Tag: গল্প

  • স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার

    স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার

    আজকে আমি আমার স্বপ্নের আইফেল টাওয়ারের গল্প করবো। কয়েক বছর পিছন থেকে বলতে হবে।

    ২০১৩। ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে, দেশে যাওয়ার আয়োজন চলছে। যেহেতু ৩ পোলাপান এখনো ছোট বড় মেয়ে রুহি(১১) ছোট মেয়ে হাসরাত (৭) ছেলে মাহদী(৬), দের মাস তো থাকবোই থাকবো, এরকম একটা হিসেব করছি।
    হঠাৎ আমার উনি প্রস্তাব দিলেন, যদি দুই সপ্তাহ কম থাকি, তাহলে ফেরার পথে প্যারিস ঘুরতে নিয়ে যাবে। প্রথমে রাজী হইনি, পরে বড় মেয়ের প্যানপ্যানানিতে রাজি হয়ে গেলাম।

    দেশে গেলাম। হেব্বি মজা করে বিয়ে খেলাম। দুই সপ্তাহ চলে গেলো চোখের পলকে। আর দুই সপ্তাহ বাকি। এর মধ্যে আমার উনি চলে এলেন ক্যানাডার উদ্দেশে, আর কথা রইলো আমরা দু সপ্তাহ পর সবাই প্যারিস এয়ারপোর্ট এ দেখা করবো। কথা মত সেরকমই হলো।

    আল্লাহর নামে রওনা হলাম প্যারিসের উদ্দেশে। প্লেন উড়া শুরু করতেই মাহদী কান্না শুরু করলো ভ্যা ভ্যা করে। আর ছোট মেয়ে হাসরাত নিজের কানে নিজেই থাপর মারা শুরু করলো, কারণ কান বন্ধ হয়ে গেছে। আসে পাশের লোকজন গুলো মনে হচ্ছিল চিড়িয়াখানা থেকে ছুটে আসা বান্দরের খেলা দেখছিল। বাচ্চাদের বলছি চুপ করতে, কিন্তু কথা শুনছে না। কি যে একটা অবস্থা। মনে মনে ধৈর্য ধরলাম। ধৈর্যের ফল নাকি মিঠা হয়!

    চোখের সামনে ভেসে উঠলো আইফেল টাওয়ার! আহা… ভুলে গেলাম সব যন্ত্রণা। কুয়েতে ট্রানজিট ছিল এক রাত। কোনরকম হোটেলে রাত কাটিয়ে সকালে আবার আনডা বাচ্চা নিয়ে রওনা হলাম প্যারিসের উদ্দেশ্য। সেই আবারও একই কাহিনী। কান্না শুরু পোলাপানের। মনে হচ্ছিল বাসায় থাকলে সবগুলোকে মুখে কাপড় ঠুসে বেধে রাখতাম।

    কিছুই করার নেই। মানুষের সামনে কি আর মাইর দেয়া যায়! কিন্তু লুকিয়ে লুকিয়ে চিমটি দিলাম কয়েকটা, আর কানে কানে বললাম “একদম প্লেন এর জানালা দিয়ে ফেলে দিবো”। কান্নার শব্দ না কমে বেড়ে গেলো আরো।

    আবারো নিজেকে শান্তনা “সবুরে মাওয়া ফলে” (আম্মা বলতো)

    অবশেষে পা রাখলাম স্বপ্নের শহরে! রাস্তায় যেতে যেতে ঠিক হলো হোটেলে গিয়ে রেস্ট নিয়ে বিকেলে ঘুরতে বের হবো। হোটেলে পৌঁছানোর পর দেখি মাহদীর গায়ে প্রচুর জ্বর। Plan changed, বিকেলে বের হলাম না। ভাবলাম জ্বর কমলে পরের দিন বের হবো।

    ঘুমিয়ে পড়লাম রাতে খাওয়া দাওয়ার পর। স্বপ্ন দেখলাম আইফেল টাওয়ার… Wow… কত সুন্দর! আমি উপরে উঠছি.. উঠছি.. উঠছি… হঠাৎ করে এত্ত উচু থেকে পরে গেলাম। ধরফর করে উঠে গেলাম ঘুম থেকে বুকে থুতু দিয়ে বললাম “যাক বাঁচলাম,স্বপ্ন ছিল”! আর মাত্র কয়েক ঘন্টা পর সকাল হবে, তার পর দেখবো… ভাবতে ভাবতে চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।

    সকালে নাস্তার পর থেকে ছোট মেয়ের বমি শুরু হলো। হয়তো কিছু উল্টা পাল্টা খাওয়াতে এমন হচ্ছে। এখন দুজনের শরীর খারাপ। প্ল্যান আবার চেঞ্জ। আজকের মধ্যে সুস্থ না হলে আগামী কাল চলে যাবো ক্যানাডা। মুটা মুটি সব গুছিয়ে রেডি থাকলাম পরের দিন রওনা হবো। ঘুমিয়ে পড়লাম।

    আবার স্বপ্ন দেখলাম, আমি আইফেল টাওয়ারের সামনে দাড়ানো…কি সুন্দর… কত উচু! হঠাৎ করে ভেঙে পড়তে লাগলো টুকরো টুকরো হয়ে, আর সেই কারণে ভূমিকম্পের মত পুরোটা শরীর কেপে উঠলো! লাফ দিয়ে উঠে পড়লাম, জেগে দেখি জ্বরের কারণে ছেলে হাইপার হয়ে বিছানায় লাফাচ্ছে। সকালে উঠে চাট্টি বাটটি গোল করে রওনা হলাম নিজের গন্তব্যে।

    এই ছিল আমার স্বপ্নের আইফেল টাওয়ার পরিদর্শন!

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৪)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৪)

    শফিউল আলম সাহেব খাওয়ার টেবিলে বসেছেন, ডাল ভাত ভর্তা ভালো করে একসাথে মেখে, খাচ্ছেন। পলি পাশে বসে আছে।

    বউমা!
    – জি।
    – নিয়াজ কে বলেছি, তোমাকে চট্টগ্রাম দিয়ে আসতে। নিয়াজের এখন ভার্সিটিতে ক্লাস নাই। কয়েকদিন থেকে আসো। পরে, তোমার মাস্টার্সের ক্লাস আরম্ভ হয়ে গেলে, আর যেতে পারবেনা।
    – ও তো মেসে থাকে।
    – সে ব্যবস্থা করে নিবে। তুমি কাল নিয়াজ কে নিয়ে রওনা হও। ওর স্কুলে চলে গেলে, ওকে পেয়ে যাবে। আমি স্কুলের ল্যান্ড লাইনে আজ কলেজে গিয়ে কল দিব। বাসার ফোন টা কেন যে এতো ডিস্টার্ব করে! লাইন ঠিক করলেও বার বার নষ্ট হয়, নয়তো বাসা থেকেই কল দিতাম।
    – আব্বা কালই যাবো?
    – হ্যা কালই যাও। কিছু বাজার সদাই সাথে নিয়ে যাও।
    – জি আব্বা।

    পলি শ্বশুরের সাথে আর কিছুই কথা হয়নি, তিনি মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছেন। আর কথা না বললেও পলির মনের ভিতরে বেশ খুশি লাগছে। শ্বশুরের খাওয়ার পরে, পলি প্লেট হাতে রান্নাঘরের বেসিনে প্লেট রাখলো।

    শ্বাশুড়ি মুচকি হেসে বললেন কি গো এখন খুশি?

    পলির বেশ লজ্জা লাগছে। সত্যি সে ভীষণ খুশি।

    গতকাল বললাম, আবিদের আব্বাকে তোমাকে পাঠাতে। মাস খানেক থেকে আসবে। মন ভালো করে এসে পড়তে বসো। আর আমার ছেলেটা একা একা থাকে, আমার ও মন পুড়ে, কি খায় না খায়। তুমি গেলে একটু যত্ন পাবে। আমি সব কিছু বাজার হালকা দিয়ে দিচ্ছি, সপ্তাহ খানেক খেতে পারবে।
    – লাগবেনা আম্মা।
    – লাগবে, আমার ছেলেটার আর কত টাকা ইনকাম বলো, তুমি যাচ্ছ কত জিনিস কিনতে হবে।
    – আম্মা, আপনিও চলেন।
    – সাত বউ ঘরে এনে, বুড়া বুড়ির ছুটি হবে। আপাতত ছুটি নাই মা। যাও, ব্যাগ গুছিয়ে নাও।
    – জি।

    পলির আনন্দে নাচতে ইচ্ছে করছে, আবিদ আজ ফোন পেয়ে, হয়তো না করেই দিবে, যাওয়র দরকার নাই। সে একটু বেশি পন্ডিত, সারাক্ষণ ভাবে, তার কাছে গেলেই বুঝি মা-বাবা অসন্তোষ হবেন। তার সব প্রেম দেখায়, চিঠির পাতায়! এতো কিছু চিন্তার মাঝেও এটা ভেবে ভালো লাগছে, কাল সে আবিদের কাছে যাচ্ছে….

    বিকেল বেলা, সাঈদ বড় এক ফ্রিজ নিয়ে বাসায় এসে উপস্থিত। রাহেলা বেগম দেখে চমকে গেলেন। কলি দাঁড়িয়ে হা করে দেখছে।

    দুই জন লোক ধরাধরি করে রাখলো। সাঈদ তাদের টাকা দিয়ে বিছানায় বসলেন।

    কলি বললো ভাইজান, এতো বড় ফ্রিজ!
    – হ্যা। এখন একটু আরামে থাকতে পারবি।
    – এটা কি নতুন?
    – ফ্রিজ, নতুন পুরাতন দিয়ে কি করবি?

    রাহেলা বেগম বললেন বাবা কেন এই টাকা নষ্ট করলে? ফ্রিজ দিয়ে আমরা কি করবো?
    – আহা! থাকুক সমস্যা নাই। এটা আমার এক বন্ধুর দোকান থেকে এনেছি। এক বড়লোক বিক্রি করে নতুন ফ্রিজ নিয়েছে। নাহিদ আসলে চালু করবে! এখন এভাবেই থাক। মা, আমি এখন যাই।
    – একটু লেবুর শরবত দেই, অফিস থেকে এসেছিস।
    – না না। এই বাসায় প্রচন্ড গরম। নিচের দিকে বাসা দেখো। এখন আসি। সময় নেই।

    সাঈদ যাওয়ার পর পরই বাড়ীওয়ালা চাচা আসলেন। ফিজ দেখে বললেন, ভাবী সাহেবা আপনার রাজ কপাল দেখি! এতো বড় ফ্রিজ? সেকেন্ড হ্যান্ড লাগছে, দেখে। কিন্তু কত বড় ফ্রিজ!

    আপনাকে আর এই ছাদে মানায় না, দুই তলার ফ্ল্যাট আগামী মাসে খালি হবে, এটায় উঠে পড়ুন। ভাড়া সামান্য বেশি, এই আর কি!
    – ভাই এখানেই হয়ে যায়, বাচ্চাগুলো পড়াশোনা করুক।
    – আপনি এতো বড় অফিসারের মা, আপনাকে এইখানে মানায় না!
    – সময় আসুক ভাই দেখি।

    কলি বললো ব্যাপার কি মা? ভাইজান হঠাৎ ফ্রিজ নিয়ে আসলেন? খুলে দেখবো নাকি?
    – না, নাহিদ আসুক। এতো কথা বলিস কেন? ভালো করলেও তোরা দোষ ধরিস।

    নাহিদের রবিবারে একটু দেরী হয়ে আসতে, তিন টা টিউশনি থাকে সন্ধ্যার পরে। শাহিদ বাসায় এসে বলছে, মা এই আলমারি কখন আনলে?
    – এটা ফ্রিজ। কি বলছিস আলমারি?
    – তাই নাকি? দেখি!
    – হাত দিবি না, নাহিদ আসুক, ও কানেকশন দিবে।
    – কবে কিনলে মা? মেজ ভাই এনেছে নাকি?
    – সাঈদ কিনে দিয়েছে।
    – সত্যি?
    – হ্যা।
    – সত্যি?
    – একবার বলেছি না? আমি কি মিথ্যা বলি। এই যা, মুখ হাত ধুয়ে নে, আর ফ্রিজ ধরবিনা।

    শাহিদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আটটা বাজে, নাহিদের আসতে আসতে এগারো টা হবে। ততক্ষণ এই জিনিস না দেখেই থাকতে হবে, হাত দিল্রি মা চিৎকার করে উঠবেন।

    দশমিনিট পরে, তিন তলার এক মধ্যেবয়েসী মহিলা দরজায় নক করলেন।

    নাহিদ খুলতেই বললেন, বাসায় মহিলা কেউ নেই?
    – জি আছেন। আমি তিন তলায় থাকি, সুহেলের আম্মু।
    – আসুন, ভিতরে আসুন।

    রাহেলা বেগম কে দেখে বললেন আসসালামু আলাইকুম আপা, আমি তিন তলায় থাকি।
    – ওয়ালাইকুম আসসালাম। বসুন আপা।
    – বিকালে দেখলাম, এক ভদ্রলোক ফ্রিজ নিয়ে উপরে উঠছেন। আমরা তো ভেবেছি এখানে ব্যাচেলর থাকে, তাই আসিনি।
    – ওহ। ভালো আছেন?
    – আছি। আপনার ফ্রিজের কালার সুন্দর হয়েছে অনেক।

    ছেলে মেয়ে কয়জন, কে কিসে পড়ে সব খবর নিলেন এই মহিলা। অনেকক্ষণ গল্প করে বললেন, আপা, আমার মামাতো ভাইয়ের ছেলে চকবাজারে ব্যবসা করে, মিরপুরে নিজেদের বাড়ী। ছেলে দেখতে সুন্দর, ডিগ্রি পাশ। আপনার এই মেয়ে কে কি বিয়ে দিবেন?
    – আপা, মেয়ে মাস্টার্স পড়ছে, পড়া শেষ করুক। আর ছেলেদের সাথে আলাপ করি।
    – সমস্যা নাই, জানাবেন। আমাদের ও ফিজ আছে, তবে অনেক ছোট। ভালো হয়েছে, আমার সাহেব বাজার বেশি আনলে আপনাকে এসে ডিস্টার্ব করবো।
    – কোন সমস্যা নাই, আসবেন।
    – আপনার ছেলের রুচি ভালো এই জলপাই রঙ আমার ও খুব পছন্দ। আসি!

