Tag: গল্প

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৯)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (৯)
    সেলিমের জামিন হয়েছে। তবে দেখা দিয়েছে আরেক সমস্যা। জামিন পেয়ে সে কোথায় গিয়ে উঠবে? বড় মামার কড়া হুকুম আমাদের বাসায় না। মান-ইজ্জত যা গেছে সেটুকুই যথেষ্ট। নতুন করে সবার কাছে আর পরিহাসের পাত্র হওয়ার দরকার নেই। আম্মারও তাই মত। মলি ভোট দানে বিরত। আমার কাছে মনে হলো জামিন পেয়ে একবারের জন্য হলেও বাসায় যাওয়া উচিত। অন্তত তাতে আমাদের আশেপাশের আর অন্য ফ্ল্যাটবাসীদের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মাবে যে হয়রানীমূলক বা ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তাকে ফাঁসানো হয়েছিলো। বড় মামা একথা শুনে আমার মুন্ডুপাত করতে চাচ্ছে। ছোট মামা তাকে বুঝালেন। সেলিম জামিনে মুক্ত হয়ে বাসায় এলো। এসেই মলির রুমে গিয়ে সটান শোয়া দিলো। কোথায় সে আমাদের কাছে ক্ষমা চাইবে, কান্নাকাটি করবে, অপরাধ স্বীকার করে আর করবেনা মর্মে মুচলেকা টাইপের কিছু একটা বলবে। কিন্তু এর কোনটাই করেনি। উল্টো তার হাবভাব এমন যে আমরাই অপরাধী। মাথায় রক্ত উঠে যায়। কিন্তু কিছু করার বা বলার উপায় নেই। তার নিজ বাড়ীতে যাবারও কোন উদ্যোগ নেই। মলিরও এ নিয়ে কোন মাথাব্যাথা আছে বলে মনে হলো না। ভাবটা এমন যে সোনার টুকরো পিতলা ঘুঘু হাত ছাড়া হয়ে যাবে। এখানেই সেলিমদের তেলেসমাতি। ওরা জানে কোনটা কার উইকনেস আর কোনটা স্ট্রেংথ। ফোন দিয়ে বললাম, “এখন কি করবা”?
    — জানিনা। তার সংক্ষিপ্ততম উত্তর।
    — কেন?
    — মাথা কাজ করে না
    — আস্তে আস্তে চিন্তাভাবনা শুরু করো।
    — জ্বী
    — বাড়ী যাবা না?
    — ইচ্ছে নাই
    — কেন?
    — ফ্যামিলি প্রেস্টিজের ব্যাপার
    — আমাদের এখানেও তো একই ব্যাপার
    — তাহলে অন্য কোথাও চলে যাবো।
    — আমি কি তাই বলেছি?
    — বেশিদিন শ্বশুর বাড়ি থাকা ঠিক না।
    — মলি কি বলে?
    — সে কি বলবে? দোষ তো আমার।
    — তাহলে তার মুখের দিকে চেয়ে কিছু করো
    — জানিনা।
    এরকম জেগে ঘুমানো ছেলেকে আর কি বলা যায়? আম্মাকে বললাম। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শুধু। আর বললেন তাকে কিছু না বলতে। মলি মাইন্ড করে।

    মিটিং আর ওরিয়েন্টেশন কোর্সে যোগ দিতে ঢাকায় এসেছি। আমি আসবো শুনে সেলিম চুল কাটার নাম করে উধাও। আবারো মহা যন্ত্রণায় পড়া গেলো তাকে নিয়ে। এদিকে মলি আমার উপর মহা ক্ষ্যাপা। সেলিমের সাথে আমার ফোনালাপ মলিকে বলে দিয়েছে সে। অনুমান করছি যতটা না অপব্যাখ্যা করেছে সে, তার চেয়ে বেশি বদ অনুমান করে নিয়েছে মলি নিজে। সকালে অফিসে যাই। ফিরতে ফিরতে সেই রাত। সেলিমের পাত্তা নেই। মলিও জানেনা কোথায়। বাসার পরিস্থিতি সেই আগের মত। মলির রুম বন্ধ। খায় তো খায় না। রুমের বাইরে আসে তো আসেনা। কথা বললে উত্তর দেয় তো দেয় না। কি যে একটা বিদঘুটে অবস্থা। আম্মার অবস্থা আরো খারাপ। বড় মামা বেজায় বিরক্ত। সিরাজগঞ্জের বন্ধুর কাছে খবর নেওয়া হয়েছে। সেখানে যায় নি। ওদের বাসায় খবর নেওয়া হয়েছে। সেখানেও যায় নি। খবর দিয়েও হয়েছে আরেক ঝামেলা। ছেলের জন্য যেন তাদের দরদ এতদিনে উথলে উঠেছে। পুনরায় নিখোঁজ সংবাদে তাদের মাতম শুরু হয়ে গেছে। একদিন জানা গেলো যাত্রা বাড়ীতে তাদের এক দুঃসম্পর্কীয় দুলা ভাইয়ের ওখানে গিয়ে ঘাটি গেড়েছে। তারাও ত্যক্ত। বিজনেস করবে তাই টাকা চাচ্ছে। অনুমান করতে অসুবিধে হলো না যে, এ ছাড়া তার বিকল্প কোন পথ খোলাও নাই। অবশেষে অনেক বলে কয়ে তাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে।

    কয়দিন যাবত শরীর খুব খারাপ। দুর্বল আর খাবার রুচি কমে গেছে। শরীরের সাথে মনের যোগাযোগ যে কত নিবিড় তা অসুস্থ না হলে বুঝা যায়না। বিশেষত রাতে অসহ্য লাগে। মনে থেকে থেকে যতসব অলুক্ষণে কথা এসে হাজির হয়। শুধু হাজিরই হয়না। সম্ভাব্য অশুভ পরিণতিও দেখাতে থাকে। এর মাত্রা আরো বাড়ে যখন চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যাও। স্থানীয় ডাক্তার দেখিয়েছি। বললেন, কিছুনা। টেনশন কাজ করছে তাই এমন হয়েছে। বললেন, “এই বয়সে এত টেনশন কিসের? খাবেন-দাবেন আর ঘুড়ে বেড়াবেন। চাকরি তো ভালই করেন। বিয়েশাদি করে ফেলেন”। আব্বার কথা মনে পড়লো। ছোট বেলাতে দেখেছি কারো খেতে ইচ্ছে না করলে তিনি ধরেই নিতেন, বাথরুম ক্লিয়ার হয়নি। কোষ্ঠকাঠিন্যের লক্ষ্মণ। কখনো কখনো তাঁর কথা সত্যিও হত। আবার কখনো ক্লিনিক্যাল টেস্টে অন্য কিছু ধরা পড়ত। আর এখন আমার কাছে মনে হচ্ছে পৃথিবীতে মাদার অফ অল ডিজিসেস হলো এই টেনশন। ডাক্তাররাও এটা ধরে নিয়ে ব্যবস্থাপত্র লিখে থাকেন। আর রোগী যদি তরুণ বয়সের হয় তাহলে তো অবধারিত ভাবে সন্দেহের তীর এফেয়ারস আর এতদসংক্রান্ত টানাপোড়েনের উপর গিয়ে পড়বে। কি ভেবে যেন ডাক্তার মৃদু হাসলেন। কথা যে বেশ খানিকটা সত্য তা উপলব্ধি করে ঢোক গিললাম। কি কি সব ওষুধ দিলেন। সাথে মাসল রিল্যাক্স ও টেনশন রিলিফের ওষুধও। বললেন, “আপনার ঘুম দরকার। এগুলো খান। ভাল ঘুম হলেই ঠিক হয়ে যাবে”। সেই ঘুম আর আসেনা। একেবারে ভোরের দিকে শরীর ক্লান্ত হয়ে নার্ভ যখন আর কুলিয়ে উঠতে পারেনা তখন ঘুম আসে। ছুটির দিন হলে অসুবিধে হয়না। কিন্তু অফিস দিনে হয় বিপত্তি।

    আমাদের বাল্যবন্ধু লালনের জিএফ সম্পর্ক কাট অফ করে দিয়েছে। তৌহিদের কাছে জানলাম, তার অন্যত্র বাগদান হয়ে গেছে। ছেলে আমেরিকায় থাকে। কি করে জানিনা। পারিবারিক পর্যায়েই এই ব্যবস্থা হয়েছে। লালনকে ফোন দিতে স্বস্তি পাচ্ছিনা। বুঝতে পারি তার বুকের ভেতরের দহন জ্বালা কত তীব্র! অথচ তাদের রিলেশন আমাদের ফ্রেন্ড সার্কেলে সৌরভ ছড়াতো। মানব-মানবীর মধ্যেকার সম্পর্ক অনেক ভেরিয়েবলস এর উপর ভর করে এগোয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই প্রেম-ভালোবাসায় অনেক বাধার চিত্র পাওয়া যায়। ব্যাক্তি স্বাধীনতার এযুগে প্রেম আজকাল সামাজিক আর পারিবারিক ভাবে অনেকটাই স্বীকৃত। এই রিলেশন নিয়ে অনেক কথা চালু আছে। ফেবু পেইজে কেউ “ইন এ রিলেশন” সেঁটে দিচ্ছে। কেউ কনফিজড হয়ে লিখছে “ইন এ কমপ্লিকেটেড রিলেশন”। আজকাল ভালবাসা প্রমান সাপেক্ষ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কথায় কথায় প্রমিজ করা আর ভাঙ্গা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। বাসা বাড়ীতে কারেন্টের সুইচও এত অন অফ করতে হয়না যতটা ব্রেক আপ আর ব্লক ব্লক অনুশাসন চলে। আস্থার অগ্নি পরীক্ষা দিতে তাই উভয়ের পাসওয়ার্ড উভয়ের করতলগত থাকে। তাই ফেবু জুড়ে সচিত্র প্রেমের উদগীরণ দৃশ্যমান। আসল আর মেকির এই ভেল্কি দুর্বোধ্য ও অসহনীয়।

    লালনের জন্য মন কেমন যেন করছে। তৌহিদকে বললাম ওকে এখানে নিয়ে আসতে। প্রাকৃতিক এই নিসর্গে ভাল লাগবে।

    এমন সময় আম্মার ফোন। বাসায় কুরুক্ষেত্র অবস্থা। ভোরে সেলিমের সাথে মলির তুমুল কথা কাটাকাটি। দরোজা বন্ধ। ডাকাডাকি করলেও দরোজা কেউ খুলছে না। এই কিছুক্ষণ আগে মুখের উপর ব্যাগ ছুড়ে মেলে বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছে মলি। সেলিমও ত্যাড়ামো করে সেই ব্যাগ সম্বল করে ঝটিকা বেগে বেরিয়ে গেছে। কেন এই অবস্থা বিস্তারিত জানা না গেলেও আম্মা যতটুকু জেনেছে সে মলির কাছে টাকা চেয়েছে। অথবা গয়না। বিদেশ যাবে। মলি নাকচ করে দিয়ে বলেছে তাকে ওদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে রাখতে। সেখানেই টুকটাক কিছু করতে। আব্বার অবর্তমানে আম্মাই আমাদেরকে মানুষ করেছে এতকাল। তার শরীর যথেষ্ট খারাপ। তারচেয়ে আরো খারাপ তার মানসিক অবস্থা। পৃথিবীতে সুখের সংবাদ কমে যাচ্ছে দিনে দিনে। পেরেশানির যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে মানুষ ভুলে যাচ্ছে তার সুখের স্মৃতিগুলো। কয়েকদিন আগে পেপারে দেখলাম দেশে মানসিক রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক ভাবে দ্রুত বাড়ছে। আমাকে দেওয়া ডাক্তারের ওষুধগুলোর বেশির ভাগই নার্ভ রিলাকসেশন ও নিউরো ধাঁচের। তাহলে কি আমিও সেপথে এগোচ্ছি?

    চলবে…

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৭)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৭)

    ভোর চার টার দিকে, ফুটফুটে এক ছেলের জন্ম হলো জলির। ছেলেকে পাশে নিয়ে শুয়ে আছে সে। সিজার ছাড়াই, নরমাল ডেলিভারি হয়েছে।

    রাহেলা বেগম মেয়ের মাথার পাশে বসে আছেন, গাইনি ওয়ার্ডে গিজগিজ করছে মানুষ। যত সময় যাচ্ছে ততোই মানুষ বাড়ছে।

    জলির চোখে-মুখে এখনো ক্লান্তির ছাপ! জলি ছেলেকে হাতে শুইয়ে রেখেছে। জলি মাকে বললো মা, আমি বাসায় কখন যাবো?
    – বাবু হয়েছে মাত্র কয়েক ঘন্টা হয়েছে, এখন বাসায় যাবি কেন? ডাক্তার এসে বলবেন কি করা যায়!
    – আমার এখানে একদম ভালো লাগছেনা মা! এতো গন্ধ, আর মানুষ লজ্জা লাগছে!
    – কি করবি! কিচ্ছু করার নাই। তুই তবুও সিট পেয়েছিস, দেখ, কত মানুষ নিচে শুয়ে আছে।
    – মা, আমার ছেলে কার মতো হয়েছে?
    – আমার নানুভাই খুব সুন্দর হয়েছে। আরো সময় গেলে বুঝা যাবে, এখন প্রতিদিন কত চেহারা বদল হবে!
    – হুম, মা, নাহিদ কি এখনো হাসপাতালের বাইরে?
    – হ্যা। আছে বাইরে। ভিজিটিং আওয়ারের সময় আসবে। ভাগ্নে কোলে নিয়ে কি খুশি! মামা হয়েছে প্রথমবার!

    জলির বেশ লজ্জা লাগছে! জলি এক দৃষ্টিতে ঘুমন্ত রাজপুত্রের দিকে তাকিয়ে আছে!

    কলির সারারাত এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি। বাড়ীওয়ালা নিজের ছোট দুটি মেয়েকে কলির পাশে থাকার জন্য দিয়েছেন। কলির বার বার মনে হচ্ছে কি যে হচ্ছে, কে জানে! ভোর হওয়ার পরে, কলি ছাদে দাঁড়িয়ে আছে, শুধু নিচের দিকে দেখছে কেউ আসছে কিনা! রান্না করবে কিনা! বুঝতে পারছে না। সেও রাতে কিছুই খায়নি! রান্না ও করেনি। কিন্তু চিন্তায় খেতেও ইচ্ছে করছেনা।

    বিকাল চার টার দিকে এক ব্যাবি ট্যাক্সি করে জলিকে নিয়ে বাসায় এলেন রাহেলা বেগম। জলি চার তলায় উঠতে পারছেনা। এক তলায় উঠার পরে, আর কোন ভাবেই পারছেনা। পরে বাড়ীওয়ালা তার কাঠের হাতলওয়ালা চেয়ার বের করে দিলেন। নাহিদ আর কলি মিলে বোনকে উপরে তুললো।

    কলি, বোনের ছেলে কে নিয়ে খুব আদর করছে। শুধু বলছে কেন চাচার নাম্বারে কল দিলেনা! বাইরে কি ফোনের দোকান নেই? সারারাত সারাদিন কত চিন্তা করেছি।
    – আমার মুখস্থ নেই নাম্বার, এদিকে মা আর আপাকে রেখে বাসায় আসবো, সেই অবস্থায় ও নেই। দুলাভাইকে কল দিয়েছিলেআর?
    – একবার দিয়েছিলাম, কিন্তু কেউ ধরেনি!
    – এখন, আমি দোকানে গিয়ে দিচ্ছি! আর আসতে সময় বাবুর জন্য জামা নিয়ে আসবো।
    – মেজ ভাই জানে?
    – এখন কল দিব গিয়ে।

    কলি বললো, মা ভাইজান কোথায়?
    – অফিসে এখন।
    – কাল রাতে কতক্ষণ ছিল?
    – দশটা পর্যন্ত ছিল, পরে ডাক্তার বললো অবস্থা ভালো ডেলিভারি হয়ে যাবে, এজন্য চলে গিয়েছে।
    – ওহ!
    – বউ একা বাসায়, আইরিন বাড়ীতে।
    – আজকে সকালে একবার এসে দেখে গিয়েছে।
    – মা, বিল কত আসছে!
    – সরকারি হাসপাতালে আর কত আসবে! ঔষধের টাকা লেগেছে। আল্লাহ, কতবার সুবাহানআল্লাহ পড়ে পড়ে সারা রাস্তা গিয়েছি। যদি সিজার লাগতো! আল্লাহর অশেষ রহমত।
    – হ্যা, ঠিকই বলেছো। কি করলেন ভাইজান এটা?
    – থাক, যা হওয়ার হয়েছে। তার বিবেচনা যেমন, তেমন কাজ করেছে। তুই গরম পানি দে, গোসল করি, গা ঘিন ঘিন করছে। আল্লাহ, কেউ যেন এই নোংড়া ওয়ার্ডে কাউকে না নেয়।

    সন্ধ্যার কিছু পরে বাড়ীওয়ালা একসেট জামা নিয়ে, বাচ্চাকে দেখতে এসেছেন। জলির খুব আনন্দ লাগছে নতুন জামা দেখে। গতরাতে জামা কেনার সময় ছিলনা। আর হাসাপাতাল থেকে আসতে সময়, নাহিদ বলেছে সে বের হয়ে গিয়ে নিয়ে আসবে, এখন গাড়ি থামিয়ে জামা কেনার সরকার নাই। তাই নতুন জামা পেয়ে খুব খুশি জলি।

    বাড়ীওয়ালা যাওয়ার পর পরই জলি মাকে বলছে, মা আমার ছেলেকে নতুন জামা পরিয়ে দাও।
    – না ধুয়ে?
    – সমস্যা নাই, নাহিদ কোন রাতে আসে কে জানে!
    – দশটার ভিতরে চলে আসবে, চিন্তা করিস না।
    – না, পরিয়ে দাও। আমার যে কি আনন্দ লাগছে, আমার ছেলে হয়েছে।
    – দোয়া কর যেন বুদ্ধি বিবেচনার ভালো মানুষ হয়, আমি রান্নাঘরে যাই, তুই একটু চোখ বন্ধ করে থাক।

    দরজার কড়ার শব্দে রাহেলা বেগম দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখেন সাঈদ-শারমিন দাঁড়িয়ে আছে।

    রাহেলা বেগম বেশ চমকে উঠেছেন কারণ এতো দিন
    হয়েছে ঢাকায় এসেছে, একবার ও শারমিন এ বাসায় আসেন নি।

    আসসালামু আলাইকুম।
    – ওয়ালাইকুম আসসালাম। আসো বউমা।
    – জি।

    শারমিম চারপাশ ভালো করে দেখছে! জলির পাশে গিয়ে দাঁড়ালো শারমিন। কেমন আছ জলি?
    – ভালো আছি ভাবী৷ যাক, ভাগ্য ভালো ভাবীর সাথে দেখা হয়ে গেল। আব্বাজান কোথায়?
    – ঘুমে, ফুপির কাছে রেখে এসেছি। এই সিনথেটিক জামা কে দিয়েছে?
    – বাড়ীওয়ালা আংকেল।
    – তুমি কিচ্ছু কিনলেনা কেন?
    – আরও দেরী ছিল, বাবু হওয়ার।
    – আমার জিহান কে কখনো আমি সুতি ছাড়া কিচ্ছু পরাই না। তা, তোমার জামাই কোথায়?
    – খবর পায় নাই।
    – এখন ফোন ছাড়া কেউ থাকে!
    – জিহান বাবাকে একদিন এখানে নিয়ে এসো ভাবী।
    – হ্যা, দেখি! তুমি সুস্থ হলে, একটু ঘুরে এসো।
    – আমার ইচ্ছা ছিল, তোমার বাসায় উঠবো, কিন্তু..
    – জিহান কি দুষ্টু! ওর পিছনেই সব সময় শেষ।
    – হ্যা, তোমার তিন জন মানুষের জন্য বড় বাসা দরকার।
    – কি?
    – না, বলেছি জিহানের দুষ্টুমির জন্য জায়গা দরকার।

    শারমিন গিয়ে ফ্রিজের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, সাঈদ আম্মা ফ্রিজ ও কিনেছেন নাকি? নাহিদের ভালো ইবকাম তাহলে!
    – হুম।

    আম্মা, একটা ভালো বাসা নিতেন, এতো ছোট বাসায় এতো মানুষ থাকেন কেম্নে! ছাদের সাথে বাড়ী!
    – আমাদের হয়ে যায় বউমা!
    – গাদাগাদি করে?
    – যদি হয় সুজন, তেঁতুল পাতায় নয়জন।

    এই কলি, একটু গুছিয়ে রাখবে ঘর, তোমার আর কাজ কি!
    – আমাদের কি তোমার মতো বড় ঘর! যা আছে তাই আর কি সুন্দর করবো?
    – ভালো দুইটা পর্দা লাগিও।
    – আচ্ছা!

    রাহেলা বেগম সাঈদ কে ডেকে নিয়ে গেলেন, ছাদের কোনায়, বললেন, বাবা একটু এদিকে আসো।
    – কি?
    – তুমি ফ্রিজ টা নিয়ে যাও। এটা, আমার দরকার নাই।
    – চারতলা থেকে নামাতেই অনেক টাকা চায় মিস্ত্রিরা!
    – নাহিদ-শাহিদ নামিয়ে দেবে, সমস্যা নাই।
    – হুম, হাসপাতালে আর টাকা লেগেছিল।
    – আল্লাহর অশেষ রহমত কারো টাকাই লাগেনি। আল্লাহ গরীবের দুঃখ বুঝেন।
    – জলির জামাই পুরাই স্টুপিড, কি সুন্দর বউকে অন্যের ঘাড়ে রেখে হাওয়া।
    – সে যে টাকা রেখে গিয়েছিল, তাতেই হয়ে গেছে বাবা।
    – যদি লাগতো!
    – যদি নিয়ে চিন্তা করার দরকার নাই।
    – তুমি কে রেগে আছ নাকি?
    – আল্লাহ কবেই আমার রাগ সব পানি করেছেন, রাগ ও নাই দুঃখ নাই, আছি আলহামদুলিল্লাহ! ফ্রিজ নিয়ে যেও বাবা। আর কিচ্ছু বলার নাই, এজন্য ডেকেছিলাম।
    – বেতন পেয়ে ওকে কিছু দিব, এখন হাত খালি।
    – সমস্যা নাই।

    রাহেলা বেগমের গতরাতের দুঃখ এখনো যায়নি, কেমন করে টাকার কথা বলেছিল সাঈদ, তা তিনি ভুলতে পারছেন না।

    রাতের বেলা নাহিদ দুই সেট জামা, আর কিছু দরকারী জিনিস পত্র নিয়ে এলো ভাগ্নার জন্য। বেতন পায়নি, কিন্তু বন্ধুর কাছ থেকে ধার করে এনেছে। ভাগ্না কি খালি গায়ে থাকবে নাকি! এনেই সব একটা একটা করে, জলিকে দেখাচ্ছে।

    কলি বললো এই নাহিদ বাবুর বড় মামি এসেছিলেন, বলে গিয়েছেন সিনথেটিক কাপড় না পরাতে, কিন্তু তিনি সুতি কিংবা সিনথেটিক কিছুই নিয়ে আসেন নি, এসেছেন শুধু জ্ঞান বিতরণ করতে।
    – এছাড়া আর তিনি পারেন কি! দুলাভাইয়ের এই ভাই বাড়ীতে গিয়ে জানাবেন, বলেছেন।
    – ফোন ধরেনা কেন এই লোক?
    -সে নাকি বাইরে ছিল দুদিন।
    – এজন্য ফোন ধরবেনা! অদ্ভুত মানুষ।

    পরের দিন কাঁথা বালিশ, কোল বালিশ, মশারি বাচ্চার জামা, শার্ট, দুটি খেলনা, জলির জন্য একটা সুতির লাল শাড়ি, পাঁচ কেজী মিষ্টি নিয়ে হাজির জলির জামাই, সাথে তার মামাতো ভাই রবিন।

    এসেই ছেলেকে কোলে নিয়ে শুধু মিটি মিটি হাসছে। কপালে বার বার চুমু দিচ্ছে।

    কলি বলছে, দুলাভাই মিষ্টি খাওয়ালে হবেনা, চাইনিজ খেতে চাই।
    – ইনশাআল্লাহ

    জলি সাথে সাথে বলছে, তোর দুলাভাইয়ের কি সেই অবস্থা আছে! এতো মিষ্টি কেন এনেছে কে জানে।

    রাহেলা বেগম হাসছেন, জলি সব সময় সহজ-সরল রয়ে গেল, শালি যে, দুলাভাইয়ের সাথে একটু মজা করছে, সেটা বুঝতে পারছেনা। তবে, জামাই সত্যি তার মেয়েকে ভালবাসে, সামান্য ইনকাম তার মধ্যে থেকে বউয়ের জন্য একটা শাড়িও নিয়ে এসেছে।

    জামাই, শ্বাশুড়িকে বলছে আম্মা, আমাকে মাফ করবেন, আমি সময় মতো আসতে পারিনি।
    – না বাবা, তুমি তো আর ইচ্ছে করে দেরি করনি।
    – খবর পেয়ে হাওয়ার বেগে দৌড়ে এসেছি। ভাইজান কাছে ছিলেন, তাই রক্ষা হয়েছে। আল্লাহ ভাইজান কে হাজার বছর আয়ু দিন। আম্মা, আমার মামাতো ভাই, ব্যবসা করে ঢাকায়। কলিকে দেখাতে নিয়ে এসেছি। কলিকে বলার দরকার নাই। পরে, আমরা আলাপ করবো।
    – আচ্ছা।

    রাহেলা বেগম চিন্তা করছেন আল্লাহ জোড়া মিলিয়ে দেন, এই জলি যেমন সরল জামাই ও তেমনই সহজ সরল, মামাতো ভাই এক্কেবারে সাথে করে নিয়ে এসেছে। কিন্তু এই মুহুর্তে বিয়ে দেওয়ার কোন চিন্তা নাই। সাঈদের প্রশংসা করছে ভালো কথা, শুধু জলি সব বলে না দিলেই হোক। সাঈদ খারাপ কাজ করেছে সত্য, তবুও বাইরে সম্মান হানি হউক এটা কখনোই চান না, রাহেলা….

