অনেক কিছু রান্না করছে। মুরগী ভুনা করেছে, ডাল ভুনা করেছে, করলা ভাজি, ডিম ভুনা, ভাত।

    শাহিদ বললো কিরে খাওয়া যাবে?
    – তুই টেস্ট করে দেখ। শুধু ভুল ধরা না? অনেক মনোযোগ দিয়ে করেছি।

    বাসায় ফ্রিজ নেই, তবুও লেবুর শরবত গ্লাসে ঢেলে ছোট রুমে রেখেছে নাহিদ। তার খুবই আনন্দ লাগছে তার সাথে বেশ উত্তেজনাও লাগছে তার।

    সে জাহিদ কে ফোন দিল।

    মেজ ভাই কোথায়?
    – এয়ারপোর্ট স্টেশন কর্স করেছি, কমলাপুর আসছি।
    – আচ্ছা, মুগদা এসেই কল দিবে, আমি চলে আসবো।
    – আচ্ছা, আসছি।

    নাহিদ ঘর থেকে বেড়িয়ে ছাদের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছে। তার একটাই চিন্তা মায়ের কি এই বাসা পছন্দ হবে? নাকি এই চিপা রুম দেখে তিনি রাগ করবেন? তবে মা আসছেন এটাই সবচেয়ে আনন্দের, তবুও কিঞ্চিত চিন্তা হচ্ছে মা কি ভাববেন তাই নিয়ে….

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ২৪.০১.২০২২

  • আজিমপুর টু উত্তরা –  ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-১)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।


    শ্রোতব্যঃ
    (গল্প লেখার ঝক্কি অনেক। তাও আবার উত্তম পুরুষে লেখায়। এর বাইরে প্রায়শই যে সমালোচনার সম্মুখীন হতে হয় তাহলো, গল্পের আকার আর ফিনিশিং নিয়ে। গল্পের আকার একটু বড় হলে বেশির ভাগ তরুণ পাঠকই অধৈর্য্য হয়ে বলে ওঠে আকার কমাতে। আবার একদল আছে যারা ছোট লেখা পড়ে বলে বসে, এরপর? অন্যদিকে অনেকেই, বিশেষত মেয়েরা গল্পের হ্যাপী এন্ডিং পছন্দ করে। অন্যরা চান ঘটমান বাস্তবতার মত ‘পাইয়াও হারাইবার বেদনা’। মূলত ট্র্যাজিক এন্ডিংই কমবেশি সবার হৃদয় স্পর্শ করে যায়। এই দুই টানাপোড়েনে কলম ধরতে বড় সংশয় জাগে।
    এই গল্পটি তাই উভয় প্রকার পাঠকের চাহিদাকে সম্মান দিয়ে লেখা। গল্পটি বড়। তবে পর্ব করে একূল- ওকূল দু’কূল রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। আবার গল্পের এন্ডিং নিয়েও দ্বিধাগ্রস্ত আছি। তাই একটা ‘সমাপ্তি পর্ব’ ঠিক করে রেখেছি সত্য। তবে পর্ব চলাকালীন পাঠকদের মন্তব্য, আলোচনা, সমালোচনা দেখে ভিন্ন চিন্তাও করা যেতে পারে। আপাতত কৈফিয়ত আকারে এটুকুই থাক)।


    (১)
    বাসার আবহাওয়া খুব গরম। অনেক দিন হলো আম্মা বেজায় রেগে আছেন। প্রায়ই বাসায় এরকম গরম গনগনে মৌসুমি আবহাওয়া বিরাজ করে। এবার প্রলম্বিত। আবহাওয়া উত্তপ্ত হওয়ার একমাত্র কারণ আমি। আম্মার ইচ্ছে আমি বিসিএস দেই। আমার সাফ উত্তর ‘না’। আমি চাই ব্যবসা করতে। আম্মার এক কথা ‘কভি নেহি’। সকাল থেকেই শুরু হয় আম্মার চিল্লাচিল্লি, “মরার আমার হয়েছে জ্বালা। দামড়া পোলা দুপুর পর্যন্ত ঘুমায়। কাম নাই, কাজ নাই। ধান্ধাও নাই, চিন্তাও নাই”। আমার ঘুমে ব্যাঘাত হয়। বালিশ কান চাপা দিয়েও ঘুম জমাতে পারিনা। থেকে থেকে আম্মার চোখা চোখা কথা কানে আসে। আর মাথার রক্ত গরম হয়ে যায়। বারোটার দিকে সকালের নাস্তা করতে গেলেই দিনের প্রথম বোমা ফাটা শুরু হয়। সঙ্গত কারণেই লাঞ্চের সময় হয় বিকেলে। সেটা অবশ্য বাইরেই সেরে নেই। আর বাসায় ফিরতে ফিরতে সেই রাত এগারো-বারো। খেতে খেতে রাত একটা। তখন শুরু হয় আম্মার বোমা ফাটানোর ক্লোজিং সেশন।