    মহিলা যেতেই শাহিদ বললো কিরে কলিপা ফ্রিজ দেখে তোর বিয়ের প্রস্তাব চলে এসেছে। বুঝ, এক ফ্রিজে তোর কদর কত বাড়লো।
    – চুপ থাক। কে বিয়ে করছে চক বাজারেএ ব্যবসায়ী কে!
    – আলাপ তো আসলো, তোকে দেখে নয়, এই ফ্রিজ দেখে।
    – চুপ থাক।

    রাতে নাহিদ এসে একদম থ হয়ে তাকিয়ে দেখছে, ২৯০ লিটারের ফ্রিজ! বাবারে! এতো বড়!
    – তুই এখন কানেকশন দে, আমার তোর অপেক্ষায় আছি।
    – সত্যি কি ভাইজান দিয়েছে?
    – এই কথা কম বলে, কাজ কর।

    নাহিদ ফ্রিজ খুলতেই এমন বিশ্রি একটা গন্ধ নাকে লাগছে, মনে হচ্ছে বিড়াল পচে মরে ছিল! অনেক চেষ্টা করেও কোন ভাবেই ফ্রিজের কানেকশন হয়নি। ফ্রিজ খুললেই সবার বমি চলে আসছে, এমন বাজে গন্ধ!

    নাহিদ রাগে গজগজ করছে, কে বলেছো ফ্রিজের কথা? এই বাসায় কার ফ্রিজ লাগবে?
    – কে বলবে?
    – তবে কেন এই নষ্ট ফ্রিজ বাসায় আসলো? এতো বিশ্রি গন্ধ, নাক মুখ বেঁধেও বমি আসছে।
    – হয়তো বন্ধ ছিল, অনেকদিন। এজন্য!
    – মা, এটা নষ্ট ফ্রিজ। ভাইজানের এক বন্ধুর ফ্রিজ ঠিক করার দোকান আছে, আমি জানি। ভাইজান সেখান থেকে এই শো পিস এনেছে, আমি শিওর।
    – থাক, দেখি সাঈদ কি বলে।
    – এই জিনিস শো পিস হিসাবে রাখতে পার মা। আর কিছুই না!

    রাহেলা বেগমের এখন সত্যি রাগ লাগছে, কি দরকার এই জিনিস কেনার? এখন নষ্ট কি ভালো কে জানে? সত্যি যদি নষ্ট জিনিস সাঈদ আনে, তবে তিনি তাকে এবার ভালো করে বকে দিবেন, এই চিন্তা করলেন। আবার ভাবলেন, হয়তো ফ্রিজ ভালো, কিন্তু নাহিদ ই কানেকশন দিতে পারছে না। তিনি কাল ছেলের অফিসে কল দিয়ে জানাবেন, বাড়ীওয়ালার বাড়ী থেকে এই ভেবে রাখলেন।

    শাহিদ বললো এই নাহিদ ফিজ দেখে, তিন তলার আন্টি কলিপার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এনেছে।
    – এজন্য তো বললাম শো পিস, মানুষ দেখবে আর বলবে আহা! কত হড় ফিজ, ছেলের হ্রদয় না জানি কত বড়!

    পলির রাতে এক ফোটাও ঘুম হচ্ছেনা। কাল সে চট্টগ্রাম যাবে, নিয়াজ চুপচাপ থাকে, খুবই লাজুক ছেলে। তার সাথে এতো লম্বা জার্নি খারাপ হবেনা, শুধু মুখ বন্ধ করে রাখতে হবে এই আর কি! আপাতত আবিদের কাছে ত্রিশ দিন থাকা যাবে, তাই শান্তি। শফিউল আলম সাহেবের আজ ফোন দেওয়ার কথা, ভুলে গিয়েছিলেন, এটা ভালোই হয়েছে, নয়তো আবিদ নিষেধ করতো হয়তো। কাল যখন জানবে, তখন তারা ট্রেনে থাকবে! শুনে কি করবে, আর দেখে কি করবে, তাই ভাবছে পলি! ঘুম একদম আসছেনা…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ০৪.০২.২০২২

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৩)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৩)

    রাহেলা বেগম সকালে উঠে ভাত তরকারী রান্না করে, গোসল করে ছাদে বসে আছেন। ঘড়িতে তখন নয়টার সামন্য বেশি বাজে।

    হাতে একটা মোড়া নিয়ে পলি মায়ের পাশে গিয়ে বসলো। রাহেলা বেগম দেখে বললেন আরাম করে ঘুমাচ্ছিস দেখে ডাকিনি।
    – হ্যা, ঘুম ভালো হয়েছে।
    – রান্নাঘরে সব রেডি করা আছে খেয়ে নে।
    – তুমি খেয়েছো?
    – কলি বিছানা-পত্র গুছিয়ে গোসল করছে, বের হলে খাবো।
    – এতো সকালে? ব্যাপার কি?
    – সাঈদ মালামাল নিয়ে আসছে, নাহিদ সাত টায় ওই বাসায় চলে গিয়েছে। শাহিদ দোকানে গিয়েছে, বারো টার দিকে আসবে। কাজের চাপ বেশি, তাই যেতেই হয়েছে।
    – মা,
    – কি?
    – এখানে অনেক আরামে আছ, থাকো। কষ্ট পাবে কেন শুধু শুধু ভাইজানের বাসার কথা চিন্তা করছো?
    – নাতিটা বড় হয়ে যাচ্ছে আদর করলাম না! বউ কি একা একা এই সংসার করতে পারবে?
    – মেয়েরা সব পারে।
    – নাহিদ-শাহিদ কে অর্ধেক বাসা ভাড়া দিতে বলবো। এখানে তো ভাড়া আছে, ওখানেও শরিক হবে। কিছু বাজার সদাই ও করবে, তবুও এক সাথে থাকলাম।
    – দেখো কি হয়!
    – হুম।
    – মা, আমি চাচ্চি চট্টগ্রাম চলে যেতে, আমার শ্বশুর বাড়ী একা, একদম ভালো লাগেনা।
    – এগুলো তোর জামাই আর শ্বশুরের ইচ্ছা মা, আমি নাক গলাতে যাবো না। বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিবি, নতুন বিয়ে হয়েছে মাত্র।
    – আচ্ছা বুঝলাম, কি রান্না করেছো?
    – মাছের মাথা লাউ দিয়ে রান্না করেছি, করলা ভাজি, আর মাষকলাইয়ের ডাল। আর এখন খাওয়ার জন্য বেগুন ভর্তা, আর শিম ভাজি করেছি। আর কাল শাহিদ ডিম এনেছে, ডিম ভাজি করে দিব?
    – না। ওই বাড়ীতে প্রতিদিন আলু ভর্তা আর ডাল খেতে খেতে মুখে কড়া পরেছে। এখানে অন্য রকম খাবার আছে, শান্তি।
    – আমি রুটি করি সকালে, আজ সময় কম, তাই ভাত রান্না করলাম।
    – ভালো করেছো। এখন একটু মাথায় তেল দিয়ে দাও, আমি রোদে বসি।
    – বসো।

    মা-মেয়ে তিন জন খাওয়া শেষ করে হাত ধুইছে তখন নাহিদ এসে রুমে বসেছে।

    কলি আড় দৃষ্টিতে ভাইয়ের রাগী চেহারা দেখছে, ফর্সা মুখ লাল হয়ে গিয়েছে। কলি এক গ্লাস পানি নিয়ে বললো কি হয়েছে নাহিদ।
    – আমি না খেয়ে দৌড়ে সকাল সাতটায় গেলাম, বলে এখন এসে কি করবি? আমি তো ছয়টায় এসেছি। যা,চলে যা বাসায়। তুই বল, আমি কি স্বপ্নে দেখবো যে, এতো সকালে চলে এসেছে। তার মধ্যে আইরিন কে নিয়ে এসেছে। সে যে, পন্ডিতি করছে।
    -খেয়েছিস?
    – কিচ্ছু থাকলে দে, নাশতা হয়েছে?
    – মা, ছেলের বাসায় যাবেন, দুপুরের রান্না শেষ করে ফেলেছেন।
    – ভালো। ভাত থাকলে, ভাত দে।

    নাহিদ বললো, মা তোমার ছেলের তিন বেডের বাসা। এক রুমে সে থাকবে, এক রুমে শালী মাঝে মধ্যে থাকবে, আর আরেক রুম নাকি গেস্ট রুম। ড্রয়িং- ডাইনিং সেট আপ করা শেষ।
    – তুই চলে এসেছিস কেন?
    – আইরিনের কি কাগজ জমা দিবে, তাই মেডিকেলে যাবে। ঘর তালা দিচ্ছে, মিস্ত্রি রা সব মালামাল জায়গায় রেখে চলে গিয়েছে। দুপুরের পরে এসে, বাড়ীওয়ালা চাচার নাম্বারে কল দিবে, তখন যেতে বলেছে।
    – ওহ। আমি ভাত দিচ্ছি খেয়ে নে।

    নাহিদ মাকে দেখছে, কিভাবে চুপ করে সব হজম করছেন, এতো কাছাকাছি এসেও ছেলে আলাদা বাসা নিচ্ছে, এতো কোন দুঃখ বোধ নেই। অথচ তিন দিন ধরে আশায় আছেন, নাতি আদর করবেন, সবাইকে নিয়ে থাকবেন। অথচ একটা ওহ বলেই চুপ করেই আছেন তিনি। সবসময় দুঃখ কাউকে বুঝতে দেন না।

    পলি এসে নাহিদ কে বললো প্লিজ তুই মাকে কিচ্ছু বলিস না, এমনি ভেতরে ভেতরে কষ্ট পাচ্ছে। মায়ের কি ছেলের বাসায়, ছেলের টাকায় থাকবেন, সে আশায় থাকতে চান নি, ভেবেছিলেন নাতি নিয়ে আদর করবেন, এক সাথে থাকবেন, তিন ছেলে নিয়ে কিন্তু!
    – পলিপা আমি সব বুঝি। কিন্তু ভাইজানের এই সব বুঝেন না, এটাই কষ্ট লাগে।

    রাহেলা বেগম বিকালে ছেলের বাসা দেখতে গেলেন, কি সুন্দর সুন্দর ফার্নিচার কিনেছে সাঈদ। নতুন দুটি খাট ও কিনেছে। তারা সুখে থাকলেই ভালো।

    সাঈদ বললো মা, পছন্দ হয়েছে বাসা?
    – হ্যা বাবা। পছন্দ হয়েছে।
    – জিহান বড় হচ্ছে, একটু বড় বাসা লাগবেই।
    – হ্যা। আমি কি কিছু সাহায্য করবো?
    – কাজ শেষ। আর নাহিদ দেরী করে এসেছে, কাজ আর থাকে? আমি ছয়টায় এসে সব লেবার দের নিয়ে কাজ করেছি।
    – ভালো করেছিস। রাতে আজ আমার এইখানে থাক।
    – না, মা। আমি একটু পরেই রওনা হবো। থাকা যাবেনা। কাছাকাছি এলাম, এখন তোমাদের দেখতে যাবো।
    – হ্যা, খুব ভালো হয়েছে।

    রাহেলা বেগম সেদিন সারারাত ঘুমাতে পারেন নি, কেন যেন খুব কষ্ট লেগেছিল। এই ছেলে এক সময় বলতো, মাকে ছাড়া আমার এক ঘন্টা বাইরে কেমন অশান্তি লাগে, এখন মায়ের সাথে এক ঘন্টা কথা বলার সময় নেই, কত কাছে থেকেও কত দূরে!! চোখ থেকে এক ফোটা পানি বালিশে গিয়ে পরেছে, সাথে সাথে আঁচল দিয়ে চোখ মুছলেন রাহেলা।

    দুই, তিন মাসের মধ্যে এই দুই রুমের বাসা একটা মিনি হোটেল হয়ে গেল। কাছের দূরের সকল আত্নীয়ের ডাক্তার দেখানো, ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া, ঢাকার সকল কাজ হয়, এই বাসায় থেকে।