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ১৩.০২.২০২২

  • ঝাপসা দুপুর (শেষ পর্ব-৪)

    ঝাপসা দুপুর (শেষ পর্ব-৪)

    সকালে দোকানের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে খেয়াল হয় চাবি আনতে ভুলে গেছি। বাইক ঘুরিয়ে আবার বাসায় ফিরি।

    বাসায় এমন কিছু দেখবো আশা করিনি। মাহিন চিৎকার করছে কংকার সাথে।
    — মেহমান হয়ে এসেছেন মেহমানের মতো থাকেন। খবরদার আম্মুর সাথে বাজে ব্যবহার করবেন না।

    কংকা চেঁচিয়ে বলে, বড়দের সাথে কি করে কথা বলতে হয় জানো না? এই শিক্ষা দিয়েছে তোমার মা?
    — যা দিয়েছে আপনার পরিবারের চেয়ে ভালো শিক্ষা দিয়েছে।

    আমি অবাক হয়ে যাই মাহিনের এমন বেয়াদবি দেখে। এগিয়ে যাই কষে একটা চড় মারতে। হঠাৎ লামিয়া আমার হাত টেনে ধরে। ওর দিকে তাকালে সে ইশারায় আমাকে থামতে বলে।

    কংকা বলে, আমার পরিবার নিয়ে কথা বলো এতো বড় সাহস? নিজের ভাই হলে এতোক্ষণে থাপ্পর মেরে ঠিক করে দিতাম।

    আমি আর চুপ থাকি না। চেচিয়ে বলি কি হচ্ছে মাহিন? এভাবে চেঁচাচ্ছিস কেন?

    মাহিন আমার দিকে তাকালে ওর চোখে আমি ভিন্ন কিছু দেখতে পাই। সবসময়ের নিরীহ হাসিখুশি মাহিন যেন আজ অন্য কেউ।
    — ভাইয়া আমরা তোমার সব টাকা লুটে খাচ্ছি? তোমার আমাদের পালতে কষ্ট হয় বললেই পারো, বাইরের মানুষের কাছে কেন বল?

    আমি অবাক হয়ে বলি, কি যা তা বলছিস?
    — ঠিক ই বলছি। সমুচা ভাজা দেখে আম্মুকে বলেছিলাম কয়েকটা বক্সে ভরে দিতে বন্ধুদের দেবো। কংকা আপুর হাতে বানানো জানলে জীবনেও চাইতাম না। আপু বলে আমি নাকি এভাবেই টাকা উড়াই।

    কংকা বলে উঠলো, মিথ্যা কথা কেন বলছো মাহিন?

    মাহিন কংকার দিকে না ফিরে আরো চেঁচিয়ে উঠলো।

    আমি তোমার টাকা কোথায় উড়িয়েছি ভাইয়া? কেন আম্মুকে কংকা আপু সুযোগ পেলেই কথা শোনায়? আম্মু তোমার সাথে কি ভেদাভেদ করেছে বলো তো?

    ছোট মা হঠাৎ মাহিনের গালে চর মেরে বলে, চুপ থাক বেয়াদব। কখন থেকে তর্ক করে যাচ্ছিস?
    — কেন চুপ থাকবো? আমরা সৎ বলে? ভাইয়া আমাদের বের করে দেবে বলে? করে দিক। আমি ছোট হতে পারি তবু আমার মায়ের অসম্মান আমি সহ্য করবো না। চলে যাবো তোমাদের নিয়ে।

    কংকা ঝাঁঝিয়ে বলে, বাহ্ মাহিন, তুমি তো আচ্ছা গুটি চালো। কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? আমি এসব কিছু বলি নি।
    — ও তাই! আপনি সারাক্ষণ আম্মুকে ভাইয়ার সৎ মা ফিল করান না?
    — মাহিন তুমি ভয়াবহ মিথ্যুক ছেলে। তুমি…

    আমি কংকাকে থামিয়ে বলি, আমার ভাইকে আমি চিনি কংকা। আমার পরিবারকেও আমি চিনি। তুমি দয়া করে আমার পরিবারে অযথা নাক গলাতে এসো না। আমি কি খাই, খাই না, কি পাই,পাই না তা আমার ব্যাপার। তোমার মাথা ব্যথার দরকার নেই।
    –আশ্চর্য মানুষ আপনারা? মাহিন বেয়াদবি করে যাচ্ছে আর আপনিও তাতে সায় দিচ্ছেন?

    মাহিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে, ভাইয়া তুমি এমন মেয়েকে এ পরিবারের বউ করতে চাও যে কিনা বিয়ের আগেই পরিবার ভাঙ্গতে চায়।
    — কি পাগলের মতো কথা বলছিস? আমি কংকাকে বিয়ে করতে চাই তোর মাথায় কেন এলো? এসব ফালতু কথা কেন ভাবছিস?

    ওয়েট ওয়েট ওয়েট! কংকা হাত নেড়ে বলল, কে কাকে বিয়ে করবে? সবার কেন মনে হলো মইন ভাই আমাকে বিয়ে করতে চাইলেই আমি উনাকে বিয়ে করবো? একটু রান্নাবান্না, খাতিরদারি করেছি বলে সব আমাকে এ বাড়ির বউ ভাবতে শুরু করেছেন কেন? আসলেই ছোট শহরের মানুষদের মানসিকতা ছোট থাকে দেখছি!

    আমি ঢাকায় বড় হওয়া মেয়ে এখানে এমন ছোট শহরে কেন আমার পরিবার বিয়ে দেবে? কি দেখে দেবে?

    আজকাল নিজ শাশুড়ীকেই মানুষ সহ্য করে না সেখানে সৎ শাশুড়ী সৎ ভাইবোনের মাঝে কোনো ভালো পরিবারের মেয়ে কি করে এডজাস্ট করবে শুনি?

    তাছাড়া আমার বা…

    লামিয়া কংকাকে টেনে রুমে নিয়ে যায়। কংকা রুমে ঢুকেও চেঁচাতে থাকে। মুমু বোকার মতো দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকে।

    আমি মাহিনের কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরি। ভাইটা আমার হঠাৎ যেন বড় হয়ে গিয়েছে। আমাকে জড়িয়ে এখন আবার বাচ্চাদের মতো ভেউভেউ করে কাঁদছে।

    মুমু পাশে এসে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, সরি ভাইয়া, আমি বুঝিনি কংকা এমন কিছু করবে। আম্মু কিছুই আমাকে জানায় নি।
    আমি মাহিনের দিকে চেয়ে বলি, আর কোনদিন যেন না শুনি আমরা সৎ ভাইবোন। এ বাড়ি শুধু আমার বা তোর না। এ বাড়ি আমাদের সবার।

    কংকা রুম থেকে বের হয় থমথমে মুখে, হাতে ব্যাগ।

    লামিয়া বলে, আমি আর মুমু কংকাকে বাসে তুলে দিয়ে আসি। ও চলে যাবে এখন।

    আমার বিরক্তভাব কোনোভাবেই আড়াল করতে পারছি না। ভদ্রতার যথেষ্ট অপব্যবহার করছে এই মেয়ে। মুখ ফিরিয়েই বলি ঠিক আছে আমি দিয়ে আসছি।

    মাহিন বলল, না ভাইয়া তুমি দোকানে যাও। আমি ফ্রি আছি। আমি বাসে তুলে দেবো। নইলে বড় শহরের মানুষ ভাববে আমরা দায়িত্বহীন।

    নিঝুম রাত দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে যেন। দিনের বেলা ব্যস্ততায় কাটলেও রাত যেন টুটি চেপে ধরে। টয়ার কথা বার বার মাথায় ঘুরে।
    টয়াকে নিয়ে কি আমি একটু বেশি চিন্তা করছি? একটু হেসে ,একটু বন্ধুর বেশে নাহয় আমার সাথে দু চারদিন কথা বলেছে তাই বলে আমাকে এতো রিয়্যাক্ট করতে হবে কেন? কংকার বলা কথাটাই কি ঠিক? ছোট শহরের মানুষদের মানসিকতা ছোট। আমি হয়তো একটু বেশি কিছু ভেবে নিয়েছিলাম। টয়া হয়তো অনেক ভালো, যোগ্য পাত্র পেয়েছে তাই বিয়ে করছে।

    যত যাই হিসেব মিলাই না কেন মনে শান্তি পাই না।ভালো লাগে না কিছু। এতো হাসফাঁস নিয়ে চলা মুশকিল। রুম ছেড়ে বাগানে হাঁটতে থাকি কিছুক্ষণ। ফিরে এসে রুমে ঢোকার পথে লামিয়া মৃদুলয়ে ডাক দেয়। টিভি ছেড়ে বসে আছে যেন আমার অপেক্ষায়।
    –মইন ভাই, কথা ছিল।
    — হুম, বলো।
    — বসুন প্লিজ।

    আমি পাশে বসলে লামিয়া বলে, বুকে এতো অভিমান নিয়ে চলা কি ঠিক?

    আমি দ্বিধা চোখে তাকাই।
    — ভাইয়া, বন্ধু মানে তার সাথে শুধু ভালো সময় কাটানো নয়। তার মনটাও ছুয়ে দেখতে হয়। বন্ধুর কষ্ট, আনন্দ, না বলা কথা সব বুঝে নিতে হয় চুপ করে।
    — তুমি কি বোঝাতে চাচ্ছো, লামিয়া?
    –যার সাথে রাত জেগে জেগে কথা বললেন তাকে একবার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন করা গেলো না?
    আমি চমকে উঠি।
    — আপনাকে সেদিন চা দিতে এসে শুনেছি এবং ওপাশে কে তাও বুঝেছি। আজ কংকার সাথে আমারও চলে যাওয়ার কথা ছিল। শুধু একটা কাজ রয়ে গেছে বলে যাই নি।

    টয়ার ফটফট কথা শুনে সবাই ধারণা করে মনের সব কথা টয়া হয়তো অবলীলায় বলতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। বড্ড অভিমানী টয়া ঠিক আপনার মতো।

    ওর মনের গহীনে কারো প্রবেশ নিষেধ। এমন কি আমিও প্রবেশ করতে পারি নি। ভেবেছিলাম আপনি হয়তো সে দরজায় কড়া নেড়েছেন। কিন্তু আপনি তো সে চেষ্টাই করেন নি দেখছি।

    আগামীকাল ভোরে চলে যাচ্ছি ভাইয়া। যাওয়ার আগে একটা কথা বলতে চাই, কিছু প্রত্যাশা করলে তাকে পাওয়ার স্পৃহা থাকতে হয়। এমন যেন না হয় অভিমানী হয়ে দুজনই একা রয়ে গেলেন নিজ মনের কুঠরীতে।

    ভালো থাকবেন।

    লামিয়া আজ ভোরে চলে গেছে। ওর বলা কথাগুলো থেমে থেমে মনের মাঝে বেজে উঠছে। টয়াকে তবুও ফোন করছি না।

    অভিমানের কাছে মন যেন বন্ধক রেখেছি।

    রাতের নির্জনতায় মনের আয়নায় নিজেকে কোথাও না কোথাও অপরাধী পাই। এতো কিসের অভিমান আমার? ভুলটা আমিই কি করছি না? একবার কল করতে ক্ষতি কী?

    সকল দ্বিধা কাটিয়ে টয়াকে কল করি। ওপাশ থেকে নিষ্প্রাণ কণ্ঠ শুনতে পাই।

    কি বলে কথা শুরু করবো বুঝি না।

    দুজনই চুপ করে থাকি কিছুক্ষণ।
    –সেদিন আর কল দিলে না যে?
    — আপনিও তো দেন নি ।
    — শুনলাম তোমার আংটি বদল হয়েছে।
    — হু
    — আগে থেকেই ঠিক ছিল?
    — না।
    — তাহলে?
    — ছেলে পিউকে আংটি পরাতে আসার কথা। কিন্তু পিউ সকাল থেকে বেঁকে বসলো বয়স্ক ছেলে বিয়ে করবে না। কোনোভাবেই রাজি করাতে না পেরে মামী আমাকে অনুরোধ করলেন বিয়ের জন্য। মামা বন্ধুকে আগেই কথা দিয়েছিলেন। পরিবারের ইজ্জত বাঁচাতে আমি রাজি হয়ে গেলাম।
    — ইজ্জত বাঁচাতে রাজি হয়ে গেলে?
    টয়া চুপ করে রইলো।
    –তুমি এমনভাবে বিয়ে করতে চাও?
    — আমি কিভাবে বিয়ে করতে চাই তা তো জানি না মইন ভাই। আমি শুধু জানি আমার নিজের কেউ নেই যার জন্য আমি বিয়েতে মানা করবো। কেউ নেই যে আমাকে ভালোবাসে, আমার অপেক্ষায় বসে আছে। তাহলে কেন, কি কারণে,কার জন্যে আমি মানা করবো?
    — তারমানে তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছো?

    টয়া মৃদু হেসে বলল, না করার কোনো কারণ আছে কি?

    আমার বুকে কেমন ভোঁতা অনুভূতি হতে থাকে।
    –ছেলে কি করে?
    — ইটালি থাকে।
    — ছেলের ছবি আছে? আমাকে দিও দেখবো তোমার হবু বরকে।

    টয়া দীর্ঘ শ্বাস আড়াল করে বলে, আচ্ছা।
    — রোজ বুঝি কথা হয়?
    — হয় তবে পিউর সাথে।
    — মানে?
    — ছেলে বয়স্ক হলেও দেখতে হ্যান্ডসাম। মিষ্টি কথায় বেশ পটু। পিউর সাথে জমে গেছে। রোজ ফোনালাপ হয় তাদের।
    — তাহলে আর সেদিন বেঁকে বসেছিল কেন?
    — হয়তো পিউ এখন আফসোস করছে। অবাক হবো না যদি পিউ মত পাল্টায়।
    — তোমার বিরক্ত লাগছে না ওর এমন আচরণে?
    — নাহ্, স্বার্থপরতা দেখে আমি অভ্যস্ত।
    আমি চুপ হয়ে রই কিন্তু মনের মাঝে কত কথা হাসফাঁস করছে যেন।
    — এতোদিন পর আজ কি মনে করে ফোন করেছেন? অভিনন্দন জানাতে?

    আমি বোবা হয়ে থাকি।
    — অভিনন্দন জানিয়ে শেষ করুন কথা।
    — টয়া!….. আমাকে একবার বলতে পারতে। একটা কল দিতে পারতে।

    টয়া হয়তো রেগে গেল। কাটকাট সুরে বলল, আমাকেই কেন কল করতে হবে মইন ভাই? কল করে কি বলতাম, আমাকে উদ্ধার করুন? কোনো লাভ হতো কি?

    ধরে আসা কণ্ঠ আড়ালের চেষ্টা করে বলে, লামিয়াকে জানিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম আপনি হয়তো…. থাক বাদ দেন। রাখি মইনভাই। কথা বলতে ভালো লাগছে না।
    — না টয়া! কথা শেষ করো প্লিজ।
    — আমার কোনো কথা নেই… ফোন রাখছি।
    — টয়া থামো, প্লিজ। আমি… আমি… সরি। আমার আসলে কল করা উচিত ছিল। আমি ভুল করেছি। নিজের জন্য আমি আসলে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে জানি না। কি করে নিজের কিছু চাইতে হয় তাও জানা নেই আমার। একা বড় হয়েছি বলে অনেক কিছু শিখি নি। হয়তো..
    — মইন ভাই, একা আমিও বড় হয়েছি। কিন্তু আপনার মতো নিজেকে একা ভাবি নি। আশেপাশের সবাইকে ভালোবাসার চেষ্টা করেছি তারা আমাকে ভালোবাসুক আর না বাসুক। সত্যি কথা কি আপনি নিজেকে দুঃখী ভাবতে ভালোবাসেন। একা ছিলেন একাকীত্ব ই আপনার পছন্দ।

    কিন্তু জানেন কি, আপনি আমার চেয়ে সৌভাগ্যবান। আপনার মৃত মায়ের ছবির সামনে দাঁড়িয়ে অন্তত আপনি অভিযোগ, অনুযোগ করতে পারেন ।

    আমার কথা ভাবুন। আমার আপন জনরা জীবিত থেকেও মৃত। তাদের কাছে আমার দুঃখের কোনো মূল্যই নেই। যাদের আমি মনেপ্রাণে পরিবার মানি তারা বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাকে আশ্রয় দিয়ে তারা ধন্য করেছে। যে ছেলে পিউর মতো সুন্দরী মেয়ের কল্পনা নিয়ে আসে অথচ আমাকে আংটি পরাতে বাধ্য হয় সে কি আর খুশি? ওর মুখ দেখে যে কেউ স্পষ্ট বুঝতে পারবে। কিন্তু আমি বুঝলেও কিছু বলতে পারবো না। কারণ আমি আশ্রিতা! এমন সোনার টুকরো পাত্র পিউ আমাকে ছেড়ে দিয়েছে সেটাই তো আমার সৌভাগ্য। তবে কাল যদি পিউ মত বদলায় তবে আমাকে হাসিমুখে তা মেনে নিতে হবে। কারণ পাত্র তো পিউর জন্যই ছিল।

    পরিবারকে অনেক ভালোবাসি তাই হয়তো বার বার আমাকে পরীক্ষা দিতে হয়।

    যাই হোক, অনেক কিছু বলে ফেললাম। আমাকে আর কল দেবেন না। আজ কল করে এমনিতেও আপনি দায়মুক্তি পেলেন। নিশ্চিত মনে ঘুমোতে যান। ভালো থাকবেন।

    টয়া লাইন কেটে দিলে আমি মোবাইল কানে ধরেই বসে থাকি। মাথা যেন কাজ করছে না। কেমন বোবাকান্না পাচ্ছে। এতোটা অসহায় আমি কখনো কি হয়েছি? মন কি চাচ্ছে, আমি কি চাচ্ছি কিছুই বুঝছি না। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। সেটাও যে শিখিনি। বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হচ্ছে অথচ চোখ দুটো মরুভূমির উত্তাপ ছড়াচ্ছে।

    মোবাইলে ছবি আসে। টয়ার পাশে একজন পুরুষ বসা।

    বুকের ভেতরে চলা নিঃশব্দ প্রলয় হঠাৎ যেন থেমে যায়। টয়ার পাশে বসা মানুষটি আমার কাছে অদৃশ্য হয়ে রয়।

    একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে আমি চেয়ে থাকি কাজল কালো নত চোখজোড়ার দিকে। হাতে সবুজ রেশমি চুড়ি, কপালের সবুজ গোল টিপ উঁকি দিচ্ছে সোনালী শাড়ির ঘোমটার ভেতর থেকে।

    আমি মন ভরে দেখতে থাকি অভিমানী মেয়েটিকে। যত দেখি বুকের ভেতর কেবল শূন্যতা অনুভব করি। অস্থিরতা বাড়ে তবু চোখ সরাই না। চোখের আড়াল হলেই যেন আমাকে একা করে হারিয়ে যাবে।

    কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না। ঘুম ভাঙে কাচের চুড়ির শব্দে। আমার পাশে কে যেন শুয়ে আছে। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দ। কে শুয়ে আছে ঝাপসা চোখে বুঝতে পারছি না। হাত বাড়িয়ে দিলে আঙ্গুলের ডগায় নরম গালের অনুভূতি টের পাই। কে মেয়েটি?

    শরীর থেকে সোনালী রোদের আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে। কিন্তু চেহারা দেখা যাচ্ছে না।

    মেয়েটির কাছে এগিয়ে যাই। যতটা কাছে গেলে ঠোঁট ছোঁয়া যায়। আস্তে আস্তে মেয়েটির অবয়ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঘন কাজল কালো চোখ। কপালে সবুজ গোল টিপ। গায়ে সোনালী শাড়ি জড়ানো।

    আমার দিকে চেয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলে, কি, এতো দেরী হলো আমাকে চিনতে?

    টয়া!

    আমি চমকে উঠি।

    আমি সত্যিই চমকে উঠি। ঘুম ভেঙে চারিদিকে তাকাই।ফজরের আযান শোনা যাচ্ছে সাথে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। স্বপ্নে টয়া ছিল!

    আমার পাশে? আমার মনে?

    টয়া! কিভাবে হতে দিচ্ছি ? সব বুঝেও কেন অবুঝ হচ্ছি? কিছু পেতে হলে তাকে চাইতে হয়! কিছু প্রত্যাশা করলে তাকে পাওয়ার স্পৃহা থাকতে হয়। আমি কেন একবারের জন্যেও হাত বাড়াই নি?

    অস্থির মনে বিছানা ছাড়ি। তৈরী হয়ে রুম থেকে বের হলে ছোট মা পেছন থেকে ডাকেন, মইন!

    আমি চমকে তাকাই।
    — কি হয়েছে মইন? এতো ভোরে কোথায় যাচ্ছো?