    টিউশনি করি দু’টা। একটা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রীকে। ম্যাথ আর কেমিস্ট্রি। এইট স্ট্যান্ডার্ডের। নাম ইলমা। আরেকজন পাবলিক স্কুলের ছাত্রী। আগামী বছর ইন্টার দেবে। নাম শৈলী। টিউশনি করে যা পাই তা হাত খরচ হিসেবে যথেষ্ট। কিন্তু জীবিকা নির্বাহের পক্ষে যৎসামান্য। আমার আবার স্টুডেন্ট ভাগ্য ভাল। এমনিতেই ওরা মেধাবী, তার উপর ফিনানশিয়াল কন্ডিশন সেইরকম সাউন্ড। তবে দু’টোতেই দু’ধরণের অস্বস্তি রয়েছে। ইলমা খুব কিউট, স্মার্ট ও স্টুডিয়াস। কিন্তু তার বড় বোনের দীপিকা পাডুকোন লুক মাথা আউলা ঝাউলা করে দেয়। তার নাম জেমি। প্রায়ই টিউশনি শেষে তার সাথে শর্ট সেশন হয়। সে অনেক কথা। টক ঝাল মিষ্টির। টিউশনির প্রথম দিনেই তার ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি হলাম। আর দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেলাম। এটা কি চাকরির ইন্টারভিউ নাকি পাত্রের বায়োডাটা ভ্যালিডেশন? ইন্টারভিউয়ের মাঝেই এক কিউটি এসে ঝামেলা শুরু করে দিল। জেমি কিছুটা লজ্জায় কিছুটা রেগে তাকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। আমি ছাত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম, “এই পিচ্চি তোমার কে হয়”? “আমার নিস, বোনের মেয়ে” ইলমার উত্তর। আমার আউলা মাথায় যেন কারেন্টের শক খেলাম। যাহোক, সেই জেমির কাহিনী সিনেমার কাহিনীর মত। অল্প বয়সে এফেয়ার করে বিয়ে করেছে যাকে সে জনকের চিহ্ন রেখে দেশান্তরি হয়ে গেছে সেই কবে। প্রথমে মালয়েশিয়া, তারপর কম্বোডিয়া। এরপর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। জেমিকে আমার খুব পছন্দ। পছন্দ করার মতই। চেহারায়, স্মার্টনেসে, কথাবার্তায়, চোখের নড়াচড়ায়, হাসিতে, রাগে, অনুরাগে, অভিমান-অপমানে সবকিছুতেই অপূর্বা। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলাম এভাবে। আর যায় কোথায়? সেই থেকে জেমি অনন্যা হয়ে দেখা দেয়। কোন দিন দেখা না হলে দিনটাই মাটি বলে মনে হয়। জেমিও ছাত্রীর গার্ডিয়ান হিসেবে আরো সক্রিয় হয়।
    আমার অন্য ছাত্রী শৈলী। সে ভাবে সপ্তমী। কিন্তু তার মা রাগে অগ্নি। সারাক্ষণ পায়চারি করেন। আর ছুতানাতা করে দেখে যান আমাদের বিদ্যা শিক্ষার শব্দমাত্রা কাংখিত মাত্রার চেয়ে নিম্নগামী কিনা। আলাপের ফ্লাইট বই, খাতার বাইরে চোখে চোখে পরিভ্রমণরত কিনা? অসহ্য ঠেকে। তবে যে কোন মেয়ের মা’র এই উদ্বেগ থাকাটা অতি স্বাভাবিক, তাও উপলব্ধি করি। আবার মজাও পাই এই ভেবে যে, তাঁকে নিত্যদিন ঘন্টাখানেকের জন্য হলেও প্যারা দিতে পারছি। শৈলী ছাত্রী হিসেবে ভাল। রেজাল্টও। তবে খুব চঞ্চল আর দুষ্টু টাইপের। বয়সটাই তো এরকম। মাঝে মধ্যে আমার সাথে সিলেবাস বহির্ভুত ফ্ল্যাগ মিটিং করতে চায়। আমি সাবধানী। কায়দা করে ফোকাস ফিরিয়ে আনি পড়ালেখায়।