    আজ বাসায় চারজন মেহমান, রাহেলা বেগমের ছোট বোন , তার দুই মেয়ে, তার জামাই। মোট চার জন মানুষ। ছোট বোনের ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকায় এতো জন এসেছেন। গত রাতে নাহিদ-শাহিদ মাথায় পিঁড়ি রেখে ঘুমিয়েছে। কারণ বাসায় নতুন দুটি বালিশ কিনেও মেহমান দের বালিশ দিয়ে তাদের জন্য আর বালিশ অবশিষ্ট নেই।

    রাহেলার ছোট বোনের জামাইয়ের আর্থিক অবস্থা ভালো। আসার সময় বেশ বাজার সদাই করে এনেছেন। রাহেলার বাজার ছাড়াও মেহমান দের খাওয়াতে খুব ভালো লাগে। হোক ডাল-ভাত তাই দিয়ে আপ্যায়ন হবে।

    রাহেলা তরকারি বসাচ্ছেন, তার বোন শরিফা পাশে এসে বসে বললেন আপারে, আমি তোকে কষ্টে ফেলে দিলাম।
    – কি যে বলিস তুই!
    – আমি ভেবেছি সাঈদের বাসা কাছে দুই মেয়ে কে সেখানে পাঠিয়ে দিব। এখন, বউ যে পছন্দ করেনা যাওয়া, সেটা বুঝিনি।
    – কষ্ট একটু তোদের হচ্ছে শুইতে। নজরুল ভাই নেহাৎ ভালো মানুষ তাই কিছু বলছেন না।
    – না, সে তোমাকে তার আপন বোনের মতো সম্মান করে। মেয়ে দুটিকে কার কাছে রেখে আসবো! এজন্য নিয়ে এসেছি। আজ রিপোর্ট দেখিয়ে, কালই চলে যাবো।
    – মেয়ে গুলিকে নিয়ে ভালো করে ঘুরাঘুরি করে যা।
    – না, এবার নয়, পরে আরেকবার আসবো। এখন ডাক্তার দেখিয়ে যাই।
    – কি ভর্তা মর্তা দিয়ে খাওয়াচ্ছি, জাহিদ বেতন পায়নি, এখনো। নয়তো হাতে টাকা থাকতো!
    –আপারে তুই তো ভর্তা দিয়ে খেতে দিচ্ছিস আনন্দ নিয়ে, এই ঢাকা শহরে কেউ খাওয়া ছাড়াও থাকার জায়গা দেয় না।

    প্রতি শুক্রবারে জুম্মার নামায পড়ে কিছু সবজি আর দুই হালি ডিম নিয়ে মাকে দেখতে আসেন সাঈদ। আজ ঘরে ঢুকেই বলছে মা, বড় টাটকা লাল শাক, আর মিষ্টি কুমড়া পেলাম নিয়ে আসলাম।
    – বাসায় সবজি আছে।
    – আমি কি খালি হাতে আসবো নাকি? মা বাসায় ফ্রিজ নাই, একটা ফ্রিজ থাকা জরুরি।
    – ফ্রিজ কোথায় পাবো বাবা? আর ফ্রিজের দরকার নাই।
    – আছে। আমি দেখি আগামী সপ্তাহে একটা ফ্রিজ কিনে আনতে পারি কিনা!
    – না, লাগবেনা৷ বাবা, ভাত খেয়ে যাও।
    – শারমিন অপেক্ষা করছে৷ একা খাবে। আমি যাই। আসবো, সুযোগ পেলে।

    কলি, ভাই যাওয়ার সাথে সাথে বললো, কেন একটা মাছ/ মুরগী নিয়ে আসতে পারেনা। খালি শাক-সবজী আনে। সস্তায় পায়, তাই আনে।
    – এখানে কি মাছের বাজার আছে? যে আনবে?
    – নিজের বাসায় মাছ কিনেনা?
    – কিনুক। যার যা ইচ্ছা করুক, আমি মাথা ঘামাইনা।
    – আবার বলে, ফ্রিজ নাই, ফ্রিজ কিনে দিবে।
    – আমি কি বলেছে দিতে? আমার ফ্রিজের দরকার নাই।
    – তুমি আশাও করনা, করলে কষ্ট পাবে।
    – চুপ কর তুই। যা, ভাত রেডি কর। শুধু বেশি বেশি কথা….

    কলি ভাত নিয়ে ভাবছে কি কথা, ফ্রিজ কিনে দিবে। কি ফ্রিজ কিনে দিবে তা আল্লাহ শুধু জানেন। একটা মাছ কিনে দিলেন না, এখন ফ্রিজ…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ০২.০২.২০২২

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৫)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৫)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (৫)
    রাজউক অফিসে এসেছি। এক আত্মীয়ের পূর্বাচল প্লটের রেজিস্ট্রেশন কাজে। অফিস আদালতের কাজে আমার বড়ই বিরক্তি। সরকারি অফিস হলে তো আরো। এখানে সব অদ্ভুতুড়ে কায়কারবার হয়। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। সেবা আছে, পাওয়া যায় না। আবার লাইন ঘাট, চেনা-জানা থাকলে মিলে যায় সহজে। এখানে কর্তাব্যক্তি থেকে নীচের পিওন পর্যন্ত সবাই যেন কেমন মন মরা, ম্যাড়মেড়ে। কথা বললে শুনে কি শুনে না, বুঝে কি বুঝে না জাতীয় ভাব নেয়। কোন পেপার বা ডকুমেন্ট দেখালে দেখতে পায় কিনা তাও বুঝিনা। অথচ শক্তিশালী কারো রেফারেন্স নিয়ে গেলে বা সিন্ডিকেটের হাত ধরে গেলে এসি রুমে অপত্যস্নেহে বসিয়ে পই পই করে সব কিছু বললে শুনে আর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা দেখালে গুরুত্ব দিয়ে দেখে। আর যদি কেবলাকান্ত’র মত একাকী যান তাহলে মধুমক্ষিকাদের কবলে পড়তে হবে। অনুযোগ করবেন? নথী গায়েব হয়ে যাবে। নয়ত রাজধানীর ক্যাবল জটের মত আগামাথা কিছুই বুঝে উঠতে পারবেন না। এমন প্যাচ কষবে যেন মনে হবে এর চেয়ে ছোটবেলার তৈলাক্ত বাঁশে বানরের আরোহন-অবরোহন অংকই অনেক সহজ ছিলো। তাই পারতপক্ষে সরকারি অফিসে যাইনা। যেতে চাইনা। তৌহিদ সেক্ষেত্রে হরফুন মাওলা, সকল কাজের কাজী। তাকে ফোন দিয়ে নিয়ে এসেছি উদ্ধার করার জন্য।

    কাজ শেষে প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। রাজউক ভবনের পাশের গলিতে নিয়ে গেল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অল্প তেলে ভাজা গরম গরম পরোটা আর ডাবল ডিম মামলেট দিয়ে করা দেশজ রোল খেতে খেতে আলাপ জমে উঠলো। হঠাৎই প্রশ্ন করে বসলো, “সেই মহিলাটা কে? কি করে? কদ্দিন চলছে”? মুখে দেওয়া খন্ডিত রোল গলায় আটকে গেল। গলা শুকিয়ে গেছে। রোল আর নামছেও না, বেরও হচ্ছেনা। পানি খেলাম। বললাম, “আরে না। ওরকম না। সে তো ম্যারিড। তার এক কিউটিও আছে”। “ডিভোর্সি”? তৌহিদের পাল্টা প্রশ্ন। আমার খাওয়ার ইচ্ছে শেষ। কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিনা। অসহায়ের মত সরল স্বীকারোক্তি দিলাম, “ না”। ততোধিক বিস্ময় নিয়ে সে পাল্টা প্রশ্ন করলো, “তাহলে কেমনে কি? এর পরিণতি কি”? আমার অস্বস্তি লাগছে। বললাম, “জানিনা। লিভ ইট”। তৌহিদ স্বগতোক্তির মত অস্ফুটস্বরে বললো, “পরকীয়া”? শব্দটা কানে যতটা বাজলো তার চেয়ে গুনিতক হারে হৃদয়ে গিয়ে ধাক্কা মারলো। লজ্জায়, শংকায়, অপমানবোধে সব কিছু অন্ধকারাচ্ছন্ন লাগছে। তৌহিদকে বিদায় দিয়ে যতই এগোচ্ছি ততই একটা শব্দ ‘ইকো’ হতে থাকলো। তা হলো পরকীয়া।

    বাসায় ফিরে গুগলে সার্চ দিলাম। পরকীয়া মানে কি? তেমন কনভিন্সিং কোন উত্তর পাওয়া গেলনা। যা পাওয়া গেল তাহলো, স্বামী বা স্ত্রী অন্য কারো সাথে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে দোষী সাব্যস্ত হবে। ব্যভিচারী বলে গণ্য হবে। আমি কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম, আমাদের সম্পর্ক এই সংজ্ঞায় পড়ে না। কিন্তু মাথায় অনেক প্রশ্নের উদয় হলো। পরকীয়া তাহলে কি? কারা এর পর্যায়ভুক্ত? কেবলই বিবাহিত পুরুষ আর বিবাহিতা নারীরাই এর আওতাধীন? যদি তাই হয় তবে আমাদের সম্পর্ক সে পর্যায়েও পড়ে না। পরক্ষণেই জানার আগ্রহ আরো বাড়লো। একজন বিবাহিত আর অপরজন অবিবাহিত হলে কি তাদের সম্পর্ক ‘পরকীয়া’ বলে গণ্য হবে? এ বিষয়ে কোন সদুত্তর পাওয়া গেলনা। মন আরো জিজ্ঞাসু হয়ে উঠলো। তাহলে কি পরকীয়ার জন্য বিবাহিত হওয়া আর যৌন সম্পর্ক স্থাপন আবশ্যকীয় শর্ত? যদি তাই হয় তাহলে দু’জন বিবাহিতের বিবাহ বহির্ভূত অথচ যৌনতা মুক্ত সম্পর্ককে কি পরকীয়া বলা যাবে? আচ্ছা, এর কারণইবা কি? এর কারণ শুধুই কি মনস্তাত্ত্বিক নাকি দৈহিকও? নাকি উভয়ই? এর উপকারিতাই বা কি? এর উপকারিতা ততক্ষনই বেশুমার আনন্দময় থাকে যতক্ষণ তা অনুকূল আবহাওয়ায় থাকে। তাহলে এর অপকারিতা কি? এর অপকারিতা অপরিসীম। কপাল মন্দ হলে প্রতিকূলতায় এর পরিণতি মৃত্যু অবধি সম্প্রসারিত। নিদেন পক্ষে লাঞ্চনা-গঞ্জনা, জেল আর ডিভোর্স অতি স্বাভাবিক। অনেকটা দু’কুল হারাবার মত। নীতির মানে তা অনৈতিক। সামাজিক মানদন্ডে গর্হিত। ধর্মীয় ফয়সালায় ইহকাল চৌচির আর পরকালের ডেস্টিনেশন হাবিয়াময়। মাথা আউলিয়ে গেলো। তাহলে মোটের উপর দাঁড়ালো কি? যাই দাঁড়াক আমি এর মধ্যে পড়িনা। তৌহিদকে ফোন দিতে গিয়েও দিলাম না। একটা জায়গায় গিয়ে আটকে গেলাম। জেমি বিবাহিতা। পরক্ষণেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম এই ভেবে যে এত অংক কষে আর যা হোক প্রেম-ভালোবাসা হয় না।

    দুপুর থেকেই মনটা বিষন্ন। শুয়ে শুয়ে ভাবছি অনেক কিছু। পুরনো দিনের। ছোট বোনের বিয়ে হয়েছে প্রায় দুই বছর। ভালবেসে যাকে বিয়ে করেছে সে একটা জিনিস বটে। যত সব উদ্ভট আর মেগা মেগা চিন্তা তার। কাজের বেলায় বিরাট অশ্ব ডিম্ব। এই ধরনের ছেলেদের আমি ছাত্রাবস্থা থেকেই অপছন্দ করতাম। পকেটে নাই দুই টাকা অথচ গপ সপ লক্ষ টাকার। মানুষও এদের কথায় বিমোহিত হয়। নিজে যেমন অলীক স্বপ্ন দেখে তেমনি তার চারপাশ ঘিড়ে থাকা লোকজনকেও দেখিয়ে ছাড়ে। বলা নেই কওয়া নেই, বাসার চাল চুলোর খবর নেই হঠাৎ করেই একদিন পুরোনো এক কার নিয়ে হাজির। তার শ্বাশুড়িকে দেখাতে। আমাকে বলেনি। জানে, এগুলো আমার মোটেই পছন্দ না। শ্বাশুড়িকে সারপ্রাইজ দিয়ে জামাই হিসেবে তার উপযুক্ততা প্রমানের এই প্রয়াস হাস্যকর সন্দেহ নাই। কিন্তু জীবন যাপন প্রণালীর ভবিষ্যত হিসেবে আশংকার বটে। সেই কার নিয়ে সে বোনকে সাথে করে ঘুড়বে আর বন্ধুদের সাথে ফুটানী করে বেড়াবে এটাই তার মিশন, ভিশন। অদ্ভুত। গাড়ীর জ্বালানী কোত্থেকে আসবে? এর উত্তর নাই। যোগানের ব্যবস্থাও নেই। তার উপর আরেকজনের গছিয়ে দেওয়া সেই পুরোনো গাড়ী এক কিলো যেতে তিন বার বন্ধ হয়ে যায়। আজ তার টায়ার পাংচার তো কাল লাইট জ্বলেনা। পরশু হর্নে সমস্যা। তরশু ব্রেক সু প্রবলেম। বোন দুয়েকবার তার সাথে গাড়ী চড়ে ঘুড়তে গিয়ে এই বিড়ম্বনায় পড়ে আর উঠেনা। বাসায় এই নিয়ে থমথমে পরিবেশ। আম্মা পড়েছেন উভয় সংকটে। একদিকে জামাই বলে কথা। হোক তা ‘না পছন্দ’। অন্যদিকে নিজের মেয়ে ও তার সংসার।