    আমি চুপ করে থাকায় ছোট মা মলিন মুখে নিজ রুমের দিকে পা বাঁড়ান। পেছন থেকে ডাক দেই আমি।
    — ছোট মা, একটা কথা ছিল।
    — বলো!
    — আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আপনি এ পরিবারের কর্তি। তাই আপনার মতামত চাইছি।

    ছোট মা আগ্রহ নিয়ে চেয়ে থাকেন।
    –আপনার বড় ছেলের বউ যদি জিন্স ফতুয়া পরে ঘুরে বেড়ায় আপনার তাতে সমস্যা আছে?
    — তোমার সমস্যা না থাকলে আমার কেন হবে?
    — বউ যদি আমার বাইকের পেছনে দুদিকে পা ছড়িয়ে বসে? কুকুর বিড়াল এনে ঘর ভরে ফেলে কিংবা….
    — কিংবা মোবাইলে একে তাকে শাসায় কিংবা রাত জেগে তোমার সাথে কথা বলে তাও আমার কোনো সমস্যা নেই মইন। তোমার পছন্দ ই আমার, আমাদের সবার পছন্দ।

    আমি গলা নামিয়ে বলি, ছোট মা আমি আজ ঢাকা যাচ্ছি টয়ার কাছে।
    — দেরী করে ফেললে না?
    — হয়তো, হয়তো বা না। ভাগ্য ভালো থাকলে টয়া আমার বউ হবে মা।

    ছোট মা হয়তো মা ডাক শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কেঁপে ওঠে আমার দিকে তাকান। কাছে এগিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, মায়ের দোয়া রইলো।

    দু’জনই একে অপরের দিকে খানিক সময় তাকিয়ে রই। দীর্ঘদিন পাশাপাশি থেকেও যে বন্ধনটিকে উপেক্ষা করে এসেছি আজ যেন তার গভীরতা অনুভব করি।

    মা আমাকে বললেন, তোমার মায়ের একটা সোনার হার আমার কাছে আছে। সেটা টয়ার জন্য সাথে করে নিয়ে যাও।
    — না মা, আপনার ছেলের বউ হয়ে এলে আপনিই তাকে নিজে হাতে পরিয়ে দেবেন।

    ঝুম বৃষ্টিতে বন্ধ দোকানের টিনের ছাউনির নীচে দাঁড়িয়ে আছি। ভোর থেকে মুসলধারে বৃষ্টিতে আবহাওয়া একবারে শীতল হয়ে আছে। ভেজা শরীরে কাঁপন সৃষ্টি হয়েছে। সাথে করে ছাতা অন্তত আনা উচিত ছিল। গাজীপুরের এ গলির ভেতরের সব দোকানই প্রায় বন্ধ। এমন মুষলধারে বৃষ্টিতে নিতান্ত কাজ ছাড়া সবাই কাথামুড়ি দিয়েই শুয়ে থাকবে।

    টয়াকে কল করছি, ধরছে না। বেশ কয়েকবার কল দেয়ার পর নিজেই ব্যাক করলো।
    — টয়া!
    — বলুন মইন ভাই!
    — একটু বাইরে আসতে পারবে?
    — মানে?
    — মানে তোমাদের গলির সামনে রহমত স্টোরে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
    — মানে?
    — মানে সব দোকান বন্ধ। আমি ভিজে চুপচুপে হয়ে আছি। খুব ঠাণ্ডা লাগছে।
    — মানে কি?
    — আর বোঝাতে পারবো না। তুমি কি আসতে পারবে?
    — আ.. আমি আসছি। এখনি আসছি।
    — শোনো!
    — কি?
    — সাথে ছাতা এনো, অনেক বৃষ্টি হচ্ছে।
    — আচ্ছা।
    — শোনো!

    • কি?
      — রাস্তায় পানি জমে গেছে। সাবধানে এসো।
      — ইস! থামেন তো। আপনি বেশি কথা বলেন।

    বেশি ক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি।

    বৃষ্টির ঝুমঝুম ছন্দের মাঝে তাল কেটে ছপাৎ ছপাৎ শব্দে এগিয়ে আসছে কেউ। হয়তো টয়া!

    আমাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেল। জোরে জোরে শ্বাস টানছে। ছুটে এসেছে বোধহয়। সাথে ছাতা আনে নি। কাকভেজা হয়ে গেছে পুরো। ঠাণ্ডা লেগে যাবে নির্ঘাত।

    অবাক চোখে ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসে।
    — আপনি… আপনি কেন এসেছেন?
    — আসা ঠিক হয় নি ?
    — না না তা বলি নি। কিন্তু এভাবে হঠাৎ?
    হাত বাড়িয়ে টয়াকে আমার পাশে দাঁড় করাই। বৃষ্টির ঝাপটায় টয়া থরথর করে কাঁপছে। আমিও কাঁপছি।
    –কিছু বলছেন না যে?

    আমি চেয়েই থাকি। কিছু বলতে ইচ্ছে করছে না। থাক না কিছু সময় এভাবেই থমকে।
    — আপনি কি এতোদূর শুধু আমাকে দেখতে এসেছেন?
    — হুম।
    টয়া হতাশ হয়।
    –দেখা শেষ এবার চলে যান।
    –তুমি চাও আমি চলে যাই?
    –আমাকে জিজ্ঞেস করে তো আসেন নি। আমার চাওয়া কেন জিজ্ঞেস করছেন? থাকেন আপনি বৃষ্টিতে একা দাঁড়িয়ে।

    টয়া চলে যেতে নিলে আমি ওর হাত টেনে কাছে নিয়ে আসি।
    — আশ্চর্য! আমি এতোদূর এলাম আর তুমি চলে যাচ্ছো?
    — তো কী করবো? সব আপনার ইচ্ছেতে হবে?

    আমি কল করবো, আমি ব্যাখা দেবো, আমি দুঃখের সাগরে ডুবে যাবো, আমি ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাবো আর আপনি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখবেন কিন্তু কিছু বলবেন না। কোনো দায়িত্ব নেবেন না।

    কেন এসেছেন আপনি? যান এখান থেকে।

    দুহাতে ধরে কোনোভাবেই আটকে রাখতে পারছি না টয়াকে। বার বার ছিটকে চলে যেতে চাচ্ছে।
    –থামো না প্লিজ, এতো ছটফট কেন করছো? সরি বলছি।
    — কিসের সরি?
    — সেটা বলতেই তো এসেছি।
    — কিছুই তো বলছেন না।

    টয়াকে কাছে টেনে ঝাঁকিয়ে বলি, এই মেয়ে, স্থির হও এবং মনোযোগ দিয়ে শোনো। কেউ একজন তোমাকে খুব পছন্দ করে, প্রচণ্ড ভালোবাসে! তোমার মামা- মামীকে এ কথা বলতে পারবে?

    টয়া কিছু বলতে গিয়েও পারে না। কেবল ঠোঁট নড়ে ওঠে।
    — আমি ইতালির মতো জমকালো রঙিন দেশে থাকি না। খুব ছোট শহরে, সাধারণ পরিবারের সাধারণ ছেলে আমি। ব্যবসা করি, ইনকাম মন্দ নয়। দেখতে মোটামুটি পর্যায়ের তবে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে জানি না। তোমাকে সানন্দে বিয়ে করতে চাই। এক আকাশ সমান ভালোবাসা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। তুমি কি তা গ্রহণ করবে?

    টয়া চেয়ে আছে। বৃষ্টির পানি টয়ার কপাল বেয়ে গাল গড়িয়ে পড়ছে। সাথে চোখের নোনাজল মিশে যাচ্ছে।
    — বলো টয়া? আমাকে বিয়ে করবে?
    — করবো। কিন্তু…..
    — কিন্তু কী?
    –আমি যে রান্না পারি না। খুব ভোরে ঘুমও ভাঙ্গে না আমার, শাড়ি পরতে মোটেও ভাল লাগে না, আর…

    আমি হেসে বলি আমি মনের সঙ্গী চাই, শাড়ি চুড়ি পরা প্রতিমা নয়।

    ঝুম বৃষ্টির মাঝে ঝাপসা দুপুরে নির্জন গলিতে একা দাঁড়িয়ে আছি দুজন।

    নতমুখে কাঁদছে টয়া। শরীর কেঁপে উঠছে অবাধ্য কান্নায়।

    টয়ার গালে দুহাত রেখে বলি, ভালোবাসার কথা অধিকার নিয়ে বলতে দেরী করে ফেলেছি। তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, নিজেও কষ্টে জ্বলেছি।

    আমার বুকে মুখ লুকায় টয়া।
    — আপনি সবকিছু এতো দেরীতে বোঝেন কেন?
    — সরি বলছি তো।
    — সরিতে কি সব কষ্ট মুছে যায়?
    –কি করতে হবে বলো?
    –আমাকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন?

    শীতল বাতাসের দাপটে ভালেবাসার উষ্ণ আলিঙ্গন হয়তো আমারও প্রয়োজন ছিল।

    সমাপ্ত

    ঝিনুক চৌধুরী

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৬)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৬)

    রাহেলা বেগম রাতের বেলা ভাইকে ফোন করে বললেন, যেন পাত্র পক্ষ কয়েকদিন পরে আসে। এখন এই মুহুর্তে কলির বিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। যখন সময় হবে তিনি জানাবেন। যদিও প্রচন্ড রাগ করেছেন ভাই, তবুও তিনি বুঝিয়ে বলে, চিন্তা মুক্ত হয়েছেন।

    আবিদ টুকটাক জিনিস প্রতিদিন একটু একটু করে কিনে আনে, আসবাব পত্র কিছুই কিনেনি কারণ পলি এখানে কিছু দিনের অতিথি মাত্র! পলির এই ছোট্ট রুমের টোনা-টুনির সংসার খুবই আনন্দের ও সুখের লাগে।

    জলি দুই দিন পর এই বাসায় জামাই রনিকে নিয়ে এলো। চার তলা উঠে যেন পুরোপুরি হাঁফিয়ে গিয়েছে সে। রাহেলা বেগম মেয়েকে চিনতে পারছেন না, সারা শরীরে পানি চলে এসেছে। মুখ টা ছোপ ছোপ দাগ ভরে গিয়েছে।

    রাহেলা চিন্তা করছেন, কষ্ট হোক তবুও এই সময়ে সত্যি তার মাকে দরকার, খুব ভালো হয়েছে এখানে এনে, নাহয় তিনি নিজেই কষ্ট পেতেন সবচেয়ে বেশি। সামনে থেকে মেয়ের যত্ন নিবেন, তাই শান্তি।

    জলি বললো মা, এই চার তলার উপরে উঠান সহ ঘর কেমনে পেলে?
    – নাহিদ ঠিক করেছে।
    – খুব সুন্দর হয়েছে। মা, ডাক্তার কালকে দেখাবো, তোমাদের জামাই কাল ডাক্তার দেখিয়ে চলে যাবে।
    – কাল কেন যাবে? পড়শু যাবে।
    – না, কালকেই চলে যাবে, কষ্ট হবে মা তোমাদের একটু।
    – মায়ের কাছে এসেছিস, আর কি বলিস এসব!

    কলি রান্না করছে আর ভাবছে সেও কি এক সময় এই বাসায় অতিথি হয়ে যাবে, জলি আপার মতো? তার ও কি এরকম মায়ের কাছে থাকতে হলে, সবার কষ্ট হবে কিনা, খেয়াল করতে হবে? দুনিয়া খুবই অদ্ভুত, খুব!

    জলি রাতের বেলা, কলির পাশে গিয়ে বসলো, এই কলি আমি কি খুব বিশ্রি হয়ে গিয়েছি?
    – না, কে বলেছে?
    – আয়নায় দেখি।
    – না, ঠিক আছ।
    – সত্যি?
    – সত্যি।
    – তোর দুলাভাই আমার খুব যত্ন করে এখন আমার।
    – হ্যা, দুলাভাই খুব ভালো মানুষ।
    – আমার ইদানীং খুব মৃত্যু ভয় ঢুকেছে৷ মনে হয় আজই বোধহয় তোর দুলাভাই কে শেষ দেখা দেখছি, যদি মরে যাই?
    – কি যে বলো আপা!
    – আচ্ছা, যাই তোর দুলাভাইয়ের সাথে একটু গল্প করে আসি, ওই দেখ, ছাদের কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।
    – যাও।

    জলি হাঁটতে ও যেন পারছেনা, খুব কষ্ট হচ্ছে। পেট বেশি বড় হয়ে গিয়েছে। জামাই ছাদের এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে, জলি আস্তে করে গিয়ে পিছনে দাঁড়ালো।

    জলি তুমি বাইরে এসেছো কেন?
    – ঢাকা শহরে জ্বীন নাই। সমস্যা নাই বের হলে।
    – জ্বীনের জন্য বলিনি, তোমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। চলো রুমে যাই, আমি এমনি রখানে দাঁড়িয়েছি।
    – না, এখানে বাতাস লাগছে, ঘরে প্রচন্ড গরম।
    – আচ্ছা থাকো।
    – এই বাসায় আরেকটা রুম থাকলে, আজ রাত তোমার বাহুতে ঘুমাতাম, যদি মরে যাই, তবে কি আর থাকবো?
    – কি বলে পাগল মেয়ে। মরবে কেন? আমাদের বাবু নিয়ে আমরা আনন্দে থাকবো।
    – খুব ভয় হয়।
    – আমি আছি তো! এখানে আম্মা আছেন, সবাই আছেন।

    রাহেলা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েকে জামাইয়ের সাথে গল্প করতে দেখে, খুব ভালো লাগছে। যাক মেয়েটা অর্থনৈতিক দিক থেকে বেশি স্বচ্ছল না হলেও মনের দিক থেকে, অনেক শান্তিতে আছে।

    পরের দিন ডাক্তার দেখানোর পর, ডাক্তার বললো বেবি বড় হয়ে গিয়েছে। আর রেগুলার কিছু হাঁটাহাঁটি দরকার, সাথে কিছু খাবারের পরিবর্তন দরকার। বাবু হয়তো আর দেড় মাসের পরের তারিখ দিল ডাক্তার আর কোন সমস্যা নেই আপাতত।

    বাসায় আসার সময়, রনি সব ধরনের ফল, সবজি, হরলিক্স, দুধ কিনে আনলো, আর শাশুড়ী কে বললো আম্মা, আমি এখন দুই হাজার টাকা দিয়ে যাচ্ছি। আবার আগামী মাসে ডেলিভারির সম্পূর্ণ খরচ নিয়ে আসবো। এর মধ্যে যদি কোন সমস্যা হয়, আমার চাচাতো ভাইয়ের ফোন নম্বরে কল দিবেন। আর আমি দুই দিন পর পর ফোন দিয়ে খোঁজ নিব।
    – আমরা আছি তো! চিন্তা করবেনা বাবা। তুমি সাবধানে যাও।

    পলির যেন চোখের পলকেই এক মাস হয়ে গেল। এই বাসায়। আবিদ বললো আমি তোমাকে নিয়ে আগামী শুক্রবার বাড়ী যাবো।
    – আমি আর যাবো না। প্লিজ আমাকে বাড়ীতে দিবেনা। আমি এই বাদায় থাকবো, কিন্তু তোমার সাথে।
    – পলি পাগলামি কর কেন? এই বাসায় কি পরিবার নিয়ে থাকা যাবে, তাছাড়া বাড়ীওয়ালা এক মাসের জন্য তোমাকে নিয়ে থাকার জন্য রাজী হয়েছে, সব সময়ের জন্য রাজী হবেনা।
    – আমি তাদের রাজী করাবো।
    – পলি, বাড়ীতে মা-বাবা আছেন কত কষ্ট পাবেন জানো?
    – তোমার বড় ভাই, ঠিকই বউ নিয়ে থাকেন, কেউ কিছু বলেনা। আমার ওই বাসায় ভালো লাগেনা।
    – ভাইসাহেবের ভালো চাকরি, সেজন্য থাকে।
    – আমি তো তোমাকে ভালো চাকরি ধরতে বলছিনা! এইখানে, এইভাবে থাকতে চাই। শুধু তোমার সাথে।
    – মাস্টার্সের ক্লাস করবেনা?
    – আমি শুধু পরীক্ষা দিব।
    – তোমার মাথা খারাপ হয়ে আছে, বোকা মেয়ে। আমি স্কুলে যাচ্ছি, সারাদিন চিন্তা কর।
    – আমার ডিসিশন একই থাকবে, শত চিন্তা করার পরেও।

    সকালে রনির সাথে দুই মিনিট কথা বলে এসেছে জলি। পুরোপুরি সুস্থ আছে। আরও পনেরো দিন পর ডেলিভারীর তারিখ। জলি রোদের মধ্যে চেয়ারে বসে আছে।

    মা তরকারী কাটছেন, সে গল্প করছে মা, তোমার জামাই শুক্রবারে আসবে, টাকা নিয়ে।
    – আরও পনেরো দিন বাকি আছে। চিন্তা নাই।
    – আমার শ্বাশুড়ি কত কাঁথা বানিয়েছেন, তাই দিবেন সাথে।
    – আমার ও দশ টা কাঁথা সেলাই শেষ।
    – সকালে শাহিদ কোথায় গেল?
    – জাহিদ যাওয়ার জন্য বলেছে, তাই ওর এখানে গিয়েছে। বেতন দিবে, আর লাইব্রেরির কি কাজ ও জানি আছে।
    – কবে আসবে?
    – তিন দিন থাকবে, বললো।
    – ওহ।

    এই দিন সন্ধ্যার দিকে জলির ব্যাথা উঠেছে হালকা করে। জলির মুখ অন্ধকার হয়ে আছে ব্যাথায়। রাহেলা বেগম বুঝতে পারছেন না, এটা কিসের ব্যাথা? কিন্তু সময় সময় ব্যাথা বাড়ছে। তিনি তাড়াতাড়ি করে সাঈদ কে আসতে বললেন অফিস থেকে ফিরতে যেন, এখানে আসে একবার।

    নাহিদ বার বার বলছে মা, আপাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে?
    – সাঈদ আসুক। ওর জানাশোনা ভালো আছে।
    আর ব্যাথা কিসের বুঝতে পারছিনা।
    – আমি এক টিউশনির বেতন শনিবারে পাবো, এখন কি টাকা আনতে যাবো?
    – না, এখন তুই থাক এখানে। সব চলে গেলে হবে নাকি?
    – আচ্ছা।

    কলি বোনের পায়ে হাতে তেল লাগিয়ে দিচ্ছে। তার ব্যাথায় মুখ টা কালো হয়ে আছে। শুধু অস্থির অস্থির করছে সে।

    সাঈদ আসলো ঘন্টা খানেক পরে। এসে বললো আমি কি এসব বুঝি? আমাকে যে ডাকলে।
    – হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। তাই চিন্তা করছি, কোথায় নিব? আমি কি ঢাকায় কিছু চিনি!
    – কিরে জলি তোর জামাই কত দিয়ে গিয়েছে?
    – জামাই শুক্রবার দিন আসার কথা। এখন হাজার দুই টাকা আছে, আমার হাতে ও টাকা নাই, জাহিদের বেতন আনতে গিয়েছে শাহিদ। মাসের শেষ, এখন!
    – মা, দুই হাজার টাকায় ডেলিভারি হয়?
    – জামাই এসে দিয়ে দিবে, তুi এক্টু নিয়ে যা বাবা।
    – এই নাহিদ বেবি ডাক, ঢাকা মেডিকেল নিয়ে যেতে হবে। সরকারি ছাড়া হবেনা।
    – ঢাকা মেডিকেল অনেক দূরে।
    – মা, তোমার যেমন টাকা, তেমন ব্যবস্থা। এই টাকায় আর কোথায় নিয়ে যাবে? আর টাকা সাথে নাও পরে গিয়ে বলবে, ভুলে গিয়েছিলে আনতে। এক্ষুনি নাও।

    নাহিদ আর কথা না বাড়িয়ে বেবি টেক্সি ডাকতে বেড়িয়ে গেল, তার পকেটে একশো টাকার দুটি নোট এছাড়া কিছুই নেই। ভাইজানের কথা শুনলেই মাথা ধরে যায়।

    কলি তিন বার রনির চাচাতো ভাইকে ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলো, কিন্তু কেউ ফোন ধরছেনা। রিং হয়ে কেটে যাচ্ছে।

    জলি গাড়ীতে উঠার সময় বারবার বলছে কলিরে, আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, যেমনেই হোক, তোর দুলাভাইকে ফোনে খবর দে।

    কলির বোনের কষ্ট দেখে, দুচোখ বেয়ে পানি পড়ছে, আহারে! একটা সন্তানের জন্য কত কষ্ট করছে জলিপা।

    রাহেলা বেগম মেয়েকে শক্ত করে ধরে আছেন, জলির ব্যাথা বাড়ছে, আর বার বার কুঁকড়ে যাচ্ছে। তিনি বারবার চিন্তা করছেন, কেন তিনি এমন পাষান ছেলেকে পেটে রাখলেন, যে বোনকে ডাক্তার নিয়ে যাওয়ার আগে, টাকা কত আছে সে হিসাব নেয়। আজ আর কোন উপায় নাই, সাঈদ ছাড়া। তাই তিনি এই রাতের বেলা তাকে বলতে বাধ্য হয়েছেন, হাত একেবারেই শূন্য বলে, নয়তো তিনি বলতেন না। শাহিদ থাকলে, একটা ব্যবস্থা হয়ে যেতো! কিন্তু সেও নেই এখন।

    নাহিদ সামনে বসেছে, বার বার ঘুরে বোন কে দেখছে। চেহারা কেমন কালো হয়ে আছে জলির।

    রাহেলা বেগম বার বার আল্লাহর কাছে দোয়া করছেন, আল্লাহ আমার মেয়েকে উদ্ধার কর, সুস্থ বাবু দাও। কোন ধরনের অপারেশন যেন না লাগে। সব কিছু সুন্দর কর সহজ কর মাবুদ….