    প্রতিদিনের মত আজো আম্মার চিৎকার চেচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মুখের উপর তিন খন্ড কাগজ আর টাকা ছুঁড়ে মেরে বললো, “আজ লাস্ট ডেট। বিল গুলো দিয়ে আসবি”। চেয়ে দেখি গ্যাস আর কারেন্টের বিল। সাথে সিটি কর্পোরেশনের হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধের তাগিদ পত্র। এই ধরণের কাজ আমার একেবারেই নাপছন্দ। ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে পিপীলিকার মত হাটি হাটি পা পা করে বিল দেওয়ার মত প্রাগৈতিহাসিক পদ্ধতি আমাদের দেশেই বোধহয় পপুলার। অন লাইনে দিতে চাইলেও আম্মার চিল্লাচিল্লিতে চুপ হয়ে যাই।


    আম্মা গরম গরম পরোটা এনে দিচ্ছে। ডিম মামলেট আর গরুর ভুনা আমার খুব পছন্দের। খেতে খেতে রাগাবার জন্য বললাম, “ব্যাংকের সাথে কথা পাক্কা হয়ে গেছে। দশ লাখ লোন নেবো”।
    আম্মা চক্ষুচড়ক গাছ করে বললো, “তোকে কোন ব্যাংক লোন দেবে”?
    — দেবে, দেবে। বাড়ী বন্ধক রাখবো
    — বাড়ী কি তোর নামে?
    — তোমার নামে। তাতে কি? তোমার নামেই নেবো
    — এতই সোজা?
    — বিজনেস করবো। দশ লাখ হলেই চলবে। ভাবছি ব্যবসা স্টার্ট করেই বিয়ে করে ফেলবো
    — তোকে মেয়ে দেবে কে?
    — মেয়ে তো স্ট্যান্ডবাই।
    — তাই নাকি? তা কি করে সেই মেয়ে?
    — কিছু না। একটা ছোট্ট কিউটি আছে তার।
    — কি? এই বলে আম্মা চুলো নিভিয়ে বেডরুমের দরোজা লক করে দিলো। আজ আর চা মিলবেনা বুঝলাম।

    চলবে…

  • পরিণতি

    পরিণতি

    ঝামেলা করো না। তোমার অর্ধ নগ্ন অর্ধশত ছবি আছে আমার কাছে।সেগুলো কিন্তু ফেসবুকে পোস্ট করে তোমার এই সতি সাবিত্রী হয়ে নাটক করা চেহারাটা সবার সামনে বের করে দিবো। গলাই দড়ি দেওয়া ছাড়া পথ পাবেনা। দুপুর পর কলেজ রোডে দেখা করবে।

    ফোনের ওপাশ থেকে আসা কথাগুলো জুলির কাছে বজ্রপাতের মতো লাগলো। ছেলেটাকে ভালোবেসে নিজের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছিল তার মুখ থেকে আজ এগুলো শুনতে হবে ও ভাবতেও পারেনি। ছেলেটা আহামরি সুদর্শন ছিল না বরং প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত চিকুন আর বখাটে টাইপ ছিল তবুও কেনো জানি তার উপরেই মায়া জন্মেছিল জুলির। কয়েকবার মানা করার পরেও ছেলেটার পাগলামির কাছে হার মেনে নিয়েছিল। ভেবেছিল পরবর্তীকালে নিজের ভালোবাসা দিয়ে এই বখাটে ছেলেটাকে ঠিক শুধরে নিবে। কিন্তু এমন কিছুই হয়নি বরং নিজেই পরিবর্তন হয়ে গেছে। ছেলেটা প্রথম প্রথম ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসতো খেয়াল রাখতো আর সেই সঙ্গে চলতো তার আবদার। জুলি ছেলেটার আবদার পূরণ করতে নিত্য নতুন ছবি তুলে পাঠিয়েছে এখন সেগুলোই ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রচণ্ড টেনশন হচ্ছে ওর যদি এমন কিছু করে তাহলে ও সমাজে মুখ দেখাবে কিভাবে? ওকি সত্যিই এমন করবে নাকি হুমকি দিচ্ছে?। না হুমকি দিচ্ছে না গতকাল ও কয়েকটি ছবি আপলোড দিয়েছিল যদিও সেগুলো খারাপ ছিল না ওগুলো নাকি নমুনা ছিল এবার হয়তো সত্যিই দিবে। কথাগুলো ভেবে জুলির কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো। ওপাশ থেকে আবারও ধমক আসলো,