    হঠাৎ একদিন শুনি সেই গাড়ী অর্ধেক দামে বিক্রী করে দিয়েছে। ভাবলাম সুমতি হয়েছে। অন্তত দুঃশ্চিন্তা থেকে তো বাঁচা গেলো। কিছুদিন যেতেই দেখি বাসায় চিল্লাচিল্লি। বোনের। আম্মা থেকে থেকে চোখ মুছছে আর বোনকে বলছে, “আমার হয়েছে জ্বালা। হুট করে বিয়ে করে বসলি এই ছেলেকে। কতবার বললাম এর চাল চুলো ঠিক নেই। এখন বুঝ”। আমার ঘুমে যথেষ্ট ব্যাঘাত হচ্ছিলো। ভাবলাম নিত্যকার টপিক একটু পরেই থেমে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই কান গরম হয়ে গেলো, “আর একটা পোলা খালি ঘুমায়। চাকরি বাকরির খবর নাই। ইচ্ছাও নাই। খায় দায় আর বাবুগিরি করে বেড়ায়’। এ পর্যন্ত তবু মেনে নেওয়া যায়। ঠিকই তো বলেছে। কিন্তু পরের কথাটা ধক করে বুকে সুই ফোঁটালো, “ আমারে বিধবা করে তুমি কই রেখে গেলা”? আমি আর শুয়ে থাকতে পারলাম না। রুম থেকে বের হয়ে এলাম। আম্মাকে বললাম, “কি হয়েছে আম্মা? এ আর অমন নতুন কি? সেলিম তো এরকমই। তোমার মেয়েই তো গোঁ ধরে এই বিয়ে করেছে। আমি তো তখনই বলেছিলাম এই বিয়েতে আমার মত নেই। এখন পস্তাচ্ছো কেন”? এই কথা বলা শেষ আর পাশের রুম থেকে বোনের বিলাপ শুরু, “বাবা তুমি আমারে কই রেখে গেলা? আমার তো কেউ নাই”। বোনের এই বিলাপে মেজাজ শূন্য ডিগ্রীতে নামিয়ে আনলাম। বোনের কান্না সহ্য হয়না। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে চাইনি। আম্মার কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললাম, “কি হয়েছে বলো তো”। আম্মার কথা শুনে চক্ষু চড়কগাছ। বোনের হাসবেন্ড মানে সেলিম লাখ পাঁচেক টাকা তার এক বন্ধুকে দিয়েছিল যৌথ ভাবে গার্মেন্টসের স্টক লটের ব্যবসা করবে বলে। এর মধ্যে আম্মার দুই আর বোনের দুই। বাকী টাকা সেলিমের গাড়ী বিক্রির। সেই বন্ধু স্টক লট ব্যবসা শুরু করার আগেই স্টপ করে সোজা মালয়েশিয়ায় চলে গেছে কাউকে না জানিয়ে। এর আগেও আম্মার কাছ থেকে নিয়েছে তিন লাখ আর বোনের বিয়ের গয়না বিক্রি করে নিয়েছে তিন লাখ। আমি জানিনা। এই টাকা ই-ভ্যালিতে খাটিয়েছে। সেটাও খোয়া গেছে।

    পরিস্থিতি ভয়াবহ। সান্ধ্য আইন জারী করেও লাভ নেই। প্রলাপ-বিলাপের এই হৃদয় বিদারক পরিবেশ কবে কোথায় গিয়ে শেষ হয় কে জানে? আম্মাকে বললাম, “এতগুলা টাকা ওরে দিলা আমারে একবারও বললা না”? আম্মা কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো, “বললে কি তুই দিতে দিতি? তাছাড়া জামাই আর মেয়ে দু’জনেই বারণ করেছিলো”। “অবশ্যই না করতাম” মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। আম্মাও বললো, “নিজের একটা মেয়ে হলে তখন বুঝবি”। আমি থ মেরে গেলাম।

    প্রতিটি ফ্যামিলিতে এরকম একটা না একটা ‘ইন্দ্রনাথ’ টাইপের অবিমৃষ্যকারী থাকে। পুরো পরিবার এই হিডেন ডিনেমাইট নিয়েই প্রতিটি দিন গোজরান করে, কখন সেটা ফেটে সব কিছু চৌচির করে দেবে এই আতংকে। এই প্রথম মনে হলো, ফ্যামিলির জন্য কিছু করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এর ফলশ্রুতিতেই এই দুই টিউশনি।

    সেলিমের মত এই ধরণের উচ্ছন্ন প্রকৃতির ছেলেদের সাংঘাতিক রকমের কারিশমা দেখে আশ্চর্য্য না হয়ে পারিনা। ওয়ান টুয়ের মধ্যে যে কাউকে যাদুবশ করে ফেলতে পারে। যাদের কাছে সে ধরা খায় তারা কাছের লোক। আবার যাদেরকে সে ধরা খাইয়ে দেয় তারাও তার কাছের লোক। ঘটনাগুলো পুনঃ পুনঃ ঘটে কিন্তু বিস্ফোরণ হয়না। আজ তার প্রতি বড় রাগ হচ্ছে। “সে কোথায়” বোনকে জিজ্ঞেস করলাম। জানা গেলো, সে লাপাত্তা। কোত্থেকে যেন ফোন করে জানিয়েছে তাকে খুঁজে লাভ নেই। সামর্থবান না হওয়া পর্যন্ত সে আর তার সামনে আসবেনা।

    মানুষ বেশি বিপদে পড়লে বলে ত্রিশংকু অবস্থায় পড়েছে। আমার হয়েছে সেই দশা। আম্মার ঘরে যাই। আম্মা শুয়ে আছে। শান্তণা দেই। যদিও জানি ছেলে ভোলানোর মত শোনাচ্ছে। এর ইমিডিয়েট কোন দাওয়াই নেই। বোনের কাছে যাই। আজকাল অল্পতেই মানুষজন সুইসাইড করে বসে। আত্মা ধক করে উঠলো। আল্লাহ না করুন এমন কিছু করে বসে। তার অবস্থা ভয়াবহ। কথা বলেনা। বলে, “ওরে আমার কাছে ধরে আনো”। আমিও কৌশূলী না হয়ে বলে ফেললাম, “এনে দিলে কি করবি? তুই-ই তো সবাইকে অশান্ত করে জোর করে এই বিয়ে করেছিস। এখন বুঝ”। কথা মাটিতেও পড়তে পারেনি। তার উচ্চ বিলাপে বাসা মুখর। আশেপাশের ফ্ল্যাটের লোকজন হয়ত লজ্জায় এখনো দরোজায় টোকা দিচ্ছেনা। আমি সরে পড়লাম। আম্মা উঠে এসে আমাকে মৃদু বকা দিলো। বললো, “পারলে খোঁজ নিয়ে দেখ হতচ্ছাড়াটা কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে”। সেদিনের পর থেকে সেলিমকে আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ।

    এদিকে জেমিকে নিয়ে আমিও প্যারার মধ্যে আছি। আম্মাকেও রেখেছি। বাতের ব্যাথাটা খুব ভোগাচ্ছে তাকে। সারাদিন গরম পানির ছ্যাঁক দেয় আর তেল জাতীয় কি যেন মালিশ করে। এ অবস্থায় খাগড়াছড়ি যেতে মন চাচ্ছেনা।

    চলবে…

  • তব্দা খাওয়া

    তব্দা খাওয়া

    তব্দা কি! অন্যের অভিধানে কি বলে আমার জানা নেই। তবে আমার অভিধানে তব্দা খাওয়া হলো স্তম্ভিত হয়ে নির্বাক হয়ে যাওয়া।

    এরকম আমার প্রায় ই হতো আগে। এখনো হয় তবে খুব কম। আমি মানুষ টা একটু বেশিপ্র‍্যাক্টিকাল। তাই অবাক হবার মতো কোনো বিষয়ে ও খুব একটা অবাক হইনা।এজন্য অনেকেই হয়তো আমার সাথে কথা বলে মজা পান না। সেটা তাদের ব্যাপার! আমি কি করতে পারি!

    আমি এক বিশেষ নীতিও ধারণ করি তা হল,টেনসন লেনেকা নেহি টেনসন দেনেকা। আর আমার হাসবেন্ড ফুল টাইম সিরিয়াস পাবলিক। টেনসন নিতেই ভালোবাসেন। এবং উনি সেই টেনসন কৌশলে আমার মাঝে স্প্রেড করতে চান। একই কথা অনেক বার বলেও যখন কাজ হয় না তখন ব্যাচারা মন খারাপ করে অন্য ঘরে গিয়ে বিড়ি ধরান।উনার এই যে একটা বিশেষ সংগী আছে বিড়ি। সুখে দুখে ভাবে অনুভবে,রাগে অনুরাগের সংগী! আমার কে আছে যে আমি অযথাই টেনশন করবো?

    তারপর ও মাঝে মাঝে তব্দা খেয়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ি। আমার বড়ো ছেলে কেজি তে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার আগে ই বানান করে অনেক শব্দ ও বাক্য লিখতে পারতো। তাই পরীক্ষা নিয়ে আমার কোনো টেন্সন ছিলো না। জানি ভালোই করবে। আগের রাতে ফ্ল্যাটের এক বাচ্চার বার্থডে তে গিয়ে আনন্দ করলো। আনন্দের মাঝে তখনই ঢাকা থেকে অনেক গেস্ট এসেছিল আমাদের বাসায়। তাই বার্থডের প্রোগ্রামের মাঝে চলে এসেছিলাম। ওর দুই ফুপুর ফ্যামিলি এসেছিল। তাদের সাথে কথা বলে অনেক রাতে ওরা চলে যাবার পর অতি পরিশ্রমে তব্দা খেয়ে গেলাম। আমার মাথা ও মন কাজ করছিল না আমি আর ওকে কিছুই পড়াতে পারিনি বা কিভাবে পরীক্ষা দেবে তাও বলে দিইনি। তো সকালে উঠে ওকে নিয়ে পরীক্ষার হলে গিয়ে ছেড়ে দিয়ে বললাম যা যা আসে সব লিখ। আমি জানি সে পারে। কিন্তু আমি বুঝিনি সে শিশু,তাকে ক্ষণে ক্ষণে ই মনে করিয়ে দিতে হয়। যথারীতি সে বিশাল খেলার মাঠ দেখে পাগল হয়ে গেল। কি যে লিখেছিল কে জানে। পরে প্রতিবেশীর বাচ্চার কাছে শুনলাম ও নাকি বেশির ভাগ সময় কে কি করছে তাই দেখেছে।তবুও দশম হয়েছিল।

    প্রাইমারি সেকসনে যখন পড়তো তখন রেজাল্ট দেয়া হতো ক্লাসে। সেবার ক্লাস টু থেকে থ্রি তে উঠবে, সেবারই প্রথম মাঠে রেজাল্ট দেয়া হচ্ছিল। আমি সাধারণত রেজাল্ট আনতে যেতাম না ওর বাবা যেতো। সে বার কি কারণে উনি যেতে পারেন নি,আমি ও সংসারের কাজকর্ম সেরে তখনই গেটে ঢুকেছিমাত্র রেজাল্ট ঘোষণা হচ্ছে। আমি আমার বাচ্চার রেজাল্ট শুনে তব্দা খেয়ে গেলাম। দুই সেকসান মিলে সে থার্ড হয়েছে!সবাই আমাকে বলছে কিন্তু তব্দা খেয়ে চুপসে আছি।কি করা উচিৎ কিছুই ভেবে পাচ্ছিলাম না!