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ১০.০২.২০২২

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৮)

    আজিমপুর টু উত্তরা
    ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    আনোয়ার হাকিম।

    (৮)
    খাগড়াছড়ি এসেই দুটি খবর পেলাম। একটা সেলিমের আবির্ভাবের। আরেকটা হলো আগামী সপ্তাহে দাপ্তরিক কাজে ঢাকায় যাওয়ার। মিটিং প্লাস তিন দিনের ওরিয়েন্টেশন। দুটোই দারুন খুশির খবর।
    সেলিমকে পাওয়া গেছে বললে ভুল বলা হবে। সে-ই এসে উদয় হয়েছে। বোনের সাথে থেকে থেকে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। খালা মাঝখানে পরে ভ্যাবাচ্যাকা খাচ্ছে। আম্মা বোনকে গলা খাকাড়ি দিচ্ছে। কিন্তু জামাইকে তো আর সেভাবে কিছু বলতে পারছে না। চুল-দাড়ি নিয়ে কিম্ভুতকিমাকার অবস্থায় বাসায় এসে উঠেছে সে। আম্মার হয়েছে জ্বালা। বুয়াকে আসতে বারণ করে দিয়েছে। বাসার এই একশন বেইজড, সাসপেন্সে ভরপুর বিরতিহীন সার্কাস প্রত্যক্ষ না করাই ভাল, তাই। খালার উপর পড়েছে বাড়তি চাপ। সেলিম এসে সেই যে লম্বা শোয়া দিয়েছে বোনের অগ্নুৎপাতেও আর উঠার নাম নেই। বালিশে মাথা গুঁজে চুপ মেরে পড়ে আছে। মুখে রা নেই। হাতে টাকা নেই। টাকার যোগান দেবে বোন। বোনের সোর্স আম্মা। আম্মার ভরসা ফ্ল্যাট ভাড়া। অর্থনীতির এই চক্রাকার বলয়ে চলছে আমাদের জামাই-পালন অর্থনীতি। তবু সবার মন খুশি নিঁখোজ লোককে খুঁজে পাওয়া গেছে। আম্মাকে বললাম,“কি বলে ও”?
    — কি আর বলবে? চুপ মেরে আছে। মুখে কথা নাই
    — কোথায় ছিলো এতদিন?
    — সিরাজগঞ্জে, ওর এক বন্ধুর ওখানে।
    — হতচ্ছাড়া
    — আমার হয়েছে যত জ্বালা। মলিকেও কিচ্ছু বলা যায় না।
    — কেন?
    — বললে কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে কান্না শুরু করে দেয়। সেলিমকে কিচ্ছু বলা যাবেনা। যা বলার ওই নাকি বলবে।

    আম্মা এগুলো বলে আর কাঁদে। বলে বলে হাল্কা হয় বুঝি। সেলিম টাইপের ছেলেদের সম্মোহনী গুণ মারাত্মক। এই যে এত অঘটন ঘটিয়ে কপর্দক শূন্য হয়ে শ্বশুর বাড়ীতে এসে লম্বা শোয়া দিয়েছে তাতে তার না আছে কোন শরম, না আছে কোন চিন্তা। নন-স্টপ বকা দিতে দিতে মলির রাগও পড়ে গেছে। মলি মানে আমার বোন। বাসা আপাতত শান্ত। তবে যে কোন সময় তেতে উঠতে পারে। ফোন দেই, ধরেনা। ধরবে কেমনে? মলি তার ফোন সীজ করে সুইচ অফ করে রেখেছে। বললেও তাকে ফোন দেয় না। আমার ভয় তার আবির্ভাবের খবর যদি পাওনাদাররা জানতে পারে তাহলে তো বাসায় এসে আবার ক্যাচাল শুরু করে দেবে। অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাসায় খোঁজ নেই। শুনি ‘ওয়ার এন্ড পিস’ খেলা চলছে। আম্মার কাছেই শুনি, চুল-দাড়ি বড় হয়ে জংলী রুপ নিয়েছে। কিন্তু কাটার নাম নেই। বোন খোঁচা দেয় ঠিকই। কিন্তু বেশি চাপাচাপিও করেনা। কারণ, সেলুনে গেলে যদি পাওনাদাররা গলায় গামছা দেয়? গুম, খুন করে ফেলে? অবশেষে বোনের মাধ্যমে ফোনে সেলিমকে পাওয়া গেল আজ। বললাম, “কাজটা তুমি মোটেই ভাল করো নি”।
    — জ্বী। তার সরল স্বীকারোক্তি।
    — এভাবে বাসার সবাইকে টেনশনে রাখা উচিত হয়নি। বিশেষত আম্মাকে।
    — জ্বী
    — তা এখন কি করবা?
    — জানিনা
    — একটা কিছু তো করতে হবে
    — কি করবো?
    — মুদির দোকান হলেও দাও
    — পয়সা নাই
    — এত এত টাকা কি করছো?
    — লস খাইছি
    — এখন পাওনাদারদের টাকা দিবা কেমনে?
    — জানিনা
    — জানিনা বললে তো হবেনা। ওরা তো আবার আসবে। তোমাদের বাড়ীতে বলো হেল্প করতে
    — দিবেনা
    — কেন?
    — ওখান থেকেও নিয়েছি
    — সেটা দিয়ে কি করেছো?
    — সাভারে মার্কেটে দোকান নিয়েছিলাম। পজিশন পাইনা
    — কেন?
    — যার কাছ থেকে দোকান নিয়েছিলাম আসলে সে ওটার মালিক না।
    — মানে?
    — বন্ধু ভুল বুঝিয়ে টাকাটা মেরে দিয়েছে।

    তার সাথে আলাপ করতে আমার মন আর রুচির কোনটাই হচ্ছেনা। অধিক শোকে পাথর হয়ে ফোন ছেড়ে দিলাম। মনে মনে ভাবছি, ফোনটা না করলেই ভাল হত।

    জামান ভাইয়ের শরীর ভাল না। অফিস করেন ঠিকই কিন্তু দুর্বল দুর্বল ভাব। বললাম, “চলেন সাজেক ঘুরে আসি। ভালো লাগবে। সবার কাছেই শুনি। আমি যাইনি কোনদিন”। হাসলেন। বললেন, “ছোট ভাই, মনটা আজ কয়দিন যাবত ভালো না। কেন জানি খুব অস্বস্তি লাগছে”। “কেন” জানতে চাইলেও কিছু বললেন না। জেমির কথা মনে হলো। জেমির সাথে দেখা হওয়ার পথ রুদ্ধ। কথা বলাও। তার উপর রাগ হলো। দুঃখও হলো। রাগ না দুঃখ ঠিক কোনটা হলো বুঝে উঠতে পারছিনা। থেকে থেকে অভিমানও হচ্ছে। ইলমাকে ফোন দিতে মন চাচ্ছে। বাটনে আঙ্গুল নিয়েও ফিরিয়ে নিলাম।

    একদিনের কথা মনে পড়ে গেলো। ধানমন্ডির দৃক গ্যালারিতে নবীন চিত্র শিল্পীদের চিত্রকলা প্রদর্শনী চলছিলো। জেমিই খবর এনেছে। সেখানে সিলেকটিভ লোক জন যায়। কেউ যায় কলা দেখতে। কেউ কলকাকলি করতে। দোতলায় ঘুরে ঘুরে শিল্পীদের চিত্র কর্ম দেখছি। দেখছি বললে ভুল হবে। জেমি দেখছে। আমি তার নিকটবর্তী হওয়ার চেষ্টা করছি। ভিজিটরের সংখ্যা কম। যারা এসেছে তাদের মধ্যে চার ধরনের লোক রয়েছে। এক, চিত্র বোদ্ধা। দুই, অংশগ্রহনকারী শিল্পীদের পরিচিতজন। তিন, এসির বাতাস খাওয়া ও সময়ক্ষেপনকারী। আর চার, অল্প বয়ষ্ক জুটি। তারা হাত বগলদাবা করে, কখনো কাঁধে হাত রেখে, আবার কখনো আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙ্গুল লেপ্টে চিত্রকলা দেখার নামে নিরবে পাশা খেলছে। এদেরকে দেখে আমার কেন জানি অসহ্য লাগছে। বললাম, “দূর ছাই। এগুলো ছাতামাতা কি এত দেখছো”? “কেন, কি হয়েছে? ভালো লাগছে না”? জেমির প্রশ্ন। বললাম, “এ জন্য ডেকে নিয়ে এসেছো এখানে”? জেমি কেমন করে যেন তাকালো। মুচকি হেসে বললো, “অন্য কোন মতলব আছে নাকি”?

    আমি থতমত খেয়ে বললাম, “মানে”? জেমি এক জুটির দিকে চোখ ফেললো। ধরা খাওয়ার লজ্জায় বললাম, “কি যে বলো? আমার সেই ভাগ্য আছে নাকি”? বলা শেষ। অমনি হাতটা নিয়ে তার হাতের সাথে লেপ্টে নিলো। আমি কারেন্টের শক খাওয়ার মত হাত ছাড়িয়ে নিলাম। জেমি হাসলো। বললো, “ভিতুর ডিম। তার আবার খায়েস কত”? কখনো কখনো লজ্জা রাখার জায়গাও পাওয়া যায় না। বললাম, “এখানে চা-কফির ব্যবস্থা নেই। নীচে পিছনের গলিতে আছে। চলো”। সেই স্মৃতি আজো মনে পড়লে হাসি পায়।

    ইদানীং সন্ধ্যার সময়টায় খুব অস্থির লাগে। দিন রাত্রির পালা বদলের এই স্বল্প সময়টায় বিষন্নতা ভর করে। মনে হয় কি যেন বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে আর ফিরে আসবেনা কোন দিন। মহাকালের আবর্তে কালের এই যাত্রা অন্তহীন, নিত্যই উধাও। অস্বস্তি কাটাতে তাই মাগরিবের নামাযকেই উৎকৃষ্ট বিকল্প বলে মনে হয়। নামায শেষে মুসুল্লীদের সমাগম কিছুটা কমলে ইমাম সাহেবের কাছে গিয়ে বসি। কিছু বয়ান হয়। অনেকেই মাসলা মাসালা জিজ্ঞেস করে। অনেক মাসালা আমার নিজেরও জানা। অনেক অজানা। এভাবেই ইমাম সাহেবের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ব্যাক্তিগত বিষয়াদি ছাড়াও নানাবিধ আলোচনা হয়। তাঁর বাড়ী হবিগঞ্জ। উচ্চারণে সিলেটি প্রভাব নাই বললেই চলে। একদিন একান্তে পেয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “হুজুর, কাউকে ভালোবাসা কি অন্যায়”? ইমাম সাহেব হাসলেন। বললেন, “বাবাজী কি পেরেশানীতে আছেন”? আমি ধরা খাওয়ার মত লজ্জা পেলাম। বললেন, “যাকে ভালোবাসেন তারে তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলেন”। আমি মাথা নাড়লাম। কিন্তু মানুষ চাইলেই কি নামতার মত সব ক্ষেত্রেই দুই দুগুনে চার হয়?

    অস্থিরতা এমন এক বায়বীয় জিনিস যা বুকের গভীরে থেকে বিনাশী আগ্নেয়গিরির মত থেকে থেকে চাড়া দেয়। কিছু অস্থিরতা আছে অন্য কারো সাথে শেয়ার করা যায়। তাতে বুকের ভেতরে থাকা বিষবাষ্প নিঃসরণের সুযোগ পায়। পরামর্শ পাওয়া যায়। কিন্তু এমন কিছু অস্থিরতা আছে যা কারো সাথে শেয়ার করা যায় না। এর দহন জ্বালা মারাত্মক।

    আম্মার ফোন। বিপর্যয় যখন আসে তখন হাতে হাত ধরে আসে। সেলিমকে বাসা থেকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। সেই পাওনাদাররা থানায় মামলা করেছে। বড় মামা, ছোট মামা সব থানায়। বোন থেকে থেকে মুর্ছা যাচ্ছে। আম্মার প্রেসার উপরে উঠে বসে আছে সেই থেকে। এপার্টমেন্টের সবার কাছে মানসম্মান যা যাবার গেছে। থানা থেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার কোন উপায় নেই। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কাল কোর্টে তোলা হবে। সেখানেই জামিনের ফয়সালা যা হবার হবে। বাসা থেকে খাবার আর কিছু কাপড় নিয়ে গেছে মলি আর মামারা। আমার কোন প্রেসারের সমস্যা ছিলো না। এখন মনে হচ্ছে মাথা ঘুরছে, ঘাড়ও ব্যাথা করছে। চোখে ঝাপসা দেখছি। গলা শুকিয়ে কাঠ। জামান ভাইয়ের কাছে গিয়ে বসলাম। খুলে বললাম সব। হাসলেন। বললেন, “ছোট ভাই, এতেই ঘাবড়ে গেলে? যা হবার হয়ে গেছে। লিভ ইট। এখন বোল্ডলি সিচুয়েশন ফেস করতে হবে। ইউ হেভ টু ফাইল এ বেইল পিটিশন, এন্ড কনভিন্স দা লারনেড কোর্ট সো দেট বেইল বি গ্রান্টেড”। সমস্ত কাহিনী শুনে তিনি আরো বললেন, “ফাইল কেইসেস এগেইন্সট দৌজ হু চিট হিম টু রিকভার মানি”। আরো বললেন, “দুনিয়া কো লাত্থি মারো, দুনিয়া তুমারি হ্যায়। শুনো নি”? তার কাছে বসে আলাপ করে অনেকটাই হাল্কা বোধ করলাম। গা ঝাড়া দিয়ে উঠলাম। ছোট মামা সরকারি চাকরি করেন। তাকে বললাম জামান ভাইয়ের পরামর্শ মত কাজ করতে। রাতে ডিনারের পর জামান ভাই বেলকনিতে ডেকে নিয়ে বললেন, “এখনই এত হার্ড লাইনে যাওয়া দরকার নেই। যাদের কাছে সে টাকা পায় তাদের সাথে কনটাক্ট করো, মামলার ভয় দেখাও। উকিল নোটিশ পাঠাও। এনগেজ পলিকাল পাওয়ার, ইউজ মাসল, ইফ সিচুয়েশন ডিমান্ডস সো”। কাঁধে হাত রেখে বললেন, “ধরে নাও তোমরা এখন ওয়ার ফিল্ডে আছো। অল ইজ ফেয়ার ইন লাভ এন্ড ওয়ার। পড় নি”? তার কথা শুনে মাথা ঘুড়ানী কমে গেল। স্পষ্ট দেখতে পারছি শামুকের মত গুটিয়ে থেকে লাভ নেই। অফেন্সিভ হতে হবে। নাচতে নেমে ঘোমটা টেনে লাভ নেই।

    চলবে…

  • ঝাপসা দুপুর (পর্ব-৩)

    ঝাপসা দুপুর (পর্ব-৩)

    টয়া আজ রাতের বাসেই ঢাকায় ফিরতে চায়। তার মামী কল করে ফিরে যেতে বলেছে জরুরি ভিত্তিতে। মুমুর কাছ থেকে এ কথা শুনে বাসায় চলে আসি। রিসোর্ট থেকে ওদের বাসায় ফিরতে বলে আমি দোকানে গিয়েছিলাম।

    কি কারণে, কেন যেতে বলেছে জিজ্ঞেস করে কোনো সদুত্তর পেলাম না। বরং রাতের বাস আছে কিনা উল্টো জিজ্ঞেস করলো। পরদিন যেতে বলেও লাভ হলো না। শেষে দশটার দিকে বাস স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। বাস রাত দুটোয় ছাড়বে। কি যেন গাড়ির সমস্যা হয়েছে।

    টয়া মুখ কালো করে বলল, এতক্ষণ বসে থাকবো! বাসায় আণ্টির কাছ থেকে কত আদর নিয়ে বিদায় নিলাম এখন আবার ফিরে যাবো?
    — না, বাসায় ফেরার দরকার নেই। একটা সুন্দর কফি শপ আছে টিলার উপর। এতোক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে তবে আমি বললে পেছনে চেয়ার পাতা খোলা অংশে বসা যাবে। টিলার উপরে বসে জোছনায় ভেজা সবুজ গাছপালা দেখতে তোমার হয়তো ভালো লাগবে। যাবে?
    — বাহ্ শুনেই তো লোভ হচ্ছে।

    আমি পরিচিত বন্ধুর বাইক কল করে আনাই। ব্যাগ কাউন্টারে জমা রেখে টয়াকে নিয়ে রওনা হই।

    উচু টিলার উপর আধো অন্ধকারে টয়ার পাশে বসে আছি। নীচের ঘন গাছপালা একে অপরকে জড়িয়ে আছে। টয়া মুগ্ধ হয়ে জোছনায় ভেজা প্রকৃতি দেখছে।
    — ভালো হয়েছে বাস লেট করবে। এতো সুন্দর দৃশ্য মিস হয়ে যেত।
    — তোমার আজ যাওয়া কি খুব জরুরি ছিল? থাকলে আরো জায়গা ঘুরে দেখাতাম।
    — আছে না লামিয়া, কংকা। ওদের দেখান। ওরা খুশি হবে।
    — টয়া, তুমি আজকের ঘটনায় রাগ করেছো?
    — না না, রাগ করবো কেন? আপনার ভালো লাগা সেটা একান্ত আপনার। আমি কেন রাগ করবো?তাছাড়া আপনি এতো কৈফিয়ত দিচ্ছেন ই বা কেন?

    আমি চুপ হয়ে যাই। সত্যি তো!
    — টয়া!

    • জ্বি!
      — তোমার মামী এতো জরুরি ভিত্তিতে কেন ডেকেছে?
      — জানি না তো।
      — বিয়ে বিষয়ক কি?

    টয়া হেসে উঠে বলে, কার বিয়ে, আমার? কি যে বলেন। আমার কেন বিয়ে হবে? আমার মামাতো বোন পিউর আগে বিয়ে হবে। ও বেশ সুন্দরী। আমার মতো বেশভূসা বা চলন বলনও না। দেখা মাত্রই পছন্দ হওয়ার মতো। ওকে রেখে আমাকে কে বিয়ে করবে?
    — তোমার আগে তোমার ছোট বোনের বিয়ে হবে?
    — হবে, এ আর এমন কি।
    — আর তোমার?

    • আমারও একসময় হবে। আসলে যার বাবা মা ভিন্ন ভিন্ন সংসারে নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকে তাদের মেয়ের বিয়ে দেয়া কি আর সহজ কথা, বলেন?
      — এটা কি তোমার কথা নাকি তোমার মামা-মামীর কথা?
      — তারা কেন বলবে? তারা আমার ভালো চায়। এটা সমাজের কথা। সমাজ বড্ড খারাপ জিনিস। যারা একা, অসহায়, সমাজ তাদের আরো একা করতে পছন্দ করে।
      — কিন্তু তুমি বললে তোমার পরিবার তোমাকে অনেক ভালোবাসে। পরিবার এক থাকলে সমাজ তো পাত্তা পায় না।

    টয়া আমার দিকে চেয়ে হঠাৎ হেসে ওঠে। অন্ধকারে মুখ ফিরিয়ে বলে সে পরিবারের অংশ নিজেকে ভাবাই ভাগ্যের ব্যাপার। বাদ দেন তো। মামা মামী যখন বিয়ে দেবে আমি চুপচাপ করে নেবো কোনো কাহিনী ছাড়া।
    — তোমার কোনো মতামত নেই?
    — ওদের মতই আমার মত। আমার নিজেস্ব কোনো পছন্দ তো নেই। কাউকে আজ পর্যন্ত প্রেমেও ফেলতে পারি নি। টয়া হাসতে থাকে।

    আমি চুপ করে টয়ার দিকে চেয়ে থাকি। ওর হাসিটা কেমন যেন প্রাণহীন।

    হাসি থামিয়ে বলে, আমি আসলে আমার পরিবারের ব্যাপারে কোনো দ্বিধা মনের মধ্যে বসতে দেই না। তারা ছাড়া আমার আছে কে? পরিবার ছেড়ে একা হয়ে চলা আমি ভয় পাই। আমার কাছে পরিবারের প্রাধান্য অনেক বেশি, সবচেয়ে বেশি।

    টয়ার দৃষ্টি কেমন যেন উদ্দেশ্যহীন, বিভ্রম জড়ানো।
    — মইন ভাই, আগেও বলেছি আপনার পরিবারের প্রতিটা মানুষ ভালো। মুখে সারাক্ষণ ভালোবাসি ভালোবাসি বলার প্রয়োজন পড়ে না। এটা উপলব্ধির ব্যাপার। আপনার কোনো একটা ভুল সিদ্ধান্ত কিন্তু সব শেষ করে দিতে পারে।
    — বিয়ের কথা বলছ তো, ভালো মেয়ে কোথায় পাবো?
    — আপনি চাহিদা বিহীন নির্ঝঞ্জাট মানুষ। আপনার পাত্রীর অভাব হবে না।
    — তাই? দু একটা পাত্রীর সন্ধান দাও তো।
    –শুনেছি প্রকৃতির মাঝে বেড়ে ওঠা মানুষের মন অনেক বড় হয়। এ শহরের কাউকে বেছে নিতে পারেন।
    — তেমন কাউকে কখনো মনে ধরে নি।
    — কোনো অপরিচিত নতুন মুখ বেছে নিন।
    — আগ্রহ নেই।
    — লামিয়া ভালো হতো। কিন্তু ফাজিলটা তো প্রেম করে।
    –আফসোস! এতো ভালো মেয়ে হাত ছাড়া হয়ে গেল।

    টয়া হেসে ওঠলো । আমি মৃদু হেসে বলি, আর কেউ আছে?
    — আমার মামাতো বোন পিউকে করবেন? মেয়ের জামাই হিসাবে মামা-মামীর অনেক আদর পাবেন। পিউ একটু ডিমান্ডিং তবে মন্দ না। এখানে নিয়ে বসলে পিউ বলবে আমাকে সামনের পাহাড়গুলো কিনে দাও না প্লিজ!

    আমি হেসে বলি ওতো বড়লোক আমি নই। আর কারো নাম বলো।
    –আর কে? যে আপনাকে যত্ন করে রেঁধে খাওয়াচ্ছে, আপনার আলাদা খেয়াল রাখছে….তার নাম শুনতে চাইছেন?
    — তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি কংকার প্রতি আগ্রহী?
    — নয় তো কি? আমার প্রতি আগ্রহী তো আর না।

    আমি চুপ করে টয়ার চোখের দিকে তাকাই ।

    টয়া চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বলে, আমাদের ফেরা উচিত। আপনি কল করে দেখেন গাড়ি ঠিক হয়েছে কিনা।
    — হুম দেখছি।

    বাস একঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেবে। স্টেশনে ফিরতে বললো।

    টয়ার নাম্বারটা নিয়ে নিজেরটাও দিলাম। বাসায় পৌঁছে কল করে জানাতে বললাম।

    বাস ছেড়ে দিলে আমি একা হাঁটতে থাকি নির্জন রাস্তায়। কেন যেন বাসায় ফিরতে মন চাচ্ছে না।

    অদ্ভুত শূন্যতা ভর করেছে মনে।

    আরো কথা বলতে ইচ্ছে করছে টয়ার সাথে। কিন্তু কি বলবো কল করে। কিছুক্ষণ আগেই তো চোখের সামনে ছিল।

    বাসায় ফিরে চুপচাপ রুমে ঢুকে পড়ি।

    কিছু ভালো লাগছে না। ঘুম আসছে না। মনটা অস্থির হয়ে আছে। রাত যত বাড়ছে দীর্ঘশ্বাস ততো আষ্টেপৃষ্টে ধরছে।

    হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে।

    এতোটা অপ্রত্যাশীত ছিল যে মনে হলো বুকের স্পন্দন ব্যস্ত গতিতে ছুটতে শুরু করেছে।
    — হ্যালো!
    — গাড়ির টায়ার প্যাংচার। বসে বসে বোর হচ্ছি। ঘুম ভাঙ্গালাম কি?
    — না, ঘুম আসছিলো না।
    — গাড়ি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত কথা বলা যাবে?

    আমি হেসে ফেললাম।

    টয়ার বাড়ি ফেরা পর্যন্ত আমাদের কথা চলল। ওর মামী দরজা খোলার আগ মুহুর্তে ফোন রাখলাম।

    ঘুম ভাঙ্গলো দেরীতে তবে মিষ্টি একটা রেশ রয়ে গেল মনে। নিজেকে কেন যেন সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে রইলো নিজের অজান্তে। বাগানে হাঁটতে বেরুলে লামিয়ার হাতে ধরা পরলাম।
    — ভাইয়া আপনাকে অন্যরকম দেখাচ্ছে কেন?
    — কি রকম?
    — খুব সুখী মানুষ লাগছে। অথচ গতকাল মুখ কেমন অন্ধকার করে ঢুকেছিলেন।
    — তাই নাকি? কি জানি!

    কদিন ধরে নিজের মাঝে বুদ হয়ে আছি আমি। দিনের বেলা দোকানে ব্যস্ত থাকি রাতে চুপচাপ খেয়ে ঝটপট রুমে ঢুকে পড়ি। মুমু নিজের মতো করে ঘুরচ্ছে কংকা আর লামিয়াকে নিয়ে। ওদের ফিরে যাওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে।

    রাতের খাবারে বসলে কংকা একটা পাঞ্জাবি এগিয়ে দেয় আমার দিকে।
    — এটা আপনার উপহার।
    — কি দরকার ছিল কংকা?
    –বা-রে, আপনি সেদিন আমাদের এতো সুন্দর শাড়ি গিফট করলেন আমাদেরও তো আপনাকে কিছু গিফট করা উচিত, তাই না?

    মাহিন এবং আন্টিকেও দিয়েছি। এটুকু তো করতেই পারি। টয়া তো আগেই পালিয়েছে আর লামিয়ার মাথায় এসব নেই। তাই আমিই আজ মুমুকে নিয়ে এসব কিনে কানলাম।

    লামিয়ার মুখ মুহুর্তে লাল হয়ে ওঠে। বিব্রত হয়ে বলে, আমাকে তো বলে যাসনি। তাহলে আমিও কিছু কিনতাম।
    — বলে যাবো কেন? সবার ভাষ্য অনুযায়ী তোর মাথায় অনেক বুদ্ধি। কিন্তু জায়গা মতো কাজে লাগাস না কেন? নাকি লাগাতে চাস না?