    > বোবা হয়ে গেছিস কথা বলছিস না কেনো? আমার কথার বাইরে চললে তোর খবর আছে। আর শোন তোর ফেসবুক পাসওয়ার্ড আমি চেঞ্জ করে নিয়েছি তাই নিজের মতো আরেকটা খুলে নিবি।
    > তুমি এভাবে কথা বলছো কেনো?আর পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেছো কেনো জাবেদ? আমি তো তোমার কথার বাইরে কখনও কিছুই করিনি তাহলে এসবের মানে কি?
    > নাটক করবি না আমি জানি সব। তুই নিয়মিত পড়তে যাচ্ছিস ওখানে নিশ্চয়ই কিছু ঘটাচ্ছিস। আমি ওসব কিছুই হতে দিবো না বুঝলি?
    > এগুলোর মানে কি? আব্বু পড়তে পাঠাচ্ছেন ,টাকা দিচ্ছেন তাহলে সমস্যা কোথায় তোমার? যদি অসুবিধা হয় তাহলে বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাও আমি তোমার বাড়িতে গিয়ে তোমার মতো চলবো।
    > তুই ভালো করে জানিস আমার সঙ্গে বিয়েতে তোর বাবা রাজি হবে না তবুও তুই এসব বলছিস? ফোন রাখ।

    জাবেদ ফোনটা কেটে দিলো। জুলি কয়েকবার ফোন দিয়েও রিসিভ হলো না। ও হতাশ হয়ে বিছানার বসে পড়লো। খুব কষ্ট হচ্ছে, চিৎকার করে কান্না পাচ্ছে। খুব বড়সড় একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছে এর থেকে উদ্ধার কিভাবে হবে আল্লাহ্ জানেন। জুলি কাধের ওড়নাটা নিয়ে উপরের দিকে তাকালো। তারপর কিছু একটা ভেবে ওড়নায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।ওর সঙ্গে বেশ অনেকদিন পরে দেখা হচ্ছে। জাবেদ গরুর মাংস আর খিচুরি খেতে পছন্দ করে তাই আজ ওর জন্য ও পছন্দ মতো রান্না করবে। ভাবনা অনুযায়ী জুলি রান্না গুলো করে টেবিলে সাজিয়ে দিয়ে লুকিয়ে কিছু খাবার টিফিন বাটিতে সাজিয়ে নিলো। তারপর রুমে গিয়ে পরিপাটি হয়ে বন্ধুর বাড়িতে যাবার নাম করে বাইরে বের হলো। শীতের দুপুরটা বেশিক্ষণ স্থায়ি হয়না। শীত শীত করছে। জুলি বাড়ি থেকে বেরিয়ে কলেজ রোডে গিয়ে দাড়ালো। জাবেদ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জুলিকে দেখে ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। মেয়েটাকে ভয় দেখাতে ওর বড্ড সুখ অনুভব হয়। মেয়েদের কিভাবে হাতের মুঠোয় নেওয়া যায় ও খুব ভালো করে জানে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জুলি ওর বাইকের পেছনে গিয়ে বসলো। জাবেদ গাড়ি ছেড়ে শহরের দক্ষিণ দিকে এগিয়ে গেলো। সেখানে নদীর পাড়ে নির্জন একটা জায়গা আছে ওখানে বসবে। সমস্ত রাস্তায় জাবেদ একা একাই বকবক করলো কিন্তু জুলি চুপচাপ। ঘন্টা খানিকের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেলো। জুলি গাড়ি থেকে নামতেই জাবেদ ওকে নিয়ে নদীর কাছে বটগাছের পেছনে গিয়ে বসলো। এসব ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে বসতে জুলির একদম পছন্দ হয়না কিন্তু ও বলতে পারবে না। জাবেদ পছন্দ করেনা। ওরা দুজনে বসতেই জুলি ব‍্যাগ থেকে খাবারগুলো ওর সামনে নিয়ে ধরলো। ছেলেটা খাবার পেয়ে অপেক্ষা করলো না তাড়াতাড়ি খেতে শুরু করলো। জুলিকে বলেছিল খেতে কিন্তু ও রাজি হলো না বাসা থেকে খেয়েই এসেছে তাই আর ওকে জোর না করে জাবেন খাওয়া শেষ করলো। কিন্তু সমস্যা হলো জুলি পানির বোতল গাড়িতে রেখে আসছে। জুলি ওকে বলল,

    > তুমি এখানে বসো আমি টিফিন বাটিগুলো রেখে পানির বোতল নিয়ে আসছি। এগুলো বাড়িতে নিয়ে পরিস্কার করবো।
    > আচ্ছা দ্রুত আসবা কিন্তু।

    জুলি মাথা নাড়িয়ে দ্রুত উঠে আসলো গাড়ির কাছে। তারপর পানির বোতল নিয়ে গাড়ির সিটটা ওড়না দিয়ে ভালো করে মুছে পেছনের দিকে হাটা ধরলো। ওর আর পেছনের দিকে তাকালোনা। জুলি বাড়িতে এসে চুপচাপ ঘরে দরজা আটকে বসে থাকলো। টেবিলের উপরে ফোনটা নিশ্চুপ হয়ে আছে একটাও ফোন আসছেনা। জাবেদ ওকে ঘন্টায় দশবার ফোন করে কিন্তু আজ করছে না। কথাগুলো ভেবে ওর আরও কেমন টেনশন হচ্ছে। পরদিন বিকালে জুলি টিভি অন করতেই নিউজ আসলো,