    এরপর এস এস সি পরীক্ষার রেজাল্ট এর দিন।

    তার দুতিন দিন আগে ওর পা এর প্লাস্টার খোলা হয়েছিল। পরীক্ষা দিয়ে মামা বাড়ি গিয়ে ফেরার আগের দিন খেলতে গিয়ে লিগামেন্ট ছিঁড়ে গিয়েছিল। ঐ অবস্থায় ঢাকা হয়ে চট্টগ্রামে ফিরেছিলাম। এর এক সপ্তাহের মধ্যে ওর দাদি মারা গেলেন। ১৭/৬/২০০৮তারিখ দাদি মারা গেলেন ২৬/৬/২০০৮ রেজাল্ট হলো। বাইরে সকাল থেকে বৃষ্টি। ও কোত্থেকে যেন রেজাল্ট পেল। এ প্লাস পেয়েছে। আমরা ও তাই ই আশা করে আছি।বাবু তাড়াতাড়ি নামাজে দাঁড়িয়ে গেল। এর একটু পর আমি আর বাবু নাসিরাবাদ স্কুলের দিকে রওনা হলাম। স্কুলে বোর্ডের দিকে তাকিয়ে বল্লো আম্মু আমি তো এ প্লাস পাইনি বি পেয়েছি! আমি আবার তব্দা খেয়ে গেলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ়! এমন সময় ওর বন্ধু আরিক দৌঁড়ে এসে ওকে বল্লো, “আরে এটা সায়েন্স এর রেজাল্ট চাট। আমাদের টা ওদিকে চল দেখবি।আন্টি আসেন দেখেন। গেলাম দেখলাম সত্যি সত্যিই ডে সেকসানে সে একমাত্র এ প্লাস। কিন্তু সেই তব্দা খেয়ে আছি কোনো প্রতিক্রিয়া হচ্ছে না। ওই অবস্থায় দুই নাম্বার গেটের কাছে ওর অংকের স্যারের বাসায় গেলাম। স্যার আমাকে দেখে ধরে ফেললেন। বল্লেন, “আপনি খুশি হন নি। এমন চুপ করে আছেন কেন।সেলিব্রেট করেন।” উনার কথায় সম্বিৎ ফিরে পেলাম। বাসায় এসে আধামন মিস্টি কিনে বিতরণ করেছিলাম।

    তখনও সাথে সাথে গোল্ডেন কিনা জানা যেত না। পরদিন ২৭/৬ এ ওর জন্মদিন। ও মিস্টি নিয়ে আমার আম্মা কে সালাম করতে খুলসি রওনা হয়েছে বাসায় ল্যান্ড ফোনে ওর এক বন্ধু (আজ আর নাম মনে নেই) খবর দিল আন্টি নয়ন গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। পরে জানলাম স্ট্যান্ড ও করেছে।

    এরকম তব্দা খাওয়া গল্প আরও আছে। সময় করে আবারও বলবো!

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৪)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৪)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (৪)
    টিউশনি শেষে বই খাতা গুছাতে গুছাতে ইলমা আচমকা আবদার করে বসে, “স্যার, আপনার সাথে কাল বিকেলে রিক্সা করে ঘুড়বো”। আমি থ। বুঝে উঠতে পারিনি। বললাম, “ না, না। তা কিভাবে সম্ভব”? ইলমা পাল্টা প্রশ্ন করে বসলো, “ কেন, স্যার? ঘুরলে কি হয়”?
    — অসুবিধে আছে। তাছাড়া তোমাদের বাসা থেকে এটা এলাউ করবেনা।
    — বাসার কাউকে বলবো না তাহলে।
    — সে কি করে হবে? আর এটা হয়না।
    — কেন, আপু রাগ করবে?
    — মানে?
    — মানে, আপুকে ভয় পান? ইলমা হাসলো। সে হাসির রহস্যভেদ করা গেলনা। আমি প্রসঙ্গান্তর করার চেষ্টা করলাম। ইলমা মুখ কালো করে বই-খাতা গুছিয়ে নিয়ে চলে গেলো। তবে কি ইলমা আমাদের সম্পর্কের কিছু আঁচ করতে পেরেছে? কিছুটা লজ্জায় আর ততোধিক অজানা আশংকায় নিরবে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

    বাসায় পাত্রী দেখার ধুম পড়ে গেছে। শেষতক একজনকে সিলেক্ট করা হয়েছে। বড় মামার এক জুনিয়র কলিগের একমাত্র সন্তান। বিদেশী ব্যাংকে চাকরি করে। ধানমন্ডি আর বনানীতে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং আর মার্কেট আছে। বড় মামার প্রেসক্রিপশন, আমার চিত্ত বৈকল্য হয়েছে। আমি ডিট্র্যাক্ট হয়ে গেছি। বিয়ে দিয়ে দিলেই প্রবলেম সলভ। সেই মেয়েই নাকে রশি বেঁধে ট্র্যাকে উঠিয়ে নেবে। ‘বিজনেস’ ভুত মাথা থেকে পালাবে। তাঁর এই প্রেসক্রিপশন আম্মার মনমত হয়েছে। তাই কয়েক দিন যাবত তাকে ফুরফুরে লাগছে।

    বিসিএস না হোক ছেলের সুমতি হয়েছে। জীবিকার ভাল একটা রাস্তা তো হয়েছে। তাঁর কথা মত কাজ হয়েছে- সেই উত্তাপ নিয়ে বড় মামা আবার এলেন। কেন এলেন? সেলিব্রেট করতে? মোটেই না। আম্মা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে চাকরি তো হলো। এখন যদি সেই কিউটি সহ মহিলাকে বিয়ে করে বসি? মামা এসেই ওযু করে জোহরের নামায আদায় করলেন। লাঞ্চ করলেন একটু। বক বক করলেন অনেক। বললেন, “চাকরি হয়েছে ভাল। ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন। সেলারি, ফ্যাসিলিটিজ, প্রসপেক্ট সবই ভাল। প্লেস অফ পোস্টিং ইজ ফার এওয়ে ফ্রম ঢাকা বাট নট দেট মাচ ব্যাড”। এই পর্যন্ত ভালই লাগছিলো। এরপর শুরু হলো, “ইন দ্য ইয়ার নাইনটিন নাইনটি ওয়ান, হোয়েন আই ওয়াজ পোস্টেড ইন পানছড়ি –” । কান দিয়ে শুনছি আর বের করে দিচ্ছি। হঠাৎই এলো বিয়ে প্রসঙ্গ। পাত্রী ঠিক করা আছে। আগামী শীতে ডেট ফিক্স করে অনুষ্ঠান করা যাবে। এর আগে অন্য কোন চিন্তা মাথায় আনা যাবেনা। আমার মাথা ঝিম ঝিম করছে। রক্ত বিদ্রোহ করতে চাচ্ছে। বুকের গভীরে হঠাৎ মোচড় মেরে উঠলো। মুহুর্তেই জেমির মুখটা ভেসে উঠলো । আমি আর বসে থাকতে পারলাম না। উঠে রুমে গিয়ে লক করে দিলাম। বুকের ঠিক মাঝখানে বিষ বাষ্প জমাট বেধে আছে। নিঃশ্বাস ঠিক মত নিতেও পারছিনা। প্রশ্বাসেও স্বস্তি পাচ্ছিনা। ঘরে মন বসছেনা। মুহুর্তেই চেনা পৃথিবীটাকে খুব অচেনা আর খুব রুক্ষ বলে মনে হলো।
    আমার ‘অস্বস্তি’ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। অবশেষে জেমির সাথে কথা হয় ফোনে। বললো, কি যেন জরুরি কথা আছে। দেখা করে বলবে। স্থির হলো, কিউটিকে যেদিন ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাবে সে দিন। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। তার মা সাথে যাবে তাই। ইলমা’র কথা জেমিকে জানালাম। সে ঘন নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “ লিভ ইট। এই নিয়ে বাসায় অনেক অশান্তি চলছে। আমি আর নিতে পারছিনা”।

    ইতোমধ্যে দু’টো টিউশনই আমি ছেড়ে দিয়েছি। আরো স্পষ্ট করে বললে ছাড়তে হয়েছে। কারণ দ্বিবিধ। এক, জেমিকে নিয়ে যে প্রায়ই রিক্সায় ঘোরাঘুরি করি ইলমা তা দেখেছে ও তার মা-কে জানিয়েও দিয়েছে । একদিন পড়া শেষে আচমকা বলেই ফেললো, “আপুকে নিয়ে তো ঠিকই রিক্সায় ঘুরেন। আপু কিন্তু ম্যারিড”। আমি হতবাক। জেমিও সেদিন আর দেখা দেয়নি। বাসায় না বাইরে বুঝতে পারিনি। আর দ্বিতীয় কারন হলো, বুয়েটের ব্যাকগ্রাউন্ড আর রেজাল্ট ভাল থাকায় এক বন্ধুর কল্যাণে ইউ এন ডি পি’র এক প্রজেক্টে ভাল একটা চাকরি পেয়ে গেছি। কর্মস্থল খাগড়াছড়ি।

    প্রিয় রাজধানী ছেড়ে পাহাড়ে গিয়ে থাকতে হবে। যদিও পাহাড় আমার খুব প্রিয়। তবু মন সায় দিচ্ছেনা। কেন? প্রিয় পরিবেশ ছেড়ে যেতে হবে, তাই? মুহুর্তেই জেমি’র মুখটা ভেসে উঠলো। মানুষের মন বড়ই অদ্ভুত। অনুকূল পরিবেশে পেখম মেলে। আর প্রতিকূল পরিবেশে শামুকের মত গুটিয়ে থাকে। সব কিছু ঠিক ঠাক। আগামী পরশু লাগেজ সমেত খাগড়াছড়ি যাবো। মনে হচ্ছে কারা যেন জোর করে আমাকে বোচকাসহ আর্মি লরীতে উঠিয়ে দিচ্ছে অজানা পথে। জেমির সাথে দেখা করতে মন চাইছে। কিন্তু এটা বাড়াবাড়ির পর্যায়ে পরে যাবে কিনা ভাবছি। ছাত্রীর কুশলাদি জানার ছুতোয় যাওয়া যায়। তাতে রথ দেখা আর কলা বেচা দু’টোই হবে। পরক্ষণেই মুখোমুখি ধরা পড়ার লজ্জায় পেয়ে বসলো। লক্ষ্য করেছি আজ বেশ ক’দিন যাবত জেমির ফোন বন্ধ। ফেবু আইডি ডিএক্টিভ। ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সটাগ্রামে তাকে পাওয়া যাচ্ছেনা। কোন বিপদ হয়নি তো?

    মানুষের মন বড় বেশি সেনসিটিভ। অযত্নে কুঁকড়ে যায়। অবহেলায় অভিমানী হয়। প্রত্যাখানে হয় বিধ্বংসী । আর আলাপনে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে যায় তা কেউ টেরই পায়না। এই দহন জ্বালা ক্রমান্বয়ে যেন বাড়ছেই। স্মৃতিরা বড় বেশি ক্ষুরধার। ঘাপটি মেরে থাকা সুখময় স্মৃতিরা অসময়ে পেখম মেলে ধরে। জেমিকে নিয়ে অমল ধবল সেই সব স্মৃতিকে চেপে রাখা যায়না।

    এত কিছুর মাঝে একটা ভাল খবরও আছে। বড় মামার সিলেক্ট করা পাত্রী ভেটো দিয়ে বসেছে। তাঁর ও আম্মার সন্দেহ এটা আমার চাল । তাদের মুখ কালো। চোখে গভীর সন্দেহ। মাথায় যে গভীর শংকা সে আমি বুঝতে পারি। ক’দিন যাবত বাসার পরিবেশ বেশ শান্ত। কোথাও কোন চিল্লাচিল্লি নেই। বেলা বারোটা বাজলেও ঘুমের ব্যাঘাত আর ঘটেনা। সেই বকাবাদ্যও নেই। আম্মার জন্য মনটা সিক্ত হয়ে উঠলো। জানি জেমি প্রসঙ্গ মাথা থেকে নামিয়ে ফেললেই আবার সব কিছু আগের মত হৈ চৈ মুখর হয়ে উঠবে। নাস্তার টেবিলে আম্মা এসে বসলো। খাবার তুলে তুলে দিচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি কিছু বলতে চাচ্ছে। বললাম, “ কিছু বলবা”? দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, “বাবা, তোর বাবা নেই আজ কত বছর হলো। কোনদিন কোন কিছু নিয়ে এত টেনশন হয়নি। আজকাল হচ্ছে” ।
    — হঠাৎ আজকাল আবার কি হলো? আমার প্রশ্ন।
    — কি জানি বাবা? আজকাল সবসময় মনে কু ডাক শুনি। আর দুঃস্বপ্ন দেখি
    — ওগুলো তোমার নিছক দুঃশ্চিন্তা। মাথায় নিও না। শুধু শুধু প্রেসার বাড়বে।
    আম্মা কি যেন বুঝলো। হয়ত ভেবে নিয়েছে আমি ট্র্যাকে এসে গেছি। ঘন করে দুধ চা এনে দিলো। আমার খুব মায়া হলো।

    চলবে…

  • এসো ঝরোঝরো বৃষ্টিতে

    এসো ঝরোঝরো বৃষ্টিতে

    ঝকঝকে নীল আকাশ। আকাশে দলবাধা সাদা মেঘ। গাছের পাতাগুলো গতরাতের বৃষ্টিতে আরো সজীব হয়েছে। কত শত পাখি নির্ভয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক–ওদিক। অপরূপ একটি বিকেল। তবুও কেমন যেন বিষণ্নতা ছেয়ে আছে। মনে হচ্ছে, কী যেন নেই। চাপা একটা হাহাকার। তবে কি সুন্দরের মধ্যে কষ্ট মিশে থাকে? নীলা, পাঁচ মাস পর বাবা–মায়ের কাছে এসেছে। বার বার মা–বাবার ফোন, সে অগ্রাহ্য করতে পারেনি। চলে এসেছে। ট্রেনে। একা। আজ আর পাশের সিটে শাওন নেই। উত্তরার ছোটো ছিমছাম একটি ফ্ল্যাটে ছোট্ট সংসার শাওন আর নীলার। বিয়ের তিন মাস চলছে। একটি কর্পোরেট অফিসে চাকরি করে শাওন। সপ্তাহে পাঁচ দিন কাটে ব্যস্ততায়। শুধু বিশুদবার ব্যতিক্রম। দিনটা যেন সকাল থেকেই হাসে। নীলাও সেদিন প্রজাপতি হয়ে যায়। শাওনের অফিস সপ্তায় দুদিন বন্ধ। তাই বিশুদবার অফিস থেকে ফিরেই নীলাকে জড়িয়ে ধরে। কী এক উত্তেজনায় বলে, আমাদের দুদিন ফুরফুরে দিন। নাস্তার টেবিলে প্ল্যান হয় কোথায় ঘুরতে যাওয়া যায়।

    বিশুদবার কলিংবেলের শব্দ নূপুরের মতো মনে হয় নীলার। নূপুরের শব্দের রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই ঘরে ঢোকে শাওন। নীলার মন আজ অন্যরকম আনন্দে ভরে আছে। আজ নাস্তার টেবিলে আরেকটি প্লেটে, একটুকরো কাগজে মুড়েরাখা আছে একটি গোলাপের পাশে আরেকটি গোলাপি লেখা। ঘ্রাণ নিতে নিতে দেখবে শাওনের চেহারার পরিবর্তন। কিন্তু শাওনকে দেখে মুহূর্তে উবে গেলো সেই আনন্দ।

    – এ কী চেহারা হয়েছে তোমার শাওন? কী হয়েছে?