    আমি লামিয়াকে বললাম, লামিয়া তোমার কিচ্ছু গিফট করা লাগবে না। তবে এমুহূর্তে এককাপ চা নিজ হাতে বানিয়ে খাওয়ালে আমি সবচেয়ে খুশি হবো। পারবে?

    লামিয়া হেসে বলল, জ্বি ভাইয়া।

    কংকা তড়িঘড়ি করে বলে, চা আমিই দিচ্ছি। লামিয়ার কষ্ট করার দরকার কি? তাছাড়া আপনি এতো রাতে ঘুমানোর সময় চা খাবেন কেন? এসব বাজে অভ্যাস…

    কংকার দিকে না তাকিয়েই আমি বলি, আমি লামিয়ার হাতের চা-ই খেতে চাই। লামিয়া, চা হলে আমাকে ডেকে দিও। আমি রুমে গেলাম।

    আজকাল রাতগুলো কেন যেন অনেক ছোট হয়ে গেছে। টয়ার সাথে কথা শুরু হলে কিছুক্ষণেই দুটা তিনটা বেজে যায়। খুব সাধারণ কথা হয় আমাদের, প্রতিদিনের কথা। তবু সারাদিন অপেক্ষা করি কখন রাত হবে। মনের মাঝে চাপা আনন্দ কাজ করে। টয়ার মামী কেন জরুরি ভিত্তিতে টয়াকে ডেকেছিল জিজ্ঞেস করি নি। জিজ্ঞেস করেই বা কি হবে? দূরে থেকেও টয়া যেন এখন অনেক বেশি কাছে।

    আজ দোকান মালিক সমিতির মিটিং ছিল। মিটিং শেষে প্রতিবারের মতো বিয়ে কবে করছি এই নিয়ে হাসি ঠাট্টা শুরু হলো। আগে এ ধরনের প্রশ্নে গম্ভীর মুখে এড়িয়ে যেতাম কিন্তু আজ শুনতে খারাপ লাগছিল না।

    ইনকাম ভালো বলে পরিচিত অনেকেই আকার ইঙ্গিতে তাদের বোন শালীদের ছবি দেখাতে চায়।

    বিয়ে নিয়ে আসলে ভাবা দরকার। বয়স তো কম হলো না। সমবয়সীরা সব বউ বাচ্চা নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।

    রাতে খাওয়ার সময় লামিয়া গম্ভীর মুখে বলে, মইন ভাই, জানেন কিছু?
    — কি?
    –টয়া কল করেছিল। ওকে আজ আংটি পরিয়ে গেছে ছেলেপক্ষ।

    আমি এতোটা অবাক হই যে হা হয়ে ওর দিকে চেয়ে থাকি।

    কংকা ঠেস দিয়ে বলে, এমনই হওয়ার কথা। বললাম না মামা- মামী স্বার্থপর, লোভী। আমার কথা তো টয়া পাত্তা দিতো না।

    আমি দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে লামিয়াকে জিজ্ঞেস করি, টয়া রাজি এ বিয়েতে?
    — জানি না ভাইয়া, ও ব্যাপারে কিছু বলল না। আমাকে শুধু আংটি পরানো হয়েছে জানিয়ে রেখে দিলো।

    কংকা বলল, দেখ টয়া মনে মনে খুশি হয়তো। দেখামাত্র যে ছেলে টয়ার মতো মেয়েকে আংটি পরিয়ে দেয় সে একটা গর্ধব। কাজে কম কথায় ফটং ফটং বেশি যখন দেখবে তখন আংটি ফেরত নিয়ে পালাবে দেখিস।

    আমি প্রচন্ড ক্ষেপে ধমকের সুরে বললাম, কংকা সবকিছুর এতো বাজে মন্তব্য করো কেন তুমি?

    কংকা অপমানিত হয়ে লাল মুখে চেয়ে থাকে আমার দিকে। কিছু বলার আগেই আমি নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকে দেই।

    সবকিছু অসহ্য লাগছে। কংকার চেয়েও শতগুন রাগ হচ্ছে টয়ার উপর। একবার বলতে তো পারতো! গতকাল বলল মেহমান আসবে তাই সারাদিন ব্যস্ত থাকবে। মেহমান বিদায় হলে নিজে কল দিবে। কিন্তু কোথাও একবারো বলেনি ওকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে।

    এতোবড় ঘটনা আমাকে পুরোই চেপে গেলো টয়া?

    রাগে ক্ষোভে টয়াকে আমি আর কল করলাম না। মনে মনে আশা ছিল টয়া হয়তো কল দিবে কিন্তু ওর কোনো কল এলো না।

    এরপর দুরাত কেটে গেল টয়া কল করেনি। আমিও অভিমানে কল দেই নি। তবে ভেতরে ভেতরে ভীষণ ভেঙে পড়লাম।

    আমাদের কোনো প্রতিশ্রুতি হয়নি, একসাথে দুজন বিশেষ কোনো স্বপ্ন দেখিনি। তবু কোথাও না কোথাও একটা অধিকার জন্মেছিল। একবার কি বলা যেত না?

    মনের শূন্যতা আবার আমাকে পেয়ে বসলো। সাথে যোগ হলো আকাশ সমান অভিমান।

    বুঝে নিলাম একা ছিলাম, একাই চলতে হবে বাকিটা পথ। কাউকে পাশে পাওয়া, মন খুলে কথা বলার মতো বন্ধু হওয়ার যোগ্যতা আমার নেই।

    চলবে…

    ঝিনুক চৌধুরী

  • ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৫)

    ভাবীর সংসার (পর্ব-৩৫)

    সকাল বেলা হেঁটে হেঁটে সাঈদের বাসার গেটের সামনে গেলেন রাহেলা বেগম। ঘড়িতে হয়তো আটটা বাজে তখন। কাল সারারাত ঘুম হয়নি, প্রচন্ড খারাপ ছিল মন। তাই একদম সরাসরি কথা বলতে ছেলের বাসায় এসে হাজির হলেন তিনি।

    দরজার সামনে গিয়ে তিন বার নক করলেন, কিন্তু কোন সাড়া শব্দ নেই। দরজা ভেতর থেকে লাগানোই মনে হচ্ছে। চার নম্বর বার নক করার পর, দরজা খুললেন সাঈদ।

    মা, কি ব্যাপার এতো সকালে?
    – অফিস নাই আজ?
    – আজ অফিস ছুটি, সরকারি বন্ধ।
    – বউমা কোথায়?
    – জাহান রাতে, ওর খালার বাসায় গিয়েছে।
    – তুই বাসায় একা?
    – হ্যা। আচ্ছা, কোন সমস্যা হয়েছে কি মা?
    – না।
    – হঠাৎ এভাবে সকাল সকাল দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছি। এখন দুই মিনিট বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
    – আয়।

    রাহেলা বেগম ছেলের বসার ঘর দেখছেন, দামী সোফা সেট চক চক করছে, সাদা আর সোনালী কাজ করা পর্দা গুলি বেশ ভারী এবং সুন্দর। বউমা বেশ পরিপাটি সব সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছে। ডাইনিং আসতেই কালো চিকচিক করা ফ্রিজ টি চোখে পরলো। বেশ কিছু শোপিস লাগানো চম্বুক দিয়ে, হাতলেও সুন্দর চেক কাপড়ের কাভার করা। কাচের ডাইনিং টেবিল সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা।

    সত্যি কথা, রাহেলা বেগমের ছেলের ঘরে এসে মন আগের চেয়ে সামান্য ভালো হয়েছে। বউ কত গুছিয়ে সংসার করছে। তারা নিজেরা সুখে আছে৷ এটাই অনেক বিশাল বিষয়, ছেলে মেয়েদের দাম্পত্য জীবনে সুখ থাকলে মায়েদের মন কত শান্তি পায়৷ খুশি হয়, এটা শুধু তারাই জানে।

    কিন্তু একবার সাঈদের ফ্রিজ খুলতে ইচ্ছে করছে, তার ফ্রিজ দিয়েও কি এভাবে বিশ্রি গন্ধ আসে কিনা? দেখতে ইচ্ছে করছে। সম্ভবত আসেনা। এটা একদম নতুন ফ্রিজ। তবে, কেন সে মাকে, এই নষ্ট ফ্রিজ কিনে দিল।

    সাঈদ, মুখ হাত ধুয়ে, মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো, রাহেলা বেগম তাকিয়ে আছেন, তাই সাঈদ কে দেখতেই এখন কত বড় অফিসার লাগে।

    সাঈদ তোর ফ্রিজ অনেক সুন্দর।
    – জাহান পছন্দ করে কিনেছে, আগের ফ্রিজ বিক্রি করে দিয়েছি।
    – তোর মা অনেক গরীব, আর তোর বউ বড় লোকের মেয়ে, এজন্য মায়ের জন্য নষ্ট ফ্রিজ নিয়ে এসেছিস।
    – ওহ, এজন্য তুমি এসেছো?
    – সাঈদ, আমি সব কিছু মেনে নেই, তুই আমার বড় ছেলে, তিন ছেলের মৃত্যুর পর তোকে পেয়েছি। তুই আমার জন্য ছাত্র অবস্তায় অনেক কিছু করেছিস। আমি চাই তুই তোর পরিবার নিয়ে সুখে থাক। যতটুকু করেছিস, তাই আমি খুশি। কিন্তু এই নষ্ট ফ্রিজ দিয়ে কেন লজ্জা দিলি, বলতে পারবি? আমি কি চেয়েছিলাম?
    – এটা আমার বন্ধুর দোকান থেকে নিয়েছি, সে বললো ভালো ফ্রিজ, শুধু হালকা গন্ধ আসে। লেবু রাখলে, নিয়মিত পরিষ্কার করলে, গন্ধ থাকবেনা।
    – তাহলে কানেকশন আসেনি কেন?
    – মা, আমি ফ্রিজের মিস্ত্রি নই। আমি তাকে বিশ্বাস করে এনেছিলাম। আর সামান্য গন্ধ হলে সমস্যা কি?
    – মা তো ছাদের চিল কোঠায় থাকে, গন্ধ হলে সমস্যা কি?
    – আমার ভুল হয়েছে। ভালো ভেবে কাজ করেছিলাম। তোমার দুই মেয়ে বেশি পন্ডিত। আর নাহিদের কথা নাই বললাম। তাদের তো দোষ ধরার শেষ নাই। আমার বউকে তারা পছন্দই করেই না।
    – বউমাকে এখানে আনার দরকার নাই। আমি তোকে বলছি, পরের ঘরের মেয়েকে কেন দোষ দিব?
    – বললাম তো ভুল হয়েছে। শুক্রবার পর্যন্ত রেখে দাও, আমি শুক্রবার মানুষ পাঠিয়ে দিব। আজ আমার খালা শ্বাশুড়ির বাসায় দাওয়াত।

    – দাওয়াত খেতে যা, সমস্যা নাই। কিন্তু তোর নিজের খালা আছে, আপন বোন আছে, তাদের জামাইরা আসে, তাদের ও দাওয়াত খাওয়াতে শেখার চেষ্টা কর। দাওয়াতে যাও, আমি যাই।
    – তুমি কিসের মধ্যে কি বলো?
    – দরজা আটকে দাও, আমি যাচ্ছি। ওরা বাসায় না পেয়ে চিন্তা করবে।
    – বসো।
    – না।

    রাহেলা বেগম আর কোন কথা না বলে বেড়িয়ে এলেন। সাঈদ ও যেন মায়ের সব কথা শুনে চুপ হয়ে গিয়েছে।

    সাঈদ কে তিনি কখনো শক্ত করে কিছুই বলতে পারেন না, তিন পুত্র মারা যাওয়ার পরে, সাঈদ এসেছিল, এক ভুবন খুশি নিয়ে। প্রচন্ড মেধাবী, বুদ্ধিদীপ্ত সাঈদ সারাক্ষণ মায়ের পাশে পাশে থাকতো। আজ সে মা ছাড়া ভালো থাকতে পারে, কিন্তু মা তো তাকে ছাড়া ভালো নেই। ছেলের আচরণে তিনি সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেন নি, অথচ ছেলেকে কঠিন কথা বলেও, এখন যেন আরও বেশি বুকে কষ্টের চাপ হচ্ছে। সাঈদ কি তা বুঝে, হয়তো বোঝার মতো ক্ষমতা এখনো হয়নি!

    পলি স্কুলের সামনে নিয়াজ কে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। স্কুলের ভেতরে যাবে কিনা, বুঝতে পারছেনা। এই শহর খুব বেশি ব্যস্ত। স্কুলের সামনে চানাচুর ওয়ালা, আমড়া ওয়ালা সহ বিভিন্ন ধরনের হকর রা দাঁড়িয়ে আছে।

    নিয়াজ বললো ভাবী চলো।
    -তুমি যাও, আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি।
    – তুমি একা থাকবে?
    – সমস্যা নাই।

    নিয়াজ ভেতরে গিয়ে কথা বলছে, পলি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়ীর আচল বার বার সামনের দিকে আনছে, কেমন লজ্জা লাগছে তার।

    সাদা ধবধবে শার্ট পরা আবিদ বাইরে আসছে নিয়াজের সাথে কথা বলে বলে। পলির বুক ধড়ফড় করছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ বহুদিন বিদেশে থেকে, এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে আসছে।

    পলি, কেমন আছ?
    – ভালো আছি।
    – আব্বা, সকালে কল দিয়েছেন, এজন্য অপেক্ষা করছি। আমি ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ক্লাস নেই। তাদের ছুটি হয়ে গিয়েছে। শুধু নাইন টেন বাকি। কিন্তু আমি জানি, তোমাদের স্কুলে আসতে দেরী হবেই। এতো লম্বা জার্নি।
    – হুম।
    – খাওয়া দাওয়া করেছ?
    – ক্ষিদা নাই।
    – কি যে বলো, চলো তিনজন খেয়ে নিই।

    দারোয়ান বলছে, স্যার ভাবী সাব নাকি?
    – হ্যা জয়নুল ভাই।
    – আসসালামু আলাইকুম ভাবীসাব।

    পলি সালামের উত্তর দিয়ে হাসলো।

    আবিদ খুব সহজেই তার আসা মেনে নিল, এটাই তার বেশ অবাক লাগছে!

    খাওয়া-,দাওয়ার পর, আবিদ তার বাসায় নিয়ে গেল, আবিদ রাস্তার বললো আমি যে বাসায় থাকি, সেখানে একজন খালা আর খালু আছেন, তারাই বাড়ীওয়ালা। তাদের সব ছেলে-মেয়ে বিদেশ থাকে। তাদের একটা রুমে আমি থাকি, আগে তাদের উপর তলার মেসে থাকতাম। কিন্তু খালু গতমাসে তাদের নিচের তলার গেস্ট রুমে থাকতে বলেছেন। উনারা আমাকে নিজের ছেলের মতো আদর করেন।
    – আগে তো বললে না রুম নিয়েছো?
    – চিঠিতে কি এতো কিছু লিখা যায়? চলো।

    পলিকে দেখে খুব আদর করছেন মহিলা। আবিদ খুব লজ্জা পেয়ে বলছে, খালা আমি আসলে জানতাম না আব্বা ওকে পাঠাবেন, নয়তো বাসা নিতাম।
    – এটা কি মেস নাকি? এটা তো বাসা।
    – বউয়ের চেহারা খুব মিষ্টি। খুব ভালো হয়েছে এসেছো। আবিদ সকালে স্কুলে যায়, আর ফিরতে ফিরতে দশটা। এখন আমাদের বুড়ো-বুড়ির সময় ভালো কাটবে।

    নিয়াজ সারা রাস্তা আসলো, অথচ স্কুলে পৌছেই বললো দাদাভাই আমার বন্ধু চবি তে পড়ে আমি চলে যাচ্ছি।
    – খেয়ে যা।
    – না, আমি চলে যাচ্ছি।

    আবিদ জোড় করেই খাওয়ে দিয়েছেন। কিছুতেই আর সাথে আসেনি নিয়াজ। রাতের ট্রেনেইন্সে আবার ফিরে যাবে।

    পলি, রুমে গিয়ে দেখলো একটা সিংগেল খাট, আর একটি আলনা আছে, আর কিছুই নেই। তার একমাস এই বাসায় কাটবে, আস্তে আস্তে কিছু জিনিস কেনা দরকার। আবিদ কি কিনবে? না বলবে থাক, কেনার দরকার নাই, এক মাসই মাত্র থাকবা! কিনে কি হবে। তারপরও পলির বেশ আনন্দ লাগছে, আবিদের কাছে এসে।

    রাহেলা বেগম বাসায় এসে দেখেন জলির জামাই উপস্থিত। তিনি রুমে ঢুকতেই পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো জামাই। তিনি কুশল বিনিময় করে ভিতরে গেলেন।

    কলি বললো কাউকে কিছু না বলে, কোথায় গিয়েছিলে মা?
    – হাঁটতে।
    – নাহিদ তোমাকে খুঁজতে বেড়িয়েছে, যদি হেরে যাও।
    – আমু কি শিশু যে হারিয়ে যাবো। জলির জামাই কি মনে করে? জলি ভালো আছে?
    – ডাক্তার ব্জলিপাকে বেড রেস্টে থাকতে বলেছে। আর ঢাকায় একজন ভালো গাইনী বিশেষজ্ঞ দেখাতে বলেছে, দু এক দিন পর ঢাকায় নিয়ে আসবে। এখন দুলাভাই চাইছে ডেলিভারি এখানে করাতে। ডেলিভারির আর দুই মাস মাত্র বাকী, এই সময় আমাদের বাসায় রাখতে চাইছে। তোমাকে লজ্জা পায়, তাই বলেনি।
    – এখানে থাকবে! আচ্ছা। কিছু খাবার দিয়েছিস?
    – কি দিব? মুড়ি?
    – নাই নাই করার অভ্যাস গেল না। ময়দা আছে ডিম আছে, রুটি আর ডিম ভাজি দে, এখন আর কি দিবি। দুপুরে ভালো কিছুর ব্যবস্থা করছি।

    রাহেলা বেগমের চিন্তায় ভালো লাগছেনা, মেয়ে এখানে এনে এতো দিন কোথায় থাকবে? পোয়াতি মেয়ের কত যত্ন দরকার। আবার সাথে সাথেই ভাবছেন, কিন্তু মেয়েদের এই সময় মাকেই বড় বেশি দরকার। তিনি কি খুব স্বার্থপর হয়ে যাচ্ছেন! না, থাক নুন-ভাত যাই হবে, তাই খাওয়াবেন মেয়েকে। তবুও আসুক, চোখের সামনে থাকবে, তাই শান্তি।

    তিনি আবার জামাইয়ের সামনে যেতেই সে বললো,

    আম্মা, আপনি ব্যস্ত হবেন না। আমি বাইরে রুটি সবজি খেয়ে এসেছি।
    – কেন বাবা?
    – সাত সকালে ঝামেলা করবেন না।
    – জলির কি শরীর খারাপ?
    – জি, জটিল কিছুনা তবে, পা ফুলে আছে। শরীরেও পানি এসেছে। আমার মা, চাইছেন আপনাদের কাছে থাকুক। আর এখানে একজন ভালো ডাক্তার দেখানো জরুরি।
    – বেয়ান কে অশেষ ধন্যবাদ মেয়েকে এই সময় এখানে দিচ্ছেন। তুমি ওকে নিয়ে আসো বাবা।
    – আমি কি কষ্টে ফেলে দিচ্ছি আম্মা?
    – বাবা কি যে বলো! এই মেয়েটা আমার মেয়ে। কি কষ্ট দিবে তুমি?
    – জলি, আসতে রাজী না। ভাবছে বাসা-বাড়ীতে কষ্ট হবে। আমি চিন্তা করলাম ভাইজানের বাসাও আছে। মিলেমিশে থেকে যাবে।
    – হ্যা বাবা।

    রাহেলা বেগম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলছেম আর ভসবছেন ভাইজানের রাজপ্রাসাদ বোনেদের জন্য না বাবা। সহজ-সরল মেয়েটা এসব বুঝেনা।

    বাড়ীওয়ালা এর মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন, ভাবী আপনার ছোট ভাইয়ের ফোন। একটু নিচে আসেন।
    – আসছি।

    রাহেলা বেগম দৌড়ে গিয়ে ফোন ধরলেন।

    বুবু আসসালামু আলাইকুম।
    – ওয়ালাইকুম আসসালাম। বুবু ভালো আছ?
    – ভালো আছি তুই?
    – ভালো। শোনো আমার কলিগের ছোট ভাই ফরেস্টে চাকরি করে। কলির ছবি দেখে পছন্দ করেছে। আমি জাহিদের সাথে আলাপ করে, এই নাম্বার পেলাম।
    – এখন বিয়ে না ভাই।
    – দেখুক সমস্যা কি? এখানে নাকি দুই রুমের বাসা! সাঈদ সেদিন বললো বড় বাসা নিয়েছে। তুমি ওর বাসায় আয়োজন কর।
    – না, এখানেই…
    – আরে বুবু প্রথম দর্শন সুন্দর রাখতে হয়, আর কষ্ট করে দুপুরে খাওয়ার ব্যবস্থা করবে। তারা নারায়ণগঞ্জ থেকে আসবে।
    – শোন।
    – আমার বস ডাকছে যেতে হবে। রাতে ডিটেইলস বলবো। তুমি কালকের জন্য প্রস্তুতি নাও। রাখছি।

    কট করে কেটে গেল ফোন। রাহেলা বেগম ফোন রেখে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছেন। কি করবেন তিনি? কেমনে বলবেন যে, বড় ছেলের বাসায় এটা সম্ভব নয়। আর তার মেয়েকে এখানেই দেখে পছন্দ করলে করবে। তবুও তিনি ছেলের কাছে আর কিছু বলবেন না। কালকে দুপুরে কি খাওয়াবেন ছেলে পক্ষকে? কালকের চেয়ে এই মুহুর্তের চিন্তা আরো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, জামাই কে কি দিয়ে ভাত দিবেন? তিন টা ডিম আর সবজি ছাড়া আর কিছুই নেই ঘরে! নাহিদের কাছে টাকা আছে কিনা কে জানে! শাহিদের বেতন দিয়ে বাসা ভাড়া দেওয়া শেষ। এই ভবের এতো যন্ত্রণা আরও ভালো লাগেনা তার, তবুও সব সহ্য করে সুন্দর সমাধান দিতেই হবে কারণ তিনি যে, মা…..

    চলবে…

    আন্নামা চৌধুরী।
    ০৭.০২.২০২২

  • ঝাপসা দুপুর (পর্ব-২)

    ঝাপসা দুপুর (পর্ব-২)

    ভোরে বাগানে হাঁটছি। লামিয়ার চোখ পড়তেই মোবাইল কান থেকে সরিয়ে নিল।

    আমি না দেখার ভান করে অন্যপাশে হাঁটতে গিয়ে টয়ার সাথে রীতিমতো ধাক্কা খেতে খেতে বাঁচলাম।

    টয়া এলোমেলো চুলে ঘুমঘুম চোখ তুলে আমাকে দেখে হেসে বলল, শুভ সকাল মইন ভাই।
    — টয়া, তুমি এতো ভোরে?
    — অবাক কাণ্ড না? আমি নিজেও নিজেকে দেখে অবাক। আমি এতো সকালে কিভাবে উঠলাম। হাউ?