    ” ব্রকিং নিউজ, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে জাবেদ নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার। যুবকের গায়ে কোনো আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী ছেলেটা বিষপানে আত্মহত্যা করেছে”।

    জুলি তাড়াতাড়ি টিবি বন্ধ করে আবারও নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করলো। টেবিলের উপরে থাকা ফোনটা অনবরত বাজতেই আছে। জুলির ওড়নাটা বারবার কাধ থেকে পড়ে যাচ্ছে। হয়তো আগামীকাল আরও একটা নিউজ প্রকাশ হবে, “প্রেমিকার দেওয়া খাবার খেয়ে প্রেমিকের মৃত্যু,খরবটা ছড়িয়ে পড়াই প্রেমিকার আত্মহত্যা”

    কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-২৯)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-২৯)

    দুই রুমের একটা ছোট্ট বাসা, এক রুম সামান্য বড়, আরেক রুম একদম ছোট, শুধু মাত্র একটা সিংগেল খাট, আর একটা পড়ার টেবিল জায়গা হবে কষ্ট করে।এই রুমের সাথেই ছোট্ট একটি বাথরুম। আর রান্নাঘরে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে রান্না করতে পারবে, কোন মতে।

    তিন তলা বাড়ীটির, ছাদের সাথে এই দুটি রুম ভাড়া নিয়েছে নাহিদ। সে বাড়ীওয়ালাকে এক মাসের এডভান্স তিন হাজার টাকা দিয়ে দিল। যদিও উপরে টিনশেড এবং ছাদের সাথে রুম গুলি, গরম বেশি লাগবে, তারপর ও খারাপ না! তাদের জন্য খুব ভালো করে হয়ে যাবে, এই বাড়ীটি।

    রহমত সাহেব বললেন, বাবা জি, দয়াকরে পরিবারের নাম করে, ব্যাচেলর থাকবেনা। আর, মাসের পাঁচ তারিখের মধ্যে ভাড়া দিয়ে দিবে। তোমার ভাই সরকারি চাকরি করে, শিক্ষক মানুষ, তাই বাড়ী টি দিলাম।
    – চিন্তা করবেন না, চাচা। আগামী সপ্তাহে আমার মাকে নিয়ে আসবো।
    – আচ্ছা। এই নাও, চাবি। নতুন তালা এনে, আমার তালা-চাবি ফেরত দিয়ে যাবে।
    – জি।

    নাহিদ বাড়ী থেকে এসে শুধু তিন দিন বাসা খুঁজেছে, তার বাজেটে বাসা পাওয়া এই শহরে দারুন কষ্টের। যদিও মা এখনো রাজী না। তবুও কিচ্ছু করার নাই, এভাবে একা রাখা তো যায়না।

    শাহিদ, আর নাহিদ তাদের মেস থেকে সিংগেল খাট, তাদের পড়ার টেবিল, ফ্যান সব নিয়ে এসেছে।

    শাহিদ কড়াই আর ভাতের পাতিল কিনে এনেছে। সেগুলো দিয়ে রান্না বসিয়েছে। ডিম ভাজি, আর ভাত। শাহিদ গুন গুন করে, গান গাইছে, আর রান্না করছে।

    নাহিদ ফ্লোরের মধ্যে শুয়ে আছে, ফ্যান ছেড়ে। দারুন এক ধরনের শান্তি লাগছে। মা কাছে থাকবেন, এরচেয়ে শান্তি আর কি হতে পারে!

    পলির মন খুবই খারাপ, আবিদ তিন দিন হয়েছে কর্মস্থলে চলে গিয়েছে। কেমন যে, খারাপ লাগছে বোঝানো যাবেনা। নতুন বিবাহ দম্পতি বিয়ের পর পর হঠাৎ আলাদা হলে, কলিজা কত টুকরো হয় শুধু তারাই জানে।

    বিয়ের আজ আঠারো দিন, কিন্তু একবারের জন্য কেউ এই বাসায় তাকে দেখতে আসে নি। ভাইজান কেন এতো নিষ্টুর! রিতা আন্টি দুদিন ফোন দিয়ে খোঁজ নিয়েছেন। তিনি ও অনেক ব্যস্ত, তাই আসার হয়তো সময় হয়নি।

    এতো এতো মানুষ এই বাসায়, কিন্তু কেন যেন প্রচন্ড একা লাগে পলির। সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত, কথা বলার সময় নেই। পলি নিজের রুমের জানালার দিকে তাকিয়ে আছে, যেন এই শহরে তার কেউ নেই। প্রচন্ড কষ্টে ভেতর কুঁকড়ে যাচ্ছে।