    – কাল রাত থেকেই শরীর ম্যাজম্যাজ করছিল। আজ অফিস যাওয়ার পর সর্দির সঙ্গে প্রচণ্ড মাথাব্যথা। জ্বরও এসেছে মনে হয়।

    – তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করে নাও। আমি মিনহাজকে ফোন দিয়ে কী ওষুধ খেতে হবে জেনে নিচ্ছি। নীলা জ্বর মেপে দেখল একশো এক। থার্মোমিটার দেখে শাওন হেসে বললো, ও কিছু না। মাথাব্যথায় হয়তো। একটু গা গরম হয়েছে। চলো নাস্তা করে নিই।

    – আজকাল কী কাগজও নাস্তার রেসিপিতে যোগ হয়েছে! প্লেটে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা কাগজের দিকে তাকিয়ে বললো শাওন।

    – হুম। খেয়ে দেখো। পৃথিবীর সবচেয়ে মজাদার খাবার মনে হবে। করোনা মেয়েদের ভালোই ঘরকন্যা বানিয়েছে। বলতে বলতে প্লেটে রাখা কাগজটি খুলে হতবাক। চেয়ার থেকে উঠে নীলাকে কোলে তুলে ঘুরে গেলো একপাক।

    – নীলা – নীলা – নীলা! এখানে তো একটি নয়। হাজার হাজার গোলাপে আমার মন, আমাদের ঘর ভরে গেছে। দেখো চারদিকে! কবে আসবে আমাদের গোলাপি?

    – সেতো ডাক্তার বলবে। এখন আমাকে নামাও, নাস্তা করে নাও।

    উত্তরার ছোট্ট ফ্ল্যাট জুড়ে আনন্দ খেলা করছে। রাত এগারোটার দিকে জ্বর একশো চার ছাড়িয়ে গেলো। নীলার কেমন ভয় লাগছে। মিনহাজকে ফোন দিতেই বলল হাসপাতাল নিয়ে যেতে। হাসপাতালের কথা শুনেই কান্না করে দিলো নীলা।

    – মিনহাজ, ওর কী খারাপ কিছু হয়েছে? – এমন ভেঙে পড়ছিস কেন? পরিস্থিতি ভালো নয়। তাই হাসপাতালের কথা বললাম। ভয় পাসনে আপুনি। আমি আসছি।

    জ্বরে ছটফট করছে শাওন। আধঘণ্টা পর এলো মিনহাজ। গাড়ি ছুটছে কুর্মিটোলা, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, জেনারেল হাসপাতাল…। কোথাও সিট নেই। জ্বর, সর্দি বললেই ডাক্তার, নার্স সরে যাচ্ছে দূরে। নীলার কান্না আর থামে না। মিনহাজের অনুরোধেও কিছুতেই কিছু হয় না। হাসপাতালের আশা ছেড়ে দিয়ে প্রাইভেট ক্লিনিকের দিকে ছুটল গাড়ি। ওদের দরজা একেবারেই বন্ধ। দরদর করে ঘামছে শাওন।

    – নীলা, গাড়ির গ্লাসগুলো নামিয়ে দাও! বাতাস লাগলে ভালো লাগবে মনে হয়। পূর্বদিক লাল হয়ে জানান দিচ্ছে, দিন আসছে। কিন্তু ভোরের স্নিগ্ধ, নরোম আলোর সঙ্গে মিশে গেলো শাওন। নীলা নির্বাক চোখে তাকিয়ে আছে শাওনের দিকে। মিনহাজ দেখছে এক নিষ্ঠুর ভোর। যার সঙ্গে মিশে আছে একজন ডাক্তারের ব্যর্থতা। কখন যে এক টুকরো মেঘ এসে নীলার নীল সমুদ্র ঢেকে দিয়েছে! কোথায় উড়ে গেলো সাদা মেঘ। কখন যেন পড়া শুরু করেছে টুপটাপ করে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি। নীলার ছাদ থেকে নামতে ইচ্ছে করছে না। বৃষ্টি বেগ বাড়ছে। চোখমুখ ভিজে যাচ্ছে সেই পানিতে। এ কী, বৃষ্টি নোনা কেন! নীলা বুঝতে পারে বৃষ্টি আর চোখের জল এক হয়ে নামছে দুগাল বেয়ে। পাঁচ মাস আগে ঠিক এইখানেই, পিংক মুন দেখার জন্যে শাওনের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল ও। বাসার নিচের সরু গলি, বড়ো দালানের লোকজন, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গাছ সবাই ঘুমোচ্ছিল। নিজের উজ্জ্বল হাসি নিয়ে শুধু জেগেছিল চাঁদ। জেগেছিল শাওন আর নীলা। সেই তীব্র সুন্দর জোছনায় ভিজেছিলো দুজন। আজও নীলা ভিজছে। সেদিনের জোছনার আলো আজ বৃষ্টি হয়ে ঝরছে। ঝরোঝরো বৃষ্টির ধারা নামছে তার কালো চুল বেয়ে। মুখ ছুঁয়ে। চোখ ছুঁয়ে। শাওন কি মিশে আছে বৃষ্টিতে? প্রশ্নটা কার কাছে? কে দেবে উত্তর? ওপারে শাওনরা কোথায় থাকে! কেমন থাকে! কোনো পূর্ণিমা রাতে আবার এসে দাঁড়াবে কী সে নীলাদের পাশে? ছাদের রেলিংয়ের বাইরে বাড়িয়ে রাখা হাত। আঙুল বেয়ে চোখের জলের মতো বেয়ে পড়ছে বৃষ্টির জল।

  • মৃন্ময়ী (শেষ পর্ব-৫)

    মৃন্ময়ী (শেষ পর্ব-৫)

    দীর্ঘ তিন ঘন্টা ভাড়া গাড়িটা চলার পর অবশেষে মৃন্ময়ীর গ্রামের মাটিতে পৌঁছে মৃন্ময়ী কে যখন কোনদিকে যাবে জিজ্ঞেস করল ড্রাইভার তখন মৃন্ময়ী নিজের মধ্যে ছিল না।সে ক্রমাগত ভাবছিল কি হবে কিভাবে সকলে তাকে দেখে কি আচরণ করবে।ড্রাইভার বুঝতে পারল মৃন্ময়ী ড্রাইভার এর কথা শুনতে পায় নায়। ড্রাইভার এবার একটু জোরে যখন কোনদিকে যাবে জিজ্ঞেস করল মৃন্ময়ী প্রকৃতস্ত হয়ে লজ্জা পেয়ে গেল।কারণ সে নিজে ও পথঘাট কিছুই চিনতে পারছে না। এত সময় ধরে চেকার মিজান মৃন্ময়ী যে চিন্তিত মনে বসে ছিল তা খেয়াল করছিল।

    তাই সে তাড়াতাড়ি বলে উঠলো ম্যাডাম আমাকে বলুন কোন পাড়ায় কার বাড়িতে যাবেন। আমি ব্যাবস্থা করছি। মৃন্ময়ী মিজান কে মৃন্ময়ীর বাবা ভাই এবং কোন পাড়া বলে চুপ করে বসে রইল।আসলে যতই বাড়ির কাছে যাচ্ছিল মৃন্ময়ী ততই মনের সাথে যুদ্ধ করে সাহস সঞ্চয় করছিল।

    চেকার মিজানই জিজ্ঞেস করে করে অবশেষে মৃন্ময়ীর বাড়ির সামনে এসে গাড়ি দাঁড় করাল।

    পাশাপাশি কয়েকটি ঘর দেখে মৃন্ময়ী বুজে উঠতে পারছিল না কোন বাড়িটাতে মা বাবা ভাই বোন থাকে।

    তখন দুপুর গড়িয়ে দুটো তিনটা বাজছিল।মৃন্ময়ী কতক্ষন যে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে ছিল মনে নেই। হঠাৎ মিজানের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে কিছুটা লজ্জিত স্বরে বলে উঠল বুঝতে পারছি না কোনটা আমার বাড়ি।

    মিজানকে কিছু বলতে হয়নি।কারণ এমন সময় সামনের এক বাড়ি থেকে পনের ষোলো বছরের যে মেয়েটিকে বের হয়ে আসতে দেখল সে অবিকল দেখতে মৃন্ময়ীর মতো। যে বয়সে মৃন্ময়ী বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল।

    মেয়েটি ও মৃন্ময়ী কে দেখতে পেয়ে এবং বাড়ির উঠোনে গাড়ি দেখতে পেয়ে সামনে এগিয়ে আসল কিছুটা। বিশ পঁচিশ কদম সামনে এগিয়ে এসে পিছন ফিরে একটা চিৎকার দিয়ে দৌড় দিল।কারণ সে তার প্রতিচ্ছবি সামনে দেখতে পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। মৃন্ময়ী এক কদম ও সামনে এগোতে পারলো না।কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছে তার সমস্ত কর্মশক্তি। যে মৃন্ময়ী দু চারটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি নানাপ্রকার মানুষ জনকে সামলিয়ে দিন পার করে সে এই মুহুর্তে যেন অন্য এক মৃন্ময়ী।

    মেয়েটি ভিতর বাড়ি দৌড় লাগানোর পরে আর বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়নি। একে একে সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসছিল কি ব্যাপার।

    সবার লাস্টে মৃন্ময়ী লাঠি ধরে তার বাবাকে আসতে দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না। দৌড়ে গিয়ে বাবার পায়ে উপুড় হয়ে পড়ে ক্ষমা চাইতে লাগল। ভাইয়ের বউরা মৃন্ময়ীকে চিনে না। শুধু এর নামে নানা রটনা শুনেছিল।তাই তিন ভাইয়ের বউ মৃন্ময়ী কে দেখতে পেয়ে কিছুটা বিরক্ত প্রকাশ করতে গিয়ে আবার সামলে নিল।কারণ মৃন্ময়ীর বেশ ভুষায় একটা আভিজাত্যের ছাপ ছিল।ভাইরা ও এতদিন পরে বোনকে দেখতে পেয়ে সমস্ত রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরতে গিয়ে সংকোচে আবার পিছিয়ে গেল।কারণ ভাইরা মোটামুটি ভাবে সংসার চালায়।তাদের কাপড়ে চোপড়ে দারিদ্র্যতার ছাপ রয়ে আছে।

    মৃন্ময়ীর কিন্তু সেদিকে খেয়াল নেই।নিজেই দু ভাইকে চিনতে পেরে জড়িয়ে ধরল।আর এক ভাই ছোট ছিল বলে তাকে চিনতে পারল না।

    মৃন্ময়ী কে দেখার জন্য আসে পাশে ক্রমশ লোক জড়ো হতে লাগলো। সবার মাঝে মৃন্ময়ী মাকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসু নেত্রে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করে কয়েক বছর আগে মা বিনাচিকিৎসায় মারা গেছে শুনে আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।

    ড্রাইভার আর চেকার মিজান এতক্ষন হতম্ভব হয়ে সব কিছু নিরীক্ষণ করছিল চুপচাপ। তাছাড়া ভাড়া ও বাকি আছে।মৃন্ময়ী ও ভুলে গেছে ভাড়া দিতে। এদিকে প্রায় বিকেল হয়ে যাচ্ছিল।উঠোনের মধ্যেই এতক্ষন ভাই বোন বাবার সাথে মিলনের মাঝে ভুলে গিয়েছিল মৃন্ময়ী সব কিছু।অকস্মাৎ মনে পড়ায় ড্রাইভার কে ভাড়ার চাইতে দেড়গুন টাকা বেশি দিল।আর চেকার মিজান কে অনেক অনেক ধন্যবাদ দিয়ে তাকে ও জোর করে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য ফলমূল কিনে নিয়ে যেতে বলল।