    পেছন থেকে কংকা হেঁটে এসে বলল, কিরে টয়া আজ এতো সকালে? তোর তো নয়টার আগে ঘুমই ভাঙ্গে না!
    — সেটাই তো, আজ এমন অঘটন কেন ঘটলো তাই তো বুঝলাম না।

    টয়া হেলেদুলে সামনে এগিয়ে গেলে কংকা বলল, মামা মামীর সাথে থাকে তো যত বাজে অভ্যাস সব ওর মধ্যে আছে। দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, ঝাব্বাঝুব্বা পোষাক পরা, কোনো রান্না না পারা, ছেলেদের সাথে মেশা, সবার সাথে বেয়াদবের মতো কথা বলা, সব বদঅভ্যাস।

    লামিয়া এসে বলল, টয়া বেয়াদবের মতো কথা বলে না, উচিত কথা বলে।
    — আসছে টয়ার ভয়ে থাকা আমজনতা। আমি কি তোর মতো? টয়া বেয়াদব সুতরাং সে বেয়াদব। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই।
    — তাহলে টয়ার সামনেই বলতি।
    — আমার অযথা ঝগড়া করার ইচ্ছে নেই। জানেন মইন ভাই, টয়ার মামা-মামী আস্ত একটা ক্রিমিনাল। সবকিছুতে নিজের স্বার্থ দেখে। আমাদের সাথে আনতে ওর মামীকে কত যে অনুরোধ করতে হলো। এমন স্বার্থপর মানুষ তারা যে কি বলবো।

    আমি বিড়বিড় করে বললাম, টয়া মামা- মামীর সাথে থাকে?

    কংকা আবার বলল, নিজ পরিবার নেই বলে টয়া ভালো শিক্ষা পায় নি।

    কংকা চলে গেলে আমি লামিয়ার দিকে তাকাই। টয়া মামা-মামীর সাথে থাকে?
    — জ্বি ভাইয়া, তবে কংকা যেভাবে বলল ওতো ভয়ংকর জীবন টয়ার না। আপনি টয়াকেই জিজ্ঞেস করুন।

    টয়ার দিকে এগিয়ে যাই আমি। ওর চলন বলনে কেউ বলবে না সে অন্যের বাড়িতে আশ্রিতা। বরং ওকে দেখলে মনে হয় অন্য দশের চেয়ে সে বেশি প্রশ্রয় পায় পরিবারে।

    টয়াকে কিছু বলার আগেই সে বলে ওঠে, এ বাগানের দেখাশোনা কি আপনিই করেন মইন ভাই?
    — না, একজন মালি আছে। তবে আমিই বেশিরভাগ সময় দেই।
    — আপনি খুব সৌখিন মানুষ। আচ্ছা আপনি কি ফুলেদের সঙ্গে কথা বলেন?
    আমি হেসে বললাম, না তো? এমন আজব প্রশ্ন মাথায় এলো কেন তোমার?
    — না মানে অনেকে কাব্যিক ঢংয়ে বলে না ফুল,পাখী লতা, পাতা আমার বন্ধু, আমি তাদের সাথে কথা বলি।
    — আমি কাউকে বলতে দেখিনি।

    টয়া দাঁত বের করে হেসে বলে আসলে আমিও দেখি নি। আপনার সাথে কাব্যিকতা চালাতে চেয়েছিলাম। আপনি নিষ্ঠুরভাবে ব্রেক টেনে ধরলেন।
    — টয়া, একটা প্রশ্ন ছিল…তুমি… তোমার…
    — বলে ফেলুন মইন ভাই। মামার সাথে থাকি সে ব্যাপারে জানতে চাচ্ছেন তো?

    আমি কী বলব বুঝছিলাম না। টয়ার গম্ভীর মুখ দেখে বিব্রত হয়ে পড়ি।
    –আমিই উত্তর দিচ্ছি। হ্যাঁ আমি মামার সাথে থাকি। তবে এটা দুঃখের কিছু নয় আমার জন্যে।

    আব্বু আম্মুর ডিভোর্স হয়েছে ছোট বেলায়। আব্বু প্রথমেই আমার দায়িত্ব নেয়নি পরে আম্মুর বিয়ে হলে আমাকে মামার কাছেই থাকতে হয়। ছোটবেলা থেকেই পরিচিত অপরিচিত সবাই আমার দিকে করুনার চোখে তাকাতো। আমার ভালো লাগতো না। তাই নিজেকে এমনরূপে সাজালাম যেন করুনা করা তো দূর সবাই রীতিমতো ভয় পায় আমাকে। কেউ করুনা দেখালে আমি রীতিমতো ঘেউ ঘেউ করে উঠি।

    কংকাও আমাকে ভয় পায়। তাই আমার পেছনে সবার কাছে আমাকে অসহায় প্রমাণ করে একধরনের আনন্দ নেয়। আপনার কাছেও কংকা এ কথা বলেছে তাই না?

    আমি ইতস্তত করে বলি না… মানে.. ও রকম…

    • শুনুন, মামা মামী আমাকে অনেক আদর করে।
      — কিন্তু এখানে আসার ব্যাপারে তোমার মামী নাকি অনেক ঝামেলা করেছে?
      — হ্যাঁ করেছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ বাবা-মাই তাদের মেয়েকে নতুন কোনো পরিবেশে পাঠাতে বাধা দেয়। মামী নিজের মেয়ের বেলায়ও তেমনি করতো। আপনিও কি মুমুর বেলায় করতেন না?
      — হুম, তা করতাম…. সরি!
      — আরে বাদ দেন তো! মজার কথা শুনেন, আন্টির সাথে গতকাল আড্ডা দিয়ে কত কি জেনেছি? আন্টির মনটা এখনও বাচ্চাদের মতো। সমুদ্র দেখার শখ, কত আফসোস তার মনে! আন্টি যে ভালো গান গাইতে পারে তা কি আপনি জানেন?
      — ছোট মা গান জানে? আমি খুব অবাক হলাম।
      — হুম। খুব মিষ্টি সুর।

    মুহূর্তে আমার মনে অপরাধ ঘিরে ধরলো। সে রাতে নিজের মূলয়্যান, নিজের চাওয়া-পাওয়া নিয়ে কত কি ভাবলাম। অথচ ছোট মায়েরও কত শখ থাকতে পারে তা কখনো মাথায়ই আসে নি। তথাকথিত সৎ মা ভেবে আমি সবসময় দূরে থেকেছি কিন্তু মানুষ টা দূরে থেকেও আমার যত্ন নিয়েছে।
    — একটা কথা বলি? যদিও কথাটা কংকার মতো কুটনা মার্কা হবে।
    আমি মৃদু হাসলাম।
    — মুরগীর রান কিন্তু আমিও খাই না। পরিবারের বড়রা ছোটদের আদর করে অনেক কিছু স্যাক্রিফাইজ করে। এতে আপন-পর বা আদর-অনাদর ইস্যু আসে না।

    আপনার পরিবারের প্রতিটা মানুষ চমৎকার। তারা ভালোবাসতে জানে। আপনি নিজেকে মেলে ধরুন তবে তা অনুভব করতে পারবেন।

    মনের মাঝে অভিমানী জলকণা পুষে রাখলে ঝলমলে দুপুরও ঝাপসা মনে হয় মইন ভাই।

    আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি।

    টয়া সামনে এগিয়ে যায়। হঠাৎ চাপা শব্দে উহ্ বলে নীচে বসে পড়ে।

    আমি ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করি কি হয়েছে?

    ব্যথায় মুখ লাল হয়ে গেছে তবু বলে কিছু হয় নি। ইটের কোনায় পা লেগেছে একটু।
    –ঠাণ্ডা পানির নীচে পা রাখলে ব্যথা কমবে। এসো এদিকে।

    টয়ার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। আমি ওর হাত ধরে বাগানের কল ছেড়ে ওটার নীচে পা রাখতে বলি।

    টয়া চুপ হয়ে আছে তবে মুখ এখনো কুঁচকে রেখেছে।
    –বেশি ব্যথা হচ্ছে? বরফ দিবে? চলো, ঘরে চলো।
    ওর পায়ের আঙ্গুলে হাত রাখতে গেলে টয়া ঝটপট পা সরিয়ে নেয়।
    — না না, মইন ভাই আমি ঠিক আছি।

    বোকার মতো কি করতে যাচ্ছিলাম ভেবে আমি লজ্জিত হই।
    — সরি.. আমি আসলে…
    — না না ভাইয়া, সরি বলছেন কেন? এতো অস্থির হবেন না। এমন অল্প ব্যথায় কাতর হওয়ার মেয়ে আমি নই। তাছাড়া এতো যত্ন পেয়েও আমি অভ্যস্ত নই।

    আমি টয়ার দিকে তাকালে সে চোখ সরিয়ে নেয়। মুখে হাসি টেনে গলার জোর বাড়িয়ে বলে, আমি অনেক স্ট্রং মেয়ে তো তাই কেউ এতো অস্থির হয় না আমাকে নিয়ে।
    — হুম তোমার জায়গায় মুমু হলে কান্নাকাটি করে হুলুস্থুল করে ফেলতো।
    — আর আপনি অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করতেন। মুমু আপনার যত্নশীলতার কথা আমাদের বলেছে।
    — না ওরকম কিছু না। আসলে মুমুকে একটু বেশিই আদর করি হয়তো। দেখো না কেমন আহ্লাদী হয়ে গেছে।
    –আহ্লাদী হওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আদর পায় বলেই তো আহ্লাদী।
    এখন বেটার ফিল করছি ভাইয়া, আমি যাই।
    — চলো তোমাকে ভেতরে নিয়ে যাই।
    — না না ভাইয়া আমি পারবো।

    টয়া খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেঁটে ভেতরে চলে গেলে আমি একা দাঁড়িয়ে থাকি বাগানের মাঝে।

    আনমনে ভাবি কংকা সারাক্ষণ ছোট মাকে অপরাধী বানাতে চায় অন্যদিকে টয়া বার বার পারিবারিক বন্ধনের গভীরতা বোঝাতে চায়। মামার কাছে বড় হলেও টয়ার চিন্তাধারা কত পজেটিভ অথচ আমি কংকার এক কথায় আমার পরিবারকে নিয়ে কত না প্রশ্ন সাজালাম। কেন? তারা কেবল সৎ বলে?

    আমার নিজের তো আপন কেউই নেই। বন্ধু বান্ধব নেই, কোনো মেয়ের প্রতি ভালোলাগাও নেই। কাউকে ভালোবাসবো, আমার একার সুখের সংসার হবে এমন চিন্তাও মাথায় নেই। তবে কী আমি বাবার স্বভাবই পেয়েছি? স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক!

    এতোদিন ভাবতাম মুমু মাহিন তার মায়ের কাছ থেকে যে ভালোবাসা পেয়েছে সে ভালোবাসা আমি পাইনি।অনেক বেশি অবহেলিত আমি। আমাকে কোলে করে বা পাশে বসিয়ে কেউ কিছু শেখায়নি।

    কিন্তু আজ নিজের কাছে নিজেকে খুব হীন মনে হচ্ছে। পরিবারের সাথে থাকছি, খাচ্ছি, ঘুমোচ্ছি কিন্তু তারপরও নিজেকে অবহেলিত ভাবছি। অথচ পরিবারে আমার সিদ্ধান্ততে সব হয়।

    কেন আমি নিজেকে পরিবারের অংশ ভাবতে পারি না? আমার মনে এতো অভিমান কার বিরুদ্ধে? নিরবে কাজ করে যাওয়া অসহায় ছোট মায়ের বিরুদ্ধে? যার কোনো কিছুতেই সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার ছিল না। নাকি ছোট ভাই বোনগুলোর উপর যারা আমাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে।

    রাতে শোবার সময় টিভির শব্দ পাচ্ছিলাম। পানি খেতে বেরিয়ে দেখি টয়া আর লামিয়া টিভি দেখছে।

    আমাকে দেখে টয়া ডেকে বলে ভাইয়া আসেন, আমাদের সাথে মুভি দেখেন।
    — না থাক তোমরা দেখো।
    — আহা আসেন তো।

    মনে মনে ইচ্ছে যে একেবারে হচ্ছে না তা না। অপেক্ষায় ছিলাম টয়ার জোর দিয়ে বলার। হলোও তাই।

    কিছুক্ষণেই লামিয়া হামি তুলতে তুলতে বিদায় নিয়ে ঘুমাতে চলে গেল। টিভির সামনে রয়ে গেলাম আমি আর টয়া।

    টয়ার পাশে বসে টিভি দেখা অস্বস্তিকর নয় তবুও আমার অস্বস্তি হচ্ছিল। প্রতিদিনের মতো ট্রাউজার ফতুয়া পরে আছে টয়া।

    লম্বাচুলগুলো একপাশে ছড়িয়ে রেখেছে। কিছুক্ষণ আগে হয়তো গোসল করেছে। বার বার চুলে আঙ্গুল চালিয়ে শুকানোর চেষ্টা করছে। আমার চোখ বার বার ওর চুলে আটকে যাচ্ছে। অন্ধকার রুমে আধভেজা চুলে টিভির আলোয় টয়ার মুখটা অসম্ভব মায়াবী লাগছে।

    কেমন হচ্ছে ব্যাপারটা? ভারী অন্যায়। টয়া টের পেলে খুবই লজ্জাজনক হবে। ভাববে একটু হেসে কি কথা বললাম ওমনি মুমুর ভাই প্রেমে পড়ে গেল!

    ছি! মুমুর কাছেও লজ্জা পাবো আমি। ঝটপট দাঁড়িয়ে বলি, তুমি থাকো টয়া আমার ঘুম পেয়েছে।

    টয়াকে রেখে রুমে চলে আসি।

    সকালে নাস্তায় বসলে টয়া টেনে টেনে বলে, মইন ভাইয়ের জন্য স্পেশাল বুটের হালুয়া হচ্ছে না কেন?

    আমি ভুলেই গিয়েছিলাম কংকা বুটের হালুয়া খাওয়াবে বলেছিল।

    কংকা ভারী মুখে বলে, এতো রান্না একা হাতে সামলেও কাউকে সুনাম করতে দেখি না…

    টয়া ফিক করে হেসে বলে, তোর রান্না এতো মজার ছিল যে সব চেটেপুটে খেতে গিয়ে সুনামের ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। জানিস আমার মন কি চায়? তুই সারাদিন এমন রান্না করবি আর করবি আর আমি বাইরে থেকে ঘুরে এসে আয়েশ করে পা নাচিয়ে নাচিয়ে খাবো আর খাবো। আহা…

    ছোট মা বলল, কংকা, তোমার রান্না খুব ভালো হয়েছিল। দারুন রান্না পারো তুমি। তুমি মেহমান এখানে, ঘুরতে এসেছো তাই কর। আর রান্নার ঝামেলায় যেতে হবে না।

    কংকা বলল, মইন ভাই তো আমাদের কোথাও নিলেন না।

    আমি বললাম, দুপুরের পর সবাই তৈরী থেকো একটা রিসোর্টে নিয়ে যাবো।

    দুপুরে ফিরে দেখি সব দরজা লাগিয়ে তৈরি হতে ব্যস্ত। মুমুটাই বরং সবার আগে রেডি। সবুজ শাড়িতে বেশ সুন্দর লাগছে মুমুকে। কি রে বাকি সব রেডি হয় নি?
    –হয়েছে। ওরা মাকে রেডি করছে।
    — মাহিন কি ঘরে?
    –না। মাহিনের রুমে কংকা রেডি হচ্ছে। ও নিরিবিলি তৈরি হতে চায়। সবাই আজ তোমার দেয়া শাড়ি পরেছে।
    দরজা খুলে লামিয়া বের হয়। গোলাপি শাড়িতে লামিয়াকে আরো মিষ্টি লাগছে। ভাইয়া সারপ্রাইজ আছে।
    — তাই নাকি, কি?

    আমি ভাবলাম টয়াকে শাড়ি পরা দেখবো এটাই সারপ্রাইজ বুঝি। কিন্তু না, টয়া মাকে সাথে করে বের হলো।

    মা কামিজ ওড়না পরেছে। আমার সামনে লজ্জায় মরে যাচ্ছেন যেন।

    টয়া বলল, ভাইয়া কেমন সারপ্রাইজ হলো? আন্টি কোনোভাবেই রাজি হচ্ছিল না। দেখেন আন্টিকে কত সুন্দর লাগছে।

    আমি হা হয়ে ছোট মাকে দেখছি। সত্যি ছোট মায়ের বয়স কমে যেন অর্ধেক হয়ে গেছে।

    ছোট মা লজ্জায় নত মুখে বললেন, এতো করে বললাম ছেলেটার দুদিন পর বিয়ে হবে এখন এসব মানায় না। ওরা শুনলই না।

    আমি হেসে বললাম মাহিনের বিয়ের চিন্তা এখনই করছেন কেন? সে তো বাচ্চা ছেলে। তার আগে মুমুকে বিয়ে দেব।

    ছোট মা আরো লজ্জা পেলেন যেন। হেসে বললেন, আমার বড় ছেলে রেখে ছোট ছেলের বিয়ে দেবো কেন?

    টয়া বলল, আন্টি যুগ পাল্টেছে। এখন বউ শাশুড়ী কামিজ পরে একে অন্যের গলা ধরে মুভি দেখতে যায়। আপনিও যাবেন।

    সব হাসতে হাসতে সামনে এগিয়ে গেলেও আমি স্থির দাঁড়িয়ে থাকি। ছোট মায়ের বড় ছেলে আমি, কথাটা মনের মাঝে প্রবলভাবে নাড়া দেয়।

    টয়া পেছন থেকে ডাকে, মইন ভাই!

    আমি চমকে ওর দিকে তাকাই। ছোট মাকে অবাক চোখে দেখতে গিয়ে টয়াকে খেয়াল করিনি। টয়া ওর ফতুয়ার উপর কিভাবে যেন আঁচল উল্টো করে সামনে এনে শাড়ি পরেছে। পায়ে ক্যাডস, চুলগুলো দুই বেণী করা।
    — আপনার দেয়া গিফটের মর্যাদাহানি করিনি তো?
    — মোটেও না। তোমাকে সুন্দর লাগছে। বরং মুমুর মতো শাড়িতে তোমাকে বেমানান লাগতো।
    — সত্যি বলছেন? আপনার খারাপ লাগছে না?
    — না।

    টয়ার চোখ দুটো কেন যেন হালকা দুলে ওঠলো। আমার মনের ভুলও হতে পারে।

    বাচ্চাদের মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে চলে গেল টয়া।

    মাহিনের রুম থেকে নীল শাড়ি পরে কংকা বের হয়। আমি একপলক দেখেই চোখ সরিয়ে নেই। কংকাকে অবশ্যই সুন্দর লাগছে তবে তা দেখে মুগ্ধ হওয়ার কিছু নেই। মন না টানলে কোনো সৌন্দর্য চোখে পড়ে না।

    বেশি দূর না রিসোর্টটা। শহরের ভেতরেই। সবাইকে ইজিবাইকে উঠতে বলে আমি রিক্সায় বসি। ইচ্ছে করে বাইক নেই নি। টয়া যদি শাড়ি পরে আমার পেছনে ওভাবে পা ছড়িয়ে বসে ভয়ংকর হবে ব্যাপারটা। টয়াকে কিছু বলাও যাবে না।

    রিক্সায় বসতেই চমকে উঠি যখন দেখি আমার পাশে কংকা বসেছে।
    — কংকা তুমি?

    শাড়ি ঠিক করতে করতে কংকা বলল, ওখানে জায়গা হচ্ছে না। তাই সবাই বলল আপনার সাথে বসতে।

    আমি আর কিছু বললাম না। ভালো লাগছিল না। মনে মনে আমি টয়াকে আশা করেছিলাম।

    শহরের ভেতর দিয়ে এগুতেই রিক্সা চালককে কংকা হঠাৎ উল্টো রাস্তায় যেতে বলল। আমি জিজ্ঞেস করায় বলল শহরটা একটু ঘুরে দেখি।
    –কিন্তু এটা তো পরেও দেখা যাবে।
    — বেশিক্ষণ না অল্প সময় ঘুরবো।

    কংকা তোতাপাখির মতো বকবক করে যাচ্ছে। বেশিরভাগ নিজের সুনাম।

    আমার অস্বস্তি ও বিরক্তি দুটোই বাড়ছে। কংকার সাজগোজ চোখে পরার মতো। বিভিন্ন মোড় থেকে পরিচিতরা লম্বা সালাম দেয়া শুরু করেছে। অলরেডি দুবার কল এলো বিয়ে করেছি কিনা জিজ্ঞেস করে। মেজাজটাই বিগড়ে গেল। রিকশা চালককে ঘুরাতে বলে গম্ভীর হয়ে বসে থাকলাম। খুব বাজে হলো ব্যাপারটা।

    মুমুরা রিসোর্টের গেইটে অপেক্ষা করছিলো। তাদের দেখে নিজেকে কেমন দায়িত্বহীন মনে হল। সবার চেহারা মলিন হয়ে আছে।

    মুমু বলল, এতো দেরী করলে ভাইয়া?

    কংকা বলল, মইন ভাই আমাকে শহর ঘুরে দেখাচ্ছিল।

    আমি সাথে সাথে টয়ার দিকে তাকাই। মোবাইলে চোখ রেখে দাঁড়িয়ে আছে টয়া।

    সবাইকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলে যে যার মতো ছড়িয়ে হাঁটতে থাকে। কংকা আমার সাথে সাথে হাঁটছিল। ওর ভাবভঙ্গি আমার ভালো লাগছে না। কেমন কথা ঘুরাতে জানে মেয়েটা?

    কংকাকে সবার সাথে যেতে বলে আমি দূরে সরে আসি। একাই দাঁড়িয়ে থাকি কিছুক্ষণ।

    মুমু এসে আমার পাশে দাঁড়ায়। ইতস্তত করে বলে, ভাইয়া কংকা কিন্তু আমাদের বান্ধবী না, রুমমেট। আমরা আসবো প্ল্যান করায় ও আসতে চাইলো তাই মানা করতে পারি নি।

    আমি তাকিয়ে থাকি মুমু কি বোঝাতে চাইছে তা বোঝার জন্য।
    –কংকা অনেক সুন্দরী, অনেক গুণী ;কিন্তু ও…..
    — তুই কি বোঝাতে চাইছিস খুলে বল।
    মুমু আঙ্গুল ডলতে ডলতে বলে, তুমি কি কংকাকে পছন্দ করো? মানে ওকে …
    — তোর কেন এমন মনে হচ্ছে?
    — না মানে কংকা বলল…
    — কি বলেছে কংকা?
    — তুমি রিক্সা ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গিয়েছিলে। একটু আলাদা ঘুরতে চেয়েছিলে…

    এমনিতেই মেজাজ বিগড়ে ছিল এবার সপ্তমে চড়লো। শক্ত চোয়ালে বললাম তোর বান্ধবীর মিথ্যা কথা বলার অভ্যাস আছে নাকি?
    — আছে। প্রায়ই বলে।
    — ওকে আমার সাথে বসতে কেন পাঠিয়েছিলি?
    — আমরা পাঠাই নি। ও নিজে থেকেই গেছে।
    — তুই যা এখান থেকে। ফালতু টেনশন নিবি না। আমি কাউকে পছন্দ করি না, বুঝলি?

    আমি বিরক্ত মনে আনমনে হাঁটি।

    টয়াও কি ভাবছে আমি কংকাকে নিয়ে আলাদা ঘুরতে গেছি?

    টয়াকে একবারের জন্যেও একা পেলাম না। লামিয়ার সাথে যখন হাঁটছিল তখন এগিয়ে গেলাম। দুজনের উদ্দেশ্যে বললাম, কংকা তোমাদের কি বলেছে জানি না তবে ওকে নিয়ে আলাদা ঘুরার কোনো ইচ্ছে আমার নেই।

    টয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে অন্যদিকে চেয়ে বলে, ব্যাপার না। সুন্দর মানুষদের সঙ্গ ভালো লাগতেই পারে।

    খুব জরুরি কিছু দেখলো এমন ভান করে টয়া চট করে সরে গেল।

    লামিয়া হেসে বলল, ভাইয়া এতো টেনশন করছেন কেন? একজনের ভালোলাগা থেকে অন্যজনেরও ভালোলাগা তৈরি হয়। এভাবেই আস্তে আস্তে প্রেম হয়। প্রেম তো খারাপ কিছু না।

    আমি বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকলাম। মেয়ে মানুষের মাথায় এতো আবোলতাবোল ব্যাখা ঘুরে কেন?