    বউমা, কি কর?
    – জি আম্মা?
    – মন খারাপ?
    – না।
    – তোমার শ্বশুর আমার চাচাতো ভাই ছিল আমার, কত দুষ্টুমি করে বড় হয়েছি। কিন্তু বিয়ের পর, যখন চলে গিয়েছিল কলেজে। হায়, চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হয়েছে, হায় হায়! এই আলম ভাইয়ের জন্য আমার বুক এমন খালি খালি লাগছে কেন! আগে তো এমন খালি লাগে নাই। এর টানের নামই স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক। কেউ চিনেনা-জানেনা, তবুও অল্প দিনেই কেমন মায়া হয়, এটা আল্লাহ দুইজনের মনে সৃষ্টি করে দেন বউ। মন খারাপ করবেনা।
    – না, আম্মা।
    – বউ, আমি ও বউ ছিলাম, বুঝি সবই। যাই হউক, তোমার ছোট ননদকে পড়ানোর দায়িত্ব তুমি নাও, সে প্রচন্ড ফাঁকিবাজ।
    – আম্মা, আমি আজ থেকে রান্না করি?
    – না। সারাজীবনই চুলার সামনে থাকতে হবে, এখন না। আরও সময় যাক। বউ?
    – জি আম্মা?
    – মাস্টার্স করবা?
    – জি আম্মা, ইচ্ছা আছে।
    – আচ্ছা, দেখি, তোমার শ্বশুর কি বলেন।
    – জি।

    পলির শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে, কিছু সময়ের জন্য মন ভালো হয়েছে। তিনি মানুষ ভালো, কিন্তু এই এতোগুলি ছেলে মেয়ের দায়িত্ব করতে করতে তিনি কথা বলারই সময় খুঁজে পান না। সত্যি আবিদের জন্য তার ভেতর পুড়ছে। কি মায়ায় ফেলেছে তাকে!
    মাস্টার্স পড়তে পারবে, ইশ! কি যে ভালো হবে। শ্বশুর কি রাজী হবেন? কি জানি!

    জাহিদ আজ লাইব্রেরির সব কিছু নিতে এসেছে, নতুন স্কুলের পাশেই দোকান ভাড়া করেছে সে। নাহিদ ও বাড়ীতে আছে, সে ভাইকে সাহায্য করতে এসেছে। ভোর বেলা, এসে বাড়ীতে পৌছেছে দুই ভাই।

    বাড়ীতে আসতে সময় এক জোড়া ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে জাহিদ।

    রাহেলা বেগম বললেন, বাবা একটা মাছ জলির বাড়ীতে নিয়ে যাও। তার ইলিশ মাছ খুব পছন্দ।
    – মা, আগামী সপ্তাহে আসলে নিয়ে যাবো। আজ সময় হবেনা।
    – আচ্ছা। আগামী সপ্তাহে নিয়ে যেও। মা হওয়ার অনেক জ্বালা! মেয়েটা ইলিশ পছন্দ করে, রান্না হবে বাড়ীতে অথচ সে খাবেনা, ভাবতেই খারাপ লাগে। মা হয়ে কি গলা দিয়ে নামবে। আগামী সপ্তাহে নিয়ে এসো।
    – অবশ্যই মা, নিয়ে যাবো। চিন্তা করবে না।

    নাহিদ পুকুর পাড়ে এসে বললো, মেজ ভাই আমি একটা কাজ করে ফেলেছি।
    – কি?
    – বাসা ভাড়া নিয়েছি।
    – কি বলিস?
    – হ্যা, অনেক খুঁজে মুগদার দিকে বাসা পেয়েছি। এদিকে বাসা, কিছু সস্তা।
    – বলিস কি,?
    – হ্যা, আমি মা আর কলিপা কে নিতে এসেছি।
    – ঢাকা শহরে একটি ফ্যামিলি চালিয়ে নেওয়া কি কষ্ট তুই জানিস?
    – চেষ্টা করলে, পারবো।
    – যা, ভাড়া নিয়ে নিয়েছিস যখন ভালোই করেছিস। আনিও বেতন পেয়ে টাকা নিয়ে যাবো। ডাল-ভাত খেয়ে থাকা যাবে কষ্ট করে।
    – এখন তুমি, মাকে রাজী করাতে হবে।
    – দেখি, আগামী সপ্তাহে আসি, দেখা যাক।
    – না, আগামী সপ্তাহে না। তুমি আজই রাজী করাও, আমি দুই/ তিন দিনের মধ্যে মাকে নিয়ে ঢাকায় যাবো।
    – তোর কি মাথা খারাপ? মা কি এতো সহজে রাজী হবে? আর আজ সময় একদম অল্প। আগামী সপ্তাহে আসি, সময় নিয়ে মা কে বুঝিয়ে রাজী করাতে হবে।
    – আমার আগামী সপ্তাহে আসা, ঝামেলা হয়ে যাবে। তুমি আজই রাজী করাও, প্লিজ।
    – আচ্ছা এক কাজ কর, বাজারে যা। এক জোড়া ইলিশ কিনবি, আর দুই কেজি মিষ্টি, কিনে জলির বাড়ী দিয়ে আসবি।
    – কেন? আজ কেন? সময় কম এখন।
    – শোন, মা জলিকে খাওয়াতে চেয়েছেন। তাছাড়া ঢাকা যাওয়া ঠিক ঠাক হলে, আগামী সপ্তাহে বাড়ী না এসে ঢাকা যাবো। জলির বাড়ী যাবো কেমনে! তাছাড়া এই মাছ দিলে মায়ের রাজী হওয়ার জন্য এক পয়েন্ট বেশি পাওয়া যাবে। কারণ মা খুশি হবেন।
    – আচ্ছা আমি যাচ্ছি।