    বোনের এত উন্নতি দেখে ভাইয়ের বউরাই মৃন্ময়ী কে খুশির সাথে ঘরে নিয়ে গেল।

    সারা গ্রামে রটে গেল মৃন্ময়ী মস্ত বড়লোক হয়ে গ্রামে ফিরে এসেছে।

    আজ সেই মৃন্ময়ীর জন্য এক ইতিহাস গড়ার দিন।স্বপ্নের মতো।যে মেয়ে জীবনে বড় হওয়ার জন্য পরিবারের ভালবাসাকে উপেক্ষা করে সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে রাতের অন্ধকারে বাড়ি থেকে পালিয়ে রাজধানীর বুকে একটু ঠাঁই পাওয়ার জন্য নিজের জীবনকে বিপদের মাঝে নিক্ষেপ করেছিল সেই মৃন্ময়ী কিনা এত বড় রাজনৈতিক প্লাটফর্মে সেরা শিল্পপতির পদক নিতে এসেছে পরিবার সমেত।আর সেই পদক কিনা মৃন্ময়ীর হাতে তুলে দিবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ।মৃন্ময়ী যত ভাবে ততই নানা স্মৃতির ভান্ডার একে একে মনের দরজায় এসে জানান দেয় সত্যিকারের স্বপ্ন দেখতে চাইলে এবং সে স্বপ্ন পূরণের জন্য যদি কঠোর অধ্যাবসায় থাকে তবে সৃষ্টিকর্তা কাউকে নারাজ করে না।আজ তাই তো মৃন্ময়ীর জীবনে প্রতিস্টিত হওয়ার স্বপ্ন জয় লাভ করেছে।বঙ্গবন্ধু আর্ন্তজাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয়ভাবে পদক অনুস্টানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।মৃন্ময়ী নানা অনুস্টানে আগেও এই হলে যোগদানের জন্য এসেছে নানা মিটিং এ কিন্তু আজকের আয়োজন সম্পুর্ন অন্য একপ্রকার ভালো লাগা সৃষ্টি করেছে।আজ যে তার পাশে তার পুরো পরিবার সাথে আছে।বাবা বুড়ো হলেও বাবার জন্য গাড়ি পাঠিয়ে বাবাকে গ্রাম থেকে রাজধানীতে আনার ব্যাবস্থা করেছে।মৃন্ময়ীর দু পাশে আজ দু পিতা বসে আছে।একজন জন্মদাতা পিতা আর একজন মৃন্ময়ী কে নতুন জীবন দানকারী ধর্মপিতা। মৃন্ময়ী আবেগে দু পিতার হাত ধরে বসে আছে। আজ তার স্বপ্ন পুরণের দিন।আকাশ ছোঁয়া স্বপ্নকে যে আজ সে তার যোগ্যতা আর শ্রমের দ্বারা নিজের মুঠোয় নিতে পেরেছে।শুধু কি তাই মৃন্ময়ী সপ্তাহ খানেক নিজ গ্রামে থাকার সময় গ্রামবাসী কে কথা দিয়ে এসেছে গ্রামে সে একটা মায়ের নামে হাসপাতাল বানাবার সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাবে।যাতে আর কেউ যেন মৃন্ময়ীর মায়ের মতো বিনাচিকিৎসায় মারা না যায়।সেদিন সবার হাততালিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়েছিল।মৃন্ময়ীর নামে জয়ধবনি রব উঠেছিল।

    অবশেষে সেই মহেন্দ্রক্ষন মৃন্ময়ীর সামনে উপস্থিত হলো।ক্লিক ক্লিক হাজারো ছবি উঠানোর মধ্যে দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে শ্রেষ্ঠ শিল্পপতির পদক নিয়ে মৃন্ময়ী গর্বিত প্রতিস্টিত নারীর মর্যাদায় নিজেকে সমাজ দেশ সবার কাছে জয়ীতা হিসেবে প্রমান করলো। হাজারো করতালিমুখর পরিবেশে নতুন আর এক আত্মপ্রত্যয়ী মৃন্ময়ীর জন্ম হলো।

    সমাপ্ত

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩২)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩২)

    শাহিদ দোকানে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। রাহেলা বেগম একটা বাটি হাতে দাঁড়িয়ে বললেন, বাবা, এখানে রুটি আর সবজি আছে খেয়ে নিস দুপুরে।
    – মা, সময় হয়না। আমি একবারে সন্ধ্যায় বের হয়ে দোকানের নিচে খিচুড়ি খেয়ে নিই। আর এই খাবার ততক্ষণে নষ্ট হবে যাবে।
    – এক ফাঁক করে দুপুরে খেয়ে নিবি।
    – আচ্ছা দাও, দেখি।

    শাহিদ বললো কলিপা, আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ বাসায় আসলে দরজা খুলবেনা। আর দরজা খুলে ছাদে বের হওয়ার দরকার নাই। যদিও ছাদে কেউ আসেনা, তবুও কিছু দিন যাক।
    – ভাইরে, ভাই। আমি হলে থেকে এসেছি। যা, তুই।
    – এটা ঢাকা শহর।
    – আচ্ছা।

    কলি দরজা লাগাতে লাগাতে বললো মা, শাহিদ মনে করে আমি ছোট্ট শিশু।
    – চিন্তা করে, এজন্য বলে।
    – বেশি চিন্তা করে।

    তিন মিনিট পরেই দরজায় আওয়াজ হচ্ছে দেখে কলি এসে বললো কে?
    – আমি!
    – আমি কে?

    রাহেলা বেগম বললেন দরজা খোলার দরকার নাই। আমি দেখছি।

    রাহেলা বেগম বললেন কে?
    – মা, আমি সাঈদ।

    রাহেলা দরজা খুলেই ছেলেকে জড়িয়ে ধরেছেন। আমার সাঈদ বাবা, কত্তদিন পর, বাসা কেমনে চিনলি বাবা?
    – শাহিদ উপরে তুলে দিয়ে গেল, নিচেই পেয়ে গিয়েছিলাম ওকে।
    – ওহ। কেমন আছিস বাবা?
    – খুব দৌড়ের উপর আছি। গত সপ্তাহে এসেছিলাম ঢাকা। আসতে পারিনি এই দিকে, ঝামেলা ছিল।
    – বউমা, নাতি ভালো আছে?
    – হ্যা। আমার ঢাকায় ট্রান্সফার হয়েছে মা।
    – আলহামদুলিল্লাহ।
    – ঢাকায় বাসা নিব, শ্বশুর বাড়ী থাকতে ভালো লাগেনা। মায়া কানন জাহানের ফুপির বাসা।
    – মায়া কানন কোন দিকে?
    – এখান থেকে বেশী দূরে না। উনারা সবাই কানাডা থাকেন, পুরো বাসা ভাড়া দেওয়া, এক ফুপাতো বোন আছেন এখানে। তাই, জাহান এই বাসার এক ফ্লোর ভাড়া নিতে বলছে। বড় বাসা, ভাড়া কম নিবে। ফুপাতো বোন আছে, অফিসে গেলেওবামি চিন্তা মুক্ত।
    – ভালো হয়েছে, নেও বাবা।
    – হ্যা, তিন বেড রুম, ডাইনিং – ড্রয়িং ও আছে। খোলামেলা বাসা। আর আইরিন ও মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। এইখান থেকে যাওয়া আসা করতে পারবে হলে।
    – বুঝেছি। যাক ভালো হয়েছে। বাবা, পলির বাসায় গিয়েছিলে?

    – মা, সময় কোথায়? আর তুমিও হুট করে ঢাকায় চলে এলে! এই শহরে আমি থেকে গিয়েছি, আমি জানি। কত ঝামেলার শহর, নাহিদ বাচ্চা ছেলে, ও কি বুঝে!
    – তিন জন ছেলে-মেয়ে পড়াশোনা করবে, আমি একা বাড়ী থেকে কি করবো?
    – কলি কি ভর্তি হয়েছে নাকি?
    – না, শাহিদ খোঁজ করেছে, ভর্তি দেরী আছে। খিলগাঁও কলেজে ভর্তির চেষ্টা করবে।
    – কি দরকার মা? আর শাহিদ কি পুরোপুরি দোকনেই চাকরি করছে?
    – ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছে, এখন সেকেন্ড ইয়ারে আছে, পড়ছে, চাকরি ও করছে। বাবা, বসো আমি ভাত বসাই।
    – না, মা। আমার এই বাসায় বেশ কিছু কাজ আছে। আমি আগামী মাসে উঠবো, এর আগে তো আসবোই, তখন খাবো। আজ শুধু তোমাকে দেখার জন্যএলাম।

    সাঈদ আরও ঘন্টা খানেক বসে চলে গেল। রাহেলা বেগম বলছেন তিন বেড রুমের বাসা, আমার ছেলে চিন্তা করেই নিচ্ছে। কারণ, নাহিদ-শাহিদ এক রুমে, আমি-তুই এক রুমে, বউমা এক রুমে।
    – কি যে বলো মা।
    – কি বলি?
    – ভাইজান কখনোই আমাদের জন্য বাসা নিবেনা।
    – চুপ কর, সব সময় বেশি বুঝিস।

    আবিদ আজ ছুটিতে এসেছে। পলির কেন যেন রুমে যেতেই খুব লজ্জা লাগছে। এতো দিন যার জন্য অপেক্ষা করছে, আজ সে এসেছে কিন্তু ভীষণ লজ্জা লাগছে।

    আবিদ বললো তোমার আজ কি হয়েছে?
    – কি হবে?
    – লজ্জায় লাল হয়ে আছ কেন?
    – না, কিসের লজ্জা। আম্মা ডাকছেন, খেতে আসো।

    পলি এই কথা বলেই দ্রুত রুম থেকে বেড়িয়ে এসে, খাবারের টেবিল ঠিক করছে।

    প্রফেসর সাহেব বললেন বউমা আগামী মাসে মাস্টার্সে ভর্তি হবে, সব কাগজপত্র গুছিয়ে রাখবে।
    – জি বাবা।
    – আবিদ কোথায়?
    – রুমে বাবা।
    – আমার খাওয়া শেষ, এখন ঘুমাবো। সকালে দেখা হবে।
    – জি।

    পলি ভাবছে কি রোবটিক এই মানুষ। ছেলে এতো দিন পর আসছে। তবুও ঘুমের সময়ের দেরী হয়ে যাবে, তাই দেখা করছেন না।

    পলি আবিদ কে খাওয়ার পর বললো আমাকে এইবার তোমার সাথে নিয়ে যাবে! এক কথায় শেষ।
    – পাগল হয়েছ?
    – হ্যা হয়েছি। আর মায়ের চিঠি পেয়েছি। তারা ঢাকায় বাসায় নিয়েছেন। যাওয়ার সময় মাকে দেখে যাবো।
    – আচ্ছা, মাকে দেখতে যাবো। মাছ বাজার করা বাকি আছে। তুমি কয়েকদিন ঢাকায় থাকবে। পরে নাহিদ তোমাকে বাসায় দিয়ে যাবে।
    – আমার এই বাসায় ভালো লাগেনা, বিশ্বাস কর।
    – মাস্টার্স পড়বেনা?
    – চট্টগ্রাম গিয়ে পড়বো।
    – আমি এক রুম নিয়ে মেসে থাকি।
    – আমি এই রুমেই থাকবো। কিন্তু, প্লিজ তুমি আমাকে এখানে রেখে যাবেনা।

    আবিদ অনেক বোঝানোর পর, পলি রাজী হলো সে এখন তার সাথে যাবেনা, কিন্তু ঢাকা গিয়ে কয়েকদিন থাকবে।

    রাতে নাহিদ-শাহিদ কে রাহেলা বেগম সব বললেন।

    নাহিদ বললো মা, ভাইজান কখনোই আমাদের জন্য বাসা নিবেনা, এটা আমি শিওর। আর নিলেও আমি থাকবো না।
    – আচ্ছা যা এখনো সামনে, তা নিয়ে কথা বলিস না। বড় ভাই বাপের সমান।
    – বাপের সমান কিন্তু বাপ না। আমি আর জিহান কখনোই এক হবো না, আর এটা হয় ও না।
    – রাত হয়েছে ঘুমা, কথা বেশি বলিস না।

    কলি বললো আমিও যাবোনা। এই বললাম।
    – তুই আর কথা বলিস না, ছোট ভাইয়ের সাথে ঘুমা।

    তিন দিন পর পলি আর আবিদ এসে উপস্থিত হলো বাসায়, আবিদ বড় বড় দুইটা কাতল মাছ নয়ে এসেছে বাসায়।

    রাহেলা বেগম বার বার বলছেন, বাবাজী কেন এই খরচ করতে গেলে বাবা? আর বাসাটা এতো ছোট্ট, কষ্ট করে থাকবে একটু।
    – সমস্যা নেই আম্মা। আর আমি আজ রাতেই রওনা হবো, পলি থাকবে।
    – তুমি থাকবেনা?
    – জি না। আমার কাল স্কুল ধরতে হবে গিয়ে।
    – আজকের রাত থাক।
    – অন্য সময়। এবার আর হবেনা।

    পলি আর কলি দুইবোন খুব হাসাহাসি করছে। পলি বলছে, নাহিদ কে আমার পক্ষ থেকে এক হাজার ফুলের শুভেচ্ছা এই ভালো কাজ করার জন্য।
    – বাসা অনেক ছোট।
    – থাক। ঠিকই আছে। আচ্ছা দেখি আবিদ মাস্টার কি করছে!