    টয়া কি অভিমান করেছে? কিন্তু কেন?

    আমারই বা টয়াকে নিয়ে এতো ভাবাভাবির কি আছে?

    চলবে…

    ঝিনুক চৌধুরী

  • আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৬)

    আজিমপুর টু উত্তরা – ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু (পর্ব-৬)

    • আজিমপুর টু উত্তরা
    • ছিটমহলে আটকে পরা একজন উদ্বাস্তু।
    • আনোয়ার হাকিম।

    (৬)
    এর আগে খাগড়াছড়ি আসিনি। প্রাকৃতিক অপার সৌন্দর্যে লালিত, শোভিত এই উপত্যকা যেন বর্ণিল পশরা বিছিয়ে রেখেছে সর্বত্র। আমার থাকার জায়গা হয়েছে এক ফ্ল্যাট বাড়ীতে অপর তিন সহকর্মীর সাথে। সহকর্মীরা সবাই আমার সিনিয়র। সারাদিন প্রত্যন্ত এলাকায় ঘুড়ে বেড়াই কাজে। সন্ধ্যায় সব পাখী ঘরে ফেরে। তাই বাধ্য হয়েই ঘরে ফিরি। ফেবুতে মজে থাকি। বন্ধুদের সাথে ফোন আর চ্যাটিং করে রাত কাবার করে দেই। জেমির কথা থেকে থেকে মনে পরে। দিনে কাজের মধ্যে যতটা হাল্কা থাকি রাতে ততটাই জেমি নির্ভরতা পেয়ে বসে। আমারই আবেগের বেয়ারা বেগ যে পরিস্থিতিকে আজকের এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে তা বুঝি।

    আমাদের সিনিয়র সহকর্মী কাম হাউজ মেট রশিদ জামান ভাই বড় ভালো মানুষ। বয়স চুয়াল্লিশ-পয়তাল্লিশ হবে। বিয়েশাদি করেন নি। কাজ ছাড়া আর সব কিছুতেই তিনি বড় বেশি উদাসীন। তার কোন পিছু টান নেই। শিশুর মত সরল সহজ এই মানুষটি রাতে খাবার পর দরোজা এঁটে পুরোনো দিনের আধুনিক বাংলা গান করেন। তাও বিরহের। তার ঢেউ এসে হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায়। তাঁকে ঘিড়ে আমার কৌতুহল বাড়তেই থাকে। তার গাওয়া গানগুলো সব বিরহের । এই গানগুলো আগে অনেকবার শুনেছি। কিন্তু হৃদয়ে এভাবে বিঁধে নি এর আগে কোনদিন। শুনতে শুনতে আমি আপ্লুত হয়ে যাই। আচমকা একদিন বললেন, “ছোট ভাই, হেভ ইউ গট এনি প্রবলেম ইন সাইড”? আমি থতমত খেয়ে গেলাম। তিনি তা বুঝতে পেরে বললেন, “আই কেন গ্যেস। লিভ ইট। ইউ নিড নট এক্সপোজ , ইফ ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডু”। আমি আরো কুঁকড়ে গেলাম। তাকে মনে হলো মাইন্ড রিডার। বললাম, “আপনিও কি কিছু বয়ে বেরাচ্ছেন”? তিনি আশ্চর্য হয়ে বিস্ফারিত চোখে বললেন, “কেন এমন মনে হলো”? আমি কাঁধ নেড়ে বললাম, “কেন জানি মনে হলো”। প্রসঙ্গ পাল্টাবার অছিলায় বললাম, “আপনার গলা কিন্তু ভারি সুন্দর। বিশেষত বিরহের গানগুলো সুপার্ব”। সেই মুহুর্ত থেকে আমাদের যৌথ অবসর কাটে নানা প্রসঙ্গে।

    খাগড়াছড়িতে আমাদের বাসার লাগোয়া জামে মসজিদ। বেশ বড়। পাঁচ বেলা আযানের ধ্বনি কানে এসে নাড়া দিয়ে যায়। অস্বস্তি ফিল করি তখন যখন মুয়াজ্জিনের কন্ঠে শুনিঃ হাইয়া আলাস সালাহ, হাইয়া আলাল ফালাহ। নামাযের জন্য আসো, কল্যাণের জন্য আসো। মনে পড়ে ছোটবেলায় বাসায় নামাযের কড়াকড়ি ছিল। বাবা আঙ্গুলে ধরে নিয়ে যেতেন মসজিদে। কাতারের এক প্রান্তে নিয়ে বসতেন। বলতেন তাঁকে অনুসরণ করার জন্য। আম্মা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে বা অবসরে ছোট ছোট সুরা মুখস্ত করাতেন। কাল গড়িয়ে গেছে অনেক। বাবা হয়েছেন গত। কিশোর হয়েছে যুবক । সব কিছু শিথিল হতে হতে আজ যৌবনের সম্ভারে যুক্ত হয়েছে রকমারি বিষয়াদি।।

    এখানে আসার পর ছুটির দিন গুলোতে আযানের সমর্থনে একটু একটু করে জামাতে গিয়ে দাঁড়াই। ইমাম সাহেবের কেরাত খুবই সুললিত। মনে গেঁথে যায়। সেই টানে ‘নিয়মিত’ হতে চেষ্টা করছি। বিশেষত ছুটির দিন গুলোতে। মনের ভেতর অস্বস্তি থাকলে মানুষ নিষ্কৃতির পথ খুঁজে। কেউ নেশায় সমাধান পথ বেছে নেয়। কেউ নিজেকে হনন করে, আর কেউ সন্ন্যাস পথে। এর কোন পথই আমাকে টানেনা।

    আম্মার জন্য মন পোড়ে। জন্মেছি ঢাকায়। সে অবধি আম্মার সাথেই থেকেছি বরাবর। এক নাগাড়ে এত দিনের জন্য ঢাকা ছাড়িনি এর আগে কোনদিন। ছোট বোনটা বাসায়। আছে খালাও। বোনের হাসবেন্ড সেলিমের এখন পর্যন্ত কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই নিয়ে বাসায় অশান্তি। আমি দুশ্চিন্তায়। সেই দুশ্চিন্তা চরমে গিয়ে পৌছলো সেদিন, যেদিন বাসায় দুই পাওনাদার এসে হাজির। আম্মার প্রেসার চরমে। বোন বিলাপে। নীচে পাওনাদারদের উচ্চস্বরে হৈ চৈ, হুংকার। তারা থানায় মামলা করার হুমকি দিয়ে গেছে। খালা ঘন ঘন ফোন দিয়ে ঢাকা যেতে বলছে। বড় মামা থানা-পুলিশের বিষয়টা দেখছেন। এ সময়ে আম্মার কাছে আমার থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু ছুটি চাই কি করে? মাথায় এলো জামান ভাইকে বলে দেখা যেতে পারে। কাজও হলো। বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় কর্মস্থল ত্যাগের অনুমতি মিলেছে।

    নাইট কোচে রওনা দিয়ে যখন বাসায় গিয়ে পৌছলাম তখন খুব ভোর। আম্মাকে পেলাম কোরআন তেলওয়াতরত। খালা রান্নাঘরে। বোনের রুম লকড। তবে বাসায় নতুন অতিথির আগমন হয়েছে। আম্মা ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বললো,“সরাফত এসেছে। অতএব সাবধান”। সরাফত আব্বার দূরসম্পর্কের চাচাত ভাই। অতিশয় বৈষয়িক ও কথাকে ইচ্ছেমত মাল্টি চ্যানেলে সম্প্রচারে চ্যাম্পিয়ন। তাকে দেখলেই আমার কেন জানি বিটিভি নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা প্রয়াত ফখরুল হাসান বৈরাগীর কথা মনে হয়। দেখতে অবিকল তারই মত। আচার-আচরণ ও কথাবার্তাতেও। আমি নিজের মনকে শাসন করলাম এই বলে যে, এমন ভাব করতে হবে যেন কোথাও কিচ্ছু হয়নি। সব কিছুই আগের মত চলছে। ওয়াশরুমে যাওয়ার মুখে তার সাথে দেখা। দেখা না, বলা ভাল তিনি দেখা দিলেন। গলা খাকারি দিয়ে বললেন,“ভাতিজা, তুমি নাকি অনেক টাকার চাকরি পাইছো”? আমি প্রমাদ গুনলাম। এর উত্তরে কি বলি আর উনি কি থেকে কি তর্জমা করেন কে জানে? বললাম,“চাচা, সারা রাত জার্নি করে এই এলাম। আপনি নাস্তা-টাস্তা করেন। পরে কথা হবে”। ভেবেছিলাম এতে সাময়িক মুক্তি পাবো। কিন্তু মাথা নেড়ে বললেন,“তা ঠিক। তবে আমারও তাড়া আছে। হাই কোর্টে যাইতে হবো। বরং দুইজনেই নাস্তা করি আর জরুরি কিছু কথা আছে, সেগুলি সারি। এই সাংসারিক আরকি”। আমার প্ল্যান ভস্মীভূত হয়ে গেলো। বললাম, “আইচ্ছা”।
    ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আম্মার কাছে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম,“উনি কেন এসেছেন”? আম্মার উত্তর, “কেন আবার? টাকা চাইতে। ক্ষেত কিনবে”।
    –টাকা কি গাছের গোটা? চাইলেই হলো? আমার উত্তর।
    — সেটা তো আর সে বুঝবে না।
    — ব্যস। এই টাকা চাইতেই এসেছেন?
    — আরো একটা উছিলা আছে
    — কি?
    — তোর বিয়ের সম্মন্ধ নিয়ে এসেছে। গ্রামের মেম্বরের একমাত্র মেয়ে। জমিজমা প্রচুর। ইন্টার পড়ছে।
    আমার মাথায় রক্তের স্ফুটনাঙ্ক উচ্চ স্কেলে গিয়ে অনবরত বাড়ি মারছে। গত রাত্রে এসেছেন। টাকা পেলেই চলে যাবেন। বাসার সাম্প্রতিক খবরাখবর এখনো জানতে পারেন নি। তবে ছুটাবুয়া এলেই জেনে যাবেন নিশ্চিত । তবে ভাগ্য ভাল যে, আম্মা তাকে আজকে আসতে বারণ করেছে।
    সেই সরাফত চাচার সাথে খাবার টেবিলে আলাপ। আমার উদ্দেশ্য নাস্তা করিয়ে বিদায় করা। বললাম, “আজই চলে যাবেন”?
    — মনে হয় সেটা হবে না। তবে তাড়াতাড়ি যাওয়াই দরকার। বাড়ীতে আমার অনেক কাজ।
    — ঢাকায় কি কাজে এসেছেন?
    — আমাদের গ্রামের কাসেম মাস্টারের পোলার হাইকোর্টের মামলার খোঁজ নিতে
    — আপনি কেন? তারা খোঁজ নিতে পারেনা? শুধু শুধু আপনাকে কষ্ট দেয়।
    — আরে ওরা কি লাইন ঘাট এত বুঝে?
    — আপনি বুঝেন?
    — আল্লাহর রহমতে গাও গেরামে এই বিষয়ে আমার নাম আছে।
    — আর কোন কাজ?
    — আছে। সেটা ভাবীরে কইছি। তুমি চাকরি পাইছো শুনলাম। বিদেশি অফিস। মনে হয় ট্যাকা পয়সা ভালই পাও।

    আমি গরম চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়িয়ে ফেললাম। বিরক্তি চেপে বললাম, “চাচা, আমি টায়ার্ড। এখন ঘুমাবো”। এতে তিনি যেন বিস্মিত হলেন। চা খেয়ে কেউ ঘুমায় নাকি? তাই তো। আমি তাড়াতাড়ি আমার রুমে গিয়ে দরোজা লক করে দিলাম। এ যেন ফাঁসির আসামীর মত কনডেম সেলে নিজেকে বন্দী করে রাখা।

    চলবে…

  • ঝাপসা দুপুর (পর্ব-১)

    ঝাপসা দুপুর (পর্ব-১)

    বাবা যেদিন দ্বিতীয় বিয়ে করলেন তখন আমার বয়স আটের আশেপাশে। মা খুব সাধারণ জ্বরে হুট করেই মারা গিয়েছিল। আমার দেখাশোনার জন্য যে বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিলেন তা কিন্তু নয়। আট বছর বয়সেই আমি অনেক পরিপাটি ছেলে ছিলাম।

    বিয়ের সময় ছোট মায়ের বয়সও খুব বেশি ছিল না। হয়তো উনিশ কি বিশ হবে। তিনি আমাকে অনাদর করে নি কিন্তু অতি আদরও করে নি। হয়তো আমার বয়সটা কোলে নিয়ে আদর করার মতো ছিলো না।

    বাবার সংসারে খুব একটা ভালো ছিলো না আমার মা। ছোট মা যে খুব ভালো ছিল তাও নয়। বাবা কাউকে সম্মান করতে জানতেন না, স্বার্থপর মানুষ ছিলেন। আমার দুই মা ই নীরবে সংসার করে গেছে।

    ছোট মায়ের সংসারে আমার দুটো ভাই বোন। আমার খুব আদরের। আমি আদর পাইনি তো কি হয়েছে আমার ভাই বোন কেন অনাদরে থাকবে?

    পাঁচ জনের সংসারে আমরা তিনটি বিচ্ছিন্ন দ্বিপে বাস করতাম। বাবার দ্বীপ, ছোট মায়ের দ্বীপ, আমার দ্বীপ। মুমু আর মাহিন ছোট মা আর আমার দ্বীপে ঘুরে বেড়াতো।

    বাবা যখন মারা যায় তখন আমি অনার্সের পাশাপাশি বাবার ব্যবসা অনেকটাই নিজের আয়ত্তে করে নিয়েছি। শহরে আমাদের একটা মার্কেট আছে। সেটার ভাড়া ছাড়াও আমাদের নিজেস্ব চা- পাতার ব্যবসা রয়েছে।

    বললাম না বাবা স্বার্থপর মানুষ ছিলেন। তিনি একবারও চিন্তা করেন নি তার অবর্তমানে আমি যদি আমার সৎ মা আর ভাইবোনদের বাসা থেকে তাড়িয়ে দেই তবে তাদের কি হবে।

    বাবার কাছে ছোট মা বাসার কেয়ার টেকারের মতো ছিলো তবে বেতন বিহীন। আমাদের রান্নবান্না, মুমু মাহিনের পড়াশোনা ,ঘরবাড়ি দেখে রাখা এসব কাজ ছাড়া আর কোনো ভূমিকা তার ছিলো না। রান্নার বাজারও বাবার ইচ্ছে অনুযায়ী হতো।

    বড় হতে হতে আমার কাছেও ছোট মা কেবল কেয়ার টেকার রূপে আবর্তিত হয়। আমি যেহেতু আমার ভাইবোন দুটোকে ভালোবাসি তাই ওদের তাড়িয়ে দেয়ার কথা আমার মাথাতেও আসে নি। তবে ছোট মা সবসময় আতংকিত মুখ নিয়ে চলতো।

    সবই কয়েকবছর আগের কথা। বাবার অবর্তমানে আমাদের মোটামুটি ভালই চলে যাচ্ছে দিন। মাহিন এখন ইন্টার দেবে আর মুমু ঢাকা ভার্সিটিতে অনার্স তৃতীয় বর্ষে।

    কদিন হলো মুমু তার তিন বান্ধবীকে নিয়ে বাসায় এসেছে। আমাদের বাসাটা ছোট একটা টিলার উপর মৌলভিবাজার শহরে। যে কেউ প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে চলে আসে। সবুজে ঘেরা কোলাহলমুক্ত বাসা আমাদের।

    সেদিক থেকে মুমুর বান্ধবীরা পুরোবাড়ি যেন মাতিয়ে রেখেছে। মেয়েমানুষ মানেই সারাক্ষণ হৈচৈ, মাতামাতি। আমি সকালে বেরিয়ে পড়ি দোকানের উদ্দেশ্যে। দুপুরে আর রাতে একা বসে খাওয়া ছাড়া নিজের রুমেই আমার বসবাস। এভাবেই অভ্যস্থ আমি। আমার একমাত্র সঙ্গী বই। ছোটবেলা থেকেই বইয়ের মাঝে মুখ গুজে রাখতাম বলে তেমন বন্ধুবান্ধবও নেই।

    আমার একা খেয়ে চলার অভ্যস্ততা যেন মুমুর বান্ধবীরা পাত্তাই দেয় না। সব মেয়েদের মাঝে যথেষ্ট অস্বস্তি নিয়ে খেতে বসতে হয় প্রতিদিন। ওদের চড়ুই পাখির কিচির মিচির শব্দে এখন অবশ্য এতোটা অস্বস্তি আর হয় না।

    মেয়ে বলতে আমি কেবল ছোট মা আর মুমুকে চিনি। আমার জগৎ নারী বিহীন। কলেজ লাইফেও কোনো মেয়েদের সাথে মিশি নি। মুখচোরা মানুষ আমি।

    মুমুর বান্ধবীগুলোর সাথে আমি না মিশলেও তারা মিশতে বাধ্য করছে। তাদের সাবলীল কথাবার্তা আমারও মন্দ লাগছে না। তিন বান্ধুবী তিন স্বভাবের। টয়া মাথার চূরায় একটা খোপা করে আজুবা মার্কা আলখাল্লা পরে সারাক্ষণ ফোনে একে তাকে ধমকাতে থাকে। আমার উপরও জোর জবর চালায়। এটা খাবো, ওটা খাবো, জলদি খেতে আসেন, আমাদের সাথে মুভি দেখেন সবকিছুতেই তার অধিকার জড়ানো। লামিয়া একেবারের চুপচাপ। শুধু মিষ্টি করে হাসতে জানে। আর কংকা যে কিনা চোখে পড়ার মতো সুন্দরী সাথে গুণী মেয়ে। ঘরের কোনো না কোন কাজ করায় ব্যস্ত থাকে। আর আমার বোন মুমু আহ্লাদ করা ছাড়া আর কিছু পারে কিনা সন্দেহ।

    আজ রাতে খাবার সময় কংকা খাবার বেড়ে দিচ্ছিল। ছোট মা সবসময়ই আমার থেকে দূরে থাকেন। আমার প্লেটে মুরগির রান তুলে দিলে আমি হেসে বলি কংকা ওটা মাহিনকে দাও, ওর রান খুব প্রিয়।

    কংকা বলল, মাহিন তো প্রতিদিনই খাচ্ছে দেখলাম, মুমুও নিজের পাতে তুলে নেয় আপনাকে তো কখনও খেতে দেখি না। কেন?
    হঠাৎ এমন প্রশ্নের কি উত্তর দেবো আমি বুঝছিলাম না। শেষ কবে রান খেয়েছি আমার মনেও নেই। আমি শুধু জানি মুমু মাহিনের মুরগীর রান খুব প্রিয়।

    কংকা আবার প্রশ্ন করলো, আপনার শখ করে কিছু খেতে ইচ্ছে করে না? যা দেই তাই চুপচাপ খেয়ে ওঠেন কেন?

    এমন অদ্ভুত প্রশ্ন আমার মাথায় কখনো আসে নি। আমার কি সত্যিই কোন কিছুর শখ নেই? কেন? শখ পূরণ করার কেউ নেই বলে?

    কংকা আমার কোনো উত্তর না পেয়ে ছোট মায়ের দিকে তাকায়।

    কংকার সাথে আমার দৃষ্টিও ছোট মায়ের দিকে যায়। দেখি তিনি অপরাধী মুখে কাচুমাচু হয়ে আছেন।

    কংকা আমার পাতে মুরগির রান দিয়ে বলে, নিজের অধিকার নিজেকে বুঝে নিতে হয়। নইলে সব পেয়ে বসে।

    হঠাৎ ডাইনিংয়ে নিরবতা নামে। কংকা যা বোঝাতে চাইছে এখানে বসা সবাই তা বুঝতে পেরেছে। মুমু মাহিন মাথা নিচু করে খেয়ে ওঠে।

    সে রাতে আমার ঘুম আসে না। পরিবারে আমার মূল্যায়ন কতটুকু মাথায় ঘুরতে থাকে। বর্তমানে এ পরিবারে আমি একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি অথচ আমি যেন পরিবারের সাথে সংযুক্ত নই। অনাহূত মেহমানের মতো।

    মুমু মাহিন কী আমাকে ভালোবাসে কেবল তাদের সব আবদার পূরন করি বলে?

    আমাকে নিয়ে কি তারা আদৌ কখনো ভাবে?

    পানি খেতে রুম থেকে বের হলে দেখি ছোট মায়ের রুমে মুমু, টয়া আর লামিয়া বসে আড্ডা দিচ্ছে। টয়া যথারীতি মোবাইলে কাকে যেন আগামীকাল কি কি করনীয় মুখস্থ করাছে।

    মুমু ছোট মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে আর লামিয়া ছোট মায়ের চুলে বিনুনি করে দিচ্ছে। কংকাকে কোথাও দেখলাম না। ছোট মায়ের প্রতি কংকার রুষ্টতা আজ স্পষ্ট ছিল।

    ভোরে ঘুম ভাঙ্গলে প্রতিদিনের মতো বাগানে হাঁটতে বের হই। লামিয়াকে দেখি মোবাইলে কার সাথে যেন কথা বলছে। আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে এগিয়ে আসে।
    –কি লামিয়া,আমাকে দেখে লাইন কেটে দিলে কেন? তুমি তোমার মতো কথা বল।
    — না না ভাইয়া। এমনি কথা শেষ তাই।
    কংকা এগিয়ে এসে বলে, মঈন ভাই নাস্তায় কি খাবেন?
    — প্রতিদিন যা খাই তাই খাবো।
    — না না আমি আপনার জন্য আজ স্পেশাল কিছু বানাবো। আপনি হালুয়া খান?
    — তা খাই।
    — কিসের হালুয়া খাবেন?
    — যে কোনো একটা করলেই হবে।
    — আহা, আপনার স্বাদ আহ্লাদ হীন জীবন দেখে খুব কষ্ট লাগে। আপনার জীবনে স্পেশাল কেউ চাই, যে শুধু আপনার খেয়াল রাখবে। বুঝলেন!

    নাস্তার টেবিলে বসে দেখি টয়া ছোট মাকে আমাদের সাথে জোর করে বসিয়েছে।
    ছোট মা অস্বস্তিবোধ করছেন।

    কংকা বলল, আন্টির যখন অভ্যাস নেই কেন জোর করছিস?

    টয়া বলল, অভ্যাস হতে সময় লাগে না। পরিবারের কর্তি কেন আলাদা খাবে? তোদের বাসায় কি এই রীতি?

    কংকা গরম চোখে টয়ার দিকে তাকায়। আমার দিকে ফিরে বলে, ভাইয়া কেমন হয়েছে হালুয়া?
    — হুম বেশ মজা।
    — আরেকটু দেই?
    — দাও।
    — আপনার এতো প্রিয় অথচ মুমু জানেই না। আন্টিকে জিজ্ঞেস করলাম তিনিও দেখি জানে না। কিন্তু মাহিনের কি প্রিয় সেটা ঠিকই জানে।

    আমার চোখ সাথে সাথে ছোট মায়ের দিকে গেল। দেখলাম ছোট মায়ের মুখ লাল হয়ে গেছে। মুমুও বিব্রত বোধ করছে।

    মুমুকে জিজ্ঞেস করলাম, মাহিন কোথায় রে?
    — ভাইয়া, ও আগেই খেয়ে বেরিয়ে গেছে।
    — এতো সকালে?