    কলি পুকুর পাড়ে চাল ধুইতে এসেছে। কলি বললো মেজ ভাই এখানে কি করছো?
    – না, কিছু না। ট্রাক রেডি, খেয়ে রওনা হবো।
    – মাকে রাজী করিয়ে আমাকে হলে দিয়ে দাও, পড়াশোনা টা শেষ করি।
    – দেখা যাক, কি করি।
    – দেখো, আর রাজী করাও প্লিজ।
    ,- হুম।

    জাহিদ পুকুর পাড় থেকে দেখছে মা মনোযোগ দিয়ে মাছ কাটছেন। কলির গ্রাম একদম ভালো লাগেনা, এবং পড়াশোনার তীব্র ইচ্ছা, তাই সে চলে যেতে চায়। জাহিদ ভাবছে নাহিদ কত বড় হয়েছে, সাহস করে অনেক বড় কাজ করে ফেলেছে। ভালো করেছে, মা, ঢাকায় গেলে কলির ও পড়াশোনা হবে, নাহিদ-শাহিদ ও মায়ের সাথে থাকবে, তার ও চিন্তা কম হবে।

    কিন্তু মাকে রাজী করানো, সহজ বিষয় নয়, তিনি অত্যন্ত কঠিন হৃদয়ের মানুষ! স্বামীর ভিটা ছেড়ে, ইট পাথরের শহরে যেতে সহজে রাজী হওয়ার পাত্রী তিনি নন। কিন্তু, কিভাবে কথা শুরু করলে, তিনি রাজী হবেন, তাই নিয়ে এখন ভাবছে জাহিদ…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ২১.০১.২০২২

  • আমি ভোরের পাখি

    সারাদিনের মধ্যে সকাল বেলাটা আমার অতিপ্রিয় একটা সময়। সেই ছোট্ট বেলা থেকে আমি যতরাত করেই ঘুমুতে যাইনা কেন,সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠা আমার অভ্যাস।

    ভোর হবে সূর্য মামা গাছের আড়াল থেকে ঝিলিক দিয়ে উঁকি দিবে এই দৃশ্য দেখা আমার অতি প্রিয় একটা বিষয়! আর উঠোনের উপরেই ডালিম গাছে টুনটুনি,আর বুলবুলি পাখির কিচিরমিচির করে লাফিয়ে বেড়ানো দেখা এক আনন্দদায়ক ব্যাপার।কখনো তা মিস করতে চাইতাম না।

    অনেক ছোটো বেলায় আমরা যখন মেহেরপুরে ছিলাম তখন সবার আগে ঘুম থেকে উঠে দরজা খুলতে পারতাম না বলে একটা জানালার শিক ঘুরিয়ে বের হয়ে আসতাম। ওটা ঢিলা ছিল।আমরা ছোটো তিনভাইবোন ই ইউজ করতাম। বড়ো রা যখন তালা দিয়ে রেখে বাইরে যেতেন।আমরা নিজেরাই ঐপথ আবিষ্কার করেছিলাম!