    আবিদ পলিকে ছাদের এক কোনে নিয়ে বললো, পলি আমি আম্মাকে বলেছি আজ রাতের ট্রেনে চট্টগ্রাম যাবো।
    – কেন? তুমি বলেছিলে, কাল দুপুরে যাবে।
    – বাসাটা অনেক ছোট, তাছাড়া আজ গেলে, কাল সারাদিন রেস্ট নিয়ে সন্ধ্যায় টিউশনি গুলিতে যেতে পারবো।
    – এটা কোন কথা?
    – আগামী মাসে আসবো। কিন্তু তুমি আম্মার সামনে আবার থাকার জন্য বলবেনা।
    – হুম।
    – মন খারাপ?
    – না।
    – আমি আগামী মাসে এক সপ্তাহের ছুটিতে আসবো।
    – মিথ্যা আশ্বাস এক দম দিবেনা।

    পলি সাথে সাথে ঘুরে ঘরের দিকে রওনা হলো, সত্যি এই বাসাটা অনেক ছোট, আবিদ থাকবে কোথায়? কত্তদিন পর সবার সাথে দেখা ভালো লাগছে, আবার আবিদ আজ চলে যাবে, এটা ভেবেই মন প্রচন্ড খারাপ লাগছে।

    নাহিদ কে বাড়ীওয়ালা ডেকে বললেন বাবাজী, তোমার বড় ভাই ল্যান্ড লাইনে কল দিয়েছেন, তুমি আসো।
    – জি চাচা আসছি।

    আসসালামু আলাইকুম ভাইজান
    – আগামী কাল, ঢাকায় আসছি, সব কিছু নিয়ে। তুই আর শাহিদ বাসায় থাকিস। ঠিক সকাল আট্টায় মায়াকানন দুই নম্বর গলির ১২ নম্বর বাসার সামনে থাকবি। আমি কাল মালামাল নিয়ে আসছি৷ আগামী এক তারিখ তোর ভাবীকে নিয়ে আসবো। মাকে নিয়ে আসিস, বাসা দেখে যাবে।
    – জি ভাইজান।
    – সবাই ভালো আছে।
    – জি।
    – রাখছি, এখন।

    রাহেলা বেগম বললেন ঠিকই আমার ছেলে আমাদের সহ বাসা দেখেছে, এজন্য বলেছে আমাকে নিয়ে যেতে।

    পলি বললো মা তুমি যা ভাবছো তা সত্য হবেনা। যাই হউক্, থাক সেসব আলোচনা। তোমার জামাইয়ের সামনে ভাইজান মহান আছেন, তাই থাকুন।

    নাহিদ জানে, মা শুধু শুধু কষ্ট পাবেন। মা কত্ত দিন ছেলেকে আদর করতে পারেন না, সেজন্য ছেলের কাছাকাছি থাকতে এতো আকুতি, নাতিকে আদর করতে ভালবাসতে মন খুব চায়, কিন্তু দূরে থাকায় পারেন না। কিন্তু ভাইজান ভুলেও সবাইকে নিয়ে বাসায় উঠবেনা। আর সে নিজেও কখনো থাকবেনা, দেখা যাক কাল কি হয়, আপাতত দুলাভাই কে সময় দেওয়া যাক…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ৩০.০১.২০২২

  • মৃন্ময়ী (পর্ব-৩)

    মৃন্ময়ী (পর্ব-৩)

    অবশেষে মোটামুটি একটা রুম,এটাস্ট বাথ সম বাসা খুঁজে পেল। তবে বাড়িওয়ালা নাছোড়বান্দা। তিন মাসের বাড়া অগ্রিম নিয়ে নিল। মৃন্ময়ীর এই বাসাটা সব দিক দিয়ে ভালো মনে হয়েছিল।পাঁচ মিনিট হাঁটলেই বড় রাস্তা। তাই ঝামেলায় না গিয়ে বাসাটা নিয়েই ফেলল।বাসার জন্য কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে গিয়ে ও বেশ কিছু টাকা খরচ করে ফেলতে হয়েছে। বাসায় থিথু হওয়ার পর একটা চাকরি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন অফিসে ধর্ণা দিতে লাগলো। কিন্তু সবখানে নো ভেকেন্সি কার্ড ঝুলানো দেখতে দেখতে যখন মৃন্ময়ী মনের দিক থেকে ভেঙে পড়ছিল তখন হঠাৎ করে এক গার্মেন্টস থেকে তার ডাক আসল।অনেক জায়গায় মৃন্ময়ী চাকরির দরখাস্ত দিয়ে রেখেছিল।তাই খবর পাওয়ার সাথে সাথে মৃন্ময়ী সে গার্মেন্টস এ যেতে সময় ব্যয় করল না।

    গার্মেন্টস এ পৌঁছে মৃন্ময়ী নিজের নাম ঠিকানা পিয়নের মারফত অফিসের ভিতর পাঠিয়ে দিল।কিছুক্ষণ পরেই ভিতর থেকে মৃন্ময়ীর ডাক আসল।দুরুদুরু মনে মৃন্ময়ী যখন রুমে ঢুকল তখন দেখল সৌম্য চেহারার এক প্রৌঢ ভদ্রলোক চেয়ারে বসে আছে। কিছু কিছু লোক আছে পৃথিবীতে প্রথম দেখাতেই অনেক আপন এবং শ্রদ্ধা লাগে চেয়ারে বসে থাকা সে ভদ্রলোক ও তদ্রূপ। উনাকে দেখেই মৃন্ময়ীর ভালো লেগে গিয়েছিল।আর ভদ্রলোক ও প্রথমেই মা বলে সম্বোধন করে জিজ্ঞেস করল পড়াশোনা কতদূর করেছে।যদিও দরখাস্তে লেখা ছিল তবু্ও তিনি জিজ্ঞেস করলেন পড়াশোনার কথা। কারণ উনার ও মৃন্ময়ীর শান্ত সুন্দর বিচক্ষণতার চেহারা দেখতে পেয়ে মৃন্ময়ী কে উনার গার্মেন্টস এর সেক্রেটারি পদটা দেওয়ার আগ্রহ দেখালেন।সাথে সাথে এও বলে দিলেন কঠোর শ্রম দিতে হবে ফ্লোরের কাজ আনুষঙ্গিক অনেক কিছু একসাথে দেখতে হবে উনার সেক্রেটারি হিসেবে। বেতন ও মোটামুটি দেওয়া হবে।

    অনেক ভোরে উঠার অভ্যাস ছিল মৃন্ময়ীর।আজও তার ব্যতিক্রম হলো না।যদিও জাহাজে তার ভালো ঘুম হয়নি তবু ও সূর্য উঠার আগেই মৃন্ময়ীর ঘুম ভেংগে গিয়েছিল। জাহাজে ভালো কেবিন পাওয়ার জন্য ও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল।কারণ যখন মৃন্ময়ী গ্রামের বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তখন দু দিনের মধ্যে কেবিন পাওয়া মুশকিল ছিল।কিন্তু জাহাজের নিয়ম অনুযায়ী কিছু ভি আই পি কেবিন রেখে দেওয়া হয় ভি আই পি দের জন্য।তাই সেদিন মৃন্ময়ী নিজের পরিচয় যখন দিল জাহাজের ম্যানেজার তৎক্ষনাত মৃন্ময়ীর জন্য এই কেবিন বুক করে পাশে লিখে রেখেছিলেন মৃন্ময়ীর পূর্ণ পরিচয়।তাই তো চেকার সে সময় মৃন্ময়ী কে দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়ে কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। অবশ্য মৃন্ময়ী একসময় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিল ভি আই পি মর্যাদায়।

    সেদিন যদি দৃঢ প্রত্যয় এ গার্মেন্টস এর চাকরি টা না নিত আজকের এই পজিশনে মৃন্ময়ী কোনদিন ও আসতে পারতো না।গার্মেন্টস এ যোগদানের পরদিন থেকে নতুন এক জীবন শুরু হলো মৃন্ময়ীর জীবনে।সেদিনের পর থেকে অবশ্য আর পিছন ফিরে থাকাতে হয়নি মৃন্ময়ী কে। একের পর এক সিঁড়ি ভেঙে মৃন্ময়ী উপরের দিকে উঠছিল।এর মধ্যে কঠোর অধ্যাবসায় করে রাতের সিফটে লেখাপড়া করে সে মাস্টার্স ও কমপ্লিট করে ফেলেছিল।আর গার্মেন্টস এর সে সৌম্য শান্ত মালিক হাতে কলমে মৃন্ময়ী কে গার্মেন্টস এর সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে গড়ে তুলছিল একদিন যেন সে সফলতা পেতে পারে। এর মধ্যে অবশ্য মৃন্ময়ীর জীবনের কষ্ট কর কাহিনি তিনি ধীরে ধীরে জেনে গিয়েছিলেন। সেই থেকে তিনি মৃন্ময়ীকে নিজের মেয়ের মতো দেখতে শুরু করলেন।অবশ্য এর পিছনে ও কারণ ছিল।ভদ্রলোক এর একটা সাজানো পরিবার ছিল।যেখানে এক কন্যা এক ছেলে আর শান্ত শিষ্ট স্ত্রী নিয়ে সুখীই ছিলেন।কিন্তু উনার কপালে সে সুখ চিরস্থায়ী হলো না।একদিন সবাই যখন উইকেন্ডে বেড়াতে বের হলেন পথে বড় রকমের অ্যাকসিডেন্ট এ উনি সবাই কে হারালেন।

    এরপর পুরো এক বছর উনি মেন্টালি আপসেট ছিলেন। সময় একদিন মানুষের শোক ভুলিয়ে দেয়। উনিও ধীরে ধীরে কাজের মধ্যে ডুবে থেকে নিজের কষ্টের কথা ভুলে যেতে লাগলেন।ফলে দিনে দিনে উনার গার্মেন্টস ব্যাবসা অনেক বড় আকার ধারণ করল। এর মধ্যে তিনি মৃন্ময়ীর মাঝে নিজের মেয়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলেন।
    কখন যে মৃন্ময়ী ও ভদ্রলোক কে নিজের পিতার আসনে বসিয়ে ফেলেছে টের পায়নি।দিনে দিনে দুজনের মধ্যে পিতা কন্যার সম্পর্ক তৈরি হলো।

    এভাবে বেশ ভালো ভাবেই মৃন্ময়ীর জীবনটা ধীর গতিতে চলে যাচ্ছিল।অবসরে রজতের কথা মনে আসলেও সে মাথা থেকে রজতের চিন্তা ফেলে দেয়।কারণ রজত এখন সংসারী হয়েছে।এক ছেলের পিতা হয়েছে। অবশ্য মৃন্ময়ী এত কিছু জানত না যদি না সেদিন রজত মৃন্ময়ীর কাছে এসে কান্নাকাটি না করত।রজত ভুল করে ফেলেছে বলে বারবার ইনিয়ে বিনিয়ে মৃন্ময়ী কে বুঝাতে চাইল।পুরাতন সম্পর্ক টাকে আবার নতুন করে পেতে চাইল রজত।কিন্তু মৃন্ময়ী কঠিন স্বরে বলে দিল রজত যেন আর কোনদিন তার কাছে না আসে।রজতের এখন বউ বাচ্ছা আছে মৃন্ময়ী অন্য একটা মেয়ের সংসার ভাংতে পারে না।তাই দৃঢ স্বরে রজত কে যখন বকা দিল তখন রজত মৃন্ময়ী এর এই রূপ দেখে ভয় পেয়ে গেল।কারন শান্ত শিষ্ট মেয়েটি এখন আর আগের মতো নেই।তার মধ্যে শান্ত স্বভাবের সাথে ব্যাক্তিত্ব যোগ হয়েছে।কথা বার্তায় চলনে বলনে আভিজাত্যের ছাপ পড়েছে। তাই রজত মৃন্ময়ীর এই রূপ দেখে কিছু বলার সাহস না পেয়ে ফিরে গেল।যদিও মৃন্ময়ী এখন ও রজত কে ভুলতে পারেনি তবু্ও কঠিন ভাবে সে নিষেধ করে দিল আর কোনদিন যেন রজত মৃন্ময়ীর সাথে দেখা করতে না আসে।

    না আর কোন দিন রজত মৃন্ময়ী মুখোমুখি হয়নি।এমনি করে আজ মৃন্ময়ীর জীবন থেকে আপন মানুষ ছাড়া পঁচিশ টা বছর চলে গেল।দেখতে শুনতে মৃন্ময়ী এখনো অনেক যুবকের রাতের ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো সুন্দরতা মৃন্ময়ীর মাঝে এখন অব্দি আছে কিন্তু মৃন্ময়ী সংসারের ভিতরে নিজেকে আর জড়াতে চাইল না।

    মনে পড়ে যাচ্ছে মৃন্ময়ীর সেই দুর্যোগের কথা। হঠাৎ করে সে রাতে যখন বুকে প্রচন্ড ব্যাথা নিয়ে মৃন্ময়ীর মালিক ধর্মপিতা হসপিটালের বেডে ছটপট করছিল তখন তাকে বাঁচাতে কি যুদ্ধই না করেছিল ডাক্তার আর মৃন্ময়ী মিলে।পুরো পনের দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করে মৃন্ময়ী তার ধর্মপিতা কে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনল। পুরোপুরি ভালো হতে প্রায় দু মাস লেগেছিল।

    চলবে…