    কংকা কথার মাঝে বলল, আগামীকাল বুটের হালুয়া করে খাওয়াবো।

    টয়া বলল, ভেরি গুড, ওয়েল ডান কংকা। এভাবেই আগুন জ্বালিয়ে যা। ভাইয়া চলেন আমি আপনার সাথে শহর ঘুরতে বেরুবো। আমার তো আর আগুন জ্বালানোর গুণ নেই কংকার মতো।

    কংকা ফোঁস করে ওঠে। আগুন জ্বালানো মানে কি বোঝাচ্ছিস?
    — মানে চুলোর কাজ তুই ভালোই পারিস। আমরা তো আনারী। ভাগ্যিস চুলার ধারে কাছে যাই না, নইলে এমন সুন্দর ছিমছাম বাড়িটায় আগুন লেগে যেত।

    কংকা গজগজ করে বলল, তুই পারিসটা কি? পশু পাখি নিয়ে কি সংগঠন খুলেছিস। কাজের কাজ তো কিছু না সারাদিন শুধু একে ওকে দৌড়ের ওপর রাখিস।

    টয়া চেয়ার ছেড়ে উঠে ব্যাগ গোছোতে গোছাতে বলে, ওটাকে ম্যানেজম্যান্ট বলে ডিয়ার। আমি যাদের চালাই তারা বিনে পয়সায় শুধু মাত্র ভালোবেসে কাজ করে।

    কংকা বাঁকা হেসে বলে, কুত্তা বিলাই এর প্রতি ভালোবাসা, হেহ্!

    কংকার দিকে ঝুঁকে টয়া বলে, ভালোবাসতে জানি কংকা, সেটা মানুষ হোক আর পশু পাখি। অনেকেই আছে ভালেবাসার নাম করে মগজে সুক্ষভাবে বিষ ঢালতে ওস্তাদ হয়।

    টয়া হনহন করে বেড়িয়ে গেল। যেতে যেতে বলে গেল আমি বাইরে অপেক্ষা করছি মইন ভাই।

    কংকা ফোঁস করে চেয়ার সরিয়ে রুমে ঢুকে গেল।

    আমি আক্কেল গুডুম হয়ে ডাইনিং এ বসে পুরো যুদ্ধটা দেখলাম। এছাড়া আমার কি বা করার ছিল। এসব মেয়েলি ঝগড়া দেখে আমি অভ্যস্ত নই। দু একটা বন্ধুর কাছে তাদের প্রেমের বা সংসারিক ঝগড়া শুনেছি তবে তা খুবই কিঞ্চিৎ। আমার অতি অনাগ্রহের কারণে ওরা আমাকে বলতেও চায় না।

    ছোট মা উঠে গেলেন কংকাকে সামলাতে। মুমুকে মনে হলো বেশ অনিচ্ছায় উঠে গেল মায়ের পিছে পিছে।

    লামিয়া হেসে বলল, অবাক হবেন না ভাইয়া। রুমে সবসময়ই কংকা আর টয়ার ঝগড়া চলে। আমরা দেখে অভ্যস্থ।
    — তোমাদের সমস্যা হয় না?
    — হলে থাকার এটা একটা মজা। ওখানে মানিয়ে নেয়া, মেনে চলা, প্রতিবাদ করা, সমঝোতা করা সব শেখা হয়ে যায়।

    লামিয়া তার চিরাচরিত মিষ্টি হাসিটি দেয়।

    লামিয়া মেয়েটা চুপচাপ হলেও বেশ বুদ্ধিমতী। সবকিছুর পজেটিভ ব্যাখা দাঁড় করায়।

    মেইন দরজায় দাঁড়িয়ে টয়া বলে, মইন ভাই, আপনি কি আমাকে ভয় পান?
    — না তো, কেন?
    — তাহলে এতোক্ষণ হয়ে গেল আসছেন না কেন?

    আমি ঝটপট দাঁড়িয়ে বলি, চলো।

    আমার বাইকের পেছনে বসেছে টয়া। জিন্স ফতুয়া পরে দুপা ছড়িয়ে বসেছে। একটু অস্বস্থি হচ্ছে আমার। ছোট শহর। সবাই মোটামুটি চেনে আমাকে। কি না কি ভাববে তাছাড়া এমন পোশাকের মেয়ে আমার পেছনে বসা দেখে ভীমড়ি খাবে সব।

    টয়া মোবাইলে যথারীতি দাঁত কিড়মিড় করে কাকে কি যেন বলছে। কল রেখে আমাকে বলে, ভাইয়া, আপনি প্রেম ভালোবাসা সাপোর্ট করেন?
    — কি? বাইকের শো শো বাতাসে টয়ার কথা স্পষ্ট শুনতে পাই না।
    টয়া গলা উচিয়ে বলে, আপনি প্রেম ভালোবাসা সাপোর্ট করেন?
    — আমার সাপোর্ট করা না করা দিয়ে কি আসে যায়? তুমি কেন জানতে চাইছো?
    — না মানে আমার বন্ধু তার গালফ্রেন্ডকে খুশি করতে গিয়ে আমার কাজ করেনি। এখন সরি সরি বলছে, শালা।
    আমি মনে মনে হাসি।
    — আপনি হাসছেন কেন?
    — কই, নাতো!
    — আমি মিরোরে আপনাকে দেখছি।

    আমি গম্ভীর হওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু তারপরও আমার হাসি পেয়ে যায়।
    — ভাইয়া, আপনি ভাবছেন আমার মতো টমবয় মার্কা মেয়ে প্রেম ভালোবাসা কি বুঝবে, তাই না? মানি প্রেমে তেমন সুবিধা করতে পারিনি তবে আমি প্রেম বিরোধী নই মোটেও।

    টয়ার কথার ধরনে আমি আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারি না। জোরে হেসে বলি সুবিধা করতে পারো নি মানে?

    টয়া ভ্রু কুঁচকে মিররে আমার দিকে বিরক্তি চোখে তাকায়। বলে, ছেলেটা ভালোই ছিল। চুপচাপ মিশুক। আমি তাই একটু পাত্তা দিলাম। কিন্তু বেটা আমার বয়ফ্রেণ্ড কম বাপ বেশি হওয়ার চেষ্টা করলো। এভাবে কথা বল কেন, এমন পোষাক পর কেন, এদের সাথে মিশো কেন? আরে বাপ রে…. আমিও বলে দিয়েছি, চান্দু, তোমার পথে তুমি চল আমার পথে আমারে ছাড়ো। আলবিদা..
    — আমি হো হো করে হেসে উঠি।

    টয়া মিররে আমাকে সরু চোখে দেখে বলে, মইন ভাই আপনার হাসিটা কিন্তু চমৎকার, সবসময় এমন হাসিখুশি থাকতে পারেন না?
    আনমনা হয়ে আমি ভাবি, শেষ কবে এমন হেসেছি?
    — মইন ভাই, যাই ভাবেন না কেন আমি কিন্তু ওতোটাও ঝগড়াটে মেয়ে নই।
    — আমার কিন্তু তোমাকে ঝগড়াটে মেয়ে মনে হয় নি। তুমি ভালো কে ভালো মন্দকে মন্দ বলতে জানো। তোমার মধ্যে লোক চালানোর ক্ষমতা আছে। আমাদের মুমুটা তোমার মতো হলে ভালোই হতো।
    — হ্যাঁ, মুমুটা একটু আহ্লাদি কিন্তু ভালো মেয়ে। একেবারে সরল সোজা। চিন্তা নেই হাসনাত ভাই ওকে সামলে নেবে বলেই টয়া জ্বিব কাটে।

    আমি মিররে ওর দিকে তাকাতেই সে পেছনে সরে যায়।

    বাইক পাশে সাইড করে টয়ার দিকে ঘুরে তাকাতেই সে বলে, তেমন সিরিয়াস কিছু না,ভাইয়া। আপনি টেনশন নেবেন না। চলেন।
    — আমার দোকান এখানে, তাই থেমেছি। মুমুর ব্যাপারটা আমি জানি। হাসনাতের পরিবারের খবর নিয়েছি। ভালো পরিবার।
    টয়া অবাক চোখে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বলে, আপনাকে যেমন ভেবেছিলাম আপনি তো তার চেয়েও ভালো মানুষ দেখছি।
    — তাই। এতো অল্প কারণে আমি ভালো মানুষ?
    — আপনি চুপচাপ থাকেন হয়তো সহজে মিশতে পারেন না কিন্তু সঙ্গ পছন্দ করেন। নইলে আমাদের মতো আধপাগল মেয়েদের সাথে বসে প্রতিদিন খেতেন না। আপনি যতটা গম্ভীর তারচেয়ে মনের দিক থেকে অনেক বেশি একা। নিজেই সে দেয়াল তৈরী করেছেন। তবে আপনি সংকীর্ণ মনের নন। আমার পোশাক বা আমার চলাবলায় আপনি এখনও কিছু বলেন নি।
    — আমার সম্পর্কে এতোকিছু এনালাইসিস করে ফেলেছো?
    — ভুল বলেছি কি?
    — না। আমি আসলে একা বড় হয়েছি বলে তেমন মেশা হয়নি কারো সাথে কিংবা মন মতো বন্ধু পাই নি। তবে তোমরা অনেক মিশুক, তোমাদের সাথে মিশতে আমি সাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। হয়তো তোমরা মুমুর বন্ধু বলে। আর তোমার পোশাক সেটা একান্ত তোমার ব্যাপার। আমি কেন কিছু বলবো?
    তবে আমি মুমুর ব্যাপারটা যে জানি তা মুমু বা ছোট মা যেন না জানে, ঠিক আছে?
    — কেন? ওরা জানলে আপনার গাম্ভীর্যতা বজায় থাকবে না বলে?
    — আমি মুমুর বড় ভাই। মুমু আমার সামনে লজ্জা পাবে।
    — ঠিক আছে বলবো না। তবে এখানেও আপনি ভালো। বড় ভাইয়ের দায়িত্ব নীরবে ঠিক পালন করছেন কিন্তু বড় ভাইগিরি আই মিন কোনো হম্বিতম্বি নেই আপনার।

    আমি মৃদু হেসে বললাম আধ ঘণ্টার মতো একটা কাজ আছে আমার। তুমি চাইলে অপেক্ষা করতে পারো কিংবা পাশের শপিংমল ঘুরে আসতে পারো।

    টয়া বলল, আমি শপিং মলে যাই তাহলে।

    কাজ সেরে আমার মনে পড়লো টয়ার নাম্বার তো আমার কাছে নেই। টয়াকে খুঁজে পাবো তো?
    শপিং মলে ঢুকে এদিক সেদিক তাকাতেই টয়াকে পেয়ে যাই।
    –ভাইয়া, কিছু টাকা ধার দেয়া যাবে? আমার তিনশো টাকার ঘাটতি পড়েছে।
    — কি কিনবে?
    — একটা ফতুয়া। বেশ সুন্দর।
    — আচ্ছা চলো।
    –ভাইয়া টাকা কিন্তু ধার দেবেন নইলে নেব না।
    — আচ্ছা ঠিক আছে।
    আমি দোকানে ঢুকতেই কর্মচারী দাঁত বের করে হাসলো।
    — মইন ভাই, আপু আপনার সাথে আসছে?
    — হুম, ওর ফতুয়াটা প্যাক করে দাও। সাথে আরও ফতুয়া দেখাও।
    — আরো কেন ভাইয়া?
    — তোমাদের সবাইকে গিফট করবো।
    — আমি তো বললাম ধার নেবো টাকা।
    — হ্যাঁ, তিনশো টাকা দিয়ে দিও। এখন যা দেবো সেটা গিফট।
    — ঠিক আছে। কিন্তু লামিয়া আর কংকা তো ফতুয়া পরে না।
    — তাহলে কামিজ দেই?
    — ভাইয়া শাড়ি দেন সবাই পছন্দ করবে।
    — তুমি পছন্দ করবে?
    — আমি সবই পরি। আমাকে লুঙ্গি দিলেও দেখবেন নিজেস্ব স্টাইলে আমি ঠিকঠাক পরে নেবো।

    চারটা মনিপুরী শাড়ি কিনলাম ভিন্ন রংয়ের। টয়াই ওদের পছন্দ মাফিক বাছাই করলো। ছোট মায়ের জন্যও একটা শাড়ি নিলাম।
    কর্মচারীকে সব প্যাকেট করে আমার দোকানে পাঠিয়ে দিতে বলে টয়াকে জিজ্ঞেস করলাম দূরে ঘুরতে যাবে?
    — অবশ্যই যাবো। ঘুরতেই তো এসেছি এ শহরে।
    টয়াকে নিয়ে প্রথমে যে অস্বস্তি হচ্ছিল এখন আর তা হচ্ছে না। বরং টয়ার সঙ্গ ভালো লাগছে।
    –ভাইয়া, এখন কোথায় যাচ্ছি?
    –একটা সুন্দর জায়গা আছে শহরের বাইরে চা বাগানের দিকে। চারিদিকে নিরবতা শুধু অজস্র পাখির কিচিরমিচির। তুমি তো পশুপাখি প্রেমী, তোমার ভালো লাগবে।
    বাইকে চলতে চলতে টয়া আফসোস করলো লামিয়াকে সাথে না আনায়।
    লামিয়াকে তোমার বেশ পছন্দ, তাই না?
    — হ্যাঁ, মুমুকেও পছন্দ করি।

    মুমুর সরলতা সবাই পছন্দ করে আর লামিয়া হচ্ছে বুদ্ধিমতী মেয়ে। সবাইকে বোঝে। আপনার কখনো মন খারাপ হলে লামিয়াকে কল করবেন দেখবেন কিভাবে মেয়েটা আপনার মন ভালো করে দেবে। কিন্তু ঝামেলা হলো ফাজিলটা প্রেম করছে আমাদের না জানিয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে। সবাই ঘুমিয়ে থাকলে খুব ভোরে উঠে মোবাইলে কথা বলে। কোনো দূর সম্পর্কের আত্মীয় ছেলেটা, কানাডা থাকে।
    — ও হ্যাঁ, আমিও ওকে ভোরে কথা বলতে দেখেছি।
    — তাই না? ওর প্রেম না থাকলে বলতাম আপনি ওকে বিয়ে করেন। মহা সুখী হবেন।
    — কি যে বল না তুমি?
    — জ্বি হা, আমি যাহা বলি একশোভাগ সঠিক বলি। আচ্ছা কংকার ব্যাপারে কিছু জানতে চান না?
    –বিশেষ করে জানার আগ্রহ নেই।
    — আহা! বেচারী কত সেবা করছে আপনার। কষ্ট করে আজ হালুয়া রেঁধে খাওয়ালো। মিনিমাম আগ্রহ না দেখালে তার প্রতি অবিচার হবে না?
    আমি মিররে তাকিয়ে দেখলাম টয়া মুখ টিপে হাসছে। চোখে চোখ পড়তেই জিভ কেটে পিছিয়ে গেল।
    –জিজ্ঞেস না করলেও আমি নিজ দায়িত্বে বলি। কংকা হচ্ছে রূপে গুণে অনন্যা, মেধাবী এবং সুশৃঙ্খল জীবনে মোড়ানো মূল্যবান কোহিনূর। আমার মতো চলায় বলায় বেখেয়ালি মেয়ের প্রতি তার ভীষন এলার্জি।
    — তাহলে বন্ধু হলে কিভাবে?
    — ও আসলে আমাদের রুমমেট। বন্ধু নয়। ওর বন্ধু হওয়ার মতো যোগ্যতা আমার মতো অতি সাধারণ মেয়ের নেই।
    টয়া হাসতে থাকে।
    আমি কোনো কথা না বলে সামনে তাকাই।
    — মইন ভাই, কংকা কিন্তু কারো সাথে প্রেম করে না। এসব ফালতু জিনিসে সে সময় নষ্ট করতে চায় না। সে নিরীহ ভদ্র চাচাছোলা পরিবারের ছেলে খুঁজছে বিয়ের জন্য….. আপনার মতো ছেলে।
    আমি মিররে তাকালে টয়া যথারীতি জিব কেটে সরে যায়। আমি না শোনার ভান করি।
    কিছুক্ষণ বাদে টয়া বলে, ভাইয়া একটা কথা বলি?
    — বল।
    — আপনাদের বাগানটা অনেক সুন্দর। সেখানে চকচক করা আর্টিফিশিল কিছু রাখলে বাগানের সৌন্দর্যহানী হবে। পুরো বাগান তার সজীবতা হারাবে।
    আচ্ছা,আপনি বিয়ে করছেন না কেন? বিয়ের বয়স তো পার হয়ে যাচ্ছে। স্পেশাল কোনো রাজকুমারীর প্রতীক্ষা?
    — না ওরকম কিছু না।
    — শুনুন, আপনি যদি ভাবেন আন্টি আপনার বিয়ের ব্যবস্থা করবে তবে ভুল করবেন। তিনি আপনাকে ভয় পায়। তবে আপনি যাকে বিয়ে করতে চাইবেন তিনি তাই মেনে নেবে। এমন স্বাধীনতা কোথায় পাবেন মইন ভাই?
    তাই আর দেরী না করে জলদি জলদি পাত্রী বাছাই করে বিয়ে করে ফেলুন এ সপ্তাহের মধ্যে। সময় সীমিত। আমরা একটু বিয়ে টিয়ে খেয়ে যাই, কি বলেন?
    টয়ার কথার ধরনে আমি স্বজরে হেসে উঠি।
    — টয়া, তুমি আসলেই একটা পাগল।
    টয়া মিররে আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে।
    — মইন ভাই, জীবনে পাগলদের সাথেও চলা উচিত। নইলে আপনি যে এমন প্রাণ খুলে হাসতে জানেন তা কী কখনো বুঝতে পারতেন?
    আমি খানিক চমকে মিররে টয়ার দিকে তাকাই। দেখি দুহাত ছড়িয়ে চোখ বন্ধ করে টয়া সবুজ পাহাড়ের ঘ্রাণ নেয়ায় ব্যস্ত।

    টয়াকে দুপুরে বাসায় নামিয়ে আমি দোকানে চলে যাই। রাতে ফিরে দেখি কংকা ড্রইংরুমের শোকেস গোচ্ছাচ্ছে। টয়া টিভি দেখছে।

    আমাকে দেখে কংকা বলে, আপনার জন্য আজ স্পেশাল রান্না করেছি।

    আমি রান্না ঘরের দিকে মাথা হেলিয়ে দেখি মুমু ও ছোট মা ঘেমে নেয়ে কাজ করছে।

    আমার দৃষ্টি বুঝে কংকা সাথে সাথে বলে আমি সব করে এইমাত্র এসেছি। মুমু আর আন্টি তো কেবল ঢুকেছে।

    টয়া ডাইনীর মতো খিক কিক করে হাসতে শুরু করে।

    আমি ওর দিকে তাকালে বলে, সরি ভাইয়া, আমি টিভি দেখে হাসছি অন্য কিছুর জন্য নয়।

    লামিয়া এগিয়ে এসে বলল, আপনার গিফট আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে ভাইয়া। আপনাকে ধন্যবাদ।

    কংকা বলল, আপনার পছন্দ প্রশংসনীয়। গলা উচিয়ে বলল, এই মুমু দেখে যা শোকেস কেমন গুছিয়েছি!

    আমি বললাম, খামাখা এসব কেন কষ্ট করছো কংকা?
    –এলোমেলো জিনিস দেখতে আমার একদম ভালো লাগে না। হাত নিশপিশ করে যতক্ষণ না এগুলো গোচ্ছাচ্ছি। খুব যে কষ্ট তা না, মুমু চাইলেই সব সুন্দর করে রাখতে পারে। খুবই অলস মুমু।
    টয়া আবার ডাইনীর মতো খিক খিক হাসি দিল।
    আমি খেয়াল করলাম দেয়ালে টাঙ্গানো মাহিনের মেডেলগুলো একটা বাটিতে জড়ো করে রাখা।
    –মেডেল গুলো এখানে কেন?
    — এগুলো দেখতে ভালো লাগছিল না। তাই নামিয়ে রেখেছি।
    — ওগুলো যেভাবে ছিল ওভাবেই রাখো।
    — কিন্তু ওখানে আপনার মায়ের ছবি রেখেছি। ওটা বেশি ভালো লাগছে না?
    — না, আমার মায়ের ছবি আমার রুমেই থাকবে। মাহিনের মেডেলগুলো আগের জায়গাতেই থাকবে।
    কংকার মুখ মুহুর্তে অন্ধকার হয়ে গেল।
    আমি নরম গলা বললাম, তুমি হয়তো কাজ করে টায়ার্ড হয়ে গেছ। রেস্ট নাও। টয়া, তুমি পারবে সব আগের মত করতে?
    টয়া উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট দিয়ে বলে ইয়েস বস!
    আমি রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। মুমুকে জিজ্ঞেস করলাম মাহিন কোথায়?
    — ও বন্ধুর বাসায় পড়ছে।
    — কখন ফিরবে?
    — ওখানে খাওয়া শেষ করে আসবে।
    –মাহিনকে কল করে বল এক্ষুনি আসতে। বাসায় ভালো রান্না রেখে বাইরে কেন খাবে? এক্ষনি আসতে বল।

    বাসার পরিবেশ কেমন যেন বদলে গেছে। মুমু, ছোট মা, মাহিন মুখ কালো করে ঘুরছে সারাক্ষণ। বাসায় মেহমান অথচ পরিবারের সবার মুখ কালো।

    রাতের খাবারে ডাইনিংয়ে বেশ কটা আইটেম দেখতে পেলাম। ছোট মাকে সাথে নিয়ে টয়া আর লামিয়া বসেছে। মাহিন মুমু পুরোই চুপচাপ। কংকা আমার পাশে বসে আমাকে বেড়ে দিচ্ছে। ওর আদিখ্যেতা আর ভালো লাগছে না। কিন্তু কিছু বলাও যাচ্ছে না।

    আমার পাতে রোষ্টের রানের অংশ দিয়ে মাহিনকে বুকের অংশটুকু তুলে দিলো কংকা। মাহিন বাটি ভর্তি মাংসের দিকে তাকিয়ে মাথা নীচু করে খাওয়া শুরু করলো। বাটিতে আরো রান ছিল। কিন্তু মাহিন কিছু বললো না। আমি খেয়াল করেছি মুমুর বন্ধুগুলোকে এড়িয়ে চলছে মাহিন। বিশেষ করে কংকাকে।

    মাহিনের প্লেটটি আমার কাছে এনে আমার প্লেটটি মাহিনকে এগিয়ে দেই আমি।

    মাহিন অবাক চোখে তাকালে বলি তোর রান প্রিয় তুই বুকের মাংস কেন খাচ্ছিস?

    মাহিন আড় চোখে ছোট মায়ের দিকে তাকায় কিন্তু মুখে কিছু বলে না।

    কংকা হেসে বলে, মাহিন কি এখনও ছোট বাচ্চা নাকি? সব কিছুই খাওয়া ওর শেখা উচিত, তাই না মাহিন!

    আমি বিরক্তি কণ্ঠে বলি, মাহিন আমার কাছে এখনও বাচ্চা। আমার যতদিন সামর্থ থাকবে আমার ছোট ভাই-বোন মুরগীর রান ওদের পাতে পাবে।

    সবাই নিরবে খেতে শুরু করলে খেয়াল করি ছোট মা কিছু খেতে পারছেন না। আড়ালে চোখের জল মুছে নিচ্ছেন।

    আজ প্রথম মনে হলো পরিবারকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে আমার আসলে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত। আমার সিদ্ধান্তের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে।

    চলবে…