    বাড়িতে দুটো উঠোন ছিল।একটা ভিতর বাড়িতে অন্যটা বাহির বাড়িতে। তো আমার কাজ ছিল পৈঠার উপর রাখা ওজুর জন্য কাঁসার বদনা টায় পানি ভরে কেঁচোয় উঠানো মাটি দেখে দেখে সেই গর্তে পানি ঢালা।সে এক মজার খেলা।এখন কার শহুরে বাচ্চারা জানবেও না।গর্তে পানি ঢালতে থাকলে এক সময় ভেতরে লুকিয়ে থাকা ঘুগরো পোকা বেরিয়ে আসতো।তখন একটু ভয় পেয়ে লাফ দিয়ে সরে যেতাম।

    তারপর হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসতাম।উচ্চঃস্বরে পড়তাম যাতে সবার ঘুম ভেংগে যায়।তখন বড়ো রা এক এক করে উঠে পড়তো।একবার বারান্দায় পাটি পেড়ে অ -তে ঐ অজগর আসছে তেড়ে এইভাবে পড়ছি!

    তখন দেখি একটা সাগর কলা এসে আমার গায়ে পড়লো। আমি ভয় পেয়ে এদিক ওদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে ট -তে টুনি পাখির বাসায় ডিম, ঠ -তে ঠান্ডা পানি বেজায় হিম পর্যন্ত পড়তেই আরেক টা কলা তারপর একপিস পাওরুটি এসে গায়ে পড়লো! আমি মোটেও ভয় পেলাম না। বুঝে গেলাম কার কাজ!চিৎকার দিয়ে মাকে ডেকে উঠলাম মা ওমা মিয়া এসেছে ওঠ দেখে যাও।উনি আর মামা চট্টগ্রাম থেকে যাবার সময় এই গুলি আর আনারস নিয়ে যেতেন।আমার ডাক শুনে সবাই হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে আসলে মিয়া ভাই ও দেয়ালের আড়াল থেকে হাসিমুখে বেরিয়ে আসলেন। বল্লেন কিরে, তোর ভয় করে না?

    আমিও মাথা ঝাকিয়ে বললাম না।

    আজকের সকাল টাও ঠিক যেন সেরকম একটা সকাল। স্মৃতিতে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।

    সময় টা ২০০০ এর আগস্টের শেষ সপ্তাহ। ২৮শে আগস্ট আমি এডমিট হলাম চট্টগ্রাম হলিক্রিসেন্ট হসপিটালে। পরেরদিন দুপুরে অপারেশন এর মাধ্যমে ছোটু জন্ম নিল।ডাঃ তাহের খানের তত্বাবধানে। কয়েক দিন ওখানে ছিলাম। এক সপ্তাহ।

    আমার কেবিন টা ছিল পিছনে। সর্দার নগর ঝাউতলা দেখা যেত।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আসার ট্রেন এদিক দিয়ে আসা যাওয়া করতো।রেললাইন ঘেসে একটা কাচা রাস্তা। সেই রাস্তার পাশে খেজুরগাছ ছিল।যেন গ্রাম্য মেঠো পথ।রাতে আমার বড়ো ভাবি থাকতেন।যদিও সার্বক্ষণিক আয়া ছিলো, তবুও তিনি রাতে প্রচন্ড বৃস্টির মধ্যে কোনো রকম যানবাহন না পেয়ে প্রায় দিন ই হেঁটে হেঁটে আসতেন।এখন ভাবলে ও কস্ট হয়।

    বাচ্চাদের রেখে আসতেন। (যদিও তারা মোটামুটি বড়োই হয়ে গিয়েছিল)। তাই ভোর হতে না হতেই নামাজ শেষে বেরিয়ে যেতেন। উনি হেটেই যেতেন। উনাকে যতক্ষন দেখা যেত ততক্ষণ আমি চেয়ে থাকতাম। আর আমার বন্দী মন ছুঁটে যেত ঐপথে।শুধু মনে হত আহা! এই ভোরবেলায় আমিও যদি এই পথটা ধরে হেঁটে যেতে পারতাম!
    আজকাল আবারও এমন হয়। কিন্তু শারীরিক সমস্যার কারণে ভোরে হাঁটা হয়না। আর অট্টালিকায় ভরা এই শহুরে ভোরে আলাদা কোনো রোমাঞ্চনেই। কখন রাত কখন দিন সবসময় কোলাহল লেগেই থাকে। গাড়ির শব্দে দিনরাতের পার্থক্য খুঁজে পাওয়াই দায়।

    এখানে নিরবতা নির্বাসনে গেছে!
    এখানে আঁধার কে হটিয়ে দেয়া হয়েছে
    স্ট্রিট লাইট আর নিরাপত্তা লাইটের
    অথবা গায়েহলুদ, বিয়ে বাড়ি,বিশেষ দিনের
    আলোক সজ্জায় নকল আলোর টুনিবাতি জ্বেলে!
    এখানে ভোর হয় আজও প্রকৃতিতে,
    সময় হয়না তা দেখার রাতজাগা মানুষগুলোর
    সাধ করা ঘুমের ঘোরে।

    ফাতেমা_হোসেন
    ১৯/১/২২.
    সকাল সাড়ে আটটা।